সুনীলদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, যতদূর মনে পড়ে ১৯৯৩-এর কোনো একটা সময়ে । সূত্র, আমার প্রথম লেখা `ভাটিপুত্রর পত্র বাখোয়াজি' নামক পত্রানিবন্ধটি । তপনবাবুর নির্দেশে সেটি তখন প্রকাশ করেছিলাম নাইয়া নামের একটি অ-সাময়িকী পত্রিকায় । পত্র নিবন্ধটির তখনকার নামকরণ ছিল আহ্লাদে ফাউকানো অথবা ভাটিপুত্রর পত্র বাখোয়াজি । পত্রিকাটির একটি কপি দিয়েছিলাম নীলুদা অর্থাৎ নীলরতন মুখোপাধ্যায়কে । নীলুদা প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পি বুলবুল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর জীবনীকার । এ ছাড়াও তাঁর আর একটা পরিচয় হলো শিশু সাহিত্যিক হিসাবে । মানুষটি নানা গুণের অধিকারী, মায় চমত্কার রন্ধন-কলায় নিপুণ । আমরা মধ্য আশির দশক থেকে পরিচিত শুধু নই, আত্মার আত্মীয়ও । যাহোক, নীলুদার কল্যাণে ঐ লেখাটি বেশ কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যাক্তির গোচরে আসে । সুনীলদা তাঁদের মধ্যে প্রথম । সাধারণ একটি লেখা, তাও চিঠি এবং চিঠির মধ্যে চিঠি যে এরকম একটা ব্যাপক পরিচয়ে আমাকে পরিচিত করবে, তা আমার ভাবনাতে ছিলই না । সুনীলদা লেখাটির আরও পাঠক বিস্তৃতি ঘটান । বস্তুত, একটিমাত্র সামান্য লেখার মাধ্যমে যে এতটা পরিচিতি লাভ করতে পেরেছিলাম, তার জন্য প্রাথমিক ভাবে তিনজন ব্যাক্তির অপরিসীম স্নেহ এবং একজনের সপ্রেম শ্রম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । লেখক হিসাবে যেটুকু হয়ে ওঠা আমার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে, তার জন্য এঁদের কাছে আমার ঋণ কৃতজ্ঞতা স্বীকারেই শুধু পরিশোধ্য নয় । এঁরা হলেন, শুরু থেকে বললে, তপন রায়চৌধুরী, তরুণ পাইন, নীলরতন মুখোপাধ্যায় এবং সুনীলদা । তরুণ পাইনকে বইপাড়ায় আণ্ডা বাচ্চারাও চেনে । সে আমার অনুজপ্রতীম এবং একদা নাইয়া পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক । নীলুদা আরেকজনকে লেখাটি পড়িয়েছিলেন । তিনি সম্প্রতি পরলোক গমন করেছেন । সারস্বত জগতে জ্যোতিভূষণ চাকির নাম শোনেননি বা জানেন না, এরকম কেউ যদি থাকেন, তবে তিনি দুষ্ট সরস্বতীর সেবকমাত্র । কিন্তু তাঁর কথা ভিন্ন অধ্যায়ে ব্যাপক বলব ।
সুনীলদাও অকালে প্রয়াত । বয়স যাই হোক, এইসব আত্মীয় মানুষেরা যখনই বিদায় নেন, সেটা শুধু অ-কাল নয় দুষ্কালও বটে । প্রষ্টেটে ক্যান্সার ধরা পড়ার মাস তিনেকের মধ্যে তিনি চলে গেলেন । বেলভিউতে শেষ যেদিন দেখা করতে যাই, হুইল চেয়ারে করে তাঁকে ডায়ালিসিসে নিয়ে যাবার সময়ের হাত নেড়ে বিদায় নেওয়াটা আক্ষরিক অর্থেই শেষ বিদায় ছিল । তার দুদিন পরই টেলিফোনে জানলাম সেইদিনই সকাল নটায় তিনি চলে গেছেন । ছোটোখাট্টো চেহারার ঐ মানুষটির মৃত্যুর ভার আজও আমাকে দগ্ধ করে । কিন্তু রোগগ্রস্ত হবার আগে এবং রোগশয্যায় থেকেও তিনি আমাকে যে কী অপরিসীম ভাবে উত্সাহ অনুপ্রেরণা এবং উদ্যম জুগিয়েছেন তার তুলনা আজ পর্যন্ত নজরে আসেনি । ইতিমধ্যে, অর্থাৎ ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আমি লিখে ফেলেছিলাম, প্রাগুক্ত পত্র-নিবন্ধটিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা ছাড়াও, বিদুর, সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম এবং পরিবর্ধিত বিদুর । ১৯৯৬ এর মধ্যেই এর সবকটি প্রকাশিত হয়েছে এবং বিষাদবৃক্ষ লেখা শুরু হয়েছে । সুনীলদা বিষাদবৃক্ষের কম্পিউটার কম্পোজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তার ছোট জামাতা সৌমিত্রকে দিয়ে । সৌমিত্রই বইটি ছাপার ব্যবস্থাও করেছিল । সুবর্ণরেখা প্রকাশনীর নাম ব্যবহার করে নিজের খরচে পাঁচশো কপি ছেপেছিলাম । এ ব্যাপারে কৃতিত্ব সুনীলদা এবং তাঁর জামাতা সৌমিত্রর, ভুল ত্রুটির দায় আমার, কারণ Proof টা আমিই দেখেছিলাম । আমার একটা তৃপ্তি এই যে সুনীলদা বিষাদবৃক্ষের একটা প্রিন্ট-আউট পড়ে যেতে পেরেছিলেন এবং তাঁর গুরুপ্রতিম অগ্রজ বন্ধু ড: শিশির সেনকে পড়িয়েছিলেন । সুনীলদা জীবিত থাকতেই শিশিরদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হয় । তিনি এবং সুনীলদাই প্রথম বিষাদবৃক্ষ সম্পর্কে অপরিসীম আশাবাদী হয়ে আমাকে বইটির দ্রুত প্রকাশনার জন্য তাড়া দিতে থাকেন । ২০০২ এর কোনো একটা সময়ে সুনীলদারই আগ্রহে, শিশিরদা মারফৎ আমি বর্ষীয়ান অধ্যাপক ড: রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের সান্নিধ্যে যাই । তাঁকে প্রকাশিত বই ও বিষাদবৃক্ষের লাস্ট প্রিন্ট-আউটটি পড়ালে তিনি বললেন, এটিকে এক্ষুনি প্রকাশ করা প্রয়োজন । এই লেখা দীর্ঘজীবী হবে । পাব্লিশার না পেলে নিজের খরচে ছাপাও । - বস্তুত তাঁর মত একজন ব্যাক্তিত্বের প্রশ্রয় পেয়েই আমি ঋণ করেও বইটির ছাপার খরচ জোগাড় করেছিলাম । এইসব কথা খুব বেশি দিনের নয়, তবু মনে হয় যেন কতযুগ পেরিয়ে গেছে তারপর । রবিদা বিষয়ে `রশ্মিদ রবি এবং কেরাচিনির অম্ফ' - নামে একটি হাল্কা প্রবন্ধে এ বিষয়ে বিশদে লিখেছি । এই ধারাবাহিকে সেটির পুন:প্রকাশ করলাম আলাদা অধ্যায়ে ।
সুনীলদা আর একজন মানুষকে আমার `ভাটিপুত্র' রচনাটি পড়িয়েছিলেন । তিনি শ্রী দ্বিজেন শর্মা । এক রাতে টেলিফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আরে শোনো দ্বিজেন শর্মার কোনো লেখা পড়েছ, তাঁর নাম জানো ? তিনি তোমার `ভাটিপুত্র' পড়ে ভীষণ মুগ্ধ । আমার সঙ্গে সরাসরি আলাপ নেই, তবে লেখা পড়েছি তাঁর । সুলেখক এবং মস্কো প্রগতি প্রকাশনায় অনুবাদকের কাজ করেন । আমার এক বন্ধুর বন্ধু । - বললাম, লেখা পড়িনি, তবে আমি একজন দ্বিজেন শর্মাকে জানতাম, যিনি বরিশাল বি. এম কলেজে বোটানির অধ্যাপক ছিলেন । মাস দুয়েক তাঁর ছাত্র ছিলাম । নিজের এলেম না বুঝে ভুল করে ইনটার মিডিয়েট ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম । পরে কলাবিভাগে চলে যাই । ঐ মাস দুয়েককাল আমি দ্বিজেন শর্মার ছাত্র ছিলাম ।
------- কী আশ্চর্য ! তিনি কিন্তু তোমাকে দেখার জন্য খুব আগ্রহ প্রকাশ করছেন ।
------- কিন্তু তিনি তো এদেশে থাকেন না । তিনি এদেশে চলে আসেননি । তাঁর স্ত্রী দেবিদি আমার স্ত্রীর সহকর্মিনী ছিলেন বরিশাল উইমেন্স কলেজে ।
------- তিনি শিগ্গিরই এদেশে আসছেন, তখন দেখা হবে । ইতিমধ্যে তোমার যে কটা বই বেরিয়েছে, সব আমাকে এক কপি করে দাও । লাড্লি আমার বন্ধু, এখানে এসেছেন, ওঁর সঙ্গে পাঠিয়ে দেব । ড: শর্মার দ্বিতীয় আস্তানা বাংলাদেশের ঢাকা শহরে, যদিও সিলেট জেলার মানুষ ।
জীবনের সুখ সৌভাগ্যের দরজা বোধহয় এভাবেই খোলে । আমরা তার খেয়াল রাখি না । জীবনের দাহটাই বেশি করে দাগ কেটে বসে আমাদের মনে । ওটাকেই একমাত্র পাওনা হিসাবে মনে করি । শিশুকাল থেকে এই আমার একটা মস্ত অসুখ । পছন্দের কিছু, আনন্দের, ভালবাসার ক্ষণগুলি বড় দ্রুত নি:শেষ হয়ে যায় । দু:খ আর তাপ আর তার দাহ যেন চিরস্থায়ী মনে হয় । একারণেই কী জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কারণে অকারণে বিষন্নতাকেই ধ্রুব মেনে নিয়েছি ? কিন্তু তার স্থায়িত্বও তো শেষ বিচারে ক্ষণিকত্বের সত্যে বাঁধা ।
সুনীলদা তাঁর বিষয়ের বাইরের বিষয় নিয়ে কম মগ্ন ছিলেন না । ছোটবড় নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধের বিষয়, ভূতাত্ত্বিক গবেষণার গণ্ডি পেরিয়ে কতকিছু নিয়েই না সরস আলেখ্য সৃষ্টি করেছিলেন । সেসব অবশ্যই ব্যাপক পাঠকদের দরবারে পৌঁছোয়নি । নিজের পরিচয় গোপন রাখার এক অদ্ভূত স্বভাব ছিল তাঁর । আলাপের কিছুদিন পরে, অত্যন্ত সলজ্জভাবে একদিন তিনি তাঁর পুস্তকাকারে প্রকাশিত একটি ক্ষীণকায় বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন । ছায়াবৃতা । সূচীতে রচনা নির্দেশনা ছিল এরকম -------
     সুনীল সেনশর্মা
তা তিনি যাই বলুন, বইখানা প্রকাশের ব্যাপারে যে চারজন মহারথীর নাম ওতপ্রোত, তাঁরা সবকজনই সাংস্কৃতিক মণ্ডলের হেভিওয়েট । তাঁরা হলেন, অরুণা হালদার, গোপাল হালদার, অচ্যুতানন্দ সাহা এবং শ্রী অশোক সেন (`বারোমাস' পত্রিকার কর্ণধার) । এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন প্রয়াত । অশোকদা অনুগ্রহ করে ইহজগতটাকে এখনও তুচ্ছ বোধ করছেন না । বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি আমার কলমটাকে সুনীলদার কলমের অনুসারী করতে পারতাম বা সামান্যতম রকমেও যদি ঐ প্রসাদগুণ আমাতে বর্তাতো, আমার লেখাও হয়ত লেখা পদবাচ্য হতো । কিন্তু ক্ষোভের কথা এই যে, সুনীলদা ঐ পথে আর হাঁটেননি । তাঁর নিজস্ব বিষয় ভূতত্ত্ব বা নদী সম্পর্কীয় লেখা ছাড়া, তিনি প্রায় লিখতেই চাইতেন না । সবচেয়ে বড় ক্ষোভ এই যে, বইখানা সামান্যতম প্রচারও পায়নি । আমি একবার মহাশ্বেতা দেবীকে প্রশ্ন করেছিলাম, সুনীল সেনশর্মাকে চেনেন ? ------- উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ছায়াবৃতা ১ ছায়াবৃতা ২ ইত্যাদি বইখানা পড়েছ ? ------- ততদিনে বইটি পড়েছিলাম । উনি বলেছিলেন, ওর আরো লেখা উচিৎ ছিল । লোকটাকে নদী আর পাথরেই খেলো । কী সুন্দর লেখা ! ------- সত্যিই ছায়াবৃতা র তুলনা হয় না ।
আমার লেখালেখি বিষয়ক এই পরিক্রমায় সুনীলদার ভূমিকার কথা শেষ হবার নয় । কত গুণী এবং বিদ্বজ্জন তথা কলাবিদদের সঙ্গে যে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ! কীভাবে যে তিনি আমাকে তাঁদের সামনে তুলে ধরবেন যেন তার উপযুক্ত ভাষাই খুঁজে পেতেন না । আমার ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তি হতো । যেমন সুনীলদা, তেমনই তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী মণি বৌদি, এ বলে আমায় দ্যাখ্, ও বলে আমায় । নিজেকে যে কী অপরিসীম ভাগ্যবান বলে মনে হয়, লিখে বোঝানো যাবে না । আমার কলম-নবিশীর এই স্বল্প পরিসরে তাঁদের অবদানের কোনো পরিমাপ হয় না । কিন্তু একই সঙ্গে চরম দুর্ভাগ্য আমার । তাঁদের সংশ্রব বড় ক্ষণস্থায়ীই হলো । সুনীলদার সেই ছায়াবৃতা র উপরে লেখা ------- `সদ্যলব্ধ চিরকালের সুহৃদ' কথাটি আমার তরফ থেকেই বোধহয় অধিক সত্য । সুনীলদা মারা যাবার পর বৌদি চলে গেলেন ছেলের কাছে দুর্গাপুরে । কিছুদিন ফোনে যোগাযোগ রেখেছিলাম । কিন্তু চোখের অদর্শন মানুষকে বোধহয় অকৃতজ্ঞ করে । বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই, সংসারের নিত্য নতুন চাহিদার কাছে নিজেকে বন্ধক রেখে সবার কথাই ভুলে বসে আছি । ফিরে চাওয়ার সামান্যতম সময়ও যদি হৃদয় বরাদ্দ রাখত !
ছায়াবৃতা ------- ১
নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন, "সদ্যলব্ধ চিরকালের সুহৃদ মিহির সেনগুপ্তকে"
ছায়াবৃতা ------- ২
ছায়াবৃতা ------- ৩
ছায়াবৃতা ------- ৪ থেকে ছায়াবৃতা ৭ অবধি ।
     ২৮/৫/৯৪
মাত্র ১০৬ পৃষ্ঠার একটি চটি বই, প্রথমে শ্রীযুক্ত অশোক সেন মশাই এর `বারোমাস' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত এবং পরে অরুণাদির সুপারিশে পুঁথিপত্র থেকে বই আকারে । কর্মসূত্রে নেফা অঞ্চলে (বর্তমান অরুণাচল) থাকার সময়ে দেশটাকে তিনি
যেভাবে দেখেছিলেন, তারই মনোজ্ঞ আলেখ্য এটি, যদিও তাঁর ভাষায় "ওসব এক অজাগতিক পরিবেশে আদিমতার মাঝে আবোল তাবোল চিন্তার হিজিবিজি রূপলেখা । ঐ `মেঘমুলুকের ঝাপসা রাতে' বা `আদিম রাতের চাঁদিম হিম' জাতীয় ।"
সম্প্রতি ঢাকা গিয়েছিলাম । গিয়েছিলাম আত্মীয়বিয়োগে বিধ্বস্ত মনটাকে খানিক ধাতস্থ করার আকাঙ্ক্ষায় । কিন্তু সে দেশটা আমার অতি প্রিয়তমা জন্মভূমি হলেও, আমাকে সামান্যতমও ধাতস্থ করতে পারল না । বিগত বছরের সিডার নামধারী সমুদ্র-দস্যু তাকে এমন ধ্বস্ত করে রেখেছে এবং এই রাজধানী শহরটির হালও এমন হয়েছে যে মন তো দূরস্থান, সেখানে ক্ষণকালের স্থিতিও অসহ্য দেহের দাহ পর্যন্ত দূর করতে পারে না । ঠিক সেই সময়ের একটি রাত্রের মধ্যযামে টেলিফোনে স্ত্রী জানালেন, জ্যোতিভূষণ চাকী মশাই আজ চলে গেলেন ।
জ্যোতিবাবুকে আমি মেশোমশাই ডাকতাম, তাঁর স্ত্রীকে মাসিমা । তিনি আমার তিন অগ্রজের মাস্টারমশাই ছিলেন, তাঁদের স্কুল-জীবনের প্রথম দিকে । তাঁদের কাছে জ্যোতিমশাই এর হরেক গল্প শুনেছি, নানা প্রসঙ্গে, বিশেষত বাল্যস্মৃতি রোমন্থনের সময় । কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ করার কোনো হেতু বা সুযোগ ঘটেনি । তিনি ক্লাসের কাকে মজা করে কী নাম দিতেন, কী কী গান করতেন, কী সব ছড়া চট্ জি বানিয়ে ফেলতেন ইত্যাদি শুনে শুনে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আমার মনে কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, আমি তাঁকে বহুকাল ধরেই চিনি এবং তিনি আমারও মাস্টারমশাই । তখনও আমি তাঁকে চাক্ষুষই করিনি যদিও । মাস্টারমশাই হিসাবে তাঁর অসাধারণত্বের গল্প বলার সময়, দাদারা কেমন যেন আত্মহারা হয়ে পড়তেন । আমি তখন সদ্য আমার মাস্টারমশাইদের সংসর্গ ছেড়ে এদেশে এসেছি । জ্যোতিমশাইয়ের নানান গুণপনার কথা শুনে শুনে, তাঁর সঙ্গে আমার ফেলে আসা দেশের শিক্ষকদের তুলনা করতে গিয়ে বড় মন খারাপ হতো । কারণ তাঁদের মধ্যে এমন একজনও ছিলেন না, যাঁর মধ্যে জ্যোতিভূষণ চাকীর মত অতসব গুণের সমাহার দেখেছি । একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি আমার প্র-পালক শিক্ষক । শিক্ষক হিসাবে তিনি অবশ্যই চমত্কার ছিলেন, কিন্তু তা শুধুই শিক্ষক হিসাবে । তাঁর মধ্যে ছাত্রদের আকর্ষণ করার জন্য ছড়া বাঁধার, গান গাওয়ার বা গাওয়াবার, নাটক করাবার কুশলতা তো ছিল না । সে কারণেই দাদাদের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত বোধ করতাম । আমার সেই মাস্টারমশাইও বিভিন্ন বিষয় অবলীলাক্রমে পড়াতে পারতেন জ্যোতিমশাই এর মতই এবং যে কোনো শ্রেণীতে, কিন্তু মৌলবী সাহেব অনুপস্থিত থাকলে, আরবী উর্দু পড়াতে পারতেন না । দাদার কাছে শুনেছি, একটা ক্লাসে পণ্ডিতমশাই আসেননি বলে সেই ক্লাসে সংস্কৃত পড়িয়ে, মৌলবী সাহেবের অনুপস্থিতির কারণে অন্য ক্লাসে আরবীও তিনি অক্লেশে পড়িয়ে আসতেন । আবার অঙ্কের ক্লাসেও নাকি উত্তম গণিত শেখাতেও তাঁর অসুবিধে বা আপত্তি হতো না । এমন একজন শিক্ষকের কাছে আমি পড়তে পাইনি, এমন কী সেই মানুষটিকে তখনও দেখতেও পাইনি, এ দু:খ আমার বহুকাল ছিল ।
আমার বড়দাও ছিলেন খুবই সংস্কৃতিমনস্ক গুণী মানুষ । গান, নাটক, আবৃত্তি, ছড়ালেখা, পদ্যলেখা এসব যেমন পারতেন, তেমনি তাঁর দক্ষতা ছিল, আঁকা, বাঁশি বাজানো এবং সর্বোপরি শিশুদের নিয়ে এইসব তালিম দেওয়ার । জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর বেশ হৃদ্যতা ছিল । তাঁদের দুজনের পরিচালনায় অন্তত দুটি নাটক আমি দেখেছিলাম রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে । একটির নাম `অঙ্কমালার দেশে' এবং অপরটি `ছড়ার দেশে আনন্দ' । এর মধ্যে কিছু ছড়া বড়দার তো কিছু জ্যোতিমশাইয়ের । সুর বেশিরভাগই জ্যোতিবাবুর । আজও `মাহিন্দরের বড় ব্যাটা মেঘনাদ গো' বা `শূন্য কোথায় ? শূন্য কোথায় ?' এই টুকরো টাক্রা লাইন মনে পড়ে । ঢাকুরিয়ার পূজারিণীর আসরের তখনকার শিশুরা আজ বোধহয় সবাই শিশুদের পিতামাতা হয়ে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে । তাদের এইসব মনে থাকার কথা । কিন্তু তখন বড়দাকে অনেকবার অনুনয় করেও জ্যোতিমশাই মানুষটিকে দেখার সুযোগ হয়নি । আসলে সেটা যে তাঁর অনিচ্ছা ছিল এমন নয়, হয়ে ওঠেনি ।
এই সব ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালের কথা । তখন আমার বয়স ১৭ থেকে ২২ । বড়দা, জ্যোতিমশাই সদ্য প্রৌঢ়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন, এমন কী জ্যোতিমশাই সবে বা বার্ধক্যস্তরেই উঠে গেছেন । সে যাই হোক, এইসব সাংস্কৃতিক ব্যাপার স্যাপারে দুজনেরই মানসিকতা শৈশব থেকে পৌগণ্ডের বিষয়ের মধ্যেই ঘোরা ফেরা করছে । কিন্তু ৬৭'র সময়টায় আমি অকস্মাৎ যেন ছিন্নরশিষণ্ডবৎ । সুতরাং এইসব শিশু পৌগণ্ড সুলভ ব্যাপার স্যাপারে আমার কোনো চাঞ্চল্য বা উত্সাহ ছিল না । যে ব্যাপারে ছিল, তাও তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে অনেকেই শিশুসুলভ চপলতা বা
infantile disorder বলে ব্যঙ্গ করতে থাকলেন । অর্থাৎ আমি তখন অত্যন্ত উগ্রভাবে সমাজবিপ্লবের জগতে ঘোরাফেরা করছি এবং সাংস্কৃতিক জগতের এইসব ব্যাপারগুলো আমার বা আমাদের কাছে পুতিগন্ধময় বুর্জোয়া ব্যাপার স্যাপার । বড়দাও তাই । এসবের ডামাডোলে মন থেকে জ্যোতিমশাই উধাও । তখন চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, রেডবুক গীতা এবং পিকিং অপেরার নাটক বা ভিয়েতনামের ওপর পোস্টার ড্রামা একমাত্র সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হাতিয়ার । কিন্তু সেসব কথা এই আলেখ্যে প্রাসঙ্গিক নয় বলে, এখানেই তার আলোচনা বা উল্লেখের ইতি করছি । বরং জ্যোতিমশাইতে প্রত্যাবর্তনের কথাই বলা যাক ।একটু খাপছাড়া ভাবে হলেও একটি কথার কৈফিয়ৎ দিয়ে রাখি । জ্যোতিভূষণ চাকীকে আমি এই স্মৃতিচারণায় কখনো জ্যোতিবাবু, কখনো, জ্যোতিমশাই, কখনো জ্যোতিভূষণ চাকী এই পুরো নামটি ধরেই উল্লেখ করে যাচ্ছি । অন্য নামগুলো নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু জ্যোতিমশাই শব্দটি হয়তো অনেকের কানে অশোভন বা অদ্ভূত শোনাতে পারে । তবে কৈফিয়ৎ এই যে শব্দটি আমি শুনেছিলাম পূজারিণীর আসরের একটি কিশোরীর মুখে । আরও অনেক সভ্য সভ্যারাও নামটি ব্যবহার করত এবং নামটি আমার বেশ পছন্দের, যদিও পরবর্তী কালে যখন আলাপ পরিচয় হলো, আমি তাঁকে মেশোমশাই বলেই সম্বোধন করতাম । প্রথম দিকে দুএকবার মাস্টারমশাইও বলেছি । কিন্তু তাঁর ছাত্র না হতে পারার সুবাদে, ঐ ডাকটা স্থায়ী হয়নি । মনের অভিমানটা বড় বেয়াড়াভাবে বাধা সৃষ্টি করে রেখেছিল । এসব কথা উল্লেখের কোনো বিশেষ হেতু নেই । তবে বলতে যখন বসেছি, খুঁটিনাটি সবই বলি না কেন ।
এদেশে আসার তিরিশ বছর পরে তাঁর সঙ্গে আমার সামনা সামনি সাক্ষাৎ হয় । সেই ঘটনাটির কথা আমার পক্ষে আত্মপ্রশংসার হলেও আমাকে বলতে হবে । অন্য অনুরূপ অনেকের সঙ্গে আলাপের কারণের মত, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রটিও আমার `ভাটি পুত্রর পত্র বাখোয়াজি' নামক রচনাটি । নীলুদা, নীলরতন মুখোপাধ্যায় নামে আমাদের এক স্নেহপ্রবণ, অগ্রজপ্রতিম দাদাবন্ধুর মারফতে ঘটেছিল বহু অপেক্ষিত তথা কাঙ্খিত এই পরিচয়, নীলুদার ক্রিস্টোফার রোডস্থ ফ্ল্যাটে । রচনাটির ভাষা ও বিষয়বস্তুর গোত্র ছাড়া ধরনটির জন্য জ্যোতিমশাই এর খুব পছন্দ হয়েছিল সেটি । লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলেছিলাম, যে ব্যাপারটি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সে বিষয়ে তো আমার কোনো প্রথাগত বা রীতিসম্মত পড়াশোনা নেই, সেসব থাকলে হয়ত ভাল হতো । প্রসঙ্গত লেখাটিতে ভাষা এবং শব্দ নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য এবং আলোচনা তাঁর ভাল লেগেছিল । বলেছিলেন, প্রথাগত এবং রীতিসম্মত কাজকর্ম ঢের দেখেছি । তাতে অরিজিনেল কিছু হয় না । যাঁরা বড় কাজ করেছেন, তাঁরা রীতি, প্রথা ভেঙেই খাস কিছু করেছেন । ------- জ্যোতিমশাই ভাষা, শব্দ নিয়ে কতটা ভিন্ন ধারায় চিন্তা ও কাজ করতেন, তা পরবর্তী কালে বাগার্থ কৌতুকী নিয়ে যখন দেশ এ ধারাবাহিক লিখতে শুরু করলেন, সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন । আমি তখন তাঁর সঙ্গে রীতিমত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি । কাঁকুলিয়ার বাসায় যাতায়াত চলছে মাঝে মাঝে । বস্তুত আমার ঐ `ভাটিপুত্রর পত্রবাখোয়াজি' নামক লেখাটি জ্যোতিমশাই ইত্যাদি গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, আমি সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম রচনাটিতে হাত দিই । জ্যোতিমশাই এ সময়টায় আমার নিয়মিত দূরভাষি-মনিটর । প্রথম উপদেশ, কোনো লেখককে লেখা পড়ে শোনাবে না । প্রথমে দলিলায়নটা একটানা করে যাবে । তারপর পরিমার্জনা, পর্বভাগ ইত্যাদি । গান ব্যবহার করলে, কম্পোজ করার আগে সুরটা মাথায় কদিন ধরে খেলাবে । যে লেখা স্বাভাবিক ভাবে আসবে, তাই লিখবে । বনাওটি ততটুকুই থাকবে, যতটুকু অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । পণ্ডিতি একদম ফলাবে না । ------- প্রতিটি কথা দাড়ি, কমা সহ মনে আছে । জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেশোমশাই, গল্প, উপন্যাস লিখতে গেলে কীভাবে তৈরি করব নিজেকে বা লিখব ?
------- দেখো, ও ব্যাপারে একটা ভিন্ন প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় । বিভিন্ন ছোট ম্যাগাজিনে লিখেলিখে দীর্ঘকাল ধরে হাত আর মগজ মেজেঘষে পালিশ করলে, ভাষা, ভাব, কল্পনা, ঠাটবাট এইসব তৈরি হয় । চরিত্র নির্বাচন করতে অনুশীলন করতে হয় মানুষকে । আরও অনেক কিছুই করতে হয় । কিন্তু সেসব বলে বোঝানোর ব্যাপার নয় । তবে একটা সরলসোজা কথা বলি, তোমার লেখা পড়ে মনে হয়, ওটা তোমার ক্ষেত্র নয় । আমি বলি কী, ঐসব প্রথার মধ্য দিয়ে যাওয়ার বয়স বোধহয় তোমার আর নেই । ওসব নিয়ে ভেবো না । বরং তোমার স্বাভাবিক ক্ষেত্রে, তোমার যা আসে, তাই নিয়ে কাজ করে যাও । তার মধ্য থেকেও তো কিছু গল্প বা উপন্যাস গড়ে উঠতে পারে । নাহয়, অন্য কিছুই হোক । আসলে, পরিবেশনার পদ্ধতি, বিষয় এবং ভাষাটাই ব্যাপার । ভাষাটা মাধ্যম ।
একটি সুন্দর উপমা দিয়েছিলেন মশাই, ------- ভবাপাগলার গান শুনেছ তো ? ঐ যে রাজার কথা আছে না, "রাজার চৌঘোড়ার গাড়ি, হাতে চন্দনের ছড়ি, আগুপাছু মোগোল পাঠান যায় দড়োবড়ি ।" একটি সুদৃশ্য, শোভন রচনাকর্মের সঙ্গে এর অর্থ-পট মিলিয়ে দেখ, দেখবে কেমন খাপ খায় । আরে, রাজা চলেছেন, তাঁর পোষাক আসাক, ঠাটঠমক, জাঁকজমক রাজার মতন না হলে, লোকে তাঁকে তাকিয়ে দেখবে কেন হে ? তবে হ্যাঁ, ছুতোর, কামার, কুমোর বা হেলেচাষি তাদের কথা বলতে গেলে কিন্তু আবার অন্য কথা । সেও ভবা পাগলা তাঁর গানে বলেছেন । গিরি-রাজকে বাগ্দি বানিয়ে, তাঁর মেয়ে উমাকে বাগ্দিনীর সাজে সাজিয়েছেন তিনি । কালিদাসীয় সূক্ষ্মতায় রাখেননি তাঁর বিন্যাস । সেখানে তিনি বাগদিনীর বেশে শ্যামাকে সাজিয়েছেন, বলেছেন, -------
চল্ বাগদিনীর বেশেকী বললাম কিছু বুঝলে ? ------- যখন বলেছিলেন তখন বুঝেছিলাম ঠিকই, কিন্তু অনুসরণ করাটা হলো কী না, তা আজ আর কে বলে দেবে ? তিনি তো বলা কওয়ার বাইরে চলে গেলেন । এমন একটা বয়সে গেলেন, যে, চোখের জল ফেলতে গেলেও লোকে পাঁচকথা বলে মস্করা করবে । আর আমিও যে তাঁর বুড়ো-খোকা । কাঁদি কোন্ আক্কেলে ?
শ্যামা মা আমার সঙ্গে চল্ ।
হাতে দেমা মাছের খালুই
কাঁধে নে মা বেঁকি জাল
চল্ বাগদিনীর বেশে -------।
সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম তাঁকে দিয়েছিলাম । পরে এদিক ওদিক দাতব্য করতে আরো কয়েক কপি নিয়েছিলেন । বইটি পড়ার মধ্যে একদিন ফোনে জানার ইচ্ছে হয়েছিল, কী প্রতিক্রিয়া । বাড়ি ছিলেন না । মাসিমা তখন সুস্থ । ফোনটা তিনিই ধরেছিলেন । বলেছিলেন, পড়া শেষ হয়নি । তবে পড়তে পড়তে, একা একাই হাসছেন, চোখও মুছছেন । শুনে ভাল লেগেছিল । কয়েকদিন পরে একটি পোস্টকার্ড পেলাম । খুদে খুদে অক্ষরে ঠাসা লেখা । পাঠটির উদ্ধৃতি সামলাতে পারছিনা । এ যে আমার অমূল্য সমপদ চিঠিটি এরকম, -------
[আমার একটা কাজ করে দাও । যে কোনো একটা বাক্যকে ও বাংলার অন্তত চারটে লোকভাষায় (আঞ্চলিক) এবং এ বাংলার চারটে লোকভাষায় তর্জমা করে দাও ] ------- এ খেলাটা বাক্য ও শব্দের ব্যাপারে আমাদের বহুদিন চলেছিল । মনে হয়, এটাও আমাকে হাতে ধরে প্রস্তুতির পথে নিয়ে যাওয়ার, তাঁর একটা পদ্ধতি । আমার চাইতে ভাগ্যবান শিষ্য তাঁর আর কে আছে ? দেরিতে পেয়েছি বটে, তবে ভাগে কম পড়েছে, এমনটা বলতে পারব না ।৮১ কাকুলিয়া রোড
স্নেহের মিহির,
কলকাতা - ২৯
৩১. ৫. ৯৮
   আমি এখন উত্সে । ফকির সাহেব, মোকছেদ, কার্তিক আর ছোমেদদের মধ্যে ।
সবই অমৃত ------- না, না------- অমের্ত ।
আমার কী মনে হয় জান মিহির, যে ঘ্রাণটা নাকে আসে তা চিরকালের মানুষের উত্সের ঘ্রাণ । শুধু নস্ট্যালজিয়ায় তা বোঝায় না ।লোক ভাষাতে মাটির পরাণ কান্দে । তোমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম এ, মোকাম কথাটাও চম্কে দিল আমাকে । সুফি ফকিররা গন্তব্যের প্রান্তলোককে বলে মোকাম । আশ্চর্য নামকরণ !
হৃদয়রসে জারিত ------- না ------- মানবরসে জারিত তোমার এই বাঙ্ময় উপহার আমার জীবনে এক মহার্ঘ প্রাপ্তি । আশীর্বাদ নাও ।
জ্যোতিভূষণ চাকী ।
নীলুদার দেড়খানা ঘরের ফ্ল্যাটেও কখনো কখনো বৈঠক হয় । কতভাবে তিনি যে শেখান কতকিছু, তার কোনো হিসাব নেই । আমার মনোবাঙ্ছা এতদিনে পূর্ণ হয়েছে । যেভাবেই হোক, শিক্ষক হিসাবে তো শেষ তক্ পেয়েছি তাঁকে । না হয়, তাঁর ক্লাস পড়ুয়া নাই হলাম । এখানেও রীতি পদ্ধতির রাস্তা ধরে নয় । আমার লেখালেখির যে প্রথা-বিরুদ্ধতার কথা আমি মাঝেমাঝেই বলি তার পিছনে জ্যোতিমশাইয়ের একটা গূঢ় প্রশ্রয় এবং ইচ্ছা যে খুবই সক্রিয় ছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই । আবারও বলছি, এইসব স্মৃতিচারণা করা মানে খানিকটা যে আত্মপ্রচার, তাতে ভুল নেই । কিন্তু তা এড়ানো যাচ্ছে না । ঐ সময়টা, সন তারিখের হিসাবে নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি কী শেষের দিকেই হবে । তাঁর বাগার্থ কৌতুকী তখন চলছে । প্রায় রাত্তিরেই ফোনে কিছু নির্দেশ দেন । একদিন বললেন, আরে তোমাদের বরিশালিয়াদের `ইশে' বলে একটা বাগ্বিধি আছে না ? ------- বললাম, শুধু `ইশে' তে থামলে তো চলবে না, তত্সহ `কচু' আছে । আর ওটাতো শুধু বরিশালিয়া নয় অন্য বাঙাল জিলাগুলিতেও কমবেশি আছে । এপারে `ইশে'র কাছাকাছি `ইয়ে' আছে । ------- তা তোমাদের ইশের তাত্পর্যটা কীরকম ? ------- আজ্ঞে, ইশে অতি ব্যাপক শব্দ । এতদ্বারা জগৎ সংসারে না বোঝানো যায় হেন বস্তু নেই । ------- ইশের প্রতিশব্দ কী ? ------- বললাম, বাংলা প্রতিশব্দ ঐ ব্যাপকতায় নজরে আসেনি এক ঐ যে বললাম `ইয়ে' ছাড়া । । হিন্দুস্তানীতে একটা পেয়েছি, প্রায় সম-ক্ষমতা সম্পন্ন । শব্দটি `এথি' । ------- না, হিন্দুস্তানী শব্দে হবে না, বাংলা প্রতিশব্দ খোঁজো । ------- খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি । `ইয়েতে' তাঁর মন ভরেনি
একরাতে টেলিফোন । ------- কাল সকাল দশটার মধ্যে ফোনে কম করে পাঁচটি বরিশালিয়া প্রবচন চাই যার ব্যাপক প্রচলন নেই । বললাম, দশটার সময় হবে না । বর্ধমানের সাতগেছিয়াতে অফিস । খুব সকালে বেরিয়ে যেতে হয় । রাতে জানাব । অফিসে একটা রাফ প্যাড নিয়ে স্মৃতি কচ্লে, বিকেল নাগাদ দেখলাম ১২০ কী ১২১ টা মতন নানাধরনের শোলোক, শাস্তর, পল্কি জড় হয়েছে । রাতে সবগুলো বললাম । তার থেকে তাঁর প্রয়োজন মত নিলেন । বললেন, বাকিগুলো ফেলে দিও না । এগুলোর আলাদা আলাদা বর্গীকরণ কর, শোলক, শাস্তর, পল্কি হিসাবে । তারপর আমাকে এতক্ষণ যা বললে, সেই কথাগুলোর মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে দাও, দিব্য একটা লেখা হবে । ------- পরে সেই লেখাটি `চান্দ্রদ্বীপি শোলোক, শাস্তর, পল্কি কথা' এই শিরোনামে একটি ছোট সাহিত্যপত্রে বের হয় এবং ত্রক্রমে উজানি খালের সোঁতা নামক সংকলন গ্রন্থের অন্যতম রচনা হিসাবে স্থান পায় । বইটি আনন্দ প্রকাশ করেছিল ২০০৬ এর বইমেলায় । জ্যোতিমশাই এর সঙ্গে এরকম একটা সম্পর্ক যে আমার ঘটেছিল, তার জন্য নিজেকে বড় ভাগ্যবান বলে মনে হয় । বহুপ্রতীক্ষিত একটা আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি এভাবেই হয়েছিল । কিন্তু ব্যাপারটা যদি আরো আগে ঘটত ! সেই `ছড়ার দেশে আনন্দ'র সময়টায়ও যদি সাক্ষাত্টা পরোক্ষে না হ'য়ে প্রত্যক্ষে ঘটত, লেখালেখির জগতে হয়ত বেশ খানিকটা আগে এসে, অন্যভাবে নিজেকে গড়তে পারতাম । হয়ত ভাল কিছু কাজ করার জন্য প্রস্তুতিটা উপযুক্ত সহায়তায় অনেক বেশি অর্থবহ হতো ।
ঐ সময়েই একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, দেখ, এই বয়সেও কী অপরিসীম পরিশ্রম করতে হয়, মাঝে মাঝে বড় ক্লান্তি আসে । ইচ্ছে হয়, কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি । কিন্তু আমার স্ত্রীর শরীর একেই ভাল নয়, তার ওপর সম্প্রতি পা ভেঙে `দ' হয়ে আছেন । আমি আবার একা কোথাও যাইনা কী না । ------- কথাটা ঠিক, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও নিরুদ্বেগ বিশ্রাম বা নিশ্চিত নিশ্চিন্ত অন্ন তাঁর অদৃষ্টে ছিল না । তখনও বাংলা একাডেমির আনুকূল্য তাঁর ঘটেনি । অর্থকরী কাজ বলতে প্রধান ছিল
Proof Editing এবং সাময়িক পত্রে লেখালেখি করে কিছু উপার্জন । বাগার্থ কৌতুকী-র পর্ব তখন শুরু হয়েছে বলে কিছু নিয়মিত রোজগার । কিন্তু বিশ্রাম নেই । এসব কাজে থাকেও না । একদিন বললাম, আমার বাড়ি যাবেন ? ------- এক কথায় রাজি । কিন্তু মাসীমার পা ভাঙা যে ? বললাম ট্যাক্সিতে নিয়ে যাব । ------- সেরকমই সাব্যস্ত হলো । একদিন কোলকাতায় বন্ধুর বাড়ি রাত কাটিয়ে ভোরবেলা কাঁকুলিয়ায় গেলাম । ততক্ষণে দুজনে স্নানটান সেরে, সেজেগুজে বসে আছেন । কী উত্সাহ দুজনের ! ট্যাক্সিতে বসে বললেন, শোনো, তোমার ভদ্রেশ্বর স্টেশনটার আগের স্টেশনে কী সিঁড়ি না ভেঙে বাসস্টপ অবধি যাওয়া যাবে ?
------- তা যাবে । কিন্তু তার দরকার কী ?
------- না, অতদূর অবধি ট্যাক্সিতে যাওয়া মানে বেকার গুচ্ছের টাকা খরচ । সিঁড়িভাঙার ব্যাপারটা যদি এড়ানো যায় তো যেমন বললাম, ------- ও তোমার মাসিমা দিব্য পেরে যাবেন । কী গো অসুবিধে হবে ?
------- না -------, একটু আস্তে আস্তে হাঁটলে ঠিক পেরে যাব ।
জ্যোতিমশাই পণ্ডিতমানুষ বলে আমি বা আমার মত সাধারণেরা বিশ্বাস করি, যদিও কোলকাতার তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবিদের, কারুর কারুর এবং তাঁদের কুঁচো কাঁচা চামচাদের অভিমত এই যে, `জ্যোতিবাবু নাকি ঠিক পণ্ডিত পদবাচ্য নন ।' তা হবে । পণ্ডিত কথাটিকে নানা মুনি নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, করেনও । তার একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে সর্বং পণ্ডয়তি য: স: পণ্ডিত: ইতি । সে অর্থে জ্যোতিমশাই পণ্ডিত অবশ্য নন । তাঁকে কোনোদিন কোনো কর্ম পণ্ড করতে বোধহয় কেউ দেখেনি । এই ব্যাখ্যাটা ক্রিয়ার দিক থেকে ব্যাখ্যা, এক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও ক্ষেত্রান্তরে বা পাত্রান্তরে ক্রিয়াশীল, সুতরাং, মিথ্যে নয় । আরেকটি টীকাও চালু আছে । সেটি আরো গভীর অর্থবহ । সেখানে বলা হয়েছে যে পণ্ডিতদের সবটাই গুণ, একটিমাত্র দোষ এবং তা হলো যে তাঁরা মূর্খ । এটিকে বিশেষণধর্মী অর্থ-প্রকরণ বলা যেতে পারে । কিন্তু জ্যোতিমশাইকে সেদিকেও ফেলা যায় না । আমরা যারা প্রবল রবকারী ভীষণ তাত্ত্বিক ও তার্কিক পণ্ডিতদের থেকে সহস্রযোজন দূরে অবস্থান করা নিরাপদ মনে করি, তারা জ্যোতিমশাইকে ভিন্নকারণে পণ্ডিত মনে করে থাকি । সেখানে পাণিণি পান থেকে চূণ খস্লেই খড়্গপাণি হন না বরং একটি কান্তকোমল ছড়া বা শ্লোকের বাগার্থ নিয়ে কৌতুক রসের ধারা বইয়ে দেন । আমরা তাতে তাঁর সহজিয়া পাণ্ডিত্যের শীতল তক্র পান করে প্রাণে মনে বড় ঋদ্ধ হই । সেখানে বোধের চাইতে অনুভবের অতীন্দ্রিয় আনন্দটাই প্রবল হয় । তাই তিনি আমাদের পণ্ডিত ।
যাহোক্, আমার বাড়িতে তাঁদের নিয়ে আসার পথে আমার মনে একটা ফন্দি এসে গেল । জ্যোতিমশাই একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তোমাদের আগের ঐ বৈদ্যবাটি জায়গাটি আমার তীর্থস্থান । ------- বৈদ্যবাটির গঙ্গায় নিমাই তীর্থের ঘাট বলে একটি বিখ্যাত ঘাট আছে বটে, তবে তাতো তারকেশ্বর গামী তীর্থযাত্রীদের জল নেবার স্থান । জ্যোতিমশাইকে বলতে বললেন, আরে সে তীর্থ নয় । ওখানের কাছে পিঠে থাকো, অথচ জানো না বৈদ্যবাটি কেন আমার তীর্থক্ষেত্র ? ওখানে যে মহামহোপাধ্যায় ঠাকুর অনন্তলাল চক্রবর্তী মশাইএর বাড়ি । ------- জানিনা আবার ! তাঁর কাছেই তো অরুণাদি অর্থাৎ ড: অরুণা হালদার আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন এক কপি বিদুর তাঁকে দেওয়ার জন্য । আর তারপর সে কী কেলেঙ্কার ! প্রণামসহ বিদুর -তো এক কপি দিয়ে এসেছিলাম । নিয়েও ছিলেন বেশ হৃষ্টচিত্তে লম্বা একটা শ্লোকে আশীর্বাণী উচ্চারণ করে । তার দিন কয়েক পরে টেলিফোনে যা একখানা ধ্রুপদি নিরুক্তিতে ঝাড়্ দিয়েছিলেন না যে আমার অবস্থা প্রায় ঝাড়ে বংশে নির্বংশ হবার মত । ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম তার পরের দিন, তা প্রায় ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না বাড়িতে । ভাগ্যিস মাসিমা ছিলেন, কোনোক্রমে পার পেয়েছিলাম । পরে আবার একদিন ফোনেই উল্টো দু:খ করে মনের খেদ দূর করে দিয়েছিলেন আমার । তারপর থেকে বাড়িটি আমারও তীর্থস্থান হয়েছে । এবার ফন্দি করলাম এই দুই পণ্ডিতকে এক জায়গায় এনে রঙ্গ দেখার । এরকম রঙ্গ দেখার বাই আমার পুরোনো । তবে তা কোনোক্রমেই শালীনতা বা ভব্যতার সীমা ডিঙিয়ে নয় । রঙ্গের বিষয়টা সাধারণত নির্ভরশীল হয় দুই পণ্ডিতের বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিতর্ক বিস্তারের মাধ্যমে খুঁটিনাটি, এটা ওটা মুফতে জানতে পারার সুযোগ লাভের জন্য । জ্যোতিমশাই আমার এই স্বভাবটা বেশ জানতেন । তাঁকে কথাটা বলতে, বললেন, প্রস্তাবটা আমার খুবই মন মতন, তবে জানো তো, সমুদ্দুরের সীমায় একবার পড়লে, নালা খালের কলধ্বনি আর থাকে না । তোমার কৌতুকী বোধহয় সিদ্ধ হবে না, ------- তবে আমার খুব আহ্লাদ হচ্ছে । বাড়িটা চেনো না কী ?
------- একেবারে নিজের বাড়ির মতই চিনি, ফলারটাও হয় খাঁটি ফলুরে বামুনবাড়ির মতই । মাসিমা খাওয়ান ভাল ।
এদিকের মাসিমার চরণ সমস্যা এই প্রস্তাবে তখন অনেকটা কমের দিকে । দুজনেই বললেন, চল তিথ্থিটা সেরেই যাই না কেন । বৈদ্যবাটি স্টেশানে নেমে দুখানা রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম । খবর দেওয়া নেই, হঠাৎ করে গিয়ে যদি বাড়ি না পাই, বাহাদুরিটা মাঠে মারা যাবে । তাছাড়া দুইজন এই বয়সী বৃদ্ধবৃদ্ধার হয়রানিটাও কম আফশোসের কথা হবে না । এ কারণে মনে আশঙ্কা । পাড়াটার নাম মালির বাগান । জ্যোতিমশাইদের রিক্সাওলাকে জায়গাটার হদিস বলে আমার রিক্সা নিয়ে একটু দ্রুত গেলাম । পণ্ডিত মশাইকে জানাতে যে খবর না দিয়ে বাড়িতে অতিথি নিয়ে এসেছি । সভাসমিতিতে দুজনের ইতিপূর্বে পরিচয় কিছুটা ছিল, তবে গভীর আলাপ সে অর্থে ছিল না । দুজনে দুজনার কর্ম সম্পর্কে অবশ্য জানতেন । মহামহোপাধ্যায় বৌদ্ধ-ন্যায়ের পণ্ডিত এবং দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে পর্বতাকৃতিপ্রায় কাজ করেছেন । বিশুদ্ধ জ্ঞানতাপস বলতে যা বোঝায় তাই । তাছাড়া কালিপ্রসন্ন সিংহের `সাক্ষরতা প্রকাশন' কৃত মহাভারত সম্পাদনা করেছেন, প্রয়াত গোপাল হালদার মশাই এর সহযোগে । তার ভূমিকাটি পড়লেও পঙ্গু গিরিলঙ্ঘন করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে । কোটালিপাড়া অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্ডিতবংশের তিনি প্রথম পুরুষ, যাঁকে, কৌলিক প্রথা ভঙ্গ করে তাঁর পিতাঠাকুর গোবিন্দলাল চক্রবর্তী মশাই সেই যুগে ইংরাজি শিক্ষার অনুমতি দিয়ে জ্ঞাতিদের তিরস্কার হজম করেছিলেন । এসব কাহিনী তাঁর শ্রীমুখেই শোনা । বয়স তখন, অর্থাৎ এই সাক্ষাত্কারের সময় বোধহয় ৮৬ না কত যেন বলেছিলেন, আর জ্যোতিমশাই আশির আশে পাশে । মজা লাগছিল যখন দুজনে সামনাসামনি পরস্পরকে অভিবাদন করছেন । দুজনেই দুজনের প্রশংসায় সব সুছন্দবদ্ধ শ্লোক আওড়াচ্ছেন আর তত্সহ নমস্কার প্রতি নমস্কার করছেন । আমি এবং আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুজনে অবাক হয়ে তাঁদের কাণ্ড দেখছি । আমার বন্ধুটিও ঠাকুর চক্রবর্তী পদবীর এবং ঐ পাড়ায়ই থাকেন । বয়সে আমার চাইতে অনেক ছোট, কিন্তু পড়াশোনার পরিধিতে তার থই পাওয়া ভার । এমন বিষয় পাওয়া ভার যেখানে তার গতিবিধি নেই । ও যে কখন এত পড়ে, তা ওই জানে । এবং কোনোটাই ভাসাভাসা নয়, সবটাই গভীরে ।
কথাবার্তা এবং ফলারের সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিতমশাই এর কাজকর্ম দেখা চলছিল । একটা বড় টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত এবং রচিত গ্রন্থাবলী । সেসবের আনুপূর্ব বিবরণ বলে যাচ্ছিলেন মধ্যঅশীতি অতিক্রান্ত পণ্ডিতমশাই । পূর্ব এবং উত্তর মীমাংসার, নব্যন্যায়, বৌদ্ধন্যায়ের নানা প্রসঙ্গ ছিল তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু, যার সামান্যতম অংশও আমার মাথায় ঢুকছিল না । ঢোকার কথাও নয় । বন্ধুটির কথা আলাদা । সে আবাল্য এঁর সংসর্গে মানুষ, উপরন্তু ঠাকুর চক্রবর্তীর রক্ত তার ধমনীতেও বহমান । একসময় জ্যোতিমশাই পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, সারাজীবন এই যে এতসব করলেন, তার উত্তরাধিকার এই সমাজে কাকে দিয়ে যাবেন ? ------- বৃদ্ধ খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন । ভাবলাম, নিজের কাছে এই প্রশ্ন বোধহয় তারও এবং তা বহুদিনের । কিন্তু না, হতাশাকে যেন সজোরে দূরে নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন তিনি, কেন, এঁরা রয়েছেন । এঁরা বহন করবেন এই উত্তরাধিকার । ------- বলে আমাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন । কিন্তু আমি নিশ্চিত, তিনি আমার বন্ধুটিকেই বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন সেদিন । ঐ গৌরবের ভাগী অন্তত আমি হবার যোগ্যতা রাখি না । পণ্ডিতমশাই নেহাৎ ভদ্রতাবশত বহুবচনটি ব্যবহার করেছিলেন ।
আধুনিক সমাজে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্য অহংকার, ব্রাহ্মণ্যধারা বা তাঁদের ভেদবাদি ব্যাপারাদি নিয়ে নানান সমালোচনায় আমরা যেমন মূখর, তেমনই আক্রমণ প্রবণ । ভারতীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা প্রকৃত জ্ঞানতাপস এবং নিরলস মস্তিষ্কশ্রমী স্বাধ্যায়ী, তাদের অবদান এবং নির্লোভ যাপিত জীবনের কথা আমরা আজ কদাচিৎ স্মরণে মননে লালন করি বা শ্রদ্ধা জানাই । সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে হয়ত অনেক ত্রুটিই তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে আছে, কিন্তু হাজার বছরের, কী তারও অধিক কালের সাধনার মধ্যে কি কোনো লোকহিতৈষণার প্রজ্ঞার আবির্ভাব ঘটেনি ? জ্ঞানের পরম্পরাগত সংরক্ষণ এবং প্রসারণের জন্য বংশানুক্রমিক অনুশীলনের যে তপশ্চর্যা একশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা প্রকৃত নিরাসক্ত এবং স্বার্থশূন্য হয়ে করেছেন, আমরা আজ তার ফল এবং গৌরব ভোগ করে যাচ্ছি, কিন্তু সামাজিক ভেদ আর বর্ণাশ্রমী বা জাতপাতের কদর্যতার দায় তাঁদের উপর পুরোটা চাপিয়ে দিয়ে ভিন্নতর এক বিভেদের সূচনা করে যাচ্ছি । সেখানে মুড়ি মিছরির তফাৎ করা হচ্ছে না ।
পণ্ডিতমশাইয়েরই বংশলতিকায় দেখছি, ধারাবাহিকভাবে এই পাশ্চাত্য বৈদিক পরিবারটি কী অপরিসীম নিষ্ঠায় একের পর এক প্রজন্মে জ্ঞানবর্তিকাটি বহন করে চলেছেন । এইসব দেখে শুনে মনে হয়, শুধু কঠোর গালাগালি এবং নিন্দাবাদই এইসব মানুষদের একটা মাত্র প্রাপ্য হওয়া উচিৎ নয় । তাঁদের মূল্যায়ন আরও অনেক গভীরে গিয়ে করার প্রয়োজন আছে । আমি কোনোক্রমেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ভেদাচারের সপক্ষে নই । কিন্তু একথাটিও ভুললে চলবে না যে গোটা সমাজবিন্যাসের ভালমন্দের মন্দটা বিশেষ এক গোষ্ঠীর মানুষদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অন্যদের দায়মুক্ত করাটাও কোনো কাজের কথা নয় । সূক্ষ্মবিচারে অসুবিধে ভোগীরা সুবিধেভোগীদের চাইতে খুব কম দায়ী কি ? তাদের সহযোগিতা ছাড়া সুবিধেভোগী শ্রেণী বা জাতটি তৈরি হয় কী করে ? এখন কথা হচ্ছে, ক্ষমতার অধিকারী কারা ? অবশ্যই ব্রাহ্মণ ইত্যাদি উচ্চবর্ণীয়রা । কিন্তু কারা তাঁদের ক্ষমতায় রাখে এবং কেন ? এসব জটিল ব্যাপার গুলোর বোধহয় নিষ্পত্তির প্রয়োজন ।
এইসব কথা নিয়ে সেদিন দুই বৃদ্ধের দীর্ঘ আলোচনা শুনেছিলাম । পণ্ডিতমশাই এর একটি কথার মীমাংসা আমি আজও করতে পারিনি । অথচ তা এড়িয়ে যেতেও পারছি না । তিনি বলেছিলেন, পুরুষানুক্রমে আমরা জ্ঞানচর্চার এইসব অনুশীলন করে আসছি । আমার বংশ পুরুষেরা রাজন্যদের কাছ থেকে ভূমি, বৃত্তি ইত্যাদি পেয়ে নিশ্চিন্তে এইসব কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারতেন । আজ যদি আমাকে দিনান্তের শাকান্নের ব্যবস্থার জন্য কায়িক প্রচেষ্টা চালাতে হয় এসব কাজ কীভাবে করব ? সবার জন্য কী একই নিয়ম বা বিধি চলে ? ঐতিহ্য এবং পরম্পরার বাইরে গেলে কী ইতোনষ্টস্ততোভ্র্রষ্ট হব না ?
তাঁদের অনেক যুক্তিরই প্রতিযুক্তি আছে, আছে তর্কের বিরুদ্ধে প্রতিতর্ক । কিন্তু সেটাই কি সব ? কোনো দৃষ্টিকোণই কী সর্বাংশে সঠিক ?
এ আলেখ্যে এইসব কথা প্রধান আলোচ্য নয় । দুইজন প্রাচীন জ্ঞানী মানুষের খানিক্ষণের আলাপের সূত্র ধরে এসব বললাম ।
রাস্তায় এসে জ্যোতিমশাই বললেন, অনেক দিনের একটা সাধ পূরণ হলো হে, তোমার কল্যাণে । আহা কী মানুষ ! আমার মত একজন অজ্ঞাত কুলশীলকে কতটা সময় দিলেন, অ্যাঁ ভাব দেখিনি একবার । একটি প্রকৃত মহীরূহ ! আর আমি ? ------- মনে মনে বললাম, বটে ? তাহলে আমাহেন অভাজনের গৃহ ধন্য করতে যাঁরা চলেছেন, তাঁদের তুলনায় আমি কী ?
গোটা একটা দিন জ্যোতিমশাইএর সঙ্গে কাটাব, এই চিন্তাটাই আগের কয়েকটা দিন আমাকে উত্তেজিত রেখেছিল । দাদাদের কাছে শুনেছি মুখে মুখে ছড়া তৈরি করাটা তাঁর কাছে ছিল যেন ভোজবাজি । আমার সদ্যাগ্রজ অভিজিৎ দশ এগারো বছর বয়স থেকেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । ওকে একটা ছড়া লিখে দিয়েছিলেন একেবারে চট্জলদি । অভিজিতো প্রতিদানে একটা লিখে নিয়ে দিয়েছিল তাঁর হাতে । সেটা আমি শুনিনি । তবে জ্যোতিমশাইয়ের ছড়াটি সেই কবে অভিজিৎ বলেছিল, আজও মনে আছে । ছড়াটির কিছুটা বলি -------
     রাজা মশাই রাগ করলেনছড়া, কবিতা, গান, নাটক, বিশেষ করে সেসব যদি শিশুদের কৃত বা শিশু উপভোগ্য হতো জ্যোতিমশাই সেসব ক্ষেত্রে একা একশো হয়ে পরিবেশনা, নির্দেশনা ইত্যাদি করতেন । নিজের কোনো সন্তান ছিল না । প্রথমে ভাইদের সন্তান হিসাবে মানুষ করেছেন, পরে তো তাবৎ শিশুদেরই নিজের করে নিয়েছেন । অভিজিতের মধ্যে ছড়া, কবিতা লেখার প্রবণতা দেখে, তার শৈশবের দিনগুলিতে প্রভূত উত্সাহ তিনি দিয়েছেন । একজন লেখকের প্রস্তুতিপর্বে এমন একজন প্রকৃত রসবেত্তা, পণ্ডিত তথা গুণী ব্যাক্তির পোষকতা পাওয়া ভাগ্যের কথা । আমার যদিও শৈশবে এই সৌভাগ্য ঘটেনি, তবে অভিজিতের মধ্য দিয়ে প্রথমে পরোক্ষে এবং প্রৌঢ়ত্বে এসে প্রত্যক্ষ ভাবে আমি যে তাঁর পোষকতা পেয়ে ধন্য হয়েছি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেকথা আজ স্মরণ করি ।
     সে কী রাগ !
     রাজামশাই তাগ্ করলেন
     সে কী তাগ !
     রাজামশাই বাঘ মারলেন
     সে কী বাঘ !
সেবার পণ্ডিতমশাই এর বাড়ি থেকে বেরি.য়ে বাসে করেই আসতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে । আমরা মফ:স্বল অঞ্চলে থাকি, ইচ্ছে করলেই গাড়িটাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি না । ভীষণ খারাপ লাগছিল । বললাম, রিক্সায় চলুন না । রিক্সায় আসতে গেলে চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিটের মত সময় লাগবে । ------- না, বাসেই ঠিক আছে হে । ওতেই তো অভ্যস্ত । ------- কিন্তু মাসিমার যে পায়ের অবস্থা খারাপ ? ওনার কষ্ট হবে । ------- মাসিমা বললেন, বসতে পারলে হবে না । ------- বাসে উঠে কোনো মতে মাসিমার একটা সীট পাওয়া গেল । জ্যোতিমশাই হাঁফ্ ছেড়ে বললেন, বাস্, আর সমস্যা নেই । মাসিমার কোনোরকম অসুবিধে না হয়, সেদিকে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল সবসময় । কিন্তু নিজেওতো ভীষণ দুর্বল এবং ক্ষীণজীবী ! এইসব কথাগুলো এমন কিছু বলার বা উল্লেখ করার বিষয় নয় । তবে করছি একারণে যে, একটু নামী দামি লোক হলেই, তাঁদের নাড়াচাড়া করতে বড় ঝঞ্ঝাট । খরচে খরচ, তার ওপর আবহাওয়ার তীক্ষণতার জন্যও যেন নিজেকে দায়ী মনে হয় । যেন এরকম একটা গরম বা শীত বা বৃষ্টিপাতের ব্যাপারটা আমার মাথায় রাখা উচিৎ ছিল । জ্যোতিমশাইয়ের ব্যাপারে এসব আদৌ ছিল না ।
বাস স্ট্যাণ্ড থেকেও রিক্সা নিতে দিলেন না । হেঁটেই চল । জায়গাটাতো দেখতে হবে, না কী । আমার বাড়িটা একটু বড় । একটু একটু করে প্রয়োজনের দিনে করা । তখন অনেকে একসঙ্গে । যে সময়টার কথা বলছি, তখন প্রায় সবাই নিজের নিজের আলাদা ব্যবস্থা করে দূরে দূরে । বাড়ির কাছাকাছি এসেই বললেন, এত প্রাসাদ হে । বড় সুন্দর তোমার বাড়ি এবং বাগান । ভালোই হলো, মাঝে মাঝে এসে হাঁফ ছাড়া যাবে । আসলে কাকুলিয়ার ঐ চৌখোপী ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে থাকতে প্রকৃতি-পরিবেশ বেমালুম বিস্মৃত হয়ে আছি । আমরা যারা ওপার থেকে এসেছি, তাদের জন্য ফ্ল্যাটবাড়ি কোনো বাড়িই নয় । ঘর থেকে এক পা বাইরে দিলেই সেটা পরের জায়গা । বাঙালমতে ওটা বাসা । বাড়ি নয় ।
চা জল খাবার সময় পেরিয়ে গিয়েছিল । তবু `চন্নগরের' সূয্যমোদকের জলভরা তালশাঁস একটা, আর গোটাদুয়েক মিত্যুঞ্জয়ের ভদ্রেশ্বরী লর্ড চম্চম্ খেয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান সুখাদ্যের গল্প । সে গল্প শুনলেও খিদে বাড়ে । পাবনা জিলার লোক । কিন্তু সেখানকার স্মৃতি বেশি দিনের নয় । এ জেলা ও জেলায়ই বাল্যকালটা কেটেছে । কবে নাকি তাঁর বাবা না কাকা ঢাকার ভাগ্যকুলের দোকান থেকে সন্দেশ এনেছিলেন । তেমনটি নাকি আর কখনো জিবে পড়েনি । ঢাকায় ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বেশ কয়েকটি মিষ্টান্নের দোকান পরে আমিও দেখেছি । সে মিষ্টির `তার' আলাদা একথা মানতে হবে এবং অপর একটি দ্রব্য, সেটি মিষ্টান্ন নয়, বাখরখানি । আহা ! সে যেন `বেহেস্তি বাসে' ভরপুর খাস্তা আহার, তবে দামে সস্তা নয় । দামে আর স্বাদে সেসব নাকি এখন আর জ্যোতিমশাইদের সেকালের তুল্য আদৌ নয় । একথা মশাইয়ের এবং দোকানিদেরও । তবে কিনা এই আফশোসটি মানুষের চিরন্তন, একাল সেকালের ভালত্বের তরতম নিয়ে দ্বন্দ্ব সর্বযুগের প্রাচীন নবীনে থাকবেই । তা কী মানুষ, কী বস্তু, সর্ববিষয়ে ।
বাড়িতে আসার আবেদনটি গ্রাহ্য হবার প্রাক্কালে জানতে চেয়েছিলাম, কী মাছ পছন্দ ?
------- প্রথম ইলিশ এবং শেষ পাতেও ।
------- রান্না বিষয়ে ?
------- বরিশাল রান্নার জন্য বিখ্যাত নয় । তবে ঐ `ইশে'র, মানে কচুর সুখ্যাতি ইদানিং দেখছি সবাই, মায় ঘটিরাও করে । তা, বৌমার হাত কেমন ?
------- শোলোকে কই, `মায় রান্দে য্যামন ত্যামন, বুইনে রান্দে পানি ।
ঐ আবাগীর হাতের রান্দন, যেন চিনির পান খানি ।'
------- ভাল বলেছ, বাগার্থ কৌতুকীতে ঠুসে দেবার কথা ভাবব । তবে বৌমাকে বল, আমি জাতে মাস্টার । রান্নাও পরীক্ষা বিশেষ । খেয়ে বলব কত নম্বর পেলেন । এ ব্যাপারে আমি কিন্তু প্রকৃতই কর্তিত-ওষ্ঠ ।
চার রকমের মাছ, ঢেঁকি-শাক-নারকোল কোর.ংআ সহযোগে, মানকচুর ডালনা, পাতলা মুসুর ডাল সঙ্গে অল্পমাত্রায় আমচূর ------- এইসব ভোজ্যবস্তু । বুড়োবুড়ি দুজনকে নিয়ে খেতে বসেই এক ধাক্কা খেলাম । মশাই মাছের বাটিগুলো থেকে পটাপট্ মাছগুলো তুলে, সব ধপাধপ মাসিমার থালায় ফেললেন । গিন্নি এবং আমি দুজনেই হতভম্ব । তাহলে কী রান্নার রঙ দেখেই তাঁর পিত্তি চটে গেল ? বললাম, কী হলো ? একটু মুখে দিয়েও পরখ করলেন না ? ততক্ষণে তিনি ডাল আর শাক দিয়ে খাওয়া শুরু করেছেন । চোখ বুজে চিবোচ্ছেন, কিন্তু দুজনেরই চোখেমুখে একটা চোরা হাসির আভাস । আমি শুরু করতে পারছি না । মাছগুলো তাহলে কোনোটাই খাবেন না ? ইলিশ তো ব্যবস্থা করেছি । জিজ্ঞেস করলাম আবার । বললেন, ও একটা ব্যাপার আছে, পরে বুঝবেক্ষণ । ডালটা বেশ নতুন রকম লাগছে । এজন্যেই বোধহয় বরিশালের লোকেরা বেশিরভাগ, সবশেষে ডাল খায় ।
ও হরি ! ব্যাপার তাহলে এই ! মশাই এর প্রেমিকাটি মানে স্ত্রী মানে মাসিমা ততক্ষণে সব মাছের কাঁটা বেছে, আলাদা আলাদা করে তার পাতে তুলে দিয়েছেন । চোখ বন্ধ অবস্থায়ই তিনি গপাগপ্ সেসব সাপটে চলেছেন অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় । ইলিশ শেষ হলে চোখ খুললেন, বললেন, একশোর মধ্যে একশো । কিন্তু কাচকলা সহযোগে ইলিশ খাওয়া এই প্রথম । বললাম, বরিশালি ওদন সংস্কৃতিতে একটি শোলক আছে, ইলিশ কাচকলা দিয়ে গিলিস ।
------- বৌমাকে বলো, এ নিয়ে থাকল না কোনো নালিশ । তবে অবশ্যই খাওয়ার পরে লাগবে দুটো বালিশ । বৌমার জয় হোক ।
------- কম্বিনেশন মিলিয়ে সওদা করার ক্রেডিটটা ?
------- ওটা মহতী সংসর্গের অভ্যাস । তা অবশ্যই সদভ্যাস বটে, তবে কোনোক্রমেই প্রতিভাজনিত সৃজনশীলতা তাকে বলব না ।
------- আপনি কী একারণেই সব ছেড়েছুড়ে পুস্তক সমালোচনার কর্মটি ধরেছেন ?
------- আহা চট্ছো কেন ? বাজার করাটারও সংসারে দাম আছে । প্রয়োজনতো আছেই । ------- হাত মুখ ধুয়ে, সোজা গিয়ে বসলেন ফোনটার কাছে । বললেন, একটা জরুরি ফোন করতে হবে । সংযোগ হলে, ফোনে বললেন, নীলুবাবু, মাছ চার রকম । এলে পারতেন ।
পণ্ডিত অনেক হয়ত আছেন । কিন্তু প্রকৃত নিরভিমান, রসে টুইটুম্বুর অথচ তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিত খুবই কম পাওয়া যায় । আমার ধারণা, রসশাস্ত্রে যতগুলো রসের বিবরণ আছে, তার সবকটির নির্যাস নিঙ্ড়ে রস শাস্ত্রকার জ্যোতিমশাইয়ের আজীবন লালিত ভাবটি বোধহয় তৈরি করেছিলেন এবং তারমধ্যে `শান্ত' রসটির প্রাধান্য ছিল । সেই শান্তরসটিকে মশাই স্থাপনা করেছিলেন আবার দুই ভাবের চাকার উপর, তা হলো সখ্য আর মধুর বা প্রণয়, যার ফলে তাঁর জীবনরথটি শত বন্ধুরতার মধ্যেও গড় গড় করে এগিয়ে চলেছে । এই ভাবটিকে কোনো রসান্বেষণকারীই বোধ হয় উপেক্ষা করতে পারে না । অবশ্য যাঁরা পাণ্ডিত্যকে রসব্যাতিরেকী গাম্ভীর্যে পাথর করে রাখেন, তাঁরা তাঁর এই সদাশান্ত রসাশ্রয়ী সখ্য ভাবটিকে হয়ত দীনতা বিবেচনা করে তাঁকে তাঁদের সমাজে ব্রাত্য রাখতে চান । এইসব কথা বলছি একারণে যে নাগরিক সারস্বত সমাজকে জ্যোতিমশাইয়ের জীবত্কালে বিশেষ মনোযোগী খুব কমই দেখেছি । তার মধ্যেও যাঁরা তাঁর যত্কিঞ্চিত গুণগ্রাহী ছিলেন, তাঁদের সংখ্যা এবং ক্ষমতার পরিধি বড়ই সংকীর্ণ । তথাপি সরকারি, বেসরকারি কিছু লোক তাঁর কথা দেরিতে ভাবলেও ভেবেছিলেন । নচেৎ চিরদু:খী, রোগজর্জর এই মানুষটি এবং তাঁর আজীবন দয়িতা ও পত্নীর শেষের দিনগুলি হয়ত আরও মর্মন্তুদ হতো । আমি এই রচনায় তাঁর অপরিসীম ক্লেশকর জীবনযাপনের, বিশেষত, মাসিমাকে নিয়ে তার প্রায় একক জীবনযুদ্ধের কথার বাস্তব উদাহরণ কিছুই দিলাম না । কারণ, যাঁরা এই রচনা পড়বেন, সেইসব দু:খস্মৃতি তাঁদেরও হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করেই চলেছে এই মুহুর্তে, এরকমই আমার বিশ্বাস । তাঁরা সেসব জানেন । যাঁরা ক্ষমতাশালি হওয়া সত্ত্বেও সেসব জানার প্রয়োজন বোধ করেননি, তাঁদের এখন আর জানার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই । মাসিমাকে প্রশংসা না করে উপায় নেই । তিনি বাস্তবিকই, আক্ষরিক অর্থে জ্যোতিমশাইয়ের দয়িতা । মশাইয়ের বড় দুশ্চিন্তা ছিল, যদি তিনি আগে যান, মাসিমার শুশ্রুষা কে করবে ? তাই আগেভাগে তিনি সরে গিয়ে মশাইকে নিশ্চিন্ত করাটা সংগত মনে করেছিলেন । সেটা করা দয়িতা হিসাবেই কর্তব্য হয় । শুধুমাত্র স্ত্রী হলে প্রথাগত ভাবে আগে তাঁকে রওনা করিয়ে পরে নিজে যেতেন । স্ত্রীরা এরকমই করেন কী না । আদর্শক্রমে স্ত্রী তো ছায়ামাত্র, অতএব পশ্চাদগামিনী ।
এই মানুষটির বিষয়ে এত ব্যাপক কথা বলার আছে যে তাতে একটা মোটা বই লেখা যায় । এতক্ষণের আগোছালো বক্বকানিতে তাঁর সামান্য পরিচয়টুকুও দেওয়া গেল না । আবার ভাবছি, লিখে লাভই বা কী ? তাঁর লেখাপত্তরই বা কজনে পড়েছেন বা পড়েন ? বাজারে তাঁর নিজস্ব লেখা কটাই বা বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ? এ এক অন্ধ স্বার্থপর সময় । সব কিছুরই পরিমাপ বা মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের নিয়মে, প্রোডাক্ট হিসাবে । জ্যোতিমশাইয়ের মধ্যে যতটুকু বাজারে বিক্রেয় বস্তু আছে, তা নিঙড়ে, যাদের ব্যবসা করার, তারা তা করেছে । তিনি অবশ্য সেসব নিয়ে ভ্রুক্ষেপমাত্র করেননি । স্বভাবটা যে বুনো রামনাথের তুল্য । ঘরে তণ্ডুল হয়ত এক আধমুঠো আছে । তিন্তিড়ী বৃক্ষটিও পত্রহীন নয় । পুঁথিপত্রও আছে । সুতরাং সংসারে কিছুই অপ্রতুল নাই । এই সব শতাব্দী প্রাচীনপ্রায় জ্ঞানতাপসেরা পৃথিবীকে বাস-অযোগ্য বিবেচনায় ত্রক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছেন । এরপর আমরা আরো বেশি করে ভোগের নৈবেদ্য সাজিয়ে শ্মশানকালীর তামস উত্সবে মত্ত হতে পারব ।
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)