তাই ব্যক্তি আমার নাড়া ঘাটা, যা কিছু করণকারণ, সবই এই অতীতকে নিয়ে । ঘটনার কেন্দ্রে নিজেকে রাখলে কাল শুধু একটাই থাকে, সেটা চরিত্রে পলাতকা । নচেৎ সময়কে ছোঁয়ার ক্ষণটা বর্তমানতায় কীভাবে সম্ভব ? কোনো কিছুকে যদি আমরা চিরস্থায়ী বা `সনাতন' আখ্যায় আখ্যায়িত করতে পারি তা এই অতীতই । যেটাকে স্মৃতি বলে আমরা সচরাচর বলে থাকি এবং নানা ভাবে তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করি । বর্তমানকে নিয়ে সেরকম করা যায় না । কখনো এমনই বোধহয় যে কাল একটাই, আর সেটা অতীত । বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বলে কালের অপর দুটো পর্বের আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই । কোনো কাহিনীর বিন্যাসে হোক, কিম্বা তত্ত্বালোচনা, সৃষ্টিশীল শিল্পকলা অথবা নন্দন তাত্ত্বিক প্রচেষ্টা, সব কিছুরই শেকড়ে স্মৃতি বা অতীতই প্রধান অবলম্বন হিসাবে থাকে । এটাই আমার এখনো পর্যন্ত সর্বশেষ অনুভব এবং উপলব্ধি ।
গোটা জীবনের দিকে এই বেলাশেষের ম্লান আলোয় যখন ফিরে তাকিয়ে দেখতে যাই, তার ফেলে আসা দিনগুলো অতি শৈশব কাল পর্যন্ত যেন একটা প্রব্রজিত পথের মতোই বোধ হয় । সে পথের শুরুটা অন্ধকারে ঢাকা । আবার সামনের দিকে সেটা যে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, তা তো আরো অন্ধকার । পিছনের ফেলে আসা পথটার অন্ধকার, নিজের স্মৃতির বাইরের যেটা, তাকে সম-চৈতন্যের প্রাক্ প্রব্রজকদের দলিলস্থ করা কথা, কাহিনী, কলা বা কার্যের আলোয় তবু যদি বা খানিক দেখা বোঝা যায়, ভবিষ্যের গোটাটাই চিরস্থায়ী অন্ধকারে আচ্ছন্নই থাকে এবং অনন্তকাল থাকবেও, এমন বলা যায় ।
আমার এই ছন্নছাড়া, প্রায় ভবঘুরের মতো যাপিত জীবনটার ছেঁড়া-কাটা কথাই এযাবৎ সবাইকে শুনিয়ে এসেছি । সেসব এমন কিছু মহার্ঘ বা আকর্ষক কাহিনী নয় । আমার মতো মানুষের অকিঞ্চিত্কর জীবনে আর কতটাই বা আকর্ষক বস্তু থাকতে পারে ? আজকের সমাজ সংসারে যে লক্ষশত উত্তেজক ঘটনা মানুষের জীবনকে ঘিরে নিত্য সংঘটিত হচ্ছে, তার তীব্রতা, বর্ণাঢ্যতা এবং সংগ্রাম মুখরতা সেখানে কোথায় ? তথাপি সেটাও তো জীবন, আমার যা বলার বা লেখার, তার উপকরণ তো সেখান থেকেই নিতে হবে । আমরা সবাই যে যার জীবনটা যেন একটা পথের মতোই হেঁটে পার হই । আপ্রাণ চেষ্টা করি সেই পথটা এবং তার অনুষঙ্গগুলোকে বুঝতে, তার অর্থ খুঁজি । কিন্তু অর্থ যেন সোনার হরিণ । তাকে ঐ পথের আঁকেবাঁকে খুঁজতে খুঁজতে বেলা বয়ে যায় । সোনার হরিণটা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই `কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে ।' কখনও মনে হয় সোনার হরিণটা আদপেই নেই । এটা যেন অদৃশ্য এবং ভীষণ স্বভাব-রগুড়ে কারুর একটা নির্মম কৌতুকের খেলা । তখন সবকিছু মায়ার খেলা বলে মনে হয়, আর পথিক আমরা, মুখ থুবড়ে পথের আনাচে কানাচে বা প্রান্তে পড়ে থাকি, অতীত গ্রাস করে নেয় বর্তমানকে । তার পর অতীতই গল্পের আকার নিয়ে প্রকাশ পেতে চায় ।
শিশুকাল থেকে ঘরে পরে সবার কাছে দুচ্ছাই, ছিছিক্কার শুনতে শুনতে, নিজের সম্পর্কে নিজেরও ধারণাটা সেরকমই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । আত্মবিশ্বাস বলে যে বস্তুটা মানুষকে পৌগণ্ড থেকে পৌরুষে উত্তীর্ণ করে একজন উত্তম জীবনযোদ্ধা হিসাবে তৈরি করে, প্রকৃতি সেখানে আমার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে কার্পণ্য করেছে । মোটামুটি রকম একজন জীবন পথিক হওয়ার জন্য জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতাগুলো ঠিকভাবে মন্থন করতে না পারায়, যে পথটা অতিক্রম করে এসেছি, তার অলিগলি, সুলুক-সন্ধানের বিষয় আশয় বড় ছন্নছাড়া এলোমেলো হয়ে গিয়েছে । ফলে সেসব নিয়ে এই অবেলা বা কালবেলায় যখন আখর কাটতে বসেছি, তখন কথা শুধু শৈশব, কৈশোর, পৌগণ্ড কালের পথের আশপাশেই চক্কর খাচ্ছে, তার বাইরের যে বিস্তৃত এবং অলিগলি বহুল পথটা, তার সম্পর্কে কিছু বলা যাচ্ছে না । কৈশোর, পৌগণ্ডের স্মৃতির মাধুর্য যৌবনের দাবদাহের সময়ের অস্থিরতার স্মৃতির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেনা । সে কারণেই বোধহয়, ঐ কালের আলেখ্য রচনা করতে উত্সাহী বোধ করিনি নিজেকে । কিন্তু তারও প্রকাশিত হবার দাবি আছে । তাকেও উপেক্ষা করা যায় না ।
এই আলেখ্যেও আমার প্রধান অপ্রধান সব কুশীলবেরা, আমার চারপাশের রক্তিয় আত্মীয় জন এবং তাবৎ পরিপার্শ্ব যারা দেশভাগে অথবা ভিন্নভাবে শিকড়চূযত লক্ষ লক্ষ আশ্রয়কামী মানুষদের সহ-যোদ্ধা । যে সময়কালটা ধরতে চাইছি, তার প্রেক্ষাপট গতশতকের মধ্যষাটের দাঙ্গা এবং ভারত-পাক যুদ্ধকালের পরবর্তী সময় থেকে আজকের বহমানতা পর্যন্ত একটা প্রায় অর্ধশতক কালের । স্বভাবতই এর ধরনটাও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার রাস্তা ধরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই উপস্থাপনা । এই সময়ের আমার পারিবারিক এবং ব্যক্তিক নির্মাণ আর ধ্বংসেরও আলেখ্য এটি । যে সময়কালটিকে এই আলেখ্যের শুরুয়াৎ বলে বলছি, কোথাও সেই সময়ের স্মৃতি-আলেখ্য অনেকটাই খাপছাড়াভাবে বলা হলেও, অনেক কিছুই আরো বলতে হবে এই রচনার স্বার্থে । এ কারণে কখনো কখনো হয়ত কিছু পুনরুল্লেখ দোষ ঘটাটা অসম্ভব নয় ।
মধ্যষাটে দ্বিতীয়বর্ষ স্নাতকশ্রেণীতে তখন একটা গয়ংগচ্ছ পড়াশোনার প্রচেষ্টা চলছিল । ছাত্রছাত্রী পড়ানোর ব্যাপকতা সাংসারিক প্রয়োজনে বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠেনি তখনো । সংসারে ব্যাপক জনসংখ্যা । সালটা ১৯৬৬-র মাঝামাঝি । দেশ থেকে মা-বাবা, ভাইবোনদের এদেশে আসা, ইতিপূর্বের চৌষট্টির দাঙ্গা, আর পাক-ভারত যুদ্ধের মূর্খামির অভিঘাত জনিত রকমারি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবশ্যম্ভাবি ফলাফল তখন তুঙ্গে । এরকম একটা সময় একদিন দাদা অর্থাৎ আমাদের সহোদর জ্যেষ্ঠ, খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপণ দেখে আমার বয়ানে একটি আবেদন পত্র লিখে আমায় দিয়ে বলল, সই করে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দে । বিজ্ঞাপণটি একটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের কেরানি সংগ্রহ সংক্রান্ত । দাদা দরখাস্তটি দিল বটে, কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগল । যেন পারলে সে আমার কাছে ক্ষমা চায় । অন্যত্র বলেছি, আমার এই দাদার আকাঙ্খা ছিল আমাকে ভাল কলেজে পড়িয়ে, বেশ উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলে । আমার মেধা, মননের উপর তার একটা অন্ধ বিশ্বাস ছিল । নিজে সুস্থ মতো পড়াশোনা করতে পারেনি, যদিও সে ছাত্র হিসাবে প্রথম শ্রেণীরই ছিল । এখন স্নাতক পর্যায়টা শেষ করার আগেই `কেরানি' গিরির জন্য দরখাস্ত করাটা যেন কোনোভাবেই সে বরদাস্ত করতে পারছিল না । তাই খানিক বাদে সেটা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দলামোচা করে বাইরে ফেলে দিয়ে বলল, না থাক, দেখি আরও কিছুদিন । সঠিক মনে নেই, সম্ভবত ঐ সময়টারই - একটু আগে পিছে পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা, ফলে তীব্র খাদ্য আন্দোলন চলছে । সংসারে দুজন লোক চাকুরে এবং আমিও যত্সামান্য রোজগার করিনা তা নয় । কিন্তু তত্সত্ত্বেও চালানো বড় কষ্ট । তবু দাদার আকাঙ্খা তাকে নিবৃত্ত করল ।
মা, বাবা ভীষণভাবে সংকোচে ম্রিয়মাণ । বুঝতে পারি তাঁরা একটা অপরাধ প্রবণতায় ভুগছেন । যাদের প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য কিছুই করেননি বা করতে পারেননি, শেষ বয়সে তাদের ঘাড়েই চাপতে হয়েছে, এরকম একটা মানসিক ক্লেশ তাঁদের পীড়িত করছে । সংসারে মাঝেমাঝেই কেউ কেউ সামান্য কারণে মেজাজ খারাপ করে ফেলছি । অনেক অনভিপ্রেত, কঠিন কথা হঠাৎ করে কারুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অন্যদের করছে আহত আর যার মুখ থেকে বেরোচ্ছে তাকে লজ্জিত এবং অনুতপ্ত । এসবের ব্যাপক খুঁটিনাটি লেখার মতো নয় । অভাব মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু বলায়, করায়ও, এসবই আমি দেখি । সবার বেদনার, অসহায়তার শরিক আমি হতে চাই, পারিও । কারণ, তাদের সবাইকেই তো আমি ভালবাসি । ছোট ভাইবোনেরা সবসময়ই যেন অপরাধী ভাব নিয়ে থাকে । এ সময়টায় আমার আচরণও কেমন অন্যরকম হচ্ছিল । মনে তীব্র ক্ষোভ আর অসন্তোষ । ঠিক কার বিরুদ্ধে, তা পরিষ্কার নয় । দেশে থাকতে ভাই বোন গুলোর সঙ্গে যেমন মিশতাম, তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য চেষ্টা করতাম । এই সময়টায় আমার সেরকম উত্সাহ উদ্দীপনাও যেন আর ছিল না । দেশে অত অভাবের মধ্যেও, এদের প্রতি আমার যতটা ভালবাসার টান, কর্তব্যনিষ্ঠা বা মেলামেশার সহজতা ছিল, এখানে যেন তাতে ভাঁটা পড়ছিল ত্রক্রমশ । এর একটা কারণ বোধহয় এই যে বাইরের জগত্টা, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছিল । দলীয় রাজনীতির শূন্যগর্ভ আবর্তের মধ্যে নিজস্ব ক্ষোভ প্রকাশের একটা নিস্ফল উত্তেজনা আমাকে যেন পারিবারিক অভ্যস্ত বেষ্টনির বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল । অথচ সেটাতো আমার স্ব-ভাবজ ব্যাপার ছিল না । ফলে মানসিক স্থৈর্য যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল । একএক সময় যখন নিরালায় একাকী বসে বসে দেশের বাড়ির কথা, তার মাঠ, ঘাট, জঙ্গল, খালবিলের স্মৃতিচারণা করতাম । ইচ্ছে হতো একছুটে সেখানে চলে যাই । মনে পড়ত সেখানকার শান্ত দিনগুলোর কথা, বন্ধুদের কথা, ইসকুল, কলেজ আরো কত স্মৃতি । জীবনে এই প্রথম আমি হৃদয়ের সংকোচন অনুভব করেছিলাম, যদিও তা সাময়িক এবং তার প্রকৃত কার্যকারণ উপলব্ধি করতে পেরে সবলে হৃদয়কে তার নির্ধারিত বৃত্তে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলাম । কিন্তু আজ দেখি, সেই হৃদয়বৃত্তির আধিকারিক আমি আজ আর নেই । হৃদয়ের পথ ধরে যেসব মানুষ চলতে চায়, তাদের কাছে এর চাইতে বড় পরাজয় এবং দু:খের বিষয় আর কীই বা হতে পারে ? আমি যেন আমার অভ্যস্ত স্বভাবটা হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছিলাম ।
দাদা দরখাস্তটা গুলি পাকিয়ে ফেলে দিয়েছিল । তার সেই সময়টার মুখের অবস্থাটা দেখে আমি আড়ালে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিলাম । মানুষটির কষ্টের স্থানটা, ক্ষতটা আমি যেন পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম । পরে দাদা আপিসে চলে গেলে ঐ দরখাস্তটা তুলে এনে একটা কপি করে ব্যাঙ্কের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম । তখনও আমার স্নাতক ফার্স্ট পার্ট পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি । দরখাস্তটা পাঠাবার ব্যাপারে দাদার মনোকষ্ট হলেও, আমি কোনোরকম ক্লেশ বোধ করিনি । কারণ, নিজের সম্পর্কে আদৌ কোনো উচ্চধারণা, বিশেষত, পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারে, কোনোকালেই আমার ছিল না । উচ্চশিক্ষা, কেরিয়ার, ভবিষ্যতে বেশ বড়সড়ো চাকরি, অনেক টাকা রোজগার, এইসব ব্যাপারে আমার কোনোরকম ধারণা বা আকাঙ্খাই কোনোদিন গড়ে ওঠেনি । সব সময়ই ছোট মাপের জীবন দেখে অভ্যস্ত দীনভাবাপন্ন মানুষ আমি, বড় কিছু ভাবতেই পারতাম না । ভাবতাম, কোনোরকম একটা কেরানিগিরি বা অনুরূপ রোজগারের কিছু ব্যবস্থা হলে সংসারের এদেরকে নিয়ে সাদামাটা জীবন চললেই হলো । বড় কিছুর জন্য আকাঙ্খা বা স্বপ্নদেখা, এসব আমার যেমন অভ্যাসে ছিল না, তেমনই এ নিয়ে কখনো কোনো অভাব বোধ করিনি, ভাবিই নি ছাই ।
দরখাস্তটা করে দাদাকে কিছু বলিনি । বলার সাহসও ছিল না । আবার এও ভাবছিলাম, দরখাস্ত করলেই যে ডাক পাব তার কী স্থিরতা আছে । দেশজুড়ে বেকারের সংখ্যার তো শেষ নেই । যাদের সমাজে মিশি তারা সবাই তো আমাদের মতোই হা-ঘরের । দরখাস্তের পর দরখাস্ত করে তারা হন্যে হয়ে গেল, আর আমি একটা দরখাস্ত ঠুকেই ডাক পাব, বা চাকরিতে বহাল হয়ে যাব, তার কী নিশ্চয়তা আছে ?
কলেজে যাই । যতটা না পড়াশোনা হয়, আড্ডা, গান, বাজনা, ছাত্র রাজনীতির নামে শব্দ-ডম্বর হয় তার তুলনায় ঢের বেশি উচ্চনাদে । ক্লাসের নিয়মমাফিক পড়াশোনার ব্যাপারে উত্সাহে ভাটা একেবারেই মরা কোটালের ভাটা, উদ্দীপনার স্রোত একেবারে হড়হড় করে নেমে যাচ্ছে । কারণ চাকুরির ভাবনা মাথায় ঢুকেছে । ভাবছি, এই দরখাস্তে যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, একাডেমিক পড়াশোনার পোঁদে কষে এক লাথি ঝাড়ব । শালা হারামি আমাকে বেহদ্ জ্বালিয়েছে জিন্দিগীভর । ও পথে আর না । তবে গ্র্যাজুয়েশনটা পুরো করতে হবে । নাহলে দুটো সমস্যা । এক, বন্ধুমহলে, তারা হাতের জল শুদ্ধ মানবে না, দুই চাক্রিতে স্কেলটা পাব না । দুটোই হরগিজ লোকসানের ব্যাপার । একটা আঁতলামো না করতে পারার, অন্যটা সামান্য কারণে পয়সার পারমান্যান্ট ঘাটতির । ওটা করা জরুরি । অবশ্য আগে ডাকতো পাই । ওখানে তো আবার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য লিখিত, মৌখিক দুরকম আয়োজন । দেখা যাক্ । এসব ব্যাপারে তো আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা বা সাধারণ জ্ঞানও অষ্টরম্ভা । এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে, কিন্তু তা মননে জারিত হচ্ছে না ঠিকমতো । এগুলো সব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনামাত্র । সারবস্তু বলতে যা, তা হলো এর লড়াইয়ের অংশটুকু । গোটা ব্যাপার মননে আনার ফুরসত্টুকুও পাই না ।
ব্যাঙ্কের দরখাস্তটার উত্তর এসেছিল তাড়াতাড়িই । একটা লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে । পাশ করলে ইন্টারভিউ । দাদাকে চিঠিটা দেখাতে দেখাতে, বলল, তাহলে ওটা পাঠিয়েছিলি ? আমি ভেবেছিলাম বকুনি খাব । বকেনি কিন্তু চোখমুখের অসহায়তাটা, কষ্টটা আগের দিনের তুলনায় বেশিই কষ্টদায়ক ছিল যেন । অল্প কথার মানুষ । বলল, কী আর করবি, অনেকেই তো দিনে চাকরি ক'রে নাইট কলেজে পড়াশোনা করে । তাই করবি । - বলল বটে, কিন্তু মনোকষ্টটা দূর হলো বলে বোধ হলো না । এই মনোভাবটাকে তখনকার দিনে আমরা পাতিবুর্জোয়া মানসিকতা বলে অভিহিত করতাম বটে, তবে তার এই মানসিক কষ্টটাকে আমি মনে প্রাণে শ্রদ্ধা করি আজও । তখন বামপন্থী আন্দোলনের প্রায় অগ্নিযুগ । মার্কসবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টি, সব বামপন্থীদের নিয়ে একটা যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । আমরা উঠ্তি ছোক্রারা এবং কিছু পোড়খাওয়া বয়স্করা তখন ভীষণভাবে আগুনখেকো । কথায় কথায় তখন আমরা অভিভাবকদের `পেতি বা পাতি' বলতাম । দু একখানা বস্তুবাদি দর্শনের চটি বই, বুঝে না বুঝে পড়ে, ভাবতাম দ্বান্দিক বস্তুবাদ গুলে খেয়েছি । প্রতিটি কথায় বিতর্ক । প্রতিপক্ষের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশকেই চূড়ান্ত বিপ্লবীয়ানা ভাবতাম । এই সময়টায়, মনে আছে, অনেক শ্রদ্ধেয় এবং যথার্থ পণ্ডিত জনেদের শুধু বুক্নি আর গলার জোরে অপদস্থ করতাম । আজ ব্যাপারগুলোকে খুবই হাস্যকর এবং নিষ্ঠুর বলে মনে হয় । মানুষের মধ্যের স্বাভাবিক স্নেহ ভালবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি, পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে বুর্জোয়া বা পেতি-বুর্জোয়া ভ্যালুজ বলে তুচ্ছ করার প্রবণতাটা এই দিনগুলোতে যেন আমাদের অবশ্য কর্তব্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । আমি যদিও স্বভাবগতভাবে এই আচরণটা মানতে পারতাম না এবং এজন্য ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেতাম, তথাপি দলীয় লোকদের কাছে বাহাদুরি পাওয়ার লোভে প্রকাশ্যে অকপটে ভেতরের এই দ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করতাম না । পরে বুঝেছি, এর মধ্যে পুরোটাই ছিল একটা নৈরাজ্য-সূচক মানসিকতা যার সঙ্গে বিপ্লবী চিন্তা চেতনা বা কর্মকাণ্ডের আদৌ কোনো যোগ ছিল না । কিন্তু এসব ব্যাপার যথাসময়ে বলব । শুধু দাদার সেই সময়ের মানসিকতাটাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি বলে, খানিকটা বললাম । দাদা বড়ো দু:খী মানুষ ছিল তখন । সেটা বুঝতাম, কিন্তু ঐ পর্যন্তই ।
নির্ধারিত দিনে দাদা সাথে করে ডালহৌসি পাড়ায় ব্যাঙ্কের অফিসটিতে পৌঁছে দিল । তখনও ঐ এলাকাটা ডালহৌসি স্কোয়ার নামেই পরিচিত । বি. বা. দি বাগ নামটা এর বছর দুয়েক পরেই সম্ভবত দেওয়া হয়েছিল । ঐ দিনই প্রথম আমি কোলকাতার আপিস পাড়ায় যাই । মনে আছে, শিয়ালদা স্টেশানে নেমে, বৌবাজার স্ট্রীট ধরে দাদার সাথে ব্যাঙ্কের আপিস পর্যন্ত গিয়েছিলাম । দাদা রাস্তাটা ভাল করে চিনিয়ে দিয়েছিল । পরে অবশ্য চৌদ্দ নম্বর ট্রামে কোথ্থেকে উঠতে হবে এবং কোথায় নেমে, কীভাবে আপিসের দোরগোড়ায় পৌঁছোনো যাবে, তাও হাতেকলমে শিখিয়ে দিয়েছিল । প্রথমদিনেই একটা জিনিস বুঝেছিলাম যে আমি আদ্যন্ত একটা ভীতুর ডিম । ভেতরে সামান্যতম সাহসও নেই, তা মুখে যতই বাত্তেল্লা মারিনা কেন । বাত্তেল্লাবাজি ভীরুদের স্বভাব ।
দাদা আপিসের পরীক্ষার জায়গাটা চিনিয়ে দিয়ে বলে গেল যে, পরীক্ষা শেষে আমি যেন আপিস ছেড়ে না বেরোই । সে তার আপিসের ছুটির পর এসে আমাকে নিয়ে যাবে । কারণ ঐ এলাকার কোনো কিছুই আমার তখন চেনাজানা ছিলনা, আর রাস্তাঘাটে চলাচলও ঠিকভাবে রপ্ত হয়নি ততদিনেও । এতসব খুঁটিনাটি একারণে বলছি যে, আমার ঢেঁড়সত্বের জন্য তার কী হ্যাপাটাই না পোহাতে হয়েছে ।
পরীক্ষায় তেমন কিছু শক্ত প্রশ্নট্রশ্ন ছিল না । বেয়াড়া গোছের বড় কিছু যোগ, গুণ, ভাগের অঙ্ক ছিল, যা একমাত্র পাঁঠা ছাড়া সবাই পারে । কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন আর ইংরেজিতে এক আধটা প্যাসেজ জাতীয় রচনা । সবটা এইট্থ্ কী নাইনথ্ স্ট্যাণ্ডারডের উপযুক্ত । ঐ বছরটায় নাকি প্রথম কম্পিটিটিভ টেস্ট এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কে ব্যাপক কেরানি সংগ্রহের শুরু । পরে জেনেছি যে আগে লোক নেওয়া হতো, আপিসের বড় সাহেবদের মেজাজমর্জি মতো । তাঁরা কোনো কর্মীর উপর কোনো কারণে খুশি হলে, বলতেন আজ ছুটির পরে দেখা করে যাস্ তো । যাদের বলা হতো, তাঁরা বুঝতেন, সাহেব তাঁদের কিছু মেহেরবানি করবেন । সুতরাং ছুটির পর হাত কচ্লাতে কচ্লাতে সাহেবের চেম্বারে হাজিরা । সাহেব তখন দিনের শেষে, কড়া মেজাজে, খয়ের খাঁ, বা চামচাদের ঘাবড়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করতেন, তোরা কী ভেবেছিস্ বলতো ? - সবাই জানতো সাহেবের এটা বাহ্য রূপ । আসলে শেষ প্রশ্নে গিয়ে দেখা যাবে, ব্যাঙ্কে কিছু লোক নেওয়া হবে । কার কার ভাই, ছেলে, শালা বা ভাগ্নের জন্য সাহেব করুণাবতার হবেন এ তারই প্রস্তুতি মাত্র । অবশ্য তার জন্য উপকৃতদের কিছু যথা কর্তব্য করতে হবে ।
একটি ঘটনার কথা পরে এক সিনিয়রের মুখে শুনেছিলাম । সে বড়ো মজাদার কাণ্ড । সেদিন, তখনকার একজন আপিস-সুপ্র্রীমো কাউকে ডাকেন নি । দুর্গাচরণ পোদ বলে জনৈক পুরোনো কর্মচারি ছুটির পর সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিতে চেম্বারে ঢোকার অনুমতি চাইলে, সাহেব বললেন, ভেতরে আয়, আর দরজার ছিট্কিনিটা লাগা । দুর্গার তথাকরণ । সাহেব গভীর চিন্তামগ্ন । দুর্গাকে বসতে বলে ধন্য করে, সেই আদিম অকৃত্রিম প্রশ্নটাই করলেন তিনি । কিন্তু এদিন তাঁর গলায় এক গভীর সংকটের সুর যেন । বললেন, তোরা কী আমাকে শান্তিতে মরতেও দিবি না ? কী ভেবেছিস তোরা ? বলতে পারিস সেখানে তাঁকে আমি কী জবাব দেব, যখন দেখা হবে ?
- `আজ্ঞে, কাকে ? কার সঙ্গে দেখা হবার কথা বলছেন, ঠিক বুঝলাম না তো ।
- তা বুঝবে কেন ? বুঝলে যে আমার চিন্তা একটু লাঘব হয় । বলি, আমার রিটায়ার দিনটা তো এসে গেল । এর পরই তো ওপারে যাবার পালা । সেখানে তোর বাবাকে কী জবাব দেব ? তিনি তো হিসাব চাইবেন, নাকি ?
দুগ্গা পোদ সাহেবের কথা ঠিক্ঠাক্ বুঝতে পারলেন না । এত কথা তিনি সাধারণত বলেন না । সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, কাল থেকে সেই হতভাগাটাকে সাথে নিয়ে আসবি । দশটা পাঁচটা পাসবুক এন্ট্রি করবে । - ব্যাস, ছোটভাই, বা বড়ছেলে, যে-ই হোক, তার গতি হয়ে গেল । চৌধুরি সাহেব দেবতুল্য মানুষ, ডেকে ডেকে গাঁয়ের তাবৎ ছেলেছোকরাদের চাকরি করে দিতেন । তার মধ্যে এন্তের পাঁঠা গাধাও থাকত না যে এমন নয় । চাকরি তখন তেমন সাঁসালো ছিল না । মাইনে সামান্য । তবে হ্যাঁ, বকশিস, ওভার টাইম এইসব দেদার ছিল । করিত্কম্মারা করে খেতে পারত । সে একরকম ছিল । এবার সাহেবের মেজাজ কীরকম যেন ন্যাত্প্যাতে ভেজা তুলোর মতো মনে হল । সাহেব কী সত্যি সত্যি মরার কথা ভাবছেন ? দুগ্গা পোদ বললেন কী যে বলেন স্যার, আপনার অবসরের তো এখনও দুবছর বাকি । আর শরীর স্বাস্থ্যও তো বেশ ভালো আপনার । তা ওসব ভাবছেন কেন ? আমিও তো, ধরুন না কেন, আরো বছর পাঁচেক চাগরি কোরবো । - দুগ্গা কর্ডলাইনের লোক, হুগলির শেষ প্রান্তের । চাকরিকে কে `চাগ্রি', কেট্লি কে `কেড্লি', দাঁড়িয়ে কে `ডেঁইড়ে', সকালকে `সকালা' বলেন । বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলেন বড়ছেলের সম্বন্ধীটাকে যদি ঢোকানো যায় । সেটা বে'থা করেছে অথচ একটা পয়সা রোজগার নেই । ব্যাইমশায় বলছিলেন । কিন্তু এদানি আপিসে লোকজন নেওয়া প্রায় বন্ধ । সরকার ভাবছে, এখন থেকে নতুন নিয়মে লোক নেওয়া হবে । ধরে এনে পুঁতে দিলে হবে না । বেশ যাচাই করে নিতে হবে ।
সাহেবও সেসব কথা তুললেন দাঁড়ি বললেন, ওসব দিন আর ফিরবে না । তাও যতক্ষণ নতুন নিয়ম চালু না হচ্ছে, দু-পাঁচটা না ঢুকিয়ে কী ছাড়বো ? এইসব কথাবার্তায় বড়ছেলের সম্বন্ধির চাক্রির ব্যবস্থা হয়ে গেল । দুগ্গা জানতে চাইলেন, তা এবার কোথায় যাবেন ? কদিনের প্রোগ্রাম ?
- ভাবছি । তুই বলনা । জিনিস কেমন ?
- খাসা । আসবাবপত্তর ভাল । তাছাড়া -
- তাছাড়া ?
- ডিম পাড়েনি এখনও ।
- বয়স ?
- কুড়ি একুশ হবে । বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে ।
- তা বেশ । বাঁজা নাকি ?
- এখনই বলা যাচ্ছেনে । হতেও পারে । এইতো কালই বিকালা এয়েছেলো, গড়ন লগ্ত বেশ ।
- ছেলেটা, মানে তোর ছেলের সম্বন্ধিটা ঝঞ্ঝাট করবে নাতো ?
- না । বাপ বনেদি রসিক মানুষ, এখনও মাসে অন্তত দুবার শ্যাওড়াফুলিতে আসা যাওয়া । ছেলে কী আর নিজের আখের বুঝবে না ? মোটামুটি বলা কওয়াতো থাকবেই । ও আপনি ভাববেন না । - এসব গল্পকথা আমার পরে শোনা ।
তখনকার চাকরি পাওয়ার দস্তুর ছিল এরকম । এবার থেকে চালু হলো পরীক্ষা, ইন্টারভিউ । সুতরাং, ইন্টারভিউ পেয়ে গেলাম । সে ব্যাপারটাও একটু বিশদ বলতে হবে । কিন্তু তার আগে দুটো পাশকথা কই । পরীক্ষা ব্যাপারটার জন্য আমার কোনোকালেই মানসিক ভীতি তেমন ছিল না । কিন্তু স্কুল, কলেজে, ক্লাসে কোনো প্রশ্নের উত্তরে মুখে কিছু বলতে হলে, আমার সর্বশরীর এবং সর্বেন্দ্রিয় আদৌ বশে থাকত না । আজও কোনো অনুষ্ঠানে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেলে, নিজেকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ বা পাঁঠা বলে মনে হয়, মানে বলির পাঁঠা আর কী ? প্রথম যে মানসিক অবস্থাটা হয়, তা হলো আমি যা বলবো, তাতো সবাই জানে, তা আর বলার কী আছে ? তারপর ক্লাসে বা সভায় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সমস্যা, হাত দুটো রাখার সমস্যা, বক্তব্য আরম্ভ করার বা গুছিয়ে নেবার সমস্যা ইত্যাদি হাজার সমস্যা এসে চেপে ধরে যেন । সুতরাং ইন্টারভিউর আহ্বান পেয়ে তো আমার হয়ে গেল । ওরে ভয়রে ভয় ! শুনেছি বাঘা বাঘা সাহেব সুবোরা নাকী শক্ত শক্ত ইংরেজিতে, ততোধিক শক্ত শক্ত প্রশ্নের গুলি ছোঁড়েন তখন । অভিজ্ঞতা নেই । দাদা আর সেজদা দুজনে বছর কয়েক আগে চাকরি পেয়েছে ইন্টারভিউ দিয়ে । তারা আমার অবস্থা দেখে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে । দাদা রীতিমতো তালিম দিয়ে, পালিশ ক'রে ভাইকে তোয়ের করার চেষ্টা করছে । কিন্তু আমার গাঁইয়া `আভোদা' ভাব কিছুতেই কাটছে না । আভোদা অর্থে নির্বোধ । যতই ভাবি নার্ভাস হব না, তোত্লাবো না, তাতেই যেন গলা শুকিয়ে আসে, মেরুদণ্ডের নিম্নাগ্রে একটা কেমন কেমন ভাব, বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কার সীম্সীমানি । সে এক নান্দিভাস্যি ব্যাপার । দিনটা যত এগোয়, এসব ততই বাড়ে ।
দুএকজন কদাচিৎ বন্ধু, যারা এই ভবনদী ইতিপূর্বে সাঁতরাবার চেষ্টা ক'রে বেশ খানিকটা জল খেয়ে এখনো লেগেপড়ে আছে, তাদের অভিজ্ঞতা ততোধিক ভীতি, কম্পন, স্বেদ, বাহ্যপাওয়া ইত্যাদি সমস্যা বাড়াচ্ছে । সবচেয়ে বড় ভীতি হচ্ছে যে ইন্টারভিউর মাতৃভাষা ইংরাজি । আমি যদিও বা তখন মোটামুটি ভাল ফল করে, স্নাতকক্লাসে প্রায় সেরা ছাত্তরের লোকশ্রুতি নিয়ে স-সম্মানে, অর্থাৎ with Hons, ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষ, তথাপি দুটো কথা ঐ ভাষাতে বলতে গেলে, মনে মনে, বার কয়েক তর্জমা না করে বলতে পারি না । তর্জমা করে মনোভাব প্রকাশ করতে গেলে, তোত্লানো ঠেকায় কার বাপের সাধ্য ? তাছাড়া প্রতিপক্ষ যদি অবাঙালি হয়, তাহলে আমার কথার গতিবেগ ঘন্টায় আধা কিলোমিটার তো তাঁদের নিদেন দশ K. M. P. H | একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না দিতে নাকি উল্টোদিকের প্রশ্নকর্তারা একযোগে গাঁক্ গাঁক্ করে । তাঁদের সদস্য সংখ্যার দ্বিগুণ প্রশ্ন ছোঁড়েন এক সাথে । খোদায় মালুম, তাহলে উত্তরটা শোনেন কখন, বা শোনেন কীনা ।
খাস্ কথা জানালো ক্লাসের এক বান্ধবী । তার মাতৃভাষা ছিল চাঁট্গাঁইয়া প্রথম ভাষা মানে ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরাজি এবং দ্বিতীয় ভাষা বার্মিজ । `সেটা' নিজেরা নিজেরা বলে মাতৃভাষার সঙ্গে পাঞ্চ করে । ঐ সময়টায় সে এবং আমি পরস্পরের প্রতি ভীষণভাবে প্রণয়াবদ্ধ, যদিও তা টেঁকেনি । কিন্তু সে কথা এখন আর বলে লাভ নেই । যাহোক্ সে বলল, যখন সবাই প্রশ্ন করতে থাকবে, তুমি চেষ্টা করবে
যাহোক, এবার আসল কাহিনীটা বলি । ইন্টারভিউর দিনও যথারীতি দাদা পায়ে পাখি পড়া করাতে করাতে আপিসের দরজায় পৌঁছে দিয়ে, নিজের আপিসে চলে গেল । সেখানে জনা চল্লিশেকের মতো বলির পাঁঠা একই উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করেছিল । দাদা সবাইকে দেখিয়ে সর্বশেষ অভয় জানিয়ে বলল, এইতো এরাও আছে । ভয়ের কিছু নেই । ঠিক পারবি । সেখানে যারা ছিল, তারা বেশির ভাগই কোলকাতার বনেদি
তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেশ একটু সাহস হলো, মানে ঐ ডোন্টো-কেয়ারি ভাবটা ভেতরে এসে গেল । ভাবলাম, দাদাতো আর বলেনি যে চাকরিটা তোকে পেতেই হবে । তাছাড়া এরা সবাই তো বলছে যে, এর আগে তারা অনেক ইন্টারভিউ, পরীক্ষা এসব দিয়েছে । একবারেই হয় নাকী ? জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাবার একটা কথা আছে না ?
এক একজন ঘর থেকে বেরুচ্ছে, আর সবাই তাকে ছেঁকে ধরছি । প্রশ্নের ধরন, গতি কীরকম । তার কেমন হলো, এইসব জিজ্ঞেস করছি । যথারীতি চূড়ান্ত হেজিয়ে আমার ডাক এল । দরজা ঠেলে,
:
:
:
কর্তারা সব পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলেন । অবশ্য আমি যে ঠিক এই ভাষাতেই কথাগুলো বলেছিলাম এমন নাও হতে পারে । তবে সেইদিনকার, ঐ সময়ের আমার মেজাজ এবং
-
:
:
:
:
:
:
:
:
:
:
এরকম আরও রকমারি এবং মজাদার প্রশ্নোত্তর চলেছিল । আবার বলছি এইসব কথা ঠিক আক্ষরিক ভাবেই হয়েছিল এমন দাবি নেই । তবে ঐ সময়টাতে আমি যে কোনো কারণেই হোক্না কেন, ভয়, নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠে একটা আত্মতুষ্টি-কর বাগ্যুদ্ধে জিতে গিয়েছিলাম । প্রায় আধঘন্টা ধরে ইন্টারভিউটা চলছিল । ১৯৬৬ সালের কোনো একটা সময়ের কথা এসব । সবকিছু ঠিকঠাক মনে নেই । তবে একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে, এস. আর. দত্তগুপ্ত নামক একজন ভদ্রলোক হঠাৎ কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর শুনে রগড় করে তাঁর মাতৃভাষায় বলে উঠেছিলেন, আপনার চাকরি হইবো না । ভদ্রলোক কুমিল্লা-সম্ভূত বাঙাল ছিলেন । সবাই জানেন, ব্যাঙ্কশিল্পে কুমিল্লাবাসী, বিশেষ করে `দত্তগুপ্ত'রা এককালে খুব দড়ো ছিলেন । এই দত্তগুপ্ত মশাই, একদা নামজাদা ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন । তাঁর চরিত্রে প্লেয়ার সুলভ স্পিরিটের কথা ঐ ব্যাঙ্কের তাবৎ কর্মীরাই সেযুগে জানত । চাকরিটা আমার হয়েছিল এবং আমার ধারণা, সে ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী অবশ্যই ছিলেন । ভদ্রলোক আমাকে অন্ধের মতো ভালবাসতেন । কিন্তু ঐ সময়টায় আমি তাঁকে ভীষণ জ্বালাতন করেছি ।
গতশতকের গোটা মধ্য ষাটের এবং প্রথম সত্তরের সময়কালটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত উপমহাদেশ নয়, তামাম বিশ্বেরই একটা অস্থির এবং বাত্যাবহ সময় । এদেশে এর
পশ্চাদ্ভূমিটা তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতা, দেশভাগের নানান কাণ্ডকারখানা অনুসরণ করে । সংক্ষেপে কয়েকটা মোটা দাগের ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে । যেহেতু এর সবটাই সাম্প্রতিক ইতিহাসের ঘটনা, তাই সবারই বোধহয় সেসব জানা । বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নেই । শুধু পরপর কয়েকটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট । স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পন্থা এবং তার সূত্র ধরে বিভিন্ন মতবাদী দলের উত্পত্তি, দলগুলির বাম এবং দক্ষিণ মতাদর্শের জন্য পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও হিংসা, নেতাদের অতিকথন অভ্যাস এবং ফলত অবাধ মিথ্যাচার, সাম্প্রদায়িক কারণে ব্যাপক উদ্বাস্তু সমস্যা, সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ব্যর্থতা, পাক-ভারত সম্পর্কের বিষাক্ত বাতাবরণ, ষাটের দশকের শুরু থেকে কম্যুনিস্ট পার্টির অর্ন্তবিরোধ, চীনভারত সংঘর্ষ, পার্টিভাগ, পাক-ভারত যুদ্ধ, খাদ্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং তার পতন, নকশালবাড়ি আন্দোলন তথা পুনরায় পার্টিভাগ ইত্যাকার তাবৎ বিষয়গুলিই পরস্পর পরস্পরের কারণ ও ফল এবং ঐ সময়কালের অস্থিরতা ও বিভিন্নধরনের যুবাবিদ্রোহের হেতু ।
আমি ঐ সময়কালের যুবক, সুতরাং, এসবের প্রভাব আমার উপর পড়বে না, তা অস্বাভাবিক । এই প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছিল তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ বা পাকিস্তান থেকে আগত যুবদের উপরেই । কারণ, তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ বাপ, জেঠা, কাকারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী এবং ততদিনে বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত । তাঁদের সন্তানেরা, পশ্চিমবঙ্গীয় এবং দেশভাগে কিছুমাত্র স্পর্শিত না হওয়া, প্রতিষ্ঠিত সমাজে বর্ধিত । ফলে উদ্বাস্তু এবং আধাউদ্বাস্তু যুবকেরা তথা তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান থেকে ত্রক্রমাগত ভাবে আগত জনেরা, প্রায় সবাই যেহেতু একটা রাজনৈতিক আলোড়নের মধ্যে বাধ্য হয়ে কাল কাটিয়েছেন, তারা ষাটের দশকের মধ্যকালের অস্থিরতায় সর্বাধিক চঞ্চল হয়েছেন ।
এ-বঙ্গীয় যুবজনেরা তাদের তুলনায় কম অস্থির । কারণ, দেশভাগ, বিশেষত বঙ্গভাগে বাস্তবত তাদের কোনো স্বার্থহানি হয়নি ।
অতএব আমার ক্ষেত্রে যৌবনের শুরুতেই এরকম একটা বাতাবরণে এসে পড়ায়, এসময়ের অস্থিরতাটা প্রায় উচ্ছৃঙ্খল করেই তুলেছিল আমাকে । ব্যাপারটি হয়ত কার্যকারণগত ভাবে স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু তার উগ্রতাটা ক্ষতিকারকই হয়েছিল । সেটা যেমন সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে তেমনই ব্যক্তিগত স্বভাব গঠনের ক্ষেত্রেও । একারণে, অনেক নমস্য ও পূজ্য আত্মীয় এবং অনাত্মীয় মানুষের কাছে অপরাধী হয়েছি, যদিও শ্রেণীগত ভাবে তাঁরা কেউই আমার শত্রু ছিলেন না । পরে বিচার করে দেখেছি যে, অতিশৈশব থেকে যে বিষন্নতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি বড় হয়েছি, দেশ, সমাজ এবং পরিবারের যে উদাসীনতা এবং অবক্ষয় তথা নির্যাতনের চাপ আমার মধ্যে ক্ষোভের এবং হতাশার সঞ্চার করেছিল, প্লবতার সামান্যতম পরিবেশে এসেই তা যেন বিকৃত একটা অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল । যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপক সুফল নিজেকে গড়ে তোলার জন্য আমি প্লবতার সময়ে লাভ করতে পারতাম, তা নষ্ট হলো শুধুমাত্র উগ্র, কুরুচিকর এবং অপরিণামদর্শী কথাবার্তা আর আচরণের দ্বারা । এর ফলে ব্যক্তিমানুষ হিসাবে যেমন আমার মানসিকতা কলুষতা পূর্ণ হয়েছিল, তেমনি সমাজ বিপ্লবের প্রকৃতপাঠ গ্রহণে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম । এবং এটা আমার মতো জনেদের ঐ সময়ে যেন একটা সাধারণ প্রবণতা, এমনই বলবো ।
চাকরিক্ষেত্রে বৈষয়িক উন্নতি অবনতির কথা বলছি না, মানুষে মানুষে, সহকর্মী হিসাবে যে সম্ভ্রমপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়া উচিত, আমার ঐ সময়ের আচরণের জন্য তা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে নি:সন্দেহে । যদিও আমি ত্রক্রমাগত নিজের ত্রুটিগুলোকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখছি । তথাপি একথা মনে করার কোনো হেতু নেই যে আমার বা অন্য গোষ্ঠীর যুবরা আমার অনুরূপ মানসিকতার চাইতে ভিন্নতর ছিল । ব্যাপারটা স্বগোষ্ঠী বা দলের ক্ষেত্রে একই রকমের ছিল । আমাদের পারস্পরিক আলোচনা, সমালোচনার উদ্দেশ্য যতটা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য সক্রিয় ছিল, তার শ ভাগের একভাগও কোনো সুস্থ মীমাংসায় পৌঁছোনোর জন্য ছিল না । ব্যাপারগুলো যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক পেরিয়ে চলে যেত হিংস্র কুতর্কে, ত্রক্রমশ, গালিগালাজ, মারপিট এবং অন্যান্য শত্রুতামূলক চূড়ান্ত আচরণে । নিজে ব্যক্তিগত ভাবে খুন বা হত্যাকাণ্ডে অবশ্যই থাকিনি বটে, তবে তাত্ত্বিকভাবে অনেকক্ষেত্রেই পক্ষাবলম্বন যে করেছি, সে গ্লানি মোছার নয় । ব্যাপারটার মধ্যে নানান চরিত্রের রাজনৈতিক তথা ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের নেতাদের কুশিক্ষাগত প্রভাব যেমন ছিল, তেমনি ছিল বয়সজনিত চপলতার কারণে বাহাদুরি দেখাবার মোহ । সেটা সর্বার্থেই একটা নৈরাজ্যের মনোভাব । কিন্তু তার দায় সম্পূর্ণ যে আমার মতো জনেদেরই নয়, এসত্য তদানীন্তন সমাজ অভিভাবকেরা স্বীকার করেন নি, আজও করেন না । পরে প্রসঙ্গক্রমে তা নিয়ে বিস্তারিত হবার ইচ্ছে আছে ।
আমি এবং আর কয়েকজন ঐ আপিসে এবং বাকিরা ভিন্নভিন্ন শাখা আপিসে ত্রক্রমশ বহাল হলাম । প্রথম দিনটাতেই আপিসটা এবং তার কাজকর্ম আমার এতই কুরুচিকর মনে হলো যে ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীষণভাবে কাতর হয়ে পড়লাম । মাথার মধ্যে একটা কথাই তোলপাড় করছিল যে, এই বাড়িটাতে অথবা এই আপিসের ঘেরাবন্দিতে আমাকে সারাজীবন দশটা পাঁচটা আবদ্ধ থাকতে হবে । বড় বড় খাতা, যেগুলো কাউন্টারে সাজানো রয়েছে, তার মধ্যের হিসাব নিকাশের কাজ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে, বড় বড় ফর্ম ভরতি বা স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে প্রথম অভিজ্ঞতায় আমি সামান্যতম ভাললাগার রসাভাস পেলাম না । প্রথমদিন যে কাজটা আমাকে দেওয়া হলো, তা হচ্ছে গুচ্ছের সেভিংস পাশ বই নম্বর অনুযায়ী পরপর কেবিনেটে সাজিয়ে রাখা এবং গ্রাহকেরা কোনো নম্বরের বই চাইলে সেটা খুঁজে তাদের দেওয়া, তত্সহ অবশ্যই তাদের ডিপোজিট স্লিপের কাউন্টার ফয়েলে 'Pass book delivered' এই স্ট্যাম্পটি মুদ্রিত করে দেওয়া । কিছুতেই মানতে পারছিলাম না, এটা একটা কাজ হতে পারে । কোনো কাজই ছোট বা নিন্দনীয় নয় তা মানি, কিন্তু তাবলে এটা একটা কাজ ?
তাহলে এই হলো আমার এতদিনের এদেশ ওদেশ ক'রে মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টার পরিণতি ? কোথায় সেই কলেজের বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর, গাছপালা, তৃণক্ষেত্র, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আড্ডার জীবনের স্বপ্ন ! অধ্যাপকদের সস্নেহ শিক্ষাদান, ব্যাপক খোলামেলা আলাপ আলোচনা, আর কোথায় ডেবিট ক্রেডিট, স্টেটমেন্ট, রিটার্নের শুকনো কাজ কর্ম ! দরখাস্তটা পাঠানোর সময় মাথায় শুধুই পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কথাটাই ছিল । এ বঙ্গে আসার পরে, সবরকম সংকট এবং দেশের বাড়ির জন্য বুক নিঙ্ড়োনো বেদনাটা সত্ত্বেও একটা নতুন ভাললাগার জগৎ তো তৈরি হচ্ছিলই । নতুন জায়গা, নতুন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব, নতুন আদর্শের প্রতি টান । নতুন বিষয়ে পড়াশোনার বিস্তার এগুলোতো স্বাভাবিক ভাবেই জীবনটাকে একটা নতুন ছন্দে আন্দোলিত করতে শুরু করেছিল । হঠাৎ সেই অবস্থাটা স্তব্ধ হওয়ায় ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লাম । এরপর কী তাহলে একটা বিয়ে করে সনাতন সংসারী হওয়া ?
আপিসের কাজকর্ম শেখার ব্যাপারে, একসঙ্গে চাকরিতে বহাল হওয়া বন্ধুদের যতটা উত্সাহ এবং আগ্রহ ছিল, আমার মধ্যে তা সামান্যতমও ছিল না । আসলে এই ধরনের কাজ করার কোনো মানসিকতাই আমার ছিল না । প্রয়োজনে বাল্য কৈশোরে দিন মজুরের কাজও করেছি, কিন্তু এরকম গ্লানি বোধ হয়নি তাতে ।
যদিও আমার একাডেমিক জীবনটা শুরু থেকেই ছিল অত্যন্ত বিশৃঙ্খল এবং ছন্নছাড়া, তথাপি মানসিকভাবে আমার পছন্দের কাজ ছিল শিক্ষকতা । অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা নিয়ে নিজের জীবনটা গড়ে তুলবার একটা তীব্র আকাঙ্খা আমার বরাবরের । কিন্তু সেই কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করার সময় এবং সুযোগ আমার হলোনা । চেষ্টা করলে যে চাকরি করতে করতেও সে রাস্তায় যেতে পারতাম না, এমন না । কিন্তু যতই অপছন্দ করিনা কেন, চাকরিটা পাওয়ার পর ত্রক্রমশ যেন আমার সেই মানসিকতাটা আমূল পাল্টে যেতে থাকল । কোনোক্রমে নাইটক্লাশ করে বি. এ. অনার্সটা শেষ করে একাডেমিক পড়াশোনার লাইনটাই ছেড়ে দিলাম । তদানীন্তন রাজনীতির মতাদর্শগত ছেলেখেলায় একেবারে এমন উন্মত্ত হলাম যে, না রাজনীতির ব্যাপারে কোনো শৃঙ্খলাপরায়ণ দলীয় কর্মী হলাম, না পড়াশোনা নিয়ে ব্যক্তিক সন্তুষ্টির জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলাম । এই পর্যায়ে বৃথা সময় নষ্ট করে নিজেকে নষ্ট করার জন্য আমি পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র কাউকেই দোষী করতে পারিনা । এর
সম্পূর্ণটাই নিজের অদম্য হতাশার জন্যেই ঘটেছে । সুতরাং এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠাযোগ্য যে `আবোড়' বা `ঢ্যাঁড়স' হিসাবে আমার প্রতিভা খারাপ নয় । শুনেছি এক `বাঙাল' মাস্টার মশাই নাকী তাঁর ব্যোপি দেবতুল্য জনৈক ছাত্রের বুদ্ধি বিদ্যার বহর দেখে বলেছিলেন, "কালিদাস গাছের ডাইলে (ডালে) বইসা ডাইল কাটছিল, তুই বরং পাতায় বইসা পাতা কাট - এই আপ্ত বাক্যটি আমার ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণই যে সঙ্গত, সেবিষয়ে কেউই দ্বিমত হবেন না । রাজনীতির কারণে অনেক যুবজনই পড়াশোনা, ডিগ্রি ইত্যাদি তুচ্ছ করেছে । সেক্ষেত্রে রাজনীতিটা অন্তত তারা ধরে রেখেছে এবং পরে কালে দিনে করে খাচ্ছে । আমি ধরেছিলাম অনেক কিছুই, কিন্তু ক'রে খাওয়ার এলেম অবধি যেতে পারিনি । সেটা আসলে ইচ্ছার অভাব, না খ্যাম্তার অভাব, তার পরখ হয়নি । এসব ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত সততার বাহাম করে থাকে । আমিও কিছুদিন তাই করেছিলাম । পরে বুঝলাম, লোকেরা ওটাকে সততা বলে বোঝে না, অক্ষমতা বলেই জানে । বস্তুত কিছু করা বা হওয়ার মতো কোনো মুরোদই আমার ছিল না ।
সেবছরই আমাদের আপিসের পরিসরটা বাড়ানো হয়েছিল । পুরোনো বাড়িটার সঙ্গের এই বর্ধিত অংশটাকে আমরা বলতাম
মজার কথা হলো, মধ্যষাট থেকে মধ্যসত্তর, গতশতকের এই দশকটিতে সব দলই বিপ্লবের কথা বলতো, যদিও একদলের সঙ্গে অন্য দলের সম্পর্ক ছিল চূড়ান্ততম শত্রুতার । মিত্রতার লেশ মাত্রও ছিলনা । কিন্তু সেসব অনেক জটিল রাজনীতির কথা । আপিসে যেটা হতো শুধু সেটাই বলি । দলমত নির্বিশেষে ব্যাপারটাকে হুল্লোড়বাজি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না । গোটা আপিস-টাইম ধরে চলতো সেই হুল্লোড়বাজি । আজ অবশ্য সবাই দোষটা দেয় নকশালি নৈরাজ্যের এবং নকশালিরা যা করেছিলাম ঠিক করেছিলাম, এরকমই বলে । কিন্তু একটু থিতু হয়ে চিন্তা করলে নিজের কাছে সবাইই স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমরা তখন দলমত নির্বিশেষে সবাই খুব অস্থির ছিলাম এবং সেই অস্থিরতার বিবিধ ঐতিহাসিক কারণ ছিল । সেই কারণ, দেশভাগ, কম্যুনিস্ট পার্টিভাগ, সবরকম রাজনৈতিক দলীয়দের চিন্তন, মনন এবং কর্মে, দার্শনিক দেউলিয়াপনা ইত্যাদির মধ্যেই নিহিত, যে কথার ইতিপূর্বে আভাস দিয়েছি খানিকটা । ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, স্বাধীনতাপূর্ব বিভিন্ন ধারার তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রান্ত মতাদর্শের অবশ্যম্ভাবি পরিণতিই এই মধ্যষাট এবং সত্তরের দশকের অস্থিরতার হেতু । সুতরাং কেউই অন্যকে দোষ দিয়ে, এই দায় এড়াতে পারেন না । আর রক্তপাত বিষয়ে যদি বলতে হয় বলবো এই সময়কার কোনো দলই ভ্রাতৃরক্তে হাত রাঙায়নি এমন বলা চলবে না । এরকম দাবি যারা করে তাদের দাবি মিথ্যে দাবি । এ সময়ে সবাই-ই প্রতিহিংসায় চঞ্চল ছিল এবং প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজকে সঠিক বলে দাবি করতো, আজও করে । এদিক দিয়ে বিচার করলে মনে হয় বাঙালি প্রকৃতই যেন আত্মঘাতী । সাম্প্রতিকতম ঘটনাগুলোও তার সপক্ষেই সরব ।
আপিসে নির্দিষ্ট কাজ না করাটা আমি খুব দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছিলাম । যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতো, তারা ছিল আমার মতো `ফোপড়া' বাক্সর্বস্ব বিপ্লবীদের কাছে ব্যঙ্গের পাত্র । ইউনিয়ন ছিল একাধিক । এই কাজ না করার সংস্কৃতি নির্মাণে তাদের প্রত্যেকেরই উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল । বিক্ষোভ, তা কারণে হোক বা বিনাকারণে কোনো না কোনো ইউনিয়ন তাকে প্রশ্রয় দিত । বিক্ষোভ প্রকাশের প্রথম পদক্ষেপই হতো কাজ বন্ধ করে দেওয়া, তত্সহ উচ্চৈ:স্বরে বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত বা অসম্পর্কিত উগ্রশ্লোগান এবং গালাগালির বন্যা বইয়ে দেওয়া । বিচার, বিশ্লেষণ, শত্রু মিত্র নির্দিষ্টকরণ, কোনো কিছুরই যেন বালাই ছিল না । শৃঙ্খলা বস্তুটাকে, দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন দাসত্ব মনে করতো । যতই চেষ্টা করিনা কেন, এই সময়টার অস্থিরতা এবং উগ্রতার স্বরূপটা কিছুতেই যেন পরিষ্কার করে বর্ণনা করতে পারিনা ।
অফিস পাড়াটা তখন ছিল যেন রাজনৈতিক গলাবাজির এবং তথাকথিত বিপ্লবী বাহাদুরি দেখাবার মুক্তাঞ্চল । এ ব্যাপারে নকশালপন্থীদের বদনাম সর্বাধিক । আজ অনেক দলই সেই সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাদের কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করে থাকে । যেটা করেনা, তা হলো আত্মসমালোচনা । নিজেরা তখন কী করতো সেটা তাদের স্মরণে নেই, অথবা যা করতো, তা সবটাই সঠিক এই বিশ্বাসে তারা এখনো অটল হয়েই আছে । বলা বাহুল্য এটাই মধ্যবিত্ত স্বভাব ।
একথা সত্য যে, নকশাল কথিত যুবকেরা তখন ব্যক্তিহত্যার রাজনীতিকে সরাসরি সমর্থন জানিয়ে এক চোরাগলিতে ঢুকে পড়েছিল এবং তাদের তাত্ত্বিক নেতারা এই ব্যাপারটাকেই মার্কসবাদ সম্মত হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়ে বিষয়টাকে আরো ঘোলাটে করে ফেলছিলেন । কিন্তু মার্কসবাদের ধুয়ো ধরে অন্যান্য অনেক ছোটবড়ো দলই যে একই কাজ করে চলেছিল তখন সেটা আজ তাদের আর মনে নেই । কিন্তু সে একটা দীর্ঘ সমাজতাত্ত্বিক জটিল পরিস্থিতি । তার তাবৎ বৃত্তান্ত বলার পরিসর এবং প্রয়োজন এখানে নেই । আমি শুধু এই প্রসঙ্গে ষাট এবং সত্তরের দশকের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে, এর পরের অধ্যায়টিতে কিছু বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার কথা বলবো । ব্যাপারটি প্রাথমিক ভাবে বক্তৃতা হিসাবে ছিল । এই অধ্যায়ে পাঠক লক্ষ করবেন যে আমার উদ্দেশ্য ছিল একটা সুস্থ বিতর্ক সৃষ্টি করা । কিন্তু তা সম্ভব হয়নি । উপরন্তু চূড়ান্ত ব্যক্তিগত শ্লেষ এবং বিদ্রুপের পাত্র হয়ে সভাস্থল থেকে চলে আসি । যাহোক, আলোচনাটি পাঠক-স্বার্থে পরবর্তী অধ্যায়ে বিন্যাস করলাম ।
আমার মতো যাঁরা স্মৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন, তাঁদের এইসব ঘটনা, অপঘটনা থেকে রসদ সংগ্রহ করতে হয় । এর সবটাই শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা, সুতরাং চলমান স্মৃতি আলেখ্যে এর গুরুত্ব তো থাকেই । তাছাড়া এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার কিছু না হয়ে ওঠার পথে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ।
আমন্ত্রিত আলোচক হিসেবে এই অকিঞ্চিত্কর বক্তব্যটি বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে আয়োজিত একটি সভায় পাঠ করেছিলাম । লিখিতভাবে এখন সামান্য সংযোজন বিয়োজন করছি । তবে মূল বক্তব্যটি অটুটই থাকছে । জনৈক অধ্যাপক-সাহিত্যিকের উপর দায়িত্ব ছিল ষাট-সত্তরের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত গল্প উপন্যাস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার । আলোচনা চক্রটির বিষয়ে সবিস্তারে কিছু বলছি না । কারণ তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে । তা আমার রুচির পরিপন্থী এবং তাই অনভিপ্রেত ।
অধ্যাপক-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবি হিসেবে স্ব-নামখ্যাত । আমি বিপরীত পক্ষে নিতান্তই এক অখ্যাত অভাজন । কর্মকর্তারা সম্ভবত নেহাতই আমার একটা সাময়িক খ্যাতিতে বিভ্রান্ত হয়ে, তাঁর মতো একজন বিদগ্ধজনের সঙ্গে সমভূমক স্তরে আলোচক হিসেবে আমাকে যুক্ত করেছিলেন এবং বার বার আপত্তি সত্ত্বেও আমার অনুরোধ রক্ষা করে আমাকে অব্যহতি দেননি । তাই আমার আলোচনা অধ্যাপকের ক্রোধ বৃদ্ধি করেছিল, আর আমি তাঁর প্রভূত কটূক্তি, শ্লেষ এবং ব্যঙ্গের পাত্র হয়েছিলাম । আমার প্রসঙ্গ ছিল ষাটসত্তরের দশকের সামাজিক প্রেক্ষাপট ।
জীবনের নানা ঘাটে নানাভাবে অপদস্থ এবং লাঙ্ছিত হবার অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয় । ফলে, এইসব ব্যাপারে অভ্যস্তই আছি । শুধু সেদিন অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবিরা এই একবিংশ শতকেও কতটা পর-মত-অসহিষ্ণু হতে পারেন । অপেক্ষাকৃত কম বোধবুদ্ধির লোকদের নিজস্ব ঔদার্য এবং যুক্তির সাহায্যে স্ব-মতে আনার চাইতে, তাদের কদর্যভাবে নিন্দামন্দ করা যদি কোনও বুদ্ধিজীবির ধর্ম হয়, তবে বলব, সেই বুদ্ধিজীবির কোনও মুক্তমঞ্চের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার চাইতে নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক পৃষ্ঠকণ্ডুয়ণ করাই কায়িক তথা মানসিক স্বাস্থ্যসম্মত । নচেৎ ভিন্নমতের সামান্য আলোচনায়ও তাঁর বা তাঁদের ক্রোধাতিশয্য আকস্মিক বিপদের কারণ হতে পারে, এমনকী সময় এবং স্থানবিশেষে ব্যাপক বিশৃঙ্খলারও সৃষ্টি হতে পারে । বস্তুত সেই অধ্যাপক-সাহিত্যিক তথা রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তির সেদিনকার উগ্রচণ্ড ক্রোধের বহি:প্রকাশে আমি এবং সভাস্থ অনেকেই, তাঁর ভাষণ শেষ হবার আগেই, তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ে আতঙ্কিত হয়ে সভার প্রায় নব্বই শতাংশ অংশগ্রহণকারী সহ কক্ষত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম । মহাশয় সেদিন প্রসঙ্গ বহির্ভূত বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণে যা যা বলেছিলেন, তার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন বোধ করছি । আমার বক্তব্যটি ছিল নিম্নরূপ --
ষাট এবং সত্তরের দশকের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এই আলোচনাচক্রে অংশগ্রহণ আমার পক্ষে শ্লাঘনীয় হলেও একটা সমস্যার কথা শুরতেই জানিয়ে রাখা ভাল । ৪৭'এর দেশভাগের পরবর্তী ষোল সতেরো বছর আমি মূলত দক্ষিণপূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত এক গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছি । সুতরাং কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে আমার সেই সময়কার ধারণা ব্যাক্তিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নয় । আমার এ-পারে অবস্থানটা ১৯৬৩ থেকে । তাই ইতিপূর্বের সামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ে পুঁথিপত্তর অথবা এঁর-তাঁর কাছে শোনা কথায়ই যা জেনেছি । সেই জানার প্রেক্ষিতে ষাট-সত্তরের দশকের যুগান্তকারী সমাজ-মানস প্লবতা নিয়ে আলোচনা অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ হবে, বিশেষত, যেহেতু আমি অত্যন্ত কম পড়াশোনা করা লোক এবং বোধিবৃত্তিতে মধ্যমেধায়ও স্থান পাবার যোগ্য নই । যেহেতু, কোনও যুগ বা দশক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাক্যধনুর গুণটি পিছন দিকে আকর্ষণ করতেই হয়, তাই এ-কথা বলা । আরেকটা সমস্যা এই যে তখন আমার বয়স মাত্র ষোল বা সতেরো এবং আমার এ-পারে আগমনটা অত্যন্ত আকস্মিক । তাই পশ্চাত্পটের আবশ্যকীয় তথ্যাদি যথেষ্টভাবে আলোচনায় আনা হয়তো সম্ভব হবে না । সে যা হোক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাহায্যেই আমি আমার বক্তব্য বলার প্রয়াস করছি । আশা করি এই প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে রচিত কথাসাহিত্য নিয়ে, পরবর্তী সুধী বক্তা তাঁর মূল্যবান বিশ্লেষণ আমাদের উপহার দেবেন । আমি শুধুই সেইসব কথাসাহিত্য নির্মাণের প্রেক্ষাপটটির আভাস দেব ।
যখন একটা একান্ত গ্রামীণ পরিবেশ থেকে, এরকম এক কর্মচঞ্চল নাগরিক আবর্তে এসে পড়লাম, তখন খুবই দিশেহারা বোধ করছিলাম । ফেলে আসা দেশ, গাঁ এবং মানুষদের প্রতি ভালবাসা, আবার সেই রাষ্ট্রের প্রতিই ঘৃণা আর আতঙ্কের স্মৃতি এবং দেশভাগ তথা পঞ্চাশের গোটা দশক জুড়ে ব্যাপক উদ্বাস্তু প্রবাহ, এপারে তাদের ছিন্ন ক্লীন্ন জীবন-জীবিকা, বাসস্থানের জন্য পারিবারিক এবং গোষ্ঠীগতভাবে অমানুষিক সংগ্রাম, আর সামাজিকভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য ত্রক্রমান্বয়ী আন্দোলন, ক্ষমতাসীনদের মিথ্যে আশ্বাস, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভেদনীতি, দুর্ভিক্ষাবস্থার পৌন:পুনিকতা এবং একদা সুস্থিত অধুনা বিধ্বস্ত ছত্রাকার মানুষদের অসহায়তা - সব মিলিয়ে সে এক আশা, আশাভঙ্গ, স্বপ্ন ও স্বপ্নসমাধির ব্যাপক বিচিত্র টানাপোড়েন । প্রাথমিক সমস্যাটা ছিল, একটু যেমন তেমন মাথা গোঁজার ঠাঁই, পেটের দানাপানি জোগাড়, আর মানসিকভাবে থিতু হওয়ার । এইটুকুর জন্যই তখনকার যুদ্ধ এক মহাযুদ্ধ । পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের মধ্যকাল পর্যন্ত এখানকার শহর, শহরতলির প্রতিইঞ্চিস্থান পরিকীর্ণ এই যোদ্ধাদের দ্বারা । সামাজিক সুস্থিতির চিহ্নমাত্রও চোখে পড়েনি তখন । শুধু যুদ্ধ, যুদ্ধ । সংগ্রাম আর আন্দোলন এবং আত্মকলহ এবং ক্ষমতাকাঙ্খীদের এই পরিবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক জুয়া খেলা । রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতি-কর্মীদের একাংশের প্রাণপাত নতুন উপায় অন্বেষণ এবং ব্যর্থতা । কিন্তু সদর্থক নঞর্থক কোনও পক্ষই নিশ্চেষ্ট নেই । সব পক্ষই নিজ নিজ অভীষ্ট অনুযায়ী যুযুধান । কে কোন পক্ষে খেলছে, বোঝা দায় ।
সমাজে চারটি ভাগ তখন বেশ নজর কেড়েছিল । হিন্দু, মুসলমান, (নেড়ে বলা হত এখানে, পূর্ববঙ্গে, আমার অঞ্চলে অন্তত, এ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না) ঘটি এবং বাঙাল । প্রথম দুটির ব্যাপ্তি দ্বিতীয় দুটির চাইতে অবশ্যই বেশি । বহুকাল আগে থেকেই ঘটিরা ভাষা, খাদ্যাখাদ্য এবং আচার-আচরণে নিজেদের কুলীন তথা এলিট মনে করত । তারা অবহিত ছিল না, কী কারণে তাদেরই রক্তীয় কিছু গোষ্ঠী পূর্বদেশে বসতি বিস্তার করেছিল একদা, এবং বাঙালেরাও তাদের ওই স্থানে অধিষ্ঠান বিষয়ের ঐতিহাসিক কার্যকারণ সজ্ঞানে জানত না । ফলে বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মতো রক্তক্ষয়ী না হলেও, ঘৃণা প্রতিঘৃণার নির্বোধ আচরণে কিছুমাত্র কম তীব্র ছিল না, যা পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকেও ক্লেদাক্ত করেছিল সাম্প্রদায়িক নষ্টাচারের মতোই । ইতিপূর্বের এবং ওই সময়ের নিরন্তর উদ্বাস্তু প্রবাহ এই ঘৃণাকে সমধিক মাত্রা দিয়েছিল । কারণ, উদ্বাস্তুরা বাঙাল, আর তাদের স্ফীতি এ-পারের জনেদের স্বার্থের অন্তরায় হয়েছিল । এটা যে শুধু কলকাতা বা শহরতলিগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, গ্রামগুলোতেও এই দ্বন্দ্ব ব্যাপক ছিল এবং এই একটি ব্যাপারে অন্তত, হিন্দু-মুসলমানের মানসিকতায় কোনও তফাৎ ছিল না । তবে রাষ্ট্রীয় কল্পে যেহেতু হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটাই ব্যাপক ছিল, সামাজিকভাবে তাই দ্বিতীয়টির স্ফূর্তি তেমন ছিল না । বাঙালি হিন্দু সমাজে ঘটি ও বাঙাল বিভাগ দুটি বেশ আলাদাই ছিল । সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপেও এই মানসিকতার প্রাবল্য লক্ষ্যণীয় ছিল । বোধহয় ত্রক্রমাগত বাঙাল উদ্বাস্তুদের সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং সামাজিক সংখ্যা এবং প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি তাদের একটা অস্মিতা-সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল । তাদের বিশিষ্টতা বিলোপের তথা ক্ষমতাচ্যুতির ভীতিও যে এর পেছনে কার্যকরী ছিল না এমনও বলা যায় না । এবং তাকে অযৌক্তিক এমনও বলা যায় না । সৌভাগ্যক্রমে এই উপমহাদেশের স্বাভাবিক আত্মীকরণের ধর্ম এখানেও অনুপস্থিত ছিল না এবং এই সময়কার ব্যাপক গণআন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাতে, দ্বন্দ্ব-বিরোধ সমন্বয়ের প্রক্রিয়ায় সমীকরণের কাজ খুবই দ্রুত কার্যকরী হয়েছিল ।
পঞ্চাশের দশক থেকেই কোলকাতা এবং তার উপকন্ঠীয় বিস্তীর্ণ এলাকায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রয়োজনে কলোনিগুলোর পত্তন হচ্ছিল । এইসব কলোনিতে মুসলমান বসতি আদৌ ছিল না । এ-বঙ্গে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু নয় । সুতরাং পূর্বদেশের যেস্থান থেকে এসেছি, সেখানকার মতো এখানে তাদের সঙ্গে সংস্পর্শটা অনিবার্য এবং স্বাভাবিক ছিল না, যদিও আমার মতো অনেক মানুষের তত্কালীন বসতির চারদিকেই মুসলমানদের বসতি ছিল । এই একটি ব্যাপারে এপার এবং ওপারের এক তাত্পর্যপূর্ণ মিল দেখতে পাই হিন্দু-মুসলমানদের ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থিতির ক্ষেত্রে । ওখানে যেমন উভয় সম্প্রদায়ের গ্রামগুলির অবস্থান আলাদা আলাদা এবং তাদের সীমান্ত বিভাজিকা একটি খাল কিম্বা রাস্তা, এখানেও ব্যাপারটি প্রায় অনুরূপ । এর কারণ হিসেবে নানা ব্যাখ্যা শুনেছি, তাতে কখনও হিন্দুদের, কখনও বা মুসলমানদের দায়ি করা হয়েছে । কিন্তু আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে উভয় সম্প্রদায়েরই কিছু পারস্পরিক আপোস মীমাংসার ব্যাপার সমাজ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে কার্যকরী ছিল । অবশ্যই তা নিজেদের আলাদা আলাদা ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার স্বার্থে । কিন্তু কোলকাতা মহানগরীর মতো এক মহামিলনক্ষেত্রে ব্যাপারটি আমার স্বাভাবিক বলে কখনওই মনে হয়নি । এই সময় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু ও অন্যান্যরা যে কলোনিগুলো স্থাপন করতে থাকে, সেখানে মুসলমানদের অস্তিত্ব রাখার কথা নয়, যদিও ওইসব জমির মালিক ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমানেরা । সেসব কোথাও জবরদখল, কোথাও বা অর্থমূল্যে হিন্দু উদ্বাস্তুরা দখল বা ত্রক্রয় করে কলোনির পত্তন করেছিল । অবশ্য এই কর্মে এখানকার হিন্দুদের জমি-বাগানও যে তারা দখল করেনি এমন কথা নয় । এর ফলে ব্যাপক সামাজিক প্লবতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার স্থায়িত্বও ষাটের মধ্যকাল পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল ।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধের এইসব ঘটনা ছাড়া যেসব বড় মাপের অনভিপ্রেত ঘটনা অপঘটনা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যাপক অভিঘাতের সৃষ্টি করে, আমি সেইসব নিয়ে ব্যাপকতায় না গিয়ে শুধু উল্লেখ মাত্র করছি । নচেৎ আলোচনার পরিধি অনাবশ্যকভাবে বৃদ্ধি পাবে । সেগুলো সবাই-ই জানেন । ইতিপূর্বে ১৯৬২-তে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ এবং তার অব্যবহিত পরে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির বিভাজন । ১৯৬৪র হযরতবাল সংক্রান্ত হিন্দু-মুসলমানি দাঙ্গা এবং ১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের মতো নির্বোধ ঘটনাগুলিই এক্ষেত্রে উল্লেখনীয় । ৬২'র ভারত-চিন যুদ্ধের সময় আমি এখানে আমি ছিলাম না । কিন্তু তার ফল হিসেবে যে অপরিসীম সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মূখার্মি এ-দেশে চলছিল, কিছুদিন পরে এলেও তার প্রচণ্ডতা দেখেছি । তবে তার প্রকোপ মধ্যবিত্ত বুদ্ধি এবং দুর্বুদ্ধিজীবীদের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ব্যাপক জনতার সমস্যার বিষয় হয়েছে বলে মনে হয়নি । কিছুই না বুঝে, না জেনে, বিশেষ এক পক্ষের অন্ধ সমর্থক হয়ে, নিজেকে প্রগতিশীল, এমন কী বিপ্লবী বলেও ভাবতে শুরু করেছিলাম এই সময় থেকে । বাস্তবের সঙ্গে এই ভাবনার বিশেষ কিছু মিল ছিল না । একসময় বামপন্থী রাজনীতির আবর্তে, বিশেষ করে কম্যুনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এরকম কিছু আত্মজন এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের আলাপ আলোচনা শুনে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুবাদেই এক ধরনের বামপন্থী অহংকার তৈরি হয়েছিল । আমার বয়সি বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের মধ্যেই এই ব্যাপারটা ছিল । ৬৬'র খাদ্য আন্দোলন থেকে নিজের মধ্যে এবং সামাজিক স্তরে একটা দার্শনিক রূপান্তরের ব্যাপার লক্ষ করতে থাকি । এই সময়কার যেসব ঘটনার কথা সংক্ষেপে জানালাম, সেসবই ষাট এবং সত্তরের দশকের যুববিদ্রোহ তথা তাবৎ উথালপাথাল করা কর্মকাণ্ড আর সার্বিক মুক্তির স্বপ্নদেখার পৃষ্ঠভূমি । তাই সে বিষয়ে দু-একটি কথা আরও বলা প্রয়োজন ।
শিশুকাল থেকে পূর্ববাংলায় বড়দের শিক্ষা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একদেশদর্শী মানসিকতার প্রভাবে, আর তত্কালীন নানান ঘাত-প্রতিঘাতে একটা দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে গিয়েছিল যে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অত্যাচার-নিপীড়ন করা, হিন্দুদের উপর নানান উপদ্রবের অনুষ্ঠান হচ্ছে মুসলমানদের কাজ । তারা অসভ্য, বর্বর, অশিক্ষিত, কুআচারি এবং যাবতীয় অসামাজিক আচরণের দোষে দুষ্ট । তাঁদের মধ্যে বড় জোর দু একজন মাত্র ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন, নচেৎ তাঁরা জাতি হিসেবে এরকমই । কিন্তু হিন্দুরাও যে এসব ব্যাপারে সমান দড়, বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে অধিকতর পারদর্শী, সেই অভিজ্ঞতা লাভ করলাম, '৬৪-র দাঙ্গায় । প্রত্যক্ষভাবে রায়ট দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম । আমি খুব কাছ থেকেই তা দেখেছিলাম বলে, আজন্মলালিত বিশ্বাসের ভিতটা আমূল নড়ে গিয়েছিল । বাল্যাবধি জানতাম, মুসলমানরা ভারতবিদ্বেষী, কারণ ভারত হিন্দুদের দেশ, হিন্দুস্তান । এটা ওখানে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু উভয় সমাজের কাছ থেকেই শিখেছি, যদিও ভিন্নভাবে । '৬৫-র যুদ্ধের সময়ও সেটাই জানলাম । দেখলাম, হিন্দুরাও পাকিস্তান বিদ্বেষী, কারণ, পাকিস্তান মুসলিম প্রধান দেশ, মুসলমানদের দেশ । এরফলে, একেবারে অকস্মাতি বিগত দিনের শিক্ষা, অভ্যাস এবং ধ্যান ধারণার ঠিক বিপরীত ব্যাপারগুলোর মধ্যে পড়ে সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম । ইতিপূর্বে যে গ্রামীণ সরলতা এবং সহজ বিশ্বাসে একটা পরম্পরাগত আদর্শে স্থিত ছিলাম, সেখানে একটা বিরাট সন্দেহের ফাটল দেখা দিল । যেন এক ধরনের নতুন যন্ত্রণাবোধের জন্ম হল, যা শুধু ব্যক্তিগত ভাবে আমারই নয়, আমার স্বগোত্রীয় সমবয়সিদের সবার মধ্যেই তা দেখতে পাচ্ছিলাম । এভাবেই ষাটের দশক আমাদের গড়ে তুলেছিল সত্তরের পদাতিক হিসেবে । আমাদের বোধের জগতটা যখন এরকম, তখন নাকি ভারতের গৌরবোজ্জ্বল বিকাশের দশক চলছে, এরকমটা অনেকেই বলেন । তবে সে বিকাশটা কার বা কাদের, তা আমরা ঠিক জানি না । আজ পরিণত বয়সে, ষাটের দশকের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়, ঐ সময়টা যেন একটা আসন্নপ্রসবা গর্ভিণীসময় । যদিও তখন সেটা ততটা বুঝিনি । সত্তর, আশি, নব্বই এমনকী শতকের ঘর পেরিয়ে সহস্রাব্দের প্রায় এক দশক অতিক্রম করে আজ বুঝতে পারছি যে-ব্যাপারটা প্রকৃতই সেরকমই । ইতিহাসের গতিটা বোধহয় এমনই হয় । অবশ্য অভিভাবকতন্ত্র চিরাচরিত প্রথানুসারে একে মাত্স্যন্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন । কিন্তু বিনাপ্রশ্নে ইতিপূর্বকালে পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় অভিভাবকদের যে শ্রদ্ধা সম্মান এবং মহত্বের আসনে বসিয়ে পুজো করে আসছিলাম, একের পর এক ধাক্কায় বুঝলাম, তাঁরা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন । কারণ তাঁরা আমাদের কাছ থেকে যা আশা করেন, নিজেরা তা পালন করছিলেন না । নৈতিকতার, ত্যাগের, মেধার বা সংগ্রামের কতকগুলো ফাঁকা বুলিই তাঁরা আওড়াতেন এবং চাইতেন আমরা যেন তাতে উদ্বুদ্ধ হই । কিন্তু তাঁরা নিজেরা সে ব্যাপারে না সত্, না ঐকান্তিক ছিলেন । আমরা যারা তখনও লেখালেখি বা অন্য কোনও রকম সাংস্কৃতিক কর্মে জড়িত ছিলাম না, উপরিউক্ত কারণে তাদের ক্ষোভের এবং ক্রোধের প্রকাশটা প্রাথমিক অবস্থায় রাজনৈতিক, বিশেষ করে কোনও না কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে ফেটে পড়তে চাইছিল, যা পরিণতি লাভ করল '৬৬-র খাদ্য আন্দোলনে এবং, ৬৭-তে শুরু হওয়া নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহের নতুন দিগ্দর্শন মারফৎ । বস্তুত গোটা ষাটের দশকের তাবৎ বামপন্থী আন্দোলনই ছিল সত্তরের দশকের সার্বিক প্লবতার প্রস্তুতি পর্ব । সেই অবস্থাটা ছিল সবকিছুর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহের অবস্থা, এমনকী নিজেদের বিরুদ্ধেও । কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক বা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ যাঁরাই প্রতিষ্ঠানের আওতায় অবস্থান করেছিলেন - সবার বিরুদ্ধে সে এক সার্বিক অনাস্থা, যা কখনও কখনও অন্ধ এবং বিচার-ব্যতিরেকী আক্রোশেরও জন্ম দিচ্ছিল ত্রক্রমশ । পারস্পরিক মতবিরোধ, পর-মত-অসহিষ্ণুতার প্রাবল্য, দলগত এবং ব্যক্তিগত হানাহানি এবং কাটাকাটির সূচনাও এই সময়েরই অবদান, যা সত্তরের দশককে এক রক্তাক্ত বিতর্কিত সময় হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত করেছে । সেই অস্থিরতা যে এখনও নেই, সে কথা বলা যাবে না, শুধু তার প্রক্রিয়াগত কিছু ভিন্নতা ঘটেছে মাত্র । তবে সে ইতিহাস এবং বাস্তবতার বিষয়ে সবাই অবগত, বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন হয় না, বাসেসব তেমন কিছু অভিনব নয় ।
তবে একটা কথা এই যে, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং এমনকী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও সর্বস্তরে যে ব্যাপক ধাক্কা এই সময়ে দেওয়া হয়েছিল, তার তুলনা উনিশ শতকীয় ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সঙ্গে কিছুটা তুলনীয়, যদিও ষাট সত্তরের দশকের অস্থিরতা এবং কর্মকাণ্ডের হিংস্র তীব্রতা, তার তুলনায় অনেক গুণই বেশি আর তার বিস্তৃতি ও গভীরতাও বহুগুণ অধিক ও তাত্পর্যপূর্ণ । বিভিন্ন তরফ থেকে বিদগ্ধজনেরা সেইসব তাত্পর্যের আলোচনা করেছেন, মূল্যায়ন করেছেন । এই সময়কে উপজীব্য করে নাটক, ছায়াছবি, কাব্য, গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ প্রচুরই লেখা হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে । অনেক ক্ষেত্রেই সত্তরের দশকের হানাহানি, কাটাকাটি বা অনুরূপ ব্যাপারগুলিকে আরবান্ গেরিলাদের হঠকারিতা হিসেবে যেমন চিহ্নিত করা হয়েছে, অনেকক্ষেত্রে আবার ওই সময়ে কে কতখানি বিপ্লবী ছিলেন তার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাজারো বাত্তেল্লাবাজিরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে । আমি রাজনীতির ভাষ্যকার অথবা সাহিত্য শিল্পের বিদগ্ধ সমালোচক নই । ষাট-সত্তরের দশক সঠিকভাবে বিপ্লবের দশক ছিল কি না, অথবা ওই সময়কে উপজীব্য করে যাঁরা আজ পর্যন্ত এক ভিন্ন ধারায় সংস্কৃতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কতখানি সার্থক, তার যথার্থ মূল্যায়ণ করার সাধ্য আমার নেই, বর্তমান পরিসরে তা সম্ভবও নয় । শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, বিপক্ষীয় যাঁরা শুধু এই সময়কার আন্দোলনের দোষ, ত্রুটি বা আতিশয্য নিয়ে পাঁচকাহন নিন্দাবাদ করেন অথবা পক্ষে থেকে যাঁরা অসম্ভব গল্পকথায় আসর গরম করেন, তাঁরা কেউই বোধহয় ইতিহাস চর্চার মৌল শর্তগুলো পূরণ করেন না । আমি আশা করবো, এই সময়কার কথাশিল্প নিয়ে আলোচনায় সেসব সূত্র নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে আসবে ।
'৪৭-এর দেশভাগ এবং ক্ষমতার হস্তান্তরের পরের মাত্র দেড়দশকের মধ্যে উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রপুরুষদের, প্রশাসনিক আমলাদের এবং সর্বস্তরের অভিভাবক শ্রেণীর নষ্টামি আর ভণ্ডামির প্রবাহ যে অব্যাহত গতিতে চলছিল, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবেই ষাট-সত্তরের যুব উথ্থান । এই প্লবতা উপযুক্ত পরিচালনায় স্বচ্ছন্দ গতি পেলে নি:সন্দেহে মহৎ ফল লাভ হত । কিন্তু বিগত আরও অনেক অনেক প্লবতার মতোই একটা সময় এটিও বিনষ্ট হল রঙবেরঙের নিহিত-স্বার্থীদের সমবেত প্রতিক্রিয়ায় । কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সার্বিকভাবে উথ্থানের যে স্বপ্ন যুবজনেরা এই সময়ে দেখেছিলেন, তার সবটাই নষ্ট হয়ে গেছে । প্লবতার স্বাভাবিক ধর্মই হচ্ছে ভালমন্দ সব একাকার করে দেওয়া । সামাজিক প্লবতার সময় শুধু ভাল ভাল স্বপ্নগুলোই সফল হবে, দু:স্বপ্নের কিছুই থাকবে না, এ রকম নজির ইতিহাসে নেই । কোনও প্লবতাকালীন সময়ের সুফলই তাত্ক্ষণিক ভাবে পাওয়া যায় না বা তার অন্তর্নিহিত গতির গূঢ় স্রোত অনুভবও করা যায় না । অবস্থা থিতু হলেই আমরা আস্তে আস্তে পেতে থাকি প্লবতাবাহিত পলির প্রসাদ এবং তত্সহ অবধার্য হয় তার অভিশাপও । তাকেও অস্বীকার করা যায় না । মনে রাখতে হবে, এই সময়েই রাষ্ট্রযন্ত্র বাধ্য হয় কৃষকদের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসতে । কৃষক সমস্যা যে আসলেই একটা মূল জাতীয় সমস্যা এবং তার সমাধান যে শুধু কাগুজে কিছু আইন দিয়ে বা গতানুগতিক আন্দোলনের মাধ্যমে হয় না, এই সত্যটা সবার কাছে পরিষ্কার হল এইসময় । কৃষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে ইতিপূর্বের গতানুগতিক ধারার আন্দোলনগুলোর ধরন পাল্টে গেল । ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র বাধ্য হয়ে উদ্যোগ নিল । অবশ্য শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সদর্থক অগ্রগতির বিষয়টা বিতর্কমূলক । তার সঠিক মূল্যায়ণ এখনও হয়নি । তবে বিভিন্ন শিল্প জাতীয়করণ করাটা তাত্ক্ষণিক ভাবে ফলদ হয়েছিল । যদিও এর পদ্ধতি বিষয়ে তাত্ত্বিক মতবিরোধ তখনও ছিল । আজও প্রবল । বর্তমান বিশ্বায়নের বাতাবরণে, তত্কালীন বিতর্কগুলোর পুনর্মূল্যায়ণ প্রয়োজন বলে মনে হয় । আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করা গেল যে, দাঙ্গার ব্যাপারটা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই এই বঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ।
এই প্লবতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার বদ্ধাবস্থার মুক্তি । এর উদাহরণ দিতে গেলে ব্যাপক আলোচনায় যেতে হয় । তবে এ নিয়ে চর্চাও খুব কম হয়নি, এখনও নানা বিদগ্ধজন নানাভাবে করে চলেছেন । শুধুমাত্র এই আন্দোলনকে উপজীব্য করে যে পরিমাণ পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে বা এখনও হয়ে চলেছে, তার সংখ্যা এবং মান যে কোনও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পক্ষে গর্ব করার মতো । এখানে আলাদা আলাদা করে কাব্য, সাহিত্য, নাটক বা শিল্পকলার কথা বলার অধিকার বা ক্ষমতা কোনওটাই আমার নেই । শুধু এইটুকু বলতে চাই যে ষাট-সত্তরের উত্তাল সময়টাকে যেসব নিহিত-স্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবীরা সেই সময়ে `ফুঁ' দিয়ে ছাই-এর মতো উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বা এখনও চান, তারা বোধহয় যুগলক্ষণ বিচার করে ওই সর্বাত্মক প্লবতাটিকে সম্মান জানাতে অনিচ্ছুক এবং অসমর্থ । কিন্তু সে কারণে প্লবতাটি নি:সন্দেহে তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় না, বা তার ঐতিহাসিক প্রায়োগিকতার বিলুপ্তিও ঘটে না ।
এতক্ষণ যা বলার চেষ্টা করা হল, তা শুধুই কিছু গোদা কথায় তত্কালীন কতকগুলি দেশীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেই প্লবতার কার্যকারণের আভাস । কিন্তু ঐ সময়ের আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহের অভিঘাতের বিষয়ে কিছু আভাস না দিলে, মুক্তি অন্বেষণকারী যুবজনদের পথ খোঁজা প্রচেষ্টার কথা এবং গোটাবিশ্বের সমস্যার সঙ্গে নিজেদের জাতীয় সমস্যার সংযুক্তির সংগ্রামের কথা অনুক্ত থেকে যায় । যদিও এসব সবারই জানা কথা, তবু প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে । মধ্য ষাটের দশক থেকে ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ, লাতিন আমেরিকার, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের বিপ্লব প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ, মহাচীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অভূতপূর্ব উন্মাদনা, কম্বোডিয়ার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং সর্বশেষে ১৯৭১ এর বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধ - এর প্রত্যেকটি সংগ্রাম নিয়ে এখানের বামপন্থীদের তথা অতিবাম বলে নিন্দিত তত্কালীন প্লবতাকামী স্বপ্নাতুর যুবগোষ্ঠীর আন্দোলনের কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য । এর সবগুলোর, বিশেষ করে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাব এদের উপর অপরিসীম । এই সব যুদ্ধ এবং আন্দোলনের চুলচেরা বিচার বিতর্কের মাধ্যমেই সার্বিক প্লবতাকামী যুবজনেরা, তাদের রণনীতিগত কৌশল অন্বেষণ করছিল । `তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম' বা `চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ' - এই সব স্লোগান এই সময়েই ধ্বনিত হয়েছে । আন্দোলন, ব্যারিকেড, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ ইত্যাদির ব্যাপক কথায় না গিয়ে, আমি এই স্লোগানগুলো নিয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই ।
তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম । এই স্লোগানটি তখনকার সব বামপন্থী পার্টিকর্মী এবং সমর্থকদের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে, এ নিয়ে বিশেষ সমালোচনা বা কটূ কাটব্য হয়নি । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নানান স্লোগানে তো ইন্দিরা গান্ধী এশিয়ার মুক্তিসূর্য । কিন্তু `চীনের চেয়ারযান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ' এই স্লোগানটি নিয়ে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর এবং আজও যে তা একেবারে থেমে গেছে, এমন নয় । এ নিয়ে মতবিরোধ প্লবতাপন্থীদের মধ্যেও ছিল । বিপক্ষীয়দের সমালোচনার জবাবে দেয়ালে লেখা হয়েছিল, `হ্যাঁ, আমরা বলছি চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, শুয়োরের বাচ্ছারা, তোরা বল, নিক্সন তোদের বাপ ।' অর্থাত্, আমরা আমাদের বিশ্বাসের এবং আদর্শের কথা পরিষ্কার ভাষায় স্পষ্ট করে বলছি । তোমাদের বিশ্বাস এবং আদর্শ স্পষ্ট ভাষায় বল । ব্যাপারটা প্রগতি এবং প্রতিক্রিয়ার তত্কালীন দ্বান্দ্বিক সংলাপ । কিন্তু জাতীয়তাবাদের অহংকার একে দেশদ্রোহিতা হিসেবেই বিচার করে । বিশেষ করে চীন তখন ভারতের জান্কা দুশমন, আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত । কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এর যুগ গত হয়েছে । সোভিয়েট রাশিয়া যদিও তখনও পিতৃভূমি, কিন্তু জাতীয় নীতি-নির্ধারণের স্তরে, তথাকার কর্তাদের প্রকাশ্যে `কত্তাবাবা' কেন যেন বলা হচ্ছে না, যদিও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে, জাতীয় স্বার্থে তাদের বাবাগিরির ছত্রছায়া অসামান্য আশ্রয় এবং তা সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়ের । জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিদেশীয় দার্শনিক, রাজনৈতিক তথা রঙবেরঙের বিপ্লববাদীদের প্রভাব এবং তাঁদের ধূপধূনো দিয়ে পুজো ও স্ব-ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ হওন খুব বেশি দিনের কথা নয় । প্লবতাকামীরা সেইসব তথ্য-তত্ত্ব যে জানে না এমন নয় । মাও-সে-তুং তখন তাদের বিচারে বা পৃথিবীর অনেক নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর বিচারে একজন নির্ভুল শিক্ষক । আর চেয়ারম্যান শব্দটি তখন, যতটা না চীন পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রযুক্ত, তার চাইতে অধিক প্রযুক্ত নামের বিশেষণ হিসেবে, যার মর্মার্থ শিক্ষক । জাতীয় ক্ষেত্রে তারা মাওয়ের সমতুল্য কোনও শিক্ষক পায়নি । আর মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্তালিনের প্রদর্শিত পথ যখন এতকাল ধরে স্বীকৃত হয়ে এসেছে, তখন মাও-ই বা তাদের পথপ্রদর্শক হবেন না কেন, যখন আন্তর্জাতিকভাবে তাঁকে অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন মার্কসবাদ লেনিনবাদের তত্কালীন শ্রেষ্ঠ এবং সার্থক প্রয়োগকর্তা ও দার্শনিক হিসেবে, এই প্যারাডক্সের উত্তর তারা পায়নি । তাই এরকম চিন্তা তাদের ছিল । অবশ্য এই আলোচনা দ্বারা আমি তাদের স্লোগান দুটি সমর্থন বা অসমর্থন কিছুই করছি না । কিন্তু এ নিয়ে ওই সময়ের পারস্পরিক খেউড় প্রতিযোগিতার অনাবশ্যকতা বিষয়ে অবশ্যই বিতর্ক তুলছি । এ বিষয়ে আমার প্রস্থান শুধু একটি বিষয়ে, তা হল, নিজেদের চিন্তা এবং আদর্শের কথা সরাসরি স্পষ্টভাবে বলার সৎ সাহস, তা সঠিক অথবা ভুল যাই হোক, তা তাদের ছিল । সঠিক বা ভুলের প্রতিষ্ঠা প্লবতার ঘটনার সময়ে হয় না, তার জন্য সময় দিতে হয় এবং তার বিচারটা সৎ ও মোহমুক্ত হয়ে করতে হয় । আপনারা বলতে পারেন যে, এতক্ষণের বাচালতার মধ্যে আমি ওই সময় এবং আন্দোলনের কোনও নতুন ব্যাখ্যা বা সূত্র আপনাদের সামনে উপস্থিত করতে পারিনি এবং আমার বক্তব্যে প্লবতাকামীদের প্রতি বেশ খানিকটা আপাত-পক্ষপাতিত্ব হয়তো আছে । নতুন সূত্র বা ব্যাখ্যার বিষয়ে নি:সন্দেহে আমার অক্ষমতা দায়ী । পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে, কৈফিয়ৎ হিসেবে বলতে হয় যে, আমি যেহেতু খুব সামান্যভাবে হলেও ওই প্লবতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেই সময়ে জড়িত ছিলাম, আমার চেতনায় আজও তার সদর্থক রণনটি স্তব্ধ হয়নি । সেটা যদি পক্ষপাতিত্ব হয়, তবে সে দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি । কিন্তু একথা বলব যে, এই প্লবতার সঙ্গে ওতপ্রোত দুটো ব্যাপার আমি অন্তর থেকে কোনওদিন মেনে নিতে পারিনি, তা হল, ব্যক্তি সন্ত্রাস এবং পারস্পরিক চরিত্র হনন । সর্ব বর্ণের সাধারণ বর্গের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং নিজ বিশ্বাস ও চিন্তনের অকুন্ঠ প্রকাশ, পরিচ্ছন্ন বিতর্কের মাধ্যমে নতুন ও কল্যাণকর মূল্যবোধের অন্বেষণ যা এই আন্দোলনকে বিশিষ্ট করেছিল, তার প্রতি আমি আজীবন সৎ ও নিষ্ঠ থাকতে আকাঙ্খী, এখনও । যদিও কোনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে আমি যুক্ত নই ।
এই আলোচনা এত স্বল্প পরিসরে করা খুবই সমস্যাজনক । এর এত ব্যাপক এবং বিচিত্রতর দিক আছে যে, যথেষ্ট সময় নিয়ে যদি বেশ কয়েকজন উপযুক্ত আলোচক সেই দিকগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে সন্দর্ভ রচনা করে এক পাঠচক্রে পরিবেশিত করেন, তবেই বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হয় । এত বড় মাপের ঘটনা বা আন্দোলন, একটা দেশে হরবখ্ত ঘটেনা, বা তার প্রভাবও সমাজজীবনে যাকে স্তব্ধ নি:শেষ বলে মনে হয়, তা কিন্তু শুধুমাত্র আন্দোলনের উপরিতলের চিত্রমাত্র । তার অন্তর্নিহিত স্রোত বহুকালাবধি চেতনায় বহমান থেকে ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষায় থাকে । শিল্প সাহিত্যাদিতে ওই অন্ত:স্রোতের বহতা কখনওই স্তব্ধ হয় না, কখনও চেতনে, কখনও বা অবচেতনে শিল্পী সেই সোঁতাকে অবলম্বন করে পথ চলেন । এভাবেই প্লবতার পলি গণচেতনায় থিতান পায় এবং ভবিষ্যতের জন্য এক মজবুত ভূমি প্রস্তুত করে । শিল্পী ও গ্রাহক যদি এই রসায়নকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করে এগিয়ে চলেন তবে ইতিহাসের দেবতা তাঁদের অবশ্যই বরমাল্য দেন । কথাসাহিত্য নিয়ে যিনি আলোচনা করবেন, তিনি নিশ্চয় এ বিষয়ে বিশদ হবেন ।
একটি বহুচর্চিত আফশোষ নিয়ে দুটি কথা বলে আমার আলোচনা শেষ করছি । একথা নি:সন্দেহে সত্য ও দু:খদ যে ষাট-সত্তরের রক্তক্ষয়ী প্লবতায় অগণ্য প্রাণ নষ্ট হয়েছে, অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কেরিয়ার নষ্ট হয়েছে এবং কিছু মাথা গরম, অপরিণামদর্শী নেতার ভুল শিক্ষার জন্য একটা প্রজন্মই ছন্নছাড়া হয়ে গেছে । এসব যে হয়নি একথা বলছি না । কিন্তু আফশোষকারীদের মধ্যে একটা ব্যাপক প্রবণতা দেখা যায় যে, তাঁরা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জীবন ও কেরিয়ার নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে যতটা সোচ্চার, সাধারণ অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ বিষয়ে, তাদের সর্বস্বান্ত হওয়ার বিষয়ে ততটা স্পর্শিত নন যেন । প্রাণ ব্যাপারটা কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই অমূল্য । তা মেধাবীদেরও যেমন, সাধারণ চাষি মজুরদেরও তেমনি । সবক্ষেত্রেই প্রাণহানি দু:খজনক । কিন্তু আরও দু:খজনক এই যে, ইতিহাসে অনুরূপ প্লবতার ক্ষেত্রে এর কোনও ব্যতিক্রমী নজির নেই । যে কথা আগেও বলেছি, আবার বলি যে প্লবতার ধর্মই হচ্ছে সব একাকার করে দেওয়া । গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনও কিন্তু এর ব্যতিক্রমী নয় । অনেকেই খুব সহজে ওই সময়কার আন্দোলনকারী যুবগোষ্ঠীকে ব্যক্তিহত্যা এবং সন্ত্রাসের জন্য সর্বৈব দায়ী করে থাকেন । তাঁরা একটা ব্যাপারে বেশ চোখ ঠার দিয়ে পাশ কাটান যে, ইতিপূর্বের এমন কোনও আন্দোলন বা বিপ্লব প্রচেষ্টা নেই যেখানে ব্যক্তিহত্যা নামক অনভিপ্রেত কর্মটির অসদ্ভাব দেখা গেছে, আর রাষ্ট্র তো আইন শৃঙ্খলার নামে ইচ্ছেমতো গণখুনের ইজারা নিয়েই রেখেছে । বর্তমান ক্ষেত্রে আরেকটি স্মরণযোগ্য কথা হচ্ছে, এই সময়ে শুধু এতদ্দেশীয় যুবকেরাই যে মাথাগরম করে সব লণ্ডভণ্ড করছিল তা তো নয়, গোটা তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্রই এরকম অশান্ততা বিরাজ করছিল । কিন্তু আমাদের দেশীয় সমালোচকদের দৃষ্টি ততদূর প্রলম্বিত হয় না । তার প্রকৃত আর্থসামাজিক কার্যকারণও তাঁরা খোঁজেন না । এরই নাম নিহিত-স্বার্থ । আমার আলোচনাটি সর্বঅর্থেই আগোছালো এবং চর্বিত-চর্বন । আমি আশা করব, উদ্যোক্তারা সময়ান্তরে বিষয়টি নিয়ে একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করে এর সদর্থক দিকগুলিকে যেন পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন, যাতে বর্তমান প্রজন্ম সম্যকভাবে ঐ অসম্ভব সম্ভাবনাপূর্ণ সময়ের প্রকৃত স্বরূপ অবগত হতে পারেন । আলোচনাটা পারস্পরিক খেউড় না হয়ে, ঐ সময়ের সংঘর্ষের দোষ গুণ নিয়ে ইতিহাসসম্মত হলেই ভাল হয় ।
এই ছিল আমার বক্তব্য । সভাসমিতিতে বলা কওয়ার অভ্যাস আমার নেই । মনে একটা বিশ্বাস ছিল যে, এরকম সভায় বুদ্ধিজীবিরা গণতান্ত্রিক আচরণকেই মূল্য দেন । পর-মত-অসহিষ্ণুতাটা বাহুবলিদের চর্চার বিষয় । আমার পরবর্তী বক্তার ত্রক্রুদ্ধ আচরণে সে বিশ্বাস সেদিন অটুট থাকেনি । অবশ্য এইসব বুদ্ধিজীবিরা অহরহ চিত্কার করে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে থাকেন এবং স্ব-বক্তব্য, তা কুত্সিত আচরণ ও শব্দযুক্ত হলেও, গণতান্ত্রিক অধিকারের নামেই উপস্থিত করে থাকেন । তাঁরা ভুলে যান, যাকে তাঁরা প্রতিপক্ষ বা বিরুদ্ধবাদী ধরে নেন, তাদেরও গণতান্ত্রিক অধিকার আছে । এঁদের এই আচরণকেই সুস্থ মানসিকতার মানুষেরা বোধ হয় ক্ষমতার দম্ভ বলেন । অধ্যাপক-সাহিত্যিকদের আচরণে সেদিন এই কথাটিই আমার মনে হয়েছিল । তাঁর জন্য নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে গিয়ে সেদিন তিনি যা করেছিলেন, তাকেই ক্ষমতার দম্ভ বলা হয় । বুদ্ধিজীবিরা অবশ্যই সাধারণের ঊর্ধ্বে, কিন্তু ঊর্ধ্বে অবস্থান করলেই বোধহয় অ-বিনয়ী বা দম্ভী হওয়ার অধিকার জন্মে না । এই শিক্ষাটা অশিক্ষিত-ছোটলোক, বা আমার মতো অর্ধশিক্ষিত ছোটলোক-সংসর্গকারীর আচরণ থেকে গ্রহণ করলে (অবশ্যই আমার কাছ থেকে নয়) `বিদ্যা বিনয়ং দদাতি' কথাটির যাথার্থ্য প্রতিষ্ঠিত হয় । বিদ্যা, কুল, শীল, মান ইত্যাদির সঙ্গে যে বিনয় নামক গুণটি আর সহবাসে নেই, একথা বোধহয় বিতাং এর অপেক্ষায় নেই । অথবা কোনোকালেই যে সার্বিক ভাবে ছিল মন ও প্রমনোভাব । পরন্তু, অশিক্ষিত ছোটলোক নামধারীরা তাঁদের হীনমন্যতায় হোক অথবা নাগরিক শীলিত শিক্ষিত জনের কাছে মনাবিস্কৃত কোনো গূঢ় কারণেই হোক, যে বিনয় এবং শীল স্বাভাবিক ভাবে আচরণ করেন, তা যে সর্বতোভদ্র একথা ভগবান লোক বুদ্ধ স্বয়ং স্বীকার করতেন । ভগবান শিক্ষিত ছিলেন না, একথা কোনোযুগে কেউই বলেছেন বলে জানিনা । তথাপি বিনয় তাঁর প্রধান শিক্ষা । সমাজে বিদ্যার সঙ্গে বিনয়ের বিচ্ছেদ বোধহয় ঠিক ভারতীয় সভ্যতাজাত নয় মূলত । তবে বর্ণাশ্রমী ক্ষমতা বিন্যাসের ধারা ধরে ঔপনিবেশিক বাতাবরণে তার যে পুষ্টি হয়েছে এমন ধরা যেতে পারে । সে অনেক কথা । আমি শুধু বর্তমানের অবিনয় বিষয়ে দুকথা বলছিলাম ।
আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল `ষাট ও সত্তরের দশকের সামাজিক প্রেক্ষাপট' । পাঠকগণ সহমত হবেন যে এরকম একটি বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বেঁধে দেওয়া সময়ের গণ্ডির মধ্যে কিছুই বলা সম্ভব হয়না । অথচ আজকাল এই রীতিটি খুব চালু হয়েছে নবীন প্রজন্মের বিদ্বজ্জনদের উত্সাহে । প্রচুর অর্থও এজন্য বরাদ্দ হয়ে থাকে । কিন্তু কাজের কাজ বলতে যা হয়, তা ন দেবায় ন ধর্মায় । আমার মনে হয়, এর চাইতে মঞ্চে খানিকক্ষণ সরাসরি তরজা বা খেউড় এর লড়াই করলে শ্রোতারা অধিক পুলক বোধ করবেন । তবে সেক্ষেত্রে একটাই অসুবিধে, বর্তমান সাহিত্যিক-অধ্যাপক মশাই এর মতো মনীষীরা সেখানে তাঁদের বৌদ্ধিক যুযুত্স্যুর প্যাঁচ দেখাবার সুযোগ থেকে হয়ত বঞ্চিত হবেন । সেটা তাঁদের সমূহ ক্ষতি । সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা বোধহয় শুধু পুঁথি পড়ে হয়না, সমাজের সর্বস্তরের সংঘর্ষের প্রতি মোহমুক্ত দৃষ্টিপাত এবং মানুষের নিয়ত সংসর্গ সেক্ষেত্রে আবশ্যিক শর্ত ।
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯ )