চারজন নামলেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে । বাদুড়বাগানে বাগানঘেরা বড় বাড়ির চারদিকে পাঁচিল । দুতলার একটা ঘরকে সাগর বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার এবং শোবার ঘর এই তিনরকমভাবেই ব্যবহার করেন । গাড়ি থেকে নেমেই বিহঙ্গ ভয়ে ভয়ে বললেন - মাস্টার, আমাদের তাড়িয়ে দেবে না তো ?
বিহঙ্গের পরনে লালপেড়ে ধুতি, গায়ে লংক্লথের জামা । বয়স পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ হবে । মহেন্দ্রনাথ বিহঙ্গকে আশ্বাস দিয়ে বললেন - না, না । ভারি অমায়িক লোক । আগে থাকতেই বলে রেখেছি তো আপনাকে নিয়ে আসব । জামার বোতাম খোলা বলে ভয় পাচ্ছেন ? উনি মানুষকে পোষাক-পরিচ্ছদ দিয়ে বিচার করেন না ।
- আচ্ছা চলো তাহলে ।
একদিকে প্রতাপ এবং অন্যদিকে ভবনাথকে নিয়ে আড়ষ্টভাবে সিঁড়ি ভাঙতে আরম্ভ করলেন বিহঙ্গ । আগে আগে মহেন্দ্রনাথ । এবাড়ির পথঘাট মহেন্দ্রনাথের চেনা । অতএব সিঁড়ি দিয়ে উঠে দুতলার বৈঠকখানা ঘর অবধি পৌঁছতে কোন অসুবিধে হল না ।
বৈঠকখানার ঘরের একদিকে কাঠের চেয়ার টেবিল পাতা । দেয়ালের সঙ্গে লাগানো আলমারিভর্তি অনেক রকমের দেশি-বিদেশি বই ও পুঁথি । তার মধ্যে মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা থেকে শুরু করে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া এবং ডারউইনের বিবর্তনতত্বের বই রয়েছে । ঘরের আরেকদিকে ছোট একটা খাটের উপর সাদামাটা বিছানা পাতা । টেবিলের আশেপাশে কয়েকজন বয়স্ক লোক বসে ছিলেন । এঁদের চশমা ও টিকির সঙ্গে মহামহোপাধ্যায় বা তর্কচঞ্চু উপাধি বেমানান নয় । যে দরজা দিয়ে ঢুকলেন বিহঙ্গ, তার পাশে একটা কাঠের বেঞ্চির উপর সতেরো আঠেরো বছর বয়সের একটা ছেলে একটু উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে বসে ছিল ।
মহেন্দ্রনাথ ও বিহঙ্গকে ঢুকতে দেখে সাগর শশব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন । অতিথিবত্সল লোকটির পরনে থানের ধুতি আর ফ্ল্যানেলের জামা । তিনি সহাস্যে বলছিলেন - আসুন, আসুন । বিহঙ্গ সাগরের মুখের দিকে চোখ রেখে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেলেন । আর তক্ষুনি তাঁর ভাবাবেশ হল ।
বিহঙ্গের দুহাত অঞ্জলিবদ্ধ, দেহ একেবারে নিস্পন্দ, চোখ বিস্ফারিত এবং মুখের ভঙ্গীতে উল্লাস । মহেন্দ্র এবং ভবনাথ বিহঙ্গকে দুদিক থেকে ধরে ধৈর্যযসহকারে দাঁড়িয়ে । সাগর প্রথমে ভেবেছিলেন ডাক্তারকে খবর দেবেন । তারপর মুহূর্তটি ত্রক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছে দেখে তাঁর মনে হল পুরো ব্যাপারটাই সাজানো । একটা অতিরিক্তরকমের নাটকীয় আবির্ভাব ঘটানোর জন্য বিহঙ্গ আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল । কিছুটা বিরক্ত আর কিছুটা হতাশ হয়ে সাগর ঠিক করলেন ডাক্তার ডাকার দরকার নেই । ফিটের ব্যাপারটা যদি পথশ্রমহেতু হয় তাহলে একটু জলমিষ্টি খাইয়ে দেখা যাক । আর যদি সাজানো হয় তাহলে এই প্রহসনে কোন ভূমিকাই পালন করবেন না তিনি । মৌনই হবে তাঁর সমালোচনার ভাষা । তাঁর নীরবতার ইঙ্গিত বুঝে যদি ভণ্ডগুলো পালায় তাহলে সব ভালো যার শেষ ভালো । মহামহোপাধ্যায় আর তর্কচঞ্চুর সাথে যে কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা জমে উঠেছিল সেটা শেষ করা যেতে পারে ।
বিহঙ্গ একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বেঞ্চের উপর বসতে যাচ্ছিলেন । সাগর জল আর মিষ্টি আনাবার ব্যবস্থা করলেন ।
শুনে ছেলেটা বেশ ঘাবড়ে যায় । মুক্তি টুক্তি নিয়ে ভাবছিল না সে । তার ধারণা হয় যে চাকরি হবে না একথাটাই বলা হচ্ছে তাকে । মুখটা আরো শুকিয়ে যায় তার । দূর থেকে সাগর তাকে ইঙ্গিতে জানান চুপ করে বসে থাকতে ।
বিহঙ্গ হঠাৎ সাগরের দিকে চেয়ে বললেন - এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি । এবার সাগর দেখলাম ।
সাগর বুঝতে পারলেন না, তাঁকে নিয়ে পরিহাস করা হচ্ছে কিনা । সাবধানের মার নেই । হাসতে হাসতে বললেন - হ্যাঁ, শুধু জলই মিলবে, তাও নোনা ।
বিহঙ্গ তাড়াতাড়ি বললেন - নোনা হবে কেন ? তুমি তো ক্ষীরের সমুদ্র । বিদ্যার সাগর, দয়ার সাগর । এত তোমার দয়া, তুমি তো সিদ্ধ পুরুষ ।
- অ্যাঁ ! আমিও সিদ্ধ পুরুষ ? সেটা হলাম কীভাবে ?
- কেন, আলু পটল সিদ্ধ হলে নরম হয় না ? তোমার মন তো খুব নরম । অত দয়া !
ঘরের সবাই, মায় চাকরিপ্রার্থী ছেলেটা পর্যন্ত এ-কথায় হাসতে শুরু করেছে । সাগর জীবনে বহু তর্কে জিতেছেন । কিন্তু সে সব তর্ক ছিল শুকনো পণ্ডিতি কচকচানি । এরকম প্রবল দিশি বাক্চাতুর্যের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তাঁর ভালো জানা নেই । তিনি আমতা আমতা করে বললেন - কিন্তু কলাই বাটা সিদ্ধ করলে শক্তই হয় !
- তুমি তা নও গো । তুমি তা নও । শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া ।
বিহঙ্গ সাগরকে বললেন যে পণ্ডিত যত উঁচুতে ওঠে শকুনের মত তার দৃষ্টি চলে যায় তত নিচুতে, ভাগাড়ে । সাগর এরকম দিশি পণ্ডিত অনেক দেখেছেন । নিজেকে তিনি কোনো অর্থেই পণ্ডিত বলে মনে করেন না । ছোটবেলা সস্কৃতের সম্যক্ জ্ঞানকেই পাণ্ডিত্যের পরিচয় বলে মনে করতেন । কিন্তু বড় হয়ে বুঝলেন সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা । এত কষ্ট করে যা শিখেছেন সেই ভাষাতে কথা বলতে সাহস হয় না তাঁর । লিখতে গেলে ভুল হয়ে যায় । যে সব পণ্ডিত বিদ্যা জাহির করার জন্য লেখে তাদের লেখাতেও দেখা যায় অসংখ্য ভুল । নিজের চেষ্টায় পরবর্তীকালে ইংরেজি শিখেছেন । সাগরের মনে হয় আরেকবার যদি ছোট থেকে বিদ্যার্জন শুরু করার সুযোগ তিনি পেতেন তাহলে এবার অংক আর বিজ্ঞানই হত তাঁর সাধনার বিষয় । নিউটনের দৃষ্টি কী ভাগাড়ের দিকে ? গ্যালিলিওর ? ডারইনের ? অথচ দেশের লোক জ্ঞান বিজ্ঞানের জগত্টা চিনলই না । এ কী এক সমাজ আমাদের যাতে পণ্ডিত বলতে লোকে শুধু চেনে লোভী ও দাম্ভিক কয়েকজন জোচ্চোরকে যাদের সত্যিকারের জ্ঞান সামান্য, বিচারবোধ স্বার্থসর্বস্ব এবং কোনো কিছু সৃষ্টি করার বা আবিষ্কার করার ক্ষমতা শূন্য ?
বিহঙ্গের প্রশংসার মধ্যেই রয়েছে বিদ্রুপ । সাগর তার কারণটা বুঝতে পারছিলেন না । তিনি তো কোনোদিন পাণ্ডিত্যের অভাবের জন্য কাউকে ছোট করেননি ।
বিহঙ্গ অনর্গলই কথা বলে চলেছেন । তাঁর কথার স্রোত একটি বিশেষ খাতে চলেছে । তিনি বলছেন ব্রহ্মবিদ্যার কথা । ব্রহ্ম নির্লিপ্ত । বিদ্যামায়া ও অবিদ্যামায়া দুয়েরই প্রতিই তার সমান অপক্ষপাত । অর্থাৎ তাকে লাভ করতে গেলে বিদ্যা ও অবিদ্যা দুইই অতিক্রম করা প্রয়োজন ।
সাগর বক্তব্যটা একটু একটু ধরতে পারছেন । অর্থাৎ পড়াশোনা করে যে জ্ঞান অর্জন করা যায় সে সবের উর্ধ্বে কোনো একটা উপলব্ধির কথা বলা হচ্ছে । সাগরের মতে অবশ্য এ সব মিস্টিক ব্যাপার স্যাপার বুঝতে চেষ্টা করাই বৃথা । `বিদ্যামায়া,' `অবিদ্যামায়া', `ব্রহ্মবিদ্যা' সবই এক একটা কথার ধাঁধা । কোনটারই মানে পরিষ্কার করে কেউ বুঝিয়ে বলে না ।
- ব্রহ্ম যে কী আজ পর্যন্ত কেউ মুখে বলতে পারে নাই । বলছিলেন বিহঙ্গ । - বেদে পুরাণে যা বলেছে - সে কিরকম বলা জানো ? যেন কেউ একজন সাগর দেখে ফিরেছে, তাকে জিজ্ঞেস করলে, কেমন দেখলে । সে শুধু মুখ হাঁ করে বলে - ও:, কী দেখলুম ! কি হিল্লোল কল্লোল ! এই হল তার বলা । ব্রহ্ম যে কী তা মুখে বলা যায় না । সব জিনিস উছিষ্ট হয়ে গেছে । বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড়্ দর্শন - সব এঁটো হয়ে গেছে ! মুখে উচ্চারিত হয়েছে যে ! কেবল একটি জিনিস উচ্ছিষ্ট হয় নাই । সে জিনিসটি ব্রহ্ম !
শেষ তুলনাটা বেশ লাগল সাগরের । মনে হল - না: লোকটার এলেম আছে তো ! বেশ কবিত্ব করে বলল জিনিসটা । পরক্ষণেই মনে হল - কিন্তু তাই বলে কি কোনো মানে হল কথাটার ? যদি তাকে মুখে না বলা যায়, লিখে না বোঝানো যায় তাহলে তোমার উপলব্ধি আর আমার উপলব্ধি সমান কিনা কী করে জানা যাবে ? এ তো একটা অমীমাংস্য ব্যাপারই দাঁডালো । যে কোন অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে এর তফাৎ কি ?
বিহঙ্গ এবার তাঁর সার কথাটি বলে নিচ্ছেন । কলিযুগে ব্রহ্মকে জানার একটাই উপায় । ভক্তি । পাণ্ডিত্যকে অতিক্রম করে যেতে হবে কোথায় ? না বিশ্বাসে । সাগর একটু রুষ্ট হলেন । কথাটা যে আপামর জনতা খাবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । পড়াশোনা করো, অনুসন্ধান করো, গবেষণায় মন দাও এ সব বলে কখনো জনপ্রিয় হওয়া যায় নাকি ? কিন্তু যদি বল চৈতন্যদেবের মত দুহাত তুলে নৃত্য করতে তাহলে বঙ্গসন্তান সর্বদাই রাজি । ভাবলেন একবার বলবেন - মহাশয় এইসব আগডুম বাগডূম কথা বলে লোকগুলোকে আরো অপদার্থ না করে তুলে যদি কিছু কাজের কাজ করতে বলতেন তাহলে অন্তত এদের ছেলেমেয়েগুলো খেয়ে পরে বাঁচত ।
বিহঙ্গ বলছিলেন - গীতা পড়ে কী হবে ? কী আছে ওতে ? `গীতা' কথাটা দশবার বল্লে কী হয় ? না 'ত্যাগী' `ত্যাগী' । সেটাই গীতার শিক্ষা । আসক্তি ত্যাগ করে ঈশ্বরকে লাভ করার চেষ্টা কর ।
যখনই সাগর ভাবেন প্রতিবাদে কিছু বলা উচিৎ তখনই এরকম একটা দারুণ কিছু বলছেন বিহঙ্গ যে সাগরের মুখ বন্ধ হয়ে যায় । হঠাৎ তাঁর ভীষণ ভয় হতে থাকে । একেই কী বলে সম্মোহন ? আচ্ছা এমন তো নয় যে এক অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিকাল ব্যক্তিত্ব তার সম্মোহনের জাল আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনছে চারদিকে ? এই যে মহেন্দ্রনাথ গম্ভীরমুখে ঘন ঘন মাথা নাড়াচ্ছে - এ ছোকরার তো ইংরেজি বিদ্যে কম নয় । বিহঙ্গের এইসব ভাবাবেশ দেখতে দেখতেই কখন নিজের অলক্ষ্যে তিনিও কি এদের মত ভক্ত হয়ে যাবেন ? সাগরের দম বন্ধ হয়ে আসছে ।
সাগর মনে মনে গরুড়পুরাণের যাজ্ঞবল্ক্য সূক্ত আওড়াতে থাকেন । জীবনে বহু যুদ্ধে নেমেছেন তিনি । জয়ের চেয়ে পরাজয়ের সংখ্যাই বেশি । পরাজয়ের পঙ্ক থেকে আবার উঠে আসার সময় তিনি শাস্ত্রের সেই শ্লোকগুলি ভাবেন যাতে তাঁর ক্রোধ বৃদ্ধি হয় এবং বাহুতে বল আসে ।
রক্ষেৎ কন্যা পিতা বাল্যে যৌবনে পতিরেব তাম্ ।
বার্ধক্যে রক্ষতে পুত্রো হি অন্যথা জ্ঞাতয়স্তথা ॥
নিজের সম্মুখে একটি অর্বাচীন প্রতিদ্বন্দ্বীকে কল্পনা করে কুলীনপ্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে একটি নতুন যুক্তি নিয়ে ভাবতে থাকেন সাগর ।
বিহঙ্গ বললেন - আমাদের ওদিকে এসো কিন্তু । ভুলবে না তো ?
- পাগল ? সে আর ভুলি ?
মনে মনে সাগর বললেন - নৈব নৈব চ ।
ঘোড়াগাড়িকে রওনা করে দিয়ে সাগর যখন ফিরলেন ঘরে তখন চাকরির জন্য আসা ছেলেটা ক্লান্ত হয়ে হাই তুলছে । সাগর তার জন্য ভাত আনতে বলে তাকে ঠেলেই তুললেন একরকম । তারপর ধরে ধরে চটপট ইংরেজিতে দরখাস্ত লেখালেন একটা । লেখা শেষ করে ছেলেটা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল ।
মহামহোপাধ্যায় আর তর্কচঞ্চু আগেই বিদায় নিয়েছিলেন । বাতির আলোয় দ্রুত টেবিলের উপর রাখা চিঠিগুলো পড়তে শুরু করলেন সাগর । প্রথমটা শুরু হয়েছে এভাবে -
মহাশয়, আমি যখন বিধবা হই তখন আমার বয়:ক্রম তেইশ । তখন আমার কন্যা সন্তানের বয়:ক্রম ছিল দুই । ইচ্ছা ছিল তাহার বিবাহ সম্পন্ন করিয়া কাশী চলিয়া যাইব । আজ কন্যার বয়:ক্রম আট পুরাইয়াছে । সে স্বামীগৃহে যাইবার পূর্বেই বিধবা হৈয়াছে । আপনি মহানুভব, কি করিয়া তাহার প্রতিপালন কর্ব্ব বলিয়া দিন ।ডাল আর আটার রুটির খাওয়া সারতে সারতে সাগর বাকি চিঠিগুলোর উপর চোখ বোলাতে লাগলেন ।
বিহঙ্গ মুখের সামনে একটা তুড়ি মেরে বললেন - শালা সত্বগুণ থাকলেই কি ঈশ্বর মেলে ? লোকটা জ্ঞানী, দানী হতে পারে কিন্তু ব্রহ্মের খপর নাই । শোন একটা গল্প বলি । এক বনের মধ্যে দিয়ে এক গেরস্থ যেতে যেতে পথ হারিয়েছিল । তাকে ধরল তিন চোর । এক চোর বলল - আয় এটার গলা কাটি । অন্য এক চোর বলল - তার চেয়ে টাকাকড়িগুলো কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দে । তারপর তারা টাকাগুলো নিয়ে পালাল । একটু পরে তৃতীয় চোরটা ফিরে এল, কিছু টাকাও সে ফেরৎ আনলে । সে লোকটাকে বলল - চলো তোমাকে বাড়ির পথ দেখিয়ে দিই । সে যত্ন করে গেরস্থকে তার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল । লোকটা বড় খুশি, সে চোরের হাত ধরে বলল - তুমি এতদূর এলে তো বাড়ি অবধি চলো ভাই । তখন সে চোর হাত ছাড়িয়ে পালাচ্ছে । বলছে - পাগল, ও বাড়িতে গেলে পুলিশ ধরবে ।
বিহঙ্গ বললেন - এই তিন চোর হল সত্ব, রজ: আর তমোগুণ । তমোগুণ তো মানুষের বিনাশ চায় । রজ: অর্থলাভ করায় । আর সত্বগুণ হাত ধরে তাকে ব্রহ্মজ্ঞানের দরজা অবধি নিয়ে যায়, কিন্তু নিজে সেখানে যেতে পারে না । কারণ সেখানে তো পুলিশ । ব্রহ্মজ্ঞান হল ত্রিগুণাতীত । একে পেতে গেলে সত্বকেও ছাড়াতে হবে । কলিতে একে পেতে গেলে চাই বিশ্বাস, চাই ভক্তি । তোমাদের সাগরের সে চোখ হয়নি এখনও হে ।
ভবনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও প্রতাপচন্দ্র তিনজনেই মাথা নেড়ে স্বীকার করলেন কথাটা ঠিক ।
বিহঙ্গের দুচোখ দিয়ে গড়াচ্ছিল অনবরত অশ্রু । মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত । তিনি অং বং চং বলে উল্টোপাল্টা মন্ত্রে পূজো করতে লাগলেন বালিকাটিকে । মাঝে মাঝে গাঁদা ফুলে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন তার দিকে । আস্তে আস্তে তাঁর বাহ্যজ্ঞান লোপ পেতে লাগল । পূজারীর আসনে বসে পাথরের মূর্তির মত জড় ও জমাট হয়ে গেল তাঁর শরীর । দেহের স্বেদবিন্দুগুলো বরফের কুঁচি হয়ে খসে পড়তে লাগল ধুতির উপর । চাঁদের কিরণ তুষারের ফলার মত বিদ্ধ করছিল মন্দিরের চত্বরে সমস্ত কীট পতঙ্গদেরও । তারাও দেখতে দেখতে শীতল ও জড় হয়ে ভেঙ্গে যেতে লাগল ।
লালপেড়ে শাড়ি পরা মেয়েটা মন্দিরের মেঝে থেকে উঠে পড়ে ফিস ফিস করে বলল - চুপ করে বোস । আমি আসছি এক্ষুনি ।
এই বলে মেয়েটা এক ছুটে বেরিয়ে এল রাস্তায় । হাওয়ার উপর ভর দিয়ে সে উড়তে শুরু করল । একটু পরে তাকে দেখা গেল বাদুড়বাগানের গলি দিয়ে একটা পাঁচিলঘেরা বাগানবাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে ।
সাগর নিজের পড়ার ঘরের একদিকে খাটের উপর চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছিলেন । মেয়েটা সেই ঘরে ঢুকে পড়ে একমুহূর্তের জন্য থামল । হঠাৎ তার শরীরটা সূক্ষ্ম হতে হতে বায়ুর মত পাত্লা আর ধুলোর মত ক্ষুদ্র হয়ে গেল । সে এক লাফে টুক করে নেমে পড়ল সাগরের মস্তিষ্কের মধ্যে । একেবারে তার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে সে থামল ।
সাগর ঘুমের মধ্যে অনুভব করলেন তাঁর কাছে একটা সাত আট বছরের মেয়ে এসেছে । তার পরনে বৈধব্যের সাদা থান ।
সে রিন রিন করে বলল - কি সাগর, আমাদের কী হবে বলে দিলি না তুই ?
ঘুমের মধ্যে সাগরের ঠোঁট বিড়বিড় করে নড়তে লাগল । তিনি বলতে চাইলেন - তিন জায়গায় দরখাস্ত করে দিয়েছি । কাল নিজে গিয়ে তদ্বিরও করে আসব । কোথাও না কোথাও একটা মাসোহারার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে । কিছু টাকা মনি-অর্ডার করেও পাঠাচ্ছি পত্রপাঠ । আমি থাকতে ভয় কী ?
- ঠিক তো ? কথার খেলাপ হবে না তো ?
সাগরের চিন্তা হল । বাষট্টি বছর বয়স । যদি মরে যাই কাল ? তাহলে এদের মাসোহারার কী হবে ? না:, ছোট মেয়েটাকে এ কথা বলা যায় না । মরলে চলবে না । নিজেকে শক্ত সমর্থ ও যুবা থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন সাগর । ঘুমের মধ্যে তাঁর ডান হাতের তর্জনী সোজা হয়ে গেল ।
- ঠিক ।
- না তুই কথা দে । সত্যি করে বল যতদিন বেঁচে আছিস ততদিন তোর কাছে এসে বাংলাদেশের কোন মেয়ে অভুক্ত থাকবে না । কোন অত্যাচার হতে দিবি না তুই তাদের উপর । বল । কথা দে । দিবি না ?
এত শক্ত কথা কী দেওয়া যায় ? এই বয়সে ? সাগরের দুই হাতের পাঞ্জা তাঁর নিজের অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল । কিন্তু মেয়েটা বোধহয় কথা আদায় করেই ছাড়বে ।
- দিলাম ।
পরম সন্তোষে তাঁর অং বং চং ইত্যাদি উল্টোপাল্টা সরল মন্ত্রের শিশুসুলভ পূজো উপভোগ করতে থাকল বাচ্চা মেয়েটা ।
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)