বইটিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং কবিতা থেকে বাছা প্রায় দুশোটি চরিত্র সম্পর্কে একটি করে নাতিদীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে । এই বর্ণনা পড়ে মূল রচনার আখ্যানটি সম্পর্কে পাঠকের একটা ধারণা হবে ।
বইয়ের গোড়ায় শ্রী সিংহরায় নিজে একটি সাত-পাতার দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন । তাতে বলা হয়েছে, যে এই অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য ইংরেজি-জানা (এবং বাংলা পড়তে না-জানা) পশ্চিমের পাঠকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার পরিচয় ঘটানো । এ-সঙ্গে মনে রাখা ভালো যে ভারতবর্ষে বাঙালি বাদের অনেক সাহিত্যরসিক আছেন । ইংরেজি অনুবাদটি তাঁদের কাজে লাগতে পারে ।
রবীন্দ্রনাথের গদ্য এবং গদ্য ধরনে লেখা পদ্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে যে ধরনের অসুবিধে হয়, তার অনেকটাই এ-ক্ষেত্রেও হওয়া স্বাভাবিক । কারণ বিশেষ করে ছোট গল্পের ক্ষেত্রে, চরিত্রবর্ণনার অনেকটাই হলো মূল গল্পের নির্বাচিত কিছু বাক্যের অনুবাদ । সেই মূল গদ্যের ধরন স্বভাবত বাঁকা -- নানা ধরনের শ্লেষ, অনন্ত উপমা এবং "মেটাপয়রে" সেই গদ্য অদ্ভুত এবং অনন্য । ইংরেজি ভাষার সহজ এবং সরাসরি বাচনভঙ্গির সঙ্গে তার মিল খুব কম -- বর্তমান বইটিতে অনুবাদিকা প্রায় আক্ষরিক অনিবাদ করে সু-বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন । ফলে হয়তো অনেক অংশ ইংরেজি-ভাষী মানুষের কানে খুব বেমানান অতহবা আড়ষ্ট শোনাবে । কিন্তু একটু অভ্যেস হয়ে এলে বুদ্ধিমান পাঠক হয়তো মূল আখ্যান এবং চরিত্রগুলির সূক্ষ্ম বিশেষত্বগুলি ভালো করে ধরতে পারবেন । যেমন "মুক্তির উপায়"-এ গুরুদণ্ড-প্রাপ্ত ফকিরচাঁদ "
তুর্নেদ দোষন থেইর অপ্পেঅল তো রেসুমে হিস স্তুদিএস. ঠে গুরু ষস অগৈনসত থে পস্সিনগ ওয় এক্ষমিনতিওনস. " (পৃ: ৮৮) ।বইটির সম্পর্কে একটি অসন্তোষের কথা বলি । চরিত্রগুলি সাজানো হয়েছে ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী । এ-বাদে একটি কালসূচি আছে--সেটাও একইভাবে ত্রক্রমান্বিত । আদ্যক্ষর অনুযায়ী চরিত্রগুলিকে সাজিয়ে বইটির ধারাবাহিক পাঠযোগ্যতা অনেকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে মনে হয় । পরীক্ষার্থী বা গবেষক যদি রেফারেন্স হিশেবে এ-বই ব্যবহার করেন, তবে আদ্যক্ষর-ভিত্তিক একটি সূচিপত্র করা যেত । মূল বাংলা রচনাটি উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক প্রভৃতি খণ্ডে ভাগ করা । এখানে সেরকম কোনো ভাগও নেই । পর পর "চৈতালী পূর্ণিমা", "চারুলতা", "চিত্রাঙ্গদা"র মতো সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের এবং আলাদা অর্থে "চরিত্র"-গুলির কথা পড়তে খুবই অদ্ভুত এবং খটোমটো লাগে । একটি পরিশ্রমসাপেক্ষ বিকল্প হতে পারে এইরকম । ধরা যাক "গৃহবধূ" ধরনের চরিত্রগুলিকে পর পর রচনাকাল অনুযায়ী সাজানো যেতে পারে -- যেমন চারুলতা ("নষ্টনীড়"), বিমলা ("ঘরে বাইরে"), চন্দরা ("শাস্তি"), কুমুদিনী ("যোগাযোগ") । এবং একটি আদ্যক্ষরভিত্তিক সূচিপত্র করে দিয়ে রেফারেন্স-যোগ্যতাও বজায় রাখা যেতে পারে একই সঙ্গে । কালক্রমে লেখকের ভাষা ও ভাবনার যে পরিণতি ঘটেছিল তার একটা ছবি তাহলে হয়তো প্রকাশ পাবে ।
বইটির বাঁধাই ভালো, ছাপার ভুল আমার চোখে পড়েনি ।
(পরবাস-৩৮; ডিসেম্বর, ২০০৬)