• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৮ | জানুয়ারি ২০০৭ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থসমালোচনা : `এই পৃথিবীর তিন কাহিনী', ও`জল ফুঁড়ে আগুন' - কেতকী কুশারী ডাইসন : সুমনা দাস সুর

    কেতকী কুশারী ডাইসন, `এই পৃথিবীর তিন কাহিনী : নারী, নগরী/ নোটন নোটন পায়রাগুলি/ ভাসিলি', পরিমার্জিত নূতন সংস্করণ, ছাতিম বুক্স্‌, কলকাতা ১৬, জানুয়ারি ২০০৬; `জল ফুঁড়ে আগুন', আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা ৯, জুন ২০০৩



    `এই পৃথিবীর তিন কাহিনী'-র নামেই প্রকাশ পায় তার ব্যাপ্তি । এই সংকলনের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বিভিন্ন সময়ে রচিত তিনটি আখ্যান । এর মধ্যে `নারী, নগরী' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ খ্রি:, `দেশ' পত্রিকায় । এটি কেতকীর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা । পরে, ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । এই সংকলনের দ্বিতীয় কাহিনী লেখিকার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস `নোটন নোটন পায়রাগুলি' । এটি গড়ে ওঠে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় জুড়ে । `দেশ'-এ ১৯৮১-৮২ সালে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর বই হয়ে বেরোয় ১৯৮৩-তে । তৃতীয় অর্থাৎ সর্বশেষ রচনাটিকে গোত্র বিচারে বড়গল্প বলা যায় । `ভাসিলি' নামের এই গল্পটি ১৯৯৯ সালে `দেশ'-এর শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । ইতিপূর্বে কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত হয়নি । এই তিনটি কাহিনীই বহুদিন বইয়ের বাজারে সহজপ্রাপ্য নয় । আগ্রহী পাঠককে স্বতন্ত্রধারার এই রচনার স্বাদ গ্রহণ করতে হলে লাইব্রেরি কিংবা অন্য কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছে । ছাতিম বুক্স্‌-এর উদ্যোগে এক প্রজন্মব্যাপী এই অভাববোধ, এই শূন্যস্থান পূর্ণ হল । বাংলা প্রকাশনার জগতে সদ্য আগত এই সংস্থাটির অভিনন্দন প্রাপ্য তাদের উচ্চমানের কাজের জন্য । দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ছাপা এবং বাঁধাই-এ যত্নের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় । খরচ কমাতে হরফগুলিকে ক্ষুদ্রাকৃতিতে নামিয়ে এনে বইয়ের আয়তন হ্রাসের চেষ্টা করা হয়নি । চোখকে এতটুকু কষ্ট না দিয়েও ছশো একাত্তর পৃষ্ঠার বইটি পড়ে যাওয়া যায় ।

    `নারী, নগরী'কে কেতকী `আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা' আখ্যা দিলেও এটি মূলত তাতয়ানা আন্তনভের জীবনের কাহিনী -- যে নামের আড়ালে থাকা বান্ধবীকে বইটি তিনি উত্সর্গ করেছেন । আরও খানিকটা বিস্তৃতভাবে বলা যায় তাতয়ানা, তার মা মাদাম্‌ আন্তনভ্‌ এবং দিদিমা মাদাম নার্সিসিয়েন -- এই তিন প্রজন্মের গল্প বলেছেন তিনি এখানে । যার চালচিত্র রচনা করেছে প্যারিসের উপকন্ঠে ম্যদঁর শহরতলির পরিবেশ, মানুষজন ও তাদের জীবনযাত্রা ।

    অক্সফোর্ডে লেখিকার ছাত্রজীবনের বন্ধু তাতয়ানা । একই ছাত্রাবাসে কিছুদিন থাকার সুবাদে তাদের পরিচয় । কলেজের পাট শেষ হলে দেশে ফেরার প্রাক্কালে লেখিকা কিছুদিনের জন্য ম্যদঁতে তাতয়ানা ও তার পরিবারের আতিথেয়তা স্বীকার করেন । অক্সফোর্ডে অন্তরঙ্গ আলাপের মুহূর্তে তাতয়ানার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তথা স্ববিরোধগুলি তাঁর মনে যুগপৎ কৌতূহল ও আকর্ষণ জাগাতো । তাতয়ানা একাধারে রোমান্টিক, আবেগপ্রবণ এবং অন্তর্মুখী । তার স্বভাবে কৌতুকপ্রিয়তা, ছেলেমানুষী এবং তীব্র আত্মমর্যাদাবোধের মিলমিশ । তাতয়ানা তার উনত্রিশ বছরের জীবনের একাধিক সম্পর্ক ভাঙা এবং গড়ার গল্প শুনিয়েছিল তার ভারতীয় বান্ধবীকে । তার জীবনে পর্যায়ক্রমে এসেছে এক আফ্গান, এক ফরাসী যুবক, এবং এক ইংরেজ । সম্পর্কের এই ক্ষণিকতার জন্য দায়ী কি তাতয়ানার বিভিন্ন সময়ের প্রেমিকেরা নাকি সে নিজেই ? এর উত্তর একভাবে খুঁজে পাওয়া যায় তাতয়ানার জীবনের গভীরে নামলে - যা ছড়িয়ে আছে তাদের পরিবারের তিন প্রজন্মব্যাপী ইতিহাসে । জন্মসূত্রে রুশ-আরমানী রক্তের উত্তরাধিকারী, ধর্মে অর্থডক্স, ফ্রান্সে বসবাসকারী তাতয়ানার অন্তর্গত চেতনায় একাধিক স্রোত প্রতিস্রোত ত্রক্রীড়া করে - যা তার জীবনের ছন্দকে করে তোলে অস্থির, বিপর্যস্ত । তার ভিটেচ্যুত দিদিমা - যাঁকে বৃদ্ধ বয়সে এতটুকু আশ্রয়ের জন্য সন্তানদের দোরে দোরে ঘুরতে হয়, তার স্বামী-পরিত্যক্তা মা - যাঁকে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় - এঁদের জীবনের অতীত ইতিহাস এবং ভাঙা স্বপ্নের বর্তমান ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাতয়ানাকে; তার নিজের ঘর বাঁধার স্বপ্নকে অলীক, বিভ্রম বলে মনে হয় ।

    তাতয়ানার এমিগ্রে জীবনের দ্বন্দ্ব এবং যন্ত্রণা এই স্মৃতিভিত্তিক কাহিনীর কেন্দ্র হলেও প্রকৃতি এবং চলমান জীবনের স্রোত এখানে উপেক্ষিত নয় । অক্সফোর্ডে থাকাকালীন নৈশবায়ু সেবনের নামে নির্জন পথের দুধারে গৃহস্থবাড়ির বাগানের উপচে পড়া ডাল থেকে ফুল ছিঁড়ে আনার বর্ণনায় দুই বান্ধবীর পুষ্পপ্রীতির সঙ্গে মিশে থাকে তরুণ বয়সের ছেলেমানুষী এবং উত্তেজনার আগুন পোহানোর ইচ্ছা । ইংরেজ এবং ফরাসী জাতির বাগানবিলাসে রুচির রকমফের উস্কে দেয় তাদের চিরন্তন প্রতিতুলনাকে । প্রাক্‌-বাস্তিল রজনীর উদ্দাম উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি আছে উষাকালে, ব্রাহ্মমুহূর্তে দেখা মহিমময়ী নোতরদাম্‌-এর বর্ণনা ।

    ১৯৮১ সালে `নারী, নগরী' যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তখন কেতকী তার ভূমিকায় লিখেছিলেন, "... `নোটন নোটন পায়রাগুলি', যেটি এখন `দেশ'-এ বেরোচ্ছে - সে-পরিণতির বীজ, আমার তো মনে হয়, নিহিত আছে এই `নারী, নগরী'তেই ।" (পৃ.১৭) `নারী, নগরী'র যে ভাবনাবীজ `নোটন নোটন পায়রাগুলি'তে বৃক্ষের পরিণতি পেয়েছে তার কয়েকটি অভিমুখকে সনাক্ত করা যায় । প্রথমত, বিংশ শতকীয় নারীভাবনা - যা শুধুমাত্র লিঙ্গবৈষম্যের প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর ও ব্যাপকতর এক পরিসরে পৌঁছোয় । নারীর বৈদগ্ধ, মনন এবং আত্মমর্যাদাবোধের স্বীকৃতি দাবী করে । দ্বিতীয়ত, লেখিকা স্বভাবতই তাঁর পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে উত্সুক এবং কৌতূহলী । অধ্যয়নের সুবাদে তরুণ বয়সে বিদেশ বাস এবং তারপর সে দেশে বিবাহ করে সংসারজীবনযাপন তাঁর সেই সহজাত প্রবণতার শিকড়ে জলসিঞ্চন করেছে । ফলত:, অধুনা প্রচলিত অর্থে বিশ্বায়নের বহু পূর্বেই তাঁর চেতনা বিশ্বায়িত । আন্ত:সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান তাঁর কাছে হাওয়া বাতাসের মতোই স্বাভাবিক । তৃতীয়ত, লেখিকার এই বিশ্ববীক্ষা বহুস্তরান্বিত । একদিকে যেমন তিনি মানবিক সম্পর্কের অন্দরমহলে প্রবেশ করেছেন, মিশ্রবিবাহ ও মিশ্ররক্তের উত্তরাধিকারের বিভিন্ন দিককে তুলে এনেছেন, তেমনই ইতিহাসের পালাবদল কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনীতি - রাষ্ট্রনীতিও তাঁর বিচরণক্ষেত্রের বাইরে থাকেনি । চতুর্থত, শিক্ষায় এবং মননে আন্তর্জাতিক মানসিকতার হলেও লেখিকার সত্তা পরিচয় পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়না কখনো - বরং তা আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে - মাতৃভাষায় লেখালেখি করা যার অন্যতম । `হাইব্রিডিজম্‌'-এর পক্ষপাতী হলেও ঐতিহ্যের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ । তাঁর গল্প উপন্যাসে যে মানুষগুলির কথা তিনি বলেন তাদের মধ্যেও এই আত্মপরিচয়ের খোঁজ অন্ত:সলিলা ধারায় প্রবাহিত ।

    `নোটন নোটন পায়রাগুলি'র নারীভাবনা বিষয়ে কেতকী তাঁর বইয়ের মুখবন্ধে বলেন, "এই উপন্যাসে... সত্তরের দশকের নারী-আন্দোলনের ফসল ঘরে আনা হয়েছে" । (পৃ. ৯) কেতকী কুশারীর কথাসাহিত্যের এই দিকটি নিয়ে ইতিপূর্বে লেখা একটি প্রবন্ধে আমি মোটামুটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি (লিলিথ ও তার সঙ্গিনীরা / পুরবৈয়াঁ / ৭ম বর্ষ / ১ম সংখ্যা / জুলাই ২০০১) । `নারী, নগরী'র তাতয়ানা ছিল কিছুটা বিভ্রান্ত । একদিকে হৃদয়াবেগ, ঘর বাঁধার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে দু:খিনী মায়ের প্রতি কর্তব্যবোধ এবং এমিগ্রে জীবনের বঞ্চনা মিলে মিশে অস্থির, অনিশ্চিত তাতয়ানার জীবন । তাতয়ানার জীবনের সঙ্কট ও দ্বন্দ্বগুলিকে যেন প্রিজম্‌-এর মধ্যে ফেলে বর্ণভঙ্গ ঘটিয়েছেন লেখিকা `নোটন নোটন পায়রাগুলি'-তে । কিংবা বলা যায় অনেকগুলি নদী যেন তাদের উত্স থেকে নির্গত হয়ে নিজস্ব ছন্দ ও গতিতে খুঁজে চলেছে কাঙ্ক্ষিত মোহনা । ফতিমা হাচিনসনের ডায়রিতে নোটন লিলিথের মিথ-এর সন্ধান পায় - যা ত্রক্রমশ পরিণত হয় এর কেন্দ্রীয় নারীভাবনার প্রতীকে । আদম্‌-এর প্রথম সঙ্গিনী ছিল লিলিথ । কিন্তু সে পুরুষ অর্থাৎ আদমের সমান অধিকার দাবী করায় ঈশ্বর তাকে বন্দিনী করে সৃষ্টি করেন ঈভকে, যে কায়মনোবাক্যে মেনে নেবে আদমের শ্রেষ্ঠত্ব । এই উপন্যাসে এরিকা গ্রেগ, ভ্যালেরি রলিনসন, পিক্সি স্কিনার, ফ্রাঁসোয়াজ বেনেট, ফতিমা হাচিনসন, ফিয়োনা স্যণ্ডারসনের জীবনের ঘর ও বাহিরের গল্পে ধরা পড়ে লিলিথ ও ঈভ-এর সেই চিরন্তন লড়াই । তারা কখনো লিলিথ হয়ে সমান অধিকার চায় আবার কখনো বা ঈভ হয়ে কম্প্রোমাইজ করে ।

    ১৯৭৮-৭৯ সালে যখন `নোটন নোটন পায়রাগুলি' ত্রক্রমশ গড়ে উঠছে সেই সময় একটি ইংরাজি প্রবন্ধ লেখেন কেতকী - "Towards a Multi-Dimensional Women's Movement"; পরে, ১৯৮৫-তে `জিজ্ঞাসা' পত্রিকার জন্য এর একটি বাংলা রূপ দেন `বহুমাত্রিক নারী-আন্দোলনের অভিমুখে' - নাম দিয়ে । বাংলা প্রবন্ধটি বর্তমানে তাঁর প্রবন্ধ সংকলন `চলন্ত নির্মাণ'-এর অন্তর্গত হয়েছে । এই প্রবন্ধে লেখিকা বিভিন্ন মহাদেশের, বিভিন্ন স্তরের মেয়েদের জীবনের ছবি তুলে এনেছেন - স্থান পেয়েছে তাদের শোষণ, বঞ্চনা এবং প্রতিবাদের ইতিবৃত্ত । বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র চাষী পরিবারের মেয়েদের কথা যেমন আছে, তেমনই আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃতী মেয়েদের প্রসঙ্গ । এরই সঙ্গে যুক্ত করেছেন লেখিকা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাকে । কানাডা এবং গ্রেট ব্রিটেনে তাঁর সংসার-জীবনের প্রথম পর্বে একাধারে মা, স্ত্রী এবং গৃহকর্ত্রীর ত্রিবিধ দায়িত্ব সামলে কেমনভাবে গবেষণার কঠিন শৃঙ্গে আরোহণ করলেন সংক্ষেপে অথচ মর্মস্পর্শী বর্ণনায় সেই ইতিহাস বিবৃত করেছেন তিনি । পাশাপাশি পড়লে বোঝা যায় `নোটন নোটন'-এর নারীভাবনারই সম্প্রসারণ এই প্রবন্ধ । লেখিকার নিজের ভাষায় চেতনার `সর্বত্র বিকীর্ণ তরঙ্গমালা' ।

    তবে এই উপন্যাস শুধুমাত্র মেয়েলী সংলাপেই সীমাবদ্ধ নয়, সমকালীন দেশ-কালের প্রতিও বিশ্বস্ত । ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের নির্বাচন জয় সহ সত্তরের দশকের শেষভাগের রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনাসমূহের রেখাচিত্র এখানে ধরা পড়েছে । মধ্যপ্রাচ্যের ছাত্রদের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উড়ে এসে বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যা শিক্ষার প্রবণতাও এইসময় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায় । নোটন-এর স্বামী অতীনের `সায়ন্স স্কুলের' ছাত্রসমাগমের বর্ণনায় বিষয়টি ধরা পড়েছে । নোটনের বান্ধবী এরিকা ও তার স্বামী আইভান প্রোটেস্টান্ট আইরিশ । তাদের পারিবারিক সমস্যা ও দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে উঠে এসেছে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্টদের চিরন্তন বিরোধের প্রসঙ্গ । অপর এক বান্ধবী ফতিমার জন্ম আলজেরিয়ায় । তার স্মৃতির পথ ধরে উপন্যাস পৌঁছে গেছে কন্সটানটাইনের মুসলমান খানদানের অন্ত:পুরে ।

    `নারী, নগরীর' সময় থেকেই মিশ্র বিবাহের ফলে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান এবং সঙ্করায়ণ কেতকীর আগ্রহের বিষয় । এসব ক্ষেত্রে তিনি কেবল বাইরের গল্পটা বলেই থেমে যাননি, জাল ফেলেছেন দুটি মানুষের সম্পর্কের গভীর জলাশয়ে । যেমন, ফতিমা ও তার ইংরেজ স্বামী ডেরেক হাচিনসন অথবা কুইবেকের ফরাসীভাষী মেয়ে ফ্রাঁসোয়াজ এবং তার ব্রিটিশ স্বামী স্যাণ্ডি বেনেট । এরা তাদের দাম্পত্য জীবনে জল ও দুধের মতো মিশ খায় না, অনেকক্ষেত্রেই, তেল ও জলের মতো আলাদা হয়ে থাকে । ফতিমা কিংবা ফ্রাঁসোয়াজের আত্মিক সংকট প্রমাণ করে আধুনিক, বিশ্বায়িত মানুষের হাইব্রিড আইডেন্টিটির গভীরে প্রতিনিয়ত যে অভিযোজন প্রক্রিয়া চলে তা নেহাত সহজ নয় ।

    উপন্যাস এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিনে নিতে পারি নোটন, তাতয়ানার বাঙালি বান্ধবীটিরই সম্প্রসারণ । তারই মতো মিশুক, তারই মতো জীবন ও জগৎ সম্পর্কে উত্সুক এবং তারই মতো প্রকৃতির মধ্যে সে নিজেকে আবিষ্কার করে । উপন্যাসের শুরু ১৯৭৮-এর সেপ্টেম্বরে, শেষ ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে, গ্রীষ্মাবকাশের শেষে এসে । মধ্যবর্তী এক বছরের সময়সীমায় ঋতুবদলের প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূর্চ্ছনাকে ছুঁয়ে গেছেন লেখিকা । আকাশের রং থেকে গাছের পাতার রং বদল, পাখির ডাক, মরসুমী ফুলেদের ফুটে ওঠা কিংবা ঝরে যাওয়াকে সংসক্ত আবেগে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি । নাগরিক বৈদগ্ধের উপন্যাসে প্রকৃতির সারল্য ও স্বত:স্ফূর্ততাকে সোনালী পাড়ের মতো বুনে তোলায় এক চমত্কার, স্পর্শযোগ্য বৈপরীত্যের সৃষ্টি হয়েছে ।

    প্রাথমিক পাঠে `ভাসিলি'কে `নারী, নগরী'র ঢঙে লেখা আত্মজৈবনিক রচনা মনে হয় । সম্ভবত এই কারণে যে এটিও উত্তমপুরুষীয় বয়ানে নিবদ্ধ এবং `নারী, নগরী'র মতো স্বনামে উপস্থিত না থাকলেও বক্তার যে রেখাচিত্রটি ফুটে ওঠে তার সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই লেখিকাকে একাত্ম মনে হয় । যেমন, রবীন্দ্রনাথের ছবির বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিত্সা, ভাসিলিকে রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ পড়তে দেওয়া, তাঁর ইংরেজ স্বামী - প্রভৃতি ইঙ্গিত যে চরিত্রের সিল্যুটটি তৈরি করে সেটিকে যেন স্বয়ং কেতকীরই বলে সনাক্ত করার ইচ্ছা জাগে পাঠকের মনে । বিশেষত, কেতকীর 'Memories of Argentina and Other Poems' বইয়ের "The Mysterious Universe" -এর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় এই কাহিনীর কয়েকটি দৃশ্য সংস্থানের । যেমন, মোনের চিত্রপ্রদর্শনীতে যাওয়া, চায়না টাউনে মধ্যাহ্নভোজন, টি. ভি-তে দক্ষিণ আমেরিকার দুর্গত শিশুদের বিষয়ে তথ্যচিত্র দেখা প্রভৃতি । সেপ্টেম্বর ১৯৯৯-তে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থ । একই বছর শারদীয় `দেশ'-এ প্রকাশিত হয় `ভাসিলি' । সমসময়ে সৃষ্ট সাহিত্যের দুটি স্বতন্ত্র জাঁর-এর এই ধরনের ওভারল্যাপিং খুব স্বাভাবিক । অবশ্য লেখিকা জানিয়েছেন, ভাসিলি তাঁর বাস্তবে দেখা কোনো একটি চরিত্রের হুবহু প্রতিবিম্বন নয় । এটি নির্মাণের আকর তিনি সংগ্রহ করেছেন একাধিক উত্স থেকে এবং তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে । আর মানুষের কল্পনা তো অবিমিশ্র কোনো বস্তু নয়, অভিজ্ঞতার নির্যাস তাতে মিশে থাকেই ।

    `ভাসিলি' নামের বড়গল্পটিতে `গল্প' তেমনভাবে কিছু নেই । অবশ্য কেতকীর কোনো রচনাতেই তথাকথিত গল্প বলার ঝোঁক দেখা যায় না । স্তরান্বিত জীবনের তন্বিষ্ঠ পাঠেই তিনি অধিক যত্নবান । ভাসিলির জীবনের কাহিনীকে ব্যক্তিবিশেষের জীবন নিয়ে গড়ে তোলা ডকুমেন্টারি ফিল্মের ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেন তিনি ।

    ভাসিলির সঙ্গে কথকের প্রথম সাক্ষাৎ ইংল্যাণ্ডের এক আর্ট গ্যালারির প্রাঙ্গণে, "গৈরিকপত্রশোভিত হেমন্তের এক উজ্জ্বল সকালে" । ভাসিলি তখন হেনরি মূর-কৃত এক ভাস্কর্যের স্কেচ আঁকায় নিমগ্ন । কথকের স্বতোত্সারিত প্রশংসার উত্তরে ভাসিলি এই ভাস্কর্যটি সম্পর্কে তাঁর অন্তর্নিহিত জিজ্ঞাসার কথা জানান । এক বিশাল ভারী শরীরের নারীমূর্তি - যার মাথাটি ক্ষুদ্র - যেন এক ঊনমানুষ । ভাসিলির শঙ্কিত প্রশ্ন - নারীর মস্তিষ্কহীন শরীরসর্বস্বতা দেখানোই কি শিল্পীর উদ্দেশ্য ? এই পরিচয় ত্রক্রমশ গাঢ়তর হয় আর্টগ্যালারির ক্যান্টিনে দ্বিতীয় সাক্ষাতে এবং সেখান থেকে ছবির ঘরে প্রাচ্য শিল্পকলা সম্পর্কে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে । পরিচয় ত্রক্রমশ বন্ধুত্বের মোহনায় পৌঁছোয় যখন কথকেরই দেওয়া রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ পড়ে ভাসিলি ব্যাখ্যা করেন হেনরি মূরের ভাস্কর্যটির তাত্পর্য । রবীন্দ্রনাথের "বসুন্ধরা" কবিতার অনুসরণে তিনি বলেন এই গুরুভার নারীশরীর স্বয়ং পৃথিবী । জীবধাত্রী তিনি, তাঁরই মধ্যে সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব এবং বিলয় । কিন্তু মানুষ তার লোভের, পাপের ভারে জর্জরিত করে তুলেছে জননী ধরিত্রীকে । সঞ্চিত সেই বেদনাভার বহন করে অসহায়, মূক দৃষ্টিতে তিনি কেবল চেয়ে আছেন । ভাসিলির এই ব্যাখ্যায় স্পৃষ্ট হন কথক, "জীবন আর শিল্পকে, কবিতা আর ভাস্কর্যকে কিভাবে মিলিয়ে দিলেন ! বুঝতে পারি, মানুষটি সাধারণ নন ।" (পৃ. ৬৪৯) এই আপাত সাধারণ, প্রকৃত অ-সাধারণ মানুষটির প্রতি কৌতূহল এবং আকর্ষণই তাঁদের বন্ধুত্বকে দৃঢ়তর করে ।

    কখনো সাংহাই থিয়েটারের প্রযোজনায় চৈনিক নাটকের অভিনয় উপভোগ করে, কখনো সমুদ্রতটে অবসর যাপনে, আবার কখনো বা রয়াল অ্যাকাডেমি আয়োজিত চিত্রশিল্পী মোনে-র প্রদর্শনী দেখে চলতে থাকে তাঁদের সংবেদী আলাপচারিতা, ভাবনার আদানপ্রদান । কিন্তু মানুষের জীবন তো একমাত্রিক নয় । বিশেষত, ভাসিলির মতো শিল্পী মানুষের জীবনযাপনের ইতিবৃত্তগুলি সুখের কিংবা শান্তির নয় সবক্ষেত্রে । তাঁদের সাক্ষাতের প্রথম দিন ভাসিলিকে দেখে কথকের মনে হয়েছিল, "তাঁকেও একটি ভাস্কর্যের মতো দেখতে - সৌম্য ও সুদর্শন, কিন্তু একই সঙ্গে ঈষৎ বন্ধুর, যার পশ্চাদ্ভূমিতে সম্ভবত: কোনো অর্থপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে ।" (পৃ. ৬৪৭) ত্রক্রমশ উদঘাটিত হয় সেই নিহিত ইতিহাস - যা একই সঙ্গে ব্যক্তির ও সমষ্টির, নিকটের ও দূরের ।

    জাতিগত বিচারে মূলত রুশ ভাসিলি, জার্মানিতে রুশ আগন্তুকদের বংশধর । জার্মান রক্তের উত্তরাধিকারও সম্ভবত কিছুটা মিশেছে তাদের পরিবারে । শৈশব কেটেছে তাঁর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে । পরবর্তী জীবনে স্থায়ী হন ইংল্যাণ্ডে । ইংরেজ স্ত্রী লিসা, পুত্র নিকোলাস এবং কন্যা গাব্রিয়েলাকে নিয়ে তাঁর সংসার । বাবা মা পরলোকগত হলেও বেঁচে আছেন অতি বৃদ্ধা দিদিমা অল্গা । যাঁর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যুগ্মভাবে ভাসিলি এবং তাঁর বোনের । সুতরাং ভাসিলি বংশানুক্রমে অভিবাসী । রুশ-জার্মান উত্তরাধিকার, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি এবং বর্তমানে ব্রিটেন বাসের অভিজ্ঞতা মিলে মিশে গড়ে তুলেছে তাঁর বিশ্ববীক্ষা । তাঁর মনের দিগন্তকে করেছে প্রসারিত, চেতনাকে ঠাঁই দিয়েছে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ।

    এই গল্পটিতে বিংশ শতাব্দীর তিনটি প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণ আছে, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কালান্তর এনেছে এবং যা প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষে গড়ে তুলেছে ভাসিলির চেতনালোক । প্রথমটি রুশ বিপ্লব - যার পরিচয় পাঠক লাভ করেন অল্গার স্মৃতির পথ ধরে । ঝিনুকের চিরুনি এবং মুক্তাহার শোভিত লোলচর্ম অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী অল্গার যে বিবরণ কেতকী দেন তার সঙ্গে দৃশ্যতই তাতয়ানার দিদিমা মাদাম নার্সিসিয়েনের কিছুটা সাদৃশ্য মেলে । যদিও এঁদের একজন রুশ, অপরজন আরমানী, কিন্তু এই দুই মহিলা সম্ভবত একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করেন তাঁদের সাজপোশাকে । বয়সের ভারে ন্যুব্জ অল্গার কাছে বর্তমানের মুহূর্তগুলি ধূসর হয়ে এসেছে কিন্তু অতীত দিনের স্মৃতি অত্যন্ত প্রাঞ্জল । বারংবারই তিনি ফিরে যান সেই অতীতের অলিন্দে, বলেন রুশ বিপ্লবের কথা - "... দেখলাম, নিহত ছাত্রদের মৃতদেহগুলো সব প'ড়ে আছে তাদেরই বিদ্যায়তনের প্রাঙ্গণে । তারা আমার দেশের উজ্জ্বলতম ফুল - ঠিক তেমনি প'ড়ে আছে, ঝড়ের শেষে গাছের তলায় যেমন রাশীকৃত হয়ে থাকে ঝরা ফুলের পাপড়ি ।" (পৃ. ৬৫২, ৬৫৩)

    দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনাটি বিশ্বযুদ্ধ । ভাসিলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সন্তান । জার্মানিতে তাঁর শৈশব কেটেছে যুদ্ধকালীন উন্মত্ত আতঙ্কের দিনগুলিতে । সেই সময়কার বিশেষ একটি ঘটনা স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে তাঁর স্মৃতির পটে । দিদিমার সঙ্গে গিয়েছিলেন শহরের মধ্যে কেমিস্টের দোকানে । পথে ভাঙাচোরা বাড়িঘর, সাঁকো পার হবার সময় নীচে জলের ওপর ভেসে থাকা বিশালাকার চুরুটের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠা মনুষ্যদেহ - কোনো কিছুই তাঁর বোধের জগতে তেমন আলোড়ন তোলেনি । কিন্তু কেমিস্টের দোকানে অতিপরিচিত কাঠের ঘোড়াটি, যেটি পয়সা ফেললে ওঠা নামা করতো - সেটিকে যখন বিকল, নিথর হয়ে যেতে দেখেন তখন হঠাতি তাঁর সেই সময়কার শিশুর মস্তিষ্কে এই চেতনা সঞ্চারিত হয় যে চারপাশের পৃথিবীটা বদলে গেছে । আজকের প্রৌঢ় ভাসিলি বলেন, "কেবল সেই অনড় রঙচটা কাঠের ঘোড়াটাকে দেখে সেই যে একটা ভয়ের শিহরণ অনুভব করেছিলাম, সেটা আজও আমার বুকের মধ্যে ঢেউ হয়ে বেঁচে আছে ।" (পৃ. ৬৫৪) বহু বছর পেরিয়ে শৈশবে দেখা সেই বিকল কাঠের ঘোড়াটি ভাসিলির চেতনায় যেন এক প্রতীকে পরিণত হয় - মানবসভ্যতার প্রতীক । বহু নৃশংসতা, বহু হননের কাল পার হয়ে আসা এই সভ্যতার বাহ্যিক কাঠামোটি হয়তো ঠিকই আছে, কিন্তু তার অন্তর গেছে সরে ।

    অবশ্য এমন হৃদয়হীন যাপন সমস্ত ক্ষেত্রে সত্য নয়, ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে । যেমন, ভাসিলিই স্বয়ং ব্যতিক্রম । তাঁর সংবেদী শিল্পীসত্তা মানুষের হৃদয়হীন আত্মসর্বস্বতায়, সভ্যতা তথা আধুনিকতার নামে নৃশংস হত্যালীলায় পীড়িত, কাতর বোধ করে । ভাসিলি-পুত্র নিকোলাসও বহন করে পিতার সংবেদনার উত্তরাধিকার । রুশ ইতিহাস নিয়ে স্নাতকোত্তর গবেষণারত নিকোলাস একদিন কথক ও তাঁর স্বামীকে ভিডিওতে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখায় । দক্ষিণ আমেরিকার কলোম্বিয়ায় বগোটা শহরে এক ভদ্রলোক পুলিশের তাড়া খেয়ে মাটির নীচের নর্দমায় গা ঢাকা দিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছেন - এই বিষয়কেই উপস্থাপিত করেছে ফিল্মটি । নিকোলাস জানায় অ্যাকাডেমিক গবেষণার চাইতে এমন কাজেই সে অধিকতর আকর্ষণ বোধ করে ।

    ব্যতিক্রমী এই যুবকটি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে যখন এই গল্পের বর্তমানে আছড়ে পড়ে তৃতীয় ঐতিহাসিক ঘটনাটি - "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ইয়োরোপের বৃহত্তম কুরুক্ষেত্র" - বসনিয়ার যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়ায় বোমা বর্ষণ । নিকোলাসের প্রাক্তন প্রেমিকা সার্বিয়ান, বেলগ্রেডের বাসিন্দা । যুগোস্লাভিয়ার প্রতি বৃটেনের অমিত্রসুলভ আচরণ হয়তো নিকোলাসকে নিজের কাছে অপরাধী করে তুলেছিল - সে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ।

    তবে নিকোলাসের এই আত্মহননের চেষ্টা কতটা পরিস্থিতির চাপে আর কতটাই বা জেনেটিক উত্তরাধিকারের ফসল - সে সম্পর্কে একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায় । কারণ, কন্যা গাব্রিয়েলার বয়ান অনুযায়ী ভাসিলি নিজে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ । সমস্ত কাহিনী জুড়ে দেখা যায় আনন্দে, স্ফূর্তিতে, আবেগে কখনো তিনি উঠে আসেন ঢেউ-এর চূড়ায়, আবার কখনো ডুবে যান অতলে । হয়তো তাঁর ঘরছাড়া অনিকেত সত্তার বেদনাবোধ এবং কর্মজীবনের তথাকথিত অসাফল্য, খণ্ডকালীন কাজের ডেডলাইনের চাপ তাঁকে ঠেলে নিয়ে যায় পাহাড়ের কিনারায় এবং স্বভাবত ডিপ্রেশনপ্রবণতা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় খাদে । জীবনানন্দীয় নায়কের মতো এক আত্মঘাতী বিষণ্ণতা, এক "বিপন্ন বিস্ময়"বোধ তাঁরও "অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে" এবং তাঁকে "ক্লান্ত, ক্লান্ত করে" ।

    তবে "লাসকাটা ঘর" ভাসিলির শেষ পরিণতি নয় । শেষবার ডিপ্রেশনের পর বিষাদের কুয়ো থেকে উদ্ধারের আশায় তিনি স্থানান্তরিত হন আবাসিক হাসপাতালে । সেখানে কথক এবং তাঁর স্বামী তাঁকে দেখতে গেলে ভাসিলি জানান ক্লিনিকাল চিকিত্সার পাশাপাশি অখণ্ড অবসরের মুহূর্তগুলি তিনি ভরিয়ে তুলছেন কবিতা লিখে । এ লেখা ফরমায়েসী নয়, নিজের প্রয়োজনে, নিজেরই জন্য লেখা । এই কবিতাগুলির মধ্য দিয়ে তাঁর অন্তর্গত, অবরুদ্ধ আবেগ যেন খুঁজে পেয়েছে এক নির্গমনমুখ । ভাসিলির চরিত্রের এই দিকটির সঙ্গে মিল রয়েছে `নোটন নোটন পায়রাগুলি'র কবি হ্যারি বার্কেট-এর । হ্যারিও তাঁর জীবনের একটি পর্বে বিষাদে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তা কাটিয়ে উঠে `কবিতা থেরাপি'র মধ্য দিয়ে লাভ করেছিলেন স্থায়ী আরোগ্য । চরিত্রদুটির এই সাদৃশ্যের কথা কেতকী স্বয়ং উল্লেখ করেছেন বইয়ের মুখবন্ধে । (পৃ. ১২)

    কাহিনীর শেষাংশে কথক তুলে ধরেছেন ভাসিলির কবিতাগুলির মূল নির্যাস । এক ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত প্রকৃতির ছবি উঠে এসেছে সেখানে । গাছের তলায় ঝরে পড়া ফুল, ফল, পাতা অবধারিত ভাবে জাগিয়ে তোলে অল্গার মুখে শোনা রুশ বিপ্লবের স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ঝরা ফুলের মতো স্তূপীকৃত তরুণ ছাত্রদের মৃতদেহ । হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে এমন ঝড় বারংবার এসেছে । তছনছ করে দিয়ে গেছে প্রকৃতির সম্ভাবনা ও জীবনের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে । তবে ভাসিলির কবিতায় ঝড়ের বর্ণনা নেই, আছে ঝঞ্ঝাশেষের ব্যঞ্জনাগর্ভ ও প্রতিশ্রুতিময় শান্ত প্রকৃতির কথা । যে প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর কবিতায় ("বসুন্ধরা"), যে প্রকৃতির ধৈর্য ও বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে হেনরি মূরের ভাস্কর্য - সেই প্রকৃতি । ভাসিলি যেন বিশ্বাস করেন সভ্যতার ও সময়ের আগ্নেয় স্রোতগুলি পেরিয়ে মানুষ একদিন তার আশ্রয় খুঁজে পাবে প্রকৃতির বুকে ।

    কেতকী কুশারী ডাইসনের ভাবনার দোলকটি কখনো বিচ্যুত হয় না আপন ভরকেন্দ্র থেকে । তিনি যখন কোনো ভাবনাকে প্রকাশ করেন উপন্যাসে, নাটকে কিংবা প্রবন্ধে তখন তাতে প্রবলতা থাকে, আবেগ থাকে কিন্তু যুক্তির অভিভাবকত্ব স্খলিত হয়না কখনোই । তাঁর উপন্যাসের নারীরা সোচ্চার আত্মঘোষণায় উন্মুখ, বেঁচে বর্তে থাকার পরেও আত্মিক তথা আধ্যাত্মিক ক্ষুধার নিরসনে তত্পর । তবে কেতকীর নারীভাবনা কখনোই একঝোঁকো নয় । মনুষ্যজাতির অর্ধাংশ অর্থাৎ পুরুষদের গায়ে তিনি ঢালাও ভাবে নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অত্যাচারীর তক্মা এঁটে দেন না তথাকথিত বহু নারীবাদীর মতো । `নারী, নগরী' কিংবা `নোটন, নোটন পায়রাগুলি'তে তাঁর দৃষ্টির ফোকাস মূলত মেয়েদের উপর থাকলেও পুরুষেরা এসেছে তাদের পরিপূরক হয়ে । বিশেষত, `নোটন নোটন ...' -এর হ্যারি বার্কেটের কবিতাচর্চা, মাছধরা, প্রৌঢ় বয়সের নি:সঙ্গতা, স্ত্রী ক্লারার সঙ্গে অভ্যস্ত দাম্পত্যের বেড়া ডিঙিয়ে তরুণী নোটন বা ফিয়োনার সাহচর্যের জন্য ব্যাকুলতা - সব মিলিয়ে নারীচরিত্রপ্রধান উপন্যাসটিতে এক উজ্জ্বল বৈপরীত্যে উপস্থিত । এই চরিত্র সৃষ্টি বুঝিয়ে দেয় পুরুষের হৃদয়ের শব্দ শুনতে অপারগ নন লেখিকা । তাঁর বীক্ষণের এই ব্যাপ্তি এবং সহজাত ংস্‌ংঋছঞচ্ষ্‌ আরও সুস্পষ্টতায় প্রকাশিত `ভাসিলি'-তে । সেখানে পুরুষের অন্তর্জগৎ এবং বহির্বিশ্বের দ্বৈধ এবং আপোষকে মরমী কলমে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি । বিষয়টি এক নতুনতর মাত্রায় পৌঁছোয় তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস `জল ফুঁড়ে আগুন'-এ এসে ।

    এই উপন্যাসটি নির্মাণ কিংবা আঙ্গিকের দিক থেকেও খানিকটা অভিনব । অবশ্য ফর্মগত নিরীক্ষার ফসল লেখিকার প্রতিটি উপন্যাসই । চিঠির সূত্রে গেঁথে তোলা `নোটন নোটন পায়রাগুলি'র পর ১৯৮১-৮২-তে কেতকী লেখেন `রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে' (১৯৮৫-তে প্রকাশিত) । উপন্যাস ও গবেষণার দুটি ধারাকে বেণীর মতো বেঁধে তুলেছেন তিনি এখানে । উপন্যাসের চরিত্র অনামিকা পত্রপত্রিকা. স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিংশ-শতকের প্রথমার্ধের বিখ্যাত নারী-ব্যক্তিত্ব ভিক্তোরিয়ার পুর্ননির্মাণ করে । একসময় স্বয়ং ভিক্তোরিয়া যেন চিঠিপত্রের পাতা ছেড়ে মূর্ত হয়ে উঠে হাত ধরেন অনামিকার, সহায় হন তার ব্যক্তিগত সঙ্কটে । `জল ফুঁড়ে আগুন' উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে দুটি চরিত্র - অঞ্জন এবং মিলিতার জবানিতে, সম্পর্কে যারা পিতাপুত্রী । যে-পদ্ধতিতে তিনি এদের দুজনের চিন্তাস্রোতের জাল বুনেছেন উপন্যাসের টেকনিকের বিচারে তা নতুন নয় । বিংশ-শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে জয়েস্‌ কিংবা উল্ফের উপন্যাস মানুষের চেতনার গভীরতম প্রদেশে প্রবেশের যে সড়কপথ উন্মোচিত করেছিল সেই যঞশংছস্‌ ধী বধত্রযবঠধণ্ণযত্রংযয; বাংলাসাহিত্যেও বিভিন্ন সময়ে যাঁরা মননধর্মী উপন্যাস লিখেছেন, ব্যবহার করেছেন এই পদ্ধতি । ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, বুদ্ধদেব বসু থেকে সমরেশ বসু, বিমল কর কিংবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় । তবে কেতকীর উপন্যাসের বিশেষত্ব হল কখনো তাঁর চরিত্রদের তিনি পৌঁছে দেন স্মৃতির অলিন্দে যেখান থেকে দেখা যায় চারটি প্রজন্মের আসাযাওয়া রৌদ্রছায়া ঘেরা পথে । দুটি মহাদেশের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ তারা । ভীড় করে আসে আরও অনেক পরিচিত, অপরিচিত মুখ । তারা কেউ বন্ধু বা আত্মীয়, আবার কেউবা সংবাদপত্রের পাতা কিংবা টিভির পরদা থেকে মুখ বাড়ায় । অবশ্য প্রায়শই ছিন্ন হয়েছে প্রবাহের গতি । ঔপন্যাসিক চরিত্রদের নামিয়ে এনেছেন ঘটমান বাস্তবের মাটিতে । হাসপাতালের নার্স অথবা জেনের সঙ্গে অঞ্জন এবং নতুন কিংবা রিংগোর সঙ্গে মিলিতা যখন কথা বলে তখন বর্তমানের একটা পরিসর তৈরী হয়, সম্পর্কের মধ্যেকার সূক্ষ্ম টেনশনের আভাস মেলে । আর এখানেই এই উপন্যাসের অভিনবত্ব । লেখিকা কৌটোর উপরকার কারুকার্য দেখান, আবার তা উন্মোচন করে দেখান ভিতরকার মণিমুক্তাও । উপন্যাসের চরিত্রদুটির স্থান এবং কালের প্রেক্ষিতে মানসভ্রমণের ব্যাপ্তি বিস্ময়কর । দেশ, কাল, সংস্কৃতি ভেঙ্গে নারী-পুরুষ সম্পর্কের আপেক্ষিকতাকে ছুঁয়ে বিংশ-একবিংশ শতকের সভ্যতার দন্তুর রূপের ব্যাখ্যায় চলে যান কেতকী । তাঁর এমন অনায়াস প্রসঙ্গান্তরে গমন কারও কাছে হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কেন্দ্রচ্যুতি বলে মনে হতে পারে । কিন্তু মননশীল পাঠকমাত্রই বুঝবেন যে মানুষের মন এমন ভাবেই মুহূর্তমধ্যে ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা করে । তার চিন্তাস্রোতের মাঝে ছোট ছোট শরিকি দেওয়াল তুললে তা হবে কৃত্রিম, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ।

    দু'শো অষ্টাশি পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের ঘটনাক্রম একদিনের । দিনটি ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের কিংবা মার্চের গোড়ার দিকের । স্থান লণ্ডনের অদূরে একটি শহর এবং কলকাতা । আগের দিন অঞ্জনের বাঁ চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে । পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে এই চোখটিকে ব্যাণ্ডেজ-মুক্ত করার পর সে আবিষ্কার করে চোখটির স্বাভাবিক দৃষ্টি তো ফিরে আসেইনি, উপরন্তু সেটি দিয়ে দৃশ্যমান জগত্কে মনে হচ্ছে যেন ভ্যান গঘ্‌-এর আঁকা পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ছবির ল্যাণ্ডস্কেপ । স্ত্রী জেন ওরফে জেনিফারের সহায়তায় অঞ্জন পুনরায় ভর্তি হয় হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে । সেখানে তার চোখের ভিতরকার চাপ কমানোর চিকিত্সা শুরু হয় । বাকি সময়টা সে হাসপাতালের বেডে স্থানু । অন্যদিকে অঞ্জন-জেন-এর প্রথম সন্তান মিলিতা কলকাতায় । অঞ্জনের খুড়তুতো বোন অর্থাৎ তার মিনুপিসীর বাড়িতে । সে সারাদিন বই কিংবা পত্রপত্রিকা পড়ে, ইন্টারনেট-এর সাহায্যে বিভিন্ন তত্ত্ব তল্লাস চালায়, কখনো রান্নাঘরে এসে চটজলদি খাবার বানিয়ে নেয়, বড়জোর পাড়ার মোড়ের টেলিফোন বুথে যায় বা বাড়িতে বসে টেলিফোনে কথা বলে । অর্থাৎ অসুস্থতার কারণে না হলেও মিলিতা মোটামুটিভাবে নি:সঙ্গ স্থিরতায় দিনটি কাটায় । চরিত্রদুটির এই স্থিতি তাদের মনকে অবাধ বিচরণের সেই অবকাশ দেয় কর্মব্যস্ততার মাঝে যা কখনোই সম্ভব ছিল না ।

    একটিমাত্র দিনের ঘটনা হলেও এই উপন্যাস অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যের দিকে প্রসারিত । বর্তমানের অভিঘাতে যেমন তা স্পন্দিত হয় তেমনই চেতন স্তরের সন্ধানী আলো ফেলে পৌঁছে যায় অতীত স্মৃতির ঘরে । এই উত্সের দিকে ফিরে যাওয়ার গভীরে হয়তো আছে আত্মপরিচয়ের এক খোঁজ । অঞ্জনের ভাষায়, -"... `এখন' নামে বিন্দুটিতে কিভাবে পৌঁছলাম, কী সেই যাত্রার ইতিহাস, তা বুঝতে হলে সূত্রগুলোর জট ছাড়াতে ছাড়াতে ফিরে যেতে হবে একেবারে সেই অন্ধকার আবর্তে, মাতৃগর্ভে..." (পৃ. ১৭৪) । বর্তমান এবং অতীতের মাঝে যোগসূত্রের অনুসন্ধানে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে চারটি প্রজন্মের ছবি । প্রথমত, অঞ্জনের মাতামহ মাতামহীর প্রজন্ম - যাদের সাক্ষাৎ অঞ্জন পায় যৌবনে মায়ের দেশ ইংল্যাণ্ডে এসে । দ্বিতীয়ত, অঞ্জনের বাবা, কাকা, কাকিমা অরুণলেখা, মা পার্ডিটা । এখানে লক্ষণীয়, অঞ্জনের বাবা এবং কাকা অনামী কিন্তু অরুণলেখা বা পার্ডিটা কেবল স্বনামে উপস্থিত নয়, তাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে টুকরো অনুষঙ্গ । এর কারণ কি এই যে তারা লেখিকার নারীজগতের শরিক ? নাকি এই কারণে যে শৈশবে মাকে হারানোর শূন্যতাবোধ এবং সেই শূন্যতা পূর্ণ করে কাকিমার স্নেহচ্ছায়া অঞ্জনের মনের প্রাচীরে স্মৃতির যে ফ্রেস্কো এঁকেছিল তা স্থায়ী হয়েছিল পরিণত বয়সেও ? তুলনায় বাবা কিংবা কাকা কিছুটা দূরের মানুষ । মাসী ও মেসো - অ্যানিটা ও রবিন, মামা ম্যালকম । তৃতীয় প্রজন্মে আছে অঞ্জন ও তার স্ত্রী জেন এবং তাদের সূত্র ধরে এসেছে আরও বেশ কিছু চরিত্র । অঞ্জনের দাদুর সহকর্মীর কন্যা লুসি, টেড-সামান্থা-পার্সিভাল, ব্রায়ান ও মারী লুইজ, এছাড়া কলকাতায় বসবাসকারী অঞ্জনের খুড়তুতো বোন মিনু এবং তার স্বামী জিতেন । চতুর্থ প্রজন্মে আছে অঞ্জন-জেনের কন্যা ও পুত্র মিলিতা এবং রিংগো । মিলিতা-রিংগোর বন্ধুচক্রটি প্রায় আন্তর্জাতিক । যেমন, জার্মান ছেলে হান্স, আধা ইংরেজ আধা ইরানী ম্যাথু এবং তার আধা স্কটিশ আধা ইরানী স্ত্রী নিকোলা । নি:সঙ্গ ব্রিটিশ যুবক রিচার্ডের পাশাপাশি আছে কুয়েতের বাসিন্দা উনত্রিশ ভাইবোনের একজন আমিন । এদেরই সমান্তরালে আছে কলকাতার বাঙালি ছেলে নতুন যার সঙ্গে মিলিতার সম্পর্ক বন্ধুত্বের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে গভীরতর অনুভূতির উপত্যকাদেশে প্রবেশ করেছে । বিভিন্ন দেশের চারটি প্রজন্মের মানুষগুলি মিলেমিশে বহুবর্ণের কোলাজ তৈরী করে এই উপন্যাসে । তবে অবশ্যই নিছক বর্ণময়তা এর একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয় । মানুষগুলির বর্হিজীবন এবং মনোজগৎ অনেকগুলি এককেন্দ্রিক বৃত্তের মতো উপস্থাপিত হয়েছে । ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং অনুভূতির নিউক্লিয়াস থেকে বৃহত্তর সমাজভাবনা এবং ইতিহাসের পরিধির দিকে কিংবা পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে প্রসারিত চিন্তার অনি:শেষ প্রবাহ । কখনো অঞ্জনের ভাবনার পরিধি ছুঁয়ে যায় খবরের কাগজে পড়া একটি ঘটনা - লণ্ডনের শহরতলীতে বছর ত্রিশের জনৈক যুবকের মৃত্যু অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে । যুবকটি কারখানার ইভনিং শিফ্টের ডিউটি সেরে ফিরছিল । নিজের বাড়ির প্রায় দোরগোড়ায় কয়েকজন তাকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারে । সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশের বক্তব্য, মানুষটি "ওয়াজ ইন দ্য রং প্লেস অ্যাট দ্য রং টাইম"। এই মন্তব্যের মধ্যে কোথাও যেন রয়েছে এক প্রচ্ছন্ন উস্কানি । ঝর্ণা যেমন নুড়ি পাথর পেলেও তাকে ঘিরে আবর্ত রচনা করে, তেমনি এই মন্তব্যটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় অঞ্জনের ভাবনা । "তিনজন লোক অনায়াসে একটি মানুষকে খতম করতে পারে, তা হলে তিপ্পান্নজন আততায়ী তিপ্পান্নটি মানুষকে বা একহাজার মানুষ অপর একহাজার মানুষকে শেষ করে দিতে পারবে না কেন ?" (পৃ. ২৪)

    অঞ্জনের এই প্রশ্ন ভাবনার ডানায় ভর করে ঢেউ ছুঁয়ে ওড়া সিগাল-এর মতো কখনো পৌঁছে যায় এগারোই সেপ্টেম্বর আমেরিকার জোড়া সৌধ ধ্বংসের ঘটনায় । আবার কখনো বা বিংশ শতাব্দীতে হিটলারের ইহুদী নিধন যজ্ঞ, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার বোমাবর্ষণ এমনকি পূর্ববঙ্গের মাটিতে একাত্তরের হত্যাকাণ্ড, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার স্মৃতি ভেসে ওঠে তার মনের আয়নায় । হাসপাতালের বেডে শায়িত অঞ্জন পীড়িত, কাতর বোধ করে শতাব্দীর পর শতাব্দী-ব্যাপী মনুষ্যসভ্যতার এই প্রগাঢ় নিষ্ঠুরতায় ।

    অঞ্জন নিজেকে এই কালান্তরের অংশ হিসেবে সনাক্ত করতে পারে । কেননা তার বাবা যিনি জন্মসূত্রে বাঙালি, পেশায় ডাক্তার এবং মা যিনি জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, পেশায় নার্স - তাঁদের আলাপ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে । জাতিগত অবস্থানের ভিন্নতা কিংবা যুদ্ধ, রক্তক্ষয় দুজনের সম্পর্কের রসায়নে কোনো বিঘ্ন ঘটায়নি । তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । এমনকি অঞ্জনের মা পার্ডিটা যখন শেক্সপীয়রের নায়িকার মতোই হারিয়ে যান, অসুস্থ দিদিমার সেবা করতে গিয়ে নিজের জন্মভূমির মাটিতেই শেষ নি:শ্বাস ফেলেন, তারপরও আত্মীয় পরিজনের অনুরোধ উপরোধ অগ্রাহ্য করে অঞ্জনের বাবা বাকি জীবনটা একাই কাটিয়ে দেন । আর অঞ্জন তার শৈশব থেকে যৌবনপর্ব পর্যন্ত বেড়ে ওঠে কাকিমা অরুণলেখার স্নেহচ্ছায়ায় ।

    অঞ্জনের জীবনের নকশার পরিকল্পনাটি এমনভাবে করেছেন লেখিকা যাতে তার সত্তার অন্তর্গত বিমিশ্রণের ভারসাম্যটি রক্ষিত হয় । ব্রিটিশ-ভারতীয় রক্তের যুগ্ম উত্তরাধিকারের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে তার জীবনের প্রথমার্ধ কাটে কলকাতায়, বাকিটা ইংল্যাণ্ডে । কলকাতার কলেজে স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার পর অঞ্জন যায় তার মায়ের দেশ ইংল্যাণ্ডে । সেখানে মাসী অ্যানিটা এবং দাদু দিদিমার হার্দ্য আন্তরিকতায় সে সহজেই এই নতুন দেশটিকে নিজের দ্বিতীয় জন্মভূমি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে । এবং অনতিকালের মধ্যেই তার জীবনে আসে জেন । মায়ের তরফের আত্মীয়েরা অঞ্জনের সত্তাকে সেই আশ্রয় দিয়েছিল যাতে বহিরাগতের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তাকে কখনো পীড়িত করেনি । আর জেন হয় তার নতুন জীবনের তরীর নেয়ে । প্রাক্বিবাহের প্রেমপর্ব এবং বিবাহোত্তর সময়ের সন্তানধারণ, সন্তানপালন, কর্মজীবনে স্থিতি খোঁজা প্রভৃতি ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে অঞ্জন এবং জেন উভয়ের জীবনই আজ পৌঁছেছে প্রৌঢ়ত্বের শান্ত অববাহিকায় । সাধারণত এই বয়সে পৌঁছে দম্পতিরা পরস্পর সম্পর্কে অভ্যস্ত ও নিশ্চিন্ত বোধ করে । কিন্তু অঞ্জন তার সত্তার গভীরতম প্রদেশে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী নারীটি সম্পর্কে এক অনিশ্চয়তাবোধে আক্রান্ত । তার মানে অবশ্য এই নয় যে জেনের সম্পর্কে তার মনে কোনো অভিযোগ আছে বা সে অসন্তুষ্ট । অঞ্জনের এই একাকিত্ববোধ, স্ত্রীর সঙ্গে মানসিক দূরত্বের কারণ নিহিত আছে তার অভিবাসী সত্তার গভীরে । তরুণ বয়সের কর্মব্যস্ততা, একটা নতুন দেশে এসে শিকড় গাড়া, সংসার পাতা, দায়দায়িত্ব পালন অহরহ: যে উত্তেজনার সঞ্চার করে তা স্রোতবেগের মতো একজন মাইগ্রান্টকে ঠেলে নিয়ে যায় অনেকদূর । কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে অঞ্জন ত্রক্রমশ অনুভব করে জেন এবং তার মধ্যে রয়েছে অনালোকিত কয়েকটি বৃত্ত । তাদের গভীরতম সম্পর্কের নিভৃততম অনুভূতিগুলিকে জেন যেন কাচা কাপড়ের মতো ভাঁজ করে তুলে রেখেছে নিজস্ব আলমারিতে । অঞ্জন সংসক্ত আবেগে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গিয়েও গার্হস্থ ব্যস্ততা ও সাংসারিকতার আড়াল সরিয়ে ছুঁতে পারেনা জেনকে । অথচ আজও অঞ্জনের মনে উজ্জ্বল রঙে আঁকা আছে তাদের যৌবনের দিনগুলির ছবি । প্রথম পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ব্রন্টি বোনেদের বাড়ি দেখতে যাওয়া, চাইকভস্কির `সোয়ান লেক' শুনতে শুনতে জেনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে প্রথম বরফ ঝরার দৃশ্য উপভোগ করা, তাদের বিয়ের পর হ্যালিফ্যাক্স-এর উত্তরে জেন-এর পিসীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া - যখন অফ্হোয়াইট-কোট-পরিহিতা গর্ভবতী জেনকে দেখে অঞ্জনের তুষারকন্যা বলে ভ্রম হয়েছিল । কিংবা আরও কিছুদিন পরে, প্রথম সন্তান মিলিতার জন্মের পরবর্তী কয়েকমাস যখন তারা আর্থিকভাবে ততখানি সচ্ছল নয় - কঠিন পরিশ্রমের সেই দিনগুলি কখনোই গুরুভার বোধ হয়নি পারস্পরিক নির্ভরতা এবং ভালোবাসায় । প্রৌঢ় অঞ্জন আজও উদ্দীপিত বোধ করে যৌবনের সেই দিনগুলির স্মৃতিতে । কিন্তু জেন যেন নিজের চতুর্পার্শ্বে এক অদৃশ্য প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে । পরিণতবয়স্ক জেনের এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি বুঝতে অঞ্জনকে কিছুটা সাহায্য করে জেনেরই বান্ধবী সামান্থার জীবন ও মানসিকতা । স্বামী-পরিত্যক্তা সামান্থা যখন বেঁচে থাকার ও দিনযাপনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জের একা মোকাবিলা করে, ফিরিয়ে দেয় বন্ধুত্বপূর্ণ সাহায্যের হাতও তখন অঞ্জনের মনে প্রশ্ন জাগে "ইংরেজ মেয়েরা সবই ম্যানেজ করতে পারে ?" । (পৃ. ১৫৩) এই বহুবচনের একটা অংশ নিশ্চয়ই অঞ্জনের নিজের স্ত্রী জেন ।

    সামান্থার জীবনে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পুরুষ পার্সিভাল । মানুষটি তার ব্যক্তিত্বের গুণে অঞ্জনদের পরিবারের সকলেরও মন জয় করে নেয় । কিন্তু সামান্থা তার পরিচিত বন্ধুমহলে জানিয়ে দেয় যে সে এবং পার্সিভাল দম্পতি নয় এবং তারা `পরস্পরের জামার পকেটে' বাস করে না । এ বিষয়ে সামান্থার অতিরিক্ত সচেতনতা ও তজ্জনিত ক্রিয়াকলাপ অঞ্জনের চোখে বিসদৃশ ঠেকে । এমনকি কলকাতার সামাজিক জীবনের নিরিখে এগুলি যে অসৌজন্য বলে বিবেচিত হত একথাও তার মনে উদিত হয় । এ থেকে বোঝা যায় কলকাতার বাঙালি লালন বহুদিন ইংল্যাণ্ডে কাটানো অঞ্জনের প্রৌঢ় মন ও চাহিদাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে । এবং তার স্ত্রী জেন যখন কিছুটা সামান্থারই ধাঁচে নিজের চারপাশে একটা স্পেস তৈরী করতে চায় তখন সে অসহায় ও প্রত্যাখ্যাত বোধ করে । অবশ্য এই বোধ তাদের দাম্পত্যকে কোনো নেতির দিকে ঠেলে দেয় না । জেনের কর্তব্যপরায়ণতা এবং সংবেদনশীলতাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে অঞ্জন । হাসপাতালে এসে জেন যখন তাকে জানায় আফ্রিকার এইড্স্‌-আক্রান্ত মানুষদের সাহায্যার্থে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সে যোগ দিতে চায় তখন ব্যক্তিগতের পাত্র ছাপিয়ে ওঠা জেনের এই আবেগকে মূল্য দিতে কার্পণ্য করে না অঞ্জন । অঞ্জন এবং জেনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে লেখিকা হয়তো একথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে একজন মানুষ অজস্র সত্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে । তার মনের প্রতিটি তার সবচাইতে কাছের মানুষটিও হয়তো ছুঁতে পারে না - একথা যেমন সত্য, তেমন এও সত্য যে জীবনের পর্বে পর্বে, বাঁকে বাঁকে পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নবীকরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় । তবেই সম্পর্ক টিঁকে থাকে, বেঁচে থাকে ।

    অঞ্জন-জেনের সন্তান মিলিতা এবং রিংগোকে কেন্দ্র করে কেতকী তরুণতর প্রজন্মের জীবনের ও মনোজগতের একটি নকশাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন । কম্পুটারবিশেষজ্ঞ রিংগো ভাল চাকরি করে, সে কথাবার্তায় তুখোড়, মিশুক প্রকৃতির - ফলত, তার বন্ধুচক্রটি বিশাল । কিন্তু তার `বিশেষ' কোনো বান্ধবী আছে এমন আঁচ পাওয়া যায় না । রিংগোর সূত্রেই আসে তার বন্ধু রিচার্ডের কথা । ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়েও এই তরুণটি একসময় প্রথাগত শিক্ষা সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলে । দৌড়ের ট্রাক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে একদিকে যেমন থমকে যায় তার কেরিয়ারের ঊর্ধ্বগতি, তেমন হাতছাড়া হয়ে যায় মনমতো সঙ্গিনীলাভের সম্ভাবনাও । কারণ উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা রিচার্ডের মতো তথাকথিত অসফল কোনো ছেলেকে পাত্তা দিতে রাজি নয় । বস্তুতপক্ষে, লেখিকা দেখান, এই তরুণতর প্রজন্ম সঙ্গী নির্বাচনে আবেগের চাইতে হিসেবকেই প্রাধান্য দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে । যৌবনের দিনগুলিতে প্রেম করার চাইতে কেরিয়ারে মন:সংযোগ করতেই তারা অধিকতর আগ্রহী । রিংগো এবং রিচার্ড জীবনের এই যান্ত্রিকতা আর একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতেই যেন ছুটির অবকাশে লম্বা লম্বা হাঁটা দেয় । পাখী দেখে, হাঁসেদের রুটি খাওয়ায়, টিলায় চড়ে । এই `হন্টন অভিযান'গুলিতে তাদের আবেগ যেন খুঁজে পায় এক নির্গমন মুখ । নাগরিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এই প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া কি পরোক্ষে এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার আভাস দেয় ?

    উপন্যাসে রিংগোর দিদি মিলিতার অবস্থান কলকাতায় । কাহিনীর আভাস থেকে মনে হয় প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করে নিজস্ব একটি কর্মজগৎ খুঁজে নেবার ও তার প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে সে । মিলিতার সম্ভাব্য কর্মক্ষেত্র যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজ নিয়ে সে গভীরস্তরে ভাবনাচিন্তা ও পড়াশোনা করে । বর্তমান ভারতবর্ষের সমাজের বিভিন্ন স্তরের সমস্যার তথ্য সে সংগ্রহ করে এবং বিশ্লেষণ করে । গুজরাটের দাঙ্গা থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের দলিত মেয়েদের অবস্থা, হাওড়া-হুগলীর বন্ধ কারখানার শ্রমিক-বধূদের ভাতের জন্য দেহ বিক্রয় - এসবই তার ভাবনা এবং অধ্যয়নের পরিধির অন্তর্গত । দুটি দেশের, দুটি ভিন্ন সমাজের মানুষগুলির জীবনাচরণের একটি তুলনামূলক নকশাও ফুটে ওঠে তার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে । যেমন, মিলিতা দেখে ধূলো, দূষণ, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকলেও এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ব্যক্তির ইচ্ছা এবং স্বাতন্ত্র্যকে মূল্য দিতে জানে । আবার সে এও দেখে যে একদল মানুষ যখন বাংলা ভাষার প্রচলিত ব্যবহারবিধি থেকে ঔপনিবেশিকতাকে রবার ঘসে মুছে ফেলতে তত্পর হয়, `ক্যালকাটা'র বদলে `কলকাতা'র পক্ষে সওয়াল করে, তখন তারা চেয়েও দেখে না হাটে বাজারে কীভাবে ধর্ষিত, আক্রান্ত হচ্ছে বাংলা ভাষা ।

    আধুনিক সময়ের একজন তরুণী হয়েও মিলিতা একচক্ষু হরিণের মতো কেরিয়ারের লক্ষ্যে অন্ধের মতো ছোটে না । বরং সে তার পরিপার্শ্বকে দেখে, সে জানে পেছন ফিরে তাকাতে । তার মিশ্ররক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে সে গর্বিত, এর মধ্যে সে যেন নিজেকে আবিষ্কার করে । "পুরনো দিনের ঐসব গল্প শুনতে এত ভালো লাগে আমার । গল্পগুলোর মধ্যে আমার নিজের সত্তার কিছু টুকরো টাকরা যেন উঁকি মারে । তাদের খুঁজে পাবার চেষ্টা করি । আমার আমিত্বের কোনো কোনো ভগ্নাংশ কি ঐ কাহিনীগুলির আনাচে কানাচে লুকিয়ে নেই ?" (পৃ. ১০৮) অবশ্য শুধুই শিকড় খোঁজায় তত্পর নয় মিলিতা, সে বর্তমানকেও মূল্য দেয় । এই কলকাতাতেই তার জীবনে এসেছে একটি নতুন মানুষ - `রক্তকরবী'র `কিশোর'-এর মতো তার নামও নতুন । যদিও নতুন-এর জীবনে পুরানোও কিছু আছে । সে বিবাহবিচ্ছিন্ন যুবক । সেই পূর্ববিবাহের স্মৃতি - যা হয়তো একই সঙ্গে দু:খের এবং গ্লানির - তাকে সে সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারেনি । মিলিতার মধ্যে সে এক ধরণের আশ্রয় খোঁজে, আশ্বাস খোঁজে । নতুনের কিছু কিছু মন্তব্য এবং আচরণ থেকে মনে হয় তার মধ্যে এক ধরনের কমপ্লেক্স আছে । তবে এর কারণ মেন্টাল সেটব্যাকও হতে পারে । কিন্তু এটিই নতুনের একমাত্র পরিচয় নয় । কোনো কোনো মানুষ আছে, হেসে উঠলে যাদের মুখের চরিত্রটাই বদলে যায় । নতুনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে উপন্যাসের শেষাংশে মিলিতার সঙ্গে তার দূরভাষিক আলাপে । বোঝা যায় মানুষটি সংবেদনশীল, কৌতুকপ্রিয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর মতো সতেজ এবং উচ্ছল হয়ে উঠতে পারে । নতুনকে দেখে এই কারণেই হয়তো সিনেমায় দেখা বিলি এলিয়ট চরিত্রটির কথা মনে পড়ে মিলিতার । প্রচ্ছন্ন এক জেদ, লড়াই এবং একই সঙ্গে স্বপ্নকে ধরার আকাঙ্ক্ষার এক সম্মিলন দেখে তার মধ্যে । মিলিতার কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে নতুনের বৈষ্ণবপদাবলীর ব্যাখ্যায় স্বভাবতই তাদের পারস্পরিক আকর্ষণ কিছুটা তীব্রতা ও ঘনত্ব পায় ।

    এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চিত্রকল্পটির ব্যাখ্যা দেন লেখিকা অঞ্জনের মুখে -"সমুদ্রের তলদেশে যেমন জল ফুঁড়ে আগুন বেরোয়, সভ্যতার নীচেও তেমনি ফুঁসে ফুঁসে প্রবাহিত হয় বর্বরতার লাভা । উপরে সভ্যতার জল, তার নীচেই অ-সভ্যতার গলিত উত্তপ্ত নি:সরণ । ....." (পৃ. ২৬০) বেশ কয়েকবছর আগে তৈরী অপর্ণা সেনের ছবি `যুগান্ত'র কেন্দ্রীয় ভাবনাটির সঙ্গে এর সাদৃশ্য মেলে । অবশ্য সিনেমায় পরিচালক উপসাগরীয় যুদ্ধ-উত্তর চেতনাকে ব্যবহার করেছিলেন, দেখিয়েছিলেন সমুদ্রে ভাসমান তৈলস্তরে আগুন লেগে যাওয়া । আর এই উপন্যাসে অঞ্জনের চেতনাকে উদ্দীপিত করে ডকুমেন্টারি ছবিতে দেখা একটি দৃশ্য, অতলান্তিকের গভীরে নিমজ্জিত এক আগ্নেয়গিরি থেকে উত্তপ্ত, গলিত লাভা নি:সরণ । উভয়ক্ষেত্রেই জল এবং আগুনের এক লড়াই দেখানো হয়েছে । জল হারিয়ে ফেলে তার নির্বাপক ভূমিকা, পরাভূত হয় আগুনের কাছে, যেমন বর্বরতার কাছে পরাভূত হয় সভ্যতা ।

    সভ্যতা ভেদ করে বর্বরতার উত্সারণের এই ছবি কেতকী এঁকেছেন সমগ্র উপন্যাস জুড়ে একক মানুষের জীবন এবং সমগ্র মানবসভ্যতার নিরিখে, নিহত সম্পর্ক, নিহত বিশ্বাস, নিহত মানবতার মাপকাঠিতে । তবে অঞ্জনের চোখের প্রেসার নেমে আসার মতো উপন্যাসের ঘনীভূত টেনশনও একসময় কমে আসে । অঞ্জন জেনের ভালোবাসায় আস্থা হারায় না, জেন অঞ্জনের জন্য চা তৈরী করে নিয়ে আসে - তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় কাকিমার উপহার সোনার দুলজোড়া বাক্স থেকে বের করে আবার সে পরবে, রিংগো রাস্তায় পড়ে থাকা একটি মুমূর্ষু ব্ল্যাকবার্ড-এর জন্য কাতর বোধ করে, মিলিতা নতুনকে জানায় সে কখনো তাকে আছড়ে ভেঙে চুরমার করে দেবে না কারণ সে বিশ্বাস করে দুটি মানুষের সম্পর্ক "একরকমের সহসৃষ্টির গতিবিদ্যা" । (পৃষ্ঠা ১৯০)

    এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আচরণ, মানুষের চৈতন্যে ধৃত এই বিশ্বাস ও আশাই বর্বরতার হন্তারক লাভাস্রোতকে প্রতিহত করতে পারবে বলে লেখিকা বিশ্বাস করেন ।

    কেতকী তাঁর উপন্যাসে গল্প তৈরী করেন, চরিত্র কল্পনা করেন, কিন্তু তা নিছকই কল্পকাহিনী নয় । তাঁর নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতার জগৎ সেঁচে গড়ে ওঠে প্রতিটি রচনা । তাঁর নিজের বয়সের সঙ্গে সৃষ্ট চরিত্রদেরও বয়স বেড়েছে । দুই বালক পুত্রকে নিয়ে ছিল নোটনের সংসার আর `জল ফুঁড়ে আগুন'-এ পুত্রকন্যারা তাদের যৌবনে পৌঁছেছে । অবশ্য কেবল চরিত্রদের বয়স বাড়া নয়, পরিপক্বতার পাকা রঙও ধরেছে উপন্যাসের শরীরে । কেতকী কোনদিনই নিছক গল্প বলায় আগ্রহী নন, ত্রক্রমশ তাঁর কাহিনী আরও জটিল ও বিশ্লেষণমুখী হয়ে উঠেছে । ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে, ইংরেজের স্ত্রী হয়ে, ব্রিটেনে সংসার করেও যখন তিনি বাংলায় লেখেন তখন তাঁর মধ্যে দুই সংস্কৃতির অন্তর্গত স্রোত প্রতিস্রোত অত্যন্ত তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল থাকে । চেতনা যদি ধনুকের ছিলার মতো টানটান না থাকে তবে জীবনকে এমন এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখানো যায় না । তাঁর ইংরাজী কাব্যগ্রন্থ - 'ঝত্র মচ্ছঞ নংত্রযং হৃধণ্ণ মধণ্ণবচ্‌ংরু ঝঞ' -এর ভূমিকায় কেতকী লেখেন, "ঝত্র স্ষ্‌ ংঋধংস্য ঝ ছস্‌ ঞশষ্ঠত্রভ ঞধ ণ্ণত্ররুংশযঞছত্ররু ঞচ্‌ং বধত্রঞংন্ঞয ধী চ্ছৃংঋংত্রঠত্রভয ছত্ররু ঞচ্‌ং বধত্রত্রংবঞঠধত্রয ঢংঞগংংত্র ছৃংঋছশংত্রঞত্ষ্‌ রুঠযবশংঞং ংটংত্রঞয গচ্ঠবচ্‌ ছশং চ্ঠরুরুংত্র ংঈশধস্‌ টঠংগ. ঘচ্ছঞ রুধংয ঠঞ স্‌ংছত্র ঞধ যছষ্‌ ঞচ্ছঞ 'ঝ গছয ঞচ্‌ংশং' ধশ 'ঝ ত্ঠটংরু ঞচ্‌ংত্র' ? ঘচ্ছঞ ছশং ঞচ্‌ং ত্ঠত্রূয ঢংঞগংংত্র স্ষ্যংত্‌ংঈ ছয ঝ ছস্‌ ত্রধগ ছত্ররু ংটংত্রঞয গচ্ঠবচ্‌ চ্ছৃংঋংত্রংরু ঠত্র ঞচ্‌ং ংঋছযঞ, ঢণ্ণঞ ধী গচ্ঠবচ্‌ ঝ গছয ংঠঞচ্‌ংশ ণ্ণত্রছগছশং ধশ ধত্রত্ষ্‌ রুঠস্ত্ষ্‌ ছগছশং ? ণধগ ঠয ঞচ্‌ং ংঋছযঞ 'ঠত্রবত্ণ্ণরুংরু' ঠত্র স্‌ং ? ঘচ্ছঞ ছশং ঞচ্‌ং ধঢযবণ্ণশং গছষ্য ঠত্র গচ্ঠবচ্‌ ঠঞ চ্ছয যচ্ছৃংরু স্‌ং, ঢধঞচ্‌ ঞচ্শধণ্ণভচ্‌ স্ষ্‌ ংঊত্রধগত্‌ংরুভং ধী টছশঠধণ্ণয রুংঞছঠত্য ছত্ররু ংইণ্ণছত্ত্ষ্‌ ঞচ্শধণ্ণভচ্‌ স্ষ্‌ ঠভত্রধশছত্রবং ধী ধঞচ্‌ংশ রুংঞছঠত্য?"

    আমাদের বিশ্বাস এই আত্মজিজ্ঞাসা কেবল কবিতা নয়, তাঁর উপন্যাসের ক্ষেত্রেও ক্রিয়াশীল, জীবনের যে ডিটেলগুলি তাঁকে গড়ে তুলেছে বলে তিনি মনে করেন, তাঁর উপন্যাসও তিনি গড়ে তোলেন সেই ডিটেলের সাহায্যে । রান্নাবান্না, খাদ্যাভ্যাস থেকে ঘরসাজানো কিংবা বাগান করা, সাধারণ ব্যবহারবিধি থেকে জাতিগত চরিত্র - এসবই তিনি ফুটিয়ে তোলেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেলের কাজে । কেতকীর এই মনদীপ্ত ডিটেল মনে আনে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের কথা । তবে কেতকীর উপন্যাসে এগুলি অন্য এক ভূমিকা নেয় । এর সাহায্যে বাঙালি পাঠক অনায়াসে ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের জীবনের সদর থেকে অন্দরে প্রবেশ করতে পারে । সাহিত্যের জানালা দিয়ে ঘটে এক বিশ্বদর্শন ।

    !---------- সুমনা দাসসুর

    লেখক পরিচিতি : জন্ম ১৯৭২ সালে কলকাতায় । ১৯৯৩-তে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । ১৯৯৬-তে স্নাতকোত্তর, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় । পি. এইচ. ডি - যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৬-এ । ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ অবধি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার পরে বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে । ----

    (পরবাস-৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)