• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৮ | জানুয়ারি ২০০৭ | গল্প
    Share
  • প্লাবন : সাবর্ণি চক্রবর্তী


    ॥ ১ ॥


    পাঁচটা প্রায় বাজে । অফিস বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে । কলকাতার বড় অফিস থেকে আসা চিঠিগুলো দেখে নিচ্ছিল অনুপম । বিভিন্ন নির্দেশ - এই করতে হবে, ওই করতে হবে - যত্ত সব । ও যে-চিঠিটা চাইছে সেটাই নেই, ও মুখ ব্যাজার করে । তারপর চিঠির ফাইলটা আবার বেঁধে রেখে পিয়নকে ডাকে - বাবা বরুণ, সময় হয়ে গেছে । তালাটালা গুলো লাগাও ।

    ছোট একটা দ্বীপ - তাতে ওদের ব্যাঙ্কের অতি ছোট একটা ব্রাঞ্চ । কেন এসব জায়গায় ব্রাঞ্চ রাখা হয় ভেবে পায় না অনুপম । সারাদিনে কাজ বলতে গেলে বিশেষ কিছুই নেই । দ্বীপের লোকসংখ্যাও কম । নারকেলের ছোবড়া চালান যায় এই দ্বীপ থেকে - এটুকুই যা ব্যবসা । কিন্তু কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম । আর কর্ত্তা যখন এখানে ব্রাঞ্চ খুলেইছেন তখন সেটা চালাবার জন্যে তো লোকও চাই । অতএব অনুপম এখানে রয়েছে । সঙ্গে আছে বরুণ দাস । নামে পিয়ন হলেও অনেক ধরনের কাজ ও করে দেয় । ওই হচ্ছে এই ব্রাঞ্চের স্থায়ী কর্মচারী । পোর্ট ব্লেয়ারের লোক - সমুদ্রের সঙ্গে ওর পরিচয় ছেলেবেলা থেকেই ঘনিষ্ঠ । দ্বীপের আদিবাসীরা প্রায় সবাই ত্রক্রীশ্চান - প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত । বরুণ কিছু স্থানীয় মেয়ের সঙ্গে ভাবসাব করে নিয়েছে - কাজেই বেশ ভাল আছে ।

    দিন গুনছে অনুপম । দু বছরের জন্যে এই পোস্টিং । সময় পার হয়ে গেছে । কলকাতা ফিরবার অর্ডারও হয়ে গিয়েছে । কিন্তু একটা মোক্ষম ঝামেলা আছে । ওর রিলিভার এলে তবেই ও স্টেশন ছাড়তে পারবে । ওর যে রিলিভার সে দ্বীপান্তরের দণ্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল সার্টিফিকেটের জোরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । এবং চেষ্টা করছে যাতে ছন্দ মকুব হয় । চিঠির তাড়ার মধ্যে ওর রিলিভার আসার কোন খবর আছে কিনা সেটাই দেখার চেষ্টা করছিল অনুপম । কোন খবর নেই । আবার ডাক আসবে সেই দশ দিন পরে ।

    অফিস থেকে অনুপমের বাড়ি কয়েক মিনিটের হাঁটা রাস্তা । বাড়ি মানে দুটো ছোট ছোট ঘর । এখানে এর চাইতে ভাল থাকার জায়গা পাওয়া যায় না । বাড়িটা এখানকার এক সর্দারের - অনুপমের অফিসকে ভাড়া দিয়ে রেখেছে । সমুদ্র খুবই কাছে - দুশো গজও হবে না হয়তো । একটা পিচের রাস্তা এঁকে বেঁকে দ্বীপের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে - ওর বাড়ি আর অফিস দুইই এই রাস্তার ওপর । এক আধটা সরকারি গাড়ি মাঝে মাঝে এই রাস্তা দিয়ে যায় - তা ছাড়া সবাই হেঁটৈই যাতায়াত করে । বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় জয়তী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে - পাশে ওদের আড়াই বছরের মেয়ে পিকু, অনুপমকে দেখেই পিকু ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে আসে - বাবার কোলে উঠে পড়ে । মেয়ের গালে, কপালে, মাথায় চুমু খায় অনুপম । তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে জয়তীর সঙ্গে বাড়ি ঢোকে ।

    অনুপমকে চা জলখাবার দিয়ে জয়তী জিজ্ঞেস করল, তোমার বদলির আর কোন খবর পেলে ?

    থালার লুচি ছিঁড়ে টুকরোটা রেলিশ করে চিবোচ্ছিল অনুপম । একঢোঁক চা দিয়ে তা গিলে নিল । বলল, এই ডাকেও তো এল না । বোধহয় পরের ডাকটায় খবর আসবে ।

    আশাভঙ্গের ছাপ পড়ে জয়তীর মুখে । কত দেরি হচ্ছে রে বাবা - ও বলে ।

    বাঁ হাতটা উল্টে দেয় অনুপম । পিকু ওর কোলেই বসে আছে । ছোট একটুকরো লুচি ওর মুখে দেয় । খুশি হয়ে লুচির টুকরো চিবোয় পিকু । পেছনে হাত দিয়ে অনুপমের গালে ছোট ছোট থাবড়া মেরে বাবাকে আদর করে ।

    এই বদলির দেরিটা যে কতখানি কষ্টের সেটা খালি জয়তী আর অনুপমই জানে । জয়তী কলকাতায় একটা স্কুলে পড়ায়, মেয়েকে নিয়ে সেখানে থাকে । যাদের কালাপানিতে পাঠানো হয় অনুপমের অফিস তাদের কলকাতায় বা পছন্দমত কোন জায়গায় আর একটা বাড়ি দেয় - তাদের পরিবারের লোকদের থাকার জন্যে । জয়তী পিকুকে নিয়ে সেখানে থাকে । জয়তীর মা ওদের সঙ্গে থাকেন । জয়তীর পৈতৃক বাড়ি শিলিগুড়িতে । ওর বাবা নেই - দাদারা সেখানে রয়েছে । অনুপমের মা বাবা কেউই নেই । এক দাদা আছে - তার সঙ্গে বিশেষ সদ্ভাব নেই । যখন জয়তীর স্কুল ছুটি হয় তখন ও অনুপমের কাছে চলে আসে - এক মাস বা তিন সপ্তাহ কাটিয়ে যায় । কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত উড়ে আসে - তারপর শ আড়াই কিলোমিটার রাস্তা জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় । এ-সব জায়গায় আবার নির্দিষ্ট সময় মেলে জাহাজ চলে না । একই জাহাজ এই দ্বীপে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে আরও দক্ষিণ পূবের দ্বীপগুলোতে যায় । সেই জাহাজই আবার ফেরে - পোর্ট ব্লেয়ারের যাত্রীদের তুলে নিয়ে যায় । জাহাজ ফেরার কয়েক দিন আগে হয়তো খবর পাওয়া গেল যে জাহাজ আসবে না - আবহাওয়া খারাপ, সমুদ্র উত্তাল । তখন কবে জাহাজ ফিরবে তার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই । তবে এ-জাতীয় ঘটনা বেশি হয় বর্ষার সময়টায় - জয়তী যখন আসা যাওয়া করে তখন বিশেষ হয় না । অনুপম বউ-মেয়েকে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নিয়ে আসে - আবার ফেরবার সময় সেখানে পৌঁছে দেয় । সে-কদিনের জন্যে পোর্ট ব্লেয়ারের অফিস থেকে একজন লোক আসে অনুপমের জায়গায় কাজ চালানোর জন্যে । জাহাজ-ঘাটাটাও খুবই কাছে - এখান থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের পথ । জাহাজে ওঠার জন্যে কোনও বাঁধানো জেটি নেই । জাহাজ সমুদ্রেই নোঙর করে থাকে । একটা সিঁড়ি ঝোলে তার গা বেয়ে । যাত্রীরা সবাই একটা বাঁশের ভাসমান জেটিতে ওঠে । একটা টাগ্‌ সেই জেটি টেনে নিয়ে যায় জাহাজের একেবারে কাছে । সমুদ্রের দোলায় জাহাজের সঙ্গে ওই সিঁড়ি দোলে, দোলে বাঁষের জেটিও । এই দুলতে দুলতেই যাত্রীরা সিঁড়ি ধরে ফেলে - তারপর সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠে । দুর্ঘটনা ঘটে না এমন নয় । এক অন্ত:সত্ত্বা মহিলা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিজের মা-বাবার কাছে ফিরছিলেন । সিঁড়ি ধরার সময় ওই সিঁড়ি মহিলার পেটৈ লেগেছিল । জাহাজে ওঠার পরের থেকেই পেটে ব্যথা শুরু - জাহাজের হাসপাতালের চিকিত্সা সে ব্যথা কমাতে পারেনি । সে রাতেই মারা যান মহিলা । সাদা কাপড়ে মুড়ে মৃতার শরীর ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে - জাহাজ তিনবার পাক খায় সে জায়গার চারপাশে - গম্ভীর স্বরে বাজে জাহাজের বাঁশি । মৃতার প্রতি জাহাজের সম্মান প্রদর্শন । তারপর জাহাজ সাগরের ঢেউ কেটে এগিয়ে যায় উত্তরের পথে - পেছনে আসে দু একটা হাঙর - তাদের লেজের ডগাটুকু ভেসে থাকে জলের ওপর ।

    বউ মেয়ে যখন থাকে না তখন অনুপম একা - একেবারে একা । এই সঙ্গীহীনতার অনুভূতি ওকে বেশি করে চেপে ধরে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর । বেশিরভাগ সময় বিদ্যুতের সরবরাহ থাকে না বলে ও সন্ধের পর কেরোসিনের লন্ঠন জ্বালে - তার কাঁপা আলোয় ওর শরীরের ছায়াটা কখনো ছোট হয়, কখনো বা বড় । রাতে শুয়ে ঘুম আসতে চায় না - তখন অক্লান্ত সাগরের ঢেউ-এর গম্ভীর শব্দ মনে করিয়ে দেয় সেও জেগে আছে অনুপমের সঙ্গী হয়ে । চাঁদ বড় হয় - সমুদ্রের জোয়ারের জোর বাড়ে - জোরালো হয় বালির তীরের ওপর ঢেউ এর আছড়ে পড়ার শব্দ, অনেক দিন গভীর রাতে ঘুম না এলে - জয়তী আর পিকুর কথা বেশি মনে হলে - অনুপম বেরোয় । অল্প একটু হাঁটলেই সমুদ্রতীরের বালি শুরু - সেখানে দাঁড়িয়ে ঢেউ দেখে । জোছ্না ফুটলে ঢেউ-এর মাথা রুপোর মত চকচক করে - ঢেউ-এর শব্দের ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় সমুদ্রকাঁকড়া চলে বেড়াবার খসখস শব্দ - সাগরের জোরালো হাওয়ায় নারকেল গাছের পাতা দোলানির সরসর শব্দ । এখানে চুরি ডাকাতির ভয় নেই - অনুপম বালির ওপর হাঁটে - ভারত মহাসাগরের অগাধ বিশাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে মন চলে দূর অতীতে - কলেজ জীবনে, বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে, কফিহাউসে বসে আড্ডা দেওয়া, ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া । মনে পড়ে যায় রবিনসন ত্রক্রুসোর গল্প - সে যদি সেই জীবন পেত - অনুপম রায়চৌধুরী - পরণে ছাগলের চামড়ার পোষাক, পায়ে ঐ চামড়ারই জুতো, কাঁধে গাদা বন্দুক - তার সঙ্গে দৌড়ে বুনো ছাগলও পেরে ওঠে না - সে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রতীরে - দূরে একটা নৌকো দাঁড় বেয়ে এদিকেই আসছে - নৌকোয় রয়েছে পাশের দ্বীপের নরখাদকদের দল - সে তার পেছনে দাঁড়ানো ম্যান ফ্রাইডেকে নির্দেশ দেয় একটা ছোট বালির ঢিপির আড়ালে লুকোতে - সেখান থেকে বন্দুক চালাতে সুবিধে হবে । রাত বাড়ে - চাঁদ ম্রিয়মাণ হলদে হয়ে আকাশের এককোনে সরে । ব্যাঙ্কের কর্মচারী, জয়তীর স্বামী, পিকুর বাবা অনুপম ঘরে ফেরে - পলকা কাঠের দরজাটা ওর হাতের ঠেলায় ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ করে ।

    এই মাসটা অন্যরকম । অনুপম আর জয়তীর জমে থাকা কথা আর ফুরোতে চায় না । ফোনে জয়তীর সঙ্গে কথা হয়, কিন্তু সে আর কতটুকু ? জয়তী বলে ওর কলকাতার জীবনের রোজকার ছোট ছোট ঘটনা, ওর স্কুলের কথা, ওর সহকর্মীদের কথা - কে ওকে সাহায্য করে, কে মুখে হেসে কথা বললেও আসলে ক্ষতি করার চেষ্টা করে । অনুপমের বেশি কিছু বলার থাকে না - ওর এখানকার অফিস বা পোর্ট ব্লেয়ারের অফিসের দু চারটে কথা । তবে ওদের বেশিরভাগ কথা হয় পিকুকে নিয়ে - পিকু কবে কি দুষ্টুমি করল, কখন কি খেলা করল, কোনদিন খাবারদাবার টেবিলে উল্টে দিল - এবার পিকুকে স্কুলে ভর্তি করার কথা ভাবতে হবে - সেটা একটা বড় চিন্তার কথা । পিকু বোঝে ওকে নিয়ে কথা হচ্ছে । খুব খুশি হয়ে খুদে দাঁত বার করে হাসে । একবার মার কোলে ওঠে - একটু পরে নেমে এসে বাবার পা বেয়ে বেয়ে বাবার কোলে চাপে । ওর যদি মনে হয় বাবা মা ওকে বাদ দিয়ে অন্য কথা বেশিক্ষণ ধরে বলছে তখন মা কি বাবার মুখ নিজের ছোট্ট হাত দিয়ে চাপা দেয় - চেঁচিয়ে বাবা মাকে ধমকে দেয় - এই, এই, চুপ ।

    এই এক দেড় মাসই ওদের শারীরিক ঘনিষ্ঠতার সময় । রাতে দাম্পত্যক্রিয়ার পর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে জয়তী । তারপর মুখ ঘুরিয়ে পাশে শোয়া পিকুকে দেখে । পিকু জেগে যায়নি তো । রোজই জয়তী এরকম করে - যদিও কোনদিনই পিকু জাগে না । আজও নি:সাড়ে ঘুমোচ্ছে । জয়তী আবার চোখ বোজে - বড় একটা নি:শ্বাস ফেলে । বলে, আমি এখন কলকাতায় যাব না । তোমার বদলি না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকব ।

    অনুপম শক্ত করে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে । তাই ভাল - এখানেই থাকো । তারপর জয়তীর ঠোঁটের ওপর মুখ নামায় । শুক্লপক্ষের চাঁদ রাতের প্রথমদিকেই আকাশের ওপরে উঠে গেছে - অনুপমের শোবার ঘরের জানালা বন্ধ থাকলেও ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো এসে ওদের শরীরের ওপর পড়ছে । সমুদ্র নির্বিকার ভাবে একের পর এক ঢেউ পাঠাচ্ছে তীরে আছড়ে পড়ার জন্যে । জয়তী ফিসফিস করে বলে, পিকু না জেগে ওঠে । তারপর নিজেও অনুপমকে জড়িয়ে ধরে ।

    সকালবেলায় মেয়েকে নিয়ে সমুদ্রের তীরে বেড়াচ্ছিল অনুপম । কাল জয়তীর জাহাজ ছাড়বে এখান থেকে । জয়তীর মন খারাপ - সকাল থেকে মুখ শুকনো করে আছে । স্যুটকেস খুলে নিজের আর মেয়ের জিনিষপত্র গোছাতে বসেছে । অনুপম গতকাল একটা খুশির খবর পেয়েছে - ওর রিলিভার দিন পনেরোর ভেতর এসে যাচ্ছে । একথা শুনেও জয়তী খুব একটা খুশি হতে পারেনি - বেচারি খুব আশা করেছিল এবারে সবাই একসঙ্গে কলকাতা ফিরবে । খালি বলেছে - দেখা যাক । না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নেই । অনুপম কিন্তু খুশি, কারণ খবরটা পাকা । মেয়ের সঙ্গে নানারকম আবোল-তাবোল গল্প করে যাচ্ছে - মেয়ে খিলখিল করে শিশুর হাসি হাসে, এদিকে আঙুল দেখায়, সেদিকে ছুটে যেতে চায় । সমুদ্র আজ একটু বেশি চঞ্চল, ঢেউগুলো জোরালো, তাদের গর্জনের শব্দেরও জোর বেশি । পিকু আঙুল দেখিয়ে বলে, বাবা, ঢেউ এর আওয়াজ - গুম্ম, থাস্‌ । মেয়েকে কোলে তুলে নেয় অনুপম - ওর ছোট ছোট ফুলো ফুলো দুটো গাল, ছোট্ট কপাল, মাথা, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় ।

    অনুপম একটা আওয়াজ শুনতে পায় - ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকায় । পিকুও শুনতে পেয়েছে - বড় বড় চোখ করে ওদিকে তাকিয়ে আছে । গোঁ গোঁ করে একটা জোরালো আওয়াজ - মনে হচ্ছে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে । ঢেউগুলো হঠাৎ যেন প্রকাণ্ড বড় হয়ে যাচ্ছে - রুদ্ধ আক্রোশে তীরের ওপর ভেঙে পড়ছে । অনুপম অনুভব করে সে ঠিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না - পায়ের তলার বালি কাঁপছে । তারপরই চোখে পড়ল - দূরে, যেখানে মহাসাগর আকাশের সঙ্গে মিশেছে সেখানে একটা চরাচর বিস্তৃত কালো জলের দেয়াল মাথা তুলেছে - সেটা কিন্তু সজীব, গতিশীল আর গর্জায়মান । অনুপম অবাক হয়ে দেখতে থাকে প্রতি মুহূর্তে সেটা কেমন করে বড় হয়ে উঠছে - দ্রুত, অতিদ্রুত সেটা কাছে আসছে আর তার গর্জন প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হয়ে উঠছে । হঠাৎ অনুপম বুঝতে পারে ঘটনাটার বাস্তব দিকটা, বিস্ময়ের জায়গা নেয় আতঙ্ক । ঐ যে জলদৈত্য ছুটে আসছে সে মৃত্যু - ভয়ঙ্কর মৃত্যু ।

    মেয়েকে কোলে নিয়ে পাগলের মত বাড়ির দিকে ছোটে অনুপম । জয়তীকে বাড়ির থেকে বার করে নিতে হবে - তারপর দৌড়ে গিয়ে উঠতে হবে একটা উঁচু টিলার মত জায়গার ওপর । পেছনে তাড়া করে আসছে গর্জায়মান যম । কিন্তু অনুপম তার কাছে হার মানবে না । ওর অনেক স্বপ্ন জীবনকে নিয়ে, স্ত্রীকে, মেয়েকে নিয়ে । ও সামনের দিকে ছোটে । পেছনে মৃত্যু, সামনে জীবন । পায়ের নিচে এখন বেশ ভালরকম ভূমিকম্প হচ্ছে - ছুটতে গিয়ে পড়ে যাবে এরকম মনে হচ্ছে । অনুপম তবুও ছোটে । কিন্তু এইবার ওর পিঠের ওপর, মাথার ওপর আছড়ে পড়ে একটা প্রচণ্ড নিষ্ঠুর আঘাত - মেয়ে কোল থেকে কোথায় ছিটকে গেছে - একটা বিরাট শক্তি অনুপমকে চেপে ধরেছে বালির ওপর - সে অবস্থাতেই ওকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে, অসহ্য চাপ ওর সারা শরীরে - যন্ত্রণায় অনুপম শ্বাস নেবার জন্যে হাঁ করে - হুড় হুড় করে লোনা জল ঢোকে ওর বুকে, পেটে । শ্বাস বন্ধ, হাওয়া নেই, বুক, চোখ, কান সব ফেটে যাচ্ছে - অসহ্য কষ্ট - অনুপমের চেতন মনের চিন্তা শেষ বারের মত রূপ নেয় - মা, মা, মাগো -




    ॥ ২ ॥


    উদ্ধারকারীদের দলটা হেঁটে হেঁটে দ্বীপের মধ্যে ঘুরছিল । জীবিত এবং মৃত - দুরকম মানুষেরই খোঁজ করছিল । এদের পরণে নৌবাহিনীর পোষাক - আপাতত কাদায়, বালির ছোপে ময়লা । সামুদ্রিক প্লাবন হয়ে যাবার পরেই দিকে দিকে উদ্ধারকারীদের দল বেরিয়ে পড়েছে । তাদের কাজ কঠিন এবং পরিশ্রমসাপেক্ষ । জাহাজ সমুদ্রে নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে তীর থেকে বেশ দূরে । সেখান থেকে নৌকোয় দাঁড় বেয়ে তীরে আসতে হচ্ছে এদের । সমুদ্র এখনও যথেষ্ট উত্তাল - তীরে আসা কষ্টকর । দ্বীপে পৌঁছে তারপর মানুষের জন্যে খোঁজাখুজি ।

    দ্বীপটার অবস্থা ভয়াবহ - বর্ণনাতীত । নারকেল গাছগুলো গোড়া থেকে উপড়ে মাটিতে পড়ে আছে - সমুদ্রের কাছাকাছি যে-কটা বাড়ি ছিল তাদের বেশিরভাগই মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে । এখানে ওখানে মৃতদেহ পড়ে আছে - জলের প্রচণ্ড শক্তি তাদের অনেকের জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে গেছে - উলঙ্গ বীভত্স সব শরীর - কেউ কেউ ধসে পড়া বাড়ির ভেতরই চাপা পড়ে মরে গেছে । কত লোক যে ঢেউ এর ধাক্কায় ভেসে গিয়েছে সেটাও আন্দাজ করা শক্ত । উদ্ধারকারীরা জীবিত মানুষও যে একেবারে খুঁজে পাচ্ছে না তা নয় । দু চারজন ভেঙে পড়া বাড়ির ভেতরও বেঁচে আছে । দ্বীপের ভেতরের দিকে একটা উঁচু টিলার ওপর কিছু লোক আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের মধ্যে কয়েকজন ভেসে গেলেও বাকিরা বেঁচে গিয়েছে । কিছু লোককে পাওয়া গেছে অজ্ঞান, কিন্তু জীবিতাবস্থায় । উদ্ধারকারীরা এসব লোককে জল খেতে দিচ্ছে, প্রাথমিক চিকিত্সার দরকার হলে তাও করছে । এরপর এদের নৌকোয় তুলে জাহাজে নিয়ে যেতে হবে - জাহাজ এদের নিয়ে যাবে পোর্ট ব্লেয়ারে - সেখানে সরকারি আশ্রয় খোলা হয়েছে ।

    নৌ-সেনাদের ভেতর একজন চোখে দূরবীন লাগিয়ে দেখতে পায় । একটা বাচ্চা - খুব সম্ভবত মেয়ে - একটা হেলে পড়া নারকেল গাছের গোড়ায় মাটির ওপর পড়ে আছে । দুজন লোক তখনই ছুটে যায় - কাছে গিয়ে দেখে । বাচ্চাটা বেঁচে আছে - নি:শ্বাস পড়ছে । ওরা বাচ্চাটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে - সমুদ্রের জল পেটে বিশেষ যায়নি দেখে আশ্বস্ত হয় । ওর চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে - ওকে জলও খাওয়ায় । কিন্তু জল খেয়ে একটু সুস্থ হয়েই ওর মুখে দেখা দেয় ভয় - চিত্কার করে কাঁদে - মুখে বলে - মা, বাবা । উদ্ধারকারীরা ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে - ওর মার, বাবার নাম, ওর নিজের নাম জিজ্ঞেস করে । ও উত্তর দেয় না, খালি চেঁচিয়ে কাঁদে ।

    উদ্ধারকারীদের একজন কাঁধ শ্রাগ করে । অন্যজনকে বলে, একে জাহাজে নিয়ে যাই । আর তো কিছু করার নেই ।

    তারপর তারা ওকে কোলে নিয়ে মূল দলটার দিকে হাঁটতে থাকে - কান ফাটানো চিত্কারে কাঁদে বাচ্চাটা - নিজের মা আর বাবাকে ডাকে ।




    ॥ ৩ ॥


    একটা লম্বা বারান্দা - তার একপাশে সার সার ঘর । সরকারি আশ্রয় । এখানে জায়গা পেয়েছে পিকু । কিছু বাচ্চাকে উদ্ধার করা হয়েছে যারা খুবই ছোট - তাদের মা বা বাবার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি - বাচ্চাগুলোও কিছু বলতে পারেনি । তাদের সঙ্গে রয়েছে পিকু । ওর দিদিমা অনুপমের অফিসে খোঁজখবর করেছিলেন । সেখান থেকে বলা হয়েছে অনুপম রায়চৌধুরী, তার স্ত্রী বা মেয়ের কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি । মহিলা তারপর আধপাগলের মত হয়ে গেছেন আর বিভিন্ন মন্দিরে মানত করে বেড়াচ্ছেন - যদি কোন দেবতা বা দেবী দয়া করেন । অনুপমের দাদা, জয়তীর দাদারাও অল্পস্বল্প খোঁজখবর করেছিল - এখন তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে ।

    সময়ের হিসেবে পিকুর বয়েস হয়তো বেড়েছে মাত্র একমাস - কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করলে ওর বয়েস বেড়েছে অনেক বেশি । ওর মনে এখন আনন্দের কোন জায়গা নেই, সেখানে এখন খালি ভয় আর সন্দেহ - পরিপার্শ্বিকের সব কিছু থেকেই ওর কোন ক্ষতি হবে এরকম একটা ভাব । সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটার স্মৃতি এখন ওর কাছে অস্পষ্ট - ধোঁয়াটে । বিরাট আর প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছিল সেটা ওর মনে আছে । তারপর কি হলো ? ওকে কেন এ-জায়গায় থাকতে হচ্ছে ? মা কেন ওর কাছে আসছে না ? মাঝেমাঝে সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে ওর মায়ের ওপর অভিমান । তখন প্রথমে ও ফোঁপায় - তারপর জোরে কান্না । বেশিরভাগ সময় সে কান্না নিজের থেকে থেমে যায় । হয়তো বা কখনো ঘরের দরজা খোলা ছিল আর সামনের বারান্দা দিয়ে এই সরকারি শিবিরের কোন কর্মচারী হেঁটে যাচ্ছিল । সে ঘরে ঢুকে পিকুর গালে বসিয়ে দেয় এক চড়- তখন পিকু হেঁচকি তুলে কান্না থামায় ।

    খিদে আর তেষ্টা - এই দুটো কষ্টদায়ক অনুভূতির সঙ্গে পিকু এখন ঘনিষ্ঠ পরিচিত । সকালে আর রাত্রে - দুবার দুটো ছোট ছোট থালায় কিছু জলো লপসি আসে । তার সঙ্গে এক গেলাস করে জল । ওদের লাইন করে বসিয়ে দিয়ে খেতে দেওয়া হয় - কেউ খাইয়ে দিতে আসে না, পিকু ঐ বিস্বাদ খাবার কিছু মুখে মাখে, কিছু ওর পেটে যায়, কিছু খেতে পারে না - ফেলে দেয় । গেলাসের জলও অনেকটাই বাইরে পড়ে যায় - মুখে, বুকে, পেটে । তাছাড়া যে মেয়েটি ওদের দেখাশোনা করে, খাবারটাবার দেয়, সে একটি অল্পবয়েসী তরুণী - এই সরকারি শিবিরেরই এক কর্মচারীর সঙ্গে তার ভালবাসাবাসি চলছে । তার মন পড়ে থাকে কতক্ষণে সে গিয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে গল্পগুজব, বা সুযোগ পেলে তার চেয়ে বেশি কিছু করবে । একেকদিন বাচ্চারা খেতে একটু দেরি করলেই অসহিষ্ণু হয়ে যায় - তাড়াহুড়ো করে তাদের থালা কেড়ে নেয় । বাচ্চাদের হাতমুখ ধুইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ওরই - ও দায়সারাভাবে একটু জল ঢেলে দেয় - তারপর বাচ্চাদের ঘরে বন্ধ করে দিয়ে চলে যায় ।

    অতএব এখন পিকুকে কেউ স্নান করিয়ে দেয় না, আদর করে মুখ ধুইয়ে দাঁত মেজে দেয় না । ওর মাথার চুলে জট, চোখভর্তি পিঁচুটি, দাঁত-মুখ ময়লা, ওর পরণের জামা ছিঁড়ে গিয়েছে - ওর গায়ে ছোপ ছোপ ময়লা জমতে শুরু করেছে । ওরা যে-ঘরে থাকে তাতে একটা নোংরা শতরঞ্চি বিছোনো আছে - বাচ্চারা তার ওপরে শুয়েই ঘুমোয় । ঘুমোনোর জায়গা নিয়ে অনেক সময়েই ওরা লড়াই করে - পিকুর পাশের বাচ্চা ওকে লাথি মারে, গালে নখ বসিয়ে দেয় । এভাবে পিকু আবিষ্কার করে নখ আর দাঁতের প্রয়োজনীয়তা । ও নিজেও এখন কিছুটা আত্মরক্ষার জন্যে, কিছুটা নিজের সুবিধে করে নেবার জন্যে অন্য বাচ্চাদের শরীরের ওপর দাঁত আর নখ ব্যবহার করে - আজকাল তো কেউ আর ওর নখ কেটে দেয় না । রাতে ঘুমের মধ্যে অনেক বাচ্চা পেচ্ছাপ করে ফেলে - ঘরে দুর্গন্ধ জমাট হয়ে থাকে যতক্ষণ না শতরঞ্চি বদলানো হয় আর যে-সব ত্রাণসামগ্রী আসছে তার থেকে বাচ্চাদের পরিষ্কার জামা বা ইজের পরতে দেওয়া হয় । বাচ্চারা যখন নিজেদের ভেতর লড়াই করে তখন নিজেদের ভাষায় চিত্কার করে রাগ প্রকাশ করে - থামে তখনই যখন নিজেরা ব্যথাবোধ করে বা কোন কর্মচারী এসে ওদের অপক্ষপাতে পেটায় । পিকু এখন এই সব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল - সব সময় সতর্ক আর সাবধান । যে-কোন সময় যে-কোন দিক থেকে বিপদ আসতে পারে । তার পরিণতি হবে ওর শারীরিক ব্যথায় - তা সে বড়দের থাপ্পড়েই হোক বা সমবয়েসীদের দাঁত নখের আঘাতের জ্বলুনিতেই হোক ।

    একদিন সকালে খাওয়ার পর পিকু বসেছিল ঘরের এককোণে - নানারকম ভাবনা ওর মনে তাল পাকায় - অনেক পুরনো কথা ঝাপসা ঝাপসা ওর মনে আসে । ওর অনেকগুলো পুতুল, সেগুলোকেও থাবড়া মেরে মেরে ঘুমপাড়ায়, আবার মারধর করে শাসনও করে । দু-এক সময় ওর মা ওর গালে ছোট্ট করে চড় মেরেছে তো - সেই শাসনই ও ওর প্রজাদের করে । একটা বড় ডল-পুতুল - ওর ভারি পেয়ারের । সেই সঙ্গে একটা ডগি আর একটা টেডি বিয়ার । ওরা সবাই খুব ভাল - পিকু যা বলে তাই চুপ করে শোনে - ছোট ছোট চোখে খালি সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে । ঠাকুমার কোলে পিকু শুয়ে আছে - মা কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলছে - আয় চাঁদ, আয় চাঁদ, পিকুর কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা - সে যে কি আনন্দ । কিন্তু মা, দিদিমা কোথায় গেল ? কাছে নেই তো । আবার আসে অভিমানের জোয়ার । দরজার বাইরে চোখ পড়ে - সেখানে এক নারীমূর্তি - অনেকটা ছায়ার মত - ধরাছোঁয়া যায় না - ওকে ? ওকি মা ? এক মুহূর্তে ওর অভিমান পরিণত হয় আনন্দে - এসেছে - মা এসেছে । ঘরের দরজা এখন খোলা - তত্ত্বাবধায়িকা মেয়েটি গিয়েছে তার প্রেমিকের কাছে । পিকু দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে - এপাশে ওপাশে তাকায় । মা কই ? কোথায় চলে গেল এর মধ্যে ? তারপরই পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করে - একটা বড় কালো পিঁপড়ে ওর পায়ের আঙুল কামড়ে ধরেছে । পিকু বসে পড়ে পিঁপড়েটাকে পায়ের আঙুল থেকে ছাড়ায় - তারপর ওটার ওপর রাগে ওটাকে মুখে দিয়ে কামড়াবার চেষ্টা করে, পিঁপড়েটা মরেনি - প্রকাণ্ড সাইজের ডেঁয়ো পিঁপড়ে - জান অত্যন্ত কড়া । ওটা পিকুর জিভের ডগা কামড়ে ধরে । ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে পিকু - এখন ওর আর ক্ষমতা নেই পিঁপড়েটাকে জিভের থেকে ছাড়ানোর । পাশের ঘরটায় ন-দশ বছরের সব ছেলেদের থাকতে দেওয়া হয়েছে - তাদেরও মা বাবা আত্মীয় স্বজন হয় মৃত নয় কারোর খোঁজ পাওয়া যায়নি । পিকুর আর্তনাদ শুনে তিন চারটি ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে । পিকু হাঁ করে চিত্কার করছে - জিভের ডগায় একটা প্রকাণ্ড কালো পিঁপড়ে লটকে আছে - দেখে ওরা হেসেই খুন । একটি ছেলে কিন্তু হাসে না । ছুটে আসে পিকুর কাছে - পিঁপড়েটাকে ছাড়িয়ে মাটিতে ফেলে দেয় । পিকু খুশি হয়ে দেখে কি ভাবে ওর শত্রু পিঁপড়েটাকে ছেলেটা তার পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে পিষে মারছে । ছেলেটার চোখ ছোট ছোট - সরু, নাক চেপটা । দেখলেই বোঝা যায় মঙ্গোলীয় কোন গোষ্ঠীর দ্বীপবাসী । সমুদ্রের নৃশংস ঢেউ-এর ধাক্কায় সে দ্বীপের বেশিরভাগই ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে । ছেলেটা পিকুর দিকে তাকিয়ে হাসে, ওকে কোলে তুলে নেয়, ওর জটপড়া চুলেভরা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । পিকু জানে না কখন ওর নিজের মুখেও হাসি ফুটেছে, ওর ছোট ছোট দুই হাত ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরেছে । ও জিভের জবিলুন ভুলে যায় - ওর মুখে থেকে খুশির আওয়াজ বেরিয়ে আসে - দাদা, দাদ্দা ।

    এরপর এই দুই অসমবয়েসী সাথীকে মাঝেমাঝেই একসঙ্গে দেখা যেতে থাকে । নিজের ঘরের দরজা খোলা পেলেই পিকু আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় - গুটি গুটি হেঁটে পৌঁছে যায় পাশের ঘরটার দরজার কাছে । ভেতরে ঢোকে না - ওখানে সব ওর দাদার বয়েসী ছেলে - পিকুর কাছে কতগুলো অপরিচিত প্রাণী যারা কোন না কোন ভাবে ওর ভয়ের কারণ হতে পারে । ওদের ঘরের দরজা সব সময় খোলাই থাকে - পিকু সন্তর্পণে ভেতরে উঁকি দেয় । কখনো ওর দাদাকে দেখতে পায় - কখনো বা পায় না । কারণ ঐ বয়েসের ছেলেরা বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ায় - খালি খাবার সময়টায় ঘরে আসে । ঘরে থাকলে ছেলেটা পিকুকে দেখতে পেলেই হেসে ফেলে - দৌড়ে বেরিয়ে আসে । তারপর দুই সঙ্গী কত গল্প করে । পিকু তার মনের সব কথা উগরে দেয় । ছেলেটাও বলে - নারকেল গাছে ভরা দ্বীপটায় ওদের ঘর ছিল । বাবা মা ছিল, পিকুর মতই একটা ছোট বোন ছিল । ও স্কুলে যেত । স্কুলের দেয়াল মাটির, চাল খড়ের - সকালে ধর্মীয় প্রার্থনা বলে দিনের শিক্ষার শুরু । স্কুল সেরে বাড়ি ফিরে এসে খেত মার হাতের তৈরি নারকেল তেলে রান্না খাবার । তারপর মার সঙ্গে হাত মিলিয়ে নারকেলের ছোবড়া ছাড়ানো । সেই ছোবড়া বিক্রী করে যা রোজগার তাতে চাল ডাল তেল নুন কেনা, স্কুলের খরচা দেওয়া । ও সে-সব কথা বলে । দুজনে কেউ কারোর ভাষা না জানলেও মনের ভাব বুঝতে অসুবিধে হয় না । তাছাড়া বাচ্চারা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি শেখে । পিকু এই অল্প সময়ের মধ্যে ঐ ছেলেটার ভাষা বেশ ভাল শিখে গেছে ।

    বেশি আব্দার করতে ইচ্ছে হলে পিকু দাদার কোলে উঠে বসে । কোন কারণে মনমেজাজ খারাপ হলে দাদার হাতে নখের আঁচড় কাটে - দু একটা কামড় ও দেয় । ছেলেটা খালি হাসে - পিকুকে প্রশ্রয় দেয় । কখনো পিকুর মনে হয় ওর দাদা পারে ওকে মার কাছে নিয়ে যেতে । তখন দাদার হাত ধরে টানে - এই দাদা, চল্‌ না - মার কাছে চল্‌ । কিন্তু ও অবাক হয়ে যায় যখন দেখে ওর কথা শুনে প্রথমে ওর দাদার মুখের সহজ হাসি মিলিয়ে যায়, ওর দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে, দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে । ও উঠে দাঁড়ায়, আস্তে আস্তে হেঁটে নিজের ঘরে চলে যায় । পিকুর প্রবল অভিমান হয় - মুখ ভারি হয়, নিচের ঠোঁট ফুলে গিয়ে উল্টে যায় - ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে । ওর কথা শুনে দাদা কেন ওর কাছ থেকে চলে গেল ?

    আবার ওরা দেখা করে, একসঙ্গে হাসে, যে যার কথা বলে । ছেলেটা গান করে, পিকুও তাতে গলা মেলাবার চেষ্টা করে । ছেলেটা ক্রিশ্চান - ও নিজের ভাষায় ঈশ্বরের প্রার্থনা পিকুকে শেখায় - পিকুও ওর সাথে সাথে প্রার্থনা করে - হে আমাদের স্বর্গস্থ পিত: -। কিন্তু কোন কোন সময় ওদের দেখে ফেলে পিকুদের ঘরের তত্ত্বাবধায়িকা মেয়েটি । সে যদি ঘুরে ফিরে নিজের ডিউটিতে আবার ঐ সময়েই এসে পড়ে তাহলে ছেলেটার পিঠে পড়ে দমাদ্দম কিল চড় । আর পিকুর কান ধরে হিড় হিড় করে টেনে আনা হয় ঘরের ভেতর - দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে হুড়কো টেনে দেওয়া হয় । পিকু কাঁদে - কখনো বা রাগে চিত্কার করে । স্নায়ুর ওপর বেশি ধাক্কা লাগলে সময়ে সময়ে ঘরের ভেতর হিসি করে দেয় । মেয়েটা যখন আবার ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে তা টের পায় তখন ওর কপালে জোটে আর এক চোট মার ।

    প্লাবনের পরে গোটা দ্বীপপুঞ্জটায় দেখা দিয়েছে পানীয় জলের অভাব । দূষিত জলও মিশছে খাবার জলের সঙ্গে । সেই সঙ্গে ত্রাণশিবিরগুলোতে লেগেছে আন্ত্রিক রোগ । একদিন পিকু বারান্দায় বেরিয়েছিল দাদার খোঁজে । ও দেখতে পেল দাদার ঘরের দরজার সামনে একটা ছোট গোছের ভিড় - বেশ গোলমালও হচ্ছে সেখানে । সব অনাথ ছেলেগুলো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে - দুটো বয়স্ক লোক কিছু তীব্র গন্ধের ওষুধ মেশানো জল ঢালছে ঘরের ভেতর । আরও কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । ওর শিশুমন কৌতূহলী হয় - ও সেদিকে এগিয়ে যায় - তারপর সব বয়স্ক লোকগুলোর পায়ের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে ওর দাদা শুয়ে আছে একটা বড় চটের টুকরোর ওপর । শোয়াটা একটু অদ্ভূত ধরনের - চোখ দুটো বোজা, মুখটা কিরকম শক্ত হয়ে বেঁকে রয়েছে - সারা মুখে, গায়ের জামায় কি সব হলদে জিনিষ শুকিয়ে আছে - অস্বাভাবিকভাবে চিৎ হয়ে পড়ে আছে চটটার ওপর । দাদা এই সময় চটের ওপর শুয়ে বারান্দায় ঘুমোচ্ছে কেন ? ওকে ডেকে তোলার দরকার । কিন্তু আর একটু এগোতেই ওই লোকগুলো পিকুকে দেখতে পায় । একজন হাতের ধাক্কায় পিকুকে রূঢ়ভাবে সরিয়ে দেয় । পিকু ব্যথা পায়, কিন্তু তা ছাপিয়ে ওঠে ওর বিস্ময় । চারটে লোক চটটার চারটে কোনা ধরে দাদাকে মাটি থেকে ওপরে তুলে ফেলে তারপর সে ভাবেই ঝুলিয়ে ধরে ওকে নিয়ে চলে যায় । পিকু হতাশার কান্না কাঁদে - কোথায় গেল দাদা ? তারপর নিজের ঘরে ফিরে আসে ।

    তারপরেও পিকু যখনই সুযোগ পায়, পাশের ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মারে । কিন্তু দাদার সেই হাসিমুখ আর দেখতে পায় না । ফিরে আসে - নিজের কোণটায় গিয়ে বসে । ও এখন ভাবতে শিখেছে - আশা করতে শিখেছে । ওর মনে কয়েকটা মানুষের চেহারা আঁকা আছে - ওর মার, ওর বাবার আর দিদিমার । ও তার পাশে দাদার ছবি আঁকে । নিজের মনে ওর দাদার ভাষায় বলে - হে আমাদের স্বর্গস্থ পিত: - আমার মাকে দাও, বাবাকে, দিদিমাকে, দাদাকে দাও - কখনও জোরে জোরে বলে, কখনও বা গুনগুন করে । এইভাবে পিকু তার প্রার্থনা বলে যায় - বলতে থাকে - আবারও বলে ।

    (পরবাস-৩৮, নভেম্বর, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)