তাই জানালা দিয়ে আমার ব্যাকইয়ার্ডের দিকে চেয়ে থাকি । ছেলেরা যখন ঘরে ছিল, ওদের মা'ও মোটামুটি চলাফেরা করতে পারত, তখন হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সবজির বাগান করতাম গরমের সময় । বরফগলা গাছের শাখায় পাখিদের কাকলি শোনার সাথে সাথে মন চঞ্চল হয়ে উঠত মাটি খুঁড়ে চারা লাগাবার জন্যে । একরত্তি জমির ওপর কতকিছু যে লাগাতাম - টমাটো তো বটেই, তারপর বেগুন, লংকা, জুখিনি, শশা, মটরশুঁটি । আমার ক্ষেতের ফসল দিয়ে গিন্নীর একটা বড় ফ্রিজার বোঝাই হয়ে যেত । কপট উষ্মা সহকারে বলত, তোমার গায়ে চাষীর রক্ত । আমি সগর্বে স্বীকার করতাম কথাটা । আমার কাছে চাষী শব্দটা কোনও গাল নয়, উপাধি । কোন কোন মানুষ যেমন কবিতা না লিখেও কবি, আমিও তেমনি চাষ-আবাদ না করেও চাষী । গিন্নীকে হাসিমুখে কুর্নিশ করে বলতাম, আলবৎ মহারানী, আপনার প্রদত্ত খেতাব আমি নতশিরে গ্রহণ করে নিলাম ।
একসময় খোকারা চলে গেল জীবনের পথে । চাষী-বলে-খোঁটা-দেওয়া বউটাও অকারণে অভিমান করে চলে গেল কোথায় । নিজের হাতে তাকে মাটির নিচে শুইয়ে এলাম । তা'ও চার বছর হয়ে গেল । এখন আমি দিনান্তের কূলে একা একা বসে আছি শেষ খেয়ার অপেক্ষায় । অথচ কি আশ্চর্য, আমার সেই `চাষীর রক্ত' এখনো টগবগ করে ওঠে বসন্তের কুঁড়ি ফুটলে । ডাক্তার বলেছেন টমাটো জিনিসটা আর সহ্য হবে না আমার । পাকস্থলীর কোনও এক গূঢ় প্রদেশে গুরুতর গোলযোগের পূর্বাভাস - টমাটো তাকে আরো উস্কে দেবে । তাই আমি এখন টমাটো বর্জন করি খাবার টেবিলে । কিন্তু তাই বলে টমাটোর চারা লাগানো বন্ধ হবে কেন ? নিজে না খাই পাখিরা খাবে । পাড়াপড়শিরা খাবে । ফলগুলো লাল হয়ে আমার দিকে তাকাবে, আমাকে মনে করিয়ে দেবে পুরনো দিনের কথা । তাই বা কম কী আমার বয়সে । আগের মত যত্ন নিতে পারি না যদিও সেই যে কোমর ভেঙেছিল একবার ত্রিশ বছর আগে সেটা নতুন করে চাড়া দিতে শুরু করেছে । হাঁটু গেড়ে বসতে কষ্ট হয় । তাছাড়া ঘন ঘন বাইরে চলে যাই । এখানে ওখানে লোকজন যেতে বলে । অনুষ্ঠানাদিতে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির আসনে বসিয়ে ওরা মঞ্চের ওজন বাড়ায় । আমি মাননীয় অতিথির আসন অলংকৃত করে সুখের নিদ্রা উপভোগ করি, আর ওরা মাইকে দাঁড়িয়ে অনলবর্ষী বক্তৃতা দেয় । ইতোমধ্যে দগ্ধ হতে থাকে আমার অভাগী বাগান । ফিরে এসে দেখি ঘাস পুড়ে গেছে, টমাটোর চারাগুলো পিপাসায় কাতর । নিজের ওপর রাগ হয় খুব । কেন মিছিমিছি কষ্ট দেওয়া গাছগুলোকে । এবার শখ করে গোটা ছয়েক বেগুনের চারাও লাগিয়েছিলাম । বেগুন আমার খুব পছন্দের সবজি । বেগুনভর্তা পেলে আর কোনকিছুরই প্রয়োজন হয় না আমার । আগে অনেক বেগুন হত আমার বাগানে । কিন্তু এবার চারাগুলো গাছ হয়ে ওঠার সুযোগ পেল না । একঝাঁক খরগোশ এসে আস্তানা গেড়েছে আমার ব্যাকইয়ার্ডে । আমার মত ওদেরও খুব পছন্দের জিনিস এই বেগুন - তবে ফল নয়, চারা । একদিন সকালে উঠে দেখি গোড়া থেকেই পরিষ্কার করে কাটা সবগুলো গাছ । পাঁচ-দশ বছর আগে হলে খুব মন খারাপ করে বসে থাকতাম, হয়ত তত্ক্ষনাৎ `রোনা'তে গিয়ে খরগোশ তাড়ানোর জন্যে কোন বিষাক্ত ওষুধ কিনে আনতাম । এবার শুধু ভাবলাম, থাকনা । খেয়েছে, খাক । ওদেরও তো একই সংগ্রাম, আমাদের মত । ভাগ্য ভাল যে খরগোশদের কোনরকম টমাটোপ্রীতি নেই । জীবজগতের জ্ঞানকোষ ঘাটলে হয়ত দেখা যাবে খরগোশজাতির আহার্যতালিকাতে টমাটোর উল্লেখ নেই ।
ভেবেছিলাম বড়দিনের ছুটিতে দেশে যাব মাসখানেকের জন্যে । বোনটি বলল, এবার নাই বা এলে দাদা । দেশের আবহাওয়া ভাল নয় । নির্বাচন আসছে জানুয়ারীতে । ও, তাইতো ! নির্বাচন । সাংঘাতিক জিনিস । নির্বাচনে গণতন্ত্র যত কমছে খুনখারাপি ততই বাড়ছে । কি বলব একে ? অরাজকীয় গণতন্ত্র ? ঠিক আছে বোন, যাব না । কিন্তু পরের বছর ? তখন তো নির্বাচন থাকবে না, গণতন্ত্রও থাকবে না । তখন কি আবহাওয়া ভাল হবে ? কিম্বা তারও পরের বছর ? মনে তো হয় না বোন । ইতোমধ্যে বয়সের গাড়িটাও যেন স্পীড বাড়িয়ে দিচ্ছে দিনদিন । আর কতকাল ভ্রমণ করতে পারব একা একা কে জানে । দেশের মায়া এখনো কাটেনি একেবারে । দুটি ভাই আর দুটি বোন ওখানেই থাকে । ওদের বাড়িতেই পালা করে থাকি যখন যাই । বাকি দু'ভাই আর এক বোন বিদেশে । ছাত্রবয়সে আমরা সবাই এক বাড়িতে থাকতাম গোঁজাগুঁজি করে । পুরনো ঢাকার একটি ভাড়াবাড়িতে দু'টি অন্ধকার ঘরের ভেতর ন'টি ভাইবোন আর বাবা-মা । যেখানে থাকা সেখানেই খাওয়া সেখানেই পড়ালেখা, সেখানেই স্বপ্নের জাল বোনা । আমরা ভাইগুলো স্কুলে যেতাম পায়ে হেঁটে, ছেঁড়া কাপড়ের জুতো পরে, বছরে একটি শার্ট, একটি গেঞ্জি, একটি প্যান্ট । বোনগুলোর অবস্থা ছিল আরও শোচনীয় । ওরা কখনো নালিশ করত না বলে বুঝবার উপায় ছিল না কতটা শোচনীয় । তবুও কি আশ্চর্য, মোটামুটি সুখের জীবনই ছিল আমাদের । সেসময় আমাদের বৈদ্যুতিক আলো ছিল না, পানির কল ছিল না, দেয়ালবিহীন কুয়োতলায় ভাইবোনেরা একসাথে চান করতাম, নাকে লুঙি গুঁজে কাচা পায়খানায় কুঁজো হয়ে বসতাম - সে এক আদিম জীবন বটে । অথচ কি স্নিগ্ধ প্রশান্তিময় জীবন ছিল সেটা । আমাদের চাহিদা ছিল কম, প্রাপ্তি আরো কম, কিন্তু তৃপ্তি ছিল অনেক, স্বপ্ন ছিল আরো অনেক । সেই ন'জনার মধ্যে একজন চলে গেছে অকালে, বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে । বছরের পর বছর চলে যায় দেখা হয় না কারো সঙ্গে, কথাও হয় না বড় একটা, চিঠিও কেউ লেখে না আজকাল । তবু দিন কেটে যায়, জীবন চলে তার নিজের ছন্দে, কেউ কারো জন্যে এক নিমেষ দাঁড়াবার সময় পাই না । একসময় আমরা কেঁদে কেঁদে সারা হতাম যদি কাউকে একরাত্রের জন্যে যেতে হত কোথাও । আজকে আমাদের অভাব কেটে গেছে, সবারই বাড়িগাড়ি হয়েছে, ছেলেমেয়েরা সকলেই ও লেভেল এ লেভেল করে বিলেত আমেরিকায় চলে যাচ্ছে । আজকে আমরা কেউ কারো জন্যে কাঁদি না, বছরের পর বছর কথা না হলেও মন খারাপ করি না । দূরত্বটা যে কেমন করে গড়ে উঠল জানি না, সেটা নিয়ে এখন আর মাথাও ঘামাই না । বরং মনে হয় ভালই আছি দূরে আছি । কি অদ্ভুত এই মানবচরিত্র । ছোটবেলায় যত কাছে থাকি তত টান বাড়ে । বড় হলে কেন যে সে টান রাখার জন্যে দূরে থাকতে হয় সে রহস্য আমি এখনো বুঝি না । আজকে দারিদ্রের কষ্ট থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি, তার বদলে পেয়েছি আরেক-ধরনের কষ্ট, যাকে আমি বলি প্রাচুর্যের কষ্ট । প্রচুর যাদের আছে তাদের শূন্যতাও প্রচুর ।
আগে যেমন ঘন ঘন দেশে যেতে ইচ্ছে করত এখন তেমন করে না । তার বড় কারণ কিন্তু দেশের সন্ত্রাস বা অরাজকতা নয়, বড় কারণ সমমনা মানুষের নিদারুণ অভাব । কথা বলার লোক পাই না । ওদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনার কোন মিল নেই । পৃথিবীকে আমি যেভাবে দেখি ওরা সেভাবে দেখে না । ওরা যে চোখে দেশকে দেখে আমি দেখি ভিন্ন চোখে । ওরা দিনে পাঁচবার `নামাজের সময় হয়ে গেল' বলে আলাপের সুতো কেটে দেয় । আমার নামাজের সময় কখনোই হয় না । ওরা দুপুর দু'টোতে একমণ ভাত আর আধমণ মাছ মাংস ডিম পরোটা খেয়ে পেট ফুলিয়ে নাক কাঁপিয়ে ঘুমায় । আমি বারোটা বাজতে না বাজতেই একটা স্যাণ্ডউইচ আর চার চামচ দই খেয়ে বইখাতা নিয়ে বসি । আমার বন্ধুবান্ধবদের সকলেই অন্তত একবার হজ করেছে, এমনকি নিজের ভাইবোনেদেরও কেউ কেউ । আমি হজ করিনি এবং হজের সামাজিক বা আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তাও বুঝি না । বন্ধুদের অনেকেই দাড়ি কামানো ছেড়ে দিয়েছে, এমনকি মাথা থেকে টুপিটাও খোলে না সচরাচর । যেখানে যায় সেখানেই তসবিটা হাতে থাকে, বিড়বিড় করে কি বলে সারাক্ষণ । সারাক্ষণই মাথা ঠুকছে, মাথা ঠুকছে । ঠুকতে ঠুকতে কালো দাগ করে ফেলেছে কপালের মধ্যখানে । হিন্দু মেয়েদের কপালের সিঁদুর যেমন সধবার লক্ষণ, মুসলমান পুরুষদের কালো দাগ তেমনি ধর্মসাধনার লক্ষণ । এরাই আমার পুরাতন বন্ধু । এদের কেউ কেউ এককালে বাম রাজনীতি করত । মহাহুংকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর কাঁপিয়ে তুলত । বন্দুকধারী পুলিশদের ওপর ইঁট-পাটকেল ছুড়ত । তারা যখন বাম ছিল, আমি ছিলাম মধ্যম । ডান আর বাম দু'টোই আমার কাছে জটিল ও বিপজ্জনক মনে হত । গাড়ি চালাবার সময়ও আমি মাঝের লেনে থাকতে পছন্দ করি । আমি এখনো মধ্যপন্থী । বন্ধুদের যারা বামে ছিল তারা এখন ডানে । যারা ডানে ছিল তারা মৌলবাদের শিবিরে ঢুকেছে । তাহলে বলুন, কিসের মোহে আমি বারবার দেশে যেতে চাইব ? আগে দেশের গাছপালা বনবনানী নদীনালাও একটা বড় আকর্ষণ ছিল । গ্রামে গেলে ডাহুকের ডাক শোনা যেত, জোনাকিদের সঙ্গে ভাব জমানো যেত অমাবস্যার রাতে । এখন তো ওসবও চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে । নদীগুলো বেনেদের দখলে । খালবিলে কারখানার বিষাক্ত বর্জদ্রব্য । বনবাদাড় সাফ করে ফ্ল্যাট-বাড়ি বানাচ্ছে সবাই । গাছ কেটে উনুন জ্বালাচ্ছে । আগে আকাশের রং ছিল নীল, এখন হয়েছে ছাইরঙা । আগে গরিবের খাদ্য ছিল নদীর মাছ । এখন মাছ দিয়ে কর্তারা ডলার বানাচ্ছে । ইলিশমাছ খেতে ইচ্ছে হলে এখন ব্যাংকক বা রেঙ্গুন যেতে হবে । চিংড়ি, রুই, কাতলা, কই - এগুলোর ভাল বাজার হল লণ্ডন, নিউইয়র্ক আর টরন্টোতে । আমার ছোটবেলার দেশটাকে ওরা, স্বাধীনতাপরবর্তী খলশাসকরা, পাঁতিশোষকরা, প্রায় আক্ষরিক অর্থেই উলঙ্গ করে, বিশ্ববাণিজ্যের কাছে বিক্রয় করে ধনকুবের হয়েছে । না ভাই, দেশে যাবার কথা ভেবে এখন আর মন চঞ্চল হয় না, শংকিত হয়, ব্যথিত হয় ।
আমি টেলিভিশন দেখি না খুব একটা । সন্ধ্যায় খাওয়াদাওয়ার পর খবরটা দেখি । মাঝে মাঝে একলা বাড়ির শব্দহীনতা যখন পীড়া দিতে শুরু করে কিঞ্চিৎ তখন বোতাম টিপে যন্ত্রটা চালিয়ে দিই । কান থাকে ওতে কিন্তু মন থাকে অন্যত্র । বইটই পড়ি । পত্রপত্রিকা তো রোজই জমা হচ্ছে, সেগুলোতে চোখ বুলোই । সেদিন এক ভদ্রমহিলা টিভির পর্দায় এলেন এক মজার আইডিয়া নিয়ে । মনস্তত্বের ডিগ্রি তাঁর । নিজের বাসগৃহে একটা ক্লিনিক খুলেছেন তিনি যার নাম দেওয়া হয়েছে : হ্যাপিনেস ক্লিনিক । অর্থাৎ সেখানে দর্শন দিলে সুখী কেমন করে হতে হয় তা শেখা যাবে । তাঁর দু'চারটে বাণী শ্রবণে এল । এক, দুর্ভাবনাকে বিদূরিত করা । যাকে ইংরেজিতে বলে রিল্যাক্স । মনে মনে হাসলাম । আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাতে যে-কটি আপ্তবাক্য আয়ত্ত হয়েছে তার একটি হল : ইংরেজির রিল্যাক্স শব্দটির উচ্চারণ যত সহজ পালন ততটাই কঠিন । দুই, সবকিছু সহজভাবে নেওয়া । টেইক ইট ইজি - এদেশের প্রবাদ । সেটারও একই সমস্যা । `ইজি' টা সত্যি সহজ, শক্ত হল `টেইক'টা । তাঁর তৃতীয় উপদেশ : হাসুন, খুব করে হাসুন । প্রাণ খুলে যে হাসতে পারে সে'ই জানে সুখের খবর । মূল্যবান কথা, সন্দেহ নেই । কিন্তু আজকের যান্ত্রিক যুগে প্রাণটাই যখন চাকার নিচে চাপা পড়বার উপক্রম তখন প্রাণ খুলে মানুষ হাসবে কেমন করে ? সুখের প্রশ্নটা কিন্তু ভাববার মত । সারাজীবনই তো আমরা সুখ খুঁজে বেড়াই । আমি তার ব্যতিক্রম নই । কিন্তু শেষমেষ আমার মনে হয়েছে সুখ বলতে আসলে কোন জিনিস নেই । ওটা মনেরই একটা গুণমাত্র । কিম্বা দোষ । কেউ কেউ কিছু না পেয়েও সুখী । আবার অনেকে সব পেয়েও সুখী নয় । আমার মনে হয় সুখ জিনিসটা অনেকাংশেই চরিত্রজাত । সুখের বোধ নিয়ে যে জন্মায়নি সে কখনোই সুখী হবে কিনা সন্দেহ ।
সুখ ব্যাপারটা একেবারে অলীকও নয় কিন্তু । স্থায়ী সুখের একটা উপায় আছে বই কি । তবে সেটা পাওয়াতে নয়, দেওয়াতে । ভোগে নয়, ভাগাভাগিতে । কৈশোর আর যৌবনে আমাদের ভাইবোনেরা ভাগাভাগি করতে জানতাম বলেই চরম কষ্টের মাঝেও পরম সুখের পরশ পেতাম । এখন আমরা ভোগটাই জানি শুধু, ভাগাভাগিটা ভুলে গেছি । হয়ত সেকারণেই আপাত সুখের মধ্যেও আমরা একান্ত একা । আমাদের সচ্ছলতা থেকে জন্ম নিয়েছে একধরনের নিশ্চল যন্ত্রণা । জীবনের অনেক কংকরাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে এটুকু উপলব্ধি আমার এসেছে যে ব্যক্তিগত সুখ একটা মরীচিকা মাত্র । ব্যক্তিগত সুখ তখনই বাস্তব হয়ে ওঠে যখন সে সুখ ব্যক্তির কেন্দ্র থেকে নিষ্কৃত হয়ে সমষ্টির বহুত্বের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । যে-মানুষ নিজেকে নি:স্ব করে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, ক্ষুধার্তের কাছে আনতে পারে অন্ন, আর্তপীড়িতের কাছে আনতে পারে নিরাময়, সত্যিকার সুখ কেবল তাদেরই প্রাপ্য । আমার বড় হিংসে হয় যখন দেখি ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্সের তরতাজা তরুণ ডাক্তারগুলো নিজেদের জীবন কেরিয়ার পসার কোনকিছুরই বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে বিনা পারিশ্রমিকে চলে যাচ্ছেন এশিয়া আর আফ্রিকার নানা বিপজ্জনক ত্রাণশিবিরে, বা দেখি রেডক্রস, কেয়ার, অক্সফ্যাম আর চার্চসংশ্লিষ্ট শত শত স্বেচ্ছাসেবককে ; হিংসে হয় এজন্যে যে তাদের মত সুখী আমি হতে পারলাম না । যারা দাতা, যারা আর্ত আর দুর্গতের পরিত্রাতা তারাই জানেন সত্যিকারের সুখ কাকে বলে । সংসারে যারা বড় বড় কাজ রেখে গেছেন মানবজাতির জন্যে, বড় বড় দাতব্যপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গেছেন পৃথিবীর কেন্দ্রে কেন্দ্রে, আমার চোখে তারাই একমাত্র নমস্য ব্যক্তি । সুখের উত্তরাধিকার কেবল তাদেরই ।
এই এক দোষ আমার - এককথা থেকে আরেক কথায় চলে যাওয়া । কি করব বলুন, কথায় কথা এসে যায় । দেশের কথা বলছিলাম, আপনজনদের কথা বলছিলাম । সেই থেকেই তো সুখের কথা চলে এল । এবার এক পুরনো বন্ধুর কথা বলব । আমরা প্রায় সমবয়সী, একই বছর পাস করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । আমি ছিলাম গণিতে, ও অর্থনীতিতে । আমি ছিলাম শান্তশিষ্ট গোবেচারি ভালছাত্র, ও ছিল দৃপ্ত চঞ্চল প্রত্যয়ী ভালছাত্র । উচ্চতায় আমার প্রায় দেড়গুণ, দেহসৌষ্ঠবেও আমার বিপরীত । অত্যন্ত সুদর্শন সুপুরুষ, সুবেশী - গ্রীকদেবতা অ্যাপোলোর প্রতিকৃতি যেন । গুণেও অসাধারণ । বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একটি ছাত্র বা ছাত্রী ছিল না যে তার বক্তৃতা শোনার জন্যে ক্লাস কামাই করতে প্রস্তুত ছিল না । মুগ্ধ শুধু নয়, মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত সবাইকে । অত্যন্ত বাকপটু, চৌকশ, বুদ্ধিমান ও সপ্রতিভ । আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে একসময় সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে, তার বুদ্ধি ও মেধার ফসল দিয়ে ধন্য হবে সারা দেশ । এমনও আশা ছিল আমাদের যে ওর নেতৃত্বে হয়ত দেশ তার হারানো পথ ফিরে পাবে, পুনরুদ্ধার হবে আমাদের হারানো গৌরব । বলা বাহুল্য যে সাফল্য ও কীর্তির অভাব ছিল না তার জীবনে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ডিগ্রি, বিলেতে উচ্চশিক্ষা, ব্যারিষ্টারী পরীক্ষায় তাকলাগানো কৃতিত্ব, খানদানি পরিবারের রূপসী কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধন - আরব্যোপন্যাসের রূপকথারই মত অনেকটা । কিন্তু যেপথে যাওয়ার কথা ছিল তার, যেপথে যাবে বলে আমাদের সবারই প্রত্যাশা ছিল, সেপথে তার যাওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত । সে দেশবরেণ্য নেতা না হয়ে হয়েছিল দেশবরেণ্য ব্যারিষ্টার । উঁচুমানের উঁচুমূল্যের জাঁদরেল ব্যারিষ্টার । ক্রোড়পতি আইনজীবী । গুজব শুনেছি তার দৈনিক উপার্জন ছিল পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা । অথচ তার নামে বা তার অনুদানে কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান হয়েছে দেশে এমন গুজব আমার কানে আসেনি এখনো ।
অনেকদিন আমাদের কোনও যোগাযোগ ছিল না । ও দেশে, আমি বিদেশে । ওর পথের থেকে আমার পথ অনেকটাই বাঁকা । চারবছর আগে যখন দেশে গেলাম বেড়াতে, শুনলাম সে আর তার স্ত্রী দুজনই খুব অসুস্থ । ভাবলাম, দেখতে যাওয়া উচিত । ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় বিশাল জায়গা জুড়ে তার প্রাসাদ । সামন্তযুগের দুর্গের মত সুরক্ষিত - উঁচু দেয়ালের মাথায় ধারালো কাঁচের টুকরো । প্রকাণ্ড গেটের ভেতরে মাথা গলাতেই ভয় করছিল । পাছে না কোনও অ্যালসেশিয়ান এসে ঝাঁপ দেয় গায়ে । সৌভাগ্যবশত: আমাদের দেশের ধনবানদের কুকুরপ্রীতিটা খুব প্রবল নয় - না, ওবাড়িতে কোনও কুকুর ছিল না । তবে গোটাদুয়েক দারোয়ান ছিল । ভৃত্য ছিল ক'জন জানি না । একজন এসে সালাম ঠুকে দাঁড়ালো কাঁচুমাচু করে । বললাম, সাহেবকে খবর দাও ক্যানাডা থেকে পুরনো বন্ধু এসেছে দেখা করতে । ও ভেতরে গেল সাহেবকে বলতে । কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, সাহেব ঘুমোচ্ছেন । একটু দমে গেলাম । একবার মনে হল ফিরে যাই । তারপর কি ভেবে বললাম, তাহলে বিবিসাহেবকে খবর দাও । বিবিসাহেব তখন ওপরে । তাঁর নির্দেশে ছেলেটি আমাকে বৈঠকখানায় নিয়ে বসতে দিল । তারপর আমার কাছে মোবাইল ফোনটি এগিয়ে দিয়ে বলল, বিবিসাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলবেন । ফোনে ভাবীর অমায়িক কন্ঠ শুনে ভাল লাগল । দু:খ প্রকাশ করে বললেন যে তিনি নিচে নেমে আমার সঙ্গে বসতে না পারার জন্যে খুবই লজ্জিত বোধ করছেন । অনেকদিন থেকে দুরারোগ্য গেঁটে বাতে ভুগছেন । এমন অবস্থা এখন যে ওপর থেকে নিচে নামার উপায় নেই । এদিকে আমার বন্ধুটির উপায় নেই নিচে থেকে ওপরে যাওয়া । স্ট্রোক হয়ে শরীরের একটা অংশ অবশ হয়ে গেছে । কথাও বলতে পারে না কারো সঙ্গে । আমি স্তব্ধ হয়ে শুনলাম তাঁর কথাগুলো । রূপকথারই শেষ অধ্যায়টির চরম বিড়ম্বনাময় দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে নিজের অস্তিত্বটাকেই কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল আমার । যে লোকটার দেশবরেণ্য নেতা হওয়ার কথা ছিল সে আজকে শয়নকক্ষের রুগ্নশয্যায় চিরবন্দী । যার বাগ্মিতার জন্যে শত শত তরুণ ছাত্রছাত্রী ভিড় জমাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলাতে, যার ধারালো যুক্তিতর্ক মানুষ লাখ টাকা দিয়ে কিনতে চাইতো, সেই লোকটা আজকে নিয়তির এক নিষ্ঠুর বিড়ম্বনার শিকার হয়ে শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় মহাপ্রভুর দুয়ারে দণ্ডায়মান । বাংলাদেশের ইতিহাসে যার নাম সোনার অক্ষরে খোদাই হবার কথা ছিল তার স্মৃতি হয়ত পাড়ার লোকেদের মন থেকেও মুছে যাবে দু'চার মাসের মধ্যে । এত অগাধ ধনসম্পদ দিয়ে বোঝাই করেছে সে তার পারিবারিক কোষাগার, অথচ আজকে একই বাড়িতে সে ওপরতলায় যেতে পারে না স্ত্রীর কাছে, ওপরতলা থেকে তার রুগ্না স্ত্রী নিচে নামতে পারে না মৃত্যুপথগামী স্বামীকে একদণ্ড দেখার জন্যে । এরই নাম জীবন ।
ক্যানাডায় ফিরে আসার দু'মাস পর খবর পেলাম বন্ধুটি চলে গেছে । পঞ্চাশ বছর আগেকার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা সেই অশ্বারোহী যুবরাজ তার নিজেরই সৃষ্ট ধূলার রাজ্যে মিলিয়ে গেল ধূলিকণাদেরই সাথী হয়ে ।
(অটোয়া, ১২ই মার্চ, ২০০৬;
মুক্তিসন ৩৪
পরবাস, মার্চ, ২০০৬)