---------
যে ভাবে হয় সেই ভাবেই হয়ে গেল সবকিছু । প্রেমাংশুবাবুর দেহ ছাই হয়ে যেতে যতটা সময় দরকার ততটাই লেগেছিল ঠিক । চা-মিষ্টি খেয়ে যে প্রত্যাবর্তন তার কোথাও ছিল না কোনোরকম নাটকীয়তা । যখন দাহক্ষেত্রের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয় তখন নেমেছিল সবাই । সবাই খালি হাতে উঠে এসেছিল । কেবল অনিরুদ্ধই সেই মৃত্পাত্র বহন করে যার মধ্যে পিতার নাভি আছে এমন কথা জানানো হয়েছে এবং যা হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দরাদরির পর যে অর্থ ঠিক হয় সেই অর্থের বিনিময়ে । সবকিছু যে ভাবে হয় সেইভাবেই হয়েছিল ঠিক । শুধু অনিরুদ্ধ সামনেই যে জলাশয় তার শীর্ণতা ও সংকীর্ণতার মধ্যে নাভি ন্যস্ত করে ডুব দিতে চায়নি । তার আপত্তির মধ্যে বাস্তবের বাহুবল ছিল, ছিল যুক্তির প্রশ্রয় । যে জল কৃষ্ণতম হয়েছে, অবহেলিত হতে হতে পতিত হয়েছে, তার কোলে কোনোকিছু উত্সর্গ করা যায় না, সম্ভব হয় না কোনোরকম গাহনও । পিতার সঙ্গে তার যোগসূত্র কতটা আবহমান থেকেছে এই প্রশ্ন নীলিমার মাধ্যমে ধীরেন্দ্রর মনে সঞ্চারিত হলেও জলের আবহমানতা নিয়ে যে সংকট তা স্বীকার করে নিতে দেরি হয়নি তারও । ফলে যেখানে লঞ্চ চলে, স্টিমারের শব্দ শোনা যায়, শুশুকের মতো হঠাৎ মাথা তোলে শুশুকই বোধ হয়, যেখানে সাঁতারের পটভূমি মিশে যায় স্নানের পটভূমির মধ্যে, বিসর্জিত হয় দেবীশরীর, যেখানে জলের মৃত্যু নেই কখনো, শুধু তারল্যের মৃত্যু আছে সর্বদা, সেখানে নাভি নিয়ে জিপে করে সরাসরি চলে যাওয়ার প্রস্তাব শেষে সিদ্ধান্তে পরিণত হয় । চোখের সামনে দিয়ে জিপ চলে গেলে ধীরেন্দ্র আবিষ্কার করে সবাই চলে গেছে, কেবল প্রতিমা দাঁড়িয়ে । এতক্ষণ প্রতিমা ছিল সামাজিকতার কেন্দ্রে । বিলীয়মান জিপের দৌলতে সে এসে পড়েছে ব্যক্তির কেন্দ্রে এবার । ধীরেন্দ্রর মনে হলো, প্রতিমাকে এত অচেনা লাগেনি কখনো । - কী গো, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে ? বাড়ি ফিরতে হবে না ? প্রতিমার কথাও যেন দূরের শব্দ মনে হতে থাকে । ঘর যত বিমূর্ত হয় তত তার সঙ্গে পাল্লা দেয় ঘরনির বিমূর্ততা । তার পক্ষে এখনই সম্ভব নয় প্রতিমাকে পাশে রেখে কোনো লক্ষ্যের দিকে হেঁটে যাওয়া । - তুমি যাও, সারাদিন যা ধকল গেছে তোমার । রেবা বেচারা একা একা বাড়ি পাহারা দিচ্ছে সেই কখন থেকে । আমি একটু পরে যাচ্ছি । - কেন, আমার সঙ্গে ফেরা যায় না ? শ্মশানে তো অনেকক্ষণ কাটালে । পরে-টরে নয়, একসঙ্গে বাড়ি ফিরব । ধীরেন্দ্র জানে দ্বৈততা যতই বিমূর্ত মনে হোক একা থাকার চেষ্টাগুলিও খুব ভিত্তিময় নয়, ভেঙে পড়ে একটু বাধাতেই । নতুন করে হরিধ্বনি ওঠে, নতুন শব দৃশ্যমান হয় এবং নতুন এক সঙ্ঘবদ্ধতা যে পথ দিয়ে জিপ চলে গেছে সেই পথ দিয়ে প্রবেশ করায় শান্ত দীঘিতে ঢিল পড়ে । প্রতিমাকে অনুসরণ করা ছাড়া তার আর কোনো কর্তব্য থাকে না ।
শ্মশান থেকে ঘরে ফেরার পথ একটা নয় অনেকগুলো । কে কোনটা বেছে নেবে সেটা তার একেবারে নিজস্ব ব্যাপার । আজ প্রতিমারই পথ বেছে নেওয়ার পালা । যে অনুসরণকারী তার এসব কোনো দায় নেই । যে পথ বেছে নেওয়া হবে তাকেও যেতে হবে সেই পথ দিয়ে । ধীরেন্দ্র একা থাকলে যে পথ সাধারণত পরিহার করে সেই পথ প্রতিমা বেছে নেওয়ায় অনেকদিন বাদে সে দেখতে পায় সেই বাড়ি যার একতলার অধিবাসী দোতলায় উঠে এসে দোতলার অধিবাসীকে পথে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল । যিনি দোতলায় তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন তিনি যতটা সুপুরুষ ছিলেন ততটাই ছিলেন নি:সন্তান । তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হলে একতলায় যিনি থাকতেন মাসিক অর্থের বিনিময়ে, তিনি থোক টাকা দিয়ে সদ্যবিধবার কাছ থেকে কিনে নেন বাড়িটা । সদ্যবিধবা চলে যান দূরপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে তাঁর বোনপোর কাছে । দোতলার এক কোণে স্বল্প ভাড়ায় এক চিলতে ঘরে দিন কাটাতেন অকৃতদার এক বৃদ্ধ যাঁর কেউ ছিল না কোথাও । সন্ধেবেলায় তাঁর ঘরে যারা খাতা-পেনসিল নিয়ে আসত তাদের তিনি বিনামূল্যে শেখাতেন কী করে নাম সই করতে হয় । বয়স্কদের সাফল্যের হাসি তাঁকে কী যে প্রাণবন্ত করে রাখত । নীচে থেকে যে বাড়িটা কিনেছে সে নীচে আর কোনো সংসারের পাট রাখতে চাইল না । নীচে থাকবে আইনের মোটা মোটা বাঁধানো বই, আর সেই বৈঠকখানা, যেখানে আদালতে যাওয়ার আগে এবং সেখান থেকে ফেরার পরে সে এসে বসবে তার মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করতে । বাড়িটাকে নিষ্কন্টক করে সাজানো-গোছানো শুরু করে দিতে হবে, এক চিলতে ঘরও অবহেলা করা চলবে না, এই আদর্শ থেকে সে এমনভাবে আইনের জোর প্রয়োগ করে যে, বৃদ্ধের পথে নেমে আসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না । কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন ? - এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি পথে দাঁড়িয়েই ধীরেন্দ্রকে যা বলেন তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে অজানার স্বাক্ষর । তিনি যাঁদের নিষ্ঠাভরে সাক্ষর করেছেন শুধু তারা নয়, ধীরেন্দ্রও সেই স্বাক্ষরের পরিমাপ করতে গিয়ে কোনো তল পায়নি । দোতলার কোণের এক চিলতে ঘর থেকে নেমে এসে এই চরজগতের মধ্যে তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কী যে পূর্নতা পায় সেই দ্বিতলভবন । আর প্রৌঢ়ত্ব বলে কিছু থাকে না, চারিদিক ভরে ওঠে সাবানের রূপ ও গন্ধে । কত গাড়ি এসে থামে কত মামলার মর্ম নিয়ে কথা হয়, কত জয়লাভ সূচিত হয় আপনমনে । যে একতলা থেকে উঠে যেতে পেরেছে দোতলায় তার উচ্চশিক্ষার্থী কন্যার মধ্যেও স্তনচেতনা বাড়ে, রূপ সম্প্রসারিত হয় এবং তার হাসিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে হাসিখুশির ছেলেমেয়েরা । এই ধারাটাও স্বল্পায়ু ছিল । পথ দিয়ে যেতে যেতে একদিন ধীরেন্দ্র দেখে, একতলার যে আলো পথে এসে পড়ত তার তিরোভাব ঘটেছে । জানলাদরজা রুদ্ধ ষোলোআনা । দোতলায় আলো আছে । কিন্তু মানুষ আছে কিনা বোঝা যায় না । সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আইনের সেই মানুষটি প্রায় বেআইনিভাবে নিখোঁজ হয়েছে চরজগৎ থেকে মরজগতে । মক্কেলদের পরামর্শ দিতে দিতে এক বসন্তসন্ধ্যায় তার হৃদ্যন্ত্র থেমে যায় চিরতরে । আজ সেই বাড়ির সামনে এসে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া প্রতিমাকে পা চালিয়ে ধরে ফেলতে চায় ধীরেন্দ্র । তার মনে হয় কোথাও কখনো পাশাপাশি হাঁটার প্রয়োজন আছে । ঘরে ফেরার আগে একজনের পায়ের সঙ্গে আর একজনের পা মিলুক । কোনো আইনের জোরে নয়, অতি গোপন এক আর্তির জোরে ।
সব শেষ ? দরজায় হাত রেখে যে নারী এই প্রশ্ন করে তার চোখ ইতোমধ্যে কেমন করে যেন মাত্রাবতী হয়ে উঠেছে । - হ্যাঁ, সব শেষ । সব শেষ হতে কতক্ষণ আর লাগে বল্ ? প্রতিমা অন্যরকম গলায় কথা বলেও আবার ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে । কী রে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছিস, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিবি না ? - দেব । তবে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না । পেছন দিয়ে ঘুরে আসতে হবে । ধীরুদা, দিদিকে নিয়ে পেছনের দরজায় চলে যাও । আমি খুলে দিচ্ছি । বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকাটা সবসময় যে এক কায়দায় চলে না, মাথা উঁচু করে নয় নিচু করে ঘরে ঢোকারও যে একটা ঘরানা আছে তা প্রতিমা কিংবা ধীরেন্দ্র মনে ছিল না কারোরই । তারা দুজনেই বুঝতে পারল একটু আগে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে করতে তারা আসলে হারিয়ে ফেলেছিল মুদ্রা । যে ভাবেই হোক একটা পরাজয় তো ঘটেই গেছে - মৃত্যুর কাছে সেই জীবনের পরাজয় । সেখানে মাথা নত করে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো নাটকীয়তা নেই, কোনো সংস্কারের দাসত্ব নেই । আছে সেই অনুভব যার দৌলতে পার্থিবতাও শেষে সেই অপার্থিবতার অনুগামী হয় । পেছনের দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রেবা যেন তাদের বরণ করে নিতে চায় জীবনের মধ্যে । - এক এক করে স্নান করে নাও । দিদি, তোর তো সময় লাগে । আগে ধীরুদাকে ছেড়ে দে । ধীরুদার হলে ঘরে ঢোকার আগে লোহা ছুঁতে হবে, আগুন ছুঁতে হবে, মুখে কাটতে হবে তেতো, খেতে হবে মিষ্টি । সব আমি যোগাড় করে রেখেছি । শুধু মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলেই হয়ে যাবে আপাতত । যাও ধীরুদা, আর দেরি করো না, স্নান করে নাও । ধীরেন্দ্র তার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিল গায়ে জল ঢালার আগে । কারণ তার ইচ্ছে করছিল বাড়ির উঠোনে বসে একবার সেই আকাশ দেখে নিতে যা নক্ষত্রখচিত হয়ে উঠেছে বলে তার কথা জমেছে । প্রেমাংশুবাবু এই উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে কতদিন যে হাওয়ায় ধুয়ে নিতে চেয়েছেন দেহ । ভুলে গেলে চলবে না একদিন এই বাড়িতে তাঁর বসবাস ছিল । কত প্রহর এখানে কেটে গেছে তাঁর অবিবাহিত হয়ে এবং বিবাহিত হয়েও । তিনি ধীরেন্দ্রকে এই বাড়িতে বসেই তার বাল্যকালে অঙ্কের মজা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । এই বাড়িতে বসেই তাঁর অগ্রজের কাছে তাঁর স্বীকারোক্তি ছিল - অঙ্কের মজার সঙ্গে জীবনের মজাকে মেলাতে পারিনি । তাই তো তিনি একসময় জীবন থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন । আত্মহত্যা ব্যর্থ হয়, কিন্তু ঘটে যায় আঙুলহত্যা । রেবার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে সে দুপায়ের পাঁচটি করে আঙুলের কথা ভাবতে চায় । যখন একটিও আঙুল ঝরেনি পা থেকে, তখন এই বাড়িতেই রাতের খাওয়া সেরে বৌদির হাত থেকে পানের খিলি মুখে নিয়ে দেবর প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে পেরেছেন নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে একা একা । সে দৃশ্য যার মনে আছে তার বাবা ভাইকে ডাকতে গিয়ে তাঁর নাম ছোট করে এনেছেন । কিন্তু বেড়ে গেছে অর্থ । প্রেমাংশু থেকে প্রেমে আসতে পারলে অক্ষরসংখ্যা কমে আসে, কিন্তু বেড়ে যায় ভালোবাসার সেই অজানা স্বাক্ষর । স্থানকালপাত্র ভুলে কিংবা ষোলো আনা মনে রেখে উঠোনে বসে গুনগুন করে ওঠে সে । তার গলায় যে তেমন সুর নেই তাতে যেন আরো বেড়ে যায় সেই মৃন্ময়তা । আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ # সুরের বাঁধনে -/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি # অজানা সাধনে ॥ যেটা গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যায় তা শেষে আরো একটু ওপরে উঠে প্রকাশ হয়ে পড়ায় রেবা এবং প্রতিমা দুজনেই উঠোনে নেমে প্রকাশিত হয় দুই কোণে দাঁড়িয়ে । এই অজানা সাধনের মাধ্যমে তারও যেন এই বিশ্বভুবনের কাছ থেকে একটা প্রাপ্তিযোগ আছে । যত টের পায় ততই সে বুঝতে পারে যাকে সাধনা বলা হয় তা তার কণাপরিমাণ না থাকলেও তার আছে অজানা সাধন । এই সাধনের জোরে তার বাবা এবং তার কাকা ধ্বনির বলয়ের মধ্যে অত্যন্ত কাছে বসে পড়েছেন । এমনকী জীবন মৃত্যুর অষ্টম গর্ভের সন্তান হয়ে উঠেছে । দুই বোন দুই কোণে দাঁড়িয়ে পড়লেও এমনকী তারাও হয়ে উঠতে পারছে সতীর্থ । রেবা হাসে । - সুর ভুল করেছ, তবু শুনতে খারাপ লাগছে না । প্রতিমা হাসে । - ঠিক বলেছিস । অজানা সাধনে, এই জায়গাটায় এসে গোলমাল হয়ে গেছে । - একটু দেখিয়ে দে না দিদি । - তুই দেখিয়ে দে । কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ! কতক্ষণ শ্মশানে কেটেছে বল তো ? আমরা দুজনেই তো এ গানটা একসঙ্গে শিখি । তোর মনে নেই ? - কেন থাকবে না । বড়দিদিমনি কবিপক্ষে শিখিয়েছিলেন । কী ডাকাবুকো মহিলা ছিলেন, তাই না ? অথচ ছাদের ঘরে আমাদের বসিয়ে যখন শেখাতে আরম্ভ করলেন তখন তাঁর অন্য রূপ । আমি তো তখন আঁকা শিখিনি । পরে যখন শিখলাম তখন তিনি চোখ বুজেছেন । থাকলে বসিয়ে তাঁর ছবি আঁকতাম । -যাওয়ার বয়স হয়নি, অথচ চলে গেলেন । কত অল্প বয়সে চলে গেছেন ভাব তো ? সে কি আজকের কথা ? আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আমি আর থাকতে পারছি না । গায়ে জল ঢেলে আসি । আমি বেশি সময় নেব না । ততক্ষণ বরং তুই ওকে একটু ভুলটা ধরিয়ে দে । প্রতিমা চলে যায় জলের কাছে । কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে রেবা । যে ধীরেন্দ্র কোনোদিন কোনো ছবি আঁকেনি তারও এই বিশ্বাস হয় যে, তার অজান্তেই এমন কোনো শক্তি সম্ভব হতে পারে যার দৌলতে শেষে এঁকে ফেলা যায় সেই রেবাকে যে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রির কাছে সরাসরি । - ধীরুদা, এখন আর কোনো গান নয় । তুমি বিশ্রাম করো । আমি হাতের কাজ সেরে নিই ।
রেবা ভেতরে চলে গেলে ভেতরে যাওয়ার জোর বাড়ে । কিংবা ভেতরে যাওয়ার শেষ বাধাটুকুও অপসারিত হয় । এই বাড়িতে শ্মশান থেকে ফিরে আসার ঘটনা এই প্রথম নয় । কতবার কত সময়ে যে শ্মশান থেকে ফিরতে হয়েছে কে রাখে তার হিসেব ? কিন্তু কখনো শ্মশান থেকে ফিরে উঠোনে বসে থাকেনি ধীরেন্দ্র এভাবে । এদিক থেকে বেশ একটা নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছে । কত মানুষ তো কতদিক থেকে নতুনত্বের সূচনা করার কথা ভেবে চলেছে । দু বছর আগেও তো ধীরেন্দ্র তেমন এক উদ্যোগের সাক্ষী হতে পেরেছিল । এই বাড়ি থেকে হাঁটাপথে চলে যাওয়া যায় এমন কারাগারের সংখ্যা একাধিক । বাইরে থেকে কতবার দেখেছে উচ্চ প্রাচীর । মূল দরজার ভেতরদিকে যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা সশস্ত্র । যারা ভেতরে বসবাস করছে তাদের সঙ্গে যারা বাইরে থেকে আসে দেখা করতে, মূল দরজার বাইরে দেখেছে তাদের ম্লান উপস্থিতি । যেমন ম্লান তেমন যেন অবাঙ্ছিতও খানিকটা । যারা প্রহরী তাদের দাপটের সামনে যারা প্রার্থী তাদের অপেক্ষার দাপট নেই । যেন তারা দাঁড়িয়ে থাকার জন্যই এসেছে । খবরের কাগজে পড়েছে জেল ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার আকর্ষক সব বিবরণ । কারাগারের কাছেই আদালত । কেবল গাড়িতে চাপিয়ে নয়, কারাগার থেকে আসামিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে এ দৃশ্যের সঙ্গেও তার পরিচয় আছে খানিকটা । যত উগ্র আসামি তত বেশি পাহারা । কখনো মনে হয়েছে, যাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার শরীর দেখে, সত্যিই শৃঙ্খল ছাড়া আর হারাবার কিছুই নেই । ধীরেন্দ্র জানে একসময় এই দেশের বেশ কিছু কারাগারের মধ্যে নিরস্ত্র আসামিদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে । আইনের ভাষায় মুড়িমিছরির মতো যাদের বলা হয়েছে আসামি, তাদের অনেকেই ছিল প্রতিবাদী আদতে । বাইরে প্রতিবাদ করে যারা কারাগারের ভেতরে গেছে, ভেতরেও প্রতিবাদ করায় তাদের অনেককেই যেতে হয়েছে জীবনের বাইরে । অনেক বছর আগে এক সকালবেলায় যৌবনের শুরুতে দাঁড়ানো ধীরেন্দ্র চা খেতে খেতে দেখতে থাকে কাগজ । বহু দূরের কারাগারের ভেতরে যারা নিরস্ত্র তাদের ওপর যারা সশস্ত্র তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কতজনকে আহত করেছে আর কতজনকে শেষ করে দিয়েছে একেবারে তার তালিকা দেখতে পেয়ে সে নীরব হয় । লাঠির ঘায়ে যারা একেবারে থেঁতলে গেছে তাদের মধ্যে সে খুঁজে পায় অনুপের নাম । সেই অনুপ যে তারই সঙ্গে স্নাতক হয়ে আর স্নাতকোত্তর হতে চায়নি । এত গাছপালা, এত নদীনালা, এত খেতখামার সত্ত্বেও যাদের ঘর নেই, জল নেই স্নানের, যারা খেতে পায় না কিন্তু খিদে আছে ষোলোআনা, তাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল সে । মানুষকে আর বইতে নয়, পেতে চেয়েছিল মানুষেরই মধ্যে । যখন বড়ো সংসারের কথা তেমন করে সামনে আসেনি তখন ছোট সংসারের যে কোনো ঘরে বসে তারা কবিতা নিয়ে আলোচনা করত । মনে পড়ে শেষে কবিতাপ্রকাশ নিয়েও আলোচনা হয়েছে তাদের । একবার যুবকদের মতামত শোনার জন্য আকাশবাণীতে অনুপকে ডেকে পাঠায় । আর পাঁচজনের সঙ্গে তার ভালোবাসার দিকগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে সে যখন কবিতার কথা তোলে তখন খুব স্বত:স্ফূর্তভাবে উচ্চারণও করে ধীরেন্দ্রর কবিতার দুটি ছত্র । ছোট সংসারের ছোট ঘরে বসে শিহরিত হয়েছিল ধীরেন্দ্র । তার সামান্য প্রয়াস, তার গোপন আবেগ কেউ গলায় তুলে নিয়ে বহু মানুষের কানে এ ভাবে পৌঁছে দিলে জাগবেই শিহরণ ! পরে দেখা হলে গাছের তলায় বসে অনুপকে সে বলেছিল - তুমি এ কী করলে ! এত কবি থাকতে শেষে আমার মতো মানুষের কথা ? অনুপ তার হাত ধরেছিল । - আমি আমার অনুভবের কথা বলেছি । তার মধ্যে কিন্তু কোনো ফাঁকি নেই । সত্যি বলছি, তোমার বন্ধুত্বকে মনে রাখিনি, তোমার লেখাটাকেই মনে রেখেছি । একবার তারা শিক্ষাজগতের গাছগাছালির মাঝখানে পঁচিশে বৈশাখের কবিকে স্মরণ করেছিল । সবাই যখন যাঁর জন্মদিন তাঁরই কবিতা পড়ে যাচ্ছে তখন অনুপ ডাক এলে তার নিজের কবিতা পড়ে । সেই কবিতা যতদূর মনে পড়ে শ্রদ্ধার নামে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম না হয়ে প্রনতিমান প্রশ্ন হয়েছিল, কতদূর কবিতা হয়েছিল সে বিচারে না গিয়েও বলা যায় । অর্থনীতির অর্চনা গেয়েছিল - আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ # সুরের বাঁধনে -/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি # অজানা সাধনে । কে জানে `অজানা সাধনে' -তে এসে তার সুর কেটে গিয়েছিল কিনা । কিন্তু কানে এখনো বাজে সেই আপত্তির সুর । গান শুরু হওয়ার আগে বাংলার তপন ঘোষনা করেছিল - এখন রবীন্দ্রনাথের একটা প্রেমের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন অর্থনীতি বিভাগের অর্চনা সেন । তখন কিছু বলেনি অনুপ । গান শেষ হলে সে ঘাসের মধ্যে বসেই আমনের দিকে তাকিয়ে সরাসরি তপনের কাছে জানতে চায় - এটাকে কি প্রেমের গান বলতেই হবে ? এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে ? তপন মুখ মুছতে মুছতে খুব সপ্রতিভভাবে জবাব দিয়েছিল মঞ্চ থেকে - একবার কষ্ট করে গীতবিতানটা একটু দেখে নিয়ো । তখন তার ভারী গলার অনবদমিত প্রত্যুত্তর কে আর ভুলে যেতে পারে । - এই যে দাদাভাই, আমার গীতবিতান দেখা আছে । কতদিন আর গীতবিতানের গল্প শোনাবে ? এবার একটু মঞ্চ থেকে নেমে এসে নিজের গল্প শোনাও । একটু কষ্ট করে তোতাকাহিনীটা পড়ে নিয়ো, কেমন ? তপন কোনো উত্তর না দিয়ে পরবর্তী ঘোষণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । কারো কারো মতে লাঠির ঘায়ে অনুপের চোখ বেরিয়ে এসেছিল । কারো কারো মতে সেই দেহ এই মহানগরীতে নিয়ে এসে দাহ করা হয় । এতদিন ধরে সেটাই জানত ধীরেন্দ্র । কিছুদিন আগে এক ছোট পত্রিকার সম্পাদক বড়ো প্রশ্ন তোলেন তাকে ফোন করে রাত্তিরে । - আপনি বডি এখানে নিয়ে আসার ব্যাপারে যা শুনেছেন তা কি সত্যি ? ধীরেন্দ্র তাঁকে জানায় সে প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারেনি বলে শ্রোতা হয়েছে বাধ্য হয়ে । যাঁরা শুনিয়েছেন তাঁরাও শুনেছেন বিভিন্ন সূত্রে । সেই সূত্রগুলি কতটা নির্ভরযোগ্য তা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয় । বরং সে পালটা প্রশ্ন করেছিল - এত বছর বাদে এমন কথা উঠছে কেন ? - এমন কথা তো উঠবেই । কারণ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার তাগিদে খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এখানে বডি আদৌ এসেছিল কিনা সে ব্যাপারে একেবারে নি:সংশয় হওয়া যাচ্ছে না । জানেন অনুপদের যখন মেরে ফেলা হয় তখ ওই জেলের যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাঁর সন্ধান আমরা পেয়েছি । শুনেছি তিনি ছেলে হিসেবে অনুপকে খুব পছন্দ করতেন । ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে । অনেকদিন আগেই অবসর নিয়েছেন । চেষ্টা করে যাচ্ছি একবার তাঁর মুখোমুখি হতে । এত বছর বাদে মানবিকতার দিক থেকে নয়, সত্যের খাতিরে তিনি যদি কিছু প্রকাশ করেন এই আশায় । সম্পাদকমশাই এতদিনে তাঁর খোঁজ পেয়ে তাঁর মুখোমুখি হতে পেরেছেন কিনা, যদি পেরে থাকেন তবে তাঁর মুখ থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তা নিয়ে নতুন করে মুখর হয়ে উঠতে পারা গেছে কতখানি, এসব ব্যাপারে এই মুহূর্তে সে জানে না কিছু । সে বোধহয় জানতেও চায় না তেমন করে । কারণ সে জানে, শেষপর্যন্ত যাকে অর্পণ করা হয় আগুনের মধ্যে তাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জেলাশহরের আগুন যতটা নিষ্ঠাবান ঠিক ততটাই নিষ্ঠাবান এই মহানগরীর আগুন । দু বছর আগে, যে মহাপুরুষের জন্মদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, বাড়ির কাছের কারাগারের কক্ষে তাঁর বিজনবাস কেমন ছিল তা দেখার একটা সুযোগ এসে হাজির হয় হঠাৎ । ধীরেন্দ্র অনেক দ্বিধায় দুলতে দুলতে সেই সুযোগ গ্রহণ করে । স্বাধীনতাদিবস উপলক্ষে সেদিন সবকিছু বন্ধ । যারা সেই কারাকক্ষ দেখার অনুমতি পেয়েছে তারা লাইন করে দাঁড়িয়েছে সেই কারাগারের বাইরে । লাইন বেশ লম্বা । অনুমতিপত্র দেখে কিছু কিছু করে লোক ছাড়া হচ্ছে । যাদের ছাড়া হচ্ছে তারা বন্ধনের মধ্যে ঢুকতে পারছে নির্বিবাদে । তারা দেখেশুনে ফিরে না আসা পর্যন্ত লাইন সচল হতে পারছে না । এই অচলায়তনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র ভেবেছে অনুপের কথা । এক সময় বুঝতে পারল কারাগারের সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা রাখতে পেরেছে অবশেষে । যারা কারাগারে থাকতে আসে না, দেখতে আসে, তাদের কি প্রথম দেখায় মনে হয় সংরক্ষিত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করলাম ? কিংবা ঘাসে পা পড়েছে ? সকলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ধীরেন্দ্র সেই কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায় যা এখন জাতীয় স্তরে শ্রদ্ধা ও স্মরণের ভূখণ্ড হয়েছে । একবার সাহস করে সেই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে বুঝতে পারে আদি রূপের সংশোধন সত্ত্বেও সেখানে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়ালে কেমন একটা পাগল পাগল অবস্থা হয় । অথচ এই কক্ষে যিনি একেবারে একা হয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ছিলেন, তিনি ছিলেন চৈতন্যঘন স্থিরতার পরাকাষ্ঠা হয়ে নিশ্চিত । উপনিষদের সত্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি এই ঘরে বসেই । যাঁদের সেই অনুভবের শক্তি নেই, যাঁরা বাস্তবের বাইরের রূপ ছাড়া আর কোনো রূপকেই চিনতে পারেন না, তাঁরা যখন কারাবাস শেষ করে বেরিয়ে এসে সেই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে উপলব্ধির কথাটাকে আমল দিতে চান না, বরং তা নিয়ে ব্যঙ্গও করেন প্রাণ খুলে, তখন কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, কেবল বেড়ে যেতে থাকে হইচই আর অনধিকারচর্চার রাজ্যপাট, সেই কারাকক্ষের ভেতরে ঢুকে তা বেশ বুঝতে পেরেছিল ধীরেন্দ্র । যে কক্ষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে সারিবদ্ধ হয়ে দেখতে গিয়েছিল, তা দেখা হয়ে গেলেই বাইরে না বেরিয়ে এসে আরো কিছু দেখে নেওয়ার ইচ্ছে জাগে । তখন সে দেখতে পায় যারা ভেতরে ঢুকছে তাদের দেখার জন্য একটা বড়ো বাড়ির অনেক জানলা খুলে গেছে । যেন হুড়োহুড়ি করে মানুষ জমেছে বাতায়নে । সবাই চাইছে যারা বহির্জগৎ থেকে এক লহমার জন্য এসেছে তাদের এক লহমার জন্য দেখে নিয়ে মুক্তির স্বাদ পেতে । বেশ খানিকটা দূরে কারা যেন ফুটবল খেলছে । কয়েদিদের খেলা দেখার জন্যও ভিড় জমিয়েছে কয়েদিরা । ধীরেন্দ্র টের পেল ভেতরের খেলার শব্দ বাইরের খেলার শব্দের মতোই । একবার ইচ্ছে হয়েছিল একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে নিতে যারা বন্ধনের মধ্যে আছে খেলার সময় তারা কতটা খুলে যেতে পারে । কিন্তু এগোতে গেলে বাধা পায় । এগিয়ে আসে কারারক্ষী । - ওদিকে যাবেন না । শেষে একটা বাগানের দিকে দৃষ্টি পড়ে । দু-চারজন বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা লক্ষ করছে । তারা ওপরের দিকে তাকিয়ে নেই; তারা তাকিয়ে থাকতে চাইছে মাটির দিকে । কী আছে বাগানের মাটিতে ? মানুষ কেন এত সন্নত ? খেলার কোলাহল নয়, নীরবতারই খেলা চলছে । বাগানের দিকে যেতে গেলে কেউ বাধা দেয় না । যেন কারারক্ষীরাও বলতে চায় - একবার দেখে যান জায়গাটা । যারা চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রথমে যেন কিছুই দেখতে পায় না ধীরেন্দ্র । শেষে প্রতিভাত হয় বাগানের বুকে ফুটে ওঠা তাজমহল । কোনো রেখা বা রঙের সাহায্যে নয়, একেবারে উদ্ভিদের মাধ্যমে তারই সবুজ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রেমের স্মৃতিসৌধ । মনে রাখা দরকার যে এই সৌধের কোনো উচ্চতা নেই, এই সৌধ মাথা তুলতে পারেনি । ভূমিতে ছড়িয়ে থেকে সে তার উচ্চতাকেও ছড়িয়ে রেখেছে সারাক্ষণ । যার নিষ্ঠা, সামর্থ্য এবং শৈলীর ফলে এই শিল্পকর্ম প্রাণ পেয়েছে সে কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও বোঝা যাবে না যে, সে নিজেই প্রাণ নিয়েছে কারো । শাস্তি ভোগ করতে করতে যে এত তন্ময় হয়ে কাজ করতে পারে তার এই সৃষ্টির নতুনত্ব শ্মশান থেকে ফিরে খোলা আকাশের তলায় বসে থাকার নতুনত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে । ধীরেন্দ্র জানে, এই পৃথিবীতে এতদিনে একটু একটু করে তার হাতে এসে জমা হয়েছে এত উপকরণ যা দিয়ে একটা তাজমহল বানানোর তন্ময়তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সূচনা করা যায় । প্রতিমার স্নান সূচিত করেছে স্নিগ্ধতা । সে এখন লোহা স্পর্শ করছে । সবচেয়ে পুরোনো দা এনে রেখেছে রেবা । প্রতিমা সেই অস্ত্র স্পর্শ করে লোহা স্পর্শ করার অনুভব পেতে চায় । উচ্ছে দাঁতে কাটে । যে মোমবাতি জ্বলছে তার শিখা থেকে তাপ টেনে নিয়ে মাথায় রাখে । মিছরির টুকরো রেবার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে মুখের মধ্যে ফেলে দেয় । ফলে স্নান করে ঘরে ঢোকার মন তৈরি হয় এবং প্রতিমাকে আর বাইরে থেকে দেখতে পায় না ধীরেন্দ্র । শুধু তার কন্ঠস্বর শুনতে পায় । সেই স্বরে ঝরে পড়ছে বিরক্তি । - কী হলো তোমার ? উঠোনে বসে রাত কাটালেই চলবে ? কিছুই বুঝতে পারি না । প্রতিমার শেষ বাক্যটি খুব উপযুক্ত মনে হয় ধীরেন্দ্রর কাছে । সে নিজেও তো বসে বা হেঁটে বা দাঁড়িয়ে, বই পড়ে বা সই করে এমন কোথাও গিয়ে পৌঁছোতে পারে না যেখানে তার সত্যিই মনে হতে পারে, কিছু অন্তত বোঝা গেছে ।
যাক, এতক্ষণে তোমার স্নান হলো তাহলে । দাঁড়াও, মোমবাতি জ্বালি । জ্বালিয়ে রেখেছিলাম, এইমাত্র নিভে গেল । জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব নয় । কেমন হাওয়া দিচ্ছে দেখেছ ? এসো, দেরি করো না । আবার হয়তো নিভে যাবে । দা ছুঁয়েছ ? আগে দা ছোঁও । রেবার কথা শুনতে শুনতে দা স্পর্শ করে বলে ওঠে ধীরেন্দ্র - আর কী কী করতে হবে বলো । সব শেষে আগুন ছোঁব । - সবশেষে কেন, এখনই ছোঁও । দেখছো শিখা কাঁপছে । ধীরেন্দ্র দেখে, শুধু কাঁপছে না, বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধও শুরু করেছে আপনমনে । - তুমি কেবল কাঁপাটাই দেখছ, যুদ্ধটা দেখছ না ? রেবা তাকায় ! তার সামনে যে স্নাতক দাঁড়িয়ে তাকে একবার দেখে নেয় আপাদমস্তক । - এক সময় যুদ্ধটাও দেখতাম । এখন শুধু কাঁপাটাই দেখি । ঠিক আছে, এই নাও তেতো, দাঁতে কাটো । এই নাও মিছরির টুকরো । তালমিছরি । কাশি হবে না । হ্যাঁ, হয়েছে তো ? এবার তোমার শেষ কাজটা করে ফেল । একটু আগুন ছোঁও । তাড়াতাড়ি করো, এক্ষুনি নিভে যাবে । ধীরেন্দ্র কিছু করে না । তারিয়ে তারিয়ে মিছরি খায় । সেই অবসরে সেই মোমবাতি আবার নিষ্প্রদীপ হয় । - তোমার এই ছেলেমানুষি দেখার সময় নেই আমার । আমাকে এবার বাড়ি ফিরতে হবে । আমি বরং দিদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । রেবা ওই অবস্থায় ভেতরে চলে গেলে বারান্দায় খুব ধীরে পায়চারি করতে থাকে সে । প্রেমাংশুবাবু এই বারান্দায় কত নিষ্প্রদীপ রাতে পায়চারি করে গেছেন । পায়চারি করার সময় তিনি কারো সঙ্গে কথা বললেও মাত্রাপতন হতো না । একদিকের কথা শুনতে শুনতে আর একদিকে চলে গিয়ে আর একদিক থেকে উত্তর দিতে দিতে ফিরে আসতেন । হাঁটার কাজও হলো, আবার বাদ গেল না কথাও । কিন্তু তাঁর অগ্রজের ক্ষেত্রে ছিল অন্য নিয়ম । ধীরেন্দ্র তার বাবাকে নিয়ম করে হাঁটতে দেখেছে । তিনি যখন হাঁটতেন এই বারান্দার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে তখন কোনো পিছুটান থাকত না । বুক চিতিয়ে কারো সঙ্গে একটিও কথা না বলে তাঁর সেই হেঁটে যাওয়ার মধ্যে ছিল জীবনপ্রেম । - দ্যাখ, শিখে রাখ, হাঁটার সময় কোনোদিকে না তাকিয়ে বুক চিতিয়ে এইভাবে হাঁটবি । হাতদুটোও দোলাতে হবে যতটা সম্ভব । যত হাত দোলাবি তত উপকার হবে । বাবা তাঁর মতো করে বলে চলে গেছেন । শুনেছে কিন্তু মনে রাখেনি । সেদিন ফিচারের মরুভূমি থেকে বেরিয়ে এল একটি লেখা যাতে জলস্পর্শ আছে । সেই লেখায় কিন্তু সুস্থ থাকার উপায় বলতে গিয়ে নিরুপায়ভাবে বলা হয়েছে হাত দোলানোর কথা । হাতের সক্রিয়তার মধ্যে লুকিয়ে আছে হত না হওয়ার চাবিকাঠি । হাত দুলিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেন ধীরেন্দ্র দেখতে পায় পিতাকেই ।
প্রতিমা অনেক ভেতরে চলে গেছে । অনেক ভেতরেই তো রান্নাঘর । তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না । রেবাও এই মুহূর্তে চোখের সামনে নেই । তবে কি সে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে ? একদিন কি ঘরে না ফিরলেই চলে না ? আজ রাতে সে এখানে থাকলে একটা মাত্রা কীভাবে যেন সংযোজিত হয় । এটা ঠিক কাউকে বুঝিয়ে বলা যায় না । বুঝে নিতে হয় আলাদা করে সবাইকেই । কারো সাড়াশব্দ না পাওয়া গেলেও বারান্দার এক দিক থেকে আর এক দিকে যাওয়ার কাজটা থামিয়ে দিতে পারছে না ধীরেন্দ্র । তার নিজের পক্ষে থামানো অসম্ভব । এই সক্রিয়তার পর্বে রেবাকে নিয়ে প্রতিমা এসে দাঁড়ায় । ফলে তার থেমে যাওয়ার সুযোগ এসে পড়ে । প্রতিমার অভিযোগ, রেবাকে বলা সত্ত্বেও সে রাত্রে থাকতে চাইছে না । - তুমি ওকে একটু বোঝাও তো । আজ রাতটা দিদির এখানে থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় । তুমি বোঝাও । আমি রান্নাঘর থেকে আসছি । ধীরেন্দ্র দেখে রেবার শাড়ি পরা হয়ে গেছে । সেই শাড়ি যার ভেতরের কাজটা সে একদিন স্বহস্তে করেছিল । - দিদিকে একটু খেপাচ্ছি । তবে থাকবই যে এমন কোনো কথা নেই । ও-সব কথা পরে হবে । দাঁড়াও, আগুন জ্বালি । যে মোমবাতি অনেক আগেই নিভে গেছে তাকে আবার জ্বালাতে গিয়ে ভূমির সঙ্গে রেবার এমন এক সখ্য তৈরি হয় যার জোরে ধীরেন্দ্রও বসে পড়ে তার পাশে মেঝেতে । এবার কিন্তু শিখা অনেক স্থির হয়ে এসেছে । - তুমি ভালো করে আগুনের তাপ নাও । তোমাকে দেখিয়ে দিই কী করে তাপ নিতে হয় । রেবা হাত রাখে শিখার বলয়ে এবং সেই হাত মাথা ও মুখমণ্ডলে বুলিয়ে নেয় । ধীরেন্দ্র হাসে । - আর একটিবার দেখাও । তোমার মুদ্রা ঠিক ধরতে পারলাম না । সত্যি বলছি, আর একটিবার । আবার হাত এমনভাবে নামিয়ে আনে রেবা যেন সে শিখার মাথায় হাত রাখতে চাইছে । সেই হাত তার নিজের কাছে উঠে যাওয়ার আগে খপ করে ধরে ফেলে ধীরেন্দ্র । - এই তাপটুকু আমাকে দিতে হবে । কত আর নিজেকে তাপিত করবে ? রেবার হাত সে তার কপালে, মাথায় এবং মুখে বুলিয়ে নিয়ে ফিরিয়ে দেয় রেবাকে । - ব্যস, এবার আমি ঘরে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেছি । চলো ঘরে ফিরবে । তোমার এখন আর কিছুতেই যাওয়া চলবে না । - আমি তো থাকব না বলিনি । তবে শর্ত আছে । কখনো মনে হচ্ছে একটা, কখনো দুটো । প্রথম শর্ত হলো, বাড়িতে ফোন করে মাকে জানানো চলবে না । যেহেতু তোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খুব কাছে তাই গিয়ে জানিয়ে আসাটাই সবচেয়ে ভালো । যদি বলো আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি । আর একটা শর্তও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না । কী, বলব ? একটার ভারেই যদি নুয়ে পড়ো, আর একটার ভারে তবে তো আর চলতেই পারবে না । ভেবে দেখ বলবো কিনা । বলব ? ঠিক আছে বলছি । বহু যুগ আগে তুমি আমাকে কবিতা শুনিয়েছিলে । কবিতা আদৌ আর লেখো কিনা তাও জানি না । তুমি যেমন শোনাওনি তেমন পত্রপত্রিকায় চোখেও পড়েনি কিন্তু । আজ আমাকে তোমার কবিতা শোনাতে হবে । ধীরেন্দ্র চট করে কোনো জবাব দিতে পারে না । এই একটি ক্ষেত্র তার বড়ো বেদনার জায়গা । সে কোনোদিনও কবিতা লেখা ছাড়েনি । গোপনে গোপনে সে লিখে চলেছে সবসময় । কেউ যদি এগিয়ে এসে ফুল না তোলে তবে তো ফুল ঝরে পড়বেই একসময় । তার মানে এই নয় যে, ফুল ফোটেনি । ফুল ঝরে গিয়েও আবার ফুটছে ঠিক সময়ে । শুধু সাজি হাতে ভোরবেলায় চয়ন করার জন্য যার আসার কথা সে আর আসতে চাইছে না । কারণ তার বাড়ির কাছেই যে বসে গেছে ফুলের বাজার । এত কথা রেবাকে বলা যায় না কখনো । রেবা কেন, কাউকেই বলা যাবে না কখনো । বেদনার জায়গা দেখাতে গেলে অভিমানের জায়গাটাই পথ আটকে দেয় । লক্ষ্যে আর পৌঁছোনো হয় না । যে গ্রহণ করবে তার ব্যর্থতার বদলে যে দিতে চায় তার ব্যর্থতাই যেন বড়ো হয়ে ওঠে । ফলে বেদনার জায়গাটা আরো বেড়ে যেতে থাকে নি:শব্দে । যে শব্দ নিয়ে আছে তার পক্ষে খুব সহজ হয় না ব্যাপারটা । রেবাকে কিন্তু সহজভাবেই বলে ফেলে - তুমি শুধু জেনে রাখো, তোমাকে শোনানোর মতো কবিতা আমার ঝুলিতে আছে । রাত বাড়লে, যদি সত্যিই চাও, আমি তোমার কাছে সবকটাই পৌঁছে দেব । তুমি নিতে পারবে তো ? রেবা হাসতে চায় । তার ত্বকের অনুজ্জ্বলতা কেমন করে যেন মিশে থাকে সেই হাসির মধ্যে । - তুমি দিতে চাইলে আমি নিতে পারিনি এমন উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যাবে না । চলো, মাকে বলে আসি । ধীরেন্দ্র ভাবে প্রতিমার সঙ্গে আজ শ্মশান থেকে যে পথ দিয়ে ফিরতে হয়েছে রেবার সঙ্গে এখন আবার সেই পথ দিয়ে না যেতে হয় । কত পথ আছে যাওয়ার । সবসময় যে সংক্ষিপ্ততম পথ বেছে নিতে হবে তার কোনো মানে নেই । সোজা পথও খুব একটা পথিক হতে সাহায্য করে না । বরং কখনো কখনো ঘুরপথই হয়ে উঠতে পারে কাঙ্খিত সেই যাত্রাপথ ।
স্বস্তির কথা, রেবা যে পথ ধরেছে সেটা একটু অন্যরকমের । এখানে পথ বলতে প্রায় ক্ষেত্রেই বোঝায় দুপাশে ইমারত বা নানা রঙের বাড়ি, গাড়ি যাচ্ছে মাঝখান দিয়ে আর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ । প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই আছে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি, নেমে আসার সুযোগ-সুবিধে, নানা পরিবার বিভিন্ন উচ্চতায়, নানা বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন অবস্থানে । এখানে পথ এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনোরকম যাওয়ার তেমন প্রশ্রয় নেই । কতরকম কোণে কত বারান্দা ঝুলে থাকে । সেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে নীচের পথ দেখে নেওয়ার মতো গৃহস্থের অভাব হয় না কখনো । হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক নীরব দৃষ্টির পাহারার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে । এতে খুব স্বস্তি পায় না ধীরেন্দ্র । যেতে যেতে তারও ইচ্ছে করে মাথা তুলে হঠাৎ ওপরের দিকে তাকালে তার কেমন মাথা ঘুরে যায় । এমন অনেকবারই হয়েছে বলে সে আর দৃষ্টির পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবতে চায় না, বরং পরিমণ্ডলের দৃষ্টি নিয়ে ভাবার অবকাশ খোঁজে । রেবার সঙ্গে সে যে পথে এসে পড়েছে সেই পথের বাঁদিকে মাঠ আর ডানদিকে যত বাড়ি সবই একতলা । কোনো বাড়িরই আলাদাভাবে মাথা তোলার সুযোগ নেই । প্রতিটি বাড়ির ছাদে টালি । একটা কি দুটো ঘরই এক-একটা বাড়ির প্রতিনিধি । বাড়ির এত দুর্বল প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও যারা ঘরে ঘরে বাস করে তাদের সঙ্ঘবদ্ধতা প্রবল । এখানে গলা খুলে ঝগড়া হয়, এমন সব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে যাতে কোনো বসনই আর অচ্যুত থাকতে পারে না । তবু এখানে একটাই কাহিনী বারংবার পঠিত হতে থাকে । সেটা সবার পাশে সকলের থেকে যাওয়ার কাহিনী । সুযোগ পেলেই ধীরেন্দ্র এই পথ গ্রহণ করে । বাঁদিকের মাঠে ডানদিকের ছেলেমেয়েরা খেলা করতে করতে প্রহর কাটায় । পায়ে কদাচিৎ বল থাকে, হাতে ব্যাট থাকে কদাচিৎ । কিন্তু খেলা আটকায় না তাতে । প্রয়োজনে ডিগবাজি খেতে খেতেও তারা ধরে রাখে খেলার প্রাণ । এতদিন ধরে একটা মাঠ বেঁচে থাকতে পারছে এতসব মাঠের মৃত্যুর মাঝখানে, এই ব্যাপারটা ধীরেন্দ্রর কাছে কম বিস্ময়ের নয় । যারা মাঠ ধ্বংস করার অস্ত্র নিয়ে রোজ ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে, তারা কী করে এই মাঠটাকে ছেড়ে রেখেছে কে জানে । শীতকালে সকাল সকাল স্নান সেরে যাদের অনেক বয়স হয়েছে কালক্রমে তারা এই মাঠের রৌদ্র থেকে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নিতে জড়ো হয় তার শিয়রের কাছে এসে । শীতকালে এই মাঠেই বসে থাকত দোলনচাঁপা । সে যখন শান্ত থাকত তখন ডানদিকের কোনো একটা গলির কোনো একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাতসকালে হাজির হতো গত রাতের বাসন মাজার জন্য । চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিতেন ধীরেন্দ্রর মা । মা বেশ গর্ব করে পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলতেন - দোলন বাসন মাজে যেন মুখ দেখা যায় । যখন সে অশান্ত থাকত তখন তার মুখ দেখা যেত না । তাকে তার বাড়ির লোকজন বেঁধেও রাখত এক কোণে । শান্ত থাকার বছরগুলোই সংখ্যায় অনেক বেশি । সংখ্যায় কয়েক হাজার সকাল তাকে সূর্যের একেবারে ছেলেবেলায় মাথা নিচু করে আধার মার্জনার কাজে পেয়ে গেলেও কয়েকবার কয়েকটি দিনের লম্ফঝম্প তাকে হারিয়েছে বিপুলভাবে । তেমনই এক শূন্যতার দিনে কীভাবে যেন ঘরের বাঁধন কেটে সে সাতসকালে বাইরে বেরিয়ে আসে । ধীরেন্দ্র তখন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়ত বাইরের ঘরে । বেলায় তার ঘুম ভাঙাতেন মা । সেদিন কিন্তু দোলনচাঁপাই তার ঘুম ভাঙাল । বাইরের ঘরের বাইরের জানলায় দাঁড়িয়ে সেই অত্যন্ত শান্ত এবং অত্যন্ত লাজুক মেয়েটি একেবারে অন্যরকম গলার জোরে বলে উঠেছিল সেদিন - কেন যামিনী না যেতে জাগালে না দাদাবাবু । তাতে একটু সুর ছিল । কখনো কানে যাওয়া গানের সুর ছিল তিলমাত্র । বাদবাকি পুরোটাই ছিল অস্থিরতা । যেন শাখামৃগ ঘরে ঢুকতে চাইছে জানলা দিয়ে । দোলনচাঁপা পরে বেশ ভালো হয়ে যায় । তার বিয়ের জন্য মা একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনেছিলেন । বিয়ের পরে কয়েকমাস বাদে তার স্বামী ও শ্বশুর তাকে আর বাঁচতে দেয় না । যে পথ দিয়ে যেতে হচ্ছে তার ডানদিকের সব ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে তাকে পালা করে বহন করে শ্মশানে নিয়ে যায় । লোকে বলে ধীরেন্দ্রর মার দেওয়া সেই বসন পরিয়েই তাকে সেই চিরবিদায় জানানো হয়েছিল । দোলনচাঁপা ঝরে গেছে ডানদিক থেকে । কিন্তু বাঁদিকের মাঠ ঝরেনি । সেখানে এই মুহূর্তে কোনো খেলা নেই । কিন্তু বসা আছে । বিভিন্ন কেন্দ্রে গোল হয়ে বসে সব গল্প করছে । দোলনচাঁপাকে সে শেষ যে বয়সে দেখেছিল সেই বয়সটা কিন্তু হারিয়ে যায়নি পৃথিবী থেকে আজও ।
মাকে রাতে বাড়ি না থাকার কথা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পথে নেমে আসা সম্ভব হয় না বাস্তবতার দিক থেকে । সেটা প্রতিমাও বোঝে । তাই রেবা বেরোনোর সময় তাকে সে একটাই কথা বলেছিল - খুব বেশি রাত করিস না । আমার রান্না কিন্তু শেষ হওয়ার মুখে । রেবার মা ও দাদা, এমনকী কাজের ছেলেটাও দূরদর্শনের পর্দার দিকে তাকিয়ে । সেখানে রঙের খেলা চলছে । পোশাকের রঙ, সংলাপের রঙ, নিসর্গের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলা যাবে না বিফল । কারণ একটা ঘরে তিনজনই যে যার আসনে স্থির । ওই স্থিরতার প্রেক্ষাপটেই শ্মশানের কথা ওঠে । কখন দাহ হলো, কখন ফেরা হলো, যিনি গেলেন তাঁর বয়স ঠিক কত হয়েছিল, কবে তাহলে পারত্রিক কাজের দিন পড়ছে, বাড়িতে কয়েকটা দিন নিরামিষ খাওয়া মানে প্রতিমার পক্ষে সেটা কতটা অসুবিধেজনক - এমন সব কথারই জন্ম হলো সেই রঙের পটভূমিতে । দৃশ্য দেখতে দেখতে যেসব কথা বলা উচিত সেসব কথা এক এক্করে সেরে ফেলার দৃশ্য ধীরেন্দ্রকে সেই ঘর থেকে অদৃশ্য হওয়ার প্রেরণা যোগায় । রেবাও বলে ফেলে কোনো এক অচেনা রঙের দৌলতে - চলো, আমার ঘরে যাই ।
এই ঘরের কোথাও কোনো পরিবর্তন হলে ধীরেন্দ্র ধরতে পারে না এমন কথা বলা যাবে না । এই যে বইগুলো বিপুলভাবে এলোমেলো থাকত, আজ দেখা যাচ্ছে এক কোণে সঙ্ঘবদ্ধ, তা সে ধরে ফেলবেই যতই আসুক না কেন অন্যমনস্কতা । - বইগুলো গুছিয়েছ, এ সব তো আর ভাবাই যায় না আজকাল । একদিন যদি সম্ভব হয় আমাকে একটু বই গোছাতে সাহায্য করো । এমন অনেক বই জমে গেছে যেগুলো আমার আর কোনোদিনও কাজে লাগবে না । ওগুলো যাদের কাজে লাগবে তাদের দিয়ে দেব । বই গোছানোর আগে বই বিলোনোর কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে । কাকে কাকে দিয়ে দেওয়া যায় বলো তো ? - তা আমি কী করে বলব ? আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, আর যাকে হোক আমাকে নয় । আমার রাখার জায়গা প্রচুর । কিন্তু গ্রহণ করার জায়গা প্রায় নেই বললেই হয় । ওই যা গুছিয়ে রেখেছি এই জন্মের পক্ষে তাই যথেষ্ট । আরাম করে বসো । আমি একটু কাজ সেরে নিই । রেবা ঘর ছেড়ে যায় না । ঘরের মধ্যেই ঘুরতে থাকে আপনমনে । তাকে দেখে মনে হয় সে কিছু খুঁজছে । যেখানে বইয়ের বিন্যাস সেখানেও তার হাত পড়ে । এমনকী সে তার বালিশের তলাটাও দেখে নেয় একবার । কিছু একটা বলতে এসেও বলতে পারে না । আবার ফিরে যায় অনুসন্ধানে । শেষে খুঁজে বের করে একটা বই কোনো এক কোণ থেকে । - তোমাকে বলা হয়নি । সেদিন ফুটপাথ থেকে কিনেছ একদরে । এত কম দাম চেয়েছে যে দরাদরি করার ইচ্ছেই হয় না । গোপনে বলে রাখি, বেশি দাম চাইলেও আমি কিন্তু একদরেই কিনতাম । দেখো তো চিনতে পারো কিনা । বইটি হাতে নিয়ে ধীরেন্দ্র প্রচ্ছদ সরাসরি খুঁজে পায় না । কারণ রেবা ইতোমধ্যে তাকে আবৃত করেছে মলাট দিয়ে । মলাট ত্রিবর্ণরঞ্জিত । - এত সুন্দর মলাট, খুলতে গেলে যদি ছিঁড়ে যায় । তার চেয়ে বরং তুমিই খোলো । খুলে আমাকে দেখতে দাও । কত অনায়াসে মূর্তির আবরণ উন্মোচন করে রেবা । এবার ফুটে ওঠে তার শেষ কবিতার বইয়ের মূর্তি । - এ বই তুমি ফুটপাথ থেকে পেলে ! এ বই কেউ কোথাও দেখতে পায় না । কেন যে বেরিয়েছিল কে জানে । যে বের করেছিল তার সঙ্গেও আর দেখা হয়নি কয়েকবছর । দেখা হলে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করতাম, যে বই কোনোদিনও কারো চোখে পড়বে না তা বের করার মানে কী । - যাক আমার তো চোখে পড়েছে । আমি তাতেই খুশি । চুপ করে থাকলে হবে না কিন্তু । এ বই থেকে এখন কবিতা শোনাতে হবে । মনে আছে তো শর্তের কথা ? আমার দ্বিতীয় শর্ত ? ধীরেন্দ্র না করতে পারে না । সে তুলে ধরে সেই শীর্ণ সংকলন যাতে মহাসমুদ্রস্নানের কথা আছে, আছে রাত প্রায় সাড়ে আটটার কথা । আজ রাত প্রায় সাড়ে আটটায়/ আমার উপন্যাসে তোমার মুখ/ প্রবেশ করল । আছে সেই প্রশ্ন - আমাদের উপন্যাসে / তুমি কি এখনও আনো দরিয়াদর্পণ ? এমনকী আছে সেই নাভি । সেই নাভির কথাও শোনাতে হয় পরিষ্কার করে রেবাকে । বলতে হয় - আমার সামনে ভারতবর্ষ/ আমি পিতার নাভি আনতে যাব ।/ আমার পিছনে ভারতবর্ষ/ আমি পিতার নাভি আনতে যাব । শোনাতে শোনাতে, বলতে বলতে কে শুনছে আর কে বলছে সেই ভেদরেখা ক্ষীণতম হয়ে আসে । রাত্রিও আর তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না কোনোমতেই । দুজনে নেমে আসে পথে । কেউ কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে থাকে সেই ঘরের দিকে যেখানে বসে এইসব কবিতা লেখা হয়েছিল ।