• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | উপন্যাস
    Share
  • বর্ণবাসী : সুভাষ ঘোষাল


    একটু আগে যে শ্মশান ছেড়ে আসা হয়েছিল ধীরেন্দ্র তার কাছে গিয়ে বুঝতে পারে তার ভাবের পরিবর্তন ঘটে গেছে ইত্যবসরে । নতুন নতুন মুখ, নতুন নতুন অপেক্ষা, নতুন নতুন শবাধার এসে ভিড়ের মধ্যেও এনেছে এমন এক নবীনতা যার মুখোমুখি হতে গেলে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হয় । প্রস্তুতির অভাবে সে কোনোদিকে না তাকিয়ে কেবল সেই কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যেতে চাইল যেখানে অগ্নির একনায়কতন্ত্র আছে । সেখানে পৌঁছে সে দেখল, যে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে অথচ স্পর্শ করে আছে শবাধার সে যেমন নীলিমা তেমন তাকে স্পর্শ করে আছে যে সে যেন ঠিক প্রতিমা নয় । কারণ এই কয়েকঘন্টার মধ্যে তাকে খানিকটা অচেনা করে দিতে পেরেছে কালপ্রবাহ । সেও কাঁদছে, তবে সেই কান্নার মধ্যে পুরোটাই সামাজিকতার দায় নয় । প্রেমাংশুবাবুকে সে খুব বেশি চিনত না । খুড়শ্বশুরের ভূমিকায় তাঁকে খুব বেশি দেখতে পায়নি সে । তবু নীলিমাকে ছুঁয়ে থাকতে থাকতে সে কীভাবে যেন পেয়ে গেছে সেই সামর্থ্য যার জোরে শেষপর্যন্ত ব্যক্তিগত হওয়া যায়, যে শোক পেয়েছে তার কাছে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা যায় । - দাদা, দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি । তোমাকে বলেছিলাম না এখানেই নিয়ে আসব ? ঠিক নিয়ে এসেছি । কথা বলতে বলতে মাথা নামিয়ে চোখ মুছতে থাকে নীলিমা । নীলিমার পিঠে প্রতিমার হাত আছে এবং সে হাত গতিপ্রভ । তবু ধীরেন্দ্র তার পিঠে হাত রাখে, হাত বুলিয়ে দেয় । আর এইভাবেই বুঝতে পারে তার শিরে পৌঁছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে । নীলিমার শিরে তার হাত পৌঁছোলে মাথায় হাত বোলানোর স্বস্তি সে যেন পেতে চায় পুরোপুরি । আর তখনই সামনে থেকে তাড়া আসে শবাধার থেকে শব নামিয়ে মেঝেতে রাখার । যাদের মেঝেতে রাখা হয়েছিল তারা অগ্নিবলয়ের অন্তর্গত হওয়ায় নতুন একটি বিন্যাসের প্রয়োজন হয়ে পড়ে । প্রেমাংশুবাবুকে শবাধার থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখতে গেলে যে পরিমাণ বাহুবলের প্রয়োজন তা নীলিমা, প্রতিমা এবং ধীরেন্দ্রর মাধ্যমে মিটবে না বুঝতে পেরে ধীরেন্দ্র পিছিয়ে যায় অনিরুদ্ধর খোঁজে । প্রতিমা তাকে আশ্বস্ত করেছে যে নীলিমার অনুজ তার বন্ধুদের সঙ্গে কাছেই কোথাও আছে । একটু সক্রিয় হলেই তাকে পাওয়া যাবে ।

    ধীরেন্দ্র জানে সময় খুব কম । এক্ষুনি অনিরুদ্ধকে ডেকে আনতে না পারলে তারা লাইনের পেছনে পড়ে থাকবে । মূর্তির জন্য মানুষের যত দুর্বলতাই থাক তাকে বিমূর্ত করে দিতে না পারা পর্যন্ত স্বস্তি নেই । তাই লাইনের পেছনে পড়ে থাকা চলবে না । যেভাবেই হোক চোখ কান খোলা রেখে তাঁর পুত্রকে এক্ষুনি খুঁজে বের করতে হবে যাঁর মূর্তি তাঁর বিমূর্ততার কাছে ত্রক্রমশই ম্লান হয়ে আসছে । ধীরেন্দ্র অনেকদিন তার এই ভাইকে দেখেনি । কর্মসূত্রে তাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় । সে যে কোলাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি করেছে সেখানে তাকে সবসময় পাওয়া যায় না । তার প্রতিনিধি হয়ে তার স্ত্রী থাকে, তার কিশোরী কন্যা থাকে আর থাকে তার প্রত্যাগত হওয়ার প্রতিশ্রুতি । এই বাড়িতে একবারও তার পিতামাতার পদধূলি যে পড়েনি তার জন্য কি দায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদ ? এই জাতীয় প্রশ্ন এ সময়ে মাথা তুলতে চাইলে তারও মূর্তিমান হয়ে ওঠার আশঙ্কা থেকে যায় । ধীরেন্দ্র আর নতুন করে কারো কবলিত হতে চায় না বলে অনিরুদ্ধর স্ত্রী বা কন্যা কেউই যে শ্মশানযাত্রী হয়নি, প্রেমাংশুবাবুর শবাধার ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো নারীশক্তি যে উপজাত হয়নি আজ, এসব কথা বা দৃশ্যকে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে সে অনিরুদ্ধর সেই কুড়ি বছর আগের মুখমণ্ডল দেখতে চায় যেখানে সংসারের দাগ ছিল না বলে হাসি আর কৌতূহল ছিল সমপরিমাণে । কাকার ছেলেকে তাকে খুঁজে নিতে হবে এতদিন বাদে সেই ভিড় থেকে যে ভিড়ের সঙ্গে মহাবসানের যোগ যত নিবিড় ততই অস্পষ্ট । সে পা বাড়াতে যাবে যাবে এমন এক মুহূর্তে প্রতিমার কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে - ওই তো ঠাকুরপো এসে গেছে । ধীরেন্দ্র স্বস্তি পায় । তাকিয়ে দেখে তার সেই ভাইকে যে মোটা হয়েছে, উপনেত্রবান হয়েছে এবং হয়েছে আত্মসচেতন । ধীরেন্দ্রকে ধরতে হয় না, নীলিমা এবং প্রতিমাকেও সরে থাকতে হয় । কারণ অনিরুদ্ধ তার সহযোগীদের সাহায্যে তার পিতাকে শবাধার থেকে নামিয়ে এনে মাটিতে রাখে একটুও বেহিসেবি না হয়ে । খুবই অচেনা একজন মানুষ ভিড় থেকে ঝরে পড়ে নীলিমার পাশে এসে নত হয়ে জানতে চায় - কাজ করবেন কে ? চোখ মুছে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে নীলিমা যে উত্তর প্রদান করে তার মধ্যে কোনোরকম জড়তা থাকে না বলে তা সকলেরই কানে পৌঁছে যায় নিরুপদ্রবে । - মুখাগ্নির কথা বলছেন তো ? আমার ভাই করবে, তার সঙ্গে কিন্তু আমিও করব । এখানে আপনি যা যা কাজ করাবেন সবকিছুতেই আমি থাকব । কারণ বাবাকে এতদিন চব্বিশ ঘন্টা ধরে আমিই আগলে রেখেছিলাম । যে নত হয়ে জানতে চেয়েছিল সে প্রথমে মানতে পারেনি নীলিমার এই ঘোষণা কিংবা সমানাধিকারের দাবি । কিন্তু শোক, অভিমান এবং বিচারের জোর এক হয়ে এমন একটা ঋজুতার জন্ম দেয় যার মুখোমুখি হওয়ার সাহস সেই পুরোহিতের ছিল না বলে সে কাজ শুরু করে দেয় আর কথা না বাড়িয়ে । অনিরুদ্ধকে অনুশাসন যতটা সক্রিয় করে প্রায় ততটাই স্বাধীনভাবে সক্রিয় থাকে তার অগ্রজা । শেষে দেখা যায় পাটকাঠির আগুন বহন করে শবদেহ ঘিরে যে প্রদক্ষিণ সেই ধাবমানতায় নীলিমারও যোগদান নির্দ্বিধায় । আগুনের বলিষ্ঠতার পাশে প্রতিবাদের বলিষ্ঠতা সত্যিই কতটা লেলিহান সে বিচারের ভার ধীরেন্দ্রর ওপরে নেই । সে বুঝতে পারে সময় হয়ে এসেছে সেই অগ্নিকুণ্ডের দরজা খুলে যাওয়ার । প্রেমাংশুবাবু অচিরাৎ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাবেন । তার আগেই শেষ প্রণাম সেরে নিতে হবে । মাটিতে বসে পড়ে খুল্লতাতের পদস্পর্শ করে প্রণাম জানানোর কাজটা তার কাছে আবহমানের ধ্বনির সঙ্গে সংযোগ রক্ষার কাজ হয়ে ওঠে প্রায় । সে বুঝতে পারে কত কঠিন এই কাজ । কোনো ভঙ্গি দিয়ে, কোনো মুদ্রা দিয়ে, কোনো প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে এই কাজ সেরে ফেলা যাবে না । অত্যন্ত গোপনে একেবারে নিজস্ব উপায়ে তাকে সেই প্রণামের পা ছুঁতে হবে যা বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আধারে প্রতিফলিত হয়েছে । সে এক লহমায় যেন বিভিন্ন যুগেরও সেই সান্নিধ্যে চলে আসে । ফলে প্রেমাংশুবাবুর ঝরে যাওয়া সব পদাঙ্গুলির অনুপস্থিতি তাকে আর নতুন করে যোগভ্রষ্ট করতে পারে না । ধীরেন্দ্র কাজ সেরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারে । বল হরি, হরিবোল - ভিড়ের কোনো এক প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হয় এই স্বর এবং স্বরলিপি মেনে তা ছড়িয়ে পড়ে সেই অগ্নিকুণ্ডের দিকে যেখানে প্রেমাংশুতনুকে অভ্যর্থনা করার জন্য জেগে উঠেছে এক গহ্বর । সেই দিকে যতটা যাওয়া যায় ততটাই যেতে চায় শবানুগামীরা । ফলে দেখা যায় নর ও নারীর একটা সম্মিলিত পদক্ষেপ । নীলিমা প্রতিমার কাঁধে হাত দিয়ে নয়, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই চোখ খোলা রেখে এগিয়ে যেতে চায় এবং যায়ও । প্রতিমা তাঁকেই অনুসরণ করে । অনিরুদ্ধ প্রতিমাকে অনুসরণ করে আপনমনে । আর ধীরেন্দ্র যেখানে বসে শেষ প্রণাম করেছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে পরিষ্কার । তার মনে হয়, সে সত্যের নাটমন্দিরে দাঁড়িয়ে গর্ভগৃহের দিকে তাকিয়ে আছে । তার সামান্য দৃষ্টিতে অগ্নির তনু ছাড়া আর কিছু প্রকাশ না পেলেও তার সামান্য কর্ণে ভেসে এল কেনোপনিষদের একটি ছত্র যা সে মুখস্থ করেছিল হাততালি কুড়োনোর জন্য একসময় । `ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্গচ্ছিত নো মন: ।' সেখানে নয়ন যায় না, যায় না বাক্য, যায় না মন । সেই অসহায়তা টের পেল সে । - চলো দাদা, এখানে খুব গরম, বাইরে গিয়ে বসি । দাহ শেষ হতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো লেগে যাবে, তাই না ? অনিরুদ্ধ হাত ধরে সেই মানুষের যে সেইসব দিনগুলোর কথা ভাবছে যখন দেখা যেত চিতানল । দেহের সঙ্গে অগ্নির মিথুন দেখা যেত একটু একটু করে । তেমন দিন বিরাজ করলে বাবার ছোট ভাইকে দেখা যেত বড়ো করে । দেখা যেত তিনি কীভাবে রূপান্তরিত হচ্ছেন সেই খেলাটা । এখন আর কিছুই দেখার উপায় নেই । সব কাজই গোপনে গোপনে চোখের আড়ালে হয়ে যায় । ভস্মভুবনের যে প্রাণ তার স্পন্দন আর ধরা পড়ে না । হয়তো পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে অবগুন্ঠন খুলে যাবে । কিন্তু তার মধ্যে থাকবে না কোনো উন্মোচন ।

    বাইরে বেরিয়ে এসে বসার জায়গা পেয়ে যায় ধীরেন্দ্র । অনিরুদ্ধ তাকে ডেকে আনলেও সে যে তার সহযোগীদের সঙ্গে কোনদিকে চলে যায় তা বুঝতে পারে না সে । অনতিদূরে একবার নীলিমার স্বামীকে দেখতে পায় । নীলিমা আর প্রতিমার সঙ্গে যে মেয়েটি কোথাও না বসে আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে যে নীলিমারই সন্তান তা বুঝতে বোধহয় ভুল করে না ধীরেন্দ্র । সে শাড়ি না পরলেও যা পরেছে তার মাধ্যমে ফুটে উঠতে পারছে তার মাতামহকে হারানোর শূন্যতা । যে সপ্রতিভতা তাকে হয়তো অন্যসময় সাহায্য করে এই মুহূর্তে সেটাই যেন সাহায্যপ্রার্থী । সে তার মাকে শান্ত করতে গিয়ে যেন কোথায় হাত রাখবে, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না । অনতিদূরে বসে আছে বলে সে লক্ষ করতে পারে নীলিমার মেয়ে নিজেই চোখ ঢেকে কান্না সামলানোর চেষ্টা করে ফেলছে । তখন প্রতিমাই এগিয়ে যাচ্ছে । তাকেই নিতে হচ্ছে শোকের প্রেক্ষাপটে সক্রিয় ভূমিকা । আর কিছুক্ষণ বাদে তেমন করে কিছুই দেখা যাবে না যেখানে সে বসে আছে সেখান থেকে । কারণ সন্ধে নামবে বলে পা বাড়িয়েছে । শ্মশানের মূল কেন্দ্রের এই বাইরের দিকটা পুরসভার দৌলতে খুব বেশি মলিন নেই আর । বরং সজ্জিত করে তোলার একটা প্রয়াস কেবলই চাইছে তার ছাপ রেখে যেতে । একটু বাদে খোলা আকাশের তলাতেও আলো জ্বলবে । সে আলোও মূলত মায়াময় । যে বসে বসে সবকিছু দেখতে চায় তার কাজে লাগে না । বিদ্যাসাগরের তিরোধানে হেমচন্দ্র লিখেছিলেন, `ফুরাল বঙ্গের লীলা মাহাত্ম্য সকলি, -/ হরিল বিদ্যাসাগরে কাল মহাবলী ।' সেই মহাবলী কালকে এক কোণে বসে দেখার চেষ্টা করে যায় ধীরেন্দ্র । কিন্তু সফল হয় না । তার মনে পড়ে যায় গত শতাব্দীর আগের যে শতাব্দী তার শেষভাগের সেই কাহিনী । শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন বিদ্যাসাগর । কত ডাক্তার দেখতে আসছেন । মহেন্দ্রলাল সরকারও এসে দেখে গেছেন । ডাক্তার অমূল্যচরণ বসে আছেন । তিনি যাঁর কাছে বসে আছেন তাঁর কাছ থেকে পেয়ে এসেছেন পুত্রবৎ স্নেহ । রোগী যেখানে শুয়ে আছেন তার সামনে বিরাজ করছে তাঁর মায়ের ছবি । উত্তর শিয়রে যিনি শায়িত তিনি মুমূর্ষু । আর ছবি টাঙানো আছে পুবদিকে । হঠাৎ কী যে হয়, দেখা যায় রোগী পশ্চিম দিকে মাথা নিয়ে গিয়ে পুবদিকে তাঁর মায়ের ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । আর চোখ দিয়ে জল পড়ছে অঝোরে । তারপর নেমে আসে চৈতন্যহীনতা । ২৯ জুলাই ১৮৯১, রাত্রি দুটো বেজে আঠারো, দেহাবসান হলো বিদ্যাসাগরের । দুদিন আগে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে যে শ্মশানে দাহ করা হয় সেখানে পৌঁছে যায় বিদ্যাসাগরের শব সূর্যোদয়ের আগেই । তাঁর যাঁরা দৌহিত্র তাঁরা চেয়েছিলেন শ্মশানে শায়িত ঈশ্বরচন্দ্রের ছবি তুলে রাখতে । তাই শেষে অপেক্ষা করতে হয় সূর্যের আত্মপ্রকাশের জন্য । যাকে তাকে দিয়ে প্রথম আলোয় ছবি তোলানো হয়নি । ছবি তুলতে এসেছিলেন বিখ্যাত শরত্চন্দ্র সেন । যারা ভোরবেলায় হাঁটতে বেরোয় তারা ভিড় করেছিল । যারা খুব সকালে সেরে নেয় অবগাহনস্নান ভিড় করেছিল তারাও । জীবনীকার স্নানার্থী, ভ্রমণার্থী এবং অবিমিশ্র দর্শনার্থীর সমবায়ে যে ভিড়ের ছবি এঁকেছেন সেখানে আবার আলাদা করে মেয়েদের কথা বলা হয়েছে । `স্ত্রীলোক' এই শব্দের ব্যবহার হয়েছে । এসেছিল অনেক স্ত্রীলোক । বোঝা যায় গঙ্গা সেখানে শব স্থাপিত করা হয় । চিতা জ্বলে উঠতে সময় নেয়নি । পুত্র নারায়ণ এগিয়ে এলেন মুখাগ্নি করার জন্য । সেই চিতা জ্বলেছিল বেলা এগারোটা পর্যন্ত । কোনোরকম অবগুন্ঠন নয়, সকলের চোখের সামনে বিদ্যাসাগরের পার্থিব আয়তন পরিণত হয় ভস্মে । কবি মানকুমারী স্বচক্ষে দেখেছিলেন সেই বহ্নিমান চিতা । তাই তাঁকে প্রথমে লিখতে হয়েছিল সেই আগুনের কথা যার দর্শক বিশ্বব্রহ্মণ্ড । শেষে লিখেছিলেন, `ঐ চিহ্ন ফুরাইয়া আসিতেছে ।'

    সত্যিই চিহ্ন ফুরিয়ে আসছে । শুধু প্রেমাংশুবাবুর নয়, তারও । যে মুখমণ্ডল নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল তা যেমন আজ আর কেউ চিনে নিতে পারবে না তেমন হারিয়ে যাচ্ছে তার নিজেরই চতুর্দিক । যে সব পথ ধরে সে এতদিন হেঁটে যাওয়ার কথা ভেবেছে সেগুলোও লুপ্তপ্রায় । যাদের কাছে গিয়ে সান্নিধ্যের তাপ নিতে চেয়েছিল তাদের ঠিকানা সব পালটে গেছে । আর প্রতিটি ঠিকানাই এত দূরে বা এত কুয়াশাচ্ছন্ন যে ধীরেন্দ্রর পক্ষে সেগুলো আর কোনো কাজে লাগতে চায় না । প্রতিদিন বেলাশেষে সে ভাবে, এই পৃথিবীতে এসে সে যতটুকু চিহ্ন অর্জন করেছিল ততটুকুর অবস্থান ঠিক কোথায় তা বুঝতে বুঝতে সত্যিই ফুরিয়ে যাবে দিন । নীলিমার মেয়েও তো কাঁদছিল কত সপ্রতিভভাবে । অনিরুদ্ধও সাশ্রু না হয়েও মুখমণ্ডলে অশ্রুর জন্য অবকাশ রেখে দিয়েছে । ধীরেন্দ্র এদের কারো মতো করেই কাঁদতে পারে না । চোখের গোলমাল ছাড়া সে টের পায় না চোখের জলের ভূমিকা । কিন্তু মুশকিলটা হলো, সে প্রতি পদক্ষেপে বুঝতে পারে কান্নার কাজ চলছে অষ্টপ্রহর । এমনকী রেত:পাতের পরেও তার মনে হয়েছে নিবিড়ভাবে কাঁদতে পারলে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরার ফাঁকিটাকে ভুলে যাওয়া যেত । সত্যিই চিহ্ন ফুরিয়ে আসছে । সে অশ্রুর মধ্যেও খুঁজে পায় না কান্নার চিহ্ন । তার পিসিমার ছোট ছেলের চাকরিটা ছোট নয় । চাকরি করতে করতে সে বাড়ি করে এমন এক সময়ে যখন চাকরি শেষ হওয়ার কথা মাথায় না রেখে চাকরি করে যেতে হবে অনেকদিন । সে বাড়িতে প্রতিমাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল একবার । তখন পিসিমাও বেঁচে ছিলেন । তবে তাঁর অবস্থানের মধ্যে ফুটে উঠেছিল চিহ্ন ফুরিয়ে যাওয়ার আভাস । তাই হাজির হওয়ার চাপ এড়িয়ে যেতে পারেনি । যেখানে যাওয়া হয়েছিল তার কাছেই আছে সরোবর । সরকার শুধু শুধু সরোবর ফেলে রাখবে কেন ? তাকে তো সবসময় আয় বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে । তাই জলাশয়ের চারিদিকের ব্যাপ্তিকে বন্ধনী দিয়ে ঘিরে এমন প্রলোভনের সৃষ্টি করা হয়েছে যাকে জয় করা খুব সহজ কাজ নয় । এমন সব নৌকো সরোবরের জলে নামানো হয়েছে যেগুলো থেমে স্থির থাকলে ফোটা পদ্মের ভূমিকা পালন করে নির্ঘাত । পারে দাঁড়িয়ে কেউ যদি দেখে ফেলে পদ্মের শরীর এবং সে শরীরে যদি তেমন জায়গা থাকে যাতে এসে মিলতে পারে শরীরই শেষে, তবে কে আর জলে নামার টিকিট না কেটে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তীরে ? বলা দরকার যে টিকিটঘরও সুসজ্জিত । সেখানে কাউন্টার আছে । কাউন্টারে যে বসে থাকে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে তারও হাত বাড়িয়ে দিতে সময় লাগে না । ধীরেন্দ্ররা যখন সরোবরের তীরে পৌঁছোয় তখন সন্ধে নেমে গেছে জলের মধ্যেও । জলে কেবল নৌকোর চিহ্ন ফুরিয়ে আসার প্রতিযোগিতা । তীরের কাছে সেই পদ্ম ফুটে নেই একটিও । কিন্তু তার মিলিয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখতে দেখতে শুধু প্রতিমা নয় সেইসঙ্গে প্রীতিও কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছিল । তারা টিকিট কেটে নৌকোয় চেপে সারাটা সরোবর ঘুরে আসবে । সরোবরে আলো না থাক টিকিটঘরে তো আলো আছে । পিসতুতো ভাই তার স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য এগিয়ে না আসলেও ধীরেন্দ্র পিছিয়ে আসেনি তার স্ত্রীকে শান্ত করার ব্যাপারে । - দাদা, তুমি বৌদিকে বাধা দিচ্ছ কেন ? একটা নতুন জায়গায় নতুন ধরনের নৌকো চড়বে, তাতে আপত্তির কী আছে ? ধীরেন্দ্র তখনো নৌকো দেখেনি বলে নতুন ধরনটা কী তা তার জানা ছিল না । তাকে প্রীতি বুঝিয়ে দিয়েছিল । এ নৌকো চালাতে কোনো মাঝির দরকার হয় না । কাউকে বলার প্রশ্নই নেই যে পার করে দাও আমারে । নিজেই নিজের মাঝি । যত সক্রিয় রাখা যাবে পা ততই পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে পারের দিকে । প্রীতি ঘোর সন্ধেবেলায় জোর দিয়ে বলেছিল - এ বড়ো মজার খেলা । তীরে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই বোঝা যাবে না । তাড়াতাড়ি জলে নেমে পড়তে হবে । ধীরেন্দ্র শেষ বাধার দেওয়াল তুলতে চেয়েছিল । - আমাদের দুজনের কেউই কিন্তু সাঁতার জানি না । অন্ধকার হয়ে গেছে । যদি কোনো বিপদ ঘটে । দেওয়াল তুলতে দিল না প্রীতি ও তার স্বামী । তাদের বক্তব্য, এ নৌকো ডুববে না, এ জলে অন্ধকার থাকলেও থাকে না বিপদ তেমন । - দাদা, তোমার যখন এত ভয়, একটা নৌকোয় আমি বৌদিকে নিয়ে বসছি । আর একটাতে তুমি বসো তোমার বৌমার সঙ্গে । আমরা দুজনেই কিন্তু জলের পোকা । আমার সাঁতারে পদক না থাকলেও আমি কিন্তু তোমার পিসিমার কাছ থেকে সাঁতার শিখেছি । আর প্রীতির পদক সে গঙ্গা সাঁতরে পেয়েছিল । তোমার কোনো ভয় নেই । কিন্তু সেই মুহূর্তে পারে কোনো নৌকো না থাকায় তাদের অপেক্ষা করতে হয় এবং বাড়ে অন্ধকার । সেই বর্ধিষ্ণু অন্ধকারের মধ্যে যে নৌকোটি দৃশ্যমান হতে হতে একেবারে দৃষ্টির সামনে এসে পড়ে, তীরও ছোঁয়, টিকিটঘরের আলোকরেখায় স্নিগ্ধ হয়, যে নৌকো থেকে একাধিক মানুষ ডাঙায় উঠে এসে একটা উত্তরাধিকারের জমি তৈরি করে দিয়ে যায়, সেই নৌকোয় প্রথমে ওঠে পিসিমার ছেলে এবং প্রতিমা পরে । পুরুষের প্রসারিত হাত নারীকে নামতে সাহায্য করে । তীরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় নৌকোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ধীরেন্দ্র দেখেছিল প্রতিমার নৌকো এগিয়ে যাচ্ছে এবং যত অগ্রণী হচ্ছে ততই নেমে আসছে অন্ধত্ব । আর প্রীতি হেসেছিল । - দিদিভাইরা এগিয়ে যাক না, আমরা ঠিক ওদের ধরে নেব । যে প্রীতি সাধারণত শাড়ি পরে, অন্তত তেমনই ধারণা ছিল ধীরেন্দ্রর, সে সেদিন চুড়িদার পরে সরোবরের তীরে খুব বেশি অপেক্ষারত হতে পারেনি । কারণ দ্বিতীয় নৌকো এসে যায় । সেই নৌকোতে একাকিত্ব ছিল । একজনই উঠে এসে দুজনকে নেমে যাওয়ার প্রেরণা যোগায় । সেদিন প্রীতি জলের বুকের উপবিষ্ট হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলে নারীর প্রসারিত হাত পুরুষকে নামতে সাহায্য করে । - তুমি একদম ভয় পেয়ো না । যতটা পারো এইভাবে পা চালিয়ে যাও । প্রীতির কন্ঠে এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, অন্ধকারের মধ্যেও চিড় ধরেছিল কোথাও । সেদিনের সেই জলযাত্রায় সে যতটা সক্রিয় ছিল তার সানুদেশে, ততটাই প্রকৃতির জন্ম হচ্ছিল এবং ততটাই নিষ্ক্রিয় আর দ্রষ্টা হয়ে পড়ছিল ধীরেন্দ্র । যখন আর তীর দেখা যায় না, চতুর্দিক তীরস্থ হলেও যখন আর দেখা যায় না কোনো হিসেবের খেলা, যেন মৃগনাভির গন্ধে মাঝি নিজেও বিচলিত হয়ে উঠতে চায়, তখন ধীরেন্দ্র টের পায় অশ্রু না থাকলেও কান্না কতটা স্বাক্ষর রেখে যেতে চাইছে । সেদিন অন্ধকারে যে হাল ধরেছিল, তার প্রবলভাবে চিহ্নিত হয়ে ওঠার মধ্যেও কী যে এক নিশ্চিহ্নতা ছিল যার কথা কাউকে বলে বোঝানো যায় না, কী যে এক কান্না ছিল যা কেঁদে দেখানো যায় না কোনোদিনও । সেবার তারা যখন পিসিমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বগৃহে যাবে বলে একটি পুরোনো চার চাকার গাড়ির নবীকৃত ঔজ্জ্বল্যের অন্তর্গত হয়, যখন সবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাতে চায়, যখন পুত্রের সাহায্যে পিসিমাও বাইরে এসে দাঁড়ান এবং ধীরেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত করেন আপনমনে, যখন এই কথাটাই বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চায় যে, এ দেখাই শেষ দেখা এই পৃথিবীতে, তখনো কান্নার সংজ্ঞা বিরাজ করেছিল, কিন্তু কান্না নয় । এই কথাটা ধীরেন্দ্র নিজেকেও সবসময় বোঝাতে পারে না বলে, স্বচ্ছতার অভাব হয় বলে, প্রকাশ পেতে থাকে কেমন এক কষ্টের সচ্ছলতা এত অভাবের মাঝখানেও ।

    - চলো দাদা, একটু হেঁটে আসি সবাই মিলে । যে ধীরেন্দ্রকে দৈনন্দিনের মধ্যে নিয়ে আসতে চায় সে অনিরুদ্ধ । কিংবা বলা যায় যাঁর পার্থিবতার সঙ্গে অগ্নির পার্থিবতার সেই অসম যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে, সে তাঁরই ঔরসজাত । - তোরা যা । কখন কী দরকার পড়ে, আমি বরং এখানেই বসে থেকে লক্ষ করি । - এখনো সবকিছু শেষ হতে অন্তত আধ ঘন্টা বাকি । চলো, একটু চা খেয়ে আসা যাক । শুধু তো আমরা নই, আমার অফিসের কয়েকজন এসেছে । তাদের তো একটু চা মিষ্টি খাওয়াতে হবে । তুমি সবার বড়ো । তুমি না গেলে হবে না । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে অনিরুদ্ধ অবসরকে কাজে লাগাতে চাইছে । দাহ শেষ হলে যেটা করা যেত সেটা আগে করে নিতে পারলে লাভ আছে । ঘরে ফেরার একটা তাড়া থাকে । সেই ব্যস্ততার মাঝখানে সবাইকে জড়ো করে চা আর মিষ্টিমুখ করানো খুব কম সময়ের ব্যাপার নয় । ফলে তাকে উঠতেই হয় । মেয়েরা কেউ দোকানে দিকে যেতে চায় না । তারা যেখানে আছে সেখান থেকে সরে গিয়ে এমন দূরত্বে বসতে চায় যেখান থেকে দাহকর্মের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত তাদের যে কোনো ডাক শোনা যায় পরিষ্কার । দোকানে যাওয়ার ক্ষেত্রে নীলিমার আপত্তি তার কন্যা এবং প্রতিমার মধ্যে সঞ্চারিত হয় বলে বেশ একটা সঙ্ঘবদ্ধতা নিয়ে ভস্মক্ষেত্রের কাছাকাছি তাদের অগ্রসরণ দেখতে পাওয়া যায় । কিংবা নতুন করে কোথাও যেন চিহ্নের জন্ম হতে থাকে । সত্যিই মনে হয়, মাঝে মাঝে কবিতার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে একটা করে গদ্যের বাড়ি করে তুলতে না পারলে খুবই মুশকিল । বাড়িগুলো ছোট হোক তাতে ক্ষতি নেই । কিন্তু প্রতিটি বাড়িতে থাকতেই হবে বড়ো হওয়ার অভিপ্রায় । সত্যিই মনে হয়, আলাদা করে আর কোনো ঋতুকেই পাওয়া যাচ্ছে না । কে যে ঋতুরাজ তা নিয়েও আর কোনো পূর্বনির্ধারিত চেতনা নেই কোথাও । ফলে কোথাও-না-কোথাও এইসব বাড়িই শেষে হয়ে উঠতে পারে অবিমিশ্র এক একটা ঋতু ।

    দোকানের দিকে যেতে যেতে ধীরেন্দ্র একটা কথা অনিরুদ্ধকে জানিয়েছে । যে ছোট দলটিকে নিয়ে তারা অভিমুখী দেখতে হবে সেই দলটি যেন এমন কোনো দোকানের সামনে না থামে যেটা শ্মশানেরই একেবারে উলটোদিকে অবস্থিত । শ্মশানের একেবারে উলটোদিকের দোকানগুলি কেবল শ্মশানবন্ধুদেরই জন্য প্রতিষ্ঠিত এবং চিহ্নিত । যেখানে প্রতিষ্ঠা এবং চিহ্ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারংবার, যেখানে অগ্নিরই সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠা এবং লেলিহানতাই শেষে সবচেয়ে বড়ো চিহ্ন, সেখানে শ্মশানের একেবারে উলটোদিকের দোকানে ভিড় করার কোনো মানে হয় না । তার চেয়ে একটু এগিয়ে গেলে মোড়ের মাথায় যে মিষ্টির দোকান পারিবারিক হয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা মিষ্টি খেলেও অনেক স্বস্তি । সেখানেই চা পাওয়া না গেলেও, এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ না থাকলেও চা পাওয়া যাবে ঠিক তার উলটোদিকের অপ্রতিষ্ঠিত অবস্থানে । সেখানে কাচের আধারে বিস্কুট থাকে, জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসানো থাকে কেটলি, যার দোকান তার গোঁফ থাকে, গাফিলতি থাকে হাসির ক্ষেত্রে, কিন্তু পরিষেবার দিক থেকে কোনো ত্রুটি থাকে না । মোড়ের মাথার সেই মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে থামে ধীরেন্দ্র । তাকেই অনুসরণ করা হয়েছে বলে বাকি সবাই সেখানেই পৌঁছে যায় । যেখানে থরে থরে মিষ্টি সাজানো থাকে সেদিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হয় সে । বেশ কিছু প্রচলিত আয়তনের পাশে একটা তাক এমন এক মিষ্টিতে প্রায় পূর্ণ হয়ে আছে যার সঙ্গে অনেকদিন বাদে দেখা হলো তার । ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে এই মিষ্টি পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে তখনই যখন একটা অখণ্ড লবঙ্গ গেঁথে দেওয়া হয় তার শরীরে । শুধু লবঙ্গ নয়, যা কিছু অখণ্ড তার জোর অন্যরকম । ফলে এই মিষ্টির মধ্যে চিরকালই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারার শক্তি রয়ে গেছে । ধীরেন্দ্র তার অভিজ্ঞতায় কত নিশ্চরিত্র রচনার কত সব কদর দেখেছে । কত শূন্যগর্ভ সব আয়োজন কেবল পণ্য হতে পারার জোরে উঠে এসেছে আলোকসজ্জায় । পণ্য হতে পারেনি বলে কদর নেই বলে চোখের আড়ালে চলে গেছে যে সব রূপ তাদের একটিকে অন্তত থালায় ফুটে উঠতে দেখে ধীরেন্দ্র যেন বিহ্বল হয়ে এগিয়ে যায় দোকানের ক্যাশবাক্স নিয়ে যে বসে আছে তার সামনে । তর্জনী ব্যবহার করে বলে - আপনারা হঠাৎ এই মিষ্টিতে ফিরে এলেন ? এ তল্লাটে কোনো দোকানে চোখে পড়ে না তো ? যার কাছে প্রশ্ন যায় সে না হেসেই জানিয়ে দিল - আমরা এ সব ঝামেলার মধ্যে থাকতে চাই না । এক কনের বাবা ধরে বসলেন তার কাজে এই মিষ্টি করে দিতেই হবে । রাজি না হয়ে উপায় ছিল না । ভদ্রলোক আমাদের দোকানের পুরোনো খদ্দের । আমার বাবার আমলের মানুষ । মুখের ওপর না বলি কী করে । কে করবে ? আমার লোকজন এসব করতে জানে না । শেষে খুঁজে খুঁজে কারিগর ভাড়া করে আনি । কিছু বেশি করে করতে বলেছিলাম । ওই কটা পড়ে আছে । নেবেন নাকি ? দামটা একটু বেশি পড়বে কিন্তু । তাকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে ধরে কজন দাঁড়িয়ে আছে তা হিসেব করে নিয়ে ধীরেন্দ্র শেষে লবঙ্গবিদ্ধ মিষ্টি কেনে । হিসেবের মধ্যে সে প্রথমে নীলিমাদের তিনজনকে রাখতে চায় । তারা এখানে না এলেও তাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া রচনা পৌঁছে দেওয়ার প্রকাশক হতে চেয়েছিল সে । পরে ভেবে দেখল, যেখানে শোক খুব আকরিক অবস্থায় বিরাজ করছে সেখানে শোক ছাড়া আর কোনো খাদ্যই বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে । তিনজন বাদ গেলে যে সংখ্যাটা শেষে তৈরি হয় তার জোরে থালা খালি হতে পারে না, থালার একটা অংশে টাক পড়ে মাত্র । অনিরুদ্ধ দাম দেওয়ার জন্য এগোতে চেয়েছিল । তাকে প্রতিহত করে সে দাম দেয় । এই নয় যে, মিষ্টির ঠোঙা তুলে দেয় অনিরুদ্ধর হাতে বন্টনের জন্য । সে ভারও সে নিজেই বহন করে । তার ভালো লাগে । কোথায় যেন দুলতে শুরু করে রাতের কিশলয় । সেই দোলার শব্দ তার কানে যত পৌঁছোতে থাকে ততই সে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে গিয়ে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের হাতে একটা একটা করে তুলে দেয় রূপ । - তোমারটা কই ? তুমি নিলে না ? অনিরুদ্ধ তার প্রাপ্তি নিয়ে এগিয়ে আসে । ধীরেন্দ্র অবাক হয় । কারণ হিসেবের মধ্যে নিজেকে ধরলেও শেষে সে হিসেবের বাইরেই থেকে গেছে । কারণ তার হাতের ঠোঙায় কোনো বস্তু আর অবশিষ্ট নেই । - দাঁড়াও, আমি আর একটা নিয়ে আসি । অনিরুদ্ধ অগ্রজের কাছ থেকে বাধা পেয়ে তার মিষ্টির অর্ধেক অন্তত নিতে বলে তাকে । - তুই খা । আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না, খাওয়া দেখতে ইচ্ছে করছে । আমি শুধু চা খাব । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে, আজ বাদ দিয়ে কাল কিংবা পরশু হাঁটতে হাঁটতে এই দোকানে এলেও দোকান তাকে ফিরিয়ে দেবে । একটা আস্ত লবঙ্গের বিঁধে থাকার ছবিটা এখানে কোথাও আর দেখতে পাওয়া যাবে না । কারণ কনে আর কনের বাবারা থাকলেও এমন কনের বাবাকে পাওয়া যাবে না যে তেমন মিষ্টির কথা বলে স্মৃতিতীর্থ হতে পারে । ধীরেন্দ্র মানে, তবু একটা কান্না কোথাও থেকে যাবে ঠিক ।

    ---------


    যে ভাবে হয় সেই ভাবেই হয়ে গেল সবকিছু । প্রেমাংশুবাবুর দেহ ছাই হয়ে যেতে যতটা সময় দরকার ততটাই লেগেছিল ঠিক । চা-মিষ্টি খেয়ে যে প্রত্যাবর্তন তার কোথাও ছিল না কোনোরকম নাটকীয়তা । যখন দাহক্ষেত্রের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয় তখন নেমেছিল সবাই । সবাই খালি হাতে উঠে এসেছিল । কেবল অনিরুদ্ধই সেই মৃত্পাত্র বহন করে যার মধ্যে পিতার নাভি আছে এমন কথা জানানো হয়েছে এবং যা হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দরাদরির পর যে অর্থ ঠিক হয় সেই অর্থের বিনিময়ে । সবকিছু যে ভাবে হয় সেইভাবেই হয়েছিল ঠিক । শুধু অনিরুদ্ধ সামনেই যে জলাশয় তার শীর্ণতা ও সংকীর্ণতার মধ্যে নাভি ন্যস্ত করে ডুব দিতে চায়নি । তার আপত্তির মধ্যে বাস্তবের বাহুবল ছিল, ছিল যুক্তির প্রশ্রয় । যে জল কৃষ্ণতম হয়েছে, অবহেলিত হতে হতে পতিত হয়েছে, তার কোলে কোনোকিছু উত্সর্গ করা যায় না, সম্ভব হয় না কোনোরকম গাহনও । পিতার সঙ্গে তার যোগসূত্র কতটা আবহমান থেকেছে এই প্রশ্ন নীলিমার মাধ্যমে ধীরেন্দ্রর মনে সঞ্চারিত হলেও জলের আবহমানতা নিয়ে যে সংকট তা স্বীকার করে নিতে দেরি হয়নি তারও । ফলে যেখানে লঞ্চ চলে, স্টিমারের শব্দ শোনা যায়, শুশুকের মতো হঠাৎ মাথা তোলে শুশুকই বোধ হয়, যেখানে সাঁতারের পটভূমি মিশে যায় স্নানের পটভূমির মধ্যে, বিসর্জিত হয় দেবীশরীর, যেখানে জলের মৃত্যু নেই কখনো, শুধু তারল্যের মৃত্যু আছে সর্বদা, সেখানে নাভি নিয়ে জিপে করে সরাসরি চলে যাওয়ার প্রস্তাব শেষে সিদ্ধান্তে পরিণত হয় । চোখের সামনে দিয়ে জিপ চলে গেলে ধীরেন্দ্র আবিষ্কার করে সবাই চলে গেছে, কেবল প্রতিমা দাঁড়িয়ে । এতক্ষণ প্রতিমা ছিল সামাজিকতার কেন্দ্রে । বিলীয়মান জিপের দৌলতে সে এসে পড়েছে ব্যক্তির কেন্দ্রে এবার । ধীরেন্দ্রর মনে হলো, প্রতিমাকে এত অচেনা লাগেনি কখনো । - কী গো, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে ? বাড়ি ফিরতে হবে না ? প্রতিমার কথাও যেন দূরের শব্দ মনে হতে থাকে । ঘর যত বিমূর্ত হয় তত তার সঙ্গে পাল্লা দেয় ঘরনির বিমূর্ততা । তার পক্ষে এখনই সম্ভব নয় প্রতিমাকে পাশে রেখে কোনো লক্ষ্যের দিকে হেঁটে যাওয়া । - তুমি যাও, সারাদিন যা ধকল গেছে তোমার । রেবা বেচারা একা একা বাড়ি পাহারা দিচ্ছে সেই কখন থেকে । আমি একটু পরে যাচ্ছি । - কেন, আমার সঙ্গে ফেরা যায় না ? শ্মশানে তো অনেকক্ষণ কাটালে । পরে-টরে নয়, একসঙ্গে বাড়ি ফিরব । ধীরেন্দ্র জানে দ্বৈততা যতই বিমূর্ত মনে হোক একা থাকার চেষ্টাগুলিও খুব ভিত্তিময় নয়, ভেঙে পড়ে একটু বাধাতেই । নতুন করে হরিধ্বনি ওঠে, নতুন শব দৃশ্যমান হয় এবং নতুন এক সঙ্ঘবদ্ধতা যে পথ দিয়ে জিপ চলে গেছে সেই পথ দিয়ে প্রবেশ করায় শান্ত দীঘিতে ঢিল পড়ে । প্রতিমাকে অনুসরণ করা ছাড়া তার আর কোনো কর্তব্য থাকে না ।

    শ্মশান থেকে ঘরে ফেরার পথ একটা নয় অনেকগুলো । কে কোনটা বেছে নেবে সেটা তার একেবারে নিজস্ব ব্যাপার । আজ প্রতিমারই পথ বেছে নেওয়ার পালা । যে অনুসরণকারী তার এসব কোনো দায় নেই । যে পথ বেছে নেওয়া হবে তাকেও যেতে হবে সেই পথ দিয়ে । ধীরেন্দ্র একা থাকলে যে পথ সাধারণত পরিহার করে সেই পথ প্রতিমা বেছে নেওয়ায় অনেকদিন বাদে সে দেখতে পায় সেই বাড়ি যার একতলার অধিবাসী দোতলায় উঠে এসে দোতলার অধিবাসীকে পথে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল । যিনি দোতলায় তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন তিনি যতটা সুপুরুষ ছিলেন ততটাই ছিলেন নি:সন্তান । তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হলে একতলায় যিনি থাকতেন মাসিক অর্থের বিনিময়ে, তিনি থোক টাকা দিয়ে সদ্যবিধবার কাছ থেকে কিনে নেন বাড়িটা । সদ্যবিধবা চলে যান দূরপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে তাঁর বোনপোর কাছে । দোতলার এক কোণে স্বল্প ভাড়ায় এক চিলতে ঘরে দিন কাটাতেন অকৃতদার এক বৃদ্ধ যাঁর কেউ ছিল না কোথাও । সন্ধেবেলায় তাঁর ঘরে যারা খাতা-পেনসিল নিয়ে আসত তাদের তিনি বিনামূল্যে শেখাতেন কী করে নাম সই করতে হয় । বয়স্কদের সাফল্যের হাসি তাঁকে কী যে প্রাণবন্ত করে রাখত । নীচে থেকে যে বাড়িটা কিনেছে সে নীচে আর কোনো সংসারের পাট রাখতে চাইল না । নীচে থাকবে আইনের মোটা মোটা বাঁধানো বই, আর সেই বৈঠকখানা, যেখানে আদালতে যাওয়ার আগে এবং সেখান থেকে ফেরার পরে সে এসে বসবে তার মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করতে । বাড়িটাকে নিষ্কন্টক করে সাজানো-গোছানো শুরু করে দিতে হবে, এক চিলতে ঘরও অবহেলা করা চলবে না, এই আদর্শ থেকে সে এমনভাবে আইনের জোর প্রয়োগ করে যে, বৃদ্ধের পথে নেমে আসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না । কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন ? - এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি পথে দাঁড়িয়েই ধীরেন্দ্রকে যা বলেন তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে অজানার স্বাক্ষর । তিনি যাঁদের নিষ্ঠাভরে সাক্ষর করেছেন শুধু তারা নয়, ধীরেন্দ্রও সেই স্বাক্ষরের পরিমাপ করতে গিয়ে কোনো তল পায়নি । দোতলার কোণের এক চিলতে ঘর থেকে নেমে এসে এই চরজগতের মধ্যে তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কী যে পূর্নতা পায় সেই দ্বিতলভবন । আর প্রৌঢ়ত্ব বলে কিছু থাকে না, চারিদিক ভরে ওঠে সাবানের রূপ ও গন্ধে । কত গাড়ি এসে থামে কত মামলার মর্ম নিয়ে কথা হয়, কত জয়লাভ সূচিত হয় আপনমনে । যে একতলা থেকে উঠে যেতে পেরেছে দোতলায় তার উচ্চশিক্ষার্থী কন্যার মধ্যেও স্তনচেতনা বাড়ে, রূপ সম্প্রসারিত হয় এবং তার হাসিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে হাসিখুশির ছেলেমেয়েরা । এই ধারাটাও স্বল্পায়ু ছিল । পথ দিয়ে যেতে যেতে একদিন ধীরেন্দ্র দেখে, একতলার যে আলো পথে এসে পড়ত তার তিরোভাব ঘটেছে । জানলাদরজা রুদ্ধ ষোলোআনা । দোতলায় আলো আছে । কিন্তু মানুষ আছে কিনা বোঝা যায় না । সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আইনের সেই মানুষটি প্রায় বেআইনিভাবে নিখোঁজ হয়েছে চরজগৎ থেকে মরজগতে । মক্কেলদের পরামর্শ দিতে দিতে এক বসন্তসন্ধ্যায় তার হৃদ্যন্ত্র থেমে যায় চিরতরে । আজ সেই বাড়ির সামনে এসে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া প্রতিমাকে পা চালিয়ে ধরে ফেলতে চায় ধীরেন্দ্র । তার মনে হয় কোথাও কখনো পাশাপাশি হাঁটার প্রয়োজন আছে । ঘরে ফেরার আগে একজনের পায়ের সঙ্গে আর একজনের পা মিলুক । কোনো আইনের জোরে নয়, অতি গোপন এক আর্তির জোরে ।

    সব শেষ ? দরজায় হাত রেখে যে নারী এই প্রশ্ন করে তার চোখ ইতোমধ্যে কেমন করে যেন মাত্রাবতী হয়ে উঠেছে । - হ্যাঁ, সব শেষ । সব শেষ হতে কতক্ষণ আর লাগে বল্‌ ? প্রতিমা অন্যরকম গলায় কথা বলেও আবার ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে । কী রে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছিস, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিবি না ? - দেব । তবে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবে না । পেছন দিয়ে ঘুরে আসতে হবে । ধীরুদা, দিদিকে নিয়ে পেছনের দরজায় চলে যাও । আমি খুলে দিচ্ছি । বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকাটা সবসময় যে এক কায়দায় চলে না, মাথা উঁচু করে নয় নিচু করে ঘরে ঢোকারও যে একটা ঘরানা আছে তা প্রতিমা কিংবা ধীরেন্দ্র মনে ছিল না কারোরই । তারা দুজনেই বুঝতে পারল একটু আগে পা মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে করতে তারা আসলে হারিয়ে ফেলেছিল মুদ্রা । যে ভাবেই হোক একটা পরাজয় তো ঘটেই গেছে - মৃত্যুর কাছে সেই জীবনের পরাজয় । সেখানে মাথা নত করে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোনো নাটকীয়তা নেই, কোনো সংস্কারের দাসত্ব নেই । আছে সেই অনুভব যার দৌলতে পার্থিবতাও শেষে সেই অপার্থিবতার অনুগামী হয় । পেছনের দরজা খুলে দিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে রেবা যেন তাদের বরণ করে নিতে চায় জীবনের মধ্যে । - এক এক করে স্নান করে নাও । দিদি, তোর তো সময় লাগে । আগে ধীরুদাকে ছেড়ে দে । ধীরুদার হলে ঘরে ঢোকার আগে লোহা ছুঁতে হবে, আগুন ছুঁতে হবে, মুখে কাটতে হবে তেতো, খেতে হবে মিষ্টি । সব আমি যোগাড় করে রেখেছি । শুধু মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলেই হয়ে যাবে আপাতত । যাও ধীরুদা, আর দেরি করো না, স্নান করে নাও । ধীরেন্দ্র তার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিল গায়ে জল ঢালার আগে । কারণ তার ইচ্ছে করছিল বাড়ির উঠোনে বসে একবার সেই আকাশ দেখে নিতে যা নক্ষত্রখচিত হয়ে উঠেছে বলে তার কথা জমেছে । প্রেমাংশুবাবু এই উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে কতদিন যে হাওয়ায় ধুয়ে নিতে চেয়েছেন দেহ । ভুলে গেলে চলবে না একদিন এই বাড়িতে তাঁর বসবাস ছিল । কত প্রহর এখানে কেটে গেছে তাঁর অবিবাহিত হয়ে এবং বিবাহিত হয়েও । তিনি ধীরেন্দ্রকে এই বাড়িতে বসেই তার বাল্যকালে অঙ্কের মজা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । এই বাড়িতে বসেই তাঁর অগ্রজের কাছে তাঁর স্বীকারোক্তি ছিল - অঙ্কের মজার সঙ্গে জীবনের মজাকে মেলাতে পারিনি । তাই তো তিনি একসময় জীবন থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন । আত্মহত্যা ব্যর্থ হয়, কিন্তু ঘটে যায় আঙুলহত্যা । রেবার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে সে দুপায়ের পাঁচটি করে আঙুলের কথা ভাবতে চায় । যখন একটিও আঙুল ঝরেনি পা থেকে, তখন এই বাড়িতেই রাতের খাওয়া সেরে বৌদির হাত থেকে পানের খিলি মুখে নিয়ে দেবর প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে পেরেছেন নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে একা একা । সে দৃশ্য যার মনে আছে তার বাবা ভাইকে ডাকতে গিয়ে তাঁর নাম ছোট করে এনেছেন । কিন্তু বেড়ে গেছে অর্থ । প্রেমাংশু থেকে প্রেমে আসতে পারলে অক্ষরসংখ্যা কমে আসে, কিন্তু বেড়ে যায় ভালোবাসার সেই অজানা স্বাক্ষর । স্থানকালপাত্র ভুলে কিংবা ষোলো আনা মনে রেখে উঠোনে বসে গুনগুন করে ওঠে সে । তার গলায় যে তেমন সুর নেই তাতে যেন আরো বেড়ে যায় সেই মৃন্ময়তা । আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ # সুরের বাঁধনে -/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি # অজানা সাধনে ॥ যেটা গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যায় তা শেষে আরো একটু ওপরে উঠে প্রকাশ হয়ে পড়ায় রেবা এবং প্রতিমা দুজনেই উঠোনে নেমে প্রকাশিত হয় দুই কোণে দাঁড়িয়ে । এই অজানা সাধনের মাধ্যমে তারও যেন এই বিশ্বভুবনের কাছ থেকে একটা প্রাপ্তিযোগ আছে । যত টের পায় ততই সে বুঝতে পারে যাকে সাধনা বলা হয় তা তার কণাপরিমাণ না থাকলেও তার আছে অজানা সাধন । এই সাধনের জোরে তার বাবা এবং তার কাকা ধ্বনির বলয়ের মধ্যে অত্যন্ত কাছে বসে পড়েছেন । এমনকী জীবন মৃত্যুর অষ্টম গর্ভের সন্তান হয়ে উঠেছে । দুই বোন দুই কোণে দাঁড়িয়ে পড়লেও এমনকী তারাও হয়ে উঠতে পারছে সতীর্থ । রেবা হাসে । - সুর ভুল করেছ, তবু শুনতে খারাপ লাগছে না । প্রতিমা হাসে । - ঠিক বলেছিস । অজানা সাধনে, এই জায়গাটায় এসে গোলমাল হয়ে গেছে । - একটু দেখিয়ে দে না দিদি । - তুই দেখিয়ে দে । কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ! কতক্ষণ শ্মশানে কেটেছে বল তো ? আমরা দুজনেই তো এ গানটা একসঙ্গে শিখি । তোর মনে নেই ? - কেন থাকবে না । বড়দিদিমনি কবিপক্ষে শিখিয়েছিলেন । কী ডাকাবুকো মহিলা ছিলেন, তাই না ? অথচ ছাদের ঘরে আমাদের বসিয়ে যখন শেখাতে আরম্ভ করলেন তখন তাঁর অন্য রূপ । আমি তো তখন আঁকা শিখিনি । পরে যখন শিখলাম তখন তিনি চোখ বুজেছেন । থাকলে বসিয়ে তাঁর ছবি আঁকতাম । -যাওয়ার বয়স হয়নি, অথচ চলে গেলেন । কত অল্প বয়সে চলে গেছেন ভাব তো ? সে কি আজকের কথা ? আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আমি আর থাকতে পারছি না । গায়ে জল ঢেলে আসি । আমি বেশি সময় নেব না । ততক্ষণ বরং তুই ওকে একটু ভুলটা ধরিয়ে দে । প্রতিমা চলে যায় জলের কাছে । কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে রেবা । যে ধীরেন্দ্র কোনোদিন কোনো ছবি আঁকেনি তারও এই বিশ্বাস হয় যে, তার অজান্তেই এমন কোনো শক্তি সম্ভব হতে পারে যার দৌলতে শেষে এঁকে ফেলা যায় সেই রেবাকে যে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রির কাছে সরাসরি । - ধীরুদা, এখন আর কোনো গান নয় । তুমি বিশ্রাম করো । আমি হাতের কাজ সেরে নিই ।

    রেবা ভেতরে চলে গেলে ভেতরে যাওয়ার জোর বাড়ে । কিংবা ভেতরে যাওয়ার শেষ বাধাটুকুও অপসারিত হয় । এই বাড়িতে শ্মশান থেকে ফিরে আসার ঘটনা এই প্রথম নয় । কতবার কত সময়ে যে শ্মশান থেকে ফিরতে হয়েছে কে রাখে তার হিসেব ? কিন্তু কখনো শ্মশান থেকে ফিরে উঠোনে বসে থাকেনি ধীরেন্দ্র এভাবে । এদিক থেকে বেশ একটা নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছে । কত মানুষ তো কতদিক থেকে নতুনত্বের সূচনা করার কথা ভেবে চলেছে । দু বছর আগেও তো ধীরেন্দ্র তেমন এক উদ্যোগের সাক্ষী হতে পেরেছিল । এই বাড়ি থেকে হাঁটাপথে চলে যাওয়া যায় এমন কারাগারের সংখ্যা একাধিক । বাইরে থেকে কতবার দেখেছে উচ্চ প্রাচীর । মূল দরজার ভেতরদিকে যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা সশস্ত্র । যারা ভেতরে বসবাস করছে তাদের সঙ্গে যারা বাইরে থেকে আসে দেখা করতে, মূল দরজার বাইরে দেখেছে তাদের ম্লান উপস্থিতি । যেমন ম্লান তেমন যেন অবাঙ্ছিতও খানিকটা । যারা প্রহরী তাদের দাপটের সামনে যারা প্রার্থী তাদের অপেক্ষার দাপট নেই । যেন তারা দাঁড়িয়ে থাকার জন্যই এসেছে । খবরের কাগজে পড়েছে জেল ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার আকর্ষক সব বিবরণ । কারাগারের কাছেই আদালত । কেবল গাড়িতে চাপিয়ে নয়, কারাগার থেকে আসামিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে এ দৃশ্যের সঙ্গেও তার পরিচয় আছে খানিকটা । যত উগ্র আসামি তত বেশি পাহারা । কখনো মনে হয়েছে, যাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার শরীর দেখে, সত্যিই শৃঙ্খল ছাড়া আর হারাবার কিছুই নেই । ধীরেন্দ্র জানে একসময় এই দেশের বেশ কিছু কারাগারের মধ্যে নিরস্ত্র আসামিদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে । আইনের ভাষায় মুড়িমিছরির মতো যাদের বলা হয়েছে আসামি, তাদের অনেকেই ছিল প্রতিবাদী আদতে । বাইরে প্রতিবাদ করে যারা কারাগারের ভেতরে গেছে, ভেতরেও প্রতিবাদ করায় তাদের অনেককেই যেতে হয়েছে জীবনের বাইরে । অনেক বছর আগে এক সকালবেলায় যৌবনের শুরুতে দাঁড়ানো ধীরেন্দ্র চা খেতে খেতে দেখতে থাকে কাগজ । বহু দূরের কারাগারের ভেতরে যারা নিরস্ত্র তাদের ওপর যারা সশস্ত্র তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কতজনকে আহত করেছে আর কতজনকে শেষ করে দিয়েছে একেবারে তার তালিকা দেখতে পেয়ে সে নীরব হয় । লাঠির ঘায়ে যারা একেবারে থেঁতলে গেছে তাদের মধ্যে সে খুঁজে পায় অনুপের নাম । সেই অনুপ যে তারই সঙ্গে স্নাতক হয়ে আর স্নাতকোত্তর হতে চায়নি । এত গাছপালা, এত নদীনালা, এত খেতখামার সত্ত্বেও যাদের ঘর নেই, জল নেই স্নানের, যারা খেতে পায় না কিন্তু খিদে আছে ষোলোআনা, তাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল সে । মানুষকে আর বইতে নয়, পেতে চেয়েছিল মানুষেরই মধ্যে । যখন বড়ো সংসারের কথা তেমন করে সামনে আসেনি তখন ছোট সংসারের যে কোনো ঘরে বসে তারা কবিতা নিয়ে আলোচনা করত । মনে পড়ে শেষে কবিতাপ্রকাশ নিয়েও আলোচনা হয়েছে তাদের । একবার যুবকদের মতামত শোনার জন্য আকাশবাণীতে অনুপকে ডেকে পাঠায় । আর পাঁচজনের সঙ্গে তার ভালোবাসার দিকগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে সে যখন কবিতার কথা তোলে তখন খুব স্বত:স্ফূর্তভাবে উচ্চারণও করে ধীরেন্দ্রর কবিতার দুটি ছত্র । ছোট সংসারের ছোট ঘরে বসে শিহরিত হয়েছিল ধীরেন্দ্র । তার সামান্য প্রয়াস, তার গোপন আবেগ কেউ গলায় তুলে নিয়ে বহু মানুষের কানে এ ভাবে পৌঁছে দিলে জাগবেই শিহরণ ! পরে দেখা হলে গাছের তলায় বসে অনুপকে সে বলেছিল - তুমি এ কী করলে ! এত কবি থাকতে শেষে আমার মতো মানুষের কথা ? অনুপ তার হাত ধরেছিল । - আমি আমার অনুভবের কথা বলেছি । তার মধ্যে কিন্তু কোনো ফাঁকি নেই । সত্যি বলছি, তোমার বন্ধুত্বকে মনে রাখিনি, তোমার লেখাটাকেই মনে রেখেছি । একবার তারা শিক্ষাজগতের গাছগাছালির মাঝখানে পঁচিশে বৈশাখের কবিকে স্মরণ করেছিল । সবাই যখন যাঁর জন্মদিন তাঁরই কবিতা পড়ে যাচ্ছে তখন অনুপ ডাক এলে তার নিজের কবিতা পড়ে । সেই কবিতা যতদূর মনে পড়ে শ্রদ্ধার নামে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম না হয়ে প্রনতিমান প্রশ্ন হয়েছিল, কতদূর কবিতা হয়েছিল সে বিচারে না গিয়েও বলা যায় । অর্থনীতির অর্চনা গেয়েছিল - আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ # সুরের বাঁধনে -/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি # অজানা সাধনে । কে জানে `অজানা সাধনে' -তে এসে তার সুর কেটে গিয়েছিল কিনা । কিন্তু কানে এখনো বাজে সেই আপত্তির সুর । গান শুরু হওয়ার আগে বাংলার তপন ঘোষনা করেছিল - এখন রবীন্দ্রনাথের একটা প্রেমের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন অর্থনীতি বিভাগের অর্চনা সেন । তখন কিছু বলেনি অনুপ । গান শেষ হলে সে ঘাসের মধ্যে বসেই আমনের দিকে তাকিয়ে সরাসরি তপনের কাছে জানতে চায় - এটাকে কি প্রেমের গান বলতেই হবে ? এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে ? তপন মুখ মুছতে মুছতে খুব সপ্রতিভভাবে জবাব দিয়েছিল মঞ্চ থেকে - একবার কষ্ট করে গীতবিতানটা একটু দেখে নিয়ো । তখন তার ভারী গলার অনবদমিত প্রত্যুত্তর কে আর ভুলে যেতে পারে । - এই যে দাদাভাই, আমার গীতবিতান দেখা আছে । কতদিন আর গীতবিতানের গল্প শোনাবে ? এবার একটু মঞ্চ থেকে নেমে এসে নিজের গল্প শোনাও । একটু কষ্ট করে তোতাকাহিনীটা পড়ে নিয়ো, কেমন ? তপন কোনো উত্তর না দিয়ে পরবর্তী ঘোষণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । কারো কারো মতে লাঠির ঘায়ে অনুপের চোখ বেরিয়ে এসেছিল । কারো কারো মতে সেই দেহ এই মহানগরীতে নিয়ে এসে দাহ করা হয় । এতদিন ধরে সেটাই জানত ধীরেন্দ্র । কিছুদিন আগে এক ছোট পত্রিকার সম্পাদক বড়ো প্রশ্ন তোলেন তাকে ফোন করে রাত্তিরে । - আপনি বডি এখানে নিয়ে আসার ব্যাপারে যা শুনেছেন তা কি সত্যি ? ধীরেন্দ্র তাঁকে জানায় সে প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারেনি বলে শ্রোতা হয়েছে বাধ্য হয়ে । যাঁরা শুনিয়েছেন তাঁরাও শুনেছেন বিভিন্ন সূত্রে । সেই সূত্রগুলি কতটা নির্ভরযোগ্য তা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয় । বরং সে পালটা প্রশ্ন করেছিল - এত বছর বাদে এমন কথা উঠছে কেন ? - এমন কথা তো উঠবেই । কারণ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার তাগিদে খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এখানে বডি আদৌ এসেছিল কিনা সে ব্যাপারে একেবারে নি:সংশয় হওয়া যাচ্ছে না । জানেন অনুপদের যখন মেরে ফেলা হয় তখ ওই জেলের যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাঁর সন্ধান আমরা পেয়েছি । শুনেছি তিনি ছেলে হিসেবে অনুপকে খুব পছন্দ করতেন । ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে । অনেকদিন আগেই অবসর নিয়েছেন । চেষ্টা করে যাচ্ছি একবার তাঁর মুখোমুখি হতে । এত বছর বাদে মানবিকতার দিক থেকে নয়, সত্যের খাতিরে তিনি যদি কিছু প্রকাশ করেন এই আশায় । সম্পাদকমশাই এতদিনে তাঁর খোঁজ পেয়ে তাঁর মুখোমুখি হতে পেরেছেন কিনা, যদি পেরে থাকেন তবে তাঁর মুখ থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তা নিয়ে নতুন করে মুখর হয়ে উঠতে পারা গেছে কতখানি, এসব ব্যাপারে এই মুহূর্তে সে জানে না কিছু । সে বোধহয় জানতেও চায় না তেমন করে । কারণ সে জানে, শেষপর্যন্ত যাকে অর্পণ করা হয় আগুনের মধ্যে তাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জেলাশহরের আগুন যতটা নিষ্ঠাবান ঠিক ততটাই নিষ্ঠাবান এই মহানগরীর আগুন । দু বছর আগে, যে মহাপুরুষের জন্মদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, বাড়ির কাছের কারাগারের কক্ষে তাঁর বিজনবাস কেমন ছিল তা দেখার একটা সুযোগ এসে হাজির হয় হঠাৎ । ধীরেন্দ্র অনেক দ্বিধায় দুলতে দুলতে সেই সুযোগ গ্রহণ করে । স্বাধীনতাদিবস উপলক্ষে সেদিন সবকিছু বন্ধ । যারা সেই কারাকক্ষ দেখার অনুমতি পেয়েছে তারা লাইন করে দাঁড়িয়েছে সেই কারাগারের বাইরে । লাইন বেশ লম্বা । অনুমতিপত্র দেখে কিছু কিছু করে লোক ছাড়া হচ্ছে । যাদের ছাড়া হচ্ছে তারা বন্ধনের মধ্যে ঢুকতে পারছে নির্বিবাদে । তারা দেখেশুনে ফিরে না আসা পর্যন্ত লাইন সচল হতে পারছে না । এই অচলায়তনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র ভেবেছে অনুপের কথা । এক সময় বুঝতে পারল কারাগারের সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা রাখতে পেরেছে অবশেষে । যারা কারাগারে থাকতে আসে না, দেখতে আসে, তাদের কি প্রথম দেখায় মনে হয় সংরক্ষিত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করলাম ? কিংবা ঘাসে পা পড়েছে ? সকলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ধীরেন্দ্র সেই কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায় যা এখন জাতীয় স্তরে শ্রদ্ধা ও স্মরণের ভূখণ্ড হয়েছে । একবার সাহস করে সেই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে বুঝতে পারে আদি রূপের সংশোধন সত্ত্বেও সেখানে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়ালে কেমন একটা পাগল পাগল অবস্থা হয় । অথচ এই কক্ষে যিনি একেবারে একা হয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ছিলেন, তিনি ছিলেন চৈতন্যঘন স্থিরতার পরাকাষ্ঠা হয়ে নিশ্চিত । উপনিষদের সত্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি এই ঘরে বসেই । যাঁদের সেই অনুভবের শক্তি নেই, যাঁরা বাস্তবের বাইরের রূপ ছাড়া আর কোনো রূপকেই চিনতে পারেন না, তাঁরা যখন কারাবাস শেষ করে বেরিয়ে এসে সেই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে উপলব্ধির কথাটাকে আমল দিতে চান না, বরং তা নিয়ে ব্যঙ্গও করেন প্রাণ খুলে, তখন কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, কেবল বেড়ে যেতে থাকে হইচই আর অনধিকারচর্চার রাজ্যপাট, সেই কারাকক্ষের ভেতরে ঢুকে তা বেশ বুঝতে পেরেছিল ধীরেন্দ্র । যে কক্ষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে সারিবদ্ধ হয়ে দেখতে গিয়েছিল, তা দেখা হয়ে গেলেই বাইরে না বেরিয়ে এসে আরো কিছু দেখে নেওয়ার ইচ্ছে জাগে । তখন সে দেখতে পায় যারা ভেতরে ঢুকছে তাদের দেখার জন্য একটা বড়ো বাড়ির অনেক জানলা খুলে গেছে । যেন হুড়োহুড়ি করে মানুষ জমেছে বাতায়নে । সবাই চাইছে যারা বহির্জগৎ থেকে এক লহমার জন্য এসেছে তাদের এক লহমার জন্য দেখে নিয়ে মুক্তির স্বাদ পেতে । বেশ খানিকটা দূরে কারা যেন ফুটবল খেলছে । কয়েদিদের খেলা দেখার জন্যও ভিড় জমিয়েছে কয়েদিরা । ধীরেন্দ্র টের পেল ভেতরের খেলার শব্দ বাইরের খেলার শব্দের মতোই । একবার ইচ্ছে হয়েছিল একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে নিতে যারা বন্ধনের মধ্যে আছে খেলার সময় তারা কতটা খুলে যেতে পারে । কিন্তু এগোতে গেলে বাধা পায় । এগিয়ে আসে কারারক্ষী । - ওদিকে যাবেন না । শেষে একটা বাগানের দিকে দৃষ্টি পড়ে । দু-চারজন বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা লক্ষ করছে । তারা ওপরের দিকে তাকিয়ে নেই; তারা তাকিয়ে থাকতে চাইছে মাটির দিকে । কী আছে বাগানের মাটিতে ? মানুষ কেন এত সন্নত ? খেলার কোলাহল নয়, নীরবতারই খেলা চলছে । বাগানের দিকে যেতে গেলে কেউ বাধা দেয় না । যেন কারারক্ষীরাও বলতে চায় - একবার দেখে যান জায়গাটা । যারা চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রথমে যেন কিছুই দেখতে পায় না ধীরেন্দ্র । শেষে প্রতিভাত হয় বাগানের বুকে ফুটে ওঠা তাজমহল । কোনো রেখা বা রঙের সাহায্যে নয়, একেবারে উদ্ভিদের মাধ্যমে তারই সবুজ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রেমের স্মৃতিসৌধ । মনে রাখা দরকার যে এই সৌধের কোনো উচ্চতা নেই, এই সৌধ মাথা তুলতে পারেনি । ভূমিতে ছড়িয়ে থেকে সে তার উচ্চতাকেও ছড়িয়ে রেখেছে সারাক্ষণ । যার নিষ্ঠা, সামর্থ্য এবং শৈলীর ফলে এই শিল্পকর্ম প্রাণ পেয়েছে সে কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও বোঝা যাবে না যে, সে নিজেই প্রাণ নিয়েছে কারো । শাস্তি ভোগ করতে করতে যে এত তন্ময় হয়ে কাজ করতে পারে তার এই সৃষ্টির নতুনত্ব শ্মশান থেকে ফিরে খোলা আকাশের তলায় বসে থাকার নতুনত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে । ধীরেন্দ্র জানে, এই পৃথিবীতে এতদিনে একটু একটু করে তার হাতে এসে জমা হয়েছে এত উপকরণ যা দিয়ে একটা তাজমহল বানানোর তন্ময়তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সূচনা করা যায় । প্রতিমার স্নান সূচিত করেছে স্নিগ্ধতা । সে এখন লোহা স্পর্শ করছে । সবচেয়ে পুরোনো দা এনে রেখেছে রেবা । প্রতিমা সেই অস্ত্র স্পর্শ করে লোহা স্পর্শ করার অনুভব পেতে চায় । উচ্ছে দাঁতে কাটে । যে মোমবাতি জ্বলছে তার শিখা থেকে তাপ টেনে নিয়ে মাথায় রাখে । মিছরির টুকরো রেবার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে মুখের মধ্যে ফেলে দেয় । ফলে স্নান করে ঘরে ঢোকার মন তৈরি হয় এবং প্রতিমাকে আর বাইরে থেকে দেখতে পায় না ধীরেন্দ্র । শুধু তার কন্ঠস্বর শুনতে পায় । সেই স্বরে ঝরে পড়ছে বিরক্তি । - কী হলো তোমার ? উঠোনে বসে রাত কাটালেই চলবে ? কিছুই বুঝতে পারি না । প্রতিমার শেষ বাক্যটি খুব উপযুক্ত মনে হয় ধীরেন্দ্রর কাছে । সে নিজেও তো বসে বা হেঁটে বা দাঁড়িয়ে, বই পড়ে বা সই করে এমন কোথাও গিয়ে পৌঁছোতে পারে না যেখানে তার সত্যিই মনে হতে পারে, কিছু অন্তত বোঝা গেছে ।

    শেষে জলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হয় ধীরেন্দ্রকে । অনেকের আছে, কিন্তু রাতে স্নান করার অভ্যেস তার কোনোকালেই নেই । কখনো কখনো অসহ্য গরমে সে গা ধুয়েছে বটে, কিন্তু মাথা ভেজায়নি । অথচ জল নিয়ে সে ভেবেছে অনেক । এমনকী বিশ্বাসও করে জলমহিমায় । সে সাঁতার না জানলেও যারা সন্তরণের আলোর মধ্যে বাস করে তাদের কারো কারো মুখমণ্ডল সে চিনে নিতে পারে ঠিক । অনিরুদ্ধও সাঁতার জানে না । তবে তার সহকর্মীদের কেউ কেউ জানে নিশ্চয় । তারা তার হাত ধরে অবগাহনে সাহায্য করবে । কোনকিছু ভাসিয়ে দেওয়াও অত সহজ নয় কিন্তু । ছুড়ে দেওয়া আর ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেক তফাত । তীরে দাঁড়িয়েও ছুড়ে দেওয়া যায় নাভি । তার জন্য জলে নামার প্রয়োজন হয় না । ভাসিয়ে দিতে গেলে একটুখানি জলে না নামলে, একটুখানি যোগসূত্রবান না হলে ঠিক করে ওঠা যায় না কাজটা । অনিরুদ্ধ নাভি ভাসিয়ে দেবে তো ? এতক্ষণে ভাসিয়েও দিয়েছে হয়তো । নীলিমা তীরে দাঁড়িয়েই তাহলে দেখে নিতে পেরেছে সেই ভেসে যাওয়ার দৃশ্য । এখন তো তার পাশে প্রতিমা নেই । তার চোখের সেই সজলতার ভার বহন করতে তবে কি এগিয়ে আসবে তার আত্মজা ? ধীরেন্দ্র তার জানা এবং অজানা জলধারার কথা ভাবতে ভাবতে মাথায় জল ঢালে । অসময়ে মাথা ভেজানোর ভয় দূর করার জন্য সে বেশি করে জল ঢালতে থাকে তার শিরে । তার শিবরাত্রির কথা মনে পড়ে যায় । শিবের মাথায় জল দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে কত হাত । লক্ষ করে দেখেছে, অনেকে জল ঢালতে গিয়ে যেমন-তেমন করে জল ফেলতে চায় না, জল ঝরানোর মধ্যেও থাকে এমন এমন মুদ্রা যেগুলি দেখতে দেখতে গোপনতার মূল্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগে । তার অত ক্ষমতা নেই । নিজেই নিজের শিরে জল ঢালতে গেলে কোথাও কোথাও যে ক্ষমতার প্রয়োজন হয় তা তার ব্যর্থতা থেকেই সে বুঝতে পেরে যায় বারংবার ।

    যাক, এতক্ষণে তোমার স্নান হলো তাহলে । দাঁড়াও, মোমবাতি জ্বালি । জ্বালিয়ে রেখেছিলাম, এইমাত্র নিভে গেল । জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব নয় । কেমন হাওয়া দিচ্ছে দেখেছ ? এসো, দেরি করো না । আবার হয়তো নিভে যাবে । দা ছুঁয়েছ ? আগে দা ছোঁও । রেবার কথা শুনতে শুনতে দা স্পর্শ করে বলে ওঠে ধীরেন্দ্র - আর কী কী করতে হবে বলো । সব শেষে আগুন ছোঁব । - সবশেষে কেন, এখনই ছোঁও । দেখছো শিখা কাঁপছে । ধীরেন্দ্র দেখে, শুধু কাঁপছে না, বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধও শুরু করেছে আপনমনে । - তুমি কেবল কাঁপাটাই দেখছ, যুদ্ধটা দেখছ না ? রেবা তাকায় ! তার সামনে যে স্নাতক দাঁড়িয়ে তাকে একবার দেখে নেয় আপাদমস্তক । - এক সময় যুদ্ধটাও দেখতাম । এখন শুধু কাঁপাটাই দেখি । ঠিক আছে, এই নাও তেতো, দাঁতে কাটো । এই নাও মিছরির টুকরো । তালমিছরি । কাশি হবে না । হ্যাঁ, হয়েছে তো ? এবার তোমার শেষ কাজটা করে ফেল । একটু আগুন ছোঁও । তাড়াতাড়ি করো, এক্ষুনি নিভে যাবে । ধীরেন্দ্র কিছু করে না । তারিয়ে তারিয়ে মিছরি খায় । সেই অবসরে সেই মোমবাতি আবার নিষ্প্রদীপ হয় । - তোমার এই ছেলেমানুষি দেখার সময় নেই আমার । আমাকে এবার বাড়ি ফিরতে হবে । আমি বরং দিদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । রেবা ওই অবস্থায় ভেতরে চলে গেলে বারান্দায় খুব ধীরে পায়চারি করতে থাকে সে । প্রেমাংশুবাবু এই বারান্দায় কত নিষ্প্রদীপ রাতে পায়চারি করে গেছেন । পায়চারি করার সময় তিনি কারো সঙ্গে কথা বললেও মাত্রাপতন হতো না । একদিকের কথা শুনতে শুনতে আর একদিকে চলে গিয়ে আর একদিক থেকে উত্তর দিতে দিতে ফিরে আসতেন । হাঁটার কাজও হলো, আবার বাদ গেল না কথাও । কিন্তু তাঁর অগ্রজের ক্ষেত্রে ছিল অন্য নিয়ম । ধীরেন্দ্র তার বাবাকে নিয়ম করে হাঁটতে দেখেছে । তিনি যখন হাঁটতেন এই বারান্দার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে তখন কোনো পিছুটান থাকত না । বুক চিতিয়ে কারো সঙ্গে একটিও কথা না বলে তাঁর সেই হেঁটে যাওয়ার মধ্যে ছিল জীবনপ্রেম । - দ্যাখ, শিখে রাখ, হাঁটার সময় কোনোদিকে না তাকিয়ে বুক চিতিয়ে এইভাবে হাঁটবি । হাতদুটোও দোলাতে হবে যতটা সম্ভব । যত হাত দোলাবি তত উপকার হবে । বাবা তাঁর মতো করে বলে চলে গেছেন । শুনেছে কিন্তু মনে রাখেনি । সেদিন ফিচারের মরুভূমি থেকে বেরিয়ে এল একটি লেখা যাতে জলস্পর্শ আছে । সেই লেখায় কিন্তু সুস্থ থাকার উপায় বলতে গিয়ে নিরুপায়ভাবে বলা হয়েছে হাত দোলানোর কথা । হাতের সক্রিয়তার মধ্যে লুকিয়ে আছে হত না হওয়ার চাবিকাঠি । হাত দুলিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেন ধীরেন্দ্র দেখতে পায় পিতাকেই ।

    প্রতিমা অনেক ভেতরে চলে গেছে । অনেক ভেতরেই তো রান্নাঘর । তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না । রেবাও এই মুহূর্তে চোখের সামনে নেই । তবে কি সে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে ? একদিন কি ঘরে না ফিরলেই চলে না ? আজ রাতে সে এখানে থাকলে একটা মাত্রা কীভাবে যেন সংযোজিত হয় । এটা ঠিক কাউকে বুঝিয়ে বলা যায় না । বুঝে নিতে হয় আলাদা করে সবাইকেই । কারো সাড়াশব্দ না পাওয়া গেলেও বারান্দার এক দিক থেকে আর এক দিকে যাওয়ার কাজটা থামিয়ে দিতে পারছে না ধীরেন্দ্র । তার নিজের পক্ষে থামানো অসম্ভব । এই সক্রিয়তার পর্বে রেবাকে নিয়ে প্রতিমা এসে দাঁড়ায় । ফলে তার থেমে যাওয়ার সুযোগ এসে পড়ে । প্রতিমার অভিযোগ, রেবাকে বলা সত্ত্বেও সে রাত্রে থাকতে চাইছে না । - তুমি ওকে একটু বোঝাও তো । আজ রাতটা দিদির এখানে থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় । তুমি বোঝাও । আমি রান্নাঘর থেকে আসছি । ধীরেন্দ্র দেখে রেবার শাড়ি পরা হয়ে গেছে । সেই শাড়ি যার ভেতরের কাজটা সে একদিন স্বহস্তে করেছিল । - দিদিকে একটু খেপাচ্ছি । তবে থাকবই যে এমন কোনো কথা নেই । ও-সব কথা পরে হবে । দাঁড়াও, আগুন জ্বালি । যে মোমবাতি অনেক আগেই নিভে গেছে তাকে আবার জ্বালাতে গিয়ে ভূমির সঙ্গে রেবার এমন এক সখ্য তৈরি হয় যার জোরে ধীরেন্দ্রও বসে পড়ে তার পাশে মেঝেতে । এবার কিন্তু শিখা অনেক স্থির হয়ে এসেছে । - তুমি ভালো করে আগুনের তাপ নাও । তোমাকে দেখিয়ে দিই কী করে তাপ নিতে হয় । রেবা হাত রাখে শিখার বলয়ে এবং সেই হাত মাথা ও মুখমণ্ডলে বুলিয়ে নেয় । ধীরেন্দ্র হাসে । - আর একটিবার দেখাও । তোমার মুদ্রা ঠিক ধরতে পারলাম না । সত্যি বলছি, আর একটিবার । আবার হাত এমনভাবে নামিয়ে আনে রেবা যেন সে শিখার মাথায় হাত রাখতে চাইছে । সেই হাত তার নিজের কাছে উঠে যাওয়ার আগে খপ করে ধরে ফেলে ধীরেন্দ্র । - এই তাপটুকু আমাকে দিতে হবে । কত আর নিজেকে তাপিত করবে ? রেবার হাত সে তার কপালে, মাথায় এবং মুখে বুলিয়ে নিয়ে ফিরিয়ে দেয় রেবাকে । - ব্যস, এবার আমি ঘরে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেছি । চলো ঘরে ফিরবে । তোমার এখন আর কিছুতেই যাওয়া চলবে না । - আমি তো থাকব না বলিনি । তবে শর্ত আছে । কখনো মনে হচ্ছে একটা, কখনো দুটো । প্রথম শর্ত হলো, বাড়িতে ফোন করে মাকে জানানো চলবে না । যেহেতু তোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খুব কাছে তাই গিয়ে জানিয়ে আসাটাই সবচেয়ে ভালো । যদি বলো আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি । আর একটা শর্তও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না । কী, বলব ? একটার ভারেই যদি নুয়ে পড়ো, আর একটার ভারে তবে তো আর চলতেই পারবে না । ভেবে দেখ বলবো কিনা । বলব ? ঠিক আছে বলছি । বহু যুগ আগে তুমি আমাকে কবিতা শুনিয়েছিলে । কবিতা আদৌ আর লেখো কিনা তাও জানি না । তুমি যেমন শোনাওনি তেমন পত্রপত্রিকায় চোখেও পড়েনি কিন্তু । আজ আমাকে তোমার কবিতা শোনাতে হবে । ধীরেন্দ্র চট করে কোনো জবাব দিতে পারে না । এই একটি ক্ষেত্র তার বড়ো বেদনার জায়গা । সে কোনোদিনও কবিতা লেখা ছাড়েনি । গোপনে গোপনে সে লিখে চলেছে সবসময় । কেউ যদি এগিয়ে এসে ফুল না তোলে তবে তো ফুল ঝরে পড়বেই একসময় । তার মানে এই নয় যে, ফুল ফোটেনি । ফুল ঝরে গিয়েও আবার ফুটছে ঠিক সময়ে । শুধু সাজি হাতে ভোরবেলায় চয়ন করার জন্য যার আসার কথা সে আর আসতে চাইছে না । কারণ তার বাড়ির কাছেই যে বসে গেছে ফুলের বাজার । এত কথা রেবাকে বলা যায় না কখনো । রেবা কেন, কাউকেই বলা যাবে না কখনো । বেদনার জায়গা দেখাতে গেলে অভিমানের জায়গাটাই পথ আটকে দেয় । লক্ষ্যে আর পৌঁছোনো হয় না । যে গ্রহণ করবে তার ব্যর্থতার বদলে যে দিতে চায় তার ব্যর্থতাই যেন বড়ো হয়ে ওঠে । ফলে বেদনার জায়গাটা আরো বেড়ে যেতে থাকে নি:শব্দে । যে শব্দ নিয়ে আছে তার পক্ষে খুব সহজ হয় না ব্যাপারটা । রেবাকে কিন্তু সহজভাবেই বলে ফেলে - তুমি শুধু জেনে রাখো, তোমাকে শোনানোর মতো কবিতা আমার ঝুলিতে আছে । রাত বাড়লে, যদি সত্যিই চাও, আমি তোমার কাছে সবকটাই পৌঁছে দেব । তুমি নিতে পারবে তো ? রেবা হাসতে চায় । তার ত্বকের অনুজ্জ্বলতা কেমন করে যেন মিশে থাকে সেই হাসির মধ্যে । - তুমি দিতে চাইলে আমি নিতে পারিনি এমন উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যাবে না । চলো, মাকে বলে আসি । ধীরেন্দ্র ভাবে প্রতিমার সঙ্গে আজ শ্মশান থেকে যে পথ দিয়ে ফিরতে হয়েছে রেবার সঙ্গে এখন আবার সেই পথ দিয়ে না যেতে হয় । কত পথ আছে যাওয়ার । সবসময় যে সংক্ষিপ্ততম পথ বেছে নিতে হবে তার কোনো মানে নেই । সোজা পথও খুব একটা পথিক হতে সাহায্য করে না । বরং কখনো কখনো ঘুরপথই হয়ে উঠতে পারে কাঙ্খিত সেই যাত্রাপথ ।

    স্বস্তির কথা, রেবা যে পথ ধরেছে সেটা একটু অন্যরকমের । এখানে পথ বলতে প্রায় ক্ষেত্রেই বোঝায় দুপাশে ইমারত বা নানা রঙের বাড়ি, গাড়ি যাচ্ছে মাঝখান দিয়ে আর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ । প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই আছে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি, নেমে আসার সুযোগ-সুবিধে, নানা পরিবার বিভিন্ন উচ্চতায়, নানা বিচ্ছিন্নতা বিভিন্ন অবস্থানে । এখানে পথ এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনোরকম যাওয়ার তেমন প্রশ্রয় নেই । কতরকম কোণে কত বারান্দা ঝুলে থাকে । সেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে নীচের পথ দেখে নেওয়ার মতো গৃহস্থের অভাব হয় না কখনো । হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক নীরব দৃষ্টির পাহারার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে । এতে খুব স্বস্তি পায় না ধীরেন্দ্র । যেতে যেতে তারও ইচ্ছে করে মাথা তুলে হঠাৎ ওপরের দিকে তাকালে তার কেমন মাথা ঘুরে যায় । এমন অনেকবারই হয়েছে বলে সে আর দৃষ্টির পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবতে চায় না, বরং পরিমণ্ডলের দৃষ্টি নিয়ে ভাবার অবকাশ খোঁজে । রেবার সঙ্গে সে যে পথে এসে পড়েছে সেই পথের বাঁদিকে মাঠ আর ডানদিকে যত বাড়ি সবই একতলা । কোনো বাড়িরই আলাদাভাবে মাথা তোলার সুযোগ নেই । প্রতিটি বাড়ির ছাদে টালি । একটা কি দুটো ঘরই এক-একটা বাড়ির প্রতিনিধি । বাড়ির এত দুর্বল প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও যারা ঘরে ঘরে বাস করে তাদের সঙ্ঘবদ্ধতা প্রবল । এখানে গলা খুলে ঝগড়া হয়, এমন সব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে যাতে কোনো বসনই আর অচ্যুত থাকতে পারে না । তবু এখানে একটাই কাহিনী বারংবার পঠিত হতে থাকে । সেটা সবার পাশে সকলের থেকে যাওয়ার কাহিনী । সুযোগ পেলেই ধীরেন্দ্র এই পথ গ্রহণ করে । বাঁদিকের মাঠে ডানদিকের ছেলেমেয়েরা খেলা করতে করতে প্রহর কাটায় । পায়ে কদাচিৎ বল থাকে, হাতে ব্যাট থাকে কদাচিৎ । কিন্তু খেলা আটকায় না তাতে । প্রয়োজনে ডিগবাজি খেতে খেতেও তারা ধরে রাখে খেলার প্রাণ । এতদিন ধরে একটা মাঠ বেঁচে থাকতে পারছে এতসব মাঠের মৃত্যুর মাঝখানে, এই ব্যাপারটা ধীরেন্দ্রর কাছে কম বিস্ময়ের নয় । যারা মাঠ ধ্বংস করার অস্ত্র নিয়ে রোজ ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে, তারা কী করে এই মাঠটাকে ছেড়ে রেখেছে কে জানে । শীতকালে সকাল সকাল স্নান সেরে যাদের অনেক বয়স হয়েছে কালক্রমে তারা এই মাঠের রৌদ্র থেকে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নিতে জড়ো হয় তার শিয়রের কাছে এসে । শীতকালে এই মাঠেই বসে থাকত দোলনচাঁপা । সে যখন শান্ত থাকত তখন ডানদিকের কোনো একটা গলির কোনো একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাতসকালে হাজির হতো গত রাতের বাসন মাজার জন্য । চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিতেন ধীরেন্দ্রর মা । মা বেশ গর্ব করে পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলতেন - দোলন বাসন মাজে যেন মুখ দেখা যায় । যখন সে অশান্ত থাকত তখন তার মুখ দেখা যেত না । তাকে তার বাড়ির লোকজন বেঁধেও রাখত এক কোণে । শান্ত থাকার বছরগুলোই সংখ্যায় অনেক বেশি । সংখ্যায় কয়েক হাজার সকাল তাকে সূর্যের একেবারে ছেলেবেলায় মাথা নিচু করে আধার মার্জনার কাজে পেয়ে গেলেও কয়েকবার কয়েকটি দিনের লম্ফঝম্প তাকে হারিয়েছে বিপুলভাবে । তেমনই এক শূন্যতার দিনে কীভাবে যেন ঘরের বাঁধন কেটে সে সাতসকালে বাইরে বেরিয়ে আসে । ধীরেন্দ্র তখন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়ত বাইরের ঘরে । বেলায় তার ঘুম ভাঙাতেন মা । সেদিন কিন্তু দোলনচাঁপাই তার ঘুম ভাঙাল । বাইরের ঘরের বাইরের জানলায় দাঁড়িয়ে সেই অত্যন্ত শান্ত এবং অত্যন্ত লাজুক মেয়েটি একেবারে অন্যরকম গলার জোরে বলে উঠেছিল সেদিন - কেন যামিনী না যেতে জাগালে না দাদাবাবু । তাতে একটু সুর ছিল । কখনো কানে যাওয়া গানের সুর ছিল তিলমাত্র । বাদবাকি পুরোটাই ছিল অস্থিরতা । যেন শাখামৃগ ঘরে ঢুকতে চাইছে জানলা দিয়ে । দোলনচাঁপা পরে বেশ ভালো হয়ে যায় । তার বিয়ের জন্য মা একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনেছিলেন । বিয়ের পরে কয়েকমাস বাদে তার স্বামী ও শ্বশুর তাকে আর বাঁচতে দেয় না । যে পথ দিয়ে যেতে হচ্ছে তার ডানদিকের সব ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এসে তাকে পালা করে বহন করে শ্মশানে নিয়ে যায় । লোকে বলে ধীরেন্দ্রর মার দেওয়া সেই বসন পরিয়েই তাকে সেই চিরবিদায় জানানো হয়েছিল । দোলনচাঁপা ঝরে গেছে ডানদিক থেকে । কিন্তু বাঁদিকের মাঠ ঝরেনি । সেখানে এই মুহূর্তে কোনো খেলা নেই । কিন্তু বসা আছে । বিভিন্ন কেন্দ্রে গোল হয়ে বসে সব গল্প করছে । দোলনচাঁপাকে সে শেষ যে বয়সে দেখেছিল সেই বয়সটা কিন্তু হারিয়ে যায়নি পৃথিবী থেকে আজও ।

    মাকে রাতে বাড়ি না থাকার কথা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পথে নেমে আসা সম্ভব হয় না বাস্তবতার দিক থেকে । সেটা প্রতিমাও বোঝে । তাই রেবা বেরোনোর সময় তাকে সে একটাই কথা বলেছিল - খুব বেশি রাত করিস না । আমার রান্না কিন্তু শেষ হওয়ার মুখে । রেবার মা ও দাদা, এমনকী কাজের ছেলেটাও দূরদর্শনের পর্দার দিকে তাকিয়ে । সেখানে রঙের খেলা চলছে । পোশাকের রঙ, সংলাপের রঙ, নিসর্গের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলা যাবে না বিফল । কারণ একটা ঘরে তিনজনই যে যার আসনে স্থির । ওই স্থিরতার প্রেক্ষাপটেই শ্মশানের কথা ওঠে । কখন দাহ হলো, কখন ফেরা হলো, যিনি গেলেন তাঁর বয়স ঠিক কত হয়েছিল, কবে তাহলে পারত্রিক কাজের দিন পড়ছে, বাড়িতে কয়েকটা দিন নিরামিষ খাওয়া মানে প্রতিমার পক্ষে সেটা কতটা অসুবিধেজনক - এমন সব কথারই জন্ম হলো সেই রঙের পটভূমিতে । দৃশ্য দেখতে দেখতে যেসব কথা বলা উচিত সেসব কথা এক এক্করে সেরে ফেলার দৃশ্য ধীরেন্দ্রকে সেই ঘর থেকে অদৃশ্য হওয়ার প্রেরণা যোগায় । রেবাও বলে ফেলে কোনো এক অচেনা রঙের দৌলতে - চলো, আমার ঘরে যাই ।

    এই ঘরের কোথাও কোনো পরিবর্তন হলে ধীরেন্দ্র ধরতে পারে না এমন কথা বলা যাবে না । এই যে বইগুলো বিপুলভাবে এলোমেলো থাকত, আজ দেখা যাচ্ছে এক কোণে সঙ্ঘবদ্ধ, তা সে ধরে ফেলবেই যতই আসুক না কেন অন্যমনস্কতা । - বইগুলো গুছিয়েছ, এ সব তো আর ভাবাই যায় না আজকাল । একদিন যদি সম্ভব হয় আমাকে একটু বই গোছাতে সাহায্য করো । এমন অনেক বই জমে গেছে যেগুলো আমার আর কোনোদিনও কাজে লাগবে না । ওগুলো যাদের কাজে লাগবে তাদের দিয়ে দেব । বই গোছানোর আগে বই বিলোনোর কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে । কাকে কাকে দিয়ে দেওয়া যায় বলো তো ? - তা আমি কী করে বলব ? আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, আর যাকে হোক আমাকে নয় । আমার রাখার জায়গা প্রচুর । কিন্তু গ্রহণ করার জায়গা প্রায় নেই বললেই হয় । ওই যা গুছিয়ে রেখেছি এই জন্মের পক্ষে তাই যথেষ্ট । আরাম করে বসো । আমি একটু কাজ সেরে নিই । রেবা ঘর ছেড়ে যায় না । ঘরের মধ্যেই ঘুরতে থাকে আপনমনে । তাকে দেখে মনে হয় সে কিছু খুঁজছে । যেখানে বইয়ের বিন্যাস সেখানেও তার হাত পড়ে । এমনকী সে তার বালিশের তলাটাও দেখে নেয় একবার । কিছু একটা বলতে এসেও বলতে পারে না । আবার ফিরে যায় অনুসন্ধানে । শেষে খুঁজে বের করে একটা বই কোনো এক কোণ থেকে । - তোমাকে বলা হয়নি । সেদিন ফুটপাথ থেকে কিনেছ একদরে । এত কম দাম চেয়েছে যে দরাদরি করার ইচ্ছেই হয় না । গোপনে বলে রাখি, বেশি দাম চাইলেও আমি কিন্তু একদরেই কিনতাম । দেখো তো চিনতে পারো কিনা । বইটি হাতে নিয়ে ধীরেন্দ্র প্রচ্ছদ সরাসরি খুঁজে পায় না । কারণ রেবা ইতোমধ্যে তাকে আবৃত করেছে মলাট দিয়ে । মলাট ত্রিবর্ণরঞ্জিত । - এত সুন্দর মলাট, খুলতে গেলে যদি ছিঁড়ে যায় । তার চেয়ে বরং তুমিই খোলো । খুলে আমাকে দেখতে দাও । কত অনায়াসে মূর্তির আবরণ উন্মোচন করে রেবা । এবার ফুটে ওঠে তার শেষ কবিতার বইয়ের মূর্তি । - এ বই তুমি ফুটপাথ থেকে পেলে ! এ বই কেউ কোথাও দেখতে পায় না । কেন যে বেরিয়েছিল কে জানে । যে বের করেছিল তার সঙ্গেও আর দেখা হয়নি কয়েকবছর । দেখা হলে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করতাম, যে বই কোনোদিনও কারো চোখে পড়বে না তা বের করার মানে কী । - যাক আমার তো চোখে পড়েছে । আমি তাতেই খুশি । চুপ করে থাকলে হবে না কিন্তু । এ বই থেকে এখন কবিতা শোনাতে হবে । মনে আছে তো শর্তের কথা ? আমার দ্বিতীয় শর্ত ? ধীরেন্দ্র না করতে পারে না । সে তুলে ধরে সেই শীর্ণ সংকলন যাতে মহাসমুদ্রস্নানের কথা আছে, আছে রাত প্রায় সাড়ে আটটার কথা । আজ রাত প্রায় সাড়ে আটটায়/ আমার উপন্যাসে তোমার মুখ/ প্রবেশ করল । আছে সেই প্রশ্ন - আমাদের উপন্যাসে / তুমি কি এখনও আনো দরিয়াদর্পণ ? এমনকী আছে সেই নাভি । সেই নাভির কথাও শোনাতে হয় পরিষ্কার করে রেবাকে । বলতে হয় - আমার সামনে ভারতবর্ষ/ আমি পিতার নাভি আনতে যাব ।/ আমার পিছনে ভারতবর্ষ/ আমি পিতার নাভি আনতে যাব । শোনাতে শোনাতে, বলতে বলতে কে শুনছে আর কে বলছে সেই ভেদরেখা ক্ষীণতম হয়ে আসে । রাত্রিও আর তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না কোনোমতেই । দুজনে নেমে আসে পথে । কেউ কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে থাকে সেই ঘরের দিকে যেখানে বসে এইসব কবিতা লেখা হয়েছিল ।

    (ক্রমশ :)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)