• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | উপন্যাস
    Share
  • বর্ণবাসী : সুভাষ ঘোষাল

    রেবা বাইরের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । ধীরেন্দ্রকে আর শব্দ বাজিয়ে নিজের উপস্থিতির কথা জানাতে হয় না । কিংবা রেবাকে এসে দাঁড়াতে হয় না সংসারের ভিতর থেকে নির্গত হয়ে হঠাৎ । সে তার সমস্ত পরমাণু নিয়ে জানলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রায় । - তুমি কোথায় ছিলে ? এইমাত্র দিদি ফোন করেছিল । বলল কাকাবাবু এসে গেছেন । তোমাকে এক্ষুনি পাঠিয়ে দিতে । আমি আর দিদিকে বলিনি তুমি অনেক আগেই বেরিয়ে গেছ । কোথায় ছিলে এতক্ষণ ? ধীরেন্দ্র বাইরে থেকেই উত্তর দেয় - কোথায় আবার থাকব ? শ্মশানেই ছিলাম । আর অপেক্ষা করতে না পেরে ভাবলাম একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি । একটু তোমাকে দেখে আসি, তুমি কী করছ । তোমার তো আবার একেবারে একা থাকার অভ্যেস নেই । কী, নেই তো ? - আমার কথা না ভেবে এখন তোমার কাকার কথা ভাবো । কত কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন, তাই না ? ধীরেন্দ্র কোনো উত্তর দেয় না । সে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিমার সহোদরাকে দেখতে চায় । প্রতিমা পৃথিবীর আলো দেখার আগে যে সীমাবদ্ধতার মধ্যে সাঁতার কেটেছিল, যে তমসাকে ব্যবহার করেছিল নদী হিসেবে সেই একই সীমাবদ্ধতা, সেই একই তমসা রেবার কাছেও এসে হাজির হয়েছিল ব্যবহৃত হওয়ার জন্য । প্রতিমা অসিতাভ, কিন্তু রেবাকে যে-কোনো আলোতেই অসিতাই মনে হবে । প্রতিমায় কালোর হালকা টান আছে বলে তাকে নিয়ে তেমন অস্বস্তি হয় না জনপদে । কিন্তু রেবার মধ্যে কালোর চিরপ্রতিষ্ঠা ঘটে গেছে বলে তাকে নিয়ে স্বস্তির অভাব হতে পারে যে-কোনো মোড়ে, যে-কোনো সপ্তাহে, যে-কোনো অবসরে এমনকী । এরই মধ্যে কয়েক বছর আগে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যার দৌলতে রেবা যে কখন কেমন হয়ে উঠবে, কোথায় উঠে গিয়ে কোথায় নেমে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করবে অকস্মাত্‌, তা বুঝে ওঠা অত সহজ ব্যাপার নয় আর । ব্যূহ অভিমন্যুর কাছে তুলে ধরেছিল তার একটা রূপ । বাইরে থেকে তার ভেতরে ঢোকার রূপ সেটা । কিন্তু আর একটা রূপ, ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার রূপ অভিমন্যুর কাছে প্রকাশিত হয়নি । ফলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় । আর কয়েক বছর আগের সেই ডাক্তার বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে না পেয়ে হোমিওপ্যাথির বৈভব সত্ত্বেও পরাজয়বরণ করেছিল শেষে । রেবা ত্বকের সমস্যায় ভুগছিল । ডাক্তার তাদের বাড়িতে প্রথমে ডাক্তারি করতে আসেনি । সে এসেছিল তাদের এক আত্মীয়ের বন্ধু হিসেবে বিকেলবেলায় । অকাজের কথা বলতে বলতে সন্ধে হয়ে যায় । শাঁখ বাজতে থাকে ঘরে ঘরে । আর সেই ধ্বনির মধ্যে ডাক্তারের চোখে পড়ে রেবার ত্বকের অসহযোগিতা কীভাবে তাকে ম্লান করে রেখেছে । সে আর থাকতে না পেরে এগিয়ে আসে । সমস্যার ভেতরে ঢুকে পড়ে । এমনকী রেবাকে বলে পা, দুটো পাই একটু তুলে দেখাতে । সে প্রথমে দ্বিধান্বিত থাকে । বর্ষার জল থেকে শাড়ি বাঁচাতে যে ভঙ্গির আশ্রয় নিতে হয় মূর্ত করে সেই ভঙ্গি অবশেষে । ডাক্তার অবনত হয়েছিল । এমনকী টর্চের আলো ফেলেছিল গোড়ালিতে । শুধু অবনত হয়ে নয় উন্নত হয়েও দেখেছিল ঘাড়, কিংবা গলা । সর্বত্রই সঙ্ঘবদ্ধ হতে চাইছে উপসর্গ । কেবল মুক্ত আছে মুখমণ্ডল । সেই মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল ডাক্তার । - একটা কথা বলি, চিন্তা করবেন না । প্রথমে বাড়াব, তারপর সারাব । খেলাটা দেখুন । রেবা তার জীবনে খুব কম খেলা দেখেনি । ডাক্তারের এই নতুন খেলা দেখার আমন্ত্রণ সে তাই কোনো উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে গ্রহণ করে হাসিমুখেই । খেলা শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগেনি । রেবা ওষুধ খায় । কিংবা বলা যায় ওষুধ খেতে গিয়ে সে যাবতীয় শৈথিল্য বিনাশ করে । ডাক্তার এক দাগ ওষুধ খেতে বলেছিল ভোরবেলায় মুখ ধুয়ে খালি পেটে । সে চিরকাল যেহেতু অনেক রাতে বিছানায় ওঠে, বিছানা থেকে নামতেও তার দেরি হয়ে যায় চিরকাল । ভোরবেলায় তাকে ডেকে দেওয়ারও কেউ নেই । কারণ যাদের নিয়ে সে বাস করে তারা সকলেই ভোরে নিদ্রামগ্ন থাকারই চর্চা করে এসেছে । এই কারণেই তো ভোরের ট্রেনে কোথাও যাওয়ার কথা উঠলে তারা পিছিয়ে এসেছে বারংবার । কেউ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দুম করে টেনে আনতে পারে ঘড়ির প্রসঙ্গ । আরে বাবা, লোকের দরকার কী ? জাগিয়ে দেওয়ার জন্য ঘড়ির কতরকমের আওয়াজ বেরিয়ে গেছে । এমনকী এখন টেলিফোনও তো ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব নিয়ে থাকে ঘরে ঘরে । এখানে একটা কথা প্রথমেই বোধহয় জানিয়ে দেওয়া দরকার । ঘড়ি বা টেলিফোনের সাধ্য নেই রেবাদের ক্ষেত্রে এমন কিছু করার যাকে বলা চলে সাফল্যমণ্ডন । ঘড়ি বা টেলিফোনের মূর্ছনায় তারা জাগে ক্ষণিকের জন্য । কিন্তু সেই জাগরণ ধরে রাখতে পারে না । আবার ঘুমিয়ে পড়ে । যে অসময়ের মূর্ছনাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে তার ত্বক যতই পীড়িত হোক সে পারে না ভোরে উঠে মুখ ধুয়ে এক দাগ ওষুধ খাওয়ার কষ্ট স্বীকার করতে । ফলে রেবাকে প্রতিমার সাহায্য নিতে হয়েছিল শেষপর্যন্ত । প্রতিমার নিজের সংসার থেকে সে যেখানে বড়ো হয়েছে সেই সংসারে মনের আনন্দে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় ইচ্ছে হলে । দূরত্বের এই দারিদ্রের জন্য বিয়ের পর থেকে সে যে-কদিন বাপের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে তা অনায়াসে কর গুনে বলে দেওয়া যায় কিন্তু । এই সুযোগটা নিয়েছিল রেবা তার ত্বকের অসুস্থতার মুহূর্তে । - দিদি, অন্তত আমার দিকে তাকিয়ে আজ রাতটা তুই এখানেই কাটা । তুই চিন্তা করিস না, আমি নিজে গিয়ে ধীরুদাকে বলে আসছি । একদিন আমার কাছে শুলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না রে । রেবারা যতই ভোরে নির্গুণ হয়ে পড়ে থাকুক তার জন্য প্রতিমার সগুণ হওয়া আটকায়নি কোনোদিনও । আগে অথবা পরে যখনই সে শয্যায় যাক ঠিক ভোরেই তার ঘুম ভাঙবে রোজ । আর ঘুম ভেঙে গেলে কারো সাধ্য নেই তাকে আটকে রাখার । সে প্রায় লাফ দিয়ে শয্যা ত্যাগ করবে । ভোরবেলায় আলস্যের সঙ্গে যুদ্ধে বারংবার জয়ী হওয়ার ধারাবাহিকতা সে আজও সসম্মানে বজায় রেখেছে । রেবা তাই প্রতিমাকে তার স্বামীর কাছ থেকে এক রাতের জন্য সরিয়ে এনে ডাক্তারের নির্দেশ মানার পরিবেশ তৈরি করে রাখে । ঘড়ি কিংবা টেলিফোন বাজতে বাজতে থেমে যায় একসময় । কিন্তু প্রতিমা কাজ শেষ না করে থামতে পারেনি । সেদিন রাতে সে রেবার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েনি হঠাৎ । রাতের কোলে দুই বোনের এই দুর্লভ সান্নিধ্য রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন সংলাপের দ্বারা কীর্ণ হতে চেয়েছে । শেষে কে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ বলতে পারবে না জোর দিয়ে । ভোরবেলায় প্রতিমা জেগে উঠে জাগিয়েছে রেবাকে । - ওঠ । উঠে মুখ ধুয়ে আয় । আমি মুখে ওষুধ ঢেলে দিচ্ছি । বড়ো বোনের কথা শুনতে শুনতে ছোটো বোন আবার নিদ্রিত হয়েছে পাশ ফিরে । কিন্তু সেই নিদ্রার মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রতিমার কন্ঠস্বর এবং হস্ত যুগপৎ । - কী, ব্যাপারটা কী ? উঠবি, নাকি আমি সুড়সুড়ি দেব ? সুড়সুড়িও পারেনি তেমন কোনো ফাটলের সৃষ্টি করতে । শেষে প্রতিমা শেষ অস্ত্র হিসেবে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দিয়েছে । আর এতে কাজও হয়েছে তত্ক্ষণাৎ । দুর্মর গ্রীষ্মকাল হলে কী হতো বলা যায় না । কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেটা ছিল শৈত্যবান ঋতু । সেখানে জল ত্বক স্পর্শ করলে বিচলন জাগে । রেবাকেও উঠে বসতে হয়েছিল এবং যেতে হয়েছিল জলসঞ্চয়ের কাছে । মুখ ধুয়ে ফিরে এলে প্রতিমা তার দিকে এগিয়ে যায় । তার পিঠে হাত রাখে । তাকে আদর করে বসায় । হাসতে হাসতে সেই কালো মুখের দিকে তাকিয়ে সেখানে কমনীয়তার আলপনা খুঁজে পেয়ে বলে ওঠে - কীরে, এবার বড়ো করে একটা হাঁ কর । আমি তোর জিবে গুনে গুনে ঠিক নটা দানা ফেলে দিই । রেবা বড়ো করে হাঁ করেছিল ।

    জিব ওষুধ গ্রহণ করার পর রেবার পূর্ণ হয়ে উঠতে কে বলল বেশি সময় লেগেছে ? কয়েকদিন বাদে প্রতিমা দিনের আলোয় ধীরেন্দ্রকে বলল - একবার সময় করে শালিকে গিয়ে দেখে এসো । ওষুধ খেয়ে কী অবস্থা হয়েছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না । ডাক্তারের মতে এটা খুব ভালো ব্যাপার । ওষুধে কাজ হয়েছে । ভেতরের যত ক্লেদ সব বেরিয়ে আসছে । বলছে তো চিন্তার কিছু নেই । মাস দুয়েক বাদে আর একবার ওষুধ খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে । তোমার একবার যাওয়া দরকার । একটাই সান্ত্বনার কথা । মুখটা বেঁচে গেছে । আমার বোন কালো হতে পারে, কিন্তু মুখটা তো সুশ্রী । তোমার কী মনে হয়, মুখটা শেষপর্যন্ত অক্ষত থাকবে তো ? ধীরেন্দ্র প্রতিমার মুখের মধ্যে উত্কন্ঠার ক্ষত দেখতে পায় । - তুমি এত ভাবছ কেন ? ডাক্তার যখন সমস্যার ভেতরে ঢুকে যেতে পেরেছেন সেখান থেকে তিনি যথাসময়ে বেরিয়েও আসতে পারবেন । আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে এবং সেটা করতে হবে সাহসের সঙ্গে । - সব বুঝলাম । তুমি একবার যাও । অবস্থাটা দেখে এসো স্বচক্ষে । ধীরেন্দ্র দিনের আলো থাকতে থাকতে রেবাকে দেখতে যায় সেদিনই । রেবাকে প্রথম চোটে খুঁজে পায় না । যেখানে-যেখানে সে অপেক্ষা করতে ভালোবাসে ঘর থেকে ঘরে সেসব জায়গায় কোথাও তাকে দেখা যায়নি । এমনকী চট করে পাওয়া যায়নি এমন কোনো সংকেত যা দেখে বুঝে নেওয়া যায় একটু আগে এখানেই ছিল সেই মানবী ভেতরের ক্লেদ বাইরে বেরিয়ে এসে যাকে পূর্ণ করে দিয়েছে । সে সাধারণত বই পড়তে পড়তে কোথাও উঠে গেলে বই উঠিয়ে যায় না । বই যতখানি পঠিত হয়েছে ততখানি বিন্যাস নিয়ে পড়ে থাকে টেবিলে, কিংবা খাটে, কিংবা খোলা জানলার নীচে । দেখলেই মনে হয় একটা নীরব প্রত্যাবর্তন সম্ভব যে-কোনো মুহূর্তেই । সে যদি কিছু সেলাই করতে করতে উঠে যায় তবে অসম্পূর্ণ সূক্ষ্ম কর্মকে অভ্যর্থনা করার জন্য এগিয়ে আসে স্বচ্ছতা । সে যদি পাশের বাড়িতে যায় কোনো নিবিষ্টতাকে পাশ কাটিয়ে সেখানেও তার সেই কন্ঠস্বর ভেসে আসে যার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে থাকে ঘরেরই কথা । তেমন কোনো চিহ্ন আবিষ্কার করতে না পেরে ধীরেন্দ্রর একটু অসহায় লাগে নিজেকে । যে ছেলেটি ঘরের জলের কাজ করার জন্য খরার দেশ থেকে এসেছে সে ত্রক্রমে ত্রক্রমে সুস্থ আর হাস্যময় হয়ে উঠেছে । সে তার কৈশোরে দেশগাঁ ছেড়ে এ-বাড়ি এসেছিল । আপাতত যৌবন তাকে দিয়েছে উল্লেখযোগ্য কাঠামো । সে দরজার কাঠামোতে হাত রেখে ধীরেন্দ্রর অসহায়তা পরিমাপ করতে চায় । শেষে বলে - আপনি বসবেন না ? - কার জন্য বসব বলো তো ? তোমার দিদি কই ? দিদির মাকেও তো দেখছি না । - মা তো হাতে একটা থলি নিয়ে এইমাত্র বেরিয়ে গেল । মালা কিনতে গেছে । আমাকে যেতে দিল না । - কেন, মালা কেন ? ছেলেটি একটু হেসে হাত দিয়ে বিশ.ংআলতা আঁকে । - এই এত বড়ো একটা ছবি দাদা নিয়ে এসেছে ! এত বড়ো কালীর ছবি আমি আগে দেখিনি । দাদা তো এনেই খালাস । সেই ছবি টুলের ওপর উঠে দিদি নিজে টাঙিয়েছে । আমি টুল ছাড়িনি, শক্ত করে ধরেছিলাম । ধীরেন্দ্র হেসে প্রশ্ন করে - কেন ? খুব অবাক হয় ছেলেটি । - কেন তা আপনি বুঝতে পারছেন না ? দিদিকে আমি কিছুতেই পড়তে দেব না, তা দিদি যত উঁচুতেই উঠুক না কেন । মা মালা এনে দিলে দিদি রাত্তিরে পরিয়ে দেবে । আর সকালবেলায় মালার ফুলগুলো যখন ফুটে উঠবে হেভি লাগবে দেখতে, তাই না ? কী দাদাবাবু, ঠিক বলিনি ? ধীরেন্দ্র পালটা প্রশ্ন করে । - বিরাট বড়ো ছবি বলছিস, তালে তো জিবটাও খুব ছোটো নয় । কত বড়ো জিবটা ? - আমার মুখের কথায় কী হবে, আপনি নিজের চোখেই দেখবেন আসুন । দেশগাঁয়ে যার তেমন কেউ নেই সে কেমন উত্সাহে ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, কাউকে অনুসরণের উত্সাহ প্রদান করতে পারে নির্বিবাদে, তা ধীরেন্দ্রর মনের কোণে আঁকা হয়ে আছে । ধীরেন্দ্র সেদিন তার হাতছানিতে সাড়া দিয়ে অন্তর্গত হয়ে দেখেছিল রেবার স্বহস্তে টাঙানো ছবি ।

    সত্যি উপায় থাকে না, এক-একটা ছবি বেশ উঁচুতেই টাঙাতে হয় শেষে । প্রতীকের এই দীপ্তি নীচে টাঙানোর জায়গা থাকলে সেখানে যে কিছুতেই খুলত না তা বেশ ভালো করেই বুঝে ওঠা যায় । তারা ছবির ঘরে আসার আগে ঘর জনহীন ছিল । নীরবতাকেও ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি টুক করে জানলা দিয়ে এসে পড়া চড়ুই । জনহীনতার কণিকার সঙ্গে নীরবতার কণিকা মিশে গিয়ে ছবিকে দর্শনীয় করেছে । কাজের ছেলেটাকে তার কাজে ফিরে যেতে বলে ধীরেন্দ্র সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে যাতে সংহত হয়ে আছে দেশ আর কাল । রেবা ছবিটার দিকে রোজ কীভাবে তাকাবে তা একমাত্র রেবাই জানে । কিন্তু সে যেভাবে তাকাতে চায় তার মধ্যে পুঞ্জ পুঞ্জ নীলাঞ্জন আছে । কিংবা বলা যায় কালোই শেষে জন্ম দিয়েছে নীলাঞ্জনের । মহাভারতের ভীষ্মপর্বের কথা ধীরেন্দ্রর স্মরণে এসেছিল । ভীষ্মপর্বে অনেক কিছু আছে । যা জানা, যা জেনেও ভুলে যাওয়া বারংবার সবই । এখানেই পাওয়া যাবে অর্জুনের সেই বিখ্যাত বিষাদ । যে রথে বসে তিনি যুদ্ধ করবেন সেই রথে তিনি যুদ্ধাস্ত্র পরিত্যাগ করে বসে পড়লেন । কারণ অন্তর থেকে যে প্রশ্ন জাগে সেই প্রশ্নবাণে তিনি বিধ্বস্ত । স্বজনহত্যায় সত্যিই কি কোনো সুখ হয় ? এখানেই পাওয়া যাবে সেইসব বাক্য যা অর্জুনের পৌরুষ ফিরিয়ে দেবে, তাঁকে ঠেলে দেবে যুদ্ধের দিকে । যে জন্মেছে তাকে মরতে হবেই এবং যে মরে গেছে তাকে আবার গ্রহণ করতে হবে জন্ম । যে জন্মেছে সে জন্মের আগে ছিল অব্যক্ত এবং যে মারা গেছে সেও অব্যক্ত মরণের পরে । যত জীব সবাই ব্যক্ত কেবলমাত্র এই জীবদ্দশায় । কাজেই খেদ কীসের জন্য ? এই পর্বেই আছে মৃত্যুপথযাত্রী সেই পিতামহের কথা যিনি সূর্যকে দক্ষিণ দিকে দেখে দক্ষিণায়ন বুঝতে পেরেছিলেন । ফলে তাঁকে প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল উত্তরায়ণের জন্য । প্রতীক্ষারত ভীষ্মের প্রয়োজন ছিল উপধান বা বালিশের । কারণ তাঁর মাথা ঝুলে পড়েছিল । অর্জুন গাণ্ডীবের সহায়তায় তিনটি বাণ ছুড়ে তাঁর মাথা তুলে দিলেন । কিন্তু সমস্ত ঘটনাকে পেছনে রেখে এগিয়ে আসতে চায় একটি দৃশ্য । যুধিষ্ঠিরের মাথার ওপর ধরা হয়েছে সেই ছাতা যার বর্ণ শ্বেত এবং যাতে আছে হাতির দাঁতের শলা । মহর্ষিরা তাঁর স্তুতি করেছেন, প্রদক্ষিণ করেছেন তাঁকে । তাঁদের আশীর্বাদ গ্রহণ করে যুদ্ধযাত্রায় চলেছেন যুধিষ্ঠির । কিন্তু অর্জুনকে ওইভাবে যেতে দিতে পারেননি কৃষ্ণ । তাঁর তাঁকে কিছু বলার ছিল এবং সেই বক্তব্যের সারমর্ম হলো, অর্জুনকে শুচি হয়ে যেদিকে যুদ্ধ হচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে শত্রুকে পরাজিত করার জন্য একটা বিশেষ কাজ করতে হবে । পার্থ, তুমি দুর্গাস্তোত্র পাঠ কর । পার্থসারথির কথায় ভীষ্মপর্বে পার্থ শেষে পাঠ করেছিলেন দুর্গাস্তোত্র । রেবা কি বুঝতে পারবে কোনদিকে যুদ্ধ হচ্ছে ? সে রোজ টুলের ওপর উঠে যেদিকে তাকাতে চাইবে, যেদিকে তাকিয়ে শুচি হতে চাইবে সেদিকেও কি দুর্গারই প্রতিনিধিত্ব নেই ? সেই মুহূর্তে ধীরেন্দ্রর কানে ভেসে এসেছিল তার পিতামহের মন্ত্রোচ্চারণ - যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা । বলা যায় এই মন্ত্রোচ্চারণই ধীরেন্দ্রকে চালিত করে সর্বদিকে যাতে তার পক্ষে সত্যিই সম্ভব হয় রেবাকে খুঁজে বের করা । কাজের ছেলেটির কাছ থেকে রেবা কোথায় আছে তা জেনে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল । কিন্তু ওই সুযোগ গ্রহণ না করার মধ্যেই বিরাজ করছিল সেদিন একটা প্রকৃত পর্ব । সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে ঘরে যেতে থাকে । সেই ঘরে যায় যেখানে একটা পালঙ্ক আছে অনেকটা মেঝে গ্রাস করে । ওই পালঙ্কের ওপর এক কালের অত্যন্ত দাপুটে ব্যবসায়ী অত্যন্ত স্থবির হয়ে শেষ কমাস কাটিয়েছিলেন । যে মুখ থেকে বাক্যবাণ নির্গত হতো শেষে সেই মুখ থেকে অন্তর্হিত হয়েছিল বাক্য । শেষ কমাসে বাক্যের বদলে এসেছিল ধ্বনি এবং প্রতিটি ধ্বনিই বিকৃত যথেষ্ট পরিমাণে । শেষ কমাস চোখ কেবল কান্নারই প্রতিনিধিত্ব করেছে । তাঁকে যারা বুঝতে পারত তাঁকে তারা আর বুঝতে চাইত না তেমন করে । ফলে হঠাৎ হাজির হয়ে ধীরেন্দ্রকে ধরতে হয়েছে লৌহবাণিজ্যের সেই হাত যা সাফল্যমণ্ডিত ছিল একসময় । শ্বশুরের সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাত কী অনুবাদ করেছিল তা তেমন করে ধরতে না পারলেও ধীরেন্দ্র সেদিনও শুনতে পেয়েছিল শত পুত্রের অবস্থানে মুহ্যমান ধৃতরাষ্ট্রকে ঘিরে বিদুরের সেই শান্ত স্বর । - যা জমা আছে সবই চলে যাবে খরচের খাতায়, যাকে আজ উন্নতি বলা হচ্ছে তার পরিণাম পতনে, মিলন সে তো বিচ্ছেদেই শেষ হবে এবং জীবনের শেষে আসবে মরণ । অদৃশ্য স্থান থেকে যে মানুষ আসে সে অদৃশ্য স্থানেই মিলিয়ে যায় একদিন । কেউ কারো নয়; তবে দু:খ কীসের ?

    খুঁজতে খুঁজতে সেদিন ধীরেন্দ্র নিজেকে অবারিত করেছিল । যে বাড়িতে মানুষের তুলনায় ঘর বেশি, অনেকটাই বেশি, সে বাড়িতে কাউকে খোঁজার চাপ থাকলে একটা মুক্তিরও যে স্বাদ থেকে যায় চিরকাল ধীরেন্দ্র সেটা টের পেয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব মেলে ধরেছিল । একতলা দোতলা সম্পূর্ণ করে সে তিনতলায় গিয়ে দেখেছিল ঘরে ঘরে তালা ঝুলছে । তাই বলে বারান্দায় কোনো তালা নেই । সেখানে আপনমনে ফুটে উঠতে চাইছে দিনের আলোর এমন এক বার্ধক্য যার সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেনি । বেশ মনে আছে সন্ধানাভ ধীরেন্দ্র একটু থামতে চেয়েছিল বারান্দা স্পর্শ করে । এটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারে যে মানবীকে খুঁজে নিতে হবে নিজের চেষ্টায় তারই স্বার্থে একবার বিজনতম বারান্দায় দাঁড়ানোর দরকার আছে । আর কী আশ্চর্য, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মধ্যে ভূমির প্রতি মায়া জন্মায় । এমন মায়া যা তাকে টানে এবং সে বুঝতেও পারে যে তার আর দাঁড়ানোর উপায় থাকছে না । বসে পড়ে তার মনে হয় সে এতক্ষণে ভূমিষ্ঠ হতে পারল এবং এটাই ছিল তার ভবিতব্য আসলে । সেদিন বসে থাকতে খুব ভালো লাগে বলে ধীরেন্দ্র বসেছিল আর কোথাও না গিয়ে । সে জানত যে তার সামনে এখনো সিঁড়ির গুচ্ছ পড়ে আছে । আর এই সমবায়ই তাকে পৌঁছে দিতে পারে ছাদে । সেই ছাদ যেখানে শ্বশুরমশাই বিশেষ দিনে জাতীয় পতাকা তুলতেন । তবে একবারই সে নিজে সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল । হ্যাঁ, একবারই । কারণ তার বিয়ের পর একবারই কেবল তিনি সেই শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন যার জোরে কারো সাহায্য ছাড়াই একতলা থেকে দোতলায়, দোতলা থেকে তিনতলায় এবং শেষে তিনতলা থেকে ছাদে পৌঁছে নিজের হাতে পতাকা তোলার সাফল্য লাভ করা যায় । একবারই সে আগের দিন রাতে প্রতিমার বাপের বাড়ি এসে পরের দিন প্রভাতে সকলের সঙ্গে উঠে যেতে পেরেছিল ছাদে । সকলের সঙ্গে মানে সকলেরই সঙ্গে । প্রতিমা, রেবা, তাদের দাদা এবং তাদের বাবা ও মা । হ্যাঁ, আর ছিল পিঙ্কু । ধবধবে সাদা, লোম কেবল শুভ্রতারই প্রতিনিধিত্ব করত । রেবার কোলে উঠে বড়ো বড়ো চোখ মেলে সেও দেখত সেই ছোট্ট অনুষ্ঠান । যে সারাদিন মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরত, বাড়িতে জামাই এলে যে ঝাঁপিয়ে তার কোলে উঠে বসত, যে গলা খুলে ডাকত, প্রতিবাদ করত বিড়াল দেখতে পেলেই, তাকে যে চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো কালেভদ্রে, তার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পরেও চেনটাকে অনেকদিন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছিল । সেই ছোট্ট অনুষ্ঠানে হারমোনিয়ামের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল । সেই হারমোনিয়াম যাতে জ্বলজ্বল করে প্রতিমার মায়ের নাম । সেবার একটা টেবিল ধরাধরি করে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাদা কাপড় দিয়ে আবৃত করা হয় সেই টেবিল । সেখানে হারমোনিয়াম রাখা হলে দুই কন্যাকে দুপাশে রেখে এগিয়ে আসেন মা । সুরযন্ত্রে তাঁর আঙুল খেলা করতে শুরু করে এবং তাঁর গলাতেও খেলতে থাকে সুর । আর দিদির সঙ্গে মাকে সাহায্য করে যায় । বাবাকে পতাকা তুলতে সাহায্য করেছিল তাঁর পুত্র । ছাদে পতাকা ওড়ানোর মতো হাওয়া কতটা বিরাজ করেছিল, নীচে নেমে এসে কে কতটা স্বাধীনতা পাবে - এসব প্রশ্ন তুচ্ছ হয়ে যায় তিন মানবীর কোথাও মিলতে পারার আনন্দে । গান হয়ে গেলে, পতাকা তোলা হয়ে গেলে পিঙ্কু আর কোলে থাকতে চায়নি । কিংবা পিঙ্কুকেও খানিকটা পার্থিবতা প্রদান করার জন্য তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল । রেবা তখন ঝাড়া হাত-পা । প্রত্যেকেই দাঁড়ানোর পালা শেষ করে ভূমিতে ছড়িয়ে দিতে থাকে শরীর । প্রত্যেকেই । একজনই ব্যতিক্রম । তিনি প্রতিমার বাবা । দাঁড়ানোর এক ভঙ্গি থেকে আর এক ভঙ্গিতে গিয়ে তিনি আস্তে আস্তে বলতে শুরু করেছিলেন সেইসব কাহিনী যেগুলি তাঁর নিজের চোখে দেখা, যেগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে যারা বাইরে থেকে এসে এত বড়ো একটা দেশ শাসন করত তাদের বাইরেই ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ।

    শ্বশুরমশাই সেদিন আলোর ব্যবহার শিখিয়েছিলেন । যারা আরাম করে বসে আছে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বা না গিয়ে, যাওয়া না-যাওয়ার ভঙ্গি মূর্ত করে ফাঁস করে দিয়েছিলেন আলোর সেই শক্তি যা চূড়ান্ত সব পার্থিবতার মধ্যেও নবরূপে প্রকাশ পাওয়ার পথ খোঁজে । স্ত্রীর খুব কাছে এসেও সরে যাওয়ার ফাঁকেই বলেছিলেন তাঁর যা বলার এবং সেই বক্তব্যের মধ্যেই বোধহয় ছিল পতাকা গড়ে তোলার উপকরণ । যিনি ছাদে দুই মেয়ে এক ছেলে এবং জামাইকে নিয়ে বিশদ হতে পেরেছেন তাঁরও এমন একটা অতীত ছিল যার সঙ্গে এই ঘটমান বর্তমানের অন্ত্যমিল দেওয়ার চেষ্টা যে ব্যর্থ হতে বাধ্য তা বোঝানোর জন্য প্রতিমার বাবা, রেবার বাবা এমন দৃশ্যের জন্ম দিতে চেয়েছেন যেখানে পুরুষের সঙ্গে নারীও সমানতালে সহ্য করতে পেরেছে স্বাধীনতা কামনা করার পরিণতি হিসেবে সেইসব অত্যাচার । - আমি নিজে দেখেছি তোমাদের এই মা লাঠির ঘা খেয়ে পড়ে গেছে, কিন্তু পালায়নি । আবার উঠে গলা মিলিয়েছে সবার সঙ্গে । তোমরা ভালো করে দেখে রাখো তোমাদের সেই মাকে । স্ত্রী একবার চেয়েছিলেন স্বামীর আবেগ সংহত করে দিতে । তাতে কোনো কাজ হয়নি । স্বামীর কন্ঠস্বরে এসেছে কৈশোর আর যৌবনের মোহানায় দাঁড়ানো এক নারীকে স্মরণ করার উদ্যম । রেবা শুনতে শুনতে মায়ের কোলের কাছে চলে যায় এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে চুম্বন করে সশব্দে । সেই আলিঙ্গন এবং চুম্বন যে পতাকা উত্তোলিত হয়েছে তার প্রকাশের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছিল ।

    রেবাকে দেখতে গিয়ে তিনতলার তালাখোলা বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে এক গুচ্ছ সিঁড়ির হাতছানি ত্রক্রমাগতই অমোঘ হয়ে উঠেছিল ধীরেন্দ্রর কাছে । যদিও দিনের আলোয় বার্ধক্য তার নিজস্ব নিয়মেই মানুষকে বারান্দায় বসিয়ে রাখে তবুও সে খুব বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি । যে-সময় প্রত্যাশার শিরগুলো প্রণতিমান হয়ে আসে, যে-সময় মনে হয় মূলত যে কিছুই আর তেমন করে চাইবার নেই, ঠিক সেইসময় একটা আশা আস্তে আস্তে জাগতে শুরু করেছিল তার মধ্যে । নিশ্চয় সময় হয়েছে সেই সোপানগুচ্ছ অবলম্বন করে এমন কারো নেমে আসার যার ত্বকে ফুটে উঠেছে ভিতরের ক্লেদ । কিন্তু কোনো অবতরণ ঘটে না । বরং ইতিমধ্যে সুযোগ পেয়ে নেমে আসতে থাকে সন্ধ্যা । এমনকী উঠে আসতে শুরু করে শঙ্খধ্বনি এক-একটা কোণ থেকে । এভাবে আর বসে থাকা সম্ভব হয় না । যে মরণশীল সে চিরকাল যা করতে চায় ধীরেন্দ্রও সেদিন তাই করেছিল । সে সমুথ্থিত হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল ছাদের দিকে । সে যেখানে বসবাস করে সেটা যুগ যুগ ধরে একতলা বলে, সেখানে আলাদা করে ছাদের কোনো উপস্থিতি নেই বলে তার কাছে ছাদে ওঠার সুযোগ চিরকালই একটা অন্যরকম মাত্রার সূচনা করে । কিংবা বলা যায় সে সেদিন মাত্রাবান হয়ে সোপানগুচ্ছ অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে থাকে ছাদের দিকে ।

    সে ছাদে উঠে প্রথমে দেখেছিল তার আগেই যে উঠে বসে আছে সেই সন্ধ্যাকে । যে পৃথিবীতে অবতরণ করে চিরকাল সে কিন্তু কখনো কখনো আরোহণও করে নি:শব্দে । কখনো কখনো না বলে ক্বচিৎ কখনো বলা ভালো । কোনো কোনো ভাগ্যবান দেখিবারে পায় । ধীরেন্দ্র সেই প্রথম দেখে সন্ধ্যা তার আগেই শুধু এসে হাজির হয়নি, সেইসঙ্গে পরে নিয়েছে একেবারে নিজস্ব এক কাঞ্জিভরম । ফলে কেমন যেন একটা ভাব বিরাজ করছে আকাশের ঠিক নীচে । যেন এক কৈবল্যদশায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ছাদ । ওই অবস্থায় সে প্রথমদিকে কিছুই আলাদা করে বুঝতে পারে না । এমন কিছুই দেখতে পায় না যা আলাদা করে টের পাওয়া যায় । যেখানে পতাকা তোলা হতো সেই বহুদিন ধরে অব্যবহৃত বহুদিন ধরে অনাদৃত এবং ভগ্নপ্রায় সেই স্তরের কাছে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়, যোগ্য করে নেয় পার্থিবতার । একসময় সে টের পায় যেদিকে সন্ধ্যাতারা ওঠে সেইদিকে, ঠিক সেইদিকে প্রতিমার সহোদরা বসে আছে । সে তার দিকে পেছন করে বসে আছে বলে ধীরেন্দ্র তার দৃষ্টিগোচর হবে না স্বাভাবিক নিয়মে । রেবাই বরং দিনাবসানের মধ্য থেকে একটু একটু করে প্রতিভাত হতে থাকবে । যুক্তির এই পরম্পরা মেনে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকতে চায় বলে । আর এই দণ্ডায়মানতার সামর্থ্যেই সে একসময় বলে ওঠে - রেবা --- । অমরকন্টক থেকে নেমে এসে যে নদী সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে তার কত যে পথ কত যে টিকে থাকার সংগ্রাম কত যে স্থূল ও সূক্ষ্মের স্বরলিপি তা তারাই জেনেছেন যাঁরা উত্স থেকে লক্ষ্যের দিকে যাত্রা করেছেন একা কিংবা সমবেত হয়ে । সেইসব জেনে ওঠার কিছু কিছু বিচ্ছুরণ বই থেকে পেতে চেয়েছে ধীরেন্দ্র । বই থেকে কতটুকু আর পাওয়া যায় ? এ-প্রশ্ন যেমন উঠে দাঁড়ায় তেমন কোথাও তুচ্ছ মনে হয় না সেই পালটা জিঞ্জাসা - বই ছাড়া আর কোথায় হয়ে ওঠা যায় এতটা প্রসারী ? বই থেকে সে অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, সেই নর্মদা পর্যটকের কাছে যেমন পরিব্রাজকের কাছে ঠিক তেমন নয় কিন্তু । সে পর্যটক নয়, নয় পরিব্রাজকও । সে কেবল বিশ্বাসী । সে বিশ্বাস করে এমন একটা বিন্দু কোথাও বিরাজমান যেখানে এক সময় দুটোই এসে মিশতে পারে শেষপর্যন্ত । এত বিশ্বাস থেকেই সে বুঝতে পারে নর্মদা মানেই যেমন রেবাকে বোঝায় তেমন নর্মদাই যখন তখন রেবা হয়ে উঠতে পারে না । যখন রেবা জপমন্ত্রে জায়গা করে নেয় তখন সে কেবল জলধারা নয়, সে একটি চৈতন্যপ্রবাহও । প্রতিমার সহোদরাকে ডাকতে গিয়ে সে যে সত্যিই তাকে ডাকল কিনা এই সংশয় তাকে গ্রাস করার আগেই যার মুখ ছিল সামনে সে একবার পেছন ফিরে তাকায় । সেই দৃষ্টিও কিন্তু সংশয়মুক্ত ছিল না । - ধীরুদা, তুমি ? সে উঠে দাঁড়ায় । যে পোশাক তার তনুর মধ্যে কীর্ণ হয়ে ছিল তাকে করে নেওয়া হলো আবৃতির বস্তু । সবকিছু ঢেকে রাখার চেষ্টায় কেউ যদি ব্যস্ত হয়ে পড়ে তবে তার সেই ব্যস্ততার মধ্যে একটা ভয়ের ছায়াও এসে পড়তে চায় । আনমনা রেবা কীভাবে যেন শঙ্কিত হয়ে পড়ে । তুমি কি করে জানলে আমি এই সময় ছাদে আছি ? আমি কি এই সময় ছাদে থাকি কখনো ? তুমি কী করে টের পেলে ধীরুদা ? সে যত প্রশ্ন করে ততই প্রত্নতা থেকে মুক্ত করে নিতে চায় দেহ । ফলে এমনও মনে হতে থাকে যে, সে অনূঢ়.ংআ না হলে এতক্ষণে ঘোমটা দেওয়ার সুযোগ ছাড়ত না কিছুতেই । রেবা যতই নিজের চারিদিকে গণ্ডি টানতে থাকে ততই দেরি হয়, ততই বয়স বাড়ে সন্ধ্যার, ততই ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে না এক্ষেত্রে তার কী করা উচিত । সে কি রেবাকে সময় দেবে, সুযোগ করে দেবে তার মতো করে প্রস্তুত হওয়ার ? নাকি নিজেই এগিয়ে যাবে সত্যের মুখোমুখি হতে ? প্রতিমা তাকে যে সুরে বলেছে তা খুব সহজ সুর নয় । সমস্ত দেহ আক্রান্ত হয়েছে । কেবল মুখমণ্ডল রয়ে গেছে অনাহত । আলোর যে রূপান্তর ঘটে গেছে তাতে কাছে দাঁড়িয়েও কোনোকিছুই আর জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয় । তাহলে আর কাছে গিয়ে লাভ কী ? যেখানে দাঁড়িয়ে শ্বশুরমশাই পতাকা তুলতেন সেখানে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র চাইল তাঁর ছোট কন্যাকে উত্তরদাত্রী করতে । রেবা, তোমার কি নীচে নামতে দেরি আছে ? তুমি যে ছাদে আছো এটা আমি অনুমান করেছিলাম । যে একতলা, দোতলা তিনতলা কোথাও নেই অথচ বাড়িতেই আছে, তাকে ছাদে পাওয়ার আশা করাটা কি খুব অসম্ভব কিছু ? দূর থেকে মনে হয় রেবা হাসে, তবে অনায়াসে নয় । - ঠিক আছে ধীরুদা, তুমি নামো, আমি একটু পরে নামছি । আমার ঘরে গিয়ে বসো । মা বাড়ি নেই ? মার সঙ্গে দেখা হয়নি ? - না, হয়নি । আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি । তুমি নামতে দেরি করো না । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে রেবা সময় চায়, প্রস্তুত হয়ে নিতে চায় আরো ।

    রেবার ঘরে তার খাটটা কিন্তু তার বাবা যে ঘরে থাকতেন, তার মা যে ঘরে থাকেন সেই ঘরের খাটের মতো বড়ো নয় । উচ্চতার দিক থেকেও বেশ কম । তার মানে তার খাট থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেলে তেমন কোনো বিপদের সৃষ্টি হবে না । স্মরণে থাকুক যে, এই খাটেই সে প্রতিমাকে এক রাতের জন্য ধীরেন্দ্রর কাছ থেকে সরিয়ে এনে শয্যাসঙ্গী করেছিল । রেবার ঘরের দেয়ালে তেমন কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না । তবে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে যা পাড়ায় আর কার ঘরের দেয়ালে আছে তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে । কারণ সেটা ক্যালেণ্ডার নয়, মনীষীর ছবি নয়, মৃত মানুষের মুখের মুদ্রণ নয়, এমনকী নয় কোনো দিগ্গজ ঘড়ি । কেউ যদি দেবীমূর্তির কথা ভাবে তাও নয় কিন্তু । তবে সেটা কী ? সেটা একটা প্রতিকৃতি । কাঠকয়লার দু-একটা টানে ফুটে উঠেছে চোখ, কান, নাক, ঠোঁট ও চুলের সেই সমন্বয় যা শেষপর্যন্ত রেবারই প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে । কারো বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, দেয়ালে ঝুলছে রেবাই । যারা জানে না তারা ভাববে যে-মেয়ে আঁকতে শিখেছে এ তারই হাতের কাজ শুধু নয়, এ তার নিজেরও প্রতিকৃতি । কিন্তু যারা জানে তারা প্রতিকৃতিকে কখনোই আত্মপ্রতিকৃতি বলার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করবে না । যে রেবার ভেতরের ক্লেদ নয় ভেতরের সৌন্দর্য বের করে এনেছে তাকে ধীরেন্দ্র ভুলতে পারে না ।

    ধীরেন্দ্র আজকাল যে নাম মনে করতে চায় মনে করতে পারে না সব সময় । কখনো কখনো স্মৃতির সঙ্গে বিস্মৃতির সংগ্রাম চলে । সেই সময়টা খুব উত্তেজনার । যতক্ষণ নামটা না মনে পড়ে ততক্ষণ বেশ অস্থির লাগে । রেবার এই প্রতিকৃতি যে এঁকেছিল তার নামটা কিছুতেই মনে আসছিল না । মুখটা মনে আসছিল । মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় চুল কম । কিন্তু হাসি সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারত যে-কোনো সময় । প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরেন্দ্র এমন কথাও ভেবেছিল, রেবা ছাদ থেকে নেমে এলে সে তার কাছ থেকেই জেনে নেবে শিল্পীর নাম । সেই বিস্মৃতির অসহায়তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনো পথ সে ভেবে পায়নি । তখনই প্রতিকৃতির একেবারে নীচের প্রায় কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা হস্তাক্ষর তাকে জয়ের দিকে ঠেলে দেয় । সে বুঝতে পারে লুপ্ত তীর্থ উদ্ধারের সঙ্গে কতটা স্বস্তি জড়িয়ে থাকে । হ্যাঁ, সেই প্রতিকৃতি এঁকেছিল সাত্যকি । রেবা কি সাত্যকিকে সত্যিই ভুলে গেছে ?

    রেবা কয়েক বছর ধরে আঁকা শেখার জন্য যে প্রতিষ্ঠানে নাম লিখিয়েছিল সাত্যকিও ছিল সেখানকার ঔজ্জ্বল্য । ধীরেন্দ্র যে কতবার রেবাদের ঘরে ঘরে সাত্যকিকে দেখেছে ! সাত্যকি একবার একটানে এঁকেছিল পিঙ্কুকে । পিঙ্কু আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । সে শুধু নয়, তার সারা শরীরের সমস্ত লোমও অর্জন করেছে অন্যমনস্কতা । মূলত দুরন্ত চতুষ্পদের এই মানবিক অবস্থান, রেখার আশ্রয়ে এই উত্তরণ ধীরেন্দ্র বিস্মৃত হতে পারেনি । সে জানে রেবা পিঙ্কুকে মনে রেখেছে তাকে ভোলা সম্ভব নয় বলে । সেই নি:স্বার্থ প্রাণময়তা ভুলে যাবে এমন সাহস কোনো গৃহস্থেরই থাকতে পারে না । কিন্তু রেবা কি মনে রেখেছে সাত্যকির ছবির সেই পিঙ্কুকে যে অন্যমনস্ক হতে পেরে খুবই গোপনে প্রমাণ করেছিল মন ? সাত্যকির কাঁধে থাকত কাপড়ের ব্যাগ । দুজনে কতদিন আঁকা শেখার প্রতিষ্ঠান থেকে একসঙ্গে ঘরে ফিরেছে । সাত্যকি কখনো কারো সঙ্গে ছবি নিয়ে আলোচনা করত না । অন্তত তেমন কোনো কথাবার্তা ধীরেন্দ্রর কানে আসেনি কখনও । তার ব্যাগে যতই ছবির সরঞ্জাম থাক তার মুখ থেকে বেরোত রসিকতাবোধ, হাসি তথা সেই চাঞ্চল্য যা কোনোভাবেই স্থিরতাকে সংহার করতে চায় না । সে যখন নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠত সর্বাগ্রে, তখন সবার সঙ্গে সেই হাসিতে যোগ দিয়েও ধীরেন্দ্র ভাবত, রেবার এই ফিরে আসাগুলোর সঙ্গী হতে পেরে সাত্যকি কি আদতে সেইসব কাজের সঙ্গী হতে চাইছে যেখানে ফুটে উঠতে পেরেছে জলরঙের সামর্থ্য একটু একটু করে অনেকটাই । ধীরেন্দ্র চেয়েছে এমন কোনো মুহূর্ত আসুক যখন কাঁধের ব্যাগ পাশে নামিয়ে রেখে হয়তো সাত্যকি বলে উঠবে প্রকৃতিপ্রেমের কথা, সেইসূত্রে টার্নারের কথাও । সেইসূত্রে ধীরে ধীরে এসে পড়বে বড়ো বড়ো সেতু, সুরক্ষিত সব প্রাসাদ, এমনকী সেই উপাসনালয় যার ভেতরে যাওয়ার ডাক শোনা যায় বৃহৎ আর বৃক্ষাভ সব নিস্তব্ধতা সত্ত্বেও । সে যেমন সেই রূপে সাত্যকিকে পায়নি, সাত্যকিও তেমন তাকে পায়নি রূপবান প্রশ্নের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে । ফলে কেবল রসিকতার জন্ম হয়েছে রসের পরিবর্তে ।

    ধীরেন্দ্র যতদূর জানে তাতে একথাটাই বলা সংগত যে, এই শহরে ছবির টানেই এসে পড়েছিল সে । তার বাবা চা-বাগানে কাজ করতেন বলে তাঁর কোনোদিনও মনে হয়নি শহরে কোনো বাসস্থান নির্মাণের কথা । এই শহর থেকে সেই চা-বাগান শতমাইল দূরে সেইসব হিসেবের মধ্যে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তথা ভূগোলচেতনা ধীরেন্দ্রর ছিল না । সে কেবল ধরতে চাইত সাত্যকি যেখানে ঘর ভাড়া করে থাকত সেখান থেকে কত দূরে ছিল সেই হাসপাতাল যেখানে অম্বিকা থাকত কীভাবে ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্রোপচারে সাহায্য করতে হয় কিংবা হয়ে উঠতে হয় ডাক্তারি নির্দেশের রূপকার সেই শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য । ভাই বোনের মিল ছিল খুব । এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, সাত্যকির বাইরের একাকিত্বের মধ্যে কোনো কোনো বিকেলে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েই অম্বিকা তার দায়িত্ব সারতে চাইত না, সেইসঙ্গে মাসে অন্তত একবার এসে দাদার সঙ্গে সারাদিন সারারাত থেকে উপহার দিত স্নিগ্ধ গার্হস্থ্যের এক-একটি টান । সেই উপহার রেবার সঙ্গে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেও এসেছে ধীরেন্দ্র । ফলে অম্বিকাকে দু-একবারের বেশি দেখার সুযোগ পায়নি সে । সেই সামান্য যোগাযোগের মধ্যেই সে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অসংকোচে । - ধীরুদা, আমার হাতটা দেখবে ? - কেন তোমার আবার কী হলো ? - না, কিছু হয়নি, এমনি । হাত দেখাতে ভালো লাগে । - কিন্তু আমার যে হাত দেখতে একটুও ভালো লাগে না । - এমন করছ কেন ? একটু দ্যাখোই না হাতটা । আমার হাত কিন্তু দেখতে তেমন খারাপ নয় । তাই না ? অম্বিকার বাড়িয়ে দেওয়া হাত এবং হাসি দুটোরই একটা মিলনমুহূর্ত রচিত হওয়ায়, দুটোর মধ্যেই একটা গোলাপি উপস্থিতি ধরা পড়ায় ধীরেন্দ্র নতমস্তক হয় শেষে । সে যে সেদিন অম্বিকাকে কী বলেছিল সেটা বড়ো কথা নয়, সেই কথাও স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে ইতোমধ্যে, বড়ো কথা হলো এই হস্তপ্রসারণের পর তার খুব বেশি দেরি হয়নি আত্মহননের পথ বেছে নিতে । হাসপাতালের সেবিকারা যেখানে বাস করে সেই বাসভূমির কোনো একটি ঘরে তাকে ঝুলতে দেখা যায় । সাত্যকির কাছে খবর পৌঁছোয় যে, অম্বিকা ঝুলছে । এই দৃশ্য ভবিষ্যতে তার কোনো ছবিতে প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল কিনা তা ধীরেন্দ্রর পক্ষে বলা সম্ভব নয় । রেবারও এ ব্যাপারে তেমন কোনো বিশেষজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না । বলার কথা এই যে,কেউ কেউ যদি ভেবে থাকে এই ঝুলে থাকার দৃশ্যই এক শিল্পীকে অপরিমিত মদ্যপানের দিকে ঠেলে দেয় শেষে, তবে বাজারে প্রচলিত অনেক ভুলের মধ্যে আর একটা নতুন ভুল কিন্তু জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পেয়ে যাবে । ফলে এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে । এই যে সেদিন প্রতিমা বাইরের ঘরে কাউকে বসিয়ে বেশ জোর গলায় রবীন্দ্রনাথের কথা বলছিল, সেখানেও তো ছিল বেশ জোরালো এক ভুলের আসনগ্রহণ । প্রতিমা কৃষ্ণের কথা থেকে রবীন্দ্রনাথের কথায় এসেছিল । সে যতক্ষণ কৃষ্ণের কথায় ততক্ষণ যে সে নির্ভুল ছিল এ কথা বলতে ধীরেন্দ্র কুন্ঠিত হবে না । বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সবই সে শুনতে পায় । প্রতিমা যে বেশ গুছিয়ে বলছে যদুবংশের কাহিনী তা বারান্দা থেকেই বোঝা গিয়েছিল । যদুবংশের নেতা তখন সুরসেন । তাঁর রাজত্বের রাজধানী তখন মথুরায় । তাঁর পুত্র বসুদেব তাঁদের প্রাসাদে ফিরছেন বিয়ে করে । দেবকের কন্যা দেবকী তাঁর পত্নী । দেবক বিয়েতে উপহার দিয়েছেন অনেক কিছু । চারশো হাতি । তাদের গায়ে আবার সোনার গয়না । সুসজ্জিত অশ্বের সংখ্যা পনেরো হাজার । এখানেই শেষ নয়, আঠারোশো রথও আছে । মেয়ের জন্য দেবক সুন্দরী সহচরী দিয়েছেন দুশো । এত বড়ো শোভাযাত্রা চলেছে প্রাসাদের দিকে । উগ্রসেনের পুত্র কংস বসুদেব ও দেবকীর রথের সারথি । বৈদিক প্রথায় মেয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করে তখন তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য তার সঙ্গী হয় তার ভাই । ভাই সঙ্গে থাকলে বোনের মধ্যে আসবে না একাকিত্বের বোধ । কংস সম্পর্কে দেবকীর ভাই । নানা রকমের বাজনা বাজছে । শঙ্খ, বেণু, মৃদঙ্গ এবং ভেরী যে সমন্বয়ের সৃষ্টি করছে তা কানের পক্ষে সম্পদ । শোভাযাত্রার কোথাও কোনো অশান্তি নেই । তা-ছাড়া যোগ্য সারথির হাতে এসে পড়েছে বরবধূর রথ চালানোর দায়িত্ব । হঠাৎ ছন্দপতন হলো ভীষণভাবে । দৈববাণী হলো পরিষ্কার । কংস, তোমার মতো বোকা আর কেউ নেই । তুমি যে তোমার বোন আর ভগ্নিপতির রথ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছ এতবড়ো বোকামি আর কী আছে ? তুমি কি জানো যে, তোমার এই বোনের অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমার মৃত্যুর কারণ হবে ? এই পর্যন্ত শুনতে বেশ লাগছিল । বেশ বলছিল প্রতিমা । শোভাযাত্রার অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছিল তার গলা থেকে । কিন্তু এই অষ্টম গর্ভের সন্তানকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে প্রতিমা হঠাৎ বলে বসে - রবীন্দ্রনাথও অষ্টম গর্ভের সন্তান ছিলেন । এ কথা যে প্রথম ধীরেন্দ্র প্রতিমার কন্ঠেই শুনল তা বললেও ভুল করা হবে বেশ । এ কথা আরো অনেকেই বিভিন্ন সময়ে শুনিয়েছে । অথচ সত্যবান হতে গেলে বলতে হয়, দেবেন্দ্রনাথের পনেরোটি সন্তানের কথা । অষ্টম সন্তান কে ছিলেন তা ধীরেন্দ্র বলতে পারবে না । জোর দিয়ে বলতে পারবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চতুর্দশ সন্তান । অষ্টম সন্তান কখনোই নন । অমাবস্যাকে সামনে রেখে যেভাবে চোদ্দ প্রদীপ জ্বলে সংসারের সর্বত্র, সেভাবেই যেন রবীন্দ্রনাথের এই চতুর্দশ হয়ে ওঠা । আশি বছরের ওপর যে বাড়ির সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ ছিল সেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর যেমন জন্ম হয় তেমন মৃত্যুও হয় সেখানে । এই জন্মমৃত্যুর স্থানিক অনন্যতা কীভাবে যেন কারো কারো ক্ষেত্রে দৈনিক অনন্যতার বিভ্রমের খোরাক সরবরাহ করেছে আপনমনে । না-হলে এই রাবীন্দ্রিক ভুলের পাশাপাশি শ্রী অরবিন্দকে নিয়েও উপজাত ভুল জায়গা করে নিত না শেষ পর্যন্ত । বড়ো দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় শ্রী অরবিন্দের জন্মদিন পনেরোই আগস্টে নির্বিবাদে ছাপা হয়েছে এই একই দিনে তাঁর নাকি দেহাবসানও হয়েছিল । অথচ সত্যবান হতে গেলে বলতে হয় ৫ ডিসেম্বরের কথা । এই দিনেই তাঁর দেহত্যাগ হয় । অম্বিকা যখন পূর্ণ মাত্রায় বিরাজিত তখনই কানে এসেছে সাত্যকির মাতাল হওয়ার কাহিনী । ধীরেন্দ্রর কাছে সেই দৃশ্য জীবন্ত করে তোলে প্রতিমা । হ্যাঁ, প্রতিমা ছিল প্রত্যক্ষদর্শী । সেবার একটা ছোট্ট পারিবারিক গোষ্ঠী দুদিনের জন্য ভ্রমণের টানে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে । কয়েক ঘন্টার ট্রেনযাত্রা । তার পরেই পাওয়া যায় পাহাড় আর প্রান্তর । রুক্ষতার রাজত্ব, কিন্তু সজলতাও বেঁচে আছে সম্মানের সঙ্গে । এই ক্ষেত্রে প্রতিমা, রেবা, তাদের মা আর সাত্যকি দিবালোকেই আনন্দ খুঁজে নিতে যে সক্ষম তার কারণ হিসেবে প্রতিমা সাত্যকির নাম করেছিল । হ্যাঁ, সাত্যকি রেবার মাকেও সেই পান্থনিবাসে বিশ্রাম করতে না দিয়ে এলোমেলো পদচারণার সঙ্গী করে নেয় । খুব সহজেই প্রতিভাত হতে থাকে শুধু তুলির ক্ষমতাতেই নয়, সাংগঠনিক ক্ষমতাতেও তার সাফল্য । কিন্তু সন্ধের পরেই একেবারে পালটে যায় পট । সাত্যকি কিছুক্ষণের জন্য একা একা ঘুরে আসার কথা বলে বেরিয়ে যায় । দুই বোন তাদের মার কাছে বসে অন্য কোনো পাহাড় আর অন্য কোনো প্রান্তরের গল্প শুনতে থাকে । রাত বসে থাকে না । সে তার শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে সন্ধের যাবতীয় স্মৃতি । তার অন্তর্গত হতে থাকে নতুন অঞ্চলের নতুন নতুন নৈ:শব্দ্য শেষে তিনজন নারীর মধ্যে হাজির হয় উত্কন্ঠা । প্রত্যেকের নিজের কথা আপাতত শেষ হয়ে গেছে । এখন সেই পুরুষের জন্য দুশ্চিন্তা যার ভরসায় এই ভ্রমণের সূচনা । কিংবা জন্মও হয়েছে বলা যায় । যখন প্রতিমারা কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না তখন সাত্যকি এল । তবে এ কোন সাত্যকি ? একেবারে অন্যরকম এক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে । চেতনার ভূমিকা বলে আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই । পাহাড় আর প্রান্তরের অবাধ সমর্থনে যে ক্ষেত্র কিছুক্ষণ আগে প্রতিমাদের কাছে প্রায় নৃত্যাঙ্গন হয়ে উঠেছিল সেখানেই শুরু হলো সাত্যকির অচেতন অস্থিরতা যাকে প্রেতনৃত্য বললে খুব বেশি ভুল করা হয় না । দুই কন্যার মা জীবনে এই প্রথম যে মাতালের মূর্তি দেখলেন তা নয় নিশ্চয় । তবে এই প্রথম দেখলেন সাত্যকির সঙ্গে এক নিখুঁত মাতালের এত সাদৃশ্য । কিংবা বলা যায়, যে-সাত্যকি ছবি আঁকে তাকে দেখেও যে মাতালের প্রতিকৃতি আঁকা সম্ভব এই সত্যের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটল । শেষে তিনি পান্থশালার অন্য ঘরে ঢুকে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দরজা দিলেন । বাইরে বা বাকি ঘরটিতে রইল সাত্যকির তাণ্ডব যতক্ষণ না নিদ্রা এসে সবকিছু স্তব্ধ করে দিতে পারে ।

    সেই রাত্রির স্মৃতি প্রতিমার কাছে পরবর্তীকালে খুব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এমন কথা বলা যাবে না । রেবাকেও সেই রাত্রির সাহায্য নিয়ে কখনো কোনো বক্তব্য পেশ করতে দেখেনি ধীরেন্দ্র । বরং পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্নভাবে তারা দুজনেই শুনেছে কোনো-না-কোনো সূত্র থেকে আরো কয়েকটি রাত্রির সুযোগে সাত্যকি কীভাবে আর সাত্যকি থাকে না সেইসব বিবরণ । হ্যাঁ, ধীরেন্দ্ররও প্রত্যক্ষদর্শনের সুযোগ হয়েছে । তবে সেটা কোনো নিসর্গের মধ্যে নয়, এই শহরেরই এক রাত্রিকালে । দক্ষিণের দিকে একটা মোড় আছে যেখানে কয়েকটা পথের মাথা বিরাজ করে । এক দিক থেকে আর একদিকে যেতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে । কত যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার হিসেব নেই । ধীরেন্দ্রর এক বন্ধু রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে । তার মৃত্যু হয়নি, কিন্তু বাদ গেছে একটা পা । ত্রক্রাচে ভর দিয়ে তাকে আজও ওই রাস্তা পার হতে হয় । কারণ রাস্তা পার হতে না পারলে সে তার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছোতে পারবে না । এই বহুমাথার মোড়েই একদিন রাত্তিরে একটা বাস এসে থামে । সেই বাসে ধীরেন্দ্র ছিল । সে দেখতে পায় চালকের পেছনের যে দরজা সেই দরজা দিয়ে সাত্যকি উঠছে । টলতে টলতে সে এমন জায়গায় গিয়ে বসে যেখান থেকে পেছনে মুখ না ঘোরালে ধীরেন্দ্রকে দেখা যাবে না । গুপ্ত থাকার সুযোগ নিয়ে সে দেখে সাত্যকি কীভাবে যে বাসের টিকিট বিক্রি করছে তার সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয়, সে টিকিট না কাটার সিদ্ধান্তে অচল থাকায় তাকে কীভাবে বাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য করা হয়, নেমে যাওয়ার আগে সাত্যকি পরিপূর্ণরূপে যে অবৈধ শব্দটি উচ্চারণ করে তা কেমন করে রাত্রির দেহের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় নিশ্চিত । বহুমাথার মোড়ে বাসের সেই রাত্রির কথা রেবাকে শোনানোর ইচ্ছে জেগে ওঠায় একদিন সে রেবার কাছে উপনীত হয়ে কতটা বলবে আর কতটা বলবে না এই সমস্যায় দীর্ণ হয় । তার সেই সমস্যাদীর্ণ চেহারা দেখে রেবা হেসেছিল । - বললে পুরোটাই বলবে । এমন কোনো জরুরি অবস্থা জারি হয়নি যে তোমাকে সাবধানে কথা বলতে হবে । আর সাত্যকির ব্যাপারে তুমি এমন কোনো কথা বলতে পারবে না যা আমি আগে কখনো শুনিনি । ফলে ধীরেন্দ্র সব বলেছিল, পরিপূর্ণরূপে উচ্চারিত সেই শব্দটি ছাড়া ।

    প্রতিমার কাছ থেকে সাত্যকি তথা রেবা বিষয়ক এমন অনেক কিছু জানা যায় যা অন্য কোনোভাবে ধীরেন্দ্রর পক্ষে জানা সম্ভব নয় বোধ হয় । একবার প্রতিমাকে সামনে রেখে রেবার প্রতিকৃতি দেখে এসে সে যখন তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তখন প্রতিমাই তাকে জানায় সাত্যকি আসলে কী চেয়েছিল । - ও কী চেয়েছিল তা তুমি কী করে জানলে ? - ভুলে যেয়ো না রেবার পরিচয়টা কী । সে আমার মায়ের পেটের বোন । সে সব কথা আমাকে না বললেও কিছু কিছু কথা আমাকে তো বলবেই । তুমি আমার স্বামী হলেও যা শুনব সবটাই যে তোমার কাছে উগরে দেব তা কিন্তু কখনো ভেব না । তবে সাত্যকি রেবার ছবি আঁকার ব্যাপারে আসলে কী চেয়েছিল সেটা তোমাকে অনায়াসে জানিয়ে দেওয়া যায় । আশা করি একথাটা তুমি পাঁচ কান করবে না । এমনকী আবেগের বশে কখনো আবার রেবাকেই জিজ্ঞেস করে বসবে না । ও রেবার মুখ আঁকতে চায়নি । ও চেয়েছিল রেবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত আঁকতে । তবে শর্ত ছিল একটাই । মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো বস্ত্রের নামগন্ধ থাকবে না । প্রতিমা ধীরেন্দ্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, তার বোন তক্ষুনি ওই প্রস্তাবে রাজি হতে পারেনি । সে বলেছিল ভবিষ্যতে কখনো হয়তো তার পক্ষে রাজি হওয়া সম্ভব হবে । তা যতক্ষণ না হয় সাত্যকি যেন সেইসব মেয়েদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয় যারা অর্থের বিনিময়ে শিল্পীদের সামনে নির্বসন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে প্রহরের পর প্রহর । সাত্যকি নাকি রেবাকে বলতে চেয়েছিল দেহের প্রকাশের কথা, তারও যে চেতনার সঙ্গে একটা যোগ আছে তার কথা । সেই প্রকাশ বা সেই যোগের সন্ধান ব্যবহৃত অবয়বের মধ্য থেকে ঠিক বেরিয়ে আসতে চায় না । একজন শিল্পীর কাছে তাই তার সঙ্গিনীর অনিরুদ্ধ অবস্থানের মূল্য আলাদা । রেবা তার কথা মেনেও শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসতে পারেনি । তার একটাই যুক্তি । উন্মোচনের একটা মুহূর্ত আছে । যে-কোনো মুহূর্তই উন্মোচনের মুহূর্ত নয় । সে তখনই এগিয়ে এসে সামনে ফুটে উঠবে যখন সময় হবে ফুটে ওঠার । অগত্যা সাত্যকি দু-একটি টানে তার যে প্রতিকৃতি আঁকে সেটা দেয়ালে তার জায়গা করে নেয় । সব বুঝিয়ে প্রতিমার প্রশ্ন ছিল, তুমি হলে কী করতে ভেবে দেখেছ ?

    যেখানে আগে দোতলা বড়ো বাড়ি ছিল আর ছিল কয়েকটা পাম গাছের দৃঢ়তা, যেখানে শিক্ষকেরা কী করে শিক্ষা দিতে হয় তা শেখার জন্য ছাত্র হয়ে আসতেন, একদিন ঠিক সেখানেই সাত্যকি ধীরেন্দ্রকে আসতে বলে । - ধীরুদা, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে । তুমি কাল বিকেলে, এই ধরো পাঁচটা নাগাদ, একবার যদি ওখানে আস খুব ভালো হয় কিন্তু । তোমার যদি একটু দেরিও হয় কোনো অসুবিধে হবে না । আমি সামনেই থাকব । পাম গাছের পাশে চুপ করে বসে থাকার অনেক জায়গা আছে । এসো কিন্তু মনে করে । ধীরেন্দ্র যথাসময়ে হাজির হয়েছিল । শিক্ষকদের ছাত্ররূপ দেখেছিল । তাঁরা ক্লাস করে দলবদ্ধ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন কথা বলতে বলতে । পাম গাছের পাশে সাত্যকির উপবেশন খুঁজে না পেয়ে সেখানে ধীরেন্দ্র নিজেই শেষে উপবিষ্ট হয়ে পড়ে । তার মনে হতে থাকে যার আসার কথা ছিল, যার কিছু বলার কথা ছিল সে কি সত্যিই কোনোদিনও কোথাও আসতে পারে ? বলতে পারে শেষে কোনোকিছু ? তার কেবলই এসব মনে হতে থাকে । আর যত মনে হতে থাকে ততই অর্থহীন হয়ে উঠতে থাকে তার প্রতীক্ষা । অথচ সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে চলেও যেতে পারে না । যে গোধূলির এসে পড়তে হয়তো খুব বেশি দেরি নেই আর, সেই গোধূলির জন্য শেষে তার অপেক্ষা শুরু হয় । বেশ বুঝতে পারে গোপনে গোপনে যে ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে তার দৌলতে এক অপেক্ষা থেকে আর এক অপেক্ষার অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে সে । সাত্যকির আসাটা তুচ্ছ হয়ে গিয়ে গোধূলির আসাটা বড়ো হয়ে দাঁড়ায় । কত আগডুম-বাগডুমের জন্য ব্যস্ত থেকে থেকে সে প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল গোধূলির কথা । গোধূলির মধ্যেও যে প্রকাশের রোদ আছে তা প্রায় মনেই ছিল না তার । কিন্তু সেদিন মনের এই অবস্থা সত্ত্বেও তার সেই নতুন অপেক্ষা সাফল্য লাভ করতে পারেনি । কারণ গোধূলির আগেই এসে হাজির হয় সাত্যকি । - আর বলো না, এমন বিশ্রীভাবে আটকে গেলাম । আমি জানতাম দেরি হলেও তোমাকে পাব । তুমি ঠিক আমার জন্য বসে থাকবে । তাই তো এক ঘন্টা দেরি করেও ছুটে এসেছি । এখানে এখন আর বসে থাকা যাবে না । মশার উত্পাত আছে । চলো আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি ।

    হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার অবকাশ কমে আসছে । এর ওপর আর একটা সমস্যা দুজনের গতিবেগ এক নয় । মাঝে মাঝে আপন গতিবেগে এগিয়ে যেতে হয় ধীরেন্দ্রকে । সাত্যকিকে পিছিয়ে পড়তে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে । সাত্যকিও চায় গতি বাড়াতে । কিন্তু তাতে তার মধ্যে ফুটে ওঠে কেমন এক বিহ্বলতার ভাব । এই অবস্থায় দুজনেই বুঝতে পারে প্রাণের কথা বলার পরিমণ্ডল রচিত হচ্ছে না । এই অবস্থায় হঠাৎ বাঁদিকে দেখা যায় ছোট ছোট দুটো প্রবেশপথ । পথ গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানে সেখানে গোল হয়ে ফুটে উঠেছে একটা পার্ক । সেখানে বসার আসন আছে কয়েকটি । এই পার্ক সরকারের বা পুরসভার নয় । পার্কের চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা বাড়ি যাদের তাদেরই একেবারে নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এই সবুজ বলয় । বাইরের বৃদ্ধরা নয়, ভেতরের বৃদ্ধরা সেখানে বসে থাকে । সমস্ত খেলা বা সমস্ত বসে থাকার মধ্যে কেমন একটা মাত্রা আছে । এমনকী ঘাসও মাত্রাবান । যে প্রাণের কথা বলতে চায় এবং যে চায় তার শ্রোতা হতে দুজনের কাছেই বাম পার্শ্বের এই হাতছানি খুব উপেক্ষার বস্তু ছিল না । দুজনেই থেমে গিয়ে বুঝতে পারে যে-অঞ্চল সংরক্ষিত প্রায় সেখানে প্রবেশ করার ফলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে । ধীরেন্দ্র কিছুতেই ভেতরে ঢোকার শক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি । কিন্তু সাত্যকি একটু থমকে গিয়েও শেষে ভেতরে ঢোকে এবং ধীরেন্দ্রকেও ঢোকার সাহস যোগায় । - চলে এসো ধীরুদা । কেউ কিছু প্রশ্ন করলে ছবি আঁকার কথা বলব । সঙ্গে তো ঝোলা আছে । তেমন হলে ছবি আঁকতে লেগে যাব । তারা ভেতরে ঢুকে বসার জায়গা পেয়ে যায় । তাদের আসনে আর কেউ না থাকায় স্বস্তি জাগে । দুটি ফুটফুটে মেয়ে জাল না টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে । তারা যত না খেলছে তার চেয়ে হাসছে অনেক বেশি । শেষে তারা খেলা বন্ধ করে হাসতে হাসতে একটা বাড়ির মধ্যে মিলিয়ে যায় । তাদের মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে সাত্যকি বলে ওঠে - আমার যা বলার তা খুব সংক্ষেপে বলি । ফেনিয়ে কোনো লাভ নেই । তুমি তো বুঝতে পারো ধীরুদা, আমি রেবাকে কোন চোখে দেখি । আমি তোমার সাহায্য চাই । ওর মাকে তুমি একটু রাজি করাও । তিনি রাজি হলে আর কোনো সমস্যা থাকে না । কারো মতের তোয়াক্কা না করে আমরা দুজনে মিলে যে কিছু করে ফেলব সেটাও সম্ভব নয় । কারণ রেবা পরিষ্কার জানিয়েছে, আমাকে ভালোবাসলেও সে এমন কিছু করতে পারবে না যাতে তার বাড়িতে আগুন জ্বলে । তুমি একটু ওর মার সঙ্গে কথা বলবে । তিনি সবকিছু বুঝেও না জানার ভান করছেন । একটু সাহায্য করবে ? ধীরেন্দ্রর হাত ধরে সাত্যকি । তুমি তন্ত্রে ভৈরবীর ব্যাপারটা জানো তো ? আমি চিনতে ভুল করিনি । ওকে পেলে আমার অনেক জটই অনায়াসে খুলে যাবে । এখন সময় এসে গেছে । পাব কি পাব না এটা পরিষ্কার করে জেনে নিতে হবে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি একটু কথা বলো । তোমাকে ওর মা অন্য চোখে দেখেন । তোমার কাছ থেকে আমি ওর মায়ের আসল মনোভাব জেনে নিতে পারব । যে সবুজ সংরক্ষিত তার মধ্যে নেমে আসতে শুরু করেছিল গোধূলির স্বাধীনতা । ধীরেন্দ্র সাত্যকির হাত ধরেছিল । - যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তাঁর মত জেনে নেব ।

    হাঁটতে হাঁটতে একদিন ধীরেন্দ্র পাশে পেয়ে যায় রেবাকে । কিংবা হাঁটতে হাঁটতে রেবা একদিন পাশে পেয়ে যায় ধীরেন্দ্রকে । অত্যন্ত তুচ্ছ সব প্রসঙ্গ চলে আসে কথোপকথনের মধ্যে । পুরুষ এমনকী বলে হাঁটুর ব্যথার কথা । হাঁটুতে চোট পেলে মনে হয় প্রাণ অনেকটাই বেরিয়ে পড়েছে । - দেখোনি যারা ফুটবল খেলে তারা হাঁটু ধরে কীভাবে মাঠের মধ্যে কাতরায় ? নারী এমনকী বলে দাঁতের ব্যথার কথা । - আমার একবারই আত্মহত্যার কথা মনে হয়েছিল । রাত্তিরে সবাই ঘুমোচ্ছে । আর আমি যন্ত্রণায় বারান্দায় পায়চারি করছি । মনে হচ্ছে আর সম্ভব নয়, আর কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয় । তখন মনে হয়েছিল এ জীবন আর রেখে কী লাভ । ওই একবারই । আর কখনোও সেটা মনে হয়নি । ধীরেন্দ্র বড়োজোর বলে - ওই একবারই ? আর কখনো মনে হয়নি ? তবে তো তুমি ভাগ্যবতী । অত্যন্ত তুচ্ছতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে একসময় সুযোগ আসে । কারণ তখন রঙের আলোচনা শুরু হয়েছে । হাঁটুর রঙ আর দাঁতের রঙের প্রভেদরেখা ফুটে উঠতে শুরু করেছে নির্দ্বিধায় । সেই সুযোগ গ্রহণ করতে না পারলে অক্ষমতার শেষ থাকবে না । ফলে ধীরেন্দ্র এগিয়ে আসে এবং সাহায্য নেয় শব্দগুচ্ছের । মাতৃভাষার কাছে তার ঋণ বাড়ে । - তুমি সাত্যকির কাছে যাবে না ? এই প্রশ্ন রেবাকে দাঁড় করিয়ে দেয় । এগোতে এগোতে হঠাৎ থেমে গেলে এবং থেমে গিয়ে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে হঠাৎ তাকালে পৃথিবীটা যেন আর থাকে না আগের মতো । - তুমি এই প্রশ্ন করলে ? - কেন, আমি করতে পারি না ? - সেটা প্রশ্ন নয় । তুমি এই প্রশ্ন করলে, নিশ্চয় কেউ কিছু তোমায় বলেছে ? - হ্যাঁ বলেছে । অস্বীকার করে লাভ নেই । বলেছে সাত্যকি । তোমার মার মতটা আমাকে জেনে নিতে বলেছে । আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না । তোমাদের পরিণামটা কি শেষপর্যন্ত মায়ের মতামতের ওপর নির্ভর করবে ? আবার হাঁটতে শুরু না করে রেবা উত্তর দেয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । বলা দরকার সে যখন উত্তর দেয় তখন সে ধীরেন্দ্রর দিকে না তাকিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে । - হ্যাঁ, মায়ের মতামতের ওপর নির্ভর করবে । কারণ আমার সেই সাহস নেই । এই কথাটা যেমন সত্য আর একটা কথাও তেমন ভুল নয় । সাত্যকিকে নিয়ে আমার অনেক সংশয়ও আছে । আবার ওর পাশে গিয়ে কিন্তু দাঁড়াতেও চাই । ফলে সমস্যাটা চট করে কাউকে বোঝাতে পারব না । এবার পাশাপাশি হাঁটার ছবি আবার ফুটে উঠতে থাকে । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে কোনো মতবাদের প্রত্যক্ষতা দিয়ে রেবাকে সাহায্য করা যাবে না । তাকে তার মার মুখোমুখি হতেই হবে । পাশাপাশি হাঁটার যে পথ রেবাদের বাড়ির দিকে ছিল না তাকে হঠাৎ ত্যাগ করে গৃহমুখী পথ ধরে ফেললে রেবা আপত্তি করে না । - কী, পথ পালটালে ? ঠিক আছে, তাহলে ঘরেই ফেরা যাক । আমারও আর হাঁটতে ভালো লাগছিল না । তুমি আমার মনের কথা বুঝলে কী করে ? ধীরেন্দ্র শব্দ না করে হেসেছিল । মনের কি একটা কথা ? তার যে কতরকমের কথা আর যে কতরকমের ভাষা সে হিসেব যে রাখতে চেয়েছে তার তো পাগল হওয়ার উপক্রম । সেদিন ঘরে ফেরার পথ নীরবতার দ্বারাই শাসিত হয়েছিল শেষে ।

    প্রতিমার মা রেবার মা ধীরেন্দ্রকে পেয়ে সাধারণত যা করে থাকেন তা যে সব সময় রেবা বা প্রতিমার সমর্থন পায় তা বলা যাবে না কিছুতেই । সেদিনও সে বসার পর তার উলটোদিকে বসে তিনি যখন স্বধর্মরত হতে যাবেন তখন তাঁকে যেন বাধা দিতে চেয়েছিল ধীরেন্দ্র । - চলুন, এত ঘর থাকতে একটা ঘরেই কেন রোজ রোজ বসতে হবে আমাদের । বেশ বড়ো দেখে একটা ঘর খোলা যায় না ? - কেন যাবে না ? এটা আর এমন কী কঠিন কাজ । চাবি মিলিয়ে খুলে ফেললেই হলো । কোন ঘরে যাবে বলো, আমি চাবির গোছা নিয়ে আসি । ঠিক আছে, তুমি ভাবতে থাক, আমি আসছি । বেশ মনে আছে সেটা ছিল শরত্কাল । ধীরেন্দ্র যে রেবার সঙ্গে হাঁটছিল সেটাও ছিল মূলত পুজোর কেনাকাটার ভিড় দেখার জন্য । তারা যখন এক অঞ্চলের ভিড় দেখে আর এক অঞ্চলের ভিড় দেখতে যাবে তখনই রেবার ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুতোয় হাত পড়ে । একটা পিছুটান বেজে ওঠে । ঘরে ফিরে এলেও ধীরেন্দ্রর নাকে সেই ভিড়ের গন্ধ লেগে থাকায় শেষে এক আসন্ন উত্সবের গন্ধও আমন্ত্রিত হয়ে আসে । সে হতাশ হতে চায় না । রেবা বা প্রতিমার মার মুখোমুখি হওয়ার আগে সে একটা অন্যরকম ঘর চায় । এমন ঘর যেখানে জানলা খুলে দিলে আলোবাতাস খেলে এবং দেখা যায় শরতের মেঘ খুব সহজেই । তাই যিনি চাবির গোছা নিয়ে ফিরে আসেন তাঁকে কোন তালার দিকে এগিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করতে পেরেছিল সে । মনে আছে উন্মোচিত ঘরে বসার পর তিনি উন্মোচিত করেছিলেন একটি গরদের শাড়ি । - তোমাকে তো কয়েকদিন দেখতে পাইনি । ভাইপো প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে তার পিসিমাকে এই শাড়িটা দিয়েছে । কেমন হয়েছে বলো তো ? প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি চলে যেতে চান সেইসব কাহিনীতে যেসব কাহিনীর সমর্থনে রেবা বা প্রতিমাকে কোনোদিন তেমন করে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না । সেইসব কাহিনীর মধ্যে মাতৃহীন সন্তানের শৈশবও পাল্লা দেয় যাঁর স্নেহের সঙ্গে তিনি প্রথম পরিচয়ে যে পিতৃস্বসা এ কথা প্রায় ঘোষণার মতো করে এসে যায় । সেই ছেলে বড়ো হয়ে যখন আরব সাগরের তীরে বড়ো চাকরি পায় তখন তার প্রথম মাসের উপার্জনের একটা অংশ দিয়ে যে গরদ কেনা হয় সেটা তো মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইবেই । - খুব ভালো হয়েছে । আরো ভালো এই কারণে যে, ঢাকের বাদ্যি তো বেজে উঠল বলে । মহাষ্টমীর দিন পুজোমণ্ডপে এই শাড়ি পরেই তো যেতে পারবেন । মাইকে অঞ্জলি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ঘোষিত হতে থাকে সময়সীমা । আর একবার অঞ্জলি শুরু হয়ে গেলে ত্রক্রমাগত আমন্ত্রণ ছড়িয়ে যেতে থাকে চতুর্দিকে । ধীরেন্দ্র উন্মোচিত ঘরে বসেই শুনতে পায় - যাঁরা অঞ্জলি দিতে ইচ্ছুক তাঁরা আমাদের পূজামণ্ডপে চলে আসুন । আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । ধীরেন্দ্র দেখতেও পায় । তার দূরদর্শন ঘটে । মণ্ডপে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে এক জননী সবচেয়ে আপন করে নিতে চাইছেন গরদকে । - মন্দ বলোনি । মহাষ্টমীর দিন ভাইপোর দেওয়া গরদ গায়ে জড়িয়ে নিতে পারি । তবে কোনটা যে কখন পরব এ নিয়ে আজকাল বেশ সমস্যাই হয় । গরদও যে এই একটা ছাড়া আর নেই তাও তো নয় । যারা প্রতি বছর কাপড় দেয় তাদের বারণ করি । অনেক জমে গেছে, আর দিতে হবে না । কিন্তু কেউ কথা শুনতে চায় না । এই যে রেবা, কোন ফাঁকে ওর একটা ছবি কে যেন টাকা দিয়ে নিয়ে গেছে, তাও ওর কাছ থেকে নয়, অন্য কোনো জায়গা থেকে । কিছু টাকা পেয়েছিল, নিজের কাছে রেখে দে । তা কথা শুনবে না । আমার জন্য কাপড় নিয়ে এসছে । সেটাও একটা গরদ । ভাইপো আর মেয়ে দুজনেরই ইচ্ছে আমি তাদের জিনিস কোনো বিশেষ দিনে পরি । কী করব এখনও ঠিক করতে পারছি না । কথা বলতে বলতে খোলা জানলার দিকে চোখ মোছা আর পরনের বস্ত্র দিয়ে অশ্রু মোছার মধ্যে যে প্রভূত ফারাক আছে তা যেন কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল । ধীরেন্দ্র কয়েক বছর আগেও এই ভদ্রমহিলাকে বেশ খানিকটা পথিকের ভূমিকায় দেখেছে । তখন সে রেবাদের বাড়িতে আসত এক বন্ধুর সঙ্গী হয়ে । খুব কম দিনই পাওয়া গেছে যখন ভদ্রমহিলা তাদের গল্পগুজবের আসরে উপস্থিত থাকতে পেরেছেন । কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে সুপুরির টুকরো মুখে ফেলে তাঁকে কতবার হাসি-হাসি মুখে চটি পরতে দেখেছে ধীরেন্দ্র । - বেরোচ্ছেন ? একটু বসবেন না ? - আমার বসার উপায় নেই । তোমরা বসো ! চা টা খাও । গল্প করো । আমাকে একবার যূথিকাদির বাড়ি যেতে হবে । কাল আমাদের একটা পথসভা আছে । বোঝোই তো, নামে অনেকে আছে, কিন্তু কাম করার লোক খুব কম । আমরা না গেলে যূথিকাদির চলবে কী করে ? আমি আসি, কেমন ? সুপুরি মুখে রাখার ফলে যাওয়ার আগে তাঁর উপহার দেওয়া হাসির মধ্য থেকে ঝরে যেত মেদ । এই কয়েকবছরে সেই হাসি প্রায় আবিষ্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । সে কখনো যূথিকাদিকে দেখেনি । তবে তাঁর কথা অনেক শুনেছে তাঁর অনুগামীর মুখ থেকে । তাতে একটা জিনিস বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে । তাঁর সঙ্গে কোনোদিন কোথাও পরিচয় ঘটলে ধীরেন্দ্র তাঁকে ডেকে উঠবে যূথিকাদি বলেই । আর কোনো সম্বোধনের কথা মনেই আসবে না তার । যূথিকাদির কোনো অনুগামী একদিন পথিকের ভূমিকা থেকে সরে এসে বস্ত্রের কথা বলতে বলতে শেষে নীরব হয়ে সেই বস্ত্র দিয়েই চোখ মুছলে প্রশ্ন না করে কি পারা যায় ? - কী হয়েছে, আপনার চোখে জল কেন ? তিনি একবার যূথিকাদির পরিচালনায় পরিব্যাপ্ত বাউল গানের আসর থেকে ফিরে তাদের দেখতে পেয়ে কান্নার কথা জানিয়েছিলেন । এত সুন্দর বাউলগান হয়েছে, কিংবা এত সুন্দর গেয়েছে বাউল যে তিনি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি । কিন্তু সে তো ছিল একটা সংবাদমাত্র । চোখের জলের বিবরণ শোনা আর স্বয়ং অশ্রুপাত করতে দেখা দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক । ফলে ধীরেন্দ্রর প্রশ্ন প্রায় শারদীয় হয়ে উঠতে চায় । যিনি প্রশ্নবিদ্ধ তিনি আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকেন শব্দমঞ্জরীর মধ্যে । ছেলেবেলা এই শব্দটা মাথা তুলতে চায় বারংবার । - দল বেঁধে আনন্দ করে পড়তে যেতাম । পুরোনো বই যোগাড় করে এনে পড়তাম । তাতেই মন ভরে যেত । যেগুলো খুব দরকার হতো টুকে নিতাম বই থেকে । জানো, একটা বড়ো প্রার্থনা আগাগোড়া মুখস্থ ছিল । বাবা আমাকে মাঝে মাঝে কাছে বসিয়ে পুরো প্রার্থনাটা শুনতে চাইতেন । আমার খুব বন্ধু ছিল মনোরমা । ধনী ঘরের আদুরে মেয়ে । কিন্তু মনটা ছিল বড়ো পরিষ্কার । একবার একটা বই এনে আমার হাতে দিয়ে বলল - চল, বাগানে যাই । বাগানে গাছের তলায় বসে বানান করে করে দুজনে বইটা পড়তে শুরু করি । অনেক শব্দের মানেই বুঝতে পারি না । তবু ভালো লাগে । দু এক পাতা করে রোজ পড়ছি, ওই গাছের তলায় দুজনে বসে । নবকুমারের সঙ্গে কপালকুণ্ডলার দেখা হয়ে গেছে । হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে শুনতে পেলাম বাবা যেখানে চাকরি করতেন সেখানে আর তাঁকে রাখবে না । আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । দেখতে তো খুব খারাপ ছিলাম না, বিয়েও হয়ে গেল তাড়াতাড়ি । বাড়িতে কোনোদিন সচ্ছলতা ছিল না । চলে যেত কোনোমতে । আর এখন পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি । মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগে । গ্রামের সেই বাগানটার কথা খুব মনে পড়ে । বানান করে করে কপালকুণ্ডলা পড়ছি আমি আর মনোরমা । মনোরমা আমার থেকে দু-এক বছরের ছোটই ছিল মনে হয় । বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছিল । কিন্তু বাঁচেনি বেশিদিন । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে এই সেই মুহূর্ত যখন সাত্যকির কথা তোলা যায় । রেবা সাত্যকির কাছে চলে যেতে পারবে কিনা সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করা যায় । সামনে রাখা গরদের দিকে তাকিয়ে তাকে বলতে হয়, রেবার কথা কিছু ভেবেছেন ? - রেবার কথা আবার আলাদা করে কী ভাবব । ও তো আমার মন জুড়ে আছে । তবে ওকে নিয়ে আমার একটাই ভয়, মাঝে মাঝে কেমন চুপ হয়ে যায় । ওর মনের কথা কিন্তু ওর মনেই থেকে যায় । সেদিক থেকে আমার ছেলে কিংবা বড়ো মেয়ে অনেক খোলামেলা । তোমার বউ কি আমাকে কম জ্বালিয়েছে ! একটু শরীর খারাপ হলেই তার মাকে ছাড়া চলবে না । মা তুমি আমার পাশে এসে বসো । মা আমার এখানে হাত রাখো, মা আমার সেখানে হাত রাখো । একেবারে অস্থির করে দেবে । আর রেবার কথা শুনবে ? একদিন দেখি অসময়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে ঘরে । আমি আলো জ্বেলে যত জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে, কোনো উত্তর নেই । শেষে দেখি চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে । ধস্তাধস্তি করে জানতে পারলাম, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে । ব্যাপারটা বোঝো একবার । কেন, ওকে নিয়ে ভাবার কথা বলছ কেন ? ধীরেন্দ্র সাবধানী না হয়ে সহজ হতে চায় । - ওর বিয়ের কথা ভাববেন না ? - তা তো ভাবতেই হবে । মেয়ের আমার হাতে যেমন তুলি চলে খুন্তিও চলে সমানভাবে । কাপড়জামা এমনভাবে গুছিয়ে রাখবে যাতে কারো কোনো অসুবিধে না হয় । দরাদরি করে জিনিসও কিনতে পারে । আমি এটুকু অন্তত বুঝি, ও যেখানে যাবে সেখানে বেশ ভালোভাবেই হাল ধরতে পারবে । এটাও আমার বুঝতে ভুল হয়নি যে, মেয়ের আমার সংসার করার খুব শখ । তোমায় কিছু কি বলেছে ? শাশুড়ি সরলভাবে তাঁর জামাইয়ের দিকে তাকান । ধীরেন্দ্র সাহস পায় । - ও কোথায় যেতে চায় সে ব্যাপারে আপনি কিছু আঁচ করতে পারেননি ? - তুমি পেরেছ ? - পেরেছি বলেই তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই । শুনবেন ? রেবার মা সত্যিই হেসে ফেলেন । - একশোবার শুনব । তুমি বলো । ধীরেন্দ্র স্বরচিত কবিতার প্রথম ছত্র যেভাবে পড়ে ঠিক সেভাবেই বলে উঠেছিল - রেবা যে সাত্যকির কাছে যেতে চায় আপনি সত্যিই বুঝতে পারেন না ? যে মহিলা প্রশ্নবিদ্ধ হন তাঁর চোখমুখের মধ্যে নেমে আসে বেদনার সারাংশ । - এ তুমি কী বলছ ? আমি তো কোনোদিন ভাবতেও পারিনি । একসঙ্গে কলেজ করে, একসঙ্গে আঁকা শেখে, দুজনে দুজনের বন্ধু এ পর্যন্ত ঠিক আছে । বন্ধু যেমন বন্ধুর বাড়ি আসে সাত্যকিও তেমন এখানে আসে । খায়দায়, আড্ডা দেয়, গল্পগুজব করে । আমার ভালোই লাগে দেখতে । কিন্তু তার বেশি কিছু আমি মানতে রাজি নই । আমরা বেড়াতে গেছিলাম । সাত্যকিকেও আমাদের সঙ্গে নিয়েছিলাম । তুমি জানো ও কী করেছে ? আমি আর নিজের মুখে বলতে চাই না । তোমার বউয়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ো । জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে । এই অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন । যে মহিলা আবেগের দ্বারস্থ হতে হবে এই আশঙ্কায় নিজের চারিদিকে পাহারা বসিয়েছিলেন, তাঁকে বোধহয় শেষ কথা বলার জন্য বসে থাকলে চলে না, উঠে দাঁড়াতেই হয় শেষে । তিনি কাপড় ঠিক করে নিয়ে ভূমিতে পা রাখলে মনে হচ্ছিল এখানেও কোথায় একটা স্বাধীনতার আকুতি সৃষ্টি হয়েছে । যাঁর স্বামী স্বচক্ষে দেখেছিলেন স্ত্রী লাঠির ঘা খেয়েও পালিয়ে না গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী, তিনি যে তাঁর সেই ভূমিকা থেকে এবারেও সরে আসতে পারেন না এমনই এক প্রমাণ বিরাজ করছিল সেই মুহূর্তে । - ধীরেন্দ্র, একটা কথা বেশ ভালো করে শুনে রাখো । সাত্যকি যেন কখনো আমার মেয়েকে আশা না করে । আমি মেয়েকে কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেব, তবু তাকে সাত্যকির হাতে তুলে দিতে পারব না । ধীরেন্দ্রর শাশুড়ি সেদিন এই কথা বলে সেই ঘর ছেড়ে অন্য কোনো ঘরের দিকে চলে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই একাকিত্ব দানা বাঁধতে চেয়েছিল । কারণ তাকে বাদ দিলে ঘরে আর কেউ ছিল না তখন । সে তখন কী ভেবেছিল তা আর পরে মনে করা সম্ভব হয়নি তেমন । সে হয়তো পূর্ববঙ্গ গীতিকার কথা ভেবে থাকতে পারে । সেইসব অংশ যেখানে বোধহয় বলা হয়েছে - কোথায় পাব কলসি কইন্যা/ কোথায় পাব দড়ি/ তুমি হও গহীন গাঙ/ আমি ডুইব্যা মরি । ধীরেন্দ্র পরে ভেবে দেখেছে গহীন গাঙ এসেছে অক্ষমতার পটভূমিতেই । কারণ প্রস্তাব এসেছিল বোধহয় এইভাবে - লজ্জা নাইরে নিলাজ কানাই/ লজ্জা নাইরে তর/ গলায় কলসি বাইনধ্যা/ জলে ডুইব্যা মর । যখন সীমার মধ্যে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তখন সীমাকেই তো অসীম হয়ে উঠতে হবে । উঠতেও হয় চিরকাল । ধীরেন্দ্র রেবা বা সাত্যকিকে তার শাশুড়ির প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে বেশ বুঝতে পারে, কিংবা দেখতে পায় বেশ, যে ঘরের জানলা খোলা আগে বেশ বুঝতে পারে, কিংবা দেখতে পায় বেশ, যে ঘরের জানলা খোলা সেই ঘরে একা বসে বসে, প্রেমায়তন খণ্ড খণ্ড হয়ে মোহানার অখণ্ডতায় মিশে যাচ্ছে ।

    সাত্যকি রেবাকে তার কাছে না আনতে পারলেও এই সংক্রান্ত কাহিনী চট করে শেষ হয়ে যেতে পারে না । আরো কিছু কথা থেকে যায় কোথাও । রেবা সেদিন ছাদ থেকে নামতে যত দেরি করে ততই যেন বেজে উঠতে থাকে সেই শেষাংশ । সাত্যকির আঁকা রেবার প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরেন্দ্র পরিষ্কার শুনতে পায় সেই ডাক - কেমন আছো ধীরুদা ? অনেকদিন কোনো জায়গা থেকেই যার কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি, সে যদি হঠাৎ একদিন সকালবেলায় ধীরেন্দ্রর বাইরের ঘরের ভূমি স্পর্শ করে তবে তো ভালো লাগারই কথা । কিন্তু চমকে ওঠে গৃহস্বামী । এ কী চেহারা হয়েছে তার ! দু-তিন বছরে এতখানি অবক্ষয় সম্ভব ? হাত-পা যেমন শীর্ণ চোখমুখও ততটাই স্তিমিত । তার বিস্ময়ের উত্তর খুব সংযতভাবেই দিয়েছিল সাত্যকি । তার রক্তে শর্করা বেড়ে গেছে বিপুলভাবে । সে আর এই শহরেও থাকে না । যে শহরতলিতে থাকে সেখানে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে প্রথম প্রথম নিজেকেই হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে হতো বলে আর রান্না করারই ইচ্ছে হতো না অনেক সময় । ফলে জল খেয়ে শুয়ে পড়ার ধারাটাও বজায় ছিল বেশ । এভাবে খুব বেশিদিন চলে না বলে শহরতলির একটি মেয়েকেই সে স্ত্রীর আসনে বসিয়েছে বছর দেড়েক আগে । মেয়েটি ছবি আঁকতে না পারলেও তার দুঘরের ভাড়া বাড়িটাকে নাকি প্রায় ছবির মতো করে ফেলতে পেরেছে । আর যে ছেলেটির জন্ম দিয়েছে সেও নাকি প্রাণ খুলে হাসতে পারে । তবু রক্তে শর্করা বাড়ে । তবু সাত্যকিকে দেখে তার অতীতের কথাই কেবল মনে হয়েছিল ধীরেন্দ্রর । - একদিন বৌবাচ্চা নিয়ে আমাদের দেখিয়ে যাও । সেদিন এখানে সারাদিন কাটাতে হবে । আমাদের একটু আনন্দ করার সুযোগ দিতে হবে । তোমার ছেলের হাসির দামই তো এক লাখ টাকা । - হবে ধীরুদা, সব হবে । নতুন কিছু লিখলে ? ধীরেন্দ্র এই প্রশ্ন সাত্যকির কাছ থেকে ঠিক আশা করেনি । সে এর আগে কোনোদিনও তার লেখা নিয়ে কোনো কথা জানতে চায়নি তেমন । সাত্যকি যখন তাকে প্রশ্ন করেছিল ঠিক সেই সময়ে তার কাজ চলছিল একটা উপন্যাস নিয়ে । সেটা তার প্রথম উপন্যাসের কাজ । অনেকদিন ধরে কবিতা লিখতে লিখতে একসময় তার মনে হয়েছিল, এবার কবিতার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে একটা গদ্যের বাড়ি শুরু করা যাক । বাড়িটা ছোট হলেও তাতে যেন থাকে বড়ো হওয়ার অভিপ্রায় । তার নিজের কাছ থেকেই বাধা এসেছে । ভিতর থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এই যে কবিতা লিখে এসেছ, প্রকাশের সুযোগ পেয়েছ কতটা ? কতটা যেতে পেরেছ সেই ভিড়ের মধ্যে যেখানে না যেতে পারলে অপ্রকাশের নীরবতা শ্বাপদের মতো জড়িয়ে ধরে ? কবিতার মতো স্বল্পায়তনের ক্ষেত্রেই যদি এই অবস্থা হয় তবে উপন্যাসের মতো কোনো বৃহদায়তনের ক্ষেত্রে তোমার কি দুর্দশা হতে পারে একবার ভেবে দেখেছ ঠাণ্ডা মাথায় ? ভিতরের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে ধীরেন্দ্র যত ভিতরটাকে পেতে চায় ততই তার উপন্যাস লেখার বাসনা বলবতী হতে থাকে । যাঁরা একেবারে নিজের জন্য লেখা শুরু করেছেন, যাঁদের নিয়ে কোনো কলরোল হয়নি প্রথম যুগে, তাঁদের কারো কারো মুখমণ্ডল স্মরণ করে ধীরেন্দ্র তার প্রথম উপন্যাস রচনায় হাত দিয়ে ফেলে । সাত্যকি ছাড়ে না - কই বললে না তো নতুন কিছু লিখলে কিনা । - লিখে ফেলিনি কিছু, একটু একটু করে লিখে যাওয়ার চেষ্টা করছি একটা উপন্যাস । - তাই নাকি ধীরুদা ? তুমি উপন্যাস লিখছ ? আর কে খুশি হবে জানি না, তবে আমি কিন্তু খবরটা শুনে খুব খুশি হয়েছি । বাড়ি ফিরে আমার ছেলের হাসি দেখলে যেমন খুশি হই ঠিক সেই পরিমাণে খুশি হয়েছি মনে রেখো । লেখাটা শেষ হলে আমি যেন একটা খবর পাই । আমাকে তোমার পাঠক করে নিয়ো কিন্তু । নেবে তো ? - সে দেখা যাবে । আগে শেষ তো করি । ঝোঁকের মাথায় শুরু করে দেওয়া গেছে । এখন মজা টের পাচ্ছি । কবে যে শেষ করতে পারব কে জানে । স্বাস্থ্যহীনতার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়ায় সাত্যকির মধ্যে ফুটে ওঠে অতীতের বর্ণ । - আর একটা কথা ধীরুদা । খুব মন দিয়ে শোনো । তোমার এই উপন্যাস যখন বই হয়ে বেরোবে তখন আর কাউকে ডাকবে না কিন্তু । আমি বেঁচে থাকতে কে তোমার বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকবে ? দেখো, এমন প্রচ্ছদ আঁকব যা দেখে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবে একটা কাজের মতো কাজ হয়েছে বটে । - খুব ভালো কথা । সব বুঝলাম । সবাইকে নিয়ে কবে আসছ বলো তো ? - খুব একটা দেরি হবে না । হুট করে একদিন সাতসকালে সদলবলে হাজির হব ।

    সদলবলেও নয়, সাতসকালেও নয়, কয়েক মাস পর একা একা এক মহানিশীথে ধীরেন্দ্রর ঘুমের মধ্যে হাজির হয়েছিল সাত্যকি । আরো শীর্ণ, আরো স্তিমিত, প্রায় নুয়ে পড়েছে বললেও চলে । কী যেন বলতে চায়, কিংবা কিছুই যেন বলতে চায় না । ধীরেন্দ্রর ঘুমের মধ্যে প্রেমাংশুবাবুর উপস্থিতি যতটা সক্রিয়, যতটা গতিমান বা সংকীর্ণতাহীন তেমন কিছুই ছিল না এই উপস্থিতির মধ্যে । এই এসে পড়াটা যেন এক প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় মাত্র । তাকে কিছু প্রশ্ন করার অধিকার জন্মানোর আগেই স্বপ্ন অন্তর্হিত হয় । ধীরেন্দ্র প্রতিমাকে স্পর্শ না করে পারে না । অপার্থিবতার একটা চাপ আছে যে । কিন্তু সেই স্পর্শনে তার ঘুম ভাঙে না । বরং সে পাশ ফিরে আরো নিবিড় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায় । কয়েকদিন বাদে লোকমুখে খবর পায় সাত্যকির মৃত্যু হয়েছে । কবে মৃত্যু হয়েছে তা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না । তার মৃত্যু নিয়ে একটা ক্ষীণ বিতর্কও তার কানে আসে । কেউ কেউ বলতে চেয়েছিল ব্যাধি তাকে সরিয়ে দেয়নি, আত্মহননই তাকে মৃত করেছে । বিতর্ক দানা বাঁধতে পারেনি তার কারণ কেউই তার মৃত্যু নিয়ে তেমন কিছুই জানত না যার জোরে কোথাও পৌঁছোনো যায় সত্যিই । শেষপর্যন্ত তার অবসানের প্রেক্ষিতে এসে পড়েছে জলরংয়ের কোনো প্রবাসগোধূলি ।

    রেবা সেদিন ছাদ থেকে নেমে এসে তার সেই প্রতিকৃতির দিকে রেখেছিল তার পশ্চাদ্দেশ । - তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম । কেমন যেন ছাদ থেকে নামতেই ইচ্ছে করছিল না । তোমাকে বসিয়ে রেখেছি এই জ্ঞান কিন্তু সবসময় আছে । তবু নামতে পারছি না । তোমাকে কী বলব, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল নেমে আসারও একটা প্রস্তুতি আছে । বলো, কী বলবে । ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে তার সামনে যে বসে আছে তার আয়োজন সম্পূর্ণ । সে আবৃত হওয়ার সাধনায় যেন এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা । পুরোহিত পুজোর শেষে শান্তিজল ছেটানোর আগে ভক্তদের সংহত হওয়ার সুযোগ দেন । তারা এমনভাবে সবকিছু আড়াল করে বসতে চায় যাতে জলের ছিটেফোঁটা পায়ে এসে না লাগে কখনও । রেবাকে সেই মুদ্রায় পেয়ে যায় অত্যন্ত সহজভাবে সেদিন । - আজ কিছু বলতে আসিনি রেবা, দেখতে এসেছি । ওই দিকের আলোটাও জ্বালিয়ে দাও । - সে জ্বালিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু আলো কি কম আছে ? আমার মুখ দেখতে পাচ্ছ না ? রেবা মুদ্রাবতী অবস্থাতেই হাতে পেয়ে যায় আলো জ্বালানোর জায়গাটা । আলোর পাশে এসে দাঁড়ায় আলো । - কই, পাটা একটু তোলো । একটু দেখি । তুমি যে আক্রান্ত হয়েছ তার আঁচ নিতেই এসেছি । তোলো, আর একটু তোলো । একটু গোড়ালির ওপর দিকটা দেখি । সক্রিয় হয় রেবা । একটা অনাসক্তি তাত্ক্ষণিক হলেও তার মধ্যে বিরাজ করতে দেখা যায় । সে যতটা উন্মোচিত করে ততটাই শব্দহীন থাকে বলে যে ক্লেদ ত্বকে ফুটে উঠেছে তার অঘোরতা টের পাওয়া যায় । - এই অবস্থা কি সর্বত্র ? নাকি বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও ? তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে ওঠে রেবা - সর্বত্র । কোথাও বাদ নেই । তুমি যতটুকু দেখলে তার চেয়ে অনেক বেশি তুমি দেখতে পেলে না । - মুখটা তো বাদ গেছে । সেটা তো তেমনই সুন্দর আছে । - হ্যাঁ, মুখটা বাদ গেছে । ওটা হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হতো । জানি না কাল-পরশু বা যে-কোনো মুহূর্তে সেটারও অবস্থা কী হবে । তেমন কিছু হলে কাউকে আর মুখ দেখাব না । তোমাকেও না, মনে থাকে যেন । - যা বেরোনোর বেরিয়ে গেছে । নতুন করে আর কিছু বেরোবে না । এখন তো আমাদের অপেক্ষা করার পালা । ডাক্তার তো আশ্বাস দিয়েছে । তার খেলা তো শুরু হয়ে গেছে । আগে বাড়িয়ে পরে কমানোর খেলা । আমরা জানি ব্যূহের মধ্যে যে ঢুকে পড়েছে সে নিশ্চয় ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে । এখন শুধু যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে রেবার কোনো গাফিলতি ছিল না । সময় যত চলে যেতে থাকে তত ডাক্তারের গলায় ফুটে উঠতে থাকে অনুশোচনা । শেষে সে এড়িয়ে যেতে চায় রেবাকে । কালক্রমে ক্লেদ শুকিয়ে আসে, কিন্তু মুখমণ্ডল ছাড়া আর সর্বত্র রেখে যায় অভিমন্যুর পরাজয়ের স্মারকলিপি । কোনো পুরুষ কি সেই স্মারকলিপি অগ্রাহ্য করে তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে ? পারা সম্ভব ? পরবর্তীকালে তার বিবাহসংক্রান্ত কোনো উদ্যোগের অঙ্কুর যখনই প্রতিভাত হয়েছে তখনই তাকে প্রতিহত করার পক্ষে যথেষ্ট হয়ে রেবার এই স্বরচিত প্রশ্ন । এই প্রশ্নের উত্তর কেউ এখনো দিতে পারেনি বলে রেবা তার ঘরে তার সেই প্রতিকৃতির সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে বছরের পর বছর । সে যখন পথে বেরোয় তখন তার শরীরের যে আবৃতি তা তার মুখের অনাবৃতির সঙ্গে গোপন প্রতিযোগিতার নামে । আর তারও কোনো মীমাংসা হয় না ।

    - কী ভাবছ এত বাইরে দাঁড়িয়ে ? দিদি ফোন করেছিল । কাকাবাবু এসে গেছেন । শ্মশানে যাবে না ? রেবার অক্ষত বা অনাহত মুখের হাসি ধীরেন্দ্রর অন্যমনস্কতার দুর্গে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয় । - আমি বলি কি, মুখ শুকিয়ে গেছে, একটু জল খেয়ে যাও । চা খাওয়ার মতো সময় তো আর এখন হবে না । তার সম্মতির অপেক্ষা না করে রেবা জল নিয়ে আসে । হ্যাঁ, পানীয় জল । ধীরেন্দ্র নিজেও জানে না সে তৃষ্ণার্ত কিনা । তবু সে বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের জলপাত্র গ্রহণ করে । জল খেতে খেতে তার মনে হয়, খুব ভালো হতো যদি সে জল পান করতে পারত অঞ্জলি ভরে । এই দিবাবসানে পৃথিবীর আঞ্চলিক প্রতিনিধি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে উত্সারিত জল গ্রহণ করবার অধিকার সে বোধহয় এতদিনে অর্জন করেছে ।

    (ক্রমশ :)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments