• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | উপন্যাস
    Share
  • বর্নবাসী : সুভাষ ঘোষাল



    প্রেমাংশুবাবুর মেয়ে নীলিমা । তাঁর ভাইপো ধীরেন্দ্র । নীলিমা বেলা এগারোটায় কাঁদতে কাঁদতে ধীরেন্দ্রকে জানিয়েছে -- বাবা, বাবা এইমাত্র চলে গেলেন । নীলিমার কথা শোনার জন্য কানে ঠেকাতে হয়নি কোনো যন্ত্র । প্রাপকের এই সুবিধে আছে যে, বইয়ের আলমারির ওপরে রাখা যন্ত্রের কোনো এক জায়গায় আঙুল রাখলেই প্রকাশ পেতে থাকে প্রেরকের কন্ঠস্বর । ফলে খুব মুক্তভাবে, দুটো হাতকেই অব্যবহৃত রেখে ধীরেন্দ্র শুনতে পায় মৃত্যুসংবাদ । আর কান্নার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসে ঘোষণা -- যে যাই বলুক, দাহকর্ম এখানে হবে না । তোমাদের ওখানেই বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি । ছমাস আগে নীলিমা মাকে হারিয়েছে । মায়ের দাহকর্ম তাদের অঞ্চলেই হয়েছিল । মায়ের মা, মায়ের বাবা, মায়ের দাদা সবাই যেখানে ভস্ম হয়েছেন সেখানে মায়ের ভস্মও উত্পন্ন হোক এই যুক্তির বিরুদ্ধে যেতে চায়নি সে । বাবার মা বাবা দাদা ভাই যে অঞ্চলে নিরাকার হয়েছেন বাবাও সেখানে নিরাকার হবেন এই যুক্তির সপক্ষে থাকতে চেয়েছিল সে । তার অশ্রুধৌত আবেগ তার সেই অবস্থানকে যে আরো দৃঢ় করেছে তা বুঝতে পেরে খুশিই হয়েছিল ধীরেন্দ্র । তাদের বাড়ির কাছের শ্মশানে তার কাকাকে নিয়ে আসা হচ্ছে কয়েক ঘন্টার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত পুজোসংগঠনের শববহনের গাড়ি করে, এ তথ্য দুহাত এবং দুকান খোলা রেখে শুনতে পেলে একটু খুশি কিন্তু হওয়ারই কথা । স্ত্রী যেখানে আগুনের খাদ্য হয়েছেন স্বামীকেও সেখানে আগুনের খাদ্য করা হলে ধীরেন্দ্রকে যেতে হতো কয়েকমাইল দূরে, যানবাহনের নানা প্রতিবন্ধকতা স্বীকার করে নিয়ে, তার জ্যাঠা বাবা কাকা পিসিদের জগতের যিনি শিবরাত্রির সলতের মতো কয়েক বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তাঁকে শেষ দেখা দেখতে । প্রেমাংশুবাবু সস্ত্রীক যে বাড়িতে থাকতেন নীলিমা তার স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে তার খুব কাছেই আছে বরাবর । এত কাছে থাকার সুবাদে বাবা-মার শেষ বয়সের একটা জোর হতে পেরেছিল সহজেই । মায়ের মৃত্যুর সময় সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অটুট রাখতে পেরেছিল । কিন্তু বাবার মৃত্যুতে সে কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে কতটা ভেঙে পড়তে পারে তার প্রমাণ একটা যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়েই পেয়ে যায় ধীরেন্দ্র । -- বাবা, বাবা এইমাত্র চলে গেলেন । -- এই বাক্য প্রসব করার আগে নীলিমা প্রসব করে কান্না । সেই অকালমৃত কান্না তাকে যতটা দুর্বল করে ততটা সবলতা পরিস্ফুট হয় তার সেই ঘোষণার মধ্যে । সংসারে বিচক্ষণ মানুষের সংখ্যা ত্রক্রমবর্ধমান । নীলিমা বুঝতে পেরেছিল আঞ্চলিক অগ্নিক্ষেত্র ছেড়ে দূরের অগ্নিক্ষেত্রের দিকে যেতে চাইলে বিচক্ষণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না । সারা বিশ্ব যেখানে ঘরের কাছেই পৌঁছে যেতে চাইছে, দূর যেখানে নিকট হতে চাইছে সর্বক্ষণ সেখানে নীলিমার সিদ্ধান্ত জনসমর্থন লাভ করতে পারে না । তাদের পাড়ায় কি নেই ? দেশি ব্যাঙ্কের পাশাপাশি শাখা খুলেছে সাগরপারের গন্ধে ভরা ব্যাঙ্ক । পাড়ার দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে এমন সব সাবান যেগুলি পাঠিয়েছে দেশান্তরের সেইসব উদ্যোগীরা যারা হাতে নিয়ে বসে আছে জয় মাপার ফিতে । এমনকি পাওয়া যাচ্ছে দম্পতির ব্যক্তিগত উদ্যোগে মোড়ের মাথায় তিব্বতের জলখাবার । নীলিমার মুখে তা বেশ রোচে । প্রেমাংশুবাবুও যে তার স্বাদ নিয়েছেন তা কোনো গোপন তথ্য নয় । যেখানে আঞ্চলিকতা এই শব্দটি এত বছর বাদে সত্যিই পেতে চলেছে অর্থগৌরব সেখানে প্রেমাংশুবাবুকে নিয়ে দূরের যাত্রা শুরু করতে গেলে কান্নার মধ্যে থেকেই বের করে আনতে হয় ঘোষণাকে । -- যে যাই বলুক দাহকর্ম এখানে হবে না । তোমাদের ওখানেই বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি । ফলে শ্মশানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে ধীরেন্দ্রকে ।

    ঠিক কখন এসে পৌঁছোবেন প্রেমাংশুবাবু তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না ধীরেন্দ্রর । নীলিমার বেলা এগারোটার ভাষা থেকে বিকেলের আভাস পাওয়া গেছে । সাডে চারটের সময় ধীরেন্দ্র আর কিছুতেই বাড়ি থাকতে পারেনি । একটা অস্থিরতা তাকে কেবলই ঠেলে দিতে চাইছিল সদর দরজার দিকে । তার বুদ্ধি থেকে বা তার যুক্তির কেন্দ্র থেকে এই আশ্বাস মিলেছে যে, শ্মশানে কাকার দেহ এসে গেলে কেউ-না-কেউ ঠিকই ফোন করে জানাবে ভাইপোকে । কিন্তু তার বোধ একটা অনিশ্চয়তার ছবি আঁকছিল । এমনও তো হতে পারে, দেহ এসে পৌঁছোনোর পর দেখা গেল আর কোনো অপেক্ষারত দেহ নেই চুল্লির সামনে । তখন তো কাকাকে অগ্নিগর্ভে ঢোকানোর ব্যস্ততায় সমাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে চারিদিক । সেই সমাচ্ছন্নতার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কে আর তার সঙ্গে যোগাযোগের আটটি সংখ্যায় আঙুল রাখবে নির্ঘাত ? শ্মশানযাত্রীর প্রতি এতখানি বিশ্বাস রাখার জন্য যে মনোবল দরকার তা ধীরেন্দ্রর নেই । ফলে পাঁচটায় না বেরিয়ে সে ঠিক সাড়ে চারটের সময় শ্মশানের দিকে হাঁটতে শুরু করে এবং পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় সেই তোরণের সামনে যেখানে কেউ অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না । সে একবার ভেতরটা দেখে আসতে চাইল । চুল্লির সামনে যারা শুয়ে আছে তাদের মধ্যে প্রেমাংশুবাবু নেই । শব বহন করে নিয়ে আসে যেসব গাড়ি তেমন কোনোটাকে দেখা গেলেও তার ভেতরে কোনো মনুষ্যাবয়ব দেখা যায় না । তবু সে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি । তার মনে হয়েছে দুটি চুল্লির ভেতরে ইতিমধ্যে যারা ঢুকে পড়ে অগ্নিময় তার কাকা তাদের মধ্যে অন্যতম কিনা । এই ভাবনাও অস্থিরতাকেই উসকে দেয় । ফলে সে একাই ছড়িয়ে পড়তে চায় চতুর্দিকে । সে একবার মরা গঙ্গার দিকটায় চলে যায় । একবার যায় সেই ছাউনির তলায় যেখানে বেশ কয়েকটা বসার জায়গা আছে । যারা বসে আছে তাদের মুখমণ্ডল তার কাছে একেবারেই অচেনা । এমনকী যে মেয়েটি নীরবেই চোখ মুছছে তার কোথাও নীলিমা নেই । চুল্লি ও তার সামনের জায়গাটাকে যদি মঞ্চ ধরা হয় তবে সেই মঞ্চের নীচে পাখার তলায় যথেষ্ট আসন আছে দর্শকের জন্য । সেখানেও কোনো পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে চায় এই ভেবে যে, তার কাকাকে যারা নিয়ে আসছে তারা এখনো পৌঁছোতে পারেনি । সে তোরণের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পথের দিকে এমনভাবে মুখ করে যে, যারা আসছে, যাঁকে নিয়ে আসছে সকলেরই অভ্যর্থনার ভার তার ওপরেই এসে পড়েছে নি:শব্দে ।

    কী দাদা, আপনি এখানে ? কে গেলেন ? ধীরেন্দ্রর দিকে এগিয়ে আসে প্রশ্নকর্তা । সে তার কাকার কথা বলে এবং এ-কথাও বলে যে, কাকা যাওয়া মানে পিতৃকুলে একটা সময়ের আর কেউই জীবিত রইলেন না । প্রশ্নকর্তাকেও জিজ্ঞেস করা হয় তার গন্তব্যস্থল সম্পর্কে । সে একটি কালির কারখানায় কাজ করত । সে-কারখানা বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যায় । কারখানা খোলার নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে মরণ আর আত্মহননের পর যারা বেঁচে আছে তাদের আবার সঙ্ঘবদ্ধ করে । -- কী হবে জানি না । তবে চেষ্টা যখন চলছে, চিঠিও যখন পেলাম তখন একবার তো গিয়ে দেখতেই হয় অবস্থাটা কী । এদের কারখানার নীল কালিটা বেশ একটা মর্যাদার আসন পেয়েছিল । তখন ঝর্নাকলমের যুগ । কালি ফুরিয়ে গেলে নীলের তারল্যকে ঢালা হতো কলমের মধ্যে গভীর দাগের কথা মাথায় রেখে । সেই কালি দিয়েই তো প্রথম কবিতা লেখা শুরু হয় । উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে কেউ বাবা-মাকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিল । কেউ গিয়েছিল এমন জায়গায় যেখানে দিদি-জামাইবাবুর যত্ন এবং পর্বতের ঔদার্য মেলে একই সঙ্গে । কেউ অরণ্য দেখবে বলে ঠিক খুঁজে নিয়েছিল মাসির বাড়ি । ধীরেন্দ্র কোথাও যেতে পারেনি । সে হলুদ প্রচ্ছদের খাতার কাছে গিয়েছিল নীল কলম নিয়ে । এখনো মনে আছে কিছু কিছু লেখা যা কোনোদিন কোথাও বেরোবে না । যেমন, উত্তরে ছোটে তীর্থের যত কাক / রোদ্দুরে শুধু রিক্তের অনুতাপ । এর পরের ছত্র কিছুতেই আর মনে পড়ে না বলে ধীরেন্দ্র চলে যেতে চায় শেষ ছত্রে যেখানে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা ছিল -- যতীন তুমি কি এখনো জ্যোতির্ময় ? শ্মশানের সামনে অপেক্ষা করতে করতে সে বানান নিয়েও ভাবতে চায় । শব্দটা যদি হয় যতীন্দ্র তবে কি যার জ্যোতির্ময়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সে ই-কার নিয়েই থাকবে ? কিন্তু সুদূর অতীতে সে কিন্তু লিখতে চেয়েছে যতীন । নীল কলম নিয়ে একবার সে এ-কথাও লেখার সাহস পেয়েছিল -- সুতোর খেলা তাইতো ছেঁড়ার ভয় । হলুদ প্রচ্ছদের সেই খাতাটা হারিয়ে গেছে । ধীরেন্দ্রকে যে প্রশ্ন করে সেও হারিয়ে যাচ্ছে কারখানার দিকে যেতে যেতে । ধীরেন্দ্রর হাতে যে ঘড়ি সোনালি সেখানেও হারিয়ে যাওয়ার খেলা চলছে একটু একটু করে । কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তা সে নিজেও জানে না । কে গেল ? এই প্রশ্ন তাকে আবার সজাগ করে । মিষ্টির দোকানের সেই ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন করছে । যে উত্তরের জন্য দাঁড়ায় না বিন্দুমাত্র, তার প্রশ্নের আর উত্তর দেওয়া হয় না কখনো । ছেলেটি তার মামার মিষ্টির দোকানে কাজ করে । কারিগরদের সঙ্গে থেকে থেকে সে কাজ শিখেছে । মামা তাই নির্ভয় । কোনো কারিগরই তাকে ভয় দেখাতে পারে না । ভাগ্নে গামছা পরে খালি গায় বসে যেতে পারে ছানার তাল হাতে করে । ছেলেটি কয়েক মাস বাড়ির দাওয়ায় বসে থেকেছে । যেতে আসতে ধীরেন্দ্র তার ভাঙা পায়ের খোঁজ নিয়েছে । ভাঙা পায়ের প্লাস্টারও একটা শুভ্রতার স্তূপে পরিণত হয়েছিল । সে তার পায়ের দু:খের কথা বলত পথচারীকে । চিকিত্সকের দয়ার কথা বলত । বলত সেই সংশয়ের কথা যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একদিন তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য । -- কী দাদা, আবার উঠে দাঁড়িয়ে কাজে যেতে পারবো তো ? ধীরেন্দ্র পথ দিয়ে যেতে যেতে কতবার যে থেমেছে তার সামনে । কতবার যে সেই বিশ্বাসের কথা বলেছে যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নিজের পায়ে হেঁটে গিয়ে ছানা ডলার শক্তি । তার কোন পাটা ভেঙেছিল এখন আর তা জোর দিয়ে বলতে পারবে না সে । তবে সে দেখেছে যে দাওয়ায় চুপ করে বসে থাকত পায়ের শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে, তার পরিচিত মানুষ দেখলে পায়ের দু:খ নিয়ে কথা বলার যে ইচ্ছে হতো তা একসময় শেষ হতো নিজের কপালকে ধিক্কার জানিয়ে । ধীরেন্দ্রর নিজের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রশ্ন -- এভাবে আর শ্মশানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দায় কতক্ষণ ? তার ইচ্ছে করে পাকে বিশ্রাম দিয়ে কিছুক্ষণ পথচারীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ।

    শ্মশানের তোরণ থেকে চুল্লির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ধীরেন্দ্র দেখে বাঁদিকের ছাউনিটা কেবল গোল নয়, কোনো কথার গোলমালও নেই সেখানে আপাতত । যারা বসে আছে তাদের পাশেই রয়ে গেছে বেশ কয়েকটা বসার জায়গা আপনমনে । ধীরেন্দ্র উপবেশনের জন্য প্রলোভিত হয় এবং বেছে নেয় সেই আসন যেখানে ঠেস দিয়ে বসলে চুল্লির দিকে যারা যাচ্ছে এবং যারা ফিরে আসছে চুল্লির দিক থেকে তাদের সবাইকেই লক্ষ করা যায় ইচ্ছে হলে । পা ঝুলিয়ে বসে পড়ার পর সে বুঝতে পারে এই বিশ্রামের কত প্রয়োজন ছিল, পায়ের দিক থেকে বিশেষ করে । খুব ভালো হত যদি সে পা তুলে এবং পা মেলে বসে থাকতে পারত কিছুক্ষণ । কিন্তু তার কাছে আপাতত অতটা প্রসার নেই । থাকলেও সে বোধ হয় পারত না ওই ভঙ্গি বেছে নিতে নিশ্চিন্তে । একটা দল চুল্লির দিক থেকে তোরণের দিকে আসছে । একজন ভেঙে পড়েছে কান্নায় । তার ডানদিক এবং বাঁদিক দুদিকেই মানুষ । সে দুটো হাত রেখেছে দুজনের কাঁধে । ফলে পায়ের ওপর তার নির্ভরতা কমেছে । সেই সঙ্গে নির্ভরতা বেড়েছে শোকের ওপর । ধীরেন্দ্র চায় শোক তাকে স্পর্শ করুক । সেই শোক যা স্পর্শ করেছে নীলিমাকে । কাল রাতে যে ছবি সে দেখেছিল তার কোথাও শোক ছিল না । কাল রাতের ছবিতে ছিলেন প্রেমাংশুবাবু । কাকাকে সে কোনোদিনও দেখেনি ফুলপ্যান্ট পরতে । ধুতি আর পাঞ্জাবি এই ছিল তাঁর চিরদিনের পোশাক । কিন্তু ছবিতে তিনি পরেছিলেন সাদা ফুলপ্যান্ট আর সাদা জামা । তিনি চিরকাল এমন পাঞ্জাবি পরতেন যার দৌলতে পুরোপুরি ঢাকা পড়ত তাঁর হাত । শুধু প্রকাশিত হয়ে থাকত দশটি আঙুল । কিন্তু প্যান্টের সঙ্গে কাল তিনি যে জামা পরেছিলেন তাতে কনুইও থাকে অনাবৃত । তাঁকে খুব সপ্রতিভ দেখাচ্ছিল । সাদার সঙ্গে সাদার যোগফলে যে শুভ্রতার সৃষ্টি হয় তা কিন্তু পাল্লা দেয় প্লাস্টারের শুভ্রতার সঙ্গে । প্রেমাংশুবাবুকে খুব ব্যস্ত দেখেছিল ধীরেন্দ্র । তাঁর ব্যস্ততা তাঁর সপ্রতিভতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি । তিনি একটা কালো ঘরের কেন্দ্রে সামান্য উচ্চতায় দাঁড়িয়েছিলেন । তাঁকে যারা ঘিরে রেখেছিল তিনি খুব দ্রুততার সঙ্গে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন এক এক করে । তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল শিগগিরই আঞ্চলিক শুভ্রতার মাধ্যমে তিনি এই স্থান ত্যাগ করবেন । নিদ্রিত অবস্থায় এই ছবি দেখতে দেখতে ধীরেন্দ্র ভয় পায় । কালো ঘরের মধ্যে ছিল কোনো-না-কোনোভাবে আত্মার এমন অবমাননা যা কেমন এক সংকটের সৃষ্টি করে । কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় । ভয়ের পাশাপাশি ছিল একটা জয়যাত্রার বোধ । দুটো ভাবের দ্বৈরথে তার ঘুম ভাঙে । সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দেড়টা । তার মনে হয় অন্তত একটা বাক্য এই মহানিশীথে তার উচ্চারণ করার দরকার আছে । তার খুব কাছেই নিদ্রিত যে তাকে সবকথা বলা যাবে না, কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে এই চাপ থেকে তাকে সে জাগায় খুব সৌজন্যের সঙ্গে । -- একটা কথা শুধু বলি । এত রাত্তিরে আর কিছু জানতে চেয়ো না । কাল নীলিমা খবর দেবে । তার আগে আমি একটু জানিয়ে রাখি । কাকা কিন্তু চলে যাচ্ছেন । প্রতিমা থমকে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর পাশ ফেরে । -- যা কষ্ট পাচ্ছিলেন চলে যাওয়াই ভালো । একদিন নীলিমার সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিল ধীরেন্দ্র । দাদা, বাবার এই অসুস্থতার আগে তিনি মাঝে মাঝে তোমার কথা বলতেন । তোমার ওপর ওঁর অনেক আশা ছিল । হাসপাতালে আসতে তোমার খুব খারাপ লাগে জানি । তবু একবার যদি আসতে । সকালের দিকে মাঝে মাঝে একটু জ্ঞান আসে মনে হয় । তুমি একদিন সকালে আসবে ? খুব অনিচ্ছার সঙ্গে গিয়েছিল ধীরেন্দ্র । হাসপাতালের দরজায় সে একটু আগেই গিয়ে পৌঁছোয় বলে সে শুধু নীলিমারই অপেক্ষা করে না সেই সঙ্গে বাঙ্ময় পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা কোনো দৃশ্যের অপেক্ষা করে যা মূলত নির্মিত অনাবশ্যকতা দিয়ে । একটা গোল বাঁধানো চত্বরে যে উবু হয়ে বসে পরামর্শ দান করছে তার সঙ্গে মৃত্যুর যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পর্ক মর্গের । তার কথা শুনতে শুনতে মনে হয় এই জীবনের কোথাও-না-কোথাও অমরতা লাভ করতে চলেছে মর্গ । যে উবু হয়ে ত্রক্রমশ বিচক্ষণ হয়ে উঠতে চাইছে তার মাতৃভাষার সঙ্গে সে যে-দেশে কর্মরত তার মাতৃভাষা মিশে যাওয়ায় আরো মুখরোচক হয়ে উঠেছে বক্তব্য । ধীরেন্দ্র আর দাঁড়িয়ে না থেকে তার পাশের খোলা জায়গায় বসে পড়ে । দশ বছর আগে এই হাসপাতালে মহালয়ার পরে কোনো এক বিকেলে সে বাবার খাটের পাশে বসে পড়েছিল । দেবীপক্ষ তখন প্রবল । পিতৃদেব মেরুদণ্ড সোজা করে বসে মুখে এনেছিলেন চাপা হাসি । তিন-চারদিনের জন্য যিনি পরীক্ষাধীন হয়ে থাকতে এসেছেন তিনি যথাসময়ে পেয়ে গেছেন কৌতুকের উপকরণ । আত্মজকে তিনি হেসে হেসে জানিয়েছেন, প্রাণের চিরকালীন যে স্পন্দন তার গোলযোগ দূর করার জন্য যারা সহায়ক যন্ত্র বানায় তাদেরই টাকায় কাল হাসপাতালে উত্সব হয়েছে । খাওয়াদাওয়া আর কোলাকুলি হয়েছে । চিকিত্সক আর ব্যবসায়ীদের এই সংস্কৃতির ফলে এমন অনেক বুকে সেই মহার্ঘ যন্ত্র বসবে যেগুলি যন্ত্র ছাড়াই কাজ চালিয়ে নিতে পারবে স্বচ্ছন্দে । পিতা তাঁর পুত্রকে সাবধান করে দিয়েছিলেন । প্রভাতে দুধ আনতে গিয়ে তাঁর জ্ঞান হারানোর পেছনে সত্যিই যদি কোনো স্পন্দনের বিপর্যয় থাকে তবু যেন কোনোভাবেই তাঁকে যান্ত্রিক না করা হয় । -- আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে । আর এই পৃথিবীতে না থাকলেও চলবে । আমার সন্তান ঘটিবাটি বেচে আমাকে আটকে রাখুক এ আমি কিছুতেই হতে দেব না ।

    হাসপাতালে নীলিমার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে বাবার সেই চাপা হাসি যত মনে পড়েছে ততই মনে হয়েছে তার ব্যাপকতার কথা । সেটা আর কেবল একটা মুখেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে মুখ থেকে মুখে । নীলিমার আসতে সামান্য দেরি হয় । কিন্তু সে তার কাছে প্রকাশিত হয় না তত্ক্ষণাৎ । ধীরেন্দ্র নিজেই বহুবার রচনা করেছে অনেক খেলা নিজেরই জন্য একেবারে । সেদিন হাসপাতালেও সে গড়ে তুলেছিল এমন একটা খেলা যা পাঁচ মিনিটে শেষ করতে পারলে মন্দ লাগে না কিন্তু । নীলিমা প্রবেশপথের সামনে হাজির হয়ে প্রথমে ঘড়ির দিকে তাকায়, তারপর দেখে নিতে চায় তবে সেই দৃষ্টিপাতের মধ্যে অখণ্ডতা এসে পড়ায় নীলিমা তাকে আলাদা করে আর বুঝতে পারে না । সে হয়ে পড়ে একটা দিকের সমগ্রতার একটা অংশ কেবল । এই সুযোগটাই গ্রহণ করে সে । শুরু হয়ে যায় তার নতুন খেলা । অপেক্ষারত নীলিমা অপেক্ষাই করতে থাকে এবং সে চায় ধরা না দিতে । হাসপাতালের প্রবেশপথে সন্ধানী যত সজাগ থাকতে চায়, যত লক্ষ করতে থাকে বাস থেকে নেমে পড়া লোকজন, উপবিষ্ট অবস্থায় ততই নিজেকে অবিচল করে রাখে ধীরেন্দ্র । এক-একবার নীলিমা রাজপথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খানিকটা, এক-একবার চুল ঠিক করে নিচ্ছে, মুখ মুছছে রুমালে । পেছন থেকে সবকিছু দেখতে দেখতে একসময় সে বুঝতে পারে এবার ধরা দেওয়ার সময় হয়েছে । আর খেলা চালিয়ে যাওয়ার খুব একটা অর্থ নেই । চারিপাশের শত ব্যস্ততা, শত রোগ, অনেক আসন্ন বিচ্ছেদ এবং অনেক সমাসন্ন অসহায়তার পটভূমিতে ধীরেন্দ্র খুব পরিষ্কার গলায় ডেকে ওঠে -- নীলিমা । আর বলা ভালো যে, এই ডেকে উঠতে পারার মধ্যে এমন একটা বাঁশির ভূমিকা ছিল যা চিরকালই গোলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চায় নির্বিবাদে । নীলিমার মুখেও প্রসন্নতা আসে । তুমি এসে পড়েছো ! কোনদিক থেকে এলে ? আমি তো ভাবলাম তুমি বোধহয় আর এলেই না । চলো, তাড়াতাড়ি চলো । এখন বড়ো ডাক্তার আসবেন । তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে । লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে আশ্বস্তও করে । তোমাকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে কষ্ট করে পাঁচতলায় উঠতে হবে না । ওইভাবেই ওঠা নিয়ম যদিও, আমাকে সেসব করতে হয় না । রোজ আসতে আসতে চেনা-পরিচয় হয়ে গেছে । নীলিমা ধীরেন্দ্রকে ছায়া আর গলির অনুভূতি দেয় কিছুক্ষণ । তারপর এনে দাঁড় করায় আলো জ্বলে ম্লানিমাও থাকে এমন একটা চারকোণা ঘরের সামনে । এসো, ভেতরে এসো । ভেতরে গিয়ে তাকে ত্রক্রমশই পিছিয়ে যেতে হয় । এমনকী তার পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে । কারণ ঘরে ভিড় বাড়ে । যাদের অনুব্রতী বলা হয় তাদেরও কেউ কেউ এসে পড়ে । এমনকী এই ঘরের মধ্যে শেষ মুহূর্তে ঢোকে সেই যান যাতে রুগী বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয় হরদম । ঘর বন্ধ হয় । একজন পরিচালকের ভূমিকায় নামে এবং তার আঙুল ছুঁয়ে যায় বোতামের পর বোতাম । ফলে নীলিমা, ধীরেন্দ্র এবং ঘরের আর সবাই ওপরে উঠতে থাকে । ধীরেন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখতে পায় হাসপাতালের এক-একটা বিভাগ, যারা শুভ্রতা ধারণ করে আছে তাদের একদিক থেকে আর একদিকে হেঁটে যাওয়া, সর্বোপরি একটা সমাবেশ যা আরোগ্যকে খুঁজে পেতে চাইছে ত্রক্রমাগত । দাদা, আমরা এসে গেছি । -- নীলিমার এই কথাই তাকে পাঁচতলায় পা রাখতে সাহায্য করে । ধীরেন্দ্র প্রেমাংশুবাবুর শিয়রের কাছে পৌঁছে বুঝতে পারে এক-একজন মানুষ কালক্রমে কতো দূরে সরে যেতে পারে আরোগ্যের থেকে । নীলিমা পিতার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে । বাবা, দ্যাখো কে এসেছে । চোখ বন্ধ । একটা আচ্ছন্নতা বিরাজমান । ফলে নীলিমা যত্নবান হয় আবার । এবার আস্তে আস্তে কোন এক পাঁচতলায় কোনো এক পিতা তাঁর কন্যার দিকে দিনের আলোয় চোখ মেলেন । সেই ভাষাহীন চোখ কারো কোনো উপকারে আসে না । নীলিমা চায় না এত সহজে পরাজিত হতে । বাবা, বলো তো আমি কে ? আমি তোমার কে হই ? তোমার কটা মেয়ে বাবা ? তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ? কোনো প্রশ্নেরই কোনো প্রতিক্রিয়া আবিষ্কার করতে পারে না নীলিমা অথবা ধীরেন্দ্র । অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে দুজন মানুষের ব্যর্থতা সত্যিই সমপরিমাণ । ধীরেন্দ্র যার হাত ধরে তার অসফলতা তার অশ্রুর জন্ম দিয়েছে । যিনি সাধারণত সকালের দিকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও সেই চেতনাকে উপহার দিয়ে থাকেন যার সঙ্গে সকলের পরিচয় আছে, তিনি যে শেষে এতটাই অনুদার হবেন, এমনকী চিনে উঠতে পারবেন না আত্মজাকে, এটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল সেই আসন্ন মধ্যাহ্নের আলোয় যখন একটা বেশ বড়ো ঘরে শয্যা থেকে শয্যায় ছড়িয়ে পড়তে চাইছে ডাক্তারের দল । সেই দলে একজনেরই তারুণ্য কিছুটা কমে এসেছে । বাকি সবাই যৌবনেরই প্রতিনিধি অথবা বিজ্ঞাপক । নীলিমা চোখ মুছতে মুছতে প্রেমাংশুবাবুর মুখমণ্ডল তথা চোখের কাছ থেকে সরে এসে অদূরবর্তী সেই দলের দিকে সেই একজনকেই চেনানোর চেষ্টা করে । -- ওই যে রোগা, ফরসা, লম্বা ভদ্রলোক, ওই যে চশমা চোখে, কথা বলছেন ছেলেটার সঙ্গে, উনিই বড়ো ডাক্তার । দেশ-বিদেশের অনেক ডিগ্রি আছে । আমাকে একটু কথা বলতে হবে । আমি আসছি, একটু অপেক্ষা করো । ধীরেন্দ্র সামান্য সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । আর তখনই তার মধ্যে যুক্ত হওয়ার প্রেরণা জাগে । সে এতক্ষণে চারিদিকে তাকিয়ে দেখার সুযোগ পায় । আরোগ্যকামনায় যারা বিভিন্ন শয্যায় বসে বা শুয়ে আছে তাদের কেউই তার পরিচিত নয় । বহু বছর প্রেমাংশুবাবুর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না বলে তাঁর মুখমণ্ডলও যেন অপরিচয়ের পরগণায় স্থান পেয়েছে । কেউ বিছানা থেকে নেমে আবার বিছানা ছুঁয়েই বসে থাকতে চাইছে পা ঝুলিয়ে । কেউ এমন অবস্থানে আছে যা শয়ন এবং উপবেশনের সংমিশ্রণে রচিত হলেও যথেষ্ট সম্ভাবনাময় । কেউ কুদর্শন হয়েও সহাস্য হয়ে আছে কোনো লাবণ্যময়ীর উপস্থিতিতে । ধীরেন্দ্র জেনেছে চিকিত্সকরা চলে গেলেই দুপুরের খাবার আসবে । শিয়রে দাঁড়ানো অনুব্রতীরা ব্যস্ত হয়ে পড়বে যারা গ্রহণক্ষম তাদের সাহায্যে । প্রেমাংশুবাবুর খাবার নাক দিয়ে প্রবেশ করাতে হয় । ফলে তাঁর অনুব্রতী অল্পবয়স্ক হলেও কৃত্কৌশলী । নীলিমা বড়ো ডাক্তারের কাছে পৌঁছোনোর আগেই বড়ো ডাক্তার পৌঁছে গেছেন তার কাছে । ফলে দুজনের কথা শুরু হয়েছে । হাতে সুদর্শন থলি নিয়ে, বস্তুর ভার বহন করেও অনায়াসে কথা চালিয়ে যেতে পারছে না কোথাও । অগত্যা সে আবার সরে আসে সেই শয্যার কাছে যেখানে শুয়ে আছে তার পিতার অত্যন্ত স্নেহভাজন অনুজের আশি বছরের অবয়ব । অবয়ব যতটা সম্ভব আবৃত রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে । কারণ মধ্যাঞ্চল ছেয়ে গেছে শয্যাক্ষতে । যারা আরোগ্যকামনায় এসেছে তাদের চোখে পড়লে বিরূপ প্রতিক্রিয়া যাতে না ঘটে তার জন্য এই সতর্কতা । ধীরেন্দ্র তার বাল্যকালে দেখেছে শীত এলে প্রেমাংশুবাবু যে গরম জামা পরতেন তাতে খয়েরি রংয়ের রাজত্ব ছিল । জামার বিস্তার মণিবন্ধ পর্যন্ত পৌঁছে যেত । মণিবন্ধের বোতাম আটকাতে আটকাতে ভ্রাতুষ্পুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি যে ভাবটা প্রকাশ করতে চাইতেন তার মধ্যে একটা অনিরুদ্ধতা ছিল যে কোনো বিচারে । অঙ্কগুলো করে রাখিস । যেটা পারবি না সরিয়ে রাখবি । আমি ফিরে এসে দেখিয়ে দেব । চিন্তার কী আছে ? স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এ-কথাও বলেছেন -- একবার ছেলেটাকে অঙ্কের মজাটা ধরিয়ে দিতে পারলে হয় । ততক্ষণে হয়তো জামা হয়ে উঠেছে শরীর ও মনের পরমাত্মীয় । না হলে তো স্ত্রীর হাত থেকে পানের খিলি নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হবে না । ধীরেন্দ্রর মা নিজের হাতে পান সেজে ডিবেতে রাখতেন । একটা কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল বলেই তার কাকিমা পারতেন ঠিক সময়ে স্বামীর হাতে এমন কিছু তুলে দিতে যা স্বস্তিদায়ক । সে এ-কথাও গমনোদ্যত কাকার মুখ থেকে নির্গত হতে শুনেছে -- ভুলেও কখনো নিজের হাতে পান সাজতে যাবে না । বৌদির হাতের পান ছাড়া আমার চলবে না একদিনও । তিনি একদিন নতুন কোনো অনুভবে তাড়িত হয়ে লরি ডেকে এক এক করে তাঁর জিনিস তোলেন । যিনি নতুন বাসস্থানের দিকে যাত্রা করেন তিনি একদিন সেখান থেকেও নিরুদ্দেশ হয়ে যান । অফিসের পর তিনি আর বাড়ি ফেরেন না । রাত বাড়তে থাকে এবং কমতে থাকে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা । শেষে প্রেমাংশুবাবুর শ্যালকেরা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন দিকে । ফলে একদিন মহানিশীথে ধীরেন্দ্র শুনতে পায় তার বাবার নাম বেশ পরিষ্কার করে উচ্চারিত হচ্ছে বহির্জগৎ থেকে । শীতের রাতে গুটিয়ে থাকা শরীরে সেই শব্দ বেশ খানিকটা তাপের কাজ করে । সে আর বিছানায় থাকতে পারে না । ঘুমচোখে বাইরের ঘরে এসে দেখে কাকিমার ভাইরা ব্যাকুলভাবে জানতে চাইছেন কাকার কথা । তিনি একদিন স্বত:প্রণোদিত হয়ে যে ঘর ছেড়েছিলেন সেই ঘরেই তাঁকে আবার ফিরিয়ে এনেছে কিনা স্বত:প্রণোদন এই প্রশ্নের উত্তরে তার বাবা তাঁদের নিরাশ করায় তাঁরা কালহরণ না করে স্থানত্যাগ করেন ।

    কোনো অনুসন্ধানই কিন্তু কাজে লাগে না । প্রেমাংশুবাবু ঠিক চব্বিশ ঘন্টা পরে নিজেই ফিরে আসেন এবং তাঁর অগ্রজের সামনে এসে দাঁড়াতে ভুল করেন না । ধীরেন্দ্র মনে রেখেছে, তার বাবা অনুজের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে রহস্য ভেদ করতে চেয়েছিলেন । অনুজও প্রকাশ করেছিলেন প্রাণের কথা । স্ত্রীর সঙ্গে ক্ষণিকের মনোমালিন্য তাঁকে অপ্রতিষ্ঠিত করায় তিনি নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন রেলকামরায় জানালার পাশে বসে । অনেকটা যাওয়ার পর যখন বুঝতে পারেন ক্রোধ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে তখন আবার ফিরে আসার আবেগকে সম্মান জানান । ফিরে এসে দাদা-বৌদির সঙ্গে সেই সসংকোচ সাক্ষাত্কারের সময় তাঁর গায়ে ছিল সেই গরম জামা যার রং খয়েরি, যা মণিবন্ধকেও আবৃত করে রাখে এবং যা ধুতির সঙ্গে পরলে স্বাদেশিকতারও শির উন্নত হয়ে উঠতে চায় । ঠাকুরপো, অনেক খেল দেখালে । এবার একটা পান খাও । প্রেমাংশুবাবু নত হয়ে মাটিতে বসে থাকা তাঁর বৌদির হাত থেকে পান নিচ্ছেন, লেহন করছেন চুন, এসব দৃশ্য এত উজ্জ্বল যে মনে হয় মহাকালও আর পেরে উঠছে না ।

    সেদিন বড়ো ডাক্তার কথা বলতে বলতে যাঁকে নিয়ে কথা তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন । -- আগেও বলেছি, আবার বলছি জায়গা আটকে রেখে কোনো লাভ নেই । অনেক রুগি অপেক্ষা করছেন । বাড়ি নিয়ে যান । আমাদের যা করার সবই করা হয়ে গেছে । আপনি বরং আজ একটু দেখে যান কী করে নাক দিয়ে খাওয়াতে হয় । দেখুন যদি সামনের রোববার বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন । প্রেমাংশুবাবুর অনুব্রতী বড়ো ডাক্তারের নির্দেশে নীলিমাকে অনুব্রতী করার প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয় এবং একটু অপেক্ষার কথা বলে । একটু অপেক্ষা করলেই দুপুরের খাবার আসতে শুরু করবে । -- তুমি দাদা আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে । তুমি সাবধানে যাও । আমি একটু অপেক্ষা করে নাক দিয়ে খাওয়ানোর কায়দাটা শিখে নিই । চলে যাওয়ার আগে ধীরেন্দ্র প্রেমাংশুবাবুর মাথার দিকে ভালো করে লক্ষ করে । কারণ সেখানেই বাসা বেঁধেছে টিউমার । প্রবল প্রতাপে তার খেলা শুরু হয়ে গেছে । গোল হওয়ার সম্ভবনাগুলো কখন যে সার্থকতায় মণ্ডিত হবে তা হিসেব করে বলা সম্ভব নয় । বড়ো ডাক্তারের একটা আন্দাজ আছে । নীলিমাও সেই আন্দাজকে অশ্রদ্ধা করতে পারে না । তার স্বামীর সঙ্গে প্রতিদিন সকালবেলায় গেঞ্জি আর ছোটো প্যান্ট পরে পুলিশের বড়ো কর্তার সামনের দিকে ধাবিত হওয়ার ছবিটা দেখতে অনেকেরই ভালো লাগে । নীলিমা চাইলে সেই বড়ো কর্তাকে ধরে হাসপাতালে আরো কিছুদিন রেখে দিতে পারত প্রেমাংশুবাবুকে । কিন্তু সে বুঝে গেছে তাতে কোনো লাভ নেই । যবনিকা পড়তে চলেছে । তিনি একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যে বাড়িতে বাসা বেঁধেছিলেন সেখানেই মৃত্যুর বাসা বাঁধার কাজ সম্পূর্ণ হোক । নীলিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে তাকে এবার সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে । তাকে কেউ চেনে না । অচেনা মানুষ কী করে সেই ঘরে ঢোকার সাহস পাবে যে-ঘর যেমন তুলে আনে তেমন নামিয়েও দেয় ধপ করে । সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে ধরতে পারে এক-একটা অবতরণের মধ্যে কী পরিমাণ অস্তিত্বহীনতা ঢুকে পড়ে কোনো শব্দ না করে । সে কী দেখতে এসেছিল, কী দেখে ফিরছে শেষে, এসবের কোনোরকম উত্তর দিয়েই তার আর কোনো কাজ হবে না । যে চাউনির তলায় সে বসে আছে সেখানে বসতে গিয়েও বসে না । পথের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন দেখে এবং এগিয়ে যায় পথের দিকে । ছেলেটির মুখে হাসি । যাঁকে দেখে সে মুখে হাসি আনে তিনি চুল্লির দিকে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন । তিনি দীর্ঘ এবং তাঁর শ্মশ্রুও দীর্ঘতা পেয়েছে । তিনি কোনো গৈরিক বসন পরেননি । অথচ তাঁর অবয়ব তথা চোখের মধ্যে কোথায় যেন কাজ করছে গৈরিকের প্রভাব । ধীরেন্দ্র বসে বসেই তাঁকে দেখতে পায় । এও দেখে যে, ছেলেটি তাঁর পায়ে হাত দিতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয় খুবই । তিনি তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং যে-কথাটা বলেন তা এতই জোরে উচ্চারণ করেন যে, শুধু ধীরেন্দ্র নয়, পিছিয়ে থাকা আরো অনেকেই শ্রোতা হতে পারে স্বচ্ছন্দে । -- এ তো মহাদেবের ক্ষেত্র । বিশ্বমূর্তে,/ নমস্তে নমস্তে চিদানন্দমূর্তে । কাকে নিয়ে এলে ? আমি তো আমার পঞ্চাশ বছরের বন্ধুকে নিয়ে এসেছি । দুটি অবয়বের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকে কথা । ধীরেন্দ্রও একবার প্রণাম করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় । তবে বাধাটা এসেছিল ভিতর থেকে । কেউ বাইরে থেকে থামিয়ে দেয়নি । যে বছর প্রেমাংশুবাবুর চব্বিশ ঘন্টার জন্য গৃহত্যাগ ঘটেছিল তার বোধহয় দু-তিন বছর পরের কথা । খবর আসে ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে তিনি গুরুতর আহত । ধীরেন্দ্র হাসপাতালে যেতে পারেনি । হাসপাতাল থেকে তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর সে একদিন তাঁকে দেখতে যায় । তখন দেবীপক্ষ শেষ হয়নি । সবে মণ্ডপ খুলতে শুরু করেছে যারা মণ্ডপ গড়েছিল একদিন ঠিক তারাই । প্রেমাংশুবাবু চেয়ারে বসেছিলেন । প্রণাম করতে গিয়ে ধীরেন্দ্র বুঝতে পারে পিতৃব্যর পা থেকে একাধিক আঙুল ঝরে গেছে । তার হাত মুহূর্তের জন্য আটকে গিয়েছিল । পদস্পর্শ করতে গিয়ে সে দ্বিধান্বিত হয় । তবে সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠে প্রণামের কাজটা সেরে ফেললেও একটা বিষয়ে সে নিজের কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে যায় । প্রণামের পেছনে কেবল অরূপেরই নয়, রূপেরও ভূমিকা আছে । আর সে ভূমিকাকে কোনোমতেই তুচ্ছ করা যাবে না । প্রেমাংশুবাবু কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেলের কর্মচারী ছিলেন । রেলের কর্মী অসতর্কতার ফলে রেলের কাছ থেকেই সবচেয়ে বড়ো আঘাত পেয়েছেন এমন একটা ধারণা অনেকদিন ধীরেন্দ্র দ্বারা লালিত হয়েছিল । সেটা ভেঙে যায় হঠাৎ একদিন কোনো একরাত্রে । খাওয়া-দাওয়ার পর খাটে বসে তার বাবা তার মায়ের হাত থেকে পান নিতেন । আর দিতেন তাঁর শোনা বা দেখা বা অনুভব করা কথা । তার মা কথার শ্রোতা হতে চাইতেন বরাবর । আর যে-কথা কর্মব্যস্ততার অবসানে স্বামীর কাছ থেকে শুনতে পাওয়া যার তার মূল্যই আলাদা । অন্তত তেমনই মনে হতো তার মাকে দেখে । মা পানের ডিবে স্পর্শ করে মেঝেতে বসে শুনতেন মঞ্চের বক্তব্য । কখনো কখনো যাতায়াতের পথে ধীরেন্দ্ররও সৌভাগ্য হতো দু-একটা উচ্চারণকে কোলের কাছে নিয়ে আসার । আর এভাবেই সে জানতে পেরেছিল যামিনীর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা তার বাবার অভিমত । -- তোমাকে একটা গোপন কথা বলি । প্রেমের এই দুর্ঘটনাটা সে নিজেই ঘটিয়েছে । আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল । শেষে একদিন বৌমার সামনে চেপে ধরলাম । কী হয়েছিল সত্যি করে বল তো । আমি তোর দাদা । আমার কাছে অন্তত লুকিয়ে লাভ নেই । বাবা যখন চোখ বুজলেন তখন তোরা সব ছোটো ছোটো । আমিও যে খুব বড ছিলাম তা নয় । তবু আমাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল । একজনকে তো হাল ধরতেই হবে । তাই আমি যদি বলি আমি তোর পিতৃতুল্য তবে বোধহয় খুব ভুল বলা হবে না । আমার কিছু চেপে রাখাটা অন্যায় হবে । সত্যি করে বল তো কী হয়েছিল সেদিন । প্রথমে তো প্রেম মাথা নিচু করে বসে থাকল । বৌমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । শেষে হতভাগা বলল কী জানো ? দাদা, আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম । এক্ষেত্রেও ব্যর্থতা । এত ব্যর্থতা রাখব কোথায় !

    প্রেমাংশুবাবুর এইমৃত্যুর ঠিক ছমাস আগে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হলেও নীলিমার কাছ থেকে ধীরেন্দ্র শুনেছে শেষ দিকটাতে বৈধব্য নিয়ে তাঁর বেশ আতঙ্ক ছিল । -- তোর বাবার ওই অবস্থা । যদি আমার আগে চলে যায় আমি কী করব বল তো ? প্রেমাংশুবাবুর উল্টোদিকের ঘরগুলোতে যাদের বসবাস তাদের ছোটো মেয়ে তাঁর নিজের মেয়েকে কিছু বলতে না দিয়ে প্রতিবাদ করে উঠেছে । -- এসব আজেবাজে কথা ভাবেন কেন মাসিমা ? আর কি ভাবার কিছু নেই জগতে ? আমরা কি মরে গেছি, না মরে যাব ? আপনি নিজেকে সবসময় একা ভাবেন । এটাই আপনার সবচেয়ে বড়ো দোষ । নিকটতম প্রতিবেশীর বড়ো মেয়ে বিবাহিত । মনোবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখানোর পর থেকে ছোটো মেয়ের কাছে বিয়ের কথা তোলাটাই খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছিল । নীলিমার মুখ থেকে ধীরেন্দ্র শুনেছে, বিয়ের কথা চট করে না ভেবে সে ভাবতে চাইত সেইসব দাম্পত্যের কথা যা দেশ-বিদেশ জুড়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব ফাটলের সৃষ্টি করেছে । এক-একটা ফাটল বাইরের দিক থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে রংয়ের আঁচড় । সেইসব রং খুঁজে বের করে সেগুলির নিরর্থকতা কোথায় তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য কতবার যে এগিয়ে আসতে চেয়েছে মেয়েটি । দাম্পত্য কীভাবে পরিবারের স্বরলিপি তৈরি করে দিতে চাইছে তা পরিস্ফুট করার জন্য যেসব গবেষণা বাইরে থেকে বই হয়ে বেরিয়েছে সে সাহায্য নিত সে-সব বইয়েরও । নীলিমা ধীরেন্দ্রকে তার কাছ থেকে শুনে শেষে এ-কথাও জানিয়েছিল যে, প্রত্যেক পরিবারের কিছু গোপন ব্যাপার আছে । কোনো কোনো পরিবারে এর পরিমাণ বেশি । আবার কোথাও কোথাও তুলনামূলকভাবে কম । কিন্তু গবেষণার বাইরেও মেয়েটি চাইত প্রেমাংশুবাবুর পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতে । নীলিমার মায়ের কত কাজই যে হাসিমুখে করে দিয়েছে সে । তার অনেক বইপত্র পড়ে থাকত প্রেমাংশুবাবুর ঘরে ঘরে । গবেষণার পড়াশোনা করতে করতে কতদিন যে সে নিজের ঘরে না ফিরে নিকটতম দম্পতির ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে, কাটিয়ে দিয়েছে রাত নীলিমার মায়ের পাশে শুয়ে, তার হিসেব নেই কোনো । তাকে দেখে নীলিমাও মনে জোর পেত । একই পাড়ায় তার শ্বশুরবাড়ি হলেও পাড়াটা যথেষ্ট লম্বা । এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যখন তখন ছুটে আসা খুব সহজ কাজ নয় । একটা সংসারের দাবি মিটিয়ে আর একটা সংসারের কর্তব্য পালন করার ক্ষেত্রে যতটুকু ঘাটতি হয়েছে পুষিয়ে দিয়েছে মেয়েটি । গোধূলিতে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক মা আর এক মায়ের কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসছে কিনা তা পথের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইতেন । একদিন নীলিমা স্বামীকে অফিসে পাঠিয়ে মেয়েকে বলেছে -- আজ তো কলেজ নেই তোমার । তোমার বন্ধুর বাড়িও খুব দূরে নয় । হেঁটে বড়ো জোর কুড়ি মিনিট । বন্ধুর বাড়ি রিকশায় না গিয়ে হেঁটে যাও । আর আজ শাড়ি পরো । মাঝে মাঝে শাড়ি পরা অভ্যেস করতে হবে । একদম পরবে না এটা কি খুব ভালো কথা ? আমরা একটা গোলাপি এখনো ভাঙিনি । তোমার রং আমার চেয়ে অনেক পরিষ্কার । তুই আজ এটা পর । আমার কথা শোন, তোকে সত্যিই মানাবে । মেয়েকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে । মেয়ে মার একটা কথা রাখলেও আর একটা কথা রাখেনি । গোলাপি শাড়ি পরে বন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে । যথারীতি রিকশা নিয়েছে । নীলিমা হয়তো চেয়েছিল তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যেতে গোলাপের রংটাকে রৌদ্রছায়ার সঙ্গে মিশিয়ে নিলে যে কৌমার্যের সৃষ্টি হয় তার আত্মজা কীভাবে চলেছে তা বহন করে নিয়ে । রিকশা তার চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে টেলিফোন । পাড়ারই এক ভদ্রমহিলা খবর পাঠাচ্ছেন । তপতীকে পেছন থেকে অটো এসে ধাক্কা দিয়েছে । অবস্থা খারাপ । চারদিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যায় মনোবিজ্ঞানের গবেষক । মেয়েটির মৃত্যু নীলিমার মায়ের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে । -- জানো দাদা, তপু যেন মাকে ডেকে নিয়ে গেল ।

    নীলিমার মা রোগে ভুগে মারা যাননি । তাঁর শরীর তাঁর মেয়ে ও অসুস্থ স্বামীর উপস্থিতিতে হঠাৎ খারাপ হয় । একটুও দেরি না করে তাকে যে সেবাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয় সেখানে তাঁর জামাইয়ের একটা আলাদা পরিচিতি আছে । সরোবরের পাশের প্রতিষ্ঠিত এলাকায় গাছ-গাছালি ঘেরা পথ থাকলে ভোরের আলোয় ওই পথ দিয়ে হাঁটার মানুষ মিলে যায় অনেক । কেবল পুলিশের বড়ো কর্তা নন, বড়ো বড়ো ডাক্তারও সুস্থভাবে বাঁচার কামনায় হাঁটতে ভালোবাসেন । নীলিমার স্বামী প্রাত:ভ্রমণের সূত্রেই সঞ্চয় করে চলেছে অনেক সখ্য । সেবাকেন্দ্র যে ডাক্তারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনি হাঁটতে হাঁটতে প্রাণায়াম করার কায়দা শিখে নিয়েছেন নীলিমার মা তা পেয়েছিলেন পূর্ণমাত্রায় । তবু তিন-চারদিনের মাথায় তাঁকে পৃথিবী ছাড়তে হয় । চলে যাওয়ার দুদিন আগে থেকেই তিনি একাধিকবার পরিষ্কারভাবে তপতীদর্শনের কথা বলেছেন । অদূরবর্তী তপতীকে অন্য কেউ দেখতে পায়নি । যিনি মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর চোখমুখ সেই দর্শনের সপক্ষে প্রমাণ হতে চাইছিল । নীলিমার চোখে তপতী ধরা না পড়লেও এই সত্যটা ধরা পড়েছিল যে, তাঁর মা যেটা দেখতে পাচ্ছেন সেটাকে অসুস্থ মানুষের বিকার বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো স্থূলতা আর হয় না । সে তার তখনকার মনের ভাব অগ্রজের কাছে প্রকাশ করতে গিয়ে নিজের শিক্ষার অভিমানকে যে কখনো বড়ো করে তুলতে চায়নি, এই ব্যাপারটাই ধীরেন্দ্রকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে । কারণ সে পদে পদে দেখতে পায় অনধিকারচর্চা, এত তাচ্ছিল্যের প্রকাশ যার সামনে দাঁড়ালে নিজেকেই যেন ছোটো মনে হতে থাকে । মানুষ যুক্তির নামে প্রমাণের নামে এই বিশ্বভুবনটাকে এত ছোটো করে এনেছে যা দেখে বেশ কষ্ট পায় ধীরেন্দ্র ।

    নীলিমার ছোটো ভাই শহর যেখানে নতুন করে দেহধারণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেখানে জমি কিনে বাড়ি করে । ধীরেন্দ্র আজও দেখেনি সেই বাড়ি । তবে নীলিমার কাছ থেকে শুনেছে সমস্ত বাড়ির মধ্যে গৃহীকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো যোগ্য বিন্যাস বিরাজমান । প্রেমাংশুবাবুরা জনবহুল রাস্তার ওপর দোতলায় তিনটি ঘর ও দুটি বারান্দা নিয়ে দীর্ঘকাল বাস করলেও বাড়ি বাড়িওয়ালার । একমাত্র ছেলে চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভাড়া বাড়িতে বৌকে নিয়ে তুললেও সংসার করার জন্য গড়ে তোলে নিজস্ব গৃহ । প্রেমাংশুবাবু বা তাঁর স্ত্রী কেউই চাননি এত বছরের আত্মস্থ পরিমণ্ডল ছেড়ে একেবারে অপরিচিত অঞ্চলে শেষ জীবন কাটাতে । ফলে অনিরুদ্ধ কেবল তার স্ত্রীকে নিয়ে নতুন বাড়ির বাসিন্দা হয় । কিন্তু তার মায়ের পারলৌকিক কাজকর্ম সম্পন্ন হয় পুরোনো বাড়িতেই । পারত্রিক ক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় নৈ:শব্দ্যের ওপর । -- আপনারা মন্ত্র পাঠ করবেন প্রায় জপ করার মতো আস্তে । কারণ বাবা শয্যাশায়ী ভেতরের ঘরে । মায়ের মৃত্যুসংবাদ তাঁকে জানানো হয়নি । বুঝতেই পারছেন তাঁর শরীরের যা অবস্থা তাতে এই খবর তাঁর পক্ষে মারাত্মক হবে । নীলিমার কথা পুরোহিতদের মর্মে প্রবেশ করেছিল । একটা বিশেষ স্থানে নীলিমার মায়ের যে আলেখ্য বসানো হয় তাতে তাঁর চোখে যেমন চশমা এবং ঐহিক অভিজ্ঞতার সংম্রিশ্রণ ছিল তেমন সিঁথিতে ছিল সিঁদুরের অটল প্রতিষ্ঠা । এই আলেখ্য মাল্যবান হয়, ঘরে ধূপ জ্বলে, পুরোহিতের মুখ চলে আসে অনিরুদ্ধর কানের কাছে এবং অনিরুদ্ধ যা বলে তা তার নিজের কানেও পরিষ্কার হয় না । শয্যাশায়ী প্রেমাংশুবাবু রুদ্ধ ঘরের অন্তর্গত হয়ে জানতেও পারেন না যে, তাঁর এত বছরের সঙ্গীকে কোনো হাসপাতাল বা সেবাকেন্দ্রেই আর দেখা যাবে না, দেখা যাবে কেবলমাত্র সেই আলেখ্যে যা অনতিবিলম্বে শোভা বাড়াবে ঘরের দেয়ালের । স্ত্রী চলে যাওয়ার পরের একটা মাস প্রেমাংশুবাবু শয্যাশায়ী হলেও বেশ সচেতন ছিলেন । প্রশ্ন এবং উত্তরের যে খেলা মানুষের মধ্যে চলে সর্বক্ষণ তিনি তাতে যোগ দিতে পেরেছিলেন স্বচ্ছন্দে । এক মাস পর থেকেই চেতনা এবং আচ্ছন্নতা তাঁকে ঘিরে পালা করে রাজত্ব করতে শুরু করে । ফলে এটা অস্বাভাবিক নয় যে, প্রথম এক মাসে তিনি প্রশ্ন দাঁড় করাবেন প্রশ্ন ভেঙে পড়লেও । -- তোর মা হাসপাতাল থেকে কবে আসবে ? কী হয়েছে তোর মার ? বাড়াবাড়ি কিছু ? এই যে বললি শিগগিরই আসবে, কই এখনো তো এল না ? এসব প্রশ্ন ঢেউ হয়ে এসেছে । নীলিমা খুব যত্ন করে নুলিয়ার কাছ থেকে সমুদ্রস্নান শিখেছিল । সবই কৌশল । ঢেউ আসবে কিন্তু কাবু করতে পারবে না । কৌশলী হলে সবই পারা যায় । নীলিমা জীবনে এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে কৌশলী হয়েছিল যতটা সম্ভব । সে বাবাকে এই বলে বোঝাতে চাইত যে, ডাক্তারদের মতে মায়ের পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন । সেটা বাড়িতে কিছুতেই সম্ভব নয় । কারণ মা বাড়ি থাকলে বাবার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন । ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হবে । এই যুক্তি মাসখানেক বা মাসদেড়েক বেশ ভালো ভাবে টিকে থাকতে পারে । তারপর হয়তো আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলতে থাকে তার তেজ । নীলিমার এতেই কাজ চলে গিয়েছিল ভালোভাবে । এক মাস পর থেকে প্রেমাংশুবাবুর জিজ্ঞাসা যত তার তেজ হারাতে থাকে ততই উত্তরের মধ্য থেকে ফুটে উঠতে থাকে ছেলে ভোলানোর কাহিনী । -- তুমি মার ব্যাপারে কোনো চিন্তা করো না । মা খুব ভালো আছে । অনিরুদ্ধ হাসপাতাল থেকে মাকে তার বাড়ি নিয়ে গেছে । অনিরুদ্ধর বাড়ির সামনে বাগান । কত গাছপালা ভাবো তো । কত পাখি ডাকে । কত ফুল ফুটে থাকে । ডাক্তার বলেছে মার এখন টাটকা হাওয়ার দরকার । সকালবেলায় মা বাগানে ঘুরে বেড়ায় । আর পুজোর ফুল তোলে । তোমার ছোটোছেলের বাগানে কত রকমের ফুল জানো ? পঞ্চমুখী জবা, সূর্যমুখী, বকুল, অপরাজিতা, আরো কত কি । মা তোমার কাছে এসে থাকলে না পাবে গাছপালা, না পাবে পুজোর ফুল । কী, ঠিক বলিনি ? প্রেমাংশুবাবু শিশুর মতো মুখ করে সায় দিতেন । নীলিমারও ভালো লাগত গল্প বলে যেতে । -- জানো বাবা, আমি মাকে সেদিন দেখতে গিয়েছিলাম । শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মার জন্য মনটা কেমন করে উঠল । হাতমুখ ধুয়ে একেবারে ফাঁকা বাস ধরে চলে গেলাম তোমার ছোটোছেলের বাড়ি । ভোরবেলায় বাসের জানলার সামনে বসলে কী ভালো লাগে, তাই না বাবা ? মাকে না দেখতে এখন খুব সুন্দর হয়েছে । তোমার ছেলে সুন্দর একটা সাজি কিনে দিয়েছে । আমি বাস থেকে নেমে বাড়ির সামনে গিয়ে প্রথমেই মাকে দেখলাম । মা ফুলের সাজি হাতে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে । এইভাবে কাহিনী বা গল্পের শ্রোতা হতে হতে প্রেমাংশুবাবুর দিন শেষ হয়নি । আচ্ছন্নতা আর চেতনার দোলাচলের মধ্য থেকে তিনি স্বয়ং শুনিয়েছিলেন মেয়েকে -- কাল রাত্তিরে তোর মা আমার কাছে এসেছিল । সঙ্গে তপতীও ছিল । আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল । আমি বললাম তুমি আমার কাছে থাকো । তোর মা একটু হেসে বলল, আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না । তুমি চিন্তা করো না । আমরা আবার এসে তোমাকে ঠিক দেখে যাব । যাঁর স্ত্রীর অস্তিত্ব-বিষয়ক প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয়নি সজ্ঞানে, তিনি নিজেই একদিন তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন এত গোপনতা, এত ছলনার পরেও । নীলিমা ধীরেন্দ্রকে তার বাবার এই দর্শনের কথা বলতে বলতে তাঁর মুখমণ্ডলের কথাও বলেছিল । সমস্ত মুখমণ্ডলে ছিল বিশ্বাসের আলো । যারা চলে গেছে তারা আবার প্রকাশ পাবে । -- জানো দাদা, আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার কি জানো ? বাবা কিন্তু তাঁর দর্শনের ক্ষেত্রে কেবল মায়ের কথাই বললেন না, তপতীর কথাটাও বললেন বেশ পরিষ্কার করে । বাবা চেতনার এমন অবস্থায় বিরাজ করছিলেন যেখানে ভেবে বলা বা গুছিয়ে বলার কায়দা একেবারেই মাথা তুলতে পারে না । ভেবে বললে, গুছিয়ে বললে তবেই তপতীর নামটা না হয় আসতে পারে কল্পনার দিক থেকে । আমার কিন্তু একবারও মনে হয়নি বাবা কল্পনা করে কথা বলছেন । মা যাওয়ার আগে তপতীকে দেখলেন, বাবা যাওয়ার আগে মা এবং তপতী দুজনকেই দেখলেন । তপতী তো নিজেই আমাকে একবার বলেছিল, এই দেখাদেখির বিষয়টাকে অনেক মনোবিজ্ঞানী আর উড়িয়ে দিতে পারছেন না । স্বীকৃতির একটা সুর কিন্তু বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ।

    ধীরেন্দ্র প্রেমাংশুবাবুকে শেষবারের মতো দেখে ওঠার অপেক্ষা করতে করতে সবকিছু সত্যিই শেষ হয়ে যায় কিনা এই ভাবনার মধ্যে তলিয়ে যেতে যে চাইছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে বেশ । তার কাকিমার দেখা বা তার কাকার দেখার থেকেও বড়ো কথা হলো, সে আজ পর্যন্ত নিজে কিছু না দেখলেও বুঝতে পারে এই দেখার যে একটা ইতিহাস আছে তার প্রতি কখনো অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা মানে সংকীর্ণতাকেই বরণ করে নেওয়া প্রকারান্তরে । যাঁরা দেখেছেন তাঁদের অনেকেই কোনোরকম দর্শনের চিন্তা করেননি কোনোদিনও । তাঁদের কাছে যেন অকস্মাৎ প্রতিভাত হয়েছে সত্যের একটা বর্ণ । তাঁদের কারো কারো বুদ্ধির চর্চার অগ্রগতি অনেকের কাছেই বেশ ঈর্ষা করার মতো ব্যাপার । তাঁরা নিজেরাও বুদ্ধির নানা বিভূতির সাহায্য নিয়ে এইসব দর্শনকে নিজেদের কাছে মিথ্যে প্রমাণ করতে পারেননি । তাঁরা শেষে বুঝতে পেরেছেন বুদ্ধি তথা যুক্তির অস্ত্র যতই আধুনিক হোক, যতই হোক পরিব্যাপ্ত তা দিয়ে কিন্তু সব যুদ্ধ জেতা যায় না । এমন এমন পরাজয় আছে যা যেমন ব্যক্তিগত তেমন নি:শব্দ । যাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তাঁদের অনেক লেখারই পাঠক ধীরেন্দ্র । এসব পড়তে পড়তে তার মনে হয়েছে, তার এমন কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে সে হয়তো লিখতে পারত তার যোগ্যতার সবটুকু কাজে লাগিয়ে । স্বপ্নে তার অনেকরকম দর্শন হয়ে থাকে । সেগুলি নিয়ে তার কোনোরকম অধিকার বোধ নেই । জেগে থেকে যে দেখা তার ওপর সে অনেক বেশি জোর দিতে চাইছে । নীলিমার মা যে চোখ দিয়ে নীলিমাকে দেখে এসেছেন সেই চোখ দিয়েই কিন্তু দেখেছিলেন মৃত্যুপরবর্তী তপতীকে । নীলিমার বাবা দেহাবসানের আগে মেয়েকে যে দেখার কথা বলতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে কোনো স্বপ্নের প্রলেপ ছিল না । ছিল অনুভূতির ব্যাপকতা । ধীরেন্দ্রর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, মানুষ যত তার শক্তিমত্তার কথা বলছে ততই কি সে ধরে রাখতে পারছে তার অনুভূতির শক্তি ? শক্তসমর্থ মানুষের থেকেও দুর্বল মানুষ যে অনুভূতির দিক থেকে অনেক বেশি এগিয়ে তার কি সত্যিই কোনো কারণ নেই ?

    বসে থাকতে থাকতে একটা সময় আসে যখন আর বসে থাকার তেমন কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না ধীরেন্দ্র । এত দেরি হচ্ছে কেন ? -- এই প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে তার সর্বত্র । তার চোখ পথের ওপর । সেই চোখ এড়িয়ে নিশ্চয় নীলিমারা চুল্লির কাছে যায়নি । তবু সে তার চোখের ওপর ভরসা করতে পারে না শেষপর্যন্ত । যখন তার ভাবনার কাজ বেশি চলেছে তখন চলে যায়নি তো শববহনের গাড়ি চুল্লির দিকে ? সে তাই গাত্রোথ্থান করে আরো একবার । সকলেই অপরিচিত চিরদিনের । গভীরতম অপরিচয়ের মধ্য থেকে এইসব মানুষের জন্মানো, বেড়ে ওঠা এবং ঝরে পড়া গভীরতম যতদূর চোখ যায় দেখে ততদূর । না, কোথাও কোনো মহাপ্রস্থানের ইঙ্গিত নেই । তবে কি নীলিমাকে সমষ্টির চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে হলো ? কাছের শ্মশান ছেড়ে দূরের শ্মশানে পিতাকে আনতে গেলে যে বাধা বড়ো হয়ে ওঠে নীলিমার দ্বারা কি তার অপসারণ সম্ভব হলো না শেষপর্যন্ত ? সে একবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে । বিকেলও আর ঠিক বিকেল নেই । তার মধ্যেও ধীরে ধীরে এসে পড়েছে ফুরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা । আর কত অপেক্ষা করা সাজে ? আর কতকাল অপেক্ষা করলে অপেক্ষা সার্থক হবে ? কোনো প্রশ্নেরই কোনো নির্দিষ্ট উত্তর না পেয়ে সে ঘরে ফেরার পথ ধরে । তার মনে হতে থাকে এই দোলাচলের মধ্যে একমাত্র ঘরই পারে পথ দেখাতে ।

    প্রতিমা যখন শুনতে পায় নীলিমা ধীরেন্দ্রকে ফোন করে বলেছে আসন্ন শ্মশান যাত্রার কথা, তখন আর সে চুপ করে সংসারের কাজ করে যেতে পারে না । সে প্রথমেই তার সহোদরাকে ফোন করে । -- রেবা, আমি দিদি বলছি । এইমাত্র খবর পেলাম খুড়শ্বশুর মারা গেছেন । আমি বেরিয়ে পড়ছি । তুই বিকেল বিকেল চলে আয় । তুই না এলে তোর জামাইবাবু বেরোতে পারবে না । এই যে ঘরের কাজ সারতে সারতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারা, যিনি চিরকালের জন্য ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তাঁর শিয়রের সামনে ফুল নিয়ে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছেটাকে রূপায়িত করতে পারা, এটাই প্রতিমার ক্ষেত্রে আসে খুব স্বত:স্ফূর্ত ভঙ্গিতে । এতে ধীরেন্দ্রর খুব সুবিধে হয়েছে । কিংবা বলা যায় বেঁচে গেছে সে । নীলিমা যদি তার বাড়ির কাছের শ্মশানে তার বাবাকে নিয়ে আসার কথা না বলত তবে কি ধীরেন্দ্র ছুটে যেতে পারত প্রেমাংশুবাবুর ঘরে কিংবা সেই দাহক্ষেত্রে যা তার বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে ? পারত না যে সে-কথাটা বেশ জোর দিয়েই বলে ফেলা যায় । ধীরেন্দ্র বেশ কয়েক বছর আগে একটা কবিতা লেখে যার প্রথম দুটো ছত্র তার মন জুড়ে আছে । সম্প্রতি ভালো লাগে না দৌড়োদৌড়ি/যখন জেনেছি কাছে বাস করে গৌরী । এখানে সাম্প্রতিক কালের কথা বলে ফেলা হলেও তার মানসিকতার দিক থেকে এটা কিন্তু সবসময়ের সত্য । কোনোকালেই সে দৌড়োদৌড়ি করতে পারে না । সে বহু জায়গাতেই শারীরিকভাবে উপস্থিত হওয়ার বদলে কল্পনা করেছে উপস্থিত হতে পারার অনুভবমালা । ফলে তাকে তিরস্কার করার মতো মানুষের অভাব হয়নি কোনোদিনও । সে যত তিরস্কৃত হয়েছে ততই সে ভেবেছে উপস্থিত হওয়ার বদলে উপস্থিতির বর্ণ নিয়ে যে চিন্তা তার একটা মূল্য আছে কোথাও । অবশ্য প্রতিমা এই মূল্যকে স্বীকার করতে পারেনি কোনোদিনও । সেইসঙ্গে একথাও বলেনি -- আমি চললাম, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে ? এই না বলার ফলে, এই জিজ্ঞাসার অনুপস্থিতির ফলে কী যে সুবিধে হয়েছে ধীরেন্দ্রর । রেবা অবশ্য এখনো মাঝে মাঝে বলে ফেলে -- কোনো কর্তব্য নেই ? তোমার কি কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না ? কী এত ভাবার আছে বলো তো ? ধীরেন্দ্র কোনো উত্তর দেয় না । চায় না উত্তর দেওয়ার শ্রম স্বীকার করতে । তার বদলে সে হাসে । সেই হাসি যার মধ্যে কোনো শব্দ থাকে না, থাকে কেবল একটা দাগ, একটা সরলরেখা আগাগোড়া । বাড়ি ফিরে গিয়ে সে প্রতিমাকে পাবে না । প্রতিমা ডালভাত আর আলুভাজা খেয়ে কয়েক ঘন্টা আগে ঘর ছেড়েছে । ফুল কিনে নিয়ে ঠিক গিয়ে বসে পড়েছে নীলিমার পাশে । তার অশ্রুক্ষেত্রে যুক্ত করেছে তার অশ্রুর সজলতা । এতক্ষণে নীলিমার পাশে বসে শ্মশানযাত্রী হয়ে তার এসে পড়া উচিত ছিল । প্রতিমার অনুপস্থিতিতে ধীরেন্দ্র যে শ্মশানে উপস্থিত হতে পেরেছে তার জন্য রেবার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত । রেবা যথাসময়ে হাজির না হলে তার পক্ষে যথেষ্ট আগে শ্মশানে আসা কিছুতেই সম্ভব হত না । ঘরে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ার যে ঘরানা বিরাজমান তার থেকে প্রতিমা বিযুক্ত থাকতে চায় যতটা সম্ভব । উঠোনের তারে সে নিজে যে চন্দনাকে ঝুলিয়ে রেখে যায় তার জন্য তার একটা চিন্তা থাকে । তার ছোলা তার জল তার কাছেই রাখা থাকে সবসময় । সে যে কত ডাকে সাড়া দেয়, বর্হির্জগতের কতরকম প্রবাহ থেকে যে সে সংগ্রহ করে নিতে পারে তার লাফঝাঁপ এবং তার কন্ঠস্বরের খোরাক, তা গোপনে লক্ষ না করলে বোঝা যাবে না ঠিক । ঘরে ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলে একটা নির্মানুষ পরিমণ্ডলের জন্ম হয় যেটা প্রতিমার কাছে মানবিকতার দিক থেকে খুব শুভ কিছু নয় । পরস্বাপহরকের চিন্তা থেকেও চন্দনার চিন্তা তাকে বেশি উদ্বিগ্ন করে । তাই সে রেবাকে ডেকেছে । ছুটির দিন বলে রেবাও সাড়া দিতে পেরেছে তার ডাকে । বাড়ি ফিরে গিয়ে ধীরেন্দ্র প্রথমে চাইবে একটু পানীয় জল । গলা শুকিয়ে আসার অনুভব নয়, এমন এক অনুভব যার মধ্যে তৃষ্ণার অনুষঙ্গ আছে । তার মুখে একটু জলও দিতে পারিনি -- এই যে একটা কথা যুগে যুগে শুনতে পাওয়া গেছে, তা যেন আবার নতুন করেই বেজে ওঠে কোথাও । ফলে ধীরেন্দ্রকে জলের কথা ভাবতে হয় । সেই জল যা পান করা যায় দানের মধ্য দিয়ে । সে বাড়ি ফিরে রেবাকে বলবে, জল দাও । এই দানের মধ্য দিয়ে সে বুঝতে চাইবে এমন কিছু যার সঙ্গে হয়তো দর্শনের কোনো অবদান জড়িয়ে আছে নির্লিপ্তভাবে । সে বাড়ি ফিরতে থাকে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, আস্তে আস্তে ।

    (ক্রমশ :)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments