• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | উপন্যাস
    Share
  • রাতবিরেতের গজল (১১) : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত
    | | | | | | | | | ১০ | ১১



    মেজর কলাশকর




    পাথরের স্লিপটা ত্রক্রস করে পাড়া থেকে বেরোচ্ছি এমন সময় স্লিপের পিছন থেকে একটা রোগা কালো বেড়াল বেরিয়ে একছুটে ঢুকে গেল মাথুরদের বাগানে । টোটোদা বলল হারুন কালে । হলুদ বাড়িগুলোর দেয়ালে দৈত্যের মত ছায়া হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের ছেড়ে আগে । টোটোদা আর আমি পিছিয়ে পড়লাম । ঘুম থেকে তোলা ধূপেন্দ্রর গজলের এই শেষ রাতে আমাদের অত তাড়া ছিল না ।

    ধূপেন্দ্রর গজলের এই শেষ রাতে আমাদের সেট-আপ করে দিয়ে ধূপেন্দ্রই গায়েব । এক একবার মনে হচ্ছিল এসবই কী তার কারসাজি ?  হারুন কালের গল্পটাও তার কাছ থেকে শোনা । তখন ইণ্ডিয়া-পাকিস্তানের সিরিজ চলছিল । ধূপেন্দ্র নাকি লাহোরেই ছিলেন । টপ ফর্মে হোল টিম । গাভাস্কার, ভিশি বলকে ফুটবল দেখছে । এমন সময় শোনা গেল ঘোর কালো রঙের একটা বেড়াল হোটেল থেকে বেরোবার সময় ইণ্ডিয়ান প্লেয়ারদের রাস্তা কেটে যাচ্ছে আর সেটা হলেই সেদিন তাদের ব্যাটের সঙ্গে বল লাগছে না । সত্যিই চারদিনের দিন পিচ ভেঙে ইণ্ডিয়ানরা কাহিল । বোধহয় একশো'য় অল-আউট । কাগজে বেরিয়ে গেল যে মুশতাক মোহম্মদ গ্রাম থেকে হারুন কালে বলে একটা বিল্লা নিয়ে এসেছে - আসলে সে-ই ম্যান অব দা ম্যাচ ।

    তো ইণ্ডিয়ান ক্যাম্প ভেঙে পড়েছে । ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । জাহির, ইমরান, মিঁয়াদাদদের সঙ্গে টক্কর নেওয়া যেতে পারে । কিন্তু হারুন কালেকে হারাবে কে ? পার্লামেন্টে চরণ সিং প্রশ্ন তুললেন - বি-সি-সি কি এতদিন ঘুমোচ্ছিল ? লাখ লাখ টাকার বাজেট থাকা সত্ত্বেও একটা হারুন কালে তারা তৈরি করতে পারেনি কেন ? একমাত্র ক্যাপ্টেন বিষেন সিং বেদী নিরুত্তাপ । ইন্টারভিউতে জিজ্ঞেস করা হলে বললেন - আয়াম নট এ সুপার-ইস্টিশান । পরের টেস্ট-ম্যাচ শুরু হবার দিন পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা যখন হোটেল থেকে দল বেঁধে বেরোচ্ছে তখন কালো সুট আর কালো চশমা পরে ক্যাপ্টেন বেদী ধীরে সুস্থে তাদের রাস্তা কেটে গেলেন ।

    আশ্চর্য, সেই টেস্টে উল্টে গেল ভাগ্যের চাকা । এবার জাহির, মিঁয়াদাদরাই ভালো করে খেলতে পারল না । চন্দ্রা-বেদীর বল লাট্টুর মত ঘুরতে লাগল ও ভারত জিতে গেল ম্যাচ । গল্পের শেষটা মর্মান্তিক । পরের দিন বেদী যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন তখন লবির পাশে লুকিয়ে থাকা একটা কালো বেড়াল দুর্দান্ত গতিতে ছুটে এল তাঁকে আক্রমণ করতে । কিন্তু হারুন কালের শেষ প্রতিশোধ সফল হয়নি । বেদী একটা ছোট্ট লাফে আগেই তার রাস্তা কেটে নিজের বাসে উঠে পড়েছিলেন । আর পিছু পিছু একটা ট্রাক এসে চাপা দিয়ে দিয়েছিল হারুন কালেকে ।

    এ গল্প কপিল দেব বা বেদীর জীবনীতে নেই । গাভাস্কারও ঘটনাটা অনুল্লেখিত রেখেছিলেন `সানি ডে'জে' । কিন্তু উত্তর-ভারতে আমরা যারা বড় হয়েছি তাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়নি যে সে সব দিনে হারুন কালে বা ধূপেন্দ্রর মত চরিত্ররাই শিমলিপুর থেকে লাহোর অবধি সমগ্র আর্যাবর্তের ভাগ্যের রাস্তায় যানজট ঘটিয়ে বেড়াত ।



    বক্সি রোডে উঠে দেখলাম আকাশের একটা গোল জায়গা জুড়ে তারা ফুটেছে । তার বাইরে স্তরে স্তরে সাজানো কালো মেঘ । উত্তরে সম্বলপুরার দিকে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে । টোটোদা বলল - ভয়টা কিসের বলতো ? সাসপেক্টের হাতে এখন একটা বন্দুক ।

    কুড়ুলেই আমার বেশি ভয় । টোটোদাকে বললাম - আওয়াজ পেলেই মাটিতে শুয়ে পড়ব । টোটোদা বলল - হ্যাঁ । তারপর নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে ঢুকে যাস আরো ভিতরে । অবে একটা পাঁচিল ফাঁচিল খুঁজে তার আড়ালে দাঁড়াতে হবে ।

    টোটোদা ব্যাপারটাকে যখন হালকাভাবে নিচ্ছে তখন বুঝলাম তাদের ধারণা প্ল্যান একেবারে ফুলপ্রুফ । সেটা জেনেই আরো মুষড়ে পড়লাম যেন । বক্সি রোডের উপর আমাদের স্যাণ্ডেলের সপসপানি ছাড়া আর তৃতীয় কোনো জন-মানুষের শব্দ নেই । গজল একখানা শেষ হয়েছে । এবার পাঁচ মিনিটের বিরতি । যে হাওয়াটা মরে গিয়েছিল আবার উঠল । মেঘগুলো কী করবে বুঝতে না পেরে যূথ ভেঙে উড়তে শুরু করেছে । কোনদিক থেকে যে বৃষ্টিটা আসবে আমরা সেটা বুঝতে পারছিলাম না । শিমলিপুরে কখনো যদি মনে হয়ে থাকে সময়টা থেমে যাক - তো এই সেই সময় । যা হবার হয়ে যাক এই এক মুহূর্তেই ।

    কুড়ি বছর পর সেই গল্প লিখতে গিয়ে আবার একই কথা । এই সেই সময় । দরকার শিমলিপুরের ইতিহাসের এক র্যাপিড রীডার সংস্করণ । যা ভবিষ্যত্কে অনির্দিষ্টতার হাত থেকে বাঁচাবে । যা এই কাহিনীর মুখ্য ও পার্শ্ব চরিত্রদের যতদূর সম্ভব অবহেলা না করে মঞ্চে আনবে বিদায়ের বিনত বাও করাতে । কেননা গল্পের সবচেয়ে বড় কথাটাই হল যে তা শেষ হয় না । সেজন্যই আমার হিন্দী লেখাগুলো বেচে দেবার সময় টোটোদা বার বার করে বলেছিল - চরিত্রগুলো তো তোর থাকল ? নাকি সেগুলোও ওদের হয়ে গেল ? এর কিছুই ভাবিনি তখন । সত্যি সত্যিই টোপাজকে নিয়ে আরো গল্প ওরা অন্যদের দিয়ে লিখিয়েছিল । আমার টোপাজের জ্বর হত । সেই টোপাজ সকালে উঠে ব্যায়াম করে জ্বর সারিয়ে ফেলল । পড়ে এমনকী পরভীন অবধি বলেছিল - হোয়াট এ সোয়াইন । জ্বর ছাড়া টোপাজকে ভাবা যায় ? অতএব এই গল্পের চরিত্রদের শেষ পর্যন্ত কার কী হল সেটা বলার জন্য আর অপেক্ষা নয় । এখনই জানিয়ে দিতে চাই । অসময় হলেও এ-ই একমাত্র সময় ।



    মধুমালাকে দিয়েই শুরু করা যাক । ক্যাপিটেশান ফি দিয়ে সে দক্ষিণ ভারতের একটা প্রাইভেট মেডিক্যাল স্কুলে ঢুকে ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছিল । তারপর দিল্লীতে এসে চেম্বার খোলে । নেউলেদার ভাষায় চিকিত্সা বিভ্রাট তো হবেই । নইলে আর ডাক্তারিকে প্র্যাকটিস বলে কেন ? কিন্তু মধুমালার পেশেন্টরা ভালো হচ্ছিল না বলে মধুমালা হাল ছেড়ে দিয়ে একজন ব্যবসাদারকে বিয়ে করে ফেলে । এখন সে একটা ওষুধের দোকান খুলেছে এবং ভালোই চালাচ্ছে ।

    ভূবনবাবু বুড়ো হয়ে গেছেন । এক ছেলে আর এক মেয়ে । দুজনেই কলেজে ঢুকেছে শুনলাম । বছর তিনেক আগে সরস্বতী পূজোর দিন রবীন্দ্র শিক্ষাভবনে দেখা হয়েছিল । বললেন - তুই নাকি এখন বাংলায় লিখছিস ? তোর তো বাংলা কোনোদিন স্ট্রং ছিল না । আমতা আমতা করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম । এমন সময় স্কুলেরই এক ফক্কড় ছেলে বলল - হিন্দীতে স্ট্রং হলে বাংলায় আর আছেটা কী স্যার ? ভোজপুরীতে লিখে তার মাস্ল্গুলো বের করে নিলেই বাংলা । ভুবনবাবু আর তেড়ে গেলেন না । মানে সেই মাস্ল্গুলো তাঁর নিজের মেজাজ ও ভাষাতেই আর নেই ।

    আর টোটোদা, মনু, মনুর দিদি, পরভীন, লতা ? এদের কী হল ?

    মনুর দিদির কেসটা খুবই আশ্চর্যের । ধূপেন্দ্র খুন হবার পর তার অফিসেই কীভাবে সে একটা চাকরি যোগাড় করে ফেলে । ধূপেন্দ্রর স্ত্রীর কোয়ালিফিকেশান ছিল না । মনুর দিদি সেই চাকরিটা করে ধূপেন্দ্রর সংসার চালাত । দু-তিন বছর এরকম চলার পর প্রাইভেটে এম-এ'ও পাশ করে যায় ।  তারপর হোম মিনিস্ট্রির আরো কয়েকটা ভিতরের পাঁচিল ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত ধূপেন্দ্রর পোস্টটাই দখল করে বসে নাকি একসময় । লাস্ট শুনি সে আবুধাবি আর করাচিতে ধূপেন্দ্রর মতই বছরে ছ মাস কাটাচ্ছিল । ধূপেন্দ্রর পরিবারকেও ফেলেনি ।

    মনু আর টোটোদার অপারেশন হল পাশাপাশি বিছানায় । তখন শীতকাল । একদিন পরেও দুজনে কোমায় । ঝকঝকে রোদ্দুরে আমরা লবিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম । মামা-মামিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই নি । মনুর বাবা-মা'ও আসেননি । এমন সময় উপর থেকে খবরটা নিয়ে নেমে এল নেউলেদা । নেউলেদার মুখ দেখে কাঁদতে শুরু করল পরভীন । লতা বরফের মত ঠাণ্ডা । ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সাথে তখন খেলা চলছে । ভারতের একটা উইকেট পড়েছিল একটু আগে । সবাই মিলে উপরে গেলাম । কেউ কিছু জিজ্ঞেস করিনি । নেউলেদা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমাকে ফিস ফিস করে বলল - ওয়ান ডাউন । মনু নেই ।

    পরভীন পুরো খবর শোনার আগেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অজ্ঞান হয়ে গেল । তখন তাকে নিয়ে আরেক বিপদ । কিন্তু মনুর দিদি আর লতা অতি শান্তভাবে বডি নিয়ে এল বাড়িতে । পরে শ্মশানে গিয়ে শুনি মনুর বাবার স্ট্রোক হয়ে গেছে । তিনিও এবার কুছ হি দিন কা মেহমান । বছরখানেকের মধ্যে মারাও গেলেন ভদ্রলোক । তখন মনুর দিদি তার মাকে নিয়ে ধূপেন্দ্রদের বাড়িতে উঠে গেল । লতার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখাই হয়নি আমার । শুনেছিলাম সেও একটা সরকারি অফিসে চাকরি করত নাকি ।

    টোটোদা মিরাকিউলাসভাবে ভালো হয়ে গেল । অপারেশনের পর ঘাড়টা একটু বেঁকে গিয়েছিল । কিন্তু আর কোনো ব্যাধি ছিল না শরীরে । রাত্রিবেলার জ্বরটাও সেরে গিয়েছিল তার । সে যখন বাড়িতে আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে তখন পরভীন দেখা করতে আসত রোজ । হাতে করে নিয়ে আসত শীতকালের ডালিয়া বা ক্রিসেন্থিমাম । একদিন একটা ফলের ঠোঙা হাতে নিয়ে হাজির পুলিশ পাড়ার গুণ্ডা ছেলে পিংকি । ভাবছিলাম ঠোঙাটা রেখে নিয়ে ভাগিয়ে দেব । হঠাৎ দেখিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে পরভীন । পরভীন কী করে এই জানোয়ারটাকে ভুলে গেল ভাবছি যখন তখন দুজনেই তারা গিয়ে ঢুকল টোটোদার ঘরে । পরে আমি পরভীনকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - পিংকি হঠাৎ তোমার বন্ধু হল কী করে ? পরভীন রেগে গিয়ে বলল - শোন জয়, একদিন তোকে বলেছিলাম না ইংরেজিতে লিখতে ? আর তুই বলেছিলি সেটা সম্ভব নয় ? আজ আমিই বলছি যে ইংরেজি নিয়ে অবসেশানটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল । পিংকিরা ইংরেজি জানে না বলে সবসময় ওদের ছোট করে দেখেছি । সেই রাগেই ওরা আমাদের সঙ্গে অসভ্যতামো করত । কিন্তু সে দোষটা কি একা ওদের ?

    তো এরপর পিংকি পরভীনের সঙ্গে মাঝে মাঝে ফলের ঠোঙা হাতে আসতে লাগল আমাদের বাড়িতে । বোধহয় সেই ভয়েই টোটোদা খুব তাড়াতাড়ি চাঙ্গা হয়ে নেমে পড়ল খাট থেকে ।

    চিরকালই জানতাম যে টোটোদা স্বাবলম্বী । এই সব ঘটনার পরেও তার কোনো বিকার নেই । সে দিব্যি ক্রিকেট খেলে বেড়াতে লাগল । পরের গল্প সংক্ষেপের যোগ্য । বছর পাঁচেক বাদে পুলিশে যখন নতুন চাকরি পেল পিংকি এবং পরভীনের সঙ্গে ধূমে-ধামে প্যাণ্ডেল করে বিয়ে হল তার তখন সুট বুট পরে টোটোদাও নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল সেই বিয়ের । আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম - গোলমাল হলে সামাল দেব ভেবে । গিয়ে দেখি সবই নর্মাল । পরভীন সেজে গুজে চেয়ারে বসে আছে । পাশে গোলাপি রঙের সুট পরে পিংকি । দুজনেরই চেহারা ভালো । চমত্কার মানিয়েছিল তাদের । টোটোদা একটা বিরাট বুকে দিল । পিংকিকেই মনে হল অপ্রস্তুত । প্রতিশোধের সূক্ষ্ম রুচির নিদর্শন হিসেবে আমি একটা র্যাপিডেক্স ইংলিশ স্পিকিং কোর্স কাগজে র্যাপ করে পিংকির হাতে দিয়ে এলাম ।

    পরে অতিথিদের মধ্যে মিক্স করতে করতে খাবারের টেবিলের দিকে এগোচ্ছি এমন সময় জামার হাতায় হ্যাঁচকা টান । ফিরে দেখি পাঁচ বছর আগেকার একটা চেনা মুখ । ততদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে ক্যারিনা । জমকালো পোষাকে দেখাচ্ছেও তাকে ভালো । কিন্তু চোখে মুখে সেই ক্ষ্যাপাটে হাব-ভাব ।

    - তোমাদের আসতে লজ্জা করল না ? অম্লানবদনে সে বলল আমাকে ।

    - ইনভিটেশান পাঠাতে যখন তোমাদের লজ্জা করেনি তো আসব না কেন ? বললাম আমি ।

    ক্যারিনার চোখ অমনি ছলছল করে উঠল । সে বলল - পরভীনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছি । এখন তো হস্টেলেই থাকি । এসেছি শুধু মামা-মামির কথা ভেবে । বহুদিন আগে তোমাকে আর টোপাজকে হিউমিলিয়েট করার চেষ্টা করেছিলাম । সেজন্য আজ অ্যাপোলোজাইজ করছি । পরভীনই আসল ভিলেন ।

    টোটোদার কানে এসব ওঠার আগে ক্যারিনাকে নিবৃত্ত করার জন্য বললাম - দ্যাখো, ভেবো না যে টোপাজ খুব একটা ভেঙে পড়েছে এর জন্য । হি ইজ ও.কে ।

    পরে আমি আর ক্যারিনা পান খেতে খেতে গল্প করলাম অনেক্ষণ । কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুরে-ফিরে ক্যারিনা সেই প্রশ্নটাই করল যেটার ভয় করছিলাম ।

    - পরভীন কেন এরকম করল জয় ? ও তো এরকম মেয়ে ছিল না ।

    তো কড়া জর্দা দেওয়া পান খেয়েছি । মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল এমনিতেই । তার উপর মেয়েদের মনস্তত্ব, হিন্দী নভেল, ইংরেজি নভেল, কনভেন্ট স্কুল, সরকারি স্কুল, শিমলিপুর, পার্কটাউন, কোর্ট, কাছারি সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যে যুক্তিবদ্ধ মন্তব্যটা মুখ দিয়ে বেরোব বেরোব করছিল, তার বদলে বেরিয়ে এল এই - মেয়েদের বিয়ের বড় তাড়া থাকে ক্যারিনা । এটাই নেচার ।

    কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর ক্যারিনা সেই যে টর্ণেডোর মত একবার ঘুরপাক খেয়ে চলে গেল - আর কথা বলার চেষ্টা করেনি । অন্তত আমার মনে হয়েছিল যে টোপাজের প্রতি সমবেদনা এবং পরভীনের প্রতি ক্ষোভের অনেকটাই ওই এক কথায় তার মন থেকে মুছে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি ।



    বক্সি রোডের দুমাইল পেরোতে আমাদের লেগেছিল পঁচিশ মিনিট । সি-টাইপ কোয়ার্টারের ভাঙা দেয়ালগুলো পেরিয়ে যখন আমরা কলেজগ্রাউণ্ডের দিকে এগোচ্ছি তখন আবার শুরু হল টিপ টিপ করে বৃষ্টি । গজলগুলো শেষ বোধহয় তার জন্যই । কলেজগ্রাউণ্ড পেরিয়ে ফাঁকা বালির মাঠ আর ক্ষেতের ধারে কয়েকটা পুরোনো ই-টাইপ বাংলো । সেগুলো ভাঙার পরও পিছনের চাপরাশি কোয়ার্টারগুলো অক্ষত ছিল । মাঠের মাঝখানে হ্যাজাক লন্ঠন জ্বালিয়ে যে দলটা গান করছিল তারা উঠে পড়ছে । আমি আর টোটোদা কলেজ গ্রাউণ্ডের পাঁচিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম ।

    - ওই যে । ওল্ড-ফ্রেণ্ড । বলল টোটোদা ।

    গজলচিকে দেখলাম । আগের মতই কুর্তা আর ঢোলা পাজামা । চামড়ার পট্টি দিয়ে বাঁধা হারমোনিকা কাঁধে সে বেরোচ্ছিল দলটা ছেড়ে । হ্যাজাক লন্ঠনগুলো নিভছিল এক এক করে । গজলচি কাঁধে হারমোনিকাটা ফেলে হাঁটতে শুরু করল পিছনের ই-কোয়ার্টারগুলোর দিকে । খচ্‌ করে একটা গাড়ি স্টার্ট হওয়ার শব্দ । আকাশে আর তারা দেখা যাচ্ছিল না । যেটাকে কালো আকাশ বলে মনে হচ্ছিল সেটা আসলে একটা কালো মেঘ । ভিজে ধূলোর উপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ এদিক ওদিক । গজলচি অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে টোটোদা বলল - চল আরেকটু যাই । ওদিকটা আরো অন্ধকার - মাঠঘাট ভেঙে কোথায় যাব তার ঠিক নেই । না গেলেই নয় ? টোটোদাকে বললাম - কিছুই দেখতে পাচ্ছি না যে । টোটোদা বলল - ইউজ ইওর ইম্যাজিনেশান । ঝিরিঝিরি বৃষ্টির চাদর সরিয়ে আমরা অন্ধকার মাঠে নেমে পড়লাম । এবড়ো খেবড়ো মাটিতে কোনো ঘাস নেই । কিছুটা নোনাবালি, কোথাও কোথাও কাঁটা ঝোপ । এখানে কোনো জন্তু যদি থাকে তো তা নরখাদক । সাপ যদি বেরোয় তো বিষে বোঝাই । টোটোদা বলল - ইম্যাজিন কর এই মাঠেরই ওদিক থেকে একটা ছায়ামূর্তি আসছে । গায়ে হাতকাটা কুর্তা । পকেটে পিস্তল । তাতে একটা গুলি । গুলির উপর লেখা রুমী মান্তো ।

    - গজলচি ? কিন্তু কেন ?

    - মনে কর একটা লোক আসত ওদের গান শুনতে । অন্ধকারে মুখ ঢাকা । একদিন মান্তোর হাতে টাকার বাণ্ডিল দিয়ে একটা কনট্র্যাক্ট করল । মান্তোর তাকে চিনতে পারার কথা নয় । কিন্তু কয়েক মাস পরে গজলচি খোদ তার অফিসেই এসে হাজির । আরো টাকা চাই । ব্ল্যাকমেলিংই বলা উচিত । তো সে গজলচিকে বলল তিন দিনের মধ্যে এনে দেবে ।

    এসব খবর টোটোদা জানল কি করে তার একটা আন্দাজ করতে পারছিলাম একটু একটু । বললাম - তিন দিন মানে বারো জুলাই । টেলিগ্রামটা কি তুমিই পাঠিয়েছিলে ?

    - সরস্বতীও চাইছিলেন তুই থাক । একটা পজিটিভ আইডেন্টিফিকেশান হবে । আমি ভাবছিলাম নিজের চোখে না দেখলে তোর বিশ্বাস হত কি ?

    - বোধহয় না ।

    ইম্যাজিনেশান ইউজ করতে গিয়ে মাটিতে দুবার হোঁচট খেলাম । কাছের জিনিস দেখতে না পেলেও মনে হল দূরে একটা লোককে চলে যেতে ঠিকই দেখেছি । অন্ধকার থেকে একটা দুটো করে নীম আর অশ্বথ্থ গাছ বেরিয়ে আসছে সামনে । বৃষ্টিটা কমছেও না, বাড়ছেও না । টোটোদা বলল - তুই যে চিরকুটটা লিখে গিয়েছিলি সেটা হাতে পেয়েই সরস্বতী তোমরের সাথে দেখা করলাম । আলোচনা হল বাকি সবাইকে জানানো হবে কিনা । ধূপেন্দ্র বললেন - বেসিকালি নো নীড । মানে নীড টু নো বেসিস । তাছাড়া এটা তো শুধু একটা হাই-স্কুলের ছেলের সাসপিশান । আগে আমি একটু বাজিয়ে দেখি ।

    - সর্বনাশ । বাজিয়ে দেখতে গিয়েই কি ...  

    - ... নিজেরই বাজা বেজে গেল তো ? হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছিলাম । কে জানে । বলল টোটোদা । - ধূপেন্দ্রর মত শিকারি লোকের সাথে এরকম হতে পারে আগে ভাবতেও পারিনি । সরস্বতী তোমরকে গিয়ে বললাম - কনফ্রন্ট যদি করতেই হয়, একটা জাল বিছিয়ে রাখুন । গজলচিটাকে ব্যবহার করা যাক । হয়তো ও চিনতেই পেরে যাবে । আর যদি নাও চিনতে পারে, চিনতে পারার ভান তো করাই যায় ।

    বুঝলাম । সহজ কিন্তু মারাত্মক কার্যকরী প্ল্যান । মেজর কলাশকরের লেখকের ধারণা তাকে কেউ চিনতে পারবে না । কিন্তু আমাদের আন্দাজ যদি ঠিক হয় তাহলে গজলচির ব্লাফে এমন ইলেকট্রিক শকের কাজ হবে যে তারপর শুধু তার ধরা দেওয়ার অপেক্ষা । টোটোদার তারিফ না করে পারলাম না ।  

    টোটোদা বলল - সরস্বতীই শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন সবাইকে । সঙ্গে গেলাম আমি আর মনু । দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম । বাইরে থেকে শুনতে পেলাম গজলচি ঢোকা মাত্র একটা ফোন কল থেমে গেল । গজলচি মিন মিন করে বলতে শুরু করল - আমার নাম রুমী মান্তো । আশা করি চিনতে পারছেন । তারপর সেই ভয়ংকর সাইলেন্স । যার মধ্যে আস্তে আস্তে পান চিবোবার শব্দও অসহ্য হয়ে ওঠে । পরে গজলচি বেরিয়ে এসে বলল - টাকা নিয়েই আসবে । তিন দিন পর ।

    তারপর বৃষ্টিটা জোরে হয়ে গেল । আমি আর টোটোদা দৌড়ে চলে এলাম একটা নীম গাছের তলায় । ভিজে বালি লেগে পা চুলকোচ্ছিল । গাছের পিছন থেকে নজর রাখছি । গজলচি গিয়ে ঢুকেছিল একটা চাপরাশি কোয়ার্টারের ভিতর । অন্ধকার ঘর । শুধু একটা বিড়ির সিগন্যাল দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে । এবার ?



    সবকটা মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্রে যাবার পরেও প্রবুদ্ধ ডাক্তারিই পড়ল না । সে হয়ে গেছে হাই-এনার্জি ফিজিসিস্ট । এখন ফার্মিল্যাবে । মাঝে মাঝে দেখা হয় । কথা হয় ফোনে । লোটাসের খবর তার কাছ থেকেই পাই । প্রবুদ্ধ বিয়ে করেনি । দেরিতে হলেই দুরস্ত হবে বললেও প্রবুদ্ধ পাত্তা দেয় না । আমার মনে হয় ছোটবেলা এত প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হবার ফলে এখন সে আর জীবনে কোনো চাহিদা অনুভব করে না । একদিন ঈষন্মত্ত লোটাসকে দেখেছিলাম ওর কোলে বসে থাকতে । সেটা স্কুল ফাইনালের বছর । আমি আর পম্পা থানা গণ্ডগোলে জড়িয়ে সরস্বতী পূজোর দিন সন্ধ্যেবেলা স্কুলের মাঠে চূন দিয়ে আঁকা আলপনার পাশে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা যখন উদ্যাপিত হয়ে গেছে তখন ছাড়া পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দেখি দোতলায় ইলেভেনের ঘরে এই দৃশ্য । এক দঙ্গল চেনা অচেনা ছেলে লোটাসকে দেখার জন্য ভিড় করে এসেছিল । পরে যে পারে চেটেছে তার রাঙা গালদুটো । লোটাস তারপর চাকরিতে ইস্তফা দেয় । এখন সে একটা ব্লাইণ্ড স্কুলের টিচার ।

    আমি আর পম্পা পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অধ:পতনের চ্যাটালো সিঁড়িগুলো ভাঙতে ভাঙতে এমন জায়গায় এসে থামি যেখান থেকে সব পথ উপরের দিকেই যায় । উপন্যাসটা ছদ্মনামে প্রকাশ করার পর টোপাজকে নিয়ে আর কিছু লিখিনি । অথচ দু তিনখানা সিকোয়েল বেরিয়ে গেল বাজারে । তার প্রত্যেকটার শেষ পাতার শেষ লাইনে নাটকীয়ভাবে খুনীর নাম ফাঁস ও রহস্যোদ্ঘাটন - অথচ গল্পটা হয়ত মূর্তি চুরির যার সঙ্গে সে সব খুনের কোনো সম্পর্কই নেই । পরিষ্কার মহেন্দ্রবাবুর অসুস্থ রসবোধের পেটেন্ট পদচিহ্ন । কিছুদিনের জন্য ঘন হতাশায় ভুগেছিলাম এই ভেবে যে এসব নিশ্চয়ই মহেন্দ্রবাবুরই কাজ । পরের বছর ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশান নেবার সময় থার্ড লিস্টের ওয়েটিং-এ নাম উঠল । চিরকাল ওয়েট করে কাটিয়ে দেব এই আশাতে দিন কাটাচ্ছিলাম । এমন সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আগের তিনজন ক্যাণ্ডিডেট এল-এস-ডি আর ঈথার একসঙ্গে নিয়ে ফুর্তি করার নামে ধরাধাম থেকে নাম কাটিয়ে চলে গেল । আমার নাম ওয়েটিং থেকে বেরোয় সকাল দশটায় । লিস্ট ক্লোজ হয়ে যায় একঘন্টা পর । এরই মধ্যে ফি-টি জমা করে মেজোমামা আমায় ফিট করে দিয়েছে । ব্যস সেই যে লাইনে ঢুকে পড়লাম, সামনের বগি আঁকড়ে ধরে গড়-গড় গড়-গড় করে আজও আপদ বিপদ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি । ভাবলে মনে হয় অবিশ্বাস্য ।


    একটার পর একটা মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছিল । মিনিটের পর ঘন্টা । গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঝুপঝুপ করে পড়তে থাকা মেঘ আর বৃষ্টির মধ্যে আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এসেছে যখন তখন সার্ভেন্ট্স্‌ কোয়ার্টারের ঘরে একটা মোমবাতি জ্বললো । জানলায় ব্রিটিশ যুগের ময়লা কাঁচে কারো ছায়া অস্থিরভাবে এদিক থেকে ওদিক করছিল । বাঁদিকে যে মাঠ চলে গেছে সম্বলপুরার যমুনা অবধি সেখানে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে চকচকে চার জোড়া চোখ তাকিয়েছিল আমাদের দিকে । একবার নড়তেই তারা হি: হি: করে হাসতে শুরু করল ।

    পরে হায়নাগুলোও পালাতে শুরু করল । টোটোদার নিশ্বাসের শব্দটা বন্ধ হয়ে গেছে তখন । কুয়াশার মধ্যে থেকে যে প্রথম ছায়াটা বেরোচ্ছিল সেটা একটা কুকুরের ।


    সত্যিকারের মেজর কলাশকরের ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলো প্রেরকের নাম ঠিকানা ছাড়া এসে জমা পড়ত সুরিন্দার ত্রিবেদীর প্রেসের অফিসে । লেখা ছাপাবার নাকি একটাই শর্ত ছিল । লেখার কোনো অংশ এডিট করে বাদ দেওয়া যাবে না । এইভাবে চলছিল । সুরিন্দার আগরা, মথুরা, লখ্নৌ, ইলাহাবাদ থেকে খবরের কাগজ আনাতেন । কয়েক বছর পরে বোঝা যায় কলাশকরের গল্পে যে খুনখারাবার দৃশ্য ছিল তার রিয়্যালিস্টিক ডিটেল নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে হিন্দী খবরের কাগজের রিপোর্টের সাথে । সমস্যা একটাই । কলাশকরের ম্যানুস্ক্রিপ্ট জমা পড়ে যাচ্ছে খবরের কাগজে ডিটেল বেরোবার অনেক আগে । ততদিনে তিরিশটা বই ছাপানোও হয়ে গেছে । আব্বাসের পরামর্শ অনুযায়ী সুরিন্দার কলাশকরের ম্যানুস্ক্রিপ্ট ছাপানো বন্ধ করে মহেন্দ্রবাবুর ওয়ার্কশপ থেকে বেরোনো ককটেল ছাপাতে শুরু করলেন ।


    কুকুরটা আমাদের দিকে না এসে আবার ফিরে গেল কুয়াশার ভিতর । দ্বিতীয়বার বেরোল মনিবকে নিয়ে । গায়ে টি-শার্ট, ঢোলা হাফ প্যান্ট, পায়ে হাঁটু অবধি মোজা আর বুট । পকেটে কি আছে জানার উপায় নেই ।

    বৃষ্টির মধ্যে এবার একটা লোক ।

    - মেজর কলাশকর । ফিসফিস করে বলল টোটোদা ।

    চওড়া, ভারি, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার লোকটা মাঠ ভেঙে এগিয়ে আসছিল আমাদের দিকে । কাঁধদুটো তার ঝুলে পড়েছে । হাঁটছেও আস্তে আস্তে । মাথাটা নিচু করে । সার্ভেন্ট্স্‌ কোয়ার্টারের ভিতর থেকে মোমবাতি নিভিয়ে দিয়েছে কেউ । রবারের বুট দিয়ে ভিজে বালি মাড়াবার শব্দ আসছিল আমাদের কানে । নিজেদের স্যাণ্ডেলগুলো গেঁথে রেখেছিলাম মাটিতে । লোকটা প্রায় একশো গজ দূরে এসে কোয়ার্টারের দিকে ঘুরে গেল । পরে দূর থেকে শুনলাম কোয়ার্টারের দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ আওয়াজ । কুকুরটা ভুক ভুক করে ডাকতে লাগল । কেউ তাকে চুপ করাচ্ছিল । টোটোদা ফিসফিস করে বলল - লাইট্স্‌ অন, লাইট্স্‌ অন । কিন্তু লাইট কেউ অন করল না । দরজাটা খুলল । ঘর অন্ধকারেই ঢাকা । আলোর কোনো পাত্তা নেই । হয় ফিউজ উড়েছে, নয় তার পার্ট ভুলে গেছে গজলচি । লোকটা কি ঢুকে গেল ? না গজলচি বেরিয়ে এল ? নাকি ওরা দুজনেই লুকিয়ে আছে আর তৃতীয় কেউ বেরিয়ে এল সার্ভেন্ট্স্‌ কোয়ার্টারের পিছনের অন্ধকার থেকে ? টোটোদার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল প্ল্যান মাফিক আর হচ্ছে না সব কিছু ।


    কলেজে ঢোকার পর পম্পা আর আমার সম্পর্ক দু-দুবার কাট অফ হতে হতে রক্ষা পায় । দুবারই আমার বন্ধুদের কেন্দ্র করে । প্রথমবারের কারণ অতি সামান্য । পম্পার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এনগেজ্ড্‌ হবার পর সাজ-পাট দিয়ে তার বম্বাইয়া বয়-ফ্রেণ্ডকে নিয়ে আমাদের কলেজে এসে যখন বলছিল - ইয়ে মেরে ফিয়াঁসে হ্যাঁয়, তখন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আর আমার তিনজন সহপাঠী একসঙ্গে - কাঁহাসে হ্যাঁয়, কাঁহাসে হ্যাঁয়, বলে ফুকরে উঠেছিল । তায় কলেজের চাপরাশি বলল - যেখান থেকেই হোক, সেখানে ফিরে যাবার কী নেবে তাই বলো । তারপর আর কি ? তু-তু-ম্যাঁয়-ম্যাঁয় । আমার একশো অনুনয় উপেক্ষা করে সেই বম্বের বয়ফ্রেণ্ডের হাত উঠল, এবং দুখানা হয়ে নামল । সে হাত তো দু'মাসেই জুড়েছিল কিন্তু পম্পার সঙ্গে আমার সম্পর্ক জোড়া লাগেনি ছ'মাস । আর দ্বিতীয়বারের কারণ পম্পার যে ডবল প্যান্টি পরার অবসেশান সেটা বেখেয়ালে মুখ দিয়ে কখন বেরিয়ে গিয়ে চাউর হয়ে গিয়েছিল ।

    পম্পার চেয়ে আমি আড়াই বছরের ছোট বলে ওর মা একসময় আপত্তি তুলেছিলেন । প্রবুদ্ধ আবার সেদিন সঙ্গে ছিল । - ঠিক আছে আমরা আড়াই বছর পর আবার আসছি । তদ্দিন মেয়েকে একটু ফ্রিজে রাখুন - বলে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে বের করে আনে । পরে শুনলাম পম্পার বাবা প্ল্যানচেটে আমার বাবাকে ডাকবেন কনসাল্ট করার জন্য । তারপর বহুদিন কোনো খবর নেই । অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম বাবা নাকি সূক্ষ্মশরীরে এসে শুধু আবোল-তাবোল কথা বলে গিয়েছিলেন । পম্পার বাবার বিলায়তি পানির অভ্যেস ছিল । দোষের কিছুই নয় । সে সব না খেয়ে আর কটা প্ল্যানচেটের আসর বসে ? তো বোতল গেলাশ সরিয়ে ফেলার আগেই আমার মার্কস্বাদী পিতা আসরে অবতীর্ণ হয়ে - মাই ডিয়ার আনকালচার্ড স্কাঊণ্ড্রেল্স্‌ বলে সভাকে সম্বোধন করেন । তারপর হাতাহাতি - অর্থাৎ ওরা সবাই মিলে আমার বাবাকে, মিডিয়াম মারফত, ধরে মারধোর দেয় । সেই কাণ্ডের পর, বোধহয় বাবাকে শাস্তি দেবার জন্যই, ওদের বাড়ি থেকে সব আপত্তি তুলে নেওয়া হয় ।

    পম্পার বাবার বিলায়তি পানিগুলো চুরি করে দুপুরে আমরাও কম খাইনি । একদিন ভদকা সেবনের পর অন্ধকার ঘরে কালো চশমা পরে আমি আর পম্পা `শেক বেবি শেক' গানের সঙ্গে নাচছি এমন সময় ওদের চাকরটাও কখন আমাদের মধ্যে ঢুকে নাচতে শুরু করেছে বুঝতে পারিনি । তারপর যখন সে ভুল করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখতে গেল তখন টের পেলাম যে বোতলের বাকি অর্ধেকটা সে গ্রহণ করেছে । সেবার বোতলে পুরো জলই গেল । পম্পার বাবা ভদকাটা স্পেশাল দিনের জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন । খেতেন না । পরে কখনো পয়সা হলে বোতল পাল্টে দেব কথা দিয়ে রাখলাম পম্পাকে ।

    এইভাবে সম্পর্কের বন্ধুর পথে কখনো আপ কখনো ডাউন হতে হতে চলছিলাম বলা যায় । অবশ্য এক দিক থেকে পম্পা সব সময়ই আপ । চেয়ার থেকে তার বিছানায় রিল্যাক্স করার অনুমতি পাবার পর দেখলাম যে তার ডমিনেশনের ফেটিশ । উপরে থাকার স্বাদ পেয়ে আর নিচে নামতেই রাজি নয় । ওদিকে আমার একটু ভার্টিগোর ধাত । হয়ত এই বিরল মিলের জোরেই আমরা দুজন ক্রোমোসোমের ফেভিকলে ফিট করে গেলাম এ-যাত্রা । লোকে অনেক বদনাম দিলেও কলেজে পড়ার দিনগুলোতে আমাদের কৌমার্য ক্ষয় হতে হতে একটা আইনী প্যাঁচের সৌজন্যে একটুর জন্য পুরোপুরি বিনষ্ট হয়নি । পরে টোটোদা উকিল হবার পর এসব জেনেছিলাম ।


    এক দুই করে সেকেণ্ড গুনতে গুনতে শুনতে পাচ্ছিলাম সার্ভেন্ট্স্‌ কোয়ার্টার থেকে একটা মৃদু বচসার আওয়াজ । ভলিউমটা আস্তে আস্তে বাড়ছিল । হঠাৎ কুকুরটা চিত্কার করে উঠল ঘেউ ঘেউ করে । বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল তখনই । কিন্তু দূরে সম্বলপুরার স্লুইস গেট অবধি কেঁপে উঠল এর পরের আওয়াজটাতে ।

    - গড়াম্‌ ।

    চোখের সামনেই অর্জুন গাছের উপর থেকে বাদুড় আর শকুনগুলো ভয় পেয়ে পত পত করে উড়ে গেল বৃষ্টির আকাশে । টোটোদা আমার হাত ধরে বলল - হয়ে গেছে বিজয়া দশমী । আমরা গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে নিচু হয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম ই-কোয়ার্টারের ভাঙা দেয়ালের পিছনে । মাঠ আর রাস্তা থেকে জোরালো আলো ফেলে ততক্ষণে দুটো গাড়ি আসতে শুরু করেছে । আমাদের পরিষ্কার কালো ছায়া পড়ল কোয়ার্টারের দেয়ালে । জিপের আলোয় দেখি কুকুরটা গজলচিকে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে আর শর্টস্‌ পরা হাট্টাকাট্টা লোকটা মাটিতে ঝুঁকে কী যেন কুড়োচ্ছে । বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি । আমি সড়াৎ করে পিছলে পড়তে পড়তে টোটোদাকে ধরে সামলালাম ।

    দূর থেকে মাইকে কে যেন বলল - ঠহর যা । ঠহর যা । রুক । কিন্তু লোকটা উঠতে থাকল । এবার চড়া আলোয় দেখলাম মুখ । ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, চোখের নিচে পাউচ, সারা মুখ ঝলমল করছে বৃষ্টির জলে । নাকের মাঝখানে একটা কাটা দাগ । লোকটা স্বপ্নোথ্থিতের মত স্লো মোশনে হাতের পিস্তলটা তুলে গজলচির দিকে তাক করতে শুরু করল । হঠাৎ কোয়ার্টারের দিকের অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা লোক বেরিয়ে তীর বেগে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে । প্রকৃতই বিজয়া দশমী । আমি আর টোটোদা হুড়মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম মাটিতে । - ডোন্ট শুট, ডোন্ট শুট, বলছে কেউ । গজলচি এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠতে থাকা পিস্তল লক্ষ্য করে দিল একটা ঝাঁপ । কোয়ার্টারের দিক থেকে যে লোকটা গজলচির দিকে দৌড়ে আসছিল সেও ডাইভ দিয়ে মাটিতে । তখন তিনদিক থেকে গড়াম গড়াম করে তিনরকমের শব্দ । এবং সম্বলপুরার স্লুইস গেট থেকে আবার তার অপ্রাকৃত প্রতিধ্বনি । মনে হল ড্যাম ভেঙে গেছে । কুকুরটা চিত্কার করে উঠল শেয়ালের মত । মাঠের অন্ধকারে প্রতিধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে হাসতে থাকল হায়নাগুলো । আব্বাস বেগ মাটি থেকে উঠে আবার ছুটতে শুরু করলেন । আবার সরস্বতী তোমরের গলা পেলাম - ডোন্ট শুট, ডোন্ট শুট । এবং তার পরেও একটা গুলির শব্দ এল আমার কানে । কিন্তু সেটা ধ্বনি না প্রতিধ্বনি সে হিসেব রাখার মতও অবস্থা নয় তখন ।



    পরে কোনো আসামী না থাকায় কোর্টে কেস ওঠেনি । কিন্তু খবরের কাগজে আব্বাস বেগ একাই প্রায় ছ'মাস ধরে লড়ে গেলেন । আব্বাসের বক্তব্য ছিল - গজলচিকে পুলিশ সরকারি উইটনেস বানিয়ে রেখেছিল । কিন্তু যখন আসামীই নেই তখন আর উইটনেস কিসের ? মারো শালাকে ধরে ।

    ধারাবাহিক উপন্যাসের মত রোমাঞ্চকর এই প্রবন্ধের সিরিজে আব্বাস দেখান যে একটা রাজস্থানী কিলার গ্যাং-এর সঙ্গে গজলচির বহুদিনের সম্পর্ক । আব্বাসের মতে গজল নয়, কনট্র্যাক্ট ছিল মার্ডারেরই । গজলচি বা তার দলের লোকেরাই স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী মার্ডারগুলো করাচ্ছিল দিল্লীতে । আশ্চর্যের কথা এই যে এর পরেও কিন্তু মেজর কলাশকরকে নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ আলোচিত হয়নি খবরের কাগজে । যার থেকে আমরা বুঝেছিলাম যে সরস্বতীর পক্ষেও এই সত্য উদ্ঘাটন করার পথে বাধা আছে । হয়তো কারো কাছে কথা দেওয়া ছিল তাঁর ।

    মনুর ধারণা ছিল আব্বাসের থিওরিই ঠিক । আসলে কলাশকরের লেখক একজন সাইকোপ্যাথ হলেও - হাতের নয়, কলমের । সে তার লেখার ডিটেলগুলো পয়সা দিয়ে কিনত পেশাদার খুনেদের কাছ থেকে । সুরিন্দার এটা বুঝতে পেরে তাকে নভেল থেকে বাদ দিলে সে হুমকি ভরা চিঠি দেয় । তারপর সেই চিঠির স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সুরিন্দারের পরিচিত লেখকদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হতে থাকে । মানে কলাশকরকে যারা কিডন্যাপ করেছে তাদের রক্ত দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে যতদিন না কলাশকরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় আসল লেখকের কাছে ।

    আমরা জিজ্ঞেস করলাম - আর গজলগুলো আসলে কার লেখা ?

    মনু বলল - রুমী মান্তো যে গানগুলো গাইত সেগুলো বোধহয় তার নিজেরই । অরিজিনাল রাজস্থানী কথাগুলো শুনলে আমরা চিনতে পারব না । কিন্তু রুমীর নিজস্ব সাইকোপ্যাথির একটা অংশ ছিল ট্র্যাডিশনাল ঠগী গানগুলোকে উর্দু করে গাওয়া । তো তাতেও কোনো ক্ষতি হত না কেননা শিমলিপুর থানার জলসায় এই গানই গেয়ে সে আগে অনেক হাততালিও পেয়েছিল । তবে সেগুলোর কিছু কিছু যে কলাশকরের লেখকের চিঠিতে চলে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারেনি । সুরিন্দার কানেকশানটা করতে পেরে মরীয়া হয়ে বেনামে সেই চিঠিই আবার পাঠাতে থাকেন পুলিশকে । এবং তাতে কাজ না হলে আব্বাসের শরণাপন্ন হন । আব্বাসের মতে তাঁর চীনে ড্রাইভার যখন রুমীকে ধরে ভয়ংকর মেরেছিল তখন যদি পুলিশ তাদের না ধরত তাহলে আব্বাস নাকি কেসটা একাই সঠিকভাবে সল্ভ করতে পারতেন ।

    সেই চীনে ড্রাইভার কীভাবে পুলিশের চোখে ধূলো দিল এটা যখন আমি আর টোটোদা মনুকে জিজ্ঞেস করলাম তখন সে খানিক ভেবে নিয়ে বলল - চামচিকের মত ঝুলে ছিল জিপের তলায় ।

    টোটোদা বলল - তুই হঠাৎ আব্বাসের ফরে হলি কি করে ? ও না পাকিস্তানের স্পাই ?

    - কিম্বা রিসার্চ অ্যাণ্ড অ্যানালিসিস উইং-এর অ্যাসোসিয়েট । হয়ত ওকে ডীপ কভারে রাখার জন্যই ধূপেন্দ্র নানা রকম গল্প ছড়িয়েছে । নইলে এরকম প্রচণ্ড লয়ালটি বেরোল কী করে ? আব্বাস লিখেছে কী দেখেছিস ?  ধূপেন্দ্রকে কেউ একা হাতে নাকি মারতে পারে না । একটা গোটা রাজস্থানী টিম এসেছিল কাজটা করতে । পালের গোদা ওই মান্তো । নইলে ধূপেন্দ্র সব জেনেও মেজর কলাশকরের সঙ্গে দেখা করতে কুদসিয়া গার্ডেনে যাবে কেন ?

    মনুর এসব কথা পুরোপুরি যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তা জেনেও জিজ্ঞেস করলাম - আব্বাস এখন কী করবেন ?

    - মান্তোকে ও ছাড়বে না । মান্তোর পূর্বপুরুষরা ছিল উত্তরভারতের ঠগী । এখনো সমস্ত নর্থ ইণ্ডিয়া জুড়ে ওদের কারবার । কলাশকর প্রথম প্রথম ওদের কাছ থেকে গল্প কিনত । পরে তার নিজের মাথাটাও খারাপ হয়ে যেতে থাকে । তারপর যে কী হয় কেউ ঠিক জানে না । দিল্লীতে সে কি সুপারি কিনেছিল ? নাকি সেসবও মান্তোরই কোনো কারসাজি । কে জানে ? মোটকথা মান্তোদের সে এত ভয় পেত যে কোনোদিন নিজের পরিচয় ফাঁস করেনি । খুব সম্ভবত রাত্রিবেলা মুখ ঢেকে হ্যাজাকের আলোয় দেখা করত । পরে যখন সরস্বতী তোমর মান্তোকে ধরে জেলে পুরলেন তখনই বোধহয় মান্তো ঠিক করে দরকার হলে কলাশকরকে ঠিকানা লাগাতে হবে । মুশকিল হল কলাশকরকে কোথায় পাওয়া যাবে সে জানত না । তো এই সময় বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল, তোরা প্ল্যান ফাঁদলি মান্তোকে কলাশকরের অফিসে পাঠাতে হবে ব্ল্যাকমেল করার জন্য । কলাশকরের তখনই খেল খতম । আব্বাস কি সাধে খেপে আছে পুলিশের উপর ?

    - কিন্তু কলাশকরই তো গজলচিকে খুন করার জন্য পিস্তল সঙ্গে করে নিয়ে যায় ।

    তো মনু বলল - পিস্তলটা মাটিতে পড়ে ছিল । কার পকেট থেকে বেরোলো সেটা জানলি কি করে ? আর তাতে কোনো গুলি ছিল না কেন ?

    আমি আর টোটোদা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম ।

    আসলে আমরা শিমলিপুরের লোকেরা কিচ্ছু জানতাম না । কিচ্ছু বুঝতাম না । লোকে যখন যা বোঝাতো তাই বুঝেই আমাদের চলেছে চিরকাল । পরে মেজোমামা এমনকি বলল - মহেন্দ্রবাবুই পুরো ষড়যন্ত্রটা করে কেমন দিব্যি ছাড়া পেয়ে গেলেন দেখলি ? লোকটা আসলে পাগল নয়, পাগলের অভিনয় করে । আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম - তাহলে মহেন্দ্রবাবুকে গুলি করল কে ? মামা বিরক্ত হয়ে বলল - যেই করে থাকুক, তার আরো প্র্যাকটিস করা উচিত ছিল ।



    বৃষ্টিতে আব্বাস উঠে দৌড়তে গিয়ে আবার পিছলে গেলেন । তারপর একটা অদ্ভুত দৃশ্য । আব্বাস গজলচিকে ধরে উঠবার চেষ্টা করছেন । গজলচি আব্বাসকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে । দূর থেকে ধুপধাপ করে ছুটে আসছে পুলিশের দল । সরস্বতী তোমর অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে এসে পড়লেন । আব্বাসকে বললেন - লেট গো, লেট গো । আব্বাস ততক্ষণে গজলচিকে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে তার গলা মাড়াচ্ছিলেন । লোকটা আর কতক্ষণ বাঁচবে এ নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল । ঠাণ্ডা মাথায় চারটে কনস্টেবল এসে আব্বাসকে কী যেন বোঝাতে শুরু করল ।

    অন্য পুলিশগুলো জড়ো হচ্ছিল আস্তে আস্তে । আমি আর টোটোদা ভাঙা পাঁচিলের আড়াল থেকে বেরিয়ে সরস্বতী তোমরের পাশে দাঁড়াবার জন্য হাঁটতে লাগলাম ।

    মাটিতে চিত্পাত হয়ে শুয়েছিল যে লোকটা তার ছবি কোনো বইয়ের মলাটে নেই । কুকুরটা তখনও ভুকভুক করে ডাকছে আর গাল চেটে দিচ্ছে তার । কিন্তু মেজর কলাশকরের আসল লেখকের খোলা চোখের দৃষ্টি তখন ইনফিনিটিতে বিদ্ধ ।

    এক এক করে হাবিলদার আর কনস্টেবলদের আসার পালা । মৃদু গুঞ্জনও শুরু হল এবার । একজন বলল - জিন্দা হ্যায়, নইলে জিভ বেরিয়ে পড়ত । কুকুরটা ডাকাডাকি ছেড়ে শুধু মাঝে মাঝে চাটছিল মনিবের মুখ । আরেকজন বলল - অজ্ঞান হলে বারিশে জ্ঞান ফিরে আসত না ? তৃতীয়জন বলল - ইয়ার মনে আছে ওর `দুলহন কী দুসরী রাত' বইটাতে কুত্তা কাটার পর একটা লোক জিন্দা হয়ে গিয়েছিল ?

    কিছুক্ষণের নীরবতা । বোধহয় আমরা অপেক্ষা করছিলাম কুত্তা তার মৃত মনিবকে এবার কাটে কিনা । সরস্বতী তোমর কেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন জানিনা । হয়ত ভাবছিলেন ধূপেন্দ্রর কথা । নকল কলাশকরের ককটেলে ড্রামা আনার জন্য যার সাহায্য নিতে গিয়েছিলেন ধূপেন্দ্র তাকেই দুদিন পরে সন্দেহ করতে শুরু করল পুলিশ । ধূপেন্দ্র কি এটা মেনে নিতে পেরেছিলেন ? সরস্বতীর সাথে কি তাঁর এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল ? কলাশকরের বকলম হিসেবে মহেন্দ্রবাবু আর ধূপেন্দ্রর পরিচয় ততক্ষণে ফাঁস হয়ে গিয়েছে আসল লেখকের কাছে । কিন্তু পুলিশ তাও কাউকেই বাঁচাতে পারেনি । এর জন্য কি সরস্বতী নিজেকে দায়ী মনে করেন ? ধূপেন্দ্রর খুনের পর থেকে তাঁর মুখ এরকম বিষন্ন কি এইজন্য ?

    টোটোদা কোনো কথা বলছিল না । হয়ত আরেকটুর জন্য নিজেই বেঁচেছে সে । আমার নাম ধার করে টোপাজের গল্প এদিক ওদিক দিয়ে আসার পর তার নামও হয়ত উঠে গিয়েছিল নকল কলাশকরের সম্ভাব্য লেখকের লিস্টে । সে হয়ত ভাবছিল - তার যা লাক - গুজ্জররাও তাকে মারতে পারেনি । সে ঠিক কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যেতই ।

    জানিনা কলাশকরের সত্যিকারের লেখক মাটিতে চিত্পাত হয়ে শুয়ে আমাদের দিকে চেয়ে হেসেছিল কিনা । হয়ত বিড়বিড় করে বলেছিল - তু মেরা খুশকি লে । নইলে টোটোদা আর সরস্বতী দুজনেরই থ্রিলার লেখার মেজাজ ছিল । আর আব্বাসের তো জীবনটাই একটা হাই স্পীড চেজ । কিন্তু এরপর আমরা যখনই কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেছি তো সেটা কম্বখ্ৎ একটা সামাজিক লেখাই হয়ে গেছে । আব্বাস মধ্যপ্রদেশের ট্রাইবদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার সময় নিজের প্রথম বইটা লেখেন । সরস্বতী আর টোটোদা, প্রায় দশ বছর বাদে কোলাবোরেট করে এমন সব ভারতীয় আইন নিয়ে একটা বই লেখে যাদের জুড়ি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই । বইটার নাম `ঘেরাও' । সেটা বেরোনোমাত্র ভারতে ব্যান এবং পাকিস্তানে হিট হয়ে যায় । সরস্বতী বেনামে না লিখলে তাঁর চাকরিও যেতে পারত ।



    কনস্টেবলদের একজন বলল - কুত্তাটাকে ছেড়ে গেলে তার কী হবে রে ?

    আরেকজন বলল - আচ্ছা সম্বলপুরার হায়নাগুলো এত হাসে কেন ?

    কেউ একটা বলল - গুজ্জররা কাতুকুতু দেয় ।

    সরস্বতী তোমর আমার দিকে ভুরুটা তুলে প্রশ্নের ভঙ্গিতে তাকালেন ।

    মনে মনে সারাদিন ধরে আমি চাইছিলাম যেন দুমাস আগে কলেজগ্রাউণ্ডের মাঠে এবং দুদিন আগে অল ইণ্ডিয়া ইন্স্টিটিউটের লবিতে দেখা লোকটাকে চিনতে আমার ভুলই হয়ে থাকে । কিন্তু নাকের মাঝামাঝি একটা কাটা দাগ । সেটা যে আমারই ছোঁড়া পাথরের কাজ তাতে আর সন্দেহের কোনো কারণ নেই । বৃষ্টিটা একটু হালকা হয়ে এসেছিল । দেখলাম মেজর কলাশকরের লেখক আরামে চিৎ । বুকের উপর মাছির মত বসা একটা কালো ফুটো । বিশেষ কোনো রক্তের দাগও নেই । মুখের একধার দিয়ে যতটুকু বেরিয়েছিল তাও মুছে গেছে জলের ধারায় । মাথাটা নাড়িয়ে আমি সরস্বতীকে জানিয়ে দিলাম - হুঁ ।


    পেশাদার প্রকাশক সুরিন্দার ত্রিবেদী সেদিন রাতবিরেতের গজলের ভয়ে সোজা লাদাখে গিয়ে থেমেছিলেন । সমস্ত-দিন ধরে দর কষাকষির পর মহেন্দ্রবাবুর দেহকে আটটা জোনে ভাগ করে আটজন হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট নিজের নিজের হিস্সা বেছে নিচ্ছিলেন আপ্রেশনের জন্য । আব্বাস বেগ সরস্বতী তোমরের চোখের সামনেই নিজের হাতে কানুন নিতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বারংবার ।

    মেজর কলাশকরের জনক এবং আমাদের সময়ের অবিসংবাদিত সেরা থ্রিলারের লেখক কমল সাহনি তখন পাঁচ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে আর ফিরবেন না বলে শুয়ে ছিলেন শিমলিপুরের ভিজে ধূলোয় ।




    (শেষ)


  • | | | | | | | | | ১০ | ১১
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments