মেজর কলাশকর
পার্কের পাশের এই রাস্তাটা দিয়ে আগে কোনদিন ছুটিনি এমন নয় । ডানদিকে রেলিংএর গা ঘেঁষে বেলফুলের গাছ একটার পর একটা । মাঝখানে একটা ছোট কাট্ । সেখানে ভল্ট্ করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে । ভিজে ঘাসের গন্ধ । রীতিমত অন্ধকার । কোনাকুনি ছুটেই ত্রক্রস করলাম পার্কটা । উল্টোদিকে আরেকটা কাট্ ব্যবহার করে আবার রেলিং টপকে বড় রাস্তায় । জীপটাকে আর দেখা গেল না ।
বক্সি রোডের গুরদুয়ারার সামনে কিরানার দোকান থেকে একটা মোটা মোমবাতি কিনলাম । টিমটিম করে জ্বলছে পঁচিশ ওয়াটের বাল্ব । এদিকটাও অন্ধকার । কোন রাস্তা দিয়ে ফিরব ভাবছিলাম । এমন সময় দেখি কোর্তা আর চড্ডি পরা একটা বিরাট নিহাঙ্গ তার তলোয়ার ঝুলিয়ে গুরদুয়ারা থেকে বেরোচ্ছে । লোকটা বক্সি রোডে উঠে আমাদের বাড়ির দিকেই ঘুরল । আমি ছুটে গিয়ে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম ।
পার্কের ধারে জীপটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না । নিহাঙ্গ বক্সি রোড ধরেই চলল । আমাকে ঢুকতে হবে কোযার্টারগুলোর দিকে । পার্কটা পেরিয়ে অন্ধকার গলি দেখেই সুট করে ঢুকে পড়লাম । আর পাঁচশো গজ । হঠাৎ মনে পড়ল পম্পা মুখার্জির সঙ্গে কুকুর তাড়া খাবার কথা । সে থাকলে কে আজ ধরত আমায় ?
একজন বেরোলো সামনের কোয়ার্টারের বাগান থেকে । আরেকজনের পায়ের আওয়াজ পেলাম পিছনে । সামনের দিকের লোকটাকে তাক করে ছুটলাম এবং ফুলস্পীডে মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম তার সোলার প্লেক্সাসে । `বহন-কে' বলে লোকটা দড়াম করে চিত্পাত হয়ে পড়ল মাটিতে । কিন্তু পড়তে পড়তেও ধরে ফেলল আমার বাঁ পা-টা । আমি গিয়ে পড়লাম তার বুকের উপর । আর্মির ইউনিফর্মটা নজরে পড়ল এবার । লোকটা আবার `হারাম' বলে গাল দিতে যাচ্ছিল - সেই সুযোগে হাতের মোমবাতিটা আমূল ঠেসে দিলাম তার আলজিভের ভিতর । কাশতে কাশতেও পা ছাড়ল না তবু লোকটা । একটু ডেসপারেট হয়ে এবার মোমবাতিটা তুলে তার চোখে বসাতে যাচ্ছিলাম । হঠাৎ দেখি একটা চোখ ফুটো । তাতে কোনো মণিই নেই । আতঙ্কেই বলা যায়, আমার হাতটা অ্যাকশানের মাঝখানে মূর্তির মত স্থির । লোকটা ভীষণ রেগে মোমবাতিটা কেড়ে দুটুকরো করে ফেলল । আর আমি থ থ করে বললাম - সরি, সরি ।
লোকটা একটা ঝাপড় তুলেও সামলে নিল । তারপর দেখি আমি শূন্যে - লোকটা আমাকে কলার ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পার্কের অন্যদিকে দাঁড়ানো জীপটার দিকে । পিছনের পায়ের শব্দটা যারই হয়ে থাকুক সে এই জীপের ধারে কাছে আসেনি । জীপের ভিতর সোজা গিয়ে পড়লাম ফোমের সীটে । দুদিকে দুটো চেনা লোক পাইপ খাচ্ছে । এরা কেউই জীপ থেকে নামেনি । কানা আর্মি অফিসার জীপ স্টার্ট দিল । তখনও আমার মনে হচ্ছে একটা লোককে যেন ফেলে যাচ্ছি । তবে জীপে আর কেউ উঠল না । পার্ক ঘুরে আমরা উঠে পড়লাম বড় রাস্তায় ।
আব্বাস বেগ বললেন - আশা করি চিনতে পারছো ?
- ইয়েস স্যার ।
- দুজনকেই ?
- নিশ্চয়ই । সুরিন্দার ত্রিবেদী তো ।
- ভয় করছে ?
- নো স্যার ।
- পালাছিলে কেন ?
- কাজের তাড়া স্যার । বাড়িতে ফিউজ উড়ে গেছে আমাদের ।
পরে আব্বাস বেগ বার বার বললেন একটু নিরালায় গিয়ে কথা বলা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য ওঁদের ছিল না । সুরিন্দার ত্রিবেদী একটাও কথা বলছিলেন না । হয়ত নতুন নভেলের কথা ভাবছেন । জীপটা মলরোড ধরে সিভিল লাইনে ঢোকার পর কযেকটা অচেনা গলি ঘুঁজি দিয়ে একটা বাগানওয়ালা বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢুকে পড়ল । তখন আব্বাস বেগও কিছু বলছেন না । ঝিঁঝিঁর আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই । বাগানের চারদিকে উঁচু উঁচু দেবদারু গাছের সিলুট দেখতে পাচ্ছিলাম । বাড়িটার ভিতরেও বিশেষ আলো নেই । আমরা জীপেই বসে রইলাম । ইঞ্জিনটা বন্ধ করার পর কানা ড্রাইভার বেরিয়ে বাড়িটার দিকে চলে গেল ।
আব্বাস বেগ বললেন - খোলো ।
আমিও খুলতে শুরু করলাম । মানে গল্পটা । একেবারে গোড়া থেকে - প্রথম গজল শুনি যখন তখন থেকে । রাত্রিবেলা গজলচিকে অপহরণ করার ঘটনা এবং সরস্বতী-ধুপেন্দ্রর সঙ্গে বার্তালাপ পর্যন্ত । মিনিট কুড়ি লাগল পুরোটা খুলতে । সুরিন্দার আর আব্বাস কোনো প্রশ্ন না করে পুরোটা শুনে গেলেন ।
- ব্যস্ এইটুকু ?
- স্যার, ধূপেন্দ্র ভগওয়ানির ধারণা মার্ডারগুলো আপনারাই করাচ্ছেন । আপনাদের যেভাবে হোক উনি জেলে না পুরে ছাড়বেন না ।
- আলু কা পঠ্ঠা । বললেন সুরিন্দার ত্রিবেদী ।
- মানে উল্লু কা পরাঁঠা । বললেন আব্বাস বেগ । - গজলের বিষয়ে কিছু বলেনি ?
- সেগুলো তো ধূপেন্দ্র একটু পালিশ করে দিয়েছেন শুনলাম । ভালো হয়েছে নাকি আগের থেকে ।
- বলাত্কার হয়েছে । বললেন সুরিন্দার ত্রিবেদী । - রদিফ আর কাফিয়ার হিসেব জানে না তো লিখবে কী ? দশবছর আগে একটা বই ছাপিয়েছিল নৈনিতাল থেকে । নাম `মাফ কীজীয়ে মীর্জা' । সেটাতে কাব্য সমালোচনার নামে মীর, সৌদা, গালিব থেকে শুরু করে অমৃতা প্রীতম অবধি কবিদের নামে অশ্রাব্য কেচ্ছা । তারপর রাজস্থানে একটা কবি সম্মেলনে ওকে জুতো পেটা করা হয় । সঙ্গে একটা বছর দুয়েকের ছেলে ছিল । বাপ ছেলে দুজনেরই মুখে ভূষো কালি মাখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় রাস্তায় । পরে জানা গেল ব্যাটা সি-আই-ডি'র হয়ে লেফিটস্ট ইন্টালেকচুয়াল গ্রুপটাকে ইনফিলটারেট করেছিল । ভূষোকালির ঘটনার পর গভর্নমেন্ট একটা প্রোমোশান দিতে বাধ্য হয় ।
- গজলগুলো অরিজিনালি লিখল কে ?
সুরিন্দার আর আব্বাস পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন । তারপর আব্বাস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন - আমরা জানব কী করে ?
কানা ড্রাইভার একটা ট্রেতে করে চারটে বিরাট সিঙ্গাড়া আর চা নিয়ে এল । আব্বাস বেগ বললেন - গাজরের হালুয়া আনাব ?
- না না দরকার নেই । বললাম আমি ।
- পরে কাউকে বোলো না আমরা খাতিরদারী জানি না । পুলিশে কিছু জানালে তার খবর সরস্বতী তোমরের আগে আমরা পাই ।
আমি বললাম সরস্বতী আমাকে সাক্ষী বানাচ্ছেন না । সুতরাং সেদিক দিয়ে ভয়ের কিছু নেই । তবে ঘটনাটা আমি ছাড়া আরো অনেকে দেখে থাকতে পারে ।
আব্বাস বললেন - আরে ধুর্ । উইটনেস হবার জন্য যেন দিল্লী পুলিশের কাছে লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কেউ কিছু বলবে না । লাভ কী ? পুলিশের মাথায় এতটুকু ঘিলু থাকলে গজলচিটাকে উল্টো করে লটকে রাখত না যতক্ষণ না মুখ থেকে ঝুরঝুর করে খবর পড়তে থাকে ?
- আমার কিন্তু একটা মোমবাতি লাগবে ।
- সেটা ফেরার পথে কিনে নেওয়া যাবে ।
ফেরার পথে স্টিয়ারিংএ সুরিন্দার । কানা ড্রাইভার রয়ে গেল বাড়িতে । জীপটা স্টার্ট নেবার পর আব্বাস বললেন - প্রিন্সিপাল মহেন্দ্রবাবুর লেখাটা তোমরা ছাপাচ্ছো না কেন জানতে পারি ? &ত্রঢযৃ
লেখাটা টোটোদারা'ই আটকে রেখেছিল । ছাপলে নাকি মহেন্দ্রবাবুরই চাকরি খতরায় পড়ে যাবে । গল্পটার নাম `সেকেণ্ড চান্স' । তাতে কর্তৃপক্ষের ঢিলে নজর এবং নথিপত্রের গোলমালের জন্য প্রথমে একজন মেন্টাল ইনস্টিটিউশানের ইনমেট ও ওয়ার্ডেনের জায়গা বদল হয়ে যায় । তারপর আরো নথিপত্রে গণ্ডগোলের ফলে সেই ইনমেট ওয়ার্ডেন থেকে হয়ে যায় একটা স্কুলের প্রিন্সিপাল । এই ঘটনার পর তার বিশ্বাস হয় যে সুস্থ জীবনযাপনের এই যে দ্বিতীয় সুযোগ সে পেয়েছে সেই সুযোগ অন্যদের ক্ষেত্রেও করে দেওয়া তার কর্তব্য । সুতরাং সে কাগজপত্রে হেরাফেরি করে ফেল করা ছেলেদের পাশ এবং স্কুল-তাড়ানো বা জেল-পালানো ছেলেদের নির্বিচারে প্রিন্সিপাল-কোটায় ভর্তি করে নিতে থাকে । নিজের পূর্বতন ওয়ার্ডেনকে - যে কিনা উন্মাদদের মধ্যে থেকে থেকে এখন নিজেও প্রায় পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছিল - পাগলাগারদ থেকে বের করে আনার জন্য সে কয়েকটা গোপন অভিযান চালায় । প্রতিবারই কিছু ইনমেট সেকেণ্ড চান্স পেয়ে বেরিয়ে আসে । কিন্তু পাগল ওয়ার্ডেনকে আর কোথাও পাওয়া যায় না । দীর্ঘকাল এইভাবে চলতে থাকার পর শেষ পর্যন্ত একদিন স্কুলের তহবিলে গরমিল নিয়ে তদন্ত হবার সময় নকল প্রিন্সিপালের মুখোশ খুলে যায় । শেষ দৃশ্যে তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে । ম্যাজিস্ট্রেট যখন একবাক্যে বেইলের কাগজে সই করে দিচ্ছিলেন তখন প্রিন্সিপাল গভীর সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে ম্যাজিস্ট্রেটই সেই হারিয়ে যাওয়া পাগল ওয়ার্ডেন । এই সঙ্গীন মুহূর্তেও দুজনে দুজনকে চিনতে পেরে কোলাকুলি করে । এই হল গল্প । পরে ফুটনোটে বলা ছিল যে সরকারী ফাইলে আরো দু-একটা মাইনর টাইপো'র ফলে শেষ পর্যন্ত ফ্রড কেসের আসামী একটা ছোট স্টেট মিনিস্টারি পেয়ে আসামে চলে গিয়েছিল । &ত্রঢযৃ&ত্রঢযৃ&ত্রঢযৃ&ত্রঢযৃ
আব্বাসকে আমি বললাম যে ছাপানোর ক্ষমতা আমার হাতে নেই, স্কুল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের হাতে । আব্বাস বললেন - খুন ফুন আমরা করতে পারি বিশ্বাস কোরো না । মহেন্দ্রবাবুকে জিজ্ঞেস করো । ভয়ানক বিশ্বাসযোগ্য লোক । আশ্চর্য টেলিভিশন পার্সোনালিটি । যবে থেকে `সদর বাজার'এ ফিচার করেছি, দর্শকের সংখ্যা ডবল হয়ে গেছে । একদিন মিনিস্টার ফিনিস্টার কিছু হয়ে যাবেন । সরস্বতী তো সেদিনের ছোকরি ।
- আপনারা এসবের মধ্যে জড়ালেন কেন স্যার ? জিজ্ঞেস করলাম ।
খানিক্ষণ দুজনেই চুপচাপ । তারপর আব্বাস বললেন - তুমি মেজর কলাশকরের সিরিজ পড়ো ?
- ওটা আমার ভীষণ প্রিয় ।
- এই সিরিয়াল কিলারের টার্গেট হল মেজর কলাশকর ।
- কিন্তু কলাশকর তো একটা গল্পের চরিত্র ! খুবই অবাক হয়ে বললাম । এতক্ষণে মনে হল যে এই ছ'ফুটের উপর লম্বা দৈত্যের মত দুটো লোক, যার একজনের একটা চোখ পাথরের মত স্থির, অন্যজনের ছ'ইঞ্চি লম্বা ছুঁচোলো গোঁফ, দুজনেরই মুখে পাইপ, গায়ে টেরিনের দামী শার্ট, পায়ে চকচকে সরু বুট - এরা যেন নিজেরাই এক একটা গল্পের চরিত্র । মেজর কলাশকর আর এর থেকে কম বিশ্বাস্যযোগ্য কীসের ? আমি এই দুই কমিকবুক হিরো বা ভিলেনের মাঝখানে বসে যে সরল বিশ্বাসে সব শুনছি বা বলে দিচ্ছি সেটাই তো আমার গাধামো । এবার এমন একটা কিছু শুনব যা না পারব গিলতে না পারব ফেলতে ।
কিন্তু আব্বাস বেগের আর কিছু বলা হল না । আমাদের জীপটা বাড়ির কম্পাউণ্ড ছেড়ে বেরোতেই দেখা গেল একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর রাস্তাটা ব্লক করে দাঁড়িয়ে । হেডলাইটের আলোয় দেখলাম বুশশার্ট পরা ধূপেন্দ্র ভগওয়ানি হ্যা হ্যা করে হাসছেন । হাত দুটো পিছনে । পা দুটো ফাঁক । পাশে পিস্তল হাতে দুটো কনস্টেবল । এতক্ষণে পার্কের ধারে পিছন থেকে যে অদৃশ্য পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম তার রহস্যটা বোঝা গেল ।
ধূপেন্দ্র এগিয়ে এসে বললেন - পহলে তো কহতে রহে আদাব আদাব । অওর যব দাব দিয়া তো খফা হো গয়ে ! লড়কে কো উতার সুরিন্দরে ।
জীপের পিছন দিক থেকে নামলাম । অন্ধকারে প্রায় সরস্বতী তোমরের সাথে ধাক্কা । ইউনিফর্ম পরা মহিলা পুলিশ অফিসার দেখে যা হবার কথা নয় তাই হল । একটু ঘাবড়ে গেলাম ।
- কুছ কিয়া ? জিজ্ঞেস করলেন সরস্বতী ।
- সমোসা খিলায়া । বললাম ।
উল্টোদিকে আব্বাসের সাথে ধূপেন্দ্রর তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গিয়েছিল । ধূপেন্দ্র বোধহয় হাতকড়া পরাতে যাচ্ছিলেন । আব্বাস খিঁচিয়ে উঠে বললেন - হোয়াট অ্যাবডাকশান ? &ত্রঢযৃছেলেটা নিজের মর্জিতেই এসেছে । সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম । ধূপেন্দ্র রেগে গিয়ে মুখ খারাপ করে ফেললেন । আমায় বললেন - দফা হো বহনচোদ । সরস্বতী আমাকে তাঁর জীপে নিয়ে গিয়ে তুললেন ।
একটু পরে ধূপেন্দ্র এসে হাজির । মনে হল পিছনের অন্য গাড়িটাতে আব্বাস আর সুরিন্দারকে তোলা হচ্ছে । ধূপেন্দ্র বললেন - সালা, আমার লোক স্বচক্ষে দেখেছে ওদের একজনের সাথে তুই ধস্তাধস্তি করছিলি ।
আমি মাথা নেড়ে বললাম - মিসআণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং । আমারই ভুল । পরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি ।
- হারামজাদা তুই দৌড়ে পালাচ্ছিলি না ?
- তো আপনার লোকটা ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি কেন ? জিজ্ঞেস করলেন সরস্বতী তোমর ।
ধূপেন্দ্র একটু থতমত খেয়ে বললেন - আমার অর্ডার ছিল ফলো করবার । যাতে আমরা ওদের হাতেনাতে ধরতে পারি ।
সরস্বতী কোনো একটা কারণে যেন রেগে গিয়েছেন মনে হল । আর কথা বললেন না ধূপেন্দ্রর সাথে । ধূপেন্দ্রকে তুললেনও না নিজের গাড়িতে । ড্রাইভারকে বললেন - চলো । তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন - তোমাকে আর থানায় নিয়ে যাবার দরকার নেই । কোথায় নামিয়ে দেব বলো ।
মোমবাতির আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম । এতক্ষণে বাড়িতে অন্য কোনো ব্যবস্থা হয়ে গেছে । আমি বাড়ির রাস্তাটা বলে দিলাম ড্রাইভারকে ।
সরস্বতী তোমর
সরস্বতী তোমর সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন খবর শুনেছিলাম ইদানিং । প্রথমেই মনু আর মনুর দিদি এসে ভগওয়ানি বুক অব হিস্ট্রি থেকে একটা সেরকমই রোমহর্ষক চ্যাপ্টার শুনিয়ে গিয়েছিল । মনু বলেছিল - &ত্রঢযৃজাট আর রাজপুতদের মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই । দুটোই ফাইটার জাত । গোত্র আর পদবী অনেক ক্ষেত্রেই এক । জাট চিনবি কী করে ? অহলাওয়ত, কলহন, করিওয়াল, ক্ষত্রি, খোকর, গরেওয়াল, গেহলট, ঘুম্মন, গিল, চোপড়া, চৌহান, ছ্যায়েল, তনওয়ার, তরার, তেজা, তোমর, দাহিয়া, নাঙ্গল এরা হল জাট । মনুর দিদি বলেছিল - &ত্রঢযৃ&ত্রঢযৃটোকাস, ঠাকর, ডাগর, ঢিলোঁ, পনওয়ার, পরমার, পাওয়ার, বাজোয়া, বানা, বেহল, ভার্মা, ভীল, ভালোটিয়া, মদান, মাহিয়া, মলহন, মলিক, মান, মাথুর, রঘুবংশী, রাজোরি, রাণা, রাওয়ত, লাম্বা, সেহরাওয়ত, সিধু, সোলাঙ্কি এরাও । কিন্তু এর মধ্যে বেশ কয়েকটা নাম রাজপুতদেরও হয় ।
এত পদবী আছে আমাদের দেশে যে বিশ্বাস করা কঠিন । মনুর দিদি বলছিল - সরস্বতী তোমর হলেন পুরোনো তোমর রাজপুতদের বংশধর । এরা সেই কবে রাজস্থান থেকে এসে দিল্লীর রাজা হয়ে বসেছিল । টোটোদা তার জবাবে বলল - আমরা সেনগুপ্তরা বুঝলে তো সেই গুপ্তযুগ থেকে ইণ্ডিয়া রুল করে এসেছি । আমাদের আমলে সব পীসফুল ছিল । তারপর এই হূন আর জাটদের জ্বালায় দাক্ষিনাত্যে চলে যাই । ইংরেজরা আমাদের চিনতে পেরে হাতে পায়ে ধরে আর্যাবর্তে ফিরিয়ে আনে । শিগ্গীরই আবার দিল্লীর সিংহাসনে বসব ।
মনু বলতে শুরু করল - &ত্রঢযৃদু চারটে সিন্ধী পদবীও চিনে রাখ । কখন কাজে দেবে তা তো বলা যায় না । &ত্রঢযৃ- আডওয়ানি, আগনানি, আসরানি, কলানি, কৃষ্ণানি, গিডওয়ানি, গুরনানি, বিজলানি, জেঠমালানি, খেমচন্দানি, লালওয়ানি, &ত্রঢযৃ... ।
আমি তড়িঘড়ি থামিয়ে বলেছিলাম - জানি । 'আনি' দিয়ে শেষ হলেই সিন্ধী । না হলে নয় । মনু বলল - কে বলেছে ? আহুজা, বথেজা, বজাজ, ভাটিয়া, ভগত, ছবরিয়া, গোগিয়া, হিন্দুজা, কুকরেজা, খট্টর, রাহেজা, রাজপাল, মুখী, সপরা, সিপ্পি, শ্রফ, ওয়ারদে এগুলোতে 'আনি' কোথায় ? আবার আম্বানি, সোমানি, ওয়াসানি, ভায়ানি এসব তো গুজরাটিদেরই পদবী ।
কথায় কথায় মনুদের কাছে জানতে পারলাম যে বছর কুড়ি আগে সরস্বতী তোমরের বাবা একদিন কী খেয়ালে সাধু হয়ে বদরিনাথে চলে যান । তার আগে ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি পড়াতেন । এর এক বছরের মধ্যে সরস্বতীর মা-ও হঠাৎ মারা যান । তখন সরস্বতী আর তাঁর দিদি বাসে চেপে হরিয়ানার গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে এক মামাকে ধরে নিয়ে আসেন । দুজনের বয়েস তখন বারো আর তেরো । নিজেরাই তদ্বির করে মামার একটা ছোটখাটো চাকরি করে দেন, যাতে বাড়ির খরচ এবং তাঁদের পড়াশোনাটা চলতে পারে । কলেজ পাশ করার পর সরস্বতীর দিদি ব্যাংকের অফিসার আর সরস্বতী পুলিশ অফিসার হয়ে যান । এদিকে মামাও প্রোমোশান পেয়ে পেয়ে কোন একটা চিরস্থায়ী সরকারী কমিশনের অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন । তিনজনের একজনেরও বিয়ে হয়নি । ফলে মনুর মতে সবাই মিলে এখন দুহাতে টাকা লুটছেন । - ইন ফ্যাক্ট এই সব খবর আব্বাস বেগের `সদর বাজার'-এও ফাঁস হয়েছে । বলল মনু । সে নাকি অনেক দিন আগেকার কথা । তখন সরস্বতী আর আব্বাসের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল । সরস্বতীর ইন্টারভিউ নেবার সময় আব্বাসের শেষ তিনটে প্রশ্ন ছিল - আপনি কত মাইনে পান ? বিয়ে করবেন কী ধরনের লোককে ? আপনার অ্যাম্বিশান কী ? উত্তরে সরস্বতী অ-পুলিশোচিতভাবে মধুর হেসে বলেছিলেন - মামুলি, মামুলি, মামুলি । তারপর আব্বাসের স্টুডিও মামুলি পুরুষদের প্রেমপত্রে ভরে যায় । আব্বাস নাকি বহুদিন ধরে ওই চিঠি একটা একটা করে লাইভ প্রোগ্রামে পড়ে শুনিয়েছেন ।
এইসব ঘটনা থেকে আব্বাস আর সরস্বতীর পুরোনো বন্ধুত্বের একটা আঁচ পাওয়া যায় । পরে সম্পর্কটা কীভাবে অবনতির দিকে গেল সে বিষয়ে মনুরা কিছু বলতে পারল না ।
কিন্তু পরে নেউলেদা'র একদিন কথায় কথায় বলল - মূলে আব্বাসের ইগো প্রবলেম । সেই যেবার ওকে শিমলিপুরের পাবলিক ধরে প্যাঁদালো তখন থেকে ব্যাটা সরস্বতীর উপর ক্ষেপে আছে ।
টোটোদা আর আমি গল্পের গন্ধ পেয়ে নেউলেদা'কে বাড়ি নিয়ে এলাম । নেউলেদা পানমশলা খেতে খেতে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বলল - আব্বাস একটা জলসা'র আয়োজন করেছিল । বেনেডিকশান কনভেন্টের অডিটোরিয়ামে বিখ্যাত তবলচি আখতার পহলভী আর মটকাবাদক কে-পি-জেড-আন্নাদুরাই'য়ের যুগলবন্দি হবার কথা । ইয়াং মেয়েদের মধ্যে আখতার পহলভীর তখন চূড়ান্ত পপুলারিটি । &ত্রঢযৃহিপ্পি স্টাইল লম্বা বাদামী ডাই করা &ত্রঢযৃচুল, ঢুলু ঢুলু চোখ, কথাবার্ত্তায় শার্প । ফিল্ম ফেয়ার ম্যাগাজিনে প্রায়ই ছবি বেরোয় । কনসার্টের শেষে আখতার সবার সামনেই স্টেজে মহিলা ফ্যানদের আদর খেত । তো শেষ মুহূর্তে বিশপ পুপ্পুর ফোন এল রোজাম্মার কাছে । আখতারের এসব উল্টোপাল্টা কাজ বেনেডিকশানে চলবে না । শুনে আখতারও খাপ্পা হয়ে বলল - বেনেডিকশানের মেয়েদের চুমু আমি খাবই খাব । এমন একটা অবস্থা হল যে শো প্রায় ক্যানসেল হয়ে যায় আর কি । শেষ পর্যন্ত মৈথিলী মার্কেটের মৈথিলী শেঠকে গিয়ে আব্বাস বোঝালো যে আখতার তো কিষন ভগওয়ানেরই রূপ । তখন শেঠ রাধামাধবের মন্দিরে সেই জলসার পারমিশান দিল ।
টোটোদা বলল - ও হ্যাঁ, সেই কনসার্টটার কথা শুনেছি মনে হচ্ছে । শিমলিপুর থেকে তো অনেক লোক গিয়েছিল ।
- সেটাই তো কাল হল । বলল নেউলেদা । - বাজনার শেষে মেয়েরা আখতারকে ছেঁকে ধরেছে । তার মধ্যে একটা শিমলিপুরের ইংলিশ জানা পাঞ্জাবী মেয়ে ছিল । নতুন বিয়ে হয়েছে । সে গিয়ে আখতারের গলা জড়িয়ে ধরল । আখতার সবে তাকে থাবড়াতে শুরু করেছে এমন সময় মেয়েটার হাজব্যাণ্ড গলা খাঁকারি দিয়ে বলল - অটোগ্রাফ ওনলি প্লীজ । আখতার মেয়েটাকে থাবড়াতে থাবড়াতে বলল - তাইই তো দিচ্ছি । লোকটা বলল - ওটা আমার বিবি । আখতার বলল - দ্যাট্স্ ইয়োর প্রবলেম । আমরা সবাই ঝিরি ঝিরি হাসতে শুরু করেছি হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই মেয়েটা নিজেই `হাউ ডেয়ার ইয়ু ইন্সাল্ট মাই হাজব্যাণ্ড' বলে মারল ঘুরে আখতারের গালে একটা প্রকাণ্ড চড় ।
তারপর নাকি অন্য মেয়ে ফ্যানরাও, যারা একটু আগেই আখতারের গলা জড়িয়ে ধরে তাকে আদর করছিল, হঠাৎ পাগলের মত তাকে চড় চাপড় চাঁটি মারতে শুরু করে । চুল খিমচে ছিঁড়ে ফেলে দিতে থাকে । তাদের কেউ তখন হাসছে, কেউ কাঁদছে - সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য হয়েছিল নাকি । পরে কোনো এক সাইকোলজিস্ট বলেছিলেন - রাগ নয় ওটা ছিল ভালোবাসারই মার । প্রচণ্ড আনন্দে পাগল হয়ে গিয়ে ফ্যানদের ওরকম ব্যবহার নতুন নয় । আখতারের আর্তনাদ শুনে একমাত্র আব্বাসই সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেই মহিলা মবের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে । কিন্তু আব্বাসের হাতে মেয়েরা ঝাপড় খাচ্ছে দেখে শিমলিপুরের পুরুষরাও স্টেজে উঠে পড়ে এবং তার ফল আব্বাসের পক্ষে খুব খারাপ হয় । ঠিক সময়মত সরস্বতী তোমর আধ ডজন কনস্টেবল নিয়ে লাঠি চার্জ না শুরু করলে কী হত বলা মুশকিল ।
নেউলেদার মতে যবে থেকে সরস্বতী গুরুতরভাবে আহত আব্বাসকে হিংস্র মবের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন তবে থেকে আব্বাসের একটা ইগো প্রবলেম হয়ে গেছে । তার উপর গুজবও আছে যে লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতালের লেডি সার্জেন সুশীলা পদ্মনাভন নাকি আব্বাসের পারমিশান ছাড়াই এক বোতল রাজপুত মহিলার রক্ত তাঁর শরীরে ঢুকিয়ে দেন । সেটা জানতে পেরে আব্বাস বাঘের মত সার্জেনকে অ্যাটাক করার চেষ্টা করেছিলেন । সেজন্য তাঁকে বেডের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয় ।
ধূপেন্দ্রর সামনে মিথ্যে কথাগুলো বলার জন্য আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল । জীপটা চলতে শুরু করলে আমি সরস্বতীকে বললাম - আব্বাস কিন্তু খুব ভালো ব্যবহার করেছেন । ওঁকে খুনী বলে মানতে পারছি না ।
সরস্বতী স্মিত হেসে বললেন - &ত্রঢযৃকেন ? সেরকম বুঝিয়ে দিয়েছেন নাকি ?
- সেটাও । তাছাড়া সুরিন্দারও বলেছেন । এতবড় একটা লেখক ... ।
সরস্বতী হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - কলাশকরের গল্পগুলো তোমার কেমন লাগে ?
- ভীষণ ভালো । &ত্রঢযৃ
- সব পড়েছো ?
- নিশ্চয়ই ।
- সম্প্রতি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছো ? প্লটে, বা স্টাইলে ?
- কই না তো ?
- এমন মনে হয়নি যে কলাশকরের ক্যারেক্টারটা পাল্টে গেছে ?
- অ্যাঁ ?
- মানে ধরো এই যে কলাশকর ফিরল রোহিলখণ্ড্ থেকে, মনে হয়নি একটা অন্য লোক ফিরে এসেছে ?
কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম । গাড়িটা শিমলিপুরে ঢুকে পড়ল । তিনকোনা মিউনিসিপালিটির পার্কের ভিতর দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছিল মুখে ।
সরস্বতী তোমর বললেন - কলাশকর কখনো চা খেত না, নতুন বইটাতে রাস্তার ধারে দোকানে বসে চা খেয়েছে । ফালতু হিউমার তার স্টাইল ছিল না । এখন দেখছি একটার পর একটা পি-জে মেরে চলেছে ।
আমি বললাম - মোহিনী হোটেলের মালিক জে-কে মারা যাবার পর তার পোষা শিম্পাঞ্জিটাই শহরের মাফিয়াদের বস হয়ে গেল জেনেও একটু আশ্চর্য লাগছিল ।
সরস্বতী বললেন - হ্যাঁ, পলিটিকাল স্যাটায়ারও যোগ হয়েছে । এবং লাস্ট সীনে সে কিনা একটা মোটরবোট চেপে আফ্রিকায় পালিয়ে গেল !
গল্পটা সত্যি একটু অদ্ভুত, ততক্ষণে ভাবছিলাম আমি । ওদের সোনার বিস্কুটের একটা শিপমেন্ট গোয়া থেকে আইসক্রীমের ঠেলাগাড়িতে করে আসছিল । মাঝপথে সেটা হারিয়ে যায় । তখন জে-কে'র লোকেরা শহরের সবকটা আইসক্রীমের ঠেলাগাড়ি চুরি করতে বাধ্য হয় । এদিকে একদিনের মধ্যে আইসক্রীমের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে দেখে পাশের শহরগুলোর লোকাল মাফিয়াও আইসক্রীমের গাড়ি চুরি করতে থাকে ।
সরস্বতী বললেন - এবং শুরুটা ভাবো । কলাশকর রিভোলি সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কুল্ফিতে সবে কামড় দিয়েছে এমন সময়ে কালো একটা মার্সিডিজ গাড়ি এসে &ত্রঢযৃথামলো সামনে । পিছনের দরজাটা খুলে গেল তার । কলাশকর গাড়িতে উঠে দেখল পাশের সীট থেকে রোদচশমা আর বেগুনী সুট পরা একটা শিম্পাঞ্জি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । কলাশকর যেই হাতটা ধরতে যাবে অমনি শিম্পাঞ্জিটা তার কুল্ফি কেড়ে নিয়ে এক কামড়ে সেটা কপ করে খেয়ে ফেলে হাসতে লাগল । সামনের সীট থেকে সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠছিল । সেখান থেকে একটা মেয়ের গলা ভেসে এল - জে-কে হোটেল মোহিনীতে তোমাকে কফি খেতে ডেকেছে । কথা নেই বার্ত্তা নেই কলাশকর আচমকা একটা ঘুঁষি মেরে দিল শিম্পাঞ্জিটার নাকে । শিম্পাঞ্জিটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেই সাবধানে, সুট বাঁচিয়ে, তার মাথায়, বুকের লোমে নিজের কুল্ফির দুধলাগা হাতটা মুছে কলাশকর বলল - জে-কে'কে বোলো নিজের দ'ংউটাকার তোয়ালেকে যেন দু'হাজারের সুট না পরায় ।
- এর থেকে কী প্রমাণ হয় ? আমি সরস্বতীর বক্তব্যটা বোঝার চেষ্টা করলাম ।
- তোমার মনে হয় না কলাশকর একটু সাইকটিক হয়ে গেছে ? একটা নিষ্ঠুর, বদ সেন্স অব হিউমার যোগ হয়েছে তার চরিত্রে ? শিম্পাঞ্জিটাকে সে বারবার তোয়ালে বলেছে এই বইটাতে । এবং প্রতিবার হাত মুছেছে তার গায়ে ।
- ততটা হয়ত খারাপ কিছু নয় ।
- আলবাৎ খারাপ । এর আগে কোনো বইতে কলাশকর মেয়েদের গায়ে হাত তুলেছে ? এখানে জে-কে'র সেক্রেটারি মোনাকে সে অকারণে গাঁট্টা মারতে গেল কেন ?
- কলাশকরের বইতে এরকম লুজ থ্রেড থাকে । এটা পরের বইতে এক্সপ্লেন করে দেবে নিশ্চয়ই ।
- কী বলছি শোনো জয় । এর কোনো এক্সপ্ল্যানেশানই চলে না ।
- আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো ?
গাড়িটা আমাদের বাড়ির সামনে এসে থেমেছিল । ইঞ্জিন অফ করেনি ড্রাইভার । সরস্বতীকে বাড়িতে চা খেতে ডাকব কিনা ভাবছিলাম । মামার বুক গর্বে দশ-হাত হয়ে যাবে তাহলে । সরস্বতী আমাকে কলার ধরে তুলে নামিয়ে দিলেন রাস্তায় । গলা নামিয়ে বললেন - বলছি যে মেজর কলাশকরের লেখক যে একটাই লোক তা নাও হতে পারে ।
ভর সন্ধ্যেবেলা আমার বুক ধড়াস করে উঠল । আমি বললাম - সুরিন্দার ত্রিবেদীর নাম আর ছবি থাকে যে প্রত্যেকটা বইয়ের পিছনে ?
- ছবি ছাপাতে আর কী লাগে ? সরস্বতী খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন । - ওরা হল পাব্লিশার ফ্যামিলি । দেড়-দু-ডজন লেখক পোষে ।
আমার বুকে যেন একটা গুলি, কিম্বা কামানের গোলাই হবে, এসে লাগল । চোখের সামনে ছত্রিশটা মেজর কলাশকরের গল্প সিনেমার মত ভেসে উঠল । ভেসে উঠল সুরিন্দার ত্রিবেদীর বিখ্যাত গোঁফ । নকল হইতে সাবধান । ছবি দেখিয়া কিনিবেন । কাত্রে উঠে বললাম - অসম্ভব ! হতেই পারে না । সুরিন্দার শ্রেষ্ঠ থ্রিলার রাইটারের পুরস্কার নিয়ে এলেন সেদিন ভোপাল থেকে !
সরস্বতী বললেন - তাতে কী কিছু প্রমাণ হয় ?
- তাহলে মেজর কলাশকরের সত্যিকারের লেখক কে ?
- কে জানে । হয়ত যাঁরা সম্প্রতি খুন হলেন তাদের একজন । সেজন্যই হয়ত লেখক পাল্টাতে হল । এবং নতুন লেখকটি একটি সাইকটিক কেস । কে বলতে পারে, হয়ত সে-ই খুনে ।
সরস্বতী আমাকে সাবধানে থাকতে বলে গাড়িতে উঠে পড়লেন ।
সেই অন্ধকারেই বাড়িতে ঢুকে দেখলাম ফিউজ ঠিক হয়ে গেছে । মোমবাতির কথা কারো মনে নেই । টোটোদা বিনোদ শুক্লার একটা রোমাঞ্চ সিরিজের উপন্যাস পড়ছে খাটিয়ায় শুয়ে । মামা অফিস থেকে ফিরে খালি গায়ে &ত্রঢযৃনাড়া-ঝোলানো আণ্ডারওয়্যার পড়ে বসে ছিল বারান্দায় । আমাকে দেখে বলল - এই নে, চিঠি ।
দেখি একটা পোস্টকার্ড এসেছে শাকুন্তল প্রকাশন থেকে । ওরা একটা গল্প ছাপাবে আমার । কিছু কিছু পরিবর্ত্তন করতে হবে । সেইজন্য অফিসে ডেকেছে । নিচে শাকুন্তলের বিখ্যাত সম্পাদকের সই । হঠাৎ বুঝতে পারলাম সইটা আগে কখনো দেখিনি । কেননা সুরিন্দার ত্রিবেদীর মত প্রতিটি বইয়ের পিছনে ছবি আর সই থাকে না কমল সাহনির ।
ফুটবল
তো এইভাবে সেবার গরমের ছুটিতে - রটনায়, ঘটনায়, গজলে, গসিপে আমার লেখার সর্বাঙ্গীন বারোটা বেজে গেল । রাতে নিয়মিত গজলচির আওয়াজ জেড টাইপ কোয়ার্টারের সামনে ইঁটবাঁধানো চত্বরে আছড়ে পড়ছিল - যাকে স্বচক্ষে কিডন্যাপ হতে দেখার পর আর তত ভয়ংকর মনে হত না । তার অর্ধেক লিরিক তো ধূপেন্দ্র ভগওয়ানিরই লেখা । উল্টে রাতে আমি একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখে খাটিয়া থেকে পড়ে গেলাম । দেখি পরভীনের কুর্তা আর লুঙ্গি ছিন্নভিন্ন যাচ্ছে একটা বালির ঝড়ে । আমি তাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বাঁচাবার চেষ্টা করছি । কাছ থেকে দেখছি যেন তার চওড়া হাড়ের অ্যাথলেটিক শরীর জুড়ে হাজার হাজার সই । কোনোটা ইংরেজিতে, কোনোটা হিন্দীতে । খাটিয়া থেকে পড়ে গিয়ে আমি হাতটা মচকে ফেললাম ।
লেখার আকালের দিনে একটা প্লাস্টার পড়ে গেল ডান হাতের কব্জিতে । ঘোর দুপুরবেলা নভেলটা স্থগিত রেখে মামিমার ঘরে সোফায় আধশোয়া হয়ে বাঁ হাত দিয়ে ছোটি বেগমের উপর একটা আলাদা নতুন গল্প লিখতে শুরু করলাম 'চিত্রাঙ্গদা'র জন্য ।
গল্পটা দিনের বেলায় লিখতাম বলে তাতে রাতের দৃশ্যই থাকত শুধু । খাতার পাতার মধ্যে দিয়ে ভর দুপুরবেলা আমি প্রবেশ করতাম একটা রাত দুপুরের জগতে । সেখানে শীশ মহলের ভীষণ সাজগোজ করা ছোটি বেগমকে ধূলো-বালির ঝড়ে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেক রাতে নোংরা করে দিতাম । তখন ভাবতাম চিত্রাঙ্গদা'য় যদি লেখা ছাপাতেই হয় তো ছোটি বেগমকে দিয়ে বলাব - আমার তো সাজার এবং নোংরা হবারই বয়েস । যেমনটা চট্টান সিংএর হাতে পড়লে চিত্রাঙ্গদা'র হবে আর কি ।
স্পেয়ার টাইমে গবেষণামনস্ক হয়ে পড়লাম । একটা লিস্ট বানালাম পরিচিত কানা লোকদের । হিন্দী পকেটবই লিখছে যে সব লেখকরা তাদের একটা লিস্টও তৈরি করলাম বিশ পয়সার লাইব্রেরি ঘেঁটে ঘেঁটে । লিখে রাখলাম কারা কারা থ্রিলার লিখছে । কাদের ছবি বা সই নেই বইয়ের পিছনে ।
মাঝখানে একদিন মনু এসে বলল - কাকা তোর খবর নিতে পাঠিয়েছে । সব ঠিকঠাক আছে তো ?
আমাকে এখনো ওয়াচ করা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম । মনু বলল - তোর হাতে পলস্তর করে ফিরে যাবার পথে বুড়ো ডাক্তার বাজাজ কাকার একজন ইনভেস্টিগেটারকে গাড়ি চাপা দিয়ে দিয়েছে । লোকটা এখন হাসপাতালে । সেই নিয়ে গোলমাল । কাকা আবার আবুধাবি চলে যাচ্ছে ।
- সে কী ?
তারপর - ভগওয়ানিরাই যা পারে - আমাকে আর টোটোদা'কে হতভম্ব করে দিয়ে মনু বলল - ধূপেন্দ্র এই গিফ্টটা পাঠিয়েছে এবং ক্ষমা চেয়ে নিতে বলেছে । আশা করি বুঝতেই পেরেছিস, তোকে থানায় ডাকিয়ে নিজের লোককে দিয়েই আব্বাসকে খবর পাঠিয়েছিল কাকা । যাতে বোকাটা তোকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে । তুই ভেস্তে না দিলে ওরা এতদিনে `ভিতরে' হয়ে যেত আর কাকার হয়ে যেত আরো একটা প্রোমোশান । এই বলে মনু `মাফ কীজীয়ে মীর্জা'র একটা কপি রেখে চলে গেল ।
বিকেলবেলা `সদর বাজার'এ আব্বাস বেগ এসে বললেন - মার্ডারগুলো কিছুদিন হচ্ছে না বলে যদি কেউ ভাবে যে খুনী ধরা পড়ে গেছে তো খুব ভুল হবে ।
ড্রামাটিক এফেক্টের জন্য যোগী অড়োরার কাট-আউটটাকে আব্বাস নিজের স্টুডিওতে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন । সেটা যে পুলিশ প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য করছে না সেটাই দর্শকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্য বোধহয় ।
বিকেলবেলাই আর একদিন ফুটবলে খেলতে কলেজ গ্রাউণ্ডের মাঠে গিয়েছিলাম । ভাঙা হাতটা যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে খেলছি । ভূপিন্দার ইচ্ছে করে বার বার আমাকে ডানদিকে ফেলে দেবার চেষ্টা করছিল । সেই অবস্থাতেই গোল বাঁচাচ্ছি । এমন সময় পিছন থেকে সবাই বলল - জয়, তোর দিদি এসেছে বে । গোল সেভ করিস পরে, আগে ইজ্জত তো সেভ কর ।
তাকিয়ে দেখি, পম্পা ।
প্রীতপাল আর ভূপিন্দার দাঁড়িয়ে গল্প করছে পম্পার সাথে । তাকে বাঁচাতে ফুলস্পীডে দৌড়ে গেলাম । প্রীতপালের মুখের বন্ধ ড্রেন ততক্ষণে খুলে গেছে । ভূপিন্দার পালাবার পথটা আটকে দাঁড়িয়ে ।
প্রীতপাল বলছিল - স্কার্টটা খোলো, স্কার্টটা খোলো ।
পম্পা খুব অস্বস্তির সঙ্গে বলল - না না আমার প্র্যাকটিসের দরকার নেই ।
প্রীতপাল অবাক হবার ভান করে বলল - কেন, নিচে শর্টস্ নেই ? আমি যোগাড় করে দিচ্ছি । সাইজ কেয়া হ্যায় তেরা ?
ভূপিন্দার বলল - ফুটবল কা সাইজ কেয়া হ্যায় তেরা ? ফুটবল তো নিয়ে এসেছিস আশা করি ?
পম্পা বলল - প্লীজ ডোন্ট মাইণ্ড । আমি ফুটবল খেলি না ।
- তো কী হয়েছে ? আমরা খেলে নিচ্ছি । তুই গিল্লি ডাণ্ডা খেলে নে ।
প্রীতপাল বলল - বুঝেছি, ফুটবল নোংরা হয়ে যাবে ভেবে বার করছো না । তাই তো ?
ভূপিন্দার বলল - নিকালো য়ার । বড়ে পেয়ার সে খেলেঙ্গে হম ।
প্রীতপাল বলল - নরম নরম ঘাসের উপর । তার পর বাড়ি গিয়ে ধুয়ে নিও ।
ভূপিন্দার বলল - সাবুন ম্যাঁয় লগা দুঙ্গা ।
প্রীতপাল বলল - বেবি অয়েল সে চমকা দুঙ্গা য়ার তু নিকাল তো সহি ।
ভূপিন্দার বলল - বল ইয়ে চমকা দেগা, বাল ম্যাঁয় চমকা দুঙ্গা ।
আমাকে দেখে প্রীতপাল বলল - নিজের বোনকে জিজ্ঞেস কর ও ফুটবল ধোয়াবে কি ধোয়াবে না ? একবার ধোয়াবে তো বার বার ধোয়াতে চাইবে ।
পম্পা আমার দিকে তাকাল । আমি তার দিকে । এই হল শিমলিপুর । সাধে ওদের বাড়িতে ঢুকলে আমার মুখ ধোয়ায় ?
ভূপিন্দার বিরাট থাবা দিয়ে পম্পার স্কার্টের দু ইঞ্চি পিছনে গোল করে উপর-নিচ ডাইনে-বাঁয়ে হাওয়ারই একটা মাপ নিতে নিতে যেন অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলছে এমন ভাবে প্রীতপালের দিকে চেয়ে বলছিল - কাফী বড়া হ্যায় য়ার ।
আমি পম্পার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে নিয়ে দে ছুট । পম্পার ফুটবল ভূপিন্দারের থাবা থেকে শেষ মুহূর্তে বাঁচানো যায়নি । এক সেকেণ্ডের বেশি ধরে রাখতে পারেনি, এই যা ।
আমরা কলেজ গ্রাউণ্ডের পাঁচিলের ফাটল পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে থামলাম । পেট চেপে ধরে বসে পড়ল পম্পা ।
- সেলাই ঠিক আছে ? জিজ্ঞেস করলাম আমি ।
-বাস্টার্ডস্ । বলল পম্পা । গালাগালিটার রাজনৈতিক যাথার্থ্য নিয়ে তখন আর প্রশ্ন করার সময় নয় । বললাম - জানি । শিমলিপুরের কটা মেয়েকে তুমি এদিকে আসতে দেখেছো ?
- এরা তোর বন্ধু ? এর পরেও তুই কথা বলবি ওদের সাথে ?
শুধু বন্ধু নয়, বিনা মাইনের কোচ । ওরাই পয়সা দিয়ে টুর্নামেন্ট খেলায় । শিমলিপুরে জন্মেছি যখন তখন ভাগ্যকে স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই । আর কথা বাড়ালাম না । পাঁচ মিনিট সুস্থ হতে দিলাম পম্পাকে । তারপর বললাম - চলো আমরা পার্ক টাউনে গিয়ে আড্ডা দিই । কে তোমাকে বলেছে এতদূর আসতে ?
শিমলিপুর মোড় থেকে একটা ভিড় মিনিবাসে করে আমরা পার্কটাউনে গিয়ে নামলাম । বাড়ির দিকে যাবার পথে পম্পা গজরাতে গজরাতে বলল - শিমলিপুরে ঢুকলেই কিছু না কিছু একটা ভয়ংকর ঘটনা হচ্ছে আমার সঙ্গে ।
সান্ত্বনা দেবার জন্য আর কিছু না পেয়ে বললাম - ভাগ্য ভালো সেখানে থাকো না তুমি ।
- তোকেও বেরিয়ে আসতে হবে ।
- হ্যাঁ । একটা সুযোগ যদি পাই তো শিমলিপুর ছেড়েই দেব এবার । এখানে আমার কালচারাল গ্রোথ হচ্ছে না একেবারে ।
পম্পা আমার দিকে একটু বিস্ময় নিয়ে চাইল । এত বুঝদার হয়ে গেলাম কীভাবে সেটাই খোলসা করার জন্য বললাম - তোমাদের নাটকের গ্রুপে একটা যদি খালি জায়গা থাকে তো আমার কথাটা বোলো । শিমলিপুরের ছেলেদের ছাড়ব । একটা অন্য কিছু ধরতে হবে ।
- ইংরেজি বলতে হলে পারবি ?
- শুনতে শুনতে শিখব ।
পম্পার ঘরে ঢুকে দেখলাম দেয়ালের রং আর আসবাব পাল্টে গেছে । একটা আরক আরক গন্ধ । পম্পা বলল - অনেকগুলো রোগ থেকে উঠলাম বলে বাবা ঘরটা একেবারে গন্ধক দিয়ে স্যানিটাইজ করে দিয়েছে । যাই হোক, আসল কথাটা শোন । `চিত্রাঙ্গদা'র সম্পাদিকার সাথে কথা বলেছি । তোর গল্পটা ওদেরও পছন্দ হয়েছে । যা ভেবেছিলাম তাই । কয়েকটা ফিমেল ক্যারেক্টারকে লীড রোল দিয়ে গল্পটা যদি তুই আরেকটু বাড়াতে পারিস তাহলে দুই কি তিন কিস্তিতে প্রকাশ করা যেতে পারে ।
- বলো কী ? প্রায় উপন্যাসকার হয়ে যাব তো তাহলে ?
- সেজন্যই বলছি সিরিয়াসলি নিতে । একটা ফেমিনিস্ট মেসেজ থাকলে আরো ভালো । পারবি ?
- ফেমিনিস্ট মেসেজ আছে কিনা বোঝে কী করে ?
- ফেমিনিস্ট গল্প হলে তাতে একটা লীড ফিমেল চরিত্র থাকবে এবং সে কোনো একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পিছু হটে যাবে না ।
- তাহলে ততটা শক্ত হবে না যতটা ভাবছিলাম ।
- ফুটবল বলতে ওরা কী মীন করছিল জয় ? আচমকা প্রশ্ন ।
- তো-তো-তো-তো ...
বাড়ি ফিরে এসে টোটোদা'র উপর চোটপাট শুরু করেছিলাম - কে পম্পাকে কলেজগ্রাউণ্ডে পাঠাল ? কোন আক্কেলে ? টোটোদা বলল - এ কাজ বাবা ছাড়া আর কার ? কলেজ গ্রাউণ্ড বলতে একটা কলেজিয়েট অ্যাট্মস্ফিয়ার ভেবেছিল নিশ্চয়ই । বুঝলি জয়, মানুষটা ত্রক্রমশ: বাস্তব থেকে সরে একটা ফ্যান্টাসির জগতে চলে যাচ্ছে । সেদিন আমাকে রাত্রিবেলা ডেকে বলল - তোর দিদার নামে একটা সিনেমা হল করব স্বপ্ন ছিল । আমি তো পারলাম না । তুই করিস । আমি বললাম - শুধু দিদা কেন ? দাদুর নামেও একটা করে দিচ্ছি । তখন জিভ টিভ কেটে বলল - না, না বাবার নামে নয় । বাবা সিনেমা টিনেমা একেবারে অপছন্দ করতেন । তুই মায়ের নামেই করিস । শীগ্গীরই করব কথা দিয়ে তবে পালিয়ে বেঁচেছি আমি । &ত্রঢযৃ
তিনদিন প্রচণ্ড খেটে ছোটি বেগমের উপর একটা চ্যাপ্টার শেষ করলাম । অরিজিনালটাই পম্পাকে দিয়ে এলাম পড়বার জন্য ।
বাড়ি ফিরে এসে দেখি টোটোদা ভীষণ উত্তেজিত । হাতে একটা নতুন পোস্টকার্ড । শাকুন্তলের সম্পাদকের কাছ থেকে এসেছে । উপরে লেখা `সেকেণ্ড রিমাইণ্ডার' ।
টোটোদা বলল - কমল সাহনি ডেকেছে আর তুই যাসনি ?
আমি বললাম - তুমি কমল সাহনির ফ্যান হলে কবে থেকে ?
টোটোদা বলল - যতই বলিস । নামকরা জাঁদরেল লেখক । নিজে দেখা করতে চায় । যাবি না হয় নাকি ?
আমি বললাম - মারধোর দেবে কিনা ঠিক নেই । চম্বলের থ্রিলারের প্রথম চ্যাপ্টারটা পাঠিয়েছিলাম । এ ধরণের গল্প তার পছন্দ হবে তাই-ই তো ভাবা যায় না ।
এক নিমেষের মধ্যে টোটোদা ঠিক করে ফেলল যে আমার জায়গায় সেই যাবে কমল সাহনির অফিসে । জেনে আসবে কী কী পরিবর্ত্তন করলে সেটা ছাপাবার যোগ্য হয় । কিছুদিন যাবৎ টোটোদা'র জ্বর একটু যেন কম হচ্ছিল । বেশ ভালো মুডে ছিল টোটোদা । আমিও ভালো মুডে ছিলাম তাই । দুজনেরই মনে হল - টোটোদা এমন কিছু একটা বলে বা করে আসবে যে উপন্যাসকার হবার জন্য আমাকে আর পম্পার দ্বারস্থ হতে হবে না ।
কিন্তু মার্ডার-গজলের দিন আর রাত তখনো শেষ হয়নি । গরমের ছুটির শেষ কয়েক সপ্তাহের অসম্ভব ও অবাস্তব ঘটনাগুলো তখন ঘটাবার জন্য তৈরী হচ্ছিল শিমলিপুর । একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে ছিল একটি বিপজ্জনক সাইকোপ্যাথকে ধরার তদন্ত । এইসব সম্ভাবনার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে এই রকম একটা সময়ে টোটোদা আমার নাম আর পরিচয় ধার নিল কিছুদিনের জন্য ।