“সেশন শুরু হয়েছে। গোড়া থেকেই পড়াশোনার যেরকম চাপ দেখছি শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়াবে জানি না। রিসর্চ এ টার্মেও খুব বেশি করতে পারব বলে ভরসা তো দেখছি না।
কদিন ধরে এখানে মোটেই শীত ছিল না (অর্থাৎ ৩০-৩২ ডিগ্রি চলছিল)। আজ সকাল থেকে দেখছি ভীষণ শীত পড়েছে, বোধ হয় শূন্যর তলায় চলে গেছে। রেডিওতে শুনলাম মিনেসোটায় (প্রবোধদাদের ওখানে) ভীষণ তুষারপাতের সম্ভাবনা আছে। অবশ্য মিনেসোটায় এমনিতেই শীত অত্যন্ত বেশি। -১০ডিগ্রি থেকে -১৫ ডিগ্রি শীতকালে চলে। আমাদের এখানে এবার সকলের মতে অত্যন্ত অস্বাভাবিক আবহাওয়া চলেছে। বাতাসে জলীয় বাষ্প খুবই কম। তাই বরফ পড়ছে না। এর সঠিক কারণ বিশেষ কেউ দিতে পারছে না। যদিও এরা এখানে আবহাওয়া নিয়ে এতরকম পরীক্ষা করে যে হয়তো একদিন গোটা আমেরিকার আবহাওয়া পালটে যেতে পারে। যেখানে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পরীক্ষা বেশি হচ্ছে সেখানকার আবহাওয়া অদ্ভুতভাবে বদলাচ্ছে, তবে আইওয়ার ক্ষেত্রে যে কী কারণ কে জানে। বরফ না পড়লে জমির হয়তো কিছু ক্ষতি হবে কারণ এখন তুষার থেকে জমির আর্দ্রতা সঞ্চিত হয় বসন্তকালের জন্য।
এখানেও পাক–মার্কিন চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। কদিন আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পড়ছিলাম, বেসরকারিভাবে অনেক ভারতীয় ভদ্রলোকই এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনে সতর্কবাণী দিয়েছেন। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সন দূরপ্রাচ্য ভ্রমণের পর যে বিবৃতি দিয়েছেন তা পড়লে নানারকম সংশয় জাগে। “পাকিস্তান দূরপ্রাচ্যে আমেরিকার পয়লা নম্বরের বন্ধু।“ ভারতবর্ষের জমিতে মার্কিনী ডলারের বীজে খুব বেশি অঙ্কুর হয়তো নিক্সনের চোখে পড়েনি এবং নেহরুর নিরপেক্ষতা হয়ত পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। তাই ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিশেষ কোন উল্লেখ নেই, এখন আমেরিকা ভিয়েতনামের অবস্থা সম্পর্কে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ফরাসীরা যেরকমভাবে হারছে ওখানে এখন কোনো ছুতোয় ওখানে থাবা না বসাতে পারলে তো আর ইজ্জ্ত থাকে না। স্টেট সেক্রেটা্রি ডালেস কদিন আগে হুমকি দিয়েছে, যদি ভিয়েতনামে চীনা সৈন্য একটিও দেখতে পাওয়া যায় তবে আমেরিকা ইউ এন-এ বিষয়টি রফা করবে, অর্থাৎ স্বাধীন পৃথিবীর সম্মানরক্ষায় মার্কিনী সৈন্যদের ভিয়েতনামে দেতে হবে! এদের সৈন্যেরও ভাবনা নেই। ড্রাফট ল’ অনুযায়ী প্রত্যেক ছাত্রকে অন্তত তিনবছর সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতে হবে। আমার বন্ধুদের মধ্যে একজন, নাম তার পল। খাসা ছেলে। বরাবর এ গ্রেড পেয়ে এসেছে। হঠাৎ ড্রাফট বোর্ডের ডাকে পড়া ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে। এইরকম কত ছেলেকে কোরিয়া কি ভিয়েতনামে যেতে হবে। আর এরা এশিয়ার অবস্থা তো জানে না। ওখানে যুদ্ধ করা যে কত কঠিন কোরিয়া ফেরত কয়েকজনের কাছে শোনা গেল। তবে পৃথিবীকে সাম্যবাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে, এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এরা চলেছে। এখন আইসেনহাওয়ার পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগের কথা বলছে অথছ কালকেই টেলিভিশনে শুনলাম, প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও এক অজ্ঞাত দ্বীপে বিমান থেকে হাইড্রোজেন বোমা ফেলে পরীক্ষা করা হইবে। এছাড়া আরও কতো যে রকমারি অস্ত্রশস্ত্রের পরীক্ষা এরা করছে তার ঠিক নেই। এসব যুদ্ধের প্রস্তুতি ছাড়া আর কি? শান্তি আমেরিকা এখন চাইতে পারে না, চাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে অনেক জায়গা থেকেই তাকে পাততাড়ি গুটোতে হবে।
হাইকোর্টের মামলা যে তাড়াতাড়ি উঠবে শুনেছিলাম তা কি কোন কারণে সময় বেশি লাগছে/ দাদুকে কি এখনও সেই কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়? বুদ্ধকে প্রায় তিনখানা চিঠি লিখেছি। কোনই উত্তর পাইনি।
মামণিকে হিজলীর ইনস্টিটিউটের মারফত পয়ঁত্রিশ টাকা পাঠিয়েছি। মামণি পেয়েছে কি না জানিও। মানবকে ওর বই সম্পর্কে ঠিক করে জেনে লিখতে বলেছিলাম ওকে তাড়াতাড়ি জবাব দিতে বলো।
আমি আবার আগামী মাসে টাকা পাঠাবো। আমার জন্য তোমরা কোনও প্রকার চিন্তা কোরো না। কোনো জীবিত মানুষের পক্ষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (যদি কোনো আকস্মিক দুর্বিপাক না ঘটে), তত শীঘ্র ডিগ্রী নিয়ে ফিরতে চেষ্টা করব। তবে দেখলাম তো যা পরিকল্পনা করি তার সবটুকু মেলে না। কিছুটা ফাঁক থেকে যায়। নইলে হয়তো বছরখানেক আগেই ডিগ্রী নিয়ে ফিরতাম।
তোমরা আমার প্রণাম নিও। শরীরের যত্ন নিও”
৮
খপাৎ খপাৎ শব্দ হচ্ছিল। একবার করে হাতা উপুড় করছিল পেতলের বালতি হাতে কোমরে গামছা বাঁধা ছেলেটা। ঠান্ডা জল মাখানো গাঢ় সবজে রঙের কলাপাতার ওপর এক খাবলা করে গরম খিচুড়ি পড়ল, তো সঙ্গে সঙ্গে ছস্ শব্দ করে জল মেরে গেল, ধোঁয়া হয়ে গেল। এভাবেই লাবড়া এল। প্রচন্ড ঝাল সেই পাঁচমেশালি তরকারি যার মধ্যে মুলো-ফুলকপি-পালং-সিম-কড়াইশুঁটি মিলেমিশে ঘ্যাঁট হয়ে গেছে। গ্রীষ্মকাল হলে পুঁই কুমড়ো পটল ঝিঙে পড়ত এতে। তবে গ্রীষ্মকালে কবেই বা চড়ুইভাতি হয়েছে। চড়ুইভাতিই বল আর ইংরেজদের ভাষায় পিকনিক, যা এদিককার বাচনে হয়ে যাচ্ছে পিগনিগ, সেসবের প্রশস্ত সময় তো এই ডিসেম্বর জানুয়ারি মাস।
সমর নিজেও কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে তদারক করছিল। এই নিয়ে পর পর কয়েক বছর তারা এটা করছে। আশপাশের গ্রাম ঝেঁটিয়ে ছেলেমেয়ে জড়ো করে। লিকপিকে ঠ্যাং, কালোকুলো বাচ্চারা। কেউ কেউ পিলে রোগে নাদাপেটা। কেউ কেউ কোমরে ঘুনশি ছাড়া আর কোন পোশাক পরে উঠতে পারেনি। ছেঁড়া, পিঠের বোতাম খোলা, কাঁধ থেকে ঝুলে-পড়া ফ্রক পরা দিদির হাত ধরে এসেছে। বুড়ো আধবুড়ো দু-তিন জন এসেছে সঙ্গে রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। পাড়া ঝেঁটিয়ে একেবারে যাকে বলে।
কেউ কেউ লুকিয়েচুরিয়ে টিনের ডাবায় করে খিচুড়ি নিয়েও যাচ্ছে, বাড়ির অন্যদের খাওয়াবে বলে। এসব দেখলেও উপেক্ষা করাই ভাল। সমর কোন ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে যেতে চায় না। তার এই তরুণ তীর্থ সবে ডালপালা মেলেছে। আসল উদ্দেশ্য জনসংযোগ, খাওয়ার আগে দু ঘন্টা ছেলেমেয়েদের দিয়ে গান, কবিতা ছড়া, গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচ, এইসব করানো। ব্রতচারী নাচ। সমাজ সংস্কারের কথা বলা। গানের কথা লিখে দিয়েছেন বড়রা, কলকাতার তা-বড় লেখক কেউ কেউ তার মধ্যে। বুদ্ধদার বন্ধুবান্ধব। একটা গানে বলা আছে ম্যালেরিয়া তাড়াবার উপায়। একটা গানে বলা আছে ইস্কুলে যেতে হবে লেখাপড়া করতে হবে, গানের শেষে ভোরের কথা আছে। রাত কেটে ভোর আসবে, আকাশে লাল টুকটুকে সূর্য উঠবে।
ঢালু মেটেরঙা জমি, জমির কিছু অংশে ঘাস আছে চাবড়া করে। বাকিটা একেবারে উদলা, খোসা ওঠা আলুর মত। পায়ে পায়ে ধুলো, কমলা হয়ে আছে সেই ধুলো। দূরে অন্ধকারমত যেটা দেখা যায় ওটাই বন। বন না থাকলে বনভোজন হবে কেমন করে। ফাঁকা জায়গাটুকু বেছে নিতে হয়েছে বুদ্ধি করেই। সারাদিনের কর্মসূচি।
আড়াইটে তিনটে অব্দি খাওয়ার পাট চলল, তারপর চারটে সাড়ে চারটেতেই ঝুপ করে অন্ধকার নামবে। কলকাতার দাদারা একে একে ফেরার রাস্তা ধরলেন। সেই বাস রাস্তা... বাস আসে অনেক পরে পরে একেকটা। কলকাতার বাস। সকালে যেটা ধরে সমর এখন যায়। কলকাতায় তার অনেক দায়-দায়িত্ব। ক্রান্তির অফিস, কলেজ স্ট্রিটের প্রেস। লেটার প্রেসে অক্ষর সাজানোও ধীরে ধীরে শিখে নিচ্ছে সমর। কম্পোজিটর বাবুর নাম শ্যামলবাবু, রোগা কালো কোলকুঁজো। পিঠ বেঁকিয়ে একটা একটা করে অক্ষরের টাইপ বসান খাঁচায়। অক্ষরের ধাতব টাইপ গোছা গোছা সাজানো থাকে খোপে খোপে। দেখে বেছে তুলতে হয়। ঠেসে বসাতে হয়। শ্যামলবাবুর চোখ খারাপ, ভারী একটা চশমা ঝুলছে চোখ থেকে। দেখার ভুলে কখনো একটার বদলে অন্য অক্ষর বসে যায়, প্রুফ দেখতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে যায় বুদ্ধদার।
আজ সব শেষ হলে রাঁধুনি ঠাকুরের টাকা মিটিয়ে দিয়ে সমর আর বিধান বেরুল। সাদা কাগজে ঢাকা টিনের মাথায় ছোট ছ্যাঁদা করে কলকাতায় পয়সা তুলেছিল তারা। বাকি পয়সা পার্টি ফান্ড থেকে দিয়েছিল। তাই দিয়ে আজকের এই চড়ুইভাতি।
আগের একটা অনুষ্ঠানে বুদ্ধদার বন্ধু সূর্যদা এসেছিলেন। উনি বিজ্ঞানী নাকি, সত্যিকারের বিজ্ঞানী কাকে বলে সমর এই প্রথম চোখে দেখল সেবার। কই, দাড়িগোঁফ তো নেই! সূর্যদার দু-তিনটে কথা খুব মনে লেগে গেছে সমরের। বার বার সবাই বলে, তাও সূর্যদার সঙ্গে নতুন চেনা আর অল্প দিনের দেখাতেই কেমন আপন করে নিয়েছিল সূর্যদা।
বলেছিল, পত্রিকা করো, অবশ্যই করো। পত্রিকার জন্য লেখা লিখে তো দেবার চেষ্টা করবই। যাদুঘরে কী থাকে জান তো? ইতিহাসের জিনিস। মূর্তি, ফলক, পুরনো মুদ্রা। প্রকৃতিরও যাদুঘর আছে, সেটা হল পাথরের খাঁজে খাঁজে জীবাশ্ম। পুরনো দিনের প্রাণীদের ছাপ। সেইসব ছাপ থেকে আজকের বিজ্ঞানীরা কীভাবে প্রাণীদের বিবর্তন হল জানতে পারেন। আমি সেই নিয়ে প্রথম লেখাটা লিখব তোমাদের জন্য। তরুণতীর্থ ভাল কাগজই হবে রে বুদ্ধ। নাটক, ছড়া, কবিতা এসব তো পেয়েই গেছ তোমরা বেশ কটা, তাই না?
হ্যাঁ দাদা। তোমার লেখা দিয়ে তবে জাহাজে উঠবে। নইলে আমার সমস্যা। সমরের চোখ চকচক করছিল। তারপর কতদিন তো আবার লেখা পাব না। অবশ্য আমাদের তো ভাঁড়ে মা ভবানী, কদিন এ কাগজ চালাব তাই বা কে জানে।
সূর্যদা বলেছিলেন, তা কেন, আমরা চাঁদা দেব, গ্রাহক সংগ্রহ করব। সেই টাকায় চালাবে। আর আমি জাহাজি মেলে খামে করে তোমাকে লেখা পাঠিয়ে দেব ঠিক, দেখ!
ব্যাক ব্রাশ করা চুল, ধারাল নাক। বুদ্ধদা এতক্ষণ ভেতরের ঘরে কাজ করছিলেন। ঘরের থেকে রাত জেগে দ্যাখা একখানা প্রুফের বান্ডিল এনে দিয়েছিলেন সমরের হাতে, তারপর সূর্যকে বলেছিলেন, বিজ্ঞান নিয়ে লেখো, লেখো সূর্য। তবে কী জানো, মাঝে মাঝে এত হতাশ লাগে। বিজ্ঞানের লেখায় দূর গ্রহের আলো অথবা ইতিহাস থেকে আসা জীবাশ্মের খবর লিখব আমরা এদিকে আমাদের গ্রামীণ সমাজগুলোতে এখনও পণ নিয়ে বিয়ে, ঝাড়ফুঁক, জাতপাত, ডাইনি সন্দেহে হত্যা--ওখানে আলোর ক্ষীণতম রেখাটুকুও নেই।
সূর্য মাথা নাড়ে। সত্যিই। আমাদের সমাজ এখনও জীবাশ্ম হয়ে আটকে আছে প্রাচীন সময়ে। অন্যকে আর কী বলব আমার নিজেরই পিতৃদেব--বলে অর্থপূর্ণ একটা চাহনি দিল সে বুদ্ধের দিকে। বুদ্ধ ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে ঘাড় নাড়ল। সূর্য যে নিজের পিতৃগৃহে মানুষ হয়নি, হয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি উদার পরিবেশে নিজের দিদিমা দাদামশায়ের কাছে তা সে জানে...। পিতৃদেব তো বোনের বিয়ে দেবেন বলে দোজবরে একটা কুলীন কায়স্থ খুঁজে বার করেছিলেন, ওকে নাকি পনেরো বছর বয়সেই পার করে দেবেন! আমাকে কী পরিমাণ লড়াই করে আটকাতে হল সেটা কী আর বলি। আমি মানব মিলে লড়লাম। মানব তো আধুনিক কবিতা লেখে বলে বাবা ওর ওপর খড়্গহস্ত। আমার কথাই যা ফেলতে পারেন না। বড়দা তো চুপ, এতটাই শান্তিপ্রিয় আর ভীতু। সীমুর লেখাপড়া যাতে বন্ধ না হয়, বাবা যাতে ভুলভাল বিয়ে না দিয়ে দেন আমি বিদেশে থাকতে থাকতে, প্রায় আমার মাথার দিব্যি দিয়ে কড়ার করিয়ে নিয়েছি। বাবা এখনও বাড়িতে মুরগির মাংস ঢুকতে দেননি। জাতপাত, পূর্ণিমা অমাবস্যা, পাঁজি দেখে দিনক্ষণ মেলান; খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বৃহস্পতিবারে মঙ্গলবারে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ বেগুনপোড়া নিষিদ্ধ এইসব এখনও আমাদেরই পরিবারে চলছে। তাহলেই বোঝো! সমর, আমি স্বীকার করছি এখনও আরো বহুবছর লেগে যাবে আমাদের গোটা দেশের মানসিকতা পালটাতে। বৈজ্ঞানিক মানসিকতা কী, তা আমরা সত্যিই এখনও জানিনি।
সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজের একটা খবরে চোখ আটকে গেছিল সূর্যর। সমর, এই দ্যাখো খবরে লিখেছে চব্বিশ পরগনায় এখনও বালিকাদের বিবাহ আটকানো যাচ্ছে না। ইংরেজরা ঊনত্রিশ সালে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আইন করেছিল, ঊনপঞ্চাশ সালে সেই আইন ঢেলে সাজানো হল, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স পনেরো করা হল। তারপরও গ্রামে গ্রামে এগারো-বারোর ভেতরে বিয়ে দিচ্ছে লোক, গৌরীদান না কী যেন বলে। আসলে বাড়িতে একটা বেশি খাওয়ার মুখ একটা মেয়েকে প্রতিপালন করার দায়িত্ব এসব নিতে চায় না কেউ।
মাথা ঝুঁকিয়ে শুনছিল সমর। তার খুব রাগ হচ্ছিল।
তারপর সূর্যদা বলল সেই কথাটা। ... আইন করে কিছু হয় না সমর। সামাজিক আন্দোলন চাই। ঢেলে সাজানো দরকার সবকিছু। তোমরা হবে সেই সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার।
আজ, এখন, বাড়ি ফিরে সমরের বুকের মধ্যেটা ফুলে ফুলে উঠছিল। একটা মেয়ে এসেছিল আজ চড়ুইভাতিতে। নাম কালী। তাদের চালানো ইস্কুলে পড়ে। বছর দশেক বয়স। মাস ছয় আগে ওর বাড়ির থেকে ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে গিয়েছিল। বৈকুন্ঠপুর গ্রামের মেয়েটাকে সমররা দল বেঁধে গিয়ে বাঁচিয়েছিল বাল্যবিবাহ থেকে। ওর বাড়িতে চড়াও হয়েছিল পুরো। বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে, গ্রামের মাতব্বরদের বুঝিয়ে বন্ধ করে এই বিয়ে।
সেই পাত্রটাও ছিল দোজবরে। মধ্যবয়সী। বিয়ের খবর শুনে মেয়েটা কদিন ধরে শুধু কেঁদেছিল। কালীকে ঘরের শেকল বাইরে থেকে তুলে দিয়ে বন্দী করে রেখেছিল ওর বাবাটা। পাড়ার অন্য বাচ্চারা এসে খবর দেয় বিধানকে। তারপর সমররা মাঠে নেমেছিল। কী উত্তেজনা কদিন এ নিয়ে গ্রামে, বাইরে থেকে পার্টির ছেলেরা এসে লোকের ধম্মেকম্মে, শুভকাজে বাধা দিতে শুরু করবে নাকি এবার! লোকজন চটে কাঁই। একদল লোকের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করেই শেষ অব্দি কাজ হাসিল হয়েছে সমরের।
কিন্তু এইটুকু জয়, অনেকটা জয় সমরের কাছে। এখন গরানকাটি জামতলা বৈকুন্ঠপুর হরিপুরের লোকেও সমরের নাম জানে। ছোট ছেলেমেয়েরা, বিশেষত মেয়েরা, এখানে কাছে ইশকুল নেই বলে খুব ভুগত। সমরদের উদ্যোগ আয়োজনেই পাঠশালা হয়েছে একটা। এরপর বয়স্ক শিক্ষার জন্য নাইট ক্লাসও খুলতে হবে।
অনেক টাকা চাই, অনেক কাজের ছেলে চাই। রাতে গনগনে উত্তেজনা উৎসাহ নিয়ে নিজের ঘরের সরু বিছানাটার ওপর শুয়ে ছাতের আড়াআড়ি বাঁশে বাঁধা কড়িকাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে থাকে সমর। বছর পাঁচেক আগেকার আমুদে, ফুর্তিবাজ, গায়ে হাওয়া লাগানো সমর আর নেই। ইশকুল পালিয়ে যে আম চুরি করত দল বেঁধে। পেয়ারা গাছে বসে পা দোলাত। ইশ, তখন যদি মন দিয়ে আরেকটু লেখাপড়া করে নিত!
৯
১ লা অক্টোবর ১৯৫৪
মা/দাদু, তোমাদের গত শনিবারের চিঠি আজ পেলাম। দাদু, তোমার হ্যান্ডনোটের মামলায় জিত হয়েছে শুনে খুব খুশি হয়েছি। উকিলবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে শিগগিরই চিঠি লিখব। আশাকরি অন্যান্য মামলাগুলোতেও সুবিধে হবে এবার। যত মামলার সংখ্যা কমে যায় ততই ভাল।
আজ কদিন হল এখানেও খুব বৃষ্টিবাদলা হয়েছে, এ সময় বৃষ্টি অন্য বছরে তত হয় না। হয়ত হুট করে শীত নামবে। কাল সন্ধ্যে বেলায় তো কনকনে হাওয়া বইছিল। আজ সকাল থেকে টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই।
এই সপ্তাহে ফরাসী ও জার্মান ভাষার পরীক্ষায় পাশ করেছি। যত ভাবনা হয়েছিল সে তুলনায় পরীক্ষা তত কঠিন ছিল না। এখন কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কোর্স নিচ্ছি দুটো এবং কেমিস্ট্রিতে এদিকে-ওদিকে একটু-আধটু বাকি ছিল। তাও সেরে নিচ্ছি। খুব শিগগিরই কোর্সের পালা চুকবে। আমার কমিটি হয়ে গেছে, ডঃ ওয়েঙ্কার্ট ছাড়াও আর চার জন অধ্যাপক আমার শেষ পরীক্ষার আগে আর কী পড়া দরকার আগামী সপ্তাহে ঠিক করবেন। শরতের পরীক্ষা দেওয়া আর সম্ভবপর নয় তাই বসন্তকাল অর্থাৎ জুনমাস অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যে রিসার্চ এগোব, পরীক্ষার জন্য তৈরি হব এবং এছাড়া ছেলে পড়ানো তো আছেই। থিসিসে কতদিন লাগবে কে জানে। মোট কথা তার ওপরেই আমার এখানে থাকার মোট সময় এখন নির্ভর করছে। যথাসাধ্য খাটছি, আর খাটবও। মুখ থুবড়ে পড়ে যদি না যাই। এখন দেখা যাক কোন পথ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
মানবের পাঠানো পত্রিকা ও তোমাদের দেশ পেয়েছি। এছাড়া বুদ্ধ ক্রান্তি পত্রিকা নিয়মিত পাঠায়। দেশের খবর এখানে বসে ওয়াশিংটনের পাঠানো ইন্ডিয়াগ্রাম থেকে যতটুকু পাই।
এখানকার খবরের মধ্যে, নিগ্রোদের সাদামানুষের ইস্কুলে পড়া নিয়ে অনেক গোলযোগ চলেছে। দক্ষিণ অঞ্চলে, ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া প্রভৃতি রাজ্যে নিগ্রোবিদ্বেষ খুব বেশি, পূর্বে ডেলাওয়ারেও তাই। এখন কিছুদিন আগে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে শ্বেতকায়দের স্কুলে (বিশেষ করে রাষ্ট্রের অর্থে পরিচালিত স্কুলে) নিগ্রোদের প্রবেশ বাধ্যতামূলক বলে গৃহীত হয়। দুঃখের কথা কতগুলো রাজ্যে বিশেষ করে ডেলাওয়ারে সাদারা এই সমান অধিকার মেনে নিতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য সমান স্কুল করো, তবে আলাদা করো। মিলফোর্ড বলে একটা জায়গায় সাদা মায়েরা ছেলেদের স্কুলে পাঠাচ্ছে না। রাস্তায় প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। অবশ্য সরকার থেকে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ সকলকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তুমুল চেষ্টা চলছে।
কদিন বাদেই তো পুজো। তোমাদের কথা মনে হচ্ছে। আর কতদিন এখানে থাকতে হবে কে জানে? মাঝে মাঝে ক্লান্তি এসে যায় বড্ডো। সেদিন রাত্তিরে লুচি খাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম। নিজে যদি রান্না করতে জানতাম তাহলেও হতো। এখন বৃষ্টির রাত্তিরে খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা পেলে কী মজাই না হতো! ৭ই বোধহয় বিজয়া দশমী। আত্মীয়স্বজন লিস্টিমত সকলকে চিঠি লিখব। কাউকে বিশেষ যদি লিখতে হয় তো মনে করিয়ে দিও।
তোমরা বাগানে তরিতরকারি কিছু করতে পারছ কি? পুকুরের মাছ খুব হয়েছে জেনে খুব আনন্দ হল। দাদুর জন্য মাছ ধরবার সরঞ্জাম বইপত্তর কিছু পাঠাব না কি? এদেশে ওটা খুবই সখের। হোমিওপ্যাথির এখানে তো খুব বেশি চল দেখি না। দাদুর ডিপার্টমেন্টে কিছু সাহায্য করতে পারব না।
চিঠি লেখা শেষ করে, চিঠিটাকে একবার ব্লটিং পেপার দিয়ে শুকিয়ে, আবার পড়ে, দু একটা বানান ভুল ঠিক করে, ফাউন্টেন পেনের মাথাটার প্যাঁচ সাবধানে আটকে উঠে দাঁড়াল সূর্য। জিভ বুলিয়ে আঠার সরু ফালিটা চেটে আটকে দিল। হালকা একটা বিদেশ বিদেশ গন্ধ এখনও সে পায়, যখন এয়ার মেলের আঠায় জিভ বোলায়। এরা সবকিছুতে সুগন্ধ ঢালে। লোকে হেসে বলে, স্নান করে না শীতের দেশের লোক। তাই গায়ে এক গাদা পারফিউম দেয়। সেরকম সব জিনিসে সুগন্ধ। লন্ড্রিতে কাচিয়ে আসা বিছানার চাদরে ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। ও নাকি ওরা ডিটারজেন্টেই মিশিয়ে দিয়েছে। বরফ আর জল মেশানো ঠান্ডা চায়ের চল আছে গ্রীষ্মকালে। তাতেও কত সব নকল ফলের গন্ধ মেশানো থাকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে সূর্য বাইরের চৌকো দালানে এল। সবুজ ঘাসে মোড়া একটা মাঝারি মাঠ। এ মাঠের চারদিকে সাজানো তাদের হোস্টেলগুলো। পর পর এক রকমের বাড়ি। ছক কাটা কাগজের ওপর পুতুলের বাড়ির মত।
সন্ধে নেমে এসেছে। সূর্য হালকা মনে হাঁটছিল। ওদিকে গার্লস হস্টেল থেকে মেয়েদের সরু গলার হাসি আর উচ্চস্বর গল্পগাছার শব্দ। কে যেন কাকে খুব জোরে ডাকল অন্য আরেকটা হস্টেল থেকে। জোরে দরজা বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে একটা কোন বাড়ির। ছেলেরা জ্যাকেট, কোট পরে বেরিয়ে পড়ছে। টিপ টিপ বৃষ্টি, অক্টোবর মাস, শিগগিরই শীত দেখতে পাবে সূর্য এখানের। কড়া ঠান্ডা, বরফ। আপাতত মাথায় তুলে দিল সে জলনিরোধক রবার ক্লথে তৈরি একটা ম্যাকিনটশের টুপির কানাত।
হাই সুরিয়া।
পিটার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যেন বাতাস ফুঁড়ে। পিটারকে দেখে চমকে যায় সূর্য। আফ্রো-আমেরিকান ছাত্র পিটার। কুচকুচে কালো চুল স্প্রিং-এর মত কোঁকড়ানো। বাদামি ত্বক খুব মসৃণ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। আরো উজ্জ্বল তার হাসি। সাদা ধবধবে দাঁতে চওড়া করে হাসল পিটার।
কাম, এসো আমার সঙ্গে। সূর্যকে বগলদাবা করে সে নিয়ে গেল তাদের কালোদের হস্টেলে।
সূর্যর গাত্রবর্ণ দেশের তুলনায় ফর্সা। ভারতে তাকে সবাই গৌর বলে। রাঙামূলা বলে খেপায়। এখানে ভারতীয় ছাত্রকে নিগ্রোর কাছাকাছিই ভাবা হয়। গায়ের রং ঘোর বাদামি বা হালকা বাদামি... দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে মহালিঙ্গম বা কলকাতার সূজ্জি চৌধুরী... কেউ এদের কাছে আলাদা না। সাদা চামড়ার চোখে মার্কামারা এশীয়। বিশাল পৃথিবীর মানচিত্রে ভারত কোথায় জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশ মার্কিন ছাত্রই খুঁজে বার করতে পারবে না। তবু তাদের সৌজন্যে ভাঁটা পড়ে না। সহপাঠীকে তার লেখাপড়ার জন্য বা গুণের জন্য কদর দেয়।
কালো ছেলেদের হস্টেলে নানা ঘরের ভেতর থেকে গানবাজনার আওয়াজ আসছিল। কেউ নিজে গিটার নিয়ে গান গাইছে, কেউ নিজের ঘরে বসে ড্রাম বাজাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে। গমগম করছে করিডোর। পিটার একা যখন ল্যাবে কাজ করে অনেক সময় পোর্টেবল ট্রানসিস্টর নিয়ে যায়। রেডিওতে অনেক রাত অব্দি জ্যাজ শুনতে শুনতে কাজ করে। গানপাগল এরা। আর মাদক দেশজ সুর, কিছুটা লোকগানের সুর, শুনতে শুনতে সূর্যের বিদেশবাসে হোমসিক, বাড়িপাগল নিস্তেজ হয়ে আসা মন খানিক প্রলেপ পায় যেন। মেঠো সুর শুনে দেশের ভাটিয়ালি গানের কথা মনে পড়ে যায়।
একদিন তোমাকে ব্লুজ বারে নিয়ে যাব সুরিয়া।
গেল সে। পিটারের সঙ্গে, আরো দু-তিনটি বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গে। হইহই করে গা কাঁপিয়ে হাসে পিটারের বন্ধুরা। ঠোঁটে লিপস্টিক, চুল আঁচড়ে চমৎকার বাঁধা পিটারের গার্লফ্রেন্ড অ্যালিস, খুব বন্ধুত্বপূর্ণ।
এসো, ভেতরে চলো। পিটার হাত ধরে সূর্যকে টেনে নেয় ব্লুজ বারে। এটা শহরের একটা বিশেষ পাড়া। কালোদের এলাকা। সেগ্রিগেশন এখনও সারা আমেরিকায় আছে। কোথাও কোথাও সোচ্চারে। কোথাও বা পুরনো আদবকায়াদার অঙ্গ হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। বদলানোর জন্য কেউ পরিশ্রম করেনি। যদিও একশো বছর আগে প্রায়, আইওয়া স্টেটের কোর্ট প্রথম ইসকুলে সাদাকালো সবার একসঙ্গে পড়াশুনোর জন্য আইন পাস করেছিল। তবু, অদৃশ্য একটা আড়াল এখনও যেন থেকে যায়। গোষ্ঠীবদ্ধতায় সামাজিকতায়।
এমস শহরেও আছে সেরকম কফির দোকান বা পানশালা। সেখানে বাজে কালোদের গান। স্টেজে দাঁড়িয়ে পানশালায় ব্লুজ গেয়ে চলেন কালো গায়িকা। সে কী অপূর্ব গান। এক বোতল করে বিয়ার নিয়ে, সে গানে মজে যেতে হয়। কথা, গল্প, অঙ্গভঙ্গি হাসি আর গান সব মিলেমিশে যায়।
কালো মানুষের লড়াই আর কান্না। মার্কিনি সংগীতে জ্যাজ ও ব্লুজ সেই গল্প বলে গেছে দীর্ঘকাল। দাস হিসেবে বিক্রি হওয়া কালো মানুষদের কথা। তাদের লড়াই। প্রথমে কৃষিপ্রধান সমাজে তাদের শ্রমদান। দক্ষিণের দিকের রাজ্যগুলোতে তুলোচাষের মাঠে মাঠে তাদের শরীরের প্রতি বিন্দু ঘাম নিংড়ে পড়েছে। তারপর সিভিল ওয়ার। পরবর্তীতে উত্তরের অঞ্চলগুলিতে তাদের শ্রমিক হিসেবে যোগদান। শিল্প বিপ্লবের সুফলের প্রায় প্রতিটি কাহিনির পেছনেই আছে রেল পথ তৈরি, পাথর ফাটিয়ে রাস্তা বানানো আর স্টিম ইঞ্জিনের গতিপথে পড়ে থাকা অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার কাহিনি। যাদের অধিকই কালো মানুষ।
আফ্রিকা থেকে জাহাজে করে চালান হওয়া কালো মানুষদের সুরেলা গলা আর ড্রাম-বাজানোর অনবদ্য ছন্দচেতনা, এসবের থেকে দক্ষিণের দিকের রাজ্যগুলিতে ব্লুজ-এর প্রচলন। তুলোচাষের গমচাষের পরিশ্রমের মাঝে তাদের পিতৃপিতামহের গাওয়া ধর্মীয় চান্ট বা মাঠে কাজের সময়ের ছড়ার মত করে হাঁক দেওয়ার সুর… এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে ব্লুজ। সূর্য ভাবে, ভারতের পাল্কি বাহকের হুনহুনা বা মাঝির নৌকো বাওয়ার গানের সঙ্গে মিলটা তাই এত চোখে পড়ে।
নিউ অরলিন্স-এর আশপাশেই জ্যাজ-এর প্রচলন কিন্তু ব্লুজ ও জ্যাজ বিস্তার লাভ করল দক্ষিণ থেকে মিড ওয়েস্টে, কেবলমাত্র ১৯৩০ ও ৪০ দশকেই। আইওয়া স্টেট, ইলিনোয়া ইন্ডিয়ানা ওহায়োর মতই মিড ওয়েস্ট স্টেট।
সেইদিন সুরে সুরে ভরাট মন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পথে একটা বইয়ের দোকান পড়ল। থামল দোকানে একটি বই দেখে। রে ব্র্যাডবারি নামে এক লেখক, পঞ্চাশ একান্ন সাল নাগাদ তার কিছু বই বেরিয়েছে। কল্পনার জগতে পাখা মেলা দুঃসাহসী বই নাকি সেসব। বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে সূর্য তুলে নিল মার্শিয়ান ক্রনিকলস নামে এক বই। আর সে রাতেই গোগ্রাসে পড়তে শুরু করে দিল।
কিছুদূর আসার পর স্তম্ভিত হয়ে গেল সূর্য। কে এই লেখক!!! কী আশ্চর্য লেখা। একটা গল্পে একের পর এক সোনালি সুতোর ববিনের মত রকেটে চেপে একটা দক্ষিণের শহরের সমস্ত কালো মানুষেরা চলে যাচ্ছে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপন করতে, নতুন করে জীবন শুরু করতে। আর সাদা মানুষেরা চাইছে তাদের আটকে দিতে। নিজেদের দোকানে, বাড়িতে্ মোটাদাগের ভারি কাজগুলো কে করবে যদি কালোরা না থাকে? কে ঘর ঝাড়বে পুঁছবে, কে রান্না করবে, কে দোকানে মাল ওঠাবে নামাবে? একটা শহর জুড়ে নদীর মত কল কল করে কালো মানুষ হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছে রকেট যেখান থেকে ছাড়বে সেইদিকে।
বাস্তবের গ্লানি, কষ্ট, বাস্তবের রূঢ়তা অত্যাচার, অপমানের যত গল্প শোনা যায়, দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দড়িতে বেঁধে কালো মানুষকে কথায় কথায় গাছে লটকে লিঞ্চিং-এর যেসব ভয়াবহ ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে, সবকিছুকে উড়িয়ে দেওয়া এক কল্পগল্প লিখেছেন রে। রে নিজে সাদা চামড়ার মানুষ। কিন্তু কলমের খোঁচায় একটা বিপ্লব এনেছেন তিনি। মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে যে অদ্ভুত ফ্যন্টাসির জগত বানিয়েছেন সেটা তো সত্যিকারের মঙ্গলময় একটা ভবিষ্যত! কল্পনা যদি করতেই হয় তবে এভাবেই করা ভাল।
পিটার এ বই পড়েনি নির্ঘাৎ। ওকে পড়াতেই হবে এ লেখা! প্রেমেনজেঠুকেই রে ব্র্যাডবারির গল্প সম্বন্ধে অবহিত করে একটা চিঠি লিখতে হবে। সূর্য ঘুমিয়ে পড়ার আগে আধা স্বপ্নের মধ্যে দেখে, এক দল কালো মানুষের সঙ্গে সেও শহরের পথে হাঁটছে। কিন্তু এ তো অন্য এক দল মানুষ! কুলতলিতে তরুণ তীর্থ নামের যে সংগঠনটা করেছে আর এস পি-র তরুণেরা...সুকান্ত-নজরুলের জন্মদিনে গান-কবিতা-চড়ুইভাতি সব মিলিয়ে একটা মজলিস-সমাবেশ হয়েছিল। বিদেশে পাড়ি দেবার আগে সেদিন গিয়ে ওখানেই বুদ্ধ, ঢাকুদা সবার সঙ্গে দেখা করে এসেছিল সূর্য। সেই দিনের শোভাযাত্রায় পা মেলানোর কথা মনে পড়ে গেছে সূর্যের। মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়। বুদ্ধ তার ক্রান্তিতে সে রিপোর্ট ও লিখেছিল। ছেলেরা গাইছিল, বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙো... নজরুলের চল্ চল্ চল্ ...রক্তে দোলা লেগেছিল। ঘন সবুজ গাছের সারির তলায় যেন সেদিনও কালো নদী বইছিল একটা। মানুষের উষ্ণ রক্তে ঘামে ভেজা সেই ঢল।