• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • ফাল্গুনের গান (৮- শেষ) : যশোধরা রায়চৌধুরী



    ২৩

    সময় বড় কম। তবু সময়ের পদপাত নিঃশব্দ। সময়ের পদপাত বড্ড লঘুও, অজানতে অসংখ্য বছর চলে যায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভুল আর প্রেম আর কান্না আর রতি নিয়ে মানুষ বড় হাঁকপাকায়। তবু স্বপ্ন থেকে যায়। স্বপ্নের রেশ রাখে। বহুদিন অব্দি প্রাচীন জীবাশ্মের চিহ্নের মত স্বপ্নেরা দাগ ফেলে যায় পরের জীবনে। পারিবারিক বলয়ে।

    অদ্রীশ বর্ধনের আশ্চর্য! পত্রিকার ছত্রচ্ছায়ায় এখন সাই-ফাই ফিল্ম ক্লাব রমরমিয়ে চলছে। সে ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোক্তা সত্যজিত রায়। আর চলছে প্রকাশনা সংস্থা, আলফা বিটা। পাতলা বই বেরুচ্ছে পর পর। ওদের প্রকাশনার বইগুলোর নাম দিয়েছে রকেট বই। সূর্য একটি মৌলিক উপন্যাস লিখেছে একটি পুজো সংখ্যায়। সেটা বই আকারে ছাপার কথা চলছে। সালটা ১৯৬৬।

    আর, এই বছরেই, রেডিওতে একটা গল্প পড়বে বলে কথা হচ্ছিল ওদের। সে এক নতুন ধারণা। মহাকাশযাত্রার গল্প, বারোয়ারি লেখা হবে। চারজন অথর, লেখকের রচনা এক সঙ্গে। চারজনের মধ্যে সূর্য একজন। বাকিরা মহারথী... প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, সত্যজিৎ রায়।

    এরকম একটা বিশাল সম্মানের কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সূর্য। ভাবেনি নীপমঞ্জরীও। আনন্দে ডগমগ নীপমঞ্জরী ততদিনে সন্তানের মা। পৃথিবীটা আশা আর আকাঙ্ক্ষায় ভরে উঠেছে তাদের।

    এরই ভেতরে একদিন জ্বরগায়ে ফিরে এল সূর্য আপিস থেকে। আর দু দিনের মধ্যে তার ব্রেইনে পৌঁছে গেল ব্রেইন ফিভার। ডাক্তারি নাম এনসেফেলাইটিস। আচমকা তাড়স দিয়ে খুব বেশি জ্বর। তার পর ভুল বকা। তার পর কোমা।

    তিন দিনের মাথায় সূর্যশেখরের শবদেহ পৌঁছে গেল চেতলার কাছে, কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। সেদিন তার প্রিয় ছোট্ট গাড়িখানা নাকি খুব কেঁদেছিল... অনেকে বলে ওটা হর্নের ত্রুটি।

    অণু, পরমাণু, কণার বিশ্ব তখনো অবিনশ্বর এবং নিখুঁত। কোথাও বেশি বা কম হয় না। পলিথিন পলিপ্রপিলিন, বিবিধ কৃত্রিম পলিমারের সেসময় ছিল শুরুর কাল। ভারতের বুকে পঞ্চাশ ষাট বছর পরে সেই সব প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাছাড়া উপস্থিতি হয়ে দাঁড়াবে এক চূড়ান্ত বিপদ। পশুপাখির মৃত্যু সমুদ্রজল নদী হ্রদের জলের দূষণ আর শহরগুলির নিকাশিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার একমাত্র কারণ।

    জীবন গিয়াছে চলে বহু বহু বছরের পার।


    ২৪


    দুটো একরকম দেখতে কাঠের আলমারি। একটা মেয়েদের জন্য আর একটা ছেলেদের। সেগুনকাঠের। স্নেহলতা দিয়েছিলেন নীপুর বিয়েতে। ডান দিকেরটা নীপুর। ভেতরে ওর বিয়ের পেঁয়াজি রঙের বেনারসি থেকে শুরু করে চান্দেরি, কত যে শাড়ি। ১৯৬৬ সালের সেই দুর্ভাগা দিনটির পর হাতই দেয়নি নীপু। সূর্য আর সে গিয়েছিল মাদুরাই, ব্যাঙ্গালোর। এক গোছা অপরূপ প্যাস্টেল রঙা দক্ষিণ ভারতের সুতির শাড়ি তার। সেসবও যেমনকার তেমন পড়ে আছে। গ্রে রঙা সরু সোনালি পাড় শাড়িটি। পেস্তা সবুজে হলুদ ঢালা পাড় শাড়িটি। আর অনেকগুলো ঢাকাই। স্নেহলতার বাপের বাড়ির দেশের জিনিস। দাদু নিজে হাতে নাতনিকে দিয়েছিলেন কোনটা, পঞ্চাশ সালে ও দেশ থেকে পাকাপাকিভাবে চলে আসার আগে। নীপুর নিজের অতি প্রিয় হালকা রঙের ঢাকাই। আদত ঢাকার বুনুনি। সাদাতে কালো ধানছড়া আঁকা। সব ভেতর দিকে সরিয়ে সে এখন সাদা খোলের ধনেখালি আর টাঙাইল পরে।

    সূর্যশেখরের আলমারির দশা আরো করুণ। দুচোখে জলের ধারা, সেসব ঘাঁটছে এখন নীপু মাটিতে মাদুর পেতে বসে। বহুদিন পরে সূর্যশেখরের আলমারিটা খোলা পড়েছে। দুটো সদ্য বানানো স্যুট, চার পাঁচটা অতি উৎকৃষ্ট কাপড়ের ফুল শার্ট। হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। স্থির হয়ে আছে সময়। যেন এইবার অফিস যাবার উদ্যোগ নেবে সূর্য, স্নান করে আসবে মস্ত বড় টার্কিশ তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে। গৌর অঙ্গ থেকে টপটপ জল গড়াবে। সহাস্য চেহারাটি। মাথায় সদ্য টাক পড়তে শুরু করেছে। আলমারিতে নানা রঙের শৌখিন টাই করুণভাবে ঝুলছে। কয়েকটা ছাপ দেওয়া বুশশার্ট ছুটির দিনে পরার। বেশ ক জোড়া জুতো। ন নম্বর সাইজের।

    একটু একটু করে সূর্যর এইসব জামাকাপড় দানদাতব্য করে দিতে হবে। মেয়ে বড় হচ্ছে। তারও তো জামাকাপড় বাড়ছে। নীচের তাকে অনেক জিনিস। ফোলিও ব্যাগে সূর্যর চিঠি, নানা সময়ে লেখা। আর এক ব্যাগে দুটো ডায়েরি। বেশ কিছু খাতা। সূর্য লেখালেখি করত, সেসব অর্ধসমাপ্ত লেখা।

    সমর এসেছিল সেদিন। রত্না, রমা সব বড় হয়ে গেছে। সমর কিন্তু রত্নাকে বিয়ে করে নিতে পারত। করেনি। ওদের আলাদা আলাদা দুটো চাকরি তো আছে। সামান্য হলেও চাকরি। ওরা দুজন দুজনকে ভালও বাসে বোঝা যায়। অথচ বিয়ে করেনি। কেন করেনি! জাতপাতের বাধা! সমর হাজার হোক নিচু জাত। রত্নারা গরিব কিন্তু ব্রাহ্মণ। এইই কারণ? না কি কমরেডদের বিয়ে করতে নেই! সেই চার অধ্যায়ের এলার মত রত্না শুধু পার্টির কাজ, সমাজসেবার কাজ করে যাবে। ডুরে শাড়ি। সাদা খোল। বিনুনি পিঠের ওপর। রোগা, মাজা মাজা রং। খুব ক্লান্ত দেখাল সেদিন রত্নাকে। মুখে হাসিটি লেগেই আছে তবু।

    নতুন প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছে নীপমঞ্জরী। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে ইলাসট্রেশনের স্কেচ দিয়েছে। প্রুফের তাড়া রেখে গেছে সমর তরুণ তীর্থের। সেইখান থেকে পড়ে পড়ে বিষয় ধরে ইলাসট্রেশন করেছে নীপমঞ্জরী।

    বু-কে মানুষ করতে গিয়ে তার বড় অয়েল পেন্টিং ধরা আর হয় না। মাঝে মাঝে খুব টানে তেলরঙের গন্ধটা। তার্পিন তেল লিনসিড অয়েলের গন্ধ। রঙের গন্ধ। একেকটা টিউব এখন দাম হয়েছে খুব। ধর্মতলা যাওয়া হয় না কত্তোদিন।

    সমর, তোমাকে যদি সূর্যদার একটা প্যান্ট দিই নেবে? কিছু মনে করবে না তো?

    সে কী বলছেন বৌদি! নেব না! মাথায় করে নেব।

    ঢলঢলে হবে তোমার। খরচা করে দর্জিকে দিয়ে অলটার করিয়ে নিও।

    এইসব ছেলেমেয়েরা আসে। নীপমঞ্জরী খানিকক্ষণের জন্য সূর্যের ছোঁয়া পায়। সূর্যের পুরনো লেখা রিপ্রিন্ট করবে ওরা। সূর্যের লেখার খাতা খুঁজে নতুন লেখা কাচিয়ে গুছিয়ে ওদের দেবে সে প্রিন্ট করাতে। এসব করলে ও ভাল থাকবে। মহাশূন্য নিয়ে গল্পের সঙ্গে এঁকে দিল গ্রহ-উপগ্রহের ছবি। আকাশে ঘুরছে বলয়যুক্ত শনি। উপগ্রহেরা ঘুরছে... তারা ফেটে যাচ্ছে দূরে... একটা ঘূর্ণিপাকের মত ছবি... যেন নীপমঞ্জরীর মনের এখনকার অবস্থারই ছবি...

    সমর বলল, বৌদি আপনি লিখুন ছোটদের জন্যে। ভাল হবে। লিখুন, লিখুন, প্লিজ।

    আচ্ছা বেশ। আমার ছোটবেলার কথা লিখব। রংপুরে আমরা ছিলাম। সেই সময়ের গল্প। এক সময়ে বেদেরা এসেছিল... কারমাইকেল কলেজের মাঠে। বেদেদের তাঁবুর পাশে আমরা ঘুরঘুর করতাম। তারপর চোর অপবাদ দিয়ে কলেজের অধ্যাপকেরা আমার বাবাকে বলে তাড়াতে বাধ্য করল ওদের। বাবা প্রিন্সিপাল ছিলেন কিনা। সেইসব গল্প। ছবির মত মনে পড়ছে এখন।

    ভাগ্যিস লিখতে বললাম আপনাকে। দারুণ লেখা হয়েছে বৌদি। নীপমঞ্জরীর লেখা মাথায় করে নিয়ে গেছিল সমর। ছেপেছিল।

    বেদেরা চলে যাবার পর গোটা মাঠে ছড়িয়ে থাকা তাদের চিহ্ন... পোড়া কালো হয়ে যাওয়া ঘাস, ইতস্তত পাথর, ইঁট, যা দিয়ে উনুন হয়েছিল তাদের। ভাঙা মেটে হাঁড়ি। এখনো ভাত লেগে আছে। এসবই নীপমঞ্জরীর সংসারের মত... সূর্যের ছোঁয়া এখনো লেগে আছে সর্বত্র।


    ২৫


    সমর রত্নাকে বিয়েই করে নিল শেষ পর্যন্ত। আবার নতুন করে কাজ বাড়িয়ে নিয়েছে অনেক। তরুণ তীর্থের কাজ তো আছেই। পত্রিকাটাও চলছে। নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্তও তো করতে হয়।

    মাঝে মাঝে নীপমঞ্জরীদের ছাতে আড্ডা বসে সমররা এলে। বিপাশা ইস্কুল ছাড়িয়ে কলেজে যাবে এবার... আশির দশক গড়াতে গড়াতে চলেছে। সাতাত্তরেই হাতবদল হয়েছে সরকার। আর আশির মুখেমুখেই বাংলা দেখেছে সিনেমাপাগল বাঙালির একটি বিশাল নক্ষত্রের পতনকে। উত্তমকুমার।

    অনেক কর্মী দল ছেড়ে দিয়েছেন। আর এস পির আগের জেল্লা নেই। ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে চলেছে অনেক সংগঠনের কাজ। তরুণতীর্থকে সমর রাজনীতির ছায়া বাঁচিয়ে মহীরুহ করে না তুলতে পারলেও অন্তত একটা ছোটখাট পাতাবাহার গাছের মত করে তুলতে পেরেছে। তাই সে সুখী।

    কতদিন চালিয়ে নিতে পারবে জানা নেই অবশ্য।

    একদা ওর জীবন ছিল রং-তুলির, তীব্র সুন্দর গন্ধের তিসির তেলের সংগে তেলরঙের টিউবের গলগল করে বেরিয়ে আসা হলুদ বেগুনি সবুজের। মোটা তুলির জোরালো টানটোন ওর, অনেকে বলেছে পুরুষালি। সতেজ গাছের ডালের মত নীপমঞ্জরীর স্বস্থ, স্বাস্থ্যময় বাহু বড় একটা ক্যানভাসের ওপর থেকে নীচে অব্দি টেনে দিতে পারে বক্ররেখাকে। থকথকে আধ জমাট বাঁধা রঙের পরতে স্প্যাচুলার আঁচড় দিয়ে ও ফুটিয়ে তুলতে পারে আলোছায়া, উচ্চাবচ পরতে ছিটকে পড়তে পারে কুসুম আলো বা গহন অরণ্য।

    প্রথমে স্কেচ। কালো খড়ি, কাঠকয়লার টুকরো দিয়ে আবছা আলতো অবয়ব আঁকা৷ চারকোল স্কেচের বড় খাতাগুলো এখন লফটে উঠে গেছে। বেলেঘাটা, লবণ হ্রদের ভেড়ি, পেরিয়ে পেরিয়ে হেঁটে ওরা স্কেচ করতে যেত মেছুনির তীব্র আঁকবাঁকের শরীর, জেলেবস্তি, উলটে রাখা ডিঙি।

    আর্টের জগৎ এখন অপসৃয়মান স্বপ্নের মত লাগে। তারই ব্যাচের সুনীল দাস ঘোড়ার স্কেচের জন্য বিখ্যাত হয়েছে, দিল্লিতে আছে। শ্যাম কিশোর সেই গ্রামের ছেলেটি, পরিমল। নারী শরীরকে এঁকে এঁকেই সে বিশ্বজয় করল। আর্ট জগতকে কাছে থেকে দেখে সে জেনেছে এখানে বাজি রাখতে হয় পুরো জীবন, যাপন, ধন, মান। বিদেশে একজিবিশনে ডাক পাওয়া, দিল্লিতে মডার্ন আর্টে ডাক পাওয়া বা জাহাংগির আর্ট গ্যালারিতে শো করা, সূর্য বেঁচে থাকলে তাকে উৎসাহ দিতই। অন্যথা স্বামী বা সংসারের উদ্যোগ না থাকলে যে-কোন মেয়ের পক্ষেই এ কাজ খুব কঠিন। টিঁকিয়ে রাখা আঁকাআঁকি।

    তবু সে কিছুদিন চালাল। ৭৪-এ তার শেষ প্রদর্শনী আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসএ। তারপর আর ভাল লাগে না উদ্যম পায় না সে।

    মেয়ে বড় হচ্ছে, আর তাকে সারা বেলা শুধু আটা চাল ইলেকট্রিক বিল, কেরোসিন গ্যাসের জোগাড়ে মাথা দিতে হচ্ছে।

    হারিকেনের ডুম মুছে পরিষ্কার রাখা হয় রোজ। কেরোসিন ভরে হারিকেন রেডি করে রাখা থাকে লাইন দিয়ে। বিকেলের আগেই।

    সন্ধেয় ঝপ করে আলো যাবে। ইস্কুল থেকে বু ফিরলে আটারুটি দিয়ে কুমড়োর তরকারি খেয়ে খানিকক্ষণ ছাতে ঘুরে বেড়িয়ে তারপর যে সময়টা পড়তে বসবে, তখনই লোডশেডিং।

    অবশ্য বেরিয়ে পড়লে আর চিন্তা নেই। রাস্তায় নামলেই কলকাতা শহর তাকে গিলে নেয়। ধূসর, শ্যাওলার ছাপ ছোপ, নোনাধরা দেওয়ালের সার, এই হল তাদের মধ্যবিত্ত লোকালয়। বাঁ-দিকে বস্তি। নীপমঞ্জরী একটা মোটামত বউয়ের নাটক করা দেখে দেখে তার নাম দিয়েছে হেমা মালিনী। কথায় কথায় ঝগড়া করতে করতে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে। নর্দমায় ময়লায় গু মুতে নিজেকে মাখামাখি করে। পড়োশিনীর চুলের মুঠি হাতে করে তুলে আনতে পারে গোছা গোছা। আবার তার নিজের বর তাকেও পিঠে চ্যালাকাঠ ভেঙে শাসন করে যখন, ভূত-পেত্নির আড্ডাখানা মনে হয় তখন এ পাড়াটাকে।

    চিমসে দুটো কালোকোলো ছেলের মা এই হেমা মালিনী। দুটো ছেলেই বারো তেরো বছরের, এখনই ব্ল্যাকার হিসেবে নাম লিখিয়েছে। পূর্ণ সিনেমায় টিকিট ব্ল্যাক করে। মধ্যবিত্ত বাঙালির হাতে টাকা নেই। আম কিনতে পারে না বৈশাখে। তখন ওদের হাতে হাতে সদ্য ওঠা হিমসাগর। কিম্বা বেলা চারটেতে গ্রীষ্মের খর দুপুরে যখন আইসক্রিমওয়ালা হেঁকে যায়, অ্যাই আইচ কিরিম… বিপাশা ছোটে বারান্দায়, দেখতে কোয়ালিটির কে আছে না কিউ… কিউ দিয়ে লেখা কোয়ালিটির বানান মানে ঠিক বানান, তার মানেই ভুল আইসক্রিম। মা শিখিয়েছে তাকে। ভুল বানান মানে ঠিক আইসক্রিম। কী জটিল এই অঙ্ক। সে জেনেছে, বেশিরভাগ আইসক্রিমে থাকে নোংরা নর্দমার জল। কীকরে আইসক্রিম ওয়ালারা নর্দমার জল দিয়ে আইসক্রিম বানায় লাল নীল, জানে না।

    সেই কে লেখা আইসক্রিম কিনে দেবে মা গোটা গরমের ছুটির মধ্যে এক দিন কি দুদিন। বস্তির ছেলেরা প্রায়ই খায়, লাল টুকটুকে অরেঞ্জ আইসক্রিম। ওইসব নর্দমার জল দিয়ে বানানোগুলোই খায় বোধ হয়। খেলে ওদের জিভ লাল। আর এ ওকে জিভ বার করে দেখায় সেই রং।

    মেয়ে আর মা রাস্তায় বেরোলেই, রাস্তা ওদের টানে। এক একজনকে এক এক রকম করে টানে। রাস্তার হোর্ডিং, বিজ্ঞাপন, দোকানের নাম পড়ে বিপাশা। গিলতে থাকে। বাস স্টপে দাঁড়ালে ঋতুবন্ধে লেখা বিজ্ঞাপন দেখে মাকে জিগ্যেস করেছে, কী, মা? ঋতুবন্ধে? মা উত্তর দেয়নি। গম্ভীরভাবে অন্যদিকে তাকিয়েছে।

    তার মানেই গোলমাল। বিস্তর গোলমাল।

    মা একা বেরলে আজকাল একা বাড়িতে বিপাশা থাকতে পারে।

    মা জানে, পাড়ার দুষ্টু ছেলেগুলো ফোন করে প্রথমটা, বিপাশাকে দিন না মাসিমা, বলবে। তারপর নীপমঞ্জরী গম্ভীর হয়ে ফোন রেখে দিলে পরের বার ফোন করে শুধু ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা। কারা কে জানে। তবে ফোন নম্বর জোগাড় করেছে তো বটেই।

    ছেলেদের সঙ্গে মেয়েকে মিশতে দেওয়া স্বপ্নাতীত। কল্পনাই করা যায় না। আর মেয়েদের সঙ্গে? স্কুলেও কটা ধিঙ্গি বছর বছর ফেল করা মেয়ে জুটেছে কটা। এখন থেকেই বসে শুধু লাভারের গল্প। চুলে লকস কেটেছে সব। লম্বা ঢ্যাংঢেঙে চেহারা। এখনো ক্লাস সিক্সে কি সেভেনে আটকে। তিয়াত্তরে ববি সিনেমা আসার পর এই এক হয়েছে। ববি হাতা জামা, ববি দুল… বড় বড় রিং… ববি গগলস। আর ববি লকস। সব মেয়ের কানের পাশ দিয়ে চুল ঝুলছে, কপালে এসে পড়ছে।

    টান টান দুবিনুনি বেঁধে বিপাশা ইশকুলে যায়। মেয়ের চারিত্রিক অবনতির ওপর নজর রাখতে রাখতেই যৌবন অজানতে চলে যাচ্ছে নীপমঞ্জরীর।

    অসিতকে যখন এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিলেন, সাক্ষাৎভাবে তো প্রণোদনা ছিলই বনলতা আর তার দলবলের। গোটা পাড়া যেন তীক্ষ্ণ নজরে রেখেছিল নীপমঞ্জরীকে। যুবতী মেয়ে, ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে কীভাবে একা থাকে। বাড়িতে কারা কারা আসে। অসিত একটু বেশিই আসছিল মধ্যে। কয়েকটা চিঠিও লিখেছিল। অস্বস্তিতে নীপমঞ্জরী কাঁটা হয়ে গিয়েছিল। আর বেশি এগোতে দেওয়া যাবে না তাকে। থামিয়ে দিয়েছিল অসিতের আনাগোনা, পাড়ার লোকের দোহাই দিয়েই।

    কিন্তু পথ, পথ তো আছে। বাড়ির চৌহদ্দিতে সে আসেনি আর। কিন্তু বাইরে? আর্টের সার্কিটে বার বার দেখা হয়। সেবার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ দেখা হল। সুবিমলের একজিবিশন দেখতে গিয়ে। ইন্ডিয়ান আর্টের ফর্মে নতুনত্ব এনেছে সুবিমল। সূক্ষ্ম কাজ। মন দিয়ে দেখছিল সে। বিপাশা ছিল না সেদিন। বিপাশা মাঝে মাঝে পরীক্ষার পড়া করে টুটূনের বাড়িতে বসে। নীপমঞ্জরী একলা বেরয়, কেনাকাটি করে, বন্ধুদের সঙ্গে এখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কোন ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানোর কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। এক অদৃশ্য লৌহবলয়ে নিজেকে ঢেকেছে সে। কারো কোন বেচাল হবার জো-টি নেই তার সামনে। এক অবদমনের প্রাকার তুলে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছে, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে তো। সাদা শাড়িও এক রকমের সুরক্ষা, এক রকমের বর্ম তার। অবশ্যই। মিসেস চৌধুরী নামটি আর এই সিঁদুরবিহীন সিঁথির সঙ্গে সঙ্গে পোশাকের শ্বেততা তাকে বলয় দিয়েছে ।

    অসিত বার বার ভাঙতে চেয়েছে। একাডেমি থেকে বেরবার সময়, নীপমঞ্জরী, কেমন আছো? বলে সঙ্গ ধরল তার।

    ভালই আছি।

    মেয়ে কেমন? মা-বাবা সবাই ভাল ত?

    হ্যাঁ, তোমার কী সংবাদ বল?

    আমি তো ওই খবরের কাগজের চাকরি ছাড়লাম। টাকা দিত না ঠিক করে। জানতে না তুমি, না? আমার নতুন চাকরি তো এই পাশেই… হিন্দুস্থান টমসন অ্যাসোসিয়েটস-এ জয়েন করলাম। লাইফবয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছ কাগজে? আমার বানানো।

    বাহ, বেশ তো। এতদিনে তুমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেলে। আমি তাই ভাবছিলাম, তোমার ঐ কমিক স্ট্রিপ বন্ধ হয়ে গেল কেন হঠাৎ। বেশ হচ্ছিল ওটাও।

    ওপর থেকে, দূর থেকে কথা বলে নীপমঞ্জরী। অনেক প্রচেষ্টায় এমন একটি ভঙ্গি সে আয়ত্ত করেছে। তারা এখন হাঁটছে। লঘু পায়ে কথা বলতে বলতে একাডেমী ছাড়িয়ে চলে এসেছে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের দিকে। কলকাতার রাজপথে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার বিস্তার। গাছের নুয়ে পড়া ডাল ফুলে ফুলে আকীর্ণ। ক্যানোপির মত আড়াল ও ছায়া রচনা করেছে। অ্যাভেনিউ না হলেও, এ ক্যাথিড্রাল রোড এক মনোরম সবুজের আচ্ছাদন।

    অসিত ঘন হয়ে আসে হঠাৎ। তোমার মন ঠিক আছে তো?

    কেন, মনের আবার কী হবে। গলার মধ্যে মৃদু হাসি, অল্প ভর্ৎসনা নিয়ে বলে নীপমঞ্জরী।

    না, দেশের অবস্থাও ভাল না, তারপর শেয়ারের দামটাম সব যেভাবে পড়ে যাচ্ছে। শুনলাম তুমি নাকি গাড়িও বিক্রি করে দিয়েছ।

    নীপমঞ্জরী তার চিরদিনের উজ্জ্বল হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে অসিতের দিকে। স্নায়ুতন্ত্র টান করে নিজে হাতে ধরা। কোথাও কোন বিচ্যুতি সে নিজের ও পরের কারুর ব্যাপারেই বরদাস্ত করে না।

    হ্যাঁ, আর্থিক পরিস্থিতি দেখেশুনেই সিদ্ধান্ত নিতে হল আর কি। তার জন্য কি। মেয়ে বড় হচ্ছে। বাসে ট্রামে চড়তে শিখুক। এসব বিলাসিতা মানায় না আমাদের এখন আর।

    এখনো তো তোমার বয়স আছে। সময় আছে। এত কঠোর নিজের প্রতি তুমি না হতেও পারতে নীপমঞ্জরী।

    হঠাৎ যেন অসিতের গলায় এক পোঁচ গাঢ়ত্ব বেড়েছে। এত্তো সাহস পায় কী করে সে? বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে নীপমঞ্জরীর কপালে।

    দাঁড়িয়ে পড়ে অসিত নীপমঞ্জরীর দিকে তীব্র চোখে তাকায়।

    কতদিন স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে থাকবে তুমি। এদিকে যে প্রার্থনার উত্তর মেলে না। তোমার কি চোখেও পড়ে না কতদিন ধরে অপেক্ষা করছে অন্যেরা? এত ব্যথা দিতে হয়?

    থরথর আবেগে অসিতের গলা কাঁপে। এর চেয়ে বেশি প্রচ্ছন্নভাবে প্রকট কথা বলা তার মত শিক্ষিত ভদ্র বাঙালির পক্ষে সম্ভব ছিল না আর। চিঠিতে সে আরো বেশি প্রচ্ছন্ন ছিল কিন্তু সুর ছিল এইরকমই।

    নীপমঞ্জরী ছিঁড়ে যাওয়া বেতের ছিলার মত ছিটকে যায়। দুচোখ অগ্নিবর্ষী। ছি ছি অসিত ছি! তোমার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে নাকি! কাকে কী বলছ তুমি! নিজেকে, আমাকে, আমার স্বামীকে সবাইকে অপমান করছ তো! কেন!

    প্রায় অর্ধচিৎকারে গলা তারসপ্তকে বেজে ওঠে তার। আশপাশের পথচারিরা ফিরে তাকায়। পাছে তারা মজা দেখতে দাঁড়িয়ে যায়, নীপমঞ্জরী আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। অসিত ভঙ্গুর কিন্তু নাছোড়ভাবে সঙ্গ ধরে। ছিপছিপে রোগা অসিত, সামান্য পৃথুল ও বেঁটে নীপমঞ্জরীর দিকে ঝুঁকে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু নীপমঞ্জরীর কথার আঘাতে ছিটকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

    দাঁড়িয়ে পড়া, বাজে পুড়ে যাওয়া তাল গাছের মত অসিতকে ফেলে দ্রুতপায়ে নিজের হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ বুকের কাছে টেনে, সাদা শাড়ির আঁচল গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে নীপমঞ্জরী অতিদ্রুত হাঁটে বাস স্টপের দিকে। তার যেন হঠাৎ শীত করে ওঠে। যেন জ্বর এসেছে।

    আকাশে তখনও চৈত্র খেলা করছে।

    বাড়ি ফিরে সে ঢোঁক ঢোঁক জল খায়। মাথা দুহাতে চেপে ধরে বসে থাকে বহুক্ষণ। শরীর থেকে সব তাপ নেমে যায় যখন, নিজের পক্ষে সব যুক্তি আবার খুঁজে নিয়ে সে সাজাতে বসে।

    পুনর্বিবাহ যাদের দরকার তারা করুক। তার তো প্রয়োজন নেই।

    সে যদি পুনর্বিবাহ করে, তার মেয়েটা যে ভেসে যাবে।

    তার এখন একটাই কাজ। মেয়েকে মানুষ করা। তার চোখে স্বপ্ন পুরে দিয়েছে সে। বাবাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধার স্বপ্ন। বাবার ছবি ছোট্ট থেকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে তাকে শিখিয়েছে, বাবা তোমাকে ওপর থেকে দেখছে।

    এই গোটা কাহিনিতে কোন তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকতেই পারে না। তৃতীয়, না চতুর্থ?

    এ গল্পে শুধু সূর্য, নীপমঞ্জরী আর বিপাশা থাকবে। আর কেউ কোনদিন ঢুকবে না।

    বিপাশা, তোর বাবা লেখক ছিল। তুইও লিখবি, কেমন?



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments