সাত সকাল থেকেই শরতের আভা মেখে সেজে উঠেছে আকাশটা। সকালে একটু ঠান্ডা ভাব। প্রতিদিন সকালে পবনের দোকানে এসে বসে হারু। বহু বছরের অভ্যেস। এখানে না এলে দিন শুরু হয় না, সারাদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কত রকম লোক আসে। কত রকমের গুলতানি, আলোচনা, খবরাখবর দেওয়া নেওয়া আর খবরের কাগজ পড়া। সেইখান থেকে আবার আরও কত কি। প্রতিদিন সকালে চায়ের দোকানে কাগজ পড়ে শোনায় হারু আর পবন চা বানাতে বানাতে সে সব শোনে। আরও যারা যারা থাকে তারাও শোনে। কাল কাশ্মীরে উগ্রপন্থিরা অতর্কিত আক্রমণে একজন পুলিশকে খুন করেছে আর বিস্ফোরণে কিছু সাধারণ মানুষও আহত। তার খবর পড়ছিল একটু আগে। সেই নিয়েই এতক্ষণ চা খেতে খেতে লোকেরা আলোচনা করছে। হারু আপাতত পড়া থামিয়েছে। খবর পড়া ছাড়া হারু কোন কথা বলে না। আজও বলছে না। সে শুধু শোনে। পবন কিন্তু কথা বলায় ওস্তাদ। আর তার বাঙ্গাল ভাষা শুনতেও বড় চমৎকার। বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যে কথা হচ্ছে সে সব আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি।
--জন্ম থেকেই কাশ্মীর নিয়া শুনি। আরে স্থানীয় মানুষদের জিগা না কোথায় থাকবো। পাকিস্তানে না ভারতে। তা না কইরা রোজকার মারামারি কাটাকাটি।
--তা বললে হবে? কত সুন্দর সে জায়গা। ভারত ছাড়বে কেন। যার আলাদা থাকার দরকার সে পাকিস্তানে যাক।
--আরে বাদ দাও এসব, শুনেছ বড় কারখানা হচ্ছে মির্জাহাটির সাইডে?
--উড়া উড়া শুনতাসি। ডিটেইল জানোস কিসু?
--কারখানা হলে একদম বদলে যাবে দরিয়াপুর, লোকের ভাগ্য খুলে যাবে কাকা।
--আর চাষবাস সেইগুলা কে করব?
--সেই এক কথা কাকা আরে যন্ত্রে করবে গো? মানুষ চাকরি চায় বোঝ না? চাকরি করলে কত সুবিধে বলতো?
--চাকরিও তো আজকাল যন্ত্রেই করে রে বোকা।
--তোমরা যাই বল মানুষ এবার আর কারখানার বিরুদ্ধে যাবে না।
--মানুষের সঙ্গে কি সম্পর্ক? রুলিং পার্টি কি চায় সেটা দেখতে হইবনা? তায় আবার মির্জাহাটির মুসলমানগো জমি।
--মুসলমানরা না দেয় হিন্দুরা দেবে। ডি এম অফিস থেকে লোক এসে মিটিং হবে, কারখানা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ও এবার হতেই হবে কাকা।
--এই সরকারই এবার কারখানা করব। কোন অসুবিধা নাই। সময়ের সঙ্গে লোকে নিজের বাপের নাম ভুইল্যা যায় তো জমিনীতি ভুলতে কতক্ষণ?
--আমি তো আবার ইউনিভারসিটি হচ্ছে শুনছিলাম যেন। কারখানার কথা শুনিনি, সেইটা কি ঠিক?
--হ্যাঁ আমিও শুনছি। শুনছি ইউনিভারসিটির শিলান্যাস হইব পূজাতেই।
--ইউনিভারসিটি হবে, বড় কারখানা হবে আর কি চাও? শপিং মল হয়ে গেছে কতগুলো। তোমার চায়ের দোকানটা এরকম রেখো না কাকা। বদলে ফেলো। ঝাঁ চকচকে করে বানাও তো, মনে হয় যেন ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকেছি।
--দিবি তো এক কাপ চায়ের জন্য হাজার টাকা? মুরোদ আছে?
--পবনকাকা, তুমি কফিশপ বানালেই দেব। একদম মোবাইল ফোনের দিব্যি দিয়ে বলছি।
--তোমরা চালিয়ে যাও আমি চলি। একজন ওঠে।
--আমিও যাই কাকা দেখি আমায় আবার ইলেকট্রিক অফিস যেতে হবে। আরও একজন উঠে পড়ে।
একে একে সকালের দলের লোকজন উঠে পড়তে থাকে। হারুও উঠি উঠি করে। হারুর পুজোর মুখে কাজ একটু বেড়েছে। বেদোটার বড্ড বাইরে মন হয়েছে। কারখানায় থাকেই না। সারাদিন টইটই, কিচ্ছু কাজ কারবার শিখলো না। কি যে করবে।
--পবনরে কত কিছু হচ্ছে রে চারপাশে।
--হইব না? সময় নিজেই তো করায় রে সব।
--আমরা কাটিয়ে দিলাম কি বলিস?
--না আমি কাটাই নাই। আমরা হালায় রিফিউজি মাল। আমরা কাটাইনা, নিজেরা বদলাই। আবার বদলামু। তগো এদেশিগুলার ভাবনা অন্যরকম। তোরা সুখিরে হারু। তোরা সুখেই বাঁচস। আমাগো ভিতরে সুখ নাই, জ্বালা আসে।
হারু জবাব দেয় না। সে ভাবে, সেও কি রিফিউজি নয়? কাঁটাতারের এদিকেই নয় তার জন্ম কিন্তু তার জন্মস্থানেই কি সে থেকেছে কোনদিন? না থাকতে পেরেছে? ওর নিজের সম্পত্তি থাকলে কি এখানে রুজিরোজগারের জন্য চলে আসতে হতো? সে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। কবেকার কথা। এই মোমবাতির অন্ধকার কারখানা, এই দরিয়াপুরের পাঁচমেশালি মানুষ, এ কি তার নিজের জন্মভূমি? কিন্তু সে জন্মভূমির থেকে কম কিসে? হারু এসব কথা কাউকেই বলতে পারে না। নিজের কথা তো কিছুই না। সে শুধু খবরের কাগজ পড়তে পারে। রেডিও স্টেশনের দেবদুলাল যেমন পড়ত তেমন করে পড়ার চেষ্টা করে। আহা কি গলা। খবর যেন সত্যি আকাশবাণি হয়েই আসত। লোকে হারুর খবরের কাগজ পড়া অবশ্য শোনে। পবনের চা আর সেখানে হারুর খবর পড়া এইটা চলছে কতদিন ধরে। এটার লোভে হারু বেঁচে থাকে, যেমন বেঁচে থাকে বেদোর একটা হিল্লে হবে এই আশায়।
--কারখানা হলে এই বেদোর মতো ছেলেগুলো কাজ পেতে পারে কি বলিস?
--পাইতেও পারে আবার নাও পাইতে পারে। কেমন কাজকাম তার উপর তো নির্ভর করব। কিন্তু এখন তো দারওয়ান হইতেও ল্যাখ্যাপড়া জানতে হয়। দ্যাখস্ না এ টি এমে বইস্যা থাকে, সব গুলার মাধ্যমিক পাশ মাস্ট। বুজছস?
--তাহলে বেদোর কোন উপায় নেই?
--সেকি কওয়া যায়? সবার উপর ভাইগ্য বুঝছস না? তার উপর অনেক কিসুই নির্ভর করে রে হারু, সে তুইও জানোস।
হারু একরাশ চিন্তা নিয়ে আসতে আসতে উঠে পড়ে। সত্যি কারখানা মানে কত রকম হয়। ওরও কারখানা আর টিউব লাইটের কারখানা কত তফাৎ। দেবদুলালের খবর পড়া আর ওর পড়ায় কত তফাৎ। পড়াশোনা জানা ছেলে আর বেদোর মধ্যে কত তফাৎ। সত্যি যদি ওদের এই কারখানা উঠে যায় তাহলে বেদোটার যে কি হবে, অন্য কিচ্ছু কাজ জানে না। ওর নিজের জীবন তো চলেই গেল। এখন যতদিন বাঁচে সে উপরি পাওনা, পুজোর বকসিসের মতো। কেন যে বেদোটাকে ও মাধ্যমিক পাশ করালো না নিজেকেই মনে মনে গাল পারতে পারতে চলে যায়। পবনের দোকান শূন্য হয়। প্রতিদিনই বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দলটা চলে যায়। আবার এরা কয়েকজন সন্ধে বেলার দিকে আসে। সকালে এদের পর খুচরো লোকের ভিড় শুরু হবে। পবন মন দিয়ে দুধের ঢাকনাটা খুলে কতটা দুধ ফুটেছে সেটা দেখে নেয়। কেটলিতে গরম জল ভরে আরেকটা উনুনে বসিয়ে দেয়। গুলের আগুনে উনুন সে এখনো ব্যবহার করে জল আর দুধ ফোটানোর জন্য। কিন্তু চা গ্যাসেই বানায়। তাপটা গ্যাসে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। উনুনে তো এমন হয় না, মুখের কাছে এনে বা দূরে সরিয়ে তাপটা ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নিজেই তো দেখল আস্তে আস্তে কয়লা থেকে গুল সেখান থেকে গ্যাস, তারপর সেসব বাদ দিয়ে এখন অনেক চায়ের দোকানেই ইলেকট্রিক স্টোভে কাজ হচ্ছে। হিটার নয়, ওদের বলে ইন্ডাকশন স্টোভ। মনে মনে ভাবতে থাকে কারখানার কথা। হলে সে কি করবে? সে রিফিউজি, ও দেশে তো সকলেরই অল্প বিস্তর জমি ছিল। এখানে পবনের নিজের একছটাক জমিও নেই। কিন্তু তবুও সে আজও ভাবে জমিতেই মানুষের ক্ষমতা। কাশ্মীরে জমির জন্যই তো দুটো দেশ হামলাহামলি করছে। চায়নাও তো দখল করে আছে কত জমি। জমি ছাড়া কিছু হয় নাকি!
আজ রাতে স্টাফ কোয়ার্টারে ও একা। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততার পরে কাল কোন কাজ নেই। কলকাতা যাবে না উইকেন্ডে। মেয়েকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে যদিও। কিন্তু এই সময় খুব মূল্যবান। এই রাতগুলোকে বড্ড ভালোবাসে। ফোন অফ করা, কাল সক্কালের আগে খুলবে না কিছুতেই। অন্ধকার করে দিয়েছে সব কিছু। একা এবং একা। চুপ করে বসে আছে। কম্পাউন্ডের এই অঞ্চলটা নিঃশব্দ। এই সমস্ত রাতগুলোর জন্য ও পথ চেয়ে বসে থাকে। খুব শান্তির এ সময়। এ শান্তি ব্যাখ্যাহীন ও একান্ত। বাইরে ও ভেতরে শান্ত খুব শান্ত করে নিতে চেষ্টা করে নিজেকে। বন্ধ করে ফেলে দুই চোখ। সব কিছু অন্ধকার থেকে আরও তীব্রতর অন্ধকারের দিকে পৌঁছে যেতে যেতে, শব্দহীনতা থেকে তীব্রতর নীরবতার গহনে প্রবেশ করতে করতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলার খেলায় ডুবে যায়। কতক্ষণ সে নিজে জানে না, হয়তো কয়েক মুহূর্ত বা সময়হীন সময়ের বুকে হারিয়ে যায় সে। একটা স্নিগ্ধ আলোর রেখা দেখতে পায়, সেই আলোর রেখা যেন আসছে সমদ্রের মতো বিশালাকৃতি এক সরোবরের স্বচ্ছ জলে আপতিত সূর্যালোক থেকে। সরোবরের ঠিক পাশেই সবুজের ওপরে হলুদের মায়া মাখানো সরষের খেত, সেই খেতের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটা পাথুরে অথচ মসৃণ লম্বা রাস্তা। চলতে চলতে মিলিয়ে গেছে সে দূরের পর্বতমালার মাঝখানে কোথাও। সেই পর্বত নীলচে সাদা বরফ ঢাকা। যে রাস্তাটা চলে গেছে তার দুধারে উঁচু উঁচু সারি সারি কাচিল গাছের দল দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। মাঝে মাঝে আছে বুদলুর সারি। দূরের পাহাড়গুলোর কোলে রয়েছে ভূর্জ। কোথাও কোন জনমানব নেই। এ কোন জায়গা? উত্তর আর উত্তর পূর্বের যে বিস্তৃত পর্বতরাজী সে তো হিমালয়। আর দক্ষিণ আর দক্ষিণ পশ্চিমের যে পর্বতশ্রেণী? সে নিশ্চিত পিরপঞ্জাল। কিন্তু এমন সমুদ্রসদৃশ সরোবর তো এখানে থাকার কথা ছিল না। তবে এ অপরূপ অঞ্চল পৃথিবীর কোথায়? আরও একটু দক্ষিণে অবশ্য জনবসতি আছে। সেখানে মাটির ও কাঠের তৈরি বাড়িঘর আছে, গ্রাম আছে। দু একটি মানুষ দেখা যাচ্ছে এবার, তারা আনন্দ করছে। পুরুষ ও মহিলা একই সঙ্গে গান গাইছে আর একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলে নিচ্ছে গানে গানে কত কথা। এ তাদের ফসল তোলার গান। শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো কত সহস্র বছর ধরে ফসলের উৎসবে এই গান গেয়ে আসছে সে কথা তারা নিজেই জানে না। কিন্তু হঠাৎ করে এ কি হচ্ছে! কেন এমন হচ্ছে! এত কম্পন এত গর্জন কিসের! ওই লোকগুলো ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিল কেন? সারা পৃথিবী দুলছে, উত্তরের পাহাড় যেন কাচিলের পাতার মতো নড়ে নড়ে উঠছে। কি সাঙ্ঘাতিক! ভীম বেগে নেমে আসছে সেই পর্বতরাজী, নিজেই, ক্ষিপ্ত বৃষের মতন। পর্বতের সঙ্গে বরফের ধস, কী দানবীয় শব্দ! উত্তর আর উত্তর পশ্চিমের পাহাড়ের দেওয়াল যেন নিমেষে ভেঙ্গে বেড়িয়ে গেল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। ওলট পালট হয়ে গেল খড়কুটোর মতন। ভেঙ্গে, গুঁড়িয়ে, উড়ে যেতে থাকল ভূর্জ, বুদলু, কাচিলের সারি। মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেল এই সবুজ হলুদের বিস্তীর্ণ ক্ষেত, কবেকার সহজ মানুষের গ্রাম। প্রবল ভূমিকম্প। হ্যাঁ, ঠিক। এই সেই মহাপ্রলয়। তবে এবার আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সমুদ্রের মতো সেই সরোবর নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মিলিয়ে গেল এক স্রোতস্বিনী হয়ে। উত্তর পশ্চিমের পর্বতের সদ্য ভেঙ্গে পড়া দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে সে স্রোতস্বিনী চলে গেল অন্য দেশে। সেই সঙ্গে মিলিয়ে যেতে থাকল সেই দৃশ্যপট। যেমন উদ্ভাসিত আলোর হাত ধরে এই দৃশ্যের সঞ্চার হয়েছিল তেমনই আস্তে আস্তে অন্ধকারের হাত ধরে সে দৃশ্য মিলিয়ে যেতে থাকল অদৃশ্যে।
কষ্ট হচ্ছে তার। কেন মিলিয়ে গেল! আরও কিছুক্ষণ তার দরকার ছিল এই দৃষ্টি। মন কি অশান্ত হল! সে আবার মনোনিবেশ করতে শুরু করল। মনকে শান্ত করতে শুরু করল ধীরে ধীরে। ডুব দিতে থাকল আবার দৃষ্টির অতীতে। আর কিছুক্ষণ পড়ে সে অনুভব করল আবার ফিরে আসছে যেন সেই আলো। যেন এক নতুন রূপ ধরে, হ্যাঁ আবার সে দৃশ্যমান। সেই অঞ্চলই তো। হ্যাঁ সেই পর্বতরাজিই তো ঘিরে রেখেছে এখন এক বিস্তীর্ণ উপত্যকাকে। বোঝা যাচ্ছে সে মহাপ্রলয়ের পরে কয়েক সহস্র বছর পার হয়ে গেছে। বদলে গেছে এই অঞ্চলের গাছপালার ধরন। পুরনো গাছও কিছু আছে কিন্তু সংখ্যায় কম। পরিবর্তে এসেছে অন্য নতুন গাছ, অন্য অঞ্চল থেকে। কিছু প্রকৃতি নিজে এনেছে আর কিছু নিয়ে এসেছে মানুষ। হিমালয়ের আর পিরপঞ্জালের বুকের গাছপালাগুলো যদিও প্রায় একই আছে। তাদের দেখেই তো চেনা যায় এই দৃশ্যপট আসলে পূর্বেরই পরিবর্তিত রূপ। সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের পরে এখান থেকে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন নতুন গিরিপথ তৈরি হয়েছে, কিছু তো ছিলই। সেই গিরিপথগুলি ধরে চলে যাওয়া যায় আরও দূরের দূরের এক এক উপত্যকায়, বা অন্য কোন সমতলে। সেই সমস্ত বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সভ্যতার বাস। সেই সভ্যতার মানুষজনের সমাগম হয় এই অঞ্চলে। এই উপত্যকা এখন বাণিজ্যিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে এখন পশ্চিমে ভূমধ্য সাগর ও পারস্যে, উত্তরে গ্রিস ও রাশিয়া আর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ ভারত ভূখণ্ডের বাণিজ্যিক প্রবেশ পথ। এই উপত্যকাই এখন কাশ্যপ--পূর, তাকেই সুদূর গ্রিসের লোকেরা বলে কাস্পেরিয়া, আর স্থানীয় আদিবাসীরা বলে কশ্মির, শুকিয়ে যাওয়া সরোবরের দেশ।
এখন গ্রাম নয়। এখন নগর। সরোবর শুকিয়ে এখনো যেটুকু পরে আছে তা নগরের বিকাশের জন্য যথেষ্ট। সেই অবশিষ্টাংশর মূল জলরাশি এখন মহাসরিৎ নামে পরিচিত। সেখানে আছে এক অশেষ ঝর্না। নাম তার শতধারা। আর সেই ঝর্নার পাশে যে নগর তার নাম সুরেশ্বরী। সেই নগরের একদম প্রান্তে আছে সবুজে সবুজ শস্য ক্ষেত, মহাসরিতের কোল ছুঁয়ে। সেখানে আছে এক ছোটো প্রাসাদ। পাথর ও কাঠের সংমিশ্রণে তৈরি। তার দোতলার বারান্দায় বসে থাকতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এক সুপুরুষ যুবক। তিনি অধ্যয়নরত। তার সারা বাড়ি জুড়েই পুস্তক আর ভূর্জপত্রের সমাহার। তিনি অধ্যয়ন করেন পৃথিবীর ইতিহাস, তিনি প্রাচীন গ্রন্থ ঘেঁটে সংগ্রহ করেন কাশ্যপ পুরের পুরাকাহিনী, ক্লান্তিহীন অশ্বারোহে ছুটে চলেন ক্রোশের পর ক্রোশ নতুন শিলালিপি বা পত্রলিপির সন্ধানে। তারপর সে সমস্ত তথ্য গ্রন্থিত করেন সংস্কৃত শ্লোকে, অনায়াসে মুহূর্ত প্রবাহে। তাঁর সঙ্গে আছেন বেশ কয়েকজন লিপিকার। লিপিবদ্ধ হতে থাকে কাশ্যপপুর তথা উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারতের প্রথম প্রামাণ্য ইতিহাস -- রাজতরঙ্গিনী। তিনিই কাশ্যপপুরের রাজা হর্ষদেবের মন্ত্রী চম্পকের পুত্র কলহন। খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার সালে কাশ্মীরের রাজা প্রথম গোনন্দের রাজ্যাভিষেক থেকে তাঁর নিজের সময় পর্যন্ত অর্থাৎ বারোশো খ্রিস্টাব্দের মাঝমাঝি দীর্ঘ ব্যপ্ত কালকে তিনি লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। কলহন প্রমাণ পেয়েছেন কাশ্মীরে এখনো স্থানীয় কিছু আদি মানুষ আছেন। বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষে কলহন তাদের প্রাচীন অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। তাদের ধর্ম মানে দৈনন্দিন জীবন যাপনের আচার আচরণ। মাতৃ আরাধনা আর প্রকৃতির আরাধনাই ছিল তাদের উপাসনার বিষয়। তারা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে প্রায় একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল, মিল স্বভাবতই ছিল। তারপর খ্রীস্টজন্মের দেড় হাজার বছর আগে যখন থেকে এখানে উত্তরের গিরিপথ পেরিয়ে কুরু সম্প্রদায়ভুক্তু মানুষ এসেছিল তখন থেকে শুরু হয়েছিল বদল। শুরু হয়েছিল বৈদিক যুগ। সেই বৈদিক মানুষজনের হাত ধরেই সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে এখন এই উপত্যকা। বেদ রচনার সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ হতে থাকল বৈদিক সংস্কৃতির রূপরেখা। মানুষ বদলে যেতে থাকল। একসময়ের সরল সাধাসিধে জায়মান জীবনচর্যা একটা বাঁধাধরা আগরের মধ্যে বাঁধা পড়তে থাকল। সেই সময় মানুষ পেশার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল ঠিকই, তবে পেশার পরিবর্তনে তাদের সামাজিক স্তরবিন্যাসে বদল হত। জন্মের সঙ্গে সরাসরি সেই স্তরবিন্যাসের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরে সেই স্তরবিন্যাস হয়ে উঠল জন্মগত, মানুষ চিরকালের জন্য বাঁধা পড়ে গেল তার জাতিগত গণ্ডির মধ্যে। শুরু হল বিভেদ। এ সবের মাঝেই তৈরি হল প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্ম।
এই উপত্যকা অনেক কিছু দেখল। অনেক কিছুকে জন্মও দিল। যেমন জরাথ্রুষ্ট। যে কাশ্মীরী ব্রাহ্মণের হাত ধরে ছশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে জরস্ট্রীয়ান ধর্ম প্রচারিত হল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। যাইহোক কাশ্মীর নিজে ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দু রাজা আভিসারের সময়ে আলেকসন্দারকে দেখেছে। মৌর্য যুগে সম্রাট অশোককে দেখেছে। দেড়শ শতকে দেখেছে কুষান সম্রাট কনিষ্ক। পরবর্তীকালে দেখেছে হূন রাজা। দেখেছে তিব্বতের যুদ্ধ। আর এ সবেরই মধ্যে সুরেশ্বরী নগর কবে যে হয়ে গেছে শ্রীনগর বা মহাসরিৎ হয়েছে ডাল হ্রদ সে কথা কলহনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। এখন অবশ্য কলহন দেখছেন মুসলমান আক্রমণ। ইতোমধ্যেই গজনীর সুলতান মামুদ বেশ কয়েকবার কাশ্মীর আক্রমণ করার চেষ্টা করেছেন। কাশ্মীরের সামনে কি আছে কলহন জানেন না। না জানাতেই তো রহস্য। তবে এটুকু জানেন কাশ্মীর স্বাধীণ থাকুক বা না থাকুক কোনদিন ভারতবর্ষের সামগ্রিক রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি, পারবেও না। আসলে সুন্দর মাটি আর সুন্দর নারীর শান্তিতে থাকা হয় না কখনও।
টাকাটা বিরাট। সন্ধ্যে ছটায় পাঁচজন মিলে বোলেরোতে উঠে বসলো। ড্রাইভারটাকে ও চেনে না। সুনীল, আলি, রাজু, দিলীপ আর দিলু। জি টি রোড ধরে জোরে গাড়ি চলছে। বর্ধমান পার করে ঝাড়খণ্ডে ঢোকার আগে মাল গুলোকে ধরতেই হবে, নইলে সব ফসকে চউপাট। ফ্যাসফ্যাসে গলার গগনের কথাটা মনে পড়ছে বারবার। -- ঝাড়খণ্ডের চুতিয়াগুলোর সঙ্গে পারবি না তোরা? দশ লাখ। -- না পারার তো কিছু নেই। সুনীল ফস করে বলে দিল। কিন্তু কথা হচ্ছে এই হারামি গুলোকে ধরার কাজ তো পুলিশ বাঁ হাতে করতে পারে। এত টাকা দিলুর দলকে দিচ্ছে কেন। যদিও একটা গ্যাং গত ছমাস ধরে জ্বালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক মাসেই একটা দুটো গাড়ি হাইজ্যাক থাকে। কিন্তু সুনীলটা বড্ড বেশি নাচছে আজকাল। ওইটা খচ্চরের গাছ। পকিয়ে পাকিয়ে তখন দলে ভিড়ে গেছে এখন ফাল হয়ে বেরোচ্ছে। মনে হয় সুনীল আর গগনের আলাদা সাঁট আছে। দুটো বিচ খচ্চর জুটেছে একসঙ্গে। কিন্তু টাকাটা পাওয়া জরুরি। তবে গগন বলেছে মানে কলবাবুই বলেছে। কলবাবুর অনেক অনেক লরি খাটে ক্ষিদিরপুর পোর্টে। পোর্ট থেকে কয়লা নিয়ে যায় উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোয়, সাবানের কাঁচামাল নিয়ে যায় আসামে। আবার ফেরার সময় চা নিয়ে আসে কলকাতা বা সোজা চলে যায় অন্য ষ্টেটে। কয়লা, সাবানের কাঁচামাল আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ট্রান্সপোর্টের সময় চাইলে ড্রাইভাররা দু--তিন টন নামিয়ে সহজেই ফেলতে পারে। এই বাজারে তিন টন কয়লা নামাতে পারলে সলিড আট হাজার টাকা ড্রাইভারের থাকে। মালদা ঢোকার আগে, নবদ্বীপে, বিরহী এই সব জায়গায় কাটিং এর ব্যবস্থা আছে। এমন চমৎকার করে মিলিয়ে দেয় কাটিঙের জায়গা বোঝাই যায় না মাল সরান আছে। ওজন পুষিয়ে দেয় পাথর কয়লা দিয়ে, চালের বস্তা হলে গুঁড়ো পাথর ঢুকিয়ে। কিন্তু এ সব সেটিং মালিক জানে। যেখানে পৌছনো হবে তারাও জানে। এগুলো ছুটকোছাটকা ব্যাপার। এগুলো নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সমস্যা হল হাইজ্যাক হলে। প্রত্যেক বছরেই চার পাঁচটা ড্রাইভার খালাসি লাশ হয়ে যায় হাইজ্যাকের ঘটনায়। এই যে এই মুহুর্তে রাস্তার দুপাশে এত ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে এর মধ্যে কত যে ভুয়ো নম্বর প্লেট লাগানো কে জানে। এত গাড়ি এত রাস্তা কি করে জানা যায় কে কোথায় গেল। পুলিশের গাড়ি একটা সামনে। চেকিং করতে পারে। নাকা হলে সমস্যা। লাইসেন্স নেই মালটার, সিটের তলায় গুঁজে রাখা।
আটটার পড় বড় গাড়ি খুলে দিয়েছে। তার মধ্যে দিয়েই ওদের গাড়িটা জোরে ছুটছে। তুলে নিয়ে আসবে সোজা, লরিটার হদিশ পেলে ওদেরও পাওয়া যাবে। একটা ড্রাইভার আর খালাসি, কতদূর যাবে? ভর্তি প্রিমিয়াম চা। নর্থ বেঙ্গল থেকে যেত কলকাতাতে। কয়েক কোটি টাকার মাল নিয়ে খুঁজে পাওয়া যাছে না কাল থেকে। একটু আগে খবর হয়েছে, পেরোতে পারেনি। একটা পকেট রোড ধরেছে, মালগুলো খালাস করে, লরি কাটতে দিয়ে দিতে পারে। পাঁচঘণ্টা লাগে একটা লড়ি কাটতে। আলিটাও রামঢ্যাম না। কতকুতে চোখে কি যেন একটা হারামিগিরি চলছে। সুনীলটা সামনে বসেছে ড্রাইভারের পাশে। রতনটা এদের মধ্যে ঠিক আছে। একদম পেছনে। মাঝের সিটে আলি আর ও। পথে পুলিশের গাড়ি কিছুই করল না, আরও রাতে মালগুলো ঝামেলা করবে। কোনো শালার ফোনের প্রোটেকশন পাওয়া যাবে না এই সব কাজে। পুরো দায় বাঞ্চোৎ নিজের। এই রাস্তাতেও কত ট্রাক চালিয়েছে। পয়সা আছে, কাঁচা। সেই ভালো ছিল। লোকালে জয়দেব থেকে একবছর টানা বালির লড়ি নিয়ে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত কাজ করেছে। দশ চাকার গাড়িতে পঁচিশ টনের জায়গায় ষাট টন নিয়ে গেছে, সব সেটিং। বি এল আর ও, এম ভী আই, পুলিশ কেউ ধরবে না সেটিং থাকলে। বাংলার গাড়ি নিয়ে নলহাটি পেরিয়ে ওয়ে বিল, চালান ছাড়াই ঝাড়খণ্ডের পাথর খাদান থেকেও পাথর এনেছে। নলহাটির রাজপুর স্টেশন বাংলায়, ওটা পেরোলেই ঝাড়খণ্ড, ওখানে পাথরের দাম অনেক সস্তা। শালা এক একবার কুড়ি টন মাঝখানে নামিয়ে দিয়ে কত রোজগার হতো ওর। ওই পয়সা থেকেই পুলিশের ঝামেলার টাকা মিটিয়ে দিত দিলু। মালিকও খুশি থাকত। ওর গাড়ির কোন সমস্যা হত না। এক্সট্রা পয়সা লাগত না। অন্ধ্রের মাছের গাড়িতেও রোজগার করেছে অনেক। পরিষ্কার সাদা কাজ। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে ভাইজ্যাগ থেকে ডালখোলায় মাল ঢোকাতে পারলে এগারো শতাংশ কমিশন পাওয়া যায়। মানে দু লাখ টাকার মাছ ঢোকালে বাইশ হাজার পকেটে টাটকা। কিন্তু শালা খারাপ জীবন। সারাদিন রাস্তায়, ফালতু লোকের সঙ্গে ওঠাপড়া। খালাসি গুলোর ওপর অত্যাচার করতে হয়, নেশা করিয়ে শুধু শুকনো মুড়ির ওপর রেখে তিন দিনে গাড়ি ঢোকাতে হয়। ড্রাইভার ঘুমোলেও খালাসীরা ঘুমোতে পারেনা, ওদের তখন চালাতে হয়। তবে ও কোনদিন এমন অত্যাচার করেনি খালাসিগুলোর ওপর, না কথা শুনলে বেদম মেরেছে কিন্তু খেতে পড়তে দিত। ওর নিজেরই বা বয়েস কত ছিল, চব্বিশ। মাঝ বয়েসি ড্রাইভারগুলো হারামি হয়। ওগুলো দয়ামায়াহীন কিন্তু চালায় ভালো। কম বয়েসি অবস্থায় বেশি লোভ করে অনেকে ভুল পথে চলে যায়। এই ড্রাইভারটাও নাকি কম বয়েস। খালাসিটাও তাই। একটা চক্র আছে। ওদের দিয়ে এই কাজ করায়, টাকার লোভে। টাকার লোভ শালা কে ছাড়তে পারে। কিন্তু এত রাতে কেন চলেছে দিলু? ধুর বাল। টাকার জন্য। টাকা দরকার ওর। ভদ্র ভাবে বাঁচার জন্য টাকা লাগে। ধুর শালা আবার ভাবতে বসেছে। রাত এগারোটা গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য থামল। সুনীলের ফোন এল। কথা বলল। তারপর দিলুর দিকে ফিরে বলল
--দিলু এখনো পজিসন যা চার ঘণ্টা লাগবে, রাত তিনটে। এখনো এই পারেই আছে বলছে। তেল ভরেছে। মাল খালাস করতে পারেনি এখনো।
--ছেলে দুটো কোথায়?
--গাড়িতেই।
--সোজা চল। কোন মাল নয় -- দিলু বলল।
জোরে ছুটছে ওদের গাড়ি। পথে এক একটা ঠাকুরের প্যান্ডেল একা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখনো ঠাকুর আছে। আজকাল আর বিসর্জনের কোন দিন নেই। লক্ষ্মীর সঙ্গেই একসঙ্গে দেবে মনে হচ্ছে। সামনে একটা নাকা।
--গাড়ির কাগজ? ড্রাইভার ছেলেটা গাড়ির কাগজ দেখায়।
--ডিকি খোল। ছেলেটা ডিকি খোলে। দিলুর দিকে ভালো করে তাকায় একটা পুলিশ তারপর পেছনের ডিকিতে চোখ বোলায়।
--ক্লিন। বলে ওঠে।
আবার গাড়ি ছোটে। -- হারামিগুলো এমন খাতির করে দিলু তোর রূপ দেখে, বুঝলি? নোংরা দাঁত বের করে সুনীল খ্যাঁক খ্যাঁক করে মুচকি হেসে বলে আর একটা গুঠখার পাতা মুখে পুড়ে দেয়। চড়াক করে রাগ চড়ে যায় দিলুর কিন্তু কিছু বলে না। সামনে কাজ আছে, মাথা ঠান্ডা রাখেতে হবে। একদিন সুনীল ওর কাছে খাবে, খুব তাড়াতাড়ি। গগনের আস্কারা পেয়ে ও আরও নিজেকে কি না কি ভাবছে! পুলিশের কাছে ইনফরমেশন না থাকলে কখনই এসব করে না। ওদের ইনফরমার ঠিক জুটে যায়। পুলিশ শালা খানকির ছেলে। দিলুকে অবশ্য কিছু করেনি। রামবাবুর সময় পুলিশ নিজেই ওকে প্রোটেকশন দিয়েছিল। কলবাবুও তো রামবাবুকে চাইছিল না। কোন কেসই দেয়নি দিলুর বিরুদ্ধে। অবশ্য সে নিজে কিছুই করেনি। নিজেকে বাঁচাতেই গেছিল। কিন্তু যাই হোক সুনীলেরও এমনই দশা হবে। বেশি বাড়লেই ফুড়ুত। রতন এক মনে হেড ফোন কানে লাগিয়ে কিশোর কুমার শুনছে।
দুটো বাজে। কেউ কোন কথা বলছে না, সুনীলটা ঘুমোচ্ছিল বলে আলি সামনে গেছে। সুনীল এখন দিলুর পাশে। এখানেও ঘুমোচ্ছে। পেছনে রতন। সেও ঘুমিয়েছে। আলিকে বোঝা যাচ্ছে না। ড্রাইভার আর ও জেগে আছে ভূতের মতো। এই মুহূর্তে সময়গুলো অনেক বড় মনে হচ্ছে। তবে কি টেনশন হচ্ছে কোন ওর? না সে সব ভাবছে না। এইটা খুব বেশি ভারী কাজ কিছু নয়। কিন্তু একটা কথা ওকে বার বার ভাবাচ্ছে। এই কাজটার জন্য এত টাকা কেন? পুলিশকে দিয়ে এটা উদ্ধার করায় কোন সমস্যা ছিল না। শুধু মাল হলে, গাড়ি হলে এই সব খবর তো পুলিশের কাছে তো আছেই। নইলে ওরা পাচ্ছে কি করে। ছেলে দুটোকে অ্যারেস্টও করতে পারত। কিন্তু তবে কি আরও বেশি কিছু করবে? তুলে নিয়ে আসতে বলল কেন? ধুর্ বাল। তুলে নিয়ে এসে কি করবে গগন বা কলবাবু এসব কথা ও জেনে কি করবে? কিন্তু ভাববে নাই বা কেন? টাকা পাচ্ছে বলে ভাববে না? কি করবে ছেলেগুলোকে নিয়ে? এদের দশ বছরের জেল হলেই তো মিটে যায়। আরও অন্য ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে না তো? অবশ্য ঝামেলা ছাড়া ওদের কাজ কি অবশ্য আছে? ঝামেলা না থাকলে ওরা এত টাকা রোজগার করবেই কেন? ঝামেলা তো থাকবেই। সুনীল কি এটা ভেবেছে? না ভাবতে পেরেছে? না হারামিটা টাকা ছাড়া কিচ্ছু চেনে না। এসব ভাবার মতো অবস্থায় ও থাকে না। থাকলে এমন ঘুমোয়? পেছন থেকে একটা গাড়ি অনেকক্ষণ থেকেই ফলো করছে বলে মনে হচ্ছে। ড্রাইভার ছেলেটা এই কথাটা বলতে যাবে এমন সময় গোঁ গোঁ করে বেজে উঠল মোবাইল। সাইলেন্ট ভাইব্রেসন। এই সিমটা আর মোবাইলটা আজকের জন্য টাটকা সুনীল জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। ওদের কারো কাছেই কোন ফোন নেই। ধড়ফড় করে উঠে ফোন ধরল। তারপর থামাতে বলল গাড়ি। গাড়ি থামল।
--দিলু আর আধ ঘণ্টা পরেই ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে, একটু ভেতরে। একটা ধাবার সঙ্গে লাগোয়া গ্যারাজের পেছনে। ওরা ছাড়াও দু একজন আছে। কি করবি?
-- তোরা ভেতরে যাবি ওই দুটোকে বাইরে নিয়ে চলে আসবি। থোবড়ার ছবি দেখে নে আরেকবার, ভুল না হয়। দিলু বলে।
--কিন্তু পেছনে একটা গাড়ি মনে হয় ফলো করছে। রতন খবর দেয়।
--ও কিছুনা, ধুস।
--চল পিস্তল তো একটাই। তুই রাখ এটা। আমি বাইরেটা দেখবো।
উত্তরে কিছু কথা না বলে একটা শয়তানের হাসি হেসে সুনীল নেমে ডিকি থেকে ফেলে রাখা ব্যাগ দুটো নিয়ে এলো, ওর ভেতর থেকে বার করল একটা সাইলেন্সার পিস্তল। একদম অটোম্যাটিক। দিলু অবাক হয়। আরও দুটো মুঙ্গেরি দিল দিলীপ আর আলিকে। সব লোড করে নিলো। গাড়ি আবার চলল। সুনীলের মুখটা শয়তানের মতো লাগছে। দিলু কিচ্ছ জানে না! শালা কোথায় জড়াচ্ছে ও! প্রথম থেকেই কিছু লুকোচ্ছে হারামিটা। কিন্তু ওকে তো নিশ্চয়ই কেউ মদত দিচ্ছে। কলবাবু? দিলুর ধারণা ছিল গাড়িতে একটাই পিস্তল আছে। আর সেটা আছে ওর কাছেই। মাথা ঠান্ডা রাখল, সিটের ভেতর থেকে রিভলবার বার করে পজিসন নিল। মাথা ঠান্ডা রাখল কিন্তু রাগে ওর শরীর জ্বলে যেতে থাকল কিন্তু কিচ্ছু বলল না। ওরা কি করবে, কোথায় যাচ্ছে এখন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না, ওকেও এরা মার্ডার করে দিতে পারে সুনীল। মুখ বুজে রাগ থামাল, মনটাকে শান্ত করল, শান্ত করলে সব উদ্ধার হবে। ঠিক আধঘন্টা দূরেই এক ধাবার সঙ্গে গ্যারেজ মতো। এটাই। বাইরে কেউ নেই। অনেক ট্রাক আছে এদিক ওদিক কিন্তু ওই নাম্বারের কোন ট্রাক নেই, থাকবেও না। ওরা গাড়ি থামাল, দিলু আর দিলীপ একদিকে আর ওদিকে সুনীল আর আলি ভাগ হয়ে গেল। উনুনটার পাশে একটা খাটিয়ায় একটা বাচ্চা ছেলে ঘুমোচ্ছে। আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরে শুল। ধাবার ডান পাশ দিয়ে একটা রাস্তা, অন্ধকার। সেইখানে এগোল ওরা, দিলু গাড়িটাকে ইশারায় বড় রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে বলল। হেড লাইট বন্ধ। ওরা ঢুকে গেল ভেতরে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে খালাসী আর ড্রাইভার দুটোকে ধরে নিয়ে এলো। ভেতরেই ছিল। বন্দুকের সামনে সকলেই ফেকাসে, পুতুলের মতো যা করতে বলা হল তাই করল, দুটো বিরাট পেটি বার করে রাস্তার সামনে রাখল। চায়ের পেটি নয়। সুনীল সিগনাল দেখাতেই ওদের গাড়ি থেকে ড্রাইভার ছেলেটা তিনবার হেড লাইট জ্বালাল আর নেভাল। দু মিনিটের মধ্যেই একটা স্করপিও এসে দাঁড়ালো।
-- তোল পেটিগুলো রেন্ডীকা অওলাদ। সুনীল চাপা গলায় বলতেই ড্রাইভার আর খালাসীটাই স্করপিওতে পেটিগুলো তুলল। গাড়িটা সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর আলি আর সুনীল ড্রাইভার আর খালাসিটার কানে বন্দুক ধরে ওদের গাড়ির পেছনে তুলে দরজা লক করে দিল। সব্বাই উঠে পড়ার পর ওদের গাড়ি যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলল, সামনে সামনে সেই স্করপিও। খানিক চুপচাপ কোন কথা নেই। একটা ফোন। সামনের স্করপিও বাঁদিকে একটা বাঁকে ঢুকে পড়ল। দিলুরাও ঢুকল। তারপর একটা জায়গায় থামল। আলি আর সুনীল লোকদুটোকে নামাল, দুটো গাড়িরই হেডলাইট অফ। লোক দুটোকে এক ধারে নিয়ে গেল সুনীল। সাইলেন্সারের থেকে কয়েকটা চাপা ধুপ ধুপ শব্দ। চিৎকার ছাড়াই ছটফট করতে করতে ড্রাইভার আর খালাসিটা নিমেষের মধ্যেই লাশ হয়ে গেল। কয়েক মুহুর্ত পরেই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ওরা স্করপিওটায় তুলে দিল। তারপর ধরল ফেরার রাস্তা। অন্য গাড়িটা চলে গেল এবার উল্টোদিকে। দিলু বুঝল সে নয়, সুনীলই এখন চালাচ্ছে দলটা।
--বেশ চমৎকার বলছেন আপনি। এ সমস্ত কি আপনার লেখায় থাকছে?
--হ্যাঁ আমি সব কিছুই নিজের মতো করে লেখার চেষ্টা করছি।
--আমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সেই সময়ের কাশ্মীরের কথা আরও একটু বলুন আপনি। কলহন অনুরোধ করেন।
--কাশ্মীর ভারতে ইংরেজরা আসার পরে আরও একবার বদলে যায়। সেই অতিথি যুবক শুরু করে আবার। -- আপনি তো জানেন জম্মুকে কোনদিনই কাশ্মীর ভূখণ্ডে ধরা হত না। যেমন বালুচিস্তান ও লাদাখও ছিল আলাদা। জম্মু তখন শিখদের দখলে। পঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিংহ, গুলাব সিং নামে একজন ডোগরা শিখকে জম্মুর গভর্নর হসেবে নিয়োগ করলেন। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও বুদ্ধিমান গুলাব সিং কিছুদিনের মধ্যেই বালুচিস্তান ও লাদাখ দখল করে জম্মুর অন্তর্গত করলেন। এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের সর্বত্র একাধিপত্ব কায়েম করতে চায়। শিখরাও ছাড়বে না জমি। তারা তাদের অঞ্চলে ইংরেজদের কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। তখন তাদের সঙ্গে শিখদের যুদ্ধ বাধল। ১৮৪৫ এ শুরু হল প্রথম শিখ--ইংরেজ যুদ্ধ। কিন্তু ধুরন্ধর গুলাব সিং শিখদের এই যুদ্ধে অংশই নিলেন না। বরং তিনি ইংরেজদের বুদ্ধি দিয়ে সাহায্যই করলেন। ফলে শিখরা এই যুদ্ধে হেরে গেল। কোম্পানি পাঞ্জাব দখল করল। ১৮৪৬ সালে অমৃতসর চুক্তির বলে গুলাব সিং জম্মু ও কাশ্মীরকে ইংরেজদের কাছ থেকে পঁচাত্তর লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। হলেন জম্মু--কাশ্মীরের রাজা। এই রাজ্য জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, পুঞ্চ, মিরপুর, গিলগিট, বালুচিস্তান, মুজাফফরাবাদ, নাগার ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হল। কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠিত হল ডোগরা বংশের শাসন।
--সেই ডোগরা যারা আওধ আর দিল্লি থেকে আসা রাজপুত যোদ্ধা? যারা এক সময়ে আলেকজান্ডারকে প্রতিহত করতে জম্মু পর্যন্ত চলে গেছিল? তখন থেকেই তো তারা জম্মুতে ছিল বলে জানি।
-- হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আপনি। যুবক বললেন। বৃদ্ধ তাকালেন সেই নতুন মানুষের চোখে। বললেন -- আমার একটা অনুরোধ আছে। আপনি যা লিখছেন আমায় একটু বিস্তারিত ভাবে শোনাবেন। কারণ বুঝতেই পারছেন আমি যেখানে কাজ শেষ করেছিলাম তার পরবর্তী সময়ের পুরোটাই আমার অজা না।
--আচ্ছা, তাহলে আমার লেখা থেকেই আপনাকে সরাসরি পড়ে শোনাই।
তারপর সেই যুবক পরে চললেন তার সুদীর্ঘ পাণ্ডুলিপি আর আগ্রহ বশে শুনতে থাকলেন বৃদ্ধ। কতদিন কত সময় ধরে এই পাঠ চলছে সে আমরা জানি না। পাঠ বিরতির মাঝে মাঝে আলোচনাও চলতে থাকে। যেমন এই সময়ে কথা বলছেন সেই মধ্য ত্রিশের যুবক
--হরি সিং এর আমলে মুসলিমদের মনে অসন্তোষ এমন তীব্র হতে থাকে শুরু হয় কাশ্মীর ছাড় আন্দোলন। সে ছিল তিরিশের দশক। তারপর ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় বটে কিন্তু দুভাগে ভাগ হয়ে। পাকিস্তান মুসলিম দেশ হিসেবে আর ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে জন্ম নেয়। দুটি দেশই গণতাত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কলহনের চোখে আবার একটু রহস্যের হাসি দেখতে পাওয়া যায়, অস্ফুটে বলে ওঠেন -- গণতন্ত্র!
--স্বাধীনতার সময় কাশ্মীর ছিল স্বাধীন। কিন্তু ১৯৪৭ এর অক্টোবরে পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র উপজাতিরা কাশ্মীরে দলে দলে এসে উপস্থিত হয় ও উপত্যকার পশ্চিমের অনেকটা অংশ দখল করে। হরি সিং দেখলেন বিপদ। তখন তিনি ভারতের সাহায্য চাইলেন। জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা প্রবেশ করল। ভারত জম্মু কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব নিল আর সংবিধানের ৩৭০ ধারায় এই বিশেষ অঞ্চলকে কিছু স্বায়ত্ব শাসন দেওয়া হল। শুরু হয় কাশ্মীরের নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাস পরস্পর বিরোধিতার, দ্বিচারিতার, অবহেলার, আগ্রাসনের ও রক্তক্ষয়ের।
--বঙ্গ দেশকেও তো এই দেশ বিভাজনের জ্বালা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বলে লিখেছেন আপনি।
--হচ্ছে। কশ্মীরকে নিয়ে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ যেমন চলেছে, পূর্ববাংলাকে নিয়েও তো চলেছে।
-- কারণ কাশ্মীরের মতো আপনার বঙ্গদেশও তো ভারতবর্ষের আর এক প্রবেশদ্বার। স্বভাবতই তাই ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র। এই দুই অঞ্চল তাই আদতে উদার। সেখানে শত চেষ্টাতেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কখনো মানবতার থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
--একদম সত্যি কথা। কশ্মীরে যে মুসলমান ধর্ম এক সময়ে ছিল সে ছিল নরমপন্থী। হজরতওয়াল মসজিদ সে তো সুফি মসজিদ।
--সারা পৃথিবীতে সব সময়েই বিভাজন চলেছে ঠিক কথা। কিন্তু ওই আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এখনকার পৃথিবী একটাই বাজারে পরিণত হওয়ার পর থেকে এই প্রবণতা আরও সাঙ্ঘাতিক হয়েছে।
--রাজনীতিতে জাতি আর ধর্মের খেলায় এখন সব দলই বেশ ভালো জায়গা করতে পারছে। সারা পৃথিবীতেই। উন্নত দেশগুলোই পথ দেখাচ্ছে। নইলে ব্রেক্সিট আন্দোলন এত সফল হয় না ব্রিটেনে আর ইউ এস এর মতো অভিবাসীর দেশকেও পাঁচিল তুলতে হয় না। ব্রিটেনে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলে গেল ব্রেক্সিটের হাত ধরে। ইউ এস এ তেও একই অস্ত্রে ডনাল্ড ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট। ব্রিটেন মনে করেছিল তারা ইওরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর দায় তাদের ওপর এসে বর্তাচ্ছে। তারা নিজেরা উপকৃত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রেরও মূল গল্পটাও এক। সে দেশে বহুদিনের সংগ্রামের ফলে কালো মানুষগুলোর এখন একটু সামাজিক অবস্থা ভালো। তাই তারা শ্রমিকের কাজ ছেড়ে অন্য বিভিন্ন সম্মানজনক কাজ পাচ্ছে। সেই জন্য গত বেশ কয়েক দশক ধরেই সস্তার শ্রমিক হিসেবে মেক্সিকানরা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ইউ এসে এ তে। কিছুদিন আগেও সান ডিয়েগোর মতো শহর গুলোতে প্রচুর শ্রমিক মেক্সিকোর লাগোয়া শহর তিফানা থেকে প্রতিদিন এসে, কাজ করে দিনের দিন ফিরে যেত। মেক্সিকান মিউজিসিয়ান ইউ এস এর হোটেলে রাতে গান বাজনা করে রোজগার করত।পুরুষেরা কলকারখানা বা রাস্তা মেরামতির শ্রমিক আর মহিলারা ঘরোয়া পরিচারিকার কাজ করে মোটামুটি চালিয়ে নিত তাদের সংসার। সুযোগ পেলে থেকেও যেত। এখন উঠল কাঁটাতার। ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিন্টনের আমলে ডেমোক্র্যাটরা যদিও এর প্রতিরোধে আইন তৈরি করেছিল কিন্তু সেই আইন বলবত করার জন্য কড়াকড়ি তেমন কিছু করেনি। কারণ তারা অনুপ্রবেশ নিয়ে নরম ছিল। কিন্তু রিপাবলিকানরা এই আইনকে কাজে লাগাল। রাস্তার কুকুর বেড়ালের মতো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ধরে ধরে পুরে দিল খাঁচায়।
--কিন্তু এই সব সাধারণ মানুষের জন্য কর্ম সংস্থান কী করা যেত না?
--যেত হয়তো। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে জন সংখ্যা গরীব দেশে বেশি। এর ওপরে প্রযুক্তি এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে যে সমস্ত শ্রমিক নির্ভর কাজই এখন যন্ত্র করে দিচ্ছে। গরিব লোকেরা কাজ হারাচ্ছে। জীবিকাহীনতা তৈরি হচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই এখন কাজ কম। সেই বাজারে মোটামুটি সব রাষ্ট্রই বাইরের লোককে ঘরে ঢুকতে দিয়ে ঘরের মানুষের গোঁসার মুখে পড়তে চাইছে না।
--ঠিক। অভিবাসনের চাপ সীমান্ত পেরিয়ে সর্বত্র উন্নত দেশের অভিমুখেই হয়, সে তো সত্যিই অবাঞ্ছিত দায়।
--অথচ বড়লোক দেশগুলোর গড়ে ওঠার সময়ে সেই অন্য দেশের গরীব মানুষগুলোর অবদান প্রচুর ছিল। এমনকি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ইউ এস এর দক্ষিণের রাজ্যগুলো আসলে ছিল মেক্সিকান বা মেহিকানদেরই ।
--আর গরীব দেশগুলো কি করছে?
--গরীব দেশগুলোও এখন একই ঘরানায় নাম লিখিয়েছে। রোহিঙ্গার থেকে হাতের কাছে কোন বড় উদাহরণ আর নেই। মায়ানমার, এক কালের বার্মা। সেই মায়ানমারের পশ্চিমের রাজ্য রাহিনে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত লাগোয়া। সেখানে বহু শতক ধরে রোহিঙ্গাদের বাস। তারা আরব থেকে বার্মায় এসেছিল। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা পেলে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি এক অদ্ভুত প্রশ্ন চিহ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ মায়ানমারে সংখ্যাগুরু হল বর্মীভাষী বৌদ্ধ। আর সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা হল মুসলমান। তাদের ভাষাও আলাদা। এদেরকে বর্মীরা নিজেদের দেশের বলে মনে করত না। তারা সামজিক ও আইনি অধিকার থেকে কার্যত বঞ্চিত ছিল, সঙ্গে ছিল অত্যাচার। সত্তরের দশক থেকেই বাংলাদেশে তারা ঢুকতে শুরু করেছিল। যাকে বলে অনুপ্রবেশ। বাংলাদেশ মুসলমান দেশ বলে তারা ভেবেছিল সেখানে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। শুধু বাংলাদেশ নয় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাম্বডিয়া, লাওস বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয়ের জন্য ছড়িয়ে পড়ছিল। ছোট্ট ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকো করে পাড়ি দিয়েছিল উত্তাল সমুদ্র। যদি কোথাও ঠাঁই পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ কেন, কোন দেশই তাদের নাগরিক হিসেবে কোনদিনই স্বীকৃতি দেয়নি। উপরন্তু ২০১৪ সালে তাদের নিজেদের দেশ মায়ানমারেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হল। তারা হয়ে গেল পুরোপুরি দেশবিহীন। একটা জাতি সারা পৃথিবীতে রিফিউজি হয়ে গেল রাতারাতি।
সেই ভিনদেশি একটু থামলেন। তাকালেন সেই অজর বৃদ্ধের দিকে। কলহন তখন তাকিয়ে আছেন তার সেই চিরসঙ্গী মহাসরিতের দিকে। সেখানে বিভিন্ন জলচর পাখির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে আনন্দে। জল খেতে এসেছে এক দল নির্ভীক হাঙ্গুল। দূরে নীলচে সাদা পর্বত গুলো সময়হীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন তাদেরও প্রত্যেকেরই নাম কলহন। সময় কাটে আরও কিছুক্ষণ সময়হীনতার মাঝেই। আরও কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। তিনি অতিথিকে খবার এগিয়ে দিলেন স্বহস্তে। নিজেও নিলেন। তারপর চলল আরও কথোপকথন। সেই তাম্রবর্ণ যুবক পাণ্ডুলিপি থেকে পরে যেতে থাকল একের পর এক পাতা। তারপর একসময় থামল। জিজ্ঞাসু চোখে জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধকে
--আমি কি ঠিক করছি মহান?
--একদম ঠিক করছেন।
--কিন্তু আমি তো শুধু এক অনামি অজানা ছোট অঞ্চলের নিজের কথা লিখতে চেয়েছিলাম। তাকে ইতিহাস বললে ইতিহাস, পাগলামি বললে পাগলামি। কিন্তু আমি যে কিছুই বাদ দিতে পারছি না। সারা পৃথিবী যেন আমার লেখায় চলে আসছে।
--আমি আবার বলছি আপনি একদম ঠিক করছেন। আমার সময়েও কাশ্মীরের জীবন ধরতে গিয়ে আমি সমস্ত ভারত ভূখণ্ডেরই ছবি আঁকতে গিয়েছিলাম, পারিনি। তথ্য ও যোগাযোগের অভাবে। আপনার বৈদ্যুতিন সময়ে একটি ছোট্ট অঞ্চলও আরও বেশি করে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে জড়িয়ে। তাই কোন কিছুই অপ্রাসঙ্গিক আপনি লিখছেন না। আপনি সম্পূর্ণ ভাবে ঠিক কাজ করছেন।
শিউলি পড়েছে লাল পাড় সাদা শাড়ি আর লাল ব্লাউস। আজ এই কোজাগরীর রাতকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে থালার মতো চাঁদ উঠবে। ওর ঘরটাতে ও একা। ওর আজ খুব আনন্দ হচ্ছে। আজ আর কাল ও কোন কিচ্ছু করবে না যা ওর নিজের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ও যাবে না।এই যে মনটা ভালো হয়ে আছে এটাকে পুষতে হবে। ওর ঘরটা থেকে বাইরেটা ভালো দেখতে পাওয়া যায় না। ও জানলা খুলে দেখতে চেষ্টা করল এমনিতে কতটা আকাশ দেখা যায়। চাঁদ দেখতে যদি নাই পাওয়া যায় তবে দরকার হলে ছাদে যাবে। কেন পড়ল এমন শাড়ি? ওর নিজেকে কেমন লাগছে দেখার জন্য? কি মনে আসছে ওর? কারো কথা? যেখান থেকে ও চলে এসেছে? সেই পুরনো কথা? না ভাবছে না। কিছুই আলাদা করে মনে হচ্ছে না। তাহলে কি ভাবছে? হাতের কাছে পড়ে থাকা বইটার কথা? হতে পারে। দুদিন ধরে একটা আবেশের মধ্যে রেখেছে তাকে এই বইটা, কিন্তু এটাই কি সব? নাকি অন্য কিছু। কটা বাজে? এখনও দুপুর তেমন করে হয়নি। কটা বাজে দিয়ে সে কি করবে? তার তো আজ সময়েরও কথা ভাবার কথা নয়। তাহলে কি সময় চলে যাচ্ছে এই কথাটা ভাবল এই মাত্র? এই চমৎকার দিনের চলে যাওয়ার কথা সাত সকালেই কেন ভাবতে যাবে ও? ও কি নিয়ম ভেঙ্গে একটা বিয়ার খাবে আজ? আচ্ছা খাবে। সন্ধ্যে বেলা না দুপুরবেলা? দুপুর বেলা খেলে খারাপ হয় না। আজকে ও নিজেকে নিজে সঙ্গ দেবে। সেইটাই কি ওর আনন্দের কারণ? ও আর সরস্বতী ছাড়া এ বাড়িতে কেউ নেই। তাই ভালো লাগছে? নাকি ওর মনে পড়ছে ওই পুজোর প্যান্ডেলের কথা? কি হাস্যকর এই থিমের পুজো। কলকাতায়, কলকাতার বাইরে সর্বত্র, কর্মকর্তারা ভাবে কি না একটা কাজ করলাম, কি দুর্দান্ত বার্তাই না ছড়িয়ে দিলাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বার্তা বহনের স্থূলতা কষ্ট দেয়! কিন্তু আনন্দ কেন হচ্ছে? তাহলে কি আজ খুব আরাম করে স্নান করেছে তাই? নাকি সরস্বতী ওর সারা শরীরে সুন্দর করে মাসাজ করেছে তাই? নাকি দুর্গাপুজা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কালীপূজো এখনো বাকি আছে ভেবে ছোটবেলার মতো মন ভালো হয়ে যাচ্ছে?
বাঃ। নিজের সঙ্গে নিজে বেশ লুকোচুরি খেলতে পারে তো? নিজেই লুকিয়ে নিজেই ভুলে যাওয়া কোথায় লুকিয়েছে, কেন লুকিয়েছে! অ্যালিস মুনরো সাইকোলজি? কি অদ্ভুত। একটা ছোট্ট বুক রিডার কিনতে হবে। আর আরেকটা খাতায় সব কিছু লিখে রাখতে হবে। মন ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন তো এত সময় ওর কাছে থাকবে না, তাই লিখে মন ভালো রাখতে যদি পারে। চিন্তার জাল যদি বোনা যেত সারাদিন ধরে। রবি ঠাকুরের কুমুর মতো। কিন্তু জাল বোনা কেন? কে ধরা পড়ে সে জালে? নিজে? না অন্যেরা? ওফ্। কি আশ্চর্য ন্যাকা মেয়ে সে? এই এত কিছু করেও এত ন্যাকামি! হায় রে ন্যাকামি। মেয়েরা ন্যাকা হয়, ন্যাকা হয়ে যায়, অজান্তেই। কিন্তু ওর নিজের ন্যাকামির কোন কারণ খুঁজে পায় না। কার সঙ্গে করবে? নিজের সঙ্গে? তাহলে সে আদিখ্যেতা। ঠিক আছে। আদিখ্যেতা চলতে পারে। আদিখ্যেতা করার অধিকার ওর আছে। সব সময়ই আছে। এই সময়ে তো আছেই। তাহলে সে এখন একটু আদিখ্যেতা করছে। যা সচরাচর ও করে না। নিজেকে আদর করছে। সেতো ওকে করতে হয় অনেকের সামনে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। মনটা নষ্ট হয়ে গেছে ওর? না মন তো নষ্ট হয়নি। ও আদরের ধরনটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু না এমন নয়। ওকে ও ভালোবাসছে। ভালোবাসছে নিজেকে, এই তো যথেষ্ট। নিজের মূল্য খোঁজার জন্য নিজেকে ভালোবাসতে হয়। তাহলে এইটাই ভালো লাগার কারণ? অনেকটা, হ্যাঁ অনেকটা আর বাকিটা? ওই তাহলে অষ্টমীর রাতে ওর আর সরস্বতীর বেরোনো? সেখানে ওই বিশ্ববোকা প্যান্ডেলটার সামনের মাঠের এক কোণায় একটা লম্বা ছিপছিপে ছেলের এক মনে দাঁড়িয়ে থাকা? কি মনে হচ্ছে তোমার শিউলি? কি মনে হচ্ছে তোমার এখন? মনকে কি বোঝাচ্ছ? কাকে ভুল বোঝাচ্ছ?
পূর্ণিমার চাঁদের আলোর আভায় মাখামাখি যে সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে সে কে? একে তো প্রথম দিন সে দেখেনি। কেন সে এসেছে আবার? কেন সে কথা বলে না? কেন সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। শিউলির মনে কোন বিহ্বলতা খেলা করে এমন ভালো থাকার দিনে। কিন্তু সে যে ভয়ঙ্কর, তার এই দেহ জানে। কিন্তু সেকি সত্যিই ভয়ঙ্কর? তাহলে সে আজও কেন দাঁড়িয়ে আছে একা এই জ্যোৎস্না ঘেরা সময়ে? অনাহূত। কিন্তু সত্যি কি সে অনাহূত? সেইতো আসতে দিয়েছে, সেইতো ডেকেছে, দিন রাত মনে মনে, হাজার ব্যস্ততা হাজার চিন্তার মধ্যে তাকেই তো খুঁজেছে, তাকে চেয়েছে কি এক নির্মল আকাঙ্ক্ষায়। সে যদি মনে মনে তাকে না ডাকে তাহলে এই মানুষটাই বা কেন পাগলের মতো দাঁড়িয়ে আছে এখানে আবার আর সেই বা কেন বেরোল বাইরে? ঠিক এই সময়ে? তাহলে তাকে চাইছে শিউলি আর সক্কাল থেকে সেই তার মনে আনন্দের আসল কারণ? মিথ্যে বোঝাবে না শিউলি, তাকেও না, নিজেকেও না। সে যদি ভয়ঙ্করই হবে তাহলে কেন শিউলি দাঁড়িয়ে আছে এখনো তার সামনে? সে কেন চলে যাচ্ছে না ফিরে? শিউলি নিজে কি চায়? কতক্ষণ ধরে খুঁজতে হবে সে উত্তর? আজকে এই নির্ভার সময় কি সেই উত্তর খোঁজার সময়? নাকি সারাজীবন ধরেই সে যেমন খুঁজে আসছে তেমনই আজও আরও একটা দিন বা রাত?
--এসো ভেতরে এসো। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা, কিন্তু সেই ছায়া মূর্তি নড়ে না, --এসো ভেতরে, কি হল ডাকছি তো তোমায়। তাকে সে বসতে দেয় তার নিজের ঘরে। ছায়ামূর্তি ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন মন্ত্রতাড়িত।
--চুপ করে বোস, আমি চা নিয়ে আসি।
ছায়ামূর্তি নির্বিকার, সেই একই ভাবে তাকিয়ে থাকে সামনে, জিজ্ঞাসাহীন। সে নিজে জানে না কেন সে এসেছে, কতক্ষণ সে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কতক্ষণ সময় কাটল সেও মনে হয় সে বুঝলনা বা বুঝতে চাইল না। তারপর একসময় বড় টি পটে চা নিয়ে শিউলি ঢুকল ঘরে। সে তখনো সেভাবেই বসে আছে। ধীরে ধীরে বড় বড় দুটো কাপে চা ঢালল। মনে হল মুখটা এখন অনেক শান্ত। সেই ভাষাহীন চাহনি যেন বদলেছে খানিক, খানিক শান্ত, কিন্তু অস্বস্তি জড়িত। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল সে -- এই নাও। কি ভাবছ তুমি? জানতো কোন উত্তর আসবে না, উল্টো দিকের মানুষ জবাব দেবার মতো অবস্থায় এখনো নেই। কিন্তু শিউলির এমন কেন হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে এই মানুষ যেন কবেকার চেনা এবং সে চেনায় কোন ভুল হয়নি। ওর হাতটা ছুঁতে ইচ্ছে করছে, সে কি ছোঁবে? তার ছোঁয়ার তো আবার অন্য মানে করে সব্বাই, কিন্তু এর শিউলিকে দরকার।
-- কি হল জবাব দেবে না? কি হয়েছে তোমার বল আমায়। তবুও মানুষটা নিরুত্তর, খানিক ঠোঁট কাঁপে কিন্তু সেখানে কোন শব্দ বেরোয় না। অব্যক্ত কথা শব্দ খোঁজে যেন, পায় না। -- সে বলে, চা খাও। মানুষটা চা খায়, তারপর তার দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে অনেকক্ষণ। -- অনেক চা বাকি, শেষ করো। সামনের লোকটা আবার চা মুখে দেয়। আসতে আসতে চা শেষ করে। -- আমার কাছে এসেছ ভালো হয়েছে, তুমি আমার কাছে ছাড়া কার কাছে আসবে? কে বোঝে তোমায়? এ পৃথিবীতে খুব কম মানুষই একে ওপরকে বোঝে। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। তোমার খুব কষ্ট হয়েছে, সব গুলিয়ে গেছে তোমার। দেখ আমি তোমার সামনে, আমার জন্যই তো তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে, কতক্ষণ আমি জানিনা, কতদিন সেও আমি জানি না। কিন্তু তোমার জন্যও কি আমি অপেক্ষা করছিলাম না?
শিউলি থামে না স্বগতোক্তির মতো বলেই চলে -- নইলে সেই সময় আমি বাইরে বেরবো কেন? বা সেদিনের পর থেকে তোমাকে নিয়ে এত ভাবব কেন? তুমি যদি না বল তাহলে আমিও যে শান্তি পাচ্ছি না। দেখ আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি, তোমাকে এমন করে দেখে আমার ভয় হচ্ছে। জানো, আমিও তোমাকে দূর থেকে দেখেছি, তুমি তো এমন ছিলেনা, কি হয়েছে তোমার? আমাকে না বললে তুমি কাকে বলবে? এই দেখ কি চমৎকার সময়, কোথাও কোন তাড়া নেই, কোথাও পৌছনোর দরকার নেই, এখান থেকেই তো শুরু করা যায়, দেখ। তাকিয়ে দেখ? তোমার কি মনে হচ্ছে আমি এমন করি সকলের সঙ্গে? এই ঘরটা দেখ আমার ঘর, এখানে আমি ছাড়া কেউ থাকেনা, এখানে কেউ ঢুকতে পারেনি কোনদিন কোন অন্য মানুষ। এই বইগুলো দেখ, ওই ফুলের তোড়াটা দেখ, দেখ এরা তোমায় কেউ সত্যি বলছেনা? আমার নাম শিউলি, শুনেছ আমার নাম শিউলি। এই নামটা আমার আমাকে দেওয়া। ভালবেসে দেওয়া। ডাকো একবার আমার নাম ধরে। ভাবছ প্রথম পরিচয়ে এমন করে কথা কেবল আমার মতো মেয়েরাই বলতে পারে? না গো বিশ্বাস কর, কোনদিন এমন ভাবে আমি কথা বলিনি কারো সঙ্গে, আমি তো তোমার নামও জানি না। তোমার কষ্ট হচ্ছে না? খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি দেখো আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে।
খুব অস্ফুটে নড়ে ওঠে দিলুর ঠোঁট-- সে বলে মৃদু প্রায় স্বগতোক্তির সুরে
--আমি এমন হতে চাইনি।
--আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি। আমি বিশ্বাস করি। আমি তোমাকে এমন হতে দেব না। আর দেব না। আমি তোমাকে আগলে রাখব। আমি তোমাকে জড়িয়ে রাখব।
শিউলি নিজের হাতে রেঁধে খাইয়েছে আজ তাকে। একটা গান গুনগুন করে গাইছে শিউলি, সে গানের সুরটা অচেনা, সম্পূর্ণ অচেনা, কেউ কোনদিন শোনেনি, কি গান এটা? খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। লোকটা এখন অনেক স্বাভাবিক। ঘরের আলো নিবিয়ে একটা টেবল ল্যাম্প জ্বালানো। হলদে আলো তে ঘরটা ভরে আছে। বড় সোফাটায় ওরা বসে আছে পাশাপাশি। গরম আছে, ফ্যানটা ফুল স্পিডে চালানো। তার গুনগুন করে গানটা মনে মনে চলতেই থাকছে, সে নিজেও মনে করতে পারছেনা এ গান সে কোথায় শুনেছে। তার ঘরে যে জানলাগুলো আছে সেগুলো সে খুলে দিয়েছে। একটা মৃদু ঠান্ডা হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। ফিস ফার্মের ভেতর থেকে শেয়ালের ডাক আসে, এখানে ওরা এখনো বেঁচে আছে। শেয়াল ডাকলেই গেটের বাইরের কয়েকটা কুকুর নিয়ম করে জবাব দেয়। শিউলি শুনতে পায়। এ ওদের রোজকার কাজ।
সে তো স্নান করতে গেছে। তোমার কেমন লাগছে শিউলি? তুমি এমনই সময় চেয়েছিলে তো? তোমার মন কি বলছে শিউলি? তোমার এইভাবে জড়িয়ে যেতে কে বলেছিল? ঠিক করছ তুমি? তোমার জীবনের সঙ্গে তুমি মানাতে পারবে তাকে কতদিন? নাকি সেও পারবে তোমাকে মেনে নিতে সময় চলে গেলে?
-- কেন ভাবাও কেন ভাবাও? শিউলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, একটু আমার মতো থাকতে দাও। পৃথিবীতে ভবিষ্যৎ ভেবে তো চলল সবাই। আমি নয় নাই চললাম। আমার কোন ভবিষ্যৎ ছিল কি? না আছে? আর যদি থাকেও কে দেখেছে সে ভবিষ্যৎ? আমার অতীতই বা কি ছিল? জানো তুমি? সে কি তুমি ঠিক করেছিলে? তবে কেন তুমি আসো আমার কাছে? আমি তোমায় চাই না এই মুহূর্তে। তোমার মতো করে আমার নিজের কোন মানে খোঁজার দরকার নেই। আমি তোমার কথা শুনব না। কিছুতেই শুনব না।