আলু বেচবে আলে
মাছ বেচবে বিলে
ধান বেচবে আলেকালে।
(আলুকে মাঠেই বেচে আসবে, মাছকে বিলেই বেচে আসবে। আর ধান? তাকে কিছু মাঠে আর কিছু ধীরে সুস্থে বেচবে)
অগ্রহায়ণ চলছে। কার্ত্তিকের শেষ থেকেই কম বেশি সবার ক্ষেতেই ধান পাকতে শুরু করে। চাষির সব থেকে আনন্দের সময় আজ। এই সেই সময় যার জন্য এত পরিশ্রম, এত আশা। কঠোর সংগ্রামের জীবনে একটু প্রাণ খুলে হাসির সময় এখন, ভালো থাকার সময়, ফসল তোলার সময় এখন। কারো কারো ধান কাটা হয়ে গেছে কারো কারো হচ্ছে। কে কেমন সময় রুয়েছে, কি জাতের ধান রুয়েছে তার ওপর ফসল কাটার সময় নির্ভর করে। শুধু তো ফসল তোলা নয়। আলু আর বোড়ো চাষও শুরু হয়ে গেছে। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার চতুর্দিকে। নতুনহাটের এই দিকটায় এখন জোর কদমে কাজ চলেছে। কুমার আর নিমাইয়ের জমিতে এখন ধান কাটার পর শুকোনোর কাজ চলছে। ওদিকে জয়গোপালের পরিবারের তিন ভাইয়ের প্রায় সত্তর বিঘা জমিতে ধানের গোছ কেটে এঁটোনোর কাজ বা আঁটি বাঁধার কাজ চলছে। তারপর এমন কুড়িটা আঁটিকে একসঙ্গে বেঁধে নিয়ে হয় একেকটা বড় তড়পা। চারটে তড়পা মিলে হয় এক পন, তারপর ষোল পনে হয় এক কাহন। এই পুরো বাঁধাবাঁধির কাজটাকে পাঁজা দেওয়া বলে এ অঞ্চলে। এক কিষান একদিনে নিয়ম মতো আট পন পাঁজা দেবে। ব্রিটিশ আমলে ষোল পনে এক কাহনের হিসেব চলত, এখন আর চলে না। আগে বাড়িতে বাড়িতে ছিল ধানের গোলা। আশির দশক পর্যন্তও এই ধানগাছ বাড়ি নিয়ে গিয়ে ধান ঝাড়ানোর কাজ চলত। বাঁশের মাচার ওপর আঁটিগুলোকে আছাড় মেরে মেরে। তারপর চলে এল ধান ঝাড়ানোর মেশিন। সেই মেশিনে পাকা ধানের গোছা ধরলে ধানগুলো ঝুর ঝুর করে পড়ে যেত নিচে। এখন হারভেস্টার মেশিন সরাসরি আসে মাঠে, জাপানি কোম্পানি কুবোতার তৈরি। সেই মেশিনে ধানের আঁটি ঢোকানো হয় আর ধান জমা হয় বিরাট বড় একটা চেম্বারে আর বিচুলি বা খড় বলে তেমন কিছু থাকে না। খড় সরাসরি আট দশ ইঞ্চির ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে যায়। সেগুলো গরুকে খাওয়ানো যায় কিন্তু এখনো এর কোন অন্য বাজার নেই।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও বাড়ির বউয়েরা ধান রাত জেগে সেদ্ধ করত। তারপর সকাল থেকেই রোদে বিছিয়ে দিত শুকোতে। এখনো একদম ছোটো চাষি তাই করে। কিন্তু বেশিরভাগই নিজেরা আর এ সব কাজ করে না। তাই কিছু মানুষ এটাকেই আবার রুজি রোজগারের উপায় করেছে। তারাই এই ভাপিয়ে, সেদ্ধ করে, শুকিয়ে দেওয়ার কাজটা নিজেদের ছোটো পরিসরে করে দেয়। বস্তা পিছু কিছু টাকা নেয়। সেদ্ধ করে শুকিয়ে নেওয়ার পরে হাস্কিং মিলে দেওয়ার পালা, মানে যেখানে ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাল বার করা হয়। ষাট কেজি ধান থেকে আটত্রিশ কেজি চাল পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় তিন টিন কুড়ো। টিন প্রতি যার মূল্য এই বাজারে পঞ্চাশ টাকা। এই কুড়ো বহুদিন ধরেই এদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যায় তেল কলের মালিকরা, তৈরি হয় রাইস অয়েল। কিন্তু এখন রাইস--মিলের রমরমা, আগের রাইস--মিলের থেকে এখনকার রাইস--মিলের ধরনও সম্পূর্ণ আলাদা। রাইস--মিলের নিজস্ব এজেন্ট থাকে তারা চাষীদের কাছ থেকে জমি থেকেই সরাসরি ধান কিনে নেয়। এক এক জন এজেন্ট তিরিশ, চল্লিশ, একশ বা তিনশ গাড়ি ধানও রাইস--মিলগুলোতে জমা দেয়। রাইস--মিলগুলো নিজেরাই এজেন্সি খোলে। তারা চাষিকে একটা বাজার দর অনুযায়ী মূল্য দেয়, সেই মূল্য নির্ধারণে ওদের ক্ষমতাই বেশী, খুব স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু ইদানিং সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস ধার্য করেছে, যার ফলে চাষিদের খানিকটা হলেও সুবিধে হয়েছে। জাপানি প্রযুক্তিতে চলা রাইস মিলগুলোতে এখন সব কিছুই যন্ত্রেই হয়ে যায়, সেদ্ধ, শুকনো, হাস্কিং সব হয়। মুনিষের আর তেমন কোন প্রয়োজন হয় না।
কলকাতার সংলগ্ন জেলাগুলোতে নবান্নের রেওয়াজ কমে এলেও দূরের জেলাগুলোতে এখনো এর প্রভাব আছে। নবান্নের উৎসবে ভাঁটা পড়ার একটা বড় কারণ অবশ্যই সংস্কৃতির পরিবর্তন। কিন্তু সময়ের অভাবও আছে। আগে আমন এর পর কোন চাষ হত না, হাতে সময় থাকত অনেক। আমনচাষের ওপর নির্ভরতা ছিল অনেক বেশি তাই সেই ধানের ওপর মায়া ছিল অনেক বেশি। সে যেন আদর করে জড়িয়ে রেখেছিল আগের কৃষককে। এখন চাষি আর মাঠ কেউই ফুরসত পায় না। কেউ জীবন উপভোগ করতে পারে না নিজের মতো। যেমন ওই ভুবন, নিমাই, জয়গোপাল, নীরজ, খালেক কেউই পাচ্ছে না ফুরসত। এর পরে সব্বাই বোড়ো বা আলুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মাটির রস দেখে নিয়ে আলু চাষ দিতে হয়, রস না শুকোলে ফলন ভালো হয় না। মাটির তলার যে কোনো ফসলেরই একই নিয়ম। ভেতরে ফাঁপা না হলে ফলন ভালো হবে না। নীরজের জমিতে রোটার ট্রাক্টর চলছে। ওর হলে খালেকের জমিতে চাষ হবে।
ওদিকে ভুবনের এসব হয়ে গেছে আগেই। প্রথমবার জমি চষে দেবার পর পরিমাণ মতো ফসফরাস, পটাশ আর ইউরিয়া মিশিয়ে জমি তৈরি করে, আরও এক বার ট্রাক্টর চালিয়ে, আলুর চোখ থেকে বীজ লাগিয়ে, তারপর বীজ থেকে চারা বেরিয়ে, তাতে জলের ছিটনি দিয়ে এখন তার জমিতে চার--পাঁচ ইঞ্চির গাছ। ধান ফলে থাকলে তার রূপ একরকম। আলুচাষে রূপ আরেক। একই জমি একমাসের তফাতে একদম কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। আলু চাষে মাঠের তেমন রুপ খোলে না বরং গোপন রহস্যের মতো মাটির তলায় সব কাজ কারবার চলতে থাকে। গোপনীয়তাই তার রূপ। ভুবন মাঝে মাঝে চুপ করে বসে দু চোখ ভরে সে রূপ দেখতে থাকেন। অল্প বয়েসি চাষিগুলো এগুলো তেমন বোঝে না। কোনকালেই কেউ তেমন বোঝেনি। সবাই তো যন্ত্রের মতই কাজ করে। রূপ দেখার চোখ কই? দূরে নিমাইয়ের জমিতে তিনটে মুনিষ কাজ করছে। তাদের উনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন -- ফালটা ভালো করে ধর। একদম হালকা দিবি না। আর তুই। ওই ছেলে। তুই ভালো করে ভেতরে গোঁজ বীজগুলো, বাইরে যেন না আসে। ভালো করে চাপা দে মাটি।
পাটাতনের ওপরে তিনটে ফলা। একটা কিষাণ টানতে টানতে যাচ্ছে মাঝে লাগানো একটা লাঠি ধরে। তিনটে রেখার মতো গর্ত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আর এক চাষি আলুর বীজ গুলো পুঁতে দিচ্ছে আর পেছনে আরেক জন কিষাণ দুপাশের গর্ত থেকে ওঠা মাটি ভালো করে চাপা দিয়ে দেয় বীজগুলোর ওপর। ওরা কোন কথার উত্তর করে না। একমনে কাজ করে। মাটি চাপা দেওয়াটা বীজের খুব বড়ো ব্যাপার। ওপরের দিকে উঠে এলেই আলু সবুজ হবে, সালোক সংশ্লেষ শুরু হবে, ফলন কম হবে। যতই মাটির নিচে হোক আলু যে পরিবর্তিত কাণ্ড বোঝা যায় তার চামড়া সবুজ হওয়া দেখে। এর মাঝেই নিমাই এসে বসে বিচিত্র মুখ করে। ভুবন জিজ্ঞেস করে
--কাজের মাঝে কোথায় যাস?
--পেটের গণ্ডগোল।
--শীত কালে পেটের গণ্ডগোল। খালি পেটে পেঁপের আঠা আর বাতাসা খা। ওতে কাজ না হলে ভেরেণ্ডার আঠা খাস।
--আমার মায়ে একটা টোটকা দিত -- আপান গাছের শেকড়ের এক ইঞ্চি টুকরোকে বেটে তার সঙ্গে সাতটা আলোচালের দানা, একদম সব ঠিক হয়ে যেত গো।
--হ্যাঁ আমিও শুনেছি। তবে বাড়াবাড়ি হলে তো মুস্কিল।
--ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাব তাহলে, মোচড় দিচ্ছে গো মাঝে মাঝে ।
--এক্কেবারে ডিসেণ্টরি। মোচড়ের কথা ভুলে যা। হ্যাঁরে নীরজের তো এখনো ধান মাঠ থেকে উঠলই না ভালো করে এর মধ্যে চাষ দিচ্ছে কিরে!
--আর কি হবে? তা, আলুর বাজার প্রথমে ধরবে গো বোঝো না? দাম ভালো পেতে হবে না?
--কিন্তু ফলন যদি ভালো না হয়?
--ও ভেবে কি লাভ? পড়াশোনা শিখেছে, তোমার থেকে কম বুঝবে না গো।
--না রে গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে চাষ, সে নিয়ে ভাবতে হবে না?
--চাষ-- আবাদ তো লটারি গো, এত ভেবে কি হবে? তাছাড়া ভালো হিম পড়লে আর বীজ ভালো হলে ও সব টেনে দেবে খনে।
আলুর ফলন পুরো শীতের ওপর নির্ভর। গুমোট গরম আর কুয়াশায় চাষ খারাপ হয় কারণ তখন ছত্রাকের সংক্রমণ বাড়ে। ফাঙ্গিসাইড দিয়েও সে রোধ করা যায় না। হিম পড়লে ছত্রাক তেমন সুবিধে করতে পারে না। নিমাই নিজের জমির ভিতর কোদাল চালিয়ে দেখে কি অবস্থা, গন্ধ শোঁকে আর মাথা নাড়ে। সামনে অনেক কাজ ওর। জমির ধান উঠেছে বটে কিন্তু আলুর জন্য জমি শুকলেই চাষ দেবে সে। এক সপ্তাহ বড়জোর। সারের দাম এবারেও চড়া। বিঘে প্রতি আলুর বীজ সেও দু বস্তা লাগে, মানে পঞ্চাশ কেজি করে একশ কেজি।
--যাক্। ভালো করেছিস একটু সময় নিয়ে চাষ দিয়ে। তোর মাটি ভালোই শুকিয়েছে। তুই খাদানের জমিটায় কি করবি?
--খাদানের দিকেরটায় বোড়ো করব। ওতে আমার চলে যাবে। চারজন মানুষ কত লাগে?
--এবারে তো বর্ষা ভালোই ছিল শীতটা ভালো হতে পারে।
--আলুর বীজ কত যাচ্ছে।
--চার ধরে রাখ।
--তোমার চাষ তো ভালোই হয়েছে মাস্টার। কানি দেওয়াও হয়ে গেছে। তা কটা ছেঁচ দেবে গো? [আলুর চারা একটু বড় হলে গাছের সারির মাঝে মাঝে ছোটো কোদাল দিয়ে লম্বা নালা করা হয়। তাকে বলে কানি দেওয়া। কানি দেওয়ার পর যে মাটি উঠল সেটা আগের মতোই এবার গাছের গোড়ায় ভালো করে চেপে দেওয়া হয় যাতে মূল বাইরে বেরিয়ে না আসে। কাণ্ড যত বেশি ঢাকা দেওয়া যাবে তত বেশি ভালো হবে ফলন, গাছ নিচে বাড়বে বেশি। তাকে বলে তলা দেওয়া। তলা দেওয়ার সময়ও জল লাগে। কানি দেওয়ার বা তলা দেওয়ার সময় গাছের বার দেখে আরেকবার সার দেওয়ার দরকার হয়। তারপর সেখানে নালা বরাবর জল দিতে হয়। এখানে বলে ছেঁচ। আসল কথা সেচ]
--ওই আটটা। আমি আটটার কমে দেবই না। কোন দিন দেখেছিস আটটার কম দিতে? সত্তর সালে যখন আমি প্রথম চাষ করি তখন জলের অভাব। তখনও কম সেচে কাজ করেছি কোনদিন? তখন আমি একা আলুর চাষ দিতাম। তোরা খেতিস রেঙ্গুন থেকে জাহাজে আসা আলু।
--আমি তখন কিছু বুঝতাম না মাস্টার। তুমিই তো বোঝালে সবারে।
--কী জানিস? মূর্খ চাষি হল ভেড়ার পালের ভেড়া। সামনেরটা যেদিকে যায় পেছনেরগুলো সব তার পিছু পিছু যায়। সব এক চাষ করে। এক সময়ে রোয়। একসময় কাটে। নতুন কিছু করে না। আজ এই যুগেও করে না। মাটি বদলে যাচ্ছে কিন্তু চাষ বদলাবে না এরা!
--যা বলেছ। তা এবারে বীজটা নিয়ে চিন্তায় আছি।
--আমি আমার গত বছরের রাখা ক্যাট আলুই লাগিয়েছি। দুবার তো একই বীজে চাষ করা যায় দেখি কি হয়।
--ভালো করেছ, আমি পাঞ্জাব -- এস আলুই লাগাই এবার।
--লাগা, দেখ তোর আলুই তোর কাছে ফিরে এলো কি না।
আলুর বীজ নিয়ে বহু বছর ধরে যে অদ্ভুত মিথ্যাচার হয় তা হাস্যকর। আলু বীজ মাটি বদল করলে ফলন ভালো হয়। আলুর মাদার বীজ বানালে তার দাম বস্তা প্রতি কুড়ি হাজার টাকার কমে দেওয়া যায় না। আলুর ফুল হয় সাদা, তার থেকে কাঁচের গুলির মতো আকারের ফল হয়। সেই ফলের ভেতর যে বীজ থাকে সে ছড়িয়ে যে আলু হয় তার চোখকে মাদার বীজ বলে। কিন্তু বাজারে পাঞ্জাব এস বীজ বলে যে বীজ বিক্রি হয় সে বড়ো জোর চার হাজার দাম। মাঠে সব বাছা আলু নেওয়ার পরে যে কাটা আলু পড়ে থাকে তাকে এখানে ক্যাট আলু বলে। পাঞ্জাবের ক্যাট আলু ভালো করে প্যাকেট করে এক বছর কোল্ড ষ্টোরে থেকে যখন স্ট্যাম্প মেরে বেরোয় সে হয়ে যায় পাঞ্জাব এস আলুর বীজ। বাংলার একদল ফড়ের দল সেই আলুই কিনে নিয়ে আসে সস্তায় আর চাষি নাচতে নাচতে মাদার বীজ ভেবে কিনে নিয়ে যায়। আরও বড়ো অনাচার হয় অবশ্য যখন বাংলার ক্যাট আলুই বিহার বা রাঁচির কোল্ড স্টোরেজে এক বছর ঘুমিয়ে এসে, এস স্ট্যাম্প নিয়ে বাংলার বাজারেই আবার ফিরে এসে বাংলাতেই বিক্রি হয়। বছরের পর বছর ধরে এই ফেরব্বাজির খবর আলু ব্যাবসায়ি সমিতি বা সরকার সবার কাছে থাকলেও কেউ কিছুই বলে না। কোন সরকারই না। একই ব্যাপার হয় পাঞ্জাবেও, মাটি বদলের জন্য ওরা হিমাচলের পাহাড়ি আলুগুলোর ক্যাট আলু নিয়ে নিজেদের জমিতে লাগায়। আসল মাদার বীজের নাম করে সাধারণ বীজ পাহাড় থেকে পাঞ্জাবে, পাঞ্জাব থেকে বাংলায় আসে।
--কিন্তু একটা কথা বলি নিমাই। হুঠ করে ওষুধ দিবিনে বুঝলি?
--কেন?
--আরে ওষুধের কোম্পানিগুলো দোকানিকে কত কমিশন দেয় জানিস প্রায় দুগুণেরও বেশি। তাছাড়া নাম বদলে বদলে ওই একই ওষুধ চালায় কোম্পানিগুলো। ও দিলেও যা হবে না দিলেও তা হবে। আমি একটু তামাকের জল দেব ভাবছি।
--পয়সায় কুলোতে পারবো না গো, আর কাজও হবে না তেমন।
--আরে খানিকটা তো দেখ, যদি হয়। নিজে আর ছেলেমেয়েগুলোর জন্য। বিষ খেয়ে খেয়ে কিছু তো রাখলি না শরীরটার।
--তা দেখি। কিন্তু কোন কিছুতেই আর কাজ হবে না গো। সে দিন কি আর আছে!
--তা ঠিক বলেছিস এখন অর্গানিক চাষে আর পৃথিবী ফিরতে পারবে কি না আমারই সন্দেহ আছে। আমরা কেমিক্যাল দিয়ে দিয়ে এমন জায়গায় গেছি যে আর ফেরার পথটাই হয়তো রাখিনি। তা কুমার দুদিন আসে না যে? কি ব্যাপার?
--সে মামলা ঠুকেছে চাষিদের হয়ে।
--মামলা করছে মির্জাপুরের জন্য? ভালো করেছে। খুব ভালো করেছে। ও করবে নাতো কে করবে। ভুবন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
--টিকতে পারবে? জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়া যায়। ওর কি ক্ষমতা আছে? টাকা--পয়সা আছে না লোকবল? কতগুলো গন্ধ ওঠা মুসলমানের জন্য আপদ ঘরে ডেকে আনা, বিয়ে সাদি নেই, পয়সার চিন্তা নেই, পড়াশোনা নেই, ওর দিদি কেঁদে কেঁদে মরে গেল গো।
--তুই থাম। বাজে কথা রাখ। আরে ওর জন্য তো আমার গর্ব হচ্ছে রে নিমাই, আমার আশীর্বাদে যদি কোন কাজ হয় তাহলে আমি উজাড় করে ওকেই দিলাম রে নিমাই।
একটা ছোট্ট ছেলে চা বিক্রি করতে করতে সামনে উদয় হল, সেও যেন এই ভেসে থাকায় ওদের সঙ্গেই ভিড়ে গেছে। ছেলেটা রোগা পাতলা, কালো, লম্বাটে মুখের। বছর দশেক মেরে কেটে। এই ছেলেটা ডিপ চা বেচছে না। বানিয়ে দিচ্ছে। দিলু ওকে দুটো চা দিতে বলল। ছেলেটা মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসলো। এক বালতিতে তার চায়ের সরঞ্জাম। বালতির ধার ঘেঁষে সে গোল করে সাজিয়ে রেখেছে কাগজের কাপের সারি, যেমন পোড় খাওয়া চাওয়ালারা রাখে। ছোট বড় সব কাপ আছে তার কাছে। দুটো বেশ বড় কাপ বার করে রাখল আলাদা করে। ছোটো কাপ গুলোর মধ্যে একটাতে খুচরো পয়সা রেখেছে। মাঝখানে চায়ের কৌটো, চিনির কৌটো, যদি কারো বেশি লাগে। পাশের আরেকটা আংটা থেকে স্টোভের ওপরে গরম চিনি সমেত দুধ। যত্ন করে চা বানিয়ে দিচ্ছে সে। চুলগুলো তেল দেওয়া আর টানটান করে আঁচড়ানো। সামনের চুলগুলো লম্বা আর পেছনের দিকে বাঁকানো। ক্রিকেটারদের মতো মাথার পেছনের চুল ঘাসের মতো ছাঁটা। কালো সরু আঙুল গুলো চায়ের কৌটোর ঢাকনা খোলে, চামচ দিয়ে চা দেয়, আবার কৌটোর ঢাকনা লাগায়। অদ্ভুত কায়দা নিয়ে চা ছাঁকে আর বড়দের মতো মুখের ভঙ্গি করে তাকায় আশপাশ। কাস্টমার খোঁজে। সরু পায়ের কাছে অনেকটা গোটানো তার জিন্স। কোমরে বড়ই হবে, বেল্ট দিয়ে কোনরকমে পড়ে আছে। বেল্টের ল্যাজটা অনেকটা লম্বা। বক্লেস থেকে বেরিয়ে ঝুলছে পাশ থেকে। বোঝাই যায় প্যান্ট বা বেল্ট কোনটাই ওর মাপের নয় বা ওর জন্য কেনাও হয়নি। শিউলি ওর দিকে তাকিয়ে কি আনন্দ পাচ্ছে। ওর বড়দের মতো হাবভাব দেখেই আরও মজা পাচ্ছে। কৌতুক তার চোখে। শিউলি জিজ্ঞেস করে
--বাড়ি কোথায় তোর?
--উই জেলেপাড়ায়।
--কোন ক্লাসে পড়িস?
--ফাইভ।
--স্কুলে যাস? ছেলেটা এত কথার জবাব দিতে পছন্দ করে না। চুপ করে থাকে। শিউলি মজা করে ধমকে জিজ্ঞেস করে -- কিরে স্কুলে যাস?
--না।
--বাড়িতে কে আছে? ওর চা বানানো হয়ে গেছে সে একে একে দু কাপ ওদের হাতে দিয়ে দেয়।
--পয়সা দাও আমি যাব।
--যাবি। আগে বল কে কে আছে।
--মা আর দুই বোন।
ছেলেটা চলে গেল বা হাতের কব্জির পেছনে প্লাস্টিকের বালতিটা ঝুলিয়ে। ডান হাতে স্টোভ। পেছন থেকে মনে হল যেন ছেলেটা চে না। কোথায় দেখেছে ছেলেটাকে? মাথাটা একমুহুর্ত নিচে নামিয়ে ছিল দিলু চায়ের কাপটার দিকে, তারপর সামনে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল ছেলেটা? ক্লাস ফাইভে সে রচনা লিখেছিল সমুদ্রে ঘুরে আসার কথা। নিজের মন থেকে লিখেছিল যা পারে। লেখা পড়ে পরের দিন মৃন্ময় স্যার মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এটাই নাকি সারা ক্লাসে একমাত্র আসল লেখা। গর্বে বুক ফুলে গেছিল। কোথায় গেল সেই কল্পনা? ওই ছেলেটাও তো হারিয়েই গেছিল। না। এখন ও কিছু ভাববে না। চা ভালো বানিয়েছে। পাতার জাতটা ভালো। চায়ের কষ রয়েছে পাতায়, গন্ধও। শিউলি ওর দিকে তাকায়। কি অপরূপ সে মুখ। সাজগোজ দরকার হয় না এই মেয়ের। এমনিই সে সুন্দর। তার দিকে তো এমনিই চাইতে পারছে না দিলু। কি করে চাইবে সে। এমন মেয়ে সে দেখেছে কোনদিন? শুধু মনে হয়, এ কে? এমন সুন্দর মানুষ হতে পারে? সেকি স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে! মানুষের জীবনের বয়ে চলার কথা সে জানে, সে নিজেও তো পড়েছে সে কথা গল্পে উপন্যাসে। সে কতদিন আগে। মনে হচ্ছে সে যেন শুধু ভেসে আছে। ভেসে আছে এই সমুদ্রের মাঝে কোথাও। আচ্ছা শিউলি কি ভাবছে? ওর ভাবনা দিলু ধরতে পারে না কেন? যদি কোন বিশেষ তরঙ্গে ও বুঝতে পারতো ওর মনে কি চলছে তাহলে ও কি করত? কেন এই মেয়ে তার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে নিজেকে একটু একটু করে? এই মেয়ে একদম অন্যরকম। ও যেন দিলুর ভেতরটা দেখতে পায়। যার উল্টোটা দিলু পারে না। কত পড়াশোনা করে মেয়েটা, কত কিছু জানে। কি লাভ ওর এই পড়াশোনা করে এত জেনেশুনে? বা ওর কি লাভ হচ্ছে দিলুর সঙ্গে থেকে?
শিউলির আঙুলগুলো গরম চায়ের কাপ ধরতে পারে না। যতবার চা খায় দিলুর কাছ থেকে রুমাল চায়। দিলু তাই আগে থেকেই সেই রুমাল বার করে দিয়েছিল। দিলুর দিকে তাকিয়ে সে একঝলক হেসেছিল। কি সুন্দর সেই হাসি। সে সামনের চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে নিচ্ছে মাঝে মাঝে আর তাকিয়ে থাকছে দূরে। শিউলির বাঁ হাতটা পাশে রাখা সে আঙ্গুলে একটা সাদা আংটি। রুপো নয় আরও দামি কিছু। হতে পারে সাদা সোনা বা খুব দামি প্লাটিনাম। দুই হাতে ওই একটাই গয় না। কানে দুল নেই ।নাকে তো আজকালকার মেয়েরা কেউ নাকছাবি পড়ে না। মা পড়ত। গলায় একটা চেন আছে সেও ওই সাদা রঙের, কিন্তু রুপোর নয়। ওর শ্যামলা গায়ে সে আভরণ মানিয়েছে চমৎকার। অপরূপ আভা যেন ঠিকরে পড়ছে ওর সারা শরীর থেকে। সেই আভায় যেন উজ্জ্বল হয়ে আছে আশপাশ।
ক্লান্ত ছিল ওরা দুজনেই। সারারাত বাসে ট্রেনে চেপে এসেছে। দুপুরে ঘুমের পরে যখন উঠল তখন প্রায় সন্ধ্যে। শিউলিই আগে উঠল। দেখল অন্য পাশে একদম ধার বরাবর জড়সড় হয়ে ঘুমোচ্ছে দিলু। গর্ভের শিশুর মত দুহাত মুখের কাছে, হাঁটু দুটো পেটের কাছে নিয়ে বেঁকে, অতি নিশ্চিন্তে। ওর নিজের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, একটু হাঁটলেই ঠিক হবে। কিন্তু মনে হল ওই শিশুকে জড়িয়ে আদর করে। কিন্তু ঘুমোক। সারারাত ছেলেটা দুচোখের পাতা এক করেনি। পাশে শিউলি বসে ছিল বলে অবাঞ্ছিত ছোঁয়া পর্যন্ত বাঁচিয়ে চলেছিল। সেই প্রথম রাতের পর থেকে এমনই কুঁকড়ে থাকে। শিউলির চোখে তাকাতে পারে না। ছুঁতে পারে না। শুধু মনে হয় ক্ষমা চায় মনে মনে। ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরে শুল দিলু। শিউলি নিজে সেই লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকেই ছুটি কাটাচ্ছে আয়েশ করে। প্রত্যেক মুহূর্ত সে নিজের মতো উপভোগ করছে। সে একা একা আগেও ঘুরে বেরিয়েছে অনেক জায়গায়। একা ঘুরতেই তার ভালো লাগে। কিন্তু এই মানুষটা তার সঙ্গে আছে কিন্তু তার মনে হচ্ছে না সে কারোর সঙ্গে এসেছে বলে।
এই জায়গাটা অদ্ভুত। সমুদ্র আছে। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল আছে। পাখি আছে। কাঁকড়া আছে। পিঁপড়ে আছে আর নির্জনতা আছে। কখনো কখনো মানুষ সব থেকে বেশি যা চায় তা হল নির্জনতা। মানুষ তো একাই। তাও সে আরও নির্জনতা খোঁজে, চলে যায় দূর দূরান্তে। মানুষ আসলে আড়াল খোঁজে, কখনো কখনো এমন আড়াল যা তাকে নিশ্চিন্ত করে। তার মনে আবেশ আনে, সে নিজেকে খুঁজতে চায় নিজের ভেতর। প্রত্যেক দিন তো মানুষ একটু একটু করে হারিয়ে যায়। মানুষকে হারিয়ে দেয় এই মানুষই, তার নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে বাধ্য করে সমাজ নামের বিষম ভয়ঙ্কর এক প্রতিষ্ঠান। তাই মানুষ হাঁফিয়ে ওঠে। মানুষের মন ভারী হয়। ভালো না বেসে কাজ করলে তো মন ভারী হবেই, তারও তো হয়। ও নিজেই তো তাই আড়াল খুঁজতে বেরোয়।
জানলার পাশ দিয়ে সারি সারি ঝাউ গাছ যেন জঙ্গল তৈরি করেছে। এখান থেকে সমুদ্রের শব্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু এখান থেকে সমুদ্রের গন্ধ আসে। ঝাউ গাছগুলোয় হাওয়া চলছে হালকা শন শন শব্দে। ও পর্দা সরিয়ে দিল আর কাঁচের জানলাটা দিল সম্পূর্ণ খুলে। এক ঝটকায় অনেকটা হাওয়া ঘরে ঢুকে গেল। মনে হল ওদের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাইল। শিউলি আসতে আসতে বিছানার ওপর এসে দিলুর মাথায় হাত রাখল। দিলু চোখ মেলল ধীরে, ক্ষণকাল পরেই কি চমৎকার হাসল, কি সরল সে হাসি। পুরোপুরি ঘুমের ঘোরে। কিছুক্ষণ পরেই ওর বোধ ফিরে এলো, হাসিটা বদলে গেলো, সেখানে এলো সম্মান, দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা, যাকে নিজেকে লুকনো বলে। শিউলি তখন ওর বুকে রাখল হাত। তার হাত বুঝল মানুষটার বুকের মৃদু স্পন্দন। মানুষ যখন লুকনোর চেষ্টা করে তখন সে স্পন্দন তো বদলে যায়। এখানেও তাই। আর উল্টো দিকে দিলু দেখছে শিউলির মুখটা ওর মুখের সামনে নামানো। চুলগুলো সামনে ঝুলে পড়েছে। সাদা চেইনটাও ঝুলছে। কালো চোখে তখন সন্ধ্যের ছায়া। দিলু অবাক হয়ে দেখতে থাকল সেই দৃশ্য। অনেকক্ষণ ধরে নিল ঘ্রাণ, সেই ঘ্রাণে পদ্মেফুলের গন্ধ সে আবার পেল। শিউলি তখন ওর দুটো হাত ধরল নিজের হাতে আর বলল -
--কি ভাবো?
ওরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল বিচে, এই বিচটা নির্জন। সকালেও দেখেছে বেশ নির্জন। বিচের ধারে সেই বাঁধানো জায়গাটায় আবার বসল। দু একটা দোকানে নিজস্ব ব্যাটারির আলো রয়েছে। লোকজন এখানে বেশি আসে না। সাত আট জনের একটা দল দূরের একটা দোকানে বসে গল্প করছে। ওদের সঙ্গে উকুলেলে। মিষ্টি সুর হয় এই উকুলেলের। বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ। ছোট্ট অথচ বেশ সম্পূর্ন। দলটায় মাঝে মাঝে কেউ একা আবার কখনো সবাই একসঙ্গে গাইছে। খুব সুরে গাইছে। এরা হয়তো খুব সিরিয়াসলি গানের চর্চা করে। চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্না সঙ্গে নিয়ে। সেই আলোয় ঢেউগুলো যেন রুপোর চাদর গায়ে মেখে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। আকাশে চাঁদের দাপটে আজ কোনকিছুই তেমন আড়াল নেই, মাঝখান থেকে তারাগুলোই অদৃশ্য। পরিষ্কার আকাশ তাই মেঘগুলো এই রাতেও লাগছে সাদা। কয়েকটা পাখি যখন ওই মেঘের বুক ঘেঁষে চলে গেল উড়তে উড়তে তখন ওদের পরিষ্কার দেখতে পাওয়া গেল।
--ওগুলো কি পাখি জানো?
--গাংচিল।
--বাঃ তুমি তো বেশ পাখি চেনো। দিলু হাসে কিন্তু মুখে কিছু বলে না। -- কত পাখি আছে রাত্তির বেলায় পাড়ি দেয় দূর থেকে দূরে। সাধারণত ছোটো পাখি তারা। দিনের বেলায় সেগুলো লুকিয়ে থাকে অন্য বড় পাখিদের ভয়ে। সবারই মনে ভয় থাকে তাই না? দিলু আবার হাসে, তাকায় শিউলির দিকে আর মুখ ফিরিয়ে নেয়। শিউলি আবার বলে -- বছরের পর বছর কত পাখি হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে আসে আর চলে যায়, কেউ উত্তর থেকে দক্ষিণে আর কেউ কেউ দক্ষিণ থেকে উত্তরে। কিন্তু এদের পথ ভুল হয় না। এদের কে পথ চেনায়? এদের কম্পাস নেই, ম্যাপ নেই, পড়াশোনা নেই, তবু এদের তো ভুল হয় না। ঠিক তোমার মতো। তুমি কেমন ঠিক আমার কাছে চলে এসেছ পথ চিনে চিনে।
দূরে দল বেঁধে লোকগুলো একের পর এক গান গেয়ে চলেছে, হঠাৎ হঠাৎ করে হাওয়ার গতিপথ ওদিক থেকে এদিকে এলে তখন আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, যেমন ঠিক এই মুহূর্তে। -- এই লোকগুলো বেশ অদ্ভুত তো!
-- আমার যা মনে হয় তোমার তাই মনে হয় দিলু? দিলু তাকায়। শিউলি বলে-- আমার সমুদ্রে এলে মনে হয় এখানেই আমার জন্ম হয়েছিল। কেন মনে হয়?
এ কথা শুনে দিলু ভাবে -- কি অদ্ভুত ব্যাপার! সকালে তো দিলু নিজেও তাই ভাবছিল। দিলুর মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে।
-- দিলু তোমার মনে হয় কেমন করে আমরা এই বালি পাথরের মতো প্রাণহীন পদার্থ থেকে আসতে আস্তে জীব হয়ে গেলাম? দিলু ভাবার চেষ্টা করে। সৃষ্টির শুরু তো সে জানে না। তবে শেষ জানে, এই দেহের মাটিতে বা আকাশে মিলিয়ে যাওয়া। যেমন ওর মায়ের শরীরটা মিশে গেছিল হাওয়ায়। সে যদি জৈব থেকে অজৈবে মিশে যাওয়া হয় তাহলে উল্টোটা হতেই পারে। কিন্তু কেমন করে সে কথা দিলু জানে না। দিলু ভাবে। দিলু যে ভাবছে কিন্তু পারছে না তা শিউলি বুঝতে পারে। তাই শিউলি বলে --বিজ্ঞানীরাও জানেন না। ঠিক কি ভাবে। জীবন নাকি এই সমুদ্রেই কোথাও তৈরি হয়েছিল, সমুদ্রের নীচে যেখানে ভেতর থেকে গলানো লাভা বেরিয়ে আসে সেই লাভার মুখের আশেপাশে কোথাও, কখনো। আগুন নাকি প্রাণকে পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করেছে। ভাবো সেই ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎ আর এই শান্ত জল তারা দুইয়ে মিলে আনল প্রাণ। ভয়ঙ্কর কি করে প্রাণকে পৃথিবীতে আনে দিলু? তারপর সেই নতুন প্রাণকে নাকি জলই তার মধ্যে পুষেছে, উল্টে প্রাণ সেও জলকে নিয়েই বেড়েছে। কেন এমন হয়? তুমিও কি এমন ভাবে এসেছিলে? দিলু ভাবতে থাকে এর সম্ভাব্য উত্তর মনে মনে। এসবের উত্তর তারও জানতে ইচ্ছে করে। সেও ভাবে একা একা। ভেতরের আগুন যে নতুন কিছুকে জাগায়, সে প্রাণ বা চিন্তাই হোক, যাই হোক, তার থেকে আর কে ভালো ভাবে জানে। কিন্তু সেই প্রাণের বেড়ে ওঠায় যদি জল লাগে তাহলে শিউলি কি সেই জল? যেখানে সে ভেসে থাকতে পারে সারা জীবন? দিলু নিজে এই পৃথিবীতে কেন এসেছে কি করতে এসেছে সে জানে না। কিন্তু মনে হচ্ছে এর উত্তর পাওয়া সম্ভব। সে এর উত্তর খুঁজবে। তার এই উত্তর খুঁজতেই এখন সব থেকে ভালো লাগছে। এই সময়, এই মেয়েটিকে আর নিজেকে তার ভালো লাগছে। জানে মেয়েটার জীবনও ওরই মতো থমকে আছে, আটকে পড়েছে জালের মধ্যে। কোনভাবে কি ভাবে সে কথা জানতে চায় না দিলু। কি হবে জেনে! কিন্তু এই যে জীবনগুলো তাদের আটকে গেছে কোথাও সেখান থেকে তাদের মুক্তি কি কোনদিন হবে?
-- আমাকে তোমার অচেনা মনে হয় দিলু? দিলু তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ শিউলির দিকে তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। -- কিন্তু আমার তো তোমাকে মনে হয় কবেকার চে না। কেন এমন হয় দিলু? উত্তরে দিলু মনে মনে বলে -- তোমার যা মনে হয় আমার তাই মনে হয় শিউলি। তুমি যা ভাবো আমি তাই ভাবি শিউলি।
--তুমি কি কোন কথা বলবে না?
--বলছি তো।
শিউলি হাসে আর বলে -- না তুমি বলনি। তুমি ভাবছ তুমি কথা বলছ। কিন্তু বলছ না। তুমি যদি কিছু বলতে তাহলে আমি বুঝতাম সত্যি করেই আমি তোমাকে বুঝছি কি না। তোমার জন্য নয় আমার নিজের সুবিধের জন্য তুমি কিছু বলবে না?
--আমি কিছু জানি না।
--তুমি তোমার মত কত কিছু জানো। নিজের জীবন দিয়ে জানো। সেইগুলকি আমি জানি? সেগুলো বলবে না আমায়?
--আমি যা জানি সেগুলো যে কোন জানা নয়।
--কে বলেছে এমন কথা। আমরা কে এমন কি বা জানি আসলে বলতো? এই বইপত্র স্কুল কলেজ আমাদের কি শেখায়? প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্য যা লাগে সে টুকু শেখায় তার বাইরে যে নিজেকে শিখতে হয়। তার বাইরেই তো সমস্ত পৃথিবীটা সেখানে বাঁচার কথা কেউ কাউকে শেখায়?
--কুমারদাও সেই কথাই বলে।
--যারা সত্যি করে জানে আসল জানা কি তারা সবাই তাই বলবে দিলু। আমি তোমাকে যা মনে আসবে বলব আর তোমার যা মনে হবে আমাকে বলবে।
-- আবার ঘাড় নাড়ে। হাঁ বা না বলতে পারনা? তুমি না একটা বিরাট ক্লাবের বিরাট সেক্রেটারি। তা এমন সেক্রেটারি হলে তো ক্লাবের হয়ে গেছে। দিলুর মাথা এবার লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়। সে যেটুকু বা ঘাড় নাড়ছিল সেটুকুও বন্ধ করে দেয়। সেই দেখে শিউলি ওর মাথাটা খুব জোরে ঝাঁকিয়ে দেয়। ওদিকে দলটা তখন গান ধরেছে -- সুনীল সাগরে শ্যামল কিনারে দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে......
--আপনারা জানেন ম্যানগ্রোভ গাছ কলকাতা কেন শ্রীরামপুরে বা ব্যারাকপুরের ঘাটেও ছিল? কেওড়াতলা? কেওড়া কিন্তু ম্যানগ্রোভ গাছ। মানুষের বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে।
--ঠিক। এত স্পেসালাইসড একদল গাছ এরা তো অন্যত্র বাঁচতেও পারবে না।
--ঠিক বলেছেন। একদম ঠিক কথা বলেছেন। লোকটা একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে শিউলিকে দেয় বলে চেটে দেখুন। শিউলি খানিকটা মুখে দেয় তারপর বলে -- নোনতা।
--হ্যাঁ নোনতা। নোনাজল এখানে আসল চ্যালেঞ্জ। এই গাছটা হল বাইন। এগুলো শরীর থেকে অতিরিক্ত নুন বার করে দেয়, পাতার তলায় দেখুন কেমন ক্রিস্টাল তৈরি হয়ে আছে।
--তাই তো! সব গাছই কি এমন ভাবে নুন বার করে দেয়।
--না বাইন, হাড়--খোঁচ--কাঁটা এমন কতগুলো গাছ নুন বার করে দেয় আর গরান, গর্জন, গেঁওয়া আর কাঁকড়া শরীরে নুন ঢুকতেই দেয় না।
--হাড়--খোঁচ--কাঁটা? নাম?
--হ্যাঁ এত দুর্দান্ত কাঁটা যে হাড়ের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে তাই এর নাম এমন। সুন্দরবনে প্রায় পঞ্চাশ রকমের ম্যানগ্রোভ আছে। কিন্তু এখানে কম। এখানে বাইন আর কাঁকড়া খুব দেখতে পাবেন।
--কাঁকড়া গাছের নাম এমন হল কেন? কোন কিছু কাঁকড়ার মতো দেখতে? দিলু বলে ।
--প্রায় তাই। ওই গাছের ফুল দাঁড়া মেলে রাখা কাঁকড়ার মতো দেখতে সে জন্য ওর নাম কাঁকড়া। আর আছে গেঁওয়া যে নিজের ছাল বাকল ফলে অতিরিক্ত নুন জমিয়ে রাখে আর মাঝে মাঝে ওগুলো ফেলে দেয় আর শরীর থেকে নুনের বোঝা কমায়।
--কি অদ্ভুত। আচ্ছা গেঁওয়াকেই ব্লাইন্ড ম্যানগ্রোভ বলে তো? যার আঠায় চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
--ঠিক ঠিক আপনি এত কিছু জানলেন কি করে?
--আমার হাংরি টাইড পড়ে এক সময় খুব এগুলোকে নিয়ে পড়তে ইচ্ছে করেছিল, সামনে থেকে কেউ তো আগে চিনিয়ে দেয়নি। কি সৌভাগ্য আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনি কবে থেকে এখানে আসছেন?
--আমার বহুদিনের গবেষণা সব এই ম্যানগ্রোভ নিয়েই। আমি সর্বত্র ঘুরে বেড়াই।
ওই ভদ্রলোক তার কয়েকজন ছাত্র নিয়ে এসেছেন কাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে। মাথায় সাহেবি হ্যাট, জিন্স আর টি শার্ট। বয়েস হয়েছে ভালোই, কিন্তু শরীরে তরতাজা ভাব। যা ভালোবাসেন তাই নিয়ে থাকেন বোঝা যায়।
--ম্যানগ্রোভ জঙ্গল কিন্তু আমাদের মূল ভূখণ্ডের জঙ্গলের মতো এমন সুখী নয়। তাকে সারাদিন প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়, অন্যদের থেকে অনেক বেশি। সে কথা কেউ খেয়াল করে না। এখানে সব সময় ভয়ঙ্কর লড়াই চলে গাছগুলোর সঙ্গে প্রকৃতির। মাটির ভেতর অক্সিজেনের জন্য, নরম মাটিতে আটকে থাকার জন্য এমনকি বীজ থেকে চারা গাছ বেরোনোর জন্যও। বীজ থেকে এই নোনা জলে কোনমতেই চারা বেরোবে না, তাই গাছ কি করে? সে গাছে থাকা ফলের মধ্যেই চারা বড় করে নেয়। বলা যায় মানুষ যেমন ডিম না পেড়ে বাচ্চা প্রসব করে তেমন। চারা বড় হয়ে গেলে তখন সে ফল তাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে, ততদিনে সে চারা প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করার জন্য খানিকটা তৈরি হয়ে গেছে।
এপাশে সুবর্ণরেখা আর ওপাশে বঙ্গোপসাগর। মাঝখানে চর যার অনেক অংশ জোয়ারে ডুবে যায়। পা ডুবে যাচ্ছে এক্কেবারে ভেতরে। কাদায় কাদা কিন্তু এই তো তারা চেয়েছে এখানে। সব মিলে বিচিত্রপুরই বটে। এক্কেবারে নির্জন সৈকত। দাঁড় কাক, সাদা বক, কাদা খোঁচা, আরও কত কি পাখি। একটা সাদাকালো পাখি লেজ দোলাচ্ছিল। লম্বা দোয়েল বলে মনে হচ্ছিল। দিলু তাকে বলল সাদা খঞ্জ না। গাছের গোড়ায় কাদার মধ্যে থাকা মাছ। চোখগুলো ওপরের দিকে বার করা, যাতে কাদার ভেতর থেকেও দেখতে পায়। ওগুলো ডাঙ্গায় দিব্যি অনেকক্ষণ বাঁচতে পারে। ওগুলো পেরি--অপ্থালমাস -- বিস্ফারিত চোখের মাছ।
মোহনায় চমৎকার রূপ। নদীর শেষে কিন্তু প্রচুর খাঁড়ি, সেই খাঁড়ি দিয়ে যায় স্পিড বোট। দুপাশে গ্রাম, সেখানে মাছ ধরার নৌকো রয়েছে, সেই নৌকো করে ওরা সমুদ্রে চলে যায়। কোন ভরসায় যায় কে জানে। এক একটা খাঁড়িতে জোয়ার না এলে জলে নৌকো ভাসে না। জোয়ারের সময় অনুযায়ী মোহনায় যেতে হয়। ওই দলটা ওদের সঙ্গে ছিল বলে নৌকো নিয়ে জলের ধারে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছিল। ভদ্রলোক খুব উৎসাহ নিয়ে শিউলি আর দিলুকে সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এও এক যোগাযোগ। জীবনটাই তো যোগাযোগ।
বেশী দূরে নয় বিচিত্রপুর। দিঘা থেকে ষোল কিলোমিটার। খুবই নির্জন কিন্তু সেই নির্জনতার মধ্যে কেমন শূন্যতা রয়েছে। কোন কোন খাঁড়ির দুই কিনারা বরাবর অবশ্য ঘন জঙ্গল। কিন্তু মোহনায় প্রচুর মরে যাওয়া গাছের কঙ্কাল। যেন মৃত্যুর পরেও এখনো তারা জোয়ার ভাঁটার সঙ্গে খেলে যাচ্ছে। সেই সুবর্ণরেখার শেষ বুঝি এই মৃত্যুর মতো। যদিও সুবর্নরেখার মূল স্রোত দগারার সৈকতের কাছে সমুদ্রে মিশেছে। এখানে মিশেছে এক শাখা। সেই সুবর্ণরেখা। নাম শুনলেই কেমন রোমাঞ্চ হয়। যার বালিতে নাকি পাওয়া যেত সো না। কত গল্পকথা তাকে ঘিরে। এ নদী খুব পুরনো, বোধ হয় গঙ্গার থেকেও। পূর্ব ভারতের সব থেকে পুরনো পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে ঘিরে বইতে বইতে এখানে এসে সাগরের বুকে এসে মিশেছে। কিন্তু সে শিউলির চেতনাকে নিয়ে যেতে চায় প্রাচীনে। হয়তো সে এখানেই কোথাও ছিল। হয়তো তার নাম তখন ছিল অন্য। কিন্তু এ নদী শিউলির যেন চেনা নয়। যে ছবি মনে মনে এঁকেছিল শিউলি তার সঙ্গে মোহনার সুবর্ণরেখার কোন মিল নেই। এত জল তবুও কেমন খাঁ খাঁ করছে। দিলুরও এই জায়গায় এসে তেমনই মনে হয়েছে বলল। কিন্তু এও এক সৌন্দর্য। এই রূপ নিয়েই সে বয়ে চলেছে।
-- ম্যানগ্রোভ গাছ খুব বড় হয় না কেন? এই বট বা অশ্বত্থের মতো?
--এই নরম মাটিতে বিরাট চেহারা নিয়ে আটকে থাকা খুব মুস্কিল, তাছাড়া সমুদ্রের উপকূল সব সময়েই বড় বড় ঝড় হয়। সেখানে নিজের আকার খুব বড় করলে মুস্কিল ছিল।
--সুন্দরবন তো কত ঝড় সামলে দেয় সে তো এই ম্যানগ্রোভের জন্যই ।
--হুম। খুব ঘন হয়ে থাকে তাই এদের মধ্যে দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে পারে না। কিন্তু লোকে একটা কথা খুব একটা জানে না ম্যানগ্রোভ ঘাসও হয়। সুন্দরবনে ওদের বলে ধানি ঘাস। ওগুলো হরিণের দল খেতে আসে। তাদের খেতে আসে বাঘ। তবে বাঘ আর হরিণ তো কেবল ওই সুন্দরবনে। কিন্তু যেখানে যেখানে ম্যানগ্রোভ সেখানেই কত কাঁকড়া, মাছ, চিংড়ি জন্মায়। বড় হয় সবই তো এই গাছগুলোর জন্য। সেখানে পোকা মাকড়, মউমাছি মধু সাপ ব্যাং সব আছে।
--তাহলে ম্যানগ্রোভ আসলে একটা ইকোসিস্টেম। যেখানে এরা সবাই আছে।
--ঠিক কথা, বিরিয়ানি ভালোবাসেন আপনারা?
--খুব। কিন্তু কেন?
--এই ম্যানগ্রোভ গাছগুলো পোড়ালে অনেক বেশি তাপ পাওয়া যায়। মানে এদের ক্যালরিফিক ভ্যালু অনেক বেশি। সাধারণ গাছের থেকে অনেক বেশি। তাই একসময় গরান কাঠে বিরিয়ানি রান্না হতো। সে আগুন জ্বলত অনেক ক্ষণ ধরে। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলত আর তাপ বেশি হওয়ায় একদম ঠিকঠাক পাক হতো।
--গরান কাঠ তো ভিজে থাকলেও জ্বলে। দিলু অনেকক্ষণ বাদে একটা কথা বলে।
--একদম। আপনি জানলেন কেমন করে? দিলু হাসে। কিছু বলে না।
--সেই জন্যই তো গরান কাঠ নিয়ে জেলেরা রান্না করে।
--সব ম্যানগ্রোভ গাছেরই কি শ্বাসমূল থাকে?
--না না গর্জন গাছে যেমন ঠেস মূল থাকে, শ্বাসমূল থাকে না। গরান গাছের মূল ভাজ করা হাঁটুর মতো, তাই ওদের নি রুট বলে।
--কি মজার। যেমন দেখতে তেমন নাম।
--ঠিক ঠিক। তবে আমি যে নামগুলো বলছি সেগুলো সুন্দরবনে প্রচলিত নাম। উড়িষ্যায় এদের স্থানীয় নাম কিছু ক্ষেত্রে আলাদা। কিন্তু আপনি খুব চমৎকার বলছেন তো। বেশি বয়েসও নয় আপনার। লেখেন নাকি?
--না না আমি শুধু পড়ি আর দেখি।
--দেখাটাই তো সব। মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানেন? এই ম্যানগ্রোভ গাছগুলো যারা কোনদিন শাল সেগুন বা বট অশত্থর মত কুলীন হতে পারল না, যাদের ফুল কোন বিশেষ দেবতার পুজোয় লাগল না, তারা যেন সেই ব্রাত্য মানুষগুলোর মতন। যাদের দিকে কেউ তাকায় না, যাদের বাঁচতে হয় জীবনের মূল্য চুকিয়ে, প্রতিদিন, ঠিক সেই সাধারণ মানুষগুলোর মতন।
শিউলি ভাবে এ কাদের কথা বলছেন ভদ্রলোক? তাদের কথা?
--মানুষ বাঁচবে না দেখবে? বাঁচতে গিয়ে সে যে শুধু ছুটছে। শিউলি বলে।
--নিজের বাঁচার জন্যই তো তাকে দেখতে হবে। তাকে দেখা শিখতে হবে। বাঁচতে গেলে আর বাঁচাতে গেলে তো দেখতে হবেই। তবে এটা নিয়ে এত চিন্তা করার দরকার নেই। প্রকৃতি এসব নিয়ে নিজে কিচ্ছু মুখ ফুটে বলে না। সে সব্বাইকে বাড়তে দেয়। তারপর একদিন পছন্দ না হলে আলতো করে গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। কারো কিচ্ছু করার থাকে না। সেই তো সভ্যতার আসল অসহায়তা।
সুন্দর করে বলে যেতে থাকলেন ভদ্রলোক কত কিছু। উনি বললেন ম্যানগ্রোভের এই নোনা জলকে সহ্য করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের ধান তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, ওদের অতিবেগুনি রশ্মিকে সহ্য করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ রোগ আর বার্ধক্যের চিকিৎসার গবেষণা হচ্ছে। উনি এও বললেন বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞানে কোনদিনই তেমন টাকা পয়সা পাওয়া যায় না। মানুষের কাজে না লাগলে কোন বিজ্ঞান নাকি সমাজে মহান হয়ে উঠতে পারছে না। সেখানেও আদতে সমাজ আর তার রাজনৈতিক দাদাগিরিই কাজ করে।
দুপুর থেকে বিকেল কেটে গেল যেন মুহূর্তের মধ্যে। বোটে করে ফেরার সময় দিলু প্রথমবার বলল সুবর্ণরেখার জন্যই নাকি তার ঝাড়খণ্ডে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে, শিউলির সঙ্গে। সে রাস্তা তার চে না। ওখান থেকে হোটেলে ফিরতেই লাগলো দুঘণ্টা। অন্ধকার নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ। ঘরের সব আলো নিবিয়ে বসে আছে ওরা দুজনে। বাইরে বারান্দা। এই ঘরটাতেও কেমন মায়া পড়ে গেছে দুদিনে। কেন এমন মায়া পড়ে যায়। অথচ ও নিজে তো বেছে নিয়েছে মায়াহীন জীবন। তাহলে কি সে যুদ্ধ করছে নিজের সঙ্গে। এই মুহূর্তে একটা কষ্ট হচ্ছে শিউলির মনে। পাশের মানুষটার কাছে নিজেকে লুকোতে ইচ্ছে করছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সারাদিন ধরে এত সুন্দর ঘুরে কেন আজ ওর এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে?