• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (৮) : অংশুমান বিশ্বাস



    দ্বিতীয় অধ্যায়

    ।।১৯।।

    সারাদিন শিউলি এখন ঘর গোছায়, গান গায় গুনগুন করে। আর অপেক্ষা করে দিলুর। দিলু এখন খুব ব্যস্ত। ওদের বিয়েতে এসেছিলেন কুমারবাবু নিজে, মোরশেদ আর ভুবন স্যার। বেদোতো ছিলই। বিয়ে মানে মালা বদল। কোন রেজিস্ট্রেশনও হয়নি আর পুরুতও ডাকা হয়নি। ওই লক ডাউনে সম্ভব ছিল না। বিয়ে যে হতে পেরেছে ওই দিনেই সেই কি কম। দিলুর জন্য থানা থেকে কিছু বলেনি। ভুবনস্যার বলেছিলেন মালা বদল, শুভ দৃষ্টি আর অগ্নি সাক্ষী এর বেশি বিবাহে আর কিছুই নেই। মালা বদল নাকি মনের দেওয়া নেওয়া, আর শুভদৃষ্টি মানে গহিনে ঢোকা। আর আগুন? সে ছাড়া নতুন করে গড়বেই বা কে? তাই 'মহাকালী মোমবাতি' ছিল অগ্নিসাক্ষী। বেদো নিজের বানানো একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়েছিল। কুমারদা কলকাতা থেকে থানায় স্পেশাল পারমিশন করে আগেই দরিয়াপুরে ফিরে এসেছিলেন। উনি এখন এখানেই আছেন। এই বাড়িটা শিউলির খুব পছন্দ হয়েছে। ফ্ল্যাটটা ভালো। আশপাশে নির্জনতা আছে। শিউলি কি কোনদিন ভাবতে পেরেছিল শেষ পর্যন্ত ও সংসার করবে। ওর ফেলে আসা জীবন ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কোথা থেকে কোথায়।

    আচ্ছা পৃথিবীর সবাই যদি জেনে যায় শিউলি কে ছিল কিছুদিন আগেও? তাহলে তখন কেমন থাকবে সে? আগে এসব চিন্তা তার মাথায় আসত না কিন্তু এখন আসে। কিন্তু ওর এসব কথা ভাবার কথা তো ছিল না। কি খারাপ ছিল সে? কোন লজ্জা পাওয়ার মতো কাজ করত কি? এসব সে ভাবছে কেন। কিন্তু এখন ও বেশ আনন্দে আছে, আনন্দের সময় সে আনন্দ করবে, করবেই করবে। পুরনো দিনের কথা মনে হয়। যদিও করোনার পর থেকেই দেহ ব্যবসায় খুব খারাপ অবস্থা। কোন কাস্টমার আসে না। হদ্দ গরিব লোকগুলো এমন ভাবে আরও কিছুদিন চললে না খেয়ে মরে যাবে। ছোঁয়াচে রোগে এ ব্যবসা সবার আগে মার খায়। রেড লাইটের মেয়েদের দিয়ে মাস্ক বানানোর কাজ করাচ্ছেন কুমারদা। যথারীতি বাকী কেউ তেমন ব্যাপারটায় উৎসাহ দেখায়নি। শিউলির কষ্ট হয় ওই হতভাগা মেয়েগুলোর জন্য। ওদের সঙ্গে এখনো আগের মতো কথা বলতে ইচ্ছে করে। যেমন ও বলত আগে। কিন্তু ও নিজের নম্বর বদলে ফেলেছে। জয়াদির সঙ্গেও যোগাযোগ এক্কেবারে নেই। তার ইচ্ছে করে ওর সঙ্গেও কথা বলতে। কিন্তু বলে না। দিলুর খারাপ লাগতে পারে। দিলু যেন উল্কার বেগে বদলে যাচ্ছে। দিলু আজকাল কুমারদার সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রাখতে পারে না। সময় পায় না। লকডাউনের গেরোয় মানুষের জীবন যত ঝিমিয়ে পড়েছে দিলু তত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চতুর্দিকে ট্রান্সপোর্টের সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। ইস্ট ওয়েস্ট লজিস্টিক্স। নামটা শিউলিই দিয়েছিল। ট্রান্সপোর্ট বিসনেস সারা পৃথিবীতে লজিসটিক্স হয়ে গেছে। মানানসই হয়েছে বলেছেন কুমারদা। কিন্তু একটা কথা শিউলি বুঝতে পারে না। দিলুর এত বদলে যাওয়ার ক্ষমতা কোথায় লুকনো ছিল! দিলু গত কয়েক বছরের চর্চাতেই শেয়ার কেনা বেচা এখন এতোটাই ভালো বুঝে গেছে যে এই চূড়ান্ত মন্দার বাজারেও ও মাসে পঞ্চাশ থেকে এক লাখ শুধু শেয়ার ট্রেডিং করেই রোজগার করছে। তার ওপরে কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোনের দোকান দিয়েছে, তিনটে ছেলে বসে সে দোকানে। কয়েকটা লড়ি কিনেছে লোনে আর একটা পুকুর সমেত বড় জমি লীজ নেওয়ার কথা পাকা করে ফেলেছে। সত্যি কি খাটতে পারে দিনরাত। ক্লাবের ছেলেগুলোকে বিভিন্ন কাজ দিয়েছে। বাবু এখন শহরের গরিবদের চাল ডাল তেল নুন সাবান বিলি করছেন। দরকার মতো যা দিয়ে পারে পাশে দাঁড়িয়েছে। লোকজন ওকে ধন্য ধন্য করছে। সে কথা শুনে তিনি আবার বেশ পুলকিতও হয়ে যান। কলবাবুর সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করার পর ও হারিয়ে যাওয়া দূরে থাকুক এমন ভাবে নিজেকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছে যে আশপাশের লোকজন ওকে পারলে মাথায় নিয়ে ঘোরে। কুমারদার অবদান এক্ষেত্রে সব থেকে বড়। ও আজ অল্প সময়ে যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে তার পেছনে কুমারদাই হয়ত আসল শক্তি। কোথাও কি ও নিজেও আছে? নাহঃ সে নয়, সে নয়। সে নিজে কে! বরং দিলুকে পেয়ে ও নিজেই ধন্য হয়েছে। দিলুর মনটাও তো বড়। যে কোনো বিপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চেনা অচেনা যেই হোক না কেন। আশপাশের বেশ কয়েকটা ক্লাবের ওপরেও সেই জন্য ওর বেশ প্রভাব হয়েছে। লোকজনের মুখে কুমারবাবার নাম তো শ্রদ্ধার বিষয় আগে ছিলই, দিলুরও নামও যোগ হয়েছে তার সঙ্গে। আচ্ছা দিলু কি সব সত্যি বলে? সব কিছু অবশ্য সত্যি বলতে নেই, কারণ এ পৃথিবী ক্ষমতার দাস। হয়তো সে বুঝে গেছে প্রত্যেকটা ইতিহাস ক্ষমতার ইতিহাস আর এখন ক্ষমতা মানে বন্দুক পিস্তল নয়, বুদ্ধি আর সাহস। আইডিওলজি কি? সেটা মাথায় মাখে না খায়? একই লোক তাহলে তিন রকম পার্টি জয়েন করে একজীবনে? হাসি পায়। গরিব লোকগুলো যখন হাঁটছিল, রেলে কাটা পড়ছিল, পুলিশের বেধড়ক ঠ্যাঙ্গানি খাচ্ছিল কোন দলের লোক দাঁড়িয়েছিল? কটা লোক নিজের রোজগারের অর্ধেক দিয়ে দিয়েছে গরীবদের জন্য এই দুঃসময়ে। কেউ দেয়নি। কেউ দেয় না বিনা কারণে। তাই দিলুও নিজেরটাই দেখবে। দিলু এখন জীবনকে দাবার চালের মতই ভাবছে। ভাবতেই হবে, নইলে ও বাঁচবে না। দিলু না বাঁচলে শিউলিকেও কেউ বাঁচতে দেবে না।

    #

    জুনের শুরুতে এখন বেশ গরম। বৃষ্টির অপেক্ষায় সারা বাংলা। বৃষ্টিতে নাকি ধুয়ে যাবে করো না। এ এক অদ্ভুত শব্দ 'আনলক'। যেমন গ্লাসে অর্ধেক জল থাকলে কি বলব? অর্ধেক ভর্তি বলব না অর্ধেক খালি? সেই উত্তরহীন প্রাচীন প্রশ্ন যেন। বজ্র আঁটুনির পরে মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এখন। এসব কিছুর দরকার ছিল কি ছিলনা, প্লেগের তুলনায় এই কভিড কতটা মারাত্মক বা আদৌ তেমন কিছু কিনা বা হার্ড ইমিউনিটি যথেষ্ট ছিল কিনা এসব বিষয়ে এদিক ওদিক চর্চা চলতেই থাকছে। মানে যাদের চর্চা করার অবকাশ আছে তারা করছে। কিন্তু যাদের না বাড়ির বাইরে বেরলে বাড়ি সুদ্ধু সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে তাদের মুখের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি না। কোনদিনই পাইনি। তবে এই সময়টা মিটে গেলে একটা পরিসংখ্যানের প্রয়োজন আছে, তা হোল, ভারতে সামগ্রিক মৃত্যু হার অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি হল কি না। আমাদের মতো দেশে কোন পরিসংখ্যানই তো ঠিক হয় না। সুতরাং কোন ক্ষেত্রে কতটা কি ব্যবস্থা নেওয়া হল বা রোগ কতটা ছড়াল তার সঠিক তথ্য কোন ভাবেই হাতে এসে পৌঁছয় না। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সব স্তরেই পরিসংখ্যান বেশ হাস্যকর।

    এই বাড়িতে এসে ওঠা থেকে ওর আর কোন কাজ নেই যেন। পড়াচ্ছিল তা স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। পড়াতে পারে না। বেরোতে পারে না। বাড়িতে বসে কত পড়া যায়। অল্প লেখালেখি করে আজকাল, আগের থেকে বেড়েছে। শখ করে রান্না করে। কিন্তু দিলু এত ব্যস্ত যে সে অর্ধেক দিন বাড়িতেই থাকে না। বিয়ের পরে এই মানুষটা যেন কেমন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। আবার সে চুপচাপ হয়ে গেছে। এবার কিন্তু লজ্জায় নয়। অন্য কারণে, যেন প্রতিদিনের ছোটখাটো কথায় আর ওর কোন উৎসাহ নেই। দিনকে দিন ওকে এত ছুটতে কে বলেছিল কে জানে! বিয়ের পরে কোথাও বেড়াতেই যেতে পারল না, যদিও এমন হবে সে তো আর কেউ বুঝতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ে তিন মাস বাড়িতে এমনি থাকা যায় কিন্তু যেই কেউ তোমাকে বলে দেবে তোমার বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ, তখন সেই থাকা অসহ্য হয়ে ওঠে। কারাবাসের পীড়া নিয়ে যেন দিনযাপন করছে সকলে। সব যেন পাগল পাগল লাগছে। অবশ্য পাশের গ্রামগুলোতে কেউই তেমন কিছু কেউ মানছেনা, বেশ আছে। আজ এসব কিছুর মধ্যেও বেশ অন্যরকম একটা দিন। আজ দিলু দুপুরে বাড়িতে, বেদো এসেছে। নিজের হাতে বেদো একটা চমৎকার বাহারি মোমবাতি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। বোরোসিলের দামি গ্লাসের মধ্যে মোমবাতি ভরেছে, তার ভেতরে পাথর, গাছের মতো কিছু একটা আর স্বচ্ছ মোম। ঠিক মনে হচ্ছে একটা সিনারি। এত ভালো হয়েছে জ্বালাতে কোনদিন ইচ্ছে করবে না। বিভিন্ন জায়গা থেকে বেছেবুছে সব নাকি কিনে রেখেছিল। এই ধরনের মোমবাতির স্যাম্পল বানিয়ে দিলুর সঙ্গে বিসনেস করবে বলে। এই লক ডাউনে আর কোন কাজ না থাকায় এই সব করছে। এই রকম হদ্দ অশিক্ষিত এক ছেলে এমন একটা চমৎকার জিনিস বানিয়ে নিয়ে এসেছে। শিউলি অবাক হয়ে গেল। না হোক এক্কেবারে নতুন আইডিয়া, ডিসাইনটা তো নতুন। একা একা করেছে তো।

    — বউদি একদম ঘর অন্ধকার করে এটা জ্বালিয়ে রাখবে। তুমি আর দিলু গান শুনবে, আশিকির অরিজিৎ সিং চালিয়ে দেবে। জমে যাবে বউদি। দিলুতো আর বাহারি মোমবাতির কারখানা করল না। করলে দেখত আমি কেমন সব জিনিস বানাই। বিদেশে যেত বিদেশে। বউদি, নাম ছড়িয়ে পড়ত আমাদের।

    শিউলি বেদোর কথা শুনতে খুব ভালোবাসে। ছেলেটা যা মনে আসে সব বলে যায়। বেদোর বয়েস বোঝা যায় না। সে কতটা যুবক আর কতটা কিশোর তা ওর শরীর আর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। কোনরকমে চামড়া দিয়ে একটা কাঠামো ঢেকে রাখা। সঙ্গে ফড়িঙের মতো সারাক্ষণ ফরফরানি। কখনোই থামে না। হয় শরীরে নইলে মুখে সারাক্ষণ খই ফুটছে। সকাল বেলার দিকটা দিলুর সঙ্গে অনেক লোক দেখা করতে এসেছিল, সেই সময়টা বেদো আর শিউলি নিজেদের মধ্যে অনেক গল্প করে কাটিয়েছে। শিউলির মনের মতো কথা বলার যেন এক সঙ্গী হয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সকাল থেকে শিউলি রান্না করেছে ভাত, সুক্তো, পোলাও, পনির, কষা মাংস, চাটনি, পাঁপড়। মিষ্টি আনানো আছে। সকলে মিলে খেতে খেতে আজ অনেক কথা হচ্ছে।

    — বউদি তুমি আমায় বিরিয়ানি করে খাওয়াবে একদিন। মাংসের পাত চাটতে চাটতে দিলু বিগলিত হয়ে বলতে থাকল — তুমি রান্না করলেই সব অন্যরকম খেতে হয়ে যায়। শালা কাকার রান্না খেতে খেতে একদম জিভটা কেমন আলা হয়ে গেছে। এইরে তোমার সামনে একটু খিস্তি করে ফেললাম বউদি। কিছু মনে কোরো না।

    শিউলি হাসে। বউদি বলে ডাক বেদোর মুখে বেশ ভালো লাগে।

    — তোমায় আরও একটু মাংস দিচ্ছি। বেদোর মাংসে না নেই। সে ঘাড় কাত করেই আছে। শিউলির খুব আনন্দ হচ্ছে। এই ছেলেটা যেন ওর আপন আত্মীয়। অলক্ষ্যে আবদারের সম্পর্ক যেন গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। ভালবেসে সে খাওয়াচ্ছে একটা সবে বড় হয়ে ওঠা ছেলেমানুষকে। দিলুর মুখ দেখে অবশ্য কিছুই বোঝা যায় না, কখনই। এখনো যেন সে নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। খাওয়ার সময়ও দিলু ভাবলেশহীন। ভালো মন্দ কেমন খেল কিছুই বলে না, কখনই না, চায়ও না, দিলে খায়, কম খায়। কিন্তু বেদো যেন সাক্ষাৎ খিদে। কত খেতে পারে সে কথা আগেই বলে রেখেছিল দিলু, তাই সে মাংস মিষ্টি নিয়েও এসেছিল প্রচুর। খাওয়া দাওয়া মিটলে বিভিন্ন বিষয়ের কথা হচ্ছিল। বেদো আবার শুরু করল

    —দিলু তুই পুকুরের লাগোয়া বড় জমিটায় কি ভেবেছিস? দিলু চুপ করে থাকে। শিউলি বোঝে কোন কথা বাড়াতে চায়না সে। — বুঝলি এখন কলকাতায় শুয়োরের মাংসের চাহিদা অনেক। সেদিন কুমারদাদের ক্লাসে বলছিল। আমাকে তোর জমিটায় শুয়োরের চাষ করতে দে না। বেদো বলেই যায়। কিন্তু কি অদ্ভুত কারণে দিলুর চোয়াল যেন ক্রমে শক্ত হয়ে যাচ্ছিল, খাওয়াও থামিয়ে দিল সে। শীতল গলায় বলল

    —চুপ কর্, থাম্।

    —আহা বলতে দাও না ওকে।

    —দিলু প্রথমেই না করে দিলে আর বলা যায়! বেদো বলে।

    —আরে বল না তুমি। শিউলি আশ্বস্ত করে বেদোকে।

    শিউলির আস্কারা পেয়ে বেদো আবার একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর এক নিশ্বাসে বলে। — ইইয়র্কশায়ার জাত খুব ভাল। জাত শুয়োর। রোগ বালাই কম। ঘরের বাড়তি খাবার আর হোটেলের ফেলে দেওয়া মাল দিয়েই এর চাষ হয়ে যায়। ছ মাসে ৬০ থেকে ৭০ কেজি ওজন হয়। বিক্রি করা যায় অর্ধেকের বেশি লাভ। আর পাশে পুকুরে শুয়োরের পায়খানা খাবার হিসেবে দিলে মাছ নাকি দারুন হয়।

    —তুই এইসব প্ল্যান আর আমার কাছে কোনদিন বলবি না। প্রচণ্ড ধমকে উঠল দিলু। বেশ জোরে। এতক্ষণের আনন্দকে খান খান করে দিয়ে এই চিৎকার অদ্ভুত, অসম্ভব। অপ্রস্তুতে হল শিউলি। বেদো গুটিয়ে গেল। কিছু সময় সবাই চুপ। তারপর বেদোই আবার নিজে থেকে শিউলিকে বলতে থাকলো

    —আরে না বউদি দিনরাত আমি দিলুর কানে এসব বলে বলে ওকে বিরক্ত করি। তারপর খানিক উদাস হয়ে বলে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আমাকে করার দরকার নইলে এই মোমবাতির কারখানার কোন ভবিষ্যৎ নেই।

    —আমি আগে বলেছিলাম তুই দোকানে আমার দোকানে বোস। কমপ্লেক্সে আমার তিন তিনটে দোকান। ঠান্ডা, কাটা কাটা চাপা গলায় দিলু বলে বেদোকে। দুপাশে মাথা নাড়ে বেদো। তারপর বলে — আমি এমন একটা কাজ চাই যাতে আমি কি রোজগার করব সে বড় কথা নয়। চলে গেলেই হল কিন্তু সে কাজ আগে আমার ভালো লাগতে হবে।

    —চুপ কর। বড় বড় বাতেল্লা। দিলুর যেন আজ মেজাজ সত্যি গরম হয়ে গেছে। কিন্তু বেদো নিজেকে প্রমাণ করার জন্য পিছপা নয়, হয়তো শিউলির সামনে এই বকুনি ও মনে মনে মেনে নিতে পারেনি। তাই দিলুর সামনে অন্য বারের মতো চুপ করার বদলে ও বলে চলল

    —না রে ভালো লাগার কাজে না থাকলে শান্তি পাওয়া যায় না। বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। আমি ওই দোকান ঘরে হাঁফিয়ে উঠবো।

    শিউলি ভাবল বেদো ভুল বলছে না। কিন্তু দিলু ওর কোন কথা শুনছে না। বা এই বাজারে এসব নতুন কাজে ও যেতে চাইছে না বা অন্য কোন চিন্তা দিলু করছে। কিন্তু বেদোর কথাটা দিলুর বোঝা উচিত। একদম কাছের মানুষের কথা তো মন দিয়ে শুনতে হয়।

    মাঝরাতে হালকা আলোয় শিউলির ঘুম ভাঙল। আজকাল ঘুম হালকা হচ্ছে, কাজকর্ম কম সারাদিনে, আনলক বললেও আসলে লকডাউনই তো চলছে। বাইরে যাওয়া শিউলির আর হয়ই না। পরিশ্রম না হলে তেমন ঘুম আসে না, তবে দিলুর তো সারাদিন সারারাত কাজ। লোকে বিয়ে করে চুপ করে বসে থাকে বউয়ের কাছে, এ পাগল সারাদিন ছুটে বেড়াচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। দিলুর মুখটা সুন্দর লাগছে বড্ড। মায়া মাখানো। শিউলি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। টয়লেটে গিয়ে ফিরে এসে আবার শুল। এসে দেখল দিলু জেগে গেছে। জড়িয়ে ধরল শিউলিকে। কিন্তু কেউই কোনও কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর শিউলি শুরু কথা শুরু করল — বেদো বেশ অন্যরকম ছেলে। দিলু চুপ করে থাকে। শিউলি আবার বলে — ও যা করতে চাইছে আমাদের ওকে সাহায্য করা উচিত। দিলু তাও চুপ করে থাকে। শিউলি আবার বলে — কিছু বল।

    —তুমি ওর হয়ে আমায় কোন কথা বলবে না। আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি, কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই, হারুকাকার আঁচলে থাকে, বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখে না কেন? কেন ওইটুকু নিয়ে ও বাঁচতে চায়।

    —সবাই কি একরকম হয় দিলু। সবাই কি একরকম হতে পারে? সবার একই রকম ইচ্ছে হয়? নাকি হওয়া উচিত? এক একটা মানুষ এক এক রকম হবে সেই তো কাম্য, তাতেই তো এ পৃথিবী সুন্দর হয়। তাকে মেনে নিতে হয়।

    দিলু নিরুত্তর থাকে। অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে যায় তারপর। ঘুম কারো আসছে না। রাত বেশি নয় একটা হবে। বাজারের টহলদার বাঁশি বাজিয়ে যেতে যেতে বলে — হুঁশিয়ার। দিলুর চোখ বোজা। এই কিছুক্ষণ আগেই যে জেগে ছিল — দিলু ঘুমিয়ে পড়েছ? সাড়া নেই। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো ইচ্ছে করেই সাড়া দিচ্ছে না। শিউলি আর ঘাঁটাল না, একটা বই নিয়ে বিছানার পাশের ল্যাম্পে পড়তে শুরু করল। কিন্তু মন বসে না। এখানে আসার পর থেকেই তেমন পড়া হয় না, ঘরের কাজ করতে ইচ্ছে করে, দিলুর জন্য নিজের হাতে রান্না করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দিলু কি দরকারের থেকে বেশি বদলে যাচ্ছে? নাকি একইরকম আছে। তারপর নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেল যে দিলুর নিজের বদলে যাওয়াটা শিউলির সঙ্গে এই মিলনেই কি থেমে থাকবে? নাকি উচিত? তারপর শিউলি আবার একই প্রশ্ন করল নিজেকে নিজে। না সে নিজেকে বদলানোর কথা এর পরে আর ভাবতে পারে না। সে সুখী হয়েছে। সে দিলুকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেছে। আর জীবনে নতুন করে কোন বদল তার প্রয়োজন নেই। শিউলির মনে হয় দিলুর জীবনে এমনই হওয়ার ছিল। ও না হলে অন্য কারোর হাতে দিলু পালটে যেতই। কারও কারও পৃথিবীতে আসা আর তার পরে বয়ে চলা হয়তো আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের থেকে আর কে বড়ো উদাহরণ হতে পারে? ধুস কি থেকে কি ভাবতে শুরু করেছে সে। কিন্তু তার নিজের চারদিকে কিন্তু এত প্রাপ্তির মধ্যেও একটা দমবন্ধ ভাব মাঝে মাঝে লাগছে। ও কি একা হয়ে গেল একসঙ্গে চলার শুরুতেই। হয়তো না, তাহলে হয়তো চারপাশের এই অবস্থার জন্যই, কারোর মনই তো ভালো নেই। সাধারণ মানুষ কারোরই রোজগারপাতি নেই। চাষিরা অবশ্য এই অবস্থায় তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। ছোট ব্যবসায়ী আর ছোটোখাটো বেসরকারি চাকুরেদের ওপরেরই যত কোপ। পৃথিবীতে তাই হয় সবসময়েই। আর তাদের জন্য চাল ডাল আর ছোলা দিয়েই খালাস। সেও তো আবার পাচ্ছে না সবাই, সেখানেও কালোবাজারি। মানুষ কোথায় যাবে। এই সাধারণ মানুষ গুলো আজকাল দিলুর কাছে দেখা করতে আসে, দিলুও করছে ওদের জন্য। কিন্তু মুস্কিল হল এই কাপড় জামা, খাবার, সাবান এসব দিয়ে আসল দৈন্য কি ঘোঁচানো যাবে? কিন্তু দিলু কিই বা করতে পারে। ও ওর মতো করছে। আরেকটি মানুষ অবশ্য আসল কাজ করে চলেছেন অক্লান্ত ভাবে। তিনি হলেন কুমারদা। চুপচাপ। কোন প্রচারের বাইরে থেকে। প্রচার ওই মানুষটাকে বিব্রত করে। সত্যি করেই। কিন্তু দিলু কুমারদার পথ নেয়নি। নিজের পরিচিতি এখন সে আরও মজবুত করতে চায়।

    শিউলি ছাইপাঁশ কি যে ভেবে চলেছে কে জানে। শিউলির ঘুম না আসার রোগ কি আবার এল? আরেকটা লোক কি করছে কে জানে। শেষ যে বার দেখা হল সেবার বলল সে আর ওই কুলাবাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে খুঁজে যাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না সে জানে না। সেই নিয়ে লোকটা কষ্টে আছে। ওই লোকটা আসলে কষ্টে থাকে। দুঃখবিলাস নয় কিন্তু থাকে। হয়তো তার জন্যেই থাকে। তাকে শিউলি হয়তো কিছুই দিতে পারল না। সেও যেন এক বাচ্চা ছেলে। সেও এক অদ্ভুত মানুষ যাকে শিউলি সব কিছুর সঙ্গে প্রণামও করেছিল। সেই মানুষ তার কে সে আজও জানে না। তাকে একেবারে ফেলে আসতে পেরেছে কি সে? জানে না, জানতে চায় না। ওই মানুষটা কি পাচ্ছে? ভালো আছে নিশ্চয়ই। অমন মানুষ ক্ষেপামিতেই ভালো থাকে। তাকে সাধারণের মতো রাখলে হয়তো ভালো হতো না। বেশিরভাগ মানুষ একাই হয়। কিন্তু ওই লোকটার একাকিত্ব বড়ো অদ্ভুত, কষ্টের আর মায়ার। ওই লোকটা কবে থেকে শিউলির সঙ্গে আছে? কে জানে কবে থেকে আছে? সে কি এখনো সঙ্গে আছে? এখনো আছে? কি মনে হচ্ছে শিউলি সঙ্গে এখনো আছে? ওফ্। শিউলি এই চিন্তা কি তোমার ঠিক? তুমি এখনো এমন কথা ভাবো? তুমি সংসার করছ শিউলি। তুমি যত এমন ভাবে ভাববে ততই একা হয়ে যাবে আরও। কিন্তু মানুষের ভেতরে ভেতরে একা একা থাকা কি অস্বাভাবিক? মোটেও নয়। এক এক মানুষ কেমন বয়ে চলেছে নিজের জগতে, লড়াই করে চলেছে একা একা, এক একটা তারার মতো আকাশে, একা ও বিচ্ছিন্ন। কিন্তু সে কত কিছু দিয়ে মনকে সরিয়ে রেখেছে। রান্না করেছে, সিনেমা দেখেছে, লিখতে চেষ্টা করেছে, টবের ছোটো ছোটো গাছগুলোকে জল দিয়েছে, যোগাসন করেছে। ওর কি নিজেকে ডাক্তার দেখাতে হবে? কি বলবে ডাক্তারকে?

    #

    দরিয়াপুর শহরে পুলিশে চেপে ধরে লকডাউন করালেও আশপাশের গ্রামে তেমন কড়াকড়ির কোন বালাই কোনদিনই ছিল না। আর করোনারও তেমন কোন খবরও ছিল না। তাই এখানে মেলামেশায় বাধা কেউ রাখছে না। পঞ্চায়েত থেকে প্রচার হয়েছে। কিন্তু কেউ তেমন কিছু মানে না। ট্রেন বাস সব বন্ধ করোনা আসবে কি করে। শহরের জীবন নাকি বন্ধ কিন্তু এই গ্রামে ফাহমিনার সময় কোথা দিয়ে যে কেটে যায় এখন আর ঠাহর করতে পারে না। আগে শুধু ঘরকন্যার কাজ ছিল এখন বরের সঙ্গে এই কাজে নেমে সে আর মোটে ফুরসত পায় না। শুধু সে নয়, আশপাশের যে লোকগুলোর নিজের জমি নেই তারা সকলেই অল্পবিস্তর নতুন জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়েছে, গত বছর থেকেই। সাবধানের মার নেই। কুমারবাবা বলে দিয়েছিলেন। ব্যবস্থাও সব তার। এখন আর মাথা ঝুলিয়ে এ গ্রামের জমিহীন পুরুষদের বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে না। মহিলারাও একসঙ্গে কাজে নেমেছে। ফাহমিনাদের বসত বাড়ির লাগোয়া তাও এক বিঘে জমি আছে। যাদের নেই তাদের জন্য মসজিদ বেশ খানিক জমি ছেড়ে দিয়েছে। মোরশেদের উদ্যোগে আর কুমারবাবুর ব্যবস্থায়। চলছে হাস মুরগি পালন। আর তৈরি হচ্ছে জৈব সার। সেই জৈব সারে ফলছে ফসল। কোলকাতায় আর কিছু দরিয়াপুর শহরে সে ফসল বিক্রি হচ্ছে, সরাসরি চাষিরাই বিক্রী করছে। কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসছে কুমারবাবার লোকজন। কো অপারেটিভ সংস্থা গড়ে উঠেছে। আপনজন। মুসলমানদের সঙ্গে কিছু হিন্দুরাও আছে। সব মিলে এই গাঁ দেখলে কারো মনে হবে না যে জীবন থেমে আছে। শুধু ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনা বন্ধ। মিড ডে মিল বন্ধ। যদিও সরকার থেকে বিনা পয়সায় চাল গম ডাল দিচ্ছে কিছু কিছু। বি পি এল দের বেশি। এ পি এল ও পাচ্ছে।

    কিন্তু যা কথা হচ্ছিল। মির্জাহাটিতে আজ রোজকার মতো ব্যস্ত একদিন। মিনা এখন হাঁসের খাবার মাখছে। ওই পাশে মোরশেদ মুর্গীর খাবার দিয়ে এলো। এই মুহূর্তে মাঠে তেমন কাজ নেই। আলু উঠে গেছে। ফাহমিনা আর মোরশেদ দুজনেই সারাদিন পড়ে থাকে হাস মুর্গীগুলোর সঙ্গে। ওদের ছেলে আর মোরশেদের মা সবাই হাত লাগায় কাজে। ফাহমিনার ডাকনাম মি না। মোরশেদ তো বটেই আর সবাই ডাকে মি না। পাঁচশ মতো হাঁস রয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল নোংরা কাজ। কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক ঘর দোর বানিয়ে কাজ করলে পরিষ্কার রাখা সম্ভব। প্রথম প্রথম মিনাই আপত্তি করেছিল প্রবল, কিন্তু এখন ওই সব থেকে বেশি আগলে রাখে সব কিছু। এই হাঁসগুলোর এখন মাস পাঁচেক বয়েস। ওদের বাড়ির মধ্যেই ছোট পুকুর আছে এক। গোটা দশ বারো দেশি হাঁস আছে, ওই পুকুরেই সারাদিন থাকে। কিন্তু যেগুলোর চাষ করছে সেগুলো খাঁকি ক্যাম্বেল আর রানার, নামেই হাঁস, মোটেও জল পছন্দ করে না। কতগুলো বুড়ো মেয়ে ক্যাম্বেল অবশ্য জলে যায়। কিন্তু এগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে জলে নামালে বড় জোর আধঘণ্টা কাটিয়ে উঠে আসে।

    —মিনা তোমার হোল? বাকি গুলোকে ছাড়ি? চেঁচায় মোরশেদ।

    —ছাড়ো। ছোটঘরেরগুলো ছাড়ো আগে।

    —আচ্ছা।

    মোরশেদ হাঁসের ঘরের দরজা খুলে দেয়। হাঁসগুলো ছাড়া পেয়ে পাগলের মতো দুলতে দুলতে ছুটতে থাকে। ছোটো দরজা দিয়ে যখন বেরোয় যেন মনে হয় বাঁধের লক গেট খুলে দিয়ে জল ছাড়া হচ্ছে। মেয়েগুলো বেশি বেঁকে বেঁকে হাঁটে। আর একটু মোটা ধরনের হয়। ছেলেগুলোর গলা চকচকে সবজে নীল, বিশেষ করে রানারের। চিনতে অসুবিধে হয় না। একে অপরের মাথায়, গায়ে চড়ে বেরোয় হুড়মুড় করে। সামনে কি আছে দেখে না, শুধু জানে খাবারের কাছে ছুটতে হবে আগে। পুকুরের এক পাড় ঘেঁষে ঘেরা জায়গায় খাবার দেওয়া হয়। ওইদিকে ছুটতে থাকে পাগলের মতো। সে এক দৃশ্য। মিনা প্রতিদিন দেখে আর প্রতিদিন হেসে মরে যায়। সামনে কি আছে কিচ্ছু দেখে না। সামনে ফাঁকা বালতি টালতি কিছু থাকলে তার ভেতরেও ঢুকে যায়, তারপর আবার ডানা ঝাপটে বেড়িয়ে পড়ে। একটা বেরোলে পেছনের আরেকটা উদ্ভ্রান্তের মতো বালতি বা গর্তে এসে পড়ে। না জানি ওখানে পড়লে কি না কি পাওয়া যাবে। তারপর সেও বেরোয় কোনরকমে। ততক্ষণে তার দেরী হয়ে গেছে অন্যদের তুলনায়। সেও তখন পড়িমরি করে খাবারের গামলাগুলোর দিকে উর্ধশ্বাসে ছুটে যায়। হাঁসের যা খাওয়া। প্রথম আড়াই মাস ছশ বাচ্চাকে পঁচাত্তর কিলো খাবার দিতে হতো। নিমেষে উধাও। সারাদিনে চারবার খেত। এমনি বলে হাঁসের মতো খাওয়া! মুর্গী এমন খায় না। এখন একটু বড় হয়ে অবশ্য খাওয়া একটু কমেছে। দুবার খাবার দেয়। হাঁসের বাচ্চাগুলো ছোটবেলায় খুব সাবধানে রাখতে হয়। ছশো তে একশ মরবেই। প্রথম দিকে চিন্তায় পড়ে গেছিল মি না। একের পর এক মরে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরে আর কিছু হয়নি। বরং হাঁস বড় হলে মুর্গীর থেকে ঝামেলা কম। হাঁসের তেমন কোন রোগ বালাই নেই। প্রথম দিকটা সামলে দিলে তারপর আর কিছু দেখতেই হয় না। মুর্গীকে নিয়মিত ওষুধ, ভ্যাক্সিন দিতেই হয়, পান থেকে চুন খসলে তাদের রোগে ধরে। যদিও ওরা দিশি মুর্গী চাষ করে। দিশি মানে এক্কেবারে দিশি নয়। ব্রয়লার নয় তাই দিশি বলে। রোড আইল্যান্ড রেড।

    একটু একটু করে নিজের সংসার আর আশপাশের মানুষগুলো যেন মনে বল পাচ্ছে। কিন্তু করোনার থাবায় বিক্রি বাটা এক্কেবারে কমে এসেছে। যদিও ও নিজে ডিমের জন্য হাঁস মুরগি চাষ করছে। কিন্তু শহরে ব্রয়লার মাংসের চাহিদা কমেছে। মাংসেরই চাহিদা কমেছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে। যারা ব্রয়লার করেছিল তারা খুব সস্তায় বেচে দিয়ে এখন চুপ করে বসে আছে। হাঁসের চাহিদা খুব কিছু কমেনি। ডিমেরও না। গত শীতে ভালো রোজগার হয়েছে, শুরুর জন্য ঠিক ঠাক। গেল যা। ছুটতে ছুটতে একটা হাঁসের পায়ে সুতো আটকে গিয়ে সেইটা কিছুতেই আর নড়তে পারছে না। বেচারা ছেলে হাঁস তাই গলায় তেমন জোরও নেই। মেয়ে হাঁস হলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত। মিনা ছুটল তাকে ছাড়াতে।

    —কি কর গো? বাকিগুলো ছাড়ব নাকি? মোরশেদ দূর থেকে বলে।

    —বুড়ো হয়ে চোখেরও কি মাথা খেয়েছ? দাঁড়াও না তোমার এত তাড়া কিসের? মিনা একটু ছদ্ম ঝগড়া করে। আসলে মিনা আনন্দে আছে। সব নিয়ে সে আনন্দে আছে। যে মানুষটাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল সেই মানুষটার মন ভালো আছে দেখে সে ভালো আছে। মাঝখানে কতদিন লোকটাকে হাসতে দেখেনি সে। তখন মনে হয়েছিল এ জীবনে আর হয়তো ওর সুখ করা কোন দিন হবে না। কিন্তু এখন এই দুর্দিনেও ওরা ভালো আছে। আল্লা দয়াময়। সারাজীবন কারো খারাপ অবস্থা রাখেন না।

    —ছাড় এবার। চেঁচায় ফাহমি না। মোরশেদ সে কথা শুনতে পায় না। তার মন তখন পাশের সুলেমানের বাড়ির দিকে। ওর মেয়ের শাদি লেগেছে। ঢোল বাজিয়ে মেয়েদের গানের আওয়াজ আসছে। স্ত্রী-- আচারে নাচ গান খুব বড় এক ব্যাপার। এখানে সবাই নিম্নবর্ন মুসলিম, অর্জল। বোরখা প্রথা তেমন নেই নিম্ন বর্ণের মুসলিমে। যেমন নেই নাচ গানেও বাধা। মনে হয় এখন গায়ে হলুদ হচ্ছে মেয়ের। লালপাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে পিঁড়ির ওপরে বসিয়ে ওজু করানো হচ্ছে, আল্লাহর নাম স্মরণ করে দিদি, বোন, ভাবি, চাচি, খালা, ফুফু, বান্ধবী, পাড়ার বউয়েরা সব মিলে আশীর্বাদ হচ্ছে গানে গানে।

    রজয় নদীর বাঁদা ঘাটে জোড়ে বাঁধে লা
    বল আল্লা আল্লা বল আল্লা আল্লা
    সেই লাঈয়ে চাপবে আমার বালি—বালা
    বল আল্লা আল্লা বল আল্লা আল্লা
    —কি হল ছাড়।

    —চেঁচাও কেন? ছাড়ছি, সবুর কর না কেন।

    —আচ্ছা সবুর করি। তাহলে গোসল করে তুমি আমিনাকে গায়ে হলুদটা দিয়ে এসো। আমার তো সারাদিন তোমার মত ভাবার ক্ষমতা নেই।

    —দাঁড়াও দাঁড়াও ভুলে গেছিলাম গো। তোমার তো একবার গায়ে হলুদে যেতে হবে!

    —ভুলেই তো যাবে, এই সংসারে আমার কি মরার ফুরসত আছে। সবুর করিনা কেন। কথার ছিরি কি।

    মিনা বকে চলে, কতকিছু, যার বেশিরভাগ কথা মোরশেদ শোনেই না। ফাহমিনার গোপন আনন্দ উপভোগ করে মোরশেদ। ওদিকে গান ভেসে আসছে। নিম্নবর্নের মুসলিমরা একসময় সুফি ফকিরদের হাত ধরেই ইসলাম গ্রহন করেছিল। তাই লোকাচারে মেলে সুফিয়া না। এই সব সাধারণ মানুষ অভিজাত আশরাফদের থেকে অনেক দূরে থাকে। পঞ্চবেনা বা ইমামকে মানে কিন্তু সাধারণ লৌকিক ঐতিহ্যই এখানে বড়। এসব কোরান মেপে হয় না। এসব সংস্কার বাঙালির নিজের। গায়ে-হলুদ, তেল ঢালা, সোহাগ দেওয়া, সোঁদা, ঢেঁকি মাংলানো, কড়ি খেলা, নিশানি বা ক্ষীর খাওয়ানো আর কোথাও মুসলমানদের মধ্যে আছে কিনা মোরশেদ জানে না। কিন্তু আজকাল সব বদলে যাচ্ছে যেন। কম বয়েসিদের মধ্যে বেশি যেন। শাস্ত্র তাদের কাছে মাটির থেকে বেশি পছন্দের। মোরশেদ বোঝেনা কি হতে চলেছে সামনে। অনেকেরই চোখ মুখ যেন বদলে যাচ্ছে। মোরশেদকে এড়িয়েও যাচ্ছে এরা। বড্ড কট্টর হয়ে যাচ্ছে কম বয়েসিরা। হিন্দুরাও হচ্ছে। এসব কথা যত ভাবে ভাববে না তত মনের মধ্যে কোথাও একটা যন্ত্রণা হয়। ভাইটা বেঁচে থাকলে কি এদের মতো হয়ে যেত? কিন্তু শুধু তো কম বয়েসি নয়। উস্কাচ্ছে কারা? তারাতো কেউ কম বয়েসিও নয় আর অসহায়ও নয়।

    একটু বাদে গোসল করে ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ি গেল ফাহমি না। উত্তর পশ্চিম কোণের আলাউদ্দিনের বাড়িতে ছাগল খুঁটিতে বাঁধা। কুকুর দুটো গা ঘেঁষে অদ্ভুত মুখ করে বেড়িয়ে গেল। যেন হাসল। ছাগল দেখলে আজকাল কুকুরেও কিছু বলে না। কুমারবাবা আর পঞ্চায়েতের উদ্যোগে অনেকেই পুষছে। বাংলার কালো ছাগল। পাশের গ্রামে হিন্দুরা তো কতদিন ধরেই পোষে। ও নিজেও পুষবে বলে ভাবছে। দুধ ছাড়াও মাংস, চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যায়। ঘাস পাতা আর ঘরের ফেলে দেওয়া খাবার থেকেই ওগুলোর হয়ে যায়। ছাগলে কিনা খায়। পোষা সহজ, লাভজনক। কো-অপারেটিভটা দাঁড় করাতেই হবে। পঞ্চায়েত আর ব্যাঙ্কেও সারা পাওয়া গেছে। নিজেদের উৎপাদন শুধু ছড়িয়ে দিতে হবে জায়গা মতো। সেইটাই সব থেকে কঠিন কাজ। প্রথম প্রথম মানুষকে বিশ্বাস করানোটা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু কুমারবাবা কলকাতায় অনেক যোগাযোগ করছেন। দিলুদাও করেছেন কিছু। সব মিলে একটা ভালো কিছু দাঁড়িয়ে যাবে বলে ওর বিশ্বাস। ভরা গরমে এদিকের কাজ কমে গেছে এমনিতেই। ছেলে হাঁস মুর্গী এমনিতেই প্রতিদিন কিছু না কিছু বিক্রি হচ্ছে। হাঁস মুর্গী যাই বল ছেলে হাঁস অর্ধেকের একটু বেশীই জন্মায়। মানুষেরও নাকি তাই। ছেলেদের মাংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কাজ নেই। মনে মনে ভাবে, বেশিরভাগ ছেলেগুলো যেন জন্ম আহাম্মক। মরতেই যেন এসেছে, মউমাছিরও তো তাই। মনে পড়ল হঠাৎ, আপনজনে মউপালনের কাজ শুরু হবে সামনের শীতে। আজ বিকেলেই মিটিং আছে। সেখানে সামনের দিনের কর্মসূচি নির্দিষ্ট হবে। কোন জমিতে কি ভাবে কে দায়িত্ব নেবে সে সব। মাস্টারমশাই থাকবেন, মৌলবি সাহেব থাকবেন আরও সমাজের মান্য গণ্য কয়েকজন আসার কথা। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে মনে একটা কোথাও অস্বস্তি হয়। সামনের বছরে এমন সময়ে বিধানসভা ভোটের সময়। প্রত্যেকবারের মতোই এই সময় কিছু কাজ নিঃশব্দে হয়ে যায়, যার আঁচ ঠাহর করা যায়না প্রথমে। আরও বড় রকম মন খচখচানি হয় কম বয়েসি ছেলেগুলো যেন চাকরি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না দেখে। কম বয়েসিদের টানতে না পারলে কতদূর এ উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে কে জানে। ওদের কথাও ফেলে দেওয়ার নয়। মুসলমানরা বিভিন্ন কারণেই তো নিজেদেরকে খুঁজেই পায়নি কখনো। খুঁজতেও দেওয়া হয়নি। নিজেদের খুঁজে না পাওয়াটাতোই তো তারা ব্যবহৃত হয়ে যায়।

    সারাদিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা মোরশেদের মনে আসে যেন। ফাহমিনা কাল রাতেই বলছিল সে এত কেন ভাবে। ও হেসেছিল আর বলেছিল বয়েস হলে ভাবনা বাড়ে, তারপর বউয়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিল অন্ধকার ঘরে ছাদের দিকে। মিনা ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভালো মেয়ে মি না। ওর মতোই গ্রাজুয়েট আর ওর মতোই সোজা সাপটা, সাধারণ। বড় ঘরের মেয়ে, এক বাক্যে চলে এসেছিল ওর কাছে। কিই বা দিতে পারলো ওকে। তাও একা হাতে সামলে রাখে কত কিছু, হাসি মুখে। মিনা আছে বলেইনা ওর জীবনে এত ওঠাপড়ার মধ্যেও আশা হারায়নি কখনো। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেখে একটা হাঁস বেড়িয়ে পড়ে রাস্তার দিকে এগোচ্ছে। সে ওটাকে ধরবে বলে এগোয়। ধান গাছ ধরা হাতে এখন হাস মুরগি ধরতে হচ্ছে। তাল রাখতে গেলে কত কিছু করতে হয়। মোরশেদ ধরে ফেলেছে হাঁসটাকে। হাঁস ধরতে গেলে হাতে লাগে। হাঁসের গা বড় খড়খড়ে। কাঁটার মতো বেঁধে। মুর্গীর গা নরম। যেমন ধানের গাছ খসখসে আর আলুর পাতা নরম।

    সোহাগি গান ভেসে আসছে পাশের বাড়ি থেকে —

    সোহাগ মানাণী চাহিরে, খোদা রসুল দরবার
    সোহাগ মানাণী চাহিরে, পাঁচ--পীরের মাজার
    সোহাগ মানাণী আব্বা--আম্মা আপেনা সোহাগ
    সোহাগ মানাণী চাচি--খালা আপেনা সোহাগ
    সোহাগ মানাণী বুবু--ভাই আপেনা সোহাগ
    সোহাগ মানাণী চাহিরে, খোদা রসুল দরবার
    ।।২০।।

    আরও বেশ কিছু দিন যায় কিন্তু সেই একই রকম, দিলুর কোন সময় নেই আর বেদোর কোন কাজ নেই। বেদোর সময় কাটে কি কাটে না সে নিয়ে বেদোর মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু শিউলির সময় যেন কাটেই না। দিলু কলকাতায় রয়েছে কাজ নিয়ে। বেশ কয়েকদিন হল। সেখানে ওর একটা টিম তৈরি হয়েছে। এদিকে শিউলি একা। তবে বেদো কখনো কখনো আসে। গল্প করে। বেদোর কথা বলার ধরনই এমন যে যাই বলে বেশিরভাগই যেন নির্ভেজাল আনন্দ দিয়ে যায়। কার না কার টোটো নিয়ে এসে সেদিন বেদো ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে আশপাশের গ্রামগুলোর ভেতর। হয়তো বুঝেছিল বউদি একা থেকে থেকে মন খারাপ করে ফেলছে। গ্রামের জীবন ও রূপ এত কাছাকাছি দেখে নি আগে। সেদিন দেখেছে বিঘের পরে বিঘে নার্সারি-- ফুলের, ফলের। ওই অঞ্চলের নার্সারি খুব বিখ্যাত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চারা, বীজ, গাছ এদের এখান থেকে যায় একথা আগেই শুনেছিল। দেখেছে আমের বাগানে জোর কলম পদ্ধতি। বর্ষা কালেই কলম ভালো হয়। কত বছর ধরে যে কলমের গাছ বানায় মানুষ কে জানে। দুটো ডালকে জুড়ে দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে শেকড়। নতুন শেকড়। মানুষ কি না করে। ছোটো ছোটো কলমের গাছ অথছ তারা আসলে কিন্তু অনেক বয়েসের গাছের অংশ থেকে তৈরি। মাটিতে নতুন করে শেকড় গজানোর পরে তাদের কচি বলা যাবে না বুড়ো বলা যাবে কে জানে! বিঘের পর বিঘে চাষ জমি দেখিয়ে নিয়ে এসেছে বেদো। দেখিয়ে এনেছে আদিবাসীদের গ্রাম। দেখেছে কেউ কেউ খ্রিস্টান হয়েছে কিন্তু তুলসি তলায় প্রদীপ দেয় তারাও। যদিও পাড়ার লোক তাদের এক ঘরে করেছে। বেদোর কি সব বন্ধু বান্ধব আছে সব জায়গাতেই। আদিবাসীরা নাকি হিন্দুই নয় এমন আন্দোলনও চলছে আজকাল। তাদের ধর্ম নাকি আলাদা। তারা নাকি সারি। সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডা, মাহালি জনজাতির লোকেদের আদি ধর্মের নাম 'সারি' বা ‘সারনা'। তারা নাকি কোনদিনই হিন্দু ছিল না। কিন্তু তবুও ওরা নিজেরা দুর্গা, সরস্বতী কালি সব পুজোকেই আপন ভেবে এসেছে।

    বেদো মনে হয় ওদের গ্রামে ঢুকে এক পাত্র চরিয়ে এসেছিল। কারণ খুব সুখ্যাতি করছিল ওদের মদের। আর হালকা একটা গন্ধও টোটোর পেছনে আসছিল মাঝে মাঝে। টোটো চালিয়ে সে কি আনন্দ বেদোর। তার ওপরে শিউলির মতো একজনকে সেই বাহাদুরি দেখানোর সুযোগ। তার মনের গল্প বেড়িয়ে আসছিল একেক করে। ছোটবেলায় এসব জায়গায় দিলুর সঙ্গে কত এসেছে, সেসব নাকি আরও অন্যরকম ছিল। রাস্তাঘাট মোটে গাড়ি চলার মতো ছিল না। ট্রাক্টর চলত তখন। আর কিছু না। দিলুর সঙ্গে কি কি করেছে এসব কথা বলার মধ্যেই বেদো সব থেকে আনন্দ পায়। অন্য কিছুতেই তার চোখ মুখ তেমন ঝকঝকে হয়ে ওঠে না। বেদো শিউলির জীবনে যেন এক সরল বাতাস। হোক সে মাঝে মাঝে কুশ্রাব্য। বেদো এমন একজন যার সঙ্গে মেলে না কিছুই, যাকে কিছুই বলা যায় না, কিন্তু যে থাকলে হালকা লাগে। যেন সে হালকা হয়ে যায় ওই জলের ফোঁটার মতো। যে ফোঁটাগুলো মেঘের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেমে আসছে পৃথিবীর টানে। নেমে আসছে দলে দলে আর নিয়ে আসছে বর্ষা।

    কিন্তু এই বর্ষায় শিউলি যাবে কোথায়? এমন তো কথা ছিল না। তার তো ভেজার কথা ছিল কৃষ্ণকায়, ভারী হয়ে আসা আকাশের নিচে। একা নয় তার মনের মানুষের সঙ্গে। একসঙ্গে। তার যাওয়ার কথা ছিল হয়তো দূরে নয়, কিন্তু অচেনায়। চেনা যায়গাই যে অচেনা হয়ে যায় মনের মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তার তো শুরু হয়েছে অপেক্ষা। কবে থেকে যে সে এই অপেক্ষা করে আছে নিজেই তা ভুলে গেছে। আনমনা সে ভুলে যায় -- কে সে। কোথায় আছে, কেমন আছে। সে যেন খোদাই করা অপেক্ষারত পাথরের মূর্তি, কবে থেকে সে আছে এভাবে কেউ জানে না। তার আজকাল মন খারাপ হয়, সে নিজেই বোঝে। অথচ তার এমন হওয়ার কথা ছিল না। সে যতদিন আশাহীন ছিল ততদিন তার মনের কোন খারাপ থাকা ভালো থাকা ছিল না। আশায় বাঁচতে গিয়েই দেখছে সে যেন কিছুই পাচ্ছে না। প্রথম বর্ষায় আজ সারাদিন সারারাত একা থেকেছে। হয়তো সামনের কয়েকদিন আরও থাকবে। কি করবে সে। সে কি হারিয়ে যাচ্ছে নতুন করে। সে কি সত্যি খুব বেশি চাইছে? কিন্তু কি এমন বেশি চাইছে? দিলু ওকে কেমন ভাবে দেখছে এখন? দিলু ভবিষ্যৎকেই বা কেমন ভাবে দেখছে, কেন সেসব নিয়ে কোন কথা বলে না। কেন কোন কথা বলে না। দিলুর কি ওকে পাওয়া হয়ে গেছে।

    শিউলি আজকাল গান করে একা একা। তার কাছে সুরগুলো গলায় নয় কেন যেন ধরা দেয় শরীরে। সে নিজে কেমন গায় সে সব বিচার করে গান গাইতে চায় না। সে তো আর কাউকে শোনাতে যাচ্ছে না। সুরগুলো তার কানে আসে সেগুলো যেন তার অন্তরঙ্গ কথা। যেন পাশে পাশে আছে, সঙ্গে সঙ্গে আছে। তাহলে সঙ্গীত কি ভ্রম? হতে পারে। এই সৃষ্টি, এই অস্তিত্ব, এই সম্পর্ক আর এই জীবন, কোনটা ভ্রম নয়। সেই ভ্রম নিয়েই তো বেঁচে থাকে মানুষ। সামনে যা দেখানো হয়, যা ভাবানো হয় সেও তো একরকম ভ্রম। মানুষ মাত্রেই ভ্রম নির্ভর। বিজ্ঞান এই ভ্রমের রহস্য সমাধান করে যায়। একটু একটু করে। কিন্তু সে বড় ধীরে। এতটাই ধীরে যে এক রহস্য সমাধান হতে হতে আরও হাজারো রহস্য এসে তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু সেখানেই মজা, সেখানেই খেলা, সেখানেই আনন্দ। শিউলি তাই নিজের মতো করেই এই ভ্রমে জড়াতে থাকে। তাকে কবিতা যেমন অপার্থিব রূপ চেনায় সুরও চেনায়। কখনো কখনো সুর ধ্বনির বাইরে বেরিয়ে আসে, সুর যেন তখন মুক্ত হয়। সেই সুর যেন মনের ভেতর বইতে থাকে। সে সুর কোন গান নয়, সরোদ বা বাঁশির সুর নয়, সে সুর পাখির কলকাকলি বা নদীর স্রোতও নয়। সে যেন সেই কণার মতো যে কণা জড়ো করে এই শরীর তৈরি হয়েছে। প্রাচীন, নিশ্চিত অথচ সঞ্চরণশীল। মাটি, বাতাস জল আর শরীরে যা চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায় তেমনই কিছু। সে অনুভব করে। এই বর্ষার দিনে সে অনুভব করে আসলে জলকণা আর তার নিজের মনের ভেতরে অনুরণিত হওয়া সঙ্গীত আবর্তিত হতে হতে মুক্তির কথাই কেবল বলে। যা কিছু মুক্ত তাই বিমূর্ত। তাই সে অনুভূত, কিন্তু বর্ণনার অতীত। সে যখন মুক্ত তখন সে নির্বিকার, উদাসীন। তার ধ্বংস নেই, সৃষ্টি নেই। তার মনও নেই তাই মনে বাঁধা পড়াও নেই। কিন্তু সেই বিমূর্তকেও তো প্রকাশ পেতে হয়, হয়তো নিজের অজান্তেই। তখন তার একটা মন লাগে। মনের মতো মন। সেই মনের যদিও কোন রূপ নেই। কিন্তু একটা অস্তিত্ব আছে। সেই মন আস্তে আস্তে জমতে থাকে নিজেকে কেন্দ্র করেই। সুরের পরে সুর বেঁধে চলতে থাকে তার প্রকাশ। তখন মনের বাইরের এক রূপের প্রয়োজন হয়। সুর যখন রূপ পেতে চায় তখন সুর আকার ধরে। সে তখন গলায় আসে বা মনের ভেতর বা বাঁশি বা গিটারে, যা দিয়ে তাকে ছুঁতে পারা যায় তা তা দিয়েই। শিউলি মিলিয়ে দেখেছে এভাবেই যেন ধরা যায় তাকে। নইলে যায় না। কোন কিছুই যেমন সরলরেখার মতো হলে একে অপরের থেকে আলাদা করে বোঝা যায়না তেমনই সুরকেও কল্পনা করলে সে সরলরেখার মতো নয়। সে তাই হয়ে ওঠে আঁকাবাঁকা রেখার আঁচড়। সে আঁচড় ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে নিজে ভরাট করতে করতে আসলে হয়ে যায় সেই ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ বা বহুভুজ। সেখান থেকে এক শরীর। তারপর কখন যেন বন্ধু হয়ে যায় আর শিউলির সঙ্গে ঘুরতে থাকে, পাশে পাশে। এঘর থেকে ওঘরে। বারান্দা থেকে রাস্তা পেরিয়ে দূরে দূরে। দূরে যখন সে বিস্তৃত তখন সে হয় অন্যরকম। যেন সে শিউলিকেই আগলে রাখে। তার কোলে মাথা রেখে ছোট্টো শিউলি ঘোরে বা হয়তো কাঁধে চেপে বড়বড় কাজল মাখা চোখে চারদিক দেখতে থাকে। সেই তাকে চেনাতে থাকে এই পৃথিবী। এই পৃথিবীর মায়া আর গন্ধ। কিন্তু কেন যেন মনে হয় এই সুরেও শুধুই কান্না জড়ানো। কান্না, বিরহ, বেদনা একাকার হয়ে গেছে। কান্নাতেই যেন এর প্রকাশ। কেন এমন হয়। সুর কেন কাঁদে? ভারতীয় রাগ রাগিণী কেন কান্নার মধ্যে দিয়ে কথা বলে। নাকি এ তার নিজের অনুভূতি। সেকি তার নিজের মনকে সুরের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে পেতে চাইছে তাকেও? নাকি সত্যি সত্যি? বিরহ কি ভ্রম নয়? সেই কি সত্য আর অলঙ্ঘনীয়ভাবে ধ্রুব? বর্ষার জলকণাগুলোর মধ্যে যে সঙ্গীত সেখানে কেন বিরহ তীব্র? মানুষ যদি এত হিংস্র জাতই হবে তাহলে তাদের মধ্যে সঙ্গীতের মতো এত পেলব সৃষ্টির সঞ্চার হল কি করে? নাকি এও হিংস্রতার সঙ্গে একসঙ্গেই বড়ো হয়, ঘুমিয়ে থাকে পাশাপাশি আর মাঝে মধ্যেই প্রয়োজন মতো বেড়িয়ে এসে তার রূপ ধারণ করে। শিউলি ভাবতে থাকে অবিচ্ছিন্ন ভাবে। সে যে ক্রমাগত ভাবছে সে বোধ তার থাকেনা আজকাল। সে কেমন করে সময় কাটায় সেকথা মাঝে মাঝে সে লিখে রাখে। আবার রাখেও না। যেখানে সে কিছুই লিখে রাখে না সেখানে তারা থেকে যায় তার লেখার খাঁটায় অসঙ্গতি হয়ে। কিন্তু এই না লেখা বা তার চারপাশে এই না হওয়া, না দেখা বা না বোঝাগুলো এসব তো থাকবেই। সেই অসঙ্গতি আসলে প্রকৃতিরই তৈরি করা। তাই সে নতুন করে লিখতে শুরু করল আবার। তার অসঙ্গতির খাতা যদি পড়া যায় আজ থেকে যা ঠিক প্রথম দিন নয়, কোনো একটা দিন তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি --

    দিন ১

    অসঙ্গতির শুরু পৃথিবীর জন্মমুহূর্তে, হয়তো সূর্যের দিকে সেই পৃথিবীর হেলে থাকার মধ্যেই। সেখানেই ঠিক হয়ে গেছিল বিধান। কেউ বেশি আলো পাবে আর কেউ পাবে না। সব্বাই সমান ভাবে সবকিছু যেন পেতেই পারে না। আলো বা রাত আর দিন শুধু নয়, উষ্ণতা, জল, বাতাস, সবুজ প্রভা, আনন্দ, বিরহ আরও কত কি। তাই কি পৃথিবী জুড়ে এত রঙ? কে জানে? সুরের মধ্যেও নাকি অসাম্য আর সেখানেই নাকি সৌন্দর্য। এক একটা স্বরের সঙ্গে অন্য একটা স্বরের শক্তির অসাম্য। কিন্তু অসাম্য যতই থাকনা কেন প্রবল শক্তির স্বর আর ক্ষীণ শক্তির স্বর সব মিলে তৈরি হয় অনুভূতি। পূর্ণ অনুভূতি। সাত রঙ যেমন মিলে গিয়ে সাদা রঙ তৈরি করে তেমন সাত সুর মিশে গিয়ে তৈরি হয় সা এর স্বর। তাইতো সা তে ফিরে আসতে হয় বার বার। এক একটা রাগ রাগিণীর সা এক এক রকম হয়ে যায়। আর আছে নীরবতা। যা না থাকলে স্বরও হয়ে যায় ম্লান। সুরের পাশে নীরবতা আলোর পাশে অন্ধকারের মতো।

    দিন ২

    সুরের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে সুর স্বাধীন আর ছন্দ যেন মুক্তিহীন যন্ত্র। সে চায় সুরকে বেঁধে রাখতে নিজের মতো করে। যতক্ষণ সুরের সে বন্ধন ভালো লাগে ততক্ষণ সে থাকে তালের সঙ্গে, যখন ভালো লাগে না সে আর থাকে না। ছন্দ যেন এই দিন রাত্তির, বছর, জোয়ার ভাঁটার মতো নিয়মনিষ্ঠ আর সুর যেন এক একটা ছন্নছাড়া মানুষ। সে আসে যায় কিন্তু কেন আসে যায় কেউ জানে না। কেন মনে হয় সাধারণ মানুষের জন্য ছন্দ খুব জরুরি কিন্তু যিনি বন্ধনহীন তার কাছে সুরই একমাত্র অভীষ্ট। দলের জন্য তাল আর একার জন্য সুর। তবে কি এই মনে ছন্দ নেই? নিশ্চয়ই আছে। হৃদয় স্পন্দনে আছে, চলাফেরায় আছে, কথা বলায় আছে কিন্তু ছন্দকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেন যাওয়া যায় না। ছন্দ বিমূর্ত হয়ে উঠতে পারে না।

    দিন ৩

    এখন এই ভারী হয়ে আসা সন্ধ্যের ডানায় ইমনের তীব্র মধ্যমের মুর্ছনার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। সেই তীব্র মধ্যম যা নিজেই নাকি ইমনের কারিগর। তার ওপর ভর করে এই সন্ধ্যে এবং আরও কত কত সন্ধ্যে ভেসে যাবে এই বিশ্বে। ন র গ ম প ম গ র স। ম কে ঘিরে আন্দোলন না ম নিজেই এই আন্দোলনের সৃষ্টি করছে তার উত্তর খুব কঠিন। তীব্র হয়ে ওঠে অতি তীব্র সেই ম। রক্তে রক্তে রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে ঢুকে পড়তে থাকে। ঘুরে ফিরে সেখানে আবার খুব কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। সেখানেই তার অসহায়তা আবার সেখানেই তার মুক্তি অপেক্ষা। সে আশারও সঞ্চার করে, সে পথ চেয়ে অপেক্ষা করায়, সে আবার পথেও নামায়।

    দিন ৪

    ভালোবাসা আমার। তুমি কি আমায় পরীক্ষা নিতে এসেছ? এই মাঝরাতে। তোমার গায়ের গন্ধ আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি এসে বসেছ আমার পাশে, আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছ আদর করে। আমি চোখ বুজে আছি। শুধু স্পর্শে তোমায় চেনা যায় আর অস্পর্শে তোমায় অনুভব করা যায়। তাই কি চাইছ তুমি?

    দিন ৫

    ভোরবেলা একটু ঘুম এসেছিল। আমি দেখলাম এক কিশোরী মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে করে ক্লান্ত হয়েছে। তারপর সে দেখল একসময় মা তার সঙ্গে কথা বন্ধ করেছে। অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে মেয়েই আর পারছে না। তার মনে দুঃখ হল। কেন তার মা কথা বন্ধ করেছে!। তখন সে আবার মাকেই জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে মা কথা বল, ও মা কথা বল, কথা বল। সে বলেই চলে আর কাঁদে। মা কথা বলে না। সে আরও কাঁদে। কেন জানি না এই দৃশ্য মনে এল। তার পর সারদিন ধরে আমি কাঁদলাম। শুনলে তুমি? জান তুমি কেন এ স্বপ্ন আমি দেখলাম? সারাদিন ধরে আমি কাঁদছি। শুনতে পাচ্ছ তুমি? আমার কথাগুলো আর সুরগুলো এমনকি বইয়ের অক্ষরগুলোও সব কান্না হয়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছ তুমি?

    দিন ৬

    সারাদিন বৃষ্টি, সারাদিন তুমি আর সারাদিন তোমার অপেক্ষা। কোথাও কেউ নেই, কোন দৃশ্য নেই, সব ধোঁয়া। কোন অতীত নেই, কোন ভবিষ্যৎ নেই। জীবন নেই। তাই মৃত্যুও নেই। কেন এমন হচ্ছে বল তো? তুমি জানো এখন ওরা আমার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের কি পরিচয়? তারা বলল কাফি। আমি বললাম — তোমরা বেশ সহজ, খুব নিজের। তারা বলল — বৃষ্টির জল যে সহজ। তাই আমাদের তো সহজ হতেই হয়। আমি বললাম আমি কি সহজ? তারা বলল — আমাদের কাছে সবাই সহজ। সত্যি বলতো তুমি আমি কি সহজ নই? আমাকে তোমার খুব জটিল বলে মনে হয়? দেখ কথায় কথায় আজকাল আমার কান্না পায়। সহজ না হলে হত? দেখ, ওই আবার শোনা যাচ্ছে। এখন গান হয়ে — 'পিয়াতো মানত নাহিঁ। অব কওন গুণন সে মানাউঁ'। দেখ, ওরা তোমার কথাই বলছে। জানে এই গান শুনলে আমি কষ্ট পাব। তাও ওরা এমন ভাবেই গান গাইবে। কেন বলতো আমি কি অপরাধ করেছি? ওই দেখো কাফি এখন আস্তে আস্তে মিয়াঁমল্লার হয়ে যাচ্ছে।

    দিন ৭

    দিন সাত মানে দিন সাত নয়। মাঝে দুদিন লিখিনি কিছু, জানি না কেন লিখিনি। কিন্তু আসলে লিখেছি, তোমায় চিঠি। আমি জানি তুমিও আমায় কোনদিন লিখবে। যা আমি যত্ন করে রাখব। বারবার করে বার করব, আর পড়ব। আবার রেখে দেব সিন্দুকে। আগলে, চাবি দিয়ে। কেউ যার নাগাল পাবে না। তুমি কাল বহুদিন বাদে ফোন করে বলেছ আরও দেরি হবে। হোক। সময়তো অসীম। আমি সময়ের শাসনে মোটেও ভয় পাই না। কারণ সময় এখন সঙ্গীত হয়ে গেছে।

    দিন ৮

    আমার আজকাল না খেলেও হয়। আমি জানি আসলে আমি অণু পরমাণুগুলোকে পুষতে শিখছি। তাদের গ্রাস করতে নয়।

    দিন ৯

    বোঝ না? যেকোনো একটা মেয়ের নামই শিউলি হতে পারত। হয়ও। এই একলা ঘরে বসে বসে শিউলি বলে মেয়েটা কি সেই যে কোনো একটা মেয়ের খোঁজ করে চলেছে? আচ্ছা ঠিক আছে সে নয় বসেই থাকবে এইখানে বা অন্য কোনখানে। কিন্তু এই সময়কে সে কাছছাড়া করবে না। এই খুঁজে যাওয়াই তার দোলাচল। সে এই দোলাচল নিয়েই জীবন দেখেছে। সে কি করবে? সে কেন অন্যরকম হল? এখানে কি তার নিজের খুব হাত ছিল? সে জানে ছিল না। সে যে সাধারণ। অপরূপের খোঁজে সে কি করবে? সে বিস্তার চায়নি কখনো। সে চেয়েছে গভীরতা। সে আকাশ হতে চায়নি, সে চেয়েছে শিশির বিন্দুর সাধ না। কিন্তু এই অসীম বা এই ব্যাপ্তি কেন সে এত সর্বগ্রাসী? সে কি শিউলিকে তার মতো থাকতে দেবে না? এই সুর, এই কবিতা এই জীবন সবাই কি অসীম হতে চাইছে? যদি চায়ও তাতে ওই শিউলি বলে মেয়েটার কিছু এসে যায় না। সে এমনই থাকতে চায়। যদি হারিয়ে যায় সেও ভালো কিন্তু সে বদলাতে পারবে না। সে অণু পরমাণুতে খুঁজতে চায় বন্ধনের রহস্য। প্রত্যেক মুহুর্ত অনুরণিত সুরের মতো সে ঢুকে পড়তে চায় বন্ধনের গভীরে। সে জানে গভীরতার সত্য অসীম। বিস্তারহীনভাবে অসীম। সে নিশ্চিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের মধ্যে যা ঘটে তাই ঘটে এই ব্যপ্ত মহাকাশে। একই ভাবে। তাকে জানতে হবে এই অণু পরমাণুকে। সে নিজে যদি সুর হত তাহলে এই কাজ হয়তো তার সহজ হত।

    “ভাণ্ডেতে দেখে ব্রম্ভাণ্ড দেখে দিপ্তকার বশে
    খেপা মনরে চৈতন্য চাঁদের উদয় হয়েছে যার হৃদয় আকাশে।”
    কিন্তু দিলু বলে যে ছেলেটা আছে সে চাইছে বিস্তার। সে তার দোষ নয়। সে তার নিজের পথ, সেখানে তার সিদ্ধি হোক সেই তো শিউলি চাইবে। কিন্তু তাহলে কি তারা একসঙ্গে পথ চলতে পারবে? দিলু কি মনে মনে ভাবছে সে কথা তার নিজের জন্য জানা দরকার। এভাবে দুই আলাদা পথ নিয়েও তো একসঙ্গে দিব্যি থাকা যায়। শুধু ভালোবাসা দিয়ে কাছাকাছি থেকে। কেন? ওই ছোট্ট পাখিটাকে আকাশ নিজের বুকে রাখেনা? তারা দুজনেই তো আনন্দ পায়। দুজনেই ভালোবাসে দুজনকে। ডানায় লাগে আকাশের আহ্লাদ। আকাশে লাগে ডানার পেলবতা। সে কি দুজনের মধ্যে দুজনের মুক্তি নয়? দিলু আকাশ হোক শিউলি বলে মেয়েটা তা নিজেই চায়। দিলু বলে ছেলেটাও কি শিউলি বলে মেয়েটার মতো ভ্রম?

    দিন ১০

    নাগো আমি পাগল হয়ে যাইনি। পাগল হওয়া আমার হবে না। হলে তোমাকে দেখতে আমি নেমে পড়তাম পথে। সে শক্তি এখনও আমার নেই। কিন্তু তোমার মুখটা আমি মনে করতে পারছি না কেন। মোবাইল ফোনে যে ছবিগুলো আছে সেগুলো দেখতে ইচ্ছে করে না, চোখ বুজে দেখতে ইচ্ছে করে যে। চার্জ না দিয়ে সে ফোনও মনে হয় আর খুলবে না। আমি এখন শুধু বসে থাকি, এই বিছানায়। খাতা কোলে নিয়ে, বৃষ্টির তো শেষ নেই। সারাদিন সে বয়েই চলেছে আমার প্যানপ্যানানির মতো। বারান্দায় যে ফিঙ্গে পাখির বাসা হয়েছে সেখানে ওরা ভিড়তে দেয় না মোটেও। আমিও তাই যাই না জ্বালাতে। আমি ওদেরকে ছেড়ে দিয়েছি ওদের জমি। আমি যা ভাবি কিছুই লিখতে পারছি না। শক্তি এখনো আছে, তুমি এলে আমি এখনও দরজা খুলতে যেতে পারব। ঠিক পারব। তুমি তো জানো এখন এভাবেই আছি আমি। যা আছি তাকে থাকতে দাও। যা আসছে তাকে সেভাবেই আসতে দিলে সে হয় খাঁটি, যতই সে সহজলভ্য হোক। আমি তোমার সহজলভ্য কিন্তু সেই তো আমার গৌরব। দেখ এই অগোছালো লেখা, এলোমেলো চিন্তা আমায় কেমন চিনিয়ে দিচ্ছে আমায় আমার কাছে। আজ মনে হচ্ছে তুমি, আমি, সুর সপ্তক, মন, এই বৃষ্টিস্নাত পৃথিবী, এই সময় কেউ আলাদা নয়। কেউ আলাদা নয় বলেই আমি এমন টান অনুভব করছি। যেন সে নাড়ির টান। আমি জানি তারাও আমার জন্য টান অনুভব করছে। আমিও যে আছি তারা জানে। তুমি দূরে বা কাছে আছ সে কথা আর বড় কথা নয়। তুমি আছ এই তো যথেষ্ট। পাগলটাকে সেদিন নার্সারিতে দেখেছি। সে একলা পাগল যার জন্য আমি কিছু করতে পারিনি। পাগলটা নার্সারিতে কি করছিল কে জানে!

    তুমি কি ডাকছ? দরজায় কি তুমি এসে দাঁড়ালে? আমি উঠতে পারছিনা যে, তুমি এসো তোমার তো দরজা লাগে না।

    #

    কতদিন কত সময় কেটে গেছে শিউলি ঠিক জানে না। সে আচ্ছন্ন না জেগে আছে সে বোধ নেই। কোনও রকমে শরীরটাকে দরজা পর্যন্ত টেনে আনতে পেরেছে সে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে বেদো। অস্ফুটে বলে ওঠে — একি চেহারা করেছো বউদি।

    #

    বৃষ্টি যেন থামতেই চাইছে না। দিন রাতের তফাতও যেন বোঝা যায় না। যেন দিনের পর দিন বা রাতের পর রাত বৃষ্টি চলেছে। প্রথম প্রাণ সৃষ্টির সময়ের মতো যেন। বৃষ্টি অক্লান্ত, অবিশ্রান্ত। এই দিনে সে কোথায় যাবে। তার যাবার কোন জায়গা নেই। সূর্যশেখরের সব কিছু বদলে গেছে। সে কথা কেউ নাই বা জানল। দোষ হয়তো তারই। সে যে কিছুই মানাতে পারে না। তাই তার ঘরও নেই তার বাইরেও নেই। সে আসলে কোথাও নেই। কবে থেকে যে সে ধীরে ধীরে একা হয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। সে যেহেতু কিছুই মানাতে পারে না তাই তাকেও কেউ মানিয়ে নিয়ে থাকে না। একজন কেউ দলছুট কেন হয়ে যায় সে নিয়ে কোন দলই বেশি মাথা ঘামায় না। কারণ দল নিজে তো দেখে সংখ্যা। সবাই কোয়ান্টিটিকে নিয়ে চিন্তিত কোয়ালিটিকে নিয়ে নয়। যে দলছুট সে নাকি অহংকারী। উল্টোদিকে দলছুটও বোঝাতে যায়না আসলে এমনটা নয়। সারা পৃথিবী যেখানে এক রকম করেই ভাবতে শিখছে সেখানে সে কাকে বোঝাতে যাবে? যা হবার তাকে আটকানোর ক্ষমতা তার অন্তত নেই। যখন সব ঠিকঠাক চলছে তখন আসলে বোঝা যায়না তফাৎ। যা নিয়ে ভালো ব্যবসা হচ্ছে তা ছাড়া বাকি সব কিছু বাড়তি, অদরকারি, অচল। সমস্ত পৃথিবী যেন একটা মনোকালচারাল সোসাইটি তে পরিণত হতে চলেছে। সারা পৃথিবীর মানুষ শুধু একইরকম পোশাক পরবে, একই রকম খাবার খাবে, একই দেখতে আপার্টমেন্টে থাকবে, সামাজিক মূল্যবোধগুলোর গঠনও একই রকম হবে, পারলে ধর্মও থাকবে একটাই। সে ধর্ম হবে মানবতার বা মনের নয়, বহিরাচরনের ধর্ম। বিশ্বস্ততার মানদণ্ড হবে অর্থ। ধর্ম আর অর্থ দুটোই আর্টিফিসিয়াল সিস্টেম, মানুষের তৈরি করা। কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেশ বিদেশের মানুষের সংস্কৃতি আর অন্যান্য পছন্দ অপছন্দ আলাদা রাখার উপায় ছিল। ধর্মও তো আসলে ছিল সংস্কৃতিই। কিন্তু বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী বাণিজ্য ও প্রযুক্তির বিপ্লব মানুষকে একপ্রাণ করার বদলে করে দিচ্ছে ক্লোন। অসংখ্য রক্ত মাংসের রোবট যেন। যাদের মাথায় জন্মের আগে থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এইটা এইটা আসলে ভালো জিনিস আর এইটা এইটা হল খারাপ। যাদের নিজের কোন বেছে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা দল বেধে হাসে, দল বেঁধে কাঁদে, দল বেঁধে মারে, দল বেঁধেই আবার মরে যায়। কোন কিছু না বুঝেই। যারা এরকম হতে পারছে না, যারা বদলাতে পারছে না তারা ছিটকে যাচ্ছে দূরে। হারিয়ে যাচ্ছে চিরকালের মতো। সে নিজেও হারিয়ে যাচ্ছে জানে। যেমন করে পৃথিবীতে হারিয়ে গেছে একে একে আরও অন্তত পাঁচ প্রজাতির মানুষ। আর মানুষের জন্যই হারিয়ে গেছে কত হাজার অন্যান্য প্রজাতি। তারা এক সময়ে সবাই ঘুরে বেড়াতো। লড়াই ঝগড়া করে হোক, কষ্ট করে হোক, আনন্দ করে হোক তারা এই পৃথিবীতে ছিল। আজ নেই। এই পৃথিবীতে এখন শুধুই মানুষ। মানুষ তার জীবন সহজ করার জন্য একেকটা বিপ্লব এনেছে আর নিজের দিকেই বন্দুক চালিয়েছে। বারো হাজার বছর আগের কৃষি বিপ্লব, দুশো বছর আগের শিল্প বিপ্লব, আর এই সময়ের বৈদ্যুতিন বিপ্লব। যদিও কৃষি বিপ্লবের আগেও মানুষ ছিল এমনই হিংস্র, শ্বাপদ। কিন্তু তখন তারা নিজেদের মহান করার চেষ্টা করেনি। মানুষ নিজেকে মহান করার খেলায় নেমেছিল সেই সময় থেকে, জেনে বুঝে। তার আগে সে জন্তুই ছিল কিন্তু সে যে জন্তু নয় তা প্রমাণের চেষ্টা তার মধ্যে ছিল না। মানুষের আর সহজ হওয়া হয় না কিছুতেই। একটা জটিলতা কাটাতে গিয়ে আরেক জটিলতা। তাকে কাটাতে গিয়ে আরেক। এই যেন সেই গোলকধাঁধা। চক্রব্যূহ। কেউ কোথাও ফিরে যেতে পারবে না আর। কোন ভাবেই না। যেমন সে নিজে ফিরে যেতে পারবে না তার শৈশবে তেমন মানুষও নিজে ফিরে যেতে পারবে না সেই আড়াই লক্ষ বছর আগে। কেউ ফিরে যেতে পারে না বলেই হয়তো এই সর্বব্যাপি বিষাদ।

    এত ভাবে কেন মানুষ? এই মস্তিষ্ক এই স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে এত কিসের চিন্তা তার? এই ভাবতে পারার উপহার স্বরূপ এই বিশাল মস্তিষ্ক, যার বেশিরভাগটাই বেশিরভাগ মানুষের কাজে লাগে না, তাই নিয়ে মানুষের কত অহংকার। সফল মানুষ ভাবতে পারে সঙ্গে ভাব বিনিময়ও করতে পারে। দুটোরই সংমিশ্রণ দরকার। সূর্যশেখরের পরের ক্ষমতাটা নেই। সেইজন্যই সে অসফল। আবার সেইজন্যই তো সে শক্তিশালী। তার কোন ইসম নেই, তার কোন দল নেই, তার কোন পিছুটান নেই। সে মুক্ত তাই সে ঈর্ষণীয়। সূর্যশেখর আস্তে আস্তে মনটাকে এসব মন খারাপের কথা থেকে সরাতে চেষ্টা করে। দেখতে পাওয়ার চেষ্টা করে আরও একবার সেই প্রাচীন যুবককে। কিন্তু এতদিন ধরে সে হাজার চেষ্টা করেও কুলাবাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। সেই সে একবারই তাকে দেখেছিল। তার কষ্টটা দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। কষ্টটা যত বাড়ছে তত মনে ছটফটানিটাও বাড়ছে। অসহায়তা তাকে ঘিরে ধরে। তার কি কিছুই করার ছিল না এই দুনিয়ায়। সব কিছুতে কেন তাকেই হেরে যেতে হবে। সে যে তার লেখাটাও আর শেষ করতে পারছে না। বরং মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ওই কলহন লোকটার সঙ্গে না দেখা হওয়াই ভালো ছিল। তাহলে সে হয়ত কুলাবার দেখা পেত। এখন না চাইলেও লোকটা হাজির হয়। যেন ভেতর থেকে খুঁড়ে সব কিছু নিয়ে নেবে যা কিছু ওর দরকার। মনে হয় বুড়োটা ওকে ব্যবহার করছে। যেন ও শুধুই একটা টাইমস্কোপ। কে জানে লোকটাকে স্বার্থপর বলেও মনে হয় আজকাল। সূর্যের মতো এমন কাউকে ওর দরকার ছিল হয়তো, নইলে বুড়োটার ইতিহাস লিখে যাওয়াটা হোত না। সূর্য জানে কলহন এখনো লেখেন। সে লিখুন, মরুন বাঁচুন যা ইচ্ছে তাই করুন। কিন্তু গণ্ডগোলটা হল লোকটা ওর ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে যায়। কিন্তু এতটাই অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব যে অস্বীকার করা যায় না। আর তার সঙ্গে অযাচিত ভাবে তার সারল্য। না আজকে লোকটাকে একদম পাত্তাই দেবে না।

    আচ্ছা শিউলি কি করছে? আজ মনে হচ্ছিল কেউ তাকে ডাকছে। শিউলি কি? নাহ্ তা কি করে হবে। সে কি আর তার কথা ভাবে। কেনই বা ভাববে? সে তাকে কি দিতে পারত? কোন কিছু দেওয়ার প্রশ্নই তো ছিল না সে সম্পর্কে। মেয়েরা প্রাকৃতিক নিয়মেই নিশ্চয়তা খোঁজে। একটি সন্তান ধারণ, তাকে প্রসব ও বড় করা সব কাজটাই দীর্ঘ আর শারীরিক শ্রমসাধ্য। উল্টোদিকে পুরুষের লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু তৈরি করা ছাড়া বিশেষ কোন শক্তি ক্ষয়ই নেই। পুরুষ তাই নারীর মতো ভাবে না। নারীও তাই তার নিজের মনের থেকে নিজেকে সরিয়ে বাঁচতে পারে। অনেক পুরুষও পারে যদিও। সূর্য এসব কথা জানে, বোঝে তাও তার কষ্ট ফিরে ফিরে আসে। কি চমৎকার ছিল সেই সময় যখন সে বলে যেত তার যা জানা হয়েছে আর সেই ডাগর চোখের মেয়ে শুনত বসে অবিচল। নিজে পড়ত যা তাকে পড়াত। তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতিহীন দিন যাপন সেই কি তার সব থেকে আনন্দের সময়? সে কি ভুলতে পারবে সূর্যশেখরকে কোনদিন? যদি না পারে তাহলে সূর্যশেখর কি খুশি হবে? এ কি তার প্রতিশোধ স্পৃহা? তাহলে সে নিজেই কি ভালোবাসতে পারে না? সেই জন্যই কি আর সে লিখতে পারে না? সে নিজে জড়িয়ে যাচ্ছে যে কাজে সে কাজ সে করতে তো চায়নি। সে চেয়েছিল লিখতে। সে যে খেলতে পারত না ভালো, বন্ধু করতে পারত না কোথাও। সে যে নিশ্চিন্ত থাকত তার ঘরের এক কোণে, সে যে আকাশ পাতাল ভাবতে পারতো আর তাতেই পেত আনন্দ। এমন কি তার মা যখন তার সামনে একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল তখনও সে আপন মনে ভাবছিল মৃত্যু আসলে কী? সে উলটে বুঝতে চেষ্টা করছিল তার মায়ের সঙ্গে এরপর থেকে কীভাবে যোগাযোগ হতে পারে। তার জন্য বিজ্ঞান কি ভাবছে বা কল্পবিজ্ঞান বিজ্ঞানকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। হায় কি বোকা, সেই মৃত্যুর দিনও তার মধ্যে দুঃখ নয়, রোমান্টিকতা কাজ করছিল। বাস্তবতাহীনভাবে মূর্খ, অপদার্থ এবং স্বার্থপর। সে কোনদিনই কোন কিছুরই যোগ্য ছিল না। সে অপ্রয়োজনীয়। তাকে ভাবনার মধ্যেই আনেনি শিউলি। একদম ঠিক কাজ করেছে। আবার সেই তীব্র চিনচিনে ব্যথা। আবার সেই ভয়ঙ্কর অস্থিরতা।

    মনকে শান্ত করার একমাত্র উপায় মনকে ছেড়ে দেওয়া নিজের মতো। বৃষ্টির দমক যেমন বাড়ে কমে তেমন মনেরও ঝড় বাড়ে কমে। সে নিজের নিয়মেই চলে। তাকে বশ করার মন্ত্র তার নিজের জানা নেই। সুর্যশেখরের ঘরের জানলা খোলা। জলের কণাগুলো গ্রিলের প্রান্ত বেয়ে চলতে চলতে হঠাৎ করে ঝরে পড়ে। প্রায় একই রকম জায়গায় ওরা ঝরে পড়ছে, একই রকম সময়ের ব্যবধানে। বোঝা যায় অনেকক্ষণ ধরে বাইরে একই গতিতে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। জলের ফোঁটাদের সময়ের ব্যবধান সে গুনত মায়ের ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে। মায়ের এইচ এম টি। বিয়ে বাড়িতে বা বেড়াতে গেলে যেটা থাকত মায়ের হাতে। সেই ঘড়ি সময় রাখতে ভুলে গেছে। কিন্তু জলকণারা ভোলেনি। বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতো জলের কণা লেগে থাকত জানলার ক্ষয়ে যাওয়া শিকে। টুপুস টুপুস করে নামত নীচে। সেগুলো ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের ফ্রেমের গর্তের ভেতর দিয়ে নেমে আসত নীচে, তারপর মেঝে দিয়ে চলে যেত নির্দিষ্ট এক রেখায়, নদীর মতো। ঘরের মাঝে সেই নদীকে তাকিয়ে দেখত এদিক থেকে সূর্য আর ওদিক থেকে জানলায় বাঁধা মানিপ্ল্যান্ট। বেনাড্রিলের খয়েরি শিশিতে মানিপ্লান্ট। সে গাছে নতুন পাতা এল শুধু জল খেয়ে থেকেই, বেরোল শেকড়। শিক থেকে ঝরে পড়া নতুন জলের ফোঁটা গায়ে লাগিয়ে তখন সেই গাছ যেন আহ্লাদে আটখা না। সে যেন মাথা নেড়েই চলেছে। দুজনেই যেন দুজনকে দেখতে পাচ্ছে এখনো তারা। সেও তো ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার নদীই তো বয়ে যায়। সেই তো ভাসিয়ে নিয়ে চলে আজীবন। যতবার জীবন ততবার ভাসায়। বার বার কেন এই ভালোবাসায় মরল মানুষ? কেন এই ভালোবাসা সৃষ্টি করল পৃথিবী? উত্তর সেও খুব কঠিন নয়। প্রাণ মানেই তো বহতা নদী আর প্রাণ মানেই তো ভালোবাসা। এই অফুরন্ত বৃষ্টির নেমে আসা পৃথিবীর বুকে সেও তো ভালোবাসা।

    কিন্তু এত বৃষ্টির মধ্যেও শূন্যতা কেন? মানুষ শূন্যতায় ভোগে বলেই তার এত চাওয়া। সে চির অতৃপ্ত।এই অতৃপ্তি তার রোগ আর এই অতৃপ্তিই তার শক্তি। এই অতৃপ্তির জন্যই হয়ত এই আশা নিরাশা, জন্ম--মৃত্যু আর নারী--পুরুষের সৃষ্টি। সে নিশ্চিত নারী পুরুষ এই দুইয়ের অস্তিত্ব শুধু যৌনতার জন্য নয়, শুধু বংশবৃদ্ধির জন্যও নয়, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য। বারবার নিজের সামনে নতুন নতুন লক্ষ্য স্থাপন করার জন্য। আরও কঠিন, আরও দুর্লঙ্ঘ্য, আরও নির্মম আরও বিপদসংকুল। তাহলে সে নিজে কী লক্ষ্য স্থাপন করছে নিজের সামনে? সে হাসে নিজের মনে মনে। সে জানে কি চায় এখন। কি চাইছে যে যত তাড়াতাড়ি জেনে ফেলতে পারে সে তত এগিয়ে যায়। সূর্যের সেই বোঝায় দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু আফসোস নেই। বেশিরভাগ মানুষ কি চায় নিজে সেটাই আমৃত্যু বুঝে উঠতে পারে না। তাই তাদের বোঝানোর নামে ব্যবসা হয়। সভ্যতা তৈরি হয়। সভ্যতার নিয়ম তৈরি হয়। তারা সেই বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু মজার কথা হল যারা সেই নিয়ম তৈরি করে তারা সেই নিয়ম মানতে বাধ্য নয়। তাই ধীরে ধীরে দুই পক্ষ তৈরি হয়। তখনও কিন্তু ভালোবাসা হাসে আর অপেক্ষা করে, ধ্বংসের।

    না। তাকে আর অপেক্ষা করলে হবে না। কত রাত হয়েছে জানে না সূর্য। লোকটা উদয় হওয়ার আগেই তাকে বেড়িয়ে পড়তে হবে। এই ঘন বর্ষার রাতই আদর্শ সময়।

    #

    শিউলি এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। হারু রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রতিদিন বেদোর হাত দিয়ে। বেদো এসে শিউলির সঙ্গে কথা বলে যায় খানিক। সে বলে মোমবাতির কারখানা না করে যদি চানাচুরের কারখানা করত মালিক তাহলে ভালো চলতো। বেশি খরচ নেই। শুধু বড় গ্যাস আর চুল্লি লাগে। সে তো ওদের আছেই। প্লাস্টিকের প্যাকেট আলাদা করে কিনতে হয়। বাকি সব কিছু যেমন বেসন, ছোলা, বাদাম সব বড়বাজার থেকে ট্রান্সপোর্টে চলে আসবে। কোন সমস্যা নেই। দিলুও যদি ওকে এমন একটা কাজ ওকে করে দিত তাহলে ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। শিউলি শোনে আর বলে — আমি তোমায় দেব, তুমি বল কত খরচ।

    —কি যে বল বউদি। জায়গাটাই তো আসল। সেটা কোথায় পাই। একটু জায়গা। বুঝলে বউদি। আমাকে ভরসা করে যদি একটু জায়গা কেউ দিত তাহলে আমি দেখিয়ে দিতাম।

    শিউলি ভাবে সে দিলুকে কিইই বা বলতে পারে। এই ছেলেটার মধ্যে যথেষ্ট বুদ্ধি ও সততার ছাপ দেখেছে। কিন্তু ওর জন্য কেউই কিছু করছে না। হয়তো আসলে লাজুক বলেই একে নিয়ে কেউ ভাবেও না। দিলু ওকে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। এসব প্রস্তাব দিলু আগেই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। এখনও দেবে। দিলু নির্মম হয়ে উঠছে। সে কুমারদাকেই বলে দেখবে বেদোর জন্য কিছু করা যায় কি না।

    —আমার সঙ্গে আজ একটা জায়গায় যাবে? তোমার নাও ভালো লাগতে পারে। কানাই বলে একজন আমায় নাম গানের আসরে যেতে বলেছে। একটু দূরে, সনকা পেরিয়ে নদীর ধারে। ঠিকানা জেনে নেব। পারবে? অনেক দিন ধরেই বলেছে। কুমারদা থাকতে পারে।

    —কি যে বল বউদি। এ কোন কাজ নাকি। রতনের টোটো চয়ে নিয়ে আমি তোমায় চালিয়ে নিয়ে যাব। সিন্নি খেতে আমার ভালো লাগে। সিন্নির লোভে আমি যেকোনো জায়গায় যেতে পারি। আমি বহুদিন আগে একবার নাম গান শুনেছিলাম। আমাদের শহরে তো এসব উঠে গেছে। কিন্তু খুব যে বৃষ্টি। নামগান হবে কি করে গো? সব তো ভেসে যাচ্ছে।

    —বাড়ির ভেতর হবে মনে হয়।

    —ভিজলে তোমার যদি শরীর খারাপ বাড়ে।

    —আরে না না। বেরোলেই ভালো হয়ে যাবে।

    চারটে বাজতেই বেদো টোটো নিয়ে হাজির। প্লাস্টিকে ঘিরে রাখা। জল তেমন ঢুকছে না। অবিশ্রান্ত ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিকেল না রাত না সকাল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বেশ কিছুদূর হাই রোড ধরে যাওয়ার পর শহরের অস্তিত্ব শেষ। একটা ছোটো রাস্তায় ঢুকে কিছুদূর যাওয়ার পরে ছোটো খালের মতো নদী। যা গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে কিছু দূরেই। তার ওপর ব্রিটিশ আমলের ছোটো ঝুলন্ত ব্রিজ। দিব্যি সুন্দর আছে এখনও। ওর ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল টোটো। যেন চলে এল ওর চেনা পৃথিবীকে পেছনে ফেলে অন্য পৃথিবীতে। শিউলি কমলা প্লাস্টিকের ঘেরাটোপ থেকে মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে। তার চোখের পল্লবে বৃষ্টির ফোঁটা। তার নাকের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা। তার প্লাস্টিকের পর্দা ধরে থাকা তর্জনির ওপর বৃষ্টির ফোঁটা। এ যেন তার শৈশব। এই টোটো যেন সময়-যান। কুঁ করে শুধু এক শব্দ সে যানে। একঘেয়ে। নিশ্চিত। বেদো যেন সেই সময়জানের নিঃস্পৃহ চালক। ব্রিজের এপারের রূপ আলাদা। যেন কেউ সদ্য আঁকছে জলরঙে। সে ক্ষেত, পথ, পুকুর, দূরের বাড়ি আর বৃষ্টি, সবই এঁকে চলেছে এক রঙে, কালচে অজানা সে রঙ। চারপাশের বড় গাছগুলো সমর্পন করেছে নিজেদের। তাদের গা থেকে চুঁয়ে পড়ছে সেই একই রঙ। গাছগুলো কি গাছ বোঝ যায় না আলাদা করে। মাঝে মাঝে জল জমে আছে পথে। তার ওপর দিয়ে এক উটকো ভেজা কুকুর ছপাত ছপাত করে চলে গেল ভিতু চোখে। তার কি প্রয়োজন এই বর্ষায় ভিজে কে জানে! আবছায়া ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে টোটো। যেন কুয়াশা। যেন অস্বছ একটা আয় না। সেখানে নিজেকে দেখা যায় কিন্তু ঠিক মতো বোঝা যায় না। শুধুই অবয়ব চেনায় যেন, মানুষের মুখ নয়। কোন আয়নাই তো চেনায় না সত্যি করে কোন মানুষের মুখ।

    —অনাদি আদি গোবিন্দ, তিনি একা। তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই নিতাই, তিনিই সৃষ্টি, তিনিই প্রেম। সেই গোবিন্দের সঙ্গে কথা হয় এক্কেবারে সদ্য প্রসবের পরে, কথা ফোটার আগে। যেন নিজের সঙ্গেই কথা। কথা শেখার পর সে কথা মানুষের হারিয়ে যায়। সে কথা ভুলে যায় মানুষ। নিজেকে ভুলে যায়। তখন নিজেকে জানতে গেলে রাধার কাছে যেতে হয়। রাধা কে? সে হল প্রকৃতি। কৃষ্ণ হচ্ছে সূক্ষ্ম, এতোই সূক্ষ্ম একমাত্র রাধারানী তাকে জানেন। কৃষ্ণসেবা না শিখে কৃষ্ণকে পাওয়া যায় না। কৃষ্ণতেই রাধা থাকেন। কোথায়? ওই ঋ কারে? কৃ এর ঋ সেই তো আমাদের রাধারানী, আমাদের প্রকৃতি। কৃষ্ণকে রাধা ধারণ করেন।

    নিমীলিত চোখে কানাই মাঝি বলে যায় কৃষ্ণকথা। সাদা ধুতি আর বাসন্তী ঊর্ধাবাস, গলায় কণ্ঠী, নাকে ও কপালে তিলক। একমনে সে কথা শুনছে ঘরে থাকা কয়েকজন মানুষ। সেই ঘরে এক কোণে আছে শিউলি আর অন্য কোণে কিভাবে সূর্যশেখর। সে যে এখানে আসবে সে কথা শিউলি জানত না। বেদো একেবারে সামনে। সে কি বুঝছে সেই জানে। যদিও বোঝার কিছু থাকে না কখনো। কখনো কখনো থাকে নিশ্চেষ্ট অনুভব। সম্পন্ন চাষির বাড়ি। বড় জমি ঘিরে তিনদিকে পাকা বাড়ি, মাঝে মন্দির, রাধা মাধবের। বড়ো ঘর, সন্ধে নেমেছে আগেই, বৃষ্টি সে তো পড়বেই। সে না পড়লে এই অন্তরঙ্গ সন্ধ্যের কি মানে থাকত। কানাই মাঝি এ বাড়িতে আমন্ত্রিত কথক। কানাই মাঝির কথকতা এ অঞ্চলে বিখ্যাত। সেই সেদিনের নৌকোর মাঝি। আজ এ তার অন্য রূপ। এই মানুষটাই নৌকো বায়, মাছ ধরে, গরু চড়ায়, সংসার করে আবার এমন সব কথাও বলতে পারে। মানুষ, সে বড় বিচিত্র। সেই কি কৃষ্ণ? চোখ বুজে শুনতে থাকে শিউলি।

    —কৃষ্ণ সর্বত্র। সর্বত্র বিরাজিত, সর্বগ্রাসী আর স্বয়ম্ভু। কীভাবে কেন? আপনি অঙ্কে যান। সেই একই খোঁজ পাবেন। আমরা নবগ্রহের থেকে সৃষ্ট দেখুন নব মানে সেই শেষ সংখ্যা, নয়। কেমন সংখ্যা সেই নয়? অক্ষরে প্রকাশ করলে হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্বপদ। নয়ে নয় কৃষ্ণ ছাড়া কিছু নয়। নয়ের নামতা দেখুন না। নয়ে একে নয়। নয়। নয়ে দুয়ে আঠেরো। এক আর আটে কত? নয়। তিন নয়ে সাতাশ। দুইয়ে আর সাতে কত হয়? সেই নয়। এমনি করে হিসেব করে যান সর্বত্র সেই নয়, কৃষ্ণ ছাড়া কিছু নয়। রাধারানী বলছেন — আমার কৃষ্ণ ছাড়া কিছু নয়। পুরুষ প্রকৃতি দুইয়ে মিলেই তো সৃষ্টি, সৃষ্টি যখন হল সে কিন্তু তখন এক। নারীতে পুরুষ থাকে পুরুষে থাকে নারী। কেউ যদি বলেন এ হয় না চৈতন্য মহাপ্রভু বলছেন এও হয়। সমস্ত অঙ্গ দেখুন পুরুষে যা আছে নারীতে তা সব আছে। কম আর বেশি। ভালোবাসতে হলে প্রকৃতি হতে হয়। পুরুষকেও প্রকৃতি হতে হয়। আমি মূর্খ মানুষ আপনারা অনেক জানেন কিন্তু যে পুরুষ পূর্ন হয় তাকে নারী হতে হয়। সেই রাসলীলার গল্প জানেন তো?

    —জানি না। আপনি বলুন আমরা শুনি।

    —কৃষ্ণ তো রাশ লীলা করেছিলেন সখীদের নিয়ে। একশ আট জন সখী। সেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্বয়ং দুর্গা সেই সখীদের মধ্যে একজন। কৃষ্ণ সবাইকে নিয়ে খেলছেন খেলছেন কিন্তু হঠাৎ করে মনে হল তিনি যেন আনন্দ পাচ্ছেন না। তিনি রাশ উৎসব ভেঙ্গে বেড়িয়ে গেলেন। আসলে কি হয়েছিল জানেন? দুর্গা সেই রাসলীলায় যাওয়ায় দেবাদিদেব মহাদেব খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি নিজেও তো পুরুষ তাহলে তাঁর স্ত্রী কী করে তাকে ছেড়ে কৃষ্ণের সঙ্গে রাশ লীলা করতে গেলেন? কেন কৃষ্ণ এই সম্মান পাবেন? মহাদেব তাই নারী বেশে সেই লীলাক্ষেত্রে ঢুকেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ বুঝে গেছিলেন যে এই স্থানে কোন পুরুষ উপস্থিত আছে। পরে দুর্গা এসব জানতে পেরে ওনাকে বললেন— কেন আপনি এমন কাজ করলেন? এ আপনার ঠিক হয়নি, আপনি কি ভাবলেন এ শুধুই কাম? এ যে পূর্ণতার সন্ধান। তখন শিব কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বললেন — প্রভু আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমার কি রাসলীলা দেখা হবে না? আমি কি পূর্ণতার খোঁজ পাব না? জবাবে কৃষ্ণ বললেন — নিশ্চয়ই পাবেন। কিন্তু সে ভাঙা রাশে। জানেন তো? সেই তখন থেকেই নবদ্বীপে হয় রাশ আর শান্তিপুরে হয় ভাঙা রাশ। কিন্তু আসল কোথা হল কামনাকে অবদমন নয়। কামের ভেতর সূক্ষ্মতাকেই উনি খুঁজেছেন। এর এই কাম মানে চাওয়া। সেই তো আসল, সেই তো প্রেম, সেই যে অবিনশ্বর।

    সূর্যশেখর ভাবে ভুল তেমন নেই। এই সাধারণ কানাই মাঝির কথার সঙ্গে তার মতো নাস্তিকের চিন্তার কোন তফাৎ নেই। বিজ্ঞান তাই বলে। পুরুষ হরমোন স্ত্রীর শরীরেও থাকে, স্ত্রীর হরমোন পুরুষে। কম বেশি শরীর ভেদে। পুরুষ-যৌনাঙ্গ সেও থাকে নারীতে। পুরুষের স্তনও নারীর মতো উত্তেজিত হয়। নারীও পুরুষের মতো ভালোবাসে। তাছাড়া জীবজগতে নারী-পুরুষহীন প্রজাতির সংখ্যাটাও কোন অংশে কম নয়। যৌনতাহীনতা তাদের কি পৃথিবী থেকে উৎখাত করেছে? না তারা ভালো নেই? না। সে পুরোপুরি নাস্তিক হলেও এইসমস্ত যুক্তি তর্কের ভেতরে আজ ঢুকতে চায় না। জীবনের কিছু পর্যায়ে এসে যুক্তির থেকে অনুভূতির দরজা খুলে রাখা মনে হয় লাভজনক বেশি। আর যে লাভে অন্য কারো ক্ষতি নেই সে লাভ সে করবে নাই বা কেন? আজ সে কষ্টি পাথরে ঘষে কিছুই দেখবে না। কষ্টি পাথরে কৃষ্ণ আছে এমন ভেবে নয়। আজ যে সবই সম্ভব। আজ যাকে সে কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছে সে যে আর কেউ নয়, সে হল শিউলি। হোক সে মেয়ে তাকে ভালোবাসে না কিন্তু তাকে সূর্য তো অনুভব করতে পারে। এই রক্ত মাংসের বাইরে, অন্য কোথাও অন্য কোনখানে। এক ঝলক সে শিউলির দিকে তাকায়। এ কি দেখছে সূর্যশেখর! হ্যাঁ সেই, সেই চোখ। তার আর কোন সন্দেহ নেই। সে নিশ্চিত।

    —প্রেম যে সূক্ষ্ম। সে সূক্ষ্মতা কেবল সূক্ষ্ম মনেই আসতে পারে অন্য কোথাও নয়, অন্য কোন ভাবে নয়। তুলসি পাতায় নয়, পাথরের বিগ্রহে নয় বা নিরামিষ খেয়েও নয়। ওই যে বলে না—

    তুলসি পূজনে সে মিলত হোরি তো পুজত ঝাড়
    পত্থরপুজনেসে মিলত হোরি তো পুজত পাহাড়
    ঔর তৃণ খানে সে অগর মিলেত হোরি তো মিলত ছাগ।
    তুলসি পুজো করলে যদি কৃষ্ণ মিলত তাহলে একটা পাতা কেন সারা তুলসি বাগান পুজো করতাম। পাথরের বিগ্রহে যদি তিনি থাকতেন তাহলে পাথর কেন পাহাড় পুজো করতাম আর নিরামিষ খেলেই যদি তাঁর দেখা পেতাম তাহলে ছাগলের সবার আগে ঈশ্বর দর্শন হত। হয় না। সূক্ষ্মতাকে সূক্ষ্মতা দিয়েই ধরতে হয়। দেখেন না একটা পোষা কুকুর মানুষে খাবার দিলে খুশি হয়, গাছে জল দিলে গাছ খুশি হয়। কেন বলুন তো? সেই সূক্ষ্ম কৃষ্ণ খুশি হয় প্রাণ খুশি হয়।

    —কৃষ্ণস্মৃতি জ্ঞান সেই আসল কথা। সেই তো ভালোবাসা শেখায়। সেই প্রেম, সেই মুক্তি। সেই কৃষ্ণস্মৃতি জ্ঞান স্বয়ং কৃষ্ণেরও প্রয়োজন। কারণ তিনিও তো সেই প্রেম খুঁজছেন। তবে সেই প্রেমের কথা বলি। আপনারা তো কদম ফুল দেখেছেন। কেমন চমৎকার সে ফুল, তিন রঙকে যেন বুকে নিয়ে থাকে, যেন সত্য, রজঃ আর তম। আপনারা আমার থেকে ভালো জানেন আমি আর আপনাদের কি বলি। নতুন ফোটা ফুল সে এক্কেবারে বাইরে সাদা। তার পর তাতে ধীরে ধীরে বাসন্তী রঙ ধরে, আর ভেতরের কুসুম হয় হলুদ। সে ফুল যেন আনন্দ, আনন্দে বিরাজিত প্রেম। একদিন কি হয়েছে! রাধারানীর খুব কদম ফুলের সখ হয়েছে। কিন্তু সে তো অনেক উঁচুতে। কৃষ্ণ পাড়ার চেষ্টা করেন কিন্তু হাত পাননা, রাধারানী লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করেন, তাঁরও লাফানিই সার। কৃষ্ণ তখন বললেন — দেখো রাধারানী, তুমি এক কাজ কর। তুমি আমার বুকে পা রেখে ওপরে ওঠো আমি তোমায় শক্ত করে ধরে থাকি। কেননা কৃষ্ণের তো সেই সব অভ্যেস আছে। বন্ধুদের বুকে কাঁধে করে সে তো এই খেলা কত করেছে, ননী চুরি করেছে। এই ভাবেই সব থেকে সুবিধে। দুই পা বুকে নিয়ে চেপে ধরে রাখলে সুবিধে হয় যে — কেউ যদি ঝটকা মারে কোন কারণে ওপরে উঠে তাহলে টাল সামলানো যাবে। কৃষ্ণও তেমন রাধারানীর চরণ যুগল বুকে নিয়ে দুহাতে শক্ত করে চেপে থাকলেন। রাধারানীর নজর ফুলের দিকে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চান। কিন্তু তবুও তিনি হাত পান না। ওই অবস্থাতে আরও উঁচু হয়ে চেষ্টা করেন, তাও পান না। কৃষ্ণ তাঁকে ধরে আছেন। কৃষ্ণের পায়ের গোড়ালি মাটির সঙ্গে লাগানো। যদি গোড়ালি দুটো উঁচু করেন তাহলেই কিন্তু রাধারানী সে ফুল ছিঁড়ে আনতে পারেন। কিন্তু কৃষ্ণের সে ইচ্ছে নেই। তিনি যে বিভোর হয়ে আছেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন — আমি এতদিন ধরে কত আশা করেছিলাম এই চরণ যুগল হাতে পাবো, আজ আমার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। তিনি ভুলে গেলেন তিনি কেন রাধারানীর চরণ যুগল জড়িয়ে আছেন, তিনি ভুলে গেলেন তার গোড়ালিদুটো তুলে ধরলে রাধারানী সেই অভীষ্ট হাতে পাবেন। তার চোখ ভেসে যেতে থাকলো অশ্রুতে। সে জলধারা চোখ বেয়ে, চিবুক বেয়ে নেমে এল তার বুকে, ভিজিয়ে দিল রাধারানীর চরণ যুগল। রাধারানী অনুভব করলেন গরম স্রোতে ভিজে যাচ্ছে তার তুই পা। তিনি বললেন — প্রভু কি হয়েছে? কেন আমার পায়ে গরম লাগছে? কৃষ্ণ তার কি জবাব দেবেন। তিনি তো বাকরুদ্ধ। তিনি ডুবে যাচ্ছেন অতল সাগরে, আনন্দের গভীরে অশ্রুর খবর তিনি রাখেন কি করে। তিনি যে তখন নিজেই কৃষ্ণ প্রেমে আত্মহারা। রাধাকে জানতে পেরেছেন তিনি, প্রকৃতিকে জানতে পেরেছেন তিনি। তার মানব জন্ম তখন স্বার্থক হয়েছে। তার তখন কৃষ্ণস্মৃতি জ্ঞান জাগরিত হয়েছে। আর রাধারানীর তখন কি হল? আপনারা জানেন কদম ফুল পেকে গেলে সে আপন ভারেই নেমে আসে। একটু ছুঁলে তো কথা নেই। মাটিতে পরে যায়। অনেকক্ষণ পরে কৃষ্ণের সম্বিত ফিরলে তিনি তাঁর দুই গোড়ালি উঁচু করলেন। রাধারানী তখন ফুল ধরতে পারলেন দুই আঙুলে। তারপর কৃষ্ণ তাঁকে ছেড়ে দিলেন। আর রাধারানী ঝুলতে থাকলেন সেই কদম ফুল ধরে। রাধারানীকে নিয়েসেই ফুল কিন্তু পরল না মাটিতে। কারণ রাধারানী যে তখন হালকা, ভারহীন, সূক্ষ্ম কারণ তিনিও যে তখন কৃষ্ণ লাভ করেছেন।

    কানাই মাঝির চোখে তখন জল, বাইরের পৃথিবীতেও তখন জল। শিউলি যদিও সেসব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কারণ তার দুচোখ অনেকক্ষণ থেকেই কি এক আবেশে বুজে এসেছে। শিউলি দেখতে পাচ্ছে না এই ঘরেই আরেক জনের চোখেও তখন জল, আর সেই জলই যেন ঝরে পড়ছে বুভুক্ষু মাটির গায়ে, পৃথিবী ব্যাপী ভালোবাসা হয়ে। ঘরের ভেতর তখন গান শুরু হয়েছে। চন্ডীদাস।

    পিরীতি পিরীতি এ রীতি মূরতি,
    হৃদয় লাগলো সে।
    পরাণ ছাড়িলে পিরীতি না ছাড়ে,
    পিরীতি গড়িল কে।।


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments