বৈঠকখানা বাজারের মধ্যে ট্রাম লাইন আর বাস রাস্তার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এমন কোনো অডিটোরিয়াম আছে জানতাম না কস্মিনকালেও। ও রাস্তায় বাড়ি ফিরেছি, মিছিলেও হেঁটেছি একসময়, বান্ধবী ছুঁয়ে থেকেছে আমার বাহু— কিন্তু নৈঃশব্দ চুরমার করা সে রাস্তায় সভাঘর থাকতে পারে ভাবিনি কোনোদিন। অমিয় রায়চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বলবেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। বিকেল বিকেল যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে জমায়েত নেহাত মন্দ না। একটি পত্রিকার উৎসব সংখ্যাও প্রকাশিত হবে সেই সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই চেনা মুখের সারি। অভ্যেস মতো আমি গিয়ে বসলাম জানলার ধারে এক সারি চেয়ারের শেষপ্রান্তে। খেয়াল করিনি জানলার ওপাশটাই মির্জাপুরের রাস্তা। ফাঁকা খুঁজতে গিয়ে এমন কাণ্ড বারবারই হয়ে যায়। লোকাল ট্রেনে লাফিয়ে উঠে ফাঁকা খুঁজে এমন জায়গায় বসি যেখানে টানা রোদের সম্ভাবনা, গরমে একটু হাওয়াও আসে না। আমার এক সহকর্মিণী তেমনি এক দুপুরে আমার এই স্বভাব নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন খুব। অনুষ্ঠানের শুরুতেই রবীন্দ্রগান, প্রথা হিসেবে যা ইদানীং বেশ বিরক্তিকর লাগে। তবু প্রায় বছর দুয়েক গৃহবন্দিদশা কাটিয়ে প্রথমবার সভা-সমিতিতে গিয়ে এবার দেখলাম আমার সহনশীলতা খানিক বেড়েছে। প্রথম গানটা এমনিই মাথার চারপাশে গুনগুনিয়ে চলে গেল। তারপর হঠাৎ শুরু হল ‘এ পরবাসে রবে কে’। যে ভদ্রমহিলা গাইছিলেন তাঁর নামটাও আমার খেয়াল নেই। কিন্তু কোথায় যেন প্রবল টান খেলাম। সোজা হয়ে গেল মেরুদণ্ড। আমি কি তখন গানটা আদৌ শুনছিলাম? আমার মাথায় তখন খেলা করছেন অমিয়া ঠাকুর, রাজেশ্বরী দত্ত, বিক্রম সিং খাঙ্গুরা। সামূহিক স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে কি উঠে আসছে না সুরের ঢেউ? জানলার বাইরে পড়ন্ত বেলার রোদ, শিয়ালদার রাস্তায় ঝাঁকামুটে, ভ্যানরিক্সা, মুখর সহনাগরিকেদের মাথা ছাড়িয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি দার্জিলিঙে শাল গায়ে বসে আছেন ক্লান্ত করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, লন্ডনে একা প্রবাসী রাজেশ্বরী দত্ত। তেইশ-চব্বিশ বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এই গান। তার বছর দুই আগে বিয়ে করেছেন মৃণালিনীকে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ বইয়ে লিখছেন, ‘বহু শতাব্দী আগে পাঞ্জাবের উট-পালকেরা যে গান গাইতো সেটি হল টপ্পা। টপ্পা সম্পর্কে একটি ধারণা আছে, যে এটি ওস্তাদী গান। আসলে এটি একেবারেই গ্রাম্য সংগীত। অযোধ্যার গোলাম নবি মারা যান উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। তাঁর প্রিয়ার নাম ছিল শোরী। এই নামেই তিনি প্রচলিত করলেন শোরীর টপ্পা। রবীন্দ্রনাথ টপ্পা গানের সুর নিয়ে চর্চা করেছিলেন। বাংলাদেশেও টপ্পা ছিল— নিধুবাবুর টপ্পা। রবীন্দ্রনাথ শোরীর টপ্পার ঢঙ পছন্দ করতেন। এ টপ্পায় বাহাদুরি দেখিয়ে রসবর্জিত দীর্ঘ তান দেওয়ার সুযোগ নেই। এখানে প্রকাশিত হয়েছে সুরের চিকনতা। তাই রস-সংযমী রবীন্দ্রনাথ নিধুবাবুর টপ্পা না নিয়ে শোরীর টপ্পাই নিলেন। এই সুরে বহু গান তাঁর আছে।’ শোরীর টপ্পা ভেঙে রবীন্দ্রনাথের চারটে লাইন ‘এ পরবাসে রবে কে হায়/কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে॥/হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে—/তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে॥’ রাস্তার ওপারে একটা ভাঙা পাঁচিল আর তার গায়ে এখনও ভাঙা বোতলের টুকরোর আভাস। এখনও নজর এড়িয়ে টিকে আছে কিছু বুনো ঝোপঝাড়। চকিতে মনে পড়ে গেল প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের ইউজেনিও মনতালেকে নিয়ে নিবন্ধে উদ্ধৃত করা এক লাইন গদ্যলেখা, ‘But to show preference for energy rather than idealistic reason or unknown God does not solve any problem— it is mererly a change of labels.’ যন্ত্রে, ঈশ্বরে, ফড়েদের চালাকিতে মোড়ক বদলে যায় শুধু? আমার কানে তখন রবীন্দ্রনাথ, মনে মনে দেখছি পাহাড় আর বিলেতের কুয়াশামাখা বিকেল, কিন্তু জগৎ সিনেমার সামনে থেকে হাঁক পাড়ছে বাসের কন্ডাক্টর, ধোঁয়া উগরে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ৭১ নং বাস। যে না কি আজকাল পুরোনো রাস্তা ভুলেছে। যায় না আর সল্টলেকের করুণাময়ী, যেখানে নেমে এমন গরমের বিকেলে কখনো আমরা ধীর পায়ে হেঁটে গেছি বনবিতানের পুকুরপাড়ে বসে থাকতে। ডুবতে দেখেছি সূর্য। কিন্তু আজ বারবার ভাঙা দেওয়ালটার দিকে মন যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল মনতালের কথা, নাছোড় তিক্ততায় একা। আশ্চর্য অস্তিত্ব হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায়, যেমন ‘দুপুর কাটানো’ কবিতায় বলেছিলেন :
দুপুর কাটানো, ম্লান, মগ্নতালাল পিঁপড়ের সারি দিয়ে হেঁটে যাওয়া, একচিলতে গাছের সবুজ, কর্কশ বাতাসের নুন, মোবাইলের টুংটাং, তামাকের গন্ধ সব সরিয়ে মনতালের কবিতাটির শেষ চারটি লাইন ছেয়ে ফেলে মনকে
ঝলসানো, ভাঙা দেয়ালের পাশে বাগানে,
কান পেতে শোন, ঝোপের কাঁটার ভিতরে
পাখির কিচির, সাপের চলার খসখস।
প্রখর রৌদ্রে কিছু দূর হেঁটে যাওয়াততক্ষণে হয়তো রবীন্দ্রনাথের গান শেষ হয়েছে। আমার মন আবার সভাঘরে। রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে স্বস্তি দেয় না। আরও জাগিয়ে তোলে। কালপুরুষের মতো টানে। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একা আমি তাঁর সঙ্গে এভাবেই বেকুবের মতো কথা বলি। মনতালে অবশ্য বলেছিলেন—Only the isolated communicate.
অনুভবে শুধু বিষণ্ণ বিস্ময়
এ জীবন আর জীবনের যত শ্রম
পাশে হেঁটে যাওয়া— এই দেওয়ালের মতো
যে-দেওয়ালে ভাঙা বোতলের কাঁচ বসানো।
----------------------
ইউজেনিয় মনতালের কবিতার অনুবাদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের করা।