• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | বিবিধ
    Share
  • জলের মতো ঘুরে ঘুরে : শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
    | | | ৪



    বিশ্বাসের চর

    লালগোলা প্যাসেঞ্জার যখন পলাশী ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় রেজিনগরের দিকে তখন কি মাটির গন্ধ, বাতাস সব পালটে যায়? কয়েক কিলোমিটারে তা নিশ্চয় হবার নয়। তবু আমি যেন টের পাই মুর্শিদাবাদের গন্ধ। অনেক আগে যখন সন্ধের ট্রেনে ফিরতাম কলকাতা থেকে, তখন সবার মতোই সারগাছি পেরুলে তৈরি হতাম নামার জন্য। কাঁধের ব্যাগটা কোলে নিয়ে বাঁ-দিকের জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম কখন দেখা যাবে বহরমপুরের টিভি টাওয়ারের পাঁচটা লাল বিন্দু। বাকিরা যখন হুটোপাটি করছে ট্রেনের দরজার দিকে যাবার জন্য আমি প্রায় তথাগত হয়ে তাকিয়ে থেকেছি পাঁচটি লাল বিন্দুর দিকে। যেন একটা ত্রিভুজের মধ্যবিন্দু দুটি জোড়া আছে ভূমির সমান্তরাল রেখায়। ততদিনে কলকাতার ধর্মতলায় সিম্ফনি থেকে জন ডেনভারের অ্যালবাম কেনা হয়ে গেছে। ক্যাসেটকে কেন অ্যালবাম বলে তা আমার কাছে রহস্য ছিল। কিন্তু নরম প্লাস্টিকের খাপে ভরা মোটাসোটা ডেনভারের ক্যাসেটটা দেখে বেশ অ্যালবামই মনে হত। ডেনভার বোধহয় প্লেন ক্র্যাশ করে মারা যাবেন ১৯৯৭ সালে। প্লেনটা নিজেই চালাচ্ছিলেন। ট্রেন যখন শেষ পাঁচ মিনিটের দৌড়ে বহরমপুরের দিকে আমার মাথায় হয়তো গুনগুন করতেন ডেনভার : ‘I hear her voice in the mornin' hour, she calls me/ The radio reminds me of my home far away/ Drivin' down the road, I get a feelin'/ That I should've been home yesterday, yesterday’. ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া আর ওয়েস্ট বেঙ্গলের মধ্যে যা দূরত্ব, গানটার সঙ্গেও আমার তেমনই দূরত্ব। কিন্তু ওই যে লাইনটা ‘আমার গতকালই বাড়ি ফেরার কথা ছিল’ এর রেশ আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পঁচিশ বছরের বেশি হল ছেড়ে এসেছি শহরটা। একসময় লোকের মুখ দেখে কোন পাড়ায় বাড়ি চিনতে পারতাম, এখন আমি কোন বাড়ির তা চিনিয়ে দিতে হয় পাড়ার মোড়ের দোকানদারকেও। বন্ধুরা নেই। প্রায় সবাই শহর ছেড়ে প্রবাসে কর্মের বশে। একমাত্র পুজোর সময় মিঠুনের সঙ্গে দেখা হয়। ও এখন থাকে দমদমের কমলাপুরে। কোনো বছর আমি পুজোয় না গেলে সে-বছরটাই হয়তো দেখা হয় না। লোকে একসময় ব্যঙ্গ করত আমাদের বন্ধুদের দলে তর্ক করা দেখে। মিঠুন ডিবেট কম্পিটিশনে সোনার মেডেল পেত। আমি কখনো নাম দিইনি। কিন্তু প্রতিবার বন্ধুর তর্ক শুনতে যেতাম। অন্যদের সঙ্গে আমাদের এই যে তর্ক তার ধরাবাঁধা কোনো বিষয় ছিল না। ‘নাথিং হিউম্যান ইজ এলিয়েন’ গোছের ব্যাপার আর কি। একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমরা দু-জনে নিজেদের মধ্যে সেভাবে কখনো তর্ক করিনি। দু-জনে শুনে গেছি দু-জনের কথা। সেই ক্লাস ফোর থেকে একসঙ্গে পড়েছি। ক্লাস এইট থেকে সকাল-বিকেলের সঙ্গী, দুপুরেরও। হয় স্কুলে নয়তো উঁচু ক্লাসে উঠে স্কুল কেটে গঙ্গার ধারে। মে-জুনের তীব্র গরমে জলের ধারে ছোটো-ছোটো গাছপালার ফাঁকে কাত হয়ে বসে কথা বলে গেছি। কবিতাও কি ছিল না? ও আমার থেকে অনেক ভালো লিখত। ইদানীং বললে লাজুক হাসে। লেখে না আর। এখন আমরা সিগারেট খাই, থমাস পিকেটির ব্রাহ্মণ্যবাদী কমিউনিস্টদের ঠেস মারা কথা শুনে হাসি, আমার কালচারাল লেফটের কথা শুনে সে উজ্জ্বল চোখে তাকায়। রাতে মাঠের ঘাস আবার পঁচিশ বছরের পুরোনো গন্ধ জাগিয়ে তোলে। বাড়ি ফিরে আসি। তারপর হয়তো বছরখানেক কথা হয় না। বা কখনো টানা দিন কুড়ি রোজ ফোন চলল একাধিকবার। ফের নীরবতা। এই আমার বহরমপুর। এখন অনেকটা একার। বাড়িতে ভালো লাগে না। আমার বাবা-মার চোখে আমার আঠারো বছর বয়স পেরোয়নি কখনো। অল্প বয়সে ছেলে মারা গেলে যেমন তার বয়স বাড়ে না। আমার বাবাও আমার চোখে এখনও আটান্ন, মা পঞ্চাশের নীচে। বাবা যদিও আমার হাত ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেল দশ মাস আগে। আসলে এক অলৌকিক টাইম মেশিনে সব ঘেঁটে যায়। নিয়ম করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। ভাইঝির সাইকেলে ঘুরে বেড়াই কাটমাপাড়া, লেঠেল মণ্ডপ, বাঙালপাড়া, গোরাবাজার, বরিশাল কলোনি— অনেক বাড়ি বদলে গেছে, বহুতল উঠেছে কোথাও। কোনো বাড়ি দেখে চকিতে মনে পড়ে যায় পুরোনো কোনো কথা। কিন্তু কাউকে চিনতে পারি না। মাঝে-মাঝে গলিরাস্তা হারিয়ে ফেলি। বেকুবের মতো হাতড়াই। অথচ কলকাতায় কেউ আমার শহরের কথা তুললে বুক ভরে বলতে ইচ্ছে করে :

    যদি যান,
    কাউতলী রেলব্রীজ পেরুলেই দেখবেন
    মানুষের সাধ্যমত
    ঘরবাড়ী।
    চাষা হাল বলদের গন্ধে থমথমে
    হাওয়া।
    কিষাণের ললাটরেখার মতো নদী,
    …      …       …
    এক নির্জন বাড়ীর উঠোনে ফুটে আছে
    আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী
    একটি ম্লান দুঃখের করবী!
    আমার শহরে ওসব হাল বলদ চাষার নামগন্ধ নেই। শহরে ঢুকতে রেলব্রিজ নেই। পাঁচটি আলোক বিন্দু ছিল। সকাল ন-টায় একবার সাইরেনের আওয়াজ ছিল। তবে তখনও জোড়া শিবমন্দিরের গলির সামনে দাঁড়ালে সামনে নদীর হাতছানি পাওয়া যেত, এখনও যায়। পাশেই যামিনী পালেদের মাটির ঠাকুর গড়ার স্টুডিয়ো। নদীর ধারে দাঁড়ালে এখনও নিজেকে লোরকার জিপসি ছেলেটির মনে হয়, যে কথা দিলে তা রাখতে জানে। মুশকিল হল আমাদের বাড়িতে করবী গাছ নেই, উচ্ছল মাধবীলতা আছে। আর বৃষ্টির দুপুরে মাঠের একপাশে কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ার লাল-হলুদ মনে করিয়ে দেয় ইউরোপের ‘ফল সিজন’। আমি যতবার শহরটাকে ধরতে যেতে চাই ততবার সে আড়ে-বহরে বদলে গিয়ে আমাকে হতবাক করে দেয়। জেলখানার উত্তর দিকের যে-ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে একদিন এক বান্ধবীর সঙ্গে দু-চার কদম হেঁটেছি, সে-রাস্তায় এখন হাইমাস্ট আলো আর সিঁদুর কুড়িয়ে নেওয়ার মতো চকচকে অ্যাসফল্ট। এভাবে কি আমার স্মৃতিগুলো সব মুছে যাবে বাস্তব থেকে। স্মৃতির এ এক আশ্চর্য খেলা। ঠিক উনতিরিশ বছরে আমাকে ভূতপূর্ব বানিয়ে ফেলল সেই শহর, যা আমার প্রথম সব কিছু জানে। মানুষের স্মৃতি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা যেমন আছে তেমনি শহরের স্মৃতি বলে কি কিছু হয় না? সুধীরকুমার নন্দী লিখেছেন স্মৃতির মূলে আছে ধারণক্রিয়া, পুনরুদ্রেক ও প্রত্যভিজ্ঞা। তিনি মানব মনস্তত্ত্বের আলোয় ভেবেছেন, তাই মানুষের মস্তিষ্কের কথা গুরুত্ব পেয়েছে সেখানে। কিন্তু শহরের ধারণক্রিয়া নেই? প্রত্যভিজ্ঞা মানে তো রেকগনিশন, তাও নেই? নিঝুম রাতের রাস্তা আর স্কোয়্যার ফিল্ডের চারপাশের সেই কয়েকশো বছরের পুরোনো গাছগুলো যখন আড্ডা জমায় তখন কি পুনরুদ্রেকও নেই। অবশ্য সুধীরবাবু মনোযোগ, অনুরাগ, স্মরণ করার ইচ্ছের কথাও বলে রেখেছেন। শহরের কি হৃদয় নেই? জানি না। তবে মাথা নীচু করে ফিরে আসি বারবার। ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। বলব কাকে? সাদা পাতাকে আক্রমণ করতে ইচ্ছে করে। ঘুম আসে না। যেখানে ফেরার কথা ছিল আর কোনো দিন ফিরব না। দেখন-হাসি সম্বল করে ফেরার দিন ট্রেনে উঠি। পুরোনো চা-ওলাকে বড়ো আপন লাগে। দুটো কথা বলি। যে একসময় ছোটোদের খেলনা বেচত, ইদানীং ছোলা-বাদাম বিক্রি করে, তার সঙ্গে গল্প করি পুরোনো দিনের। মেয়ে অবাক হয়। বলে, বাবা এত মানুষের সঙ্গে কথা বলে কেন? আসলে আমার আমার বিশ্বাসের চরটা ভেসে গেছে তা কী করে বোঝাই তরুণীকে? একটা কবিতা জাগে মনে ভেতর :
    আর উপশম নেই, তবু এই ব্যথার বিষয়
    তোমাকে জানাতে বড়ো সাধ জেগেছে হৃদয়ে
    এই তবে ভালোবাসা? এই নাকি প্রেমের গুঞ্জন—
    দেওয়ালে তোমাকে দেখে কেঁপে ওঠা আপাদ মস্তক
    তারপর কলকাতায় ফিরি। বিশাল শহরটায় মেতে উঠি বন্ধুদের সঙ্গে তরজায়। সংসার, ইশকুল, ছাপাখানা। কখনো ঘেমো সন্ধেবেলা গড়িয়া বাজারের বদলে নেমে পড়ি কুঁদঘাট মেট্রো স্টেশনে। আদি গঙ্গার খাল পেরিয়ে ওপারে যাই। ডানহাতে কালী মন্দির ফেলে বাজার পেরিয়ে বাঁদিকে এগিয়ে যাই গঙ্গাপুরীর দিকে। আদি গঙ্গায় একদিন নৌকো চলাচল করত, সেই কথা ভাবি। ভাবি কুঁদঘাটে জলপথের শুল্ক আদায় করত কোনো মণ্ডল বা নস্কর পদবিধারী মানুষ, যারা আজ শহরে প্রান্তিক প্রায়, তখন অবশ্য এদিকে শহর কোথায়! গঙ্গাপুরী জায়গাটার নাম আমায় টানে। এ-পাড়ায় কাউকে চিনি না। কিন্তু নামটা টানে। আর ধাঁ-চকচকে শহরের আলো ঝলমলে বাস্তবতা থেকে ঘণ্টাখানেকের ছুটি। নিজের শহরে ফিরতে ইচ্ছে করে। সম্ভব নয় জানি। মন মনে আউড়ে চলি :
    আমাকে ফিরতে হবে। বাঁধাছাদা হলও না এখনও।
    কে তুমি নৌকার মাঝি ধরে আছো আমস্তুলের দড়ি
    ঢেউয়ের মাতন দেখে ভুলে গেছি কোন দিকে যাবো
    কোনদিকে, কোনদিকে— কোনদিকে বিশ্বাসের চর?
    …       …       …
    … ভুলে গেছি নিজের কি নাম :
    কি নামে ডাকতো লোকে, কোন গ্রামে ছিল পিতৃকূল?
    আজ শুধু হাওয়া থাক, আর কালো মেঘের গর্জনে
    একটি মাস্তুল শুধু ভেসে ভেসে দূরে চলে যাক।
    ব্যবহৃত কবিতাংশগুলি আল মাহমুদের লেখা।
  • | | | ৪
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments