• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • পূজোর দিন, পূজোর রাত : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


    পূজোর দিন

    পূজোর দিনগুলোতে আমাদের শহর ছিল পৃথিবীর সেরা। নরম রোদ্দুরে সেঁকা রাজধানীর রাস্তাঘাটে ভিড় হত না। ডিটিসির বাসে চেপে গড়গড় করে আমরা পার্কটাউন বা কাশ্মীরী গেটে গিয়ে অঞ্জলি দিয়ে আসতাম। ফুল-বেলপাতার গন্ধের মধ্যে যখন প্রসাদ বিতরণ হত তখন স্কুলের নিজস্ব চেনাজানা আর সহপাঠীদের দল খুঁজে নিয়ে পম্পা মুখার্জি আর আমি পরস্পরকে দূর থেকে দেখতাম। টোটোদার সঙ্গে কলেজ স্টুডেন্টদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার সালক্তকা বান্ধবী সুতির শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরে যখন তখন হেসে গড়িয়ে পড়ত। স্যাণ্ডেলের ফাঁক দিয়ে তার রক্তের চেয়ে লাল পা দেখে ফেলার পর কথার খেই হারিয়ে জটলার সবচেয়ে নালায়েক সদস্যের মতো আমি আনতাবড়ি ফোড়ন কেটে ঝাড় খেতাম।

    - কী করে এটা সম্ভব যে একটা ময়ূর আর একটা প্যাঁচা এত কাছে থাকা সত্ত্বেও ইঁদুরটা পালিয়ে যাচ্ছে না?

    - বকরা, তোর পিঠে একটা হাতি চেপে বসলে তুই পালাতে পারতিস?

    প্রথম ব্যাচে ভোগ সংগ্রহ করে আমাদের বন্ধুরা একটা কাঠের টেবিল দেখে বসে পড়ত। চাটনি মাখা ঘ্যাঁট দিয়ে খিচুড়ি ধ্বংসের পর গপগপিয়ে পায়েস খাওয়া হয়ে গেলে আমি আর পম্পা আলাদাভাবে সবার নজর এড়িয়ে সরে পড়তাম। মল রোড থেকে তাড়াতাড়ি কোনো বাস ধরে আমরা চলে যেতাম করোল বাগ কিম্বা কনট প্লেসের বাজারে। সেখানে দশহরার ঝলমলে রোদে উদ্ধত সুটিং শার্টিং আর ড্রেস মেটিরিয়ালের মডেলের মতো রোদচশমায় টানটান হয়ে ফুটপাথের ধুলোর সেলাম কুড়িয়ে নিতাম আমরা। বিশেষ করে ছোট দোকানগুলো আমাদের পছন্দ ছিল, কারণ দেয়াল থেকে ঝোলানো অসংখ্য এটা-সেটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করার সময়ে বিনা পয়সায় মিউজিয়ম দেখা হচ্ছে বলে দুজন দুজনের দিকে ফিরে ফিক ফিক করে হাসা যেত। দোকানদাররা আমাদের মন পাওয়ার জন্য মরীয়া হয়ে উঠলে আমি পম্পার দিকে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তাকাতাম। সুযোগ বুঝে দোকানদার তড়িঘড়ি যোগ করত – সস্তা ভী হ্যায় ম্যাডম্‌। আর আমার বান্ধবী তার একটু উপর দিকে ঘোরানো নাক কুঁচকে মধুর হাসির সঙ্গে বলত – সস্তা মুঝে বিলকুল পসন্দ্‌ নহীঁ।

    শিবাজী মার্গের অর্জুন গাছগুলোর ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে গোলমার্কেট ছাড়াবার পর ভাই বীর সিং রোডের দোকান থেকে এক ঠোঙা গরম জিলিপি কিনে আমরা পৌঁছে যেতাম বিড়লা মন্দিরের চত্বরে। মন্দিরে ওঠার সিঁড়িকে দূর থেকেই নমস্কার জানিয়ে তারপর রামনবমীর মেলার রং-বেরংয়ের পুঁতির মতো মানুষগুলোকে কমলা আলোর বন্যায় মুগ্ধ চোখে দেখব বলে দুজনে ঘুরতাম, আর সেই সঙ্গে আঙুলের ডগায় সাবধানে ধরা জিলিপিও কয়েকটা খাওয়া হয়ে যেত। কখনো পথ আটকে দিত সাপ কিম্বা বাঁদরের নাচ। বা মালকোঁচা মারা শাড়ি আর সাদা লুঙ্গি পরা প্রৌঢ় কোনো দম্পতি মোটা কাঁচের ছানিকাটা চশমার ভিতর দিয়ে আমাদের ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন – হাউ টু গো টু ডি-টি-ই-এ-এস অন রীডিং রোড? আমি আর পম্পা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম আর আমার বান্ধবী ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করত – স্যর, ক্যান ইউ টেল আস দ্য ফুল নেম অফ দ্য প্লেস? তখন মালকোঁচা মারা শাড়ি বলতেন – ট্যামিল স্কুল অফ রীডিং রোড। আমার মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে যেত যে আমাদের জন্মের অনেক আগে রীডিং রোড হয়ে গেছে মন্দির মার্গ, আর তামিল অ্যাসোসিয়েশানের স্কুল তো কাছেই। – আই বিলীভ উই আর স্ট্যান্ডিং অন দ্যাট রোড অ্যাণ্ড দ্য স্কুল ইজ বিহাইণ্ড ইউ। জানাতাম আমি। বান্ধবী আমাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখিয়ে দিত যে অভিশপ্ত আত্মা না, আসলে একটা মানুষই রয়েছে তার পাশে, এবং বলত – ওয়েলকাম টু আওয়ার হিস্টরিক সিটি। উড ইউ লাইক টু হ্যাভ এ ওয়ার্ম জলেবী?

    প্রৌঢ়দের রওনা করিয়ে দিয়ে যখন আমরা কালিবাড়ির চত্বরে এসে উপস্থিত হতাম তখন প্রথম গেটের সামনে বিরাট অশ্বত্থ গাছটার নিচে ঘোড়ার মল-মূত্র আর কালো চানার সুগন্ধ নিয়ে টাঙ্গার স্ট্যাণ্ড আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত থাকত। লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। পম্পা নাকে একটা কাপড় দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেত দূরের গেটে যেখান থেকে শুরু হয়ে রবীন্দ্র রঙ্গশালা মার্গ পর্যন্ত রিজের জঙ্গল আর নাম-না-জানা ফুলের রাজত্ব। পূজোপ্যাণ্ডেলে প্রবেশ করে আমরা প্রতিমা আর বইয়ের স্টলগুলো ঘুরে দেখতাম। মন্দিরের কলে জিলিপির রস মাখা আঙুলগুলো ধোওয়ার সময় জোর করে কেউ আমাদের হাতে এক দোনা প্রসাদ বা একটা মোতিচূরের লাড্ডু ধরিয়ে দিত। ঈশানতোষ হলের বাইরে রাখা বাংলা খবরের কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেবার পর আরো একবার চাতাল প্রদক্ষিণ করতাম দুজন। পম্পা সবার অলক্ষ্যে তার নতুন চুড়িতে অলঙ্কৃত হাত দিয়ে আমার কবজি ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করত – আর ইউ অফরেইড? আর আমি বলতাম – জাস্ট এ লিট্‌ল্‌। দুপুরের ভোগের শেষ ব্যাচ উঠে যাওয়ার পর তখন এক এক করে নারী-পুরুষ ও শিশুরা প্রাঙ্গন থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। কেউ মারছে হাইয়ের উপর তুড়ি, কেউ থেমেছে গেটের নিচের পানের দোকানে। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো এক এক করে চলে যাওয়ায় রীডিং রোডের চওড়া নির্জন বুক আবার শহরটাকে ব্রিটিশ যুগে ফিরিয়ে নিতে চাইছিল। প্যাণ্ডেল আর লাইব্রেরির মাঝখানে ঝুলে থাকা একটুকরো আকাশ পেরিয়ে যাওয়ার পথে পাখিরা শব্দ না করার জন্য ডানা মুড়ে ফেলছে। স্বচ্ছ বাদাম তেলের মতো মসৃণ আলোয় কালিবাড়ি মার্গ ধরে আমরা গোল ডাকখানায় চলে আসি। - আর এক পা হাঁটতে পারছি না, জয়। এই আমি বসে পড়লাম, বলে শাসাতে থাকে গুলাবো-জান। কোথাও কোনো রিকশার চিহ্ন নেই। তবে এরকম দিনে বান্ধবীর নালিশ ফুরোবার আগে পথ ফুরিয়ে যায়।


    ***

    রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে এবার যক্ষিণীর মূর্তিটাকে আরো বড়ো মনে হচ্ছিল। সামনের বাসস্টপের রেলিংয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পম্পা বলল – তুই যেতে চাইলে যা, আমি এখানেই থাকব।

    – কতক্ষণ?

    – যতক্ষণ না ওই যক্ষটাকে তুই আর টোটো সরিয়ে ফেলছিস ততক্ষণ তো বটেই। বেশিও হতে পারে। কী ঠিক করলি বল।

    আমার গার্লফ্রেণ্ড নিউ দিল্লীর রাস্তায় ঘুরতে ভালোবাসত। আজ রাস্তাটাকে সে এমনভাবে দেখছিল যেন এই শেষ দেখা।

    - আগেই তো বলেছি, তুমি যা চাও। তুমি চাইলেই ‘হ্যাঁ’।

    - সেটা হচ্ছে না। নিজের থেকে, নিজের জন্য চাইতে হবে। নইলে তোর মায়ের কাছে কী মুখ থাকবে আমার?

    বান্ধবী রেগে যাবে জেনেও আমার মুখে মুখে তর্ক করার স্বভাব যায় না। বললাম - কেউ কী করে জানবে আমি কার জন্য ‘হ্যাঁ’ বলছি? একটা অমীমাংস্য ব্যাপার। আনপ্রুভেবল্‌ হাইপথেসিস।

    - তোর চোখ দেখে বোঝা যায় তুই মিথ্যে বলছিস না সত্যি।

    - যা বোঝার বোঝো। কিন্তু তোমরা কীভাবে এত সহজে একটা আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করো সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। লোকটা যা বলে তার অর্ধেক বানিয়ে বলে।

    - এটা গল্প নয়, সত্যি। তুই নিজেও তার প্রমাণ দেখেছিস।

    - আমি যা দেখেছি তার কোনো মানে হয় না। হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট মীনিংলেস। এক বর্ণও সত্যি সেটা তুমি জানলে কী করে? ঠাকুরের গাইডেন্স?

    পম্পা মুখার্জির কনুইয়ের সঙ্গে আমার কনুই ঠেকে যাচ্ছিল। সে রেগে গিয়ে রেলিং থেকে নেমে বিবেকানন্দের মতো বগলের নিচে হাত লুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমিও লাফিয়ে নামি এবং আমাদের পায়ে হেঁটে শহর মাপার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছিল।


    ***

    কনট প্লেস থেকে তখন ফেরার বাস ধরতে যেতাম আমরা। আমার বান্ধবী বলত – দেখ, আজ রাতে একটা নতুন স্যাটিনের লহঙ্গা পরব। দেখলে মাথা ঘুরে যায়। পার্ক টাউনে আসছিস তো? হোল-নাইট সিনেমার প্রোগ্রাম। মহিলারা সব এক সঙ্গে বসবে, অনেক গল্প হবে। তোকে আমি টেনে নেব সেই দলে। স্টলের অসাধারণ ঘুগনি। গোটা প্যাণ্ডেলে তার সুগন্ধ পাবি। আমি বলতাম - হোল নাইট জাগতে পারব না। সকালে আবার শিমলিপুরের পূজোবাড়িতে কী সব বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। পম্পা বলত – তিনটের সময়ে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়িস। বাবা-মা আগেই ফিরে যায়। না রে, এক ঘরে শোওয়া হবে না তোর। আমি পাহারা দেব বাইরের ঘরে। তুই আমার বেডরুমটা পাবি। তাও তো কী কাছে, বল? মাঝখানে মাত্র এক ইঁটের দেয়াল। আমি মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলতাম – আগুন আর ঘি। এ জিনিস খেলার নয়। রাত্রিবেলা যদি আমাদের খাট দুটো চুম্বকের মতো একটা আরেকটাকে টানতে থাকে, আর দরজার ছিটকিনিটা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সড়াৎ করে নেমে যায়? পম্পা হা হা করে হাসত। – আমাকে এত ভয় পাস তুই? কী ছেলে রে বাবা! তখন আমি বলতে বাধ্য হতাম – যাই ঘটুক না কেন, কে আমাকে বিশ্বাস করবে? গুলাবো থেমে গিয়ে বলত – কে তোকে বিশ্বাস করবে জানিস? তোর মা আর তোর মামিমা। কিছু হলে তারা বলবেন আমি তোকে জাদু করে হীরে থেকে কয়লা বানিয়েছিলাম।

    বাসে ওঠার আগে আমরা আইসক্রীম কিনতাম। সীটে বসে আমার বান্ধবী বলত – আই ক্যান সী দ্য ইনসাইড অফ এ ক্যারেক্টার। আমি একটা মানুষের ভিতরটা দেখি। তুই দেখিস বাইরেটা।

    - তুমি রঙ্গার ক্যারেক্টারের ভিতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছিলে সে তোমায় কিছুক্ষণ বাদেই চুষতে শুরু করবে?

    রেগেমেগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিত আমার গুস্‌সেওয়ালি গার্লফ্রেণ্ড। চুপ করে বসে একসঙ্গে আইসক্রীম খাওয়ার সময়ে আমি জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় চুলের সুগন্ধ আরেকটু বেশি করে পাওয়ার জন্য সন্তর্পণে তার দিকে সরতাম। এক সময়ে সেটা টের পেয়ে গিয়ে চট করে একটা সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে তাকাত আমার সঙ্গিনী। তারপর কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে উদাসভাবে বলত – আমি রঙ্গার নয়, ডক্টর বাজাজের কথা বলছি।

    না বোঝার ভান করি। আসলে আমি জানতাম।


    ***

    আমাদের বাস বারাখাম্বা রোড, মডার্ন স্কুল, মন্ডী হাউস, আইটিও হয়ে লালকেল্লার দিকে এগোত। শরতের দুপুরে এই শহরে কোনো কাজ করা সম্ভব নয় বলে তখন কলম নামিয়ে রেখে কেরানিরা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, ইলেক্ট্রিশিয়ানরা দাঁতে টেস্টার চেপে স্ত্রীট লাইটের পোল বেয়ে নেমে আসছে, ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামার ছাত্র-ছাত্রীরা পরস্পরকে না চেনার কপটভানে কেউ ইণ্ডিয়া গেট আর কেউ প্রগতি ময়দানের দিকে হাঁটা দিয়েছে, টুরিস্টরা তাদের সারাজীবনের অন্বেষণ সাঙ্গ করে এই ধুলোতেই মিলিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় কালোজাম গাছের নিচে চটি পেতে বসে পড়ছে। গুলাবো আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলত – গুরু গোবিন্দ্‌ সিংয়ের মতো সাহসী চাইলে তুইও হতে পারিস, জয়।

    আমি লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতো বাসটাকে আরো খানিকটা এগিয়ে যেতে দিতাম। আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আমার বান্ধবী হঠাৎ একটা নতুন আশার উদ্দীপনায় ছটফটিয়ে উঠে বলত – আর এর বদলে যেটা তুই চাস সেটা যদি পেয়ে যাস, তাহলে? কথাটা বলে ফেলার পর সে অসম্ভব সরলতায় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হাসতে থাকত যেন এরকম নির্লজ্জ আচরণ পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো মেয়েকে করতে হল। আমি তখন গুলাবোর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলতাম – আমি কী চাই জানো তুমি? সোডার বুদবুদের মতো বেরিয়ে আসা বিস্ফোরক হাসির ভলি এসে ঝাঁকাত আমার তন্বী বান্ধবীকে। সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে সে বলত – হ্যাঁ, জানি। আমি যেন সেটাকেই মেনে নিয়েছি এমনভাবে চুপ করে বসে থাকতাম। সে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার দিকে একবার অপাঙ্গে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলত – আমার স্কিন। অল অফ ইট! নো?

    পরে লালকেল্লার সামনে রামলীলা গ্রাউণ্ডের ভিড় সামলাতে গিয়ে আমাদের বাসটা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। গুলাবো আর আমি রাত জাগতে হবে বলে চোখ বুজে ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনি আর বাস আড্ডার কোলাহলে যখন তন্দ্রাঘুম, লজ্জাঘুম, তীব্রঘুম, স্বপ্নঘুম, শঙ্খঘুম, আর ঘন্টাঘুম পেরিয়ে ধাক্কাঘুমে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি তখন খেয়াল হত – কোথায় আমরা? বাস কবে কিংসওয়ে ক্যাম্প থেকে ঘুরে পার্কটাউনের রাস্তায় এসে পড়েছে। - ওঠো, ওঠো! স্টপ মিস্‌ হয়ে যাবে। সঙ্গিনীর হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নামাই তাকে। - এই কী করছিস, বদমাইশ? লোকজন দেখে কী ভাববে? আমি থামি না। – যা ভাবে ভাবুক। বাড়ি যেতে হবে না? – এত টানা-হেঁচড়ার কী দরকার ছিল? আগে জাগাতে পারলি না? আমার সোলটাই বাসে রয়ে গেছে। - থাকুক সোল বাসে। তোমার মা তোমার আত্মার ফ্যান হয়ে বসে নেই। বডিটা তাঁর জিম্মায় করে দিয়ে তবে আমার ছুটি। রাত এখানে কাটাতে চাইলে আমাকেও তো বাড়িতে একটা খবর দিয়ে আসতে হয়। পরে আমার বান্ধবী মাথা ভর্তি চুল ঝাঁকিয়ে বলে - ছি, ছি। একটা সামান্য বডি বের করে আনার জন্য এত গর্ব করছিস? করবি না কেন? তোর সমস্ত লোভ যে বডির উপর। পারভার্টেড ক্রীপ!

    আমি গুলাবোকে তাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে বললাম – তোমাকে একটা গল্প শোনাতে চাই। আমাকে গুরু গোবিন্দ্‌ সিং বানাবার আগে সেটা শুনে নিও।

    - নতুন লিখলি? কী নাম?

    - নাম হল ‘আওয়ার স্কিন’। আমাদের ত্বক। তোমার প্রিয় টপিক। কিন্তু আমি লিখিনি। আমার জন্মের অনেক আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। এই গল্পটা শোনার জন্য ডক্টর বাজাজ আমার পা ধরতে রাজি হয়ে যাবেন।

    - উঃ। মনে হচ্ছে থ্রিলিং। সিনেমা-টিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পর শোনা যাক তাহলে? দুজনে পাশাপাশি, হালকা কম্বলের তলায়?


    ***

    পম্পাদের পূজোর ব্যবস্থা শিমলিপুরের চেয়ে ভালো। ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। চেয়ার বেশি। শিমলিপুরে গেলে আমাদের মাটিতে পাতা দরির উপর বসতে হত। এখানে প্রোগ্রাম শুরু হবার অনেক আগে না গিয়েও মহিলাদের ব্লকে চেয়ারে জায়গা পেয়ে গেলাম। পম্পার একদিকে আমি, আর একদিকে মাসিমা। মেসোমশাই ঘুগনির স্টলে ক্যাশ বাক্সের ভার নিতে চলে গেছেন।

    অতি পুরাতন সুচিত্রা-উত্তমের ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট ছবি। আমার চারদিকে তারই মুগ্ধ দর্শক। এক-একটা রীল শেষ হলে কেউ সেটাকে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ভরে শিমলিপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেখানে একই সিনেমা দেখানো হয় আধঘন্টার গ্যাপ দিয়ে। পম্পা গদ্গদিয়ে উঠে বলে – বাঙালিদের মধ্যে উত্তম কুমারের মতো ছেলে আর পাওয়া যায় না! মাসিমাও গাল ভরা হাসি হাসছিলেন। আমি বললাম – আমার বড়োমামার মতো গায়ের জোর কোনো অভিনেতারই নেই। তিনিও ফিল্মে চান্স পেয়েছিলেন। কিন্তু অত পাউডার লিপ্স্‌টিক মাখতে রাজি হননি বলে ডাইরেক্টারের সাথে ঝগড়া হয়ে যায়। হয়তো উত্তমকুমার অভিনয়ে একটু এগিয়ে, কিন্তু বড়োমামার মুখশ্রী ঢের বেশি রোমান্টিক। দেরাদুনে চলুন, দেখিয়ে আনব।

    চারপাশের মহিলাদের ব্যূহ থেকে যা-তা রকমের মন্তব্য ভেসে আসতে শুরু করে। – কোত্থেকে এসেছে এই ভুঁইফোঁড়? – ওভারস্মার্টটাকে কান ধরে বার করো। পিছন থেকে কেউ বলল – আরেকবার বললে গরম সাঁড়াশি দিয়ে জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে।

    পম্পা আমার কনুই খামচে ধরেছিল। – মুখ ঢাক নির্বোধ, নইলে তোর জন্য আমরা মুখ দেখাতে পারব না।

    টোটোদার দেওয়া জিমখানা লেখা টুপির ভাইজার নামিয়ে নটা-বারোটার শো শেষ করলাম। তারপর প্যাণ্ডেলে আলো জ্বলার আগেই টুপিটা সরিয়ে ফেলি যাতে টুপিওয়ালা বলে আমাকে কেউ চিনতে না পারে।

    বিরতিতে জানা যায় পরের শো’য়ের রীল এখনো মিন্টো রোডে চলছে। বেলুন নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলতে শুরু করল দরির উপর। বড়োদের কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে। মাসিমা হাই তুলতে লাগলেন। ওঁদের হয়ে গেছে। - বাড়ি যাবে, মা? পম্পা জিজ্ঞেস করে। - তোর বাবা থাকে থাকুক, আমরা যাই চল। কিন্তু মেসোমশাইও স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আধখানা চাঁদের নিচে কুকুরের ঘেউ ঘেউ উপেক্ষা করে আমরা চারজন শরতের ঠাণ্ডা হাওয়া উপভোগ করতে করতে বাড়ির দিকে চলে আসি। পার্কটাউনে আমার প্রথম রাত্রিযাপন। পম্পা কানের কাছে বলে – মা চাইছে আমি বেডরুমেই শুই। তোকে বাইরের ঘরে বিছানা করে দিলে মাইণ্ড করবি?

    মাইণ্ড হী নহীঁ তো কেয়া মাইণ্ড করনা? বললাম – বিছানাটা মাইণ্ড করবে কিনা জিজ্ঞেস করো। রাত্রে আমার গা থেকে নতুন শিকারের খোঁজে ছারপোকা আর উকুন বেরিয়ে আসে।

    - জয়, এই পোকাদুটোর নাম তুই মায়ের সামনে ঠাট্টা হিসেবেও উচ্চারণ করিস না। ম্যাসিভ প্রবলেম হয়ে যাবে।



  • পূজোর দিন, পূজোর রাত ২ | পূজোর দিন, পূজোর রাত ১ | পূজোর দিন, পূজোর রাত ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments