এর পরের কদিন টোটোদা আর আমি ভোরবেলা শিমলিপুরের প্যাণ্ডেল থেকে হোল নাইট প্রোগ্রামের চেয়ারগুলো তুলে দিয়ে মণ্ডপের টুকিটাকি কাজ সারতাম। প্রসাদের ফল কাটার দল এসে হাজির হওয়ার আগে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ক্যান্টনমেন্টের ধার দিয়ে আমাদের মর্নিং ওয়াক শেষ হয়ে যেত। রাস্ক দিয়ে চা খাবার পর টোটোদা দাড়ি কামিয়ে স্নান করতে যেত, আর আমি সোফার উপর ফ্যান চালিয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নেবার পর মায়ের দেওয়া কড়া লুচি কিংবা পাতলা একটা রুটির সাথে কাঁচা লংকা দিয়ে আলুর তরকারি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সে দিনের অভিযানে, যা শুরু হত মল রোড কিংবা ইউনিভার্সিটির বাস স্টপ থেকে। বেলা এগারোটা নাগাদ গুলাবো এসে পৌঁছোত। পূজোর দিনগুলোতেও সে শাড়ি পরতে না, কারণ আমরা দূর পাল্লার বাস ধরে কোনোদিন যাব কনট প্লেসের কাছে আর কোনোদিন সাউথ দিল্লী।
– স্টিল অফরেইড?
– নো।
– যাদের মন পরিষ্কার তারা কখনো ভয় পায় না।
বিনয়নগর কিংবা মিন্টো রোডের পূজোবাড়ি থেকে একটা ভোগের দোনা ভাগাভাগি করে খেয়ে আমরা কনট প্লেসের কফি হাউসে গিয়ে বসতাম আবার। শরতের দিন বলে উন্মুক্ত ছাদের কোনো টেবিল দখল করা যেত। কফি ছিল বাহানা। আসলে আমরা ইনার সার্কেলের বাড়িগুলোর উপর ফাঁকা জায়গায় হ্রদের মতো জড়ো হওয়া নীল আকাশের শরবত বিনে পয়সায় চোঁ চোঁ করে গিলতে আসি।
পম্পা হয়তো গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথ কি আনন্দ্ বকশীর গান গাইতে শুরু করেছে। আমি একটা হিন্দী দৈনিক যোগাড় করে খবর খুঁজছি; শিমলিপুরের খুনের সমাধান কি হবে এ বছর? উর্দি পরা বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করত – কিছু চাই, ম্যাডাম? ম্যাডাম তার রোদ চশমার ভিতর দিয়ে উদাসভাবে চেয়ে বলত – সবই তো আছে। – কোই প্রবলেম নহীঁ, বলে পুরোনো পাম্প–শু পরা বেয়ারা তার খালি থালা নিয়ে চলে যেত।
সব কি সত্যিই আছে? খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলে আমি মনে মনে ভাবতাম। রোদ চশমাকে ঝাঁকিয়ে নাকের ডগায় নিয়ে আসার পর তার উপর থেকে সন্দেহের দৃষ্টি ফেলে ম্যাডাম শুধোত – তোর কী চাই বলতো?
– কিছুই না।
– না। কিছু একটা চাই তোর। আমি বুঝতে পারছি। কী সেটা?
খবরের কাগজ পাশে সরিয়ে রেখে বলি – চল্লিশ বছর আগে এখানে একটাও উঁচু বিল্ডিং ছিল না। হনুমান মন্দির বলতে একটা ছোট্ট গাঁয়ের বাড়ি। সকালবেলা কনট প্লেসের রাস্তায় গাড়ি নয়, শত শত সাইকেলে কেরানিরা ছুটত সেক্রেটারিয়েটের দিকে। চিন্তা করো, হাতে গোনা যায় এমন কয়েকটা মাত্র বাস। ছাদখোলা মরিস কিংবা অস্টিন গাড়িতে ভারতীয় রয়্যাল ফ্যামিলির সদস্যরা হুশ করে আমাদের সামনের বাবা খড়ক সিং মার্গ দিয়ে চলে যাচ্ছে, যার নাম তখন ছিল আরউইন রোড। অথবা ভাবো ইণ্ডিয়া গেটের কাছে রাজপথ বা কিংসওয়ে নেই, সে জায়গায় শের শাহ সুরীর আমলের দেয়াল আর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। রাইসীনা হিলের উপরে অস্তগামী সূর্যের আলোয় একটা সোনার লঙ্কার রূপ নিয়েছে। তার নিচে কিলবিল করছে মাইলের পর মাইল জুড়ে আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্যাসেজ আর গলির তৈরি লুকোনো শহর। সেই শহরটাকে আমি ফিরে পেতে চাইছিলাম। বা তার অভাবে দুজন ফিট করতে পারে এমন একটা টাইম মেশিন।
– ওঃ, কী আব্দার! একটা অমলেট আর টমেটো সস্ পেতে পারিস। নিবি?
– হুম্ম্ম্। আচ্ছা, দাও।
পেট ভরলেও মন ভরত না। মন ভরলে ইচ্ছেগুলো বেরিয়ে এসে ন্যাংটো ছেলের মতো ফুটপাথে দৌড়োত। রিখিরামের সেতারের দোকানে আমরা এস্রাজ আর পাখোয়াজগুলো খরিদ্দারের মতো পরখ করতাম। গলগোটিয়া ব্রাদার্সে গিয়ে খুঁজতাম এমন কোনো বুড়ো জেলখাটা কয়েদীর মতো বই, তিরিশ বছরে যে কোনো মানুষের মুখ দেখেনি। – আজ আমি পার্কটাউনের পূজোবাড়িতে ধুনুচি নিয়ে নাচব। তুই আসবি তো? বান্ধবী জানতে চায়।
আমি বলি – নিশ্চয়ই। তুমি কি হিপ গ্রাইণ্ড করবে?
– বাজে বকিস না। আমি পাড়ার লোকদের সামনে ওসব করব কেন?
– ইচ্ছে করে নয়। এমনিই।
– এমনিই?
– হ্যাঁ। মানে যদি না চাইতেও হয়ে যায়?
খানিকক্ষণ রাগী রাগী মুখ করে চলার পর যথারীতি আমার বান্ধবী হেসে ফেলত।
কীসের আশায় আমরা এইভাবে চলে বেড়াই? কী খুঁজছি দুজনে? একই জিনিস খুঁজছি কী? দিনের আলো নিভে আসার সাথে কারো রক্তে লাগে যায় ধুম। কেউ সেই রূপোর টাকার মতো দিনটা আরেকবার খরচ করা যাবে না বলে হতাশ হয়ে যায়।
সন্ধ্যেবেলা আমার বান্ধবী একটা সুতির লালপাড় সাদা শাড়ি পরে বেরিয়েছিল। ধুনুচি নাচার সময়ে সিল্ক চলবে না। মাথার চুল ডাকিনী স্টাইলে খুলে দেবার পর কাপড়ের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে সুরক্ষিত। আঁচল টাইট করে কোমরে জড়ানো। পায়ের গোড়ালি থেকে খানিক উপরে শেষ হয়েছিল কস্টিউম। – শাড়ি বেশি উঁচু হয়ে গেল কি? সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। মুগ্ধ চোখে তার পায়ের গোছ দেখতে গিয়ে আমি তোতলাতে শুরু করেছি। মাসিমা আমাদের আলাদা করে দিলেন।
একটা নতুন পাঞ্জাবি পেয়ে গেছি। মাসিমা বললেন – কাল দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু আজ যখন তুই পূজোর কোনো জামা আনিসনি তখন আজই পরে ফেল।
মেয়েরা নাচবে বলে বাঙালি লুম্পেনদের মধ্যে কিছু অবাঙালিও ঢুকে গেছে। পম্পা হাতে একটা মিষ্টির বাক্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ঝলমলে প্যাণ্ডেলে পা দিল। পিছনে মাসিমা আর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে এক পরিবারের সদস্যের মতো আমি। মণ্ডপের সামনে সাফসুফ করা কিছুটা জমি দড়ির বেষ্টনী দিয়ে আগলানো। তার বাইরে পার্কটাউনের স্থানীয় বাসিন্দাদের গুঁজে দেওয়া হচ্ছে যাতে বাইরের লোকেরা ঢুকে ঝামেলা না পাকায়। কিন্তু বেঁটেরা জায়গা ছিনিয়ে নেওয়ার ফলে মেসোমশাই আর আমি পিছিয়ে গেলাম।
গোটা চারেক ধুনুচি জ্বালানো হয়েছে। ঢাকের বাজনার সাথে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রবীণদের মধ্যে দু একজন শুভারম্ভ করেছিলেন। যাঁদের ফিটনেস শুধু মনে। পায়ে ঝরা পাতার গতি। তবু ধুনোর ধোঁয়া এবং গন্ধে আকাশ যখন ভরপুর তখন বাজনায় তাল ধরে রাখতে পারলেই হল। নন্দী ভৃঙ্গী এবং শিবের বিদেহী অনুচররা এসে আসর জমিয়ে তোলে।
ঢাকীরা বাংলার গ্রাম থেকে অপহরণ করে আনা মজুর। মুখে অবিরল হাসি, বুকে অফুরন্ত দম, পোষাক পরিচ্ছদ ধুলোমলিন এবং শরীরের কাঠামো মর্মান্তিক। এই হাড় জিরজিরে খড়ের মূর্তিগুলোকে পূজো কমিটি নীলকরের জমিদারদের মতো চোষে। পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়সের মধ্যে যখন বঙ্গবীরদের পেট, লোভ, আর পাষণ্ডত্ব পূর্ণ বিকাশ লাভ করে, তখন তাদের কাজ হল পূজো কমিটি বানিয়ে চালানো। সত্যি বলতে কী, তিরিশের পর বেঁচে থাকতে আমার ভয়ের মূল কারণ এটাই। মাঝে মাঝে ভাবি, সোজা তিরিশ থেকে ষাটে পৌঁছে যাবার একটা এক্সপ্রেস ট্রেন যদি পাওয়া যেত!
চার নম্বরে পম্পাকে ঢুকিয়ে দিল ওরা। সবাই খুব আশা করে থাকলেও বান্ধবী আমাকে কানে কানে বলেছিল – ঢাকের স্পীড বাড়াতে বলেছি। খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে, দেখিস। তবে একটা পোজও রিপিট করব না।
তারপর মণ্ডপের সামনে একটা ঝড় উঠেছিল। সবার মতো পাঁচ মিনিট ধরে স্লো মোশনে প্রণাম করেনি চণ্ডীগড়ের সিখনী। লো-পাওয়ার, গতানুগতিক যে মুদ্রাগুলোর মাধ্যমে নাচিয়েরা ভক্তির প্রদর্শন করে তার একটাও আমি হতে দেখিনি। পম্পা মুখার্জির প্রতিটি ভঙ্গী ছিল নতুন। একটার বেশি ধুনুচি সে তোলেনি, কিন্তু তার মুক্ত হাত আর উত্থিত জঙ্ঘার টেম্পো ঘূর্ণিহাওয়া বইয়ে দিচ্ছিল। দুরন্ত ঢাকের কাঠির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার বান্ধবী ববি সিনেমার ঝুট বোলে কৌয়া কাটে নাচটার অবলম্বনে মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত এক পায়ে হপ আর অন্য পায়ে কিক করতে করতে যখন গেল তখন লুম্পেনদের জটলা থেকে আলতো সিটি শুনেও মাসিমার উদ্ভাসিত মুখ থেকে গর্বের হাসি মোছেনি। পরে সমালোচনা বা প্রশংসা কুড়োবার জন্য ধুনুচিটাকে মঞ্চে বসিয়ে দিয়ে গুলাবো চট করে বেরিয়ে এসেছিল। আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হবার পর আড়মোড়া ভাঙার ছলে স্পষ্ট একবার হিপ গ্রাইণ্ড করে দেখায় সে।
শাড়ি পালটে লহঙ্গা পরার জন্য পম্পা বাড়ি ফিরবে। মাসিমা আর আমি সঙ্গে এলাম। নাচের ধুমে ঠাসা শকুন্তলা কলকলিয়ে উঠে তার মাকে বলে – আমার তো ইচ্ছে করে প্রত্যেকটা পাড়ায় গিয়ে নেচে আসি। এতে কি কিছু দোষের আছে, মা?
– তোর নিজের কী মনে হয়?
হাই অ্যাড্রিনালিনের জন্য শকুন্তলা হাঁপাচ্ছিল একটু। খানিকদূর গিয়ে সে বলল – আমি বুঝতে পারি না।
মাসিমার কাছ থেকে একটা গজল উদ্ধৃত করার অনুমতি চাইলাম। কবির নাম সুদর্শন। তখল্লুস ‘ফাকির’, যার অর্থ ভাবুক।
গম বঢ়ে আতে হ্যাঁয় কাতিল কী নিগাহোঁ কী তরহ
তুম ছুপা লো মুঝে অ্যায় দোস্ত গুনাহোঁ কী তরহ।।
অপনী নজরোঁ মেঁ গুনাহগার ন হোতে, কিঁউকর
দিল হী দুশমন হ্যায় মুখালিফ কে গওয়াহোঁ কী তরহ।।
ফুল আর কবিতা। দিল্লীর অধিকাংশ মহিলার ফেভারিট। প্রথমটা সস্তার সস্তা। দ্বিতীয়টা পাওয়াই যায় না। সারাদিন বসে গজলের বই চাটবার সুবাদে আমার কাছে দ্বিতীয়টার অভাব নেই। সেই একটা গুণে আজ আমি পম্পা মুখার্জির গা ঘেঁষে হাঁটছি।
পম্পা বলে – এটা আমি আগে শুনেছি। কিন্তু সবকটা শব্দের মানে জানি না।
বান্ধবীর মনোরঞ্জনের জন্য ফাকিরের তর্জমা আমার আগেই করা ছিল। বললাম – মুখালিফ মানে হল প্রতিপক্ষ। বাকিটা আশা করি বুঝতেই পেরে গিয়েছিলে।
বিষাদগুলি বাড়িয়ে আসে থাবা, আততায়ীর দৃষ্টি যেমন হত
বন্ধু আমায় লুকিয়ে তুমি ফেলো, গভীরতম অপরাধের মতো।
নিজের কাছে না হয়ে যাই দোষী, সফল হবে কী করে এই সাধ
হৃদয়ও যখন দুশমনের দলে, আমার অভিযোগীর অনুগত।
পম্পা মাসিমাকে আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। – লাস্ট দুটো লাইনে বলছে মন যখন নিজেরই বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকে তখন নিজেকে অপরাধী ভাবা ছাড়া মানুষের কোনো উপায় থাকে না। আর মন তো যুক্তি দেবেই। তোমরা সারাক্ষণ কানের কাছে বলো যার আড়াল নেই সে বৃষ্টিতে ধুয়ে বেরিয়ে যায়। অথচ ছেলেদের বেলা সেটা খাটে না। জয়কে কোথাও লজ্জা পেতে দেখেছ? যা ইচ্ছে তাই করে। বাড়িতে তাও বলে হীরের টুকরো। আমি সেরকম পারি? না মেয়েদের কেউ কখনো হীরের টুকরো বলে?
এই কথাটার পর আমরা সবাই চুপ করে গেছি। দেখতে দেখতে চলার পথও ফুরিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমাদের চিন্তার মেশিনগুলো বন্ধ হয় না। কয়েক দিন ধরে আমার স্কিনটা আমার বান্ধবীকে দিয়ে আমি তারটা পেতে চাইছিলাম। যাতে ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া সে আমার সহযোগিতা ছাড়াই করে নিতে পারে।
উৎসবের কদিন একটানা ঝড়ের মতো কেটে যায়। পার্কটাউনের আট দশ মাইলের মধ্যে কোনো পুজোবাড়িতে কলকাতার যাত্রা পার্টি এসেছে। পম্পার খুবই ইচ্ছে যাওয়ার। মাসিমা বললেন – রাত দুটোয় শেষ হয়, তারপর কী করবি? বান্ধবী আমার দিকে তাকায়। আমি বলি – অত রাতে বাস নেই। সাধারণত সবাই চেয়ারে ঘুমোয়, বা গল্প করে কাটিয়ে দেয়। মাসিমা বলেন – সারারাত চেয়ারে? পম্পাও মুষড়ে গেল। আমার আইডিয়ার দৌড় প্রবুদ্ধ। বললাম – তার মোপেডে ফিরলে কেমন হয়? মাসিমা চোখ কপালে তুলে বলেন – সেই ক্ষ্যাপাটার ভরসায় অত রাতে রাস্তায় নামবি? চোখে দেখে কিনা কে জানে।
অত রাতে কারোই প্রবুদ্ধর পিলিয়নে চাপবার সাহস হল না। ফলে রাতগুলো পার্কটাউনেই কাটত। একটা কি দুটো বাংলা সিনেমা দেখে আমরা পম্পাদের বাড়িতে ফিরে আসতাম। সকালে আবার ছুটতে হত বাড়ি, যাতে টোটোদার সঙ্গে মর্নিং ওয়াক মিস না হয়ে যায়।
সেই ছাই-ধূসর সকালগুলো গোলাপি হয়ে যাওয়ার আগে আমি টোটোদাকে যমুনার পুল পার করিয়ে দিতাম। টোটোদা আর তার বন্ধু মনু যখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র তখন গুজ্জররা তাদের সাইকেলের চেন আর বাঁশ দিয়ে মেরেছিল। তারপর মেরুদণ্ডের ইনফেকশানে দুজনেই মরো-মরো হয়। নতুন এক ধরনের সার্জারির পর টোটোদা বেঁচে ফিরল। মনু বাঁচেনি। তখন বহুদিন আমরা যমুনার দিকটা আসতাম না। অবাক হয়ে দেখলাম টোটোদার মন থেকে এখনো ভয় কাটেনি। আমাকে সে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
– টোটোদা, এই সব রাস্তায় কত দোকান উঠছে এখন। কোথাও সাইকেল সারায়। কোথাও নতুন একটা র্যাশন শপ। আগের মতো আর নেই। আমাদের বয়সী ছেলেদের উপর চাকরি খোঁজার চাপ। গুণ্ডামি কমে গেছে অনেক।
আমি টোটোদাকে পুরোনো কয়লার দোকানটা দেখিয়ে আনতে চাইছিলাম। তার বদলে সে-ই আমাকে টানতে টানতে পুলের এদিকে নিয়ে আসে। – জয়, এই বছরেও একটা লাশ পাওয়া গেছে যমুনার ধারে। আজ অবধি কিনারা হয়নি। পুলের দুদিকে শিমলিপুর। কিন্তু এদিকটা হল শহুরে ইঁদুরদের কলোনি, আর ওদিকটা মেঠো ইঁদুরদের পাড়া। শহুরে ইঁদুররা মেঠো হতে পারে না।
বাড়িতে মামিমা বলে – তোদের তো দেখা পাওয়া ভার। মনেই হয় না এ বাড়ির ছেলে। টোটো তাও মাঝে মাঝে রাতে ফেরে। জয়, তুই কোথায় থাকিস?
মা দূর থেকে অনুরোধ করল – বৌদি, পারলে জিজ্ঞেস কোরো নতুন বাবা-মা পেয়ে গেছে কিনা।
কোথায় রাত গুজরান করি সবাই আন্দাজ করে নিয়েছে। অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। টোটোদা আমাকে বাঁচাবার জন্য ডাহা মিথ্যে বলে দেয়। – আমার কাছাকাছিই থাকে। মাঝে মধ্যে প্রবুদ্ধর সঙ্গে। প্রবলেমটা কী?
দিন হয়ে যায় বিকেল। বিকেলগুলো সন্ধ্যে। মেলা গ্রাউণ্ডের পূজো প্যাণ্ডেলের বাইরে আমি আর গুলাবো পাশাপাশি এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটাতে থাকি। অথবা গে-লর্ডের দোকান থেকে আইসক্রীম কিনে কনট প্লেসের সেন্ট্রাল পার্কে বসে গলে যাওয়ার আগে খেয়ে ফেলা যায়। টাকা যা লাগে গুলাবোই দিচ্ছে। কে জানে কোথায় পায়। সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট থেকে বাস ধরতে গিয়েছিলাম। আমার বান্ধবী বলল – রকাব গঞ্জের গুরদুয়ারাটা কি দেখে যাব? দুর্গাপূজোর মাঝখানেও জুতো খুলে এবং মাথায় রুমাল বেঁধে তার পিছু পিছু গুরদুয়ারায় মাথা ঠেকিয়ে আসতে হল।
পরে গুরদুয়ারার সংলগ্ন নীরব নিউ দিল্লীর চওড়া সড়কের ফাঁকা ফুটপাথ দিয়ে নীম আর অশ্বত্থ গাছের তলায় হাঁটতে হাঁটতে পম্পা মুখার্জি তার সানগ্লাস খুলে আমাকে বলে – বেশি খাটাচ্ছি তোকে, জয়?
– না তো!
দাঁত দিয়ে সানগ্লাসের ডাঁটি চেপে ধরে মুহতরমা ভাবছিল কিছু। তারপর আমার দিকে একটা স্বপ্নের লজেন্স ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে উদার হয়ে সে বলল – তুই যদি কোনোদিন কাউকে প্রপোজ করিস তাহলে কোথায় গিয়ে করবি?
একটু চিন্তা করে বলি – হুম্ম্। ধরো এখানেই। এরকম কোনো নিরিবিলি অতীতের ছায়ায় ডোবা রাস্তায়। যেখানে গাছের উপর থেকে অতিকায় পাখি সেজে পুরোনো দিনের ভূতেরা আমাদের উপর নজর রেখেছে।
– কোনো হিল স্টেশন কি সমুদ্রের ধারে কেন নয়? শিমলাতে কী ভালো ভালো স্পট আছে! তোর সেরকম রোমান্টিক কিছু করতে ইচ্ছে করে না?
মহিলাটির মন থেকে রঙ্গার স্ট্যাম্প এখনো মোছেনি। বললাম – ধুর্! শিমলাতে আছে সুইসাইড পয়েন্ট। আর লুত্যেনের দিল্লীর নিরালা রাস্তাগুলোতে অসংখ্য জিন এসে আস্তানা গাড়ার পর পুরো শহরটাই লাভার্স লেন হয়ে গিয়েছিল।
– হা, হা, হা। হাউ অ্যামিউজিং! ব্যুরোক্র্যাটদের শহর একটা!
– ব্যুরোক্র্যাটদের কম ভেবো না। ব্রিটিশ যুগে ছেলেরা শনিবার বিকেলবেলা সেজেগুজে পার্টিতে যাবার পথে একেবারে অচেনা মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে যেত। কেউ কাউকে চেনে না, একজন অন্যজনের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আচমকা মিষ্টি সুরে ঘন্টা বেজে উঠত। হঠাৎ দেখা যেত নীম গাছের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে জিনরা রাস্তার পাশে ফাঁকা জমির উপর একটা পুরোনো চার্চ বসিয়ে দিচ্ছে।
পম্পা হাসতে থাকে। – আস্ত চার্চ?
– ব্রিটিশ শহরে তাজমহল বসালে মানাত না! পুরোনো চার্চটা কোথা থেকে তুলে এনেছে কে জানে। হয়তো আফ্রিকা, কিম্বা স্পেন। চার্চের দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে দিত কোনো পাদ্রী। – কাম, কাম, মাই চিল্ড্রেন, হারি। কেউ এসে পড়ার আগে কাজটা ফিনিশ করে নাও। আর কী? ক্রিশ্চান না হলেও দুজনে এক ছুটে ঢুকে পড়ত অজানা সেই গির্জার ভিতর আর একটু পরে যখন হাতে একটা ছোট ফুলের বুকে নিয়ে বেরোত তখন তাদের গা দিয়ে ঘাম বেরোচ্ছে। চোখের মণির ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন যা জিনরা সেখানে ফুঁ দিয়ে ভরে দিয়েছিল। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য তখন তাদের টাই, আর স্কার্ফ উপড়ে ফেলে ছুটতে হত একটা হোটেল ঘরের খোঁজে।
– অ্যাবসার্ড! এটা মোঘলদের দিল্লী নয়। ব্রিটিশদের শহরকে কেউ কোনোদিন লাভার্স লেন বলবে ভাবাই যায় না।
– সত্যি কি তাই? এই শেষ পাঁচ মিনিটে তোমার কোনো অনুভূতি হয়নি?
– কীসের অনুভূতি?
– এই যেমন রাস্তাটাকে কেউ পালটে দিয়েছে। আমাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে এটাকে। চার্চ না হোক, আমরা হয়তো তার যোগ্য নই, কিন্তু গাছের উপর থেকে নির্ঘাত কারো হাত এসে একটা ফুলভর্তি ডালের তলায় দুজনের বসার মতো বেঞ্চ রেখে যাবে।
– কোথায় বেঞ্চ? চোখ খুলে দ্যাখ, শুধুই অশ্বত্থ গাছ আর ফুটপাথ, আর পিচের রাস্তা, আর ইঁটের দেয়াল, আর… এটা কী? আমার বান্ধবীর চোখ বেলুনের মতো বিস্ফারিত।
একসঙ্গে এগোতে এগোতে আমরা দেখতে থাকি। রাস্তার বাঁদিকে একটা পুরোনো ক্যাথিড্রাল উদিত হচ্ছিল। লাল চূড়ার উপর ক্রসটা খুব ভালো করেই দেখা যাচ্ছে এবার।
– গুড গড! চার্চই তো দেখছি একটা। পম্পা মুখার্জিকে বলি আমি। – চেহারাটাও পুরোনো খুব। আগে দেখেছ নাকি?
– না তো!
– একটা কলোনিয়াল গন্ধ পাচ্ছি। আফ্রিকারই কি? চলো ভিতরে গিয়ে চেক করে আসি পাদ্রী আছে কিনা। তাহলে…।
পম্পা এদিকে কোনোদিন আসেনি আগে। ক্যাথিড্রাল অব রিডেম্পশানটা তাকে দেখাব বলেই আমি এই রাস্তা ধরেছি। ভেবেছিলাম যীশুর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করব ত্রিশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সে আমাকে তার একমাত্র বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে কবুল করতে পারবে কিনা। কিন্তু জিন ফিনের গল্প শুনিয়ে দেওয়ায় সব পণ্ড। পম্পা স্তব্ধের মতো আরো খানিকদূর গিয়ে সেটা যে সত্যিই একটা চার্চ যাচাই করে আসে। সঙ্গে একটা জেনুইন গোরস্থানও আছে। সব দেখার পর সে আমাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ফিরিয়ে নিয়ে চলল।
পরে গুলাবো আমাকে গাঁট্টা মারতে চেয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমরা একটা পূজোবাড়িতে ঢুকে পড়েছি। ধুনোর ধোঁয়া আর ঢাকের শব্দ আমাদের সংযমের দরজা ভেঙে দিচ্ছিল। সেটা সামলাতে গিয়ে আর কার কী মনে থাকে।
প্রতিমা বিসর্জনের দিন এসে যায়। কাহারবা ছেড়ে ধাগেটে তাকেটে করে ঝুমুর তাল বাজাচ্ছে বিষণ্ণ ঢাক। যমুনার ঘাটে সত্তরটা পূজোর ব্যানারের নিচে সত্তর হাজার চলন্ত পুতুলের মতো মানুষ। বালি আর ঘাসের জমিতে প্রতিমা এনে বসাচ্ছে এক একটা কলোনি। অনেক হাঁটার পর প্রবুদ্ধ আর আমি পার্কটাউনের ব্যানার খুঁজে পেয়েছিলাম। একদিকে লরি আর অন্যদিকে বাস দাঁড় করিয়ে ওরা নিজেদের জায়গাটা আলাদা করে নিয়েছে। এখানে আরেকবার ধুনুচি নাচ হবার কথা। পম্পাকে সেখানে না পেয়ে আমি নিরাশ হয়ে প্রবুদ্ধর সঙ্গে শিমলিপুরের বলদে টানা প্রতিমার বাহনের কাছে ফিরে আসি। মাঝে মধ্যে চেনাজানা আর স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের দেখতে পাচ্ছি। কেউ পরেছে পাঞ্জাবি আর জিন্স্। কেউ পরেছে চুড়িদার। মাইকে চিৎকার। অমুক কলোনির সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে নিজেদের নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসুন, বিসর্জন শুরু হবে এবার। কোথাও বাচ্চাদের হামলায় ভড়কে গিয়ে বিপন্ন মালিককে নিয়ে আইসক্রীমের ঠেলাগাড়ি মেরেছে ছুট। কোথাও বেলুন বিক্রি করছে একটা অদৃশ্য রোবট। অর্ধেক মানুষ যাচ্ছে ডানদিক থেকে বাঁয়ে। অর্ধেক বাঁ থেকে ডাইনে। এমনকি নদীর বালি আর কাঁচের গুঁড়ো মেশানো হাওয়াও দুভাগে ভাগ হয়ে মানুষদের পিছনে ধাওয়া করে চলেছে দুটো বিপরীত দিকে। রাঙালুর মতো সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে টার্টল শেল প্যাটার্নের রোদ চশমার পিছনে লুকোনো দুটো আমাদের বয়সী মেয়ে আলাপ করতে এসেছিল। সেই মুহূর্তেই কান ফাটানো শব্দে কাছাকাছি কোথাও একসঙ্গে গোটা ছয়েক ঢোল বেজে ওঠে। তারপর আমরা কেউ কারো কথা শুনতে পাইনি, এবং স্লো মোশনে চলতে চলতে এক সময়ে সেই সত্তর হাজার বাচ্চা, বুড়ো, নারী পুরুষ, বলদ, লরি সব সমেত পূজোর শেষ দিনটা যমুনার উঁচু পাড় থেকে নিচের কালো শীতল জলের আবর্তে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল।
বান্ধবীর খোঁজে আমি বাস ধরে যতক্ষণে পার্কটাউনে ফিরে গিয়েছিলাম ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। প্যাণ্ডেল জনশূন্য। ওদের পার্টি আগেই ফিরেছিল। শান্তির জল নিয়ে সবাই বাড়ি চলে গেছে। নির্জন গলিগুলো পেরিয়ে গুলাবোদের পাড়ায় পৌঁছলাম। লাল সালোয়ার কামিজ পরে সে দুতলার জানালা দিয়ে রাস্তায় নজর রেখেছিল। আমায় দেখে দুদ্দাড়িয়ে নেমে আসে।
– এতক্ষণ কোথায় ছিলি? ভেবে ভেবে আমাদের মাথা খারাপ। তোর ঘাটে আসার কথা ছিল না? তিনঘন্টা ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। খুঁজতে খুঁজতে গায়ে হাত পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।
– সেখানেই তো ছিলাম! তিন ঘন্টা আমিও এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চষে বেড়িয়েছি।
– বাজে বকিস না। এরকম একটা টকটকে লাল জামা তোর চোখ এড়িয়ে গেল?
– বাই গড, এরকম লাল জামা পরা ডজন ডজন মেয়ে এসেছিল। তাদের প্রত্যেকের মুখ আমি লক্ষ বার চেক করেছি। প্রবুদ্ধ ছিল আমার সঙ্গে।
ক্রমশ প্রকাশ হয় আমি আর পম্পা পরস্পরকে একই মেলায় একই সময়ে এক ব্যানারগুলোর তলায় খুঁজেছি। একই পাথরগুলোতে হোঁচট খেয়েছি, একই আইসক্রীমের ঠেলা, বেলুনওয়ালা, চানাওয়ালার চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে মরেছি। ইস্কুলের একই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে পালিয়েছি। কিন্তু অবিকল এক রকম দেখতে হলেও তকদীরের জগতে এই দুটো বিসর্জনের ঘাট আলাদা হয়ে ছিল। কপাল যাদের পৃথক করতে চায় তাদের মনের ইচ্ছের জোর কী করবে? বালির উপর প্রতিমার সামনে আমাকে দেখিয়ে ধুনুচি নাচার শখ গুলাবোর পূর্ণ হয়নি বলে সে আক্ষেপে মরে যাচ্ছিল।
মাসিমা আমাকে মালপোয়া, সন্দেশ, আর ঘুঘনি এনে দিয়েছিলেন। পম্পা খুন খুন করে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে যায়। আমি বললাম – কাল একটা পুরোনো আর ভাঙা চার্চ দেখতে যাবে? আমাদের হেরম্ব জ্যাঠা বলেন দ্য চার্চ অব আওয়ার মিস্ফরচুন। সেটাতে যে বছরেই মাস্ হয়েছে তার ছ মাসের মধ্যে চার্চে আগুন লেগেছে। সেই থেকে মাস্ বন্ধ কিন্তু প্রতি রবিবার সার্ভিস হয়।
– এটাও কি আফ্রিকা থেকে জিন এসে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল?
– না। এটা আমাদের শিমলিপুর ব্র্যাণ্ডের মাল।
পম্পাকে বলিনি গীর্জাটা বেশ খালি থাকে। অনেকের বিশ্বাস একমাত্র ভাঙা কপাল যাদের তারাই এই চার্চে গিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারে। এতদিন কেন যে যাইনি?
পরের দিন সকালটা আমি আর টোটোদা শিমলিপুরের প্যাণ্ডেল তোলার কাজে লাগিয়ে দিলাম। যতদিন প্রতিমা ছিল ততদিন কাজের লোকের অভাব ছিল না। প্রতিমা গায়েব তো মানুষও অদৃশ্য। হেরম্ব জ্যাঠা তাঁর চেয়েও বুড়ো দু-একজনের সঙ্গে শূন্য মণ্ডপে চেয়ার পেতে বসে সুপারভাইস করছেন। সঙ্গীদের মুখে দাঁত নেই। কথা বলতে গেলে গাল দুটো চুপসে ভিতর দিকে ঢুকে যায়।
টোটোদা কাঠের ফোল্ড করা টেবিল তুলছিল, এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন – তুই ক্যা রা?
– অরিন্দম সেন। টোটোদা নিজের নাম বলল।
– তরে এত বড়ো দেখাইতাসে ক্যান? গত বছর এইটুকুনি দেখছিলাম।
টোটোদা বৈরাগ্য আর বিস্ময়ের একটা উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর বলে – তখন আপনার চোখে এত মোটা প্লাস পাওয়ারের চশমা ছিল না।
– তবে কী ছিল?
– ছানি। দেখতে পেতেন না। কাছে ডেকে মুখের উপর হাত বুলোতেন।
– অ। এখন ঠিক দেখতে আসি?
– হ্যাঁ। এখন সব ঠিকই দেখছেন।
– তাইলে ক, তর নাম কী?
– আমার মনে নেই। বলে টোটোদা টেবিল সমেত রওনা দেয়।
হেরম্ব জ্যাঠা টোটোদার উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে ডেকে নিলেন। তারপর পাশে বসা বৃদ্ধটিকে বললেন – এই ছ্যামরা বেটার। আপনি এরে নাম জিগান।
– তর নাম কী?
বললাম।
হেরম্ব জ্যাঠা বৃদ্ধকে উৎসাহ দেন। – ভালো হইতাছে। আরো কিছু জিগান।
– তুই ক্যা রা?
ধৈর্য না হারিয়ে নামটা আবার টেনে টেনে উচ্চারণ করি।
হেরম্ব জ্যাঠা খুশি হয়ে গেলেন। – শাবাস! একদিন আমাদের সবার এই অবস্থা হবে, সেইটা মনে রাখবি। জীবনের অভিশাপগুলো মাথা পেতে নিতে হয়।
– আমি নেব না। চলে আসার আগে হেরম্ব জ্যাঠাকে কঠিন সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। – বুড়ো বয়স অবধি বেঁচে থাকতে কেউ জোর করে না। সবাইকে মানায়ও না।
– কী–ই–ই? কী বললি শুয়ার?
টোটোদা দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। ঘাড়ে একটা টেবিল তুলে নিয়ে যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করি পরের বছর থেকে আর এখানে আসব না।
পরে বেলা তিনটে নাগাদ পম্পাকে সঙ্গে করে আমি শিমলিপুরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার বান্ধবী আজ হলুদ টপ আর ব্রাউন প্যান্ট পরে তার ঘর থেকে বেরিয়েছিল। প্যান্টের তলা বেলবটমের মতো ছড়ানো। টপটা উপরে ঝুলিয়ে দিয়ে নিজের দেহভাস্কর্য যথাসাধ্য আড়াল করেছিল সে। আমায় দেখে আগে ভাগে বলেছিল – জানি শিমলিপুরে প্যান্ট পরে গেলে তোর গা জ্বলে, কিন্তু চার্চ বলে কথা। সেখানে একটু আধুনিক হয়ে যাওয়া উচিত।
আমি তাকে বলি – দেখো, তুমি যা ভাবছ সেরকম চার্চ নয়। এখানে কেউ যায় না। কুকুর ঢুকে বসে থাকে। কয়েকটা বুড়োবুড়ি মিলে চালায়। তারা যেদিন থাকবে না সেদিন চার্চও বন্ধ হয়ে যাবে।
– তাহলে আমরা যাচ্ছি কেন?
– কারণ এর পিছনে একটা গোরস্থান আছে। খুব ছোট। যমুনার কাছাকাছি এটাই একমাত্র ক্রিশ্চানদের সিমেটারি।
– হে প্রভু। এই কটা দিন মাত্র আছি দিল্লীতে, আর তুই সিমেটারি দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিস?
– ব্রিটিশরা যাদের সঙ্গে নেয়নি, দিল্লীতে কেউ মনে রাখেনি, এরকম আউটকাস্ট মানুষদের কবরগুলো বুলডোজ হয়ে যাওয়ার আগে যদি একবার দেখে আসতে চাও তো চলো। নইলে যাবার দরকার নেই। যমুনার ধারের জায়গাটা এত ফাঁকা যে তোমাকে এই পোষাকে নিয়ে যেতে আমার সত্যি ভয় করছে। আমিই চোখ সরাতে পারছি না তো অন্যরা সরাবে কী করে?
– এত ভয়? তাহলে কি আউটফিটটা পালটে ফেলব?
একটু দোনামনায় পড়ে গিয়ে বলি – নাঃ, থাক। পালটিও না। চার্চের ভিতরে অসুবিধে নেই। রাস্তা আর গলি তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাব। বেশি দাঁড়াব না।
পম্পা আবার নিজের ঘরে ঢুকে যায় এবং একটু পরে যখন বেরোয় তখন প্যান্টটা রয়েছে কিন্তু হলুদ টপের জায়গায় প্রায় হাঁটু অবধি ঝুলের একটা ক্রীম রঙের কুর্তা।
– এইবার বল? যদি যেতেই হয়, তাড়াহুড়ো করব না। হাতে সময় নিয়ে সব দেখতে চাই আমি।
উত্তরে বলি – সেম হিয়ার। যদিও আমি চার্চ নয়, অন্য কিছুর কথা ভাবছিলাম।
সুতরাং বকশী রোড ধরে স্কুটারে দুজন যমুনার ধারের শেষ সরকারি কোয়ার্টার অবধি এসেছি। বাকিটা আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম। গুলমোহর গাছ থেকে পাখিরা কিচিরমিচির করছিল। রাস্তার ধারে কোথাও ব্রিটিশ যুগের ভাঙা কোয়ার্টার, কোথাও বেবাক টিলা। পুল থেকে কদাচিৎ একটা ঝরঝরে বাস আসছে। গলিটা দেখা যাচ্ছিল, কিছুদিন আগে রাধা কিষনের মন্দির থেকে পম্পা এটার দিকে তার আঙুল বাড়িয়ে দেয়।
যত কাছে এসে পড়ছি আমার বান্ধবীর পেন্সিল দিয়ে সামান্য সাজানো ভুরুদুটো উপরে উঠে যাচ্ছিল। হনহনিয়ে হেঁটে আমরা গলিটাতে ঢুকে পড়ি। ডানদিকে বাজাজের বাংলো, বাঁদিকে টিলা। রাস্তা একদম শুনশান। পম্পা মুখার্জি আমাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে – চার্চ দেখাতে এনেছিস, না অন্য কিছু?
আঙুল দিয়ে গলির একেবারে শেষের আধ-ভাঙা বাড়িটা দেখাই। – ওই দেখো। এখনো ভিতরটা ব্যবহারযোগ্য আছে।
– বাজাজের বাংলোর গলিতেই চার্চ এটা তো বলিসনি আগে?
– তুমি জিজ্ঞেস করলে বলতাম। এটা একটা ঐতিহাসিক পাড়া। এককালে এখানে একটা অন্য ধরনের কলোনি ছিল।
লাল ইঁটের বাড়িটা খুব একটা উঁচু নয়, চওড়াও নয়। তবে গভীর। পাথুরে টিলার মাঝখানে একটা উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা। নীল আকাশের গায়ে আটকে থাকা ধূসর সিমেন্টের ক্রসের দিকে তাকিয়ে আমরা দুজন পরস্পরকে কনুই দিয়ে ছুঁয়ে থাকি। দৃশ্যটার মধ্যে একটা গা ছমছমে অনুভূতি লুকিয়ে ছিল। যেন কারো ছায়া পিছনের সিমেটারি থেকে আমাদের উপর নজর রেখেছে। অথবা চার্চের চূড়ার চারদিকে ধীরভাবে পাক দিয়ে যাওয়া চিলটা আসলে চিল নয়।
– গলিতে বাজাজের বাংলো আর এই চার্চ ছাড়া আর কিছু নেই কেন? পম্পা স্বগতোক্তির মতো মৃদুতম গলায় জিজ্ঞেস করে।
– আগে ছিল। বললাম তাকে। – অন্য স্ট্রাকচারগুলো মেরামতের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ময়লা সাহেবের কাছ থেকে বিনে পয়সায় উপহার পাওয়া বাংলোর মেইন্টেনেন্স ভালো করেছিলেন বাজাজ। চার্চের ভিতরে যাবে কি?
কিন্তু আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আমার বান্ধবী মন্ত্রের নাগপাশে বাঁধা অসহায় প্রাণীর মতো আস্তে আস্তে গীর্জার বিরাট কাঠের দরজা অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক পা পিছিয়ে আমি তাকে অনুসরণ করি। লোহার হাতল ধরে সে দরজাটাকে টেনে খোলার চেষ্টা করল। পাল্লা এত ভারী যে গায়ের জোর লাগিয়েও খুলতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। ভিতর থেকে একঘেয়ে অর্গ্যানের শব্দ ভেসে আসছিল। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পিছন ঘুরে দরজাটা বন্ধ করতে গেলাম। তারপর যখন আবার সামনের দিকে ফিরেছি তখন পম্পাকেও আর দেখতে পাওয়া গেল না। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য আতঙ্কে আমার হাত পা আড়ষ্ট হয়ে যায়।
– হ্যালো-ও-ও! ফিসফিস করে উচ্চারণ করেছিলাম আমি। আমার গলার স্বর অর্গ্যানের মৃদু আওয়াজের সমুদ্রে ডুবে হারিয়ে গেছে। অনেকটা দূরে চার্চের একেবারে অপর প্রান্তে বেদির উপর রাখা পিতলের বাতিদানগুলোর উপর আলো এসে পড়েছিল। মাঝখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের ব্যবধান। গোলাপ আর রজনীগন্ধার উগ্র, ভ্যাপসা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। নিঃশ্বাস চেপে আমি পা বাড়াতে যাই এবং টের পাই এখান থেকে চওড়া এক একটা ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। আরেকটু হলে ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে পড়তাম। ভয়ের চোটে আমার লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। পম্পা কি পড়ে গেল? কিন্তু শব্দ পেলাম না কেন?
অর্গ্যানটা ইনিয়ে বিনিয়ে পুরোনো যুগের কান্নাগুলো গাইছে। প্রায় অনন্তকাল বান্ধবীর সাড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারি যে চোখ সয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমশ আগের চেয়ে ভালো দেখছি। আমার সামনে কাঠের করিডরের দুধারে পিউয়ের বেঞ্চগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবার কিছু বুড়ো আর বুড়ির মাথা দেখা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কোনো অল্পবয়সী মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি না।
হাতড়ে হাতড়ে একটা রো খুঁজে নিয়ে কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লাম। সেখান থেকে একটার পর একটা সারি ধরে পম্পাকে সন্ধান করছি এমন সময়ে আমার সামনের বেঞ্চ থেকে একটা বিরাট মুণ্ডু পিছন দিকে আমার জন্য ঘুরেছিল।
এখানে যে কেউ ওৎ পেতে বসে থাকতে পারে সেটা দুঃস্বপ্নেরও অতীত। তার উপরে উৎকট হাসি আর বড়ো বড়ো দাঁত দেখে হাত-পা ঢিলে হয়ে যায়। মুণ্ডুটা যখন কথা বলতে শুরু করে তখন নিচু খাতের গর গর আওয়াজটা আমি চিনেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
– ঘোঞ্চু, তুই কি আমাকে খুঁজছিস? ভুরু নাচিয়ে গুলজারীলাল বাজাজ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।