• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | গল্প
    Share
  • পূজোর দিন, পূজোর রাত ২ : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


    আরাবল্লীর অসুখ

    – এবার গল্পটা বল। ভূত আছে কি?

    – না। তবে একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে।

    – ভূতে আপত্তি নেই। তবে অন্ধকার যেন না থাকে। অন্ধকারের গল্প পড়তে আমার ভীষণ অসুবিধে হয়। দম আটকে আসে।

    আমরা বাইরের ঘরে জানালার পাশে দুটো আদা চা নিয়ে বসে অত্যন্ত মৃদু গলায় বিড়বিড় করছি। ঘরের আলো নেভানো হলেও রাস্তা থেকে চন্দ্রালোকের সঙ্গে বড়ো রাস্তার স্তিমিত ল্যাম্পপোস্টের শুঁড়ের মতো রশ্মি অনেকগুলো বাঁক ঘুরে আমাদের সঙ্গ দিতে এসেছে। প্রায় নির্লিকার পানীয়টা আমি বানিয়েছিলাম। – কোন দিশি চা এটা? না দুধ না চিনি। এক চিমটে চায়ের পাতা। এক কুচি আদা। আমি আমার চায়ের সপক্ষে বলি – মিডনাইট টি। বডিকে ঘুম পাড়িয়ে স্বপ্নগুলো জাগায়। আমাদের ছোটবেলা দেওয়া হত।

    বান্ধবী তার বেতের আরামচেয়ারে পিছিয়ে যাবার পর কাপে চুমুক দিয়ে শুরু করেছি। – অনেক দিন আগে শিমলিপুরের পুরোনো ক্যান্টনমেন্টে একটা ছোট জেনারেল হসপিটাল ছিল। বালকবাবা হাসপাতালটা তখনো তৈরি হয়নি। এক ইংরেজ লাশকাটা সার্জেন সেই হাসপাতালের প্রধান হয়ে এসেছিলেন। আধপাগল এবং খিটখিটে এই বুড়োর নাম হামফ্রি চিল্কট। চিল্কটের বেশির ভাগ পেশেন্ট ছিল দিশি, এবং তিনি শিমলিপুরের ইংলিশ জানা ভারতীয়দের যে কয়েকজনের সঙ্গে ভাব করেছিলেন তাদের অন্যতম হলেন আমার দাদু। উদ্বাস্তু ডাক্তার গুলজারীলাল বাজাজও পরে এই দলটায় যোগ দেন। তবে চিল্কটের জীবনে একটা রহস্য ছিল যা আমি আগে জানতাম না, তাই তোমাকেও বলা হয়নি। সেটা চার্চিলের যুগ। সে সব দিনে ব্রিটিশরা যে কজন ভারতের মাটিতে পা রেখেছিল, মাউন্টব্যাটেন বাদে তাদের কেউ নেটিভদের সঙ্গে ওঠাবসা করত না। তখনকার দিল্লীতে চিল্কটই বোধহয় একমাত্র ইংরেজ যিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। তাঁকে কোনো কারণে সাহেবদের সমাজ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে। চিল্কট বিকেম অ্যান আউটকাস্ট। দ্য কোয়েস্‌চন ইজ হোয়াই।

    – জয়, দাঁড়া। হোয়াই আসছে পরে। আগে বল তুই এসব জানলি কী করে? তোর মামা বলেছেন?

    – মামাবাড়ির কেউ চিল্কট নামটাও জানে কিনা সন্দেহ।

    – তার মানে ডক্টর বাজাজ?

    – তুমি হয়তো অবাক হবে শুনে, কিন্তু আমার ধারণা যে বাজাজও এই ঘটনাগুলো জানেন না।

    – তাহলে গল্পটা কি তোর মাথায় আকাশ থেকে ঝরে পড়ল?

    – সেরকমই ধরে নিয়ে পুরোটা শুনতে ক্ষতি কী?

    পম্পা খানিকক্ষণ তার কুর্সীর গদিতে এপাশ ওপাশ করার পর চাদরের ভিতর নিজেকে আরো ভালো করে মুড়ে নিয়ে বলল – আচ্ছা, বল। কিন্তু আমি জানি তুই কিছু লুকোচ্ছিস এবং এর মধ্যে একটা কিছু জোচ্চুরি আছে।

    জোচ্চুরি ছিল আমার তকদীরে। যা নিয়ে আমি বান্ধবীকে ভাবাতে চাইনি। তাই তাকে একটু গুঁইগাঁই করার অবসর দিয়ে আবার বলতে শুরু করি।

    – হামফ্রি উইলিয়াম চিল্কট কবে ভারতে পদার্পণ করেন আমি জানতে পারিনি। তবে ১৯৩৬ সালে অল ইণ্ডিয়া রেডিও স্থাপিত হয়। এর বছরখানেকের মধ্যেই আমার দাদু দিল্লীতে চলে এসেছিলেন। চিল্কট আসেন তার অনেক আগে। তুমি হয়তো জানো, উনিশশো আঠেরো সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটা মহামারী দেখা গিয়েছিল। একটা নতুন টাইপের ভাইরাল জ্বর, যার নাম দেওয়া হয় স্প্যানিশ ফ্লু। ওই মহামারীর সময়েও চিল্কট ভারতে। হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত ভারতীয় আর্মি যখন ইওরোপ থেকে ফিরছিল তখন চিল্কট তাদের সঙ্গে ডাক্তার হয়ে আসেন। একটা মোঘল শহরকে ভেঙেচুরে তখন নিউ দিল্লীর সরকারি বাড়িগুলো সবে তৈরি হচ্ছে। কোকিল আর বুলবুলিতে মুখরিত সিভিল লাইন্‌সের ফাইন বাগানঘেরা বাংলোগুলো পেয়ে যেত ইংরেজরা। সেই লাক্সারি ছেড়ে কে শিমলিপুরে আসে? কিন্তু দশ বছর পরে যখন আমার দাদু দিল্লীতে উদয় হলেন তখন চিল্কটকে পাওয়া যায় শিমলিপুরের একেবারে শেষ প্রান্তে, আর্মি ব্যারাক্‌সের পাশে যমুনার ধারের বালিতে পোঁতা জাট আর গুজ্জরদের পাড়ায়। কী এমন অপরাধ করেছিলেন হামফ্রি চিল্কট যে তাঁকে এই নির্বাসন দণ্ড পেতে হয়?

    – ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন নিশ্চয়ই। ট্রাইবাল মহিলা? পম্পা তার প্রিয় কোনো নভেলের প্লট লাগাতে চায়। – কিংবা হয়তো, ইউ নো, নচ্‌ গর্ল?

    আমি বেচারার আশায় জল ঢেলে দিয়ে বলি – চিল্কটের জীবন একটা নারীচরিত্রবর্জিত নাটক। তিনি না করেছিলেন বিয়ে, না ছিল তাঁর প্রেমিক অপবাদ। অপরাধটা নারীঘটিত না হলে আর কী হতে পারে?

    – ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম?

    – হ্যাঁ, টাকাকড়ির ব্যাপারে ব্রিটিশরা ঢিলেঢালা জাত নয়। কিন্তু সার্জেনদের প্যানেল থেকে চিল্কটের নাম কাটেনি। ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকলে সেটা হত কি? তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায় না। তাহলে অপরাধটা কি সামাজিক? মানুষটাকে সোশ্যালি অস্ট্রাসাইজ করা হয় কেন?

    পম্পা তার খালি পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমাকে ঠেলে দিয়ে বলে – তুই নিজে জানিস, কি জানিস না?

    যে গল্পের কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব না সে গল্প বলার সময় এক পা এগিয়ে দু পা পিছোনো দোষের নয়। আমি বললাম – ভদ্রলোকের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা আমি জানি। ভাবছি সেটা এর কারণ কিনা। ডক্টর হামফ্রি চিল্কট নাকি একবার মরে গিয়ে বেঁচে উঠেছিলেন। তাঁকে গোরও দেওয়া হয়। বাট হি কেম ব্যাক ফ্রম দ্য ডেড। তাঁকে কি এই অখ্রীষ্টানী ব্যাপারটার জন্য বয়কট করা হয়েছিল? ফর বিইং দ্য আনডেড?

    – হে মাই প্রভু-উ-উ-উ-উ! ও ঠিক রাত্রিবেলা একটা ভূতের গল্প বার করেছে। এবার আসবে অন্ধকার। পম্পা নিজেই ভূতের মতো চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে সোফায় এলিয়ে গেল। আমি চুপচাপ অপেক্ষা করছি। একটু পরে চাদরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসে – এই ভূতটার সাথে আমাদের স্কিনের কী সম্পর্ক, সেটা বললি না তো!

    আমি বললাম – আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগের এক শরতকালে চিল্কট পাঞ্জাবে পোস্টেড ছিলেন। সেখানে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের দ্বিতীয় এবং মারাত্মক ঢেউটা গিয়ে আছড়ে পড়ে। এত কম সময়ের মধ্যে এত শব নাদির শাহের আক্রমণের বেলাও দেখা যায়নি। পাঞ্জাবের পাঁচ শতাংশ মানুষ কয়েক মাসের মধ্যে খতম। শোনা যায় রাজস্থানের বর্ডারে কোনো একটা প্রিন্সলি স্টেটে কর্মরত চিল্কট প্রথম রাউণ্ডেই তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চার্চের জমিতে তাঁকে কবর দেবার পর সঙ্গীরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য অর্ধেক লাহোর আর অর্ধেক দিল্লীতে পালায়। তারপর কী হয়েছিল? এক বছর ধরে কেউ কারো খবর রাখেনি। নদীগুলো বেওয়ারিস লাশের কনভেয়ার বেল্টের মতো একটু একটু করে যখন দেশটাকে আবার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে, তখন পাক্কা বারো মাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর হামফ্রি উইলিয়াম চিল্কট নামের একটা অপরিচিত লোক দিল্লীতে এসে হাজির। তাকে আর চেনার উপায় নেই। গায়ের ওজন অর্ধেক। মাথার সোনালি চুল পড়ে গিয়ে নতুন যে চুলগুলো গজিয়েছে সেগুলো কিছুটা বাদামি আর বাকিটা সাদা। গায়ের সমস্ত লোম ঝরে যে নতুন লোমগুলো গজিয়েছে সেগুলোও তাই। আর স্কিন? হ্যাঁ, স্কিনই এই গল্পের আসল চরিত্র। চিল্কটের চামড়া থেকে যেন কোনো কবরের পিশাচ সমস্ত কোলাজেন শুষে নিয়েছিল। স্বচ্ছ এবং ছাড়ানো চিকেনের গায়ের মতো ফিনফিনে আর লোল সেই চামড়ার রং ছিল ছাইয়ের চেয়ে সাদা। তার উপর বেশ কিছু চোখের মতো ক্ষত।

    পম্পা মুড়ি দেওয়া মাথাটা একটু বার করে বলল – ডিজগাস্টিং। সিফিলিসের ক্যাঙ্কারের মতো শোনাচ্ছে। লোকটা যে চিল্কটই, কোনো ইম্পস্টার নয়, সেটা কী করে বোঝা গেল?

    একটু চুপ করে বান্ধবীর সন্দেহগুলো নিয়ে ভাবছি। আমি নিজেও ব্যাপারটা ভালো বুঝিনি, তার মন্তব্য আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করছিল। চায়ের কাপের গভীরে একটা স্ফটিক স্তম্ভ দেখা যাচ্ছে। আমি এক নিঃশ্বাসে ডুব দিয়ে সেটাকে তুলে আনার চেষ্টা করি।


    ***

    পরে নিজের সমর্থনে বললাম – হামফ্রি চিল্কটের তিনকূলে কেউ ছিল না। সম্পত্তিও ছিল না। শুধু একটা সরকারি চাকরি। এরকম হাঘরে চরিত্রের পরিচয় কেউ চুরি করবে কেন? তাছাড়া একটা হাইলি কোয়ালিফায়েড সার্জেন আকাশ থেকে পড়ে না। এটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা না, যে র‍্যানডাম কোনো অশিক্ষিত মানুষকে এস্টেটের মালিক হিসেবে কল্পনা করা যায়। যাহোক, চিল্কট তাঁর কবর পাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করতেন না। তিনি বলতেন তাঁকে ট্রাইবালরা মাটি খুঁড়ে বের করে আনে। মরা দেহটা কী করে আবার বাঁচল সেটা কেউ ধরতে পারেনি। চিল্কটের ভুরু ছিল উঁচু, গভীর চোখের কোটর থেকে ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হত। ট্রাইবালরা তাঁর কান বিঁধিয়ে দিয়েছিল। পুঁতির একটা মালাও নাকি ছিল গলায়। লম্বা, কঙ্কালসার, গা ভরতি আলসারওয়ালা এই মানুষটাকে দেখে ভদ্র ইংরেজ এবং অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পরিবারগুলো শুধু নয়, উচ্চপদস্থ ভারতীয়রাও যে বিতৃষ্ণা আর ভয় অনুভব করবে সেটা কি আশ্চর্যের?

    পম্পা আবার উঠে বসেছিল। মুখোমুখি চেয়ারে বসেছি আমরা এবং মাটিতে আমাদের পা দুটো পরস্পরকে মাঝে মাঝে ঠেলে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। হঠাৎ সে একটা ঠ্যাং আমার হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা আমার পেটের উপর আস্তে আস্তে বুলোতে শুরু করে। বেশি খাওয়ার ফলে আমার প্রায়ই পেটে ব্যথা হয়। আরাম হচ্ছিল বলে সোজা হয়ে বসে জায়গা করে দিলাম। আদা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে পম্পা বলে – এই ঘটনাগুলো বাজাজ জানবেন না সেটা হয়? তুই নিজেই বলেছিস উনি চিল্কটের জুনিয়ার ছিলেন।

    – সে তো তিরিশ বছর পর। ততদিনে কত কী পালটে গেছে! চিল্কটের চামড়ায় পুরু কোলাজেনের স্তর চলে এসেছে কোথা থেকে। ক্ষতগুলো গায়েব। গায়ের রং হয়ে গেছে বাদামি। ইংরেজরা প্রায় সবাই ভারত থেকে বিদায় নিয়েছে। বয়কট করবে কে? নদীর ধারে, টিলার উপর, বাবলা গাছের জঙ্গলে, বা আরাবল্লীর নির্জন প্রান্তরে একা ঘুরে বেড়াতেন শিমলিপুরের সার্জেন। ভবঘুরে আর ফকীররা তাঁর সঙ্গী। বাজাজ তাঁকে চিনেছিলেন ময়লা সাহেব বলে। আনডেড বলে নয়।

    – তাহলে তোর জ্ঞানচক্ষু খোলাল কে? প্রশ্নটা তুই বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিস।

    – বলব। সময় হলে বলব। আগে গল্প তো শেষ হোক। বাজাজ যখন লাহোরে তখন দিল্লীতে বসে চিল্কট মেডিকাল জর্নলে দুটো আর্টিকল্‌ প্রকাশ করেছিলেন। তার বিষয় ছিল স্কিনের টাইপ। এই জর্নলটার নাম কী বলো তো?

    – হাউ অন আর্থ ক্যান আই নো?

    – ব্রিটিশ জর্নল অব ডারমেটলজি অ্যাণ্ড সিফিলিস। তুমি সিফিলিসের কথা তুলেছিলে? সেখানেই চলে এসেছি। চিল্কট এমন এক ধরণের ত্বকের কথা লেখেন যাতে সিফিলিসের ক্যাঙ্কারের মতো চাকা চাকা ক্ষত দেখা যায়, চামড়া ঝুলে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষটা সুস্থ থাকে। চিল্কট এই বিচিত্র উপসর্গের নাম দিয়েছিলেন আরাবল্লী সিন্ড্রোম। তিনি একটা কেস স্টাডির বর্ণনা করেন, যাতে পেশেন্টের ফ্লু হবার পর তাকে মৃত বলে পরিত্যাগ করা হয়।

    – মানে আসলে মরেনি?

    – কে বলতে পারে? আরাবল্লীর ট্রাইবালরা বডিটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনো উপায়ে রিভাইভ করেছিল। লোকটা যখন জাগে তার সারা গায়ে জ্বালা। হাই ফিভার। কয়েক বছর পরে চিল্কটের কাছে এই পেশেন্ট উপস্থিত। শুধু সুস্থ হয়ে যায়নি, বয়সও দশ বছর কমে গিয়েছে। সমস্ত গা জুড়ে কাঁথার মতো এপিডারমিসের প্যাচ। চিল্কটের মতে উল্কিওয়ালারা যেভাবে উল্কি তোলে সেইভাবে ঘষে ঘষে আসল চামড়ার জায়গায় অন্য চামড়ার স্তর বসানো হয়েছিল। পরে সেই টুকরোগুলো থেকে টক্সিন বেরিয়ে সারা শরীরে দাগ আর আলসারের সৃষ্টি করে। অনেক বছর ধরে সেই দাগগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়েছিল। তবে ততদিনে মানুষটার শুধু গায়ের রং নয়, গোটা শরীরটাই পালটে যায়।

    – আমি তোকে লিখে দিচ্ছি। পেশেন্ট চিল্কট নিজে।

    – আমারও তাই সন্দেহ। এই সব ঘটনাগুলো ঘটছিল উনিশশো পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। তারপর যেমন হঠাৎ করে চিল্কট সার্জেন থেকে ডারমেটলজির এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই হঠাৎ তাঁর রিসার্চের স্রোত অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি হয়ে গেলেন ডার্টি সাহেব, কারণ তখন নদীর চরে ডেরা গেড়ে বসা যত রাজ্যের ভণ্ড সাধু, ভ্যাগাবণ্ড আর ঘর থেকে পালানো দরবেশরা হয়ে গেছে তাঁর সঙ্গী। পরে আরেকটা যুগান্তর ঘটে সাতচল্লিশে, যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে এই নামগোত্রহীন ঘরবাড়িছাড়া যমুনাপাড়ের মানুষগুলোও শীতের কুয়াশার মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাদের লুকিয়ে থাকার জঙ্গল আর জমিগুলো জাটরা চাষের জন্য দখল করে নেয়। উদ্বাস্তুদের চাপে রাতারাতি দিল্লীর জনসংখ্যা আট লক্ষ থেকে পঁচিশ লক্ষ হয়ে গেছে। হাসপাতালে রুগীর লাইন দশগুণ। চিল্কট সাহেব তখন বাজাজের ঘাড়ে হাসপাতালের দায়িত্বগুলো চাপিয়ে অর্ধেক দিন গা ঢাকা দিতেন। বাজার থেকে কখনো রুটি উধাও হয়ে যেত, কখনো সাবান। একদিন চিল্কট সাহেবকেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। যেমন আকাশ থেকে টপকে পড়েছিলেন তেমনই মাটি তাঁকে হাঁ করে গিলে ফেলেছিল বোধহয়।

    আমাদের কাপে চা ফুরিয়ে এসেছে। ভাবছিলাম এখানে থামা উচিত। পম্পা আমার নাভিতে আঙুল দিয়ে বিলি কাটা শেষ করে বলল – তারপর?

    – মনে হচ্ছে তোমার ঘুম পেয়ে গেছে। এখানেই কি আজ ইতি করব?

    চায়ের খালি পেয়ালাটা ঠকাস করে নামিয়ে রেখে পম্পা বলল – ঘুম আমার পায়নি, পেয়েছে তোর। নইলে এভাবে কেউ গল্প বলে নাকি? না আছে মানে, না আছে যুক্তি। আসল চরিত্র যদি স্কিন হয় তো সেই স্কিনের পরিণতি কী হল? এই চিল্কট বলে লোকটার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কী?

    – আজই শুনতে চাও সব? এক রাত প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে পারলে হত না?

    পম্পা অধৈর্য হয়ে আমার নাভিতে একটা তীক্ষ্ণ খোঁচা মেরে দেয়। – ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলি আমি। – আজই শুনে নাও সব। বাজাজের আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়াতে স্কিন নিয়ে যে লম্বা পরিচ্ছেদ থাকে তাতে আরাবল্লী সিন্ড্রোমের উপর একটা সংযোজন হয়। এতে বলছে উপসর্গটা আসলে কোনো জীবাণুজনিত রোগ নয়। স্কিন গ্র্যাফটের মাধ্যমে একটা মানুষের ভোল পালটানোর টেকনিক। এটা যে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে চলে আসছে তাদের বিশ্বাস এইভাবে তারা নিজেদের ক্রমশ সরীসৃপদের মতো ঠাণ্ডা রক্তের দীর্ঘজীবী কোনো প্রাণীতে পরিণত করে ফেলতে পারে, যারা একটা শীতঘুমের অবস্থায় চলে যেতে সক্ষম।

    – আনডেড থেকে শুরু করে হাইবারনেশান! উফ্‌ফ্‌, তোর মামাদের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছিস তুই, জয়! আমার মধ্যরাতের সঙ্গিনী আর গল্পটাতে বিশ্বাস করছিল না। সে বলে – এর মধ্যে ব্রিটানিকাকে কেন ঢোকাচ্ছিস? ইজ নাথিং সেক্রেড?

    বললাম – কী করে সেক্রেড হবে? তার একটা কপি যে আমাদের বাড়িতে বসে ছিল। চামড়ায় বাঁধানো চল্লিশ বছর পুরোনো দশ ভলিউমের বিশ্বকোষ। বেশ খানিকটা অংশ পোকায় খাওয়া হলেও বইটা পড়া যায়। তুমি ভাবছ এতগুলো মোটা খণ্ড হজম করলাম কীভাবে? সাকুল্যে আট-দশ পাতা পড়েছি হয়তো। আমার জন্মের বহুদিন আগে থেকে স্থির করা ছিল ব্রিটানিকা খুলে এই আরাবল্লী সিন্ড্রোমের পাতাটাই সবচেয়ে আগে দেখতে পাব।

    – সবই কো-ইনসিডেন্স্‌? কাজটা টোটোর হাতে না হয়ে তোর হাতে হল কেন?

    – কারণ আমার কপাল। গল্পের একটা উপসংহার আছে। সেটা শোনাই আগে। দিল্লীতে ফিরে আসার পর ডার্টি সাহেবের দুজন সহযোগী ছিলেন। চিল্কট ঘুরে ঘুরে যখন উত্তর ভারতে সার্জারির ক্যাম্প চালাতেন তখন তাঁর সঙ্গে এই দুজনকে দেখা যেত। আমাদের গুলজারীলাল বাজাজ দিল্লীতে আসারও আট-দশ বছর আগে শিমলিপুরে একটা পুলিশ তদন্ত হয়েছিল। কেন জানো? চিল্কটের সেই দুজন সহযোগী ছমাসের ব্যবধানে রহস্যজনকভাবে ভ্যানিশ করে যান। কারো খোঁজ মেলেনি। না লাশ, না মানুষ। তো একে আনডেড। তার উপরে যেই কাছে যায় সে-ই ভ্যানিশ হয়ে যায়। এরকম সুনাম নিয়ে কে জনপ্রিয় হতে পারে? এই হল আমার থিওরি।

    আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। পম্পা কাপগুলো তোলার পর রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। মা-বাবার সামনে সে আমাকে পা দেখাবে না বলে ম্যাক্সির নিচে একটা পাজামাও পরে নিয়েছিল। তাও আমি কিছুটা রাস্তার আর কিছুটা কল্পনার আলোয় সুতির অর্ধস্বচ্ছ আবরণের আড়ালে চলন্ত দুটো উরুর বদলে একটা চিতাবাঘিনীর মোমের চামড়ার নিচে লুকোনো পেশিগুলোর ওঠানামা দেখতে পেয়ে যাই। আমার উচিত ছিল উঠে গিয়ে বান্ধবীকে সাহায্য করা, কিন্তু জানালার কাছ থেকে ঘরটাকে এক নজর দেখে আমরা দুজনেই বুঝেছিলাম এই এক্স-রের মতো রহস্যময় তালজোছনার পুকুরে শুধু একজনকে নামতে হয়, আর অন্যজনকে বসে থাকতে হয় পাড়ে।


    ***

    – এর সাথে বাজাজের সম্পর্ক কী? ফিরে আসার পর আমাকে আর নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত দেয়নি পার্কটাউনের শকুন্তলা, যার হাতে শহরের বিবেক।

    – বাজাজের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলিনি তো!

    – না বললেও আমি জানি গল্পটা কেন শোনাচ্ছিস। তোর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি।

    – কী বুঝতে পারো?

    – একটা হাইস্কুলের ছেলেকে বোঝা কী এমন শক্ত? শকুন্তলা ম্যাক্সিতে ভিজে হাতটা মুছতে মুছতে যুক্তি দেয়। – তোর গল্প শুনে মনে হয় চিল্কটের কোনো পুরোনো সঙ্গী আজও বেঁচে আছে এবং তার কাছ থেকে তুই উদ্ভট কোনো গোপন তথ্য পেয়ে গেছিস। হয়তো এমন কোনো জিনিসও তোর হাতে এসে পড়েছে যা এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। তবে আমি আলাদা করে এই খবর পেয়েছি যে বাজাজ তোর কাছ থেকে একটা কিছু চাইছিলেন, আর তুই সেটা এখনো দিসনি। এই দুটো যদি একই জিনিস না হয় তাহলে কী সেই বস্তু যা পাওয়ার জন্য ডক্টর বাজাজ হাত ধুয়ে তোর পিছনে পড়ে গেলেন?

    – ঠিক আছে। আমি যা জানি বলে দিচ্ছি। তোমার যা বোঝার বোঝো। বাজাজ কী চাইছেন আমি জানি না। তবে কারো পারমিশান ছাড়া ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়াবার পর উনি অলরেডি আমার বাঁ হাত থেকে একটা স্কিনের স্যাম্পল্‌ নিয়েছেন।

    – ও মাই ঠাকুর! পম্পা নিজের চেয়ার থেকে ছিটকে মাটিতে বসে পড়ে। আমার বাঁ হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সে কাতর হয়ে বলল। – আমি জানতাম না, জয়। বিশ্বাস কর। এত বড়ো পিশাচ, আমি ভাবতে পারিনি।

    – চিন্তার কিছু নেই। আমিও মেঝেতে নেমে গিয়ে বললাম। – খুব ছোট স্যাম্পল্‌। এখন বুঝতেও পারবে না। তোমাকে বাজাজ বলেছেন তো যে শিমলিপুরের বাংলোতে একটা প্রসিজর হত? কোনো কারণে সেটা আবার করার জন্য বাজাজের আমাকে প্রয়োজন। জানি, আমাকে ধরে আনার কাজে তোমায় লাগানো হয়েছে, নইলে গুলজারীলালের মতো নন-স্টপ মিথ্যেবাদী আমার টিকিরও নাগাল পাবে না। কিন্তু একটা ডিরেঞ্জ্‌ড লাশকাটা সার্জেনের দলে সামিল হবার আগে এটা কি ভাবা উচিত নয় যে এ সবের মূলে যে নোংরা সাহেব, সেই হামফ্রি চিল্কট শুধু একা নিজে ভ্যানিশ হয়ে যাননি, দুই ঘনিষ্ঠ সহকারীকেও গায়েব করে দিয়েছিলেন?

    টিক টিক টিক টিক করে পূজোর প্রহরগুলো আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্তরীক্ষে উড়ে যাচ্ছে। মনে উড়ছিল আশার ময়ূর। বেকুবের মতো মাটিতে বসা দুটো ভাগ্যের পুতুল কি পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে দমন করতে পারে?

    তার বদলে পম্পা মুখার্জি আমার বাঁ হাতটা আবার পর্যবেক্ষণ করে আস্তে আস্তে বলল – রিস্ক সব কাজেই আছে, জয়। তাই বলে আমরা সারাজীবন ভীতুর মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?



  • পূজোর দিন, পূজোর রাত ২ | পূজোর দিন, পূজোর রাত ১ | পূজোর দিন, পূজোর রাত ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments