• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৮ | জানুয়ারি ২০০৭ | উপন্যাস
    Share
  • ধ্বংসাবশেষ : শৈলেন সরকার

    ॥ ১ ॥


    চাকরিটা পাওয়ার আগে - মানে, যখন পেতে যাচ্ছি, যখন আমি জেনে গেছি আমাকে চলে যেতে হবে, আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলি আর তাদের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা এতদিনের বাসস্থান ছেড়ে নতুন আর এক বাসস্থানের জন্য চলে যেতে হবে, মনে হত ভয়ংকর এক শব্দ জেগে উঠছে কোথাও । যেন নতুন আর এক জীবন অপেক্ষা করছে আমার জন্য । যেন আমাকেও তৈরি হতে হবে । করতে হবে কিছু । অনেক কিছু । বা, যেন নতুন এক গল্প তৈরি হতে যাচ্ছে, আর গল্পের প্রধান চরিত্র হয়েও আমি যার শেষ জানি না । আর সত্যিই জানি না । এমনকী এই এখনও । চাকরিজীবন দুবছর পার করে দিয়েও । মনে হচ্ছে, কই নতুন কোনো গল্প শুরু হল না তো ! কোথায় ? একটা দিন থেকে আর একটা দিনের হাজির হওয়ার মধ্যে নতুন কোনো উত্তেজনা অনুভব করি না তো ! একেক সময় এর জন্য লাবণ্যকেই দায়ী করতে ইচ্ছে হয় । একেক সময় আমার বাড়িওয়ালা অবিনাশকেই । কখনো বা বাবার বন্ধু নগেনবাবুকে । এমনকী কখনো দায়ী করতে ইচ্ছে হয় নিজেকেই । কেন ? নতুন এক উত্তেজনাকর গল্প তৈরি হবে না কেন ? কেন, প্রত্যেকটা দিন আর রাত ফিরে আসবে একেবারে চেনা নিয়ম ধরে । কেন, পরপর একেবারে একই রকম কিছু কথা, কিছু ছবি ? কেন এইরকম মানুষ, একই ঘ্রাণ, পদশব্দ ? দূর নদীর সেই চিকচিক, অন্ধকারে জেগে থাকা কিছু ভাঙা বাড়ি । ছাদ, রেলিং, সিঁড়ি । একেকদিন সত্যি ক্লান্ত মনে হয় খুব । যেন সেই একই বই, একই গল্প, কাগজের একই ঘ্রাণ, পৃষ্ঠাসংখ্যা । লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, তোমার বাবা-মা, গ্রাম বা স্কুল নিয়ে কিছুই মনে নেই তোমার ? হতে পারে ? বা কী এমন রোগ ? সারবে না এ হয় কখনো ? আর সারাতেই বা চাইবে না কেন তুমি ? একেকদিন প্রতিজ্ঞা করতে ইচ্ছে হয়, যাব না । ভুলেই যাব ছাদের ওই চিলেকোঠার কথা । বরং স্কুল থেকে ফিরে পাড়ার লাইব্রেরি যাব, সবকটা খবরের কাগজ পড়ে পছন্দমতো বই বাছব একটা, এরপর না হয় হাঁটতে হাঁটতে - । হেঁটে হেঁটে কিন্তু সত্যিই যাওয়া যায় অনেক দূর । আর আলাপও তো হতে পারে নতুন কারও সঙ্গে । তখন হয়তো আর এক গল্প, নতুন আর এক বই, নতুন ঘ্রাণ । এমনকী রাতে ঘুমোবার আগে ঠিকও করে ফেলি একেকদিন, খোঁজ করতে হবে অন্য কোনো বাড়ির । একটা মাত্র ঘর হলেই যথেষ্ট তো - । অন্য কোনো পাড়া, অন্য রাস্তাঘাট, অন্য রকম মানুষ । টিউশনি ধরব । আর, আর হয়তো বা নতুন তৈরি হওয়া গল্পে কোনো ছাত্রের দিদি বা কোনো ছাত্রী -। একেকদিন চিঠি লিখতে থাকি নিজের মনে । কী এমন অসুবিধে তোমার ? কেন তুমি ? মরতে নাকি ওর ভালো লাগে -। কী অদ্ভুত কথা না ? যেন বার বার মরতে পারে মানুষ । হয়তো শুধু মেয়েরা বলতে পারে এমন । মা নাকি বলত । বড়ো হওয়ার পর মায়ের মৃত্যুর কথা উঠলেই সেজকাকি বলত । বলত, মৃত্যুর নেশা ছিল তোর মায়ের । মা নাকি - হ্যাঁ, ঠিক লাবণ্যের মতো করেই বলত, মরতে ভালো লাগে খুব । সেজকাকিকে জিজ্ঞেস করতাম, নিজের মুখে বলত তোমাকে ? নিজের মুখে ? যে মরে সে কি মরার পর বলতে পারে কাউকে ? মা নাকি বলত, জন্মের পর থেকে মানুষ মরতেই থাকে বারবার । অনেক অনেকবার মরতে মরতে তার শরীর খাক হতে থাকে জ্বলে পুড়ে । শেষমেশ একদিন - আর সেটাকেই সবাই শুধু মৃত্যু বলে জানে । মায়ের কথায়, এটা নাকি সবার বোঝার কথা নয় । হঠাৎ করেই কেউ হয়তো দেখল মৃত্যুর একটা মেঘ -। ব্যস, আর বাইরে বের হওয়া হল না তোমার । এরপর নাকি শুধু মৃত্যু আর মৃত্যুই । আস্তে আস্তে এরপর শুধুই ক্ষয়ে যাওয়া । কিন্তু তুমি বাঁচার চেষ্টা করবে না ? নিজেকে বাঁচাবার জন্য -। মৃত্যুর কথা উঠলে অবশ্য মা নয় বা সেজকাকির মুখে মাকে নিয়ে শোনা কোনো গল্পও নয়, দাদু - আমার দাদুর চোখ দুটোই শুধু ভেসে ওঠে । জীবনের শেষদিনগুলিতে সেই কুঁকড়ে যাওয়া শরীর, সেই তক্তাপোষ, সেই ঘর, টিনের চালা, মৃত্যু আমার কাছে আসে দাদুর সেই পিচুটি ওঠা ঘোলাটে চোখ নিয়ে । কুঁকড়ে যাওয়া একটা শরীর নিয়ে শুধুমাত্র মৃতুর জন্য অপেক্ষা করা । বারান্দার ডানদিকে চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা এক চিলতে জায়গায় ছোটো একটা তক্তাপোষে শুয়ে থাকত লোকটা । পায়ের দিকে সিন্দুক ছিল একটা - ছোটো চৌকির প্রায় সমান মাপেরই । কাঠের । পাশে হারিকেন রাখা থাকত, এছাড়া দেশলাই বাক্স আর কেরোসিন তেলের সবুজরঙা বোতলও । গরম আর বর্ষার দিনগুলিতে শীতের লেপ ঝুলে থাকত মাথার উপরকার বাঁশের সিলিং থেকে । দুপুরের দিকে কাক বসত টিনের চালে । ডানা ছড়িয়ে নামামাত্র খসখস শব্দ উঠত নখ ঘষটানোর । চমকে উঠত দাদু, বাবার নাম ধরে ডেকে উঠে মুখ দিয়ে শব্দ করত, হু-উ-স । আর হাত তুলে তাড়ানোর ভঙ্গি করত কাকটাকে । বাবা তখন ঘরে নেই কিন্তু -, কবে চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে, তবু -।

    দাদুকে সোজা হয়ে শুতে দেখিনি কোনোদিন । কুঁজো হয়ে ডান হাতটাকে বালিশের উপর রেখে শরীরটাকে গুটিয়ে রাখত । ঘোলাটে চোখদুটো থেকে পিচুটি গড়িয়ে পড়ত, আর জলও । দাদু বলতে অবশ্য আমার মায়ের বাবা নয় । বাবার, বাবার বাবাকেই দাদু বলে ডাকতাম আমরা । আমি, সুবল, লক্ষ্মী । সুবল আর লক্ষ্মী আমার দুই খুড়তুতো ভাইবোন । সেজকাকুর ছেলে আর মেয়ে । দাদুর ভয়ে আমাদের তখনকার বন্ধুরা কেউই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে সাহস পেত না । পশ্চিমের ঘরের পাশে পেয়ারা বা কুলগাছের আড়ালে আমাদের ছোট্ট শরীরগুলির আভাস পাওয়ামাত্র লোকটা চিত্কার করে ডেকে উঠত, সমু - ।

    লাবণ্যকে এসব কথা বলা যায় না । প্রাচীন এই দোতলার ছাদে চিলেকোঠার জানালার বাইরে তখন রাতের আকাশ থাকে একটা । কোথাও চাঁদ থাকে নিশ্চিত, কোনো দিন কোথাও দুটো একটা পাখির কিচিরমিচির করে ওঠা, বা একটা ঝাঁকই - যেন পথ ভুল করে কেউ ।

    - আপনার বাবা নিজের থেকেই হারিয়ে গেলেন ? একেবারেই খোঁজ পেলেন না কোনো ?
    লাবণ্য জানতে চাইল একদিন । যেন উত্তরের আশা করে নয়, নিজের মনেই - নিজের মতো করেই কোনো উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা ।

    - খবর আসত কখনও, কে নাকি দেখেছে, আসলে কেউ যদি হারিয়ে যেতে চায় - ।
    খসখস করে শব্দ হয় যেন কোথাও ! এরপর যেন গড়িয়ে পড়ে কিছু, বা এক্ষুনি যেন ডেকে উঠবে কেউ । ত্রক্রমে জমে উঠতে থাকা একটা ঘ্রাণ টের পাই তখন । চেনা । তার মানে ধোঁয়া । শ্মশান থেকে উঠে আসা রক্ত ও মাংসের স্মৃতি । নারী কী পুরুষ, বালক বা বালিকা । চিতাকাঠ আর জোয়ারে জলে ডুবে যেতে থাকা সিঁড়ির কথা মনে পড়ে । গঙ্গাতীর ।

    প্রাচীন সেই নদী আর তার জল অবশ্য ঠিক এখান থেকে চোখে পড়ার নয় । জানালার ভাঙা ফ্রেমের গা ঘেঁষে দাঁড়ালে বরং সেই হলুদ বা সাদার ত্রক্রমিক তৈরি হওয়া চোখে পড়ে, যাকে বলি ঢেউ - তার ভেঙে পড়াও । আর ওপার থেকে ভেসে আসা বাস বা ট্রাকের হর্ন, আর ট্রেনেরও - যেন দূরপাল্লার, একেক সময় ঝরঝর করা বৃষ্টির মতোই ।

    বাড়িটা অন্তত শ-খানেক বছরের পুরনো । মাটি দিয়ে গাঁথা ইটের দেওয়াল এখন আর কোথায় ? আমার ঘরটা দোতলায় । অবিনাশ বলছিল, খারাপ লাগতে পারে । বলছিল, চারপাশে ভাঙা দেওয়াল, জানালা । দোতলা বা ছাদের সিঁড়িও বাইরে দিয়ে তোলা - আলাদা । ও হয়তো ভয়ের কথাই বুঝিয়ে থাকবে, এ ধরনের বাড়িগুলি যেমন হয়, আলো আর অন্ধকারে মুখ গুঁজে থাকা ।

    অবিনাশ ব্যানার্জিরা লাবণ্যর স্বামীর দূর সম্পর্কের কেউ । ষাট-সত্তর বছর আগে এদের পূর্বপুরুষেরা হয়তো একজন আরেকজনের কাকা বা জ্যাঠা, বা দাদা-ভাইও হতে পারে । এসব নিয়ে অবশ্য আমার মাথা ঘামাবার কথা নয় । স্কুলের চাকরি নিয়ে শ্যামপুরে এসে থাকার জায়গার কথা ওঠায় নগেনবাবুই অবিনাশকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি না বিশ্বাসী লোকের কথা বলেছিলে ?

    অবিনাশ জানিয়েছিল, লাবণ্যের সঙ্গে ওর মামলা চলছে বছর তিনেক ধরে । বলছিল, `বউ আর দুটো মেয়ে - এই নিয়ে আমার ফ্যামিলি' । জিতলে লাবণ্যদের দিকের পুরোটাই নাকি অবিনাশের হয়ে যাওয়ার কথা । ছাদ অবশ্য ভাঙাই, এদিকটা অবিনাশ ব্যানার্জির আর ওদিকটা লাবণ্যদের । বাইরে দিয়ে ওঠা সেই সিঁড়ি বরাবর বালব আছে একটা । অবিনাশের কথায়, পাল্টানো যায় ইচ্ছে করলে । এমনকী তেমন মনে করলে, সিঁড়ির মাঝখানে কিছু একটা ঝোলাতেও পারি । ও হয়তো আলোর টিউবের কথাই বলতে চাইছিল ।

    এদিকের ছাদের এই চিলেকোঠায় আসার সময় আমাকে আমার দোতলার ঘর বন্ধ করেই আসতে হয় । নীচ থেকে ওপরে উঠে দরজা বন্ধ দেখে কেউ ভাববে, সমীরণ তাহলে রাস্তায়, বা লাইব্রেরিতেই হয়তো, এমনকী স্কুল থেকে এখনো ফেরেনি বলেও ভাবতে পারে কেউ । এদিককার কোনো ছাদেই অবশ্য কারো দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয় । নদীর জল এখানে শব্দ করে না কোনো - স্থির, যেন উচ্ছ্বাস নেই কোথাও, মৃত শ্যাওলার হলুদ । চারপাশের সবকটা ছাদই প্রায় ন্যাড়া, আর উপরে ওঠার সিঁড়ি বা আস্ত কোথায় ? রেলিং নেই বললেই চলে । দু-এক জায়গায় স্রেফ ভগ্নাংশ - সিঁড়ি বা ছাদের কারুকাজের চিহ্নমাত্র কোথাও আর অবশিষ্ট নেই । নিজের ঘরের প্রসঙ্গে লাবণ্য বলে, যেন একটা গুহা, হাজার হাজার বছরের অন্ধকার, আর ঘ্রাণও । এই অন্ধকার আর এই গুহার কথায় ফের দাদুর কথা মনে পড়ে । প্রাচীন সেই সিন্দুকের ঘ্রাণ, সেই বাসন-কোসন, কাঁথা-কাপড় । আর এক খাতার কথাও - যেখানে আমার হাতেখড়ির অ-আ-ই-ঈ -, বাবার লেখা বংশলতিকা, দাদুর লেখা গান, আর কিছু মৃত মানুষের নামও । সংখ্যা (??)। মড়া পোড়ানোর প্রমাণ হিসেবে মৃত লোকগুলির জীবত্কালীন ঠিকানা ।

    দিদিমার নাম ছিল লাবণ্য । সেদিন হঠাৎ করেই মনে পড়ায় লাবণ্যকে বললাম । পেতল আর কাঁসার সেইসব হাঁড়ি আর কলসির গায়ে আমার শেষ দেখার সময়ও স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে । লাবণ্যপ্রভা ।

    -- তার মানে আমি কি বুড়ি হয়ে গেলাম । আপনার দিদার মতো - সত্যি ?
    লাবণ্যের গলায় ঐতিহ্য ছিল, ভার আর সূক্ষ্মতাও ।
    -- আমি আসলে এক সিন্দুকের কথাই - বিশ্বাস করো -। আর দিদাকে আমি দেখিনি কোনোদিন, সম্ভবত বুড়িই হয়নি -।

    একেবারে সাদামাটা অলংকরণহীন, কালো একটা সিন্দুক । নিখুঁত আয়তঘন । যেন বন্ধ, ফাঁক নেই কোনো । লাবণ্যকে বললাম, `সেই সিন্দুকের কথাই - সিন্দুকের ভেতরকার সেই অন্ধকারের কথাই মনে পড়ে আমার ।'

    আমাদের পালপুকুরের বাড়িটা ছিল সাড়ে চারকাঠা জমির উপর । এক হিসেবে বেশিই । পরের দিকে মানে, একাত্তরের পর দখল হওয়া কোনো কলোনিতেই কিন্তু প্লটপিছু দেড়-দু'কাঠার বেশি হয়নি । এমন রাজঘড়িয়া কি ইন্দিরানগরে বড়োজোর এক - এক কাঠাই । আমাদেরটা ছিল দেশবন্ধু কলোনি । বাবা আর সেজকাকা দুজনের নামে ভাগ হলে, বাবার অবর্তমানে আমার পাওনা অন্তত সওয়া দু-কাঠা । সেজকাকা অবশ্য মরার লোক নয় । বছরদুয়েক হল আমি বাড়িছাড়া হলেও যোগাযোগ আছে । চিঠির উত্তর লিখতে হচ্ছে । পরিষ্কার আর গোটা গোটা অক্ষর দেখেই টের পাই, অন্য কেউ অন্য কারুর হাতের, হয়ত সুবল, লক্ষ্মী বা পাড়ার কেউ । সেজকাকির হয়ে কেউ লিখে দেয়, স্নেহের সমু, আশা করি ভালোই -।

    সেজকাকুর চাকরিটা খুব একটা খারাপ ছিল না কিন্তু । গান্ধীজির নামে কোনো একটা আশ্রমের । দানসামগ্রী আসত প্রচুর, যাকে বলে `ফরেন এড'- তাই । টাকা, বই, সাইকেল এমনকী টিভি-ও । অনাথ আর দু:খী ছেলেদের বিনে পয়সায় বইপত্র যোগানো আর প্রতিদিন একবার করে খাবার দেওয়া । সেজকাকু না বললেও চুরির সুযোগ ছিল জানতাম । আশ্রম ছেড়ে চলে আসার আগের বছরও রেডিয়ো এনেছিল একটা - ছোটো, সুন্দর ও চামড়ার জ্যাকেটসহ ছিমছাম । অ্যান্টেনা, শর্টওয়েভের সেই কঁকিয়ে ওঠা, সেন্টার পাল্টানো । সেজকাকু বলছিল, ধরে সব, একেবারে হোল ওয়ার্ল্ড -।

    আশি-একাশির একটা দিনে বাবা ফিরল না আর । আমার তখন কত হবে, নয় কী দশ । দিনটার এমন কোনো বিশিষ্টতা ছিল বলেও মনে পড়ছে না, মানে দিনটাকে মনে রাখার মতো কিছু । শুধু সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরে বাবাকে ডেকেছিলাম একবার । মনে পড়ার মধ্যে ওইটুকুই । বাবা তখন পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাই । আমিও ওখানেই, মানে ক্লাস ফোরের পড়ুয়া । আমার তখন, `পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল' । কী কারণে যেন স্কুলে যাইনি সেদিন । মাঠ থেকে ফিরেই বাবাকে ডাকতাম একবার । হ্যাঁ, মায়ের পুরো জায়গাই তখন বাবার । পরদিন শুনলাম, কে নাকি বড়ো রাস্তার দিকে যেতে দেখেছে বাবাকে । নীল রঙের শার্ট আর ধূতি । শার্টের কলারে নিশ্চিতভাবেই তখনও সেই ঘাম আর ময়লা, বাতাসে আমার চেনা ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীরের সেই ঘ্রাণ । লাবণ্যকে বললাম, এইসব স্মৃতি একেক সময় কিন্তু কল্পনা বলেই মনে হয় আমার । বললাম এই যেমন ভারী কুয়াশা ভেদ করে নদীর ওপার থেকে আসা যে কোনো হর্নকে দূরপাল্লার ট্রেনের বলে ভুল হয় । যেন ছাড়বে এক্ষুনি । যেন এই জল ঝরে পড়ার মতো করে শব্দ আর নৈ:শব্দের মাঝামাঝি থেকে কেউ সত্যি সত্যিই বিদায় নেবে । বললাম, একদিন আমিও দেখো -।

    লাবণ্যের কথায়, আমার গলায় নাকি দু:খের ছাপ আছে একটা । ও নাকি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবে না । প্রথমদিন আমার কথা শুনেই ও নাকি টের পেয়েছিল । এমনকী আমার চোখেও ।

    -- দু:খের ?
    -- হ্যাঁ, যেন অনেক দূরে কোথাও থেকে গেছে কেউ ।
    -- কিন্তু আমার আবার কে থাকবে আবার, বাবা বেঁচে থাকলেও আমার কথা নিশ্চিত ভুলে গেছে এতদিনে ।

    লাবণ্য রহস্য জানে । বলে, থাকতেও তো পারে অন্য কেউ ।

    স্কুলে আজ গণ্ডগোল হল খুব । পাড়ার ছেলেরা শাসিয়ে গেল । প্রতিবছর আমার দেখা প্রতিটি বছর ঘুরে ফিরে সেই এক দৃশ্য । ভরতি, প্রমোশন । রিক্রুটমেন্ট, চাঁদা । ছেলেগুলি বলে গেল ওরা নাকি বড়োজোর দু-চারদিন দেখবে । ওরা নাকি জেনে গেছে সব । শিক্ষার স্বার্থে, পাড়ার স্কুলের স্বার্থে ওরা নাকি সব এককাট্টা ।

    লাবণ্যর কাছে একবার তুললাম কথাটা । বললাম, আর ভালো লাগে না । এর চেয়ে বিশ্বাস করো, অন্য যে কোনো একটা কাজ পেলে - ।

    এ বাড়ির গা ঘেঁষে নদীর দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা সরু - একটি মাত্র ট্রাক যাওয়ার মতোই । চৈতন্যদেব নাকি এসেছিলেন এখানে একবার । দই-চিঁড়ে খাইয়ে তার কোনো দুই ভক্তের অভিমান ভাঙিয়েছিলেন নাকি ।

    একেক সময় অবাক লাগে খুব । সত্যি ? পাঁচশো বছর আগে ? গৌড়ের সুলতান তখন হুসেন শাহ । এ রাস্তায় তখন হয়তো পাল্কি । হয়তো বা অশ্বারোহী । লাবণ্য বলেছিল, এঘাটে নাকি সতীদাহ হওয়ার গল্পও আছে । বলছিল, দেখেননি, শ্মশানঘাটের পাশেই ওর শ্বশুরের বাবা না ঠাকুরদার অন্তর্জলি যাত্রার গল্পও ও শুনেছে ।

    দূরে হর্ন পড়ছে কোথাও । প্রাচীন সেই অন্ধকার ফুঁড়ে খোল আর করতালধ্বনি আসে যেন । এই সেই প্রাচীন যাত্রাপথ । রাস্তা । এই সেই গঙ্গার বাতাস । প্রাচীনতা । আহ্‌ । লাবণ্যর দেহজুড়ে যেন প্রাচীনতার ঘ্রাণ । ওকে বলি, এসব বিশ্বাস হয় তোমার ? কিছু অন্তত গল্পই নিশ্চিত । বললো, এইসব দেওয়াল আর ইটের খসে পড়া, আর তার শব্দে সত্যিই কি সেই নারীর চিত্কার লেগে থাকে, সেই আগুন, বা মৃত্যুপথযাত্রী সেই বৃদ্ধের নিশ্বাস - সত্যিই কি লেগে আছে ?

    লাবণ্য কী বুঝল কে জানে, বলল, সত্যি -। আর তখন সেই অন্ধকার যেন ভার(??) হয় খুব । শ্যাওলার ঘ্রাণ আসে । অন্ধকারে পিচ্ছিল কোনো শরীর খোলস ছাড়ে যেন । দাদুর সেই সিন্দুকের কথা মনে পড়ে ফের । কালো, আয়তঘন । আর স্থিরও । `কী আছে ওখানে'- জিজ্ঞেস করলে লোকটা বলত, সোনা-দানা, অলংকার । বলত, দেশের বাড়ির, তোর জন্য লুকিয়ে আনা । কাউকে বলতে বারণ করত লোকটা । বাবা অবশ্য হাসত । ঘুম না পাওয়া কোনো রাতে বাবাকে এই সিন্দুক নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলত, ধুত, মাথা খারাপ তোর দাদুর, মিথ্যে কথা ।






    ॥ ২ ॥


    বছর পাঁচেক আগেকার একটি দিনে, স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসতে হবে কিনা জানি না তখনো, অন্তত স্কুলের চাকরি নিয়ে নগেনদা বলেননি কিছু মধ্যমগ্রামের সেই মুকুন্দদা মনে করিয়ে দিয়েছিল, স্রেফ নগেনবাবুর মতো লোকের কথায়, ওর কথায় এরপর কিন্তু ওর কোনো দায়িত্ব নেই আর-। এসব নাকি স্রেফ কারুর জন্য কিছু অন্তত করা ।

    নগেনবাবুর দেওয়া ঠিকানামতো কালীবাড়ি স্টপেজে নেমে বাঁদিকে । শেষদিন কাগজপত্র নিয়ে চলে আসার সময় একটা কথাই বার বার করে মনে করিয়ে দিয়েছে লোকটা, স্কুল বা অফিস যেখানেই চাকরি হোক ঝুটঝামেলায় জড়াবে না একদম, কোনো রাজনৈতিক দল করার দরকার নেই । জানতে চেয়েছিল, পোস্টের লোভ নেই তো কোনো ? না করেছিলাম । বি এস সি অনার্স আর এম এস সি-র সার্টিফিকেট-মার্কশিটের জন্য মাত্র দশ হাজার দেব শুনে লোকটা তো অবাক খুব । দশ ? উনি কে হন তোমার ?

    -- বাবার বন্ধু ।
    লোকটার বাড়ির নাম কিন্তু চমত্কার । `কিছুক্ষণ' । গ্রিল দেওয়া গেট । ছোটো । সরু ড্রেনের উপর পেতে রাখা কংক্রিটের স্ল্যাব । আর নীচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকা সাদা বড়ো লোমওয়ালা স্পিত্জ ।

    লোকটার মেয়েই হবে, ডেকে উঠেছিল, বাবা -। সামনের ফাঁকা জায়গাটা পুরোপুরি বাঁধানো । সিমেন্টের গায়ে তৈরি করা নকশা । স্কোয়ার । একটা করে কর্ণ । বারান্দার পুরোটাই গ্রিল দিয়ে ঘেরা । বাস থেকে নেমে অবশ্য কষ্ট করতে হয়নি তেমন । কালীবাড়ির ঘন্টা বাজছিল । সম্ভবত সন্ধ্যা-আরতি । লাল-নীল টুনি, মন্দিরের চাতালে যেমন থাকে - দু-একজন ভিখিরি, এছাড়া কিছু ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ।

    মুকুন্দদা জিজ্ঞেস করেছিল, স্কুল সার্ভিস দেবে ? জানতে চেয়েছিল, স্কুলের চাকরি হলে কোন ক্লাস পর্যন্ত পারবে - মানে অঙ্ক -?

    -- টেন পর্যন্ত -।
    একটা টিয়েপাখি ছিল কোথাও । সম্ভবত ব্যালকনিতেই । ডেকে উঠেছিল হঠাৎ । যেন আঙুল বাড়িয়েছে কেউ । যেন ঠুকরে দেবে । ট্যাঁট - ।

    মুকুন্দদার কথায়, অফিসই ভালো । স্কুলে চাকরি হলে খাটতে হবে খুব । এমনকী স্কুল যদি হায়ার সেকেণ্ডারি হয় ভবিষ্যতে পারব কিনা জেনে নিল ।

    -- শুধু ফাইনাল পরীক্ষাটাই বাদ গেছে আমার, মানে বি এস সি-র অনার্স ছিল অঙ্কে - সেজকাকু অসুখে পড়ল খুব ।

    হায়ার সেকেণ্ডারিতে অঙ্কে লেটারের কথা বললাম ।
    `সে রকম কোনো ঝামেলা দেখলে আগে থেকে ইনফর্ম করবে কিন্তু-,' চলে আসার সময় মনে করিয়ে দিয়েছিল লোকটা । `বাড়ি কোথায়' জানতে চেয়ে `পালপুকুর' শুনে বলল চাকরি কিন্তু যত দূরে হয় ততই ভালো । ওর কথায় তোমার সার্টিফিকেট বা মার্কশিট নিয়ে সন্দেহ করার মতো কেউ যেন না থাকে । কেউ যেন না ভাবে, ও আবার এম এস সি পাশ করল কবে ? লোকটার কথায়, পালপুকুর যেন বিদায় নেয় আমার জীবন থেকে ।

    দরজায় টোকা মেরে মলি বলল, চিঠি আছে একটা । খুলে দেখি, সেজকাকির হয়ে লিখে দিয়েছে কেউ । `স্নেহের সমু-।' লিখেছে লক্ষ্মীর বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে । সামনের সপ্তাহে একবার যেন বাড়ি যাই । আর সেজকাকুর শরীর নাকি ভেঙে পড়েছে । সুবল বখে গেছে একেবারে ।

    মলিকে বললাম, তুলি কোথায় ?
    -- ঘুরছে রাস্তায়, কাজ কী আর - ?
    বললাম, কখন দিয়ে গেল ? কাল ? না আজই-?

    সম্ভবত বাতাসের জন্যই আজ ঠাণ্ডা লাগছে বেশ । উত্তাপ যেন নেই । সিঁড়ির ইটে শ্যাওলা কোথাও । অল্প পিচ্ছিল । আমি ছাড়া অবশ্য এদিক থেকে উপরে ওঠার কেউ নেই । মাঝে মধ্যে নীচের কেউ - সে অবশ্য হঠাৎ করেই - এক আধবার । এই যেমন অবিনাশ খোঁজ করতে এসেছিল গত সপ্তায় । বা মলি । মেয়ে হিসেবে মলি কিন্তু দশাসই চেহারার একেবারে । কালো । কাঁধ থেকে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত নেমে আসা ফ্রক । কী বলে এটাকে ? মিডি নাকি ম্যাকসি । এতসব অবশ্য আমার জানার কথা নয় । ওর ভারী বুক দুটো যেন বেহায়া । নির্লজ্জই একেবারে ।

    দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে মলি জানতে চাইল, রান্না হয়ে গেছে আপনার ?

    দোতলার এই ঘরগুলি অদ্ভূত । হয়তো বাকি ফাঁকা ঘরগুলির জন্যই । অবশ্য ভাঙা ছাদ, জানালা, জানালার ফ্রেম আর ভাঙা দরজার জন্যও হতে পারে, যেন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকছে কেউ, যেন শব্দ হবে কোথাও, এক্ষুনি হেসে উঠবে কেউ । গড়িয়ে পড়বে কিছু ।

    মেয়েরা যেন বিশ্বাসই করতে পারে না । লাবণ্যও । জানতে চেয়েছিল একদিন, রান্না করেন আপনি ? খাওয়াবেন তো-? সত্যি -!

    মলির মোটা আর ধ্যাবড়ানো পা চোখে পড়ে আমার । ডানপায়ের কড়ে আঙুলে রূপোর কোনো অলঙ্কার । রূপোরই । সাদা । চকচক করতে থাকা । হাঁটু অল্প ছাড়িয়ে আচমকাই ফ্রকের যেন থেমে যাওয়া । এরপর সেই ফ্রকের লেস । লেসের নকশা । কাঁধ থেকে হাঁটুর দিকে নেমে আসা লাল আর সবুজের কিছু রেখা ।

    মলিকে বললাম, এগিয়ে দেব ?
    -- কেন ? বাড়িটা আপনার না আমাদের ?
    -- মানে সিঁড়ির -।

    ওর পুরুষালি গলা চেহারার সঙ্গে মানিয়ে যায় বেশ । নাকের গর্তও । ঠোঁট আর ঝকঝক করা দাঁত । ভুরু প্রায় জোড়াই বলতে হবে । যেন ছেলে হতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে পাল্টে গেছে কেমন । আসলে বাইরের দিকের এই ঘোরানো সিঁড়ির অন্ধকারের কথা বলতে চাইছিলাম । একটা টিউব কিনবো কিনবো করেও কেনা হয়নি আর । এই ক-বছরে অবশ্য আন্দাজ হয়ে গেছে । সিঁড়ি । সিঁড়ির রেলিং । ধাপ । ধাপের বেধ । সংখ্যা ।

    -- তার মানে ভয় পাচ্ছেন আপনি - একবার বসতেও তো বলতে পারতেন -।

    মুকুন্দদার কথাটা মনে পড়ে ফের । ঝামেলায় জড়াবে না সমীরণ । একেবারেই না । কীসের থেকে যে কী হয় -।

    বললাম, না না ছি:, আসলে ছেলেদের খাতাগুলি নিয়ে -।
    যাওয়ার সময় মলি বলে গেল, এরপর নাকি ডাকলেও আসবে না । এমনকী ওর নাকি কোনোরকম দায় নেই । দরকার হলেও উপরে উঠবে না আর ।

    টেনের ছেলেরা নাকি কমপ্লেন করেছে । ওরা নাকি আমার অঙ্ক করানো একদম বুঝতে পারছে না । যা সময় আছে এর মধ্যে অবশ্য ওদের কোর্সও শেষ হওয়ার কথা নয় । স্বরূপবাবুই ডাকলেন । একা । কোনো অসুবিধা আছে কিনা জানতে চাইলেন । নতুন রুটিনে ক্লাস টেনের নিয়মিত ক্লাস দেওয়া হয়েছে আমাকে । পাটিগণিত ।
    -- একদম নাকি বোঝাতে পারছ না ? আটকাচ্ছে ।

    ছেলেরা বলেছে । দল বেঁধে নাকি এসেছিল ।

    অসোয়াস্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটু অন্য দিকে তাকাই । ওর মাথার পেছন ভারতের মানচিত্র । হলুদ, গোলাপি, লাল, সবুজ । পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীর । নড়ছে । এপাশ ওপাশ করছে হাওয়ায় ।

    -- আর একটা দুটো দিন গেলেই - মানে অনেকদিন পর- ।
    -- খুব বাজে ব্যাপার - চারপাশের চাপ তো দেখতে পাচ্ছ ? একটু খাটতেও তো পারো বাড়িতে । কাজ কী তোমার ? টিউশানি কর ?

    টেবিলটা কাচ দিয়ে ঢাকা । পুরু । আর দামিও । দাগ নেই কোনো । কলমদানি, ক্যালেণ্ডার -ডেটওয়ালাই অবশ্য, আর ছবির জায়গায় মোটা হরফে লেখা, টিচার্স আর স্পেশাল পিপল -। পেপারওয়েটের ভেতর লাল-নীল বুদ্বুদ ।

    -- যতই স্কুল সার্ভিস হোক, আমি তো জানি নগেনবাবু কীভাবে মিনিস্টার ধরে অফিসার ম্যানেজ করে তোমাকে -। আর এখন যদি এত প্রবলেম -।

    বাইরে বেরিয়ে দেখি টেনের মনিটর দাঁড়িয়ে । ফার্স্ট বয় । দীপক না দিলীপ যেন । বসু । চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল । সম্ভবত বলতে এসেছে কিছু । কী বলবে ? হয়তো আমার পরিবর্তে অন্য কোনো স্যারকে -। হয়তো বিপিন দাসকে । বিপিন অবশ্য তুখোড় । রাজ্যের অঙ্ক যেন মাথায় নিয়ে ঘুরছে । এম এস সি-তে ফিপটি ফাইভ পার্সেন্ট, অনার্সে প্রায় ফার্স্ট ক্লাস । হায়ার সেকেণ্ডারিতে স্টার মার্কসের কাছাকাছি - গত বছর ঢুকল । অল্প সময়ে এত পপুলার হয় কী করে মানুষ ? বিপিন দাসকে দেখে হিংসে হয় আমার । এবার না হলেও সামনের রুটিনে আমাকে সরিয়ে দেবে ঠিক । আর ভদ্রতার খাতিরে রেখে দিলেও বিপিনকে দিয়ে স্পেশাল ক্লাস নেওয়াবে । মুকুন্দদা বলেছিল, টাস্লে যাবে না কোনোদিন । পোস্ট নিয়ে কামড়া-কামড়ি নয় । একদম নিরীহ আর সাধারণ হয়ে থাকতে হবে । যদি নিজের থেকেই বলি, আমার ক্লাসগুলি বরং তুমিই -। যদি ক্লাস এইটের অ্যালজেবরার সঙ্গে পাল্টে দিতে বলি -। কিছু কি ভাববে ? স্বরূপবাবু অবশ্য ভাবতেও পারে । যেমনভাবে বলল লোকটা, নগেনবাবুর নামটা যেমন নাক মুখ কুঁচকে উচ্চারণ করল, ভালো লাগল না ব্যাপারটা । এখন থেকে তার মানে আতঙ্কে থাকতে হবে । সারাটা বছর আমাকে পাটিগণিতের পেছনে সময় দিতে হবে । টেক্সট বই, টেস্ট পেপার -।

    অবিনাশ অবশ্য এককথায় নগেনবাবুর অ্যান্টি গ্রুপের নির্মলদার উপর চাপিয়ে দিল ব্যাপারটা । লোকটা নাকি বেড়েছে খুব । সত্যিই আটকে যাচ্ছি কিনা জানতে চাইল । কোন কোন ছেলে গিয়েছিল স্বরূপবাবুর কাছে, স্বরূপবাবুই বা কী বলল, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল । ফোর্থ ক্লাস স্টাফ হলেও অবিনাশের দাপট আছে খুব । নন-টিচিং স্টাফদের মধ্য থেকে গভর্নিং বডির মেম্বার । পার্টি মেম্বারশিপও পুরনো । পুলিশের হাতে মার খাওয়ার মতো রেকর্ডও আছে একটা । অবিনাশের কথায়, নিজে ঠিক থাকলে কারো পক্ষে কোনো ক্ষতি করা মুশকিল । ও নিজেও নাকি এজন্যই ভয় পায় না কাউকে । ওর কথায়, বাড়িতে খাটতে হবে । ক্লাস টেন মানে তো একটা ফ্যালনা ব্যাপার নয় ।

    ভর্তির গণ্ডগোল বেশ কিছুদিন হল মিটে গেছে । পার্টির ছেলেদের কথা অনুসারে একেবারে শেষ মুহূর্তে নিতে হয়েছে একজনকে । সেভেনে ফেল করা । ভবময়ী স্কুলের । স্বরূপবাবুর কথায়, সময়মতো পার্টির কোটায় ঢুকিয়ে দিতে পারত, এতদিন পর হঠাৎ - । এটা সেপ্টেম্বর, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে সেই মে-তে । ওর কথায়, পড়াশুনা চালানো যাবে না আর ।

    টিচার্সরুমে ইদানিং পরিষ্কার দুটো ভাগ । মুকুন্দদার কথা অবশ্য মনে রেখেছি । কোনো দলেই নেই । স্বরূপবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে সবে টিচার্সরুমে ঢুকছি, আমাকে দেখেই সুবীর উঠে দাঁড়াল, বসতে বলল ওর পাশে গিয়ে । ওরও এক কথা, নির্মল হালদার -। সুবীরের কথায়, ছেলেটাকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে ঠিক, টেনের দীপক বা সুনির্মল এতো পণ্ডিত হয়নি যে-। আমাকে চুপ করে থাকতে হয় । হরিশ টেবিলের ওপার থেকে কান পেতে বসে । শুনছে ঠিক ।

    - বললে না কিছু ?
    - কাকে ?
    - স্বরূপদাকে ? ইংরেজির লোক হয়ে অঙ্কের কী বুঝবেন উনি ? তুমিও তো অঙ্কের এম. এস. সি. ?

    সুবীর সায় চাইল । বা অভ্যাসবশতই থামল একবার । চারপাশটা দেখল । হরিশের দিকে তাকিয়েই শুরু করল ফের, এবার থেকে তো ভূগোলের লোক হয়ে আমিও -।

    সুমন সোম আর কল্যাণ ব্যানার্জি ঘাড় নাড়ল ।
    -- ধরব তো আমি - শালাদের পেট টিপে বের করব-।
    বাড়ি ফিরে দেখি, দরজার সামনে ইনল্যাণ্ড লেটার পড়ে আছে নীল রঙের । আঠা লাগানো । স্পষ্ট করে লেখা নাম । সমীরণ মজুমদার, কেয়ার অফ অবিনাশ ব্যানার্জি, শ্যামপুর, সঙ্গে পোস্ট অফিস আর জেলা । পিনকোড ।

    সেজকাকুর নিজের লেখা চিঠি । বাবার খোঁজ পাওয়া গেছে কোথায় যেন । বিহারে । শিওয়ান নামের একটা স্টেশন পার হয়েই । পাড়ার কোন এক সন্দীপন নাকি দেখেছে বাবাকে । ট্রেকারে করে যাচ্ছে । একটা ত্রক্রসিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে ট্রেকারটা নাকি তখনো শব্দ করছিল । একদম নাকি চেনার উপায় নেই । লিখেছে, সন্দীপনের `সুধনদা' ডাক শুনে লোকটা নাকি ঘাড়ও ফিরিয়েছে একবার । সেজকাকু লিখেছে, যত শিগগির সম্ভব আসবি -।

    লাবণ্যর সঙ্গে আলাপ হওয়াটা প্রায় সিনেমার গল্পই । ছাদের ব্যাপারে অবিনাশ বারণ করেছিল । বলছিল, বাইরের ঘোরানো সিঁড়ি, ভাঙা রেলিং । যে কোনো সময়ই পড়ে যেতে পারে । ছাদ, এমনকী দোতলার বাদবাকি দেওয়ালও । ওরা নিজেরাই যায় না দীর্ঘদিন । বলছিল, মামলা নাকি একটা জায়গায় চলে এসেছে ।

    লাবণ্য ডেকে উঠেছিল প্রথমে । `কে ?' সেটা শ্যামপুরের প্রথম কি দ্বিতীয় দিন । চারপাশটা ঘুরে দেখা হয়নি তখনো । ব্যানার্জিবাড়ি ছাড়ালেই গঙ্গা - এইটুকুই জানা শুধুমাত্র । তাও এখান থেকে মিনিট তিন-চার ।

    ছাদটা প্রায় ন্যাড়াই । রেলিং পুরোপুরি ছিল কখনো । এখন প্রায় ভাঙা । এখানে ওখানে টুকরো । যত্ন ছিল কোনোদিন ।

    মেয়েলি গলা পেয়ে তাকিয়ে দেখি, লাবণ্য । ঠিকই, নামটা জানা ছিল না তখন । আর তেমন আলোও নেই, তবু, সাদা শাড়িতে ওকে দেখে অন্য কোনও নামও যেন ভাবা যায় না ।

    বললাম, সমীরণ, সমীরণ মজুমদার ।
    লাবণ্য নিশ্চিত অবাক হয়েছিল খুব । ও তখন অনেকটাই কাছাকাছি । বলে উঠেছিল, মজুমদার ?
    -- মানে, ভাড়া এসেছি । হরনাথ স্কুলের টিচার ।
    পরে অবশ্য ও বলেছিল একদিন । ওর ভালো লাগে । উপর থেকে এই তাকিয়ে দেখা । অন্ধকারেই । অর্ধেক আলোয় । বলছিল, এমনকী গঙ্গার জলও চোখে পড়ে এখান থেকে । কোথায় দাঁড়াতে হবে দেখিয়ে দিয়েছিল । চিলেকোঠার জানালায় । বলছিল, ওটা অবশ্য ওপার ।

    পরপর কদিন ছাদের উপর একা পেয়ে লাবণ্য অবাক হয়েছিল খুব । জিজ্ঞেস করেছিল, বেড়াতে যান না কোথাও ?

    -- নাহ্‌ - কোথায় যাব ?
    -- কেন গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে ভালো লাগে না আপনার ? বন্ধু নেই কোনো ?

    ভেবে দেখতে গেলে ওটা হয়তো বাড়াবাড়িই ছিল আমার । এতটা মিথ্যে কথা ? বা হয়তো মিথ্যেও নয়- কিছু সত্য তো ছিলই । আসলে নিজেকে বেশ অসহায় অবস্থায় দেখাতে চেয়েছিলাম যেন । একটু বোকা । বা সরলই । যেন সত্য কথা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু বলতে পারার মতো নয় ।

    সত্যি কথা বলতে কী মেয়েদের নিয়ে আমার মধ্যে কেমন এক দ্বিধা আর সংকোচই কাজ করে যেন । যেন আমি ঠিক কোনো মেয়েরই পছন্দ হওয়ার মতো নই । নিজেকে আমার বরাবরই বেশ বোকাবোকা লাগে । দেখেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, এত হাস্যকর -। বিশ্বাস করুন, ভালবাসা-টালোবাসা নয়, কলেজ জীবনের কোনও মেয়ের, হ্যাঁ সুকান্তর বোনের কথা ভেবে এই এত বছর পরও কেমন বুক কেঁপে ওঠে আমার - সেই বুক কাঁপার অনুভূতি নয়, বা সুকান্তর বোনকে একটা কথা বলব বলে সেই সারারাত জেগে থাকার মতো ব্যগ্রতাও নয় এটা । তবু, প্রথমবার লাবণ্যর মুখ থেকে `কে ?' শোনার পর থেকে এই একটা শব্দ যেন তাড়া করেই ফিরতে থাকে আমাকে । স্কুলে ক্লাস করাতে করাতেই বলুন, আর স্কুল থেকে ফেরার সময় হাঁটতে হাঁটতেই বলুন, সারাক্ষণ একটা শব্দই যেন, যেন এই একটা শব্দ শুধুমাত্র প্রশ্নবোধক একটা চিহ্ন হয়েই ধাওয়া করতে থাকে । বাড়ি ফিরে মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করব বলে খাটে শুয়েছি অমনি সেই শব্দ ফের । হয়তো ঠিক করে নিলাম, স্টেশনের দিকেই যাই একবার- স্টেশন, বড় রাস্তা, বাসস্টপ । কিন্তু কী আশ্চর্য ভাবুন, রাস্তায় পা রাখা মাত্রই সেই প্রশ্ন, `কে ?' আর আমিও তেমন কিছু একটা ভুল করে ফেলে এসেছি ভেবে ফের বাড়ির দিকেই- ।

    লাবণ্য আমাকে কী ভাবে কে জানে, একদিন বলে বসল, আপনি কি লেখেন ?
    -- তার মানে ?
    -- ওই যেমন বই লেখে কেউ, আপনিও কি-?

    আমাকে কি সত্যি লেখকের মতো লাগে দেখতে ? কোনো লেখককে কি লাবণ্য দেখেছে কোনো দিন ? লেখকদের কী রকম লাগে দেখতে কে জানে ? বললাম, না-না -। অঙ্ক করাই তো ক্লাসে ।

    -- অঙ্ক করালে লেখা যায় না ?

    লাবণ্যর কথায় ওজন থাকে এমন, আর তখনই জানতে ইচ্ছে হয়, কেমন ছিল ওর স্কুলের দিনগুলি বা ওর সেই ছোটবেলা ? ওর গ্রাম বা শহর- । ওর কোনো কথাই যেন উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় । ভেবেছি অনেক । সত্যিই তো, অঙ্ক করলে লেখা যাবে না কেন ? অঙ্ক দিয়ে কী বলি আমরা ? কিছু তো বলি । অঙ্ক তো আসলে ভাষাই একটা । কোন গণিতজ্ঞ যেন বলেছিলেন কথাটা ? বলেছিলেন, ঈশ্বরের একমাত্র ভাষা । সত্যি কথা বলতে কী, অবিনাশ ব্যানার্জি যতই বলুক, `খারাপ মেয়ে', ওর কথার সঙ্গে কিছুতেই কিন্তু মেলানো যাবে না লাবণ্যকে । লোকটা মিথ্যেবাদীই । বা যেহেতু কেস লড়ছে লাবণ্যকে তোলার জন্য- । অবিনাশ ব্যানার্জির মতে, লাবণ্য বেশ্যা । এই মেয়ের জন্যই নাকি ওর দাদা এমনকী দাদার মৃত্যুও- । ওদের গোটা ফ্যামিলিই । এসব নিয়ে লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে খুব । ওর ঘর গেরস্তালি দেখতেও ইচ্ছে করে । ওর ঘর, ঘরের আসবাবপত্র, খাট, আর ওর কথামতো সেই ঘরের দেওয়ালে ঝুলতে থাকা ওর স্বামীর ছবিও । ওর স্বামীর নামটা যেন কী ? সুহাস নাকি সুভাষ নাকি প্রশান্ত । একদম মনে করতে পারি না । কোর্ট লাবণ্যকে একটা ডেট দিল কাল । কাজ হয়নি কিছু । ফের হয়ত মাস তিনেক পর । উকিলকে সন্দেহ করছে লাবণ্য । তেমন কোনও লোকের সঙ্গে জানাশোনা আছে, নাকি জানতে চাইল । ওর কথায়, দরকার হলে কিছু টাকা- । না করলাম ঘাড় নেড়ে । মুকুন্দদার কথা মনে পড়ল ফের । নো ঝামেলা । কোথ্থেকে কী হয়ে যেতে পারে কেউ জানে ?

    পড়তাম পালপুকুর হাইস্কুলে । তখন অব্দি দোতলা । হেডমাস্টার ছিলেন নাগবাবু । মণীন্দ্র নাগ । একেবারে যাকে বলে দুধে আলতা । লম্বা । চশমা পরতেন একটা । চশমার হাই পাওয়ারের জন্য কেমন জ্বলজ্বল করত চোখদুটো । বা বলা যায় কেমন দূরত্বই তৈরি করত যেন । ইংরেজি নিতেন আমাদের । স্যার প্রশ্ন করলে একটা `এসে' নিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতাম । `ইওর ফেবারিট হিরো'। ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন খুব । গমগম করত স্কুলবাড়ি । একবার কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল, সুভাষ বোস কি বেঁচে আছেন স্যার ?
    -- কে ? কে বলল ? স্ট্যাণ্ড আপ - দাঁড়াও -।

    কে দাঁড়িয়েছিল মনে পড়ছে না । তবে পরের কথাগুলি মনে পড়ছে স্পষ্ট ।

    -- সুভাষ বোস ? উনি কি তোমার ন্যাংটো বয়সের বন্ধু ? রাস্কেল -।

    এই `ন্যাংটো' শব্দটা মনে আছে এখনও । সেই তখনও যথেষ্ট অশ্লীল অথবা অসঙ্গত ঠেকেছে । বিশেষ করে স্যারের মুখে । ওই চেহারায় । উত্তেজিত হয়েছিলেন খুব ।

    স্কুলটাকে স্যারই দাঁড় করিয়েছিলেন । এখন অবশ্য তেতলা । অনেক বড়ো । অনেক স্টাফ । সে সময়কার কয়েকজন আছেন এখনও । দেখা হলে চিনতে পারবেন কি না কে জানে ?

    ছুটির পর একটা মই নিয়ে কার্নিসে উঠতেন নাগ-স্যার । দোতলার । ফুলের টব আনিয়েছিলেন প্রচুর । কী সব ফুল কে জানে ? নীচে বাগান তৈরি করেছিলেন দুপাশে । বাহাদুরকে নিয়ে নিজেই মাটি কোপাতেন । এক্বার পুজোর ছুটির আগে স্যার বললেন, পুজোর পর কী হয় বলা মুশকিল ।

    -- কেন, কেন স্যার -?
    -- যুদ্ধ হতে পারে ।
    -- কেন ?
    -- কেন আবার -নেতাজি আসছেন -তাকে কি পছন্দ করবে কেউ ? সব শয়তান এক হয়ে দাঁড়াবে ।

    পুজোর মধ্যে আকাশ দেখতাম আমরা । আমি আর আমার বন্ধুরা । স্যার বলেছিলেন, আগে আগে আকাশ থেকে ফটো ছড়িয়ে দেবে । নেতাজির । ওর কথায় প্লেনের পর প্লেন হেলিকপ্টার । আকাশ কালো হয়ে যাবে একেবারে ।

    এখনও বিশ্বাস করুন, পুজো হলেই মনে হয় এই বুঝি শব্দ হবে । আকাশে । একের পর এক হেলিকপ্টার উড়বে । এই বুঝি ছবি ছড়িয়ে পড়বে উপর থেকে ।

    কেউ একজন বাবাকে দেখেছে বিহারে । কোথায় নাকি ট্রেকারে চেপে যাচ্ছিল । সেজকাকুর চিঠিতে নাম আছে সেই লোকটার । কী করে দেখল লেখা নেই । তবে কি ট্রেন থেকে ? কোনো কারণে থেমে যাওয়া কোনও ট্রেন । দুপাশে গমক্ষেত । দূরের টিলা । রেললাইনের দুদিকে বেরিয়ে যাওয়া রাস্তা- হয়ত কাঁচাই । ট্রেনের জন্যই আটকে যাওয়া ট্রেকার । জানালায় মুখ রেখে হয়তো তাকিয়ে দেখছে লোকটা- আকাশটা যখন টিলার আড়ালে নেমে যেতে থাকে, বা খেত জমির । সকাল কি দুপুর কে জানে ? রাত্রি তো নয়ই । বাবাকে নাকি চেনা মুশকিল । কীভাবে তবে চিনল লোকটা ? সেজকাকু লিখেছে, `সুধনদা-', বলে ডেকেছেও । পাকা চুল আর ভাঙা মুখ নিয়ে বাবা নাকি ফিরেও তাকিয়েছে তখন ।

    বাবার জন্য খোঁজখবর করা হয়েছিল । তবে যথেষ্ট কিনা বলা মুশকিল । মা বেঁচে থাকলে হয়তো খুঁজে পেত ঠিক । আমার শুধু নখদর্পণের কথা মনে পড়ে । গুনিন লোকটার সেই ধমক, দেখেছ ? দেখতে পাচ্ছো ? তাকাও । বাবার কথা ভাবো । মুখ । স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছ ?

    আমি বিশ্বাস করুন, দেখতে পাচ্ছিলাম । আমার বাবা । সেই কালো আর সাধারণ চেহারার লোকটা তখন হাঁটছে । একবার যেন দেখল আমাকে । নখের গায়েই । আমি তখন, `বাবা-', বলে ডেকেও উঠেছিলাম । এইটুকুই । গুনিন বলল, ফিরে আসবে, তাকিয়েছে যখন আর ভাবনা নেই । আসতে হবেই ।

    সেজকাকু, সেজকাকিমারা পরে জানতে চেয়েছে অনেকবার । সত্যি ? দেখতে পাচ্ছিলি ? স্পষ্ট ? জায়গাটা কেমন ? চেনা লাগছিল কি ?

    গাছগাছালির কথা শুনে ওরা বসিরহাটে খোঁজ করেছিল । মামার বাড়ি । মামার বাড়ি অবশ্য নামেই । ওরা কেউ নেই তখন । ওই পাড়ায় গিয়ে খোঁজখবর করা হয়েছে অনেক । কোনও খবর ছিল না ।

    সেজকাকুকে লিখলাম, অনেক ঝামেলা চলছে এখন, যেতে পারব না । লক্ষ্মীর বিয়ে ঠিক হলে খবর দেবে ।

    বাবার ব্যাপারে উত্সাহ দেখালাম না কোনও । একটা লাইন বা একটা শব্দও না । সেজকাকুকে লিখলাম, বরং আমার ভাগের বাসনগুলি বিক্রির কথা ভাবতে পারো ।






    ॥ ৩ ॥


    মানুষ যেমন জল আর আগুনের কথা জানতে চায়, হাজার বছরের ধরে রাখা জ্ঞানের কথা জানতে চায়, লাবণ্য তেমনি করেই যেন জিজ্ঞেস করল, প্রেমে পড়েননি কোনওদিন ? ছিল কেউ ?

    লাবণ্যের কথা শুনে মুখগুলি মনে করার চেষ্টা করি । কৃষ্ণা, সোনামণি, অপর্ণা, স্বাগতা । ছেলেবেলা, স্কুল, পাড়া, কলেজ ।

    স্কুলে পড়ার সময় কৃষ্ণার ঠোঁট টিপে দিয়েছিলাম । ও তখন ঘুমে । কৃষ্ণা কেন যে সেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল কে জানে ? তখন সম্ভবত নাইন আমার । ওর ফ্রকের ওঠানামা মনে পড়ে । লক্ষ্মীর পাশেই শুয়েছিল । দিনের বেলাই ছিল সেটা । ওরা তখন শুধুই দুজন । কৃষ্ণা টের পেয়েছিল ঠিক । পরদিন একা পেয়ে জানতে চেয়েছিল, তুই না ?

    -- আমি ?
    আমার তখন হাফপ্যান্ট । দু পাশে পকেট । সামনে বোতাম । হাওয়াই শার্ট, রবারের চটি । সেপটিপিনও থাকতে পারে এক আধটা ।

    -- ঠোঁট টিপিসনি আমার ?

    লাবণ্যকে কৃষ্ণার কথা বলা হয়ে ওঠে না । ঠিক প্রেম কি ? বা ভালবাসা ? কৃষ্ণার বিয়ে হয়ে গেছে কবে । নৈহাটি নাকি কাঁকিনাড়া । বর জুটমিলের । আমার চাকরিতে ঢোকার বছরই ওর দু-দুটো মেয়ে । দেখা হয়েছিল একবার । স্টেশনে । ওর দেখলাম কিছুই মনে নেই । ভাবলাম সেদিনের কথা তুলব একবার । আর পরের দিনগুলির কথাও । অন্ধকারে দাঁড়ানো, আমার হাত নিয়ে ওর খেলা করা । কৃষ্ণা কিন্তু বেশ ভারি মেজাজের মায়ের মতোই সেদিন বকল ওর মেয়েদের । ওর বর তখন টিকিট কাটছে ।

    চুপ করে থাকতে দেখে লাবণ্য ফের জানতে চাইল, কী হল ?

    বাইরে দু-একটা পাখি ডেকে উঠল । নাকি কাঠবেড়ালি । আকাশটা অল্প ভার হয়ে আছে তখন । ঘরে এসময় তালা থাকে আমার । মলি বা অবিনাশ ভাববে, গেল কোথায় ? বড়জোর ক্লাব বা রাস্তাঘাটের কথাই অবশ্য মনে করবে ।

    অন্ধকারে জ্বলে উঠতে থাকা ওর চিবুক স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয় । ওর হাত । হালকা আর সরু আঙুলগুলির ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে খেলা করতে ইচ্ছে করে । সেই নরম আর ভাঁজহীন ত্বক । সেই চিকণতা । যেন বিজ্ঞাপনই । সাবানের । যেন বিদেশেরই । লাবণ্যের ত্বকের ঘ্রাণ টের পাই ।

    সোনামণির কথা বলা যায় না ? সুকান্তের সেই বোন । গান গাইছিল একদিন । কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীতই । একটা বিকেল । আর হয়তো সেই বিকেলের জন্যই `প্রিয় সোনামণি'- বলে চিঠি লিখে বসলাম একটা । সারারাত জেগে । মাত্র দু-পাতাই অবশ্য । কী যেন লিখেছিলাম ? ভালবাসার কথা ছিল তো ? আমি তোমাকে -, দিন সাতেক পর কে যেন বলল, ওর জ্বর । সুকান্তকে এড়িয়ে দেখা করতে গিয়ে শুনি, এ আপনি কী করলেন ?

    -- কেন ?
    ঘরটা যেন এখনকার এই অবিনাশের ঘরের মতোই । যেন কয়েকশো বছরের ইতিহাস । আলো আর অন্ধকারই । সম্ভবত লোডশেডিং । মোম জ্বলছিল । ওর মা তখন রান্নাঘরে । বলছিল, আর কটা দিন আগে এলেন না, কেন বললেন না আগে ? কেন চুপ করে ছিলেন ? ও নাকি দুদিন আগে কথা দিয়ে দিয়েছে কোন ছেলেকে ।

    লাবণ্যকে বললাম, দশ বছর আগে দেখা হলে - অন্তত দশটা বছর আগে কেন দেখা হল না ?
    -- কেন ?
    -- ঠিক প্রেমে পড়তাম ।

    লাবণ্য বলল, আপনি একটা ছেলেমানুষ । পাগল একেবারে-।

    হয়তো সত্যিই । নগেনবাবুও অবাক হয়েছিল খুব । সুধন মজুমদারের ছেলে শুনে ভালো করে তাকিয়েছিল । কী করছি, কোন অব্দি পড়াশুনা- শুনে অবাক । উনি যে পার্টির বেশ প্রতাপের বা কোনও স্কুলের সেক্রেটারি বা উনিই যে একটা কিছু করে দেবেন আমার, সে সব তখন কে জানে ? যাওয়ার সময় শুধু বলেছিলেন, এই অবস্থা তোমার ?

    বিপিন বলল, কিছু মনে করেননি তো ? মানে ওরা কাজটা কিন্তু বাজেই করেছে ।

    ছেলেটাকে এমনিতে খারাপ লাগে না । নির্মলদার লবির লোক হয়েও যথাসম্ভব নিরপেক্ষতা বজায় রাখে । এখন পর্যন্ত কারও সম্বন্ধে খুব একটা বাজে মন্তব্যও করেনি । এমনকি আমাকে নিয়ে কোথাও খারাপ কিছু বলেছে বলেও শুনিনি । ক্লাসেও না ।

    বললাম, এই প্রথম টেন দিল তো- পাটিগণিত, একটু খটকা লাগছিল একটা অঙ্কে । তাও বইয়ের না । কোথ্থেকে নিয়ে এসেছে কে জানে ?

    ও চাকরির বাজারের কথা তুলল । ওর দুই বোন আর এক দিদির কথা বলল । বাবা নাকি রিটায়ার্ড অনেকদিন ।

    বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম আমরা । কোনও এক মন্ত্রী মারা যাওয়ার জন্য ছুটি হয়ে গেল আজ । বিপিন বলল, আগে বুঝলে- স্কুলের চাকরিতে এত দলাদলি-, এর চেয়ে পি. এস. সি-র পরীক্ষা দিলেও -।

    পি. এস. সি.-র পরীক্ষা দিলেও পেয়ে যাওয়ার কথা ছেলেটার । ওর চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ । কোথাও গতি আছে একটা ।

    আমাদের স্কুলটা দোতলা । ইংরেজি `ইউ' অক্ষরের মতোই । মাঝখানে উঠোন একফালি । দোতলার দেওয়ালে ইংরেজিতে বড় করে লেখা, হরনাথ বিদ্যাপীঠ । নীচে ঠিকানা ।

    সামনের রাস্তাটা পুরনো খুব । কলকাতা শহর থেকে সোজা নীলগঞ্জ । মানে বারাকপুর । স্বরূপবাবুই বললেন একদিন, সেই নীলকর সাহেবদের যুগ, ভেবে দেখো সমীরণ । আমার অবাক লাগে খুব । রাস্তার অবস্থা অবশ্য বেশ খারাপই এখন । পিচের ছিটেফোঁটাও নেই । খোয়া ওঠা । দুপাশের ড্রেন ভেঙে রাস্তার অনেকটাই এখন বেদখল । দেড়শো-দুশো বছর আগে এটাই বারাকপুর যাওয়ার একমাত্র রাস্তা । এই রাস্তা ধরেই তখন মুর্শিদাবাদ । মালদহ । স্বরূপবাবুর কথায় তখন শুধুমাত্র ঘোড়া, ক্বচিৎ কখনও পাল্কি, দুপাশ জুড়ে জঙ্গল । এমনকি ওদের ছোটবেলা যখন কলোনিটা গড়ে উঠছে, তখনও গর্ত কাটতে গিয়ে মাথার খুলি পেয়েছে কেউ ।

    বিপিন বলল, এসব বিশ্বাস হয় আপনার ?

    আমি কেমন করে বলব ? আমাকে তাই চুপ করেই থাকতে হয় । ফেরার সময় ওদের বাড়ি যাব বলে কথা দিই । ওর দিদির গান শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করি, কীভাবে যেতে হবে জেনে নিই ।

    নগেনবাবু ডেকে পাঠিয়েছিলেন । শ্যামপুর হরনাথ স্কুলে চাকরির বছর দুয়েকের জীবনে ওর বাড়িতে এই নিয়ে তৃতীয়বার । জানতাম ছেলেদের অভিযোগ নিয়েই কথা বলবেন । স্বরূপবাবুও যখন বিরক্ত হয়েছেন, জানা ছিল কথা শুনতে হবে । কী হয়েছিল জানতে চাইলেন । স্বরূপবাবুর কথা তুলতে যেতেই বারণ করলেন । বললেন, ক্লাসে কোনও অঙ্ক করতে গিয়ে নাকি -।

    বললাম, ও তো যে কোনও লোকেরই হতে পারে । মিশ্রণের একটা বেশ `আনকমন' অঙ্ক । বইয়ের নয় ।

    নগেনবাবু বিয়ে করেননি । ঘরে ওর এক দূর সম্পর্কের পিসিই, বা স্রেফ পুরনো কাজের লোকও হতে পারে । ভদ্রমহিলার কথাবার্তা শুনে এইটুকুই আন্দাজ করতে হয় আমাকে ।

    -- ছেলেদের নামগুলি বলতে পারবে ?

    ওকে উত্তেজিত হতে বারণ করলাম । বললাম, এ এমন কিছু নয়, মিটে যাবে । পরিশ্রম করছি বাড়িতে । বললাম, অঙ্কটা কোনও জানা বই বা টেস্ট পেপারেরও নয়, ছেলেদের ব্যাপারটা মিটে গেছে প্রায়, স্বরূপবাবুও বুঝতে পারছেন ।

    ঘরটা ছোট । ছিমছাম । একপাশে একটা চৌকি - একজনের মাপের । ছোট একটা টেবিল । চেয়ার । সোফা একটা । কোনে মাদুর গুটিয়ে রাখা । ঘরটা মেন রোডের উপরই । মেন রোড মানে স্টেশন রোড থেকে ঢুকে পড়া । নবীন পল্লির অটো জানালার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়ার কথা । দেওয়াল থেকে ঝুলতে থাকা রামকৃষ্ণদেব । এছাড়া লেনিন । যেমন থাকে আর কি - থুতনিতে দাড়ি, বাঁদিকে আড়াআড়ি তাকানো । উল্টোদিকের দেওয়ালে এক ভদ্রমহিলা - সম্ভবত মা, ছবির কিছু অংশ অবশ্য হাতেই আঁকা, বিশেষ করে কপালের সিঁদুর, শাড়ির পাড়, চোখের চশমা । ক্যালেণ্ডারে বেশ বড় একটা জিব বের করে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা কালী ঠাকুর ।

    -- তোমার বাবা আমার কবেকার বন্ধু জানো ? সেই ন্যাংটো বয়সের - হাফপ্যান্টের, এখানকার নয়- সেই জঙ্গলবাড়ি, কিশোরগঞ্জের । হ্যাঁ, বাংলাদেশ -তখন তো ইস্ট পাকিস্তান -।

    বছর ছয়েক আগে ফর্সা আর রোগা চেহারার এই লোকটাই সেদিন বাড়ি খুঁজছিল । দেশবন্ধু কলোনিতে । ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছিলাম । জানালার বাইরে তখন কে যেন, `এটা সুধনদের বাড়ি না', বলে জিজ্ঞেস করছিল । বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার তখন অনেক বছর । মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কেউ খবর দিত, তোর বাবাকে দেখেছে -।

    -- কোথায় ? কে ?

    একেকবার একেকজনের নাম উঠত । কেউ বলত, ট্রেনের জানালায়- কেউ বা শেয়ালদায় । হয়তো বাস ধরছে বা দূরপাল্লার ট্রেনে যাচ্ছে কোথাও ।

    নগেনবাবুর ডাকটা যেন কুয়াশা কেটে বের হচ্ছিল । যেন বাবার গলাই প্রায় । বা বাবাই । বা ফোন করছে অনেক দূরের কেউ, স্পষ্ট করে কিছু বুঝতে না পেরে যখন বারবার জানতে চাইব, হ্যালো, কে বলছেন, হ্যালো -।

    আমিই বলেছিলাম, বাড়ি নেই ।

    -- বাড়ি নেই । ফিরবে কখন ? বলে গেছে কিছু ।

    আমার মুখে `অনেকদিন ধরেই নেই', শুনে ভদ্রলোক বুঝেই উঠতে পারছিলেন না কিছু । বোকার মতো তাকিয়ে থেকে জানতে চেয়েছিলেন, এটা সুধন মজুমদারের বাড়ি তো -? বলতে হয়েছিল, হ্যাঁ, আমিই, মানে, সুধন মজুমদারের ছেলে ।

    -- ক' বছর হল ?

    সেজকাকি এসে গেছে তখন । পুবের ঘরে । ঘরটা তখন অবশ্য আমার আর সুবলের । রাতে ঘুমোবার । সেজকাকিকে দেখলাম চেনে লোকটা । এমনকী সেজকাকির চেহারা দেখে অবাকও হল খুব । প্রথমে চিনতে না পারলেও সেজকাকি একসময় মনে করতে পারল লোকটাকে । জিজ্ঞেস করল, নগেনদা না ? সেজকাকি হাতের কর গুনছিল ।

    সেজকাকির মুখে সেদিন `সতেরো, সতেরো বছর-' শুনে আমারও অবাক লাগছিল খুব । সতেরোটা বছর-। নগেনবাবু মনে করিয়ে দিলেন ফের । বললেন, এখনকার হিসেবে ধরলে তেইশ । সতেরো যোগ ছয় । স্কুলে চাকরির এটা আমার দু-বছর । আমার মুখটা নাকি বাবার ছাঁদমতো । যেন সুধনই । যেন সেই ছেলেবেলা । কিশোরগঞ্জের । যেন মাইলের পর মাইল হেঁটে সেই স্কুল যাওয়া । বর্ষায় জলের ঢল দেখা ।

    -- সুধনের ছেলে বলেই অত ঝুঁকি নেওয়া । ভাবলাম, ঝুটঝামেলায় বি. এস. সি. কমপ্লিট না করতে পারলেও টেনের অঙ্ক পারবে । ভাবলাম, কাছাকাছি রাখি । এই কাছাকাছি রাখার জন্যই হাজার ঝামেলা করে স্কুলে চাকরি ।

    -- বিশ্বাস করুন, অত খারাপ কোনও কিছু নয় - জাস্ট আটকে গিয়েছিলাম একটু-।
    -- ইস্কুলে তোমাকে কিন্তু আমার হয়ে বলতে হবে না কিছু ।

    বিপিনের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের কথা বললেন । নির্মলের লবির ছেলে । বললাম, ভালই । সেজকাকুর কথা বললাম । লক্ষ্মীর কথা । ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা । টাকা পয়সার খোঁজখবর নিলেন উনি, জানতে চাইলেন, ওদের জন্য কত পাঠাচ্ছ ? ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের কথা তুলে লক্ষ্মীর বিয়েতে কত দিতে পারব জিজ্ঞেস করলেন ।

    বিপিনের কথা তুলে জানালাম, সত্যিই ভাল । ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছিল, বললাম । ওদের পরিবারের কষ্টের কথা । ছেলেটার মনের কথা । ঠিক করে বলতে গেলে সেদিনের দুপুরের পুরোপুরি বিবরণ দিলাম আমি ।

    -- কোনদিন ?
    -- ওই যে মারা গেলেন যেন কে ? মন্ত্রী - ।
    -- অজয় দত্ত । আমাদেরই - কৃষির -।

    ঘাড় নাড়লাম । তার মানে, মনে পড়েছে । ওর দিদির কথা শুনে জানতে চাইলেন, গান জানে তো ? বলল কিছু আর ?

    -- বলল, পড়াশুনা তেমন জানলে চাকরির চেষ্টা করতে পারত ।
    -- তুমি নিশ্চয়ই মুকুন্দদার ব্যাপার নিয়ে বলোনি কিছু - সার্টিফিকেট বা -।

    জানালার বাইরে অটো চলে গেল একটা । কয়েকটা বাচ্চা হুটোপুটি করছে খুব । `আমার ধরা-আমার ধরা', করে চিত্কার । নাম ধরে ডাক । শাসানো । তার মানে ঘুড়ি কেটেছে কোনও । আবার সুতো হত্তা করাও হতে পারে । তার মানে চুরি করাই অবশ্য । শরশর শব্দে মাঞ্জা দেওয়া সেই সুতোর লাটাইয়ে ফিরতে থাকা । কাটা খাওয়া । লাটাই হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ - ব্যর্থ আর হতাশও, ক্লান্ত -যেন তাড়া নেই কোনও । আকাশ থেকে ছাদে সুতোর সেই গড়িয়ে পড়া- কোনও কুল বা পেয়ারা গাছ, রাস্তা, মাঠ - লাল বা খয়েরি রঙের সেই সুতোর ফিরতে থাকা টের পাই আমি । বললাম, চাকরিটা ছেড়ে দিলে হয় না ? বরং অন্য কোনও - অল্প মাইনের হলেও -। বললাম, ভাল লাগছে না একদম, বিশ্বাস করুন ।

    প্রথম প্রথম অসোয়াস্তি হত খুবই । অতবড় একটা লোককে নাম ধরে ডাকা । অবিনাশ -। স্কুলের ঢোকার প্রথম কদিন যা স্বাভাবিক, অর্থাৎ `অবিনাশদা', বলেই ডাকখোঁজ করেছি । এরপর লোকটা নিজেই ডেকে পাঠাল । ডেকে পাঠাল মানে স্টোররুমের পাশ দিয়ে কি একটা কাজে যাওয়ার সময় ডেকে উঠল, সমীরণদা -।

    -- কি হল ?
    -- না, মানে, কথা আছে একটু -।

    স্টোররুমটা দোতলায় । একুশ নম্বর । স্কুলের যাবতীয় পুরোনো খাতা, মানচিত্র, ফাইভ কি সিক্সের সরকারি বই - সব ডাঁই করা । পুরোনো ক্যারামবোর্ড, খেলার ব্যাট, ছেঁড়া ফুটবল ।

    -- কিছু বলবেন ?

    একটা বস্তার মুখ খুলে রাখছিল কি সব । সম্ভবত পরীক্ষার খাতাই ।

    -- আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন - অবিনাশদা নয় -স্রেফ অবিনাশ -।

    এত বিশ্রী মুহূর্ত ছিল সেটা, পাশ দিয়ে ফাইভ সিক্সের এক ঝাঁক ছেলে সম্ভবত জল খেতে যাচ্ছে তখন ।

    -- আপনি আমার অনেক সিনিয়র, তাছাড়া -।

    বোঝেন না আপনি । আমি তো ফোর্থ ক্লাস স্টাফই- ধরুন দাদা বলে ডাকলেন -জল আনতে বলতে পারবেন ? ফাই ফরমাস খাটাতে পারবেন ? আমিও ভাবব- এটা হয় না -।

    এরপরও পর পর কদিন ভুল হওয়ামাত্র ধরিয়ে দিয়েছে, না না- শুধু অবিনাশই -।

    এই অবিনাশ কিন্তু স্কুলের অনেক কিছুই । হেডমাস্টার স্বরূপবাবু কিংবা সেক্রেটারির বাড়ি, ডি. আই. অফিস, কার পেনসনের কাগজে গণ্ডগোল, কার নামে গণ্ডগোল - সব কিছুতেই সেই অবিনাশ । দোষের মধ্যে এগারোটার জায়গায় স্কুলে পৌঁছতে ওর বারো এমনকি সাড়ে বারোও হতে পারে ।

    অবিনাশকে ঘন্টা পেটাতে হয় না । সেসব দুলু বা মিশ্রজির কাজ, ওদের দেখার ব্যাপার । অবিনাশকে অবশ্য গেটেও বসতে হয় না । সে গভর্নিং বডিতে নন-টিচিং-দের প্রতিনিধি । পার্টির ভালই কানেকশন । পাড়ার ছেলেদের হাতে ঠ্যালাধাক্কা খেলেও এক অবিনাশই ওদের ঘাতঘোঁত জানে । কোথায় কিভাবে টিপলে কে জমে যাবে সব ওর নখদর্পণে ।

    আর এই নখদর্পণের কথায় মনে পড়ল, ও একদিন হঠাৎ করেই বাবার ব্যাপারে জানতে চাইল । কার কাছ থেকে যেন শুনেছে, নগেনবাবুও হতে পারে অবশ্য, শুনেছে, ভাল লোক ছিল খুব । স্বাধীনতা সংগ্রামী, সৎ ।

    বলেছিল, এমনিতে যাই বলি না কেন, এইসব লোকগুলিকে কিন্তু আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ।

    মুকুন্দদা বলে দিয়েছিল, ঝামেলায় যাবে না কোনও । নগেনদাও । আমি তাই চুপ করে থাকি । ভাল-মন্দ কিছুই বলি না ।

    মায়ের কথাও জানতে চাইল । বললাম । কলেরার কথা, পরপর বমি আর পায়খানার কথা । যেমন শোনা আমার । আমি তখন কোলের । সেই পুবের ঘরের । এক রাত্রেই সব কিছু শেষ হওয়ার কথা বললাম আমি ।

    -- এক রাত্রেই ?

    সেসব অবশ্য আমার ভাল করে বলতে পারার নয় । মাকে নিয়ে আমার কোনওকালেই তেমন উত্সাহ নেই । স্মৃতিই নেই কোনও । ঘ্রাণ বা স্পর্শের অনুভূতিও নেই । থাকার মধ্যে একটা মাত্র ছবি । কেউ না বলে দিলে ভাববে, কমবয়সি কোনও মেয়ে - কপালে টিপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ।

    -- তাই ?
    -- হ্যাঁ, মা বলেই মনে হবে না । মানে, মা বলতে যেমন ভারি আর বয়স্ক চেহারার একটা ছবির কথা ভাবি আমরা -।

    অবিনাশ হেসে ফেলেছিল । তোমার মায়ের তখন কত আর বয়স । তখন তো অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার যুগ । বড়জোর সতেরো আঠারো, কি কুড়ি ।

    অর্থাৎ ছবিটাকে মায়ের বলে ভাবা মুশকিল । অনেকটা লাবণ্যের মতোই । নাকি লাবণ্যের থেকেও সুন্দর । অবিনাশকে অবশ্য লাবণ্যের কথা বলা হয়ে ওঠে না ।

    না, মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে বাবার বাড়ি ছাড়ার কোনও যোগ আছে বলে মনে হয়নি আমার । বাবা বাড়ি ছাড়ল তখন আমি ফোর । তার মানে বড়জোর দশ ।

    অবিনাশ জানতে চেয়েছিল, নখদর্পণ সত্যি করে মানি কিনা, কি দেখেছিলাম সে দর্পণে । বললাম । সেই নীল শার্ট আর ধুতি পরা লোকটার চলে যাওয়া । কালো । এমনকি একবার ফিরে তাকানোর কথাও বললাম । আর আমার `বাবা-' বলে ডেকে ওঠা ।

    -- কিন্তু সেটা তো ভুলও হতে পারে, হয়ত বাবার কথা ভাবছিলেন তাই -।

    এরকম প্রশ্নে গণ্ডগোল হয়ে যায় আমার । ধাঁধায় পড়ে যাই । এর আগেও অনেকেই জানতে চেয়েছে । নগেনবাবুও । বলতে চেয়েছে মিথ্যে, শুধুই মনের ভ্রম একটা । এমনকি ইংরেজিতে কিসব বলেও নাকি এগুলিকে ।

    এই অবিনাশ হঠাৎ করেই ফের ডেকে পাঠাল আমাকে । দুলু এসে বলল, সময় হলে একটু যাবেন । স্টোরঘরে । সেটা থার্ড পিরিয়ড । ফোর্থেও ক্লাস আছে একখানা । ভাবলাম, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কোনও কথাই । ক্লাস থেকে ফেরার সময় স্টোরঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, নেই । টিচার্সরুম থেকেও ঘুরে গেছে একটু আগে । স্কুলে ঢোকার পর থেকেই ভয়টা ত্রক্রমে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে । ঢোকার সময় কিন্তু এতটা ছিল না । বা একটুও ছিল না বলতে পারেন । মুকুন্দদা বলে দিয়েছিল, এমনিতে ঘাবড়াবার কিছু নেই, এই সার্টিফিকেট বা মার্কশিট নিয়ে কেউ ভেরিফাই করতে যাবে না, আর নগেনদার কেস যখন, এমনিতে চিন্তার কিছু নেই । তবু, সাবধানে থাকাই ভাল ।

    কদিন হল মনে হচ্ছে, এই বুঝি আমাকে লক্ষ করেই কেউ বলল কিছু । বা সেই `ডুবে ডুবে জল খাওয়ার কথা' ভাবতে গেলে তো আমার কথাই মনে হবে । বা এই স্কুলে কে কিভাবে ঢুকেছে জানা আছে সব-', বলতে আর কিই বা বোঝা যেতে পারে ?

    স্বরূপবাবুর ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল অবিনাশ । কানের সামনে মুখ এনে বলল, এখানে নয়, পরে । বরং স্কুল ছুটির পর, বা বাড়িতে হলেও চলবে ।

    আর তখন থেকেই চিন্তাটা থেকে গেছে । ক্লাসে গিয়ে আর পড়ানো যাচ্ছে না । যেন এক্ষুনি কেউ এসে সার্টিফিকেট-মার্কশিট দেখতে চাইবে । যেন গম্ভীর গলায় কাগজ পরীক্ষা করে কেউ ঘাড় নাড়বে । `হুঁ' বলবে । ইউনিভার্সিটিতে ভেরিফাই করার জন্য পাঠাতে বলবে । নাকি বলেছেও । স্বরূপবাবুর সঙ্গে নগেনবাবুর কোনও ঝামেলাই চলছে তাহলে । কিন্তু অবিনাশ তো নগেনবাবুর । ওর ব্যাপারটা অবশ্য সঠিকভাবে বোঝা মুশকিল । সেদিন নির্মলবাবুও স্কুলে এসে অবিনাশের সঙ্গে ফিসফিস করল কিছুক্ষণ । তবে কি সেই ব্যাপারেই । আমি কি তাহলে -?

    অবিনাশ সেই লোকটার কথা জানতে চাইল । নখদর্পণের - নখের আয়নায় যে সবকিছু দেখিয়ে দেবে, জানিয়ে দেবে । যে যার নিজের চোখেই দেখবে সবকিছু ।

    -- কেন, ওকে দিয়ে কি করবে ?
    -- দরকার আছে খুব । মেয়েটাকে নিয়ে -আর মামলাটাও -।

    পার্টির না কি মামলাটার ব্যাপারে কিছুই করার নেই । একবার কোর্টে চলে গেলে কারও কিছু করার থাকে না ।

    অবিনাশের ধারনায়, ওইসব লোক যা তুকতাক জানে তা দিয়েও হতে পারে । ওর বউ নাকি বলেছে । অবিনাশের কথায়, সে নিজে এসব খুব একটা বিশ্বাস করে না, তবু ওর বউ নাকি নিজের চোখে দেখেছে কোথায় । প্রায় হারা মামলায় কে নাকি জিতে গিয়েছিল । একেবারে একতরফা রায় । ওর বউয়ের বাপের বাড়িতে ।

    -- পারবে ? তোমার কি মনে হয় ?

    অবিনাশের কাছে - বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝামাঝি কথা বললাম ।

    -- চেষ্টা করতে পারো বড়জোর ।

    বললাম, তেমন হলে, সবাই-ই কোর্টে কেস না করে সাধু সন্ত আর গুণিনদের কাছেই তো যেত ।
    অবিনাশের কথায়, থাকতেও পারে কিছু । মলির বিয়ের নাকি কথাবার্তা চলছে একটা । বারুইপুরের দিকে । ছেলের নাকি চাষের জমি আছে অনেকটাই । নিজের বাড়িঘর । তবে টাকা চাইছে অনেক । মামলা নিয়ে অবিনাশের আশা ছিল খুব । ওর যুক্তিতে লাবণ্যর ঘরের ওপর লাবণ্যর হক নেই কোনও । ওটার দখল পেলে পুরো বিল্ডিং ভেঙে বাইরের লোক বসাতে পারলে টাকার ব্যাপারে চিন্তা করতে হত না ।

    কটা দিন সময় চেয়ে বললাম, ঠিক আছে, দেখি ।





    ॥ ৪ ॥


    শ্যামপুর এলাকাটার একটা ধর্মীয় ঐতিহ্য আছে । বেশ পুরোনো মন্দির আছে অনেকগুলি । আশ্রম । গঙ্গার পাড় দিয়ে হেঁটে গেলে একটা অন্যরকম ভাব আসে মনে । বা যেন আর কথা থাকে না কোনও । নিজের মনের সঙ্গেও না । আশ্রম বা মন্দিরের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া জল । দুটো একটা নৌকো । ওপারের গাছপালা । বাড়িঘর । ঘাট অবশ্য অনেক । বিভিন্ন নামের । সম্ভবত আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠাতারও, নানান কারণের । যেমন বিচালিঘাট নাম শুনে ধরেই নেওয়া যেতে পারে এককালে বিচালি নামত এখানে । এককালে মানে ধরে নাও অন্তত শ'খানেক বছর আগে । বারো মন্দিরের ঘাটটা নামডাকের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় । নামেই বোঝা গেল বারোটা মন্দির । ছটা করে দুপাশে । মন্দিরের এলাকায় ঢোকার বেশ চমত্কার দরজা একটি । লোহার কারুকাজেরই । এখন আমরা যাকে গ্রিল বলব ঠিক তাও নয়, কোথাও বা লোহার জাফরি, নীচে চাকা লাগানো । হাত লাগালেই শব্দ হবে ঠিক । শব্দ অবশ্য গতিরই । চাকার । সিংহ আছে বেশ কটা । ষাঁড় । শ্বেতপাথরেরই । মূল ঘাটের পেছনে বেশ চওড়া প্রাঙ্গনই বলব আমরা । পুরোনো গাছ কয়েকটা । কাঠমালতী, নিম । নিমের ঝিরঝির শব্দের বাতাস । আর নারীমূর্তিও আছে একটি । প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝামাঝি । বোঝা যায় সে সময় ফোয়ারা জাতীয় কিছুর আয়োজন ছিল । কম বয়সের একটি মেয়েই । শ্বেতপাথরের । উদোম আর চকচকে । ছবিতে দেখা গ্রীক দেবদেবীর মতো করে কাটা চুল । আকাশের দিকে মুখ করে এই নগ্নতা নিয়ে সে কি যে করবে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । মাটি থেকে উঠে আসা একটি লতানো গাছ - মেয়েটির ঠিক দুই উরুর মাঝ বরাবর হয়ে নাভিমূল পর্যন্ত ওঠে । তার মানে মেয়েটির লজ্জা রক্ষার একটি আয়োজনই -শিল্পীর করে দেওয়া ।

    লাবণ্য জানতে চেয়েছিল একদিন, কী করেন সারাদিন ?
    -- কেন, আসব ?
    -- না, তা নয় - ।
    -- কেন ? বিকেলে না হয় তোমার মেয়েকে সঙ্গে করেই - হাঁটতে পারি না আমরা ? বারো মন্দির ঘাট -।

    না, অন্তত আমাকে কোনও অশান্তিতে ভোগাতে চায় না লাবণ্য । রাতে এই মাঝেমধ্যে দেখা হওয়া, এই নাকি ভাল । যে ভাবেই হোক ওকে নাকি তুলতে চাইছে অবিনাশ ।

    -- আমিও, বিশ্বাস করুন, একটা শেষ দেখে ছাড়ব ।

    ও নাকি ধ্বংস দেখতে চায় এ ফ্যামিলির । শুধু এ ফ্যামিলির নয়, সবার, সবকিছুর ।

    -- এত রাগ কেন তোমার, কার উপর রাগ ?
    সেসব নাকি আমি বুঝব না । আমি নাকি ছেলেমানুষ । এই বাড়িতে আমার থাকা নিয়েও রাগ আছে লাবণ্যের ।

    -- কেন এলেন এখানে ? মরার আর জায়গা পেলেন না ? আর বাড়ি নেই কোথাও ?

    চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল নিয়ে প্রায় ধ্বংসস্তূপ হয়ে থাকা গোটা দুয়েক না ভেঙে পড়ে এখনও টিকে থাকা দোতলা বাড়ি । বাড়ি, পরিত্যক্ত পুকুর এসব কিছুর কোনও মূল দলিল আদৌ কোথাও আছে কিনা সন্দেহ । অবিনাশ বা লাবণ্য কাউকে মামলা নিয়ে বাড়তি জিজ্ঞেস করিনি কিছু । আসলে মামলা বা পুলিশকে বরাবরই ভয় করি খুব । মুকুন্দদা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে, ঝামেলার ব্যাপার দেখলেই সরে পড়বে কিন্তু ।

    দরজায় শব্দ হল না একটা ? একেবারে ফাঁকা এই দোতলার ঘর নিয়ে এই একটাই ঝামেলা । মাঝে মধ্যেই উটকো শব্দ চমকে দেয় একেবারে । যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠছে কেউ । বা নামছে । বা ছাদেই কেউ । হ্যাঁ, জানি, আসলে নির্জনতাই । আর হয়তো কোনও শব্দই । কোনও ইঁদুর কি কাঠবেড়ালী । অবশ্য কোনও কোনওদিন সত্যিকারের কোনও মানুষই । অবিনাশ, কি মলি, কি তুলি কিংবা পাড়ার কেউ হতে পারে ।

    ফের শব্দ হল না ? পর পর যেন অনেকবারই । যেন টোকা মারছে কেউ । কে ? না, কেউ নয় । ছাদটা দেখে আসব একবার ? নীচে জিজ্ঞেস করব কিছু ? মলি ? না, থাক ।

    যা ভেবেছি, কেউই নয়, ছাদের উপরটা শুনশান একেবারে । পাশের ছাদ । ছাদের চিলেকোঠা, দেওয়াল - সব একেবারে আগের মতোই ।

    দরজাটা বন্ধ হল কিভাবে ? খোলাই ছিল তো । অন্ধকার । আলো ছিল না ? তার মানে লোডশেডিং । লোডশেডিংই ।

    ডানদিকে যে চৌকিটা দেখছেন তারও ইতিহাস আছে একটা । হ্যাঁ, সস্তার । এসব বাড়ি তো খাট-পালং এর । চৌকিটা অবিনাশের কেনা । ওর বাবার জন্যই । ভদ্রলোকের শরীর নাকি পচে গিয়েছিল একেবারে । দুর্গন্ধ । শেষদিন পর্যন্ত এই চৌকিতেই । বাইরে ফেলে দেওয়া ছিল । আমিই বললাম, খারাপ নয়তো, অনর্থক পয়সা খরচ করার কি আছে ? অবিনাশকে জিজ্ঞেস করেই অবশ্য উপরে তুলেছি ।

    -- কে ?

    যা চমকে উঠেছি আমি । আলো জ্বলা মাত্রই দেখি, পা একজোড়া । মলি ।
    -- তোমাকে এত করে বারণ করলাম- ।
    -- কি হয়েছে ?
    -- কি হয়েছে মানে ? আমি তো ঘাবড়েই গেছি ।
    -- কি ভেবেছিলেন, ভূত ?
    -- ইস । এভাবে আসো কেন বলত ? কে কী ভাববে ?
    -- কেন ভাববে ? আপনি কি ছুঁয়েও দেখেছেন কোনওদিন ? আমি কি লাবণ্য - আমি কি -?
    -- মলি ?

    চিত্কার করতে গিয়েও গলা শুকিয়ে আসে আমার । বাইরে একটা কাক অন্ধকারে ডেকে উঠল কোথাও - উড়ে যেতে যেতেই । আর কোথাও কিছু গড়িয়েও পড়ল যেন ।

    -- মলি প্লিজ - বিশ্বাস কর, অনেক ঝামেলা -।
    -- ছাড়ব না আপনাকে, ভালোমানুষি হচ্ছে ? মুখোস খুলে ছাড়ব -।

    ওর পায়ের শব্দ শুনতে পাই আমি । নামার । গড়িয়ে পড়ার । একতলা পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ আলাদা করতে পারি ।

    রাতে চিঠি লিখি একটা । আমাকে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও । হয়তো আগামীকাল বা পরশু । মোটকথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । হয়তো তোমাকেই, পৃথিবীতে আর কাউকে কোনওদিন ভালবেসেছি কিনা সন্দেহ । শুধু তোমাকেই লাবণ্য । আশা করি বিশ্বাস করবে ।

    চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললাম । লিখেই । লেখা শেষ হতেই । কেন যে লিখলাম ? কেন যে -?



    তুলি বলল, কাল কী বলেছেন দিদিকে ?
    -- কেন ?
    -- আপনার ওখান থেকে ছুটতে ছুটতে নামল - বালিশে মুখ চাপা দিল - বলতেই চাইল না কিছু -।

    তুলি সুন্দর । রোমান্টিক । তুলির সঙ্গে কথা বলা যায় । ছোঁওয়ার ইচ্ছে হয় । ওর পছন্দ আছে । যেন জলের উপর ছায়ার মতো । অল্প বাতাসে তুলি কাঁপে ।

    বললাম, ছাদে যেতে বারণ করলাম তোমার দিদিকে, তাই ।
    -- তাই ? বাবাও বকল সেদিন এসব নিয়ে । ওখানে কী যে আছে কে জানে ? পারেও বটে ও -।
    ছাদের উপর কী আছে ? কিছুই নেই । স্রেফ ভাঙা দেওয়াল । শ্যাওলার সবুজ । সুরকির গাঁথনি । আর এক অদ্ভুত ঘ্রাণ - তা অবশ্য প্রাচীনতার । অথবা ভাঙনেরই । লাবণ্য যেমন বলে, ওর নাকি ভাল লাগে খুব । চারপাশে যেদিকেই তাকাবে, শুধু ভেঙে যাওয়া । খসা ইট । ভাঙা দেওয়াল । বটের চারা । অথবা অশ্বথ্থ । দেওয়াল, রেন পাইপ । দেওয়ালের ফাটল । আর ফাটলের ফাঁকে জন্ম নেওয়া সেইসব চারাগাছের কাঁপুনি । আর বাতাস । আর যেমন থাকে, জায়গামতো দাঁড়ালে গঙ্গা - গঙ্গার ওপার, জলের চিকচিক - এমনকি দূরের ট্রেনও ।

    তুলি সাজে ভাল । কিভাবে যে মেয়েরা সাজে এমন । শরীরের মাপমতন একেবারে । হালকা । ফুরফুরে । তুলির খোঁপায় জরির কাজওয়ালা এক চিলতে কাপড় - গোলাপি । যেন গোলাপই একটা বা একগুচ্ছই । হালকা নীলের চুড়িদার । চমত্কার কাজের মহার্ঘ পাতাই যেন । চেনা যায়, হয়তো দূর দেশের ।

    ও বই পাল্টাতে এসেছে । গল্পের । নেবে, পুতুল নাচের ইতিকথা । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের । খুব নাকি ভাল, কার কাছে শুনেছে কে জানে ?

    সন্ধে হলে অন্য কোথাও যাওয়ার না থাকলে ক্লাবেই আসি ইদানিং । ছেলেরা পছন্দ করে আমাকে । পুজোর বিজয়া সম্মিলনীর জন্য আমার পছন্দের নাটকের নাম জানতে চায় । পুজোর সুভেনিরে অতুল ঘোষের লেখা সম্পাদকীয় আমাকে দেখে দিতে হয় । আমাকে কমিটিতে রাখতে চেয়েছিল এবার । সহকারী সম্পাদক । যেমন থাকে আর কি । গোটা চারজনের এক মণ্ডলীর একজন । না করে দিলাম । এসব পুজোয় যা হয়, আসল লোককে খুঁজে পাবেন না আপনি । প্রেসিডেন্ট করেছে সুধাংশু হাজরাকে । ওপার বাংলার লোক । সত্তর-একাত্তরে কেনা বাড়ি, বেশ নাকি সস্তায় পাওয়া । স্টেশন রোডে দোকান আছে দুটো । তুলির সঙ্গে এই সুধাংশু হাজরার ছেলের নামটাই ঘোরাফেরা করছে ইদানিং । শুধু বাইক নয় মারুতিও আছে ওদের । ট্রাকের ব্যবসাও আছে আলাদা । সুধাংশু হাজরার ছেলের বাইকের আওয়াজ চেনা হয়ে গেছে তুলির । শব্দ হতেই টের পায় ঠিক । না, এসব অবশ্য আমার বোঝার নয় । ক্লাবঘরের এদিক ওদিক থেকে শোনা । পাড়ার ছেলেরা, মেয়েরা । যখন বই নিতে আসে তুলি, যখন দরজার বাইরে দাঁড়ায়, - তুলি তাকায় না একদম । যেন গ্রাহ্যই নেই কোনও । যেন শুধু গল্পের বইই । বাপ্টু হাজরা । ভাল নাম নিশ্চয়ই আছে একটা । হয়ত সুশান্ত বা সুরজিত । কিংবা অরুণাংশুও হতে পারে । বাপ্টু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নোটিশ বোর্ড পড়ে । সিগারেট বের করে জ্বালায় । সিগারেটের ধোঁয়ায় এক তুলিরই গলা ধরে । কাশি পায় । কষ্ট হয় খুব । সুমনদার কাছে অভিযোগ করে, লাইব্রেরিতে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করা যায় না -?

    -- কেন ? কী হল ?
    -- ধোঁয়া -।

    ওর চোখ একটু কুঁচকে যায় যেন । যেন আর একটু সুন্দর । ওর একটা হাত কপাল ঢাকে তখন । আর চুড়িদারের ভাঁজ আলগা হয় । ওড়নারও । তুলির হালকা আর নির্ভার বুক আলো পায় তখন । টিউবের । সাদা । অল্প ছায়া আর আলোয় মেয়েটির শরীর একেবারে পাল্টে যায় কেমন ।

    বই নিয়ে দাঁড়াবে না তুলি । পাত্তাই দেবে না কাউকে । কাউকেই নয় । কার পরোয়া করে সে ? তুলি জানে এক্ষুনি শব্দ হবে । সজোরে লাথি মারবে কেউ । একেবারেই চালু হবে ইঞ্জিন । ভটভট শব্দ তুলবে ঠিক । ঠিকই । তুমুল ঝড় তুলে যন্ত্রের একটি গাড়ি প্রাচীন গন্ধঅলা এই পাড়ার বাতাস ভাঙবে ।

    শব্দ শুনে তাকাই । বাপ্টুর লাল গেঞ্জি রক্তের মতো কাঁপে । ফুলে ওঠে যেন । আবার টান খায় । শব্দ হুড়মুড় করে বাতাস ভাঙে । গঙ্গার । এবং প্রাচীনতারও । শব্দটা ফিরে আসবে আবার । বাড়বে । পাড়াশুদ্ধ লোক তাকিয়ে দেখবে ! আর মেয়েরাও টের পাবে ঠিক । তুলি এখন ফিরছে । তার মানে অবিনাশ ব্যানার্জির বাড়ির সামনে থেমে পড়বে শব্দটা । একটু অন্ধকারেই । তুলিও । ভাল করে বোঝার চেষ্টা করি, ক্লাবঘর থেকে রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকি । আমি তো ফিরতেও পারি । আমার তো ফেরারই কথা । তুলি জানে । বাপ্টুও । এই অন্ধকারের আর এই শব্দের ভয় হয় যদিও ।

    দোতলায় উঠতে যাব, দেখি, অবিনাশের গলা । ডাকছে আমাকে । ফিসফিস করেই ।
    -- কী বলছিলাম, বুঝলেন কিছু- ? থাকা যাবে না আর - থাকা যাবে না -।
    -- কী হল, কেন ?

    অবিনাশ তুলির কথা বলল । ওর বেহায়াপনার কথা । বাবা হয়ে নীরবে সহ্য করার বেদনার কথা । প্রায় বেশ্যার মতোই । ওইরকম লোফার মার্কা একটা ছেলে -।

    `বাবা-' বলে কেউ ডেকে ওঠায়, দেখি মলি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাদের ।



    সেজকাকু চিঠি পাঠিয়েছে ফের । `আমাদের প্রতি কি কোনও কর্তব্য নেই তোর ? তুই কি তোর বাবার মতোই হয়ে গেলি ? সবাইকেই কি ভুলে যেতে হয় ?' চিঠির শেষে নিজের শরীরের কথা । সুগার, প্রেসার । তাছাড়া সেজকাকির কথাও । আর লক্ষ্মী বা সুবলের ব্যাপারে যেমন থাকার - আমার সঙ্গে কথা না বলে নাকি লক্ষ্মীর বিয়ের ব্যাপারে এগুতে পারছে না আর ।

    দু'বছর পর ফের সেই স্টেশনে পা দিলাম । সেই ফলের দোকান । রেলের `সঠিক ভাড়া দেবেন'- লেখা বোর্ড, তিন নম্বরে সেই থ্রু ট্রেন । চায়ের দোকান, চায়ের দোকানের ছেলে, বিস্কুটের বয়াম । মাছি, এমনকি ঠাকুরের বাঁধানো ছবিগুলিও । টাইমটেবিলের গা ঘেঁষে যাত্রার পোস্টার । ঋতুবন্ধের গ্যারান্টি ।

    পিন্টু চিনতে পারল ঠিক । ওর দোকানের সামনেটা প্রায় ফাঁকাই । এগারোটার পর এটা অবশ্য ভিড় কাটার সময়, শেয়ালদার লোক এতক্ষণে ট্রেনে কি অফিসে ।

    -- দেখিনি অনেকদিন- ।
    যেন এক সপ্তাহ । বা বড়জোর এক মাস । বললাম, ছিলাম না তো । ব্যস । যেন এরপর পৃথিবীটা ফের আগের মতোই হয়ে যাওয়ার কথা । চা নেব একটা । বিস্কুট । সিগারেট । চায়ের স্বাদ নিয়ে ইয়ার্কি করব । প্লাটফর্মের মাতালদের নিয়ে টিপ্পনি কাটব দু-একটা । ভিখিরিদের ধমকাব ।

    বললাম, চাকরি করছি একটা ।
    -- কোথায় ?
    -- শ্যামপুর ।
    -- তার মানে থাকেন না এখানে আপনি ?
    -- থাকি- এই যেমন এলাম । মাঝে মধ্যে- ।

    আসলে ছেলেটাকে হতাশ করতে খারাপ লাগে । বছর দুয়েক আগে ওর বয়স ছিল বড়জোর চৌদ্দ কি পনেরো ।

    বললাম, এখনও একই দোকানে থেকে গেলি ?
    -- কোথায় যাব বলুন ? অনিতদাকে চেনেন তো আপনি ? এমন করে রেখেছে - ।

    দোকানের সামনে বাঁধানো বেঞ্চে একটা বুড়ো হাঁ করে শুয়ে । ঘুমোচ্ছে । গাল ভর্তি দাড়ি । ডাঁটভাঙা চশমা কানের সঙ্গে দড়ি দিয়ে আটকানো । টিকিট কাউন্টারের গায়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণের শপথ । একটা মিছিলেরও ডাক আছে মনে হয় । অস্পষ্ট ।

    ফের মুকুন্দদার কথা মনে পড়ল আমার । ঝামেলায় যাবে না । অনিতদা শুনলে খুশি হবে না নিশ্চিত । এটা তো প্রায় কান ভাঙানোই হয়ে যাচ্চে । ওর মায়ের কথা জানতে চাইলাম । `চার নম্বর প্লাটফর্মে থাকতিস না তোরা ?'

    ওর মা মারা গেছে । রেল অ্যাক্সিডেন্টেই । কী কারণে লাইন পার হতে যাচ্ছিল । ঝুপড়িগুলি পুলিশই নাকি ভেঙেও দিয়ে গেছে গত বছর । তার মানে পিন্টুকে অন্য কোথাও থাকতে হয় এখন ।

    -- কোথায় ?
    -- অনিতদার কাছে - বারান্দায় ঘুমোই -।

    স্রেফ রজনীদের মস্তানির জন্যই নাকি ভাঙা গেছে ঝুপড়িগুলি । পুলিশকে খেপিয়ে দিয়েছিল । পয়সা দেয়নি সময়মতো । আসলে পার্টিও ওদের উপর চটে গিয়েছিল খুব । ফের সামলাতে হল নিজেকে । বললাম, ছাড় - ।

    সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেখি অটো চালু হয়েছে রিক্সাও আছে অবশ্য । দোকান বেড়েছে অনেক । পরোটা, ব্যাগ, পান-বিড়ি-সিগারেট-এর গুমটি । মন্দিরের মতোও হয়েছে একটা । গোপালদার দোকানের পিছনে অশ্বথ্থ গাছ লাগিয়েছে কেউ । শনিপুজোর থালা, সঙ্গে সাদা কাগজে ভাঙা অক্ষরে লেখা, `সন্ধ্যা সাতটায় প্রসাদ পাইবেন' । অশ্বথ্থ গাছের নীচে রিক্সায় বসে থাকা ছেলেটাকে দেশবন্ধু কলোনির কথা বলায় ছেলেটি আঙুল দেখাল চারটি । তার মানে চার টাকা । আগে কত ছিল ? কত ছিল ? কত ছিল, স্টেশন থেকে দেশবন্ধু ? মনে করতে পারছি না কিছুতেই । অবশ্য রিক্সা চড়ে বাড়িই বা কবে ফিরলাম ? এই প্রথম । আসলে ভয় পাচ্ছি আমি, বা অস্বস্তি । চোখে চোখ পড়লেই কেউ জানতে চাইবে, কোথায় ছিলে গো সমীরণ ? বা, কবে ফিরলে ? বা জানতে চাইবে, এবার থেকে কি এখানেই -?

    দূর থেকে লাল রঙের শহিদ বেদি চোখে পড়ছে । সত্তর সালে বানানো । বোমা বানাতে গিয়ে মারা যাওয়া তুষার চক্রবর্তীর স্মৃতি । সেজকাকু বলত, আমাদের বাড়িতে আসত খুব । কুঁজ ছিল একটা পিঠে । কোথায় যেন কম্পাউণ্ডারি করত । ভাল লোক ছিল কিন্তু । সেজকাকুদের কথায় আমাকে নাকি ভালবাসত খুব । তখন অবশ্য আমি একেবারে ছোটই । মায়ের কোলে ।

    -- সমু না ?
    -- কে ? ও রিক্সা থাম একটু - এই আজকেই, ভাল আছেন তো ?

    কৃষ্ণার বাবা । যা ভয় পেতাম এককালে । কৃষ্ণার জন্যই অবশ্য । একদিনের ওই ঠোঁট টেপাটাকে ধরে বসল মেয়েটা । লক্ষ্মীর এখন কত হবে ? পঁচিশ ? কৃষ্ণা এর মধ্যেই দুই মেয়ের মা । ভদ্রলোক তার মানে দাদু । যদি সত্যিই বিয়ে করতাম কৃষ্ণাকে ? অন্ধকার আড়াল আবডালের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়লে হাসি পায় না ? মেহেন্দি বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে, তুই আমাকে ভালবাসিস সমু ? সত্যি ? আর আমার সেই হাত কাঁপা -। ওর ফ্রক । ফ্রকের ঘ্রাণ কি আশ্চর্য রকমের পাল্টায় তখন । সেই নোংরা আর ছেঁড়া ফ্রকের আড়ালে কৃষ্ণার সেই নি:শ্বাস প্রশ্বাস । আমারও । আমারও অবশ্য । সেই হাত, হাতের আঙুল - কত বড় না ? সেই নরম আর চিকন ভাব এখন আর নেই । কারই বা আছে ?

    রাস্তার খোয়া উঠে গেছে অনেকদিন । সেই দু-বছর আগেকার মতোই । পিচের চিহ্নমাত্র নেই । পুকুরটা বাঁধানো হয়েছে অবশ্য । আমগাছটা কাটা পড়েছে । এতক্ষণ সময়ের মধ্যে, চিনতে পারার মধ্যে এক কৃষ্ণার বাবাই । আর কেউ কি লক্ষ করেছে ? দেখেছে ? বা দেখে অবাক হয়নি কেউ ?

    সেজকাকির কথায়, আমার বুক - বিশ্বাস করুন, কেঁপে ওঠে খুব । আমি যে মাস্টারি করছি এটা নাকি জানে সবাই । কীভাবে জানল ? আমি তো বলিইনি কাউকে । দেখাও তো হয়নি কারও সঙ্গে । তবে ? কে কে যেন দেখেছে আমাকে । ট্রেনে ঘন্টাখানেকের তো পথ । হঠাৎ করেই কেউ গিয়েছিল কোনও কাজে । আমাকে দেখে আশপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করেছে । শ্যামপুর । এমনকি স্কুলের নামও । হরনাথ । হরনাথ বিদ্যাপীঠ ।

    -- ডাকেনি কেন ?
    -- হয়তো ভেবেছে মাস্টারি করিস তুই-, হয়তো সম্মানের জন্যই -।

    বাড়িতে টিভি এসেছে । ছোট মাপের । সেজকাকুর শরীর সত্যিই খারাপ । সুবল বাড়ি ছিল না প্রথমে । পরে এল । সত্যিই বাজে হয়ে গেছে ছেলেটা । চোয়াড়ে মার্কা চেহারা হয়েছে একেবারে । মেয়ের পাল্লায় পড়েছে কোনও । বা নেশাও হতে পারে । নেশাই । চোখ লালচে । কেমন বদরাগী লাগছে দেখে ।

    -- কোথায় ছিলি ?
    -- বাইরে । কাজ ছিল হঠাৎ -?
    -- হঠাৎ কোথায়, সেজকাকু চিঠি দিল ।

    মেঝেটা পাকা হয়েছে । কিভাবে হল কে জানে ? পুবের ঘরটা বন্ধই ।
    -- কেউ থাকে না ও ঘরে ?
    -- না, মাঝখানে ভাড়া দিলাম কিছুদিনের জন্য - তোকে তো বলা হয়নি -।
    -- সে ঠিক আছে, যা ভাল বুঝেছ ।

    লক্ষ্মী বলল, বৃষ্টি নামতে পারে আজ ।

    হঠাৎ করেই । কেন মনে হল ওর ? বৃষ্টির কথা । ঠিকই । নামতেই পারে । মেঘ ঘুরঘুর করছে সকাল থেকে । নাকি কাল রাত থেকেই । ছাতাটা নেব কিনা ভেবেছি একবার । আসলে কদিন ধরেই কাগজে লেখালেখি চলছে খুব । বর্ষা এবছর দেরি করে এসেছে, অর্থাৎ যাবেও দেরিতেই ।

    আমি ঘুমোতাম বাঁদিকের চৌকিতে । বাবাও । যতদূর মনে পড়ে জানালার পাশে । বাঁশের বেড়ার বাইরে পেয়ারা গাছে শুঁয়োপোকা হত খুব । বাতাসে উড়ত যেন । পাতলা বাচ্চাগুলি হালকা রোঁয়া নিয়ে যেন বাতাসের ধাক্কাতেই ঘরে ঢুকত । মশারির দড়ি কাঁপত । আমার অবশ্য বদ অভ্যাস ছিল একটা । বাবার শরীর চড়া । ওঠা । শুয়ে থাকা । ঘুমনো । বা বাবারও ভাল লাগত হয়ত । গল্প করত । এখন মনে হয় সেসব আসলে বাবার নিজের কথাই । সম্ভবত গ্রামের । দেশের বাড়ির । সেই জঙ্গলবাড়ি বা কিশোরগঞ্জেরই । নগেনবাবুর কথায়, ইস্ট পাকিস্তান ।

    আশপাশের বাড়িগুলি কিন্তু পাল্টে গেছে বেশ । আসল পরিবর্তন যেন ছাদে । আগেকার মতো সেইসব টিভি অ্যান্টেনা আর নেই । `কেবল' ঢুকছে । পাশের মাঠে মাটি পড়ছে । অতীনদা নাকি জিতেছে এবারে । মিউনিসিপ্যলিটিতে আগের থেকেই নাকি কথা বলা ছিল । মাঠ উঁচু করবে । কথা রেখেছে অতীনদা ।

    কেউ কিছু বলেছে কিনা জানতে চেয়েছিল সুবল । আসন পেতে খেতে বসেছি সবে ।

    -- কী ?
    -- ঘর ভাড়ার কথা - ।
    -- না, এই তো শুনলাম । দরকার হয়েছে দিয়েছিস ব্যস ।

    সুবল ওর মায়ের দিকে তাকাল একবার । লক্ষ্মী পরে বসবে, চৌকিতে বসে টিভি দেখছে । ওর বাবা, মানে সেজকাকু বিড়ি ধরাল একটা ।

    -- আমার ইচ্ছে ছিল লিজ দেব । মানিকরা কাপড় ছাপার জন্য ঘর খুঁজছিল একটা ।
    -- সে আমি কী বলব -।
    -- বলছে লিখে দিতে হবে, হাজার করে দেবে মাসে- পুবের ঘরেই -।
    -- পুবের ঘরে -?

    গলায় আটকে গেল খাবারটা । ভাত আর ডালের একটা দলা । সেই বাতাসের কথা মনে পড়ল । পেয়ারা গাছ আর রাত্রির বাদুড় । বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো আর ভয় পেয়ে বাবাকে আঁকড়ে ধরা । যেন অনেক দূর চলে যাচ্ছে সব । সব শব্দ, সব দৃশ্য, স্মৃতি । আমার মা । মায়ের বমি । পায়খানা । একট মাত্র রাত্রি । একটা মাত্র রাত্রিই । আমার ঘাম, ছেঁড়া পাজামা ।

    -- ভাল লাগছে না আর -।
    -- খাবি না ? লবণ হয়নি ?
    -- না, পেট ভরে গেছে - সত্যি বলছি ।

    বিছানায় শুয়ে মনে হয়েছিল, আর কোনওদিন পালপুকুরের বাড়ি আমাকে পাবে না । এই মাটি, এই বাতাস । কুয়োপাড় । বাসনের শব্দ, সেই ঝন করে ওঠা । কাক তাড়ানো, হুস্‌ করা ।

    চলে আসার সময় বললাম, তোমরা যা ভাল বোঝ করবে । দরকার হলে সই করে দেব । দিলামও । একটা কাগজ । নীচের দিকেই । ফাঁকা । সুবল বলল, লেখাটা পরে ঠিক করে নেবে । যা খুশি করুক । লক্ষ্মীর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করলাম । সেজকাকুকে বললাম, অনেক কষ্ট করে তুমি পড়ার টাকাটা জোগাড় করে দিয়েছিলে । হ্যাঁ সার্টিফিকেটের জন্য মুকুন্দদাকে দেওয়া টাকাটাই । নগেনবাবুর শেখানো কথামতো করেসপণ্ডেন্স কোর্সে এম. এস. সি পড়ার টাকা । বললাম, কম তো নয়, দশ হাজার । বললাম, মনে আছে আমার । লক্ষ্মীর বিয়ের জন্য হাজার পাঁচ দিতে পারব । মাসে মাসে যা পাচ্ছি তার থেকে আলাদাই । বাসনগুলির কথা তুললাম । সেজকাকু বলল, খরিদ্দার ঠিক হয়ে গেছে । এটা স্টিলের যুগ । তামা-কাঁসার বাসনের নাকি তেমন ডিমাণ্ড নেই । তাও হাজার সাতেক হয়ে যেতে পারে । আমি শুধু সিন্দুকটার কথা বললাম । কেন কে জানে ? সেই থলেটার কথা জিজ্ঞেস করলাম । লাঠি । আর খাতাটার কথাও জানতে চাইলাম - দাদুর, সেই গানের, কীর্তনের, যাতে দাদুর নিজের হাতের লেখা । মৃত লোকগুলির নাম, ঠিকানা, সংখ্যা । বাবার লেখা বংশতালিকা । এমনকি আমার নিজের সেই হাতেখড়ির দিনের অ-আ-ই-ঈ । সেজকাকুকে বললাম, শুধু সিন্দুকটাই রেখে দিয়ো । যেদিন লাগবে চেয়ে নেব ।


    (এর পরে)


    (পরবাস-৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)