• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩২ | জানুয়ারি ২০০৪ | ছোটদের পরবাস | উপন্যাস
    Share
  • কালমেঘের ফুল : চিত্তরঞ্জন দেব

    ॥ তেরো ॥


    মুনিয়ার মায়ের ভাবনা বাড়ল । এক্ষুনি নাগিনা ফিরবে ঘরে । এসে যদি দেখে যে মুনিয়া নেই ঘরে, মুংলিও নিখোঁজ তাহলে তাহলে কি যে উপায় হবে ! রঙ্গিনী অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো, মুনিয়ারে .. ও মুনিয়া ... মুনিয়া । সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই কেঁপে কেঁপে কোথায় মিলিয়ে যায় .. মুনিয়া কি শুনতে পায় ।

    পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে মুচিবাড়ি থেকে নেমে আসছে কে মুনিয়ার মাথা থেকে পা অবধি কাঁপতে থাকে । এবার সে পালাবেই কোথায় পাটক্ষেতের ভিতর ঢুকবে কিন্তু সময় নেই । বাবা-যে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে । ভয়ে আর এক পাও এগোতে পারছে না মুনিয়া । শুধু কাঁপছে আর কাঁপছে । পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে মুচিবাড়ি থেকে নেমে আসছে কে ..
    বাবা শুধালো, বাছুরটা কোথায় ?

    মুনিয়া বলল, আমিই ওটাকে ছেড়ে ছিলাম বাবা ... আরও কি সব বলতে চাইছিল, কিন্তু ভয়ে গলা আটকে আসছে মুনিয়ার ।

    নাগিনা ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, এত ভয় কিসের বাবা আমি তোমাকে মারব না । শুধু ওই পাজি বাছুরটাকে ....

    কথা শেষ না হতেই মুনিয়া বাধা দিয়ে বলল, না বাবা, ওর কোনো দোষ নেই, আমিই ওকে ছেড়ে দিয়েছিলাম ।

    নবী হুসেন একটা আলো নিয়ে এল । নাগিনা ও মুনিয়া বাইরে দাঁড়িয়ে রইল । নবী ভিতরে ঢুকে বলল, দেখ্রে নাগিনা, তোর বাছুর আমাদের গাইয়ের দুধ খেয়ে ফেলল ।

    মুনিয়ার মনে বাজে - এতটুকু ছেলেটা মুনিয়ার বাবাকে নাম ধরে ডাকে ! কি রকম লজ্জা সংকোচ নেই !

    মুনিয়া ঘরে ঢুকে দেখে - সত্যি, মুংলিটা নবীর গাই এর বাঁটে মুখ দিয়ে গুতোচ্ছে । কি অদ্ভুত কান্ড ! আপনপর চেনেনা মুংলি হতচ্ছাড়ি ।

    মুংলিকে ঠেলে ঠেলে বের করে দিল নবী । ঘরের বাইরে এসে এমন দৌড় মারল - কেউ দেখতে পেল না কোন্‌ দিকে, - শুধু গলার ঘুঙ্ঘুরটা কিছুক্ষণ দ্রুত বেজে হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেল ।

    বাপ ছেলে দুজনেই পথে নেমে দাঁড়াল । মুনিয়া বলল, ঐ শোনো বাবা, মুংলি ডাকছে - ঐ - যে হেম্বে - এ-এ-এ ।

    ছেলের কথার উত্তরে নাগিনা বলল, ঐ শোনো বাবা, পুনিও বলছে, হাম্বা ... আ...আ...আ...আ..
    মুনিয়া শুধাল, হাম্বা বলে কেন বাবা ।

    নাগিনা বলে, হাম্বা মানে আয়-মা, পুনি তার মেয়েকে ডাকে, আয়মা .... আয়মা ।
    মুনিয়া উত্তর দেয়, তাহলে মুংলি বুঝি বলে, আসছি আসছি !

    নাগিনা বলে, ঠিক ধরেছ বাবা । আমরা বাড়ি পৌঁছে ঠিক দেখতে পাবো যে মুংলি ওর মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ।

    বাবার আগেই মুনিয়া ছুটে গিয়ে উঠল বাড়িতে । গোয়ালঘরে ঢুকে দেখল মুংলি তার মায়ের বাঁটে গুঁতিয়ে দুধ বের করছে আর জিভ দিয়ে চুষছে দুধ চক্‌ চক্‌ করে । আর পুনি মুংলির গা চাটছে পরম আদরে । মুনিয়া অবাক হয়ে ভেবে - বাবা যা বলে তা এমন ঠিক হয় কেমন করে ।
    পরের দিন সকাল বেলা ।

    নাগিনা এসে বলে, বাছুরের গলায় দড়িটা পরিয়ে দিও বাপ্‌ নইলে আবার পালাবে কিন্তু ।

    । তক্ষুনি নিজের কোমরের তোড়া থেকে আরেকটা ঘুঙ্গুর খুলবে বলে চলে গেল বাবার কাজের ঘরে । কিন্তু বাবা তখন কাজ করছিল । গেল রান্নাঘরে, মায়ের বটি দিয়ে কাটতে গেল ঘুঙ্গুরের সুতো । কেটে গেল তোড়াছড়ার বাঁধুনি । সব তোড়া খুলে ছড়িয়ে পড়ল ঘরময় । ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সে সব কুড়োতে লাগল মুনিয়া । মুনিয়া অনেকক্ষণ বসে রইল মুংলির কাছে । হঠাৎ চোখে পড়ল ঘুঙ্গুরটা নেই মুংলির গলায়

    রঙ্গিনী যেন রণরঙ্গিনীর মতো ছিনিয়ে নিল এসে মুনিয়ার হাত থেকে ঘুঙ্গুর আর তোড়া যত । মুনিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে চলে গেল গোয়ালঘরের দিকে । কান্না থেমে গেল ভিতরে তাকিয়ে - মুংলি নেই !
    বাবার কথা আবার ফলল ।

    দেরি না করে ছুটেই সে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে । মুংলির গলায় এখন আর ঘুঙ্গুর নেই যে কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে বা কোথায় আছে তা বুঝতে পারবে । ধান ক্ষেতের আল ধরে সে চলল এগিয়ে । কিছুদূর যেতেই দেখে যে একটা ক্ষেতের এখানে ওখানে ধানগাছের আগাগুলি গরুতে খাওয়া । মুনিয়া ভাবল - নিশ্চয় মুংলির কাজ ।

    মুনিয়া দেখেছে বাড়ির আশপাশ দিয়ে বন্দরাখাপরা ঘুরে বেড়ায় লম্বা পাচনি হাতে । পাচনির আগায় লোহার ঝক্ঝকে ফলা ফিকল লাগানো, দেখলে ভয় করে । ঐ ফলার খোঁচা মুংলির গায়ে লাগলে কি মুংলি বাঁচবে !

    এদিকে মুংলি যখনই বুঝতে পারল যে গলায় বাঁধন বেল্ট নেই, তখনই বেরিয়ে পড়ল । চুপি চুপি নামল গিয়ে মাঠে । ধানের কচিপাতা একটা মুখে নিয়ে চিবিয়ে দেখল - বড় মিষ্টি । তারপর খেয়েই চল সারা ক্ষেত ঘুরে বেড়িয়ে । বন্দরাখালের চোখে পড়ল এ দৃশ্য । সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চুকিয়ে দিল বাজারের খোয়াড়ে ।

    মুংলিকে খুঁজতে খুঁজতে মুনিয়া এসে শেষে হাজির হল খোঁয়াড়ের কাছে । দূর থেকেই মুংলির ডাক শুনতে পাচ্ছিল - হেম্বে... হেম্বে.. । মুনিয়া তখন শব্দের পিছু নিয়েই এ পর্যন্ত এসেছে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ।

    খোঁয়াড়ের কাছে কোন লোক নেই । তালা লাগানো দরজা । চাবি কার হাত কে জানে মুনিয়া খোঁয়াড়ের চারিদিকে ঘুরতে লাগলো । কোথাও একটুকু পথ নেই যে ঢুকবে । শেষে বাঁশের বেড়া বেয়ে ঠিক উপর পর্যন্ত উঠে লাফ দিয়ে ভিতরে পড়ে গেল । মুংলিকে জাপটে ধরল গিয়ে ।

    কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল - বেরবে কেমন করে, কেউ যদি না আসে, যদি তালা খুলে না দেয় । ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে উঠল মুনিয়া । ভিতর দিকে বাঁশের ফাড়া দিকটা অমসৃন - ওতে পা দিয়ে ঘষে উঠতে গেলেই পা কেটে যাবে গরু গা চুলকাতে গেলে চামড়া কেটে যেতে পারে । ভীষন বিপদে পড়ে চীত্কার করে কাঁদতে লাগলো মুনিয়া, ও বাবা, বাবাগো, আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও ।

    নাগিনাও খুঁজতে খুঁজতে খোঁয়াড়ের কাছে এসে হাজির । খোঁয়াড়ের মালিকের বাড়ী একটু দূরে । সেখানে গিয়ে মালিককে নিয়ে এল, চাবি খুলে মুংলি ও মুনিয়া দুজনকে বের করে নিয়ে নাগিনা ফিরে চলল ঘরে । সেই দিনের রোজগারটা দিতে হল খোঁয়াড়ের মালিককে ।



    ॥ চোদ্দ ॥


    বর্ষাকাল । মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে । দুদিন মোটে সূর্যের দেখা নেই । খালে নালায় জল ধরেনা । পথে ঘাটেও জল চ্যাপ্‌ চ্যাপ্‌ । খালের জল উজান চলে । আকাশে মেঘ গরজায় থেকে থেকে । পূব থেকে পাহাড়ের জল নামে, পশ্চিম থেকে মেঘনার জল ওঠে ফুলে । সমতল টলমল । গ্রামের বাইরে নাগিনা মুচির বাড়িখানি যেন ভারতবর্ষের দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি ।

    ঘাটে নৌকা নেই নাগিনার । পা থাকলেও হেঁটে চলা যায়না, মাটি কোথায় যে হাঁটবে । জল আর জল শুধু জল - যেদিকে তাকাবে সে দিকেই জল । প্রথমটা আশায় ছিল সবাই - এই জল নেমে যাবে । একদিন গেল, দুদিন গেল, তিনদিন, চার পাঁচ চায়, সাতদিন গেল জল নামেনা ।

    চাষীরা পাটক্ষেতে নামল কাস্তে হাতে । জলে ডুবে ডুবে পাট কাটতে লাগল । মুনিয়া অবাক হয়ে দেখে - কেমন করে ওরা জলের তলায় যায় - অন্ধকারে হাতের কাস্তে চালায়, উপরে ভুর ভুর করে বুদ্বুদ ওঠে আর পাট গাছের মাথাগুলো নড়তে থাকে । দেখে দেখে মুনিয়ার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেন । জলের উপরে থেকে সে ছট্‌ ফট্‌ করতে থাকে - জলের তলার মানুষদের অবস্থা ভেবে ভেবে । হঠাৎ হুঁম করে ভেসে ওঠে এক আঁটি কাটা পাট গাছ কোলে নিয়ে । মুনিয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচে । ডুব দেবার আগে ওরা মনের আনন্দে আবার গানও ধরে,
    অকালে আইলায়রে পানি
    ও পানি সব নিলায় ভাসাইয়া
    .. ইয়া ... ইয়া ... ইয়া ..

    বলতে বলতে হুঁম শব্দে জলের তলায় যায় .. আর গান বন্ধ হয়ে যায় । আবার হুঁপ করে কিছুক্ষণ পর উঠলেই গানের পদ পূরণ হয়,
    পেটে কি মানিবরে পানি
    পাটের শাড়ি পাটয়া
    ... ইয়া .. ইয়া .. ইয়া ...

    মুনিয়া ছুটে যায় ওর মায়ের কাছে । মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে, এটা কি পাটের শাড়ি মা? মা বলে, পাটের শাড়ির অনেক দাম । সে আমরা কোথায় পাব বাবা ।

    মুনিয়ার মা আলতা পরতে বসে । মুনিয়া বলে, আমাকে একটু আলতা দেবে মা মা বলে, তুমি কি মেয়ে যে আলতা পরবে মুনিয়া বলে, আমি পরবনা, মুংলির জন্য
    মা বলে, দাঁড়াও, আগে মিনিটাকে পরিয়ে নিই ।

    মুনিয়া মায়ের হাত থেকে আলতার তুনিটা কেড়ে নিয়ে ছুটে যায় মুংলির কাছে, মুংলির কপালে প্রথমটা আলতার ছোপ লাগিয়ে দিয়ে আর কোথায় কোথায় দিতে হবে ভাবতে থাকে ।

    নাগিনা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছেলের কান্ড দেখছিল । কত অল্পেতে ছেলেটা তুষ্ট থাকে - অথচ এতেও নাগিনার মন কট্‌ কট্‌ করে । কারণ বড় অভাবের দিন পড়েছে, সারাদিন রাত্রি তার ভাবনা হয় কি করে সংসার চালাবে কিন্তু মুনিয়া - তো সে সব কথা মোটে ভাবেনা । যদি দু:খের কথা একটুকুও সে বুঝতো তাহলে কি বাছুরটার কপালে আলতা মাখাতো । নাগিনা ভাবে মুনিয়া বুঝবে দূরে থাক মুনিয়ার মা-ওতো বোঝেনা নাগিনার দু:খ, তাহলে কি বিড়ালটাকে নিয়ে এমন আদর আহ্লাদে মশগুল হয়ে থাকতো ।

    হঠাতি যেন ধ্যান ভাঙল নাগিনার । সম্মুখে রঙ্গিনী স্বয়ং দাঁড়িয়ে । বলছে, চাল এনেছ মুনিয়া কিন্তু এক্ষুনি ভাত খাইতে চাইবে ।

    নাগিনা বলল, এই দ্যাখো, মনেই ছিলনা, আচ্ছা যাচ্ছি - এক্ষুনি চাল এনে দিচ্ছি ।

    কিন্তু মুদিখানায় যাবে কি করে নাগিনা নৌকো নেই যে ! হঠাৎ এমন জল হবে জানলে আগের ভাঙ্গা নৌকোটা সে কখনও বিক্রি করতনা । এখন একটা নৌকো তৈরি করা সহজ নয় । পাঁচ টাকার জিনিস পঁচিশ টাকাও পাওয়া যায় না । বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু কাজ যোগাড় না করতে পারলে - শুধু হাটবার দিনের অপেক্ষা করলে আর দিন চলেনা । এটাতো আর শীত কাল নয় । শীতকাল ছাড়া গ্রামে আর কজনেই বা জুতো পায় দেয় তাছাড়া যারা তা-ও পায়ে দেয়, তাদের জন্য সস্তায় পাওয়া যায় রবারের জুতো । কাজেই এর উপর নির্ভর না করে নাগিনাকে ঘরে ঘরে খোঁজ নিয়ে হয় কেউ খোল ঢোল তবলা সারাবে কিনা । চামড়ার যন্ত্র ছাড়া অনেকে তারের যন্ত্রেও ছাউনি দেয় - এস্রাজ, সারিঙ্গা, সারেঙ্গি, দুতারা, একতারা - কতকিছুই আছে । কিন্তু গ্রামে এখন ও-সব যন্ত্রেরও প্রচলন কমে এসেছে । বাঁধা সুরের হারমোনিয়ম কিনেই অনেকে চালিয়ে দিচ্ছে ।

    মুনিয়ার মা আবার এল । এখনও যাওনি দুপুর হতে আর বাকি কত উননে আগুন জ্বলছে - শুধু শুধু এক হাড়ি জল চাপিয়ে হা করে বসে আছি ।

    নাগিনা বলে, শুধু শুধু জল গরম করে লাকড়ি সব শোধ করা হচ্ছে !
    রঙ্গিনী চটেমটে উত্তর দেয়, নইলে শুকনো হাড়ি ফেটে যাবে যে ।
    আগুনটা নিবিয়ে দিলেই হয় ।

    আগুন নিবিয়ে আবার দেশলাই পাবো কোথায় একটিও কাঠি নেই - গন্ধক সব শেষ হয়ে গেছে ।



    ॥ পনেরো ॥


    নাগিনা গামছা পরল । মাথায় পাগড়ি করে বাঁধল পরণের ছেঁড়া কাপড়টা । ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নামল পথে । পথে মাটি নেই এখন, বর্ষাকালে সকল পথই জলময় । জল কেটে কেটে হেঁটে হেঁটে চলল এবারে বাজারের দিকে ।

    প্রথমে হাঁটুজল ছিল । তারপর কোমর জল । তারপর বুকজল । এখানেই শেষ নয় । শুকনোর সময়েই যে খালটাতে জল থাকে এখন সেটাতে সাঁতার । পথের মাঝেই এই খালের বাঁকটাও পেরতে হয় । নাগিনা খালের গভীর জায়গাটা পার হল সাঁতার কেটে । মাথাটাকে কৌশলে ভাসিয়ে রাখতে হল জলের উপর, তা নাহলে ধুতিটা ভিজে যাবে যে ।

    একখানা নৌকো চোখে পড়ল । নৌকোখানা আলিহুসেন সাহেবের । যদি দয়া করে নেয় একবারটি নাগিনাকে তাহলে অনেক পথ আর জল ভাঙ্গতে হয়না বাজার পর্যন্ত । দেয় না- দেয় একবার চাইতে দোষ কি ! নাগিনা মনে মনে ভাবল - আমাদের তো চিরটা কালই মানুষের কাছে হাতেজাড় করেই দাঁড়াতে হয়, মিনতিতে সবারই মন গলে । মনে ভরসা বেঁধে নিয়ে সাহস করে উঠল গিয়ে আলি হুসেনের উঠনে । বলল, ভাইছাব বাড়ি আছেন <Þ>

    হুঁকো টানতে টানতে বেরিয়ে এল আলিহুসেন । নাগিনাকে দেখতে পেয়েই কোনো কথা নয় বলে আবার ঢুকল গিয়ে ঘরে । মনে মনে গজরাতে লাগল - ব্যাটা মুচির আস্পর্ধা কত, আমার উঠনে উঠে এসে আমাকে ডাকছে - যেন আমি তার ঘরের মানুষ, রেগে গিয়ে ডাকল গম্ভীর গলায় তার ছেলের নাম ধরে, নবীহুসেন ..... নবীহুসেন ..... ।
    তত্ক্ষণাৎ হাজির হয়ে নবী উত্তর দিল, কি জন্য ডাকছ বাপজান ।
    ব্যাটা মুইচ্যা কি চায় দ্যাখতো !

    নবীহুসেন নাগিনাকে এসে জিজ্ঞেস করল । পরে গিয়ে বলল তার বাপজানকে, আমাদের ডিঙ্গিটা নিয়ে বাজারে যেতে চায় ।

    শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল আলিহুসেন, চোখ লাল করে বলল, কি-ই-ই ই ! আমার নৌকোয় পা দেবে ব্যাটা ছেঁড়া মিস্তিরি দূর করে দে ব্যাটাকে ।

    আলিহুসেন সাধারণ চাষী । নিজের জমিজিরাত না থাকলেও নিজের দুটো বলদ রেখে ভাগে জমি চাষ করে অবস্থা ফিরিয়ে নিয়েছে - লোকে বলে । এখন শুধু বলদ নয়, গাই বাছুরও আছে তার নিজের । নৌকোটাও হালেই কিনেছে । তাহলেও কাছে ধারেনা কানাকড়ি । কিন্তু নাগিনা-যে ভাগার থেকে কাঁচা চামড়া যোগাড় করে, বাড়িতে নিয়ে শুকোয় । তারপর চালান দেয় কলকাতায় । কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে বলেই গ্রামের বাইরে নাগিনার বাড়ি । রঙ্গিনী আর মুনিয়া আর মিনি আর মিনি আর ভোলা আর পুনি আর মুংলি ছাড়া গ্রামের সকলেই নাগিনার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে । কিন্তু গরজ বড় বালাই, কারও জুতো ছিঁড়ে গেলে নাগিনার কাছে না এসে উপায় নেই । গ্রামে আর দ্বিতীয় মুচি বাড়ি নেই । কাজের দায়ে না পড়লে নাগিনার ছায়াও কেউ মাড়াতে চায়না, নাগিনাকে পথে চলতেও সবাই দূরে দূরে রাখে - ও যেন একটি জীবিত অশৌচ ।

    আলিহুসেনের কথায় নাগিনা বড় আঘাত পেল মনে । সামলে নিয়ে দুহাত উঁচু করে কপালে ঠেকিয়ে বলল -ভগবান, তুমিই মালিক । ভাইছাবকে দিয়েছ, আমাকে দেবেনা । স্থির করল মনে মনে - একটা নৌকো যে করে হোক কিনতেই হবে ।

    কিনতে হবে অনেক কিছুই । সামনে পুজো - রঙ্গিনীর শাড়ি চাই, মুনিয়ার জামা চাই, কাপড় চাই, তা নাহলে উপায় থাকবেনা যে । টাকা পয়সা ঘরে আছে কি নেই, যুদ্ধের দরুণ জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে কি যাচ্ছেনা, সে সব কোনো কথা কেউ শুনবেনা - সংসারের এই রীতি, যে রোজগার করে তার ঘাড়ে ঝুলছে সব সময় তাগিদের খাড়া, তাগিদ মতো জিনিস না এনে দিলেই বাড়বে অশান্তি ।

    আসলে এ-সব না কিনলেও চলে । যার মোটেই পয়সা নেই সে কিনবেওনা । কিন্তু গরু ঘরে আছে - তার খড় কিনতেই হবে । না হলে গরু বেচতে হবে । নাগিনার বুকের ভিতরটা কিরকম করে উঠে - সত্যিই তো এক গাছা খড় নেই ঘরে, ঘাসও নেই মাঠে, মাঠ এখন জলের তলায়, গরু গুলো খাবে কি মুংলির কথা যেমন তেমন, পুনির পেটে বাচ্চা এখন, প্রতিদিন পেটভরতি খেতে না পেলে দুর্বল হয়ে পড়বে যে । কাজেই সবার আগে কিনতে হবে খড়, খোল, ভূসি । তার আগে যোগাড় করতে হবে টাকা ।

    টাকা যোগাড় করতে হলে চাই দিনরাত খাটা । ঘরে বসে তো খাটতে পারবেনা । সারাগ্রাম টহলিদতে হবে । ছেঁড়া জুতোর কাজ বর্ষাকালে নেই বললেই চলে । হাতে এ সময় থাকে শুধু কাঁচা চামড়া সংগ্রহের কাজ । সকাল বিকেল দুবার গ্রামটা টহল দিতে হবে । দেখতে হবে-ত খুঁজে । কিন্তু পায়ে হেঁটে যাওয়া চলবেনা । সকল পথেই জল । জলে চলতে হলে চাই একটা নৌকো - ডিঙ্গি হোক্‌, কোষা হোক - একটা কিছু চাই ও রকম ।

    মরা গরুর চামড়া সংগ্রহের কাজটাকে গ্রামের সবাই হীন চোখে দেখে । নাগিনার এতে সুবিধেই হয়েছে - এই কাজের কোনো প্রতিদ্বন্দী নেই নাগিনার গ্রামে । গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে, নাগিনা যে উপর দিকে তাকায়, তার মানে ও দেখে নেয়, আকাশে শকুন উড়ছে কিনা । তা থেকে বুঝতে পারে কোনখানে গরু মরেছে ।

    গরু জীবিত থাকলে গৃহস্থের, মরলে নাগিনার, এ কথাটা ওই অঞ্চলে প্রবাদ হয়ে গেছে ।

    নাগিনাকে সবাই মনে মনে ঘৃণা করে, অস্পৃশ্য ভাবে, দূরে রাখে, তবু মজার কথা এই যে গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সকল ছেলে বুড়ো নাগিনা মুচিকে চেনে । চেনার আরও একটা কারণ আছে - গরু মরলে নাগিনার হয়, এই প্রবাদ প্রচলিত থাকলেও অনেক মরনোন্মুখ গরুও নাগিনার হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে ওঠে । নাগিনা গরুর টাটকা চিকিত্সা জানে ।

    কেউ কেউ তবু বলে, গরু মরলেই যে লোকটার লাভ, সে ব্যাটা আবার গরু বাঁচাবে । এ নিতান্ত বাজে কথা । তবু নমস্কার পেলে সবাই খুশি । যে লোকটা নাগিনার নাম শুনতে পারেনা সেও নাগিনাকে করজোড় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে মনে মনে খুশিই হয় । সকল মানুষই-তো সকলের নমস্কার পায়না । এমন লোকও আছে যে কোনো তুচ্ছ মানুষের নমস্কার পায়নি । কিন্তু সেই হতভাগ্যের কাছেও নাগিনা গিয়ে করজোড়ে দাঁড়ায় । নাগিনাকে দেখলেই মনে পড়ে,



    ॥ ষোল ॥


    মুনিয়ার পেটে কিছু পরতেই সে ছুটে এসেছে মুংলির কাছে । রঙ্গিনী বলেছে নাগিনাকে, ডাকের কথায় বসে -
    পেট পেট সকলের মূল
    পেট খায় জাতিকূল,

    যতক্ষণ ভাত না হয়েছে - কি যন্ত্রনাই দিয়েছে তোমার ঐ ছেলে, আর এখন দ্যাখোনা -
    মাঝ ঘর হলে ঠান্ডা
    ঘুচে যায় সকল টান্ডা
    পিঠে সয় চৌদ্দ গন্ডাকীল,
    তা নাহলে এমন হাসি মুখে গিয়ে বসে আবার মুংলির কাছে ।

    মুনিয়া হাতে করে খড় তুলে দিচ্ছে মুংলির মুখে । মুংলি শুধু খড়ের আগাগুলো খায়, শক্ত দিকটা দাঁতে কেটে ফেলে দেয় । মুনিয়া সেগুলি তুলে নিয়ে মুংলির মুখের কাছে ধরে মুংলি মুখটা সরিয়ে নেয় । মুনিয়াও জেদ করে বার বার ধরে মুংলি তাতে রেগে যায় ।

    নাগিনা এসে ঢোকে গোয়ালে । মুনিয়া সরে যায় । নাগিনার গা জ্বলে মুংলির এই ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া দেখে । যতনা খায় নষ্ট করে তার তিনগুন । মুখের কাছ থেকে খড়গুলো কেমনকরে পায়ের তলায় চলে গেল - নাগিনা ভেবে পায়না । দাঁত কটমট করে বলে, বিছানা হয়েছে বুঝি শোয়ার জন্য বলে
    পয়সা দিয়ে চাল মেলেনা
    পসসাদ নিয়ে ঠেলাঠেলি ।

    বড় বড় চোখে মুংলির দিকে তাকিয়ে শাসায়, লক্ষ্মীছাড়া বাছুর, তোমাকে বিদায় করব এবার বাড়ি থেকে !

    কথাটা বলে মনে মনে চমকে উঠল নাগিনা । সত্যিই তো, শাপে বর হবে তাতে । এই আকালের দিনে বাছুরটাকে বিক্রি করে দিলে সেই টাকাতেই একটা নৌকো হয়ে যায় । একটা পেটের খড় কেনার টাকাটাও বাঁচে, সারা বর্ষাকালে একটা বাছুরের পেটে কি কম খড় ঢোকে ! ভেবে সে খুশি হয়ে ওঠে । ছুটে যায় রান্নাঘরে । মুনিয়ার মাকে বলবে নাকি কথাটা ।

    না বলেই ফিরে এল আবার । মাকে বললেই ছেলে শুনতে পাবে - তাহলে বাছুর বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে দেবে সে কাউকে বাছুরটা যে মুনিয়ার মনের পরতে পরতে গাঁথা ।

    খুশির খবরটা একলা নিজের বুকে চেপে রেখে সারারাত ঘুমোতে পারলনা নাগিনা । কতক্ষণে ওই অলক্ষ্মী বাছুরটাকে ঘর থেকে বের করবে আর বদলে সুন্দর একটি নৌকো কিনে এনে ঘাটে বাঁধবে, আর দেখাবে আলি হুসেন মিঞাকে - যে নাগিনা যত তুচ্ছই হোক, তারও মনে কষ্ট আছে, আর সে কষ্ট সে দূর করতেও জানে ।

    চোখে তন্দ্রা এলেই নাগিনা দেখতে পায় বাছুরটাকে নিয়ে যাচ্ছে কিনে এক গরু পাইকের - আর একটা সুন্দর নৌকো এসে লাগছে তার নিজের বাড়ির ঘাটে, নৌকোটা আর কারও নয় নাগিনা মুচির ।

    পরের দিনই খদ্দের এল, পাইকের আমির বক্স । নাগিনা একখানা জলচৌকি এগিয়ে দিল বসতে । মুনিয়া ছুটে এল কাছে । বাবার কাছে ঘেঁষে কানে কানে শুধালো, কে বাবা ।
    নাগিনা বলল, তোমার বড় চাচা, ছেলাম জানাও ওকে ।
    মুনিয়া দুই হাত জোড় করে নমস্কার করল ।

    পাইকের আমির বক্স নিজের মেহেন্দি-মাখা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, বিসমাল্লা, খুদা তোমার ভার বরজায় রাখুন ।

    নাগিনা বলে মুনিয়াকে, চাচা ছায়েবের জন্য একটু তামাক আনতো বাবা ।

    মুনিয়া ঘরে যায় তামাক সেজে আনতে । খালি হুঁকো কলকে নিয়ে ফিরে এসে বলে, তামাক-তো ফুরিয়ে গেছে বাবা !

    তাই না-কি নাগিনা ছুটে যায় ঘরে । গিয়ে এটা খোঁজে ওটা খোঁজে, কোথাও এক ছিলিম তামাক নেই । লজ্জিত হয়ে আমির বকশের কাছে হাত জোড় করে বলে, বড় ভাইছাব, একটু যদি বসেন, ছেলেটাকে বাজারে পাঠাই, একটু তামাক নিয়ে আসুক ।
    মুনিয়া বলে, বাজারে যে যাবো নৌকো কোথায় ।

    নাগিনা বলে, এই যে তোমার চাচা ছায়েবের নৌকোটাই নিয়ে যাওনা । দেরি করোনা । তামাক নিয়ে এলে পর তবে-ত যাবেন ফিরে ।

    নৌকো দেখে মুনিয়ার মনে খুশি আর ধরেনা । নাচতে নাচতে গিয়ে সে চড়ল নৌকোয় । লগিটা হাতে নিয়ে বলল, এটা বড় ভারী যে বাবা !

    নাগিনা একটা হালকা ট্যাংরা লগি খুঁজে নিয়ে এসে দিল মুনিয়ার হাতে । মুনিয়া নৌকো বাইতে শুরু করল ।

    নাগিনা বলল, দাঁড়াও বাবা, তামাক-যে আনবে তার পয়সা নিয়ে যাও ।

    আমির বক্স তাকিয়ে দেখছে অবাক হয়ে । বলল, এত ছোট ছেলে তোর নৌকো বাইতে শিখল কি করে রে নাগিনা !

    নাগিনা বলল, জলের উপর জন্ম, আর নৌকো বাইতে জানবেনা । আমার ঘাটে গেল বছরেও ছিল ডিঙ্গি । তখন-তো বয়স ওর এক বছর কম ছিল । তাতেই সারাদিন ডিঙ্গিটা নিয়ে থাকত । আমাদের বুক ধুক ধুক করত কখন জলে পড়ে যায়, কখন জলে পড়ে যায় ।

    আমির বক্স বলে, জলের উপর যারা থাকে তারা জলে ডোবেনা, ডাঙ্গায় যারা থাকে তাদেরই কুমীরের ভয় বেশি ।
    নাগিনাও সায় দিয়ে বলে, ঠিক বলেছ বড়ভাই ।

    মুনিয়ার কাপড়ের কোনায় নাগিনা নিজের হাতে পয়সাটা বেঁধে দিয়ে বলল, সাবধানে চালিও ডিঙ্গি । যেতে যেতে এদিক ওদিক তাকিয়োনা যেন, তাহলে পড়ে যাবে ঝুপ করে ।
    মুনিয়া হেসে বলল, আমি খুব ভাল বাইতে পারি ।

    আমির বক্স অধীর হয়ে ওঠে । বলে নাগিনাকে, ছেড়েদে ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফিরে আসুক, আর কথা বাড়াসনে ।

    মুনিয়া ডিঙ্গি নিয়ে চলে গেল বাজারের দিকে । একটু দূর গিয়েই একটা গান ধরলো -
    নাও দৌড়াইরে হেলেঞ্চার খালে
    পাগলা কুত্তা কামড় দিল বুইড়া ব্যাটার গালে
    ওরে হে - হেইও ........

    বলে মুনিয়া লগি দিয়েই বৈঠার মতো করে জোরে একটা টান দিল জলে । একরাশ জল উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ল কদম ফুলের পাপড়ির মতো । নাগিনা সে দিকে তাকিয়ে রইল ।

    আমির বক্স ধমক দিয়েই বলল, ওদিকে তাকিয়ে দেখছিস কি, কথা বল এখন, কাজের কথা সেরে ফেল । বল্‌, তোর বকনের দাম কত নিবি ।

    দুহাত কচলে কাঁচুমাচু হয়ে নাগিনা বলে, আমি আর কি বলব ভাইছাব, আমি-তো জ্যান্ত গরুর দাম জানিনে, মড়ার খবর রাখি শুধু । আপনিই বলুন, আমার বাছুরটার জন্য কত দেবেন ।
    কত বয়স হয়েছে বাছুরের ?
    তা গত অঘ্রাণে ওর জন্ম, এটা ভাদ্র মাস ।

    একেবারে গেদা বাচ্চা-রে । বুঝতে পারছিসতো, এদিয়ে হাল দল বাওয়া চলবেনা - যে জন্য নেওয়া .....

    কথা শেষ না হতেই বাধা দিয়ে নাগিনা বলে, আমি কি বলব ভাইছাব, বাছুরটা আগে দেখুন, নিয়ে আসছি আপনার কাছে ।
    আরে থাক্‌, থাক্‌ - তোর বাছুর না দেখে কি আমি এসেছি ।

    নাগিনা হাত নেড়ে চেড়ে বলে, কি আর বলব ভাইছব, বাছুর আমার পরিবারের জানপরান, আমার ছেলের কইলজা - তাজি ঘোড়ার বাচ্চার মতো দেখতে । মানুষের বুকের দুধ আছে ওই বাছুরের মুখে ।

    নে, নে, আর বক্তিতা করতে হবেনা । সব বুঝেছি, ঠিক ঠিক বল, কতয় তুই ছাড়বি ।

    আপনিই বলে কয়ে নিয়ে যান । গরীব মানুষকে মারবেন না একেবারে ।

    পাইকার আমির বক্স দশবছর বয়স থেকে গরুর ব্যবসা শুরু করেছে এখন বয়স চল্লিশের উপর । সে বিক্রেতার মন বুঝে চট করে । বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করেনা । কোমর থেকে টাকার গেজেটা চটপট বের করে তা থেকে বের করল এক গোছা কড়কড়ে নোট - একেবারে ফ্রেশ - নাড়তে চাড়তে শব্দ হচ্ছে খস্‌ খস্‌ । দুখানি দশটাকার ও একখানি পাঁচ টাকার নোট আলাদা করে নিয়ে দিল সে নাগিনার হাতে । বলল, ধর টাকাটা - কিছু বেশিই তোকে দিলাম, কাউকে বলিসনে যেন, খবরদার !

    নাগিনার মনে ছিল দশমাসের বকন বাছুরের দাম খুব বেশি যদিও পায় দশটাকা পাবে, কিন্তু পাইকার নিজে থেকেই যে পঁচিশ টাকা দিল, তাহলে সে কি ভুল করল কেন চাইলাম না আরও বেশি যদি চল্লিশ টাকা ছৈঅত তাহলে খড়, নৌকো, পুজোর কাপড় সব কি তা থেকে হয়ে যেতোনা মুহূর্তে কত কথাই তড়িতের মতো ঝলকানি দিয়ে গেল নাগিনার মাথায় । বলল পাইকেরকে,
    কি বলছেন ভাইছাব ......

    কথা শেষ না হতেই পাইকের নাগিনার হাত চেপে ধরে বলল, ভাবছিস্‌ তোকে ঠকিয়েছি, তোকে ঠকিয়ে আমি কি দোজকে যাবো । দশ মাসের বাছুরটা এর চাইতে বেশি দামে কেনে চান্দের তলে দ্বিতীয় আমির বক্স নেই !

    নাগিনা বলে, কি যে বলেন ভাইছাব, আপনাদের নুরুদ্দিন-তো দুকুড়ির কথা বলেছিল, তাতে দিইনি তখন । বাজারটা দেখছেন-তো শুধু গরুর দামই বেশি নয়, খড়, ভুষির দামও বেড়েছে সমান ভাবেই, চালতো পাওয়াই যায় না - কোথা ছিল ৫ টাকা মণ, হয়েছে ৫০ টাকা ।

    চোখ বড় বড় করে আমির বক্স বলে নুরুদ্দিনের জন্ম আমি দেখেছি, সে দেবে আমার চাইতে বেশি দাম । কদিন ধরে গরুর ব্যবসা করে সে ।

    নাগিনা বলে, কারও দোষ আমি দিইনা । বলি, বাজারটা দেখুন, আমাকে তো আপনারা দশজনে মিলেই বাঁচিয়ে রাখবেন, তা নাহলে আগামী শীতে জুতো সারাবেন কার কাছে পাঁচ আনার গামছার দাম পাঁচ সিকে, তিন আনা সের তামাক হয়েছে তিনটাকা !

    আমির বক্স বলে, সে জন্যেইতো তোরও কপাল খুলেছে, পাঁচ টাকা যে বাছুরের জন্যে পেতে, এখন তার জন্য পাচ্ছিস পঁচিশ টাকা । যুদ্ধ লেগেছে না কপাল খুলেছে তোদের ।

    নাগিনা বলে, আপনারা তালুকদার মুলুকদার মানুষ । আমি ছেঁড়া জুতোর মুচি । জুতোর তালিতে আগে পেতাম এক পয়সা এখন পাই দুপয়সা । খুচরো না থাকলে তবেই কেউ কেউ আনিটা ফেলে দিয়ে যায়, তেমনি দুবার মেরামতও করায় ।

    আমির বক্স বিরক্ত হয়ে বলে, তুই বেশি বকর্‌ বকর্‌ করিস নাগিনা । এই নে দুকুড়িই না হয় দিচ্ছি, কিন্তু খবরদার, কাউকে যেন বলবিনা কত দিলাম । চুপি চুপি ঘরে নিয়ে যা টাকাটা । চড়া সুদে লগ্নী কর । এই সময়টা অনেকেই ধানের উপর টাকা নিতে চায় ।

    নাগিনা তবু মাথা চুলকাচ্ছে । আমির বক্স আরেকটা দুটাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে পড়ল । বলল, তোর সঙ্গে আর কথা বলব না, ব্যাটা হাজাম কোথাকার ।

    নাগিনার মনে হল ওর বকনের দাম বিয়াল্লিশ টাকার চাইতেও বেশি হতে পারত । মনটা ভীষণ মোচড় দিল । সত্যিই-তো মুনিয়ার ভালোবাসার এই জিনিসের এত কম দাম কি করে হয় । তা ছাড়া ভালোবাসা কি টাকায় কিনতে পাওয়া যায় । মুংলি একবার গেলে-তো আর আসবেনা । তাহলে এখন করবে কি মুংলিকে বেচবেনা না মুংলি ঘরেই থাক । টাকা সে ফিরিয়েই দেবে আমির বক্সকে ।

    হাত কাঁপতে লাগলো নাগিনার । তবু কারেসি নোট কখানি দুহাতে ধরে আমির বক্সের পায়ের কাছে রেখে বলল, বাছুর আমি বেচবনা ভাইছাব ।

    রেগে আগুন আমির বক্স বলে, ব্যাটা জাত চামার, জবানের ঠিক নেই তোর । তুই কেবল ঘাতিয়ে ঘাতিয়ে টাকা বের করছিস । আর একটা পয়সাও ছোয়াবোনা তোকে, বাছুর আমি ঠিক-ই নিয়ে যাবো, তোর কোন চাচা আটকে রাখে দেখবো ।

    নাগিনা তবু ইতস্তত: করছে দেখে আমির বক্স বলল, আমি মুসলমানের চাচা, আমার শরীরে নবাব বাদশার রক্ত, তোকে সিধে করতে আমার একটুও বেগ পেতে হবেনা ।

    বলতে বলতে আমির বক্স উঠে পড়ল, একেবারে নৌকো ঘাটায় গিয়ে থামল । থামতেহল, কারণ ডিঙ্গি নিয়ে ফিরে আসেনি বাজার থেকে মুনিয়া এখনো তামাক নিয়ে ।

    মুনিয়ার মা বেরিয়ে এল আমির বক্সের তর্জন-গর্জন শুনে । কিন্তু নাগিনা যে একা দাঁড়িয়ে নেই, একটা লোকের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তো সে যেতে পারেনা ।

    মুনিয়া এসে পড়েছে । টাকাগুলো নাগিনা এতক্ষণ হাতে নিয়েই দাঁড়িয়েছিল, এবার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে কোমরে গুঁজে ফেলল । আর কোনো কথা বলতে পারলনা - পাছে মুনিয়ার কানে যায় ।

    তামাকের পুঁটলি নাগিনার হাতে দিয়ে মুনিয়া আবার নৌকোতে গিয়ে ওঠে । নাগিনা ডাকল, চলে আয় বাপ, তোর চাচাছাব এখনই চলে যাবেন ।
    কেন তামাক খেয়ে যাবেননা ?

    না-রে তামাক আর এখন খাবোনা । বড় দেরি হয়ে গেছে । আরেক দিন আসব । আগে থেকে তামাক সেজে রাখিস্‌ ।

    আমির বক্সের এই কথাগুলি শুনে নাগিনা ভাবল - তাহলে আর আমার উপর রাগ নেই পাইকেরের । গরীব মানুষকে তা নাহলে কোন্‌ ভাবে জব্দ করে কে জানে !
    মুনিয়া বলে, আমিও যাবো চাচার সাথে ।

    চাচা বলে, কাজ কর্ম শিখে নে । বড় হয়ে ছেঁড়া জুতো নিয়ে আসবে আমাদের বাড়ি গিয়ে ।

    মুনিয়া বলে আমি জুতোর কাজ করবইনা । ইস্কুলে পড়ব এরোপ্লেন চড়ে বোম্বাই যাবো ।



    ॥ সতেরো ॥


    নাগিনার হাতে টাকা এসেছে । নৌকোর জন্য মুনিয়া অস্থির হয়ে উঠল । দুধের সাধ ঘোলে মেটাবে বলে তিনটে কলা গাছ দিয়ে একটা ভেলা তৈরী করে দিয়েছে নাগিনা এর মধ্যেই । মুনিয়া ওই ভেলায় চড়ে সারাদিন লগি ঠেলে । কিন্তু ভেলাতো নৌকোর মতো জোরে চলেনা, জলের উপর দিয়ে কোনোরকমে চলে এই মাত্র । ভেলায় না গিয়ে সাঁতারে গেলেও অনেক তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় । মুনিয়া ভেলা ঠেলে আর সারাদিন নৌকোর জন্যে মা-বাপের কাছে বায়না করে ।

    নাগিনা অনেক ভেবে চিন্তে নৌকোটাই আগে কিনবে ঠিক করলো । নৌকো কি আর - ছোট্ট একখানা ডিঙ্গি যত কম টাকায় হয় তাই দেখে নিয়ে কিনে ফেলল একটি দিন সাতেকের মধ্যেই । ঘাটে এসে লাগতেই মুনিয়া নাচতে নাচতে উঠল গিয়ে ডিঙ্গিতে । একটা সুন্দর গন্ধ পেলো ডিঙ্গিতে পা দিয়েই, মুনিয়া বার বার নাক টানতে লাগল । পাশে কোথাও ফুল ফুটে নাই তবে এই গন্ধ ! ডিঙ্গির তলিতে উপুড় হয়ে পড়ে নাকটা কাঠের মধ্যে লাগিয়ে গন্ধ টানে মুনিয়া - হ্যাঁ কাঠেরই গন্ধ । বাবাকে গিয়ে শুধায়, এমন গন্ধওয়ালা কাঠ কোথায় পাওয়া যায় বাবা ? নাগিনা বলে, অনেক দূরে, সমুদ্রের ধারে সুন্দর বনে । মুনিয়া বলে, আমাকে একদিন সুন্দরবনে নিয়ে যাবে বাবা ?
    নাগিনা বলে এবার খুশি হলে তো !
    মুনিয়া বলে, আমাকে একটা বৈঠা কিনে দিও বাবা ।

    গ্রামেই কাঠমিস্ত্রির বাড়ি । নাগিনা একটু বেশি দাম দিয়েই একটা বৈঠা কিনে নিয়ে এল । মুনিয়ার ফাইফরমাশ একে একে আদায় করে এ-সময়টা ওকে একটু ভুলিয়ে না রাখলে চলবেনা ।

    বৈঠা হাতে পেয়ে মুনিয়া বার বার ওটাকে দেখল । কোথায় কাঠের একটু ধার রয়েছে -সেটা দা দিয়ে চাঁচতে থাকল বার বার । দা ফেলে রেখে বৈঠা হাতে নৌকোয় গিয়ে উঠল । জল সরিয়ে সরিয়ে দেখল বৈঠাটা ভালো কি মন্দ !

    কাজের ঘরে থেকে উত্কন্ঠা নিয়ে নাগিনা তাকায়- কখন এসে হাজির হয় আমির বক্স পাইকের । তার আগেই মুনিয়াকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য কোথাও সরিয়ে দিতে হবে ।

    এত উত্কন্ঠার মধ্যেও পাইকের আমির বক্স এলনা । নাগিনার মনে একটা দুশ্চিন্তা রয়ে গেল । পাইকেরকে-তো বলা হয়নি, ও যদি মুনিয়ার সামনেই হঠাৎ বাছুর নিয়ে যাবার কথাটা তোলে !

    মুনিয়াকে কি অছিলায় কোথায় পাঠাবে, সে কথা ভাবতে লাগল শুয়ে শুয়ে নাগিনা । ভেবে ভেবে সারারাতই তার ঘুম এলনা । সে যেন ক্ষণে ক্ষণে শুনতে পাচ্ছে কার একটা নৌকো এসে ঘাটে লাগল । চটপট বিছানা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় নৌকো ঘাটায় । বহুদূর অবধি দেখা যায় জলের উপরকার আকাশ, তারাগুলি কাঁপছে -নাগিনার ভিতরটাও কাঁপছে, রাত্রিবেলার নি:সঙ্গ বাতাসের মতো চুপি চুপি ।

    রাত পোহাবার অনেক আগেই মোরগ ডাকল । মুনিয়া ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠল । কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে । বৈঠাটা হাতে নিয়ে চড়ল গিয়ে নৌকোয় বাঁধন খুলে বাইতে শুরু করল ।

    একটা তারা শুশু পূবের আকাশে । তারাটা নিস্তেজ হয়ে আসছে । লালচে আলোর আকাশ দুলছে জলে । পূবাল হাওয়া বইছে । শীত শীত করছে তবু হাওয়া ঠেলে ঠেলে উজান বেয়ে ডিঙ্গি নিয়ে চলছে মুনিয়া । নৌকোর পেটে জল চড়্‌ ... চড়্‌ ... পড়্‌ .. পড়্‌ শব্দ থেকে থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে ।

    আনন্দে মেতে উঠছে মুনিয়ার মন । বাতাসে ভেসে আসছে একটা গানের সুর -

    সুবলে ডাকিয়া বলে হারাইলাম বাছুর .. উর .. উর .. উর . একটা শব্দই কানে লেগে রইল মুনিয়ার- বাছুর ... শেষের লম্বা টানটুকুতে বাছুর কথাটা সারা আকাশে বাতাসে বিশ্বব্রহ্মান্ডে যেন ছড়িয়ে পড়ল । গানটার আগে কি ছিল, পরে কি আছে- কিছুই শোনবার আর কৌতূহল রইলনা । তার সারাটা মনোযোগ এক নিবিষ্ট হয়ে গেল বাছুর এর মধ্যে । মনের চোখে স্পষ্ট হতে থাকল মুংলির চেহারা । মনে পড়ল এতক্ষণে এই কদিন সে একবারও মুংলি বাছুরটার খোঁজ করেনি ।

    তখনই নৌকো বাড়িমুখো করতে যাচ্ছিল । হঠাৎ একটা কালো মতো কি দেখা দিল দূরে - মনোযোগটা ক্ষণিকের জন্য ওদিকে আকৃষ্ট হল মুনিয়ার । জলের উপর মাথা জাগিয়ে একটা অদ্ভুত কি যেন ভাসছে । যন্ত্রচালিতের মতো নৌকোটা ওই অদ্ভুত জিনিসটার দিকেই এগিয়ে নিয়ে চলল সে ।

    ঘুম থেকে উঠেই নাগিনা গেল গোয়ালঘরে । পুনি আর মুংলিকে বের করে এনে উঠোনের কোনে বাঁধল দুটো খোঁটায় । দুজনকেই খাবার দিল । বার বার মুংলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল নাগিনা । হাতের ছোঁওয়া পেয়ে মুংলি খাওয়া ভুলে নাগিনার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন বাছুরটা অবাক হয়েছে কি কারণে !

    এত আদর নাগিনা মুংলিকে অনেকদিন করেনি । এত বেশি খাবার একসঙ্গে কখনও মুংলির জন্য দেয়নি সে । খড় বিচালি ভূষি -একে একে আসছে । কোন না কোন ডাঙ্গা জমি থেকে কিছুটা সবুজ ঘাসও সংগ্রহ করে এনেছে নাগিনা আজ মুংলির জন্য । মুংলি তার চারপাশে এত খাবারের ঘটা দেখে অবাকই হচ্ছে, সে মানুষের মতো কথা বলতে পারলে নাগিনাকে ঠিক জিজ্ঞেস করতো- আজ কি আমার জন্মদিন- অথবা বিদায়োত্সব ।

    মুংলির সামনে খাবার স্তূপাকার- কিন্তু মুংলি কিছুই খায়না, মুংলিকে নাগিনা বার বার আদর করছে- কিন্তু মুংলি সে যেন সহজ মনে নিতে পারছে না । খুশির কোনো চাঞ্চল্য দেখা দিচ্ছেনা খুশির কারন ঘটানোর পরও ।

    মুংলির মা পুনি-তো পাশেই । সে এক দফা শেষ করে নিয়ে জিভ বাড়িয়ে দিচ্ছে মুংলির খাবারের দিকে । নাগিনা পুনির মুখে একটা থাবড়া দিয়ে বললো- এত খেয়েও আবার ও-দিকে লোভ যাচ্ছে তুই-তো এখনও অনেক দিন খেতে পাবি আমার হাত থেকে, কিন্তু তোর মেয়ে মুংলি - বলেই সে চারিদিকে তাকাল, ভাবখানা কেউ শুনে ফেলেনি-তো !

    পুনি তাকিয়ে রইল নাগিনার দিকে এক দৃষ্টিতে । যেন নাগিনার না-বলা কথাটা পুনির কানে ঢুকেছে । পুনির চোখ হঠাতি ছলছলিয়ে উঠল ।

    নাগিনার চোখ থেকে টস্‌ টস্‌ করে জল পড়ছিল । এমন সময় মুনিয়ার মা এসে হাজির । নাগিনা চটপট উঠে গিয়ে ঘরে ঢুকল ।



    ॥ আঠারো ॥


    মুনিয়ার মা এসে দাঁড়াল মুংলির সামনে । এত রাশি রাশি খাবার । মুংলি খায়না কেন ? কেন তাকিয়ে আছে বিষন্ন মুখে উদাস দৃষ্টি দিয়ে মুনিয়ার মায়ের দিকে ! মুনিয়াকে খুঁজছে নাকি মনে মনে !
    মুনিয়ার মা ডাকতে লাগল, মুনিয়ারে, মুনিয়া ও মুনিয়া ।

    নাগিনা বলল, কেন কেবল সারাদিন ওকে ডাকো, ও গিয়েছে নৌকোটা নিয়ে একটু আনন্দ করতে, এ সময় ঘর থেকে ডাকলে ওর অমঙ্গল হবে ।

    মুনিয়ার মা নিরস্ত হয়ে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে । ঘাটের দিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নৌকোটা ঘাটে নেই । মনে একটা দুশ্চিন্তা ঢোকে । কখন ছেলেটা যে গেল নৌকো নিয়ে -যদি জলে পড়ে যায় !

    চারিদিক থেকে ঢেউ এসে আছাড় খাচ্ছে নাগিনার ভিটেয় । বাতাসটা হঠাৎ বেড়ে উঠল । ফুলের মতো ছিটকে পড়ছে এক একটা ঢেউ । দেখতে ভালো লাগে তারই যার ছেলে রয়েছে এখন ঘরে । মুনিয়া এখন ঘরে নেই জলের উপরে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করছে । ছেলেটা এই ঢেউয়ের তলায় চাপা পড়েনি-তো ! যদি চাপা না পড়ল, তবে ফিরে এলনা কেন বুকটা তার ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করছে । নাগিনার মানা ভুলে গিয়ে হঠাৎ আবার ছেলের নাম ধরে ডাকতে থাকল মুনিয়ারে .... মুনিয়া .... ওমুনিয়া .....

    মায়ের কন্ঠস্বর জলের ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে আঘাত করল আবার মার্য়েংই কানে, মুনিয়ারে .... মুনিয়া .... ওমুনিয়া ...

    দূরে দৃষ্টি দিয়ে আশা ধরে বসে রইল সে নৌকো ঘাটায় - হিজল গাছের গোড়াটা আঁকড়ে ধরে ।

    নাগিনা এসে জোর করে নিয়ে গেল ঘরের ভিতরে । বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল । কিছুক্ষণ আছাড় বিছাড় খেয়ে খেয়ে সে অচেতন হয়ে পড়ে রইল ।

    কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই নাগিনা ছুটে এল ঘাটের দিকে । মুনিয়ার আশা করে আসেনি । পাইকের আমির বক্স এসেছে - বাছুরটাকে নিয়ে যাবে । নাগিনার মনটা ভয়ে কাঁপছিল, এখন যদি মুনিয়াও এসে পড়ে, তাহলে খুবই মুশকিল হবে । আবার ভাবল জীবনের মতো বিদেয় হয়ে যাবে মুংলি, আর-তো দেখা হবেনা মুনিয়ার সঙ্গে, যদি একটি বার দেখতে পেত মুনিয়া ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাগিনা ভাবছিল নানা কথা । উভয় সঙ্কট কথাটা যে কি করে সৃষ্টি হয়েছিল, নাগিনার এ-অবস্থা দেখেই নাগিনা অনুমান করেছে ।

    আমির বক্স নৌকো থেকে নামলনা । বলল, শিগগির নিয়ে আয় আমার বাছুর । নৌকোয় তুলে বেঁধেদে । বেলা হয়ে যাচ্ছে । দুপুরের আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে । নিয়ে আয়, শিগগির যা, মোটে দেরি করিসনে ।

    নাগিনা বলল, সে নিও তামাক খেলেনা, আজকেও তামাক না খেয়ে চলে যাবেন । আর-তো শিগগির আসছেননা গরীবের দরজায়, তা একটু দয়া করেন না কেন ।

    আমির বক্স বলল, এখন বেশি কথা বলার সময় নয়, বলছি তোকে বেলা উঠেছে সূর্য্য ঠাকুরতো আমার হুকুমের চাকর নয় ।

    নাগিনা এবার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ছেলেটা বাড়িতে নেই, বাছুরটা ওর জান প্রাণ, যাবার আগে একবার ও দেখতে পেলনা ।

    পাইকের বলল, তুই-তো আচ্ছা বেসামাল বোকারে নাগিনা । এই সেদিন বললি, ছেলে কাছে থাকলে বাছুর নিতে দেবেনা, আজ আবার বলছিস, যাবার সময় যদি ছেলেটা একবার দেখতে পেত । মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর মায়া আর বাড়াসনে । বাছুরের বাঁধন ছেড়ে নিয়ে আয় - ওকে ছেড়ে দে, তাহলে তুই নিজেও ছাড়া পাবি । সংসারে সবই ভেলকি । যত আঁকড়ে থাকবে ততই ভেলকি বাড়বে । জোর করে না ছাড়ালে দু:খ বাড়তেই থাকবে ।

    নাগিনা এবার ছুটেই গেল মুংলির কাছে । চটপট দাড়িটা খুলে বাছুরটাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে এল নৌকোঘাটায় । বাছুর কেবলি পিছু হটছিল আর পুনির কাছে যেতে চাইছিল, কিন্তু আর সময় নষ্ট করার সময় নেই । মুনিয়া এসে পড়লে সত্যি বিপদ, সকল পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যাবে, পাইকেরের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে সেতো আর ফেরত দিতে পারবেনা, কাজেই মুংলিকে দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি !

    পুনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুংলির দিকে, জোরে হাম্বা করে ডাকলনা, পেট খালি করে অস্ফুট স্বরে হেকরাতে থাকলো - ফিস্‌ ফিস্‌ করে ... বলার মতো । পুনি পারে-তো মুংলির সাথে চলে যায়, কিন্তু গলায় তার এখনও দড়িটা বাঁধা যে ।

    নৌকো দেখে ভয় পেয়েছে বুঝি মুংলি । কিছুতেই নৌকোয় চড়তে চাইছেনা । নাগিনা ঠেলে ঠুলে নিয়ে যায় মুংলিকে নৌকোর কাছ অবধি আর মুংলি পালিয়ে আসে ।

    পাইকের বিরক্ত হয়ে শেষে এল নৌকো থেকে ডাঙ্গায় । বাছুরটার গলায় খপ্‌ করে নিজের গলার গামছাটা দিয়ে কি রকম লাগিয়ে টেনে নিয়ে তুলল নৌকোয় - সঙ্গে সঙ্গে পাল তুলে দিল । তীরের বেগে নৌকো ছুটে চলল ।

    নাগিনা হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, একটু দাঁড়াও ভাই, পথে মুংলি খাবে, চারটে খড় দিয়ে দিচ্ছি । নাগিনা খড় হাতে নিয়ে জলে নামল, কিছুক্ষণ হেঁটেও এল যে পর্যন্ত না কাপড় ভিজে যায়, কিন্তু পালের নৌকো রাখবার শক্তি আমির বক্সের নেই -তা ছাড়া সে যখন মুংলিকে নৌকোর ডরার সঙ্গে আস্টে পৃষ্টে বাঁধার কাজে ব্যস্ত । তা নাহলে বাছুরটা ভয় পেয়ে হঠাৎ যদি জলে লাফ মেরে পড়ে, তাহলে বাছুঅরও মরবে, নৌকোটারও দুর্গতি হবে ।

    নাগিনার অনুশোচনা হল - কেন একটু আগে সে খড় গুলো দিলনা নৌকোয় তুলে - মুংলির পথের খোরাক । আবার নিজেকে সান্তনাও দিল - খড় দিলেই কি মুংলি তা খেতো, মন পড়ে আছে বেচারীর মায়ের কাছে । বোবা পশু হলেও সে কি বাজেনা যে তাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য লোক অন্য কোনখানে !

    যদি পথে দেখা হয়ে যায় মুনিয়ার সঙ্গে তাহলে তো ভালোই, মুনিয়া দেখে নিতে পারবে বাছুরটাকে জীবনের মতো শেষ দেখা ।

    মুনিয়ার ভাই নেই, বোন নেই সাথী সঙ্গী বলতে একমাত্র ছিল ঐ বাছুর - মুংলি । ওকে পেয়ে মুনিয়া কি খুশিই হয়েছিল । বাড়ি ফিরে এসে যখন দেখবে গোয়াল খালি মুংলি নেই, তখন সে পাগল হয়ে যাবেনা তো কাজটা কি ভালো হল ! পুনির মেয়েকে সে দূর করে দিল এত সহজে, পুনি একটাও কথা না বলে নীরবে সব সহ্য করল, কিন্তু নাগিনার ছেলে মুনিয়াকে যদি কেউ এমন করে কেড়ে নিতে চায় তাহলে নাগিনার মাথার ভিতর থেকে খানিকটা গরম বাতাস বেরিয়ে গেল যেন ব্রহ্মতালু ভেদ করে । বুকের ভিতরেও একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা আরম্ভ হল । কি করবে সে এখন জলে ঝাঁপ দিলে কি এই জ্বালা দূর হবে ! ধীরে ধীরে মনকে শান্ত করবার চেষ্টা করল - অন্য লোকে যদি ঠিক এমনি সমস্যায় পড়ে তাহলে তারা কি করে বেঁচে থাকে আরকি কেউ গরু বাছুর .... বিক্রি করেনা !

    জলে ঢেউ উঠেছে । বহুদূর থেকে আসছে ঢেউ । এখান থেকে তিন মাইল গেলে তবে আবার মাটি, আবার গ্রাম, গাছগাছালি । মাঝখানটা সবটাই জল সাদা জল । যখন বাতাস থাকেনা, তখন ধানের আগা-ডগা ভেসে থাকে -দেখায় সবুজ শাড়ির মতো । বাতাস বইতে শুরু করলে মনে হয় সেই শাড়িটি কাঁপছে । জোরে বাতাস বইল কি শাড়ি লেপটে গেল জলে - মনে হয়, যে শাড়ি পড়েছিল, সে সাঁতার কাটছে জলে । সাঁতার কাটতে কাটতে শ্রান্ত হয়ে কখন ডুবেই গেছে । শুরু হয়েছে জলের প্রলয় নাচন । শুধু জল আর ঢেউ, আর ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ । বিরাট বিরাট দুধ রাজ সাপের ফোনা যেন আছড়াচ্ছে নাগিনার বাস্তু ভিটেয় । মুনিয়া কি এই ঢেউয়ের উপরে দোল খাচ্ছে নূতন ডিঙ্গিতে বসে ।

    মুংলির নৌকো চোখের আড়াল হয়ে গেছে । কাছ থেকে দূরে যেতে যেতে ছোট হতে হতে একটি কালো বিন্দুর আকারে মিলিয়ে গিয়েছে দিগন্তে । তবু নাগিনা নৌকো ঘাটায় দাঁড়িয়ে । দেখছে মুনিয়া আসছে কিনা, ভয়ে সে কাঁপছে । পুনির মেয়েকে সে সরিয়ে দিল, এখন যদি তার ছেলেকে কেউ তেমনি সরিয়ে নেয় ।

    ছুতে গেল সে মুনিয়ার মায়ের কাছে । রান্নাঘরের আশেপাশেই তাকে পাবে ভেবেছিল, কিন্তু পেলনা । ডাকল, গেলে কোথায় ওগো একটা কথা শোনো, এসো একবার এদিকে ... ওগো ।

    মুনিয়ার মা অচেতন হয়েই পড়ে আছে । সাত সকালে নৌকো নেই ঘাটে-তো ছেলেও নেই । ছেলেই যে নৌকো নিয়ে গেল, সে-তো অনুমান, নিজের চোখে-তো দেখেনি । রঙ্গিনীর ধারনা মুনিয়া জলে ডুবে মরেছে, তা নাহলে একটা দুপুর ছেলে ফিরে আসছেনা । জলে ডুবলে খুঁজবে কোথায় - পুকুর নয়, নালা নয় । এখন-তো এই দেশটা একটা মহাসাগর । বর্ষাকালে নদী নালা মাঠ ঘাট সব একাকার - জল শুধু জল !


    [ক্রমশ:]



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)