রান্নাঘরের দিকেই যাচ্ছিল বুঝি মায়ের কাছে বাবার কথা সব বলতে । কিন্তু কাছাকাছি গিয়েই ঘুরে চলল খালের দিকে । ওখানে কেউ নেই । জায়গাটা নীরব নির্জন ।
খালে জল কম, তবু আছে । কচুরীপানার জন্য বোঝা যায় না কতটা জল । ছোট্ট একটি তাওয়া, নাগিনা এখানটাতে বঁড়শি ফেলেছিল কালকে । মুনিয়ারও বঁড়শি আছে একটা - এনে ফেললে হয়, কিন্তু কি টোপ দেবে ? হঠাৎ মনে পড়ল, কেন কেঁচো রয়েছে না মাটিতে । ভাবতে ভাবতে চোখে পড়ল এতটুকু একটা ব্যাঙ - তার বড় বড় দুটো চোখ - এটা কি টিকটিকির কেউ হয় নাকি !
এমন সময় একটা শব্দ হল - ঘোর্-ঘোর্- ... ঘোর .... ঘোর ... মেঘের গর্জন নয় । তবু শব্দটা আকাশ থেকেই আসছে । মুনিয়া উঠে দাঁড়াল । তাকাল উপর দিকে - ঠিক ওর মাথার উপর দিয়েই প্রকাণ্ড বড় একটা পাখির মতো কি উড়ে যাচ্ছে । আজকাল এটা বড় ঘন ঘন দেখা যায় । নামটা যেন এলোপ্পেন না কি ! এই বছরখানেকের মধ্যে এই জন্তুটাকে মুনিয়া বহুবার দেখেছে । কিন্তু এটা কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় সে যদি জানা যেত ! দেখতে না দেখতে এলোপ্পেনটা চোখের আড়াল হয়ে গেল - খালের ওপারে মিঞাসাহেবদের বাড়ির ছেলেপিলেরা দলবেঁধে এখনও ছুটছে মাঠ বেয়ে আকাশে চোখ রেখে - সবাই মিলে কলরব করছে - ওই যাচ্ছেরে এলোপ্পেন - ওই আসছেরে এলোপ্পেন !
মুনিয়া ভালো করেই খুঁজে দেখলো - জন্তুটা চোখের সীমানা পেরিয়ে গেছে - কিন্তু পাখার শব্দটা কাঁপছে এখনও মুনিয়াদের বাড়ির গাছপালায়, উঠোনের মাটিতে আর মুনিয়ার বুকের ভিতরে - ঘড়্ ঘড়্ - ঘোড়্ ঘোড়্ ... ঘুড়্ ... ড়্ ড়্ ... ড়্ ।
বাড়িতে উঠে এসে মুনিয়া দেখে - বাবা নেই গোয়ালঘরে । মুংলি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । কান দুটো ওর খাড়া হয়ে উঠেছে । মুনিয়া ভাবল, মুংলিও কি শুনতে পেল ওই শব্দটা ? দেখতে গেল ওই অদ্বুত জিনিসটা ভাবতে ভাবতে সে মুংলির কাছে - খুব কাছে গিয়ে বসে । আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় ওর পিঠে - গলকম্বল থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে ক্ষুদি ক্ষুদি কাঁটামাছি । কট্ কট্ কামড়ায় বলে ওগুলোর এরকম নাম, ভীষণ পাজি ওগুলো । তা নাহলে মুংলি এমন ছটফট করে লেজ আছড়ায় বারে বারে ।
আদর পেয়ে মুংলিও ঘাড়টা লম্বা করে দেয় । মুখটা উপরে তোলে জিরাফের মতো । আবার চোখ নামিয়ে জিভ দিয়ে চাটে মুনিয়ার মাথা । হঠাৎ চুপ করে যায়, যেন কিছু একটা মনে পড়েছে এক্ষুনি বলবে বুঝি মুনিয়ার কাছে । মুনিয়াও তাই শুধায়, বল না, বল, আমার কানে কানে, আমি শুনছি বল, আর কারও কাছে বলবো না, দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল বুঝি, সেই যে একটা কি উড়ে গেল তোকে ঠিক দেখাবো, আবার আসুক - হ্যাঁ ।
মুংলি বলতে চায় সত্যি, কিন্তু কথা মুখে ফোটে না । চোখের বড় বড় তারা দুটো কিরকম অসহায়ের মতো ঘুরতে থাকে । মুনিয়ার মনটা নরম হয়ে মিশে যায় মুংলির অশ্রুতে ।
দুপুর গড়িয়ে চলল । মুনিয়ার কি ক্ষিদে পায় না আজকে ? রঙ্গিনী নাগিনাকে লক্ষ করেই কথাটা বলল । নাগিনা কোনো কথা না বলে মুনিয়াকে খুঁজতে গেল খালের ধারে । একটু আগে তো সেখানেই ছিল সে । পালাল আবার কোথায় ? মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠে নাগিনা । বিড়্ বিড়্ করে বলে, এ আমার ছেলে নয়, এ পূর্বজন্মের সুদখোর মহাজন । গলার জোরে হাঁকল, মুনিয়া ... মুনিয়া ... মুনিয়া-রে ....।
কিন্তু মুনিয়ার সাড়া নেই । গেল কোথায় কোথায়ই বা যাবে । খাল পেরিয়ে তো কারও বাড়ি যায় না সে চেনাশোনা কেউ নেইও । কি করেই বা থাকবে? এক জাত নয়, সমাজ নয়, এক কাজ করে না - কারও সঙ্গে কোনোই যোগ নেই নাগিনার ! যেটুকু যোগ সে শুধু মজুরির । মুচির সঙ্গে মেলামেশা করবে কে ? নাগিনা নিজেকেই মনে মনে বলে - বোকা, কেন এসব বাজে কথা তোর মনে ওঠে । আরও দুবার মুনিয়াকে ডেকে সে ঢুকল বাড়ির ভিতর । গোয়ালঘরে উঁকি দিয়ে দেখে মুংলির কাছটিতে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে মুনিয়া ঘুমোচ্ছে ।
চুপি চুপি ওকে কোলে করে তুলে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল একেবারে রান্নাঘরে পিঁড়ির উপর । রঙ্গিনী চোখে মুখ জলে ধুইয়ে নিয়ে বলে - এই যে বাবা, ভাত দুটো মুখে দিয়ে তবে ঘুমোগে যা ।
মুনিয়া চোখ মেলে চেয়ে যেমনি দেখল বাড়া ভাত তার সামনে, অমনি উঠে ছুটে পালালো ।
রঙ্গিনী পিছু পিছু গেল আর বলতে লাগল, আবার কি হল রাগ করার মত ! পিঠে কিছু পড়ুক ! এই চাও বুঝি !
নাগিনা বলে, খবরদার, গায়ে হাত তুলো না । চোখে ঘুম । ঘুমের ঘোরে পালিয়ে যাচ্ছে । যেতে দাও । একটু পরে ঠিক হয়ে আপনি ফিরে আসবে ।
গোয়ালঘরের দিকেই যাচ্ছিল মুনিয়া । হঠাৎ কানে আবার এল সেই শব্দ - ঘড়্- ড়্-ড়্-ড়্ .. ঘড়্-ড়্-ড়্-ড়্ । তাকাল আকাশের দিকে । সেই অদ্ভুত জিনিসটা আবার এসেছে । মুনিয়া মুংলিকে খুলে নিয়ে এল ঘর থেকে । কাল, দেখ্ মুংলি, দেখ্ একবার তাকিয়ে - এই বলে মুংলির মুখটা তুলে ধরল আকাশের দিকে উঁচু করে ।
মুংলিও কান খাড়া করে শব্দটা শুনছিল । নাগিনা পাশে এসে দাঁড়াতেই মুনিয়া শুধাল, এমন বারে বারে এলোপ্পেনটা যাচ্ছে কোথায় বাবা ?
নাগিনা বলল, কলকাতা থেকে দিল্লী, আবার দিল্লী থেকে বোম্বাই ।
বোম্বাই থেকে কোথায় যায় বাবা ?
বিদেশে ।
কেন যায় বাবা ?
কাজ আছে তাই যায় ।
কি কাজ ?
যুদ্ধের কাজ ।
যুদ্ধ কি বাবা ?
যুদ্ধ মানে যুদ্ধ । শোননি, লোকে যে বলে যুদ্ধ লেগেছে আর সব জিনিস আক্রা হয়ে যাচ্ছে ।
কিসের যুদ্ধ বাবা ?
এই দ্যাখো দিকি ! যুদ্ধ আবার কিসের যুদ্ধ ! মারামারি হানাহানি আর কি । এক দেশের মানুষ আরেক দেশের মানুষকে মারবে, তাই যুদ্ধ । তুমি যেমন মিনির সঙ্গে ভোলার সঙ্গে করে থাকো - এই ধরনেরই ব্যাপারটা । তবে আরও বড় এই যা তফাৎ ।
মুনিয়া তবু বুঝতে পারল না যুদ্ধ ঠিক যে কি । কিন্তু চুপ করে গিয়ে আবার নতুন প্রশ্ন করল, এলোপ্পেনটা কি ব্যাপার বাবা ?
দেখতেই তো পেলে উড়ে যাচ্ছে ।
কই আর দেখা হল বাবা - ভালো করে দেখবার আগেইতো ফুরিয়ে যায় - কোথায় লুকিয়ে যায় ।
ওটা কি পাখির মতো বাবা ! পাখির তো বাসা থেকে ওটার বাসা কোন্খানে ?
ওটার বাসা নানা জায়গায় আছে ।
তুমি দেখেছো সেই বাসাগুলো ?
না, আমি দেখিনি ।
কে দেখেছে ?
আমি জানিনে ।
কেন জানো না ?
আমি যে পড়াশুনা করতে পারিনি ।
কেন পারোনি ?
ইস্কুলে যাওয়া হয়নি ।
ইস্কুল কি বাবা ?
যেখানে গেলে সব অজানা জিনিস জানা যায় ।
আমি তাহলে ইস্কুলে যাবো বাবা !
হ্যাঁ যাবে যখন যাবে । এখন তোমার মুংলিটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে খেতে দাও, আর তুমিও খেয়ে আসোগে, ভাত জুড়িয়ে বরফ হয়ে গেল ।
কোথায় ? কি ?
ঐ-যে ! মা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল একটা বাঁশগাছের জিংলা থেকে ঝুলছে একটা ছোট্ট খাঁচা - তার ভিতর ছুটোছুটি করছে একটা মাটির রঙের কিসের না কিসের ছানা ।
ইঁদুর নাকি মা ?
বোকা ছেলে, ইঁদুরের লেজ এত মোটা হয় !
নামাও তো দেখি পিঞ্জারাটা ।
রঙ্গিনী খাঁচাটা হাত বাড়িয়ে নামিয়ে আনল ।
মুনিয়া একটা ছোট্ট কঞ্চি হাতে নিয়ে বাচ্চাটাকে খোঁচা লাগাতে যাবে এমন সময় রঙ্গিনী
কঞ্চিটা কেড়ে নিয়ে বলল, এরকম করলে বেচারি ব্যথা পাবে আর কাঁদবে ।
মুনিয়া মায়ের কাছে জেনে নিল - এই বাচ্চাটা নেউলের, কেউ কেউ বেজি বলেও ডাকে । মুনিয়া বার বার ওটাকে দেখে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ যেন বলল, এটাকে কেন ধরেছ মা ?
রঙ্গিনী বলল, এই নেউল বাড়িতে থাকলে সাপ আসতে পারে না, ইঁদুর ঘরে ঢোকে না । নেউল যে সাপ আর ইঁদুরের যম, দেখতে পেলে রক্ষে নেই ।
আসল কথাটা তা নয় । সব সময় বুকে কোলে করবার মতো একটি শিশু রঙ্গিনীর নেই বলে, কোনো কিছুর বাচ্চা দেখলেই সে ধরে পুষতে চায় । নাগিনা এসব পছন্দ করে না । তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দুদিন রেখে আবার ছেড়েও দেয় । বেড়াল, কুকুর, বাছুর, বেজি ছাড়া রঙ্গিনী বক, শালিখ, দোয়েল, কোকিলও পুষেছে । সেসব মুনিয়ার জন্মের আগের কথা ; রঙ্গিনী বলে, এতদিনে হয়ত তার পোষা বক আর শালিখ দুটো মরে গেছে । দোয়েল কোকিল এখনও মাঝে মাঝে এসে দেখা দেয় । দোয়েলটা শেওড়া গাছের ওপাশে আড়ালে থেকে খুব জোরে শিস্ দেয় - সি-ই-ই-ই-ই .... আর রঙ্গিনী পাগল হয়ে ওঠে । কিন্তু খুঁজে পায় না । কোকিলটা তো এসে রান্নাঘরের কাছটাতেই বসে, রঙ্গিনী একটা ভাতের ঢেলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দেয়- ওটা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে `কুহু কুহু ' ডাকে আনন্দ জানিয়ে চলে যায় । কিছুক্ষণের জন্য রঙ্গিনীর মনটা উদাস হয়ে ওঠে । মুনিয়া এমন সময় হঠাৎ প্রশ্ন করে -
`যম' কি মা ?
যম হল মরণের দেবতা । নেউল সাপের মৃত্যুদূত - সেজন্য নেউলকে বলা হয় সাপের যম ।
নেউল সাপকে জ্যান্ত ধরে আনতে পারে মা ?
কেন পারবে না !
এই বাচ্চাটাও পারে ?
বড় না হলে শক্তি পাবে কোথায় ? তুমি যেমন ছোটো, তেমনি ওর অবস্থাও ।
এটাকে কি খাওয়াবে ?
মাছ-মাংস ।
আমি মাছ ধরে নিয়ে আসিগে ?
কোথায় পাবে মাছ ?
ঐ খালের জলে ।
কি দিয়ে ধরবে ?
বঁড়শি দিয়ে । বলতে বলতেই মুনিয়া বঁড়শিটাতে কেঁচো গেঁথে নিয়ে গিয়ে ফেলল খালের জলে । কচুরীপানার মাঝখানে একটুকু তাওয়া করা জায়গায় । বঁড়শি পেতে রেখে আবার পালিয়ে এল মায়ের কাছে । দেখতে লাগল নেউলের বাচ্চাটাকে । আবার ছুটে গিয়ে দেখে খালের জলে বঁড়শির ফাত্না নেই । নিশ্চয় টোপ গিলেছে মাছ । ছিপ ধরে টান দিল । বড় ভারি মনে হচ্ছে । খুব বড় মাছ নয়তো । টেনে তুলল একটা সাপ । সাপটা বঁড়শিতে করেই টেনে নিয়ে ছুটে এল বাড়িতে ।
নাগিনা তাড়াতাড়ি কাছে এসে দেখল সাপটাকে । বলল, ভয় নেই, বাজে সাপ । বঁড়শিতে বোধহয় মাছ লেগেছিল, আর সেই সাপ খেতে এসে তিনি আটকে গেছেন একেবারে । বলেই সাপটাকে মেরে ফেলবার জন্য উদ্যত হল সে । মুনিয়া বাধা দিয়ে বলল, মেরো না বাবা, মেরো না, এটাকে নিয়ে যাবো নেউলের কাছে ।
নাগিনা অবাক হয়েই বলল, নেউল আবার দেখলে কোথায় ।
মা পুষেছে যে - তুমি দ্যাখোনি ?
রঙ্গিনী বুঝতে পারল নাগিনাও এদিকে আসছে - আর তখনই খাঁচার মুখটা খুলে দিল । নেউলের বাচ্চাটা পালিয়ে গেল বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে জঙ্গলের দিকে ।
মুনিয়া সাপটা বঁড়শিতে রেখেই টেনে নিয়ে এসে বলল, কোথায় মা তোমার নেউল সাপ এনেছি এবার - মারুক দেখি - তবে বুঝব সত্যি সত্যি সাপের যম নেউল ।
রঙ্গিনী যেন অবাক হয়ে খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে বলল, কই কোথায় নেউল ? যেন সে কিছুই জানে না ।
মুনিয়া বলল, পালিয়ে গেল নাকি ? কিন্তু খাঁচাতো ভাঙেনি !
দেখছো না দরজাটা খোলা ।
ওরা বুঝি বন্ধ দরজা খুলতে পারে মা ?
পারে বৈকি ।
সাপটাকে কি করবো মা ?
ছেড়ে দাও বাঁশঝাড়ে, নেউলবাচ্চার বাপ-মা ওকে ধরে খাবে ।
না বাবা, আমি ইস্কুল দেখিনি । তবে শুনেছি ইস্কুলে ভালো কথা হয়, ভালো কাজ হয় ।
বাবা দেখেছে ইস্কুল । আমাকে নিয়ে যেতে বললাম । বললে এখন না । কখন নিয়ে যাবে আমাকে ইস্কুলে মা ?
বলেছে যখন ঠিক তোমায় একদিন নিয়ে যাবে । তোমার বুঝি পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছে ?
পড়াশুনা কি মা ?
পড়া আর শোনা । বই দেখে পড়া, আর মাস্টারমশায় যা বলেন তা শোনা ।
মাস্টার কি মা ?
মায়ের চেয়েও যে মানুষের বেশি আপনার তাকেই বলে মাস্টার ।
মাস্টার খুব আদর করে মা ?
হ্যাঁ, শুধু আদর নয়, সুন্দর সুন্দর গল্প বলে, গল্প বলতে বলতে এমন কথা বলে, যে কথা মনে রাখলে মানুষ বড়লোক হতে পারে ।
কি রকম কথা মা ?
এই ধরো যেমন রামলক্ষণের কথা ।
রামলক্ষণের কথা মাস্টারও জানে বুঝি ?
কেন জানবে না ।
কোথা থেকে কার কাছে জানল মা ?
বই পড়ে জেনেছে ।
বই কি মা ?
যাতে কথা লেখা থাকে - তাই বই ।
আমাকে একটা বই দেবে তো ?
একটা কেন, তুমি অনেক বই পাবে ।
বইয়েতে রামলক্ষ্মণের কথা থাকবেতো মা ?
হ্যাঁ, থাকবে ।
তুমিতো বই দেখনি, তাহলে রামলক্ষ্মণের কথা জানলে কি করে ?
শুনেছি কারও না কারও কাছে ।
আমাকে একবার বলো না মা, রামলক্ষ্মণ কি করল ?
কি আর করবে ? রাম রাজা হতে যাবে এমন সময় বনে যেতে হল তাকে ।
কেন বনে গেল ?
রামের সত্মায়ের ইচ্ছে ছিল না যে রাম রাজা হয় ।
সৎ মা কাকে বলে মা ?
বড় হয়ে রামসীতার কাহিনী যখন পড়বে জানতে পারবে ।
সীতা কে ছিল মা ?
লবকুশের মা ।
লবকুশ কি মা ?
লব আর কুশ - রাম ও সীতার দুই ছেলে । ঠিক তোমারই মতো ছোটো থাকতেই তারা রামায়ণ গান করতে শিখেছিল ।
রামায়ণ কি মা ?
রাম-সীতার কথা যে বইয়ে লেখা আছে তার নাম রামায়ণ ।
আমাকে একটা রামায়ণ দিও মা ।
তুমি আগে পড়তে শেখো - তাহলে সবই পাবে ।
আমাকে শেখাও মা পড়তে ।
আমি কি জানি পড়া শেখাতে ।
একটুকুও জানো না মা ?
দাঁড়া দেখি একটা-দুটো অক্ষর বোধহয় মনে আছে । নিয়ে আয় দেখি একটা শুকনো ডাল ভেঙে ।
মুনিয়া ছুটে গিয়ে একটা শুকনো নিশুঙ্গের ডাল ভেঙে আনলো বাড়ির পাশের জমির বেড়া থেকে । রঙ্গিনী ডালটাকে ছোটো করে ভেঙে নিয়ে ডান হাতে শক্ত করে ধরে মাটির উপর আঁচড় কেটে লিখল অ, আ । মুনিয়া তাড়াতাড়ি মায়ের হাত থেকে কলমটা নিয়ে নিজেও লিখতে লেগে গেল । মা বলল, এইটে অ ওটা আ । মুনিয়াও বলতে লাগলো এই অ ওই আ ।
লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে এল । মুনিয়া বলল, তোমার নেউলটা এখন কি করছে মা ?
ঘুমোচ্ছে ।
কেন ?
ঘুম পেয়েছে তাই ।
কেন ঘুম পেল মা আমার-ত ঘুম পায়নি ।
তোমারও পেয়েছে । একটা ছড়া বলছি, তাহলেই বুঝতে পারবে ঘুম পেয়েছে কিনা ।
নিদ্রাবলী গো আমার বাড়ি আইওএইটুকু শুনে মুনিয়া শুধায়, সোনাধন কে মা ?
সোনাধনের চৌউখে একটু ঘুম দিয়া যাইও .. ও .. ও
ধীরে ধীরে যাইও চোখনি ভাঙ্গে চাইও
পাকনা কাঁঠল ভাইঙ্গা দিমু ডালে বইয়া খাইও .. ও .. ও
নিজের দিকে খেয়াল নেই মুনিয়ার । মুংলি কেন সাত সকালে হেম্বে হেম্বে ডেকে উঠল সেটাই বড় কথা । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাছুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সে দেখতে লাগল । বাছুরের পেটটা কি রকম নেতিয়ে রয়েছে । হাত বুলিয়ে দেখে মনে হল ওর - বাছুরটা যেন কিছু খায়নি কাল রাত্তিরে ।
পৌষ সংক্রান্তির পর আর শীত থাকে না বলে । এ-যে মাঘের শেষ - তবে এত শীত কেন ? হোক শীত - মাঠে এখনই রোদ পড়বে - ন্যাড়ায় ভরা ধানক্ষেতের বুকে । ন্যাড়ার ফাঁকে ফাঁকে দুব্বো ঘাসের লতা বেরিয়েছে । মুংলি ওই লতাগুলো খেতে ভালবাসে । এক্ষুনি মুংলিকে বের করে নিয়ে গেলে হয় মাঠে ।
আর কারও ঘুম ভাঙেনি । মুনিয়া মুংলিকে নিয়ে চলল । নাগিনা বুঝতে পেরে বলল, এখন নিসনে মুংলিকে, আগে গাইটা দুইয়ে নি ।
মুনিয়া বুঝতে পারল - মায়ের দুধ খাবার জন্যই মুংলি এতক্ষণ চেঁচিয়েছিল । এখন আগে দোহানো হোক । বাবাকে ডেকে বলল, রোদ উঠেছে বাবা, শিগ্গির গাইটা দুইয়ে দাও, বাছুরকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাবো ।
ছেলে যাবো বললে ওকে আর আটকে রাখা যায় না । নাগিনা তখন তখনই উঠে পড়ল । গাই দোহালো বাছুর দুধ খেল । মুনিয়া এবার বাছুর নিয়ে চলল মাঠের দিকে ।
মুনিয়ার মা বেরিয়ে এসে ডাকতে লাগলো, ও মুনিয়া তুই কি বাছুর পেয়ে খাবার কথাও ভুলেছিস্ আর এছাড়ানি শীতে খালি গায়ে বেরিয়েছিস্ চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে যা । আর চারটে পান্তা-ভাত, নুন দেবো, লঙ্কা দেবো খেয়ে যা ।
পান্তা খেলে শীত আরও বেড়ে যাবে মা । তার চাইতে চিড়ে দাও - নুন লংকা আর পিঁয়াজ দিয়ে ।
চিড়ে কোথায় পাবো বাপ্ । চিড়ে করব যে ধান কোথায় এক মুঠি বলতো পোড়া কপালে যুদ্ধ লেগেছে । সরকারের আমলারা গিরস্র গোলার ধান তালা লাগিয়ে রেখে যাচ্ছে - ওদের হুকুম বিনা এক মুঠি ধান বের করে নেবার জো নেই ।
ওসব কথায় কান না দিয়ে মুনিয়া বলে, ঢেপের খই করেছিলে যে মা ।
রঙ্গিনীর মনে পড়ল, গেল বর্ষার শেষে শাপলাগাছের পাকা ফল কুড়িয়ে এনেছিল মাঠ থেকে । তার দানা দিয়ে খই কত ভেজেছিল সেদিন । তাই খুঁজে এনে দিল মুনিয়াকে । দেখতে ঠিক সাগুদানার মতো - কিন্তু ভিতরে ফাঁপা । চিনি দিয়ে আঁশিয়ে নিলে বেশ লাগে মুড়কির মতো খেতে । কিন্তু মুনিয়ার মা চিনি পাবে কোথায় । যুদ্ধের দরুন চিনি ময়দা আটা সব কন্ট্রোল হয়ে গেছে ।
ঢেপের খই কোঁচড়ে নিয়ে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে মুনিয়া চলল মাঠে । মুনিয়ার আগে আগে মুংলি ।
মুনিয়া লক্ষ করে বাছুরটা কি রকম যেন দুর্বল হয়ে গেল । দুধতো বাবা সব টেনে নেয় ওর মায়ের বাঁট থেকে । ও বেচারি আর পায়ই বা কি ! এখন ওকে ঠেসে ঘাস খাওয়াতে হবে । আজ সারাদিন ঘাস খাওয়াবে ওকে । মাঠে যেখানে যা ভালো ঘাস আছে খুঁজে খুঁজে বের করবে ।
একটা জায়গায় বেশ লম্বা লম্বা ঘাস পাওয়া গেল । মুংলি ছিঁড়তে লাগল সে ঘাস মাড়ি দিয়ে ঠেলে ঠেলে । মুনিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে - এরকম করে না ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে কচ্ কচ্ করে ঘাস কেটে খেতে পারে না ।
মুংলি ঘাস খায় । ঘাস পেটের ভিতর যায় আর গ-ড়্-ড়্-ড়্ ... শব্দ ওঠে । মুনিয়া মুংলির পেটে কান পেতে শোনে । দেখে কৌতূহল নিয়ে - মুংলির দু-পাশের পেট সমান উঁচু নয় । ঘাস বুঝি দুদিকে একসঙ্গে যায় না । একটা পেট আগে ভর্তি হলে অন্য পেটে যাবে । মুনিয়া নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর পেট আর মুংলির পেট ঠিক একরকম নয় । হঠাৎ একটা বিস্ময় জাগে ওর মনে । একটা অদ্ভুত জানার আনন্দে এতটুকু ছোট্ট মুনিয়া যেন কত বড় হয়ে ওঠে মনে মনে । একটা গানের কলি তার কন্ঠ থেকে আপনি বেরিয়ে আসে ।
বেলা গেল সন্ধ্যা হইল রবি গেল দূরগাইতে গাইতে চমকে উঠল সে । গান বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথে । মুংলির নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে । মুংলি কেবলই ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে হাঁচি তুলছে । মুনিয়ার ভয় দেখা দিল । ছুটে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসবে নাকি বাবাকে না মুংলিকে নিয়েই যাবে বাড়িতে ।
সুবলে ডাকিয়া বলে হারাইলাম বাছুর ...
বাড়ি পৌঁছলে পর নাগিনা বলল - খুব তাড়াতাড়িই এসে গেছিস্ যাহোক বাবা ! নে বাছুরটাকে নিয়ে বেঁধে রাখ । এবার চান্ করে আয় গিয়ে মায়ের সঙ্গে । সারা শরীরে এত কাদামাটি লাগালে কোথা থেকে বাবা ।
মুনিয়া বলে, খাল পার হতে গিয়ে এঁটেল মাটিতে পা আটকে গিয়েছিল - আমার খুব ভয় হয়েছিল । কিন্তু তার চাইতেও বেশি ভয় হয়েছে মুংলিকে দেখে, ঐ দ্যাখোনা, মুংলির নাক দিয়ে কি রকম রক্ত ঝরছে । মুংলি মরে যাবেনা তো ।
নাগিনা দেখে নিয়ে বলল, নারে বাবা ভয় নেই, এ-কোনো অসুখ নয় । ছিনে জোঁক ঢুকেছে নাকে ।
জোঁকটা বেরোবে না বাবা ।
বেরোবে ।
কেমন করে ?
মুংলি নিজেই বের করে দেবে নাক ঝেড়ে ঝেড়ে ।
যদি না পারে মুংলি ?
তাহলেও ভয় নেই । জোঁকটা রক্ত খেয়ে খেয়ে যখন মোটা হয়ে যাবে তখন আপনা থেকেই খসে পড়বে - যেমন আম পাকলে খসে যায় গাছ থেকে ।
মুনিয়া ভরসা পায় । ভয় তবু ছাডে ংআ তাকে । বাবাকে বলে কাচুমাচু হয়ে, ঠিক বলছ-ত বাবা ।
নাগিনা দেখে ছেলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে । থেকে থেকে সে চোখ মুছছে । যেন এক্ষুনি কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসবে ওর দুচোখ ভেঙে ।
তাড়াতাড়ি ছেলের পিঠে হাত রেখে তাই বলল, এর জন্য এত ঘাবড়াতে নেই বাবা । ব্যাটা ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছ, কত বাঘের হাত থেকে, কুমীরের হাঁ থেকে বেঁচে আসতে হবে, কত জল-জঙ্গল পার হতে হবে ।একটা জোঁকের ভয়ে এমন অস্থির হলে চলবে কেন ; মশা কি আমাদের কম রক্ত খায় ! মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়, তাও কি মশাকে আমরা ভয় করি ? কখনও ভয় কিছুকেই করতে নেই বাবা । ভয় কিছুতেই যেন না হয় মদন, মানুষ সকল জীবজন্তুর মধ্যে এ-জন্যই বড় । মানুষকে সব জানোয়ার ভয় করে, কিন্তু মানুষ কাউকেই ভয় করে না ।
মুনিয়া চট পট মুংলির লেজ টিপে দেয় । মুংলি নাচতে নাচতে আবার নামে গিয়ে মাঠে । মুনিয়া ছোটে পিছন পিছন হাতে নিয়ে ছোট্ট একটি পাচন বাড়ি ।
নাগিনা ডেকে বারণ করে । রঙ্গিনী এসে নাগিনাকে ধমকায়, তুমি কেন ওকে যেতে দিলে ছেলে কি এখন আর সন্ধ্যে না হলে ফিরে আসবে ।
সূর্য লাল হয়ে ডোবেনি । মুনিয়া দাঁড়িয়ে দেখে খালের জলে মুংলির ছায়া । হঠাৎ নজরে পড়ে নিজের ছবিটাও । অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জলের দিকে ।
মা খুঁজে পেতে চাদরের মতোই একটা কিছু আনল বটে, কিন্তু মুনিয়ার সেটা পছন্দ হল না । বলল, নূতন চাদর কই মা ?
রঙ্গিনী বলল, নূতন চাদর কোথায় পাব এখন সব কন্ট্রোলের বাজার । কাপড়চোপড় কি আর চাইলেই পাওয়া যায় আজকাল - যুদ্ধ লেগেছে না ।
মুনিয়া কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, বাবা যে বলেছিল বাজার থেকে কিনে আনবে ।
আনবে যখন তখনত পাবেই । এখনতো এটাই গায়ে দাও । না-হলে ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করবে যে । বলতে বলতে রঙ্গিনী চাদরটা খুলে দেখল ভাঁজ খুলে - সত্যিই তো এতে আর কিছুই নেই । কচি ছেলের গায়ে এই বুড়ো ছেঁড়া ন্যাকড়াটা কোন বুকে জড়িয়ে দেয় ।
ছুটে গিয়ে ঘরে ঢুকল রঙ্গিনী । খোঁজাখুঁজির পর বের করল থেবড়ানো টিনের তোরঙ্গটা । তা-থেকে নিজেরই একটা পুরনো শাড়ি পেল । সেও কি আর ভালো । কত জোড়াতালি তাতে ছেঁড়াজুতোর মতো । কিন্তু আর তো উপায় নেই । অগত্যা সেটাই ভাঁজের পর ভাঁজ তারপর আবার ভাঁজ করে জড়িয়ে দিল মুনিয়ার গায়ে । ঘাড়ের পিছনে শাড়ির আঁচলের কোনো গিট দিয়ে বেঁধে দিল ।
মুনিয়া হাত বের করতে পারছে না । মাকে আবার ডাকল । মা এসে গিট খুলে দিল । মুনিয়া ভাঁজ করা শাড়িটাকে চাদরের মতো করে গায়ে জড়াবার চেষ্টা করতে থাকল । কিন্তু পারল না ভাঁজগুলো খুলে গিয়ে কি রকম একটা এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি হল - মুনিয়া ছটফ্ট্ যত বেশি করছে - যেন জালে মাছ জড়িয়ে যাচ্ছে ।
নাগিনা ছুটে এসে বলল, এ কি করলে বাবা, ছেঁড়া শাড়িটা আরও ছিঁড়লে ।
রঙ্গিনীও আসছে আবার । নাগিনা তাড়াতাড়ি শাড়িটা কোনো রকমে গুটিয়ে তুলে দিচ্ছিল ছেলের কাঁধে । একটা বয়স্ক লোকের এমন অসুন্দর কাজ দেখে রঙ্গিনীর খুব রাগ হল । সে কাছে এসেই শাড়িটা খুলে দিল মুনিয়ার গা থেকে । গুম্ গুম্ করে দুটো কিল মুনিয়ার পিঠে বসিয়ে দিয়ে মনে গজ্ গজ্ করতে করতে ফিরে গেল । নাগিনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ।
মুনিয়া বলল, আমাকে চাদর কিনে দিও বাবা ।
নাগিনা বলল, হ্যাঁ বাবা দেবো ।
কবে দেবে বাবা ?
এই দ-ংউচারদিনের মধ্যেই ।
কোন দিন পাবো বাবা ?
এই রবিবারের হাটে ।
আজ কি বার বাবা ?
সোমবার ।
কালকে কি বার বাবা ?
মঙ্গলবার ।
রবিবার আসতে আর কত দেরি বাবা ?
আর ছদিন বাবা ।
আরও ছদিন আমি অত দিন কি গায় দেব বাবা ?
নাগিনা কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না । নিজের যদি কিছু একটা গায়ের কাপড় থাকত -তাহলে নাহয় সেটাই দিয়ে দিত । রঙ্গিনী ওর ছেঁড়া শাড়িটা দিয়েও আবার ছিনিয়ে নিল কেন ?
রঙ্গিনীর কাছ থেকেই আনতে যাচ্ছিল বুঝি শাড়িটা আবার ।
রঙ্গিনী নিজেই আসছে আবার এদিকে । সেই ছেঁড়াটা নিজে পরেছে । আর নিজের পরনেরটা দুভাঁজ করে নিয়ে এসে জড়িয়ে দিয়েছে মুনিয়ার গায়ে । এটা তবু একটু ভালো । কিন্তু মুনিয়ার শীত এতেও কমছে না । দাঁত ঠক্ ঠক্ করছে ।
নাগিনা বলল, অমন দাঁত ঠক্ ঠক্ করো না বাবা ।
মুনিয়া বলে, আমি ঠক্ ঠক্ করছিনে বাবা, দাঁতেরাই করছে ।
নাগিনার নিজের শরীরই কাঁপছে ঠক্ ঠক্ । এলোমেলো হাওয়া দিয়েছে তায় আবার । চলে যাবার আগে জানিয়ে যাচ্ছে শেষবারের মতো । ছেঁড়া কাঁথাখানা জড়িয়ে নিয়েছে সে গায়ে । শীতকালটা তো এ-দিয়েই কাটালো । কিন্তু এই কটা দিন যেন আর কাটে না । মনে মনে মাঘ মাসটার উপর চটে গিয়ে নাগিনা বলল, মাঘতো মাঘ নয় গরীবের বাঘ ।
সে-রাত্রিটা মুনিয়ার আর চোখ লাগে না । মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাত পা মুখ সব এক জায়গায় করে নিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে মায়ের বুকে ঢুকে যায় - তবু শীত কমে না । মা বারে বারে ছেলের শরীরে হাত দিয়ে অনুভব করে - শীত পড়েছে - কিন্তু এমনত কখনও করে না মুনিয়া জ্বরটর আসেনি তো ?
শিশির হঠাৎ বেশি পড়েছে । ঘরের ভিতরেও কি এসেছে আসতে তো পারেই । এতো আর পাকা দেয়াল নয় - বাঁশ-বেত-ছন দিয়ে তৈরি ঘরের বেড়া, বাঁশের ফাঁকে ফাঁকে ঠাণ্ডা হিম ঢুকতে পারে ।
মুখের ঢাকাটা সরিয়ে দেখে রঙ্গিনী - সত্যিত, ঘরের ভিতর থেকে দিব্যি আকাশ দেখা যাচ্ছে । এই দু:খের মধ্যেও সেই মুসলমান ফকিরের গানটা রঙ্গিনীকে দোলা দিয়ে গেল -
এই ঘরখানি ভাঙাচোরা ঘরের নেইক বেড়ারঙ্গিনী বুঝতে পারল, তাইতেই এত ঠাণ্ডা ঢুকেছে ঘরে - চাপ থেকে একটা ছনের চাব্ড়া কালকের এলোমেলো বাতাসে কখন খসে পড়েছে, তাইতেই গায়ের কাপড়চোপড় ভিজে এমন জল হয়ে গেছে । আপন মনে কুনকুনিয়ে সেই ফকিরের গানটা সে গাইতে শুরু করল, -
যে সুখেতে রাখছ আল্লা দেখি চত্রতারা
আল্লা হো ................
যে-সুখেতে রাখছে আল্লা বুঝিতে না পারি
আল্লা - হো ....
মুনিয়া ক্ষেতের আল থেকে ঘাস কেটে নিয়ে আসে ভারে ভারে । বাঁশ চেঁচে একটা বাঁক সে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে । চাষীরা যেমন যেমন করে - মুনিয়ার কাজে কর্মে তারই অনুকরণ লক্ষ করা যায় । তবে ঘাস যেটুকু আনে তাতে মুংলিরই কুলোয় না । কিছুক্ষণ খেয়েই মুংলি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর নাকে মুখে হোঁ হোঁ শব্দ তুলে মুনিয়াকে ডাকে । মুনিয়া ছুটে গিয়ে দেখে একটিও ঘাস নেই ।
সেদিন ঘাস কাটা আর চলে না । চমনিয়া গাদা থেকে খড় এনে দেয় । মুংলি কেবল শোঁকে আর শোঁকে - খড়ে মুখ দেয় না । মুনিয়ার মা দেখে বলে, ঘাস খেয়ে স্বাদ পেয়েছে এখন আর খড় ছোঁবে কেন ?
মুনিয়া বলে, ঘাস ওদের ভাত মা । আর খড় হল চিড়ে । আমরা-ত ভাত খেলেও চিড়ে খেতে আপত্তি করিনে । চিড়ে-ত আমার ভালোই লাগে । মুংলি কেন আমার মতো হয়না মা ।
মুনিয়া মুংলির অবস্থা দেখে দু:খ পায় মনে মনে । সারাদিন বেচারি ছুটোছুটি করে বেডিয়েছে - এখন এক জায়গায় এমন দিনের পর দিন কি করে দাঁড়িয়ে কাটায় । গলার ঘুঙ্গুরটা শুধু শুধুই বেঁধে দিয়েছিল । ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলে ঘুঙ্গুর বাজবে কেমন করে । মশামাছির আড্ডা হয়েছে গোয়ালটা । মুংলিকে সে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এসে উঠোনে খোঁটায় বাঁধে । বাঁধতে না বাঁধতেই ঝড় ওঠে, বৃষ্টি নামে । আবার ঘরে নিয়ে যেতে হয় । মুংলির কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে ওঠে মুনিয়া । বাছুরটা কিসে সুখ পাবে এই চিন্তায় রাত্রিবেলা ওর ঘুম ভালো হয় না । যখন খুশি উঠে দরজা খোলে । নাগিনা ভয়মিশ্রিত গলায় শোধায় - কে ?
মুনিয়া উত্তর দেয়, আমি বাবা, মুংলিকে বড্ড মশায় কামড়াচ্ছে, একটু মশা তাড়িয়ে দিয়ে আসি । জবাফুলের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে গোয়ালঘরে ঝটাপটি শুরু করে । কিন্তু মশারা কি তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাবার জীব ? এক জায়গা ছেড়ে ওরা আরেক জায়গায় যায় - কতগুলো আবার নড়েও না - গোয়ালের ভিজে মাটিতে কামড় দিয়ে ধরে বসে থাকে । রঙ্গিনী বিরক্ত হয়ে বলে, রাত্রিবেলা ছেলে ফুলের ডাল ভাঙ্গে, এ-তো ভালো কথা নয়, এ-সময় কি গাছে বিরিখে হাত দিতে হয় ! নাগিনাকে বলে, তুমি ওকে বলো কিন্তু, আমার কথা তো কিছুতেই কানে নেবে না ।
পরের দিন নাগিনা ভিজে খড়পাতা সংগ্রহ করে রাখে । সন্ধে হবার আগেই সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় । মুনিয়া বলে, এ কি জন্য করছ বাবা ?
নাগিনা বলে, এই ধূয়াতে মশার চোখ বন্ধ হয়ে যাবে - ওরা আর পথ দেখতে পাবে না -উড়তেও পারবে না, নাকে মুখে ধূঁয়া ঢুকে মরবে । গোয়ালঘরে এই জন্যই গেরস্থরা ধূঁয়া দেয় সন্ধেবেলায় । আজ দেখো, মুংলির হাত পা অত বেশি নড়বে না । চুপচাপ শুয়ে ঘুমোতে পারবে ।
ধূঁয়ার উপর আরও ভিজে খড়পাতা চাপা দাও, ধূঁয়া আরও বেশি হবে । মুনিয়ার ভারি কৌতূহল জাগে । সে একটা হাতপাখা এনে তাতে হাওয়া করতে থাকে । ধূঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে, মনে হয় এর মধ্যে কি যেন মূর্তি রয়েছে, মূর্তি কণা কণা হয়ে ভেঙ্গে শেষে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে - ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে যায় । নাগিনা বলে, এই থাক্, এবার দরজা বন্ধ করে দাও ।
মুনিয়া বলে, ধূঁয়ায় আমার চোখ কি রকম জ্বালা করছে বাবা - এই দ্যাখো, জল এসে গিয়েছে । মুংলির চোখে এরকম লাগেনি-ত
নাগিনা বলল, না, না, ওদের চোখের পরদা মোটা । আমাদের মতো অত নরম নয় - কত বড় বড় দেখোনি । চোখের পাতা কত পুরু । ঢেকে রাখলে ভিতরে ধূঁয়া ঢোকে সাধ্য কি ।
তবু মুনিয়া একবার কেরোসিনের কুপিটা নিয়ে মুংলির চোখ পরীক্ষা করতে গেল ।
মুংলিকে একবার না ছাড়লে আর চলে না । মুনিয়াকে দেখলেই মুংলি কেবল হাত-পা নাড়তে থাকে, যেন বলে - তুমি কেন আমাকে একবারটি ছেড়ে দাওনি - আমি এমন কী অপরাধ করেছি যে একটু খানি দৌড়ঝাঁপ করে আসতে পারব না । মুনিয়া দাঁড়িয়ে থাকে মুংলির সামনে, অবাক হয়ে শোনে নিজের মনে মনে - কিরকম অন্যমনস্ক হয়ে যায় । মা ডাকে মুনিয়া মুনিয়া, মুনিয়া শুনতেই পায় না । মুনিয়ার হল কি ?
হঠাৎ ছুটে এসে মুনিয়া বলে নাগিনাকে, বাবা আজকে হাটে যাবে না ?
কেন বাবা হাটবার দিনে-ত হাটে যেতে হবেই । আজকেও নিশ্চয় যাবো ।
কিন্তু, আজ তুমি এত দেরি করছ কেন ?
কই বাবা, দেরিত হয়নি । আমি আর দুজোড়া জুতো মেরামত করব তবে হাটে যাবার ঠিক সময় হবে ।
মুনিয়ার ধৈর্য থাকছে না । বার বার এসে বাবার কাজের ঘরে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছে । নাগিনা আপনমনে কাজ করেই চলছে ।
মুনিয়া একবার মুংলির কাছে যায়, একবার বাবার কাছে আসে । বাবাকে কিছু বলে না । শুধু দেখে যায় ওর কাজ শেষ হতে আর কত দেরি ।
মুংলি আর গামলায় মুখ দেয় না । যে দিকে মুনিয়া যায় সেদিকেই তাকিয়ে থাকে । যেন কি একটা জরুরি কথা সে বলতে চায় মুনিয়াকে নীরবে ।
বোঁচকা কাঁধে নিল নাগিনা । ডাকল মুনিয়াকে । মুনিয়া এলে বলল, এতক্ষণ হাটে যাবো কিনা বার বার খোঁজ নিচ্ছিলে । এবার সময় হল, চলো । চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নাও ।
মুনিয়া দাঁড়িয়েই আছে ।
নাগিনা বলল, চলো বাবা, তাড়াতাড়ি করো । বেলা চলে যায় যে ।
তবু মুনিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুলে মাটি খুঁড়ছে ।
নাগিনা বুঝতে পেরে বলল, ও, যাবার মন নেই, তা বললেই পারো । বাড়িতে বসে কি করবে আমার সঙ্গে গেলে তবুত দোকানটা একটু দেখতে পারতে, মাছ পানটা কিনে আনতে পারতাম । যাক্ .. একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে নাগিনা রওয়ানা হয়ে গেল । কুকুরটা তার পিছু পিছু চলল । নাগিনা মুনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভোলাটাকে ডেকে নাও, ওটা আবার পথে ঘাটে জাতভাইদের সঙ্গে ঝগড়া করবে ।
মুনিয়া তাকিয়ে রইল । খাল পেরিয়ে নাগিনা নবীদের বাড়ির নিচের রাস্তা ধরে খানিক দূর গিয়ে মোড় ঘুরল বাঁ-দিকে । বেতের ঝোপটার জন্য নাগিনাকে আর দেখা গেল না । মুনিয়া নাচতে নাচতে গিয়ে ঢুকল গোয়ালঘরে ।
মুংলির গলার বাঁধন দিল খুলে । বলল, চল্ মুংলি, আজ একটু বেড়িয়ে আসবে ।
মুংলি নড়ছে না তাকিয়ে আছে হাঁ করে মুনিয়ার মুখের দিকে । মুনিয়া বলছে, কি বোকা । ছাড়লাম তাও বুঝতে পারলে না ।
মুনিয়া এবার মুংলির গায়ে একটু হাত ছোঁয়াতেই ও যেন ইশারা পেল । একটুখানি নড়ে দাঁড়াল । গলাটা একবার নাড়াচাড়া করে বুঝল দড়িটা নেই, এবার সম্মুখে পা বাড়াল ।
মুনিয়া ভাবল - মুংলির সে আর নেই । থাকলে এতক্ষণে ছুটে চলে যেত অনেক দূর । এমন ধীরে ধীরে কোনোদিন-ত সে এর আগে পা ফেলেনি । ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল মুনিয়া । হঠাৎ দেখে মুংলি কাছে নেই । গেল কোথায় এরই মধ্যে । সঙ্গে সঙ্গে মুনিয়াও ছুটল সোজা পথ ধরে ।
দেখতে পেল - ঐ যে দূরে লাফিয়ে লাফিয়ে মুংলি খাল পার হয়ে যাচ্ছে, গলার ঘুঙ্গুর বাজছে ঠুং ঠুং ঠুঙ্গুর ঠুঙ্গুর ...
মুনিয়ার আনন্দ হল । মনে মনে বলল - ঠিক আছে, একটু ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়িয়ে আসুক বেচারি ।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মুনিয়া বলে, কেন আমায় ডাকছ ? মা রঙ্গিনী বলে, মুংলি কোথায় চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব নিয়ে মুনিয়া চুপচাপ থাকে । মা রেগে গিয়ে ফিস্ফিস্ করে বলে, শিগ্গির খুঁজে নিয়ে আয় বাছুর ।
মুনিয়া ছুটেই যায় । হঠাৎ দাঁডিয়ে কান পেতে শোনে - মুংলির গলার ঘুঙ্গুর বাজে কিনা । শব্দ শুনতে পায় না ।
খালের ওপারে নবীহুসেনের বাড়ি । মুনিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা নেই, তবু ওকে জানে । ওরই পাশ ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছিল মুনিয়া । নবী ওকে ধাক্কা দিয়ে শুধায়, যাচ্ছিস্ কোথায় ? মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলে, মুংলিকে খুঁজতে । মুখটা বিকৃত করে নবীহুসেন বলে, মুচিবাড়ির বাছুর, তার আবার আহ্লাদ দ্যাখো না, নাম রেখেছে মুংলি । যে আগুনের আগুন তাতে আবার কাঁঠালের বীজ পোড়া । একটু থেমে থেমে নবীহুসেন বলে, একটা কেটি কুত্তা তারও নাম ভোলা, আর একটা বিল্লি - সেটাকে ডাকে মিনি বলে - সব সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড হচ্ছে নাগিনা মুচির বাড়িতে । তা তা এদিকে বাছুর কোথায় বাজারের খোঁয়াড়ে দেখ্ গিয়ে খুঁজে । একেবারে নবাব হয়ে গেছে । না, যখন খুশি গরু ছেড়ে দাও ।
খোঁয়াড় - মুনিয়া এই নামটা জানে, জিনিসটা দেখেনি । একদিন গিয়ে দেখে এলে হয় । বাবা নিশ্চয় জানে এর সন্ধান । বাবাকে শুধাতে হবে, ভেবে নিয়ে মুনিয়া সেই ছেলেটাকে বলল, তোমাদের বাড়িতে যায়নি আমাদের মুংলিটা ?
কেন আমাদের বাড়ি আসবে ?
তোমারও তো একটা বাছুর আছে এমনি ছোটো । সেদিন গিয়েছিল আমাদের মুংলির কাছে । মুংলি কত খুশি হয়েছিল ওকে পেয়ে । তাই আজ হয়ত ওকে খুঁজতে এসেছে ।
আমাদের বাছুর তো ছেড়ে দিই না । এখনও ঘরের ভিতরে আছে । দেখতে চাস তুই ?
মুনিয়ার কি রকম ভয় ভয় করে ছেলেটাকে । দেখতে যেমনি ষণ্ডামতো, তেমনি কথাগুলো বড় কর্কশ । মুখে কি ভক্ভকে পেঁয়াজের গন্ধ । ওর কাছ থেকে পালাতে পারলে মুনিয়া রক্ষে পায় । তাই আর কথা না বলে বাড়ির দিকেই পা বাড়াল ।
ছেলেটা ধমক দিয়ে বলল, এই ব্যাটা, পালাচ্ছিস্ যে, আয় দেখে যা আমার গোয়ালঘর, বলে মুনিয়ার ডানায় শক্ত করে ধরে ঠেলে নিয়ে চলল ।
মুনিয়া যেতে চাইছে না । ভয়ে কাঁপছে । মুনিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে সেই ছেলেটা বলছে, এরকম করছিস্ কেন আমাকে তুই দেখিস্নি তোদের বাড়ি আমি গিয়েছি কতবার । তোর বাবাকে দিয়ে কত জুতো সারিয়ে আনলাম ।
মুনিয়া ভাবল - এটাই কি নবীহুসেন !
ভাবতে ভাবতেই দাঁড়ালো এসে একটা গোয়ালঘরের সামনে । দরজা খোলা । মুনিয়া উঁকি দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখে দূরে বাছুরের পাশে শুয়ে জাবর কাটছে মুনিয়ার মুংলি ।
মুংলির উপর ভীষণ রাগ হল মুনিয়ার । ঘুরে বেড়াবার জন্য ওটাকে ছাড়ল আর বোকা বাছুর কিনা এক গোয়াল ছেড়ে আর এক গোয়ালে এসে ঢুকে বসে আছে । ওই বাছুরটাকে খুব ভালো লাগে বুঝি মুংলির কিন্তু মুনিয়ার চাইতে কি বাছুরটা বেশি ভালো
ভাবতে ভাবতে সারাটা শরীর কি রকম যেন নড়ে উঠল মুনিয়ার । মুনিয়ার চাইতেও আদরের জিনিস মুংলির আছে তাহলে ।
রেগে গিয়েই মুনিয়া ডাকল, মুংলি, চল, ঘরে যাবি আয় ।
ডাক শুনে একবার তাকালো অবশ্য, কিন্তু উঠে এল না মুনিয়ার কাছে । জিভটা বের করে ধীরে সুস্থে পাশের বাছুরটার গা চাটতে লাগলো মুংলি ।
নবী ঘরে ঢুকে বের করে আনল মুংলিকে । মুনিয়া ওকে ধরতে গেল । ধরা না দিয়ে মুংলি ছুটে পালায় । মুনিয়া বুঝতে পারল না কোন্ পথে মুংলি দৌড় দিল ।
মুনিয়াও ছুটল সোজা পথটা ধরেই ।
উঁচু উঁচু পাটের গাছ ক্ষেত ভরতি । মুনিয়া দাঁড়ালেই ডুবে যায় । মুংলি যাচ্ছে পাট ক্ষেতের ভিতর দিয়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘুঙ্গুরের । আল ধরে মুনিয়াও ছুটছে । মুংলিকে ধরতে হবে যেমন করে হোক । মুংলিকে বাড়ি নিয়ে না গেলে মুনিয়ার পিঠের চামড়া থাকবে না ।
একটা আলের উপর উঠে দাঁড়াল মুংলি । মুনিয়া দেখল, ডাকল, আয়, আয় । মুখে চুমকুড়ি তুলে জানালো, আর ছুটিস্নে মুংলি । তারপর একেবারে কাছে গেল । মুংলি দাঁড়িয়ে এখনও । হাত বাড়িয়েছে গলায় হাত বুলিয়ে আদর করবে - অমনি আবার দিয়েছে ছুট, এবার নিশ্চয় বাড়িতে গিয়েছে - ভেবে নিয়ে মুনিয়াও বাড়ির পথ ধরল ।
খালের পাড় অবধি আসতেই আবার শুনতে পায় মুনিয়া সেই ছেলেটার ডাক, ও মুনিয়া, চেয়ে দ্যাখ্ তোর বাছুর আবার এসেছে আমাদের বাড়িতে ।
মুনিয়ার এবার কান্না পেল । আর সে ছুটতে পারছে না । পেটে খিল ধরে গেছে । মুংলির উপর ভীষণ চটে উঠে দুহাত জোড় করে ওর বাবার মতো বলল, ভগবান, আমাকে মুংলির মতন বাছুর করে দাও । তা না হলে ওর সঙ্গে ছুটব কেমন করে ।
নবীদের ঐ বাছুরটা কি মুংলিকে যাদু করছে ! তা না হলে ওটা এমন বার বার ছুটে আসে কেন ? মুংলি কি মুনিয়াকে আর আগের মতো ভালোবাসে না ভাবতে ভাবতে মুনিয়া দেখে - চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে । সন্ধে কখন উতরেছে সে কথা বুঝতে পারেনি ।
[ক্রমশ:]