• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • শঙ্খমালার সঙ্গে একটা বিকেল : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    এখনো অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে গৃহীত। গল্পের পটভূমিকা আশির দশকের দিল্লী।


    ঋতুওয়ালীদের মার্কেটিং






    আমার স্কুল খুলতে আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। পম্পার চণ্ডীগড়ের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। সে বলল – এখন আর তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুই আমার সঙ্গে চ’।

    - কোথায় থাকব?

    - কেন? হোস্টেলে, আমার ঘরে। মেয়ে সেজে থাকবি। আমার নাটকের গ্রুপ থেকে তোকে একটা উইগ এনে দেব। হালকা একটু লিপস্টিক। কেউ ধরতে পারবে না।

    - ধরা পড়লে কী হবে জানো?

    - আমাকে তো কলেজ থেকে বের করে দেবে। তার দুঃখ নেই। কিন্তু তোর কী হবে বয়ম্যান?

    - বলে দিচ্ছি। গণ-ঠ্যাঙানি।

    পম্পা আর আমি কনট প্লেসে ছোটখাটো কেনাকাটা করছিলাম। পম্পা একটা সালোয়ার স্যুট হাতে নিয়ে তার মুডের সাথে মানাবে কিনা পরীক্ষা করে দেখেছিল। তারপর সেই দোকানটা আমাদের পিছনে একটা বছর দশেকের ছেলেকে ফেউয়ের মতো লাগিয়ে দিয়েছে। যেখানেই যাই, সে হঠাৎ পিছন থেকে দৌড়ে এসে উদয় হয়। হাতে একটা নতুন সালোয়ার স্যুট। পম্পা যেই চোখ পাকিয়ে বলে – না—আ-আ, অমনি সে পালিয়ে যায়।



    জনপথে পম্পাকে দেখে আমাদের মুখোমুখি হেঁটে আসা দুটি স্টাইলিশ মহিলা স্ট্যাচু হয়ে থেমে গেলেন। হ্যালো, হাই বলে মেয়েরা সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরতে লাগল যেন কতদিন পরে দেখা। পরে জানলাম পাড়াতুতো বোন। গলায় গলায় না হলেও, দেখা সাক্ষাতে ভাব। তিনজনেই কলেজে ভর্তি হচ্ছে এই বছর। যার নাম সপ্‌না তার চোখে একটা ঢাউশ সান-গ্লাস। তানিয়া বলে অন্যজনের হাতে একটা কাঠের বুদ্ধমুর্তি। জনপথের দোকান থেকে তাকে গছিয়ে দিয়েছে।

    পম্পা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল রাইটার ফ্রেণ্ড বলে।

    - ও মাই গশ! অলরেডি পাব্লিশ্‌ড্‌ রাইটার! তানিয়া রাস্তার মাঝখানে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল। সপ্‌না তার সানগ্লাস খুলে আমার মুখটা ভালো করে দেখে বলল – সেই জন্যই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। আপনি ইউনিভার্সিটির ফেস্টিভালে গতবছর স্টেজের একধারে বসে ছিলেন না? কিন্তু কোনো কথা বলেননি। শুধু একমনে লিখে যাচ্ছিলেন।

    আমি ইউনিভার্সিটির ফেস্টিভালের দিন নির্ঘাত ইস্কুলে নরহরিবাবুর ইতিহাসের ক্লাসে বেতের বাড়ি খাচ্ছিলাম। পম্পা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল – জয় স্টেজে উঠে মড়ার মতো স্টিফ হয়ে যায়। আমাদের ইস্কুকের নাটকে বোবার রোল পেয়েছিল। সেটাও ঝুলিয়েছে।

    আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য পম্পার বন্ধুরা নাছোড়বান্দা। পালাবার পথ নেই। অতএব, পম্পার কথামতো আমরা রিভোলির কাছাকাছি একটা দোকানে ঢুকে কোল্ড কফি নিয়ে বসলাম।



    দেখলাম যে আমাকে লেখক বলে পরিচয় দেওয়ার পর আর কেউ কলেজে ঢুকেছি কিনা জিজ্ঞেস করেনি। সপ্‌না বলল – আপনাকে এত ইয়াং দেখতে! কী অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন?

    বাড়িতেও এই প্রশ্নটা করে। একটা উত্তর আমার তৈরীই ছিল। বললাম – দেখুন আমি থ্রিলার উপন্যাস লিখছি। তার মধ্যে অভিজ্ঞতাপ্রসূত হওয়া সম্ভব এমন ঘটনা ঢোকানোই বারণ। এছাড়া আমার মামাবাড়ির পারিবারিক ইতিহাস খুব শকিং। সেখানকার মাল-মশলা দিয়ে ছোট ছোট ভূতের গল্প, আই মীন ব্রিটিশ ভূতেদের অবক্ষয় এবং অন্যান্য সামাজিক দুর্ঘটনার পরীক্ষামূলক লেখা আছে। সেগুলো সব শোনা গল্প।

    পম্পা সহজ করে বলল – সামাজিক দুর্ঘটনা মানে জয় প্রেমের কথা বলছে। তোরা ওকে আপনি-আপনি করছিস কেন? ও তো আমাদেরই বয়সী।

    পরে তানিয়া হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলল - প্রেম একটা সামাজিক দুর্ঘটনা? এটা দারুণ বলেছ জয়। আমিও বিশ্বাস করি প্রেম একটা অ্যাকসিডেন্ট। কপালে লেখা থাকে। হওয়ার হলে ঠেকানো যাবে না। ভাবছ আমি খুব ফ্যাটালিস্টিক? এই যে বুদ্ধ মূর্তিটা কিনেছি দেখছ, এটা তাকের সেই উপরে রাখা ছিল। আমি পাশ দিয়ে যাওয়া মাত্র ধপাস করে পড়ে গেল। দোকানদার এসে বলল – ম্যাডাম আপনাকে দেখে মূর্তিটা লাফ দিয়েছে। এটাকে নিয়ে যান।

    পম্পা হাঁ হয়ে বলল – সেই জন্য কিনেছিস? আমি অনেকক্ষণ ধরে সেটাই ভাবছি। তোরা গোঁড়া ক্রিশ্চান ফ্যামিলি। এখন এই বুদ্ধমূর্তি বাড়িতে নিয়ে ঢুকবি কী করে?

    - সেটাই তো দেখতে হবে। তানিয়া চোখ গোল গোল করে বলল। - মূর্তিটা যদি সত্যিই আমার সঙ্গে যেতে চেয়ে থাকে তাহলে বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থাও সে-ই করবে। তাছাড়া বুদ্ধ তো প্রি-ক্রিশ্চিয়ান, তাই না? ক্রাইস্টের জন্মের আগেই বুদ্ধ মারা গিয়েছিলেন। আমার মায়ের বিশ্বাস বুদ্ধ ক্রাইস্টের পরে জন্মালে তাঁর ইতিহাস অন্যরকম হতো। যখন তিনি গাছের তলায় বসে সাধনা করছিলেন তখন নিশ্চয়ই তাঁকে কোনো দয়ালু নান চার্চের ভিতর নিয়ে আসত। তারপর কি আর ক্যাথলিক না হয়ে তাঁর কোনো উপায় থাকত?

    - কিন্তু বুদ্ধ যদি আমাদের সঙ্গে জন্মাতেন তাহলে তিনি কী হতেন জানিস? বলল সপ্‌না।

    - কী? কী? আমরা সবাই এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।

    - হায়ার সেকেণ্ডারিতে ফেল। যেরকম আমি। ঠোঁট উলটে বলল সপ্‌না।

    কফি এসে গিয়েছিল। গরমের চোটে সবাই প্রথম চুমুকে অর্ধেক উড়িয়ে দিল। পম্পা বলল – সপ্‌না তুই মোটেও ফেল করিসনি। ভালো কলেজেও তো পড়তে যাচ্ছিস শুনলাম।

    - আরে ওটা কলেজ নয়, বাবার মক্কেলের দোকান। আমার বাবা তো উকিল। তাঁর এক মক্কেল নিজের কলেজে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেটাও একটা কালো টাকা সাদা বানাবার ফ্যাক্টরি। সবাই ক্যাশ দিয়ে পড়ে। আমি পড়ব ফ্যাশন ডিজাইন। আসলে টাকার সঙ্গে সঙ্গে গুচ্ছের কাপড় নষ্ট করব। ফিরে আসার পর বাবা বলবে যাও আবার থেকে শুরু করো, ল’ পড়ো গে যাও।

    এমনভাবে বলল সপ্‌না যে আমরা সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করলাম।




    আমাদের টেবিলের উপর সান্ধ্য টাইম্‌স কাগজের শেষ পাতাটা ফেলা ছিল। অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম তাতে বেদীর উপর শোয়ানো সাদা কালো একটা মড়ার ছবি। আমি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবরটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম। সপ্‌না কাগজটা তুলে সবাইকে হেডলাইনটা দেখিয়ে দিল।

    যমনা-জী সে উঠা, মটকা কো লুটা


    তারপর সপ্‌না খবরটাও পড়ে দিল। যমুনা থেকে একটা লাশ উঠে ভবিষ্যত বলতে শুরু করেছে। তার বাতলানো নম্বর খেলে নাকি মটকায় এক হাজার টাকা জিতেছে একটা বুড়ি।

    সপ্‌নার কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে ভালো করে পড়ে আমি বললাম – আরে এটা তো আমাদের বেতাল। শিমলিপুরে এর একটা আখাড়া আছে। আমি গিয়েছি। কিন্তু এখানে যেটা লিখেছে সেটা ঠিক নয়। আখাড়াটা যিনি চালান তিনি বেতালনী নন। বেতালের পাতানো বোন। আমার বন্ধু অক্কির মাসি। তাই বেতালটা এখন অক্কির নতুন মামা।

    - কী দেখলে? মুর্দা জিন্দা হয়ে গেছে? সপ্‌না জিজ্ঞেস করল।

    - তাই তো বলছে লোকে। জিন্দা ঠিক হয়নি। শরীরটা মরে আছে। পচা গন্ধ বেরোয়। কিন্তু সেটা নড়তে চড়তে পারে। কথা বলে।

    - ও মাই গড! তানিয়া বলল। জাজমেন্ট ডে’র আগেই ব্যাটা উঠে এসেছে। কী স্যাটানিক ব্যাপার! হাউ টেরিবল্‌।

    পম্পা হঠাৎ নাকি সুরে আব্দার করে বলল – আঁমি এঁই বেঁতালটাঁকে দেঁখতে চাঁই।

    আর যায় কোথায়, সঙ্গে সঙ্গে সপ্‌না আর তানিয়াও যোগ দিল। আঁমি এঁই বেঁতালটাঁকে দেঁখতে চাঁই। আঁমি এঁই বেঁতালটাঁকে দেঁখতে চাঁই।

    আমি কাগজটাকে ভাঁজ করে রাখছিলাম। তানিয়া বলল – জঁয়, তুঁমি আঁমাদের দেঁখিয়ে আঁনবে প্লীঁজ ?

    - আচ্ছা আচ্ছা নিয়ে যাব। নাকি সুরে বলতে হবে না। কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, সত্যিই মড়ার মতো গন্ধ বেরোয় বেতালের গা দিয়ে। আমার বমি পেয়ে যাচ্ছিল।

    তানিয়া বলল – চিন্তা কোরো না। যাব আর আসব। দাঁড়াব না বেশিক্ষণ। শুধু ভবিষ্যতটা জেনে নেব। আমি জানি আমার ফেট-এ কোনো গণ্ডগোল আছে। সামথিং ফিশি। এই বুদ্ধের মুর্তিটা কিছু একটা বিপদের আভাস দিতে চাইছে। তাছাড়া ভাগ্যে কোনো সামাজিক দুর্ঘটনা আছে কি নেই...। সেটাও তো জেনে আসতে হবে?

    - মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলেছিস। কলেজে থাকতে থাকতে যদি চক্কর না চলে তবে বেঁচে কী লাভ? আমি তো ঠিক করেছি তাহলে সুইসাইডই করব। তার জন্য ছটা অ্যাস্পিরিন জমিয়েছি। গর্বের সাথে বলল সপ্‌না।

    সবাই সপ্‌নার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। তার চোখ মুখে এমন একটা আন্তরিক ছাপ যে এটা যদি ঠাট্টা হয় তাহলে তাকে একটা ফিল্মফেয়ার বেস্ট্‌ অ্যাক্‌ট্রেসের পুরস্কার দেওয়া উচিত। পম্পা বলল - ছটা অ্যাস্পিরিন খেলে মানুষ মরে যায়? আমি তো ভাবতাম মুঠো মুঠো খেলেও কিছু হয় না।

    - তোরা জলের সঙ্গে খাস তো? সুইসাইড করার জন্য সোডার সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়। বিজ্ঞের মত জানাল সপ্‌না।

    কথাটা সত্যি না মিথ্যে আমি বা পম্পা জানি না। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

    সপ্‌না আমাকে বলল – যদি খুদকুশী করি তো আমার জীবন নিয়ে একটা শর্ট স্টোরি লিখবে প্লীজ ? তাহলে মরে গিয়েও গল্পের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারব। তোমার চেনা কজন লোক এই বয়সে সুইসাইড করেছে বলো? এরকম স্টোরি কি সবসময় পাওয়া যায়?

    পম্পা আমার দিকে বেশ একটু গর্বের সঙ্গে তাকাল। যেন আমি কোনো জাদুকর। চাইলেই তার বন্ধুকে অমর করে দিতে পারি। তানিয়া ঝটপট তার কোল্ড কফি নামিয়ে রেখে বলল – দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই অ্যাস্পিরিনের আইডিয়াটা সপ্‌নাকে কে দিয়েছিল? আমি। সেটা লিখতে ভুলো না।

    সপ্‌না সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তানিয়ার দিকে তাকাল আর তানিয়াও উৎসাহ পেয়ে বলে চলল – জানো, আমার স্বপ্নে একবার জিসাস ক্রাইস্ট এসেছিল। দেখলাম আমাদেরই বয়সী একটা ছেলে। ভালো করে দাড়ি গজায়নি। চোখে টল টল করছে জল। তার মাথায় নাকি ভীষণ ব্যথা। চার্চের বেদীর উপর বসে সে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগল। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার চেয়েও কষ্টকর সেই মাথাধরা। সেটা দেখে তখন আমাদেরও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এমন সময় মৃদু অরগ্যান বেজে উঠল আর কেউ আমাদের বলল – যাও, গিয়ে জিসাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। যেমন বলা তেমন কাজ। স্বপ্নেই এরকম হয়। আমরা সবাই লাইন করে নিজেদের পিউ ছেড়ে বেরিয়ে জিসাসের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা করে বড়ি তার হাতে ধরিয়ে দিতে শুরু করেছি। সবার হাত বুলোনো শেষ হলে জিসাস তার বড়ির স্তূপ থেকে থেকে ছটা বড়ি বেছে একটা বড় বোতল সোডা দিয়ে খেয়ে বলল – এবার আমার মাথা ব্যথা সেরে যাচ্ছে। আমি ঘুমোব। এই বলে সে আস্তে আস্তে বেদীর উপর লুটিয়ে পড়ল। আর আমরাও কীভাবে যেন বুঝে গেলাম সেই ঘুম আর ভাঙবে না। সেটা বুঝে যাওয়ার পর চার্চ সুদ্ধু লোক পা টিপে টিপে গীর্জা ছেড়ে বেরিয়ে এসে যে যার পথে চলে গেল।

    - জিসাস ক্রাইস্ট! বলল পম্পা। - হোয়াট এ সিক মাইণ্ড!

    - আই নো। তানিয়া নিঃসঙ্কোচে জানাল। - সেইজন্য আমি চা-কফি কিচ্ছু খাই না। ডান্স্‌ আর মেডিটেশান করি। কিন্তু আশ্চর্য হল এই যে আমাদের চার্চে অনেকেই সেম টু সেম স্বপ্নটা দেখেছে। সবাই বলেছে যীশু একটা অল্প বয়সী ছেলে। আর সে ছটা বড়ির বেশি নেয়নি।

    - তানিয়া, তুই সবার আগে এত বড় একটা কোল্ড কফি শেষ করে বলছিস চা-কফি খাস না?

    তানিয়া লজ্জা পেয়ে বলল – একজন রাইটারের সঙ্গে বসে আছি। তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি। চা-কফি খেলে আমার মেন্টাল পাওয়ার শো-অফ করার জন্য হ্যাংলার মতো বেরিয়ে আসে। জয়, স্বপ্নের কথাটা শোনা মাত্র তোমার মাথায় ব্যথা শুরু হয়েছে, তাই না? অ্যাস্পিরিন চাই তোমার?

    হাতের কফি চলকে গেল। লর্ড ইন হেভেন! ব্রিটিশদের মতো বড়লাটকে স্মরণ করে চমকে উঠেছি আমি। যীশুর গল্প শেষ হওয়ার আগেই মাথার বাঁদিকটা সত্যি ধাঁ করে ধরে গিয়েছিল! কোথাও থেকে একটা অ্যাস্পিরিন যোগাড় করতে হবে ভাবছিলাম। সেটা এই পার্কটাউনের মেন্টাল কেস জানল কী করে?

    - মানে-মানে...।

    তানিয়া আমার দিকে তার গোলাপী নেল-পলিশ পরা একটা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল – আমি তোমার মাথার বাঁদিকটা একটু টাচ্‌ করতে পারি?

    ঝট করে চেয়ারটা পিছিয়ে দিয়ে আমি একটু জোরের সঙ্গে বললাম – না!

    - ভয় পেও না। তোমার ব্যথা আমি কমিয়ে দেব।

    - দয়া করে আমাকে ছুঁয়ো না তানিয়া!

    - কেন?

    - আমার মাথা তাহলে তরমুজের মতো ফেটে যাবে। বোকার মতো বললাম আমি।

    - ঠিক আছে, ঠিক আছে। টাচ্‌ করছি না।

    এটা বলার পরেও তানিয়া তার গেলাশ থেকে কাগজের স্ট্র বের করে আস্তে আস্তে আমার মুখের দিকে তার হাতটা বাড়াতে লাগল। আমিও ক্রমশ চেয়ারে হেলান দিতে দিতে মাথা পিছোচ্ছি। ‘ভয় নেই, ভয় নেই’, বলতে বলতে তানিয়া স্ট্র দিয়ে আমার কপাল স্পর্শ করেই ছাড়ল।




    পরে আমরা চারজন পালিকা বাজারের শীততাপ-নিয়ন্ত্রিক গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। আগে আগে পম্পা, তানিয়া আর সপ্‌না। তাদের চেয়ে এক পা পিছিয়ে আমি। আমার হাতে কাঠের বুদ্ধমূর্তিটা ধরিয়ে দিয়েছে ওরা। প্রতিটি দোকানে থামছে। সব রকমের পণ্য হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আদেখলার মতো। আধঘন্টা এরকম চলার পর বুঝে গেলাম এরা দোকানদারদের হয়রান করে ছাড়বে, কিন্তু কেউ কিচ্ছু কিনবে না। তারপর থেকে লজ্জায় আমি দোকানের বাইরে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়াতে লাগলাম।

    পুরো বাজারটা ঘোরার পর যখন তিন বন্ধু দ্বিতীয়বার একই গলিতে ফিরে এসেছে তখন আর থাকতে না পেরে তাদের পথ রোধ করে বললাম অন্তত একজনকে কিছু কিনতে হবে, নইলে আমি ওদের সঙ্গে যাব না।

    পম্পা বলল – এই রে, জয় ক্ষেপে গেছে। আর মার্কেটিং হবে না।

    সপ্‌না বলল – আরে রাইটার তুমি গোলগাপ্পার দোকানে বসে একটা গল্প লেখো না! আমরা ততক্ষণে বাজারটা সেরে ফেলি।

    মাথার ব্যথাটা চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এল। আমার কাছে কাগজ নেই কলম নেই। তার উপরে বেশিক্ষণ বসলে দোকান থেকে তুলে দেয়। তা সত্ত্বেও বজ্জাত মেয়েটা বলছে বসে লিখতে।

    - কীসের বাজার করতে এসেছ তোমরা? সেই জিনিসটার কোনো নাম আছে?

    - অফ কোর্স্‌! ফর ইয়োর ইনফর্মেশন - ডিসেম্বরে আমার দিদির বিয়ে। তার আগে একটা ভালো নেল-পলিশ কিনতেই হবে। সপ্‌না বিবেকানন্দের মতো দুই হাত বগলের তলায় সেট করে বলল।

    - ডিসেম্বর আসতে পাঁচ মাস বাকি! ততদিন ধরে এই গরীব দোকানদাররা তোমার জন্য চাকরের মতো খাটবে?

    সপ্‌না ভুরু কুঁচকে পম্পার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল – কমিউনিস্ট হ্যায় কেয়া?

    পম্পা নিজেকে বামপন্থী বলে চালায়। সমাজ বদলাবার নাটক করে। সে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে বলল – জয়, এরা গরীব এই খবর তোকে কে দিয়েছে? এক একটা দোকান থেকে লাখ লাখ টাকা রোজগার। আমাদের পাড়ায় যাদের তিনতলা বাড়ি সেই পিচ্চুদের একটা দোকান আছে এখানে।

    - তোমার পিচ্চু নিজে এই দোকানে এসে বসে? না কম মাইনের লোক দিয়ে চালায়?

    - হ্যাঁ, বাই গড বসে। আজকে ওর কোনো আত্মীয়কে বসিয়ে রেখেছে।

    তানিয়া আঙুলটা বাড়িয়ে আবার আমার মাথায় ঠেকাবার জন্য এগিয়ে আসছিল। বেজি যেভাবে সাপের ছোবল এড়ায় সেভাবে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। তানিয়া বলল – আমাকে ভুল বুঝো না রাইটার। মেন্টাল পাওয়ার না থাকলে আমিও কমিউনিস্ট হতাম।

    - কমিউনিস্ট না হলে মানুষের সময়ের দাম দিতে নেই? ভদ্রতা বলেও তো একটা জিনিস আছে?

    - তোমার গরীব দোকানদাররা আজকে কী করেছে জানো? বুদ্ধটার গায়ে তিনশো টাকার টিকিট লাগিয়ে রেখেছিল। আমি বললাম – মাত্র দশ টাকা আছে খাবারের জন্য। তখন ওরা আমাকে দুদিক থেকে ব্লক করে হাতের ব্যাগটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। মেয়েদের ব্যাগ কেড়ে নেওয়াটা কি ভদ্রতা?

    - তা আমি বলিনি।

    - ব্যাগ খুলে এমার্জেন্সির জন্য রাখা লাস্ট একশোর নোটটা পেয়ে যায়। বুদ্ধের সামনে আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার কী নোংরা প্রচেষ্টা! ঘেন্নার চোটে নোটটা ওদের রেখে নিতে বলি। দশ টাকা ফেরত পেয়েছিলাম খাবারের জন্য। তাও আমি চাইনি। ওরা নিজের থেকেই দিয়েছে। এখন আমার তো একটা সুতো কেনারও ক্ষমতা নেই।

    - তানিয়া, তুমি তাহলে এরকম ডজন ডজন সালোয়ার স্যুট আর ড্রেস মেটিরিয়াল নামিয়ে দেখছ কেন? আমার পাশে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছ না কেন?

    - কারণ তুমি আমাকে টাচ্‌ করতে বারণ করেছ। আর বুদ্ধটাকে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছ, যেন ওটা তোমাকে মেয়েদের ছোঁয়া থেকে বাঁচাবে।

    - কী বুলশীট্‌! এটা তুমিই আমাকে ধরতে বলেছিলে!




    পম্পা শকুন্তলার মতো তার মোহিনী হাসিটা বার করে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। আমি আবার পিছিয়ে গিয়ে ছোঁয়া এড়ালাম। সে বলল – আমি জয়কে নিয়ে কোথাও বসছি। তোরা বাজারটা শেষ করে আয়। তারপর একসঙ্গে লাঞ্চ করা যাবে।

    - না, না। আমার জন্য তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে না। একাই কোথাও গিয়ে বসব আমি।

    কিন্তু পম্পা ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আমার হাত ধরার চেষ্টা করছে না।




    আমরা দুতলায় একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। পম্পা বলল – তোর প্রবলেমটা কী? আজ সকাল থেকে তুই আমাকেও দূরে দূরে সরিয়ে রাখছিস!

    পকেট থেকে দুটো শুকনো গাঁদা ফুল মুখ বের করেছে। বেতালের অর্ঘ্য। এখনো পকেটেই ঘুরছে। সে দুটো বেঞ্চের উপর নামিয়ে রাখলাম। পম্পাকে অক্কির নতুন মামা আর পুরোনো মাসীর কার্যকলাপের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বললাম ফুলদুটো শিবের মন্দিরে দেওয়া চাই এবং এক মাস ঋতুওয়ালী মেয়েদের স্পর্শদোষ এড়াতে হবে। নইলে মাথার জায়গায় একটা লাল রঙের ফাটা তরমুজের প্রাপ্তিযোগ আছে।

    - ঋতুমতী মানে হচ্ছে ...।

    - সেটা আমি জানি। ঋতুওয়ালীটা কী?

    - হুম্‌। ওটা নিশ্চয়ই একটা বানিয়ে দিয়েছে। যে বলেছে তাকেই জিজ্ঞেস করিসনি কেন? আর তুই এসব অকাল্ট শাস্ত্রে কবে থেকে বিশ্বাস করছিস?

    বিরসবদনে পম্পাকে বললাম, কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সকাল থেকে যেই না কোনো অল্পবয়সী মেয়ের কাছাকাছি যাচ্ছি, অমনি মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে। - ব্যথার ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে দ্যাখো।

    - টাচ্‌ করে দেখব?

    - সেই রিস্কটা নেওয়ার আগে একটু চিন্তা করা উচিত।

    - ফর ইয়োর ইনফর্মেশন জয়, আমি আজ ঋতুমতী নই।

    সামনে পম্পা মুখার্জী নামের হলুদ জামা পরা একটি অভয়ের বালুচর। আমার মনে কৃতজ্ঞতার ঢেউয়ের পর ঢেউ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও বেরিয়ে গেল নাক দিয়ে। গলাটা কোমল করে বললাম – দ্যাখো, কিছু মনে কোরো না। খবরটা জানাবার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। কিন্তু ঋতুমতী না হয়েও তো ঋতুওয়ালী হওয়া যায়। এমন হতে পারে যে কথাটার মানে রিপ্রোডাক্টিভ বয়সের মেয়ে। অর্থাৎ তোমরা সবাই। মনে হচ্ছে কোনো হিন্দী বইতে শব্দটা এই অর্থে দেখে থাকতে পারি।

    - ও বুঝেছি, রাইটার। তোর মাথাটা ঋতুওয়ালীদের রাডার হয়ে গেছে! তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এখন পিঁক পিঁক করে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। পম্পা হাসি চেপে বলল।

    ছি, ছি, ছিঃ। ধিক্‌! অক্কির মামা-মামীর পাল্লায় পড়ে কীরকম হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছি নিজেকে। পম্পার খুব উচিত হয়েছে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করা। বাঙালের ছেলের কী অধঃপাত! নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিল। কোথায় আমার মাথার ব্যথা? কীসের এই বেতাল? বেতাল তো নয় একটা জোচ্চোরদের দল ছেড়ে পালিয়ে আসা শেয়াল। ঋতুমতীদের দারোয়ান বানিয়ে দিয়েছে আমায়।

    প্লেটটা পম্পার দিকে ঠেলে বললাম – ঢের হয়েছে। চলো বাড়ি যাই।

    - কেন, জয়? তাড়া কীসের?

    - তোমার ঘরে গিয়ে আজ দেখব মাথা ফাটে কিনা।

    - আমি ছুঁলেও পালাবি না? ঋতুমতী নই বলে সাহস বেড়ে গেছে বুঝি?

    - আর লজ্জা দিও না। আনন্দ্‌ বকশীর সাবধানবাণী কী বলছে শোনো। কথা ঘোরাবার জন্য বললাম।

    - কোনটা? কোনটা? পম্পা তার লালচে-বাদামী রোদ-চশমা চুলের উপর তুলে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

    আমি তার চোখে চোখ রেখে মনে মনে বলছিলাম -
          রোক রহা হ্যায় হমকো জমানা
          দূর হী রহ্‌না পাস ন আনা
          ক্যায়সে মগর কোই দিল কো সমঝায়ে –

    মুখে কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না কারণ আমার তিনটে আঙুল পম্পার সোনালী ঘড়ি পরা কবজি ছোঁয়ার আগেই ইলেক্ট্রনিক্‌সের দোকানগুলো থেকে এক ডজন গানের কাকলির মধ্যে স্যাক্সোফোনে বাহিত হওয়া শচীন দেবের একটা সুর আমাদের মতো আনাড়িদের সাবধান করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমি চোখ দিয়ে পম্পাকে বললাম ওই শোনো সে বলছে - রূপ তেরা মস্তানা, পেয়ার মেরা দিওয়ানা। আর বিশেষ করে - ভুল কোই হমসে না হো যায়ে...। দেখতে দেখতে পম্পার ধমনীর স্পন্দনও তার তালে ধুক পুক করে উঠেছে। সে বলল – জয়, তোর বকশীজী পই পই করে এত বারণ করার পরেও কী হয়েছিল জানিস?

    - কী?

    - হিরোইন প্রেগনেন্ট। দেখতে দেখতে বাচ্চা হয়ে গেল। এদিকে বিয়ে হয়নি। কিন্তু আমি সেই সব করতে আসিনি। আজকে দিল্লীর রাস্তায় তোর সঙ্গে ঘুরতে এসেছিলাম। তিন বছর দিল্লী ছেড়ে থাকতে হবে আমায়। কী কষ্ট যে হচ্ছে!

    সে তো হবেই। আমি কি বলেছিলাম চণ্ডীগড়ে যেতে?

    পম্পার হৃদয়ের রেলগাড়িতে চেপে আমি একদিন হারানো কোনো দিল্লীর স্টেশনে এসে থেমেছিলাম। আমার মাথায় ছিল ফেল্টের টুপি। পম্পা পরেছিল লাল সিল্কের ফিতে বাঁধা বেতের একটা পানামা হ্যাট। হাতে সাদা দস্তানা। কেতাদুরস্ত বিলিতি পোষাক। রেলগাড়ি থেকে নেমে যমুনার তীর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা সরাইখানায় এসে উপস্থিত হয়েছি। পম্পার দস্তানা পরা হাত দরজাটা একটু ঠেলতেই সেটা সুঁই করে খুলে গেল। ভিতরে চারজন পেশোয়ারি পাগড়ি পরা ছোটখাটো চেহারার মধ্যবয়স্ক লোক বসে একসঙ্গে মাস্তানের মতো হাসছিল। তাদের হাতে রূপোর পেয়ালায় মদ। রেশমের জোব্বার উপর সবার একই রকম কালো দাড়ি। পম্পা জিজ্ঞেস করল – তোমাদের মধ্যে আসাদ কার নাম? চারজনেরই চোখ ঝিক মিক করে উঠেছে প্রশ্নটা শুনে। ‘আমি না, এ। আমি না, এ।’ চার ইয়ার চক্রাকারে নিজের বাঁদিকে বসা সঙ্গীর দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। পম্পা কেঁপে উঠে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল - তুই এখান থেকে নড়িস না জয়।

    নড়ব কেন? আসাদের শহর ছেড়ে কেউ যায়?




    বেঞ্চের উপর আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেট এসে পড়ল। জীর্ণ গেরুয়ার উপর সবুজ সুতোয় কাজ করা সাদামাটা অথচ ভারি সুন্দর সালোয়ার স্যুট। সেই সঙ্গে বছর দশেকের ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসি উপহার দিচ্ছে। পম্পা আর আমি সোজা হয়ে বসলাম।

    - তুই অ্যা-অ্যা-অ্যা-অ্যাতদূর ধাওয়া করে এসেছিস? পম্পা থ’ হয়ে গিয়ে বলল। - কী করে খুঁজে পেলি?

    - দিদি আমি জানতাম আপনারা এখানে কোথাও খেতে আসবেন। মালিক বলেছে এই জামাটা আপনার ভালো লাগবেই লাগবে।

    - লাগছে ভালোই। কিন্তু আমি কিনব বলে আসিনি। দেখব বলে এসেছিলাম। কেন তোর মালিক তোকে এরকম বেগার খাটাচ্ছে বলতো?

    - আপনি কিনে নিন। আপনাকে ভালো দেখাবে। ছেলেটা পাক্কা সেল্‌স্‌ম্যানের মতো নিজের গৎ আউড়ে দিল।

    - শোন তুই আমাদের পিছা ছাড়ার কী নিবি? তোকে একটা আইসক্রীম কিনে দিলে তুই দফা হবি?

    দেখা গেল বালকটি জ্ঞানবৃদ্ধ। সে বলল - কেন ফালতু আইসক্রীম কিনে পয়সা নষ্ট করবেন? এটা শস্তাও আছে। এটা নিয়ে যান।

    - আমি কী করব না করব সেটা আমি জানি। তোকে জ্ঞানাতে হবে না।

    পরের দৃশ্য। পম্পা উঠে স্কার্ট ঝেড়ে হাঁটতে শুরু করেছে। ছেলেটা আমার কাঁধে ধাক্কা মেরেই চলেছিল। - তুমি বলো। তুমি বলো। আমি ওর হাত থেকে ডিস্কাউন্ট করা দামের চিরকুটটা কেড়ে নিয়ে পম্পাকে দেখিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। আর যায় কোথায়। পম্পা মুখার্জি রেগে আগুন হয়ে দপ দপ করে ফিরে এসে বলল – লজ্জা করে না? একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে এইভাবে ব্যবহার করতে হয়? তুই কি মানুষ?

    - সিস্টার এটা একটা সেল্‌স্‌ম্যান। এর কোনো বয়স নেই, জাত নেই, জেণ্ডার নেই। শুধু অ্যাজেণ্ডা আছে। কী করে একটা মাল গছানো যায়।

    - জয়, তুই একটা পশু। না। তাতে পশুর অপমান হয়। তুই একটা... একটা... বাজে লোক।

    পুঁচকে সেল্‌স্‌ম্যান আমার দিকে তাকিয়ে বেহায়ার মতো হাসছিল। আমিও তার দিকে তাকিয়ে বেশরমের মতো হাসতে লাগলাম। পম্পা আরো ক্ষেপে গিয়ে ছেলেটাকে ধরে বলল – তুই এর কাছ থেকে দূরে যা! আমি তোকে আইসক্রীম কিনে দিচ্ছি চল।

    - না, না, ভাইয়া-জী কিনবে বলেছে। ছেলেটা আমার জামা খিমচে ধরে দাঁড়িয়ে গেল।

    - ভাইয়া-জী তোকে আরো কষ্ট দেবে। তুই যা! পম্পা ছেলেটাকে শার্ট ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে টানছে। কিন্তু সেই উল্লুকও গাছের ডালের মতো আমার বাহু জড়িয়ে লটকে গেল।

    আমি পম্পাকে বললাম – মনে হচ্ছে সে্‌ল্‌স্‌বয় আমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। তোমাকে আরেকটু জোর লাগাতে হবে।

    ক্ষুব্ধ পম্পা ধপাস করে হাতের লোড ফেলে দিল। চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। ছেলেটার বোকামি তার মাথায় ঢুকছিল না। আসলে ছেলেটা খুব চালাক। সে জানত আমি স্যুট কিনব বলেই চিরকুটটা হাতে নিয়েছিলাম। পকেট থেকে পয়সা বার করে গুনে গুনে পঁয়ষট্টি টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম – খুচরো ফেরত আনতে হবে না। তোর দিদি চায় না তুই আমার কাছে আসিস।

    টাকা নিয়ে বালকটি বুলেটের মতো অন্তর্হিত হল। পম্পা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল – তুই এটা কিনলি কেন? পরবি নাকি?

    - নিশ্চয়ই। তোমার ব্লু স্কার্টের সঙ্গে একটা টপ তো চাই। গেরুয়ায় ভালো কন্ট্রাস্ট হবে।

    - ছেলেরা মেয়েদের টপ পরতে পারে?

    - স্কার্ট যদি পারে তো টপ পারবে না কেন? ব্রা-এর ভিতর দুটো তুলোর বল...।

    পম্পা ‘শ্‌-শ্‌-শ্‌-শ্‌’ শব্দে শাসিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে বলল – খোলামেলা জায়গায় এ কীরকম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করছিস তুই বাঁদর? তারপর সে ধপাস করে আমার পাশে বসে বলল – থাক আর নকশা করতে হবে না। আমি এটা নিলাম। রঙটা সত্যি সুন্দর। তবু বলছি, খরচটা না করলেই পারতিস।

    - আমি তোমার বন্ধুদের মতো কিপটে হতে পারব না।

    পম্পা উলটে পালটে স্যুটটা দেখতে দেখতে বলল – না স্যার। ওরা কিপটে নয়। হিসেব করে চলে। তোদের চেয়ে অনেক বড়লোক।

    বটে? মেজো মামা একটা লরঝরে সাইকেল চালায় বলে আমাদের আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে যা ইচ্ছে ভাবতে শুরু করেছে লোকে। এই জন্য কতবার যে বাড়িতে বলেছি একটা স্কুটার কিনতে! কেউ শোনেনি। মামাগুলোর না আছে সাহস, না আছে মুরোদ। মা একটা তলোয়ার কিনতে চেয়েছিল, সেটাও বাতিল করে দিয়েছে। বাড়ির প্রতি শ্রদ্ধা কমে গেলেও গলাটা খাঁকারি দিয়ে বললাম - শোনো, আমার মামারা একটু গরীব হতে পারে। কিন্তু মা সলিড মিড্‌ল্‌ ক্লাস। আর ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে আমি এই তানিয়া-মুনিয়ার চেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যাব। সেল্‌স্‌ম্যানরাও আমাকে চিরকাল ওদের চেয়ে বেশি পছন্দ করবে।

    পম্পা পাখির মতো ঘাড়টা একটু টান করে বলল - মোটেও না। সেল্‌স্‌ম্যানরা মেয়েদেরই কাস্টমার হিসেবে চাইবে। মেয়েরা নিয়মিত বাজারে আসে। এবং লয়াল। এই বাচ্চাটা কি তোর মুখ দেখে আমাদের পিছনে ঘুরছিল? নো স্যার। ও আমার পিছু নিয়েছিল। পরের দিন এসে আবার আমাকেই জ্বালাবে। আর একটা কথা মিস্টার। তুমি আমাকে একটু আগে আবার সিস্টার বলেছ। সেটা আমি একদম পছন্দ করি না, তুমি ভালোই জানো।

    - আচ্ছা আচ্ছা। টেরিব্‌লি সরি। বাচ্চাটা দিদি দিদি করছিল বলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাছাড়া মনটাও চঞ্চল ছিল। ভাবছিলাম এইরকম নিষিদ্ধ গেরুয়া পরে তুমি সামনে এলে আমি নিজেকে সামলাব কীভাবে?

    পম্পা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে খুব সিরিয়াসলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল – এই কয়েকটা দিন মা-বাবার সামনে কিন্তু খুব ভালো ছেলে সেজে থাকতে হবে জয়। তারপর সে আবার তার ছেলেভোলানো হাসিটা বার করে বলল – সংযম দেখিয়েই তো তুই সকলের মন জয় করে নিচ্ছিস বয়ম্যান।




    গল্পের কুয়াশা


    দুপুরে আমরা সবাই মিলে ডোসা অর্ডার করেছিলাম। যথারীতি তানিয়া আর সপ্‌না কিচ্ছু না কিনে ফিরেছে। অথচ খাবারের দোকানে ঢুকে দুজনের কাছ থেকেই টাকা বেরোল।

    পম্পার বন্ধুরা আমাকে ছেঁকে ধরল – একটা তাজা গল্প শোনাও রাইটার। অ-লেখা মাল। অনসুনী কহানী। যেটা আগে কেউ শোনেনি।

    অ-লেখা গল্প? সেটা বলতে গেলে কি হয় আমি জানি। যে শোনে সে-ই পালটে দিতে চায়। মজা দেখার জন্য বললাম - লেখা হয়নি এরকম গল্প একটা মাথায় ঘুরছে কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছি না। ঠিক কীভাবে শেষ করব সেটা মাথায় আসেনি। এখনো বানাচ্ছি।

    আর কী চাই? - বলো, বলো, সেটাই বলো! লাফিয়ে উঠল পম্পার বন্ধুরা। - আমরা হেল্প করব। এতগুলো মাথা নিয়ে বসে আছি কী করতে?




    অগত্যা আমি শুরু করেছিলাম। – এক রাজা ছিলেন।

    মৌমাছির চাকে ঢিল পড়ার মতো তিনটে মেয়ে চেঁচামেচি করে উঠল। এ আবার কী? এই বয়সে কেউ রাজা-রাণীর গল্প শোনে? আধুনিক কিছু ছাড়ো।

    - সায়েন্স ফিকশন আধুনিক নয়?

    - সায়েন্স ফিকশনে রাজা-রাণী থাকে নাকি?

    - থাকে। শুধু সায়েন্স ফিকশন নয়, এটা আবার একটা ডিটেক্‌টিভ গল্পও।

    - মরেচে! তানিয়া বলল। - গোয়েন্দা কে?

    - রাজা।

    - রাণী নয় কেন? একসঙ্গে বলল তিনজন।

    - সব গোয়েন্দা গল্পে একটা রহস্য থাকে। রাণী হল সেই রহস্য।

    সবাই একটু নড়ে চড়ে বসে বলল – ও। সেটা আগে বলবে তো। শুরু করো, শুরু করো।

    আমি বললাম – শোনো তাহলে। অবিবাহিত, সদ্য যুবক রাজা। নাম? ধরা যাক নাম হল শূর। একদিন ভোরবেলা উদ্যানে বেড়াতে গিয়ে একটি অপূর্ব রূপবতী মেয়েকে গাছের তলায় অচেতন অবস্থায় পেলেন। তার দেহে কোনো অলঙ্কার নেই। শুধু চুলের মধ্যে একটা মুক্তো বসানো সোনার কাঁটা। মেয়েটিকে তুলে এনে নিজের হাতে সুশ্রুষা করে জাগাবার পর বুঝলেন সে শুধু সুন্দরী নয়, অসামান্য বুদ্ধিমতী এবং অনেকগুলি শাস্ত্রে বিশারদা। শূর বুঝলেন এই মেয়েটিই তাঁর রাণী হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তার পরেই বেরোল একটা লোচা।

    - লোচা?

    - দেখা গেল মেয়েটির স্মৃতি বিনষ্ট হয়েছে। কুলপরিচয় তো দূর এমনকি নিজের নাম পর্যন্ত তার মনে নেই। কীভাবে এই গাছতলায় এল তাও বলতে পারছে না। বিবাহিত কিনা প্রশ্ন করা বৃথা। তবে সৌভাগ্যবশত তার অঙ্গে কোনো এমন ভূষণ বা চিহ্ন নেই যা থেকে বলা যায় সে পরস্ত্রী। শূর জানতেন অজ্ঞাতকুল হলেও গান্ধর্ববিবাহ শাস্ত্রসম্মত। মনে হল এই মেয়েটির জন্যই তাঁর মন এতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। তাহলে আর দেরী কীসের? প্রথম দর্শনেই তার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়েছিলেন রাজা যে মন্ত্রী, বয়স্য বা পারিষদদের পরামর্শ ছাড়াই মেয়েটিকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন।

    - হাউ সুইট! লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। বলল সপনা। এটা কি লাভ-স্টোরিও নাকি?

    - ও, হ্যাঁ। সেটা বলিনি আগে? ফিল্মের ম্যাগাজিনের জন্য লেখা তো? রোমান্স ছাড়া ওরা নেয় না। চলবে?

    - দৌড়বে জয়, দৌড়বে।

    - তো দৌড়োক। শূরের প্রস্তাব গৃহীত হল। বিবাহের সাক্ষী? একটা হীরামন তোতা। যে গাছের তলায় মেয়েটিকে পান শূর, তার ডালে বসে ঢুলছিল পাখিটা। তোতা পাখিরা একটু আধটু কথা বলে। এই পাখিটা অসংলগ্ন কিছু বাক্য বলছিল। যার থেকে বোঝা গেল হীরামনেরও পূর্বজীবনের স্মৃতি কোনো কারণে সম্পূর্ণ লুপ্ত। সাক্ষী হিসেবে হীরামনের উপর ভরসা করতে পারলেন না শূর। তিনি পরের দিন নেমন্তন্ন করে সারা রাজ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন রাণীর। নাম বললেন – অনামিকা।




    - বিয়ে তো হয়ে গেল। এবার ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি। শূর আর অনামিকার বিবাহোত্তর এক মাস পর গল্পের খেই আবার ধরা যাক। ইতিমধ্যে দুজনের ভাব-টাব হয়েছে। বিস্তার নিষ্প্রয়োজন। মাসের অন্তে, চন্দ্রমার কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয় যামের এক গভীর রাতে শূরের ঘুম ভেঙেছে। তাঁর বাতায়নের বাইরে উদ্যানে একটা খস খস শব্দ। শূর হঠাৎ টের পেলেন অনামিকা তাঁর পাশে নেই।

    কোথায় অনামিকা?

    শূর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আবছা চাঁদের আলোয় মাটিতে একটা কিছু হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল। শূর বললেন – কে? একটা কেউ যেন শুকনো পাতার উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল। উদ্যানের দক্ষিণ দিকে কুয়াশার পাঁচিল। তার পিছনে শঙ্খ সরোবর। কুয়াশার প্রাচীরের একটা ফাঁক দিয়ে সরোবরের উপর ভেসে থাকা পদ্মফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত কুহক মায়াবী পরিবেশ। কোথায় একটা প্যাঁচা বার বার ডেকে চলেছিল – রাজা হুপ্‌ হুপ্‌, রাজা হুপ্‌ হুপ্‌।

    আস্তে আস্তে কুয়াশার ফাঁক দিয়ে গলে শূর সরোবরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সামনে একটা জাম গাছের উপর বৃহদাকার একটি প্যাঁচা বসে রাজার নাম করে চলেছে। শূর বললেন – কে তুমি? কেন আমার নাম করছো?

    প্যাঁচাটা একদম মানুষের মতো গলায় শান্তভাবে বলল – মহারাজ সরোবরের দিকে দৃষ্টি রাখুন। সেখানে কিছু ঘটতে চলেছে।





    বলতে না বলতে জলের ধারে একটা মহান সর্পকে এগিয়ে আসতে দেখলেন শূর। সাপটা এসে মুখ তুলে হাঁ করে রইল। তারপর তার দেহটা বার বার সঙ্কুচিত আর সম্প্রসারিত হতে লাগল। গলা থেকে একটা গোল পোঁটলার মতো বস্তু তার মুখের দিকে চলে আসছিল। একটু পরে সাপের মুখ দিয়ে একটা বিশাল ও ধবল কোলা ব্যাঙ বেরিয়ে গ্যাঙর গ্যাঙ করতে করতে ঝিলে গিয়ে পড়ল।

    ব্যাঙটাকে উগরে দেওয়ার পর মহাসর্পও আস্তে আস্তে অরণ্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।

    শূর বললেন – এর মানে কী? এই মহান সর্পটি কে? কেন সে দাদুরীকে ভক্ষণ করার বদলে নিজের পেট থেকে সযত্নে মুক্তি দিল?

    প্যাঁচা বলল – অলমতিবিস্তরেন। অর্থাৎ বেশি কিছু বলব না। এই মহান সর্পরা ইচ্ছেমতো মানুষের রূপ ধারণ করতে পারে। মনে রাখুন সাপেরা কথা বলে না। মানুষ থেকে সর্পরূপে গমনের সময় স্বরযন্ত্রটিকে ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগ করা স্বরযন্ত্রটি নানা ধরণের রূপ নিতে পারে। কখনো কখনো তা ওই ধবল ব্যাঙের আকার নেয়। কেননা রাজন, পৃথিবীতে ব্যাঙের মতো শক্তিশালী কন্ঠ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব কার আছে? ভেক রূপের স্বরযন্ত্রকে এইভাবে পুষ্করিণীতে বর্জন করার রীতি। এর বেশি আজ জানতে চাইবেন না। মনে রাখুন আপনার ঘোর সঙ্কটকাল উপস্থিত।

    শূর বললেন – সঙ্কটকে আমি ভয় করি না। রাজপুরীর উদ্যানে এরকম একটা রহস্য লুকিয়ে থাকলে সেটা আমি ভেদ করেই ছাড়ব।

    প্যাঁচা বলল – উত্তম। আপনি এখন পুরীতে প্রত্যাগমন করুন। এখানে যা দেখলেন তা কাউকে জানাবেন না, কারণ আপনার পুরী শত্রুতে পরিকীর্ণ। আজ রাতেও আপনাকে গুপ্ত হত্যার একটি চক্রান্ত ব্যর্থ করা হয়েছে। সকালে জানতে পারবেন কে মরেছে আর কে বেঁচে আছে। আজ থেকে খুব সাবধানে থাকবেন আর নিজের মহিষী ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করবেন না। কাল রাত্রে আবার আমি আপনার নাম ধরে ডাকব। তখন রহস্যের উপর থেকে কুজ্ঝ্বটিকার আবরণ আপনা আপনি উন্মোচিত হবে।

    শূর প্যাঁচাকে প্রভূত ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে পুরীতে ফিরে এলেন। এসে দেখলেন অনামিকা অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য বাতায়নে অপেক্ষা করছে। রাজা বললেন – অনামিকা তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

    অনামিকা বলল – অবাক কাণ্ড, আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। ঘুম ভাঙতে দেখি উদ্যানের ঘাসে শুয়ে আছি। কোলের উপর হীরামন তোতা শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। কী করে সেখানে পৌঁছলাম, হীরামনকে কোথা থেকে পেলাম, কিছুই স্মরণে এল না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ভেবেছিলাম আপনাকে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু এসে দেখি আপনার শয্যা শূন্য। সেই থেকে ব্যাকুল হয়ে বসে আছি।

    শূর শয্যায় ফিরে গেলেন, কিন্তু চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারলেন না।

    পরের দিন একের পর এক বিপত্তি। রাজার দুজন বয়স্যস্থানীয় সভাসদ নিখোঁজ। উদ্যানে তাদের জুতো, পাগড়ি, সোনার অলঙ্কার আর চাপ চাপ রক্ত পাওয়া গেছে। রাজপুরীতে সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে কানাঘুষো চলছে। শূরের মনে পড়ল প্যাঁচাটা বলেছিল সকালবেলা জানা যাবে কে মরল আর কে বাঁচল। বৃদ্ধ অমাত্য দ্রাক্ষারাজ উদ্যানের চারদিকে বিশ্বস্ত অনুচরদের পাহারায় তন্ন তন্ন করে পুরো জায়গাটা খুঁজে একটা নলের মতো যন্ত্র পেলেন। নলের পিছন দিকে ধনুকের ছিলার চেয়ে পেলব তন্তুর আগায় বাঁধা ছিপি। ছিপিটাকে টেনে ছেড়ে দিলে নল দিয়ে একটা কিছু বেরোয়। কিন্তু সেই জিনিসটা কী?

    শূর দ্রাক্ষারাজকে তাঁর শ্যালকের আশ্রয়ে পাশের রাজ্যে চলে যেতে বলে প্রহরীদের কয়েকটা আরো কাজ সেরে ফেলার আদেশ করলেন।


    এতটা অবধি শুনে তানিয়া ক্লাসে কথা বলার অনুমতি চাওয়ার মতো একটা চামচ তুলে বলল – জয় এটা তুমি ভেবে ভেবে লিখেছো না স্বপ্নে পেয়েছো?

    কী যে আনতাবড়ি কথা বলে মেয়েটা! স্বপ্নে পাব কী করে? একটা ধোঁয়াটে প্লট মাথায় ছিল। বাকিটা তো ওদের সামনেই বসে বসে বানাচ্ছি। ক্ষুন্ন ভাবটা গোপন করে বললাম - কেন এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছো বলো তো?

    - কারণ ঠিক এই গল্পটাই আমি স্বপ্নে দেখেছি। পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন তুমি বলায় স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে। শুনে অবাক হবে আমার স্বপ্নগুলো সব সেকেণ্ড হ্যাণ্ড। যীশুরটাও তাই ছিল।

    - অ। তাহলে তুমিই বলে দাও বাকিটা। শেষ কীভাবে হল সেটা তো আমারও জানা দরকার।

    - বললাম তো, আমার একদম কিচ্ছু মনে নেই! তুমি যতটা বললে, ঠিক ততটা মনে পড়েছে।

    আমি অসহায়ভাবে সপ্‌না আর পম্পার দিকে চাইলাম। এই তানিয়া মেয়েটা একেবারে পাগল, এরা কি সেটা জানে না? কিন্তু তানিয়ার বন্ধুরা ভাব দেখাচ্ছে যেন তানিয়ার কথাগুলো খুব স্বাভাবিক। পম্পা নখ খুঁটতে লাগল। সপ্‌না আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল – অনেক সময় রাইটাররা স্বপ্নে অন্যদের মনের কথাটা জানতে পেরে যায়। তারপর সেটাকে নিজের আইডিয়া ভেবে লিখে ফেলে। এতে কোনো দোষ নেই। তুমি বলে যাও জয়। নিজের নামেই ছাপিও। আমরা কেউ কিচ্ছু বলব না।

    কী বদান্যতা! প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম – ভাগ্যিস তোমরা আছো! তানিয়া দেখো, যদি বেঠিক কিছু বলি তো ধরিয়ে দিও। অন্যের মনের কথা কি সব সময় নির্ভুলভাবে ধরা যায়?




    গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু এই অনামিকা চরিত্রটা আমাকে বশ করতে শুরু করেছে। তার মুখ ভাবলেই পম্পার মুখ দেখি। আরো দশ বছর পরের পম্পা। আরো প্রসাধননিপুণা। এবং যার স্বর্ণকঞ্চুলির তলায় পেট সবসময় দৃশ্যমান। একটা ছাই রঙের আকাশের গায়ে তার চোখ ফুটে উঠছে। পম্পার শরীর নিয়ে আমার যে অবসেশান তার থেকেই এই গল্পটার জন্ম। এই তিনজন শ্রোতাকে তার কতটা বলা উচিত?

    অনামিকার শরীর থেকে মন হটিয়ে আমি রহস্য গল্পটার দিকে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

    - সারাদিন ধরে মেঘের একটা পুরু আর নিচু আস্তরণ রাজপুরীকে আবৃত করে রইল। (দুপুরের রেডিওর মতো একঘেয়ে গলায় বলে চললাম আমি।) - কীসের যেন চাপে দক্ষিণের পবনেরও দম আটকে এসেছিল। পাখিরা কূজন ভুলে কুলায় গিয়ে লুকিয়েছে। বিকেল হওয়ার আগেই মানুষরা সবাই যে যার ঘরে গিয়ে খিল দিতে শুরু করল। শূর তখন আস্তে আস্তে নেমে গিয়ে দাঁড়ালেন শঙ্খ সরোবরের পাড়ে। শর আর দেবদারুর সারির মধ্যে কেউ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।

    শূর নিজেকে শুনিয়েই বললেন – এই সরোবর আজ প্রহরীরা ছেঁচে ফেলেছে। কী বেরোল? পায়ে ভারী ঢাল বাঁধা চার চারটে অর্ধদগ্ধ শব। তাদের দুটো আমার প্রিয় সভাসদদের। বাকি দুটো পুরোনো হয়ে গেছে বলে এখনো চেনা যায়নি। প্রশ্ন উঠছে শবগুলো কোথায় পোড়ানো হল?

    - কোথায় পোড়ানো হল? শূরের কৌতুহলটা শরবন থেকে ঠিকরে ফেরত এসেছে।

    - পোড়ানো হয়নি। অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। বললেন শূর। - যে ঢালগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো আমার নিজস্ব শস্ত্রাগারের বাইরে পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হল কে সেগুলো সরিয়ে থাকতে পারে?

    দেবদারুর আড়াল থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসছিল। দেহ জুড়ে দুর্দান্ত সব সোনার অলঙ্কার। কাঁধে ঘুমন্ত হীরামন। ঢুলতে ঢুলতে তোতাটা বলল – কে সরাল, কে সরাল?

    রাজা বললেন – গয়না আমি ভীষণ ভালোবাসি। তোমার খোঁপায় সবসময় একটা মুক্তো বসানো কাঁটা থাকে। আজ সেটা একটু হাতে নিয়ে দেখতে পারি?

    অনামিকা মাথা থেকে মুক্তো-খচিত কাঁটাটা রাজার হাতে দিয়ে বলল – এটা আমি তোমার জন্য এনেছিলাম। কোনোদিন হারিও না। রাজা তুমি রাত্রিবেলা সরোবরে নেমেছো কখনো?

    রাজা বললেন - আমি সাঁতারই শিখিনি অনামিকা।

    অনামিকা রাজাকে হাত ধরে বুক জল অবধি নিয়ে গেল। তারপর সে বলল – এসো, আমরা দুজন একসঙ্গে ডুব দিয়ে দেখি।

    অনামিকার হাত ধরে জলের তলায় গিয়ে রাজা বুঝতে পারলেন তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। জলের নিচে একটা নতুন জগত চলে এসেছে চোখের সামনে। তাঁদের ঘিরে রয়েছে নানা রঙের অলৌকিক আলোয় আলোকিত মাছ। শঙ্খ সরোবরের তলাটা হয়ে গেছে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। আর তারও তলায় দেখা যাচ্ছে হর্ম্যের সারি, দেবালয়, এবং তাঁর নিজের পুরীর চেয়ে বড়ো একটা স্ফটিকের প্রাসাদ।

    অনামিকা বলল – কী দেখতে পাচ্ছ?

    - স্ফটিকের প্রাসাদের ভিতর দুটি মহাসর্প পরস্পরকে পাক দিয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে শুয়ে আছে।

    অনামিকা বলল – ওদের একজন আমি। রাজা তোমার অনুমান ভ্রান্ত নয়। রাজ্যের চারজন প্রজাকে আমি রাত্রে গিলে ফেলে অর্ধভুক্ত অবস্থায় এই স্ফটিক হ্রদে ফেলে গিয়েছিলাম। তাই ওদের দেহগুলো পোড়া বলে মনে হচ্ছে।

    শূর যা ভয় করেছিলেন তাই। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজার হাতের মুষ্টি শিথিল হয়ে অনামিকার কবজি সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

    অনামিকা রাজার চিবুকে হাত দিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো আদর করে বলল – শূর তুমি সাপ হতে চাও? সাপেদের কন্ঠস্বর থাকে না। তুমি নিজের বাক্‌শক্তি হারিয়ে বাঁচতে পারবে?

    - চেষ্টা করব।

    অনামিকা রাজার গলায় একবার হাত বুলিয়ে দিল। হঠাৎ শূরের প্রচণ্ড কাশি পেয়ে গেছে। কাশতে কাশতে যখন তাঁর চোখ বিস্ফারিত তখন গলা থেকে একটা ছোট্ট সাদা শুক বেরিয়ে তীরের মতো আকাশের দিকে যাত্রা করল।

    আর কি। রাজা বোবা হয়ে জলে সাঁতার কাটতে লাগলেন। অনামিকা রাজার বাহুতে শেষবার হাত বুলিয়ে বলল – নিজে যা খেতে চাও, হীরামনকে আগে খাইও। এই বলে সে জলের গভীরে গোঁত্তা মারল। শূর বুঝলেন আলোকিত মাছগুলো দেখতে দেখতে কোথাও লুকিয়ে পড়ছে। জলের ভিতরটা আবার আগের মতো ঘোলাটে হয়ে এল। নিচের স্বচ্ছ তলটা আর দেখা যাচ্ছে না। অনামিকার দেওয়া সোনার কাঁটা শক্ত করে ধরে আছেন রাজা। এখনো জলের নিচে তাঁর নিশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু রাজা যখন অনামিকাকে ডাকতে গেলেন তখন তাঁর গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোল না।



    এতটা বলে আমি থামলাম। ডোসা এসে হাজির।

    সুগন্ধী ধোঁয়ার সাগরে ডুবে যাচ্ছি। সময় নষ্ট না করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তানিয়া বলল – থামলে কেন জয়? হুবহু আমার স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। শুধু ওই লাশগুলো পুকুর থেকে ওঠেনি। আর অনামিকাও পুরোপুরি নির্দোষ।

    আমি বললাম – লাশই যদি না থাকে তো দোষী-নির্দোষের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে? যাহোক, এক নিঃশ্বাসে পুরোটা বলতে গেলে আমার গলার কোলাব্যাঙ পালিয়ে যাবে। তুমি একটু চেষ্টা করে দ্যাখো না এর পর কী হল সেটা মনে পড়ে কিনা?

    তানিয়া এমনভাবে ডোসায় মন দিল যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি।



    পরে ডোসাগুলো শেষ করে যখন আমরা আইসক্রীম নিয়ে বসেছিলাম তখন পম্পা বলল – অনামিকাকে পাওয়া গেল কি গেল না?

    মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। তানিয়ার অনুমতি নিয়ে তখন আমি আবার গল্পের সুতো কাটতে শুরু করেছিলাম। বললাম – বলছি শোনো। সেদিন তো রাজা হীরামন তোতাটাকে নিয়ে পুরীতে ফিরে এলেন। রাত্রে আবার তাঁর নামে ডাক ভেসে এসেছিল – শূর হুপ্‌ হুপ্‌, শূর হুপ্‌ হুপ্‌। কাঁধে তোতাটাকে বসিয়ে রাজা সরোবরের কাছে গিয়ে উপস্থিত। এবার তাঁর কোমর থেকে ঝুলছে একটা অসি। জামগাছের উপর প্যাঁচাটা আগের মতোই বসে ছিল। রাজাকে সে বলল – আপনি যে বেঁচে আছেন তা থেকে অনুমান করি সব রহস্য ভেদ হয়ে গেছে।

    শূর কথা বলতে পারছেন না। তিনি ঠোঁট নাড়ালেন। হীরামন তোতা ঠোঁট পড়ে আন্দাজে জিজ্ঞেস করল – অনামিকা কোথায়?

    প্যাঁচা বলল – তাকে সন্দেহ করতে বারণ করেছিলাম। তা সত্ত্বেও আপনি সোনার কাঁটাটা নিয়ে নিলেন। ওটা ছাড়া অনামিকার পক্ষে মানুষ রূপে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। যখন তার উপর আপনার বিশ্বাস নেই তখন সে আপনার মহিষী হয়ে থাকবে কী করে? তাই সে শঙ্খ সরোবর ছেড়ে এক অন্য জগতে চলে গেছে। সেখানে সে অন্তত তিন বছরের জন্য আটকা পড়ে যাবে।

    রাজা আবার ঠোঁট নাড়ালেন। হীরামন ঠোঁট পড়ে বলল – কী করলে আমি একটু আফিং পাব? না না, ভুল হল। কী করলে তাকে আবার ফিরে পাব?

    প্যাঁচা বলল – আপনি নিজের ডানদিকে গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখুন। সরোবরের তীরে সেখানে কী দেখতে পাচ্ছেন?

    হীরামন মন দিয়ে রাজার ঠোঁট পড়ে বলল – সেখানে মায়াবী আলোয় দেখতে পাচ্ছি একটা মানুষ ভূমিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মৃত বলে মনে হয়। সরোবর থেকে একটি মহাসর্প উঠে এসে তাকে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

    প্যাঁচা বলল – এবার নিজের বাঁ দিকে দৃষ্টিপাত করুন। সেখানে শরবনের ফাঁকে কী দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন?

    রাজার হয়ে হীরামন বলল – সেখানে একটি পুরুষ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে এবং একটি মহাসর্প ধীর ধীরে অরণ্যে প্রবেশ করছে।

    প্যাঁচা বলল – রাজা, এখানে বাঁদিকে যা ঘটে তা হল প্রশ্ন। ডানদিকে তার উত্তর। এইটুকু শুধু আপনার জানার অধিকার।

    হীরামন বলল – আচ্ছা অন্তত এটা কি জানাতে পারবেন কেন অনামিকা আমার বয়স্যদের হত্যা করল?

    প্যাঁচা গম্ভীর হয়ে বলল – আশ্চর্য! সেটা আপনি এখনো বোঝেননি? আপনার পরিচিত রাজপুরুষরাই আপনাকে বধ করতে এসেছিল। এতদিন যাবৎ অনামিকার কাজ ছিল সারারাত আপনাকে পাহারা দেওয়া। পুরীতে যতগুলি আততায়ী প্রবেশ করেছে প্রত্যেকটি তার হাতে পঞ্চত্ব পেয়েছে। এখন অনামিকাকে প্রাসাদে ফেরাবার চেয়েও আপনার আশু কর্তব্য এই যড়যন্ত্রের চক্রটিকে ভেঙে নিজেকে ও নিজের রাজত্বকে বাঁচানো।

    শূরের হয়ে হীরামন বলল – এই চক্রের কেন্দ্রে কে? সেই নামটি আমাকে বলুন।

    প্যাঁচা যথেষ্ট উৎসাহিত হয়ে বলল – অ্যাই! এতক্ষণ পরে আসল প্রশ্নটা করেছেন! এটাই জানাবার জন্য আজ ডেকেছিলাম। সেই ব্যক্তিটি হল...। অর্থাৎ তার পরিচয়...। মানে তার নাম...। এতদূর বলার পর দেখা গেল বৃহৎ প্যাঁচাটি অদ্ভুতভাবে মাতালের মতো টলতে শুরু করেছে।

    কিছুক্ষণ যাবৎ শূরের মনে হচ্ছিল গাছের আড়ালে লুকিয়ে কেউ তাঁদের দেখছে। হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে একটা ডিগবাজি খেয়ে প্যাঁচাটা গাছের ডাল ধপাস করে থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। শূর সংবিৎ ফিরে পেয়ে এক লম্ফে তার কাছে উপস্থিত হলেন। হীরামন তোতা প্যাঁচার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল – জলদি করুন ভাই। আপনার আর সময় নেই। যাওয়ার আগে বলে ফেলুন। কে সে?

    প্যাঁচার ঠোঁটদুটো ফাঁক হল। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছুই বেরোল না। শূর দেখলেন পক্ষীটির গলার ডানদিকে একটা লোহার কাঁটা বিঁধে আছে। কাঁধের উপর থেকে হীরামন বিড়বিড় করে বলছে – বিষ, বিষ! শূরের বুঝতে অসুবিধে হল না, যে লোহার নলগুলো উদ্যানে পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে থেকে কী নির্গত হয়।

    হাতে উদ্যত অসি নিয়ে শূর যেদিক থেকে কাঁটাটা এসে থাকতে পারে সেদিকে এগোলেন। দূরে খুব মৃদু একটা পদশব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হায়, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! শূর উদ্যানের সেই দিকটাতে ভালো করে খুঁজেও কাউকে পেলেন না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সদ্য যুবক রাজা পরোপকারী প্যাঁচার নিষ্প্রাণ দেহ কোলে করে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন বলে ফিরেছিলেন। কিন্তু অকুস্থলে এসে দেখা গেল প্যাঁচার দেহটা ভোজবাজির মতো অদৃশ্য!

    জামগাছের নিচে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন হতভম্ব শূর।



    সপ্‌না এতক্ষণ চুপচাপ আইসক্রীম ধ্বংস করছিল। এবার দেখি সে কপাল থাবড়াতে শুরু করেছে। – হে ভগ্‌ওয়ান জয়! সমস্ত থার্ড ক্লাস ডিটেক্টিভ গল্পে যা হয় সেটা এই স্টোরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছো? ঠিক খুনীর নাম বলবার মুহূর্তে চাক্ষুষ সাক্ষীরা একের পর এক মাছির মতো মরবে এবার।

    পম্পাও সায় দিয়ে বলল – স্পুফ করার জন্য সাক্ষীটাকে প্যাঁচা বানিয়ে দিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি গল্পটা টোকা।

    আমি বললাম – গল্প তো এখনো পালটানো যায়। তানিয়া তোমার স্বপ্ন কী বলছে? প্যাঁচাটা বেঁচে গিয়ে গড়গড় করে সব পোল খুলতে শুরু করে দেবে?

    তানিয়া আমতা আমতা করে বলল – মনে হয় আমার স্বপ্নের সঙ্গে অন্য কারো স্বপ্নের ক্রস কানেকশান হয়ে গেছে। বাই গড আমারটাতে এত খুন খারাবা ছিল না। বেশ ভালোই রোমান্টিক এন্ডিং ছিল। এই কন্সপিরেসিটা প্লটে ঢোকাতে গেলে কেন?

    আমি বললাম – গল্পটাতে রিস্ক আনার জন্য। ঝুঁকি ছাড়া রোমান্স হয় না। সেটা কি বোঝো? না বুঝলেও চিন্তা নেই। তোমরা তো আছোই। এবার সবাই মিলে ঠিক করে দাও না স্টোরিটা শেষ করব কীভাবে?

    কথা নেই বার্তা নেই তানিয়ার মুখটা হাঁসের মতো হাঁ। চোখ গোল গোল। সে সপ্‌না আর পম্পার দিকে ফিরে বলল – অর্‌রে ইয়ে রাইটার ছোকরা তো একদম ঠিক বোলা ইয়ার! সেই জন্যই আমার আজ অবধি একটা রোমান্স হয়নি। একটা তো হতে হতেও কেঁচে গেছে। আজকে বুঝলাম কেন। আমি যে রিস্ক নিতে পারি না!

    আমরা সবাই তানিয়ার এই আকস্মিক আত্মোপলব্ধির মানে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মেয়েটা অ্যাক্টিং করছে কিনা ভাবছি। সপ্‌না হঠাৎ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল – রিস্ক নিতে পারিস না মানে? তানিয়া, তুই কোন রিস্কটা নিতে বাকি রেখেছিস? ক্লাস টেনের পরীক্ষার পর একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে হোটেলে গিয়ে উঠিসনি?

    - সেটা কোনো রোমান্সের জন্য নয়। কিছুদিন গায়েব থাকার জন্য। ওর আর আমার দুজনেরই সব কিছুতে গোল্লা পাওয়ার কথা ছিল। তানিয়া আবার হাউমাউ করে বলল।

    - আর চার্চের ব্রাদারকে যে স্কারলেট চিঠিটা দিয়েছিলি? যার জন্য বেচারাকে ইম্ফলে পাঠিয়ে দেওয়া হল?

    তানিয়ার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল। ইম্ফলের ব্রাদারই বোধহয় তার হতে-হতে কেঁচে যাওয়া রোমান্স। সে আর কিছু না বলে ঘাড় গুঁজে বসে গেল। সপ্‌না আর একটা কিছু বললে অভাগিনী ভেঙে পড়বে। আমি চেয়ার ঠেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম – আইসক্রীমের পর একটা দিশি কুলফি না খেলে জমে না। কাউকে উঠতে হবে না। সবার জন্য আমি কিনে আনছি। তারপর তোমাদের কথামতো গল্পের এণ্ডিং হবে।

    আমি দাঁড়াতেই পম্পাও উঠে পড়ে বলল – দুটো হাতে চারটে কুলফি আনবি কী করে? আমিও যাচ্ছি চল।



    পরে যেতে যেতে পম্পা আমাকে বলল – সাপেরা পাতালে চলে গেলে তিন বছর আটকা পড়ে যায় কেন জানিস? তাদের ডিগ্রী শেষ হয় না।

    - আরে ধুর, পার্সোনালি নিও না। এটা একটা গল্প।

    পম্পা বলল – সে তো বুঝলাম। কিন্তু সপ্‌না আর তানিয়াকে তুই যতটা বোকা ভাবছিস ওরা ততটা বোকা নয়। ওরকম সেজে থাকে। ঠিক বুঝে যাবে ওটা আমাকে লক্ষ্য করে লেখা। যাহোক শেষে রাজা-রাণীর মিল করিয়ে দিচ্ছিস তো?

    পম্পা আমার চেয়ে বয়সে বড়ো বলে আমি কোনোদিন তাকে নাম ধরে ডাকি না। বললাম – শোনো, গল্পটা আরেকটু এগোলে বুঝতে পারবে যে এটাতে একটা টাইম ট্র্যাভেলের ব্যাপার আছে। আসলে অনামিকা একটা অতীতের চরিত্র। তার পক্ষে শূরের বর্তমানে বেশিদিন থাকা সম্ভব ছিল না।

    পম্পা সহজ গল্পটার মধ্যে এই নতুন জটিলতা আশা করেনি। - তাহলে ওদের মিল হবে কী করে? একটু অসন্তুষ্ট হয়ে সে জিজ্ঞেস করল।

    আমরা কুলফির দোকানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি পম্পাকে বললাম – একটা জায়গায় গিয়ে গল্পেরা প্রশ্নের কুয়াশায় ঢুকে বসে থাকে। তারপর কী আছে জানবার জন্য আমাকে ওই ঠাণ্ডা কুয়াশাটার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়। আজকে আমি তোমাদের সবাইকে সেটার মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যাব।


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • ১ম অংশ | ২য় অংশ | ৩য় অংশ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments