• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • শঙ্খমালার সঙ্গে একটা বিকেল (২) : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    এখনো অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে গৃহীত। গল্পের পটভূমিকা আশির দশকের দিল্লী।



    পাতালপুরী




    কুলফির দোকান থেকে ফিরে এসে পম্পা আগেভাগে ঘোষণা করে দিল – জয় বলছে অনামিকা অতীত থেকে টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছিল। কিন্তু টেম্পোরারি ভিজিট। হলিডে কাটানোর মতো। পার্মানেন্টলি থেকে যেতে পারবে না।

    সপ্‌না আর তানিয়া দুজনেই ভুরু কুঁচকে বলল – কী প্রচণ্ড রদ্দি আইডিয়া! একদম চলবে না।

    তানিয়া বলল – বাঃ। এমনই লাভ স্টোরি যে শেষে হিরো-হিরোইনের মিল নেই। ফিল্মের ম্যাগাজিনের কোন উজবুক পাঠক সেটা পড়তে চাইবে? আর্ট ফিল্ম দেখে যে?

    আমি দাঁত বের করে বললাম – যতক্ষণে জানতে পারবে মিল হয়নি ততক্ষণে তো গল্প পড়া হয়ে গেছে, তাই না?

    - নিজে পড়ে ফেললেও অন্যদের পড়াবে না। ওয়ার্ড অব মাউথ বলে একটা ব্যাপার আছে। গল্পটা এমনভাবে শেষ করতে হয় যাতে একটা মধুর রেশ থেকে যায় সবার মনে। লাঞ্চের শেষে কুলফি খাওয়ার মতো। এই বলে সপ্‌না আমার হাত থেকে নিজের কুলফিটা কেড়ে নিল।

    তানিয়া সাফ জানিয়ে দিল – টাইম ট্র্যাভেল-ফ্যাভেল বাদ। শুধু রোমান্স আর সাসপেন্স চাই। মন খারাপ করা গল্প শুনে আমি দিনটা খারাপ করতে পারব না।

    - প্লীজ তানিয়া, প্লীজ ! টাইম ট্র্যাভেলটা থাকুক। সেটা শুদ্ধুই মিল করিয়ে দিচ্ছি। তার একটা উপায় বের করেছি আমি।

    - কী উপায়?

    - ওই যে হীরামন তোতাটাকে শূরের কাঁধে বসিয়ে রেখেছি, ওটা টাইম ট্র্যাভেল করে আসেনি।

    - তাহলে সেটা স্মৃতিলোপের ভাণ করছে কেন? পম্পা মনে করিয়ে দিল।

    - হীরামনটা ভাণ করছে না। একদম জেনুইন সাচ্চা দিল আইটেম সে। তার স্মৃতি সত্যিই দুর্বল হয়ে গেছে। অনামিকার সময়ে জন্মেছিল। শূরের টাইমেও বেঁচে আছে। একশো পাঁচ বছর বয়স পাখিটার।

    - এই রে! তার মানে তোমার হিরোইনের বয়েস কত? সপ্‌না জিজ্ঞেস করল।

    - ধরো একশো পঁচিশের মতো। বেশি হয়ে যাচ্ছে? আরো পঁচিশ কমিয়ে দিতে পারি, কিন্তু অন্তত একশো বছরের গ্যাপ না থাকলে টাইম ট্র্যাভেলের রস কেমন ফিকে হয়ে যায়।

    মেয়েরা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একজন অন্যজনের দিকে তাকাল। মানে আমার মাথায় শুভ বুদ্ধি ঢোকানো তাদের কম্মো নয়। তানিয়া আমার কুলফির গায়ে নিজের কুলফিটা ঠেকিয়ে দিয়ে বলল – একটু শান্ত হয়ে বলো তো জয় তুমি টাইম ট্র্যাভেল রাখার জন্য এমন ক্ষেপে উঠেছো কেন? বুড়ি থুত্থুড়িকে কেউ হিরোইন বানায়? হিরোইন হয় আমাদের মতো জোয়ান আর স্মার্ট কেউ।

    পম্পা ওদের পিছন থেকে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল – ঋতুওয়ালী, ঋতুওয়ালী।

    আমি বললাম – হিরোইন কীরকম হওয়া উচিত সেটা কি আমি জানি না? টাইম ট্র্যাভেল লাগাতে চাইছি কারণ আজকাল ওটা খুব ট্রেন্ডি। বড় বড় ম্যাগাজিনের বড় বড় লেখকরা এই নিয়ে লিখছেন। আমারও লেখা উচিত। নইলে লেখক হিসেবে আমি পিছিয়ে পড়ব।

    পম্পার দুই বন্ধু আমার এই কথাটা মেনে নিয়ে গুরুজনের মতো মাথা নাড়াতে লাগল। - সেটা একটা ভালো পয়েন্ট জয়। পিছিয়ে পড়া ঠিক নয়।

    আমি যোগ করলাম - তাছাড়া আমার বন্ধু প্রবুদ্ধ আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এমন একটা সায়েন্স ফিকশন লিখতে যাতে দুটো নেস্টেড টাইম ট্র্যাভেল লুপ আছে।

    এটা শুনে সবাই চুপ। তানিয়া পম্পাকে একটা ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল - কী বলল রে ছেলেটা? অশ্লীল কিছু বলল নাকি?

    পম্পা তানিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের একটা ঝপকি মেরে দিল। অর্থাৎ অশ্লীল নয়, ফালতু খবর। পাত্তা দিস না। তারপর সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল – কিন্তু তাহলে একটা টাইম মেশিন তো লাগবে? সেটা কে বানাল, কী দিয়ে বানাল, কোথায় সেই বৈজ্ঞানিক? প্রবুদ্ধ সে সব বলে দিয়েছে? সায়েন্স ফিকশনে এক ফোঁটা সায়েন্স তো থাকবে, না কি তার দরকার নেই?

    আমি বললাম – ওইখানে আমার একটু জ্ঞানের অভাব। ইংরেজি বইয়ের মতো মেশিন বা কলকব্জার বর্ণনা দিতে পারব না। সেই জন্য কথাসরিৎসাগরের স্টাইলে এই সাপ-টাপ, প্যাঁচা-ট্যাঁচা, ব্যাং-ট্যাং রেখেছি। এই সব প্রাণীরা ম্যাজিক জানে। অ্যানিমাল সায়েন্স বলতে পারো। ধরে নাও সেটা হিউম্যান সায়েন্সের চেয়ে এগিয়ে।

    তিনটি মহিলা কুলফি হাতে নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। পম্পা একটু হেসেও ফেলল। পরে তানিয়া অস্বস্তিকর নীরবতাটা কাটাবার জন্য পুট পুট করে হাততালি দিয়ে উঠে বলল – চলেগা রাইটার, চলেগা। জিসাস ক্রাইস্টের নাম নিয়ে শুরু করে দাও। আমরা উদ্‌গ্রীব হয়ে আছি তোমার এই অ্যানিমাল সায়েন্সের ফিকশন শোনার জন্য।

    গল্পটার জন্য আমি তিনটে অঙ্ক ভেবে রেখেছিলাম। তার মধ্যে একটা বলা হয়ে গিয়েছিল। এবার দ্বিতীয়টা বলার পালা। তৃতীয়টাতে আশা করেছিলাম একটা যুৎসই অন্তিম দৃশ্য থাকবে। মুশকিল হল এই যে তৃতীয় অঙ্কে ঠিক কী ঘটাব সেটা এখনো মাথায় আসেইনি।

    তানিয়ার নির্দেশমতো জিসাস ক্রাইস্টের নাম নিয়ে বলতে আরম্ভ করলাম।


    - অনামিকাকে হারাবার পর শূর শোকে মুহ্যমান হয়ে আসব পান শুরু করেছিলেন। সদ্য যুবক রাজা। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা এই বয়সে প্রবল হয়। এক পাত্র আসব পান করে রাজা অনামিকাকে ভুলতে পারলেন না। দ্বিতীয়টি ভরে নিলেন। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম। দুপুরের আগেই ষোলটি আসবের কুম্ভ নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।

    - দুজন? পম্পার কাছে হিসেবের গোলমাল হওয়ার যো নেই।

    - মানে হীরামনটাও ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছিল আর কি। শূর হাসছিলেন বা কাঁদছিলেন না। অদ্ভুত একটা বিষন্নতায় গুম মেরে ছিলেন। হীরামন তার আসবের পাত্রের গায়ে হেলান দিয়ে ঢুলছিল। নিঃশব্দে ষোল কুম্ভ সুরা শেষ হওয়ার পর হীরামনের মুখ দিয়ে প্রথম কথাটা বেরোল।

    – জীভা! জীভা হ্যায় মেরা নাম। মদ্যপের জড়ানো গলায় সে দাবী করল।

    - কী আর মন্দ সেটা? শূরের ঠোঁট নড়ে উঠল। - কাজের কিছু মনে পড়েছে?

    - ওই প্যাঁচাটার নাম পঞ্চু। ওকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। বেশি কথা বলা ওর স্বভাব।

    - অনামিকাকে আপনি চিনতেন? শূরের ঠোঁট জীভাকে জিজ্ঞেস করল।

    - বিলক্ষণ। সে ছিল রাজার মেয়ে। তার আসল নাম শঙ্খমালা।

    - ছিল?

    - একশো বছর আগে সরোবরের অপর প্রান্তে অন্য এক জগতে তারা থাকত। একশো বছর আগে, এরকমই একটা হেমন্তের দিনে সে হারিয়ে গিয়েছিল। লোকে বলে মনের দুঃখে মরেছিল সে।

    শূরের গলায় স্বর থাকলে তিনি চেঁচিয়ে উঠতেন। - তাহলে যে অনামিকা সেজে আমার সঙ্গে ছিল সে কে?

    - ভয় নেই, অনামিকাই শঙ্খমালা। আর এক চুমুক আসব খেয়ে বোধহয় আরো একটু মাথা খুলল হীরামনের। - সে কয়েকটা দিনের জন্য অতীত থেকে এসেছিল। আপনাকে কিছু জানাতে।

    শূর কপালে করাঘাত করলেন। অনামিকা কিছুই তাঁকে বলে যায়নি। সে শুধু স্মিত হাসি হাসত আর রাজার কথা শুনত।

    জীভা এক বিরাট চুমুকে পাত্রটা নিঃশেষ করে বলল – শঙ্খ সরোবরের নিচে আপনাকে নিয়ে গিয়েছিল সে। তখন কিছু বলেনি?

    সরোবরের নিচের কথা তো কানে শোনার জন্য নয়। মনে মনে বুঝতে হয়। রাজা মুক্তো বসানো সোনার কাঁটাটা দেখিয়ে বলতে চাইলেন – সে চেয়েছিল এই চুলের কাঁটাটা যেন না হারাই।

    জীভা বলল – আঃ, এটা কোনো চুলের কাঁটা নয়। এটা শঙ্খ তরঙ্গের হাল। তার মানে আপনাকে আরেকবার সরোবরে নামতে হবে।

    শূর ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে চাইলেন – কী লাভ? অনামিকা যদি একশো বছর আগেই মরে গিয়ে থাকে, তাহলে আমি কোথায় গিয়ে তাকে পাব?

    জীভা বলল – এটা আবার একটা প্রশ্ন হল? কেন? একশো বছর আগের অতীতে!

    - একশো বছর? যেখানে আমার বাপও জন্মাননি সেখানে কীভাবে গিয়ে পৌঁছোব আমি?

    - শুনেছি শঙ্খ তরঙ্গের উজান বেয়ে যেতে হয়। সেটা এমন একটা নদী যার আদি বা অন্ত নেই। অবিরাম অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে চক্রের মতো বয়ে চলেছে। লোকে বলে তার মধ্যে শুধু আলোর কণা দিয়ে গঠিত প্রাণীরা বাস করতে পারে। আপনাকে সেই নদীটা খুঁজে বার করতে হবে।

    শূর ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন – জীভা আপনার মদ্যপান বয়সের অনুপাতে অত্যধিক হয়ে গেছে। আসবের গন্ধে শোভিত যে উদ্ভট কথাগুলো এখন মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে তাদের বিন্দুবিসর্গ আমি বিশ্বাস করতাম না। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই নদীটাকে আমি দেখেছি।




    তানিয়া আর থাকতে না পেরে তার কুলফি তুলে অনুমতি চাইল কথা বলার।

    - বলো তানিয়া, বলো।

    - তাহলে তোমার টাইম মশীন হল একটা নদী?

    - অরে মশীন হী নহীঁ তো টাইম মশীন কেয়া? মেশিনটাকে নদীতে ফেলে দিয়েছি তানিয়া। রিভার অফ টাইম বলতে পারো। স্পেস-টাইমের একটা চরকি। তার মধ্যে স্রোত আছে। একবার সে আবর্তে পড়ে গেলে ওঠা দায়। ভাবো যে অতীতের মধ্যে ভবিষ্যত এবং ভবিষ্যতই অতীত। ভাবো যে হিরো আর হিরোইন একজন আরেকজনকে এই স্রোতের মধ্যে আপ্রাণ অনুসরণ করে চলেছে। অথচ কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছে না।

    - এটা কি প্রতীকী গল্প?

    - গড নোজ । ভেবেছিলাম এটা একটা অপূর্ণ অভিলাষা আর আক্ষেপের গল্প। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমাদের জন্ম আরো একশো বছর আগে হওয়া উচিত ছিল। তখন দিল্লির রাস্তায় আসাদুল্লা খাঁ নামের এক কবি হাঁটতেন। যে পথ দিয়ে তিনি হেঁটেছিলেন সে পথগুলো এখন হয়তো সোনার হয়ে গেছে। তখন সে পথগুলো ছিল সত্যিকারের ধুলোর, যাদের ছেড়ে কেউ অন্য শহরে যেত না। কিন্তু আমরা কেউ আসাদের সঙ্গে সেই ধুলোর রাস্তাগুলো মাড়াতে পারিনি। এ গল্পটা সেই আক্ষেপের। সেইজন্য আমি এটাতে হিরো আর হিরোইনের মিল হোক সেটা চাইনি।

    - ও।

    তানিয়া কেমন যেন একটু ভাবাবেশের মধ্যে চলে গিয়ে চুপ হয়ে গেছে। সপ্‌না একবার এদিক একবার ওদিক তাকিয়ে ধাঁই করে টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলল – তানিয়া মেনে নিলেও আমি এমন গল্প শুনতে চাই না যাতে হিরো আর হিরোইন কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারবে না। টাচ্‌ না করতে পারলে আবার রোমান্স কী? কান খুলে শুনে নাও জয়। আমাদের ডীল হয়েছে যে তুমি মিল করিয়ে দেবে। লাস্ট সীনে হিরো যদি হিরোইনকে টাচ্‌ না করে তাহলে আমার চেয়ে বুরা কেউ হবে না। বাড়িতে গিয়ে গল্পের খাতা ছিঁড়ে দিয়ে আসব।

    পম্পার বন্ধুটির এই স্পর্শপ্রিয়তা আমার মনের একটা সাহিত্যিক চোখ খুলে দিচ্ছিল। আমি বললাম – উঠো না সপ্‌না। গল্পটা শুনে যাও। হয়তো একটা সমাধান আছে যেটা আমাদের সকলকেই খুশি করতে পারে।




    আমি শ্রোতাদের বললাম – রাত হয়ে গিয়েছে। কাঁধে জীভাকে বসিয়ে রাজা স্খলিত পায়ে শঙ্খ সরোবরের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দু হাতে দুটি আসবের পাত্র। জীভার চঞ্চু ঢুকে আছে একটার মধ্যে।

    শূর ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন – আমি ফিরে আসা অবধি তুমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে?

    জীভা বলল - চিন্তা নেই। আপনি অতীতে গিয়ে একদিনই থাকুন বা দশ বছর কাটান, ফিরে এসে দেখবেন এখানে একটা মুহূর্তও কাটেনি। আমাকে এই সরোবরের ঘাটেই পেয়ে যাবেন। এই পাত্রটির পাশে।

    - আমাকে কি ফিরতেই হবে?

    - উপায় নেই। শঙ্খের স্রোত থামে না। আপনাকে তার ইচ্ছেমতো কোথাও নামিয়ে দিয়ে সে চলে যাবে আরো অতীতে, এবং ফেরার পথে ঠিক তুলে নেবে আবার। কতক্ষণ লাগবে তার ফিরতে সেটার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই।



    শূর অনামিকার দেওয়া সোনার কাঁটাটা নিয়ে জলে অবগাহন করতেই তাঁকে অলৌকিক আলোর কণাগুলো এসে ঘিরে ফেলল। সরোবরের অপর প্রান্তে কোথাও একশো বছর আগে একটি মহানগরী ছিল। তিনি সেটার কথা স্মরণ করে সোনার কাঁটাটা হাতে নিয়েছিলেন। জলের কলরবের মধ্যে অতীত আর ভবিষ্যতের প্রতিটি সংলাপ গুঞ্জরিত হচ্ছে। একটা শব্দও হারায় না। নির্দিষ্ট দূরত্বে পৃথিবীর ঘটনাগুলো এক অপরকে অনুসরণ করে যায়।

    এক ঝাঁক রংবেরঙের মাছ নিয়ে একটা বিরাট তরঙ্গ আসছিল। শূর সামলে ওঠার আগেই সেটা তাঁকে হ্যাঁচকা টান মেরে ভাসিয়ে নিল।



    শূরের যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর কন্ঠনালীর উপর একটা ধারালো কিছু চেপে ধরা আছে। পিঠের নিচে বালুর মেঝে। শূর বুঝতে পারলেন যেখানে তাঁর ঘুম ভেঙেছে সে দেশটা জলের তলায়। মাথার উপরে একটা আদিগন্ত স্ফটিকের ছাদ। তার উপরে শঙ্খ সরোরের জল। বাতাস খুবই হালকা। সোনার কাঁটাটা সঙ্গে থাকার জন্য তাঁর নিশ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছিল না। ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে হবে আশঙ্কা করে চোখ খুলেছিলেন শূর। তাঁর বুকের দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়ানো একটা আশ্চর্য অবয়ব। দেহটা মানুষের, কিন্তু সারা গায়ে সাপের চামড়ার মতো উল্কি আঁকা পোষাক। বা পোষাক না বলে বর্মই বলা উচিত এই আঁটসাঁট পরিচ্ছদকে। অবয়বের মুখেও সেই একই রকম মসৃণ ত্বকের মুখোশ। শূরের গলায় একটা ঝকঝকে তলোয়ার ঠেকিয়ে রেখেছে এই প্রহরীটি। নড়ার যো নেই।

    শূর বললেন – আমি নিরস্ত্র। আমাকে কীসের ভয়? কিন্তু ঠোঁট নড়লেও কন্ঠ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। মুখোশ পরা অবয়বটার ভুরু কুঁচকে গেল। সে শূরের গলায় একবার হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য ঝুঁকেছিল। শূর তার দেহের ভঙ্গী দেখেই বুঝলেন সে একটি সদ্য যুবতী মেয়ে। সে যখন কাছে এসে শূরকে ছুঁয়েছিল তখন শূর তার অভিব্যক্তির সঙ্গে চোখের মণির রঙ দ্রুত পালটাতে দেখতে পেলেন। কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়ে শূর বললেন – শঙ্খমালা!

    মেয়েটি বিষধর সর্পের মতো সটান মাথার ছোবল তুলে হাতের তলোয়ারটা আরো কঠিনভাবে শূরের গলায় চেপে ধরল। – কে তুমি? আমাদের বাড়িতে ঢুকলে কী করে? প্রশ্ন করল সে।

    শূর শঙ্খমালাকে দেখে বুঝলেন অনামিকা হতে এখনও তার কয়েক বছর বাকি। শরীর আর হাব-ভাবের মধ্যে সেটা পরিস্ফুট। অনামিকা ছিল শূরের চেয়ে ধৈর্যে একটু ধনী, বয়সে একটু বড়ো। এই শঙ্খমালা শূরের চেয়ে খানিকটা ছোট। শূর মুখ ফুটে এই কৃশাঙ্গী শঙ্খমালাকে বলতে পারলেন না যে তিনিই তার হবু বর।

    অবশ্য আগে দেখতে হবে তরবারির একটা বেকায়দার খোঁচা লেগে শঙ্খ তরঙ্গের তীরে তাঁর ভবলীলা না সাঙ্গ হয়ে যায়। অনামিকা তার অতীত গোপন রেখে শূরকে এই জলের নিচের পৃথিবীর বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ করে রেখেছিল। শূরের কাছে এমন কিছু বলার মতো নেই যা দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে পারেন শঙ্খমালাকে তিনি অত্যন্ত ভালো করে চেনেন।

    - আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না।

    শূর বুঝলেন তাঁর মুখ দিয়ে সেই কথাটাই বেরিয়ে এসেছে যেটা তিনি অনামিকার মুখে একদিন শুনেছিলেন।

    শঙ্খমালা ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি এনে বলল – এখানে প্রবেশের আগে একটা যুৎসই অজুহাতও খুঁজে বার করতে পারোনি বিদেশী? তারপর তার ভুরু আবার কুঁচকে গেল আর সে বলল – ডাঙার মানুষ হয়ে এখানে বেঁচে আছো কী করে বলো তো?

    - আমি... আমি... যোগাভ্যাস করি। শূর তোতলাতে তোতলাতে বললেন।

    শঙ্খমালা হাসবে না কাঁদবে ঠিক না করতে পেরে বলল – যোগাভ্যাস করে কোনো ডাঙার মানুষ এরকম পাতলা বায়ুমণ্ডলে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। বড়জোর কিছুক্ষণ চালিয়ে দিতে পারে। বেশি চালাকি না করে বলো তুমি কী চুরি করতে এসেছিলে?

    শূর হাতড়ে হাতড়ে পোষাকের মধ্যে সোনার কাঁটাটা পেয়ে গিয়ে তুলে ধরলেন। - এই জিনিসটা। এটা নেবে তো নাও। আমার কাছে আর কিছু পাবে না। চাইলে খুঁজে দেখতে পারো।

    কাঁটার গায়ে অনেকগুলো মুক্তো বসানো ছিল। সেগুলো থেকে নানা বর্ণের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এখন। টুং টাং করে সঙ্গীতের মতো শব্দও ভেসে আসছে। শঙ্খমালা সেটা হাতে নিয়ে বেবাক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে তলোয়ারটা শূরের কন্ঠ থেকে সরিয়ে মাটিতে রেখে দিল সে। তারপর বলল – আগন্তুক, এটা তুমি কোত্থেকে পেলে?

    - শঙ্খ তরঙ্গের স্রোত আমাকে টেনে নিয়েছিল। এটা তখন আমার কাছে চলে আসে। হয়তো বিশ্বাস করবে না, আমার মনে হয় এর দৌলতেই এই বায়ুমণ্ডলে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। শূর যে গল্পটা শোনাতে এসেছিলেন সেটা এইভাবে আরম্ভ করা যায় কিনা দেখলেন।

    শঙ্খমালা বলল - এতে অবিশ্বাসের কী আছে? এটা কী বস্তু তুমি জানো? কালের স্রোতের হাল। এর ক্ষমতার কোনো সীমা আছে নাকি? আমরাও ব্যবহার করতে শিখিনি। একটা ডাঙার মানুষ কী করে পেল সেটাই পরমাশ্চর্য। বিদেশী, তুমি কি এটা বিক্রি করতে এসেছিলে আমার কাছে?

    শূর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন – এতক্ষণে বুঝেছো রাজকন্যা। তোমার কাছে ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে জেনে আমি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এই পাতালপুরীতে এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। তুমি ওই অসির জোরে এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তারপর আমাকে হত্যা করে এই বালিতে পুঁতে ফেলবে।

    শঙ্খমালা শূরকে থামিয়ে বলল – বাজে কথা বোলো না। তোমরা ডাঙার মানুষরা কী ভাবো? সবাই তোমাদের মতো নিষ্ঠুর আর বদমাইশ? তোমাদের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার জন্য আমাদের এই পাতালের জগত সৃষ্টি করতে হয়েছে। সবাইকে আত্মরক্ষার অস্ত্রশিক্ষা নিতে হয়েছে। নইলে একদিন আমরাও তোমাদের মতো মাটির উপরে থাকতাম। আমাদের দেশে কেউ এরকম নীচ কাজ করার কথা ভাবতেই পারে না।

    শূর বললেন – তাহলে ন্যায্য দাম পেয়ে যাব বলছো?

    - কী করে পাবে? এ তো অমূল্য বস্তু। আমাদের যুগে কেউ দেখেইনি। শুনেছি ইতিহাসে কয়েকবার এরকম এক একটা হাল দৈবাৎ কারো কারো হাতে চলে আসে। তারা সময়ের স্রোতে ভেসে যে কোনো কালে পৌঁছে যেতে পারে। এই হালটাকে যে ঠিকমতো চালাতে পারে সে ত্রিকালজয়ী হয়ে ইচ্ছেমতো রাজত্ব করে।

    শূর খুব নিরাশ হয়েছেন ভাব দেখিয়ে বললেন – তাহলে তুমি কিনবে না এটা? আমি অনেক আশা করে এসেছিলাম যে তোমার কাছে ভালো দাম পাব।

    - বিদেশী তুমি কি পাগল? শঙ্খ তরঙ্গের হাল কেউ বিক্রী করে না। চাইলে তুমি পঞ্চভূতদাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, আদৌ কারো কাছে এই বস্তু কেনার ক্ষমতা আছে কিনা। তিনি অবশ্য সাধারণত থাকেন ডাঙার দেশে। সরোবরের ধারের জঙ্গলে। প্রতি মঙ্গলবার এখানে দেখা দিয়ে যান।

    - পঞ্চু প্যাঁচার কথা বলছো নাকি? শূর বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। - যে ব্যাটা বেশি কথা বলে?

    শূরের অশিষ্টতায় অসন্তুষ্ট হয়ে শঙ্খমালা বলল – কী অভদ্র তুমি! অবশ্য হবে নাই বা কেন, ডাঙার মানুষ যে। এমন গুণী আর বিদ্বান পাখির নাম এরকম অশ্রদ্ধার সঙ্গে নিতে হয়? একটু বেশি কথা বলেন সেটা মানছি।

    শূর লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন – পঞ্চভূতদা এমন জ্ঞানী-গুণী মনীষী সেটা জানা ছিল না। কতটুকুই বা চিনি তাঁকে? তিনি তো আমাকে চিনবেনও না। বরং আমাকে তাঁর সঙ্গেই দেখা করিয়ে দাও। আর ততদিন পর্যন্ত এই অমূল্য সম্পদ নিজের কাছে যদি রাখো তো উপকৃত হই। আমার ভীষণ ভুলোমন। হয়তো হারিয়েই ফেলব।

    - আচ্ছা বেকুব তো! এটা হাতছাড়া করলে তুমি নিঃশ্বাস নেবে কী করে?

    - এই সামান্য একটা গয়নার উপর নির্ভর করে আমি বাঁচতে চাই না রাজকন্যা। ব্যায়াম করে দম বাড়াব। মাঝে মাঝে জলের উপর গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আসব।

    - এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি দেশান্তরে এসেছো? এইভাবে এই দেশে বাঁচা যায় না। আচ্ছা এই নাও, আমার মুখোশটা পরো। এটা পরলে তুমি আস্তে আস্তে নিজের থেকে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। আর সোনার কাঁটাটাও আমাকে দেওয়ার দরকার নেই।

    - কিন্তু মুখোশ ছাড়া তুমি নিঃশ্বাস নেবে কী করে রাজকুমারী?

    - যার জন্ম জলের নিচে তার মুখোশ লাগে নাকি? ওটা পরি যাতে কেউ আমাকে দেখে চিনতে না পারে। কিন্তু তুমি কী করে চিনলে বলো তো?

    শঙ্খমালা মুখের আবরণ সরাতেই অনামিকার রূপের ছটা বেরিয়ে এল। শূরের চোখ দিয়ে বেরোল তরল আগুনের মতো অশ্রুর ফোঁটা। কী বিপদ! তিনি তাড়াতাড়ি মুখোশটা পরে নিয়ে সোনার কাঁটা বালুর উপর রেখে দু পা পিছিয়ে গেলেন।

    - বিদেশী বণিক, ওটা মাটিতে ফেলে যাচ্ছো কেন? যার জিনিস তার কাছেই থাকা উচিত।

    মুখোশের ভিতর তরল আগুনের ফোঁটা আর নয়, স্রোত জমা হচ্ছে। শূর ভয়ের চোটে পিছন ফিরে দৌড়ে পালাতে শুরু করলেন।




    শঙ্খমালাদের নগরটা শূরের রাজধানীর চেয়েও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর নানারকম জলজ ফুলের গাছে শোভিত। পথগুলো চওড়া। পাথরে বাঁধানো। সৌধ ও অট্টালিকাগুলো স্ফটিকের তৈরী, যাতে দিনের আলো পরিবর্ধিত হয়ে এসে সেগুলিকে আলোকিত করে। অস্ত্রের নির্মাণ এবং চালনায় নগরের আবালবৃদ্ধবণিতা সুদক্ষ। শূর বাজারের পাশে একটা কামারশালায় হাতুড়ি পেটাবার কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন।

    কাজটা ভালোই চলছিল। কিন্তু তিন দিনের দিন দুটো রাজপুরীর সৈনিক এসে শূরকে ধরে নিয়ে গেল। শঙ্খমালা উদ্যানে একটা কাঠের বিশ্রাম আসনে বসে দ্রাক্ষারস সেবন করছিল। শূরের জন্যও একটা আসন রাখা। সৈনিকরা পথেই শূরকে বলছিল – যত্ন যত বেশি হবে, কপাল তত মন্দ। শূরকে পৌঁছে দিয়ে তারা এমন মুখ নিয়ে ফিরল যেন একটা নিরপরাধ মানুষকে এই মাত্র যমের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে।

    শঙ্খমালা অবশ্য শিষ্টভাবে শূরকে স্বাগত জানিয়ে বলল – বোসো, বোসো পলাতক বিদেশী। কী খাবে বলো।

    শূর একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন – আমি কী অপরাধ করেছি? কেন আমাকে ধরে আনা হল?

    শঙ্খমালা বলল – এখানে নিয়ম হল প্রশ্ন যা করার আমিই করব।

    - উত্তর না দিতে চাইলে?

    - কামারশালার কাজটা যাবে। আর কোথাও ঠাঁই পাবে না। থাকবে কোথায়? শুনলাম একটা ঘরও ভাড়া নিয়েছো এর মধ্যে। শৌখিন আসবাব কিনে ফেলেছো ধার করে। রান্নার লোক রেখেছো একটা! তোমার বাবুয়ানির গল্প এমন ছড়িয়েছে যে প্রহরীদের খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধেই হয়নি।

    লজ্জায় পড়ে গিয়ে তোতলাতে তোতলাতে শূর বললেন - না, মানে – সামান্য আমকাঠের কয়েকটা জিনিস...। গছিয়েই দিয়েছে জোর করে। আসলে পরচর্চা করা মানুষের স্বভাব।

    শূর রুষ্ট হয়ে ভাবছিলেন সারাদিন ধরে কামারশালায় হাতুড়ি পেটাবার পরেও তাঁকে শৌখিন বলে গুজব রটানো হচ্ছে।

    শঙ্খমালা বলল – বাবুয়ানিগুলো চলে গেলে জীবনটা কীরকম হয়ে যাবে ভাবতে পারছো?

    - আহা, আমি কি বলেছি প্রশ্নের উত্তর দেব না? নিয়মগুলো জেনে নিচ্ছিলাম মাত্র। কী তোমার প্রশ্ন বলো রাজকুমারী।

    - নামটা জানাও আগে।

    শূরের মনে হল প্রকৃত পরিচয় এখন প্রকাশের প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন – আমার নাম ধুর।

    - ধুর? এটা আবার একটা নাম হল?

    - ধুরন্ধরকে হ্রস্ব করে ধুর নাম হয়। আমাদের পাড়ার এটাই সবচেয়ে ভালো নাম। ভালোবেসে লোকেরা আমায় ধুর্‌রা বলেও ডাকে।

    শঙ্খমালা চিন্তিত মুখে আসনের পিঠে হেলান দিয়ে বসে আরেকটু দ্রাক্ষা রস পান করল। - আচ্ছা ধুর, এর পরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার আগে তোমাকে তোমার আসনে বসে তার সামনে রাখা দ্রাক্ষারসের পাত্রটা খালি করতে হবে। আগেই জানিয়ে দেওয়ার নিয়ম যে তার মধ্যে একটা মাদক দ্রব্য মেশানো আছে, যেটা সেবন করলে পেটের গভীর থেকে সত্যি কথাগুলো বেরিয়ে আসে।

    - আ-আমি মাদক সেবন করি না। ধুর তাড়াতাড়ি বলল। - কুলগুরুর নিষেধ।

    শঙ্খমালা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল – তিন দিন আগে যখন তোমাকে খুঁজে পাই তখন তোমার গা থেকে কীরকম মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল জানো? নাও, ন্যাকামো না করে চটপট ওটা খেয়ে নাও। তুমি একটা পাঁড় মিথ্যেবাদী। ওষুধ না প্রয়োগ করে তোমাকে দিয়ে একটাও সত্যি বলানো যাবে না। তবে ভয় নেই। পেটসত্যি ভীমৌষধ খাওয়াবার পর আমি কখনো ব্যক্তিগত কৌতূহল প্রকাশ করি না।

    শঙ্খমালার কাছে এইভাবে নিগৃহিত হয়ে শূর অপমানিত বোধ করছিলেন। তিনি দুমদাম করে পা ফেলতে ফেলতে আসনে গিয়ে বসলেন আর পুরো পাত্রটা চোঁ করে মেরে দিয়ে বললেন। - সত্যি বলতে আমি ভয় পাই নাকি? কী জানতে চাও বলো। আমি প্রস্তুত।

    শঙ্খমালা চুল থেকে মুক্তো বসানো কাঁটাটা খুলে বলল – এই কাঁটাটা কি একটা চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র? এটা কাছে রাখলে আমি অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছি কেন?

    - কী স্বপ্ন?

    - সেটা আমার বলা উচিত না।

    - শঙ্খমালা, এই যন্ত্রটা যতক্ষণ আমার কাছে ছিল আমি কোনো স্বপ্ন-টপ্ন দেখিনি।

    শঙ্খমালা একটু ইতস্তত করে বলল - আমি সেই স্বপ্নে অনেকগুলো মানুষ বধ করে তাদের দেহ পুষ্করিণীর জলে ফেলে দিয়েছি। সেই লোকগুলোর পোষাক পরিচ্ছদ তোমার মতো। শূর বলে একটি যুবক রাজা সেই স্বপ্নে শুধু ঘুমিয়ে থাকে। আমি তার নাম জেনে গেছি, অথচ কিছুতেই তার মুখ দেখতে পাই না। স্বপ্নে কিছু লোক প্রতি রাতে আমাদের হত্যা করার জন্য একটা রাজপুরীতে ঢোকে, আর এই কাঁটাটা আমাকে দেখিয়ে দেয় তারা কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে।

    - খুবই অস্বাভাবিক। ধুর জানাল। - কোনো চেনা লোক পেলে না সেখানে?

    - কী আর বলব, স্বপ্নে একবার শূর বলে সেই ঘুমন্ত রাজপুত্রের মুখ প্রায় নিজের দিকে ফিরিয়ে এনেছিলাম, এমন সময় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চোখের সামনে পঞ্চুদা এসে উপস্থিত। আশ্চর্য ব্যাপার, তাঁর খুব বয়স হয়ে গেছে দেখলাম। দেহটা আগের চেয়ে অনেক বড় আর রঙ আরো সাদা। স্বপ্নে একমাত্র পঞ্চুদাই কথা বলছিলেন। তিনি আমাকে বললেন সোনার কাঁটাটা যার কাছে থাকে তাকে সমস্ত বিপদ থেকে বাঁচায়। এটাকে যেন কাছ ছাড়া না করি।

    - হয়তো স্বপ্নগুলো তোমার মন থেকেই বেরিয়েছে। কাঁটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

    - কাঁটাটা আমাকে ইচ্ছে মতো চালাতে শুরু করেছে। আমার নয় জেনেও আমি এটাকে দূরে রাখতে পারি না। সারাক্ষণ পরে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি জানি স্বপ্নগুলো এর মধ্যে থেকেই বেরোয়। সত্যি করে বলো তোমাকে কি কোনো শত্রুপক্ষ পাঠিয়েছে আমাকে মন্ত্র দিয়ে বশ করার জন্য?

    - অবশ্যই না।

    - পঞ্চভূতদা স্বপ্নের মধ্যে আমাকে বললেন আমি একটা ভবিষ্যতের জগতে চলে এসেছি। তার কী মানে হতে পারে?

    ধুর ধুরন্ধর মন্ত্রীদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল – পঞ্চভূতদাকেই ডেকে জিজ্ঞেস করা উচিত সেটা।

    - তুমি তো শঙ্খ স্রোতে ভেসে এসেছো, তাই না? তাহলে কি তুমি এই কাঁটাটাকে ভবিষ্যত থেকে নিয়ে এসেছো নিজের সঙ্গে?

    ধুর দেখল সে সত্যি গোপন করতে চাইলেও তার ঠোঁট আপনা থেকে নড়ে উঠে বলে দিচ্ছে – হ্যাঁ, রাজকুমারী।

    শঙ্খমালা উঠে পড়ে বলল – ওষুধ খাওয়া থাকলেও তোমার এই উত্তরটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। যতক্ষণ না আমি এই কাঁটার রহস্য ভেদ করতে পারছি, তোমাকে আমাদের পুরীতেই থাকতে হবে।

    - মানে আমি বন্দী?

    - শুধু রাত্রিবেলা। দিনের বেলা তোমার কাজে যেতে পারো, কিন্তু নগরের বাইরে পা দিতে পারবে না। ভুলে যেও না, অষ্ট প্রহর তোমার উপর আমার দৃষ্টি থাকবে।




    দিন সাতেক ধরে শূর রাত্রিবেলা শয্যা থেকে উঠে রাজপুরীর প্রাঙ্গণে হাঁটছিলেন। শঙ্খমালার বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কারো সঙ্গে তাঁর আলাপ হচ্ছে না। সেটা মনে খচ খচ করছিল। এক সময় জানানো উচিত শূর তাঁদের হবু জামাতা। বার বার কী একটা আকর্ষণে শূর রাজপুরীর পিছন দিকে বালুকাবেলায় গিয়ে উপস্থিত হন। এখানে পাতালের নিজস্ব সরোবর, যার ধারে শঙ্খমালা তাঁকে প্রথম খুঁজে পায়। শূর ভাবছিলেন শঙ্খ সরোবরের নিচে স্ফটিকের আকাশের তলায় আরেকটা সরোবর কী করে এল? প্রহরীদের কাছ থেকে জানা গেল এই সরোবরটার নাম হংস। তার মানে শূর শঙ্খ সরোবরে নেমে হংস সরোবরে এসে ভেসে উঠেছেন। দুটোর মাঝখানে স্ফটিকের দেয়াল। শঙ্খমালাকে একদিন দেখতে পেয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধরেছিলেন শূর।

    - কী ব্যাপার ধুর? হাঁপাচ্ছো যে?

    - শঙ্খ আর হংস কি কোথাও এক হয়ে গেছে?

    - এক হাজার বছর আগে নাকি এই স্ফটিকের ব্যবধান ছিল না। তখন দুটো নয়, একটাই জলাশয় ছিল।

    - এখন লোকেরা এই স্ফটিক ফুঁড়ে উপরে যায় কী করে?

    - বিহঙ্গমদের পক্ষে সহজ। মানুষদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পালাবার চেষ্টা বৃথা।

    - তাহলে তুমি আমাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করছো কেন? যেখানেই যাই, তোমার উপস্থিতি অনুভব করি।

    - মনের ভুল ধুরন্ধর পথিক। তোমার মনের ভুল।

    শূর বললেন – শঙ্খমালা, মনে রেখো আমাকে যেতেই হবে একদিন। কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।



    কামারশালার কাজের ফাঁকে ফাঁকে শূর একটা সাড়ে তিন হাত লম্বা পেটানো উড়ু লৌহের বজ্রের মতো কঠিন কিন্তু গাছের পাতার মতো পাতলা অসি নির্মাণ করছিলেন। শূর আর শঙ্খমালার পালাবার পথ খুলে দেবে সেটা। এখন শঙ্খমালাকে রাজি করানো বাকি। শূরের সঙ্গে সে শঙ্খ তরঙ্গের হাল সমেত ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যেতে চাইবে কি? সোনার কাঁটাটাই ভরসা। যদি সেটা শঙ্খমালার কানে এই মন্ত্র ঢুকিয়ে দিতে পারে।

    একদিন বিকেল হয়ে এসেছে। শূর উড়ু লৌহের অসিটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় শঙ্খমালা তার দুজন দেহরক্ষী সঙ্গিনীকে নিয়ে কামারশালায় এসে হাজির। শূর তলোয়ারটা শঙ্খমালা আর তাঁর সঙ্গিনীদের হাতে পরীক্ষা করার জন্য দিলেন। সবাই অবাক। এত হালকা একটা অস্ত্র হতে পারে?

    শূর বললেন – এখনো তৈরী হয়নি। সম্পূর্ণ হওয়ার পর এটা দিয়ে স্ফটিকের স্তম্ভ কেটে আধখানা করা যাবে। শঙ্খমালা এটা আমি তোমার জন্য বানাচ্ছি।

    - তাহলে দোকান বন্ধ করে চলো ধুর। বাইরে কী সুন্দর একটা দিন। তোমাকেও আমি বাজার থেকে একটা কিছু কিনে উপহার দেব।

    চারজনে মিলে পাতালপুরীর বাজারে হাঁটতে শুরু করল। দারুণ দারুণ সব দোকান। ডাঙার মানুষরা দেখেইনি এরকম পণ্য। এমন সব মণি ও রত্ন দিয়ে সাজানো যা শুধু জলের নিচেই পাওয়া যায়। ধুর যা দেখছে সেটাই তার পেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তিনটে মেয়ে মিলে হাসতে হাসতে এক একটা দোকানে ঢুকছে আর কিচ্ছু তাদের পছন্দ হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত যখন ধুর কোনো কিছু পাওয়ার হাল ছেড়ে দিয়েছিল তখন মেয়েরা পছন্দ করে কিনল একটা ধাড়ি আর ভূষিকালো বুড়ো ইঁদুর।



    - ওয়েট, ওয়েট, ওয়েট। আমার সামনে বসা তিনটে মেয়ে তাদের কুলফি টুলফি নামিয়ে রেখে আমার উপর ঢাল তলোয়ার নিয়ে হামলা করে দিল।

    - হোয়াট আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? সপ্‌না চার্জ্‌ করল।

    তানিয়া বলল – প্রথমে তো আমাদের স্পুফ করার জন্য তিনটে মেয়ে ঢুকিয়েছো।

    পম্পা বলল – তার উপরে পাতালের বাজার। মানে পালিকা বাজার ছাড়া আর কী?

    সপ্‌না বলল – বুড়ো ইঁদুর পৃথিবীর কোথায় বিক্রী হয়? এটা তো রদ্দি নয়, কবাড়া প্লট।

    আমি বললাম – গল্পের মধ্যে এই ইঁদুরটার একটা ব্যাখ্যা আছে। প্যাঁচা থাকতে পারে তো ইঁদুর থাকবে না কেন?

    - মানছি গিনিপিগ লোকে কেনে। বাচ্চা ইঁদুর পুষবার জন্য হয়তো বিক্রী হতে পারে। কিন্তু বুড়ো ইঁদুর একটা জঘন্য জিনিস। কে সেটা কেনে? এই মেয়েগুলো কি বোকা, না পাগল?

    - কোনোটাই না। তুমি গল্পটা আমাকে বলতে দিলে আমি সেটা প্রমাণ করে দেব। কাইন্ডলি আমি কি সেটা কন্টিনিউ করতে পারি?

    - এটা ফাইনাল কাট থেকে বাদ যাবে। সপ্‌না গজগজ করতে করতে চুপ করল আর আমিও কাহিনীর সূত্রে ফিরে গেলাম।



    আমি বললাম – ইঁদুরটাকে ভালো করে চেনা যাক। সেটা কারো পছন্দ হচ্ছিল না। হয়তো দেখতে ভালো ছিল না, কিম্বা একটু চুপচাপ ছিল বেশি। বহুদিন ধরে বিক্রী হয়নি। তার ভাইবোন সঙ্গী সাথীরা সবাই এক এক করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কোলে চেপে তাদের বাড়ি চলে গেছে। এটাই বছরের পর বছর ধরে দোকানের অন্ধকার ঘরে পড়ে ছিল। বুড়ো তো হবেই। এখন সে চোখে ভালো দেখে না। শরীরটা এমন শুকিয়ে গেছে যে বেড়ালেও পেলে খাবে না। শঙ্খমালার এক সখি বলল – আহা রে, এটা বড় দুঃখী ইঁদুর। একে একটা ভালো জীবন দেওয়া উচিত। ধুরের তো বাড়িতে কেউ নেই। ও এটার দেখাশোনা করতে পারবে।

    এদিকে ধুর বলল – দ্যাখো কাকলি, বাকলি আর শঙ্খমালা, এই ইঁদুরটা তো কয়েকদিনের মধ্যে মরে যাবে, তারপর আমি আবার একা হয়ে যাব। মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? বরং এটা এখানেই থাকুক। আমি বিকেলে মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাব।

    তখন দোকানদাররা ইঁদুরটার ঘাড় ধরে সেটাকে জমি থেকে খানিকটা তুলে দেখাল মাটিতে একটা ডিম পড়ে আছে। তারা বলল – এই বুড়ো ইঁদুরটার নাম বাজীরাও। ও কোত্থেকে একটা ডিম তুলে এনে সেটাতে তা’ দিচ্ছে। ডিমটা যদি ফুটে যায় তো তার ভিতর থেকে যা বেরোবে সেটা তোমাদের ফাউ।

    কাকলি-বাকলি বলল – তাহলে তো কথাই নেই, বাজীরাও মরে গেলেও তোমার কাছে কিছু একটা থাকবে।

    ব্যাস আর কি! বাজীরাওকে তার প্রিয় ডিম সমেত ধুরের বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে এল মেয়েরা।

    শঙ্খমালা যখন একটা তলোয়ার নিয়ে ধুরের বাড়ির উঠোনে একটু ব্যায়াম করছিল তখন কাকলি-বাকলি ধুরকে একা পেয়ে ফিসফিস করে বলল – যে লোক একটা বুড়ো ইঁদুরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না আর একটা আ-ফোটা ডিম ফোটাতে পারে না সে কখনো একটা ভালো বর হতে পারে? তাকে কোন মেয়েটা পছন্দ করবে?

    - ডিমটা ফুটিয়ে দিচ্ছি। এই ইঁদুরটার গায়ে বড় দুর্গন্ধ।

    - স্নান-টান করিয়ে গায়ের লোম আঁচড়ে এমন করে দাও যাতে সবার কোলে নিতে ইচ্ছে করে। মানুষের বাড়িতে বুড়ো দাদু-টাদু থাকে না?

    এই বলে কাকলি তার বাঁ চোখ আর বাকলি তার ডান চোখ টিপে দিল।



    মঙ্গলবার পঞ্চভূত প্যাঁচা দেখা দিল হংস সরোবরের পাড়ে। ধুর তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল স্ফটিকের দেয়াল ফুঁড়ে উপরে যাওয়ার সবচেয়ে সোজা পথটা কোথায়। পঞ্চভূত খস খস করে কান চুলকে বলল - পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সুড়ঙ্গ আছে। যে পথে আমি যাওয়া আসা করি। কিন্তু সেটা মোটেই মানুষের পক্ষে সহজ বা নিরাপদ নয়।

    - আর কোনো পথ নেই?

    একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল পঞ্চভূত। তারপর হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বলল – না।

    ধুরের মনে হল পঞ্চভূত কিছু একটা গোপন করছে।



    এক মাস এইভাবে কাটার পর এক রাতে ধুর হংস সরোবরের ধারে একা পায়চারি করছিল। আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস। শোঁ শোঁ করে কোথা থেকে একটা উষ্ণ ও শুষ্ক হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ধুরের মনে হল তার সময় আগত। দূরে অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছিল। ধুর চলার ভঙ্গি দেখেই বুঝেছিল সেটা কে। মূর্তিটা খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ধুর ভাবছিল সে-ই এগিয়ে যাবে। দূর থেকে ছায়ামূর্তি নিষেধের হাত তুলে বলল – না বিদেশী, দাঁড়াও। আর এগিও না।

    ধুর বলল – শঙ্খমালা তুমি নিজের ইচ্ছেয় এলে, না কাঁটাটা তোমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে এখানে?

    শঙ্খমালা দূর থেকে বলল – শূর বলে এক রাজার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য সোনার কাঁটাটা আমাকে ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু যাকে চিনি না জানি না তাকে আমি পছন্দ করব কেন?

    ধুর বলল – শঙ্খমালা, শূরকে আমি খুব চিনি। লোকটা মোটেও সুবিধের না। মদ্যপ, লোভী, ভীতু, আর রসকষহীন একটা চরিত্র। তাকে বাঁচিয়ে তোমার কোনো লাভ নেই।

    শঙ্খমালা জিজ্ঞেস করল – তুমি তার কে হও?

    - আমি? আমি তার রাজ্যের একটা সামান্য মানুষ। আমিও একটু ভীতু আছি। কিন্তু তার মতো অতটা নয়। শৌখিন হলেও তার মতো লোভী নয়। আর আমাকে কেমন দেখতে সেটা তো জানোই। কেউ মন্দ বলে না। শূরের তুলনায় তো অনেক গুণ ভালো।

    - উফ্‌, ধুর তুমি পঞ্চুদার চেয়েও বাজে কথা বলো। তার উপরে ঘোর মিথ্যেবাদী। তোমার কোন কথাটা রাখব আর কোন কথাটা ফেলব?

    - একটা কাজের কথা বলি তাহলে শোনো। এই ঝড়ের শব্দটা শুনতে পাচ্ছো? জলের নিচ থেকে একটা আলোর ধারার বুদবুদগুলো আমাদের ডেকে বলছে – আয়, আয়, আয়। শঙ্খমালা তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমরা এই আলোর ধারাটাকে খুঁজে বার করে অন্য কোনো একটা ভবিষ্যতে চলে যাই, যেখানে এই সব শূর-ফুরের বালাই নেই। সেখানে বিরাট কোনো হুতোম প্যাঁচা আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াবে না।

    - তোমার মতো মিথ্যুকের সঙ্গে আমি যাব কেন?

    - কারণ এই সোনার কাঁটাটা যত তোমাকে আমার থেকে দূরে করতে চেয়েছে, ততই তুমি আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছো। আজ না হয় কাল শঙ্খ স্রোত আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসবে। তখন তুমি কী করবে শঙ্খমালা?

    শঙ্খমালার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে বলল – আমার মা নেই বাবা নেই। শুধু একটা অসুস্থ দাদু আছে। তাকে ছেড়ে কোথাও যাব কী করে? আমার কাছে তো শঙ্খ সাগরের হাল। সেটা ব্যবহার করে তোমাকেই আটকে রেখে দেব আমি। শঙ্খ স্রোতকে নিতে দেব না।

    ব্যাস্‌! আর কী চাই? শঙ্খ স্রোতের নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্র হংসের তট থেকে একটা প্রচণ্ড গর্জন ভেসে এল। যেন সেটা আর কোনো পুষ্করিণী নয়, একটা মহাসাগর হয়ে গিয়েছে।

    শঙ্খমালা দুই বাহু বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ধুরের দিকে এগিয়ে আসছিল। কয়েক পা মাত্র বাকি। সে দেখল একটা দুর্দান্ত দমকা হাওয়া এসে ধুরকে উড়িয়ে নিতে চাইছে আর তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে ধুরের কাছ থেকে। ধুর বালির উপর বসে পড়ে পাতালপুরীর জমি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিল।

    হঠাৎ আকাশে প্রবল জোরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য শঙ্খমালার দুচোখ অন্ধ। সে যখন দৃষ্টি ফিরে পেল তখন ধুর বলে অজ্ঞাতকুলশীল যুবকটি আর সেখানে নেই।

    তার জায়গায় বালিতে পোঁতা আছে একটা বজ্রের মতো কঠিন, ঝকঝকে সাড়ে তিন হাতের তলোয়ার।




    এতটা বলে আমি চুপ করেছিলাম। তিনটি মহিলা শ্রোতা আমার দিকে উৎসুক মুখে চেয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম – তোমরা সবাই ঠিক আছো?

    - ঠিক থাকব না কেন? সপ্‌না জিজ্ঞেস করল।

    - না, মানে, আপত্তিজনক কিছু ছিল না তো গল্পের এই অংশটাতে?

    - ইঁদুরটার একটা যেমন তেমন ব্যাখ্যা দিয়েছ। খুব যে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে তা বলছি না। কিন্তু তুমি যে আমাদের সমালোচনা শুনে কিছু একটা করার চেষ্টা করছ সেটা প্রশংসনীয়। যা হোক, থামলে কেন?

    আসলে আমি থেমেছিলাম ভাবার জন্য। গল্পের এতটা আমার মোটামুটি আগেই জানা। এরপর যা ঘটবে সেটা বানিয়ে বানিয়ে তাজা পরিবেশন করতে হবে। বললাম - এইখানে ইন্টারভাল। গল্পের প্রথম দুটো অঙ্ক শেষ হল। এবার তৃতীয় অঙ্কের পালা। তোমরা সায়েন্স ফিকশনের কাঠামোটা ধরতে পারছ তো? আমার বন্ধু প্রবুদ্ধ যে দুটো নেস্টেড টাইম ট্র্যাভেলের লুপ চেয়েছিল, সে দুটো এখানে শেষ হয়েছে।

    পম্পা বলল – প্রথম লুপটা হল ফার্স্ট অ্যাক্ট। দ্বিতীয়টা সেকেন্ড। তাই তো?

    - কারেক্ট। একটা লুপে অনামিকা কালভ্রমণ করেছে। অন্যটাতে শূর। অনামিকার লুপটা শূরের লুপের ভিতরে পাখির বাসার মতো ঢোকানো আছে। অর্থাৎ সেটা পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়েছে। এই দুটো চক্রের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। সেটা কী বলো তো?

    - ওই সোনার কাঁটা। সেটা দুটো লুপেই বিনা ভাড়ায় যাত্রা করেছে।

    - একদম ঠিক! ধুরের রেখে আসা সোনার কাঁটাটা ব্যবহার করে অনামিকা এসেছিল শূরের বাড়িতে। অনামিকার রেখে যাওয়া সেই একই কাঁটা সঙ্গে নিয়ে শূর শঙ্খমালার কাছে পৌঁছোন। এই কাঠামোটা জিওগ্রাফির ক্লাসে বসে বসে প্রবুদ্ধ আর আমি খসড়া করেছিলাম। প্রবুদ্ধ খাতায় একটা ডায়াগ্রামও এঁকে দিয়েছিল। সোনার কাঁটাটা আসলে এই পৃথিবীর নয়। একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে টাইম লুপের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সেটার কোনো জন্ম হয়নি। কোনো মৃত্যু নেই। লুপদুটোর বাইরে সেটাকে ব্যবহার করা যাবে না।

    পম্পার পার্সে সবসময় কলম থাকে। মেয়েদের একটু অপেক্ষা করতে বলে আমি পম্পার কলমটা নিয়ে তার নতুন সালোয়ার স্যুটের ভাঁজ থেকে পাওয়া ফিনফিনে ব্রাউন কাগজের উপর প্রবুদ্ধর ডায়াগ্রামের একটা কপি এঁকে লেবেল করে দিয়ে বললাম – একবার ভালো করে দেখে নাও এটা।





    ছবিটা সবার দেখা হলে পম্পা তার বান্ধবীদের বলল - ওর প্রবুদ্ধ বন্ধুটা অসম্ভব চালাক। অর্ধেকটা ক্লাসকে সে-ই চালায়। আচ্ছা জয়, বাকিটাও প্রবুদ্ধর কাছ থেকে টুকেছিস না নিজের কিছু অবদান আছে?

    আমি বললাম – প্রবুদ্ধ শুধু লুপদুটো এঁকে দেখিয়ে দিয়েছে। সে কিরকম নাক উঁচু ছেলে তা তো জানো। তারপর সে কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে বলে বাকি অঙ্কটা সোজা। নিজেই করে নে।

    – সেটা করা হয়েছে?

    - ওই আর কি। ভাসা ভাসা ধারণা আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম বিয়োগান্তক হবে। এখন সেটাও পালটাতে হচ্ছে তো! তোমাদের আর জিসাস ক্রাইস্টের শুভেচ্ছা নিয়ে এবার পুরো অঙ্কটা মেলাবার চেষ্টা করছি। শুরু হচ্ছে থার্ড এবং লাস্ট অ্যাক্ট!

  • ১ম অংশ | ২য় অংশ | ৩য় অংশ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)