‘পলিম্যাথ’ কথাটার বাংলা বহুবিদ্যাবিশারদ বললে চলে হয়ত, কিন্তু তাতে বোঝান মুশকিল খোর্খে লুইস বোর্খেস (১৮৮৯-১৯৮৬)-কে ঠিক কোন অর্থে পলিম্যাথ বলে থাকে সারা সাহিত্যবিশ্ব। তাঁর পাঠ-পরিধির বিস্তৃতির নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে ছোট গল্প, মেটা-ফিকশন, প্রবন্ধ এবং কবিতায়। পোস্ট মডার্নিস্ট সাহিত্যধারার একটি জঁরকে তিনি এককভাবে পুষ্ট করে গেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে যেভাবে তিনি প্রভাবিত করেছেন তার তুলনা বিরল। বলবার কথা এই যে, বোর্খেসের ছোট গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতাকে একে অন্যের পরিপূরক বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাঠক জানেন, তাঁর প্রবন্ধ ফিকশনের মত, ফিকশন কবিতার মত এবং কবিতা কখনও ছোটগল্প, কখনও প্রবন্ধের আত্মাকে ধারণ করেছে।
মিউজিও বা জাদুঘর নামের এই ক্ষুদ্র সংকলনটি তাঁর El hacedor (নির্মাতা) নামের কাব্যগ্রন্থ (১৯৬০) থেকে নেওয়া। একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দেওয়াই যায় এই মর্মে যে—এই জাদুঘরের সব চরিত্র কাল্পনিক না হলেও তাদের কোটেশন নিয়ে মজা করেছেন, কোটেশনের উৎস নিয়েও। কোটেশনের উৎস হিসাবে নামাঙ্কিত গ্রন্থ বা লেখক সবই বোর্খেসের কল্পনাপ্রসূত বলে মনে হয়। ‘মনে হয়’ কথাটা জেনেশুনেই ব্যবহার করতে হবে কেন না বোর্খেসের পাঠ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। হতেই পারে সে পাঠ এক ও অনন্য।
বৈজ্ঞানিক পেশিশীতলতা নিয়ে কয়েক কথা
(DEL RIGOR EN LA CIENCIA)
...আলোচ্য সাম্রাজ্যটিতে, মানচিত্রকারের শিল্পসুষমা এত নিখুঁত মাত্রা স্পর্শ করেছিল যে একটি অঞ্চলের মানচিত্র একটা শহরকেই ঢেকে ফেলল এবং একটা সাম্রাজ্যের মানচিত্র ছেয়ে ফেলল একটা গোটা অঞ্চলকেই। কিছুদিন পরে এই অতিবৃহৎ মানচিত্রগুলো আর উপযোগী মনে না হওয়ায়, মানচিত্র নির্মাণের শিক্ষালয়গুলো সাম্রাজ্যের মানচিত্র বানালো সাম্রাজ্যের আকারেই প্রতিটি বিন্দু মিলিয়ে মিলিয়ে। পরবর্তী প্রজন্মে মানচিত্রকলার প্রতি এই উৎসাহ স্তিমিত হয়ে এলে এই মানচিত্র আনুষঙ্গিকতা হারিয়েছে বলে মনে করা হলো, এবং কিঞ্চিদধিক গুরুত্বহীনভাবে তারা সূর্য ও হিমঋতুর খামখেয়ালিপনার শিকার হয়ে পড়ল। পশ্চিমের মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মানচিত্রের প্রত্নঅবশেষ, পশুদের ও ভিখারীদের বসতি হয়ে। মাটির কোথাও ভূগোলের অবশিষ্টাংশ বলে কিছু পড়ে নেই আর।
- Suárez Miranda, Viajes de varones prudentes,libro cuarto,cap.xiv,Lérida.1658
- সুয়ারেজ মিরান্ডা, প্রাজ্ঞ মানুষের অভিযান, চতুর্থ খণ্ড, অধ্যায় xiv (Lerida, 1658)
শ্লোক চতুষ্পদী
(CUARTETA)
অন্য অনেকে মরেছে, তবে তা বিগত যুগের কথা,
সেই ঋতু (প্রত্যেকে জানে) মরার জন্য সবচেয়ে অনুকূল ছিল।
এমন কি হতে পারে আমি, ইয়াকুব আলমানসুরের* এক প্রজা
তেমনভাবেই মরতে পারি যেভাবে গোলাপ মরেছে, এবং অ্যারিস্টটল?
- de Diván de Almotásim el Magrebi (siglo xii)
- আল মাঘরেবি-র আল্মোক্তাদির-এর দিবান থেকে ( দ্বাদশ শতাব্দী)
* ইয়াকুব আল মানসুর চরিত্রটি কাল্পনিক নয় পুরোপুরি। ছিলেন একাদশ শতাব্দীর আরব যোদ্ধা যিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেছিলেন।
সীমারেখা
(LÍMITES)
ভের্লেইনের* একটা পঙ্ক্তি ছিল আমি আর স্মরণে আনতে পারি না সেটা
কাছেই একটা রাস্তা রয়েছে আমার পায়ের সীমানায় সেটা নয়।
একটা আয়না রয়েছে আমায় শেষবারের মত দেখে ফেলেছে সেটা
একটা দরজা আমি বন্ধ রেখেছি পৃথিবীর শেষ সীমানায়
আমার লাইব্রেরির বইগুলোর মধ্যে (আমি এখন তাদের দিকে তাকিয়ে) কিছু
আমি কোনদিন খুলবো না।
এই গ্রীষ্মে আমি পঞ্চাশ হব
মৃত্যু আমাকে নিংড়ে নিচ্ছে, নিরন্তর।
- de Inscripciones (Montevideo, 1923) de Julio Platero Haedo
- খোদাই করা বাক্যাবলি থেকে (মন্টেভিডিও, ১৯২৩) খুলিও প্লাতেরো আয়েদো
* ফরাসী কবি পল ভের্লেইন
কবির কথায় তাঁর গৌরবগাথা
(EL POETA DECLARA SU NOMBRADÍA)
আমার গৌরব মাপে স্বর্গসমান।
প্রাচ্যের পাঠাগারে আমার কাজের জন্য কাড়াকাড়ি।
আমীরেরা আমায় খোঁজে মুখে সোনা ভরে দিতে চেয়ে।
পরীরা আমার নতুন কাব্য সব হৃদয় হতেই আওড়ায়।
আমার কাজের প্রকরণ শুধু ব্যথা ও অসম্মান।
সুতরাং আমি জন্ম হতেই মরে আছি।
— del Divan de Abulcasim el Hadrami (siglo xii)
—হাদ্রামির আবুলকাসিম-এর গীতি থেকে
দয়ালু বান্ধব
(EL ENEMIGO GENEROSO)
১১০২ খ্রিস্টাব্দে, ম্যাগনাস বারফোড* আয়ার্ল্যান্ডের অন্তর্গত সব রাজ্যই অধিকার করে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। কথিত আছে মৃত্যুর ঠিক আগের রাতে তিনি ডাবলিনের রাজা মিউরচারটেশ-এর কাছ থেকে যে অভিনন্দনপত্র পেয়েছিলেন তা এই রকম:
আমার সোনা আর ঝড় তোমার সৈন্যদলের ভালোই কাজে আসবে, ম্যাগনাস বারফোর্ড।
আমার রাজ্যের মাটিতে তোমার আগামীকালের যুদ্ধের জন্য আগাম সাফল্য কামনা করি।
তোমার রাজকীয় হাত বুনে দিক তরবারির পোষাক, বুনে দিক ভয়।
যারা তোমার তরবারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে তারা যেন রক্তিম রাজহংসের খাদ্য হয়ে যায়।
যেন তোমার বহু দেবতার দল তোমাকে পূর্ণ গৌরবানুভূতি দিতে পারে—যেন তারা তোমার তৃষ্ণা রক্তে নিবারিত করতে পারে।
যেন ঊষার উদয় তোমার জয় নিয়ে আসে, তোমার, পায়ের নীচে রেখে যে দলে ফেলছ আয়ার্ল্যান্ডের মাটি, সেই তোমার রাজন।
যেন কালকের থেকে উজ্জ্বল কোন দিন তোমার জীবনে না আসে আর।
কারণ সেটাই তোমার শেষদিন হবে, রাজা ম্যাগনাস, দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি।
কারণ কালকের দিনের আলো ফুৎকারে নিভে যাবার আগে, আমি তোমায় হারাবো এবং ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেব তোমায়, ম্যাগনাস বারফোর্ড।
- Del Anhang zur Heimkringla ( 1893), de H. Gering
- অ্যানহ্যাং জুর হেইমক্রিংলা ( ১৮৯৩) থেকে, এইচ গেরিং কৃত
* নরওয়ের রাজা যিনি আয়ার্ল্যান্ড দখলের যুদ্ধে প্রাণ হারান।
হেরাক্লিটাসের* আক্ষেপ
(LE REGRET D’HÉRACLITE)
এই আমি যে আসলে অনেক মানুষ কোনদিন সেই মানুষটি হয়ে উঠতে পারি নি যার আলিঙ্গনে মাতিলদে উরব্যাক সান্ত্বনা পেয়েছিল।
- Gasper Camerarius, en Deliciae Poetrum Borussiae, vii
- গ্যাসপার ক্যামেরারিয়াস, ‘ডেলিসি পোয়েট্রাম বোরুসি’ vii থেকে।
হেরোক্লিটাস ( খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫-৪৭৫) বর্খেসের প্যাশন, অবসেশনও বলতে পারি। তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতায় হেরোক্লিটাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এশিয়া মাইনরের এফেসাস অঞ্চলের দার্শনিক