• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | রম্যরচনা
    Share
  • মধুপুরের পাঁচালি: বাগরো (৮০/২০); চটকার মাঠ; কহারিন (১০০/০) : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়




    মধুপুরে আমাদের সামনের বাগানের সান্ধ্য মজলিসে প্রায়ই নানা রকম অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা যেতো। উনিশ শো ষাটের দশকের গোড়ার দিক, সভ্যরা সকলেই অবসর পেয়েছেন বা পাচ্ছেন বা পাবেন, অতএব সম্রাজ্ঞীর রাজত্বের শেষ নাগাদ অনেকেরই জন্ম। কাজে কাজেই সেই সব কাহিনীগুলিতে কখনো কখনো সাহেব মেমসাহেবদের আবির্ভাব হতো।

    এমনই এক বিবরণ শুনুন। অবশ্য এটির সময়কাল স্বাধীনতার কিছুটা পরে। ১৯৫৪/৫৫। তবুও সাহেবী রাজ-এর ছোঁয়া একটু আছে।

    আট দশ বছর আগেকার কথা। মিঃ সেন তখন ছিলেন কোডার্মার মহকুমা সাহেব, মানে এস ডি ও, সাব-ডিভিশনাল অফিসার। উনিই এ কাহিনী বলছিলেন আমাদের বাগানে কফি খেতে খেতে - একমাত্র উনিই চায়ের বদলে কফি পছন্দ করতেন বলে স্টেশনের হুইলারের পালিতবাবুকে দিয়ে হাওড়া থেকে কফি আনানো হয়েছিলো।

    আমাদের কাছেই গিরিডি। সেখান থেকে কোডার্মা সোজাসুজি কাক-উড়লে সত্তর মাইল। প্রায় নব্বই বছর ধরে সিঙ্গল রেললাইন হবো হবো করছে কিন্তু হচ্ছে না। অভ্র লরীর ভাঙাচোরা জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে সরকারী গাড়ী বা জীপ যাতায়াত করে। নব্বই মাইল মত অ্যাঁকা ব্যাঁকা রাস্তা।

    সেবার বড়দিনের ছুটির পর মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার ধরে সকালবেলা কলকাতা থেকে মধুপুর এসে পৌঁছলেন মিঃ সেন। মধুপুরে অপেক্ষা করছিলো ওনার জীপ। কোডার্মা যাবেন সেটায়।

    তারপর বাকীটা সেন সাহেবের জবানিতেই শুনুন না হয়।
    ......

    এখান (মধুপুর) থেকে ছেড়ে গিরিডির একটু আগে মহেশমুন্ডায় ড্রাইভার আব্রাহাম খালখো জিগ্যেস করলো গিরিডিতে কোনো দরকার আছে কি না। দরকার নেই শুনে ও গিরিডি বাইপাস করার সরু রাস্তা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কোডার্মা রোড পৌঁছে গেলো। তারপর দিব্যি যাচ্ছি, মাইল কুড়ি মাত্র বাকি, নতুন জীপটা গেলো থেমে।

    বুঝতেই পারছেন, বেশীর ভাগ ট্রাফিক ওদিক (গ্ৰ্যান্ড কর্ড সাইড) দিয়ে যায়, এ রাস্তাটা ফাঁকা, কোথাও কিছু নেই।

    কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে আব্রাহাম বললে - স্যার কিছুই তো বুঝতে পারছি না, তা সামনে ডান দিকে বাগরো গ্ৰাম আর বাঁ দিকে ফরেস্ট বাংলো রয়েছে। আপনার ব্যাগ বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে একটা সাইকেল নিয়ে আমি কোডার্মা চলে যাই, যদি হুকুম দেন। আমি বললাম - তাই চলো।

    মিনিট কয়েক পর একটা কাঁচা রাস্তা পড়লো। দেখি কিছু দূরে একটা বড় বাংলোয় যাচ্ছে সেটা। আমাদের দেখে দুজন লোক এগিয়ে এলো। একজন খানসামা বা বাবুর্চি, একজন পাগড়িপরা বেয়ারা। মস্ত বড়ো একখানা ঘর, বিলিতি বাথরুম লাগোয়া, আমাকে ওরা খুলে দিলো। চা খেয়ে ওদের একজনের সাইকেল ধার নিয়ে খালখো কোডার্মা চলে গেলো।

    বিজলী বা টেলিফোনের কোনো চিহ্নই দেখা গেলো না। বুঝে গেলাম যে অন্ততঃ একটা পুরো দিন ঐ বাংলোয় কাটাতে হবে।

    বাড়িটার চেহারাটা একটু বলি। নীচু একটা টিলার ওপর বড় চৌকোনা বাংলো। চতুর্দিকে বিরাট চওড়া বারান্দা। পুরো বারান্দাটা গ্ৰিল দিয়ে ঘেরা, সামনে পেছনে গেট। চার কোণে চারটে বড় ঘর, প্রত্যেকটায় বাথরুম। সামনে মাঝখানে একটা মস্ত বড়ো বসবার ঘর, সেটাতেই খাবার টেবিল, গাড়ীর ব্যাটারি লাগানো রেডিও, চলে না। তার পেছনের ঘরটায় ভাঁড়ার, রান্না। চারটে গেস্ট রুমের দরজাই বারান্দার ওপর। তার মধ্যে একটা গেস্ট রুমে খানসামা আর বেয়ারা থাকে। সামনের গেস্ট রুম দুটোর আবার বসবার ঘরটার সঙ্গে দরজা রয়েছে। রান্না ঘর আর খাবার ঘরের মধ্যে স্প্রিং দেওয়া দরজা।

    বাইরে বড় কুয়ো, ডীজেল পাম্প, আধমরা কুৎসিত বাগান।

    কখন কি রকম খাওয়া দাওয়া করবো জেনে নিয়ে ওরা তো চলে গেলো। আমি কয়েকটা কাগজ পত্র বার করে ঘরের টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    তা দেখলাম ওরা খাওয়ায় ভালো। বিকেলে চা টা দিলো। তারপর অন্ধকার হওয়ার আগে সামনে পেছনে গেটে তালা লাগিয়ে বেশ কয়েকটা হারিকেন আর পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো বেয়ারাটি। আর ঘরের ফায়ারপ্লেসে রেখে দিয়ে গেলো এক হাঁড়ি আগুন।

    ডিনার সেরে শুতে যাবার সময়ে দেখলাম রাতে প্রয়োজন হলে ওদের ডাকবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। যাকগে। দরজা জানালা এঁটে শুয়ে পড়লাম, বসবার ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক রেখে। সেখানে একটা লন্ঠন কমিয়ে রাখা ছিলো।

    অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো কিসের আওয়াজে। সেই সঙ্গে শুনলাম চাপা মেয়েলি গলায় - বাবু, এই বাবু!

    পাশের ঘরের লন্ঠনটা উসকে রিভলভারটা হাতে নিয়ে দরজাটা একটু খুললাম। দেখি মাঝবয়সী এক ফর্সা রোগা মহিলা কম্বল জড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে ঠান্ডায়। আমাকে জিগ্যেস করলো - বাবু, তুমি কি বাঙালী? আমাকে রাত্তিরের মত ও ঘরটায় থাকতে দেবে? বড্ড শীত যে আজ!

    আমি অবাক - এই রাত্রে আপনি কোথা থেকে আসছেন? গেট কি খোলা? আর ও ঘরে তো কিছুই নেই, দাঁড়ান একটা কম্বল দিচ্ছি।

    - আই নো দিস বাংলো ভেরি ওয়েল, বাবু। উই উইল টক ইন দা মর্নিং। ব্লেস ইউ অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ। গুড নাইট।

    গেটটা দেখলাম বন্ধ। শুতেই চোখ কেমন বুঁজে এলো। ঘুমিয়ে পড়লাম।

    চা এনে সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো বেয়ারা। দেখি কেউ কোথাও নেই। বেয়ারাকে জিগ্যেস করতে মুখটা তার শুকিয়ে গেলো। সে গিয়ে খানসামাকে ডেকে আনলো। তারপর শুনলাম -

    বিশ তিরিশ বছর আগে কলকাতা থেকে এক সাহেব গাড়ি চালিয়ে মেমসাহেবকে নিয়ে ঐ বাংলোয় বেড়াতে আসে। কাছাকাছি বাঘের ডাকে রাতে ঘুমোতে পারেনি। সকালে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে খোঁজাখুঁজির পর জঙ্গলে পাওয়া যায় সাহেবের টুপি আর বন্দুক। মেমসাহেব কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে ওগুলো নিয়ে বাংলোয় ফেরে। তারপর একটা ঝোলায় কতকগুলো গুলি আর বন্দুকটা নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়, কেউ থামাতে পারে নি। আর ফেরেনি। তার পর মাঝে মাঝে রাতে বাঘের গোঙানি, গর্জন নয়, শোনা যেতো আর সকালে একটা করে বাঘের লাশ পড়ে থাকতো। গায়ে কোথাও কোনো গুলির দাগ কিন্ত থাকতো না। এ দিগরের বাঘ যা ছিলো ওই ভাবে শেষ।

    কখনো কখনো আপনি যেমন বলছেন ঠিক তেমনটি এখানে ঘটেছে অবশ্য। কিন্তু কক্ষণো কারো কোনো ক্ষতি হয়নি।

    আর এই এলাকার নামই হয়ে যায় বাঘ-রোয়া, মানে বাঘ কেঁদেছে, এখন লোকের মুখে মুখে বাগরো বা বগরো হয়ে গেছে।

    পরে একজন ছোকরা সাহেব এসে না কি ওনাদের জিনিসপত্র, গাড়ি সব নিয়ে চলে যায়।

    একটু বেলা হতেই খালখো আরেকটা জীপে গাড়ির মেকানিক, বাংলোর সাইকেল এসব নিয়ে এসে গেলো।
    ..........

    সবাই অনেকক্ষণ চুপ।


    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • বাগরো | চটকার মাঠ | কহারিন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments