• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | রম্যরচনা
    Share
  • মধুপুরের পাঁচালি: চটকার মাঠ : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    বাগরো | চটকার মাঠ | কহারিন




    নাপতিনী বললে - না দাদা, সে অনেক দূর, বড় ঘোড়া দিলে টাঙ্গা যেতে পারে শুনিচি। মাইল আট দশ হবে।
    - তুমি ওপারে গেছো? নিজে?
    - না রে দাদা বাবু, না। বুড়ো মানুষ, অত দূর যাবো কেন?

    কথা হচ্ছিলো চটকার মাঠ আর সেটার নাম নিয়ে। যে মাঠটা আসলে টুকরো টুকরো কয়েকটা ছোট মাঠ আর একটা বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত টাঁড় নিয়ে। টাঁড় ওদিকে বলে ঘাস-গাছপালা-হীন শুকনো পাথুরে বালির প্রান্তরকে, যা সাধারণতঃ প্রায় সমতল হয়।

    তা আমাদের সর্বজনাদৃতা নাপতিনী যা বললো -

    ওই মাঠে ভগবান আসেন। ওটির আসল নাম চটকার টাঁড়। ওনার (!) কাহিনী তোমাদের বলি শোনো।

    প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে মহাপ্রভু বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন, তা গোটা নবদ্বীপ ভেঙে পড়লো সঙ্গে যাবে বলে। সুলতানের তখন বয়স হচ্ছে, তার ওপর তাঁর দুই প্রধান অমাত্য বললেন তাঁরাও যাবেন। মহা হৈচৈ। এদিকে কাজীদের ওপর সুলতানী হুকুম - মহাপ্রভু যখন যা বলবেন তাই যেন ব্যবস্থা করা হয়।

    সবাই মিলে তো চললেন বৃন্দাবন। প্রভু দেখলেন লক্ষ লোকে মিলে নামগান, কীর্তন, চেঁচামেচি করলে কচু তীর্থকর্ম হবে।

    মহাপ্রভু ডাকলেন মোড়লদের। বোঝালেন অনেক। সবাই নাছোড়বান্দা। কেউ দল নিয়ে ফিরে যাবে না। তখন প্রভু বললেন -

    দেখুন, আমরা যাচ্ছি বৃন্দাবন, পুণ্য অর্জন করতে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আরো অনেক বড় পুণ্যের কাজ হলো অন্যদের তীর্থকর্মে সাহায্য করা। এখন না হয় স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে আমি পথ জানি, আপনাদের দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতের বাংলার বৃন্দাবনতীর্থযাত্রীরা কি ভাবে সহজে বৃন্দাবনের পথ খুঁজে পাবেন?

    তা আমি স্থির করেছি যে এখন যাবার সময়ে পথে যেখানে যেখানে সুবিধা মত স্থান দেখবো সেখানে সেখানে একটি করে জনবসতি স্থাপনা করবো। ভগবানের আশীর্বাদে আমার প্রার্থনায় সেই সব গ্ৰাম অখণ্ড পুণ্যলাভ করবে। প্রতিটি বসতির সঙ্গে সেটির আগের ও পরের বসতির সর্বদা যোগাযোগ থাকবে। এই ভাবে নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবন একটি পথ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। জলাশয়, অন্ন, আশ্রয় সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে পরে প্রবীণরাও বৃন্দাবন সহজে যেতে‌ পারবেন।

    আর এই সব নব প্রতিষ্ঠিত গ্রামের জনসাধারণও তখন অতি সহজে বৃন্দাবন ও নবদ্বীপ যাতায়াত করবেন।

    যদি কোনো কারণে আমার এই পথে বৃন্দাবন থেকে নবদ্বীপ প্রত্যাবর্তন করা না হয়? দেখুন, সেই অজানা অসুবিধার কথা চিন্তা করেই আমি চাইছি যে এখনই, এই যাবার পথেই, এই স্থানগুলির স্থাপ্রনা করা হোক। সর্বতোভাবে সেটাই বাঞ্ছনীয়।

    থামলেন মহাপ্রভু।

    আর মুহূর্তমধ্যে শুরু হয়ে গেলো উল্টো আবদার :

    - প্রভু মনে হচ্ছে আপনার মনে এই জায়গাটি ধরেছে। আমার দল এইখানেই থাকবে প্রভু।

    - প্রভু আমার প্রাচীনা প্রপিতামহীকে পিঠে তো আর বইতে পারছি না, আমাদের এখানে থাকতে অনুমতি দিন।

    - প্রভু আমরা পাঁচ-ওক্তী রোজা-রাখা মুসলমান, এদিকে জলটা দেখছি ভালো, তা আমরা এ দিগরেই থেকে যাই? তীর্থের অখণ্ড পুণ্যপ্রাপ্তির আশীর্বাদ যখন আপনি নিজে করছেন?

    ইত্যাদি

    এই ভাবে তো মহাপ্রভু হিন্দু মুসলমান বাঙালীদের ছোট ছোট জনবসতির পত্তন করতে করতে বৃন্দাবন চলে গেলেন। বহু এরকম গ্ৰাম আজও আছে। আর মা (এবার দিদাকে) তুমি তো মাঝে মাঝে বনমালীর ছেলে সীতারামের কাছে মুড়ি নাও? সন্ধ্যে হলো, ঐ বনমালীর গল্পটা দাদাকে বলে আজ এবার উঠবো।

    - সে কি, হরিয়া আটা মাখছে, আমি বলে দিয়েছি তুমি খাবে, না কি বেঁধে নিয়ে যাবে?

    - সে মা তুমি যা হুকুম করবে। যাক, দাদা শোনো। তোমাদের ঐ সীতারামের বাড়ি আমাদেরই কাছাকাছি একটা বৈষ্ণব গ্ৰামে। কিন্তু ওর বাবা খৈ-মুড়কিওয়ালা বনমালী ছিলো চটকার ওপারের লোক। হঠাৎ একদিন দেখা গেলো যে একটা লোক ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে মুরুপতলায় দাঁড়িয়ে ইদিক উদিক তাকাচ্ছে। বেশ জোয়ান মদ্দ।

    তা লোকটাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো যে ও টাঁড়পারের সিদ্ধিপুরের লোক, ওর নিকটাত্মীয় বলতে কেউ আর নেই, আর ওর নাম বনমালী। হাজারিবাগের দিক থেকে কোন একজন সাধুবাবা এসেছিলেন, তিনি নাকি ওকে বলেছেন টাঁড়পারে এসে বিয়ে-থাওয়া করে সংসার পাততে।

    তা সেদিন সকালে টাঁড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে বনমালী ভাবছিলো মাঠ পেরোতে কতটা গুড়, কতটা চিঁড়ে আর কতটা জল নেবে। হঠাৎ ঝিমুনি আসে। ঘুম ভাঙলে দেখে চটকার মাঠের এপারে পলাশ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে।

    বনমালী এদিকেই সংসার পাতে। তোমাদের মুড়িওয়ালা সীতারাম সেখানেই হয়। লোকে বলে যাত্রীর মনে খাঁটি ভক্তি থাকলে মহাপ্রভু মাঠ পেরোবার কষ্টটা লাঘব করেন ঘুম পাড়িয়ে কোলে করে পার দিয়ে। তাই ওনার নাম চটকার মাঠ।

    কতগুলো দিচ্ছো মা, রাতে দুটোর বেশী খাইনে। এদিকে এটা আবার কি?

    - রেখে দিও নাপিত-বৌ, সকালে খেও।


    অলংকরণ (Artwork) : আন্তর্জাল থেকে
  • বাগরো | চটকার মাঠ | কহারিন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments