• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | উপন্যাস
    Share
  • ডহননাগড়ার কাহন (শেষ পর্ব) : অংশুমান বিশ্বাস



    দ্বিতীয় অধ্যায়

    ।।২৩।।

    ভানু সাহা এই সময়ে বিশ্রাম করে। রাত আটটার পরে একটু বিশ্রাম না করলে মন ভালো থাকে না। থানায় থাকলে ওপরে প্রাইভেট রুমে একটু টি ভি চালিয়ে, ইজি চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে যাকে বলে একটু পাওয়ার ন্যাপের চেষ্টা করে। টিভিতে শব্দ থাকে না শুধু ছবি চলে। আজও তাই। দূরে একটা বড় জনসভা সামলাতে ফোর্স গেছে। দুটো কনস্টেবল আর ডিউটি অফিসার ছাড়া কেউ নেই থানায়। হ্যাঁ দাসও আছে। নিচে কোথাও। সন্ধ্যের পরে গরম নেই তেমন। যদিও শীত এবার বেশ তাড়াতাড়ি চলে গেছে। বেশ একটা মোলায়েম আরাম ভানু সাহার মন থেকে টুপুস করে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিল চারপাশ, তারপর বেড়িয়ে পড়ল ঘুরতে, মাথা বেয়ে উঠে তার পরে আবার নিচে নামতে নামতে পায়ের দিকে চলে যেতে যেতে ভানু সাহাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল, মোলায়েম আরামটার মুখটা অনেকটা ইন্দ্রাণীর মতো। আঃ। হালকা নাসিকা গর্জন সেই আরামকে নিয়ে সুখে তখন উড়ন্ত কারপেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে আলাদীন হয়ে, মনে হয় থাইল্যান্ড, কারণ থাইল্যান্ডের ছবি দেখেছিল তার ভায়রাভাইয়ের কাছে। ভানু সাহা কি আর যেতে পারে না? আলবাত পারে। দেখে যা অভিজিৎ। আমিও পারি। সে উড়ছে, উড়ছে, উড়ছে হঠাৎ করেই মোবাইল বেজে উঠল। ওঃ কি কুক্ষণে সুইচ অফ করতে ভুলেছিল। চোখ বুজেই কেটে দিল। আবার। ওঃ। একটা চোখ হালকা করে খুলে দেখল-- দাস। শালা এই হল চুতিয়া ভাগ্য।

    - স্যার আর্জেন্ট। বড় ঝামেলা হচ্ছে। কলবাবু আসছিল এদিকে। মাঝপথে ঘিরে ধরে ওর গাড়িকে নিয়ে গেছে অন্যদিকে। কি ভাবে কিছু জানি না। স্যার বেরোতে হবে।

    - কি?

    - স্যার কলবাবুকে অ্যাবডাক্ট করেছে মনে হচ্ছে। আপনি বেরোন। আমি রেডি।

    - ফোর্স শর্টেজ। এভাবে যাওয়া যায়?

    - স্যার আমি ওপরে এসে গেছি। বলতে বলতে দরজা খুলে ঢুকে পরে দাস।

    - তুমি কি বলছ কি! ভেহিক্ল আছে নাকি?

    - স্যার আমি বাইক নিয়ে যাচ্ছি। আমি ভালোর জন্য বলছি।

    - পাগল হয়েছ দাস? এই বোকামি কেউ করে।

    - স্যার আপনি বোকামি করছেন। আমার কথা শুনুন। আপনার গায়ে আঁচড় লাগবে না, সে ব্যবস্থা করব কিন্তু আপনি বসে থাকলে থানায় আপনার চাকরিতে আঁচড় পড়ে যাবে। কলবাবু। যে সে লোক নয়।

    - আছা আচ্ছা আচ্ছা। যাচ্ছি। দুমিনিটে আমি রেডি হচ্ছি।

    বাইক চলেছে শহর পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে। ভানু সাহার বুকের মধ্যে কেমন শূন্যতা। এমন দ্রুত গতিতে দাস বাইক চালাচ্ছে ভানু সাহা নিজে কখনো এমন চালায়নি। আজকে বিপ্লব দাসের মুখটাকে অদ্ভুত লাগছিল ওর। কি শক্ত সে মুখ। যেন এই লোকটাকে এতোদিন চেনাই ছিল না। ভুঁড়িওয়ালা সুখী চেহারার লোকটা যেন বদলে গেছে এক বেলার মধ্যে। ভানু সাহা কেন এলো। যা হবার হোতো। কোন গ্রামবাসী খবর দিয়েছে ফোন করে সে যদি ট্র্যাপ করে। চাকরি না প্রাণ? অবশ্য চাকরিহীন প্রাণ থেকেই কি লাভ। যদি এমন কালির আঁচর পড়ে সব বন্ধ করে দেয় শেষ বেলা, কিচ্ছু বেনিফিট যদি না পাওয়া যায়? কি করবে তখন ভানু সাহা। না বাঞ্চোৎ যা থাকে কপালে দেখা যাবে। সারাজীবন কুত্তার মতো জীবন কাটিয়ে শেষে গুলি খেয়ে মরে গেলেই ভালো। কি হবে এ জীবন রেখে? কি করতে পেরেছে? মাথা উঁচু করেই বাঁচবে। আমিউনিশন গুণে গুণে তিন কার্ট্রিজ লিখে নিয়ে এসেছে। এই পিস্তলের সব গুলি শেষ করে তারপর মরবে। থাইল্যান্ডে কেন কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি বউকে, ছেলে মেয়েকে। বাইরের কথা বাদ থাক, সারাজীবন ঘরের লোকরা পুলিশে চাকরি করেছে বলে মনে মনে তাচ্ছিল্য করেছে। ঘুষখোর বলে কোনদিন কোন আড্ডায় মিশতে পারেনি। আজই হয়তো সেই সময়। লোকগুলো আর তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে পারবে না। আজকের পর থেকে সব্বার মুখ বন্ধ করে দেবে ভানু সাহা।

    - মাথাটাকে ঠান্ডা করুন স্যার। ঠান্ডা রাখুন। আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আমারও জানের মায়া আছে স্যার। বলতে বলতে বাঁ দিকের একটা শর্টকাট ধরল দাস। -- এখান থেকেই কলবাবুর গাড়িকে তাড়িয়ে ঢোকাচ্ছে খবর পেয়েছি। এদিকটায় চাষ জমি মাইলের পর মাইল, রাতের দিকে কেউ থাকে না। দেখি এতক্ষণে কি অবস্থা।



    বুকের ভেতর কিহুক্ষন আগে পর্যন্ত দমাস দমাস করে যে ধাক্কা লাগছিল সেটা এখন আর নেই। বরং একটা ঠান্ডা স্রোত অনুভব করছে ভানু সাহা। সেটা উত্তেজনায় না শীত শেষের শিরশিরানি! কে জানে। কিছুদূর যাওয়ার পরে আর চার পাশে কিচ্ছু জনবসতি নেই। একদম শুনশান। মাথায় চেপে থাকা হেলমেটটার মধ্যে থেকেও যেন ঝিঁঝিঁর শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক পাশে গাছপালা, ক্যানেল আর তার পাশে বিরাট মাঠ, মাঠ আর ক্যানেল এর মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে বাইক এগিয়ে চলেছে। আলো বলতে বাইকের হেড লাইট। আর দূরে একটা পাম্পে একটা সাদা টিমটিমে আলো। ওই জমিতে পাম্পে জল ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চাপা ঘট ঘট ঘট শব্দটা ফাঁকা মাঠে কোথা থেকে যেন প্রতিফলিত হতে হতে যেন শত গুণ বেশি গাম্ভীর্য পেয়েছে। আরও খানিকটা যাওয়ার পরে দেখা গেল একটা সাদা গাড়ি যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ক্যানালে। দাস বাইক থামিয়ে দিল দূরে। একটা গন্ধ আসছে। বারুদের। বাইক স্টার্ট করে হেড লাইটটা ভালো করে ধরল ওই দিকে তারপর বড় সার্চ লাইট বার করল। সার্চ লাইটে দেখা গেল ভাঙা ভাঙা কাঁচগুলো আটকে আছে গাড়িটার জানলায়। পেছন আর যে পাশটা দেখা যাচ্ছে সেখানে কাঁচ গুলোর ভেতরে আর দৃষ্টি চলছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। চুপ করে। কোথাও কোন শব্দ নেই। অনেকক্ষন মানে কতক্ষণ সে তো আর জানা নেই। স্যার আপনি থাকুন আমি এগোচ্ছি।

    - কি করছ কি দাস।

    - দেখুন না কি হয় স্যার। মনে হয় কেউ নেই আর। আপনি ওই বড় গাছটার পেছনে যান। বাঁ হাতে সার্চ লাইট আর ডান হাতে পিস্তল বার করে দাস চিৎকার করে উঠল -- পুলিশ। কেউ নড়বে না। কোন ঝামেলা হবে না। অস্ত্র থাকলে ফেল।

    কোথাও কোন উত্তর বা আওয়াজ কিছুই হল না। দাস আস্তে আস্তে এগোতে থাকল। একদম কাছে চলে গেল গাড়িটার। কিছুক্ষণ পরে ওপাশেও গেল। দূর থেকে আর দেখা যাচ্ছে না ওকে। শুধু বোঝা যাচ্ছে ওর টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাড়ির ভেতরে পড়ল। তারপর আলোটা ক্যানালের চারপাশে এদিক ওদিক সরতে দেখল আর তারপরে একটু দূরে আটকে গেল। আরও খানিকক্ষণ পরে আলোটা ভানু সাহার দিকে তাক করে এগিয়ে আসতে থাকলো। ভানু সাহার উত্তেজ না। ওর চোখে টর্চের আলো। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। কে এ? দাস তো? এমন মুখে আলো ফেলছে কেন? মারবে নাকি? দাস যদি হয় এমনই বা করবে কেন? টর্চ নিভে গেল। চোখের ধাঁ ধাঁ কমে গেলে দেখল, দাস। একটা সিগারেট ধরাল কাছে এসে। তারপর ফিসফিস করে বলল পাঁচটা বডি। স্পট ডেড মনে হচ্ছে। চলুন দেখবেন চলুন।

    - সুনীল, আলি আর ড্রাইভার। আর একটাকে চিনি না। তবে সামনের লাশটা দেখুন স্যর।

    ভেতরে ধুপ ধুপ করছে রক্ত প্রবাহ। সোজা হার্টে ধাক্কা মারছে। ভানু সাহা দেখল সাদা জামা পড়া লোকটা পাশ ফিরে পড়ে আছে রাস্তায়। রক্ত টাটকা এখনও বেরচ্ছে। চোখ খোলা। কলবাবু। হঠাৎ করে দুটো লোক উদয় হোল। ভূতের মতো। বলল

    - উদিকপানে পেলিয়েছে।

    - তোরা কি করছিস?

    - বাপ বেটায় গরু খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলাম গো। তেখন থেকে ঘেপটি দিইছিলাম।

    - কতক্ষণ আগে পালিয়েছে?

    - এখুনি গো। নতুন জংগলের দিকে।

    - স্যার চলুন।

    - আবার কোথায় যাবো।

    - ওই নতুন জঙ্গলের দিকে যাই। এখনও হয়তো পালাতে পারেনি। সদরের ফোর্স এতক্ষণে অনেকটা চলে এসেছে। আপনি ফোন করে সদরের ফোর্সকে বলুন এই পথে আসতে।

    - সেতো সময় লাগবে, অন্তত একঘণ্টা।

    - হোক। চলুন।

    আবার বাইকটা চলতে শুরু করল। মন্ত্র মুগ্ধের মতো আবার চলল ভানু সাহা। আরও পনেরো মিনিট আঁকা বাঁকা উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে এক জায়গায় দেখা গেল আর রাস্তা নেই, জঙ্গল। বাইক থামিয়ে দিল বিপ্লব। থামাতেই চারপাশ থেকে ছ সাত জন মুখে গামছা বাঁধা লোক ওদের ঘিরে ফেললো। প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল। একজনের হাতে অটোমেটিক রাইফেল। মনে হয় লিডার। ওই লোকটা চাপা শুদ্ধ উচ্চারণে বলে উঠল

    - পিস্তলগুলো দিয়ে দিন।

    ভানু সাহা ইতস্তত করছিল, দেখল একবার বলতেই বিপ্লব নিজের পিস্তল দিয়ে দিল লোকটাকে।

    -- স্যার দিয়ে দিন।

    ভানু সাহা যন্ত্রচালিত পুতুল যেন। দিয়ে দিল লোকটার হাতে নিজের পিস্তল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উল্টো দিকে জঙ্গলের মুখ থেকে একটা ছায়া মূর্তি যেন কোথা থেকে বেড়িয়ে এল। তারপর সে ছায়ামূর্তি ভারী গলায় চিৎকার করে বলে উঠল-- আমার প্রাণ থাকতে পুলিশ বা কলবাবু কারোকে আমি এই জঙ্গল কাটতে দেব না। সবাই তফাৎ যাক। দূরে চলে যাও। এক্কেবারে দূরে। ছোঁবে না। কেউ একটা গাছে হাত দেবে না। মানুষের কোন অধিকার নেই সব কিছু ধ্বংস করার। আমার প্রাণ থাকতে এই জঙ্গলকে তোমরা কিছুতেই শেষ করতে পারবি না বেজন্মা মানুষের দল। দূর হয়ে যা। দূর হয়ে যা এই পৃথিবী থেকে।

    সার্চ লাইট ফেললো দাস। দাস লোকটার মাথা কি ঠান্ডা। মাঝারি আকারের একটা লোক দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আগলে আছে এই জঙ্গল ভূমি। কিন্তু লোকটা কি সব বলছে। পাগল না কি! ভানু সাহা ভাবে। আর কতক্ষণ বাঁচবে নিজে কে জানে। এই বিপদের মধ্যে এ আবার কি নাটক। আর ভালো লাগছে না। গুলি এসে বিঁধে যাক ওর বুকে। আর নিতে পারছে না ভানু। এমন সময় লিডার লোকটা ভানু সাহার পিস্তলটা তাক করল লোকটার দিকে।

    -- বিদায় কমরেড। লোকটা চাপা গলায় বলল। এরপর একের পর এক গুলি চালিয়ে গেল লোকটার দিকে। লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। লুটিয়ে পড়তে পড়তে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করল, বোঝা গেল না। শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে আস্তে আস্তে থেমে গেল। মুখবাঁধা লোকগুলো তার পর ঝটপট জঙ্গলের উল্টো দিকে ছুটতে থাকল। দুটো গাড়ি দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে। যাবার আগে দূর থেকে ফায়ারিং চলল এদিক ওদিক। আর লিডার লোকটা হঠাৎ করেই ভানু সাহার পা লক্ষ করে একটা গুলি করে দিল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল ভানু সাহা। সবকিছু টলতে লাগল। তারপর জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

    #

    স্যার জাগলেন? তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই ওপরের দিকে তাকাল ভানু সাহা। ধীরে ধীরে বুঝল যে সে হাসপাতাল জাতীয় কোথাও আছে। পাশেই একটা স্যালাইনের বোতল ঝুলছে, সেখান থেকে নল তার হাতে।

    -- স্যার।

    ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পাশের বেডে দাস। দাস হাসছে এক গাল। তারপর সে উঠে এসে বসল তার বেডের ধারে। ওরও হাতে একটা ব্যান্ডেজ। গলা থেকে হাতটা ঝুলিয়ে রাখা।

    - স্যার আপনার কিচ্ছু হয়নি। গুলিটা বার করে দিয়েছে অপারেশন করে। স্যার পুলিশ পদক পাচ্ছেন আপনি। সঙ্গে বাকি চার মাস পুরো বাড়িতে রেস্ট, রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত। তারপর রিটায়ারমেন্টও একটা এক্সট্রা প্রমোশন সমেত। আই জি কমিট করেছেন প্রেস মিটে।

    - কেন? আমি কী করেছি দাস? অবাক চোখে শিশুর মতো তাকিয়ে থাকেন বিপ্লব দাসের দিকে। কিছুই বুঝতে পারে না ভানু সাহা।

    - কেন আপনি একটা নিষিদ্ধ আলট্রা লেফটিস্ট দলকে তাড়া করেছেন। সেই ভয়ঙ্কর দল যারা কলবাবুকে আরও পাঁচজন দেহরক্ষী সমেত মেরেছিল। দলের মূল পাণ্ডাকে আপনি গুলি করে মেরেছেন, কোন পুলিশ ফোর্স না থাকা সত্ত্বেও শুধু অদম্য সাহসের বলে আপনি পুলিশের ডিউটি করেছেন। নিজে গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছেন। আপনি পুলিশের গর্ব। আপনার জন্য আমারও একটা প্রমোশন হচ্ছে স্যার।

    - কি বলছ এসব।

    - ঠিক বলছি স্যার। সব জায়গায় তাই বলবেন। অনেক করেছেন স্যার পরিবারের জন্য, দেশের জন্য। আমি একটু গুরুসেবা করার সুযোগ মাত্র পেয়েছিলাম, তার সদ্ব্যবহার করেছি। এই দেখুন -- দাস মোবাইল ফোনে লাইভ টিভিতে আই জির প্রেস মিট দেখাতে থাকে। হতভম্ব হয়ে থাকে ভানু সাহা। পাশ থেকে আবার বকে যায় দাস-- আপনার পিস্তল থেকে আপনি গুলি করে ফেলার পর ওপাশ থেকে গুলি এসে আপনার লাগে আপনার আর কিছু মনে নেই। আমাদের সার্ভিস পিস্তল হয়তো ওরাই নিয়ে চলে গেছে। এছাড়া আপনার আর কিছু মনে নেই। তার আগে অবশ্য যা যা দেখেছেন সবই আপনি জানেন। কি স্যার সব জায়গায় এই কথাগুলো বলতে পারবেন তো?

    ভানু সাহা শিশুর মতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। দাস বলতে থাকে -- এখন এর বেশি কিছু বলতে হবে না। পরে আপনি আর আমি একসঙ্গে বসে ডিটেইল রিপর্ট তৈরি করে নেব। নার্স আপনাকে একটা ইনজেকশন দেবে। আমি ওদের বাইরে থাকতে বলেছি। আসতে বলি স্যার? তারপর দাস গলা উঁচিয়ে নার্সকে আসতে বলে। তারপর নিজে আবার বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে ভাবতে থাকে মনোজ শুক্লা ছেলেটার কি অসাধারণ ক্যালিবার। ডান থেকে বাম, লাল থেকে হলুদ, সবুজ থেকে মেরুন, শ্রীবাস থেকে দাস, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পশ্চিম থেকে পূর্বে সবাইকে একসুতোয় বেঁধে রেখেছে। এই না হলে পলিটিকাল কনসালটান্সি। গ্যালাক্সি লেভেল। উফ্ কি অসাধারণ। এবারেরটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেছে। এই বেকুবটাকে নিয়ে সমস্যা ছিল তবে শেষ পর্যন্ত সুবিধেই হয়েছে। তবে দিলু সূর্যশেখরের কথা প্রথমেই না বললে ছকটা সাজানোই যেত না। কম্পিউটার হ্যাক করে লেখাগুলো পেয়েই ঘুঁটিটা সাজানো গেছিল। মাঝখান থেকে মাইলেজ পেয়ে গেল এই আলট্রা লেফটিস্টগুলো। সর্বত্র ওদের ইমেজ একদম তলানিতে চলে গেছিল। এই ঘটনার পরে সহানুভূতি পাবে। সে আর ও ভেবে কি করবে। ও তো আর নিজে কিছু ডিসিশন নেয়নি। সবাই মিলে নিয়েছে। দিলু এই মুহূর্তে সিস্টেম সিলেক্টেড। দিলু না চাইলেও এখন এগোবে, অনেক এগোবে, যতদিন না সিস্টেম অন্য কিছু ভাবছে। সুর্যশেখরকে নিয়ে এমনিতে কোন চিন্তা ছিল না, বিরল প্রজাতির মানুষ, কিন্তু হার্মলেস। রাতের অন্ধকারে গত পাঁচ বছর ধরে শুধু গাছ লাগিয়ে যাচ্ছিল, বীজ ফেলে রাখছিল। জঙ্গল কেটে ফেলার ফোনটা করিয়েছিল কারণ লোকটা এই খবর পেয়ে ওই জঙ্গলে যেতই। কি অদ্ভুত একটা ক্ষমতার লোক। কিন্তু যে সব কিছু দেখতে তাকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায়! সব পলিটিকাল পার্টি তো সেখানে এক। তাছাড়া তার নিজেরও তো ভয় ছিল। অবশ্য তার নিজের ভয় তো সব সময়েই থাকে। এখনো আছে। যাক, কিছুদিন এখন সে একটু আরাম করবে।

    ২৪

    সেইরাতের পর থেকে শিউলিকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। তার বইগুলো সব পড়ে আছে অনাদরে। দিলুর চিঠিতে কী লেখা ছিল সে কথা পুরোটা আমরা জানতে পারি না। খানিকটা যা আন্দাজ করতে পারি তাতে শিউলির কাছে আর কোনদিন দিলুর ফিরতে না পারার কথা আর ট্রেনের নিচে বেদোর আত্মহত্যার খবর সেখানে ছিল। এইচ আই ভি পসিটিভ হওয়ার খবর বেদো সেদিনই পেয়েছিল। আমাদের দিলু রাতে এখন নতুন বাড়িতে একা ঘুমোয়। আর ঘুমোলেই নিজের মনে গোঙাতে গোঙাতে কথা বলতে থাকে। বলতে থাকে -- "কেউ ফিরতে পারে না শিউলি …..বেদো জানত সেও ফিরতে পারবে না …..তাই আর চেষ্টাই করেনি …. বেদো তুই আসলে বুদ্ধিমান ….আমিও তো ফিরতে চেষ্টা করেছিলাম……. কিন্তু পারলাম না …তবে তাকে আমি নিজে ফিরতে দিলাম না …… …..সে শুধু বলত আমি আর সে নাকি এক…....বলত তুমিও নাকি আলাদা নও…….কেন বলত? কেউ নাকি নয়! .....এই বিশ্বের সব নাকি খেলা... ….আমি….তুমির খেলা... সে বলবে কেন এসব?……আমি এসব বুঝতে চাই নি.…আমি এসব বুঝি না ….সে তোমাকে ভালোবাসত …খুব ভালোবাসত …আমার হিংসে হতো………ও থাকলে আমি থাকতাম না….. আমাকে অনেক দূর যেতে হবে ……ওই কারখানা আমিই কিনে নেব……বেদো....…তোর আমার পার্টনারশিপ……বেদোরে………হারুকাকা......মা আমার কান্না পাচ্ছে …...মা ..... আমার খুব কান্না পাচ্ছে শিউলি……শিউলি ও মা........মাগো..………...শিউলি ...…” -- এইরকম সমস্ত কথা। আসলে এগুলো আমরা জানতে পারছি, ওই যে বলে না দেওয়ালেরও কান আছে, তাই।

    সেদিন সারারাত সূর্যশেখরের ক্লান্ত শরীর শিশিরের আদর খেয়েছিল। যে আদর সে চেয়েছিল কবে থেকে। আর আদর খেতে খেতে লিখছিল তার সাধের মাটিতে সেই কথা যা হয়তো ছিল তার না শেষ হওয়া পাণ্ডুলিপির আরও খানিকটা অংশ--

    "দেখ আমি বসে আছি। আমার কেশরাজী শুভ্র, তাই তুমি ভাব আমি বুঝি অনেকদিন ধরে বসে আছি। তেমন করে ভেব না। এখানে দিন বলে কিছু নেই। দেখ ক্রমাগত ঢেউ খেলে যাচ্ছে সামনের স্রোতস্বিনীর বুকে। যাকে প্রবাহ বলে কেউ আর কেউ বলে স্থিরতা। তোমার মাটি লেগে থাকা শরীরে জোনাকিরা যখন আর কিছুক্ষণ পরে একে একে এসে বসবে, পরম আদিখ্যেতায়, ঠিক তখনই যদি আমি অন্যমনস্ক থাকি, আমি জানি তখন আমার মাথাটা ধরে জোর করে ঝাঁকিয়ে দেবে ওপরের ওই নীলাকাশ। আমি তাতে কিছু মনে করি না। কারণ কি জানো? আমি যতবারই সেই জোনাকি আর তোমার দৃশ্যটা দেখি ততবারই মনে হয়, এই যেন প্রথম দেখলাম। আমার আশপাশের বা দূর দূরান্তের নভোচর গ্রহ নক্ষত্র গুলোও একই কথা বলে। আমার কখনো কখনো মনে হয় ওরাও আমার মতোই তোমার জন্যই বসে আছে, সময়হীন আকাশের আচ্ছাদনে। যদিও আমরা তোমাকে কেউ কোনদিন কোন কথা বলতে পারিনি। কারণ এখানে যে কথাও নেই। এখানে শুধু চেয়ে থাকা আছে। শুধু সেই দিনের জন্য যখন তুমি আসবে আর তুমিই প্রথম হবে যে করবে কোন শব্দ উচ্চারণ, গাইবে সেই খুব চেনা অদ্ভুত সুরের গান। যা বলতে চাইবে কোন অজানা ভাষায় সেই কথাই

    হারিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে আবার যাব মিশে
    ভাঙব বলেই গড়ব না হয় আবার ভালবেসে।
    গানটা গাওতো একা একা পাহাড়ের কোলে। দেখ এই ঝর্ণা, এই পাতা, এই ঝিঁঝিঁপোকারা সবাই এখানে গান গায় আর গান বোঝে। লজ্জা পেও না। সকলেরই তোমার মতো শুধু ওই একটা গানই জানা আছে। তোমার মতোই তারা সারাজীবন সেটাই গাইতে গাইতে বয়ে যায়। তাকে কি তারা একঘেয়ে বলে ভাবে? কেন তুমি ভাব তবে। তোমার যে গানটা তুমি সারাজীবন ধরে বাঁধতে বাঁধতে চলেছ সেটা গাইছ না কেন? যারা শোনার তারা কান পেতে আছে ঠিক। তারা অপেক্ষা করে আছে আনাচে কানাচে, ঝোপে ঝাড়ে, পাথরের ফাঁকে আর খোলা রাস্তায়। তুমি তাদের কথা রাখ। এই মাটিকে তুমি বিশ্বাস কর! আরে কাউকে তো বিশ্বাস কর! তোমার গানটার একটা কলি যোগ হোক আজ এই সময়ে। বোঝ না এত ফুল! এত সবুজ! এত বৃষ্টির আয়োজন! এ সব কিসের জন্য? না ছাড়। তোমায় বুঝতে হবে না কিছু। তুমি বদলিও না। কোন মূল্যেই নয়, কোন শর্তেই নয়। তোমার অজ্ঞানতা তোমার রঙ, তোমার নির্ভরতা তোমার রূপ, তোমার অশান্ততা তোমার শক্তি। নাও চোখ ধুয়ে নাও। কেঁদেছ অনেক আরও কাঁদতে হবে। তুমি না বলেছিলে কাঁদতে গেলে সব থেকে সাহসী হতে হয়। ভুলনা কিছু। ফেলনা কিছু যখন তুমি কিছুই ফেলতে পার না।

    কি অদ্ভুত দেখ! তোমায় আর আমি আলাদা করতে পারছি না। এই সবুজ পাহাড়, এই ক্ষীণ ঝর্না আর এই অক্লান্ত রাত্রির আকাশ বা আমার নিজের থেকে আর আলাদা করতে পারছি না। এই সময় হয়েছে মায়াবী বা তুমিই হয়েছ সেই সময়। আমি তোমায় ছুঁতে পারছি। যা ছিল অসম্ভব আজ তা ধরা দিয়েছে আমার হাতে। আমার আঙুলের ওপরে এসে পড়া একফোঁটা শিশিরে। এর থেকে কোন শুদ্ধতা আমি আশা করতে পেরেছিলাম? আমার অবিশ্বাসী মন সে কোন অভিশাপজাত কিনা সে বিশ্লেষণে আজ প্রয়োজন নেই। সত্য বহুমাত্রিক কিনা সে আর আমি জানতে চাই না। আমার এই খবরহীন জীবন, নেই--আঁকড়ে মন আর আমার এই অসফল অনুসন্ধান সব পড়ে থাক। এই মাটির গায়ের গন্ধ আমার সে ভাবনাকে করেছে মূল্যহীনভাবে সরল। আমি কারো প্রথম প্রয়োজন নই বা আমি কারো অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্বও নই বলে আর কোনও অভিমানও নেই। কে যেন বলছে -- তোমার এই লজ্জাহীন কান্না, ক্লান্তিহীন পরাজয় আর এই ফলহীন প্রচেষ্টা সেই তো তোমার শক্তি। দেখ সেই দুর্বার শক্তি আমার ওপর ভর করেছে। সেই অসহ্য শক্তি এখন আমার হাত ধরে দিচ্ছে টান। বলছে -- ওঠো ওঠো ঘুমিয়েছ অনেক। পৃথিবী অনেক বড় আর তার থেকেও বড় এই জীবন -- তাকে ছুঁয়ে দেখ। কাউকে কাউকে যুদ্ধ করতেই হয়। কারণ সবাই তো আর যুদ্ধ করার মতো শক্তিশালী হতে পারে না। তাই তোমার ডাক পড়ে দেশে দেশে, যুগে যুগে। তোমার সঙ্গে মিলবে না কারো। ভেব না। চিন্তা কোরো না। ক্ষয়ে যাও তবুও নিজেকে জমতে দিও না। কিছুতেই কারো পরাজয় নেই। কে থাকে? কেউ না তো। কে জানে? কেউ না তো। এই যে এই সময়ে যে তরঙ্গ উঠেছে তাতে ডুবে যাও ভেসে যাও যা ইচ্ছে হয় করো। জয় পরাজয় নাম দিও না তার।

    তাই আমি আর ভাবব না কোন কথা। ভাবব না কি থাকল, কি গেল, কোথায় ছিলাম কোথায় থাকব। এই পাহাড়, এই জঙ্গল, তক্ষকের ডাক আর নির্জন রাত্রির অন্তরাল নিয়ে আমি আছি এখানে, এই মুহূর্তে। এর বাইরে মনে রাখব না কিছু। ভুলে যেও তোমরা সব। ভুলে যেও আমায়। আহা! আমার শরীরে আছড়ে পড়ছে মৃদু সিক্ত হাওয়া। ঝরে পরার আগে বৃদ্ধ পাতা শেষ বারের মতো কাঁপে ভয়হীন। সবাই মিলেই তো আমরা চলেছি। তবু আমি কাঁদছি কেন? কেন আমি আর কিছু মনে করতে পারছি না? কিছু কি ফেলে যাচ্ছি? কিছু কি নিতে হত? না না আমাকেই তো তুমি নেবে। আমি যদি তোমায় না চিনি তুমি তো চিনবে আমায়।"



    সূর্যশেখরের দেহটা যখন একটা বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখন ওর হাত দুটো আর পা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। বাঁশটা ঢোকানো ছিল হাত আর পায়ের মাঝখান দিয়ে। কোমরটা আর মাথাটা নিচের দিকে ঝোলা। কোঁকড়া চুলগুলো তার হাওয়ায় কোনদিনই দুলত না, তাই বোঝা যাচ্ছিল না যে তখনও হাওয়া বইছিল বেশ। কারণ ক্যানালের একধারে সার বেঁধে ঘেঁটুফুলের দল সেই হাওয়ায় তখন দুলছিল। ঘেঁটুর লম্বা পুংকেশরগুলোর একটা দুটো সুর্যশেখরের কানে আলতো করে লাগছিল। অনেক বছর আগে আজকের ছোটনাগপুরের জঙ্গলকে রক্ষা করতে গিয়েই একদিন মরেছিল কুলাবা। তখন জংলি ফুলের দল এমন ভাবেই কুলাবাকে আদর করেছিল তার মৃত্যু যাত্রায়। একটা গান গাইছিল দূরে কেউ। গানটা সেই সুরে, শিউলি যে সুরটা বুঝতে পারে নি, কোথায় সে শুনেছিল, ঠিক তেমন। ওই গানটাই গাইত সরোবরের ধারে সেই আত্মবিস্মৃত নারী, যে মাধবীলতার পথ বেয়ে এসেছিল কখনো এখানে, আমরা জানি না, বা উলুখুলার সেই কালোচোখের মেয়ে বা তারও পরে হয়তো বিন্দুশিলা। আমরা সেও জানি না। অবশ্য সে সব কথা এক অবিনাশী বৃদ্ধ তার পুঁথির কোথাও লিখে রেখেছিলেন। এখন তিনি অবশ্য লিখছেন কেমন করে এক রাতে কো-- অপারেটিভের সেলাইয়ের স্কুলে আগুন লাগল, কেমন করে মড়কে ছারখার হয়ে গেল মোরশেদের হাঁস মুরগি, ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল চালু করার সরকারি নির্দেশ এলেও কুমারবাবুর স্কুলে কারো পড়তে না আসার কারণ বেশ্যার ছোঁয়া নাকি অন্য কিছু, প্রবীণ ভুবনের কৃষক আন্দোলনে যোগ দিতে দিল্লি যাওয়ার কথা, মোমবাতির কারখানায় ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে-- এইসব। তবে উনি শুধুই লিখে চলেন, ঠিক ভুল বিচার করতে বসেন না। কারণ ইতিহাস তো বিচারক নন।

    **************


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments