
 
 
 
	 
				
শান্তিনিকেতনের নিটোল, নিরুপদ্রপ জীবনে তিনি ছিলেন বেয়াড়া-বেখাপ্পা। যদিও শান্তিনিকেতন যে-মানুষটির প্রাণের আরাম ছিল— চর্বিতচর্বণ তিনি আদৌ পছন্দ করতেন না। তাঁর মাপের বুকের খাঁচা বাঙালি আর কবে তৈরি করতে পারল! বাঁকুড়ার যুগীপাড়া থেকে আসা ছেলেটিকে তাঁর মনে ধরেছিল। রামকিঙ্কর বেইজের কথা ভাবছি। ১৯২৫-এ শান্তিনিকেতনে আসার পর, তাঁর প্রথম খোলা আকাশের নীচে করা মূর্তি হল সংগীতভবনের কাছে ‘সুজাতা’, নিষ্পত্র এক গাছের সুষমায়। মাস্টারমশাই নন্দলালের পরামর্শে মাথায় পরমান্নের পাত্র। উলটোদিকে মাটির বুদ্ধদেব আছেন যে!
এদিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকলে খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সমস্ত আশ্রম ঘুরে বেড়ান। তেমনই এক সকালে বেড়াতে-বেড়াতে হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন ‘সুজাতা’। কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়েই যেন জানতে চাইলেন কে বানিয়েছে এমন মূর্তি? সবাই আমতা-আমতা করতে থাকলে তিনি সুজাতার নবীন ভাস্করকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে বললেন। গোটা ঘটনায় নন্দলাল বসুও ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। রামকিঙ্কর দুরুদুরু বুকে গেলেন রবীন্দ্রনাথের সামনে। তিনি জিগ্যেস করলেন— ‘মূর্তিটা তুই গড়েছিস?’ ভয়ে-ভয়ে মাথা নাড়লেন রামকিঙ্কর। তখন প্রায় আকাশের উচ্চতায় উঠে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘সমস্ত আশ্রম এর চেয়েও বড়ো-বড়ো মূর্তি গড়ে ভরে দিতে পারবি? সব আশ্রম ভরে দে।’ এমন বড়ো একটা কাণ্ড ঘটাতেই কি তিনি পত্তন করেননি শান্তিনিকেতন? হয়তো নাগরিক ক্ষুদ্রতা আর কলকাতার গ্রাম্যতায় ক্লিষ্ট ছিলেন। বীরভূমের গ্রামীণ প্রতিবেশে তাই পেতে চেয়েছিলেন একটুকরো পৃথিবীর অখণ্ডতা। কিন্তু তাঁর সাধের কলাভবন ততদিনে কার্বন কপির সেরেস্তাখানা প্রায়। তাই হয়তো কিঙ্করের কাছে এমন প্রস্তাব। অনেক পরে এক সাক্ষাৎকারে ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত বলেছিলেন : ‘ওইরকম একটা পরিবেশে কী করে রামকিঙ্করের আবির্ভাব সম্ভব হল— ভেবে অবাক হই। মনে হয় মাটি আর জীবনের প্রতি গভীর টানই রয়েছে এর মূলে। আর ছিল রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ নজর। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন বলেই রামকিঙ্কর বেঙ্গল স্কুলের কার্বন-কপি করার অচলায়তনে ওইরকম জোরালো বেপরোয়া কাজ করতে পেরেছিলেন।’ আর রামকিঙ্কর নিজে বলেছেন আরেকদিনের কথা, যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত মূর্তি গড়ছেন, রবীন্দ্রনাথ না কি চারপাশে কোনো অনুচর বা ভক্ত নেই দেখে রামকিঙ্করের কাছে এসে চুপিচুপি বলেছিলেন— ‘দেখ্, যখন যা পাবি, দেখবি— একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবি— তারপর তাকে নিংড়ে, ছিবড়ে করে হজম করে ছেড়ে দিবি।’
রামকিঙ্কর আরেকদিক থেকে শান্তিনিকেতনে মূর্তিমান আপদ ছিলেন— তা হল স্কেচ-ছবি বা মূর্তির জন্য মডেল ব্যবহার করা। নন্দলাল মডেল ব্যবহারের প্রবল বিরোধী। তাঁর শিল্পভাবনায় মডেলস্টাডির কোনো জায়গা নেই। কিন্তু ছাত্র মাস্টারমশাইয়ের এই পরামর্শ শিরোধার্য করেনি। মডেল নিয়েই কাজ করেছেন। অবশ্য গোপনে। নারীদেহ নিয়ে রামকিংকরের খুব ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল এমন নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শেষ কথাটা সম্ভবত মাথায় গেঁথে গিয়েছিল চিরকালের মতো। কোনো কিছুর জন্যই, কোনো সম্পর্কের জন্যই বাঁধা পড়তে তিনি রাজি নন। বাঁধা পড়লে শিল্পের ক্ষতি হয়। লক্ষ্য একটাই— আর্টওয়ার্ক। শরীর নিয়ে শুচিবাইও ছিল না। প্রচুর সাক্ষাৎকারে ধরা আছে সেসব কথা। তবে সবচেয়ে জোরালো টান অনুভব করেছিলেন বিনোদিনীর ক্ষেত্রে। হালকা গড়নের লাবণ্যময়ী। মণিপুররাজকন্যা। অপরিণামী এক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। বিনোদিনীর পোর্ট্রেট করেছেন সিমেন্টে, অয়েলে-জলরঙে অনেক ছবি। ইন্সপিরেশন পেতেন তাঁর কাছে। মণিপুরের প্রথম গ্র্যাজুয়েট মেয়ে বিনোদিনী ফিরে যান শান্তিনিকেতনের কোর্স শেষ হলে। সেখানে বিয়েও করেন। কিন্তু যে-জীবনের মানে খুঁজেছিলেন শান্তিনিকেতনে, তা হয়তো তাঁকেও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। ১৯৭৯ সালে বিনোদিনীর লেখা উপন্যাস ‘বড়ো সাহেব ওংবি সানাতোংবি’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান।
সম্ভবত ১৯৪৯-এ বিনোদিনী ফিরে গেলেন মণিপুরে। আর পরের বছরেই রবীন্দ্রনাথের ছোটোমেয়ে মীরাদেবীর ‘মালঞ্চ’ বাড়িতে রাধারানীর সঙ্গে দেখা হল রামকিংকরের। বাগাল রায়ের পরিবর্তে রাধারানী বহাল হলেন রামকিঙ্করের বাড়িতে। সদ্য প্রেম-হারানো রামকিঙ্কর সে-দিনগুলোতে আরও বেপরোয়া। তাঁর শিল্পে তখন গ্রীষ্মের রুক্ষতা। রাধারানী— স্বজন পরিত্যক্তা সাদামাটা বাঙালি মেয়ে, শিল্পকলা থেকে বহুদূরে যার বাস, তিনি রামকিঙ্করের নিছক পরিচারিকা না-থেকে হয়ে উঠলেন আরও বেশি কিছু। বিয়ে না-করলেও রাধারানী তাঁর ঘরণী এবং সবথেকে বড়ো কথা তাঁর মডেল। রামকিঙ্করচর্চায় আমাদের প্রধান অবলম্বন প্রকাশ দাসকে সাক্ষাৎকারে রাধারানী জানিয়েছিলেন— তিনি যখন তাঁর ‘বাবু’র কাছে আসেন, তখন না কি তিনি বিংশতিবর্ষীয়া যুবতী। রামকিঙ্কর তখন চুয়াল্লিশ। ফলে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে কূটকচাল করতে ছাড়েনি কুঁদুলে বাঙালি। শান্তিনিকেতনে শিল্পীর ব্যক্তিজীবন তখন চৈত্র-বৈশাখের শিমুল ফল হয়ে ফেটে পড়েছে। জেরবার রামকিঙ্কর বলে উঠলেন : ‘যখন ভদ্রলোকের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলাম তখন সবাই বলল, কী আস্পর্ধা! আবার এখন যখন ছোটলোকের মেয়ের সঙ্গে আছি তখনও সবাই বলছে ছিঃ ছিঃ।’
রামকিঙ্কর কিন্তু রাধারানীর যে-ছবি শুরুর দিকে এঁকেছেন তা আদৌ কুড়ি বছরের নারীর মুখ বলে মনে হয় না। এ যেন প্রৌঢ়ার মুখ। পাশাপাশি বিনোদিনী পর্বে এচিং-এর কাজ ‘কমরেড’ দেখলে মনে হয় কত ফুল্লকুসুমিত রামকিঙ্করের পৃথিবী। স্কেচ বোর্ড বগলে প্রায় উড়ে যাচ্ছেন মডেলের পাশে-পাশে। কিন্তু রাধারানীতে যাবতীয় উচ্ছ্বাস ছেঁটে ফেলেছেন তিনি। যেন সেবারের মতো বসন্ত গত তাঁর জীবনে। রাধারানী তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন নিম্নবিত্ত সাংসারিক জীবনের আবহ। যে-জীবনের সঙ্গে রামকিঙ্করের আজন্মের পরিচয়।
দিনকর কৌশিক অবশ্য মণীন্দ্র গুপ্তকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাধারানীর সঙ্গ রামকিংকরের ছবিতে বা আর্টিস্ট-সত্তায় কোনো বদল আনতে পারেনি। রাধারানী ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন— ‘রেতে যে ছবিগুলো আঁকতেন আমার, বিরক্ত হতাম খুব। বলতেন এমনি করে কাত হও, এমনি করে বসো, এমনি করে হও। এই করে করে রাত প্রায় দশটা-বারোটা হয়ে যেত। দৈনিক এক-একবারে চারটা, পাঁচটা, ছটা, সাতটা ছবি করতেন। বলতাম, দিনে ছবি করবেন। রেতে ছবি করা কি ভালো লাগে? বলতেন তুমি ঘুমোও কেনে, তুমি ঘুমোও কেনে। ...রাতদিন শুধু ছবি ছবি ছবি।’ ১৯৬৪ সালে রতনপল্লীর বাড়িতে এসে রাধারানী গরু ছাগল পুষেছেন, চেনাশোনা দু-তিনটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন। মণীন্দ্রবাবুর ভাষায়, ‘শান্তিনিকেতনের উঁচু সমাজের পাড়া থেকে অনেকটা দূরে দুইজন অন্ত্যজ গোত্রের মেয়ে পুরুষ সংসারের একটা মায়াজাল বুনছেন।’ রামকিঙ্কর সংসারের মলিনতা থেকে বাইরে থাকতে চাইছিলেন? মৃত্যু পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হননি। তিনবার গর্ভপাত করিয়েছেন রাধারানীর। কিন্তু তাঁরা স্বামী-স্ত্রী নন।
পূর্ণেন্দু পত্রী ‘রামকিংকরের ভূমণ্ডল’ নামে এক লেখায় স্পষ্ট বলেছিলেন রামকিংকরের দ্বৈতসত্তার কথা। তিনি যেন দুটো মানুষ। দিন আর রাত। রামকিঙ্কর নিজেই লিখছেন, ‘জীবনের উদ্যানে যেটা দেখি চোখের সামনে দিনের আলোয় তা ছবিতে আঁকি, আর যা টাচ্ করি অন্ধকারে তা স্কাল্পচার করি।’ এ কি তবে অন্ধকার-সূর্যালোকের বাইনারি? সম্ভবত নয়। মনে হয় চেতন আর অবচেতনের হাত ধরাধরি করে চলা। চিত্রকর রামকিঙ্কর আর ভাস্কর রামকিঙ্কর আসলে একই মানুষ। পূর্ণেন্দুর মনে হয়েছে ‘দ্বা সুপর্ণা’র কথা। উপনিষদের দুই পাখি। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় যা এভাবে এসেছিল— ‘এমন জটিলঝুরি সমকালীন/ সব জায়গায় থাকি, আমার/ অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।’ রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শন’-এর পৌষ ১৩১০ সংখ্যায় [পরে ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ (১৩১৪) বইতে গ্রন্থিত] ‘মন্দির’ প্রবন্ধে ‘দ্বা সুপর্ণা’র উল্লেখ করে বলছেন : ‘উপমাটি ক্ষুদ্র হইয়াই সত্যটিকে বৃহৎ করিয়া প্রকাশ করিয়াছে— বৃহৎ সত্য-দ্রষ্টার যে নিশ্চিন্ত সাহস, তাহা ক্ষুদ্র সরল উপমাতেই যথার্থভাবে ব্যক্ত হইয়াছে। . . . ইহারা দুটি পাখী, ডানায়-ডানায় সংযুক্ত হইয়া আছে— ইহারা সখা, ইহারা একবৃক্ষেই পরিষক্ত— ইহার মধ্যে একজন ভোক্তা, আর একজন সাক্ষী, একজন চঞ্চল, আর একজন স্তব্ধ।’
রামকিঙ্কর কিন্তু চিরচঞ্চল, সৃষ্টির বাসনায় উন্মুখ। মৃত্যুর সাত বছর আগেও জানিয়েছেন তাঁর না কি ইচ্ছে করে মিশরের পিরামিডের মতো বিশাল মূর্তি গড়তে— ‘এত বড়ো পৃথিবী। চন্দ্র সূর্য জ্বলছে। কী বিশাল জ্যোতি। জগৎটাই তো কী বিরাট। তাঁর মধ্যে আমি যদি একটা পুতুল গড়তে চাই, আমি তো পুতুল গড়ি, হাঃ হাঃ হাঃ, তো দিক একটা পুতুলই গড়তে দিক আমাকে।’
জীবন সার্থক ছিল তাঁর অহেতুক শিল্পে। যেখানে ভালোবাসা খুঁজে এনে ‘রূপবান মেঘে’ পারম্পর্যহীন ঈর্ষা থেকে পশ্চিমে সেগুনের কাছে যাওয়া যায়। জীবনের দুই প্রান্তে আগুন লাগিয়ে পুড়তে-পুড়তে জীবনকেই বাঁধের ওপর থেকে দেখার নাম রামকিঙ্কর। তাঁর মৃত্যু হয়েছে ১৯৮০-র অগাস্টে। কিন্তু টোকা মাথায় যিনি এখনও চলেফিরে বেড়ান আশ্রম প্রাঙ্গণে, কলাভবনের সামনের রাস্তায়, কোপাইয়ের পাড়ে। তাঁর মূর্তিগুলি পড়ে আছে বাঙ্ময়। ছাতিমের গন্ধে যখন ভারী হয়ে আসে আশ্রমের সামনের রাস্তা— উত্তরায়ণের বারান্দায় কি রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ান কখনো? তবে ওই রাস্তায় খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলেই সবুজ আভার তারজালির বেড়ার ওপারে এখনও হয়তো মাঝে-মাঝে এসে দাঁড়ান রামকিঙ্কর। বাংলা ভাষার এক কবি তাঁর ‘প্রিয় রামকিঙ্করদাদাকে’ নিয়ে হয়তো এমনই কিছু অনুভব করে লিখেছিলেন :
		তোমায় যন্ত্রণা দিতে বড়ো বেশি লাগে—
		হে তুমি, অবাক তুমি, মনোময় সংসার জগত
		কে হে তুমি মনোময়? তোমায় যন্ত্রণা দিতে লাগে।
		তোমার হাসিতে ফুল, ফুলে ও এক্ষুনি ঝরে যায়
		আগুপিছু ঝরে যায়, এবং সম্ভ্রম ঝরে থাকে
		অহংকার ঝরে যায়— কোথাকার মাতৃমূর্তি ধরে! 
		কেন অহংকার করো?— আমার সমস্ত চলে যায়
		চলে যায়, কে তাকায় ফিরে? 
		রামকিংকরের মূর্তি পড়ে আছে জগজ্জুড়িয়ে
		আগুপিছু
		তোমায় প্রণাম করি। আমার সম্ভ্রম থাকে নিচু।
(কবিতাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। শিরোনামেও তাঁরই কাব্যগ্রন্থের নাম।)