"আমাদের বাড়িতে এসে অনেকগুলো গান শোনালো সলিল। সবই প্রোগ্রেসিভ গান। কোরাস ভাল হয়। কিন্তু সোলো রেকর্ড করা মুশকিল। চলবে না। সলিলকে সেই কথাই বললাম।
সলিল শুনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপরে উঠে পড়লো। বললে, 'তাহলে আজ আসি।'
দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলো সলিল। বললে, 'হেমন্তদা, একটা অন্য ধরণের গানেরও সুর করেছি। আমারই লেখা। অবশ্য এখনও পুরোটা লেখা হয়নি। তা যেটুকু হয়েছে শোনাবো?'
বললাম, 'হ্যাঁ, শোনাও।'
সলিল শোনালো-'কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়।'
শুনলাম। ভালোও লাগল। বললাম, এটা হতে পারে। তবে গানটা আরও বাড়াতে হবে। কাহিনি-সংগীত যখন, 'রেকর্ডের দুপিঠের মতো কথা বাড়াও। তাহলে খুব ভালো হবে।'
আমার কথায় উৎসাহ পেলো সলিল। বাড়িয়ে ফেললো গানটাকে। দু'দিন পরে এসে আবার শোনালো। মন দিয়ে শুনলাম। শুনে বললাম, 'হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। আমি রেকর্ড করবো।'
... সলিলের গানটা গ্রামাফোন কোম্পানির কাছে পেশ করলাম। ওরা তো এককথায় রাজি। অতএব 'গাঁয়ের বধূ' রেকর্ড হয়ে গেল।
রেকর্ড বাজারে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল। আশাতীত সাফল্য...।"
[আনন্দধারা - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]
"হেমন্তকুমারের অনেক গানের অর্থ পাওয়া ভার। যথা, 'গাঁয়ের বধূ' যেন 'স্বাধীনতা'র সম্পাদকীয় [স্বাধীনতা তৎকালীন সংবাদপত্র - স.ব.] । যেমন তার সুর। তেমনই তার বাক্যচয়ন। তাছাড়া রেডিও মারফৎ দুয়েকটী গান গেয়েছিলেন তার ভাব ভাষা বিয়ের পদ্য। রেডিওতে বাঙলা দেশের কালচারের গর্ব্ব চলে রোজ - যদি আপনি দয়া করে গানগুলি শোনেন বুঝবেন - বাঙলা দেশে যে সাহিত্যরুচি আছে তা আপনার মনেই হবে না।" [প্রবন্ধ সংগ্রহ - কমলকুমার মজুমদার]
"হেমন্তদা একবার কলকাতায় এসেই আমার খোঁজ করলেন। 'পাল্কীর গান'-এর সুরটা তখন করেই রেখেছিলাম। গানটা হেমন্তদাকে শোনালাম। এই গানের একটা 'ধুন' হিসেবে 'হুন্হুন্না' যোগ করলাম। হেমন্তদা গানটা শুনে বেজায় খুশি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন রেকর্ড করার জন্য। এখানে একটা কথা বলার প্রয়োজন। হেমন্তদার একটা বিশেষ গুণ ছিল, যা অন্য কারো মধ্যে খুব কমই দেখা যায় সেটা হচ্ছে নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা, তাকে উপলব্ধি করার মতো বোধ। মানে, কোন পরীক্ষামূলক ব্যাপারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার সাহস হেমন্তদার ছিল। তাই 'পাল্কীর গান'টা শুনেই তিনি লাফিয়ে উঠেছিলেন। নতুন ধরনের একটা 'এক্সপেরিমেন্ট' কী হবে, না হবে, সেই ঝুঁকি নিয়েও তিনি নতুনকে গ্রহণ করতেন। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।'
[হেমন্তর কী মন্তর - সুভাষ মুখোপাধ্যায়]
"অতি আধুনিক সুরকার হলে এই গানের পটভূমিকায় ঘন ঘন মেঘের ডাকের আয়োজন করতেন এবং সম্ভবত 'শ্যামল দুটি গাই'-এর হাম্বা রবও ঐ-সঙ্গে জুড়ে দিতেন, যেমন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'পাল্কী চলে' কবিতার অদৃষ্টে জুটেছে। উক্ত কবিতাটি বাস্তব সংগীতে পরিণত করতে কত পরিশ্রমই না করতে হয়েছে। পাল্কী বেহারার ঘন ঘন 'হুম্ হুম্' আর 'হেঁইয়া হেঁইয়া' প্রভৃতি আওয়াজ, আরো কতরকম পরিবেশ সৃষ্টি। এতে নাটকীয় ভাবটি খাসা হয়েছে কিন্তু সুরের দিক থেকে একটা স্বতঃস্ফূর্ত সরল বৈচিত্র্য সৃষ্টির যে দক্ষতা তার পরিচয় অল্প।" [প্রসঙ্গ বাংলা গান - শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্রা]
'একজন নামী শিল্পী আমার কাছে স্বীকার করেছেন - "গাঁয়ের বধু হিট হওয়ার পরে একটু হিংসে হ'ল। আমিও একটা চটুল জমাটি গান করলাম। গানটা গাঁয়ের বধুর মত সুপারহিট না হলেও লোকের মুখে মুখে ফিরত। ভাবলাম জিতে গেছি। কিছুদিন পরে দেখলাম আমার আসনটি নড়বড়ে হয়ে গেছে, এইখানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নির্বাচন বৈশিষ্ট্য।"' [হেমন্তর কী মন্তর - সুভাষ মুখোপাধ্যায়]
"দমদমে প্লেন থেকে নেমে সোজা শ্যামবাজারে নচিকেতা ঘোষের বাড়ি হাজির। বন্ধু ছবির গান শিখবেন। শেখা হল 'মউ বনে আজ'। নচিদা দ্বিতীয় গান 'মালতী ভ্রমরের' যেই শুনিয়েছেন, তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন - বাবা এই গান আমি গাইতে পারব না, আপনি মানবকে খবর দিন। [বাংলা গানের পথচলা - অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়]
"... এছাড়া আমার গলার কতখানি কী ক্ষমতা সেটা বিবেচনা করে সেটুকুই দেবার চেষ্টা করি। এবং অনেক সময় অসুবিধে হয়েছে কোনও মিউজিক ডিরেকটরের কাছে। তিনি হয়ত একটু গোলমেলে কাজ দেওয়াতে চাইছেন আমাকে দিয়ে। তা আমি তাঁকে বললুম, এই যে একটা কাজ, এইটা দিতে গেলে এটার কথা ভেবে ভেবেই আমার গান নষ্ট হবে। কারণ আমাকে তো ভাবতে হচ্ছে ওই লাইনটা আসছে ... ওখানে একটা কাজ আছে, যেটা আমার গলা থেকে চট করে বেরোবে না। আর ওই ভাবতে ভাবতেই আমার গানটা নষ্ট হয়ে যাবে।" [আমার গানের স্বরলিপি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]
"সলিলকেও বলি। তুমি ভাই ভেবো না যে আমার গলা লতার মতন, যা দেবে গেয়ে দেবো। আমাকে বুঝে আমার গান দাও। ও-ও সেটা জানে। বলে, না হেমন্তদা, সে আমি জানি। আপনাকে আমি ঠিক আপনার গলার মতন গানই দেবো। তা সলিল আমার এক্সপ্রেশনটার দিকেই বেশি নজর দেয়। আমি জানি যে আমাকে এমন গলা ঈশ্বর দিয়েছেন যাতে এ রকম কিছু এক্সপ্রেশন আমি দিতে পারি। আমি সে রকম এক্সপ্রেশনই দিতে ভালবাসি। আর সে রকমই দিই।"[আমার গানের স্বরলিপি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]
)