• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • বাংলা গান আর সুমনের গান - ১ : সম্বিৎ বসু



    কাব্য করে যদি বলা হয় ঊনিশশো বিরানব্বইয়ে সুমনের "তোমাকে চাই" বাংলা গানের মরা গাঙে জোয়ার এনেছিল, তাহলে হয়তো কিঞ্চিৎ ন্যাকামো হয় - কিন্তু সত্যের অপলাপ হয় না। সত্তরে যে অবনমনের শুরু, আশিতে সেই বাংলা গানের ধারা প্রায় একেবারে শুকিয়ে গেল। শুধু বাংলা গানই নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলা ছবি, নাটক সর্বত্রই এই একই ছবি। হয়তো কিছু ব্যতিক্রম ছিল সাহিত্যে - বিশেষত কবিতায়।

    বাংলা গানের আশির দশকের অবস্থা খুবই ঘোরালো। সত্তরে মারা গেছেন শচীন দেব বর্মন, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাসগুপ্ত - শেষের দুজনের মৃত্যু অকালে, সৃষ্টিক্ষমতার প্রায়-শীর্ষে। শচীন দেব বর্মনের মৃত্যু পরিণত বয়সে হলেও, তখনও তিনি গান তৈরি করছেন। শুধু হিন্দি ছবিতেই নয়, প্রতি বছর পুজোয় বাংলা গানও পাচ্ছিল শচীনদেবের নতুন সৃষ্টি, ১৯৭২ সাল অব্দি। সত্তর থেকেই হেমন্ত-কন্ঠ পড়তির দিকে। আশির শেষের দিকে হেমন্তর মৃত্যু কন্ঠবাদনের দিক থেকে নতুন কোন শূন্যতা সৃষ্টি না করলেও, ফাঁক তৈরি করেছিল সুরসৃষ্টির দিক থেকে। যদিও আশির গোড়া থেকেই বাংলা ছবি বলিউড-মুখী, বাংলা ছবিতে সুরকার হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতি ছিল প্রখর। বলিউড-মুখী বাংলা গানে ক্রমশ আমদানি হবে বাপ্পি লাহিড়ী-মার্কা জগঝম্প। তবে এ কথা স্বীকার করব, বাপ্পি লাহিড়ী ও রাহুল দেব বর্মন বাংলায় মেলোডি থেকে কখনই খুব দূরে সরে যাননি। সলিল চৌধুরী ফিরে এসেছেন কলকাতায়। কিন্তু তাঁর নজর তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে। যদিও মাঝে মাঝে কিছু ভাল গান বেরিয়ে আসছে তাঁর হাত দিয়ে, তবুও প্রাইমটাইমের সলিলের তুলনায় আশির সলিল অনেক বিবর্ণ। গণসংগীত ঘুরপাক খাচ্ছে পুরোনো আবর্তে।

    এরকম একটা সময়ে, যখন বাংলা গানের নাভিশ্বাস, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চে অবতরণ। এবং প্রথম শ্রবণেই নবীন শ্রোতাদের পতন ও মূর্ছা। শুধু গানের জন্যেই নয়, সুমন নিজের মঞ্চপরিবেশনায় নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ এক প্যাকেজ। এর আগে ঊষা উত্থুপ ছাড়া অধিকাংশ বাংলা গায়ক-গায়িকার মঞ্চ উপস্থাপনা ছিল সংগীত পরিবেশন। আসতেন, বসে হারমোনিয়াম ধরে, খাতা খুলে একের পর এক গান গেয়ে নমস্কার করে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করতেন। হয়তো নিচুগলায় একটা দুটো কথা বলতেন মঞ্চে বসে থাকা বাদনদলের সঙ্গে, হয়তো দু-চারটে কথা ছুঁড়ে দিতেন শ্রোতাদের দিকে।

    এই দৃশ্যের বদল হল সুমনের সঙ্গে। নিরাভরণ মঞ্চের সামনের দিকে L অক্ষরের মতন রাখা দুটি কী-বোর্ড সিন্থেসাইজার, একটু পেছনে স্ট্যান্ডে রাখা একটি ক্ল্যাসিকাল গিটার। এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক লম্বা পায়ে মঞ্চে ঢুকে বিনা-বাক্যব্যয়ে কীবোর্ডের বোতাম টিপে শুরু করে দিতেন গান। সময় যত এগোত, সুমনের বাক্যজালের ছটাও তত বাড়ত। তৈরি করতেন শ্রোতাদের সঙ্গে এক অসামান্য সংযোগ। ভেবে দেখলে এও এক পারফরমেন্স স্ট্র্যাটেজি। তিন ঘন্টার একক অনুষ্ঠানে গলার বিরাম নেওয়ার প্রয়োজনেও।

    সুমন চট্টোপাধ্যায়কে বিশেষ কেউ চিনতেন না। ষাট-সত্তরের দশকে বেতারে গান গাইতেন সুমন, কিন্তু খুব সাড়া জাগাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। মহীন-পরবর্তী ব্যান্ড যুগের সুমন তৈরি করেছিলেন "নাগরিক"। সেও বিশেষ সাড়া জাগায়নি। "নাগরিক"-এর তিনটি অ্যালবাম "অন্য কথা, অন্য গান", "অন্য কথা, অন্য গান - ২" ও "নিকারাগুয়ার জন্য"-র খোঁজ পড়ল সুমন চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত হবার পর।

    "নাগরিক" আমলের সুমনের গানে শ্লেষ ছিল তীক্ষ্ণ। ভেবে দেখুন এই গানটি -

    দুচোখ বুজে যাও, কিছু চেয়ে দেখ না
    দুকান বুজে যাও, কিছু শুনে রেখ না,
    কত কী করছে লোকে
    কত কিছু বলছে লোকে
    যাও ভুলে যাও,
    কিছু মনে রেখ না।

    মনে রাখা বিপদ বড়,
    কথায় কথায় মনে পড়ে
    সেদিন ঐ ওপাড়াতে,
    কে যেন গেছে মরে।

    কী ভাবে মরে গেছে,
    চেয়ে যদি দেখেই থাক
    অথবা পথের ধারে
    আচমকা শুনেই থাক -

    সে ছিল তোমার-আমার মতই একটা দিব্যি মানুষ।
    ছিল তার ছেলেমেয়ে, বিছানায় মেয়েমানুষ।
    ছিল তার একটা মাথা, দুটো হাত আর দুখানি পা -
    ময়লা জামাকাপড় কেচে দিত পাড়ার ধোপা।
    খিদে পেলে ধিদে পেত তোমার-আমার মতই তারও,
    মিল ছিল আরও অনেক - গোঁজামিলও বলতে পারো।

    এরই মাঝে একটা অমিল, ভীষণরকম অমিল ছিল
    মাসদুই আগে হঠাৎ লোকটার চাকরি গেল। ফলে কী হল জান?
    না, জেন না, জানলে লোকে বলবে কী?
    লোকে খাচ্ছে না ভাবলে গরম ভাতে ঘি
    কী করে চটকাবে আর?
    কে খাবে তোমার খাবার?
    না, জেন না, জানলে লোকে বলবে কী?

    "নাগরিক" আমলের এই তীক্ষ্ণ শ্লেষ, বিরানব্বই-পরবর্তী সুমনে হয়ে গেল অনেক সোজা-সাপ্টা, সরল। "তিন-তালের গান"-এ প্রায় একই অনুরণন শুনি অনেক সরাসরি ভঙ্গিতে -

    কেউ যদি বেশি খাও
    খাবার হিসেব নাও
    কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না।

    খাওয়া না-খাওয়ার খেলা
    যদি চলে সারাবেলা
    হঠাৎ কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না।

    * * * * *

    সুমন বাংলার আবহমান সঙ্গীতধারার উত্তরাধিকারী। যে ধারার শুরু নিধুবাবুর গান দিয়ে, যখন বাংলার নিজস্ব মান্য নাগরিক সঙ্গীত তৈরির তাগিদে পশ্চিম-ভারতের আধা-ধ্রুপদী টপ্পাকে বাংলা কথায় পুরে শুরু করেছিলেন এক নতুন সঙ্গীতধারা। মূলত সেই ধারাই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, হিমাংশু দত্ত, সলিল চৌধুরীদের সৃজনে গতিপথ বদলাতে বদলাতে বাংলা গানের অবয়ব তৈরি করেছে, যাকে আলগাভাবে বাংলা কাব্যসঙ্গীত বলতে পারি। যে অবয়বে সুরের দিক থেকে তাদের নিশ্চিত ও দীর্ঘমেয়াদী চিহ্ণ রেখে গেছেন অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল, অনুপম ঘটক, কমল দাশগুপ্ত, রবীন চট্টোপাধ্যায়, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শচীন দেব বর্মন, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রাহুল দেব বর্মন প্রমুখরা। আর গানের কথায় দেখেছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তুলসী লাহিড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অজয় ভট্টাচার্য, হীরেন বসু, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দোপাধ্যায়, মুকুল দত্তদের নিজস্ব স্বাক্ষর। সংখ্যায় অনেক কম হলেও এই ধারাতেই অন্য স্বাদ এনে দিয়েছিলেন মোহিনী চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমলচন্দ্র ঘোষেরা। বা পরে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর বসু।

    সুমনের সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকার তো এই-ই। বাংলা কাব্যসঙ্গীতকে যদি একটি ভিন্ন জঁরা (genre) ধরি, তবে সুমনের গান সেই জঁরাতেই পড়বে। সুমন নিজে কখনও কখনও তাঁর নিজের গানকে নাগরিক লোকসঙ্গীতের ধারায় ফেলেছেন। ধার করতে চেয়েছেন উডি গাথরি, বব ডিলান বা পিট সিগারের উত্তরাধিকার। হয়তো খুব ভুল নয় সেই সাঙ্গীতিক ছাপ। অন্তত প্রথম ক'বছর তাঁর গান নাগরিক জনতার হাতে হাতে নিশানের মতন ঘুরেছিল।

    এখানে গানের অর্থনীতি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। রামপ্রসাদ সেন থেকে রামনিধি গুপ্ত হয়ে রবীন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত - কেউই পেশাদার সঙ্গীতকার ছিলেন না। সকলেই গান লিখেছেন মনের আনন্দে। এর পরে গ্রামোফোন ও সবাক চলচ্চিত্রের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল গানের চাহিদার, প্রয়োজন হল নিয়মিত গানের জোগানের। তৈরি হল সঙ্গীত-অর্থনীতির। শুধু অপেশাদার সঙ্গীতজ্ঞদের ওপরে ভরসা করে ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। ফলে তৈরি হল পেশাদার সঙ্গীতজ্ঞের, যারা গান তৈরি করে বেচে জীবনধারণ করবেন। নজরুল এ পথের পথিকৃৎ। এলেন তুলসী লাহিড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়রা। এরই সঙ্গে গান হয়ে গেল বিভাজিত শিল্প। যিনি গান লিখছেন, তিনিই গানে সুর করছেন না। সুর করছেন অন্য একজন। আবার গাইবেন হয়তো তৃতীয় কোন ব্যক্তি। ফলে গান আন্তরিক থেকে হয়ে পড়ল ফরমায়েসি। সৃষ্টির গুণগত মানরক্ষা করার আর সেই তাগিদ রইল না।

    অতএব, রবীন্দ্রনাথ কি লালন শাহের সমগ্র সৃষ্টি থেকে যেরকমভাবে তাঁদের জীবনবোধ বেরিয়ে আসে, পরবর্তীকালের কোন গীতরচয়িতার সৃষ্টিকেই আর সেরকম অখণ্ডভাবে দেখা সম্ভব হল না।

    সঙ্গীতের বাজার পেশাদার হয়ে যাওয়ায় অনেক ধুরন্ধর সঙ্গীতজ্ঞ গানকে পেশা হিসেবে নিতে পারলেন। গানের বাজারে নতুন প্রতিভা আসার পথ সুগম হয়ে গেল। আবার অন্যদিকে সঙ্গীতসৃষ্টি বাজার-চালিত হয়ে যাবার দরুন সঙ্গীত রচয়িতারা একে অন্যের সঙ্গে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়লেন। অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতায় লাভবান হল সঙ্গীত। বাংলা সঙ্গীত পুষ্ট হল নতুন শিল্পীর গানে, নতুন দেশি-বিদেশী এলিমেন্ট এল গানে, নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র, শব্দ ও টেকনোলজির আমদানি করলেন সঙ্গীতকাররা। সব মিলিয়ে বেশ হৈ-হৈ রৈ-রৈ ব্যাপার।

    সুমন অপেশাদারভাবে আশির দশকে শুরু করেছিলেন 'নাগরিক' নামের গানের দল তৈরি করে। জনপ্রিয়তায় দাঁড়ায়নি। পরে আশির শেষে, নব্বইয়ের প্রথমে বাজারে নামলেন আটঘাট বেঁধে। হতে চাইলেন পেশাদার সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু ততদিনে বাংলা ছবিতে গানের বাজার একেবারে পড়তির দিকে এবং সে বাজারে গান তৈরি করার সাধ বা সাধ্য সুমনের নেই। শুধু ক্যাসেট বিক্রি করে সংসার চলবে না। প্রয়োজন লাইভ অনুষ্ঠানের। কিন্তু সুমনের গানের যে শ্রোতা তারা একেবারেই নগর কলকাতা-কেন্দ্রিক। সুমনের পক্ষে যাত্রাদলের মতন গ্রামে গ্রামে কল-শো জুটিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়, কারণ সেখানে তাঁর গানের চাহিদা নেই।

    এর একটা আনইন্টেন্ডেড কন্সিকোয়েন্স দেখা গেল। সুমনকে ফরমায়েশি গান তৈরি করতে হল না। সেই হিসেবে তিনি একেবারে রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র-অতুল-রজনীর সঙ্গে তুলনীয়। কিছু ছুটকো-ছাটকা ছবির গানটান বাদ দিলে, সুমনের সৃষ্টিকে প্রায় অখণ্ডভাবেই দেখা যায়। আর ফরমায়েশি গান তৈরি করতে হয়নি বলে নিজের গানের একটা ন্যূনতম মান ধরে রাখাও সম্ভব হয়েছে, যে সুযোগ নজরুল থেকে সলিল থেকে গৌরীপ্রসন্নরা পাননি।

    * * * * *

    বিরানব্বইতে যখন সুমনের 'তোমাকে চাই' প্রকাশিত হল, তখন বাংলা গানের মাঠ মোটামুটি ফাঁকা। পুরোনোদের চর্বিত-চর্বণ আর নইলে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর সঙ্গীত রচয়িতারা মাঠের দখল নিয়েছেন। এমন একটা কথা চলে যে 'তোমাকে চাই'-এর আগে যদি নচিকেতার প্রথম অ্যালবাম 'এই বেশ ভাল আছি' প্রকাশিত হত তাহলে কী হত। আমরা সেসব ফাটকার মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি যে ফাঁকা মাঠের সুযোগ পেলেও, মাঠে পুরোনো প্লেয়াররা তাদের সৃষ্টিক্ষমতার চরমে থাকলেও, সুমন নতুনত্বের স্বাদ এনে দিতে পারতেন।

    সুমনের গলা ভরাট, প্রায় ব্যারিটোন। স্পষ্ট উচ্চারণ। সুরে থাকে, যদিও স্পর্শস্বরের ব্যবহার খুব স্পষ্ট নয়। বাঙালি আম-শ্রোতা যে ধরনের টিম্বার, উচ্চারণ, স্বরপ্রয়োগ পছন্দ করে এসেছেন পঙ্কজ মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের থেকে - সুমনের গলার টিম্বার সেই ধরনের।

    সুমনের গানে বাঙালি শ্রোতার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া। প্রথম গান "তোমাকে চাই"-তে স্পষ্ট কামনা বাংলা গানে নতুন উচ্চারণ। যে কামনার উচ্চারণ বাংলা কবিতায় শোনা গেছে পঞ্চাশের দশকে অরুণ সরকারের কবিতায় -

    তোমাকে চাই আমি তোমাকে চাই

    তোমাকে ছাড়া নেই শান্তি নেই

    রক্তকিংশুকে জ্বালিয়ে দাও আমার বৈশাখী রাত্রিদিন।

    সুমন তাঁর গানে মধ্যবিত্ত বাঙালির শহুরে চিত্তপট ও চিত্রপট ধরলেন এক সিনেম্যাটিক টেকনিক ব্যবহার করে। সিনেমায় মন্তাজের ব্যবহার বহুদিন ধরে হয়ে এসেছে। খণ্ড কিছু চিত্র - কখনও বিক্ষিপ্তও - মুন্সিয়ানার সঙ্গে পর পর সাজিয়ে এক পূর্ণ ছবি বা আইডিয়া তৈরি করা মন্তাজের কাজ। সুমন সেই টেকনিক ব্যবহার করলেন এই গানে। পরে আরও অনেক গানেই সুমন এই টেকনিকের ব্যবহার করবেন, বিশেষত কলকাতা বিষয়ক গানগুলোতে -

    ১। কবেকার কলকাতা শহরের পথে
    পুরোন-নতুন মুখ ঘরে ইমারতে।
    অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
    অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে।

    ২। বেদম ট্র্যাফিক জ্যাম
    ঠান্ডা সালামি-হ্যাম
    চকলেট ক্যাডবেরি
    মাদার ডেয়ারি -

    ৩। তোমাকে দেখছি কফি হাউজের ভিড়ে
    তোমাকে দেখছি খুঁজছ পুরোন বই
    পুরোন কিংবা নতুন মলাটে আমি
    আসলে কিন্তু তোমাকেই খুঁজবই।

    সেই সঙ্গে সুমন গানে ধরলেন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির ধারণায় যা কুইন্টেসেনশিয়াল বাঙালিয়ানা আর তার নস্ট্যালজিয়ার জায়গাটা। যেমন,

    শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে
    হঠাৎ পড়তে-বসা আবোল-তাবোলে
    অবোধ্য কবিতায়, ঠুংরি-খেয়ালে
    শ্লোগানে শ্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে -
    সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
    চৌরাসিয়ার বাঁশি, মুখরিত তানে
    ভুলে-যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে
    সেই কবেকার অনুরোধের আসরে -

    মধ্যবিত্ত, শহুরে বাঙালির মনে হল - আরে, এ তো একেবারে আমাদের মতন। এই সংযোগটা খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল। এইখানেই সুমন ঢুকে পড়লেন মধ্যবিত্তর হেঁসেলে। এ একেবারে শহুরে, কলেজে-পড়া মধ্যবিত্তর হেঁসেল। অথচ এই বাঙালিয়ানাকে সুমন তাঁর পরিমিতিবোধ দিয়ে একটা গণ্ডিতে আটকে রাখলেন, কখনই "বাঙালি জাগো" ধরনের প্রাদেশিকতায় ঠেলে নিয়ে গেলেন না। ওই অ্যালবামেরই অন্য গান "গড়িয়াহাটার মোড়"-এর আগের পাঠ ও গায়নে এই কথাগুলো ছিল। "তোমাকে চাই" প্রকাশিত হবার আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই কথাগুলো তিনি গাইতেনও -

    টেলিভিশনের জাঁতা
    পিষে ফেলে কলকাতা
    দূর্দর্শনাচার, হিন্দি কথা
    নয় আমাদের জন্য।

    আরেক জায়গায় ছিল -

    জ্ঞান দিয়ে গান গাওয়া অনুপ জলোটা
    নয় আমাদের জন্য।

    কিন্তু যখন গানটা ক্যাসেট হয়ে বেরোল, এই পঙ্‌ক্তিগুলো সুমন বাদ দিয়ে দিলেন। অর্থাৎ সুমন নিজেকে কোনরকম মার্জিনে নিয়ে যেতে চাইলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে সুমনের বাংলা ও গান নিয়ে প্রত্যয় ও আবেগ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তা নইলে কেউ মধ্যবয়সে তৈরি জীবিকা ছেড়ে স্রেফ বাংলা গান গাইবার জন্যে শূন্য থেকে শুরু করতে পারে না। কিন্তু সেই আবেগের ফান্ডামেন্টালিজমকে নিজের শৈল্পিক বোধ ও এস্থেটিক্স দিয়ে গণ্ডি কেটে রাখলেন। কুইন্টেসেনশিয়াল বাঙালিয়ানাকে ধরতে চাইলেন নস্ট্যালজিয়া, কথ্য ও ইডিওমেটিক ভাষা দিয়ে। মোটামুটি কুড়ি-থেকে-পঞ্চাশ - এই বয়েসটাকে ধরলেন। যারা জানে পেটকাটি চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গা - এগুলো কী জিনিস; যারা হিমাংশু দত্তর নাম জানে, শীর্ষেন্দু পড়ে। নিজের শ্রোতাকুলের বাউন্ডারি কন্ডিশন ঠিক করে নিলেন এইভাবে। আর এখানেই স্থির হয়ে গেল বাংলা গানে জনাদৃত গায়কদের তালিকায় হেমন্ত, মান্না, শ্যামল প্রমুখদের সঙ্গে সুমন কখনই ঠাঁই পাবেন না। গ্রামে কী গঞ্জশহরে পুজো প্যান্ডেলে তাঁর গান বাজবে না।

    সেই সঙ্গে এও স্থির হয়ে গেল যে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালির সঙ্গীতজগতে সুমনের জায়গা একদম পাক্কা। এর আগে এই সাইলেন্ট মেজরিটির ভাষায় বিশেষ কেউ গান গাইতে পারেননি। এদের চিরটা কাল অন্যের ধার করা ভাষায় গান গেয়ে যেতে হয়েছে। যখন তারা নিজেদের মধ্যে সন্দীপনের "ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী" হাতবদল করছে গানের জন্যে তখনও কিন্তু তাদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে "এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়"-এর কাছে। (ঠিক এই গানের উদাহরণ সুমন ব্যবহার করেছেন তাঁর এক লেখায়।) অর্থাৎ এরা প্রেমও করছে, সন্ধ্যের সৌন্দর্য নিয়ে হয়তো আলোচনাও করছে - কিন্তু তার ভাষা অন্য। সেই ভাষা কেউ মূলধারার গানে ধরলেন না। মূলধারার গান বলছি এই জন্যে যে প্রান্তিক গানে এই ভাষা এসেছে। একদম হাতে গরম উদাহরণ সুমনেরই "নাগরিক" দল। সে তো আশির দশকেই বাজারে এসেছে। কিন্তু প্রান্তিক হয়ে থাকার জন্যে সে কিন্তু এই শ্রোতাদের কাছে পৌঁছতেই পারেনি বা পৌঁছলেও ঠিকমতন জায়গা পায়নি।

    তার মানে কি এ কথা বলা যায় না যে সুমনের সুমন হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের একটা অবদান আছে? সেটা যদি মেনে নিই, তাহলে আর একটু এগিয়ে হয়তো এ কথাও বলতে পারি কোন কোন প্রান্তিক শিল্পী যদি ঠিকমতন বাজার ব্যবহার করতে পারতেন তাহলে সুমনের আগেই হয়তো এরকম গান বাংলা গানের মূলধারায় এসে যেতে পারত।

    এর আর একটা সম্ভাবনা আছে। সেটা হল, প্রত্যেক সৃষ্টিরই একটা নিজস্ব সময় আছে। সে তুমি যত যুগন্ধরই হও না কেন, সময় ঠিক না হলে তোমার সৃষ্টির সেরকম কদর হবে না। এই তো নব্বইয়ের মাঝামাঝি 'আবার বছর কুড়ি পর" বেরোনর পরে শোনা গেল মহীনের ঘোড়াগুলি নাকি বাংলা ব্যান্ডের স্রষ্টা। তখন তাদের কত খ্যাতি। কিন্তু সবই মরণোত্তর। আসল সময়ে তাদের শ্রোতাদের প্রত্যাখ্যান পেয়ে চুপি চুপি একা-একা মরে যেতে হয়েছিল।

    তাহলে কি আসলে সুমন নয়, সময় পাল্টে দিল বাংলা গানকে?

    * * * * *

    সুমনের প্রথম অ্যালবাম বেরোনর পরে "এ কী গান!" এই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে এ-ও শুনতে হয়েছে এ গানে মিউজিক্যালিটি কম। সেটার মানে কী - এই প্রশ্নের জবাবে জানা গেছে যে এ গান মনে মনে গুনগুন করা যায় না। এর উত্তরে হয়তো বলা যেত, তাহলে তো বাখ-এর ফিউগ বা চাইকভস্কির ১৮১২ ওভারচারেরও মিউজিক্যালিটি কম। কিন্তু এসব জামাই-ঠকানো তর্কে না গিয়ে আমরা বরং ভাবি তাহলে এটাই কি সুমনের নতুনত্ব?

    রবীন্দ্রনাথ যদিও আমাদের সঙ্গীতকে "নির্জন এককের গান" বলেছেন, নাগরিক সঙ্গীত সব দেশেই মজলিশি সঙ্গীত - আমাদের দেশেও। অপরের বিনোদনের জন্যেই এর সৃষ্টি। ধর্মসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত বরং দেশে দেশে নির্জন এককের গান। যে গান গেয়ে একলা মাঝি নৌকো টানে বা পাহাড়ে মেষপালক ভেড়া চরায়, সে গানই নির্জন এককের গান। সে গান কাউকে শোনানোর জন্যে তৈরি হয় না। সেই লোকসঙ্গীত সুরের দিক থেকে অনেক সময়েই একঘেঁয়ে - কথা দিয়ে আবেগপ্রকাশই তার উদ্দেশ্য। বৈচিত্র্য আনার জন্যে গায়ক নিজেই কোন যন্ত্র - অধিকাংশ সময়েই তারযন্ত্র - দিয়ে সুর ধরে রাখে - কোথাও গিটার, কোথাও দোতারা, কোথাও ব্যাঞ্জো। এই গানই যখন সফিস্টিকেটেড হতে আরম্ভ করল বিদেশে, বহুস্বরের আমেজ আনতে গিটার বা ব্যাঞ্জো তখন কর্ড দিতে লাগল।

    সুমনের নাগরিক লোকগান এই জঁর-এর সঙ্গীত - বিশেষত ওঁর গিটারের গানগুলো। প্রথম অ্যালবামের "কখনও সময় আসে" বা "হাল ছেড়ো না বন্ধু" একেবারে সেই রবীন্দ্রনাথের বলা "নির্জন এককের গান"। কাজেই এ গানগুলো সেই জঁর-এর প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। একে যদি আমরা মজলিশি গানের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে ভুল হবে।

    গানের গঠনের দিক থেকেও এই গানের অনেকগুলিরই ব্যালাডের স্ট্রাকচার। বা আমাদের খাঁটি বাংলার ঐতিহ্য থেকে ধার নিলে বলতে হয়, পাঁচালির গঠন। প্রতি পঙ্‌ক্তিতে সুরের পুনরাবৃত্তি। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, সুমনের মতন একজন আধুনিক সুরকার হয়তো প্রতি দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তিতে সুরের চলনে সামান্য পরিবর্তন আনলেন। এই গঠনের ফল হল অব্যর্থ। শ্রোতারা গানের কথা থেকে মন সরাতে পারলেন না। সুমনের আগের অনেক তাবড় সঙ্গীতকার কিন্তু এই ভুলটা করেছেন। একেবারে মনকাড়া সুর দিয়ে শ্রোতাকে হয়তো মজিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু গানের কথার মধ্যে দিয়ে যা বলতে চেয়েছিলেন, শ্রোতার মন কিন্তু সেখান থেকে সরে গেছে। এক্ষুনি মনে পড়ছে সলিল চৌধুরীর "ও বৌ-কথা-কও বলে পাখি আর ডাকিস না" আর "প্রজাপতি প্রজাপতি" গানদুটোর কথা। দুটো গানই কথার দিক থেকে ব্যতিক্রমী। কিন্তু সলিলের অসাধারণ সুরের চলনে দর্শক ভেসে যান সুরে, কথা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় সেখানে। ফলে গানের কথা তার প্রার্থিত প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে পারে না। আর এখানে সুমন সলিলের ওপর জিতে যান গীতিকার হিসেবে, হয়তো গানের কারিগর হিসেবেও।

    এর থেকে এটাও বলা যায় মজলিশি সঙ্গীতে সঙ্গীত প্রধান, লোকগানে কথা প্রধান। ভেবে দেখার বিষয় রবীন্দ্রনাথ যখন বঙ্গভঙ্গের সময়ে তাঁর বিখ্যাত স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলো রচনা করেছেন, যখন কথা দিয়ে নিজের গণ্ডির বাইরে বৃহত্তর জনসমাজে গানকে পৌঁছে দেবার প্রয়োজন হয়েছে, গান দিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার দরকার হয়েছে, তিনি বেছে নিয়েছেন লোকসঙ্গীতের সুর, লোকসঙ্গীতের আঙ্গিক। চেনা লোকসঙ্গীতের সুরে কথা বসালে সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পৌঁছন যাবে, এই চিন্তা থেকে? এর পরে বামপন্থী অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সলিল চৌধুরীর গানে পশ্চিমী-ঘেঁষা সুরের সমালোচনা করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস 'ন্যাশানাল ইন ফর্ম, ইন্টারন্যাশানাল ইন কন্টেন্ট'-প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। সুমনও তাঁর কথাপ্রধান গানের জন্যে লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকই বেছে নিলেন - হয়তো সে লোকসঙ্গীত আমাদের দেশজ লোকসঙ্গীত নয় - কিন্তু তাতে কী ? উদ্দেশ্য তো সিদ্ধ হল।

    সুমনের গানের গঠনে আসা যাক। গঠন বলতে বলছি গানের কথা, ভাব, চলন ইত্যাদি কিভাবে সাজানো হয়েছে। এখানে একটু বাংলা গানের ইতিহাস ঝালিয়ে নিই। আলোচনার সুবিধে হবে। আমি-আপনি আজ যে গান শুনি সে একেবারেই নাগরিক সঙ্গীত। লোকসঙ্গীতও যা কানে আসে, সেও শহুরে মানুষদের ভাল লাগার মতন করে তৈরি করা। তাও গঠনগত দিক থেকে লোকসঙ্গীতের কাঠামো এখনও অনেকটাই অপরিবর্তিত আছে। লোকগানে সাধারণত প্রথমে দু লাইনের ধুয়া দিয়ে গানের ধরতাই দেওয়া হয়। তারপর তিন স্তবকে বিস্তার করা হয়। স্তবক সাধারণত চার-পাঁচ পঙ্‌ক্তি লম্বা। লালন শাহর এই গানটা ধরা যাক -

    (ধরতাই) আমার বাড়ির কাছে আর্শিনগর,
    সেথা একজন পড়শি বসত করে।
    আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।

    (প্রথম স্তবক) গেরাম বেড়ে অগাধ পানি।
    তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে।
    বাঞ্ছা করি দেখতে যাব। কেমনে দিব পাড়ি?

    (দ্বিতীয় স্তবক) কী কব পড়শির কথা -
    তার হস্তপদস্কন্ধমাথা নাই রে।
    ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর ক্ষণেক ভাসে নীরে।

    (তৃতীয় স্তবক) পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
    আমার যমযাতনা সকল যেত ঘুচে।
    সে আর লালন এক থানে রয়
    (তাদের) লক্ষযোজন ফাঁক রে।

    লালন শাহ বা অন্যান্য অনেক লোক রচয়িতাই এই গঠনে গান তৈরি করেছেন। লোকগানের একটা বৈশিষ্ট্য হল গানে ভণিতা দেওয়া - মানে রচয়িতার নাম, গানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। এও একরকম চালু ব্যবস্থা বলা যায় যে যে সব লোকগানে ভণিতা থাকে, সেখানে শেষ স্তবকে ভণিতা ঢোকানো হয়।

    এবার হাছন রাজার একটা গান দেখা যাক -

    (ধরতাই) লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার।
    কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।

    (প্রথম স্তবক) ভাল কইরা ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর -
    আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার।

    (দ্বিতীয় স্তবক) এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে।
    কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায় তার লাগিয়া কান্দে।

    (তৃতীয় স্তবক) আগে যদি জানত হাছন বাঁচব কয়তো দিন।
    বানাইত দালানকোঠা করিয়া রঙীন।

    এ গানও গঠনগত দিক দিয়ে আগেরটারই মতন, কিন্তু এখানে প্রথম স্তবক থেকেই ভণিতা এসেছে। সেদিক দিয়ে হাছনরাজার গান ব্যতিক্রম। আবার ভটিয়ালিতে কিম্বা ভাওয়াইয়ায় ভণিতা ব্যবহার করা হয় না। অধিকাংশ লোকগানেই ভণিতার ব্যবহার নেই। তা সে যাকগে। বাংলা লোকগান এতই ব্যাপ্ত আর সাঙ্গীতিকভাবে পুষ্ট, যে লোকগানের আলোচনা এই পরিসরে ঢোকানো অসম্ভব। আমি যে কথা বলতে চেয়েছিলাম তা হল এই ২-৪-৪-৪ ধরনের গঠন আমরা আবার দেখব নাগরিক গানে ফিরে আসবে।

    কিন্তু বাংলা নাগরিক গানের শুরু যদি ধরি নিধুবাবুর গান থেকে, তাহলে দেখা যাক কিভাবে বাংলা গানের গঠন বদলেছে। একথা এখন সবাই জানে নিধুবাবু পশ্চিমের শোরি মিঞার টপ্পার অনুসরণে বাংলা গান তৈরি করলেন। এই গানগুলোর গঠনে কিন্তু সেরকম কোন বিশেষ ফর্মালিটি দেখা যায় না। ফ্রি-ফ্লোইং একটা ব্যাপার। একই ব্যাপার নিধুর সমসাময়িক বা একটু পরের গানবাঁধিয়েদের ক্ষেত্রেও।

    ব্যাপারটা বদলাল রবীন্দ্রনাথ গান লিখতে শুরু করার পরে। ঠাকুরবাড়িতে ধ্রুপদের কদর ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ধ্রুপদ শিখেছেন। কাজেই তিনি যখন গান লিখতে শুরু করছেন, তখন ধ্রুপদের অনুবাদের পাশাপাশি নিজের গানেও ধ্রুপদের চারতুকের গঠন অবলম্বন করলেন। ধ্রুপদের গঠন খুব কড়া - আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ - এই চারটি ভাগ। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই ধ্রুপদে থেমে থাকেন নি। ফর্ম নিয়ে নানারকম খেলাধুলো, পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে। অন্য গান থেকে যখন সুর বা প্যাটার্ন ধার নিয়েছেন, তখন সেই ধরনের গানের গঠন ব্যবহার করেছেন। স্বদেশ পর্যায়ের

    গানে লোকসঙ্গীতের সুর নিয়ে যে গান বেঁধেছেন, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যালাডের ফর্ম ব্যবহার করেছেন। কীর্তনের ঢঙের গানে আখর দিয়ে গান বেঁধেছেন। কিন্তু এসব সত্বেও, যখন নিজের সুরে নিজের মেজাজে গান লিখছেন, তখন বার বার ধ্রুপদের গঠনে ফিরে গেছেন। ধ্রুপদের চারতুক গঠনে রবীন্দ্রনাথের একটা গান দেখা যাক। এ গান কিন্তু ধ্রুপদাঙ্গের নয় -

    (আস্থায়ী) সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
    আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।

    (অন্তরা) কত বর্ণে কত গন্ধে কত গানে,
    কত ছন্দে অরূপ তোমার গানের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।
    আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ এমন সুমধুর।

    (সঞ্চারী) তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় ভুলে।
    বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে ওঠে তখন দুলে।

    (আভোগ) তোমার আলোয় নাই তো ছায়া
    আমার মাঝে পায় সে কায়া।
    হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর।
    আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ এমন সুমধুর।

    আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের একটি গান দেখুন। রাহুল দেব বর্মনের সুর। ধরে নিচ্ছি গানের গঠনও তাঁরই বাছাই। সেই ধ্রুপদী চারতুক। অ্যারেঞ্জমেন্টে অবশ্য ফিউশন।

    (আস্থায়ী) যেতে দাও আমায় ডেকোনা।
    কবে কী আমি বলেছি, মনে রেখ না।
    কিছু বলবে কি?
    না না না, পিছু ডেকোনা।

    (অন্তরা) তুমি ভরে নিও বাঁশি ওগো সুর থেকে সুরে
    নয় চলে যাব আমি শুধু দূর থেকে দূরে।
    এই তাসেরই ঘর বেঁধে, তুমি ভেঙে দিওনা।

    (সঞ্চারী) কাঁচেরই ঝাড়বাতি, নেভে সময় হলে।
    প্রেম কি মোমের আলো, জ্বালায় শুধু জ্বলে?

    (আভোগ) প্রদীপেরই শিখায় পুড়ে মরুক প্রজাপতি
    হায় এমনি করে আসে শুধু লাভ থেকে ক্ষতি।
    এই হিসাবেরই খাতা, আর খুলে দেখোনা।

    এবার থেকে আজ থেকে বছর পঁচিশ আগের সুমনের একটা গান। বাংলা লোকায়ত সুরভিত্তিক গান, কিন্তু গঠনে ধ্রুপদের চারতুক -

    (আস্থায়ী) খাতা দেখে গান গেওনা, উল্টে পাতা যেতেও পারে।
    খাতাটাতা উল্টে গেলে হোঁচট খাবে বারেবারে।

    (অন্তরা) হাওয়া দেয় যখন-তখন, হানা দেয় হঠাৎ তুফান,
    পাতাটাতা উল্টে গেলে, সামনে পাবে ভুল কোন গান।
    এ গানের মুন্ডু তখন বসবে অন্য গানের ঘাড়ে।
    খাতা দেখে গান গেওনা, উল্টে পাতা যেতেও পারে।

    (সঞ্চারী) যুগটাই দমকা হাওয়ার, হাওয়া দেয় হঠাৎ তেড়ে।
    বলা কি যায় হে কখন ধাক্কাবে ঝড় যুগের ফেরে!

    (আভোগ) মাথাতেই সামলে রেখ স্মৃতি আর গানের কথা।
    বিপদে পড়বে না আর আসলে ঝোড়ো অস্থিরতা।
    চেনা গান জ্বালবে আলো, পথ দেখাবে অন্ধকারে।
    খাতা দেখে গান গেওনা, উল্টে পাতা যেতেও পারে।

    এমনকি আজকের গানেও এই ধ্রুপদী গঠন খুঁজে পাওয়া যাবে। এরপরে যে গঠনের গান বোধহয় সবথেকে বেশি প্রচলিত তা হল লোকসঙ্গীতের অনুপ্রেরণায় ২-৪-৪-৪ ছকের গান। রবীন্দ্রনাথ বাংলা লোকায়ত সুরে যেসব গান বেধেছেন, তার অনেকই এই গঠনের। যেমন 'হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে'র সুরে -

    যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
    একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।

    যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
    যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়--
    তবে পরান খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা
    একলা বলো রে।

    যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
    যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়--
    তবে পথের কাঁটা ও তুই রক্তমাখা চরণতলে
    একলা দলো রে।

    যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
    যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে--
    তবে বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে
    একলা চলো রে।

    খুব একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হল যে, হিন্দি ছবির অধিকাংশ গানের গঠন এই ২-৪-৪-৪, যা মনে হয় লোকগান থেকেই এসেছে। এবং হিন্দি ছবির গানের অনুকরণে বাংলা গানও এই গঠন অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ আজকালকার বাংলা গানের ২-৪-৪-৪ গঠন এসেছে লোকসঙ্গীত থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে, আবার আরেকভাবে একটু ঘুরপথে হিন্দি ছবির জগৎ ঘুরে। বিশেষত বাংলা ছবির গানে।

    এর বাইরে আর একটা গঠন হল ব্যালাড বা পাঁচালির গঠন। বা কথকতা। যেখানে গান ২-২-২-২ ... করে চলতে থাকে। যেমন ধরুন লক্ষ্মীর বারমাসি পাঁচালি -

    বছরে বৈশাখ মাস প্রথম যে হয়।
    পূজা নিতে এস গো মা আমার আলয়ে।।
    জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠী পূজা হয় ঘরে ঘরে।
    কৃপা করি এস ওমা পূজা যে বা করে।।
    আষাঢ়ে আসিতে মাগো নাহি কর দেরী।
    পূজা হেতু রাখি মোরা ধান্য-দূর্বা ধরি।।
    শ্রাবণের ধারা দেখ চারিধারে পড়ে।
    পূজিবারে শ্রীচরণ ভেবেছি অন্তরে।।
    ভাদরের ভরা নদী কূল বয়ে যায়।
    কৃপা করে এস গো মা যত শীঘ্র হয়।।
    আশ্বিনে অম্বিকা সাথে পূজা আয়োজন। ...

    এও তো লোকগানই। লোকগান থেকে ধার নেওয়া একটা বাংলা গান দেখি যেখানে এই গঠন ব্যবহার করা হয়েছে -

    শুন শুন গো সবে শুন দিয়া মন।
    বিচিত্র কাহিনী এক করি বরণন।|
    এক দেশে এক বনের ধারে ছোট্ট নদীর তীরে।
    ছিল এক রাখাল ছেলে এক ছোট্ট কুটিরে।|
    আপন বলে তার কেউ ছিল না দুনিয়ার।
    সারাটা দিন ধেনু চরাত বনে।
    থামায়ে ডাকাডাকি, শুনিত পশুপাখি
    যখন বাজাত বেণু নিজেরই মনে।

    পশুপাখি, হরিণ, হাতি সাথী ছিল তার।
    সঙ্গে তাদের হেসেখেলে দিন যে যেত তার।|
    বুঝত সে তাদের কথা, তারা বুঝত তার।
    এমনি করে কয়েক বছর হয়ে গেল পার।|
    হঠাৎ কী হল মনে ভাবল রাখাল কী কারণে
    মানুষের সঙ্গ বিনা আর থাকা না যায়।
    যা ছিল ঝুলি করি তাই নিয়ে সে দিল পাড়ি
    যাবার আগে সবার কাছে নিল সে বিদায়।|

    একেবারে খাপে খাপে মিলছে না, কিন্তু মূলধারাটা বোঝা যাচ্ছে। এটাও বলা যায় লোকগান যেহেতু কথা প্রধান, মানে নিজের আবেগ কথা দিয়ে বলা এবং, যদি শ্রোতার কথা ভাবা হয়, তাহলে শ্রোতার সঙ্গে ইমোশনাল কমিউনিকেশন কথার মধ্যে দিয়ে - তাই লোকগানের গঠন সরলরৈখিক, একই গানের ভেতর সুরে বৈচিত্র্য কম রাখা হয় যাতে শ্রোতার মন কথা থেকে বিক্ষিপ্ত না হয়ে পড়ে, এবং গান থেকে গানে সুরের একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। রামপ্রসাদ সেন তাঁর শ্যামাসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এই একই ডিভাইস ব্যবহার করেছেন। আমি এই লোকগানের আলোচনায় দলগত যে লোকগান সেগুলো বাদ রাখছি - যেমন জারি, সারি, ছাতপেটার গান ইত্যাদি। সেখানেও সুরের একঘেঁয়েমি - কিন্তু ভিন্ন কারণে।

    সুমন তাঁর অধিকাংশ গানে এই পুনরাবৃত্তির গঠনকে আশ্রয় করলেন। একটু এগিয়ে এও বলতে পারি - রবীন্দ্রনাথ যে গানে সুর আর কথার সমপ্রাধান্যের জন্যে সারাজীবন সাধনা করে গেছেন (যাকে তিনি অর্ধনারীশ্বর সম্পর্ক বলে অভিহিত করতেও দ্বিধা করেননি), সেই বাংলা গান তাঁর পরের যুগ থেকে মূলত গীতিকারের তুলনামূলক অক্ষমতার কারণে সুরপ্রধান হয়ে পড়ে। এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে রবীন্দ্রনাথ যুগন্ধর হলেও মূলত শব্দের কারিগর। জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের গানে ছাড়া, তাঁর গানেও কথার ভার বেশি। তবু, একমাত্র রবীন্দ্রনাথই, বাংলা গানের বহমান ধারায় কথা ও সুরের আপেক্ষিক সমতা রক্ষা করতে পেরেছিলেন সব থেকে ভালভাবে।

    কিন্তু পরবর্তীতে সেই তুলাদণ্ড একেবারেই ঝুঁকে পড়ে সুরের দিকে। পরে কেন - দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে শুরু করে দিলীপকুমার রায়, নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্ত, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাসগুপ্ত - এদের সবাই মূলত সুরবিহারী। নজরুল আর সলিল চৌধুরী কথা ও সুরের সমতা রক্ষার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সব সময়ে পেরে ওঠেননি। সলিল না হয় সম্পূর্ণ সুরভোলা, কিন্তু নজরুল তো তখনকার অগ্রগণ্য কবিও। তাহলে তাঁর গানে কেন সুর কথার দুর্বলতাকে বার বার ছাড়িয়ে গেছে সেটা ভেবে দেখার। সলিল বরং কখনও কখনও যুগের গীতিকার হয়ে উঠতে পেরেছেন। কিন্তু আমার ধারণা, এবং অ্যানেকডোটালি যা জানি তাতে মনে হয় যে, উনি কথাকে সবসময়ে সেরকম গুরুত্ব দিয়ে ওঠেন নি।

    সুমন এসে কথা ও সুরের সমতার গল্পটাকে পাল্টে দিলে এক ধাক্কায় - স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যাই হোক। নব্বইয়ে সুমনের শুরু থেকে বাংলা গান হয়ে পড়ল বাচিক। সুরের ব্যাপারটা এদিক-ওদিক থেকে ধার করে সামলে নেওয়া যাবে - এই হল ভাবখানা। চন্দ্রবিন্দু যার উজ্জ্বল উদাহরণ।

    এই প্রেমিস থেকে আমাদের দেখতে ও শুনতে হবে সুমনের গান।



    অলংকরণ (Artwork) : উইকিপেডিয়া থেকে
  • আধুনিকে হেমন্ত | হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত | সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত | বাংলা গান আর সুমনের গান - ১ | বাংলা গান আর সুমনের গান - ২ | গুগাবাবার গান
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments