• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • গান নিয়ে : নিরানব্বই শতাংশ বাঙালির হেমন্ত (২) : সম্বিৎ বসু

    হেমন্তর অভিব্যক্তির জয়গান বার বার শুনি। কিন্তু আমার যেটা বলার সেটা হল, এই অভিব্যক্তির প্রয়োগ একান্তভাবে বাঙালি অভিব্যক্তি। হেমন্ত উর্দুতে বোনা হিন্দি গানও যখন গাইছেন "জাগ দর্দে ইশক জাগ" - ব্যবহার করছেন সেই বাঙালির অভিব্যক্তিই। হয়ত সে কারণেই গায়ক হেমন্তর হিন্দি গানের কেরিয়ার সেরকম দীর্ঘ হল না। হেমন্ত আপাদমস্তক এই বাঙালি সেন্সিবিলিটি। ছিলই, তার ওপর সেটিকে সযত্নে শুধু লালনই করেননি, ভেবেচিন্তে বাড়িয়েও নিয়েছেন। পোশাক-আশাক থেকে জীবন-আচরণে। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য জিগেস করেছিলেন, "আপনাকে একজন মডেল বাঙালি হিসেবে দেখা হয়। আপনার পোশাক-আশাক, চলন-বলন, গানের ঢং, রুচি, সব মিলিয়ে। এটা কি খুব সচেতনভাবে করেছেন? নাকি হয়ে গেছে?" এর জবাবে হেমন্তবাবু - "হয়ে গেছে। সজ্ঞানেই করেছি, কিন্তু এখন তো সময় আর বদলাবার উপায় নেই। ..." [আমার গানের স্বরলিপি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]

    এই বাঙালিয়ানার আমদানি করেছিলেন শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমদানি করেছিলেন বলা ঠিক নয়। সামগ্রিক বাঙলা সংস্কৃতি থেকে ছেঁকে একটা বাঙালি রুচি তৈরি করেছিলেন, যা খুবই পরিশীলিত, কিন্তু আপাদমস্তক শহুরে। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে আজ অব্দি যত লক্ষ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, তার এক নম্বরে থাকবে খুব সম্ভবত এক্ষণ পত্রিকায় সত্যজিৎ রায়ের লেখা 'রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা' নামের লেখাটা। লেখা সত্যজিৎ শুরুই করেছেন এই বলে যে, "... রবীন্দ্রসংগীতের একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যেটা এর আগে কোন ভারতীয় গানে ছিল না"। এর থেকে আরও একটু এগিয়ে সত্যজিৎ এও বলছেন, "প্রথম থেকে শেষ অবধি যে বিশেষত্বটা রবীন্দ্রনাথের সব রচনার মধ্যে একটা ঐক্যস্থাপন করেছে, সেটা হল এর বাঙালিত্ব। তবে বাংলা রাগসংগীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী, লোকসংগীত বা নিধুবাবুর টপ্পায় যে বাঙালি ভাব, এটা সে ভাবে নয়। এটা হল রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব একটি বিশেষ শ্রেণীর বাঙালিয়ানার সাংগীতিক প্রকাশ।" [নির্বাচিত এক্ষণ প্রবন্ধ সংকলন - ১]

    সেখান থেকে এই অংশটাও উদ্ধৃত করি - "... শুধু সুর বা ছন্দ ছাড়াও আরও যেসব দিকে দৃষ্টি রাখা দরকার, সেগুলির কোন ইঙ্গিত স্বরলিপিতে পাওয়া যাবে না।

    "এক হল উচ্চারণ। কথা যাতে স্পষ্ট হয় তার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান থেকে তান তুলে দিলেন। রাগসংগীতের শ্রুতি-মীড়-গমক - এ সবের ব্যবহারও কথার খাতিরেই এখানে অনেকটা কম। অর্থাৎ সুরের চেহারাটা এখানে রাগসংগীতের চেয়ে অনেকটা সহজ, সরল। তাহলে উচ্চারণ স্পষ্ট হবে না কেন? কথার উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হবে না কেন? কথা যদি অস্পষ্ট হয় তাহলে তার ভাবের দিকটা ব্যাহত হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, কথার অস্পষ্টতা কোনও গানেই চলে না, এবং তাল গমকের খাতিরে ছাড়া তার কোন বিকৃতি বা অস্পষ্টতা বরদাস্ত করা যায় না।" [নির্বাচিত এক্ষণ প্রবন্ধ সংকলন - ১]

    নিজের উচ্চারণ সম্বন্ধে হেমন্তবাবু কি বলছেন দেখা যাক - "গোড়াতে আমি পঙ্কজদাকে (পঙ্কজ মল্লিক - স.ব.) অনুকরণ করে গান গাইতাম। সেই ছাপটাই আমাকে এতোদিন এগিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আর তো পরের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো চলে না। নিজের পোশাক না হলে চিনবে কী করে লোক? তাই নিজস্ব ভঙ্গির দিকে নজর দিলাম। প্রথমে নজর দিলাম গানের উচ্চারণের দিকে। খুব স্পষ্ট হওয়া চাই, সেই সঙ্গে থাকা চাই মিষ্টত্ব। যা মানুষকে আকৃষ্ট করবে। এসব আস্তে আস্তে রপ্ত করলাম। উচ্চারণের ব্যাপারে অবশ্য গোড়া থেকেই আমি খুব সজাগ। উচ্চারণটা যেমন সঠিক হওয়া উচিত, ঠিক সেইসঙ্গে দেখতে হবে স্বাভাবিকতা না হ্রাস পায়।" [আনন্দধারা - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]

    কাজেই দেখা যাচ্ছে বাংলা সংস্কৃতি জগতের আরেক হাই প্রিস্ট, হয়ত ১%-এর ১% - তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে কিছু চিন্তার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চিন্তা আর প্রয়োগের খুব মিল।

    কিন্তু অমিলের জায়গাটাও খুবই বড়। ওই প্রবন্ধের ওপর ভিত্তি করে, এর প্রায় বছর চোদ্দ পরে (১৯৮১) সুভাষ চৌধুরী সত্যজিতের এক সাক্ষাৎকার নেন, যা 'প্রসঙ্গ: রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। সেইখানে বিশেষ করে এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক আলোচনা হবার পরে সুভাষ চৌধুরী সত্যজিতের সঙ্গে এই ঐকমত্যে আসছেন যে রবীন্দ্রনাথের গানের বৈশিষ্ট্য হল যে গানটি যে রাগে আধারিত, গানে সেই রাগরূপ স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। নইলে হল না। যেমন এক জায়গায় -

    সুভাষ । ... আপনি 'মন্দিরে মম কে' বলেছেন, আসলে সেটা তো খেয়ালই পুরোপুরি। এক তালের গান, খেয়ালই, ভাঙ্গা গান (অন্য গানে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ যে গান তৈরি করেছিলেন, তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত মহলে 'ভাঙ্গা গান' বলে - স.ব.) এটা - এখানেও আপনার Point-এর সাথে আমি একমত যে, আপনি কতকগুলো অলঙ্করণগুলো রাগ সংগীতে একেবারে লাগাতেই হবে। একটা লোক গাইতে গেলে ...

    সত্যজিৎ। কিন্তু লাগায়ই না।

    সুভাষ। না, লাগাবে কি করে? লাগাতে গেলে তাকে তো 'আড়ানা' (আড়ানা হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে একটি রাগ। রবীন্দ্রনাথের 'মন্দিরে মম কে' গান সেই রাগের ওপর আধারিত - স.ব.) জানতে হবে, তবে তো সেটা তার পক্ষে লাগানো সম্ভব। এবং সেক্ষেত্রে, আপনি পরেও একবার বলেছেন যে, 'এটা মাঝারীদের কম্ম নয়, অথচ মাঝারীদের মধ্যেই থাকছে, মাঝারীদের মধ্যেই থাকবে, কিন্তু মাঝারীদের কম্ম নয় - ঠিক মতো করে রবীন্দ্রনাথের গানে justice করা।' কিন্তু সে কি উপায় বলুন - এ ধরণের যে সব গান আছে, যেগুলি পুরোপুরি ভাঙ্গা গান।

    সত্যজিৎ। এখন, দুটো জিনিস হয়তো, আপনি যদি জিনিসটাকে প্রচার, যদি চান যে খুব বেশি লোক গাক, সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক, এইটেও যদি থাকে - তাহলে আর ঐ 'আড়ানার' রূপ ফুটে উঠবে সেটা কি করে হয়, সেটাতো হতে পারে না। দুটো তো Contradictory হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় ...

    ... এক এক জন exceptional গায়কের গলায় আমরা গানের সুন্দর চেহারাটা বা শ্রেষ্ঠ চেহারাটা খুঁজে পাবো। অন্যদের ক্ষেত্রে পাবো না এবং বিচারটা সব সময়েই Best কে দিয়ে হবে। আরেকটা জিনিস - সব ঘরে ঘরে রবীন্দ্র সংগীত চলছে - সে ঘরে ঘরে গাওয়াটাকে তো আমরা প্রামাণ্য গাওয়া বলে ধরতে পারবো না।

    সুভাষ। মুশকিল হচ্ছে কি - Popular গাইয়ের গলায় তো এটা Popular হচ্ছে। সেখানে এটার একটা সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি। খুব Popular গাইয়ে কিন্তু তিনি - সেখানে খুব সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি।

    সত্যজিৎ। এইতো হেমন্তই দেখনা (হাসি) অবশ্য এটা আবার উঠে গেল (হাসি) ... কিন্তু কথা হচ্ছে যে হেমন্তবাবুর গলায় ধরুন এটা নেই। একজন আমি বলছি যে এটা নেই-ই (জোর দিয়ে), সেক্ষেত্রে লোক কিন্তু হেমন্তবাবুর গলায় এটা শুনতে চাইছে।

    [ধ্রুবপদ - প্রসঙ্গ বাংলা গান]

    অথচ রবীন্দ্রনাথ স্বরলিপিতে রাগের উল্লেখ করতে নিষেধ করেছিলেন। এর একটা কারণ হতে পারে তিনি চাননি তাঁর গানের গায়ক রাগের ব্যাকরণের চক্করে পড়ে গানের সামগ্রিক দিকটা বিস্মৃত হন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে হেমন্তবাবুর রবীন্দ্রসঙ্গীতও সংস্কৃতির ১%-এর কাছে কল্কে পাচ্ছে না কারণ মূলত রাগসঙ্গীতে সূক্ষ্ম অলঙ্করণগুলো তাঁর গলায় পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তিনি ভাবছেন হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব সাদামাটা চেহারা নিয়ে আসছে। বলা বাহুল্য যে, সাদামাটা কি সাদামাটা নয় সে তো ব্যক্তিসাপেক্ষের ব্যাপার। সম্ভবত প্রথম যুগে নিজের শোনা গানের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক করছেন সাদামাটা কি নয়। বিশেষত কনক দাস (বিশ্বাস), সতী দেবী, বিজয়া রায়রা তাঁর আত্মীয় এবং রবীন্দ্রনাথ মারা যাবার ঠিক পরে বছর দুয়েক শান্তিনিকেতনে কাটাবার দরুণ শান্তিনিকেতনী গান শুনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেন্সিবিলিটি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই গানই যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঠিক রূপ সে কথা কে বলবে? বিশেষত যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিলীপকুমার রায়কে বলেছেন, “... গানের ভিতর দিয়ে আমি যে জিনিসটি ফুটিয়ে তুলতে চাই সেটা আমি কারও গলায় মূর্ত হয়ে উঠতে দেখলুম না। আমার যদি গলা থাকত তা হলে হয়তো বা বোঝাতে পারতুম কী জিনিস আমার মনে আছে। আমার গান অনেকেই গায়, কিন্তু নিরাশ হই শুনে। একটিমাত্র মেয়েকে যে আমার গানের মূল সুরটিকে ধরতে পেরেছিল - সে হচ্ছে ঝুনু, সাহানা।" [সঙ্গীতচিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] এর থেকে এ কথা সিদ্ধান্ত করা যায় তাবড় তাবড় শান্তিনিকেতনী বড়কর্তা ও কর্ত্রীরাও - সে শৈলজারঞ্জন মজুমদারই হোন কি শান্তিদেব ঘোষই হোন কি ইন্দিরা দেবীই হোন - সঠিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ঊঠতে পারেননি। অথচ তাঁরাই বিশ্বভারতী সঙ্গীত বোর্ডের মাধ্যমে ঠিক করতেন কোন গান সঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোনটা নয়।

    হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, তিনিও স্বরলিপি যথাযথ অনুসরণ করতেন না। 'তিনিও' বললাম এই কারণে যে দেবব্রত বিশ্বাসের গান সম্বন্ধে এই অভিযোগের কথা সবাই জানেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে বলা ও বহুল প্রচারিত কথাগুলো আরেকবার উদ্ধৃত করি - "... একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে গান শিখিয়ো - এইটেই আমার গানের বিশেষত্ব। তার উপরে তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চেপ্টা হয়ে যাবে। আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি (প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশকে উদ্দেশ করে - স.ব.) কোরো।" [সঙ্গীতচিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সত্যজিৎ লিখছেন, "দরদ, তান, রস, মীড় - এগুলোর কোনওটাই প্রধানত স্বরলিপির জিনিস নয়। সত্যি বলতে কী, স্বরলিপিতে অধিকাংশ গানেরই যে চেহারাটা পাওয়া যায়, সেটাকে চ্যাপটা বললে বোধ হয় খুব ভুল হবে না। সেটাকে হুবহু অনুসরণ করে যদি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যায়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ যে গুণবোধের কথা বলেছিলেন তার কোনওটাই গানে পাওয়া যাবে না।" [নির্বাচিত এক্ষণ প্রবন্ধ সংকলন - ১] রবীন্দ্রনাথের কথার সত্যজিৎ-কৃত ইন্টারপ্রিটেশন যদি মেনে নিই - না মেনে নেবার কোন যুক্তিগত কারণ নেই - তাহলে স্বরলিপির হুবহু অনুসরণ না হলেই যে গেল-গেল রব, তা মূলত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচিন্তার পরিপন্থী।

    প্রথমে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কী বলছেন, সেটাও দেখে নেওয়া যাক। "ক্লাসিকাল না শেখার আপসোস যেমন কিছুদিন ছিল, পরে দেখা গেল, শান্তিনিকেতনী স্টাইলে পড়িনি বলে আপসোস একেবারেই নেই। সেদিক দিয়ে বলব আমার ভালই হয়েছে। ... আমার নিজের ঢংটা যে কাউকে শিখিয়ে যেতে পারলাম না তার জন্যেও আমার কোন আপসোস নেই। তার কারণ আমার মনে হয় এটা কাউকে শেখানো যায় না। কেউ নিজে যদি উপলব্ধি করে তবে গান শুনেই বুঝতে পারবে। আলাদা করে শেখানোর কিছু নেই। এই উপলব্ধির পথ হচ্ছে সাহিত্যচর্চা করা, পড়াশোনা করা আর রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার সময় মনটাকে সেইভাবে ব্যবহার করা। তার আগে মনটাকে সেইভাবে তৈরি করাও উচিত। অর্থাৎ শুধু গান গাইলেই হবে না, জগতে যা কিছু ভাল ঘটছে সেসবের সঙ্গেও পরিচয় হওয়া দরকার। তবেই না মনটা গড়ে উঠতে পারবে। আমি এটাকেই তালিম বলতে চাইছি।" [আমার গানের স্বরলিপি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়] আমি, প্রবন্ধকার হিসেবে, এই উপলব্ধিটাকেও বাঙালি সেন্সিবিলিটি বলছি। প্রায় এরকম কথাই শুনছি সুচিত্রা মিত্রর কাছে। "রবীন্দ্রনাথের গান করি, যাই করি, যেকোন গান করি, আমি যে রবীন্দ্রনাথের গান করি - "রবীন্দ্রনাথ" - সম্পূর্ণ মানুষটাকে না জানলে কি তাঁর গানটাকে নিতে পারবো? তার কি ইন্টারপ্রিটেশন ঠিক হবে? আমার কি পারফর্মেন্স ঠিক হবে? হবে না। কারণ তাঁর আদর্শ যদি আমি না জানি, তাঁর কি চিন্তাধারা ছিল, কোন্‌ ইমোশান থেকে, কোন্‌ ইন্‌স্পিরেশান থেকে এই গান লিখেছিলেন, কোন্‌ গানটা কিভাবে লিখেছেন, কেন লিখেছেন, কি চাইতেন তিনি - তাঁর ক্রিয়েটিভ দিক থেকে, তাঁর সাহিত্য, তাঁর কাব্য, তাঁর পেন্টিং, তাঁর বিভিন্ন রকমের যে ক্রিয়েটিভ কাজ, সেগুলোর সংগে যুক্ত ওটা। ... মডুলেশন চাই - তুমি ফ্ল্যাট করে গান করলে হবে না - মডুলেশন মানে ওভার-অ্যাকটিং না।" [পরবাস - ‘এক বিকেলের আড্ডা’] দুজনেই বলছেন একটা মানসিক প্রস্তুতির ব্যাপার। নিজেকে সঙ্গীতের বাইরে অন্য জিনিসে পরিচয় করিয়ে মনকে তৈরি করা। এটাই সাবেক বাঙালি সেন্সিবিলিটি।

    হেমন্ত এর পরে স্বরলিপির প্রয়োগের আলোচনায় বলেছেন, "ভবিষ্যতেও যদি কেউ নিজের মত করে গড়ে উঠতে পারে আমার বা জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাস - স.ব.) মতন তবে সে তা নিজের থেকেই করতে পারবে। এটা কাউকে শেখানোর জিনিস নয়। আমি বা জর্জদা দু'জনেই তো প্রায় স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গান করেছি। সেটা আমরা মেনে নিয়েছিলাম। ... আমি অবিশ্যি রবীন্দ্রসঙ্গীতেও যা করেছি সেটা জেনেবুঝেই করেছি। একটা বিশ্বাস ছিল যে, আমি যেটা করছি সেটা ঠিক। ভাবনা চিন্তাও করতে হয়েছে অনেক যখন রেকর্ড করেছি। ওরা অনেক রেকর্ড বাতিল করল, তখন ওদের সঙ্গে ঝগড়া করিনি। এই স্বরলিপি দেখে গান করা যে কী কষ্টকর, গানের প্রতি কোন সুবিচার হচ্ছে না, অথচ রেকর্ড করতে হচ্ছে। ... স্বরলিপি নিরেটভাবে ফলো করলে শিল্পীর নিজস্ব কোন অবদান থাকে না। ওটা একধরনের স্বরলিপি চর্চা হয়ে যায়। নিষ্প্রাণ স্বরলিপি চর্চা দিয়ে কোন গানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। স্বরলিপি হচ্ছে একদম আনকোরা শিল্পীকে পথে বেঁধে রাখার জন্য। কিন্তু একজন খুব বড় শিল্পী যদি সামান্য একটু স্বাধীনতা নেন তাতে গানের মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।" এই মত থেকেই, আমার মনে হয়, হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা উচিত। ষাটের দশক অব্দি, হেমন্তর গলায় যখনও বয়েসে ক্লান্তি আসেনি, অল্প যন্ত্রানুষঙ্গে হেমন্ত যে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করে গেছেন, স্বর ধরে ধরে স্বরলিপির সঙ্গে না মেলালে, সেসব বহু গানই বাঙালির অগণিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্তূপে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সুরের প্রয়োগ আর অভিব্যক্তির নির্ভুলত্বে।

    প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডে যে গেয়েছিলেন 'কেন পান্থ, এ চঞ্চলতা', তখনও উচ্চারণ ও স্বরপ্রক্ষেপণে পঙ্কজ মল্লিকের ছায়া স্পষ্ট। অথচ দ্বিতীয় রেকর্ডের 'হে নিরুপমা' বা 'প্রাঙ্গণে মোর'-এ সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের তৃতীয় রেকর্ডের ‘আমার গোধূলি লগন' গানে আবার পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব ফিরে আসছে। রেকর্ডের অন্য গান 'তোমায় গান শোনাব'-তেও সেই প্রভাব রয়েছে। এর পরেও চলবে পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব - এই আছে, এই নেই। ১৯৪৮-এ 'পাগলা হাওয়ার' অনেকটাই প্রভাব মুক্ত কিন্তু 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা'-য় পঙ্কজ মল্লিককে এড়াতে পারলেন না। অথচ পঙ্কজ মল্লিক যে গান শুনিয়ে গান্ধীজিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন - 'অয়ি ভুবনমনমোহিনী' - সে গানই যখন হেমন্ত গাইলেন, পঙ্কজ মল্লিক বললেন, "... আমি হেমন্তর মত গাইতে পারিনি, অন্তত 'মা' ডাকটা'। [দেবাশিস দাশগুপ্ত, হেমন্তর কী মন্তর - সুভাষ মুখোপাধ্যায়] এই গান শুনলে আর একটা জিনিস নজর পড়ে। সেটা হল হেমন্তর লয় নির্বাচন। হেমন্ত পঙ্কজ মল্লিকের তুলনায় দ্রুতলয়ে গাওয়ায় ষোল মাত্রার 'মা' ডাক অনেক সাবলীলভাবে ফুটে ওঠে হেমন্তর গানে। 'অরূপ তোমার বাণী', 'মনে রবে কিনা রবে' বা 'চলে যায় মরি হায়' - বিশেষত শেষের গানে - লয়ের প্রয়োগে ঠিক যেভাবে গানের আনন্দ বের করে আনছেন, ঠিক তার বিপ্রতীপে 'আজি শরত তপনে' বা 'আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল'-র বিধুরতা ধরছেন শুধু সুর, উচ্চারণ, স্বরপ্রক্ষেপণে নয় - লয়ের ব্যবহারেও।

    হোয়্যাটস্যাপ নামক বৃহৎ সত্যিমিথ্যের বেসাতির বাজারে বছর দুয়েক আগে সুবিনয় রায়ের পুত্র সুরঞ্জন রায়ের নামে এই উক্তিটা পেয়েছিলাম। সুবিনয় রায় নাকি বলেছিলেন (এখনও এর সত্যতা বা অসত্যতা কোনটাই প্রমাণিত নয়), "হেমন্ত যেভাবে সুর লাগায় সেটা বাংলা গানের পক্ষে আদর্শ। সা রে গা মা দু’রকমভাবে লাগানো যায় গলা দিয়ে, একটা sophisticated, অন্যটা unsophisticated। হেমন্ত unsophisticated ভাবে সুর লাগায়। এর তুলনা নেই। ওর গান নির্বাচন অতুলনীয়। কোনটা ও justice করতে পারবে ওটা ঠিক বুঝতে পারে। তার বাইরে বেরোয় না। এই গুণ খুব কম শিল্পীর থাকে। তোরা ভাবিস হেমন্ত-র ক্লাসিক্যালের উপর দখল নেই - সেটা একদম ভুল। আমি তো বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে মিশছি, আমি জানি। নিজে গলা দিয়ে ওই চর্চাটা করেনি, কিন্তু ভেতরে ক্লাসিক্যাল সেন্স প্রখর। ওর মত উচ্চারণ বাংলা গানে খুব কম শোনা যায়। 'প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়', 'কেন পান্থ এ চঞ্চলতা' ভালো করে শুনিস, দেখবি মনে হবে ঝর্ণা বইছে।" হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতের এর থেকে নির্ভুল বিশ্লেষণ আর হয় না।

    হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলোর কথা এই আলোচনায় এসেছে, সেগুলো শুনতে -

  • আধুনিকে হেমন্ত | হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত | সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত | বাংলা গান আর সুমনের গান - ১ | বাংলা গান আর সুমনের গান - ২ | গুগাবাবার গান
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments