পড়ার টেবিলে বসে বসেই উপলা পা নাচাতে নাচাতে হাসছিল। হাসির কারণ ঋদ্ধিমানদার ফোন। তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত পড়ার মাঝে থেকে থেকেই মনটা ছট্ফট্ করে উঠছিল। ক’দিন ধরে তাদের সকলের উপর দিয়ে যে কী যাচ্ছে! কিছু ভাল লাগছিল না। এমন সময় ফোন বেজে উঠল; অচেনা নম্বর। ফোন তুলে অনিশ্চিত গলায় বলল, “হ্যালো?”
“এই, তোমাকে তো বলেছিলাম বাড়ি ফিরে একবার জানাতে, তারপর ভুলেই গেলে?”
উপলা থতমত খেয়ে বলল, “অ্যাঁ — মানে — তুমি কে?”
“ব্রেক্-আপ বয়। মানে ঋদ্ধিমান।”
“ওঃহো! ঋদ্ধিমানদা,” উপলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, “আসলে সেদিন আর ফোন করা হয়নি। মেজাজটা এমন বিগড়ে ছিল ...”
“কেন, রাকাকে তো সময়মতো রেস্কিউ করতে পেরেছিলে! তাহলে আবার মেজাজ খারাপ কেন?”
উপলা বিষন্নভাবে বলল, “শুধু সেদিনের ঘটনাটা নয়। গত ক’দিন ধরে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যা যা হচ্ছে তুমি ভাবতেও পারবে না। রনের সঙ্গে তো বটেই, তারপর তিলোত্তমা, সে আমার আরেকজন বন্ধু–”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওই একই দিনে ওকে আর আমার দাদাকে ডাকাতে ধরেছিল।”
“কীঃ!” উপলা চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়।
“হ্যাঁ। ওদেরও বলিহারি বাবা! প্রেম করার এত জায়গা থাকতে শেষ পর্যন্ত ভবানীপুর কবরখানা? শাস্ত্রে লিখেছে গোরস্থানে সাবধান —”
“এই! এই! দেখেছো তো?” উপলা উত্তেজিত হয়ে বলল, “এই কথাটাই আমি বলতে যাচ্ছিলাম। প্রথমে তিল্লীর বদমাশ এক্স বয়ফ্রেণ্ড ওকে যা নয় তাই বলে অপমান করল। তারপরে আমার ব্রেক আপ্, তারপরে রন্ ওই মালখোরের বাড়ি গেল, তারপর এখন আবার শুনছি —”
“এক মিনিট, এক মিনিট!” ঋদ্ধিমান অবাক হয়ে বলল, “তোমার ব্রেক-আপ মানে? সেদিন যার সঙ্গে ওখানে গিয়েছিলে সে তোমার বয়ফ্রেণ্ড নয়?”
উপলা বেজায় অবাক হয়ে বলল, “মাথা খারাপ নাকি! অত বুড়ো একটা লোক আমার বয়ফ্রেণ্ড কোথা থেকে হবে?”
“না, মানে,” ঋদ্ধিমান একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “ওকে তো দা-ভাইয়ের বয়সীই মনে হল, আর তিলোত্তমা তো দা-ভাইয়ের সঙ্গেই —”
“তিল্লীর কথা বাদ দাও। ও তো জন্মবুড়ি।”
“কিন্তু ওই ছেলেটা তাহলে কে ছিল? পূজনের কোনো বন্ধু?”
“না ...” উপলা একটু থেমে বলে, “ও আমার এক বন্ধুর দাদা। পূজনকে চেনে, তবে বন্ধু নয়।”
“আই সী। তা, ব্রেক-আপ্টা কেন হল? সেও কি তোমাকে চীট্ করেছিল?”
“না না, একদমই না। আমরা শুধু ... উই জাস্ট গ্রিউ অ্যাপার্ট আই গেস।”
“সরি,” ঋদ্ধিমান সহানুভূতির স্বরে বলল, “তবু তো তুমি ঠকোনি। রোম্যান্টিক রিলেশান থাক আর নাই থাক, ভবিষ্যতে তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা তো বলতে পারবে অন্ততঃ।”
উপলা চোখ বুজে বলল, “হুঁ।”
“না না, সিরিয়াসলি। এই, আমার অবস্থাটা ভাবো। অলরেডী তো জ্বলে মরছিলাম। তার উপর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে আমার এক্স গার্লফ্রেণ্ড তার বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে।”
“এঃ হে। রিয়লি সরি।”
“ইট্স ওকে। যা হয়েছে ভালই হয়েছে। …”
আস্তে আস্তে কথাবার্তার মোড় ঘুরে গেল আলাপ পরিচয়ে, তারপর খোশগল্পে। মনটা ভাল হয়ে যাচ্ছিল উপলার। ঋদ্ধিমান্দা কত বই পড়ে! উপলার বইয়ের নেশার কথা শুনে বলল নিজের আর দাদার সংগ্রহ থেকে মাঝে মাঝে দু-একটা ধার দেবে। শরণ্যার রঙ্গীতদা যে কেমন মানুষ, উপলা স্পষ্টভাবে জানে না। দু-একটা ছবি, আর কয়েক মিনিট গলার আওয়াজ শুনে কতটুকুই বা আর বোঝা যায়! কিন্তু রঙ্গীতদার এই বন্ধুটিকে বেশ ভাল লাগছিল তার। তার মধ্যে খুব রহস্যময় চুম্বকশক্তি নেই হয়তো, কিন্তু ছেলেটার কথা শুনে বেশ সোজাসাপটা, হাসিখুশি মনে হচ্ছিল। এমন লোকের সঙ্গে বন্ধত্ব হতে বেশি সময় লাগে না। ফোনটা রেখে দিয়েও থেকে থেকে সেদিনের সেই বাসের দৃশ্যটা মনে পড়ছিল। কি সরলভাবে বাচ্চাটার সঙ্গে খেলছিল ঋদ্ধিমানদা! অত মনখারাপের মধ্যেও।
হঠাৎ নীচে কলিংবেলের শব্দ এল। উপলা টেবিলে রাখা টাইম-পীসটাইয় দেখল, পৌনে আটটা। জেঠু-কাকুরা তো সবাই অফিস থেকে ফিরে এসেছে এতক্ষণে; বাবা-মা তারও আগে। তাহলে বাইরের কেউ হবে নিশ্চয়ই। তদন্ত করতে উঁকি মেরে দেখল, একটা রোগাভোগা চশমা পরা লোক তাদের ফ্লোরেই এসে দাঁড়াল।
উপলা দুদ্দাড় করে নীচে নেমে এসে একটু অবাক হয়ে গেল। নীচ থেকে দেখে যতটা মনে হয়েছিল, লোকটা ততটাও বয়স্ক নয়। মাথার সামনেটায় অকালে টাক পড়ে যাবার ফলেই চেহারার এই হাল। তাছাড়া, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, সারা গায়ে যেন সাদা পাউডার মেখেছে, এতটাই ফ্যাকাশে রঙ! “এটাই কি নন্দিতা ম্যাডামের ফ্লোর?” আগন্তুক উপলাকে দেখে জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ। আমি ওঁর মেয়ে।”
“ওঃ! আচ্ছা আচ্ছা! ওঁর সাথে একবার ...”
“হ্যাঁ, আসুন না।”
মা সামনের ঘরে বসেই বই পড়ছিল। ওরা ঢুকতে অবাক হয়ে বলে উঠল, “আরে, শিলাদিত্য!”
লোকটা বিনীতভাবে হাসল, “বিরক্ত করলাম না তো?”
“না না, কী যে বলো! বোসো বোসো — তোমার আসাম ট্রিপ কেমন গেল?”
উপলা চমকে উঠল। এই কটা দিনের মধ্যে কাকতালীয় ঘটনার সংখ্যা তো বাড়তে বাড়তে আকাশের চালে গিয়ে ঠেকেছে। তার সঙ্গে আরও একটা যোগ হবে নাকি এখন? মা তার অভিব্যক্তি খেয়াল করেছিল বোধহয়। কি বুঝল কে জানে, বলল, “শিলাদিত্য আমাদের ব্যাঙ্কে কাজ করে — মানে করত আর কি। রেজিগ্নেশান লেটার জমা দিয়ে দিয়েছ?”
“এই মাসের শেষেই দেব। তার যেটুকু নোটিস পিরিয়ড ...”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। এর পর তো ফ্যামিলি বিজনেসে জয়েন করছ?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম।”
“খুব ভাল, দাসত্ব করার থেকে অনেক বেটার! আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? ওর নাম উপলা। সামনেই প্রি-বোর্ড পরীক্ষা, যদিও তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়।”
শিলাদিত্য হেসে জিজ্ঞেস করল, “কোন স্কুল তোমার?”
স্কুলের নাম শুনেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “সায়েন্স পড়ো?”
“না, হিউম্যানিটিস।”
“ওঃ ...” একটু ইতস্ততঃ করে অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “মৃণালিনীকে চেনো? মৃণালিনী সরকার?”
যা সন্দেহ করেছিল, তাই। উপলা বাইরে বেশি উত্তেজনা না দেখিয়ে শুধু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লিনীকে কতটা চেনে, তা এর এক্ষুণি না জানলেও চলবে। মা ভুরু তুলে উপলার দিকে তাকালেও আর কথা বাড়াল না। এসব ব্যাপারে ভদ্রমহিলার অসম্ভব প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।
শিল্দা বলল, “আসলে আমি ওর পাড়ায় থাকি।”
“ও,” উপলা সাবধানী গলায় বলে, “তাহলে তুমি নীরাকেও চিনবে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ! চিনি তো! তোমার কথা ওদের বলব।”
“নিশ্চয়ই।”
শিলাদিত্য এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুতভাবে হাসল। মা বলল, “বলো, কি খবর তোমার। চা করতে বলি? বা কফি, যেটা ইচ্ছে — এই পলা, যা না একটু —”
“না না, কিছু করতে বলবেন না প্লিজ,” শিলাদিত্য বাধা দিয়ে বলে, “একেই রাত হয়ে গেছে, আর অনেকক্ষণ হল বেরিয়েছি। খবরটা দিয়েই উঠে পড়ব।”
মা কৌতুহলী হয়ে বলল, “কি খবর?”
শিলাদিত্য লাজুক হেসে ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙের কার্ড বার করে মায়ের হাতে দিয়ে বলল, “সকলে মিলে আসবেন কিন্তু, সারকে নিয়ে, উপলাকে নিয়ে ...”
মা কার্ডটা দেখেই হইহই করে উঠল, “আরে, কেয়াবাত! বিয়েও করে ফেলছ এর মধ্যে! কন্গ্র্যাচুলেশান্স! পাত্রী কি করে?”
“এম্. এ করছে, পরের বছর ফাইনাল ইয়ারে উঠবে।”
“ও, তাহলে তো বেশ ছোট। অবশ্য তোমারই বা কি এমন বয়স ... পাশ করবার পরে কিছু করার ইচ্ছে আছে? নাকি ফুলটাইম সংসার?”
“না না, একদমই নয়। ওর ফীল্ডে প্রচুর কাজের সুযোগ আছে। তাছাড়া ও ভাল স্টুডেন্ট, চাকরি পেতে অসুবিধে হবে না ...”
উপলা হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল ওদের সামনে। তার মাথার মধ্যে সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এটা কি হল? মৃণালিনী তো সেদিন রেস্তোরাঁয় বসে তাদের বলেছিল যে শিল্দা ওকে একরকম জানিয়েই দিয়েছে, শুধু আসাম থেকে ফিরে আসবার অপেক্ষা! মৃণালিনী কি এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও জানে এখনো? আর কেউই কি জানে!
মা ইতিমধ্যে কার্ডটা টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিল। উপল আলগোছে সেটা তুলে নিয়ে, যেন চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করবার জন্যেই পুরোটা একবার পড়ে দেখল। মা আর শিল্দা তখনও নিবিষ্টমনে কথা বলে যাচ্ছে। আর দেরি না করে উর্দ্ধঃশ্বাসে উপরে ছুট লাগাল উপলা। ফোনটা তুলে মৃণালিনীর নম্বর ডায়াল করতে গিয়েই থমকে গেল অবশ্য। ফোন করে বলবেটা কি? লিনী যদি এখনো অবধি ব্যাপারটা না জেনেই থাকে, তাহলে কি আদৌ সে তার কথা বিশ্বাস করবে? আর যদি জেনে গিয়ে তাহলে ... উপলা মাথা নাড়ল। এখন ওকে ফোন করাটাই বোকামি। অনেক দোনামোনা করে শেষমেশ শরণ্যাকেই জানাবে ঠিক করল।
“হ্যালো রন্?”
“হুঁ, বল্।”
“সর্বনাশ হয়েছে।”
“আবার কি হল?” শরণ্যা উৎকণ্ঠিতভাবে জানতে চায়।
“শিল্দা ... শিল্দা ইজ গেটিং ম্যারেড্। অন্য কাকে একটা বিয়ে করে নিচ্ছে।”
আশ্চর্য, রন্ খবরটা শুনে আঁতকেও উঠল না, চেঁচামেচিও করল না। বেশ খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর ওপার থেকে আওয়াজ এল, “আমি জানতাম।”
উপলা স্তম্ভিত হয়ে বলে, “হোয়াট! হাউ?”
“আগে তুই বল্ কি করে জানলি?”
উপলা যত সংক্ষেপে সম্ভব ঘটনাটা শুনিয়ে দিল।
শরণ্যা বলল, “কাকে বিয়ে করছে জানিস?”
“না, নামটা খেয়াল করিনি।”
“কনে হল ঋদ্ধিমানদার এক্স গার্লফ্রেণ্ড।”
উপলা খাবি খেয়ে বলল, “মা – নে?”
“মানে ... ওই পূজনের ইন্সিডেন্টটা যেদিন ঘটল? সেদিন তো ঋদ্ধিমানদা আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গেল। তিলোত্তমাও ছিল সেদিন, ধৃতিদাদার সঙ্গে বোধহয় বেড়াতে গিয়েছিল, তারপর সেখানেও এক বিশাল কেস হয়েছে —”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঋদ্ধিমানদা বলল, আজই ফোন করেছিল।”
“আচ্ছা আচ্ছা। তো সে যাই হোক, সেইদিনই ঋদ্ধিমানদা বলল, ওর এক্স গার্লফ্রেণ্ড নাকি ওকে নিজের বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে; আমাকে কার্ডটা দেখতেও দিল। তখনই দেখলাম।”
“কি করে বুঝলি, এই সে?”
“নাম দেখে বুঝিনি। পৃথিবীতে তো আর একটাই শিলাদিত্য গাঙ্গুলী নেই। কিন্তু দু-পক্ষেরই ঠিকানাটা দেওয়া ছিল। দেখলাম, পুরো লিনীদের বাড়ির ঠিকানা, শুধু বাড়ির নম্বরটা আলাদা। তাও আমি কিছু বলিনি, ভুলও তো হতে পারে। তুই মিলিয়ে নিতে পারিস এখন।”
“কিভাবে মেলাব?”
“হাতের কাছে কার্ডটা আছে?”
“হুঁ।”
“দ্য ব্রাইড্স নেম ইজ ঈশা তরফদার?”
উপলা গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ।”
“আর বিয়ের ডেট্টা দেখ, টোয়েন্টি সেকেণ্ড জানুয়ারী।”
কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলে না। বলার আছেই বা কী! অবশেষে উপলা স্বগতোক্তির মতো বলে, “একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না। লিনী তো একেবারে শিওর ছিল যে শিল্দা ওকে লাইক করে। ও এতটা ভুল বুঝল কি করে?”
“ভুল বুঝেছে, এমনটাই বা ভাবছিস কেন?”
“মানে! তুই কি বলতে চাইছিস যে ...”
“এক্জ্যাক্টলি। শিল্দা নিশ্চয়ই বিয়েটা আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। আর লিনীর সঙ্গে বিয়ের আগে কটা দিন ঘুরে ফিরে নিল।”
“উঃ, কি সাংঘাতিক লোক রে!”
“সে আর বলতে।”
খানিকক্ষণ পর শরণ্যা বলল, “একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করছিস, রন্?”
“কিসের মধ্যে?”
“আমরা প্রত্যেকে একটার পর একটা বিপদের মধ্যে পড়েই চলেছি। তিল্লীকে দিয়ে শুরু হল, তারপর তুই, তারপর আমি। মাঝখানে চার-পাঁচ দিন নির্বিবাদে কাটল বলে ভেবেছিলাম যে চোটটা বোধহয় আমাদের তিনজনের উপর দিয়েই গেল শুধু। এমনকী, এটাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে বিয়ের কার্ডের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আমারই কোনো ভুল। কিন্তু দেখ্, লিনীর কপালেও শেষমেশ এই জুটল।”
“ঠিক বলেছিস,” উপলা চিন্তিতভাবে বলে, “আমার তো নীরার জন্যেও ভয়-ভয় করছে এখন। ওর খবর জানিস কিছু?”
“ও তো পরীক্ষার দু হপ্তা আগের থেকে ফোন-টোনের ধারপাশ দিয়েও যায় না।”
“হুঁ ... কোনো গোলমাল হলে নিশ্চয়ই ফোন করত। নো নিউজ ইজ গুড্ নিউজ।”
“রাইট।”
“লিনীকে কি বলবি?”
“আমাদের কিছু বলা ঠিক হবে না। পরীক্ষা মিটে যাওয়া অবধি না জানতে পারে তাহলে সব দিক রক্ষা হয়, যদিও তার চান্স খুব কম।”
“... জীবনটা কিরকম হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে না রে?”
“হাতের মধ্যে কবেই বা ছিল?”
মন চঞ্চল হয়ে থাকলে মৃণালিনী ইলেক্টিভ ইংলিশের পড়া নিয়ে বসে। পড়ার বিষয়বস্তু পছন্দের হলে মনঃসংযোগ করতে সুবিধে হয়। আজ কিন্তু এতে কোনো কাজই হচ্ছিল না। একটা লাইনও মাথায় ঢোকাতে পারছিল না সে। মুহুর্মুহু চা বানিয়ে খাচ্ছিল, ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল, একবার কম্বলটা মুড়ি দিয়ে বসছিল, আবার পরক্ষণেই সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল। ব্যাপার দেখে মা এসে তাজ্জব গলায় বললেন, “উচ্চিংড়ের মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? হয়েছেটা কি?”
মৃণালিনী বিরক্তমুখে পায়চারি করতেই থাকে, উত্তর দেয় না। খানিক বাদে মা হয়রান হয়ে চলে যাবার পর কম্পিউটার খুলে বসল। শিল্দা আসাম থেকে ফিরেছে, তিন দিন হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত একবার দেখা করা তো দূরে থাক, ফোন-মেসেজ কিছুই করেনি। ইতিমধ্যে বার-পঞ্চাশেক ফেসবুক্ চেক করা হয়ে গেছে তার। কই, বেড়াতে যাওয়ার আধখানা ছবিও তো দেয়নি কোথাও। কী এমন রাজকার্যটা করছে যে টিকির দেখা অবধি পাচ্ছে না?
শুধুমাত্র আর একবার ফেসবুক দেখবার জন্যেই কম্পিউটার খুলেছিল মৃণালিনী। তবু অভ্যাসবশতঃ সাথে সাথে ই-মেলটাও খুলল। এবং খুলেই চমকে উঠল। কি কাণ্ড! শিল্দা তাকে আস্ত একখানা চিঠি লিখে পাঠিয়েছে? তারিখটা আজকেরই, সকালের দিকে পাঠানো। হঠাৎ করে ই-মেল পাঠাতে গেল কেন? তবে কি ... এই কি সেই স্বীকারোক্তি, যার জন্যে এতদিন সে অপেক্ষা করে ছিল! মৃণালিনী ধেয়ে উত্তেজনা আর বুক-ধুক্পুক্ নিয়ে চিঠিটা খুলে পড়ল:
ফুল্কি,মৃণালিনী বজ্রাহতের মতো বসে রইল। তার চোখের সামনে ভাসছে একরাশ মানেহীন কালো কালো অক্ষর।
কাল সকালে আমাকে তোমার বাড়ি যেতেই হবে। তাই আজকেই এই চিঠিটা পাঠালাম। আশা করি তুমি পড়বে। তোমার পড়াটা খুব দরকার।মনে আছে, যাবার আগের দিন তোমাকে বলে গিয়েছিলাম, ফিরে আসবার পরে আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাবে? সেটা সম্ভাবনার কথা ছিল না। অদূর ভবিষ্যতে যা ঘটতে চলেছে, তাই জানিয়েছিলাম সেদিন। বলেছিলাম, পুরোনো চাকরিটা ছেড়ে দেব। তাই দিয়েছি। ভেবে দেখলাম, ওই দশটা-পাঁচটার চাকরি আমার জন্য নয়। ব্যবসায় অনেক ব্যস্ততা, অনেক দায়-দায়িত্ব আছে ঠিকই। তবুও, এটা তো আমার নিজের, আমার পরিবারের তৈরি করা জায়গা। তাছাড়া, জীবনে দায়িত্ব এড়িয়ে কতদিনই বা বাঁচা যায়? একটা সময়ে তাতেও ক্লান্তি আসে।
আরও একটা কথা বলেছিলাম তোমাকে — পুরোনো এক বন্ধুকে নতুনভাবে পাওয়ার কথা। সেটাও সত্যি। তুমি আমাকে এতদিন খুব একা দেখেছ, ফুল্কি। কিন্তু জানো, চিরদিন আমি এরকম একা ছিলাম না। তখন আমার সত্যিই খুব কাছের বন্ধু ছিল ক’জন; বিশেষ করে একজন, যে আমাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবধি ছেড়ে যায়নি। আমি তার প্রতি অবিচার করে কিছুদিনের জন্য তাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। আসলে নিজের জীবনটা আমি কিভাবে বাঁচব, সেটা ঠিক করতেই বহুদিন সময় লেগে গেল আমার! সেই সময় আমার দিক থেকে সব বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছিল।
সে কিন্তু আমাকে ভোলেনি। এতদিন পরেও তাকে যখন ডাকলাম, দ্বিতীয়বার পিছন ফিরে না তাকিয়ে সে আমার কাছে চলে এসেছে। আমি ওর বন্ধুত্বের যোগ্য নই; তবু যোগ্য হয়ে উঠবার জন্য সারা জীবনটা আছে। ঈশাকে বিয়ে করে আমি সেই চেষ্টাই করব এখন থেকে। সফল হব কিনা জানিনা।
তুমি না বললেও, আমি জানি, তুমি আমাকে খুব ভালবাস। সব থেকে বড় কথা, তুমি আমার ভাল চাও। কিন্তু আমার কাছ থেকে হয়তো আরও কিছু পাওনা ছিল তোমার। আমি জানতাম তা দেবার সামর্থ্য আমার নেই। তবু, আমি চেয়েছিলাম এই ঘাটতিটা আমার বন্ধুত্ব এবং সাহচর্য দিয়ে যথাযম্ভব পুরিয়ে দিতে। আমার হাতে সময় বেশি ছিল না, সে কথা ঠিক। কিন্তু এই অল্পদিনেই আমি বুঝতে পেরেছি যে তোমার মতো বন্ধু পাওয়া আমার ভাগ্যে লেখা নেই। আমি যে তোমাকে আমার ক’দিনের সময়টুকু ছাড়া আর কিছু দিতে পারলাম না, তা আমার অক্ষমতা। কিন্তু তোমার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।
তুমি মন খারাপ না করে এগিয়ে যেও। আমার থেকে অনেক, অনেক ভাল বন্ধু তুমি একদিন পাবে, এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। কাল যখন আমি নিমন্ত্রণের চিঠি নিয়ে যাব, তখন একটাই অনুরোধ, তুমি খুশি হয়ো। আমাকে পিছনে ফেলে তুমি অনেক দূরে এগিয়ে যাবে, তা জানি। তুমি যে স্ফুলিঙ্গ; যেখানেই থাকবে, উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ভাল থেকো, ফুল্কি। পারলে আমাকে মনে রেখো।
শিলাদিত্য
বাবা-মা যেতে আপত্তি করছিলেন। যতই হোক না অফিসের বছর-শেষের পার্টি, নীরাকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে একা রেখে বেরোতে মোটেই রাজি হচ্ছিলেন না। নীরাকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে একা বেরোতে রাজি হচ্ছিলেন না কিছুতেই। নীরা একরকম জোর করেই ওঁদের পাঠাল।
“এত চিন্তা করছ কেন? এমন কিছু জ্বর নেই আর।”
মা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “তাও ...”
“কাল থেকে সমানে ওষুধ খেয়েই চলেছি। কিছু হবে না এখন। তাও যদি দেখি শরীর খারাপ লাগছে, তাহলে লিনীদের বাড়িতে ফোন করব এখন।”
বাবা বললেন, “আমাদের ফিরতে রাত হবে কিন্তু। এগারোটা — সাড়ে এগারোটা।”
“কোনো অসুবিধে নেই। চাবি নিয়ে বেরচ্ছ তো।”
রেডি হয়ে বেরোনোর আগেও মা বললেন, “রিকুর মাকে একটা খবর দিয়ে যাব?”
“আঃ, মা, সবাইকে শুধু শুধু ব্যস্ত করার দরকারটা কি? বলেছি তো, তেমন মনে হলে লিনীকে ডেকে নেব।”
কিন্তু ওঁরা বেরোবার কিছুক্ষণ পরেই আবার জ্বর এল নীরার। কান্না না থামলে জ্বরও কমবে না। তবু, মা-বাবা বেরিয়ে যাওয়াতে শান্তিতে কাঁদতে তো পারছিল! কিন্তু এভাবে চললে পরীক্ষাগুলোও ঠিক করে দিতে পারবে না বোধহয়। কিন্তু কোথাওই তার জ্বালার কোনো উপশম নেই।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। চমকে উঠে বসল নীরা। কে এল? লিনী তো সচরাচর এ সময়ে না ডাকলে তাদের বাড়ি আসে না! তবে কি অত্রি? সেইদিনের ঘটনার পর অত্রি আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। নীরার কথামতোই একা ছেড়ে দিয়েছে ওকে। অসুস্থতার কথাও কেউ জানে না। মা কি যাওয়ার সময় সত্যিই ওদের বাড়ি খবর দিয়ে গেছেন? মাথাটা ভারি হয়ে গেছে, একটু একটু হাঁপও ধরছে, তা সত্ত্বেও কষ্ট করে গিয়ে দরজাটা খুলল সে। অবাক হয়ে বলল, “রুদ্র!”
রুদ্র অপ্রস্তুতভাবে হাসল, “তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল, তাই ... একি! কি হয়েছে তোমার?”
নীরা ক্লান্তভাবে হাসল, “জ্বর। ভিতরে এসো।”
দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল হঠাৎ। রুদ্র তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেলে বলল, “তুমি দরজা খুলতে এলে কেন? বাড়িতে কেউ নেই?”
“না। বাবা-মা একটু বাইরে গেছে। তখনও ভালই ছিলাম ...”
“চলো, তোমার ঘরে চলো।”
বিছানায় বসে শারীরিক অস্বস্তিটা একটু কমলেও, মনে যন্ত্রণার কোনো হেরফের হল না। রুদ্র খাটেরই অন্য ধারে বসে পড়েছিল। সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, “অত্রির সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?”
“নাঃ।”
“কেন?”
“আমি ... আমি এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে পারছি না। সামনে এতগুলো পরীক্ষা ... আমার জাস্ট কিছু ভাল লাগছে না।”
“কোনো কথাই কি হয়নি তোমাদের?”
“না।”
“অত্রি — অত্রি একবার ফোন করেনি? দেখতে আসেনি?”
ঠেলে আসা কান্নাটা অতি কষ্টে চেপে নীরা বলল, “আমিই বারণ করেছিলাম পরীক্ষার ক’দিন যোগাযোগ না রাখতে। ও জানেনা আমার অসুখ।”
তারপরে কতক্ষণ যে নিস্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল, নীরার খেয়াল থাকেনা। জ্বরটা বোধহয় বাড়ছিল। চোখের দৃষ্টি ঝাপ্সা হয়ে আসছিল, মাথা ঝিম্ঝিম্ করছিল। হঠাৎই সে টের পেল, তার কাঁধের উপর রুদ্রর হাত। সে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
“রুদ্র ... দিস ইজ হেল্ ... আমি আর জাস্ট পারছি না!”
রুদ্র কখন যেন তার কাছে সরে এসেছিল। সে প্রথমে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল হয়তো, কিন্তু নীরা টের পেল, তার হাতদুটো আস্তে আস্তে পুরোপুরি ঘিরে নিল তাকে। কি ঠাণ্ডা রুদ্রর শরীরটা! কান্না আর মাথার ভিতরে একটানা ঝিম্ঝিমে শব্দের মধ্যে শুনতে পেল, যেন অনেক দূর থেকে রুদ্রর গলার স্বর ভেসে আসছে, “সব ঠিক হয়ে যাবে নীরা ... আই অ্যাম হিয়ার নাও ...”
নীরার মনে হয়, রুদ্র যেন তার দেহের মধ্যে জ্বলতে থাকা অসহ্য আগুনটা ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে। অনেক দিন ধরে মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তারপর একটা টলটলে ঠাণ্ডা সরোবরের মধ্যে নামলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই একটা আরাম আর অবসাদ তাকে আচ্ছন্ন করে তুলছিল। তার চোখের সামনে সব কিছু ঘষা কাঁচের মতো অস্পষ্ট মনে হয়। সব রঙ, সব রেখা, একটার সঙ্গে একটা গুলিয়ে, মিশে, একাকার হয়ে যেতে লাগল যেন!
ক্লাসরুমের চৌহদ্দীর মধ্যেও ঢোকা যাচ্ছিল না। করিডোরে যে কী ভিড়! অন্যদিনও ভিড় থাকে না তা নয়, কিন্তু আজকের অবস্থাটা আলাদা। পরীক্ষা শুরু হবার আগে ব্যাগপত্র বইখাতা বাইরে রেখে তার পরেই ঘরে ঢোকার নিয়ম। বলা বাহুল্য, কারুরই ভিতরে ঢোকার তেমন কোনো তাগিদ নেই। দেওয়ালে হেলান দিয়ে, অথবা মেঝেতে পুরোপুরি বসে সবাই যে যার পরীক্ষার বিষয়ের বই বার করে পড়ছিল, নয়তো মুখস্থ পড়া বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছিল। হাজার হাজার মৌমাছি উড়বার মতো চাপা একটা গুন্গুন্। এর মধ্যেই মৃণালিনীকে আসতে দেখে শরণ্যা তাড়াতাড়ি হাত তুলে ডাকল। মৃণালিনী কোনো কথা না বলে ইকোনমিক্স-এর বই বার করে পাতা ওল্টাতে লাগল। তিলোত্তমা, উপলা আর শরণ্যা পরস্পর তাকাতাকি করল। মৃণালিনীর চুল উস্কো-খুস্কো, চোখমুখের অবস্থা শোচনীয়। খানিক পর তিলোত্তমা আলতোভাবে ডাকল, “লিনী?”
মৃণালিনী একেবারে হাল-ছেড়ে-দেওয়া ভঙ্গিতে তাকাল। এত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল ওকে! চোখের তলায় কালি, এক ধাক্কায় যেন বয়স বেড়ে গেছে অনেকটা। তিলোত্তমা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। অনেকক্ষণ ধরে মৃণালিনী শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তারপর বলে উঠল, “পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, বুঝলি?”
তার গলার স্বরে নিশ্চিন্ত হল সবাই। মেয়েটা বড় ধাক্কা খেয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু আগের মতোই তেজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। বলতে কি, শিল্দার প্রেমে পড়বার আগে যেমন ছিল, আজ এতদিন পরে ঠিক সেই জায়গাতেই যেন ফিরে এসেছে আবার; হঠাৎই কঠিন ধাক্কায় ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে কেউ। তিলোত্তমা এবারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাক, তুই ঠিক আছিস তো?”
“ঠিক!” তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে মৃণালিনী দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজল, “শেষ কবে রাতে ঘুমোতে পেরেছি মনে নেই। পড়াশোনা করা তো দূরে থাক, ক’দিন ধরে খাওয়াদাওয়া অবধি বন্ধ হয়ে গেছে। পরীক্ষায় পাশ করব কি না কে জানে! জানিস তোরা, শিলাদিত্য গাঙ্গুলী কত বড় বাস্টার্ড্ যে —”
“ঋদ্ধিমানদার এক্স গার্লফ্রেণ্ডকে বিয়ে করছে, জানি,” উপলা বিরস মুখে বলে।
মৃণালিনী চমকে উঠল, “তোরা কি করে জানলি! আর ঋদ্ধিমানদার এক্স গার্লফ্রেণ্ড মানে?”
শরণ্যা অগত্যা গত সপ্তাহের ঘটনাটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল। মৃণালিনী সবটা শুনে অবিশ্বাসসূচক মাথা নেড়ে গেল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমার সত্যিই বলার মতো কোনো ভাষা নেই। শেষমেশ কিনা ঋদ্ধিমানদার বাইশ বছরের গার্লফ্রেণ্ড! তার মানে একজন নয়, দু-দুটো মানুষকে এরকম বিশ্রীভাবে — উফ্, কি ছোটলোক! দুটোই! একেবারে মেড্ ফর ইচ্ আদার!”
কথাগুলো বলতে বলতেই যেন ক্রমশঃ পুরোনো ফর্মে ফিরে আসছিল মৃণালিনী। তিলোত্তমা বলল, “তুই কবে জানতে পারলি?”
“ই-মেল পাঠিয়েছিল। সামনাসামনি বলার মতো সাহসটুকুও নেই! আর সেখানে কি লিখেছে জানিস? লিখেছে, ‘আমি যখন নেমন্তন্ন করতে যাব তখন আমার জন্য খু-শি হ-য়ো’!! জানোয়ার, তুই মরলে আমি খুশি হব! উঃ, হাতের কাছে যদি পেতাম না এখন! ...” রাগের চোটে মৃণালিনী হাতের বইটাকেই মোচড়াতে থাকে।
শরণ্যা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল কী?”
“আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মা-বাবার সামনে খণ্ডপ্রলয় বাধাতে কে চায় বল্? কারণ আমি যদি তখন ওখানে থাকতাম, তাহলে আমাদের মধ্যে একজন সেদিন মারা যেত। আর পল্ তো মালটার চেহারা দেখে নিয়েছে, তাই মরার চান্স কার বেশি তা ও জানে। স্বার্থপর, ঠগ, চীট —”
“ভাল, ভাল,” উপলা উৎসাহের সঙ্গে মাথা নাড়ল, “রাগটা সিস্টেম থেকে বের করে দিলে দেখবি অনেক আরাম লাগছে।”
“ড্যাম্ মাই সিস্টেম,” মৃণালিনী দেওয়ালে কিল মেরে বলল, “আমার জাস্ট ভীষণভাবে জানতে ইচ্ছে করছে, আমার মাথায় কি ঘিলুর বদলে মার্জারিন ভরা আছে? না হলে মানুষকে এতটা ভুল চিনতে পারে কেউ? আমি হয়তো হারামিটাকে বড্ড বেশি রোম্যান্টিসাইজ করে ফেলেছিলাম, হয়তো — হয়তো কেন, অবশ্যই মালটা অসাধারণ কিছুই ছিল না। কিন্তু তাই বলে তার মধ্যে সৎ-সাহস বলে একটা পদার্থ থাকবে না? আমার সাথে প্রেম নাই করতে চাইতে পারে — সেটা এসে মুখের উপর বলতে পারল না! তার বদলে দিনের পর দিন আমার সঙ্গে এমনভাবে একটা মিথ্যে নাটক করে গেল যাতে শেষমেশ নিজের গা বেঁচে যায়! দয়া দেখাচ্ছিল আমাকে? কী ভেবেছিল? ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না?!” উপলা মৃণালিনীর কাঁধে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তবু তো খাড়া আছিস। তুই ভাবিস না লিনী, আমরা সবাই তোর ক্লাবে জয়েন করে গিয়েছি। আমাদের তিনজনের সঙ্গেই এক একখানা মারাত্মক কেস হয়েছে।”
মৃণালিনী ভুরু কোঁচকাল, “কী কেস?”
“আমার আর কণিষ্কর ব্রেক-আপের ব্যাপারটা তো জানিসই —”
“হ্যাঁ, কিন্তু,” মৃণালিনী অবাক হয়ে বলে, “তুই যে বললি এটা টেম্পোরারি ব্যাপার, কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে?”
“আশা করেছিলাম তাই। কিন্তু এখন দেখছি, তা হবার নয়। কণিষ্ক এত বেশি হার্ট হয়েছে যে পুরোনো সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে এতদিনে ... যাহোক, আমার ব্যাপার তো গেল একরকম, ওদিকে রন্ এক অপ্রকৃতিস্থ মাতাল কবির খপ্পরে পড়ে বেঘোরে প্রাণটা খোয়াতে যাচ্ছিল আর কী, নেহাৎ আমি সময়মতো গিয়ে পড়েছিলাম বলে। আর ওই একই দিনে তিল্লী আর ধৃতিদাদাকে কতগুলো গুণ্ডায় ধরে কেলিয়েছে।”
মৃণালিনী খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে তারপর খাবি খেয়ে বলল, “কী সব বলছিস বে? আর আমাকে এসব কিছু জানাসনি পর্যন্ত?”
তিলোত্তমা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “একেই তো এত ঝামেলা, এর মাঝেও পরীক্ষার পড়া পড়তে হয়েছে বসে। কাউকে কিছু খবর দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল, বল্?”
“কিন্তু এত সব হলটা কিভাবে? ... আর মাতাল কবি ক্যারেক্টারটাই বা কে? রন্ কোথা থেকে তাকে —”
কথা শেষ হবার আগেই ঘন্টা পড়ে গেল। অর্থাৎ এবারে ঘরে না ঢুকে উপায় নেই। সবাই হুড়্মুড়িয়ে যে যার রুমে ঢুকে যেতে লাগল। ওরাও কথাবার্তা স্থগিত রেখে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে নিজেদের বেঞ্চের দিকে এগোল। এবং সকলেরই প্রায় একই সঙ্গে ব্যাপারটা খেয়াল হল।
শরণ্যা চাপা গলায় বলল, “কি ব্যাপার? নীরা কোথায়?”
খাতা দেওয়া হয়ে গেল, প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়ে গেল, তবু নীরা এসে পৌঁছালো না। তার খালি টেবিলটায় অনন্যা মুখার্জি ম্যাম খাতা রেখে কাগজচাপা দিয়ে রাখলেন। দু-মিনিট কাটল, দশ মিনিট কাটল; নীরার দেখা নেই। ইতিমধ্যে সবাই খাতার উপর হুম্ড়ি খেয়ে পড়ে ঝড়ের বেগে লিখতে শুরু করেছে। শরণ্যা খাতা টেনে নিয়ে লিখতে লাগল, কিন্তু একটা প্যারাগ্রাফও শেষ করে উঠতে পারল না। তার পাশেই নীরার ফাঁকা সীট্টা কিছুতেই তাকে মনোঃসংযোগ করতে দিচ্ছিলনা। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল ওইদিকে, দরজার দিকেও বটে। সে আড়চোখে চেয়ে দেখল, বাকি তিনজনের অবস্থাও তথৈবচ। তিলোত্তমা কোয়েশ্চেন পেপারটা হাতে নিয়ে পড়বার ভান করছে বটে, কিন্তু তার মন আদৌ সেদিকে নেই। উপলা দু-লাইন লিখছে, আবার দু-মিনিট আশান্বিতভাবে তাকাচ্ছে, আবার লিখছে। শুধু মৃণালিনী লেখার কোনোরকম চেষ্টাই করছে না; উৎকণ্ঠিতভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে শুধু।
দরজাটা খুলতেই পাঁচজনে চমকে উঠেছিল, কিন্তু তাদেরকে ফের হতাশ করে দিয়ে পি.এস. রোল্কলের খাতা হাতে ঢুকলেন। দেখার ভুলও হতে পারে, কিন্তু শরণ্যার মনে হল তাঁর চোখ-মুখে যেন একটা থম্থমে ভাব। ক্লাসে একটা ফাঁকা সীট দেখে তিনি অবাক হলেন না, কোনো মন্তব্যও করলেন না। একটু একটু করে ভয় দানা বাঁধছিল শরণ্যার মনে। উপলার সঙ্গে গত সপ্তাহের কথোপকথনটা মনে আসছিল। তাদের চারজনের জীবনে যা দুর্ভোগ হবার ছিল, হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যে নীরার খবর তো নেওয়া হয়নি! নীরা কারুর সাথে যোগাযোগ করেনি, আর তারাও তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোর সঙ্গে যুঝতে গিয়ে একে অপরের কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। এখন সে কথা মনে করে ভয়ানক আপসোস হচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি হচ্ছে দুর্ভাবনা। কি এমন হল নীরার, যার জন্যে প্রি-বোর্ডের পরীক্ষা দিতে আসতে এত দেরি হচ্ছে? সামান্য জ্বর বা সর্দিকাশি হলে ঠিকই সঙ্গে ওষুধ-বিষুধ নিয়ে চলে আসত। তাহলে কি আরও বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হয়েছে? নাকি আসার পথে কোনো অঘটন ঘটল?
পি.এস. সবার নাম ডাকলেন, নীরা বাদে। মনে হল যেন তার অনুপস্থিতির কারণটা আগেই ওঁর কাছে পৌঁছে গেছে। বেরোতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু দরজার মুখের কাছে কী ভেবে যেন দাঁড়িয়ে গেলেন। বেশ খানিকক্ষণ ইতস্ততঃ করে অবশেষে ডাকলেন, “শরণ্যা, তিলোত্তমা, উপলা অ্যাণ্ড মৃণালিনী?”
সবাই নিমেষের মধ্যে হাত তুলে জানান দিল। প্রত্যেকের মনেই যে একই প্রশ্ন তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। পি.এস. যেন অনেকক্ষণ একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিলেন। বেশ কয়েকবার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে কি সব ভাবলেন, যেন কথাটা কিভাবে বলা যায় বুঝতে পারছেন না। অবশেষে বললেন, “মীট্ মী আফ্টার দ্য টেস্ট্। অল ফোর অফ য়ু।”
“ম্যাম!”
পি.এস. বেরোতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিলোত্তমা আর থাকতে না পেরে পিছু ডেকেছে। কিছু না বলে তিনি জিজ্ঞাসুভাবে চাইলেন।
“ম্যাম্, নীরা আসেনি কেন?”
পি.এস্-এর মুখের চেহারা বদলে গেল। চারজনেই দেখল তিনি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছেন, যেন যে প্রশ্নের মুখে পড়তে ভয় পাচ্ছিলেন, ঠিক সেই প্রশ্নটাই করা হয়েছে তাঁকে। তিনি চারজনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “আফ্টার দ্য টেস্ট।”
যেন পালটা প্রশ্ন এড়াতেই দ্রুত বেরিয়ে গেলেন তিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইন্ভিজিলেটার মিস মুখার্জি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। মৃণালিনী নিজের সীট ছেড়ে উঠে পি.এস-এর পিছন পিছন দৌড়েছে। শরণ্যা, উপলা আর তিলোত্তমা এক মুহূর্তের জন্য পরস্পরের দিকে তাকাল; তারপর তারাও ছুটল।
বাইরে বেরিয়ে এসে তারা দেখল, মৃণালিনী পি.এস-কে থামিয়ে উত্তেজিতভাবে হাত-পা নাড়ছে, আর তিনি সমানে ওকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। বাকিদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনি হয়রান হয়ে বললেন, “ওঃহো! তোমরা সবাই মিলে উঠে এলে কেন? আমি তো বললাম, পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে দেখা করতে! যাও যাও, আগে পরীক্ষাটা —”
“ম্যাম্, প্লিজ,” উপলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বিশ্বাস করুন, আপনার মুখ দেখে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে আপনি নীরার ব্যাপারেই কিছু বলবেন, আর এটাও বুঝতে পারছি যে ব্যাপারটা সিরিয়াস। কিন্তু আপনি না বললে আমরা ঠিকঠাক পরীক্ষাটা দিতেই পারব না। এই দেখুন, কুড়ি মিনিট অলরেডি পেরিয়ে গেছে, এদিকে আমাদের চারজনের কেউই একটা উত্তরও কম্প্লিট করতে পারিনি। নীরা কখন আসবে তার জন্য বসে ছিলাম। ওর কী হয়েছে সেটা জানা থাকলে অ্যাট লীস্ট কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারব।”
পি.এস. খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “নিশ্চিন্ত হবার মতো খবর নয়।”
শরণ্যার বুকের ভিতরের ভয়টা বড় হতে হতে তার হৃৎপিণ্ডটাকেই পিষে ফেলছিল যেন। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে সে দৃঢ়ভাবে বলল, “তবু আপনি বলুন।”
পি.এস. নিঃশ্বাস ফেলে হাল ছেড়ে দেওয়ার একটা ভঙ্গি করে বললেন, “নীরার বাবা-মা ফোন করেছিলেন। একটা বড় রকমের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ... দু-ঘন্টা আগে তো শুনলাম ক্রিটিকাল। সব ডীটেল্স এখনও পাইনি, তবে আমার মনে হয় পরীক্ষার পর তোমাদের ওখানে একবার যাওয়া দরকার।”
মৃণালিনীর গলা দিয়ে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। বাকিরা সকলেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল; দুর্যোগের সবচেয়ে বড় মারটা যে এভাবে এসে পড়বে, তা ওদের কল্পনাতেও আসেনি। পি.এস. তাদের মুখ দেখে কতটা আন্দাজ করলেন কে জানে, কিন্তু হঠাৎ এক অশ্রুতপূর্ব নরম স্বরে বললেন, “এই জন্যেই আমি বলতে চাইছিলাম না। আমি জানি, নীরা তোমাদের খুব কাছের বন্ধু। এরকম একটা খবর শুনলে যে তোমাদের উপর খুবই মানসিক চাপ পড়বে এ তো জানা কথা। ক্লাসে গিয়ে যখন দেখলাম তোমরা চারজনে কেউই কিছু লিখছ না, তখনও ভাবলাম এক্জ্যামটা হয়ে যাবার পরেই জানাব। এমনিও তোমাদের ডাকতে হতই ... কিন্তু তোমরা আরেকটু ধৈর্য্য ধরতে পারলে না। যাইহোক, ভিতরে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষাটা শেষ করো, তোমাদের এক্সট্রা আধ ঘন্টা সময় দিতে বলছি —”
“অসম্ভব!”
মৃণালিনীর জোরালো আওয়াজে সকলে চমকে উঠল। সে হাতদুটো মুঠো করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। এবারে সজোরে মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব। আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে। নীরার এত বড় বিপদ হয়েছে, তা জেনেও আমি বসে বসে পরীক্ষা দেব, এটা হতেই পারেনা। ভিতরে গিয়ে পেপার স্ক্র্যাচ করে দিচ্ছি, আমাকে যেতে দিন।”
“কি সর্বনাশ!” পি.এস. আঁতকে উঠলেন, “ঠিক এই ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম! মৃণালিনী, প্লিজ কাম ডাউন। দেখো, নীরার যা হয়েছে, দ্যাট ইজ ভেরি আন্ফর্চুনেট। বাট শি ইজ গেটিং অল দ্য ট্রিট্মেন্ট শি নীড্স। তুমি গিয়ে এখন ওকে কোনোভাবেই হেল্প করতে পারবেনা। এখন যাওয়া আর তিন ঘন্টা পরে যাওয়া একই ব্যাপার। মাঝখান থেকে পরীক্ষাটা —”
“আপনি বুঝতে পারছেন না!” মৃণালিনী প্রায় চেঁচিয়ে উঠল এবার, “আপনি ভাবছেন নীরা শুধুই আমার ক্লাসমেট, আমার বন্ধু। কিন্তু এদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা জন্ম থেকে পাশাপাশি বড় হয়েছি। ওর বাড়ি আর আমার বাড়িতে কোনো তফাৎ নেই। আজ যদি আমার নিজের ভাই বা বোনের এরকম কিছু একটা হত, আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারতেন? সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে বলতেন না? শুনুন, নীরার কিছু হলে প্রি-বোর্ড কেন, আই.এস.সী পরীক্ষা ফেলে আসতেও আমি হেজিটেট করতাম না। আমি যাবই। আপনার পারমিশান নিয়ে হোক, কি না নিয়ে হোক।”
পি.এস. কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না। মুখ দেখে মনে হল আবার সেই দ্বন্দ্বটা ফিরে আসছে তাঁর ভিতর। এবারে তিলোত্তমা বলল, “শুধু মৃণালিনী কেন, আমিও পরীক্ষা দিতে পারব না। আমি হয়তো নীরাকে ওর মতো করে চিনিনা, কিন্তু যতটা চিনি এবং যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তাতে করে আমারও বসে থাকা চলে না। আই থিংক আমরা কেউই সেটা পারব না।”
শরণ্যা আর উপলা বলে উঠল, “এক্জ্যাক্টলি। আমরা সবাই যাব।”
“পল্লবীদি, আমার মনে হয় ওদের ছেড়ে দেওয়াই ভাল।”
পি.এস-এর পিছনে কখন যে এ.জি. এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তা উৎকণ্ঠার মধ্যে কেউই খেয়াল করেনি। পি.এস. ঘুরে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললেন, “অমৃতা, এর কন্সিকোয়েন্সটা তো জানো!”
এ.জি. মাথা নেড়ে বললেন, “তা আর জানব না কেন? কিন্তু আপনার কি মনে হয়, মেয়েগুলোকে জোর করে ক্লাসে পাঠিয়ে দিলে ওরা একটা কিছু লিখতে পারবে? তাছাড়া, ইস্কুলে তো ছেলেমেয়েদের শুধু নম্বর তোলানোর জন্য পড়াশোনা করানো হয়না, তাই না? আপনি তো এটা মানেন।”
পি.এস-এর গলার স্বর অনেকটা পালটে গেলেও, সংশয় পুরোপুরি কাটল না, “সবই জানি, কিন্তু এটা তো শুধু তোমার-আমার ডিসিশান নয়। প্রিন্সিপাল ছাড়াও ওদের প্যারেন্ট্রা আছেন। তাদের ব্যাপারটা কি করে হ্যাণ্ডেল করবে?”
এ.জি. এবার ওদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের দুটো কণ্ডিশানে ছাড়া যেতে পারে। এক হল, প্রিন্সিপাল আর তোমাদের প্রত্যেকের মা-বাবার পারমিশান লাগবে। দু-নম্বর, এর পর যে কটা পরীক্ষা আছে একটাও স্কিপ করা চলবে না, এবং এই সাবজেক্টের রি-টেস্ট-এ অবশ্যই বসতে হবে। তোমরা রাজি?”
সবাই নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
পি.এস. একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি প্রিন্সিপালকে ইন্ফর্ম করতে চললাম। অমৃতা, তুমি প্যারেন্ট্দের ফোন করতে পারবে?”
“হ্যাঁ।”
“বেশ। আমাকে যেতে হবে। পুলিশও এসে পড়বে বোধহয় এক্ষুণি। তুমি এদিকটা দেখো প্লিজ।”
পি.এস. চলে যাবার পর উপলা ভয়ার্ত গলায় বলল, “পুলিশ কেন?”
এ.জি. সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “তোমরা খাতা স্ক্র্যাচ করে আমার সঙ্গে অফিসে এসো আগে। পারমিশান যদি নাও পাও, নতুন খাতা নিয়ে লিখো আবার। আর সবাই যদি ছেড়ে দেন, তাহলে আর ফর্ম্যালিটি নিয়ে দেরি করতে হবে না।”
তিলোত্তমা এতক্ষণে একটু দ্বিধাভরে বলল, “ম্যাম?”
“বলো।”
“আমার বাড়িতে এখন কাউকে পাবেন না। ওঁরা দুজনেই আউট্ অফ্ স্টেশান। ফোনে কন্ট্যাক্ট করা যাবে না।”
এ.জি. ভুরু কুঁচকে বললেন, “তিলোত্তমা, সবাইকেই এক কণ্ডিশান দিয়েছি। তোমার ক্ষেত্রে তো নিয়ম বদলাতে পারি না! মা-বাবা না থাকলে, এমন কোনো আত্মীয় আছেন, বা গার্ডিয়ান, যিনি এর দায়িত্ব নিতে পারেন? কারণ বুঝতেই পারছ, স্কুল তোমাদের পরীক্ষা কামাইয়ের দায়িত্ব কখনই নেবে না।”
“গার্ডিয়ান আছেন একজন। তবে তিনি আত্মীয় নন।”
“কে তিনি? নাম কী?”
“আমার কাকুর বন্ধু। ধৃতিমান রায়চৌধুরী।”
এ.জি. তীক্ষ্ণভাবে তার দিকে চাইলেন একবার, তারপর বাকিদের দিকেও। সকলেই প্রাণপণে নিজেদের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটতে দিল না। তিনি অবশেষে বললেন, “আই হোপ আই ক্যান ট্রাস্ট য়ু তিলোত্তমা?”
তিলোত্তমা এবারে এ.জি-র চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল।
“অল্রাইট। যাও তোমরা, অনন্যা ম্যামকে গিয়ে বলো খাতাগুলো ক্যানসেল করে দিতে।”
প্রায় ঘন্টাখানেক লাগল সবকিছু মিটতে। তাদের ইস্কুলে ইতিমধ্যে আবার এক নতুন প্রিন্সিপাল এসেছেন — ঠিক ক্রিস্টমাসের ছুটির আগে। পুলিশ আসা নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলেন, যে তাদের বেরোতে দেওয়া নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা করলেন না।
একে একে সবার বাড়িতেই ফোন করা হল। মৃণালিনীর মা-বাবা তো অনেকক্ষণ আগেই হসপিটালে পৌঁছে গিয়েছেন, তাকেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতে বললেন। শরণ্যার মা-বা প্রথমটায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, কারণ আজ তো ওর পলিটিকাল সায়েন্স পরীক্ষা। কিন্তু আসল ঘটনাটা শোনবার পর ওঁরা আর আপত্তি করলেন না; ম্যামের কাছ থেকে হস্পিটালের ঠিকানাটা জেনে নিলেন। উপলার বাড়িতে বড়জেঠি ফোন ধরেছিলেন; সব শুনে দ্বিরুক্তি না করে নিজেও বড়কাকিমা-ছোটকাকিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ধৃতিমানকে ফোন করবার সময় সকলে এ.জির মুখের দিকে উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু না, সেখানেও কোনো সমস্যা হল না।
ফোন পর্ব শেষ করে এ.জি. বললেন, “যাক, ফর্ম্যালিটি মিটল। নেহাৎ আমাদের এখানে নিয়মকানুনের মা-বাপ নেই, তাই বেঁচে গেলে। অন্য কোনো নামী স্কুল হলে দেখতাম কিভাবে প্রি-বোর্ড পরীক্ষা ক্যান্সেল করে বেরিয়ে যেতে পারতে!”
উপলা বলল, “আপনি না থাকলে —”
“পল্লবীদি ঠিকই তোমাদের যেতে দিতেন,” এ.জি. অল্প হাসলেন, “উনি শুধু তোমাদের ভোগান্তির কথা ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন। অন্য কোনো পরীক্ষা হলে কোনো ব্যাপার ছিল না; প্রি-বোর্ড তো। কিন্তু ... তোমাদের যাওয়াটা দরকার। নীরাকে আমি কখনো পড়াইনি ঠিকই, কিন্তু জানতাম ও খুব ভাল মেয়ে, কারুর সাতেপাঁচে থাকত না, পড়াশোনায় যেমনই হোকনা কেন, সিন্সিয়ার ছিল। আর, কি সুন্দর ছবি আঁকত! সে কি করে এরকমটা ... যাইহোক, আমি গাড়ি বার করছি। তোমরা এসো।”
মৃণালিনী একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি পৌঁছে দেবেন?”
“সেটাই সুবিধেজনক। অনেকটা দূর তো।”
তিনি নীচে নেমে যাওয়ার পরেও ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধাতস্থ হবার বৃথা চেষ্টা করল। সবার মনেই জমাট বাঁধা ভয় আর উদ্বেগ। নীরার যে একটা বড় রকমের বিপদ ঘটেছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু, ঠিক কী যে হয়েছে, আর অবস্থাটা যে ঠিক কতটা মারাত্মক, তার কোনোটাই পরিষ্কার নয়। শরণ্যার কেবলই মনে হতে লাগল, এ.জি. তাদেরককে এখনও কিছু একটা বলছেন না। তাতে ওদের অস্বস্তিটা আরও বেড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ উপলা বলে উঠল, “এই, তিল্লী? তোর কেসটা কি রে? এ.জি-কে ঢপ দিলি কেন?”
তিলোত্তমা আস্তে আস্তে বলল, “মা-বাবা আমাকে জীবনেও পারমিশান দিত না। ধৃতিমানের নাম বললাম কারণ ওর উপস্থিত বুদ্ধি আছে, সিচুয়েশানটা সামলে নিতে পারবে। যাই হোক, চল এখন।”
গাড়িতে যেতে যেতে এ.জি. হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “নীরার সঙ্গে তোমাদের শেষ কবে দেখা বা কথা হয়েছিল?”
উপলা বলল, “দেড় দু-সপ্তাহ আগে। তারপর তো পরীক্ষা চলে এল, তখন নীরা খুব একটা ফোন-টোন করতে চায় না।”
মৃণালিনী বলল, “আমার সঙ্গে গত সপ্তাহে একবার দেখা হয়েছিল। ওর শরীরটা ভাল ছিল না, তাই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। বেশি কথা হয়নি অবশ্য, বারবার ঘুমিয়ে পড়ছিল।”
“তখন কি কোনোরকম মনোমালিন্য বা কথা-কাটাকাটি হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?”
“না, একেবারেই না!”
শরণ্যা আর না পেরে বলল, “ম্যাম্, নীরার অ্যাক্সিডেন্টটা কী? কি হয়েছে ওর?”
“আমরা বেশি দূরে নেই। পৌঁছেই জানতে পারবে।”
বাকি রাস্তাটা আর কথা হয় না। শুধু উপলা আড়চোখে চেয়ে দেখল, তিলোত্তমা ব্যাগ থেকে সন্তর্পণে মোবাইল ফোন বের করে কাকে যেন মেসেজ পাঠাচ্ছে। একটু পরেই বিশালাকৃতি সাদা রঙের হস্পিটাল বিল্ডিংটা চোখে পড়ল ওদের।
বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না। গেটের কাছেই মৃণালিনীর বাবা দাঁড়িয়েছিলেন। ওদের দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন। এ.জি. গাড়ির ভিতর থেকে বললেন, “আমি আর নামব না। স্কুলে পরীক্ষা চলছে তো, ফিরতেই হবে। কী সিচুয়েশান?”
“মোটামুটি স্টেব্ল, তবে জ্ঞান হয়নি এখনও।”
“আই সী। আমি মাঝে মাঝে ফোন করে আপ্ডেট্স নেব। ওরা রইল।”
“অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম।”
“না না, প্লিজ। আমি আসি তাহলে, নমস্কার।”
গাড়িটা চলে যেতে বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যাক, তোরা চারজনেই এসেছিস।”
“বাবা,” মৃণালিনীর গলা শুনে মনে হল তার ধৈর্য্যের বাঁধ এবারে ভেঙে যাবে, “নীরার কি হয়েছে স্পষ্ট করে বলবে? স্কুল যাওয়ার পথে গাড়ি-টাড়িতে কিছু ...?”
বাবা একটু অবাকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “সেকি, তোদের স্কুলের মিস্ বলেননি?”
“বলেননি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি!”
বাবা একটু সময় নিয়ে বললেন, “নীরু বিষ খেয়েছে।”
মাথায় বাজ পড়লেও বোধহয় কেউ এতটা হতবুদ্ধি হয়ে যেত না। মৃণালিনী রাস্তার উপরেই বসে পড়তে যাচ্ছিল, বাবা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে বললেন, “এই ফুল্কি, ফুল্কি! পাগল হলি নাকি? তোর বন্ধুর এই অবস্থা, তুই এখন বসে পড়লে চলবে?”
বাকিদের বিবর্ণ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “নিজেদের শক্ত রাখো। সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে যেতে পারত বটে, কিন্তু বিপদ প্রায় কেটে গেছে। নীরার বাবা-মায়ের কথাটা ভাবো একবার। ওঁদের সামনে গিয়ে তোমরা যদি কান্নাকাটি করো, সেটা কি ঠিক হবে?”
সবাই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িতে আসবার সময় তারা প্রত্যেকেই নানারকম মারাত্মক সম্ভাবনার কথা আশঙ্কা করেছিল। কিন্তু এরকম একটা ঘটনা যে নীরার মতো মেয়ে ঘটাতে পারে, সে কথা কারুর ভাল করে হৃদয়ঙ্গমই হচ্ছিল না, শক্ত হওয়া তো দূরে থাক। নিজের অজান্তেই পা দুটো থর্থর্ করে কাঁপছিল শরণ্যার। উপলার মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল; তিলোত্তমার হাত আঁকড়ে ধরেছিল সে। অবশেষে তিলোত্তমাই অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করল, “কেন ... কি করে এরকম ...”
“কেন সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আজ সকালে ফুল্কি বেরোনোর কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম নীরুও যাচ্ছে। আমি তো তার পরেই কলেজ বেরিয়ে গিয়েছি। তার ঘন্টাখানেক পরে ফুল্কির মা আমাকে ফোন করে জানাল যে ওকে নাকি পাশের একটা ঘুপ্চি মতো গলিতে আমাদেরই এক প্রতিবেশী অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পেয়েছেন। বিষাক্ত পেস্টিসাইড খেয়েছিল; বোতলটা পাশেই পাওয়া গেছে। ডাক্তার তো বললেন অন্ততঃ কুড়ি মিনিট পড়েছিল ওইভাবে ... ওই অন্ধগলির মধ্যে দুটো বাড়ির পাঁচিলের ফাঁকের জায়গাটুকুতে ... আর কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে নাকি বাঁচানোই যেত না। এখানে নিয়ে আসবার পর তো সোজা ভেন্টিলেশানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ... পাল্স পাচ্ছিল না নাকি।”
এক নিঃশ্বাসে অনেকটা বলে গিয়ে হঠাৎ থমকে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকালেন তিনি।
“তবে একটা ব্যাপার ... রিসেন্ট্লি কি তোদের কারুর সঙ্গে ওর কোনো সমস্যা হয়েছিল? কোনো ঝগড়াঝাঁটি, বা ... ?”
সেই একই প্রশ্ন বারবার কেন উঠে আসছে, কে জানে! সবাই কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। বাবা ইতস্ততঃ করে বললেন, “আসলে ... ওই নোটে লেখা ছিল ‘আই হ্যাভ বিট্রেয়েড মাই ফ্রেণ্ড্স’। এই কথাটার কি মানে হতে পারে আমরা বুঝতে পারছি না। তোরা কিছু জানিস?”
সবাই একইভাবে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বাবা মৃণালিনীর দিকে তাকাতে সেও মাথা নেড়ে স্খলিত স্বরে বলল, “আমাদের সঙ্গে তো সেভাবে কথাই হয়নি গত দু-সপ্তাহের মধ্যে। আমি যেদিন ওর অসুখের সময়ে গিয়েছিলাম, কই, সেদিন তো কিছুই টের পাইনি! স্বাভাবিকভাবেই তো কথা বলল! আর আমরা ছাড়া আর কারুর কথা তো —”
বলতে বলতেই থমকে গেল মৃণালিনী, যেন হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে গেছে।
“আচ্ছা, রিকুকে খবর দেওয়া হয়েছে?”
“আরে, সে তো তার মায়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছে। ছেলেটার অবস্থা চোখে দেখা যাচ্ছে না। এসে অবধি তো হাউহাউ করে কেঁদে যাচ্ছে, এদিকে পুলিশে কি কম হ্যারাস করেছে ওকে? দেখেছে একটা অল্পবয়সী ছেলে, ব্যাস্, আর যায় কোথায়! নীরুর বাবা-মা অবধি বলতে গেল যে ও বেচারার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারেনা, তা পুলিশ ধমকে থামিয়ে দিয়ে বললে, ‘চুপ করুন মশাই, আপনারা জানেননা এই কলেজে-পড়া ছোঁড়াগুলো কি সাংঘাতিক ধড়িবাজ হয়,’ এইসব। দাঁড়িয়ে দেখতেও তো খারাপ লাগে। আবার য়ুনিফর্ম পরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে বলে ইস্কুলেও এন্কোয়্যারি করতে গেছে। যাহোক, কণ্ডিশান ইম্প্রুভ করাতে রিকুকে অ্যাট্ লীস্ট আপাততঃ রেহাই দিয়েছে। জ্ঞান হলে নীরুর ফুল স্টেট্মেন্ট নেবে, তারপর ছাড়বে। এতগুলো লোকের কী ভোগান্তি!” আক্ষেপের সঙ্গে মাথা নাড়লেন বাবা।
ওয়েটিং লাউঞ্জের দৃশ্যটা সত্যিই শোচনীয়। কেঁদে কেঁদে ইরাকাকিমার চোখমুখ ফুলে চেহারাটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। কাকুর হাসিখুশি মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মৃণালিনীর মা অনেকক্ষণ ধরেই কাকিমাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছিল কতটা গভীর ধাক্কা খেয়েছেন। উলটোদিকের সীটে দু’হাতের তালুর মধ্যে মাথা রেখে অত্রি বসেছিল। ওদের পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকাতে দেখা গেল ওর চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল, সারা মখে কান্নার জলের দাগ শুকিয়ে আছে। মৃণালিনীর বাবা অন্যদিকে যাবার আগে নিঃশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বললেন, “বী স্ট্রং প্লিজ।”
মৃণালিনী হা-ক্লান্ত ভঙ্গিতে অত্রির পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল, বাকিরা তার পরেরগুলোতে। অত্রি ঘোলাটে দৃষ্টিতে মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলল, “ফুল্কি বিশ্বাস কর্, আমি সত্যি জানি না কেন এরকম হল। সবাই ভাবছে আমিই এর জন্য রেস্পন্সিব্ল, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই কিছু জানি না ...”
মৃণালিনী চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ, তারপর আলগোছে অত্রির কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেউ কিছু ভাবছে না, রিকু। নো-বডি ইজ রেস্পন্সিব্ল। আই বিলীভ য়ু।”
এক-একটা মিনিট কাটছিল এক-একটা যুগের মতো। সবাই এতক্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে উপলার বড়জেঠি, বড়কাকি এবং ছোটকাকি এসে পৌঁছালেন। ওঁদের দেখে উপলা এগিয়ে গেল। বড় জেঠি তার দিকে মাথা নেড়ে কাকুদের দিকে এগিয়ে গেলেন। বড়কাকি চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে পলা?”
উপলা মুখের উপর একবার হাত চালিয়ে ভাবনাগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করল যেন, তারপর বলল, “সুইসাইড্ অ্যাটেম্প্ট।”
দুজনেই আঁতকে উঠে বললেন, “কি বলছিস কী!”
ছোটকাকিমা উপলার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই ঠিক আছিস তো?”
উপলা জবাব দিল না। বড়কাকিমা ফোন বার করে বোধহয় মাকে মেসেজ করতে লাগলেন। ছোটকাকিমা আবার বললেন, “নীরা তো খুব সুইট্, হাসিখুশি মেয়ে। কি এমন হল?”
“জানি না ... জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছু বলা যাবে না।”
ধৃতিমান আর ঋদ্ধিমানও এল। তিলোত্তমাকে দেখতে পেয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। তিলোত্তমা উঠতে যাচ্ছিল, ধৃতিমান হাতের ইশারায় বারণ করল। ঋদ্ধিমান অত্রিকে খানিকক্ষণ নজর করে শরণ্যার দিকে জিজ্ঞাসুভাবে চাইল। শরণ্যা ঘাড় নাড়তে সে আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। শরণ্যা শুনতে পাচ্ছিল তিলোত্তমা ফিস্ফিস করে ধৃতিমানকে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছে। ধৃতিমান সবটা শুনে কোনো মন্তব্য করল না, শুধু তাদের দিকে আশ্বাসপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। খানিকক্ষণ পর ঋদ্ধিমান ফিরে এল, হাতে একটা ট্রে-তে অনেকগুলো কফির কাপ। প্রথমেই সে অত্রির হাতে কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
অত্রি খানিকটা বিহ্বলভাবে আপত্তি করবার চেষ্টা করল, “... না, আমার এখন ...”
“এটাই দরকার,” ঋদ্ধিমান দৃঢ়ভাবে বলল, “ওটা খাও, নাহলে একটু পরে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বে।” ধৃতিমানও উঠে গিয়ে সবাইকে কফি দিয়ে এল। বড়রা একটু অবাক হলেও, ওদের কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। খানিকক্ষণ পরে এক ভদ্রলোককে তাদের দিকেই এগিয়ে আসতে দেখা গেল। চুল প্রায় সবই সাদা, কপালে গভীর কতগুলো রেখা; যেন বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু চোখদুটো খুব সজাগ, সজীব। একটু অনিশ্চিতভাবে তাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন তিনি। ওঁকে খেয়াল করে শরণ্যা চমকে উঠল।
“অরিন্দমকাকু!”
ভদ্রলোকও শরণ্যাকে খেয়াল করে তাজ্জব হয়ে এগিয়ে এলেন, “একি, রাকা, তুমি এখানে?”
তারপর অদূরে দাঁড়ানো ঋদ্ধিমান আর ধৃতিমানকে দেখে আরও চমকে উঠলেন, “চুর্মুর্, ধৃতি — কি ব্যাপার কি! তোরা সবাই এখানে কেন?”
তিলোত্তমা উঠে দাঁড়াল এবার। অরিন্দমকাকু বললেন, “এই তো, তুমিই নিশ্চয়ই তিলোত্তমা। আমি অরিন্দম সিন্হারয়। এরা ... এরা কি সবাই তোমার ...”
“শরণ্যা আমার ব্যাচমেট,” তিলোত্তমাও বিস্মিতভাবে বলে, “আর ওরা দুজন আমার বন্ধু। আপনি এদের চেনেন!”
অরিন্দমকাকু কিছু বলবার আগেই শরণ্যা নীচু গলায় বলে, “কাকু হচ্ছেন রঙ্গীতদার বাবা।”
“ওঃ!” তিলোত্তমা খুব অবাক হলেও, তা প্রকাশ করে না। ঋদ্ধিমান ততক্ষণে তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করল, “কাকু, তুমি আবার এখানে কেন?”
“তিলোত্তমা মেসেজ করেছিল, ওর বন্ধুর নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ওর সঙ্গে তো বড় কেউ নেই, তাই ভাবলাম আমিই একবার দেখে আসি।”
তিলোত্তমা বলল, “আপনি চলে আসবেন আমি ভাবিনি। থ্যাঙ্ক য়ু সো মাচ্। আমাদের যে কি যাচ্ছে ...”
অরিন্দমকাকু সহানুভূতির গলায় বললেন, “সে তো তোমার মেসেজ পেয়েই বুঝলাম। সত্যি, পরীক্ষার দিনে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ... কেমন আছে এখন মেয়েটি?”
“জানিনা, কাকু। জ্ঞান ফেরেনি এখনও। কোনো আপডেট আসেনি।”
“কতটা ইঞ্জিউরি হয়েছে?”
শরণ্যা আর তিলোত্তমা মুখ-তাকাতাকি করল। ততক্ষণে ধৃতিমানও এসে দাঁড়িয়েছিল, বলল, “আমি বলছি কাকু, এসো।”
বলতে না বলতেই শরণ্যা দেখল মম্-ড্যাড ঢুকছে। ওদের দেখে অরিন্দমকাকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধৃতিমানকে সঙ্গে নিয়েই তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।
উপলা এতক্ষণ বড়জেঠিদের সঙ্গে ছিল, এবারে ফিরে এসে আগের জায়গাতেই বসে পড়ল। তিলোত্তমা নিজের মনেই বলল, “আর কতক্ষণ!”
ঋদ্ধিমান উপলার কাছে গিয়ে বলল, “ওঁদের মধ্যে তোমার মা কোনজন?”
“কেউই না। আমার বড়জেঠি, বড়কাকি, আর ছোটকাকি। বাবা-মা দুজনেই অফিস গেছে, এখন আসতে পারবে না। তবে ফোনে কথা হয়েছে।”
ঋদ্ধিমান ওর পাশের চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “আজকের ঘটনাটা যেন কোনোদিন কারুর সাথে না ঘটে। কিন্তু ... য়ু মাস্ট নো দ্যাট আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর জেস্চার।”
উপলা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
“মানে, তোমরা পরীক্ষা ফেলে দিয়ে বন্ধুকে দেখতে চলে এলে। নিজেরা পরে অসুবিধেয় পড়বে সে কথা ভাবলে না। তোমাদের কাছে সম্পর্কের দাম আছে; আর এখানে এসে তো দেখছি তোমাদের সকলের বাড়ির লোকেদেরও আছে। আই অ্যাপ্রিশিয়েট্ দ্যাট্।”
“কি বলছ কী তুমি? মেয়েটা মরে যাচ্ছিল আজকে! বন্ধুর এরকম ক্রিটিকাল কণ্ডিশান, সেটা শুনেও আসব না? তাও আবার অন্য কেউ নয়, নীরা! এটুকু যে করে না সে তো —”
“সবাই করে না,” ঋদ্ধিমান অবিচলিতভাবে বলে। উপলা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। পাশে তাকিয়ে দেখে, মৃণালিনী আর অত্রি পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে। কি অসহায় দেখাচ্ছিল ওদের! যেন গহন বনে হারিয়ে যাওয়া হ্যান্সেল আর গ্রেটেল।
প্রায় দু-ঘণ্টা পরে নার্স এসে বললেন, “নীরা চক্রবর্তীর বাড়ির লোক?”
মৃণালিনী আর অত্রি ধড়্মড়িয়ে উঠে বসল। বড়রা কেউ কেউ উঠে দাঁড়ালেন। সবার মুখেই উৎকণ্ঠা। “পেশেন্টের জ্ঞান হয়েছে, মা-বাবা এসে দেখে যেতে পারেন।”
কাকু-কাকিমা প্রায় ছুটতে ছুটতে নার্সের সঙ্গে গেলেন। অরিন্দমকাকুরা বোধহয় বাইরে গিয়েছিলেন, ড্যাড্ খানিকক্ষণ পর ভিতরে এসে শরণ্যাকে জিজ্ঞেস করে, “নিউজ?”
“জ্ঞান ফিরেছে। ওর প্যারেন্ট্স দেখতে গেছেন।”
“থ্যাঙ্ক গড্।”
খানিক পরে ড্যাড্ বলল, “অরিন্দমকে এখানে দেখব ভাবিনি।”
“আমিও না। উনি তিলোত্তমাকে কোনোভাবে চেনেন, বাট্ আই ডোন্ট নো হাউ।”
“যাক গে। নীরা যে চোখ খুলেছে এটাই বড় কথা। মৃণালিনীর বাবা তো বলেছিলেন মারাত্মক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল এখানে। আই.সি.য়ু-তে নিতে হয়েছে।”
“হ্যাঁ ... দ্য ডক্টর অ্যাপারেন্টলী সেড্ দ্যাট্ শি হ্যাড্ বিন পয়েজন্ড ফর ওভার টোয়েন্টি মিনিট্স।”
“ওয়েল্। থ্যাঙ্ক গড্ ফর দ্য ক্যুইক সার্ভিস।”
“হ্যাঁ।”
ড্যাড্ আরও খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর পকেট থেকে শরণ্যার মোবাইল ফোনটা বার করে ওর হাতে দিয়ে বলল, “আমরা একটু পরে বাড়ি যাব। একটা খবর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুই কি করবি?”
“আমি আরেকটু থাকব। সন্ধ্যে অবধি।”
“ওকে। ফোনটা দিয়ে গেলাম। অরিন্দমও রইল কিছুক্ষণ। তুই একবার তোর মমের সঙ্গে দেখা করে নে।”
একটু থেমে ড্যাড্ বিষন্নভাবে মাথা নাড়ল, “দিস্ ইজ আ মেস, তাই না?”
“ইট্ ইজ।”
কেউই কথাটা উচ্চারণ না করলেও, শরণ্যা বুঝতে পারল, এখন ড্যাড্-এর সানাকে মনে পড়ছে।
বেশ খানিকক্ষণ পর কাকু-কাকিমাকে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। কাকিমা আবার কান্না শুরু করেছিলেন; কিন্তু তা স্বস্তির। উপলা অবশ্য ডাক্তারবাবুকেই দেখছিল। তিনি বড়দের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বারবার তাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেন কিছু একটা ঠাওর করার চেষ্টা করছেন। নীরা কি তাহলে কিছু বলেছে? বাকিরাও উৎসুকভাবে তাকিয়ে ছিল ডাক্তারবাবুর দিকে। মৃণালিনী আর অত্রি তো উৎকণ্ঠার চোটে দাঁড়িয়েই পড়েছিল। খানিকক্ষণ পর তিনি নিজেই এগিয়ে এলেন ওদের দিকে।
“তোমরা নীরার বন্ধু?”
সবাই মাথা নাড়ল। অত্রি আর থাকতে না পেরে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করল, “ডক্টর ...”
“না না, বিপদ কেটে গেছে,” ডাক্তারবাবু অভয় দিলেন, “পয়জনের সাইড্ এফেক্ট্স কিছু হলেও তা মাইনর। ইমিডিয়েট ডেঞ্জার কিছু নেই। যখন আনা হয়েছিল তখন তো ... অনেকক্ষণ পড়েছিল অজ্ঞান অবস্থায়, তার উপর আবার যে পেস্টিসাইডটা খেয়েছিল সেটা মারাত্মক বিষ। ভাগ্য ভাল যে একসঙ্গে অনেকটা খেয়ে ফেলতে পারেনি। যাই হোক। রাখে হরি মারে কে।”
সবাই এতক্ষণে যেন সমবেতভাবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যে মনের অবস্থা কেমন ছিল তা বলে বোঝানো অসম্ভব। বিশেষ করে বাকি তিনজন তো মৃণালিনী আর অত্রির মুখের দিকে তাকাতেই পারছিল না ভাল করে। ডাক্তারবাবু এবারে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের মধ্যে তিলোত্তমা কে?”
তিলোত্তমা অবাক হয়ে বলল, “আমি।”
ডাক্তারবাবু খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললেন, “নীরা বারবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল। ওর মা-বাবাকে তেমন কিছুই বলল না। এখনও বেশ উইক্, আর তুমি এসেছ জেনে আরও ছট্ফট্ করছিল।”
তিলোত্তমা উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে রইল শুধু, কিছু বলতে পারল না। বাকিদের মুখে প্রচ্ছন্ন বিস্ময়; ধৃতিমানকে চিন্তিত দেখাল।
ডাক্তারবাবু বললেন, “দেখো, পেশেন্্ কে যে একদম উত্তেজিত হতে দেওয়া চলবে না সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। এটা যেহেতু সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট, সেইজন্য প্রবলেমটা অন্যরকম। তবে ওর সঙ্গে আমি নিজে যেটুকু যা কথা বললাম তাতে আমার ওকে সুইসাইডাল বলে মনে হল না। কিছু একটা ব্যাপার ওকে অল্প সময়ের মধ্যে একেবারে ডেস্পারেট করে দিয়েছিল। যে কারণেই হোক, ও ঘটনাটা তোমাকেই বলতে চাইছে। আর পেশেন্টের মন হালকা হওয়াটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।”
তিলোত্তমা বলল, “আমাকে কি করতে হবে?”
“এক্ষুণি আমি তোমাকে যেতে অ্যালাও করছি না। সেডেটিভ দেওয়া আছে, খানিকক্ষণ রেস্ট নিক। ঘুম ভাঙার পর সব নর্মাল দেখলে তোমাকে ডাকা হবে, তবে দশ মিনিটের বেশি কথা বলা যাবে না। তুমি কি ততক্ষণ ওয়েট করতে পারবে?”
“পারব।”
ডাক্তারবাবু চলে যেতে মৃণালিনী এসে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বুঝতে পারলি?”
তিলোত্তমা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “নো আইডিয়া।”
হঠাৎ লাউঞ্জের দরজা আরেকবার খুলে গেল। হন্তদন্তভাবে ভিতরে ঢুকল শিলাদিত্য। মৃণালিনীর চোখ ওর উপর পড়তেই মুহূর্তের জন্য কাঠ হয়ে গেল সে। শিলাদিত্য খেয়াল করেছিল ওকে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তাড়াতাড়ি কাকু-কাকিমার সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। উপলা আড়চোখে মৃণালিনীর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “য়ু ওকে?”
“ফাইন।”
শরণ্যা জিজ্ঞেস করল, “কে রে ওটা?”
উপলা নীচু গলায় বলল, “শিল্দা।”
ঘরটা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে আসছিল। শরণ্যার মম্-ড্যাড চলে গিয়েছিলেন, বড়জেঠিরাও ইতি-উতি করছিলেন এতক্ষণে। উপলা বলল, “তোমরা চলে যাও না। সেই কখন লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে — রান্না-টান্না ফেলে এসেছ।”
“বাড়িতে তোর মেজজেঠি আছে। তুই বাড়ি ফিরবি কখন?”
“দেখি, তিলোত্তমার সঙ্গে নীরার কি কথা হয়, সে সব শুনে ফিরব।”
“তাহলে তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তোকে নিয়ে আসার জন্য চিন্টু বা সঞ্জুকে পাঠিয়ে দেব?”
ঋদ্ধিমান পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলে উঠল, “আমি আছি তো বড়জেঠি। পৌঁছে দেব।”
“তুমি যেন কে, বাবা?”
“আমি এদের বন্ধু। আমার নাম ঋদ্ধিমান।”
বড়জেঠি উপলার দিকে তাকাতে সে শুধু মাথা নাড়ল। জেঠি আপত্তি করলেন না, বললেন, “সব হয়ে গেলে একটা ফোন করে দিস।”
(ক্রমশ)