হর্টিকাল্চারাল গার্ডেন-এর গেটের সামনেই দাঁড়িয়েছিল ধৃতিমান। তিলোত্তমা দেখতে পেয়েই অটোওয়ালাকে বলল, “কাকু, দাঁড়ান, দাঁড়ান —”
অটোটা অবশ্য কিছুটা দূরে গিয়েই থামল। তিলোত্তমা দেখল, ধৃতিমানের সাজগোজের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, শুধু আজ পায়জামার বদলে জিন্স, আর কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাকপ্যাক। নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু পড়াশোনা করছিল। কেন যে ওকে শুধু শুধু ফোন করে ডাকতে গেল! কিন্তু তিলোত্তমা আর পারছিল না। নিজের ঘরের চারটে দেওয়ালের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন।
রাহুলের সঙ্গে ওই ঘটনার পরে তিলোত্তমা আর ধৃতিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ধৃতিমানও এর মধ্যে তাদের বাড়ি আসেনি। কিন্তু গত সপ্তাহের পুরোটা জুড়ে তার উপর নানারকমভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করবার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তাতে সমস্ত দত্ত পরিবারটাই একরকম জড়িত। আগের দিন বোধহয় তাকে শায়েস্তা করবার জন্যেই জেঠুর বাড়িতে মিটিং ডাকা হয়েছিল। বাবা-মা তো তিলোত্তমার সেইদিনের দেওয়া ইঙ্গিতে বিচলিত হয়েছেই, কিন্তু জেঠু আর পিসিমণিরা সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাবার ভয়ে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। নাহলে জনে জনে হঠাৎ তাকে ফোন করা শুরু করে!
ইস্কুলে রোমিলা-উদিতাদের সঙ্গে ঝামেলা হবার দিনেই বাবারা বাড়ি ফিরল। এদিকে সেইদিন সন্ধ্যেবেলাতেই জেঠুমণির ফোন।
“কি রে মিঙ্কু, তুই যে এলি না বড়?”
তিলোত্তমা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। এই পারিবারিক নাটকগুলো সব সময়ই বাহুল্য মনে হয় তার। তবু কথা না বাড়ানোর জন্য বলল, “পাঁচ তারিখ থেকে পরীক্ষা জানো তো জেঠুমণি।”
“সে তো এখনোও দেরি আছে! ইচ্ছে করলেই আসতে পারতি। তোর জেঠিমা আর দাদারাও জিজ্ঞেস করছিল।”
“আমার যেতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু বাবা-মাই বারণ করল।”
“ওমা, তাই নাকি! কই আমাকে তো ... আচ্ছা তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? ... ”
এইভাবে আধ ঘন্টা খোশগল্প করে ফোন রেখে দিল জেঠুমণি। এতে করে লাভটা কি হল তিলোত্তমা তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। অবশ্য, উকিলি জেরায় আসামী তো কিছু বোঝে না, যা বোঝার বোঝে উকিল। এখানেই শেষ নয়। পরদিনই বড়পিসি ফোন করল, এবং সে ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে ছোটপিসির ফোন এল। তিলোত্তমা এবারে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছিল।
“কি ব্যাপার, পিসিমণি? হঠাৎ করে আমাকে ফোন করবার এত ধুম পড়ল কেন?”
ছোটপিসি থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, “মানে? আমি আবার কখন তোকে ফোন করলাম? এই তো আজকে —”
“না, তুমি করোনি, কিন্তু বাকি সবাই তো করে ফেলেছে। কাল জেঠুমণি কথা বলল, আজ বড়পিসি ফোন করেছিল, সে ছাড়তে না ছাড়তেই এখন এই তুমি। হঠাৎ আমার জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছ কেন তোমরা?”
ছোটপিসি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামাল দেবার চেষ্টা করে বলল, “এভাবে কেন বলছিস? আমি তোর পিসি, আমার কি কখনও তোর খোঁজ নিতে নেই?”
“তা কেন। কিন্তু এত বছর ধরে যখন বেঁচে আছি না মরে গেছি সে খোঁজটা অবধি নিতে ইচ্ছে করেনি কখনও, তখন হঠাৎ একযোগে সবাই মিলে এত ভাবনায় পড়লে কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
ছোটপিসি বোধহয় পরের কথাগুলো ঠিক করে সাজিয়ে নিচ্ছিল, কারণ এবারে উত্তর আসতে দেরি হল। অবশেষে বলল, “দেখ্ মিঙ্কু, অন্যদের কথা বলতে পারব না, কিন্তু আমি অন্ততঃ তোর ভালর জন্যই ফোনটা করলাম। তুই একটু সাবধানে থাকিস।”
“কেন?”
“না, মানে ... দেখ্, আমি তো নাম করে কিছু বলতে চাই না, কিন্তু যতই হোক, তুই ছেলেমানুষ, আর এতগুলো টাকার ব্যাপার —”
“এতগুলো টাকা মানে! টাকা কোত্থেকে এল আবার?”
ছোটপিসি থমকে গেলেন, “ট্টাকা — কেন, তোর শেয়ারের যে সম্পত্তি —”
তিলোত্তমা সরল, বিস্মিত গলায় বলল, “কি বলছ বলো তো পিসিমণি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
এবার ছোটপিসি সাবধানী গলায় বলল, “তোর ঠাকুর্দা তোর জন্যে যে টাকা রেখে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে মেজদা-বৌদির সঙ্গে তোর কথা হয়নি?”
“কই, না! আর ঠাকুর্দা কোন জন্মে মারা গেছেন, হঠাৎ আমার জন্য রেখে যাওয়া টাকা কোথা থেকে বেরুল?”
“না, মানে, তুই কিছু —”
“আমি কি করে জানব? এসব টাকাপয়সার ব্যাপার তো জেঠুমণি হ্যাণ্ডেল করে।”
ছোটপিসি এবার বেশ মিইয়ে গিয়ে আমতা আমতা করেন, “না ... মানে — আসলে — মানে বড়দা —”
“অদ্ভুত তো! এসব ব্যাপারে জানতে হলে তো জেঠুমণিকে ফোন করবে, কি নিদেনপক্ষে বাবাকে। আমি কোত্থেকে জানব? যাই হোক, আমি রাখলাম, কেমন? টাটা।”
টেলিফোনের ঘটনাগুলো এক হিসেবে খুব হাস্যকর মনে হলেও, তিলোত্তমার চিন্তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল। এরা সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে রীতিমতো একটা তদন্ত কমিটি বসিয়েছে। উইলের ব্যাপারটা যদি শেষ অবধি খুঁড়ে বার করে, তখন কি হবে?
অরিন্দমবাবুকে জানাতে তিনি অবশ্য খুব একটা বিচলিত হলেন না। শুধু বললেন, “ওঁরা যে ইতিমধ্যে বিস্তর জলঘোলা করবার চেষ্টা করেছেন, সে খবর আমি রাখি। আমিও সেই মতো ব্যবস্থা নিচ্ছি নানারকম।”
“উফ্, কেন যে সেদিন বোকার মতো অতগুলো কথা বলে ফেললাম!” তিলোত্তমার ভয়ানক রাগ হচ্ছিল নিজের উপর।
“তুমি কিছু না বললেও এটা হত,” অরিন্দমবাবু একটু হাসলেন, “অন্ততঃ, নতুন করে খোঁজাখুঁজি করার ব্যাপারটা তো অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল। কারণ ওঁরা জানেন যে নতুন উইল বেরোনোর সম্ভাবনা দু’ হাজার নয় সালে, অর্থাৎ সামনের বছর। তোমার জেঠু-বাবা-পিসিদের যা উঁচু-উঁচু মহলে যোগাযোগ আছে, তাতে অনেকদিন আগেই উইলটা বার করে সেটা কন্টেস্ট করে কেস বাধানোর সব রকম ব্যবস্থা করে রাখতেন। আমি বলেই এখনও বার করতে পারেননি।”
তিলোত্তমা একটু অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“আমাদের ফার্ম খুবই ছোট, এবং একেবারেই নাম-করা নয়। আর তোমার ঠাকুর্দার সঙ্গে আমার কোনোরকম প্রফেশনাল কানেক্শানের সম্ভাবনা ওঁদের মাথাতেই আসবে না। আমি সমরবাবুর ক্লায়েন্ট ছিলাম — আর উনি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নিতান্ত কেজো ব্যাপার ছাড়া সম্পর্ক তৈরি করা পছন্দই করতেন না। আমার বেলাতেই কি ভাবে নিয়মের অন্যথা হল কে জানে! কিন্তু আমার মতো একটা ছাপোষা লোককে — তাও আবার তাঁরই প্রাক্তন ক্লায়েন্ট — তাকে এতগুলো টাকার দায়িত্ব দিতে যাওয়া সমরবাবুর পক্ষে সম্ভব, এটা ওঁরা কল্পনাই করতে পারবেন না।”
তিলোত্তমা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাক, আপনার কথা শুনে অন্ততঃ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি নিজে একটু সাবধানে থেকো। রাস্তাঘাটে, স্কুলে যাবার সময় ... কিছুই না, একটু চোখ-কান খোলা যেন থাকে।”
তিলোত্তমা আর কিছু বলেনি। অরিন্দমবাবুর সঙ্গে কখনোই প্রচুর কথা হয়না তার। কিন্তু তিনি যে দত্ত-বাড়ির লোকেদের খুব ভাল করে চেনেন, তা বুঝতে পারে সে। কিন্তু একটা ব্যাপার অরিন্দমবাবুও জানেন না। রাস্তাঘাটে নয়, ঘরের ভিতরেই তার বিপদ অনেক বেশি। বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হবার পরে বেশ কিছুদিন তাকে বাড়ির কেউ বিশেষ ঘাঁটায়নি। কিন্তু জেঠুর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর কাকান যেন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো ক্ষেপে উঠেছে। আগে বাবা-মায়ের সামনে অন্ততঃ দূরে থাকত। কিন্তু এখন ওরা ঘরে থাকলেও এক মুহূর্তের জন্য অন্যদিকে চোখ ফেরালে হাত ধরে, জামার আস্তিন ধরে টানে, আরও নানাভাবে তার সঙ্গে নিকৃষ্ট মানের অসভ্যতা করবার চেষ্টা করে। মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তিলোত্তমার; টের পায় দরজা ঠেলার চেষ্টা করছে কেউ। এভাবে কতদিন চলা সম্ভব? এতটা মানসিক চাপের মধ্যে তিলোত্তমা কিভাবে নিজের বাড়িতে টিকে থাকবে, আর পরীক্ষাগুলোই বা দেবে কি করে? নাকি ওর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটানোটাও তার আত্মীয়দের প্ল্যানের মধ্যেই পড়ে? আজকাল তাই প্রায় সারাক্ষণ ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। তিন বেলা খাবারও মায়ের সঙ্গে অনেক ঝগড়াঝাঁটি করে নিজের ঘরে আনিয়ে নেবার বন্দোবস্ত করেছে। রাতে প্রায়ই ঘুমায় না, তার বদলে পড়াশোনা করে। তবু, কোনো অঘটন যাতে না ঘটে তার জন্য দরজার সঙ্গে একটা ভারি ড্রয়ার ঠেসে রাখে। সঙ্গে থাকে একটা মোটা টর্চ; আলো জ্বালানো কিংবা কারুর মাথায় বাড়ি মারার পক্ষে বেশ উপযোগী।
কিন্তু নিজের বাড়িতে ফেরারী আসামীর মতো কতদিন থাকবে সে? একটা সপ্তাহ এইভাবে কেটে যাওয়ার পর একদিন সকালে বালিশ থেকে মাথা তুলতেই পারছিল না তিলোত্তমা। সমস্ত জীবনটা বিষ হয়ে উঠেছে। অরিন্দমবাবুর দেওয়া আশাটাও এক এক সময়ে মরীচিকার মতো ঠেকছিল। এখন দূর্বল হয়ে পড়লে সর্বনাশ, কিন্তু এভাবেও বাঁচা যায় না। বাড়ি থেকে বেরোবে? বেরিয়ে যাবেই বা কোথায়? রন্-পল্-নীরা-লিনীকে এখন বিরক্ত করা ঠিক না। আগের দিন নিজেই তো লাঞ্চে যেতে পারল না। তার আগের রাতে কাকান যে শুধু দরজা ঠেলছিল তাই নয়, ফিসফিসে গলায় সমানে কি সব বলে যাচ্ছিল। তার দু-একটা কথা কানে ঢোকবার পর তিলোত্তমা মাথার উপর বালিশটা চাপা দিয়ে শুয়ে ছিল। সে কথা তো এদেরকে বলা যায় না। তবু, আজ আর পেরে উঠছিল না। এর আগে বেশ কয়েকবার যখনই বিপদে পড়েছিল, ম্যাজিকের মতো কোথা থেকে ধৃতিমান এসে উদয় হত। কিন্তু হাজার হোক, সে তো আর সত্যিকার প্রদীপের দৈত্য নয়, যে তলব করলেই চলে আসবে ... তাই তো!
ধৃতিমানের দেওয়া ফোন নম্বরটার কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। ফোনটা নিয়ে কন্ট্যাক্ট লীস্টে দেখল, হ্যাঁ, এই তো সেভ্ করা আছে। খানিকক্ষণ দোনামোনা করে নম্বরটা ঘুরিয়ে ফেলল সে। তার পিঠ একেবারে দেওয়ালে ঠেকে গেছে এখন।
ফোনটা অবশ্য বেজে বেজে কেটে গেল। এটাই বোধহয় হওয়ার কথা ছিল। হতাশভাবে ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় মুঠোর মধ্যেই বাজনা বেজে উঠল! তাড়াতাড়ি ফোন ধরে আশান্বিত গলায় বলল, “হ্যালো?”
“সরি, আমি লাইব্রেরীর ভিতরে ছিলাম, ওখানে আবার ফোন ধরা যায় না ... কে বলছেন?”
“আমি ... আমি মিঙ্কু।”
“ওঃ, আপনি!” ওপারের গলাটা চিন্তিত শোনায়, “সেদিনের পর আর খবর দেননি কেন?”
“আসলে ...” তিলোত্তমা খানিক আমতা-আমতা করে বলল, “আসলে আপনার নম্বরটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ ফাইনালি ...”
“কি কাণ্ড! যাহোক, সব ঠিকঠাক তো?”
“আপনার সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে?”
“আমার সঙ্গে!” ধৃতিমান অবাকভাবে বলে, “আজকে?”
“হ্যাঁ ... যদি আপনার কোনো অসুবিধে না হয়।”
“বিশেষ কোনো দরকার আছে কি?”
তিলোত্তমা নিঃশ্বাস ফেলল। তার যে কী দরকার, তা ধৃতিমানকে বলা যাবে না। আর দরকার ছাড়া সে কি আর তার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে? হয়তো ভাববে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ... ছিঃ, সেটা যে কী অপমানজনক! কিন্তু এই মুহূর্তে একটা কাল্পনিক দরকারই বা কি করে বানাবে সে? ক্লান্তিটা আরও বেড়ে গেল যেন। হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল, “না, দরকার কিছু না। এমনিই, ভাল লাগছিল না ... ”
“ওঃহো, বুঝতে পেরেছি,” ধৃতিমান এবারে সদয়ভাবে বলে, “আপনার তো প্রি-বোর্ড। পড়ে পড়ে হেদিয়ে গিয়েছেন তো? কদ্দিন ঘরে আটকা আছেন?”
কে বলে ছেলেটা ম্যাজিক জানে না? এক লহমায় তার বন্দিদশার কথা টের পেয়ে গেল কি করে!
তিলোত্তমা চোখ বুঝে বলল, “হপ্তাখানেক।”
“পরীক্ষা কবে?”
“সামনের মাসের পাঁচ তারিখ থেকে।”
“সর্বনাশ! ততদিন একটানা ঘরে বসে থাকলে তো আপনাকে বাঁচানো যাবে না! আচ্ছা, আপনি এক কাজ করুন। হর্টিকাল্চারাল গার্ডেন চেনেন তো? ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কাছে?”
“হ্যাঁ।”
“ওখানে আসতে পারবেন? খুব দূর হয়ে যাবে?”
“না না, পারব।”
“একটু স্বার্থপরের মতো এত দূরে আসতে বলছি, কারণ আমি এখন এখানেই আছি তো। তাছাড়া আমার মনে হয় গাছপালার মধ্যে খানিক হাঁটাহাঁটি করলে আপনার উপকারই হবে। ফেরার সময় বাড়ি পৌঁছে দেব, চিন্তা নেই।”
“আপনাকে অত করে বলতে হবেনা,” তিলোত্তমা হাসল, “ভালই হয়েছে। আমি ভাবছিলাম, বাড়ির থেকে কতটা দূরে যাওয়া যায়।”
“হাঃ হাঃ! আর কি, মেরে এনেছেন প্রায়। কলেজে ওঠবার পর পরীক্ষাগুলোকে অনেক সহনীয় মনে হয়। যা হোক, শুনুন, আপনি কিন্তু দুপুর-দুপুর চলে আসবেন। আজকাল তো চারটে বাজতে না বাজতেই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পাঁচটায় বাগান বন্ধ হয়ে যায়।”
“কটা নাগাদ যাব?”
“এই ধরুন তিনটে?”
“বেশ।”
“ওকে, দেখা হচ্ছে তাহলে। সাবধানে আসবেন, কেমন? কোথাও রাস্তা চিনতে না পারলে আমাকে ফোন করবেন।”
ঘর থেকে বেরিয়ে কাকানের কোনো সাড়াশব্দ পেল না তিলোত্তমা। রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বলল, “দুটো নাগাদ বেরোব।”
মা আকাশ থেকে পড়ে বলল, “বাবা! পুরো সপ্তাহটা লাঞ্চ খেতেও ঘরের বাইরে পা দিলি না, আজ একেবারে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
“মৃণালিনীর বাড়ি। কয়েকটা ক্লাসনোট মিলিয়ে দেখতে হবে।”
“কখন ফিরবি?”
“দেরি হবে।”
মাকে দেখে মনে হল, ভিতরে ভিতরে স্বস্তি পেয়েছে যেন। কে জানে, বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর ঘরে ঢুকে খানাতল্লাসি চালাবে কিনা! তা সে যা ইচ্ছে করুক। ওদের কাজে লাগতে পারে, এমন একটা কুটোও সেখানে নেই। এমনকি, ধৃতিমানের রেখে যাওয়া সেই নোটটাও কারুর হাতে পড়বার ভয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল সে। আর কথা বাড়াল না তিলোত্তমা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে। ...
“বাঃ, একেবারে টাইমে এসে গেছেন দেখছি,” ধৃতিমান হাসল, “আমাকে অপেক্ষাও করতে হল না।”
“আপনার পড়াশোনার ডিস্টার্ব করলাম, তাই না?” তিলোত্তমা দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলে।
“মাঝে মাঝে কারুর ডিস্টার্ব করবারও দরকার হয়। কাঁহাতক আর ঘন্টার পর ঘন্টা বই মুখে করে বসে থাকা যায় বলুন! যাহোক, ভিতরে ঢুকি আমরা? এই নিন্ আপনার টিকিট।”
সারা দিন একটা চাপা উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল। কাল রাতে শরণ্যা ফোন ধরেনি। আজ সকাল থেকেই আবার দেখছে ফোন সুইচ্ড অফ আছে। এদিকে ওদের বাড়িতে আবার ল্যাণ্ডফোন বলে কোনো বস্তুই নেই! ওর বাবা-মায়ের নম্বরও জানে না, যে একটা খবর নেবে। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে বাবা-মাদের ফোন করতে ভয়ই লাগে। বারকতক ফেস্বুকে গিয়ে দেখল, সেখানেও আসেনি। দিন যতই গড়াতে লাগল, ততই ছট্ফট্ করতে লাগল উপলা। সকাল থেকে পড়াশোনা কিছুই হল না, খেতে বসেও আনমনা হয়ে রইল।
“পলা, কি ব্যাপারটা কি? ছোলার ডাল তো তোর পছন্দ, সঙ্গে আবার বেগুনি — কিছুই মুখে তুলছিস না যে?” বড়জেঠি তাড়া লাগান।
পুলু-মিঠিরও ক্রিস্ট্মাসের ছুটি চলছে এখন, একসঙ্গেই খেতে বসেছিল। তারা পরস্পর মুখ-তাকাতাকি করে মুচ্কি হাসল। তাই দেখে বড়কাকিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোদের আবার এত হাসি কিসের?” মিঠি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, “দিদিয়ার যা অবস্থা দেখছি, তাতে দু-রকম ব্যাপার হতে পারে। এক হল, প্রি-বোর্ডের চিন্তায় ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর তা না হলে …”
পুলু গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে বড়কাকিমার দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিস্ফিসিয়ে বলল, “কণিষ্কদার সঙ্গে দিদিয়ার হেবি ঝগড়া হয়েছে।”
জেঠিমা আর কাকিমা দুজনেই চোখ গোলগোল করে বললেন, “তোরা কি করে জানলি?”
“আরে ধূর!” মিঠি অধৈর্য্যভাবে মাথা নাড়ল, “ওই যে সেদিন সকালবেলা শরণ্যাদির বাড়ি যাবে বলে বেরিয়ে অনেক লেট করে বাড়ি ফিরল না? ওইদিনই ঝগড়া হয়েছে। খেয়াল করোনি, সেদিন সেজমার সঙ্গে কতক্ষণ গুজ্গুজ্ করল?”
“আহা, কিন্তু ব্যাপারটা যে কণিষ্ককে নিয়ে সেটা কি করে বুঝলি?”
“সে তো মা কালকে বাবাকে বলছিল, আমি ওভারহিয়ার করলাম,” পুলু নির্বিকারভাবে বলে।
“কি ওভারহিয়ার করলি?” জেঠি-কাকি একযোগে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করেন। ব্যাপার দেখে মিঠি-পুলুও বেশ ঘাবড়ে গেল। শেষমেশ পুলু সাবধানী গলায় বলল, “আরে, সেরকম কিছুই না। মা বলছিল, ‘পলার তো মন খারাপ হয়েছে, কণিষ্ক ওর উপর খুব চেঁচামেচি করেছে বলে’, আর বাবা তাই শুনে বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই বোধহয় হবার ছিল, কিন্তু আমার ওদের সবার কথা ভেবেই খারাপ লাগছে,’ — এইসব আর কি।”
“দাঁড়া, দাঁড়া,” বড়কাকিমা সন্দেহের গলায় বললেন, “‘হবার ছিল’ মানেটা কি? তার মানে কি সেজদা আগেই জানত যে ওরা —”
“বড়জেঠি, মাছ-টাছ কিছু আছে?”
বলা বাহুল্য, এতক্ষণ ধরে বাকিদের কথাবার্তা উপলার কানে কিছুই ঢোকেনি। ওদেরকে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবারে একটু অবাক হয়ে বলল, “কি হয়েছে, অ্যাঁ?”
বড়জেঠি তড়িঘড়ি বললেন, “আরে, একটা ডাল খেতে তো দুপুর কাবার করে দিলি! এমন মেয়েও দেখিনি বাবা — একেবারে মাছ দিয়ে দেব? আর কিছুই খাবি না? এই যে লাউ ঘন্ট —”
উপলা ব্যাজার হয়ে বলল, “আরে না রে বাবা, ভাল্লাগছেনা।”
বড়কাকিমা খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে পলা?”
“কি আবার হবে! দেশটা বাজে লোকে ভরে গেছে, বুঝলে? যেদিকে তাকাবে, শুধু ঠগ, জোচ্চোর, গাঁজাখোর, লম্পট — একেবারে যাচ্ছেতাই!”
বড়কাকিমা আর বেশি ঘাঁটাতে সাহস করলেন না, কিন্তু ফিস্ফিস করে জেঠিকে জিজ্ঞেস করলেন, “বড়দি, তোমার কি মনে হয়, কণিষ্ক আজকাল গাঁজা-টাজা খাওয়া শুরু করেছে?”
ঘরে ফিরেও স্বস্তি হচ্ছিল না একদম। কণিষ্কর ফোনে একবার রিং করে দেখল, সুইচ্ড অফ। রনের অবস্থাও তথৈবচ। বই পড়তে গিয়েও লাভ হচ্ছিল না। একটাই লাইনে হাজারবার করে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল, একটা শব্দও মাথায় ঢুকছিল না। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল, কে জানে! একটু ঘুম এসে গিয়েছিল বোধহয়। মোবাইলে মেসেজ ঢোকার শব্দে চট্কা ভেঙে গেল তার। শরণ্যা এতক্ষণে উত্তর দিয়েছে! খপ্ করে ফোনটা তুলে মেসেজ পড়ল: ‘গোয়িং টু পুজন্স হাউজ। প্লিজ ডোন্ট্ কল্ নাও। ফিরে এসে সব বলছি।’
উপলা খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো বসে রইল। পূজনের বাড়ি যাচ্ছে মানে! তার সঙ্গে তো একদিন মাত্র ফোনে কথা হয়েছিল ওর! তারপর এই কটাদিনে আলাপ-পরিচয় এতদূর গড়িয়ে গেল কিভাবে যে একেবারে তার বাড়ি চলে যাচ্ছে? সে কি মেসেজটা ঠিক পড়ল! তন্দ্রার শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গেল তার। আরেকবার ভাল করে মেসেজটা পড়ে দেখল, না, কোনো ভুল নেই! তার মানে, কাল রাত্তির থেকে যে আশঙ্কাটা কেবলই তার অবচেতনে পাক খাচ্ছিল, সেটাই সত্যি হল, এবং এত অল্পক্ষণের মধ্যে! শরণ্যার নম্বরটা ঘোরানোর আগেই বুঝতে পারল, ওকে পাওয়া যাবে না। হলও তাই। একটানা রিং হয়ে হয়ে অবশেষে কেটে গেল ফোনটা।
ভয়ে উপলার বুক ঢিপ্ঢিপ্ করছিল। তবু মাথাটা যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রেখে ভাবার চেষ্টা করল। শরণ্যার অবস্থাটা এখন ঠিক কতটা বিপদজনক, তা সে জানে না। কিন্তু যদি সত্যিই সিরিয়াস হয়, তখন কি করবে? রনের মা-বাবাকে জানালে ... না না, তাতে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। পূজন মিত্র কোথায় থাকে সে খবর নিশ্চয়ই ওরা রাখেননা। শুধু শুধু ওঁদের টেনশান দেওয়া হবে। উপলা তো নিজেই জানে না ওর বাড়ি কোথায় ... শুধু শাক্যদা ফোনে বলেছিল নর্থের দিকে — শাক্যদা! শাক্যদা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই! সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগাল উপলা।
শাক্য বোধহয় ঘুমাচ্ছিল। একটু জড়ানো গলায় উত্তর দিল, “হ্যালো ... ”
“শাক্যদা, উপলা বলছি।”
“ওঃ, হ্যাঁ, বলো।”
“আমি একটু বিপদে পড়েছি। তোমার হেল্প দরকার।”
“বিপদ!” শাক্যদার স্বরটা সজাগ শোনায়, “কি হয়েছে?”
“বলছি। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে? নিরপেক্ষভাবে?”
শাক্যদা যদি অবাক হয়েও থাকে সেটা প্রকাশ না করে বলল, “নিশ্চয়ই। বলো।”
“একজন একা মেয়ের পক্ষে পূজন মিত্রর বাড়িতে যাওয়া কতটা সেফ্? বিশেষ করে যদি তার সঙ্গে ভাল পরিচয় না থাকে?”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শাক্য বলে, “চেনা হোক, অচেনা হোক, পূজনের বাড়িতে একা একা যাওয়া কখনোই খুব একটা সেফ নয়। নিরপেক্ষভাবেই বলছি। ও তো আর পাঁচটা সুস্থ লোকের মতো নয়; তার ওর ব্যবহারটাও আন্প্রেডিক্টেব্ল। ওকে ... শুনেছি এর আগে ওকে বেশ কয়েকবার বাড়ি বদল করতে হয়েছে। মাকেও মাঝে মাঝে দেখেছি, হাতে কাটা দাগ-টাগ ঢাকবার চেষ্টা করছে। সোবার থাকলে একরকম। কিন্তু নেশার ঘোরে কি করবে কিছুই বলা যায় না।”
উপলা টের পেল, তার হাতের পাতা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, গলার কাছে একটা শক্ত দলা ঠিকঠাক নিঃশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না। অতি কষ্টে বলল, “শাক্যদা, আমার একজন বন্ধু একটু আগে পূজন মিত্রর বাড়ি যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওকে কোনোভাবেই কন্ট্যাক্ট করা যাচ্ছে না।”
শাক্যদা এবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে বলল, “বন্ধু! সে — তোমরা — তুমি পূজনকে আগের থেকেই চেনো?”
“আমি চিনি না, আমার ওই বন্ধু চেনে। সবটা এখন বলার সময় নেই; আপাততঃ ওকে আটকাতে হবে। কিন্তু ও কোথায় থাকে তা তো আমি জানি না ...” উপলা আর কিছু বলতে পারে না।
শাক্য খানিকক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ দৃঢ়ভাবে বলে, “তৈরি হয়ে কালীঘাট মেট্রোর সামনে চলে এসো। একটু তাড়াতাড়ি।”
কলকাতার এই দিকটায় কোনোদিন আসেনি শরণ্যা। ছোটবেলা থেকেই এই শহরের সঙ্গে যা সম্পর্ক, আদান-প্রদান, সবই দক্ষিণে। লণ্ডনে যা কিছু নতুন, তা সমস্ত পুরোনোর সঙ্গে বেশ সাবলীলভাবে মিশে গেছে। কলকাতা কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলাদা। দক্ষিণ কলকাতার লোকেদের দেখেছে, ‘নর্থ্’ বলতেই মুখে বঙ্কিম হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসিতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কিছুটা ঈর্ষাও মিশে আছে কী? উত্তর মানেই পুরোনো, আর পুরোনো মানেই ফেলে দেওয়া, বাতিলের খাতায়। সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে নেমেই একটা অস্বস্তিকর মনখারাপ এসে ধরল তাকে। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো কত উঁচু-উঁচু, কিন্তু কী জরাজীর্ণ দশা! দেওয়ালে কালো-কালো ছোপ, অনেক জায়গায় পলেস্তরা উঠে গেছে; কতকাল রঙ করা হয়না কে জানে। রাস্তাগুলোও অনেকটা সরু, উঁচু ফুটপাথ, উপর দিয়ে সারি সারি ইলেক্ট্রিক তার চলে গেছে। মোড়ের মাথায় দু-তিনটে হাতে টানা রিকশা দেখে অবাক হয়ে গেল সে। আগে কখনো স্বচক্ষে এরকম রিকশা দেখেনি। পূজন ঠিকই বলেছিল, এখানে শহর কখনোই ঘুমিয়ে পড়বে না। তাদের পাড়ার বৈচিত্রহীন সোজা রাস্তা, সার দেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ি আর একটানা বাস অটোর আওয়াজের থেকে অনেকটাই আলাদা। জায়গাটার যেন নিজস্ব চরিত্র আছে। অনির্দিষ্ট গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়া অলি-গলি, দোকানের বেসমেন্ট থেকে বাড়ানো আরেকজন পান-সিগারেটের দোকানী, এমনকি মাঝে মাঝে খোলা আবর্জনার স্তুপ — সবাই এবং সবকিছুই যেন জায়গাটার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে আকাশের রঙটাও কি অন্যরকম?
শরণ্যা একজন রিক্শাওয়ালাকে গিয়ে বলল, “কালীমোহন রায় লেন যাব।”
রিক্শাওয়ালা তাকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে গম্ভীর মুখে জানাল, “কুড়ি।”
শরণ্যা কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল। রিক্শায় বসবার অভিজ্ঞতাটাও নতুন। সীটটা এতই সরু, আর এত উঁচু, উঠতে বসতে রীতিমতো কসরৎ করতে হল। চালক হাতের মতো বাড়ানো ডাণ্ডাদুতো ধরে তুলতেই ভয় পেয়ে সীটের কানাটা ধরে ফেলল; মনে হচ্ছিল বোধহয় পড়েই যাবে! চালক অবশ্য নির্বিকারভাবে এত বড় জিনিসটাকে নিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করে দিল। শরণ্যার মনে হল, পূজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন রোলার-কোস্টারের মতো হয়ে উঠেছে।
পাঁচটাও বাজেনি বোধহয়। ইতিমধ্যেই সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। রিক্শাওয়ালা তাকে লোরেটো ডে স্কুলের পাশ দিয়ে, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি পিছনে ফেলে বৌবাজারের মধ্যে দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে চলল। শরণ্যা অবাক হয়ে দেখল, রাস্তা জুড়ে রাশিরাশি সোনার দোকান, আলো ঠিকরে চোখ ঝলসে দিচ্ছে। কি অসম্ভব ঘিঞ্জি জায়গা! অবশ্য একটু পরেই কোনো কিছুই আর খুঁটিয়ে খেয়াল করছিল না সে। চাপা উত্তেজনায় বুক দুরদুর করছে। বাড়ি থেকে এতটা দূরে সে কোনোদিন একা একা আসেনি — মম্-ড্যাড্কে মিথ্যে বলে তো নয়ই। উপলাকে অবশ্য বেরোবার আগে মেসেজ করেছিল; সে আবার কি ভাবছে, কে জানে! আসলে ... রঙ্গীতদার ব্যাপারটা তো কেউ জানেইনা এখনো।
ঋদ্ধিমানদার ফোনটা আসবার পর যে একনাগাড়ে কতক্ষণ বসে কেঁদেছিল, জ্ঞান নেই। প্রায় দু-বছরব্যাপী জমে থাকা যত কান্না এই একটি ঘটনায় বন্যার জলের মতো ধেয়ে এল। রঙ্গীতদাই কি তার এতদিনের কাল্পনিক বাঁধ? তা হবে হয়তো। কিন্তু সেই কল্পনার কি এতই শক্তি ছিল, যে ছেড়ে যাওয়ার সময় একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেল! মনের ভিতরে সবকিছু চুরমার হয়ে যাচ্ছিল তার — যেন প্রচণ্ড ঝড়ে এক এক করে আলোর লণ্ঠন ভেঙে পড়ছে, একটু একটু করে ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে চোখের উপর। কার জন্যে এত কাঁদছে সে? কিসের জন্যে! রঙ্গীতদা তো কোনোদিন তার কেউ ছিলই না! কিন্তু এতদিন পর্যন্ত সেই কুয়াশা-ঘেরা মায়াদ্বীপের গন্তব্যে কোনো একদিন পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতে পারত সে। আজ এক মুহূর্তে জেগে উঠে দেখল, একেবারে দিকশূন্য হয়ে পড়েছে।
কতক্ষণ যে এই অবস্থায় কেটেছে, হুঁশ নেই। খাবার জন্য ডাকতে এসে মম্ প্রথম আবিষ্কার করল। তাকে কি এই অবস্থায় মম্ কোনোদিন দেখেছে? শরণ্যার মনে নেই, কিন্তু মমের ভয়ার্ত গলার স্বরে সম্বিৎ ফিরল তার; দেখল, সে মেঝেতে বুকের কাছে হাঁটু জুড়ে একটা অসহায় শিশুর মতো কুঁকড়ে আছে।
“ওঃ মাই গড্, রাকা? রাকা! হোয়াট্স রং — কী হয়েছে তোর? জয়ন্ত! জয়ন্ত!”
আওয়াজ শুনে ড্যাড্ ছুটে এসে দৃশ্যটা দেখে থমকে গেল কিছুক্ষণ। তারপর তাকে মেঝে থেকে তোলবার চেষ্টা করতে লাগল, “রাকা! রাকা! কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? কাঁদছিস কেন এভাবে? ...” দুজনে মিলে অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে শান্ত করার চেষ্টা করে গেল তাকে। শরণ্যাও প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে অবশেষে কিছুটা ধাতস্থ করতে পারল। মম্-ড্যাডের সামনে এভাবে ভেঙে পড়লে তো সর্বনাশ! কান্নার বেগ খানিকটা কমতে কোনোমতে বলল, “পল্ সায়েন্স ... কিছু বুঝতে পারছিনা... কান্ট ডু ইট্... ” এতে অনেকটা কাজ হল। ড্যাড্ টেবলের উপর খোলা বইটা এক ঝলক দেখে নিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই ব্যাপার? বোকা মেয়ে! পরীক্ষার তো দেরি আছে এখনোও। য়ু আর্ জাস্ট স্ট্রেস্ড্ আউট্ ... শোন্, উঠে বোস, এই ঠাণ্ডার মধ্যে মেঝেতে পড়ে থাকিস না। হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে চল্, লেট্স হ্যাভ ডিনার —”
“আই — কান্ট ...”
“ওকে, ওকে, ফাইন। খাটে তো উঠে বোস্। শ্রাবস্তী, চা করবে একটু? হার্ নার্ভ্স ...”
মম্ নিমেষের মধ্যে চা করে আনল। এক একটা মুহূর্ত এমন আসে, যখন মনে হয় তারা আগের মতোই লণ্ডনের বাড়িতেই বসে আছে। ইংল্যাণ্ডের লোকেদের কাছে চায়ের চেয়ে বড় ওষুধ আর নেই; এ ব্যাপারে বাঙালিদেরও টেক্কা দিয়ে যায় তারা। সেই রীতিটা তাদের বাড়িতেও ঢুকে পড়েছিল, এবং আজও ছেড়ে যায়নি। চা’টা কাজেও দিল সত্যি! এতক্ষণ একটানা ফুঁপিয়ে যাচ্ছিল সে; প্রথম চুমুকটা দেওয়ার পর পুরোপুরি চুপ করল।
মম্ উদ্বিগ্নমুখে বলল, “বিদিশাকে ফোন করব?”
শরণ্যা মাথা নাড়ল। এর মধ্যে আবার ছোটমাসিকে টানা কেন? মম্-ড্যাড্ যাতে চিন্তা না করে তাই জন্যে মিথ্যে বলেছে। কিন্তু ছোটমাসির সঙ্গে একটা বানানো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না, তাও আবার ফোনে। মম্ অগত্যা খাটে বসে ওর পিঠে হাত রেখে আশ্বাসের সুরে বলল, “এত ভাবছিস কেন? পরীক্ষার তো এখনোও কটাদিন বাকি আছে। তার মধ্যে ঠিকই পড়া তৈরি হয়ে যাবে। আর সব সাবজেক্টেই যে নাইন্টি পার্সেন্ট পেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? না হয় পল্-সায়েন্সে একটু কম নম্বর উঠবে। আরও তো পাঁচ-ছটা সাবজেক্ট আছে, নাকি?”
“আই জাস্ট ডোন্ট্ ওয়ান্ট্ টু ফেল।”
“য়ু ওন্ট্ ফেল। পাগল নাকি? অত খারাপ কক্ষণো হবে না। শুধু শুধু টেন্শান করছিস তুই।”
ড্যাড্ বলল, “উফ্, যা ভয়টা ধরিয়ে দিয়েছিলি না রাকা! আমি জীবনে এত ঘাবড়াইনি। ফালতু একটা ব্যাপার নিয়ে কেউ এরকম করে কাঁদে? ...”
শরণ্যার মনটা আস্তে আস্তে একটু হলেও হালকা হয়ে আসছিল। কারণটা যতই মিথ্যে হোক, আজ কতদিন পরে তারা এতক্ষণ ধরে একসঙ্গে বসে রইল। ক্রমে কথার প্রসঙ্গটা ঘুরে গেল; মম্-ড্যাড্ বোধহয় তার মন ভাল করবার জন্যেই একটা সময় হাসিঠাট্টা করতে লাগল। অপ্রত্যাশিতভাবেই অনেকটা আরাম পেল সে।
রাতের বেলা পূজনকে মেসেজ করল, ‘কাল গেলে অসুবিধে হবে?’ বাড়ি থেকে অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। নিজের ঘরে বসে তার একাকীত্বের সঙ্গে যুঝতে পারবে না এখনই। কিন্তু বাকিদের কাছেও এই ব্যাপারে এক্ষুণি কিছু বলার ক্ষমতা নেই তার।
তার মেসেজের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-র বদলে ওর ঠিকানা, আর সেখানে পৌঁছানোর নির্দেশ লেখা একটা মেসেজ এল। তাই আজ বিকেল না হতেই বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। মম্কে বলে এসেছে নীরাদের বাড়িতে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে। আসল কথাটা বললে একগাদা প্রশ্নের মুখে পড়তে হত।
“বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলবি না তো?” মম্ চিন্তিতভাবে বলল।
“না, না। আই অ্যাম ফাইন নাও। একটু দেরি হবে ফিরতে, বাট্ ডোন্ট্ ওয়রি, কাকু পৌঁছে দেবেন।”
“ওকে। সাবধানে যাস!” ...
রিক্শাটা হঠাৎ ডানদিকে মোচড় নিয়ে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
“কালীমোহন রায় লেন এসে গিইচি তো।”
শরণ্যা সজাগ হয়ে চারিদিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। এটা তো বাজারের সংলগ্ন একটা কানা গলির মতো রাস্তা। একদিকে একটা এঁদো চেহারার সরাইখানা, তার ঠিক উল্টোদিকেই একটা ছোট্ট ভাঙাচোরা মন্দির। রাস্তার দু-ধারে কাঁচা ড্রেনের স্রোত, বাড়িগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ। পরিবেশটা যে শুধু শ্রীহীন, এমন নয়। জায়গাটার হাওয়াতেই এমন কিছু একটা আছে যা ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে, ভয় ধরিয়ে দেয়। হঠাৎ যেন বেশি শীত করে উঠল শরণ্যার; জ্যাকেটটা আরেকটু ভাল করে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এক নম্বরটা কোথায়?”
গলিটার প্রায় শেষের মুখে রিকশাটা এসে থামল। বাড়ির ঠিক সামনেই একটা ল্যাম্প পোস্ট; পুরোপুরি অন্ধকার নামার আগেই টিমটিমে আলো জ্বলে গেছে তার। বাড়িটা বেশ পুরোনো হলেও, দেখে বসবাসযোগ্য বলা চলে। বাইরে দিয়ে দোতলায় যাবার একটা সিঁড়ি উঠে গেছে; জায়গাটা একটা সরু বারান্দার মতো রেলিং দিয়ে ঘেরা। শরণ্যা সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। টোকা দেবার আগে নীচে তাকিয়ে দেখল, রিক্শাটা চলে গেছে। বেশ গা-ছম্ছম্ করছিল তার। এরকম একটা জায়গায় যে পূজন থাকে, তা জানলে সে আসবার আগে দু-বার ভাবত। কিন্তু এখন তো কিছু করবার নেই! ... তাছাড়া, রাস্তাটা যেমনই হোক, ঘরের ভিতরে ঢুকলে নিশ্চয়ই অস্বস্তিটা কেটে যাবে। বেশিক্ষণ বসবে না যদিও। একটা ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছিল আনুসঙ্গিকগুলোর কথা না ভেবেই। রঙ্গীতদার ব্যাপারটা এতই আকস্মিকভাবে ... যা হোক। এতটা পথ উজিয়ে এসেছে যখন, তখন একবার দেখা করেই চলে যাবে।
কড়া নাড়বার বেশ কিছুক্ষণ পর ছিট্কিনি খোলার শব্দ হল। তারপরেই শরণ্যার বুকের ভিতরটা ধক্ করে উঠল। চমকে উঠে দু-পা পিছিয়ে গেল সে। পূজন বেরিয়ে এসেছে; চুল উস্কো-খুস্কো, চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। হাতটা কি সামান্য কাঁপছে? ভুরু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ তাকে ঠাওর করে দেখে নিল সে। তারপর একটা ঘোলাটে হাসি হেসে বলল, “গুড্ ইভনিং।”
“হর্টিকালচারে আসেননি কখনও?” ফুটব্রিজের উপর দিয়ে অলসভাবে হাঁটতে হাঁটতে ধৃতিমান বলে। তিলোত্তমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখছিল। একসঙ্গে এত গাছ আর ফুল সে কখনোও দেখেনি। আনমনা গলায় বলল, “না ... আলিপুরেই আসিনি কখনোও।”
“বাবা! অবশ্য আপনি সাউথের লোক, এদিকে চট্ করে না থাকবারই কথা।”
“সাউথের লোক নই তো।”
“বলেন কী!” ধৃতিমান অবাক, “আপনাদের বাড়ি তো আমার বাড়ি ছাড়িয়ে আরও কতটা ভিতরের দিকে!”
“তা ঠিক,” তিলোত্তমা বলে, “তবে আমার ঠাকুর্দা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন তদ্দিন আমরা সবাই নর্থে থাকতাম — আমরা, জেঠুমণির ফ্যামিলি, কাকান, সকলেই। আমার যখন সাত-আট বছর বয়স, তখন ঠাকুর্দা চলে গেলেন, তার পর-পরই নতুন বাড়িতে শিফ্ট করে গেলাম আমরা। কাকানের তখন টুয়েল্ভ ক্লাস বা ওইরকম কিছু।”
“আচ্ছা ... শৌর্য্য আপনাদের সঙ্গে গেল?”
“হ্যাঁ। বাবার আবার কাকানের প্রতি আলাদা ভালবাসা। অনেক ছোট তো ... প্রায় কুড়ি বছরের ছোট।”
“মাঝে আরও ভাইবোন আছেন বুঝি?”
“দুজন পিসি আছেন, আর জেঠুর কথা তো আগেই বললাম। কিন্তু ওঁরা সবাই কাছাকাছি বয়সের। কাকান হল গিয়ে ... ওই, ঠাকুর্দার বুড়ো বয়সের বেখেয়ালের সন্তান।”
মন্তব্যটা যে না চাইতেই বেশ অম্লরসাক্ত হল তা পরক্ষণেই বুঝতে পারল তিলোত্তমা। ঘৃণা আর তিক্ততার স্বভাবই হল তাকে কিছুতেই চেপে রাখা যায় না। কোনো একটা আলটপ্কা কথায় বা ব্যবহারে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। ধৃতিমান অবশ্য সে সবের ধার দিয়েও না গিয়ে বলল, “আপনাদের পুরোনো বাড়িতে এখন কে থাকেন, জেঠুমণি?”
“না, কেউই থাকেনা। তালাবন্ধ পড়ে আছে।”
“নর্থের কোন জায়গায় বাড়িটা?”
“আহিরীটোলা।”
“কিছু মনে আছে তার কথা?”
“ধোঁয়া-ধোঁয়া। বাড়ির ভিতরটা খুব ভাল মনে আছে, তবে আশেপাশের রাস্তাঘাট প্রায় সবই ভুলে গেছি। কত বছর হয়ে গেল ও তল্লাটে আর পা মাড়াইনি।”
“হুঁ ...”
হাঁটতে হাঁটতে একটা বিশাল ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা। গাছটার নাম ব্রাউনিয়া। গাঢ় সবুজ লম্বা লম্বা পাতা, ডালগুলো এঁকেবেঁকে চারদিকে ছেয়ে আছে, তলায় বেশ আরামদায়ক একটা বেঞ্চ। ধৃতিমান বসে পড়ল, দেখাদেখি তিলোত্তমাও। পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসা পড়ন্ত রোদটা যে কী মন ভাল করে দেওয়া! তার মাঝে হঠাৎ করেই ধৃতিমান আবৃত্তি করে উঠলঃ
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,তিলোত্তমা নিঃশব্দে হাসল। আরও কিছু বলার অপেক্ষায় রইল খানিকক্ষণ, কিন্তু ধৃতিমান চুপ করে গেছে। অবশেষে সেই উত্তর দেওয়ার মতো বলল,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরও —
তবে আমি হেঁটে চলে যাব মানে মানে।
ভিড়ের ভিতরে তবু — হ্যারিসন রোডে — আরো গভীর অসুখ,ধৃতিমান চমকে উঠল, “এটা জানেন?”
এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে: এক পৃথিবীর ভুলচুক।
“জীবনানন্দ তো। সবাই জানে।”
“এই কবিতাটা মোটেই সবাই জানে না। যেটা জানে, সেটা হল ‘চুল তা-আ-র কবেকা-আ-র অন্ধকা-আ-র বিদিশা-আ-র’ — ”
“আরে থামুন, থামুন!” তিলোত্তমা বিপন্নভাবে বলে, “আমার বাংলার মিস্কে হুবহু নকল করছেন কি করে? কবিতার এমন শ্রাদ্ধ করেছেন যে জীবনানন্দের আত্মাও বোধহয় ক্লাসরুমে কাঁদছিলেন সেদিন।”
ধৃতিমান হো-হো করে হেসে ওঠে। এবং মাথা হেলিয়ে হাসতেই থাকে। এরকম সরল, দরাজভাবে হাসতে কাউকে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না তিলোত্তমা। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ধৃতিমান বলে, “উফ্, ইস্কুলের কথা ভাবলেই এমন হাসি পায়! এক একজন যা টিচার ছিলেন, সারা জীবনেও ভুলব না।”
তিলোত্তমা বিড়বিড় করল, “আমাদের ইস্কুলের মতো অদ্ভুত জায়গা পৃথিবীর কোথাও তৈরি হয়নি।”
“সে অবশ্য আমি মানতে রাজি আছি।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিলোত্তমা বলে, “একটা পয়সার জন্য মারামারি করে মরার কিন্তু কোনো মানে হয়না।”
“সেটাই হয়তো এক পৃথিবীর ভুল।”
“আমি এই কবিতাটা ভাল বুঝতে পারি না।”
“আমিও না। তবে ভাল লাগে।”
“ঠিক।”
বাগানে আরেক পাক দিতে দিতেই সন্ধ্যে নেমে গেল। ধৃতিমান ঘড়ি দেখে বলল, “পৌনে পাঁচটা। চলুন বেরোনো যাক।”
তিলোত্তমা কিছু বলল না, কিন্তু ধৃতিমান তার দিকে একবার তাকিয়েই জানতে চাইল, “কি ব্যাপার, মুখ ভার কেন? বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই বুঝি?”
তিলোত্তমা মাথা নাড়ল। দুপুরটা যে কি সুন্দর কেটেছে! ভাগ্যিস ধৃতিমান এখানে আসতে বলেছিল, নাহলে কলকাতা শহরের মধ্যেখানে যে এরকম বিস্তৃত মায়াবী এক বাগান আছে, তাতো সে জানতেই পারত না! কত প্রাচীন এখানকার গাছগুলো। কতদিনের ইতিহাস তারা দেখেছে। গাছেরা কি ইতিহাস মনে রাখে? গাছেরা কি ওদের দুজনকে মনে রাখবে?
ধৃতিমান হাসল, “ঠিক আছে, এখনই ফিরতে হবে না। বাগান অবশ্য এক্ষুণি বন্ধ করে দেবে, তা, চলুন, আশেপাশের রাস্তায় খানিক হাঁটা যাক। ছটা বাজলে কিন্তু ব্যাক্। পড়াগুলো শেষ করতে হবে তো।”
তিলোত্তমা হেসে ফেলল, “কিরকম জ্যাঠামশাইদের মতো খবরদারি করছেন।”
“কি আর বলব বলুন। চুর্মুর — মানে আমার ভাইয়ের ওপরেও তো ছোটবেলা থেকেই খবরদারি করতে হয়েছে। না চাইতেই ভিতরের জ্যাঠামশাইটা বেরিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে।”
গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগল দুজনে। বেশিটা সময়ই চুপচাপ, মাঝে মাঝে দু-একটা কথা। ধৃতিমানকে হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনষ্ক মনে হচ্ছিল। তিলোত্তমার অবশ্য এরকমটাই ভাল লাগছিল। সে দেখেছে, ধৃতিমান সঙ্গে থাকলে বেশি কথা বলার দরকার হয়না। ওর নিঃশব্দ উপস্থিতিটাই যেন একটা মহামূল্যবান জিনিস। এই যে তারা অলি-গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে এক শীতের সন্ধ্যেবেলায়, এমনটা অনন্তকাল ধরে চললেই বা ক্ষতি কী! ঠাণ্ডা, ছায়া-ছায়া পরিবেশে প্রাচীন গাছের সারি দেওয়া পথে যদি এরকম এক সহযাত্রী মিলে যায়, তাহলে জীবনে আর কিসের অভিযোগ থাকে? ...
“ওই দেখুন, ভবানীপুর সেমেটারি, ওখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কবর আছে।”
ধৃতিমানের কথায় চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। তিলোত্তমা দেখল, সত্যিই কখন যেন বড় একটা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা। মাথার উপরে তিনকোণা ফলকে কবরখানার নাম আর সাল লেখা রয়েছে।
“চলুন না, ভিতরে যাই,” তিলোত্তমা আগ্রহের সঙ্গে বলে, “ভিতরটা বেশ সুন্দর মনে হচ্ছে।”
ধৃতিমান ইতস্ততঃ করে বলে, “অন্ধকার হয়ে গেছে কিন্তু।”
“তাতে কি? খোলা আছে তো।”
“তা আছে, কিন্তু রাতের বেলা এসব জায়গাগুলো ...”
“আরে, বেশিক্ষণ বসব নাকি? একবার দেখে নিয়েই চলে যাব। চলুন, চলুন।”
ভিতরটা সত্যিই বেশ সুন্দর। বিস্তৃত ঘাসজমির উপর সারি সারি ফলক, মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ। মৃত্যুক্ষেত্র বলেই হয়তো নিঃঝুম হয়ে আছে জায়গাটা। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছিল না। ধৃতিমান কিন্তু এসে থেকেই ছট্ফট্ করছিল। থেকে থেকেই থমকে দাঁড়াচ্ছিল, পিছনে তাকাচ্ছিল, অদূরে গাছের তলায় ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছিল। ব্যাপার দেখে তিলোত্তমা আর না পেরে বলল, “কি ব্যাপার বলুন তো? আপনার কি ভূতের ভয় আছে? কবরখানায় অস্বস্তি হচ্ছে?” ধৃতিমান চাপা গলায় বলল, “তা নয়। আমার তখন থেকে মনে হচ্ছে কেউ বা কারা যেন আমাদের ওয়াচ করছে। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় থেকেই। একদম ভাল লাগছে না ব্যাপারটা।”
তিলোত্তমা অবাক হয়ে বলল, “সে আবার কি! কই, আমি তো কাউকে —”
বলতে না বলতেই তাদের ঘিরে তিন-চারটে লোক যেন মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠল! বোঝাই গেল, এতক্ষণ তারা ফলকের আড়ালে এবং গাছের নীচের ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসা ছায়ার মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল। ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক এবং অবিশ্বাস্য, যে তিলোত্তমা খপ্ করে ধৃতিমানের শালটা চেপে ধরল।
ধৃতিমান বিড়বিড় করে বলল, “দেখলেন তো? দেখলেন তো কি বলেছিলাম?”
তিলোত্তমা হতভম্বের মতো বলে, “এরকম রিয়েল লাইফে হয় নাকি? এসব তো সিনেমায় দেখায়!”
“মিঙ্কু, প্লিজ, এরকম একটা সিচুয়েশানে ঠাট্টা করবেন না —”
ধৃতিমানের কথা ভাল করে শেষ হবার আগেই লোকগুলো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধৃতিমান ক্ষিপ্রভাবে নিজের ব্যাগটা দিয়ে দু-তিনটে মার আটকাল, নিজেও পালটা আঘাত করল কিনা তিলোত্তমা দেখতে পেল না। মুখে গামছা-জড়ানো একটা লোক এমনভাবে তাকে চেপে ধরেছিল যে মনে হচ্ছিল এক্ষুণি দম বন্ধ হয়ে আসবে। প্রবল ঝটাপটির মধ্যেই তিলোত্তমা কোনো মতে তার মুখের গামছাটা ধরে এক টান দিল; তাতে লোকটার গলায় ফাঁস লেগে যাওয়ায় তার হাত আলগা হয়ে এল। এই সুযোগে যত জোরে পারে লোকটা পেটে কনুইয়ের এক গুঁতো মারল সে। লোকটা ‘কোঁক’ করে পেট চেপে বসে পড়ল কয়েক মুহূর্তের জন্য। ধস্তাধস্তির চোটে তার মুখের গামছা সরে গিয়েছিল। এখন অন্ধকার প্রায় পুরোপুরি নেমে গেলেও, তিলোত্তমা তার মুখটা দেখতে পেল। এবং স্তম্ভিত গলায় বলে উঠল, “সনাতনকাকা!”
লোকটা নিমেষের জন্যে একটু থতমত খেয়ে গেলেও, পরক্ষণেই এক ধাক্কায় তিলোত্তমাকে ফেলে দিয়ে এক দৌড়তে দৌড়তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাকিরা কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে মুখ তাকাতাকি করল, তারপর তারাও প্রথম লোকটাকে অনুসরণ করে ছুট্ লাগাল। তিলোত্তমা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে ধৃতিমানের কাছে গিয়ে দেখল, সে মাটিতে বসে কপালের কাছটা চেপে ধরে আছে। তাকে দেখে অবিশ্বাসের সুরে বলল, “এ-রা-ও আপনার চেনা?”
তিলোত্তমা উত্তর না দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল, “লেগেছে? ইস্, কতটা কেটেছে, স্টিচ্ লাগবে?”
ধৃতিমান হাতটা একটু ফাঁক করে দেখাল, লম্বায় অনেকটা না হলেও, বেশ গভীর একটা ক্ষত। সে পকেট থেকে রুমাল বার করে সেটা কপালের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, “ওটা ঠিক হয়ে যাবে। কাঁধের উপর রদ্দা কষিয়েছে একটা, তাতেই কিছুটা কাবু হয়ে গিয়েছি।”
“ব্যাগটা আমাকে দিন।”
“নিতে পারবেন? আপনার লাগেনি?”
গলার কাছটা তখনও ব্যথা-ব্যথা করছিল। সে কথা চেপে গিয়ে বলল, “না, আমাকে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। করবার উদ্দেশ্যও ছিল না বোধহয়।”
ধৃতিমান আড়চোখে একবার তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে ব্যাজারমুখে বলল, “কবরখানা দেখার সখ মিটল তো? শিগ্গির চলুন এখান থেকে।”
তিলোত্তমা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি —”
“না না, আপনার দোষ নেই। আমি জাস্ট্ একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“উঠতে পারবেন তো?”
“পারব।”
বড় রাস্তায় পড়ে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ধৃতিমান বিনা বাক্যব্যয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাল। ট্যাক্সিওয়ালাকে সে তিলোত্তমার বাড়ির ঠিকানা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিলোত্তমা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আগে আপনার বাড়ি। এতটা কেটে গেছে, কাঁধে চোট পেয়েছেন, আপনার তো ফার্স্ট-এইড্ দরকার।”
“কিন্তু —”
“কোনো ‘কিন্তু’ নয়। এখন সবে পাঁচটা কুড়ি। আমার সাড়ে নটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছালেই হবে। আপনার বাড়ি চলুন।”
ধৃতিমান আর কথা বাড়াল না। খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটবার পরে তিলোত্তমা পরিস্থিতিটা হালকা করবার জন্য বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপনি একাই সবকটাকে শায়েস্তা করে দেবেন।”
ধৃতিমান ভুরু তুলে বলল, “কেন? আমাকে দেখে কী মনে হয় আপনার? সলমান খান না প্রসেনজিৎ?”
“আপনার মধ্যে একটা হিরো-হিরো ব্যাপার আছে কিন্তু।”
ধৃতিমান মুচ্কি হেসে বলল, “আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনোও পেলাম না।”
“কোনটা?”
“ওই লোকগুলোকে আপনি চেনেন?”
তিলোত্তমা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সবাইকে নয়। একজনকে চিনি।”
“কে সে?”
“আমার জেঠুমণির গাড়ির ড্রাইভার, সনাতনকাকা।”
“হোয়াট্!” ধৃতিমান আকাশ থেকে পড়ল। তিলোত্তমা মাথা নাড়তেই ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলল, “আর আপনি এখনোও হাত গুটিয়ে বসে আছেন? এক্ষুণি ওঁকে ফোন করে পুলিশে ডায়রি করবার ব্যবস্থা —”
“সেটা করে লাভ নেই। জেঠুমণিই ওকে পাঠিয়েছিলেন কিনা।”
“অ্যাঁ!”
“আপনি ঠিকই ধরেছিলেন। এখন বুঝতে পারছি, ও আমাকে আমার বাড়ি থেকেই ফলো করছিল, আমি কোথায় যাই তা দেখার জন্য। তাই রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় আপনার মনে হয়েছিল কেউ যেন নজর রাখছে।”
ধৃতিমান খানিকক্ষণ হাঁ করে তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হতভম্বের মতো বলল, “আপনার জেঠুমণির আপনাকে মেরে কী লাভ?”
“না, না, মারতে যাবে কেন। আমার গতিবিধির উপর নজর রাখা, আর ... একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল আর কি। দেখলেন না, ওদের হাতে মারাত্মক অস্ত্র-টস্ত্র সেরকম কিছুই ছিল না? আপনি না থাকলে বোধহয় আরও অল্পে ছেড়ে দিত। কিন্তু আপনার জন্যে এখন একটু চিন্তা হচ্ছে। ওরা জেনে যাবে যে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ —”
“কিন্তু ভয়ই বা দেখাতে যাবে কেন?”
“ওই, খানিকটা মানসিক চাপে রাখা আর কি, যাতে আমি বেফাঁস কিছু করে ফেলি।”
ধৃতিমান কিছুই ধরতে না পেরে বলল, “মানে!”
তিলোত্তমা একটু ভেবে নিয়ে বলল, “এখানে সবটা বলা যাবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, যে বহুদিন ধরে আমার সঙ্গে আমার পরিবারের একটা বিশাল যুদ্ধ চলছে। তাতে সবাই আমার বিরুদ্ধে; সবাই মানে সবাই। প্রত্যেকের কারণগুলো অবশ্য আলাদা। আর, আমার ফ্যামিলির যেহেতু সকলেই নামকরা উকিল, নয়তো উপরমহলে নানারকম কানেকশান আছে, সেই জন্য একেবারে অকাট্য প্রমাণ ছাড়া পুলিশে খবর দিয়ে কোনো লাভ হবে না; সেসবের ব্যবস্থা ওরা আগেই করে রেখেছে। আমাকে তাই খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে কিছুদিন, তারপর হয়তো পায়ের তলায় কিছুটা অন্ততঃ মাটি পাব। ... তবে আপনাকে এসবের মধ্যে আমি কোনো অবস্থাতেই টেনে আনব না। আজ ঘটনাচক্রে আপনার উপর অনেক দুর্ভোগ গেল বটে, কিন্তু কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আর কখনও ... ”
“আমি আমার কথা ভাবছি না,” বলে ধৃতিমান অনেকক্ষণ অন্যমনষ্কভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। তিলোত্তমা কী বলবে ভেবে পায় না। তার জীবনে শরণ্যা-মৃণালিনী-নীরা-উপলার উপস্থিতিই তার জীবনে কিছুটা শান্তি এনে দিয়েছিল। দেখতে দেখতে দুটো বছর ফুরিয়ে এল প্রায়, তাদের ছাড়াছাড়ির সময়ের আর বেশি দেরি নেই। তাদেরকে আর প্রত্যেকদিন দেখতে পাবে না, এ কথা জেনেও সে নিজেকে আশ্বস্ত করত এই বলে যে সত্যিকার বন্ধু হলে তা বহু বছর টিকে থাকে, যে যত দূরেই চলে যাক না কেন। এই বন্ধুত্বেই খুশি ছিল সে, যা তাকে বেঁচে থাকবার মতো বাতাসটুকু দিয়েছিল। এর বেশি তো প্রত্যাশা ছিল না জীবনের থেকে!
তবু হঠাৎ একদিন এই ছেলেটার আবির্ভাব হল। ক’দিনেরই বা আলাপ তাদের? কিন্তু আজ জানলার বাইরে চেয়ে থাকা, রাস্তার হলদে আলো পড়া অন্যমনষ্ক মুখটার দিকে তাকিয়ে তিলোত্তমা হঠাৎ করে টের পেল, ধৃতিমানের উপস্থিতিও কখন যেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে জীবনে!
“তার মানে ...” অবশেষে নিস্তব্ধতা ভেঙে ধৃতিমান জানতে চাইল, “তার মানে কি শৌর্য্যও আপনাকে সাপোর্ট করে না?”
তিলোত্তমা বিষন্ন হাসল, “শৌর্য্য দত্ত আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। ওকে মরতে না দেখলে বোধহয় আমার শান্তি হবে না।”
বদ্ধ, প্রায়-অন্ধকার ঘরটার ভিতর বসে রীতিমতো কাঁপছিল শরণ্যা। এ কোন্ সর্বনেশে জায়গায় এসে পড়েছে সে! ঘরময় ছড়িয়ে রাখা বোতল, সিগারেটের টুকরো, এঁটো বাসন; ভ্যাপসা, দম বন্ধ করা একটা দুর্গন্ধ। ঘরের কোণে একটা চৌকি, তার ওপরের বিছানাটা যে কতদিন তোলা হয় না কে জানে!
একটামাত্র হলুদ বাল্ব জ্বলছে, তাতে ঘরের সিকিভাগও আলো করতে পারছে না। পূজন তার সামনে একটা হাতলভাঙা চেয়ারে বসে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। জীবনে কোনোদিন এত ভয় পায়নি শরণ্যা। না, ড্যাডের অ্যাক্সিডেন্টের সময়ও না।
দরজা খোলবার মুহূর্তে পূজনের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল, সে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। ছেলেটার মুখ দিয়ে ভক্ভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে; নেশার ঘোরে তাকে বোধহয় ভাল করে চিনতেও পারছে না। মাতালের সঙ্গে যে ঠিক কিভাবে পেরে ওঠা যায়, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তাছাড়া এই বিকেলবেলায় এতটা নেশা করতে পারলই বা কিভাবে? কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই পূজন খপ্ করে তার হাতটা বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, “কাম্ ইন্সাইড।”
থেকে থেকেই ঘরের অন্য প্রান্তে চোখ চলে যাচ্ছিল শরণ্যার। দরজাটা অনেক দূরে, তাও আবার বন্ধ। পূজন যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে, কোথাও যাওয়া তো দূর অস্ত, সে নড়তে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছিল। নিজেকে বোধহয় আসবাবের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। যেন তার অস্তিত্বের কথা খেয়াল হলেই ছেলেটা কিছু ঘটিয়ে বসবে। নেশায় প্রায় বাহ্যজ্ঞানহীন হলে কি হবে, গায়ের জোর যে একটুও কমেনি, তার প্রমাণ তো সে একটু আগেই পেয়েছে। মনে মনে সে একভাবে জপে যাচ্ছিল, “ঋদ্ধিমানদা, সেভ মী, ঋদ্ধিমানদা, সেভ মী ...”
পূজনের থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে খুব সন্তর্পণে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে লোকানো ফোনটায় ঋদ্ধিমানদাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিতে পেরেছে: ‘অ্যাট্ পূজন্স প্লেস। এমার্জেন্সি।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঋদ্ধিমানদার ফোন এসেছে, কিন্তু পূজনের সামনে ফোন ধরা অসম্ভব। উপলাও ফোন করেছিল, কিন্তু লাভ কী! ঋদ্ধিমানদা কি আদৌ পূজনের ঠিকানা জানে? না জানলে তখন কি হবে? যদি কোনও ভাবে খুঁজে বেরও করে, ততক্ষণে কি অনেক দেরি হয়ে যাবে না? শেষমেশ কি ব্যাপারটা থানা-পুলিশ অবধি গড়াবে? ভয়ে ভাবনায় শরণ্যার চোখ ফেটে জল আসছিল। কতক্ষণ কেটে গেছে, বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন যুগের পর যুগ ধরে সাক্ষাৎ মৃত্যুর চোখের দিকে চেয়ে আছে।
“ডু য়ু ওয়ান্ট টু এস্কেপ?”
পূজনের হঠাৎ প্রশ্নে শরণ্যা চমকে প্রায় লাফিয়ে উঠল।
“হো — হোয়াট?”
“পালাতে চাও?”
“আ-আমি ... কোথা থেকে?”
“আউট অফ্ দিস্ ডার্কনেস। ইন্টু দ্য সান।”
পূজন রহস্যময় হাসল। তার চোখের দৃষ্টিতে অপ্রকৃতিস্থতার চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। শরণ্যা হতবুদ্ধি হয়ে ভাবার চেষ্টা করে, সে এতদিন ধরে কার সঙ্গে মেসেজে কথাবার্তা চালিয়েছে? কার কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছে? সামনের এই নেশায় জর্জরিত আধপাগল লোকটার সঙ্গে সে তো তার কবিকে মেলাতেই পারছিল না! এমনকি রঙ্গীতদার বাড়িতেও যাকে দেখেছে, সে একজন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। শরণ্যা কথা বলবার মতো অবস্থায় ছিল না, কিন্তু পূজন তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে যেতে লাগল, “বাট দ্য ডার্কনেস্ ইজ্ সফ্ট। দ্য ডার্কনেস ইজ্ কাইণ্ড। দ্য ডার্কনেস হ্যাজ সো মাচ্ লাইফ। অন্ধকারে কত শক্তি লুকিয়ে। আলোর জগৎ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যে ঠাণ্ডা নিস্তব্ধ অন্ধকার, যেখানে মাকড়শার মৃতদেহ ধীরে ধীরে পচতে থাকে, সেই অন্ধকার ছেড়ে আমি যাব কেন? কেন আমাকে নিয়ে যেতে চাও, হোয়াই ডু য়ু —”
দুম্! দুম্! দুম্! দুম্!
শরণ্যার হৃৎপিণ্ডটা রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়তে শুরু করল। দরজায় কে যেন প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। তাহলে কি ঋদ্ধিমানদা? সে তাকিয়ে দেখল, পূজন যেন আওয়াজটা শুনতেও পায়নি। একইভাবে সে বিড়বিড় করে যাচ্ছে, “আই ওয়ান্ট টু বী আ পার্ট অফ্ ইট্স ডার্কনেস, ওয়ান অফ্ ইট্স মন্স্টার্স ...”
আবার প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা পড়ল দরজায়, সেই সঙ্গে পরিচিত গলার স্বর, “রন্? রন্! আর্ য়ু ইন্সাইড? সাড়া দে প্লিজ! ...”
উপলা! নিমেষের মধ্যে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল শরণ্যা। এবারে নিজেই লাফ দিয়ে উঠে পূজনকে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে রুদ্ধশ্বাসে বলল, “প্লিজ জাস্ট রান্!”
কোনোদিকে না তাকিয়ে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল ওরা। উপলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শরণ্যা ওর হাত ধরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে একেবারে গলির উলটো মুখে এসে থামল। শাক্য ওদের পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে আসছিল। শরণ্যা ওকে দেখেও ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেল। “আরে, আরে, রন্, করছিসটা কী! ওটা শাক্যদা,” উপলা অতি কষ্টে ওকে থামিয়ে দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “রন্, রন্, লুক অ্যাট্ মী! আই অ্যাম্ হিয়ার! আমরা বেরিয়ে এসেছি ওখান থেকে, আর ভয় নেই।”
শরণ্যা উপলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আশেপাশের পথচারীরা একটু অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল ওদের দিকে। উপলা অবশ্য নির্বিকার। একনাগাড়ে ‘ইট্স অলরাইট, ইট্স অলরাইট,’ বলে মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগল তার।
এমন সময় একটা ছেলেকে উলটোদিকের একটা গলি দিয়ে ছুটে আসতে দেখা গেল। আরেকটু হলে হয়তো ধাক্কাই লেগে যেত তাদের সঙ্গে, কিন্তু উপলাকে দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বলল, “একি! প্রফেসার লুপিন্ না?”
উপলা একেবারে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, “ব্রেক-আপ্ বয়!”
ছেলেটা আরও কিছু বলত হয়তো, কিন্তু শরণ্যার দিকে চোখ পড়তে হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, কি কাণ্ড! রাকা, তোর আক্কেলটা কী, হ্যাঁ? আমি পই-পই করে বারণ করা সত্ত্বেও সেই পূজন মিত্তিরের খপ্পরে গিয়ে পড়তে হল তোকে?”
শরণ্যা এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে চোখ মুছে বলল, “ওঃ গড্, তুমিও এসেছ ঋদ্ধিমানদা!”
“এসেছি মানে? আমি সেই সংস্কৃত কলেজ থেকে দৌড়তে দৌড়তে আসছি, তা জানিস? তোর মেসেজটা পড়ে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছল। কি ভাগ্য যে আজ বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউজে আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় সবকটাকে ফেলে আমি দৌড় মেরেছি ... কিন্তু — কিন্তু তোর সঙ্গে প্রফেসার লুপিন্ কেন?”
উপলা এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল, এবারে অবিশ্বাসের সুরে বলল, “এ-ই-টা ঋদ্ধিমানদা?”
“হ্যাঁ ... ” শরণ্যার এতক্ষণে খেয়াল হয়, “তোরা একে অপরকে কোত্থেকে চিনলি?”
“কি কাণ্ড,” উপলা কপাল চাপড়ে বলে, “আরে এ তো সেদিন বাসে আমার সীটে বসেছিল আর ব্রেক-আপ্ হয়ে গেছে বলে কাঁদছিল!”
ঋদ্ধিমান মৃদু প্রতিবাদ করল, “ঠিক কাঁদিনি ... কিন্তু এ আমাকে খুব কাইণ্ড্লি চকলেট খেতে দিয়েছিল।”
শরণ্যা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এ উপলা, আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড। পল্, য়ু সেভ্ড মাই লাইফ টুডে। তুই ঠিক সময়ে না এসে পড়লে —”
“আমি না, বস্,” উপলা বিজ্ঞের মতো বলে, “এখানে যদি কেউ তোকে বাঁচিয়ে থাকে তো শাক্যদা। আমি তো জানতামই না মালটা থাকে কোথায়। শাক্যদা না নিয়ে এলে এরকম শেডি একটা জায়গায় বাপের জন্মে এসে পৌঁছাতে পারতাম নাকি? কই, শাক্যদা, কোথায় গেলে তুমি?”
শাক্য এতক্ষণ ওদের পিছনে অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, উপলার কথায় একটু ইতস্ততঃ করে ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। শরণ্যা ওর হাত ধরে বলল, “তোমাকে ওভাবে ধাক্কা দেওয়ার জন্য রিয়লি সরি। আমি এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, হুঁশ ছিল না। কিভাবে যে তোমাকে —”
“য়ু আর মোস্ট ওয়েলকাম্,” শাক্য একটু শুকনো হেসে বলে, “পূজন মিত্রর হাত থেকে অন্ততঃ একজনকে বাঁচাতে পেরে আমিই ধন্য হয়েছি বলা যায়। প্লিজ ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রেখো না। আই থিংক হি ইজ বিয়ন্ড্ হেল্প।”
শরণ্যা একটু অবাকভাবে উপলার দিকে তাকাতে সে চোখের ইশারা করল।
ঋদ্ধিমান বলল, “আচ্ছা, এই ভাঁটের জায়গাটা ছেড়ে বেরোই আমরা? সেন্ট্রাল মেট্রো কিন্তু হাঁটা পথে অনেকটা। প্রফেসার লুপিন্, তুমি বাড়ি যাবে কি করে?”
উপলা কিছু বলার আগেই শাক্য বলল, “আমি পৌঁছে দেব। আমাদের কাছকাছি বাড়ি।”
“আচ্ছা। বাড়ি পৌঁছে আমাকে একবার ইন্ফর্ম করে দিও, কেমন? তোমার বন্ধুর কাছে আমার নম্বর পেয়ে যাবে। ঈদের চাঁদ, বাড়ি যাবি তো? তার আগে একবার আমার বাড়ি ঘুরে যাবি? যা বুঝছি, মনখারাপ-চা খাওয়ার সময় এসেছে তোর।”
শরণ্যা ক্ষীণভাবে হাসল, “যাব।”
বাকি রাস্তাটা ঋদ্ধিমান শাক্যর সঙ্গে একতরফা বক্বক করতে করতে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটবার পর উপলা শরণ্যাকে সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করল, “সো ... হোয়াট এক্জ্যাক্টলি হ্যাপেন্ড?”
“পল্, আমি সত্যি বলছি, ঘটনাটার কথা আমি আর মনেও আনতে চাই না —”
উপলা মাথা নাড়ে, “না না, এই ব্যাপারটা নয়। আমি এটা বুঝতে পারছিনা যে হঠাৎ বিনা নোটিসে একটা র্যা ন্ডাম লোকের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলি কেন? এমন একটা লোক, যে কিনা প্র্যাক্টিকালি আ স্ট্রেঞ্জার! হোয়াট কেম্ ওভার য়ু?”
শরণ্যা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে বলল, “রঙ্গীতদা হ্যাজ আ গার্লফ্রেণ্ড।”
“হোয়াট! কি বলছিস কি তুই!” উপলা উত্তেজনায় তিন হাত লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, শরণ্যা অতি কষ্টে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “শ্শ্শ্, আস্তে। কাল রাতে ঋদ্ধিমানদা ফোন করেছিল। কথায় কথায় বেরিয়ে গেল হঠাৎ।”
“মেয়েটাকে চিনিস?”
“নাঃ ... চিনতে চাই না।”
আবার খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ। দুজনের মনের মধ্যেই এখন জমাটবাঁধা মেঘ। তবুও, পাশে চলতে থাকা বন্ধুর কারণে ততটা একা মনে হয়না নিজেকে। খানিক পরে শরণ্যার একটা খট্কা লাগে।
“এই, শাক্যদা পূজনের বাড়ি কি করে চিনল?”
উপলা একবার সামনে হাঁটতে থাকা শাক্যর দিকে তাকিয়ে ফিস্ফিসে গলায় বলল, “কণিষ্কর মায়ের ব্যাপারটা বলেছিলাম, মনে আছে?”
“হ্যাঁ, অফ্ কোর্স!”
“ওয়েল্ ... তিনি অ্যাফেয়ারটা করছেন পূজন মিত্রর সঙ্গে।”
শরণ্যা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মাথাটা ঘুরে উঠেছে। উপলা ওর হাত ধরে বলে, “য়ু অল্রাইট?”
“পল্ ... শাক্যদা কি করে এতটা কম্পোজ্ড হয়ে আছে? ও কি জানে —”
“সবই জানে। আমাকে ফোনে বলেছিল। তারপর থেকেই তো তোকে সমানে কন্ট্যাক্ট করবার চেষ্টা করছি।”
“... আই স’ দ্যাট্ গাই টুডে ... ওর সঙ্গে কোনোরকম রিলেশানশিপে কারুর পক্ষে থাকা কি সম্ভব! আমি ওর কবিতা পড়ে ভেবেছিলাম, হিজ ইম্যাজিনেশান ইজ রিয়লি পাওয়ারফুল। কিন্তু আজকে দশ মিনিট ওর ঘরে কাটিয়ে বুঝতে পারলাম যে আমি যেটাকে ইম্যাজিনেশান ভাবছিলাম সেটা আসলে মেন্টাল ইন্স্টেবিলিটি! ও তো মানসিকভাবে সুস্থই নয়! কী সব বলছিল ... অ্যাবাউট ডার্ক্নেস ... কণিষ্কর মা কি করে ওকে ...”
“বাদ দে,” উপলা তাড়াতাড়ি বলে, “এসব বাজে কথা ভেবে শুধু শুধু নিজেকে আরও ট্রমাটাইজ করিস না। যা হয়ে গেছে, গেছে।”
“কণিষ্কর সঙ্গে কথা হয়েছে?”
“... না। এর পর যদি হয়ও, আগের রিলেশানটা আর থাকবে না। আই থিংক মাই ব্রেক-আপ ইজ পার্মানেন্ট।”
ওরা সেন্ট্রাল মেট্রোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউটাকে এখন কি বিশাল মনে হচ্ছে; কি ব্যস্ত, আর আলো ঝলমলে! আনাচে-কানাচে কোথাও ভয়ের লেশমাত্র দেখতে পেল না শরণ্যা। এমন সময় উপলা বলে উঠল, “রন্?”
“হুঁ।”
“আওয়ার লাইভ্স সাক।”
“আই নো। ... বাট আই অ্যাম গ্ল্যাড টু বী ইয়োর ফ্রেণ্ড।”
“মী টু।”
দরজা খুলতেই মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা, য়ু আর ব্যাক ইন ওয়ান পীস্।”
ঋদ্ধিমান অবাক হয়ে বলল, “তার মানে!”
“মানে তোর দা-ভাই কোথা থেকে যেন মাথা ফাটিয়ে এসেছে।”
“সে কি কাণ্ড! কি সর্বনাশ!”
“মারাত্মক নয়; ফার্স্ট এইড দিয়েছি। ঢোক ভিতরে — আরে, রাকাসোনা, তুমিও এসেছ! কদ্দিন পরে এলে বলো তো! ভাল আছ? বোসো, আমি একবার তোমার ধৃতিদাদার অবস্থাখানা দেখে আসি।”
“ভাল যা আছে, সে আর বলে কাজ নেই ...” বিড়বিড় করতে করতে ঘরে পা দিয়েই চমকে উঠল ঋদ্ধিমান।
শরণ্যা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডাইনিং স্পেসের দিকে তাকাতেই তাজ্জব বনে গেল। সত্যি, আজকের দিনটা যে কিভাবে এগোচ্ছে!
“আমি কি স্বপ্ন দেখছি?” ঋদ্ধিমানদাকে ফিসফিস করে বলতে শুনল, “ডাকসাইটে সুন্দরী কে একটা বসে আছে, ও কি মানুষ না হুরি-পরী কিছু?”
“তিলোত্তমার দিকে একদম কু-দৃষ্টি দেবে না,” শরণ্যা চাপা গলায় বলল, “ও তোমার ফিউচার বৌদি হয়।”
ঋদ্ধিমানদা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “তুই আমার ফিউচার বৌদিকেও চিনিস? জ্যোতিষী নাকি রে তুই?”
তিলোত্তমা খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল, এতক্ষণে শরণ্যাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে উঠে এল, “রন্! তুই?”
“ধৃতিদাদার শুনলাম মাথা ফেটে গেছে? তুই ঠিক আছিস তো?”
“ফেটে নয়, কেটে গেছে। আমি ঠিকই আছি। আসলে ভবানীপুর কবরখানায় আমাদের ডাকাতে ধরেছিল।”
শরণ্যা হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, “কি বলছিস কী!”
ঋদ্ধিমানদা উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, “উফ্, কি এক্সাইটিং সব ব্যাপার! দা-ভাইকে ডাকাতে ধরেছিল, আর আমি গিয়েছিলাম তোকে একজন ড্রাগ-অ্যাডিক্ট-এর হাত থেকে রেস্কিউ করতে। রোমহর্ষণ আর কাকে বলে!”
“অ্যাঁ!” তিলোত্তমা আঁতকে ওঠে।
“রেস্কিউ অবশ্য উপলা আর শাক্যদা করেছে,” শরণ্যা মনে করিয়ে দিল। তিলোত্তমা চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, “সব বলছি, বোস। তার আগে আলাপ করে নে; এ হল ঋদ্ধিমানদা। তিলোত্তমা হল আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড।”
“তোর কটা বেস্ট ফ্রেণ্ড?” ঋদ্ধিমানদা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে, তারপর তিলোত্তমাকে বলে, “হ্যালো, তিলোত্তমা। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যে রাকার বন্ধু তা জেনে তো আরোই আনন্দ পেলাম। আমি তোমার ফিউচার দেওর।”
তিলোত্তমা প্রথমটা হক্চকিয়ে গিয়েছিল, তারপর শরণ্যার দিকে কট্মট্ করে তাকাল। বেগতিক দেখে শরণ্যা তাড়াতাড়ি বলল, “আমার কেসটা শুনবি না? বোস্, বোস্!”
সমস্ত ঘটনাটা শুনে তিলোত্তমা মাথা নেড়ে বলল, “কি কেলেঙ্কারী! সত্যি, পলের আসতে আরেকটু দেরি হলে কি হত বলা যায়না।”
ঋদ্ধিমানদা বলল, “কী আবার হত! তখন প্রফেসার লুপিনের জায়গায় আমিই ওকে রেস্কিউ করতাম।” তিলোত্তমা হাসল, “তুমিও কি ক্যারাটে জানো?”
“পাগল! আমি শুধু পালাতে জানি। আজকে কি কম দৌড়েছি? বাপ্রে! কিন্তু দা-ভাই নিশ্চয়ই পুরো হিরোর মতো মারপিট করল ডাকাতদের সঙ্গে?”
“একেবারেই না! ডাকাতরা ওর ঘাড়ে রদ্দা মেরে চলে গেল। আমি একবার কথা তুলতেই রেগে কাঁই হয়ে বললে কিনা সে কি সলমান খান না প্রসেনজিৎ, যে চারটে লোককে একা হাতে ঠেঙাবে?” ...
হাসিঠাট্টার মধ্যেই ঋদ্ধিমান হঠাৎ বলে উঠল, “জানিস, আজকে ঈশার বিয়ের কার্ড এসেছে।”
শরণ্যা সহানুভূতির স্বরে বলল, “আই অ্যাম সরি।”
“নাঃ, সরির কি আছে? কার্ডটা হেবি দেখতে — দাঁড়া, দেখাই।”
ঘরের ভিতর থেকে একটা লাল রঙের কাজ-করা খাম এনে শরণ্যার হাতে ধরিয়ে দিল ঋদ্ধিমান। শরণ্যা চিঠিটা বার করে পড়তে গিয়ে হঠাৎই চমকে উঠল। তারপর আবার মন দিয়ে সবটা পড়ে নিয়ে কার্ডটা বেশ কয়েকবার উলটে-পালটে দেখে অবশেষে তিলোত্তমাকে জিজ্ঞেস করল, “দেখবি?”
তিলোত্তমা মাথা নাড়ল। শরণ্যার মুখের ভাব দেখে একটু অবাক হয়েছিল বটে, তবে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশি কৌতুহল দেখানো কোনোদিনই তার স্বভাব নয়। শরণ্যাও আর কিছু ভাঙল না।
আরও বেশ কিছুক্ষণ গল্প করবার পরে ঋদ্ধিমানদা শরণ্যাকে এগিয়ে দিতে গেল। ফিরে এসে তিলোত্তমাকেও পৌঁছে দেবে। তিলোত্তমা ধৃতিমানের ঘরে উঁকি মেরে দেখল, সে আধশোয়া হয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। দুজনের মুখেই শান্ত হাসি। তিলোত্তমা ভাবল, ওদের দুই ভাইকেই অনেকটা মায়ের মতো দেখতে।
মা ওকে দেখতে পেয়ে ডেকে বললেন, “চুর্মুর যতক্ষণ না আসে তুমি এখানেই বোসো, কেমন? আমি আরেক রাউণ্ড চা বানাই।”
তিলোত্তমা একটা চেয়ার বিছানার ধারে নিয়ে গিয়ে বসল। মা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ কেউই কোনো কথা বলল না। অবশেষে যেন একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছে তিলোত্তমা বলল, “দুটো কথা বলার আছে?”
“শুনি?”
“আই লাইক য়ু,” বলেই চকিতে ধৃতিমানের দিকে তাকাল সে। দেখল, ধৃতিমান অবিচলিতই আছে, শুধু তার চোখের দৃষ্টি অনেক কোমল, স্নেহময়। কত পরিচিত এই দৃষ্টি!
সে জিজ্ঞেস করল, “অন্য কথাটা?”
“আমি ... আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আপনাকে প্রথম দিন থেকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু সাহস ছিল না। তবে আজকের পর মনে হয়, বিশ্বাস করতে পারব। আপনাকে আমার ফ্যামিলির কথা কিছু বলা হয়নি। আপনি শুনবেন?”
“তার আগে একটা প্রশ্ন আছে।”
“... কী প্রশ্ন?”
“বন্ধুদের মধ্যে অত ‘আপনি-আজ্ঞে’ চলে না। এর পর থেকে ‘তুই’ বললে আপত্তি আছে?”
তিলোত্তমা বহুদিন পর একটা সত্যিকারের হাসি হাসল।
“যা ইচ্ছে ডাকো। কোনো আপত্তি নেই।”
“বেশ, তাহলে শুনি তোর গল্প।”
(ক্রমশ)