অগত্যা ঋদ্ধিমানদাকেই ফোন করল। রাজপুত্রকে ধরা না গেলে মন্ত্রীপুত্রের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় কী! তাছাড়া, তিলোত্তমা আর ধৃতিদাদার ব্যাপারটা নিয়েও একটা কৌতুহল হচ্ছিল। ফোন অবশ্য বহুক্ষণ বেজে চলল। কেটেই যেত হয়তো, কিন্তু শেষমেশ ওপার থেকে খানিকটা যেন বিরস গলায় উত্তর এল।
“বল্ রে ঈদের চাঁদ।”
“শোনো, রঙ্গীতদার কোনো খবর দিতে পারবে?”
“না রে, কোনো খবর নেই। ওদিক থেকেও ফোন আসেনি, আমারও সেমেস্টার চলছিল ক’দিন – কেন, কিছু দরকার?”
“না গো, এমনিই। আসলে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেছে তো, তাই।”
“হ্যাঁ, ও তো ওরকমই। নিজের জগতে ঘুরে বেড়ায়। তোর খবর বল্।”
“আমার সেরকম কোনোও ... হ্যাঁ, ভাল কথা। আচ্ছা ধৃতিদাদার কোনো গার্লফ্রেণ্ড আছে?”
“দাদার গার্লফ্রেণ্ড! কই, দাদার গার্লফ্রেণ্ডের কথা তো শুনিনি! কেন? তুই আবার কোথাও থেকে কিছু জানতে পেরেছিস নাকি?”
“না না, আসলে ক’দিন আগেই ওর কথা ভাবছিলাম, তাই মনে হল।”
“ও! তা, তোর পছন্দ? তাহলে তোর হয়ে লাইন করে দিতে পারি কিন্তু, দা’ভাই আমার কথা ফেলতে পারে না।”
“হাঃ হাঃ! লোভনীয় প্রস্তাব, তবে, না গো। আমার ... মানে আই অলরেডি লাইক সামওয়ান এল্স।”
“আচ্ছা! তাই নাকি! কে সে? নিশ্চয়ই বিলিতি সাহেব কেউ, তুই তো আবার ... ”
“একদমই না, খাঁটি দেশী ছেলে।”
“বাঃ! তা ঘটিয়ে ফেলছিস না কেন ব্যাপারটা?”
“সাহসের অভাব। একদিন হয়তো বলব।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। হেল্প লাগলে বলিস কিন্তু।”
“হ্যাঁ, শিওর। তোমার গার্লফ্রেণ্ডের কি খবর?”
হঠাৎ করে ঋদ্ধিমানদার গলার আওয়াজটা সম্পূর্ণ বদলে গেল।
“আমার গার্লফ্রেণ্ড ... ?”
এই কথার পর বহুক্ষণ ওপার থেকে কোনো সাড়া নেই। শরণ্যা অবাক হয়ে দু-তিনবার ‘হ্যালো-হ্যালো’ বলার পরে ক্ষীণভাবে ভেসে এল, “আই ব্রোক আপ্।”
“সেকি!” শরণ্যা চমকে উঠল, “কবে?”
“বেশিদিন না ... পরশু, ইন্ ফ্যাক্ট।”
“ওঃহো! তাহলে এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? কথাবার্তা বলে মিটমাট করে নাও না? কত কারণে কত ঝগড়া হয়, আবার ঠিকও হয়ে যায়।”
“না রে, কিছু হবে না।”
“আরে, এত শিওর হচ্ছ কি করে?”
“ঈশা ইজ গেটিং ম্যারেড্। আমাকে পরশুদিন ফোন করে বলল।”
“হোয়াট্!” শরণ্যার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, “কি বলছ কি তুমি! হঠাৎ করে কি এমন হল যে ... ”
“কিচ্ছু জানতে পারিনি, বিশ্বাস কর্।”
“আই ডোন্ট নো হোয়াট্ টু সে। তুমি – তুমি ঠিক আছ তো? আই নো ইট্স হার্ড, কিন্তু – ”
“না না, আই অ্যাম ফাইন। জাস্ট একটু শক পেয়েছি – আচ্ছা শোন, আমি বাসে আছি, বুঝলি? আমার স্টপ এসে গেছে, নামব। আমি ফোন করব, কেমন? টাটা।”
ফোনটা রেখে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইল শরণ্যা। পর পর কী সব যে শুরু হয়েছে! ওদিকে তিল্লী, এদিকে ঋদ্ধিমানদা, রঙ্গীতদা ... এখন আবার ছোটমাসীও নানান রহস্য করা শুরু করেছে! কোনদিকে গেলে একটু শান্তি পাওয়া যাবে কে জানে?
কতক্ষণ একইভাবে বসেছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ মম্ এসে দরজা দিয়ে উঁকি মারল, “রাকা, কি ব্যাপার, কতক্ষণ ঘুমোবি?”
“ঘুমোচ্ছি না তো। জাস্ট রুম থেকে বেরোইনি।”
“ফ্রেশ হয়ে নে, উপলা এসেছে।”
শরণ্যা আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে দশটা।
“আমি ফ্রেশই আছি। ওকে এই ঘরেই চলে আসতে বলবে প্লিজ?”
“বেশ।”
উপলা ঘরে ঢুকেই হাত-পা ছুঁড়ে বলল, “আরে, কি কাণ্ড জানিস? বাসে আসার সময় আমার পাশের সীটের ছেলেটা রিসেন্টলি ব্রেক-আপ হয়ে গেছে বলে কান্নাকাটি লাগিয়েছিল, তখন আমি ওকে চকলেট খেতে দিলাম।”
শরণ্যা খানিকক্ষণ উপলার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর আবার শুয়ে পড়ে বলল, “সকাল-সকাল এত ব্রেক-আপের খবর আমি আর নিতে পারছি না।”
“আর কয়েক ঘন্টা। তারপরেই আসাম। ভাবলেই যে কি থ্রিলিং লাগছে!” শিলাদিত্য উচ্ছ্বসিতভাবে বলে। মৃণালিনী চুপ করে থাকে। কফিশপের জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে, তাদের পাড়ায় এখন আরামদায়ক একটা সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আকাশের গাঢ় নীল রংটা এত অসম্ভব সুন্দর! মৃণালিনী একদিন ওই রঙের একটা শাড়ি কিনবে, তারপর সেটা পরে দার্জিলিং-এর পাহাড়ি রাস্তায় এরকমই এক শীতের সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়াবে। কে জানে, শিল্দা তখন পাশে থাকবে কিনা!
শিলাদিত্য এতক্ষণ বক্বক্ করেই চলেছিল, তার অন্যমনষ্কতা দেখে থেমে গিয়ে বলল, “কি হে? কী এত ভাবছ?”
“আমি চলে যাব ... ” মৃণালিনী তখনও ঘোরের মধ্যে।
“চলে যাবে? চলে যাবে মানে! কোথায় যাবে?” শিলাদিত্য অবাক।
“অ্যাঁ?” মৃণালিনীর চট্কা ভেঙে যায়, “না ... আসলে ভাবছিলাম আমিও যাব বেড়াতে।”
শিল্দা কফিতে চুমুক দিয়ে হাসিমুখে বলল, “কোথায় যেতে চাও তুমি?”
“দার্জিলিং। কতদিন যাই না! পাহাড়-পাহাড় করে মনটা হেদিয়ে গেল।”
“আরে! দার্জিলিং তো কাছে। কটা মাস সবুর করো না। কলেজে উঠলেই দেখবে ডিপার্টমেন্টের এক্সকার্শানে ওইসব জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।”
মৃণালিনী ব্যাজার গলায় বলে, “বাবা-মা কি অ্যালাও করবে?”
“কেন করবেন না? অনেকের সঙ্গে মিলে যাওয়া তো।”
মৃণালিনী একটু চুপ করে থেকে বলে, “অনেকের সঙ্গে মিলে তো যেতে চাই না।”
শিল্দা তার চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, “তাহলে কার সঙ্গে যেতে চাও?”
মৃণালিনী ঘাবড়ে গিয়ে তোতলাতে লাগল, “আ-আমি – ম্-মানে ... ”
“গৌরীশঙ্কর। কী, ঠিক কিনা?” শিল্দা ফিক্ করে হাসল।
মৃণালিনী ধাতস্থ হয়ে বলল, “হ্যাঁ, তা বৈকি। গৌরীশঙ্কর যদু মল্লিকের বাজারে কুড়ি-টাকা-জোড়া দরে বিকোয় কিনা, একটাকে দার্জিলিং নিয়ে যেতে বাধা কোথায়?”
“আঃ—হা! আমি কি একেবারে উত্তমকুমার-মার্কা গৌরীশঙ্করের কথা বলছি নাকি? সবার গৌরীশঙ্কর এক রকম হয় না। তোমাকে ঠিক কেমন গৌরীশঙ্কর মানাবে, তা অবশ্য ভাববার বিষয়। ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে, তা না হলে – ”
“আরে খুঁজে দেখবার দরকারটা কি, আমি তো – ” বলেই মৃণালিনী থেমে যায়। উফ্, আরেকটু হলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আর কি! যবে থেকে তাদের মধ্যে এই অদৃশ্য দাবাখেলাটা শুরু হয়েছে, তবে থেকে অনেকটাই সচেতন হয়ে উঠেছে সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে, কোনও অবস্থাতেই কিস্তিমাৎ হবে না। কিছুতেই শিল্দার আগে মুখ খুলবে না সে।
“তুমি তো কী?” শিলাদিত্য কাপটা নামিয়ে রেখে অবাকভাবে বলে।
“আমি তো – আমি তো – আমি তো আগেই জানি যে বাস্তবে গৌরীশঙ্করের মতো কেউ হয় না।”
শিলাদিত্য বিজ্ঞের মতো বলে, “হয়, হয়, জানতি পারো না। চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখবে হাতের কাছেই আছে।”
ক’দিন ধরেই শিল্দা এই ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলছে। ওর কি ধারণা, মৃণালিনী কিছু বোঝে না? কিন্তু, এত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলবারই বা অর্থ কী! ওর মনে কি আছে, সেটা তো বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এতদিনে। তবে এত হেঁয়ালী কেন? শিল্দা কি ভয় পাচ্ছে! ভাবছে, মৃণালিনী ওকে প্রত্যাখ্যান করে দিতে পারে? কিন্তু সে নিজেও তো কম ইঙ্গিত দেয়নি! স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করে যতটুকু বলা সম্ভব, অনেকবার বলেছে। তাহলেও কেন বারবার শিল্দার চোখে দ্বন্দ্ব দেখতে পায়?
“তবে খুঁজে দাও,” মৃণালিনী বলে উঠল।
শিলাদিত্য চমকে উঠল, “অ্যাঁ!”
“বললে না, গৌরীশঙ্কর নাকি হাতের কাছেই আছে? তাহলে খুঁজে বার করে দাও, দেখি পারো কিনা।”
“আরে, আমি কেন? খুঁজবে তো তুমি। প্রেমিক খুঁজতেও তোমার ডেলিভারি-বয় চাই? তাহলে তো মহা মুশকিল!”
প্রত্যেকবার এইভাবে পালিয়ে যায় শিল্দা। কিছুতেই যেন ওকে ধরা-ছোঁয়া যায় না! সেইদিন ক্লাসে এ.জি. ‘Marina’ পড়াচ্ছিলেন না? সেই যে কুয়াশা-মোড়া দ্বীপ, সেখানে নাবিক পৌঁছাতে চাইছে, কিন্তু গন্তব্যের খুব কাছে এসেও তা যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে! উফ্, এলিয়টের আত্মা কি শিল্দার উপর ভর করল! ... “প্রেমিক খুঁজতেই চাই না। বন্ধু অনেক ভাল। লাস্টিং।”
“বেশ তো, তাহলে বন্ধুই খোঁজো।”
“খুঁজতে যাব কেন? আমার তো বন্ধুর অভাব নেই। আই হ্যাভ্ দ্য বেস্ট ফ্রেণ্ডস্ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। নীরা তো আছেই, তাছাড়া উপলা, শরণ্যা, তিলোত্তমা – একসাথে এতগুলো ভাল বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
শিলাদিত্য বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর আলতোভাবে হেসে বলল, “তোমার লীস্টে আমার নাম নেই দেখছি।”
মৃণালিনী মনে মনে জিভ কাটল। সে একটা বেপরোয়া মুখোশ পরার জন্য ইচ্ছে করেই শিল্দার নামটা বাদ দিয়ে বলেছিল। তাড়াতাড়ি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু শিলাদিত্য থামিয়ে দিয়ে আশ্বাসের সুরে বলল, “আরে না রে বাবা, ইট্স ওকে। সমবয়সীরা তো বেশি বন্ধু হবেই। সেটাই স্বাভাবিক। আর, তুমি না বললেও আমি জানি, তুমি আমাকে বন্ধু বলেই ভাবো।”
কিছুক্ষণ আবার চুপ্চাপ কাটে। এতক্ষণে অন্ধকার গাঢ় হয়ে গিয়েছে বেশ, কিন্তু দোকানের উষ্ণ অন্তরঙ্গতা ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। খানিক পর আবার মৃণালিনীই কথা শুরু করে।
“কবে ফিরবে আসাম থেকে?”
“সাতাশ তারিখ। প্রথমে যাব গৌহাটি, সেখান থেকে তেজপুর, তারপর ভালুকপং, তারপর তাওয়াং ... ভালুকপঙে থাকবার রাতটা পূর্ণিমা পড়েছে। শুনেছি চাঁদনী রাতে হাতিরা জিয়াভরলী নদীতে জল খেতে আসে। মাঝে মাঝে বর্ডার পেরিয়ে অরুণাচলের জঙ্গলের হাতি এদিকে ঢুকে পড়ে, তখন জঙ্গলের গার্ড আবার তাদের অরুণাচলের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। কি অদ্ভুত, জানো, ফট্ফটে জ্যোৎস্নার মধ্যে নদীর পাড়ে বসে নুড়িপাথরের উপর স্বচ্ছ জল বয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তোমার একবারের জন্যেও বর্ডারটা চোখে পড়বে না। মানুষ যে কিসের আনন্দে সবকিছুতে একটা বর্ডার টেনে রাখে! সারা পৃথিবীর বুকে, দেশের মাঝে, রাজ্যের মাঝে, ঘরের মাঝে, এমনকি সম্পর্কের মাঝেও ... ”
একটানা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল শিলাদিত্য। হয়তো মৃণালিনীর কাছে একটা উত্তর আশা করছিল, তা না পেয়ে কিছুটা অন্যমনষ্কভাবেই বলে উঠল, “কে জানে, ফিরে আসার পরে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হয়ে যাবে।”
মৃণালিনী কৌতুহলী হয়ে বলে, “কি রকম?”
“তা জানিনা ... হয়তো জীবনে নতুন কিছু ঘটবে।”
মৃণালিনী চাপা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, “কি ধরণের নতুন?”
“তা কি বলা যায়!” শিলাদিত্য হাসল, “কত কিছুই তো হতে পারে, তাই না? ধরো, দুম্ করে চাকরী ছেড়ে দিলাম। কিংবা, নতুন কোনো বন্ধুত্ব হল। আবার এও হতে পারে, যে পুরোনো কোনো বন্ধুকেই নতুনভাবে পেলাম ... পসিবিলিটির কি কোনো শেষ আছে?”
মৃণালিনীর বুক ঢিপ্ঢিপ্ করে উঠল। শেষ কথাটায় কী বোঝাতে চাইল শিল্দা? পুরোনো বন্ধুকে নতুনভাবে কেমন করে পাওয়া যায়? তবে কি ... তবে কি শিল্দা এতদিনে সত্যিই সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে? আসাম থেকে ফিরে তাকে বিশেষ বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেবে, এই কথাটাই কি ঘুরিয়ে বলে দিল, যাতে সে তৈরি থাকে? কিন্তু ... যদি বলতেই হয়, তাহলে আসাম যাওয়ার আগেই কেন বলে দিচ্ছে না, আজ, এখানে বসেই? সাতাশ তারিখটাকে হঠাৎ ভীষণ দূর মনে হল মৃণালিনীর; ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। শিলাদিত্য ব্যাপারটা খেয়াল করলেও আর কিছু বলল না। সত্যিই এখন ওঠবার সময় হয়ে গেছে।
বাড়ি ফেরার পথটুকুতে আর কোনো কথা হল না। কি যেন ভাবতে ভাবতে আসছিল শিলাদিত্য। নিজের বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছে মৃণালিনী সবেমাত্র তার দিকে ফিরতেই, হঠাৎ যে কি হল! শিল্দা বিনা নোটিসে তাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিস্ফিস্ করে বলল, “গুড্নাইট।”
তারপর পত্রপাট বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল সে। মৃণালিনী ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। তারপর অস্ফুটে বলে উঠল, “যাঃ শালা!”
অন্যমনষ্কভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে বসেছিল উপলা। আজ সারাদিন নানারকম অশান্তি গেছে। সকালবেলা থেকেই তো বাসের ঘটনাটা দিয়ে শুরু হয়েছিল। তার সহযাত্রীর আহত মুখটা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছিল না। ভেবেছিল রনের বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতেই বিষয়টা ভুলে যাওয়া যাবে, কিন্তু সে গুড়ে বালি। সর্বক্ষণ আনমনা হয়ে কি যেন ভেবে গেল মেয়েটা! উপলা চেষ্টা করেও কথাবার্তা জমাতে পারেনি। অগত্যা হতাশভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি হয়েছে বল্ তো?”
শরণ্যা একটু ফ্যাকাশে হেসে জবাব দিল, “আসলে সকাল থেকে মুডটা তেমন ... একেই রঙ্গীতদা আবার বেপাত্তা। কতদিন হয়ে গেল, একটা ফোন নেই, মেসেজ নেই। আমি বেশ কয়েকবার মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, জবাব দেয়নি।”
বাড়ি ফেরার সময় এমনিই মনটা বিষন্ন লাগছিল। কণিষ্ককে তাই আসার জন্য ফোন করেছিল। ঘন্টাখানেক ওর সঙ্গে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালেও হয়তো ভাল লাগবে। ফোনে ওর গলা শুনেই কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু বাস থেকে নেমে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। এমন চেহারা কি করে হল কণিষ্কর! গত সপ্তাহেই দেখা হয়েছে, তখন তো দিব্যি ছিল! তাহলে আজ চোখদুটো এরকম জবাফুলের মতো লাল, উস্কো-খুস্কো চুল, তিন দিনের না-কামানো দাড়ি ... !
উপলা ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে তারপর বলল, “কি ব্যাপার কণিষ্ক? তুই গায়ে জ্বর নিয়ে উঠে এসেছিস নাকি?”
কণিষ্ক নিজের মুখের উপর হাত চালিয়ে অন্ধকারটাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল যেন। তারপর মৃত স্বরে বলল, “কিছু হয়নি তো।”
উপলা অবশ্য তার আগেই ওর কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে নিয়েছে। কিছু না পেয়ে চিন্তিতভাবে বলল, “তাই বল্, খুব রাত জেগে প্রি-বোর্ডের পড়া পড়ছিস, তাই না? আরে কিন্তু তাই বলে শরীরের চোদ্দটা বাজালে চলবে? চল্ আমার সঙ্গে, লেক্-এর ধারে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে আসি। এই বেলা তিনটের সময় ওখানটা নিশ্চয়ই ফাঁকাই থাকবে।”
কণিষ্ক বিনা বাক্যব্যয়ে উপলার সঙ্গ নিল।
“ ... তারপর – বললে বিশ্বাস করবি না – ওইরকম কান্নাকাটির মধ্যেও আমাকে হ্যারি-পটার-রেফারেন্স দিল ছেলেটা! বলে কিনা, ‘তুমি কি প্রফেসর লুপিন, বাসে-ট্রামে লোকজনকে চকলেট খাইয়ে তাদের মনের ডিমেন্টার্স তাড়িয়ে বেড়াও?’ আমি তো শুনে জাস্ট হাঁ করে তাকিয়ে আছি; এদিকে এরকম ক্রাইসিস, এদিকে হ্যারি পটার – ”
“স্টপ ইট!”
উপলা চমকে উঠে কণিষ্কর দিকে তাকাল। খুব একটা চেঁচিয়ে না হলেও, এত জোর দিয়ে বলল কথাটা, মনের মধ্যে বিঁধে গেল যেন। এরকমভাবে তো কখনও বলে না! তাহলে কি সত্যিই কিছু সমস্যা হয়েছে?
“সরি ... ” কণিষ্ক একটু থমকে গিয়ে বলল, “আমার ... আমার জাস্ট কিছু ভাল লাগছে না।”
উপলা তার দিকে সরে এসে বলল, “এক্স্যাক্টলি কী হয়েছে বল্ তো? আমি তো সেই কখন জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই তো বললি না! কী এমন ঘটেছে যা আমাকে বলতে পারছিস না?”
“কি করে বলব!” কণিষ্ক হঠাৎ যেন ফেটে পড়ল, “কাকে বলব! তোর লাইফটা কি আদৌ আমার মতো, যে তুই বুঝতে পারবি? তুই এখনও ... তুই কতটুকু দেখেছিস মানুষকে? জানিস তাদের জীবনে কি কি ঘটতে পারে? য়ু স্টিল ফ্লাই অ্যারাউণ্ড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অফ বুক্স অ্যাণ্ড ফ্যান্টাসীজ্! তোর জীবনে কোনো প্রবলেম নেই, কোনো ওয়ারিজ্ নেই – হাউ উড্ য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড! কি করে বুঝবি আমি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি?”
উপলা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিল কণিষ্কর দিকে। সে যে খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে তা বলাই বাহুল্য। মাথা গরম করে মানুষ অনেক সময় এমন কিছু কথা বলে ফেলে যেটা পরে নিজেরাও বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমনটা তো মনে হল না! বরং কণিষ্ক যে তার এতদিনের জমে ওঠা অভিযোগগুলো আর মনের মধ্যে চেপে রাখতে না পেরে একসাথে উগরে দিচ্ছে, সেটাই স্পষ্ট হয়ে উঠল। উপলার অনুমানই ঠিক; কণিষ্ক অনেক কিছুই লুকিয়ে যাচ্ছিল তার কাছে। সম্ভবতঃ আরও অনেকদিন লুকিয়ে যেত, কিন্তু কোনো কারণে তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। খুব অভিমান হতে পারত উপলার, কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু অসহায় রাগ আর যন্ত্রণায় পুড়তে থাকা কণিষ্কর মুখটা দেখতে পাচ্ছিল সে।
ধীর গলায় বলল, “আচ্ছা বেশ, তুই বল্ তো আগে, যে কী হয়েছে? আমি বুঝি আর না বুঝি, তাতে কি এল গেল? মনের মধ্যে এ জিনিসটা কষ্ট দিচ্ছে সেটাকে বের করে দে, দেখবি ওতেই অনেকটা আরাম লাগছে।”
“মা ইজ হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার।”
খবরটা এতই অপ্রত্যাশিত, যে উপলা খানিকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারে না। কণিষ্ক বিষয়টাকে আরেকটু পরিষ্কার করে বলে কিনা দেখার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল, “কবে থেকে?”
“অনেকদিন। ইন্ ফ্যাক্ট ডিভোর্স হবার ইমিডিয়েট কারণ এটাই ছিল।”
এটা সত্যিই ধাক্কা পাওয়ার মতো খবর, উপলার কাছেও। সে এতদিন অবন্তিকাকে অন্যায়ের শিকার ভেবে এসেছে। ভেবে এসেছে যে রবিন আঙ্কল একজন হৃদয়হীন মানুষ। কিন্তু কণিষ্কর উপরে যতই অবিচার তিনি করে থাকুন না কেন, অবন্তিকা আন্টির সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যে হয়তো শুধুই তাঁর একার দায় নেই!
“তুই কিভাবে জানতে পারলি?”
“মা যখন লোকটাকে ফোন করছিল তখন খানিকটা কথাবার্তা শুনে ফেলেছিলাম। তখনই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর দাদাকে ভীষণভাবে চাপাচাপি করাতে আমাকে সবটা বলল।”
এর উত্তরে কী বলবে সেটা গুছিয়ে নিতে বেশ খানিকটা সময় লাগল উপলার। কণিষ্কর যা মনের অবস্থা, তাতে খুব সাবধানে কথা না বললে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তবু, এই মুহূর্তে ওর মায়ের প্রতি মনটা যে একেবারে বিরূপ হয়ে আছে, সেটাও তো ভাল নয়! এই মনোভাবটা ওর কষ্ট উত্তরোত্তর বাড়িয়েই তুলবে।
“দেখ্,” উপলা আস্তে আস্তে শুরু করল, “আই ক্যান আন্ডারস্ট্যাণ্ড। সত্যি বলছি, তুই যে কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস, আমি একটু হলেও বুঝতে পারছি। এই গণ্ডগোলে তোকে একটা সাইড নিতে হয়েছিল, যেটা এমনিতেই একটা অসম্ভব কাজ। তুই তাও শেষ পর্যন্ত আন্টিকে সাপোর্ট দিয়েছিস, আর তার জন্য তোকে কম সাফার করতে হয়নি। আর সেই কারণেই যখন এরকম একটা ঘটনার কথা জানতে পারলি, তখন য়ু ফিল আটারলি বিট্রেয়েড্। সেটা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয়, তুই যদি পুরো ব্যাপারটাকে একটা মাত্র অ্যাঙ্গেল থেকে বিচার করিস, তাহলে তোর কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। দেখ্, আমি জানি না অবন্তিকা আন্টি কী ভেবে এই কাজটা করলেন। কিন্তু তুই আমাকে যা যা বলেছিলি, তার থেকে তো মনে হয় যে শেষদিকে আঙ্কল-আন্টি দুজনেই পরস্পরের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তখন হয়তো আন্টির কাউকে দরকার হয়েছিল, যার সাথে নিজের প্রবলেমগুলো অন্ততঃ খোলাখুলি শেয়ার করা যায়। আই থিংক তোর একবার আন্টির সঙ্গে কথা বলা উচিৎ। এরকমও তো হতে পারে বল্, আফটার এভরিথিং শি হ্যাজ বিন থ্রু, উনি হয়তো ভিতরে ভিতরে খুব একা ফিল্ করছিলেন – ”
“একা!”
কণিষ্ক এতক্ষণ দুহাতে মাথা চেপে ধরে একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবারে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
“একা! একা বলেই হঠাৎ এই বয়সে অ্যাডভেঞ্চার করার সখ জাগল! নিজের ছেলের বয়সী একটা ফালতু লোকের সঙ্গে ... ছিঃ! আর তুই বলছিস আমি ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলব? আফ্টার হোয়াট শি হ্যাজ ডান্ টু মী? বেশ করেছে বাবা অ্যালিমনী দেয়নি! আমি হলে এত সহজে ছেড়ে দিতাম না! আমি হলে ... ”
কথা শেষ না করেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল কণিষ্ক। উপলা তাকে থামানোর চেষ্টা করল না; সেই মনের অবস্থা আর নেই। অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো লেকের পাড়েই বসে রইল সে। মাথাটা কাজ করছে না। কী বলে গেল কণিষ্ক? ছেলের বয়সী একটা লোকের সঙ্গে ... ! ঠিক শুনেছে তো?
কতক্ষণ এইরকম ঘোরের মধ্যে বসেছিল খেয়াল নেই। হুঁশ ফিরতে দেখে, কখন যেন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ঝোপেঝাড়ে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আর সেই অন্ধকারে ছায়াদের ভিড়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল উপলা। বড়জেঠির কাছে দেরি করে ফেরার শাস্তি হিসেবে দু-বাটি হালুয়া খেয়ে, বড়দা-সঞ্জুদার সঙ্গে খানিকক্ষণ ভিডিও-গেম নাড়াচাড়া করে, পড়ার ঘরে গিয়ে, আবার ফিরে এসে, এখন নিজের ঘরের জানলার তাকের উপর বসে আছে।
সকালটা কত সুন্দর ছিল! বাসে ওঠা পর্যন্ত কোনো বিভ্রাট হয়নি। যত নষ্টের গোড়া কি তবে ওই ছেলেটা? এ কথা ভেবেই উপলা জোরে জোরে মাথা নাড়ল; নাঃ, কিসের সঙ্গে কী মেলাচ্ছে সে! বেচারার দিনটাই বরং বেশ খারাপ যাচ্ছিল – তার সঙ্গে উপলার জীবনের কি সম্পর্ক?
সত্যি বলতে, সমস্যাটা তো আদপেই তার নয়। তার জীবনে কোনোদিন কোনো বাজে গণ্ডগোল ছিল না, নেইও। ভগবানের দয়ায় হয়তো বাকি জীবনটাও এইভাবে কেটে যাবে। কিন্তু তার আশেপাশের লোকজনের সাথে যা এক-একখানা ঘটনা ঘটছে, তাতে করে উপলার পক্ষেই বা কি করে সুস্থির হয়ে থাকা সম্ভব? এ তো আচ্ছা বিপাকে পড়া গেছে!
কণিষ্ককে কি ফোন করে খবর নেবে একবার? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছিল এই ক’দিন নাওয়া-খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভাল হত, ওর বাড়ি গিয়ে সরেজমিনে ব্যাপারটা কতদূর গড়িয়েছে তা বুঝে আসা। কিন্তু ... যা শুনল, তারপর কি করে অবন্তিকা আন্টির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে? ...
“কি ব্যাপার, আওয়াজ নেই যে বড়?” কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কথাই, আজ সারাদিন মা-বাবার সঙ্গে দেখাই হয়নি। দুজনে অফিস থেকে ফেরেই অনেক দেরি করে, আর আজ তো উপলাও বেশির ভাগ সময়টাই বাইরে কাটিয়েছে।
সে চট্কা ভেঙে টান হয়ে বসে বলল, “কটা বাজে?”
“বাজে তো অনেক,” মা নির্বিকারভাবে বলে, “কিন্তু তোর মুখ দেখে তো বারোটা বেজে গেছে বলে মনে হচ্ছে আমার। কেসটা কি?”
উপলা অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেশ বলল, “আমি কি বোকা?”
মা ততক্ষণে বিছানায় আরাম করে লম্বা হয়েছে।
“বোকাদের মনে তারা বোকা কিনা এ প্রশ্ন কখনও জাগে বলে তো শুনিনি।”
“ঠিক সেরকম নয় ... মানে, আমি কি ইম্ম্যাচিওরড্?”
“তোমার নিজের কি মনে হয়?”
উপলা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “আরে আমার মনে হওয়া-না হওয়া দিয়ে কি এসে যায়? আশেপাশের লোকজন যা বলছে তার থেকে তো – ”
“আশেপাশের লোকজন? তারা আবার কারা?” মা ভুরু তুলল।
“এই যে ... এই যে ধরো তোমরাই। একসঙ্গে এতগুলো লোক মিলে থাকো, নিশ্চয়ই তোমাদের লাইফেও নানারকম প্রব্লেম আছে। কই, কখনও তো সেসব কথা আমার কানে পৌঁছায় না? বড়দা-সঞ্জুদার পর তো আমিই এ বাড়ির বড় মেয়ে, নাকি! তা আমার সঙ্গে তো কখনও কোনো সিরিয়াস আলোচনা করার চেষ্টাই করোনা! তোমাদের কি ধারণা আমি বুঝতে পারব না, নাকি হ্যাণ্ডেল করতে পারব না, নাকি – কোন্টা?”
“এক সেকেণ্ড, কি ব্যাপারটা বলো তো?” মা এবার বাস্তবিক অবাক হয়ে বলে, “বড়দের ঝামেলা যেচে ঘাড়ে নেওয়ার সখ চাপল কেন হঠাৎ? এটা কি বাজারে নতুন ফ্যাশান উঠেছে?”
“আঃ!” উপলা বিরক্ত, “কী যে বলো না, কোনো মানে হয় না। এই তো আজ দুপুরে কণিষ্ক তার লাইফের লাফড়া শোনাতে গিয়ে কি ঝাড়টাই না দিল! আমি নাকি কিছু বুঝি না। আমার জীবনে কোনো সমস্যা নেই তো, তাই আমি কারোর জীবনের সমস্যা বুঝতে পারব না। আমি এখন মালটাকে বোঝাই কি করে, যে জীবনে প্রবলেম হওয়া-না-হওয়া আমার হাতে নেই!”
মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, “কী সমস্যার কথা বলছিল কণিষ্ক? অবন্তিকাদির ব্যাপারে কিছু নাকি?”
উপলা চমকে উঠে বলল, “তু-মি-ও জানো?”
“সবটা জানি না। রবিনদা একদিন তোর বাবাকে ওঁর কি একটা ফিন্যানশিয়াল দরকারে ফোন করেছিলেন, আর বলেছিলেন এটা যেন তোর কানে না যায়, কারণ কণিষ্ক কিছু জানে না। তখন বোধহয় তোরা আই.সি.এস.ই দিচ্ছিস। তখন খুব ঝামেলা চলছিল ওদের বাড়িতে, মনে নেই? ওইসব গণ্ডগোলের মধ্যেই তো শাক্য আমেরিকা চলে গেল। তখনকার ব্যাপার।”
উপলা খানিক হাঁ করে থেকে তারপর বলল, “আমাকে এটা বলোনি কেন?”
“আরে, বললাম যে রবিন্দা বারণ করেছিলেন!”
“সে তো দু-বছর আগে, তারপর তো – ”
“তারপর কী?” মা কাঁধ ঝাঁকালো, “তোর কি খবরটা পেতে খুব ভাল লাগত? এখনই কি লাগছে? একদিন না একদিন কণিষ্ক ঠিকই জানতে পারত, আর আমি জানি ও তোকে এটা ঠিকই বলত তখন; মুখে যতই বলুক যে তুই কিছু বুঝিস না।”
উপলা অন্যমনষ্কভাবে বিড়বিড় করল, “বুঝতে হয়তো পারতাম, কিন্তু ছেলের বয়সী একজনের সঙ্গে অ্যাফেয়ার করার ব্যাপারটা সত্যিই মাথায় ঢুকছে না।”
“অ্যাঁ!” মা উঠে বসে বলল, “কি বললি, কার বয়সী?”
“কেন, এটা শোনোনি?”
“কি করে শুনব, বললাম না রবিন্দা ফোনে যা বলেছিলেন সেটুকুই জানি? ... এক মিনিট, হাউ ইজ দ্যাট ইভেন লীগাল?” মা খানিকটা নিজের মনেই বলা শুরু করল, “যদি শাক্যর বয়সীও হয়, তাহলে তো ... টোয়েন্টি সিক্স, আর দু-বছর আগে হলে ... না, ওই বাইশ-তেইশ, মানে একুশের উপরেই, কিন্তু ... ”
“আঃ, মা!” উপলা অধৈর্য্যভাবে বলে, “তুমি আবার এখন এইসব হিসেব নিয়ে পড়লে? আমি এদিকে নিজের জ্বালায় জ্বলে মরছি!”
“না না, আমি তো লীগাল ব্যাপারটার কথা ভাবছিলাম। সেদিক দিয়ে অবশ্য ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে? কি বলছ তুমি! আন্টির ওর বয়সী ছেলে আছে একটা!”
“তো?” মা হাত ওলটায়।
উপলা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। সে ভেবেছিল মা ব্যাপারটা শুনে ভীষণ রেগে যাবে, এমনকি উপলাকে হয়তো কণিষ্কর সঙ্গে মেলামেশা করাও কমিয়ে দিতে বলতে পারে। কিন্তু এখন তো দেখছে এর কোনো হেলদোলই নেই!
মা হয়তো তার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেই বলল, “দেখো পলা, ম্যাচিওরিটির প্রশ্ন যখন উঠেই এল, তখন তোমাকে একটা কথা বলি। বড় হওয়ার প্রথম লক্ষণটা কি জানো? একা একা থাকতে পারা, চাকরি করা, নিজের ফ্যামিলি তৈরি করা – এগুলোর কোনোটাই নয়। সারা জীবন বড় না হয়েই হাজার হাজার লোক এই ছকের মধ্যে পড়ে দিব্যি বেঁচে বর্তে থাকে। কিন্তু সত্যিকারের প্রাপ্তমনষ্ক হতে পারার প্রথম কণ্ডিশানটাই হচ্ছে, নিজের ভ্যালুজ এবং নিজের মরালিটি-বোধের মাপকাঠি দিয়ে চোখ বুজে অন্যকে বিচার না করা। কেউ কিছু একটা করল, যেটা তোমার ভাল লাগল না – না লাগতেই পারে। কিন্তু তাই বলে তুমি তাকে আক্রমণ করতেও পারো না, তার গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দিতেও পারো না। সবার সিচুয়েশান তো আর একরকম হয়না! এই তোমার আন্টির কথাই ভাবো। এরকম একটা গোলমেলে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁর ছেলেরা সত্যিই খুব হার্ট হয়েছে, রবিনদার কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তিনি এই গল্পের মধ্যে আদৌ ঢুকলেন কেন তা তো তুমি জানো না। একাকীত্ব মানুষকে কিভাবে পাগল করে দেয় তা তুমি এখন ধারণা করতে পারবে না। এটা তো ঠিক, রবিনদা কোনোদিনই পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারতেন না, অবন্তিকাদির সঙ্গেও বহুদিন ধরেই নানারকম অশান্তি করতেন, খারাপ ব্যবহারও করতেন। এদিকে ছেলেরাও বড় হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় হয়তো এমন কারো সঙ্গে অবন্তিকাদির পরিচয় হয়েছিল যে কিছুটা হলেও মানসিকভাবে শান্তি দিচ্ছিল তাঁকে। সেটাই পরে একটা অন্য দিকে গড়িয়ে গেছে। হতে পারে না এরকম?”
উপলা মন দিয়ে সবটা শুনে বলল, “আশ্চর্য, জানো। আমি কণিষ্ককে ঠিক এই কথাটাই বলছিলাম। বলতে গিয়েছিলাম যে আন্টি হয়তো খুব লোন্লি হয়ে গিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য ও আরও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। কিন্তু তখনও বয়সের ব্যাপারটা – ”
“ওরে শোন্। আমার এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে এসে তোকে একটা কথা বলতে পারি; সম্পর্কের অতশত বয়স থাকে না। ওটাও অনেকটা সামাজিক ব্যাপার। হ্যাঁ, এখন ছেলেটা যদি অ্যাডাল্ট না হত, তাহলে একটা ভাববার বিষয় ছিল বটে, কারণ সেটা একটা বে-আইনি কাজ। সেরকম কিছু হলে তখন তার বাবা-মা, কোর্ট-কেস, সব মিলিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হত। তবে অবন্তিকাদি এতটা ইরেস্পন্সিবল্ কাজ কখনই করতেন না – যতই হোক, উনি একটা স্কুলে পড়ান। তবে কণিষ্কর ব্যাপারটা খুব স্যাড। জানল জানল, একেবারে টেস্ট পরীক্ষাগুলোর মুখে! এরকমভাবে কী রেজাল্ট করবে ছেলেটা?”
উপলা বলল, “আচ্ছা মা, ওকে পরীক্ষার কটা দিন আমাদের বাড়িতে এসে থাকতে বলব?”
মায়ের চলে যাওয়া দেখতে দেখতেই উপলা অবাক হয়ে ভাবল, ‘ছড়িয়ো না’ কথাটা কোথা থেকে শিখল রে বাবা! মাঝে মাঝে এমন সব বলে, শুনে চমকে-চমকে উঠতে হয়! ... তবু যা হোক, অনেকটা হালকা লাগছে এখন।
হঠাৎ ফোনটা নড়ে উঠল। তুলে দেখে কণিষ্কর মেসেজ। তাহলে কি সত্যি সত্যিই রাগ পড়ল? তাড়াতাড়ি মেসেজটা খুলেই থমকে গেল উপলা। দীর্ঘ একটা মেসেজঃ
দুপুরের ব্যবহারের জন্য সরি। আই হ্যাভ বীন গোয়িং থ্রু হেল। তাই আজকে এতটা রি-অ্যাক্ট করে ফেলেছি। আসলে আমি তোকে ব্যাপারটা বলতে চাইনি। একেই তোকে কোনোদিন এই ধরণের ঘটনা ফেস করতে হয়নি, তার উপর সামনেই প্রি-বোর্ড। তবে আমি সত্যিই নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। আফ্টার অল্, আই ট্রাস্টেড্ হার।
এই কটা দিনে মাই ওয়ার্ল্ড হ্যাজ টার্ন্ড আপসাইড ডাউন। আমি কখনো ভাবিনি এমন একটা সময় আসবে যখন তোকে এই কথাটা বলতে হবে; কিন্তু অনেক কিছু বদলে গেছে। তাই, আই অ্যাম সরি পলা, বাট উই কান্ট বী ফ্রেণ্ডস এনিমোর। অনেকদিন আগে তোর আর আমার জগৎটা একই রকম ছিল; কিন্তু এখন আমি অনেক বেশি অন্ধকারে চলে গিয়েছি। বাট্ য়ু আর স্টিল ফুল অফ্ সানশাইন। য়ু ডিজার্ভ বেটার। ভাল থাকিস।
উপলা যে কতবার মেসেজটা পড়ল তার ঠিক নেই। কিছুতেই কথাগুলো মাথায় ঢুকছিল না। কণিষ্ক কি পাগল হয়ে গেল! ফোনটা তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে নম্বর ডায়াল করল সে। বেজে বেজে কেটে গেল; কণিষ্ক ধরল না। উপলা আবার ফোন করল। আবার। আবার। ওপার থেকে কোনো সাড়া নেই, শুধু একটানা যান্ত্রিক শব্দ।
এই ক’দিনে কেমন একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। রাত্তির দুটো অবধি জেগে জেগে পূজনের সঙ্গে মেসেজে কথা বলে শরণ্যা। হপ্তাখানেক আগে হঠাৎ করেই একদিন রাতের বেলায় মেসেজ পেয়েছিল, “জেগে আছো?”
প্রথমটা একটু অবাক হলেও, সাত-পাঁচ ভেবে জবাব দিল, “আছি।”
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “কেন?”
শরণ্যা তাজ্জব হয়ে লিখল, “কারণ ... আমার রাত জাগা হ্যাবিট।”
এবারে উত্তরটা একটু দেরি করে আসে, “আমারও। প্রায়ই মাঝরাতে আমি হাঁটতে বেরোই। তখন শহরের একটা অন্যরকম চেহারা হয়। আই এন্জয় দ্যাট্।”
শরণ্যা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় থাকো?”
“কলেজ স্ট্রীটের খুব কাছে। তুমি?”
“গড়িয়ার কাছাকাছি।”
“আঃ। তোমাদের ওখানকার ছবিটা কেমন জানি না। তবে এখানে শহর কখনও শোয় না। সব সময়ই কিছু না কিছু ঘটতে থাকে রাস্তার উপর, গলির অন্ধকারে ... দেয়ার ইজ সো মাচ লাইফ আফটার ডার্ক্নেস।”
“সেই জন্যেই কি তোমার কবিতায় এত অন্ধকার?” ...
সেই যে শুরু হল, তারপর থেকে রোজই এই ব্যাপার চলছে। প্রথম দু-দিন দশ-বারোটা মেসেজ্-এর পরেই থেমে গেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, মেসেজের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। পরশুদিন তো মেসেজ করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শরণ্যা। উঠে দেখে, সকাল হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে ফোনে দুটো বাড়তি মেসেজ।
তাদের এই নৈশ কথোপকথনের ব্যাপারটা আর কেউ জানেনা। মম্-ড্যাড তো না-ই, উপলা, মৃণালিনী, তিলোত্তমা, নীরা, কেউ না, এমনকি ছোটমাসীও না। অথচ এমন নয় শরণ্যা বিষয়টা লুকোতে চেয়েছে। কথা-প্রসঙ্গেই বলা হয়ে ওঠেনি কাউকে। কিন্তু ... সেটা বলাও কি সম্পূর্ণ সত্যি? এই তো আজ অর্ধেক দিনটাই উপলার সঙ্গে কাটল। প্রসঙ্গের অভাবে আড্ডাটা জমলই না ভাল করে। পল্ বেচারা যে একটু হতাশ হয়েই চলে গেল, সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না তার। ইচ্ছে করলে কি আজকে পূজনের ব্যাপারটা বলা যেত না ওকে? কিন্তু তখন প্রসঙ্গটা মাথাতেই এল না! তার মানে নিশ্চয়ই তার অবচেতন থেকেই একটা বাধা আসছে। কিন্তু কেন? এই কটা দিনে এমন কিছু কথাবার্তা তো বলেনি তারা, যা অন্য কাউকে জানাবার মতো নয়? বেশিরভাগটাই সাদামাটা মেসেজ। কিছু কিছু কবিতা-গানের লাইন। দু-একটা পূজনের দার্শনীক-মার্কা প্রশ্ন। তা নিয়ে এত গোপনীয়তার কী? তবু শরণ্যার যেন এরকমই ভাল লাগে। মনে হয়, পূজনের চিঠিগুলো ব্যক্তিগত ডায়রির মতো। তাতে গোপনীয় কিছু থাকুক-না-থাকুক, সেটা পড়ার, বা তার সম্পর্কে জানার অধিকার কারুর নেই।
কিন্তু দিনে দিনে ওপারের লোকটাকে ভালভাবে চেনার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠছে। হপ্তাদুয়েক ধরে একনাগাড়ে কথা বলে যাওয়ার পরেও তার মনে হচ্ছে, কিছু তো জানা গেল না এই রহস্যময় কবির ব্যাপারে! কোথায় থাকে বলেছে বটে, কিন্তু কেমনভাবে থাকে, কিরকম বাড়ি, সেখানে কে-কে আছে, কিছুই তো বলেনি। সে কি শুধুই কবিতা লেখে, নাকি অন্য কাজকর্ম কিছু করে, তাও শরণ্যা জানে না। শুধু পূজনের কলম ভীষণভাবে টানে ওকে। ইচ্ছে করে ওর মস্তিষ্কের ভিতর ঢুকে পড়তে, এই শহরটা ওর চোখ দিয়ে দেখতে।
সত্যি, শহর নিয়ে যে কত কবিতা লিখেছে ছেলেটা! এমনভাবে সে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মানচিত্রটা মিলিয়ে দিতে পেরেছে, যে ওর কবিতা পড়লে মনে হয় বুঝি স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় খুব চেনা অলিগলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। শহরকে নিজের হাতের পাতার মতো চেনে পূজন, বিশেষ করে রাতের শহরকে। শরণ্যার চোখের সামনে এক আগন্তুকের চিত্রকল্প ভেসে ওঠে; মধ্যরাতে যে শহরের আনাচে-কানাচে হ্যালোজেনের আলো বাঁচিয়ে ক্ষুধিত আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায়। সে কি এই শহরেরই আত্মা? ...
বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমানে এইসব হাবিজাবি ভেবে মাথাটা ক্রমশই গরম হয়ে উঠেছিল শরণ্যার। কে জানে, ক’দিন ধরে পূজনের কথা এত কেন ভাবছে! উত্তরটা অবশ্য নিজেই কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে গেল। রঙ্গীতদা হঠাৎ করে এভাবে গায়েব না হয়ে গেলে হয়তো এতটা ভাবত না সে। কিন্তু এখন ওর চলে যাওয়া নিয়ে ভিতরে ভিতরে এতটাই একা হয়ে পড়েছে, যে সম্পূর্ণ অচেনা একজন লোকের ব্যাপারে চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠেছে একদম। এর ফল যে পড়াশোনার উপরে গিয়েও পড়েছে, সেটাও বেশ বুঝতে পারছে সে। কিন্তু তারই বা কী করার আছে? তার চার বন্ধু তো জ্বলে মরছে নিজেদের জ্বালায়। এদিকে শরণ্যার জীবন থেকে রঙ্গীতদার পরোক্ষ উপস্থিতিটাও চলে যেতে বসল। ... এই অবস্থায় আর কী দিয়ে শূন্যস্থান ভরাত সে?
ঠিক মাঝরাতে পূজনের মেসেজ ঢুকল। ফোনের আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেল শরণ্যার। ইন্বক্স খুলে দেখল, লেখা আছে, “একদিন অনেক-অনেক কবিতার জন্য আমার বাড়ি আসবে?”
(ক্রমশ)