মামান অবশ্য কোথাও গেলেন না। কপালের ঘাম মুছে বললেন, “উফ্, আজকালকার ছেলেমেয়েদের হ্যান্ডেল করাও বিপজ্জনক। দীপাদি, ভাববেন না, ও সুই—মানে কোনো গোলমাল করবে বলে মনে হচ্ছে না।”
এই বলে তিনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে দরজার সামনে পাহারাদারের মতো বসে রইলেন। মেজজেঠিমা এখনো পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটা চোখ বড় বড় করে দেখে যাচ্ছিলেন শুধু। এবারে আর না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “ওটা কি করছ ভাস্কর?”
মামান বললেন, “সাবধানের মার নেই। সন্দেহজনক কিছু আওয়াজ পেলেই দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ব।”
নটা বেজে গেল, ফোনের পাত্তাই নেই! উপলা মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছে শুধু। দমবন্ধ উত্তেজনায় হার্টটা ফেল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সেই সঙ্গে অবশ্য মুহূর্তে মুহূর্তেই রক্ত গরম হয়ে উঠছে। কিন্তু উত্তেজনার মাত্রাটা অনেক বেশি। কি ভাগ্য করেই না শরণ্যাকে ফোনটা করেছিল! জানতেই পারত না যে মহিলা রঙ্গীতদার বাড়ি গেছে—সেই স্বনামধন্য রঙ্গীতদা! আর এই সাংঘাতিক খবরটা তার কাছেই কিনা চেপে গিয়েছিল!
অন্যান্য দিনের মতোই কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছটার সময় শরণ্যাকে ফোন করেছিল উপলা। সদ্য ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটা পড়ে শেষ করেছে। গল্পের একটা ফিরিস্তি দেওয়াটা তার কর্তব্য। রোজই দুজনের এই ধরনের অত্যাবশ্যক খবরাখবর আদান-প্রদানের ব্যাপার থাকে। তাই শরণ্যার কোনো উচ্চবাচ্চ্য নেই দেখে উপলা নিজেই বসল নম্বর ডায়াল করতে। কিন্তু ফোন তুলেই শরণ্যা বলে কিনা, “পল্, আমি একটু ব্যস্ত।”
“আরে হ্যাঁ, কিন্তু শোন্ না, ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট—”
ওপারের গলাটা ফিস্ফিস করে বলল, “একদম পারছি না রে। প্রচণ্ড সরি।”
এতক্ষণে উপলা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার বল্ তো? কোথায় তুই?”
উত্তরটা উপলার মাথায় যেন বজ্রাঘাত করে দিয়ে চলে গেল, “রঙ্গীতদার বাড়ি। সব বুঝিয়ে বলব, এখন রাখছি।”
এই বলে কটাস করে ফোন কেটে দিল মেয়েটা! সেই থেকে উপলার মনের অবস্থাটা আর বলার নয়। সঙ্গে সঙ্গে মৃণালিনী, নীরা আর তিলোত্তমাকে ফোন করে সে শরণ্যার এ হেন বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছে। বাকিরাও উপলার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। শরণ্যা যে সবার কাছে ব্যাপারটা বেমালুম গোপন করে গেছে, এটা জানতে পেরে সবাই মর্মাহত।
ঘড়িতে যখন সোয়া নটা বাজে, তখন মোবাইলটা বেজে উঠল। উপলা ততক্ষণে ক্লান্তভাবে বিছানায় লম্বা হয়েছিল। ফোনের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসল।
“বলি এতক্ষণে লাট সাহেবের সময় হল, না?”
“আই অ্যাম রিয়লি সরি পল্-–”
“রি-য়-লি সরি? ফুঃ,” শরণ্যাকে এক নিমেষে নস্যাৎ করে দেয় উপলা, “সব তোর চালাকি! ইচ্ছে করে ব্যাপারটা হজম করে ফেলার মতলব। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা—”
“এ তো হেবি ঝামেলা হল,” শরণ্যা এতক্ষণে বিরক্ত, “তোদেরকে বেশ একটা সারপ্রাইজ দেব বলে আর কিছু বলিনি। তা যথাসময়ে ফোন করে সেটা তো মাটি করলিই, এখন উলটে আবার আমাকেই ঝাড়ছিস? যত্তসব!”
উপলা একটু ঠান্ডা হয়ে বলল, “তা সে আমিই বা কী করে জানব যে তুই সবাইকে বিট্রে মারবার তালে নেই—”
“ছিঃ পল্। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও কথা গোপন করেছি আমি? আর তুই আমাকে এই রকম অপবাদ—”
“না না, আমি অত তলিয়ে ভাবিনি,” উপলা বিপন্ন, “তুই রাগিসনি। তা কি হল, বল্?”
“কী হবে?” শরণ্যা অবাক।
উপলার মেজাজ আবার সপ্তমে, “ন্যাকামি রেখে কি হল তার ডিটেল্স দে বলছি, নইলে তোরই একদিন কি আমার—”
“উফ্, ক্ষেপিস কাহে? কিছুই হয়নি। রঙ্গীতদা এবার প্রায় এক বছর পর কলকাতায় এল। মাঝখানে কাকু গিয়ে অনেকদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তাই আর আসেনি। কলকাতায় এসেই তো ও এখানকার সব বন্ধুবান্ধবদের ডাকে, তাই—”
“তাই তোমাকেও ডেকেছিল, কেমন? হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ—”
“হাসছিস কেন পাগলের মতো?”
“আনন্দের চোটে। বল্ না, তারপর কি হল?”
“কি আর হবে রে ভাই! গেলাম, ওর অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করলাম, চা-টা গিলে চলে এলাম।”
“ওই সাহিত্য আলোচনা ব্যাপারটা কি?”
“ওই তো, রঙ্গীতদার সব কটা বন্ধুই একটু-আধটু সাহিত্য-চর্চা করে। তাই ওরা সবাই এলে কে কী নতুন লেখা লিখল, কে কী নতুন বই পড়ল, তাই নিয়ে বেশ একখানা আড্ডা হয়। রঙ্গীতদা বলে ‘সাহিত্য-সভা’।”
“বাঃ, এ তো বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার! আগে তো এসব কিছুই বলিসনি, ইয়ে কোথাকার?”
“তুইই বা কনিষ্কর কেস ক’দিন আগে ফাঁস করেছিলি, ব্যাটা জামরুল?”
“হে হে, চটিস ক্যান্! আমার কি আর তোর মতো ইন্টারেস্টিং নাকি, ওটা কত যুগের পুরোনো হয়ে গেছে। যাক্ গে, কারা কারা এসেছিল?”
“যারা বরাবর আসে। ঋদ্ধিমানদা, নীলাঞ্জনদা, অনসূয়াদি, পূজন—”
“কে?”
“পূজন।”
“পূজন! পূজন আবার কেমন নাম?”
“মানুষের যেমন নাম হয় তেমন নাম।”
“বাপের জন্মে শুনিনি। কোন দেশের লোক?”
“খাঁটি বাংলা দেশের। পূজন মিত্র। আমার সঙ্গে তেমন আলাপ নেই অবশ্য। খুব বেশি কথা বলে না, চুপচাপ টাইপ। ওর বোধহয় সাহিত্যে তেমন ইন্টারেস্ট নেই। অন্যেরা সবাই বেশ নিজেদের লেখা-টেখা পড়ে, তা ইনি ওসবের ধার ধারেন না। শুধু গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। একটু অদ্ভুত গোছের।”
“সে তো নাম শুনেই বুঝেছি। গুলি মার তো, আমি কি ওসব ঢপের লোকেদের কথা শোনবার জন্য ফোন করলাম? আসল খবর সাপ্লাই কর্ না!”
শরণ্যা হেসে ফেলল, “কী সাপ্লাই করব বল দেখি?”
“কী সাপ্লাই করবি জানিস না উজবুক? ন্যাকামি হচ্ছে? কেমন দেখলি ডেস্ক্রিপ্শান দে, ডিটেল্স, ডিটেল্স!”
“ডেস্ক্রিপ্শান দেব? এটা কি কোনো ল্যান্ডস্কেপ নাকি?”
“দেখ রন্, ভাল হচ্ছে না এই বলে দিচ্ছি—”
“আচ্ছা আচ্ছা, বলছি,” একটু থেমে শরণ্যা বলে, “আরও রোগা হয়ে গেছে। অনেকদিন চুল কাটেনি, সার লান্সেলট-এর মতো অবস্থা মাথাটার। চুলগুলো কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। দাড়ি কামায়নি আজকে—”
“তোর বিরহে কী হাল—” উপলা একগাল হেসে আরও কি সব বলতে যাচ্ছিল, শরণ্যা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বিরহ হতেই পারে, কিন্তু আমার জন্যে নয়।”
“আচ্ছা আচ্ছা, দেখা যাবে। ইয়ে, কি বেশে ছিলেন তোর রঙ্গীতদা?”
“বেশ? ওই যে সেই বিখ্যাত পিকক্-ব্লু—”
“উফ্, কি দুর্ধর্ষ ব্যাপার! তা, কি বলল-টলল?”
“আরে, তেমন কিছুই নয়। কাল স্কুলে পুরো ফিরিস্তি দেব, ঠিক আছে?”
“বটে? আচ্ছা, তাই সই। কিন্তু কাল অ্যাবসেন্ট করলে আস্ত রাখব না বলে দিচ্ছি। বাই!”
ফোন রেখে উপলা বিছানায় দু-তিনটে ডিগবাজি খেল। উফ্, কী যে আনন্দ হচ্ছে, বলার নয়!
খেতে বসে মামানরা আরও একবার অবাক এবং ভাবিত হলেন। উপলার স্বভাব যে কিছু চঞ্চল, সে কথা বাড়িসুদ্ধ সকলেরই জানা। কিন্তু আজ হঠাৎ এরকম ঘন-ঘন মুড্সুইং-এর মানে কেউই বুঝতে পারছে না। খাবার টেবিলে যে উপলা শুধু একগাল হাসি নিয়ে বসল তাই নয়, পুরো সময়টা খুক্খুক্ করে হেসে গেল! মা অবশ্য সন্ধেবেলার ইতিহাস কিছুই জানত না, তাই উপলাকে দেখে কিছুই সন্দেহ করল না। শুধু একবার জিজ্ঞাসা করল, “এত ফুর্তি কিসের? ব্যাপার কি?”
উত্তরে উপলা চাপা গলায় বলল, “রঙ্গীতদা। হিঃ হিঃ।”
“বটে? তো তাতে তোমার এত আনন্দ কেন?”
উপলা আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগল আর হাসতে লাগল। ব্যাপারটা মামান আর জেঠিমা-কাকীমাদের ভীষণ রহস্যময় ঠেকল। মেজজেঠিমা ফিস্ফিস করে মামানকে বললেন, “ভাস্কর, তুমি তো বলেছিলে ব্রেক-আপ। কারুর ব্রেক-আপ হলে এরকম করে হাসে নাকি?”
মামান ঠোঁটের কোণ দিয়ে বললেন, “বুঝতে পারছি না মেজদি। মেয়েটা একটু ইমোশানাল তো, কখন যে কী মতি হয় কে জানে! আজকালকার ছেলেমেয়েদের বোঝা সহজ নয়। সে সব দিন কি আর আছে!”
মামী ওপাশ থেকে বললেন, “কিন্তু দিদিকে পলা কী বলল বলো তো? আর তা থেকে দিদিই বা কী বুঝল?”
মামান হাত উলটে বললেন, “গড্ নোজ। কোড ল্যাঙ্গোয়েজে কথা বললে আমি কী বুঝব বলো? ওসব মা-মেয়ের ব্যাপার।”
বাবা হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে বলল, “ভাস্কর, কি হয়েছে রে তোর? সেই কখন থেকে দেখছি কেমন গম্ভীর হয়ে আছিস।”
মামান তৎক্ষণাৎ বিগলিত হেসে বললেন, “কই, না তো জামাইবাবু!”
এর পরে এই নিয়ে আর বেশি কথা এগোল না।
শরণ্যা ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসেছিল। বাইরে কিছু দেখার নেই। শুধু একটা কালো পিচের রাস্তা, তার উপর উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকা গাড়িঘোড়া, মানুষ। রাস্তার ওপারে সারি সারি খুপ্রি দোকান, আর ভাঙাচোরা অর্ধনির্মিত ফ্ল্যাট-বাড়ি। সাততলার ব্যালকনি থেকে এর চেয়ে বেশি মনোরম দৃশ্য এ পাড়ায় দেখা যায় না। তবে এখন শরণ্যার চোখের সামনে ভাসছে শুধু একটা দরজা, আর আর তার এপারে একরাশ দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সে।
এমনি সময়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ছেলেটা। তার মুখ কোনও গ্রীক ভাস্কর্যের মতো নয়। মাথার চুল রুক্ষ, কটা, হাওয়ায় ওড়ে সব সময়, যেন এক মন-খারাপ-করা দৃশ্য। শুধু তার হাসিটা বসন্তকালের দুপুরবেলার মতো; কি উজ্জ্বল, আর প্রাণবন্ত! যদিও বেশি হাসতে দেখা যায়না এই ছেলেকে, আর তাই হঠাৎ দেখলে মনে হতেই পারে, এই রোগাটে, লম্বা কাঠামোটার মধ্যে বৈশিষ্ট কিছুই নেই। শরণ্যা জানে, রঙ্গীতদাকে সে যেভাবে আবিষ্কার করেছে, তেমনভাবে কেউ পারেনি, পারবেও না।
আজ রঙ্গীতদা ময়ূরকন্ঠী নীল পাঞ্জাবিটা পরেছিল। প্রায় তিন বছর আগে ঠিক এই পোশাকেই তো তাকে প্রথম দেখেছিল শরণ্যা। সেই থেকেই গল্পের সূত্রপাত।
“হ্যালো শরণ্যা, য়ু আর রাইট অন টাইম!”
“য়ু আর লুকিং নাইস,” শরণ্যা কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে মস্ত জিভ কাটল। এঃ, প্রথমেই এরকম একটা বেফাঁস মন্তব্য!
“অ্যাম আই? থ্যাঙ্ক য়ু। বাট্ প্লিজ ডোন্ট্ কম্প্লিমেন্ট।”
“কেন?” শরণ্যা অবাক।
“লজ্জা করে,” রঙ্গীতদার চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক খেলে গেল, “আসলে এসব ব্যাপারে আমি আবার একটু বিনয়ী, মানে—”
“মডেস্ট,” বলতে বলতে শরণ্যা ঘরে ঢুকল।
“তুই ‘বিনয়ী’ মানে জানিস তাহলে?”
“নিশ্চয়ই। বাঙালি হয়েছি, জানব না?”
“কিন্তু তোমার সিচুয়েশান্টা তো একটু...”
শরণ্যা মনে মনে হাসল। রঙ্গীতদার এই অভ্যেসটা কি কোনোদিন যাবে না! প্রায় তিন বছর হয়ে গেল ওকে চেনে, কিন্তু এখনো ‘তুই’ বলবে, না ‘তুমি’ বলবে ঠিক করে উঠতে পারল না। বাইরে অবশ্য এটা টের পেতে দিল না। বলল, “একটু কী? অন্যরকম? বলতে পারো, কিন্তু তাতে আমার বাঙালিত্ব কিছু কমেনি।”
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোর দিদিও কি তোরই মতো বাঙালি?”
শরণ্যা ভিতরে ভিতরে ধাক্কা খেল একটা। সানার ব্যাপারে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই ওর মনে হয়, আসল ঘটনা জানতে পারলে এরা কি বলবে? কিন্তু রঙ্গীতদা আলাদা; তাকে ওর কোনো কিছু বলতেই বাধা নেই।
“না, সানা অতটা নয়।”
“সাহানাদি কি করছে এখন?”
“এম.এ। ওর পরীক্ষা এসে গেল।”
“তাই? শেষ হলে কি হবে? চলে আসবে?”
শরণ্যা একটু চুপ করে থেকে বলল, “জানি না। হয়তো কিছুদিন চাকরি করবে, অথবা আরও পড়াশোনা করবে।”
মনে মনে শরণ্যা ভাবল, সত্যি, তুই কি আর ফিরবি, সানা?
কথা বলতে বলতে ড্রয়িংরুমে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। কাকু সোফায় বসে টি.ভি. দেখছিলেন। ওঁকে দেখলে শরণ্যার কেমন যেন মায়া হয়। মানুষটা যেন খুব একা। অথচ মুখ দেখে বোঝা যায়, নিশ্চয়ই এক সময় ভদ্রলোকের মধ্যে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি ছিল। রঙ্গীতদা যে ওর হাসিটা কোত্থেকে পেয়েছে, শরণ্যা জানে। মম্ ড্যাডের পুরোনো অ্যালবামে এখনও দু-একটা ছবি পাওয়া যায় কাকুর।
শরণ্যাকে ঢুকতে দেখে কাকু ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কে রে রং তোর সঙ্গে?”
“বাবা তোকে চিনতে পারছে না,” রঙ্গীতদা হাসল।
শরণ্যা কাকুকে প্রণাম করল।
“আরে, তুমি তো রাকা! এত লম্বা হলে কি করে? আমি চিনতেই পারিনি। ভাল আছো তো?”
“হ্যাঁ কাকু, আপনি ভাল আছেন?” শরণ্যা হাসল।
“এই তো চলে যাচ্ছে... তোমার দিদির কি খবর? সে কি এখনও বিলেতেই আছে?”
“হ্যাঁ, এম.এ. পরীক্ষা এই বছর।”
“তাই নাকি? সবাই কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে,” কাকু স্মিতমুখে বলেন, কিন্তু তারপরে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাসও পড়ে, চলে যাওয়া সময়ের কথা ভেবেই হয়তো।
“রং, তোরা বোস, আমি একটু ভিতরে যাই। তা বাকিরা কোথায়?”
“নো বডি কাম্স অন্ টাইম, য়ু নো,” রঙ্গীতদা হাত ওল্টায়।
“আই সি। য়ুরোপিয়ান পাংচুয়ালিটিটা তার মানে একমাত্র রাকারই আছে, তাই তো?” কাকু হাসতে হাসতে ভিতরে চলে গেলেন।
শরণ্যা বলল, “রঙ্গীতদা, য়ু হ্যাভ্ আ ওয়ান্ডারফুল ফাদার।”
রঙ্গীতদা হাসল, “আই নো।”
একটু বাদেই কলিংবেল বাজল। অনসূয়াদি ঢুকল, পিছনে ঋদ্ধিমানদা। একে একে সকলে এসে পৌঁছাল। শরণ্যার মনে হল সবাই যেন বড় তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আর একটু দেরি করলে রঙ্গীতদার সাথে বসে কথা বলা যেত। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রয়িংরুম ভরে গেল। আলাদা করে কথা বলার আর সুযোগ হল না।
শরণ্যার চোখের সামনে আবার কালো পিচের রাস্তা, গাড়িঘোড়া, দোকান আর ফ্ল্যাটবাড়ির সারি ভেসে ওঠে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়ে গেছে। চাঁদটা আর নিটোল একটা থালা নেই; তার কোণে ভাঙন ধরেছে।
ছাদের একটেরে ঘরটায় শেষ বিকেলের বৃষ্টিভেজা আলো এসে পড়েছিল। এ ঘরে এই সময়ে অন্য কারুর প্রবেশ নিষেধ। খুব সাধারণভাবে সাজানো একটা ঘর। এক কোণে খাট, আলমারি, অন্য দেওয়ালের গা ঘেঁষে রাখা চেয়ার-টেবিল। ঘরের একমাত্র বিশেষত্বটি হচ্ছে জানলার কাছে এককোণে একটা ছবি আঁকার ইজেল, আর তার ধারে একটা ছোট্ট টেবিল। সেই ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে নীরা একমনে ছবি আঁকছিল।
আর্ট ক্লাসে যে ধরনের ছবি আঁকতে হয় তা যে মন্দ লাগে এমন নয়। কিন্তু যতই হোক, সেসব সিলেবাসের আঁকা। কিছুটা হিসেব-নিকেশ তার ভিতর ঢুকে পড়বেই। নম্বরের ভাবনা-চিন্তাও মাথায় ঘোরে। নীরা হেসে ফেলে। সত্যি, ভ্যান গো-র ‘স্টারি নাইট্স’-কে কি নম্বর দেওয়া সম্ভব? নাকি পিকাসো আর মাইকেলেঞ্জেলোকে পাশাপাশি দাঁড়িপাল্লায় ওজন করানো যায়?
নীরা তাই শেষ বিকেলের এই কিছুটা সময় নিজের জন্য রাখে। এই কয়েক ঘন্টায় সে যা ইচ্ছে তাই সৃষ্টি করতে পারে। ধীরে ধীরে তার ক্যানভাসে ফুটে উঠতে থাকে কত বিচিত্র জগৎ; তার হদিস মনের কোন গভীর থেকে উঠে আসে, কে জানে! তবে এইটুকু সময়ের জন্য সে দুরন্ত, মুক্ত, স্বাধীন। বাইরের জগৎ এই নীরাকে চেনে না।
আজ নীরা একটা পোর্ট্রেট আকঁছিল। এক সুশ্রী চেহারার ছেলের প্রতিকৃতি। সেই ছেলের চোখদুটো বুদ্ধিদীপ্ত, মুখে কৌতুকপূর্ণ হাসি। আঁকতে আঁকতে চারদিকে আর কোনো মন ছিল না তার।
“ওরেব্বাস! কি সৌভাগ্য আমার!” পিছন থেকে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত গলা পাওয়া গেল। নীরা চমকে উঠে তাকিয়ে যাকে দেখল, তার উপর বিরক্ত হতে গিয়েও পারল না।
“অত্রি, তুই জানিস না এই সময়ে আমার ঘরে ঢোকা বারণ?” নীরা ভুরু কুঁচকে বলে, “আর একটু হলে ছবিটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আর কি!”
“আরে, ক’দিন ধরে রোজ বিকেলবেলা কী রাজকার্যটা করা হচ্ছে সেটা জানতেই তো আসা। ঘরে ঢুকে দেখি এই ব্যাপার! বিখ্যাত আর্টিস্ট নীরা চক্কোত্তি এই অধমের পোর্ট্রেট আঁকতে ব্যস্ত—”
“রুল ইজ রুল, অত্রি,” নীরা তখনও গম্ভীর, “আমার ঘরে এখন আসাটা তোর মোটেই উচিত হয়নি।”
অত্রি এতক্ষণে একটু যেন অপ্রতিভ হয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। আমি তো তুই ব্যস্ত শুনে চলেই যাচ্ছিলাম, তারপর কাকীমা বলল, ‘যা কৈলাসে গিয়ে শিবের ধ্যান ভাঙিয়ে আয়’। আমি বরং নীচেই যাই, চায়ের সঙ্গে কি সব ভাজা-টাজা হচ্ছে দেখলাম—”
নীরা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “থাক থাক, এসে যখন পড়েছিস তখন বোস। আমি এটুকু শেষ করে নিই, তারপর নাহয় একসাথেই নীচে যাওয়া যাবে। বোস এখানে চুপচাপ।”
চুপচাপ বসে থাকা অবশ্য অত্রির স্বভাববিরুদ্ধ। খানিকক্ষণ আঁকা দেখবার পরেই প্রশ্ন শুরু করল, “তোর ফেভারিট আর্টিস্ট কে?”
“মনে ... ” নীরা অন্যমনষ্কভাবে উত্তর দেয়।
“কে?” অত্রি অবাক।
“আরে ক্লদ্ মনে, ইম্প্রেশানিস্ট। নাম শুনিসনি?”
অত্রি হেসে উঠল, “আমি ভাই ভিঞ্চি ছাড়া আর কারুর নাম জানি না।”
নীরা আঁকা থামিয়ে অবাক হয়ে বলে, “শুধু ভিঞ্চি? বলিস কি রে? ভ্যান্ গো-কে চিনিস না?”
অত্রি মাথা চুলকে বলে, “ইয়ে &mdash: শোনা শোনা মনে হচ্ছে।”
“শোনা-শোনা?” নীরার চোখ কপালে উঠল, “পিকাসোর নাম শুনিসনি? পল গগ্যাঁ? সালভাদোর দালি?” অত্রি গর্বিত মুখে বলে, “পিকাসো জানি। চৌকো চৌকো কি সব আঁকত।”
নীরা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবশ্য তোর এসব জানার কথাও নয়। আমিও কি আর থিওরি অফ রিলেটিভিটি জানি! যার যার যেখানে আগ্রহ ...”
“এই তো একটা কথার মতো কথা বলেছিস এতক্ষণে,” অত্রি উৎসাহিত, “আরে ফিজিক্স নিয়ে যা প্রশ্ন করবি সব উত্তর এই অত্রি সেনের পকেটে। কিন্তু তোর ওই গঁগা না বগা, ওসব আমার দ্বারা হবেনা এই পষ্ট বলে দিচ্ছি।”
নীরা হেসে ফেলে বলল, “বেশ, হতে হবেনা। এবার দেখ তো, ছবিটা চেনা যাচ্ছে কিনা?”
অত্রি ছবি দেখে বেজায় খুশি হয়ে বলল, “আয়নায় মুখ দেখছি মনে হচ্ছে!”
“এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যদিও—”
“মোটেই না! চমৎকার হয়েছে,” এই বলে দুষ্টুমির হাসি হাসল অত্রি, “ইন ফ্যাক্ট, আমায় যে এত সুন্দর দেখতে সেটা তো আমার নিজেরই জানা ছিল না!”
প্রত্যেক ছবিতে শিল্পী তার নিজের খানিকটা ভাবনা মিশিয়ে দেয়। নীরা সে কথা মনে করে হঠাৎ নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে ফেলল, “বিউটি লাইজ ইন দি আইজ অফ দ্য বিহোল্ডার ...”
অত্রি ততক্ষণে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল, আচমকা ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কী বললি রে?”
নীরা মহা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “না না, এমনি একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ—”
অত্রি খানিকক্ষণ নীরার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে বলল, “তুই যা বললি আমি কিন্তু শুনতে পেয়েছি।”
এই বলেই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।
নীরা তাজ্জব হয়ে অত্রির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কী শুনেছে অত্রি? শুনে বুঝলই বা কী?
মৃণালিনী ইংরেজির টিউশানে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। হঠাৎ এমন জোরে বৃষ্টি নামল, যে বাড়িটা সামনে পড়ল, গেট ঠেলে ঢুকে তার বারান্দাতেই আশ্রয় নিতে হল। মৃণালিনী অবশ্য বিরক্ত হল না। ঝড়বৃষ্টি তার দারুণ লাগে। সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে যায় নিমেষের মধ্যে। মনে পড়ে গেল, সেদিন শরণ্যা ক্লাসে বসে একটা গান শোনাচ্ছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে’ ... ব্যাপক গায় কিন্তু মেয়েটা ... সারা জীবন বিলেতে বসবাস করে কি করে এসব শিখল কে জানে ...
এমন সময় বাড়ির দরজা খুলে একটি ছেলে বেরিয়ে এসে অবাকভাবে বলল, “এ আবার কি!”
মৃণালিনী ঘুরে তাকিয়েই থমকে গেল। হঠাৎ করে মনে হল তার পায়ের তলায় যেন শিকড় গজিয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে প্রচণ্ড জোরে ছুটতে শুরু করেছে। অনেক চেষ্টা করেও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, চোখের পাতা ফেলতে পারছে না। শরীরটা যেন পাখির মতো হালকা হয়ে গেছে, বুকের ভিতর প্রজাপতি ফড়ফড় ...
পুরো ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল সে। কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারল না। অবাক হয়ে ভাবল, মাথাটা কি একটু ঘুরে গিয়েছে হঠাৎ?
সামনের ছেলেটা বলল, “কি হল? বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ যে?”
তার আশ্চর্যরকম স্বাভাবিক স্বর শুনে মৃণালিনী কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মাথা চুলকে বলল, “শিল্দা যে!”
শিলাদিত্য তাজ্জব হয়ে বলল, “এতক্ষণ কি আমাকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছিল?”
মৃণালিনী আরও অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “ন্না—মানে বৃষ্টি পড়ছিল—বারান্দাটা যে তোমাদের—”
শিলাদিত্য তাকে আপাদমস্তক জরিপ করে বলল, “সবেমাত্র ঘুম থেকে ওঠা হয়েছে নাকি?”
মৃণালিনী বোকার মতো বলল, “কই, না তো! আমি তো—”
“আর বলতে হবে না, বুঝেছি। ভিতরে এসো।”
“ভিতরে যাব? কেন?”
“নয়তো কি হাঁ করে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
“কিন্তু আমার তো টিউশান—”
শিলাদিত্য হাসল, “এই বৃষ্টি মাথায় করে কোথায় যাবে, শুনি?”
মৃণালিনী বাইরের দিকে তাকাল। সত্যি, এখন কোথাও যাওয়া যাবে না, ভেসে যেতে হবে নইলে। তাদের পাড়ায় কদিন ধরে যা জল জমছে! অগত্যা টিউশানের ম্যামকে ফোন করে ক্লাস ক্যান্সেল করল, বাড়িতেও ফোন করে সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়ে দিল। তারপর দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলল, “চলো।”
শিলাদিত্যদের বাড়িটা ছোট, কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো। এ পাড়ার প্রায় সব বাড়িই এক-দেড়শো বছরের পুরোনো। শিলাদিত্যদের বাড়িটাও ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু ঘরের ভিতর ঢুকলে টেরই পাওয়া যায় না! শরণ্যাদের ফ্ল্যাটটা অনেকটা এরকম, কিন্তু এতটা ঝাঁ-চকচকে নয়। আসলে শিলাদিত্যর মা ইনটিরিয়র ডেকোরেটার, তাই হয়তো।
মৃণালিনী সংকুচিতভাবে সোফায় বসল। এ সব জায়গায় একটু অস্বস্তি লাগে ওর; কিছুতেই যেন সহজ হওয়া যায় না! শিলাদিত্য ভিতরের ঘরে গিয়েছিল, ফিরে এসে বলল, “বৃষ্টি তো ভালই পড়ছে—এ.সি. বন্ধ করে দিই?”
“হ্যাঁ, দাও।”
এ.সি. বন্ধ করে শিলাদিত্য জানলাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে দম্কা হাওয়া আর বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ যেন অনধিকার প্রবেশ করল ঘরে। শিলাদিত্য জানলার কাছ থেকে সরে এসে বলল, “ইস্!”
হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত ভাল-লাগা ঘিরে ধরল মৃণালিনীকে। এই ঘর, বৃষ্টি, ভিজে মাটির সুগন্ধ, মেঘলা গম্ভীর আকাশ, অদূরে দাঁড়ানো শিলাদিত্য—সবকিছু তার ভীষণ ভাল লাগল, ইচ্ছে হল সময়টাকে জাদুকাঠি দিয়ে থামিয়ে দিতে, যাতে এই মুহূর্তটা চলে না যায় ...
বলা বাহুল্য, মৃণালিনী এই সব অদ্ভুত অনুভূতির কারণ বুঝতে পারল না। হতাশভাবে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল, “মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে বাবা!”
শিলাদিত্য সামনের সোফাটায় পা ছড়িয়ে বসে বলল, “তোমার আজ কিছু হয়েছে।”
মৃণালিনী সতর্কভাবে বলল, “ইয়ে, কেন বলো তো।”
“আজকে তুমি অস্বাভাবিকরকম চুপচাপ। অন্যান্য দিন তো বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই তোমার গলা পাওয়া যায়,” এই বলে নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
মৃণালিনীর কথা বলার শক্তি বা ইচ্ছে, কোনোটাই বিশেষ ছিল না। তবু, কিছু একটা বলা দরকার, নয়তো শিল্দা সন্দেহ করবে ...
আরে বাবা, কী নিয়ে সন্দেহ করবে? সন্দেহ করার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে! এরকম উদ্ভট সব চিন্তাভাবনা মাথায় আসছেই বা কেন?
সে রেগেমেগে বলে উঠল, “ধ্যাত্তোর! সব বাজে!”
“এই তো ফর্মে ফিরে এসেছো দেখছি। সব বাজে কেন? কি হয়েছে? কারুর সঙ্গে মারামারিতে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারোনি?”
“আরে না রে বাবা,” মৃণালিনী বিরক্ত, “আমি সব সময় লোকজনের সঙ্গে মারামারি করে বেড়াই না।”
“তাই বুঝি?” শিলাদিত্য সরল গলায় বলল, “অথচ তোমার ফেসবুক প্রোফাইলে নাম হল ‘কুপিয়ে দেব’—এটা কেমন হল?”
মৃণালিনী চমকে উঠে বলল, “তুমি আমার ফেসবুক প্রোফাইল কোত্থেকে খুঁজে পেলে?”
“কোত্থেকে আর? ফেসবুকের জিনিস ফেসবুকেই পেয়েছি। যাহোক, ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব, অ্যাড করে নিও।”
খবরটা পেয়ে মৃণালিনী আনন্দে লাফ দিতে গিয়ে সামলে নিল। তারপরেই চিন্তা করল, শিলাদিত্য এত কাল ওদের পাড়ায় আছে, ফেসবুকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোটা এমনই কি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার? তার জন্য এরকম পাগলের মতো খুশি হবার মানে? আজকে যে ওর কি হয়েছে, অনেক ভেবেও বার করতে পারল না। শিলাদিত্য অবশ্য তার মুখ দেখে কী বুঝল কে জানে, বলল, “অবশ্য তুমি যদি অ্যাড করতে না চাও, তাহলে—”
“না না, আমি কি তাই বলেছি নাকি?”
“না, তা বলোনি, কিন্তু তোমার ভাবগতিক আমার সত্যিই ভাল ঠেকছে না। কি হয়েছে আমাকে বলা যায়?”
মৃণালিনী বেজারভাবে বলল, “আমার মুডটা বিশেষ ভাল নেই, বুঝলে। আসলে ইয়ে, এই বৃষ্টিটা আমার ঠিক ...”
“এমন গরমের পরে তো অতি পাষণ্ডেরও বৃষ্টি ভাল লাগে।”
হঠাৎ শিলাদিত্য তার চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, “আসল কথাটা এত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় না করে বলেই ফেল না!”
মৃণালিনীর হৃৎপিণ্ডটা আবার লাফিয়ে উঠল। বেশ খানিকটা তুত্লে বলল, “ক্-কী বলার কথা ব-বলছ বলো তো?”
শিলাদিত্য মুচকি হেসে বলল, “এই, যে টিউশানের নাম করে আসলে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হচ্ছিল, আমি বাগড়া দিলাম, তাই মনে মনে এখন আমাকে গাল দিচ্ছ।”
মৃণালিনী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা অপরাধবোধও মনের মধ্যে চাগিয়ে উঠল, যেন সে গর্হিত কোনো কাজ করে পালানোর চেষ্টা করছে।
শিলাদিত্য বলল, “কি হল, চুপ করে আছ যে? হুঁ হুঁ বাবা, আমার নাম শিলাদিত্য গাঙ্গুলী, প্রখর রুদ্রকে টেক্কা দিতে পারি গোয়েন্দাগিরিতে—”
“ওই অবধিই তোমার দৌড়,” মৃণালিনী হঠাৎ ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠল, “আমি মোটেও বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম না! আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই কিনা! বাই দ্য ওয়ে, মিস্টার প্রখর রুদ্রর পিসেমশাই, জেনে রাখো, আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই!”
“বটে? অবশ্য সেটা না থাকাই স্বাভাবিক। যা গুণ্ডাবাজ মেয়ে তুমি! বয়ফ্রেন্ড ফুচকা না খাওয়াতে চাইলে তাকে হয়তো মেরেই ফেলবে,” এই বলে হো হো করে হেসে উঠল শিলাদিত্য। মৃণালিনী বেজায় অপ্রস্তুত হল, সাথে সাথে মনটাও খারাপ হয়ে গেল। শিল্দা তার মানে ওকে গুণ্ডাবাজ ভাবে! ধুস্!
খানিক পর হাসি থামিয়ে শিলাদিত্য বলে, “রাগ করলে নাকি? আমি ইয়ার্কি মারছিলাম। তোমার একদমই মুড নেই মনে হচ্ছে।”
এমন সময়ে মৃণালিনীর ফোন বাজল। মায়ের ফোন।
“কি রে ফুল্কি, বাড়ি আসবি না? বৃষ্টি তো ধরে গেল।”
মৃণালিনী অবাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, সত্যিই কখন যেন বৃষ্টি থেমে গেছে। জানলার কাছে বসেও কিছু টের পায়নি! ‘আসছি’ বলে ফোন রেখে দিল সে।
শিলাদিত্য বলল, “পালাচ্ছ? এত তাড়া কিসের? বোসো বোসো, একটু আড্ডা মেরে যাও। এমন চমৎকার আবহাওয়া, বেশ চা-টা না খেলে কি জমে?”
মৃণালিনীর মনের মধ্যে তখন মল্লযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এমনিতে বিন্দুমাত্র যাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিল যে এখানে থাকা নিরাপদ নয়। জায়গাটা প্রায় শত্রুপক্ষের দুর্গের মতো ঠেকছে এখন। একটা বেফাঁস কথা বেরোলেই সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে যাবে। এই বেফাঁস কথাটা কী এবং বিপদটা কেন, সেটা না জানার ফলেই মৃণালিনীর ভয়টা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। নাঃ, এখানে আর থাকা গেল না।
“আজ আসি শিল্দা। বাড়িতে কাজ আছে।”
“বাড়িতে কাজ?” শিলাদিত্য ভুরু তুলল, “তুমি না টিউশান যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলে?”
“না ... আসলে মা ডাকছে। বলছে তাড়াতাড়ি আসতে। আসছি, কেমন? অন্য কোনোদিন না হয় ...”
শিলাদিত্য হাসল, “অন্য কোনোদিন তো বটেই। কবে, সেটাই ভাবার। আচ্ছা যাও, তোমাকে আটকাই আমার সাধ্য কী!”
অন্যদিন হলে মৃণালিনী নির্ঘাৎ বলত, ‘সিনেমার ডায়লগ ঝেড়ো না।’ আজকে শুধু বোকার মতো হেসে বেরিয়ে এল। এবং আশ্চর্য কাণ্ড, রাস্তায় পা দেবার সাথে সাথেই আবার আগের মতো হয়ে গেল সে। তার মনে ভিড় করে আসা সমস্ত ভয়, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভোজবাজির মতো মুছে গেল। এতক্ষণ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ভিজে হাওয়ার ঝাপটায় নিমেষেই ঘোর কেটে গেল। কিন্তু তার মনে একটা খট্কা লেগেই রইল। হঠাৎ এসব হবার মানে কী? কী যে হল, সেটাই তো ভাল বোঝা গেল না!