সকাল পার হয়ে বেলা এখন দুপুরের দিকে ঝুঁকেছে, চৌধুরিপুকুরের পাড়ের গাছপালার ছায়া দেখে বুঝতে পারছে ভীম। সকালের খাওয়া খেয়েছে অনেকক্ষণ আগে, আর ঘন্টাখানেক পরেই ভাত খাবার সময় হয়ে যাবে। চান টানও এখনও করা হয়নি। কিন্তু খাওয়ার চিন্তা মাথায় এলেও যে গাছটার গোড়ায় বসে ও রোদ পোহাচ্ছিল সেখান থেকে উঠে পড়বার কোনো লক্ষণ ও দেখাল না। বাড়িতে আজ জোর ঝামেলা হয়েছে — মা বুড়িটা বাড়িতে থাকলে ফিরে গিয়ে খেতে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
অথচ দিনটা শুরু হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই। সকালে উঠে গত সন্ধেতে দেখা ছবিটার কথা মনে পড়ছিল, তখনি ভেবেছিল শিগ্গিরই বন্ধুদের সঙ্গে আবার ওরকম ছবি দেখতে যাবে। ঐ দোকানের মালিক নিত্য নতুন ছবি দেখায়। ব্যাপারটা একই, কিন্তু একেবারে অন্যরকম কায়দা কানুন দেখা যায়। মায়ের বাক্স থেকে কবে আবার টাকা সরানো যাবে তাই ভাবতে ভাবতে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছিল ভীম, সকালের আর সব কাজকর্মও সেরে নিয়েছিল। কমলামাসি চায়ের সঙ্গে নাস্তাটাও দিয়েছিল খাসা। গরমাগরম ফুলকো লুচি, ছোটো ছোটো করে কাটা আলুর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না শুকনো তরকারি, সেই সঙ্গে আবার ডবল ডিমের মামলেট। কিন্তু খেয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরোতেই একেবারে মায়ের মুখোমুখি। আর যাবে কোথায়? বুড়ি চিৎকার করে ভীমের আর ভীমের বাপের, অর্থাৎ নিজের বরের শ্রাদ্ধ করতে লাগল। চেঁচানির থেকে ভীম এটুকু বুঝে নিল যে বুড়িটা বাক্স থেকে টাকা চুরির ব্যাপারটা টের পেয়েছে। ভীম চুপ করে দাঁড়িয়ে মায়ের চেঁচানি শুনছিল আর ভাবছিল বুড়ি এবার নির্ঘাৎ বাক্সের তালা পাল্টে ফেলবে। তার মানে আবার নতুন করে তার চাবি বানাতে হবে — সেই ঝামেলাটা ওকে পোহাতে হবে।
ভীম চুপ করে আছে দেখে মেনকার রাগ ক্রমে বাড়ছিল। তখনি ওর চোখে পড়েছিল সরু লাঠির মতো দেখতে সাপ তাড়ানো গাছের ডালটা — ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা। ও ছুটে গিয়ে তুলে নিয়েছিল সেটা, ছেলেকে বসিয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েক ঘা। ভীম বুঝেছিল আর এখন বাড়িতে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে — চলে এসেছিল সোজা একেবারে চৌধুরিপুকুরের পাড়ে।
এই গাছটা বেশ বড়, এটার গোড়াটায় ঠেস দিয়ে বসাটা বেশ সুবিধের। পা দুটো আরাম করে সামনে ছড়িয়ে দেয়া যায়। ভরপেট খাওয়ার পর শীতের মিঠে রোদ পোহানোতে ভারি আরাম। শীতকালে সাপ, বিছের ভয় নেই — পোকামাকড়, লাল পিঁপড়ে, এসবের উৎপাৎও বিশেষ নেই। বেলা বাড়ছে, রোদটাও সরে সরে যাচ্ছে। একটুখানি সরে গিয়ে খানিকটা ঘুরে বসল ভীম। এবার ঠিক বসা গেছে, সারা গায়েই রোদ লাগছে।
কিন্তু চিন্তা মাথার থেকে যায় না। বাড়ি তো একসময় ফিরতেই হবে, নইলে ভাত জুটবে কোথা থেকে? কিন্তু মা যদি বাড়ি থাকে তাহলে কি হবে? আবার কি ঠেঙার বাড়ি মারবে? বুড়ি যে দমাদম বসিয়েছিল তার কয়েকটা লেগেছিল ওর পিঠে, আর কয়েকটা হাতে — কাঁধের ঠিক নিচে। বুড়িটার গায়ে জোর আছে বিলক্ষণ — ভীমের শরীরের মার খাওয়া জায়গাগুলো মাঝে মাঝে টনটন করছে — বাড়ি ফিরতে পারলে কমলামাসি সেঁক দিয়ে দেবে, তাহলে আর ব্যথা থাকবে না — ওকি, ওকি, ওদিকটায় জল থেকে উঠে আসছে কে — কে?
চিন্তা করতে করতে চৌধুরি পুকুরের দিকে অলসভাবে নজর ঘুরিয়েছিল ভীম। তাতেই চোখে পড়ল, আর সাথে সাথে মনে হল হাত পা জমে পাথর হয়ে গিয়েছে, মুখের ভেতর তালু, গলা সব একেবারে খটখটে শুকনো। ঠাকরুন আসছে, ঠাকরুন — চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুন।
ঠাকরুনের কাহিনি এদিককার সারা গাঁয়ের লোকজন সবাই জানে। লোকের মুখে মুখে এই গল্প চলে আসছে। সে বহু বছর আগেকার কথা — ইংরেজ কোম্পানির আমল শুরু হয়েছে কি হয়নি। এই পুকুর কাটিয়েছিলেন শিবশংকর চৌধুরি। এধারের সারা অঞ্চলের দুঁদে জমিদার ছিলেন শিবশংকর — ঘোর অত্যাচারী, কিন্তু তার শরীরে কিছু দয়ামায়াও ছিল। তার ছেলে ভবশংকর ছিলেন একই রকম অত্যাচারি, তার আবার ওসব দয়ামায়ার বালাই ছিল না। এই ভবশংকর তখন জমিদার, একবার তিনি এসেছিলেন এই গাঁয়ে — দল বল পাইক পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে। উদ্দেশ্য, পাশের জঙ্গলে শিকারে যাবেন। সার সার তাঁবু পড়েছিল এই চৌধুরিপুকুরের পাশে। জমিদারের চোখে পড়েছিল একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়েকে। মেয়েটি গাঁয়ের কোন বাড়িটায় ঢুকে পড়েছিল তা দেখে রেখেছিলেন ভবশংকর। সঙ্গে সঙ্গে লোক লাগিয়েছিলেন — সেই চর এসে খবর দিয়েছিল মেয়েটি বামুনের ঘরের বালবিধবা, মা অনেকদিন মারা গেছে, বাপ খুবই গরীব, এ বাড়ি ও বাড়ি পুজোআচ্চা করে দিন চালায়। সেদিনই, সন্ধে একটু ঘন হতেই জমিদারের লোকজন মেয়েটিকে লুঠ করে ভবশংকরের তাঁবুতে পৌঁছে দিয়েছিল। মেয়েটি কিন্তু সহজে আত্মসমর্পণ করেনি — বুনো বেড়ালের মতো আঁচড়ে কামড়ে লড়াই করেছিল জমিদারবাবুর সঙ্গে। রাগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন ভবশংকর — মেয়েটার এত আস্পর্ধা। প্রথমে মেয়েটিকে নৃশংসভাবে প্রহার করেছিলেন, তারপর আধা অচেতন মেয়েটিকে নিষ্ঠুরভাবে ভোগ করেছিলেন। তাতেও তার রাগ পড়েনি। নিজের সখ মিটে গেলে পাইকদের নিজের তাঁবুতে ডেকে মেয়েটিকে তাদের হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। পাইকরা মহানন্দে আধমরা মেয়েটিকে তাদের নিজেদের তাঁবুতে নিয়ে গিয়েছিল।
তার পরে ঠাকরুনের যা গল্প তা লখনা পাইকেরও কাহিনি। জমিদারের পাইকের দল যখন মেয়েটিকে শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খাওয়ার মত করছে তখন প্রতিবাদ করেছিল তাদেরই একজন — লখ্না পাইক। লক্ষণ ঢালি, যে কিনা বিনা দ্বিধায় বহু লোকের মাথা লাঠির ঘায়ে ভেঙেছে, যে সড়কি দিয়ে কত মানুষের পেট ফাঁসিয়েছে, সেই লক্ষণ মাথা নেড়ে নিজের স্যাঙাৎদের বলেছিল, এ ঘোর অন্যায় হে, বড় পাপ করছ তোমরা। অন্যান্য পাইকেরা প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল। লখ্না ব্যাটা বলে কি? জমিদারের এঁটো ও নিজেও আগে কখনো ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়নি নাকি? ভূতে হঠাৎ রামনাম করে কেন? কিন্তু এক মুহূর্তেই পাইকদের অবাক ভাবটা কেটে গিয়েছিল। ওরা সবাই মিলে পিটিয়েছিল লক্ষণকে, তারপর ওকে লাথি মেরে নিজেদের তাঁবুর বাইরে বার করে দিয়েছিল। মারের চোটে লক্ষণের সারা মুখ ফুলে গিয়েছিল, সারা শরীরেও কালশিরে পড়ে গিয়েছিল। সারা রাত পুকুরপাড়ে বসেছিল লক্ষণ। মাঝে মাঝে ওর কানে আসছিল পাইকদের তাঁবুর থেকে হল্লার আওয়াজ — আর ও মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে নিজের মনেই বার বার বলেছিল — পাপ, পাপ, পাপ হচ্ছে, ঘোর পাপ।
মেয়েটি বাঁচেনি, মারা গিয়েছিল রাত ভোর হবার আগেই। ভোরবেলা পাইকরা মেয়েটির মৃতদেহ তাঁবুর থেকে টেনে বার করেছিল, মড়ার পায়ে পাথর বেঁধে সেটাকে ফেলে দিয়েছিল পুকুরের জলে। ফেলে দিয়ে পুকুরের পাড়ে বসা লখ্নার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে গিয়েছিল নিজেদের তাঁবুতে। ওরা চোখের আড়াল হতেই লক্ষণ পুকুরে ডুব দিয়ে মৃতদেহটা তুলে এনেছিল। পুকুরের জলে শরীরটা ডুবে থাকলে মাছে নাক চোখ মুখ খুবলে খাবে। পুকুর পাড়ের মাটি জলে ভিজে নরম, একটা গাছের শক্তপোক্ত একটা ডাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে দেহটাকে কবর দিয়েছিল লক্ষণ। দাহ করার যখন উপায় নেই তখন গোর দিয়েই মেয়েটির সদগতি হোক।
তেঁতুল গাঁয়ের এই লোককথার প্রথম কথক লখ্না পাইক নিজে। কতবার কত লোককে বলেছিল, কি করে গোর দেওয়ার পরে পরেই ঠাকরুনের দেখা পেয়েছিল, তার কথা শুনেছিল। কিন্তু সে দেখা চোখ দিয়ে নয়, ঠাকরুনের কথা শোনা রক্তমাংসের কান দিয়ে নয়। সে মানুষের মন দিয়ে দেখা, অনুভূতি দিয়ে শোনা। সে বুঝেছিল তার সামনে একটি বায়বীয় নারীমূর্তির অবয়ব, ভয়াল ভয়ঙ্কর রুষ্টা সেই নারী। মানুষের ওপর ঠাকরুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধা, কারণ মানুষ তার জীবিত অবস্থায় তার ওপর জঘন্যতম অত্যাচার করেছে। কিন্তু লক্ষণের ওপর ছিল ঠাকরুনের মঙ্গল আশীর্বাদ। ঠাকরুন মানা করে দিয়েছিলেন — ঐ পুকুরপাড়ে তাকে পুজোর জন্যে কোনোরকম থান যেন তৈরি না হয়, কোনো মানুষজন যেন পুকুরের ধারে কাছে না আসে। ব্যতিক্রম লখ্না, তার বংশের লোকজন, তার রক্ত শরীরে বইছে এরকম মানুষ।
ভবশংকর ঘুম থেকে উঠতেন দেরি করে। সকালে উঠেই খবর পেলেন যে ঐ বেয়াদপ মেয়েটা গতরাতে পাইকদের তাঁবুতে মারা গিয়েছে — পায়ে পাথর বেঁধে মড়াটাকে পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু লখ্না বেইমানি করেছে — জমিদারবাবুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
আবারও রেগে গিয়েছিলেন ভবশংকর। তার হুকুমে পাইকরা লখ্নাকে ধরে নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। লখ্নার সারা মুখ ফোলা, শরীরের এখানে ওখানে কালশিটে, রক্ত। ভবশংকর খুশি হয়েছিলেন। লখ্নাকে খুব মার মেরেছে পাইকরা। বেশ করেছে, ঠিক করেছে।
তবে বাইরে রাগ দেখান নি ভবশংকর। ঠান্ডা গলায় লখ্নাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিরে, তুই নাকি বেইমানি করেছিস?
পাইকরা সবাই জানত হুজুরের এরকম ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন শুধোবার অর্থ কি। হুজুর কারোর ওপর রেগে চিৎকার করলে শাস্তি যদি জোরালোও হয় প্রাণটা বেঁচে যাবে — সারা গায়ের চাবুকের ঘা শুকোতে হয়তো কিছুদিন শরীরে কবিরাজের দেয়া মলম লাগিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। কিন্তু হুজুর এভাবে কথা বললে তার পরিণাম আসামীর পক্ষে ভয়ঙ্কর, অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে তাকে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হতে পারে, বা গাছের নিচে ঢিমে আঁচের আগুন জ্বেলে তার ঠিক ওপরে গাছের ডাল থেকে মানুষটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতে পারে — মানুষটা তাড়াতাড়ি মরবে না, ঝলসে ঝলসে ধীরে ধীরে মারা যাবে। আর একটা শাস্তিও ভবশংকরের প্রিয় ছিল। মাটিতে চার দিকে চারটে খোঁটা পুঁতে মানুষটাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে তার দুটো হাত আর দুটো পা ঐ চারটে খোঁটার সঙ্গে বেঁধে ফেলতে হবে। তারপর করাত দিয়ে মানুষটার এক একটা হাত পা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটতে হবে। একই দিনে সব কটা হাত পা কেটে ফেলার দরকার নেই, তাহলে লোকটা বড় তাড়াতাড়ি মারা যাবে। আর হ্যাঁ, সব কটা শাস্তির সময়েই মানুষটার মুখ বেঁধে রাখতে হবে। চিৎকার করতে পারলে মানুষের ব্যথা একটু কম লাগে, সেটা হতে দেয়া যাবে না।
লখ্নাও তার মনিবকে খুব ভালোই চিনত, কিন্তু সে ভয় পায়নি। দু হাত জোড় করে বলেছিল, হুজুর, আমি বেইমানি করি নাই। আমার আর সব স্যাঙাৎরা ঠাকরুনের ওপর পাপ কাজ করেছে, ভগমান আমাকে সে পাপের হাত থেকে বাঁচায়েছেন।
ভবশংকর স্থির চোখে লখ্নার দিকে তাকিয়েছিলেন। ঠিক করতে পারছিলেন না কোন শাস্তিটা ওর উপযুক্ত হবে।
লখ্না আরও বলেছিলেন, হুজুর, ঠাকরুন আমারে দর্শন দিয়াছেন, আমারে আশীর্বাদ করাছেন। আমারে মাফ করেন, আমি আর পাইকের কাজ করতে লারব। আমি ভিখ মেগে পেটের অন্ন জোগাড় করব।
ভবশংকর তার পাইকের কথা শুনছিলেন। একটু আশ্চর্য বোধও যে করেননি তা নয় — ভয়ঙ্কর মৃত্যু সামনে ঝুলছে জেনেও লক্ষণ এসব কথা বলবার সাহস পাচ্ছে কি করে?
লখ্না আরও বলেছিল, হুজুর, ঠাকরুন এখানেই বাস করছেন। এই চৌধুরিপুকুরেই তার থান। দোষ নেবেন না হুজুর, আপুনি তাঁবু উঠায়ে এ স্থল হতে এখনি চলা যান। এই চৌধুরিপুকুরের ধারে কাছে মানুষজন আসতে ঠাকরুন মানা করে দেছেন।
লক্ষণকে কোনোরকম শাস্তি শেষপর্যন্ত দেননি ভবশংকর। কেন দেননি সেটা তিনি নিজেও ভালো করে জানেন না। তবে এমন নয় যে এই ঘটনায় তার জীবনে কোনোরকম পরিবর্তন এসেছিল। এ জাতীয় ঘটনা তার জীবনে এই প্রথম, এবং এই শেষ। খালি লখ্নাকে বরখাস্ত করেছিলেন পাইকের চাকরি থেকে। তবে ওর উপদেশটাও মেনে নিয়েছিলেন ভবশংকর। সেদিনই তাঁবু তুলে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। তার জীবিতকালে আর কখনো তেঁতুলগাঁয়ে আসেননি।
ঠাকরুনের অভিসম্পাত যে খুব শিগ্গিরই ভবশংকরের জীবনে কোনো বিপর্যয় এনেছিল তা কিন্তু নয়। সুখভোগ করার কর্মফল যতদিন মানুষের থাকে ততদিন কোনো অতি ক্ষমতাশালিনী উপদেবীর শাপও তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। ভবশংকরের সুসময় শেষ হয়েছিল এ ঘটনার বেশ কয়েকবছর পরে। তখন কলকাতায় সাহেবরা ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে — ভবশংকর কলকাতা গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে ব্যবসা করার উদ্দেশ্য নিয়ে, সে সব কথাবার্তা বলতে। ফিরেছিলেন ব্যবসা সংক্রান্ত সব কথা পাকা করে। কিন্তু সেই শহর থেকে আরও একটি জিনিস তার সঙ্গ নিয়েছিল, সেটা তিনি টের পাননি। একটি ব্যাধি, ফেরঙ্গ রোগ। সাহেবদের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগও কলকাতায় এসেছিল — বিশেষ করে তাদের জাহাজের নাবিক লস্করেরা বার নারীদের ভেতর এই রোগ ছড়িয়েছিল। ভবশংকর কলকাতায় এসে ইন্দ্রিয় দমন করে থাকেননি। আর চোখে ধরে গেলে যে কোনো নারীকে তিনি নিজের বাসস্থানে নিয়ে আসবেন সেটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক — সে মেয়ে যদি রাস্তায় ঘোরা পণ্যানারী হয়, তবুও। ভবশংকর টের পেয়েছিলেন যখন রোগ তার শরীরে দেখা দিয়েছিল। কবিরাজ এসেছিল, কিন্তু তখন এ ব্যাধি এদেশে নতুন, তার চিকিৎসার চেষ্টা হতে পারে কিন্তু আরোগ্য নেই। তাছাড়া অসুখটি তখন জমিদারবাবুর শরীরের ভেতরে বহুদূর ছড়িয়ে গিয়েছিল। স্নায়ুমণ্ডলীর পক্ষাঘাত হয়ে ভবশংকর একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। তার জীবনের শেষ কটা মাস সে ভাবেই কেটেছিল।
যারা ঠাকরুনের শক্তিতে বিশ্বাসী ছিল তারা বলেছিল ঠাকরুনের শাপেই জমিদারবাবুর এই দশা হল। দু চারজন অবিশ্বাসী যে ছিল না তা নয়। ঠাকরুনের শাপ ফলতে এতগুলো বছর লেগে গেল কেন? কিন্তু তারা মুখ খোলেনি। বিশ্বাসীর দল সংখ্যায় বিলক্ষণ ভারি। তাদের ঘাঁটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
ভবশংকরের কোনো ছেলে ছিল না। তিন মেয়ে ছিল — দু জন বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিল। যে জামাই বেঁচে ছিল সে-ই ভবশংকরের সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিল।
লক্ষণ তেঁতুলগাঁয়েই থেকে যায়। চৌধুরিপুকুরের গায়ে একটা বড় অশ্বত্থগাছ, তার নিচে কুঁড়ে বেঁধে নিয়েছিল। ওর খাবার দাবার সিধের যোগান দিত গাঁয়ের লোক — ঠাকরুনের নাম করে। তবে ওর এই অবস্থা কিছুদিনের মধ্যেই বদলাতে শুরু করে। একজন দুজন করে ওর অল্পবয়েসি ছেলে ছোকরা সাকরেদ জুটতে শুরু করে, আর বছর খানেক যেতে না যেতেই তারা দলে বেশ ভারি হয়ে ওঠে। লক্ষণের সাকরেদ জুটবেই বা না কেন — এই শা-জোয়ান একটা লোক, লাঠি সড়কি চালাতে ওস্তাদ — ছোকরারা তো এরকম লোকের দিকে ঝুঁকবেই। এই দলটার বদনাম হতেও বেশিদিন লাগেনি। লক্ষণের এই দলটা তৈরি হবার পর থেকেই চারপাশের সব গাঁয়ে ডাকাতি হতে শুরু করে। লক্ষণও নিজের ভোল পাল্টে ফেলেছিল। চারচালা বড় ঘর তুলেছিল নিজের থাকার জন্যে। রকমসকম দেখে গাঁয়ের লোকেরা আস্তে আস্তে সিধে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। লক্ষণ গ্রাহ্য করেনি। ওর আর অন্য লোকের পাঠানো সিধের দরকার ছিল না।
আরও কয়েকবছর পরে লক্ষণের জীবনে একটি ঘটনা ঘটে। ও ছোটোখাটো একজন জমিদার বনে যায় — ওর ওপর ঠাকরুনের আশীর্বাদ সম্বন্ধে লোকের বিশ্বাস একেবারে বদ্ধমূল হয়ে যায়। পাশের গাঁয়ে বছর বারো তেরোর একটি মেয়েকে সতী করা হচ্ছিল। মেয়েটির বাপ মা ছিল না, কাকার কাছে থাকত। মেয়েটির বাবা বেশ কিছু জমি জায়গা রেখে মরেছিল। মেয়েটিকে মেরে ফেলতে পারলে কাকা-ই ঐ জমি জায়গার মালিক হয়ে যায়। একটা সহজ উপায় হচ্ছে মেয়েটিকে সতী করে পুড়িয়ে মেরে দেয়া। শ্বাস উঠেছে এরকম একটা পাল্টি ঘরের বুড়ো জোগাড় করেছিল ঐ কাকা — মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে। মেয়েটির সঙ্গে বুড়োটার বিয়ের প্রহসন যতক্ষণে শেষ হয়েছে ততক্ষণে বুড়ো মারা গিয়েছে। মড়াটাকে আর সদ্য সিঁদুর পরা মেয়েটিকে নদীর ধারে শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল — দুটোকে একসঙ্গে পুড়িয়ে ফেলতে পারলে নিশ্চিন্ত।
তা হতে পারেনি। লক্ষণ খবরটা পেয়েছিল। আরও শুনেছিল মেয়েটার বাপ জায়গা জমি রেখে মারা গেছে। লক্ষণকে খবরটা দিয়েছিল সেই গাঁয়েরই একজন লোক — লক্ষণের একজন বিশ্বস্ত ‘খব্রি’ আশেপাশের বেশ অনেক গাঁয়েই লক্ষণ এরকম চর রেখেছিল। তারা গোপনে লক্ষণকে সব খবর দিত — কার বাড়িতে সোনাদানা টাকাপয়সা আছে, ঘরের মেয়েদের গায়ে কিরকম গয়না আছে।
তখন বুড়োর মড়াটাকে চিতায় শোয়ানো হয়ে গিয়েছিল, আর মেয়েটাকে জোর করে চিতায় শুইয়ে ওকে দড়ি দিয়ে চিতার সঙ্গে বাঁধা হচ্ছিল। মেয়েটির কচি গলার চিৎকার চাপা দেয়ার জন্যে খুব ঢাক ঢোল বাজছে, যে বামুন পুরুৎ বিয়ের মন্ত্র পড়েছিল সে-ই চিতার পাশে বসে কি একটা পুঁথি খুলে তারস্বরে দুর্বোধ্য কোন মন্ত্রপাঠ করে যাচ্ছে। সেখানে হাঁকার দিয়ে লাঠি হাতে এসে পড়েছিল লক্ষণ, সঙ্গে তার কয়েকজন সাকরেদ। মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ওরা।
এত বড় একটা ঘটনা হয়ে গেল, গাঁয়ের কয়েকটা লোক একেবারে হাপিশ হয়ে গেল, এ নিয়ে কোনো হৈ চৈ কি হয়নি? হয়েছিল। জমিদারের কাছারিতে নালিশ হয়েছিল। জমিদারের নায়েব লোকলস্কর নিয়ে খোঁজখবর করতে এসেছিল। কিন্তু সব পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত থাকে। আর প্রায়শ্চিত্তের বিধান হল ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দেয়া। তা এ ক্ষেত্রে নায়েবকেই মূল্য ধরে দিয়েছিল লক্ষণ। ব্যাপারটা আর বাড়তে পারেনি।
মেয়েটিকে লক্ষণ নিজের ঘরে নিয়ে আসে। মেয়েটি অবশ্য প্রথমে ওর বশ মানেনি। একবার পালাবার চেষ্টাও করেছিল। বশ না মানারই কথা। অসুরের মতো শরীর, দুশমনের মতো ভীতিপ্রদ মুখ, এরকম একটা লোকের সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া? এই কচি বয়েসে একটা দৈত্যের শরীরের ঝড় ঝাপটা দিনের পর দিন সহ্য করে থাকা? তার চেয়ে কাকার কাছে ফিরে গিয়ে চিতায় পুড়ে মরাও ভালো। লক্ষণ ছোট্ট করে শাসন করেছিল মেয়েটিকে। দুই গালে দুটি খুব হাল্কা থাপ্পড় আর এক হপ্তা কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। দড়ির গিঁট ঘরের আড়ার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। মেয়েটি সেখানে হাত পাবে না। দড়ি যথেষ্ট লম্বা, ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনে পুকুরপাড়ে যেতে কোনো অসুবিধে নেই। এই শাসনের পর আর পালাবার চেষ্টা করেনি মেয়েটি।
লক্ষণ যে ওই মেয়েটিকে বাঁচিয়েছিল সে নেহাৎ দয়ার জন্যে নয়। এর আগেও তো অনেকে মেয়ে এইভাবে পুড়ে মরেছে আশেপাশের বিভিন্ন গাঁয়ে, তাতে লক্ষণের কোনো মাথাব্যথা হয়নি। মেয়েটির বিষয়আশয়ের কথা শুনেই ও লাঠি নিয়ে শ্মশানে দৌড়েছিল। কিন্তু সে সব জমিজায়গা কব্জা করবার জন্যে মেয়েটির সঙ্গে ওর একটা সমাজের মেনে নেয়া বিয়ে হওয়ার দরকার ছিল। একমাত্র তাহলেই জমিদারি সেরেস্তায় ওর নাম ঐ জমির মালিক হিসেবে লেখা হবে, আর ঐ সব জমির কর্তৃত্ব ওর হাতে আসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সেরকম বিয়ে হচ্ছে মেয়েটার কাকা মেয়েটার হেপাজত দাবি করে জমিদারের কাছে নালিশ ঠুকতে পারে। বিশেষ করে যেহেতু লক্ষণ মেয়েটাকে চিতার থেকে তুলে এনেছে পুরো সমাজ ওর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া, ওদের যে সব ছেলেমেয়ে জন্মাবে তারা একঘরে হয়ে থাকবে — চারপাশের সব লোকজন ওদের গায়ে থুতু দেবে।
কিন্তু বিয়েটা হবে কি করে? এক তো বিধবা একটা মেয়েকে মরা স্বামীর চিতার থেকে কেড়ে আনা হয়েছে, তার তো আবার চিতাতেই যাওয়া উচিৎ। তার ওপর মেয়েটি বামুনের ঘরের, আর লক্ষণ হচ্ছে ঢালি। এ বিয়ে তো মোটেই সম্ভব নয় — বিয়ে হওয়ার কোনো উপায়ই নেই।
তবে একেবারে কোনো উপায় নেই তাও কি হয়? কোনো বামুনের মুখ দিয়ে সেই উপায়টা বলিয়ে নিতে হবে, তাহলে সমাজ আর তার ওপরে কোনো কথা বলবে না। আর বামুনকে বশে আনার, এমনকি সে বেঁকে বসলে তাকে সোজা করার ওষুধ তো আছে। একটা জোরালো ওষুধ হচ্ছে টাকা। ব্রাহ্মণকে সুবর্ণ দান করলে পাপ তো পাপ, মহাপাপও ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এমনকি গ্রহপূজার জন্যেও শাস্তরে লেখে, ‘পূজার দান গ্রহবিপ্রকে দিবে, অন্যথায় (পূজা) নিষ্ফল হইবে।’ তা লক্ষণের হাতে টাকা ভালোই ছিল — ও ডাকাতি করে তো আর পেট শুকিয়ে ফিরত না। তবে কিছু কিছু বেয়াড়া গোছের বামুনের ব্যাপারে এই ওষুধে কাজ হয় না — তারা মাথার টিকি নেড়ে বলে এসব আমাদের ধম্মে মানা, আমাদের শাস্তরে মানা। তখন উপায় কি? তখন দাও দাওয়াই এর সেরা দাওয়াই, ওষুধের সেরা ওষুধ — লাঠ্যৌষধ। এতে কাজ হবেই হবে। যে পুরুৎ আগুন জ্বেলে মন্ত্র পড়ে বুড়োটার সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দিয়েছিল লক্ষণ তার বাড়িতে দর্শন দিয়েছিল — ওর হাতে ছিল ওর ভীষণদর্শন লাঠি। বামুনকে প্রথম ওষুধটা দিয়েছিল আর দরকার হলে দ্বিতীয় এবং মোক্ষম ওষুধটাও প্রয়োগ করবে সেরকম আশ্বাস দিয়েছিল। ফল হয়েছিল মন্ত্রের মতো। সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত সারা গাঁয়ে প্রচার করেছিল যে মেয়েটি বিধবা তো নয়ই, এমনকি তার বিয়েই হয়নি। মেয়েটি কুমারী, কারণ বিয়ের যজ্ঞের আগুন জ্বেলে মন্ত্রপাঠের আগেই মেয়েটির মুমূর্ষু হবু স্বামীটি মারা গিয়েছিল — একথা সেই ব্রাহ্মণ তার গায়ের যজ্ঞোপবীতটি আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে জোর গলায় ঘোষণা করেছিল। কিছু বেয়াড়া লোক প্রশ্ন তুলেছিল, মেয়েটির হবু বর যদি মরেই গিয়ে থাকে তাহলে পুরুৎ ঠাকুর আগুনটাগুন জ্বেলে মন্ত্রটন্ত্র পাঠ করে বিয়ের ব্যাপারটা পুরো করলেন কেন? বা রে বা, এটা আবার একটা প্রশ্ন হল নাকি? শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্ম — শুরু করলে তা পুরো করতে হবে না? তা না করলে অমঙ্গল — ঘোর অমঙ্গল। মা শেতলা, ওলা বিবির রুদ্র রুষ্ট নজর পড়ত এই গাঁয়ে — মানুষ উড়কুড় মরে সাফ হয়ে যেত।
তারপর দ্বিতীয় বাধাটা — বর্ণভেদের বাধা। ঐ পুরোহিত-ই আবার বিধান দিলেন। বলপূর্বক হরণ করা নারী আর বীর্যশুল্কা কন্যা, এ দুয়ের বিবাহের ক্ষেত্রে বর্ণভেদ দোষ প্রযোজ্য নয়। ব্রাহ্মণটি গাঁয়ের কয়েকজন মাতব্বরকে ডেকে নিজের বাড়িতে রাখা পুরুষানুক্রমে পাওয়া বহু পুরোনো পোকায় খাওয়া একটি তালপাতার পুঁথি দেখিয়ে বললেন, এই শাস্ত্রে এই বিধান রয়েছে। একথা পুরোহিত বলেছিলেন সেই পুঁথির একটি পাতা খুলে তার একটি পংক্তির ওপর নিজের ডান হাতের তর্জনি রেখে — শাস্ত্রটির একটা নামও বলেছিলেন, মঙ্গলপুরাণ বা আদিপুরাণ সেরকম কিছু একটা।
অতএব মাতব্বরেরা পুরোহিতের শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ফিরে গিয়েছিল — সন্ধের পর গাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপে জমায়েত হয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, আমাদের পুরুৎঠাকুর পণ্ডিত বটে। কত সব পুরোনো পুঁথি আছে ঠাকুরমশায়ের বাড়িতে। মেয়েটির কাকা অবশ্য বাগড়া দেবার জন্যে দল পাকাবার চেষ্টা করেছিল। সুবিধে করতে পারেনি। কেউ কেউ অবশ্য মুখে ওর পক্ষে দু চার কথা বলেছিল, কিন্তু কাজের সময় কেউ-ই এগিয়ে আসেনি। লক্ষণের লাঠি আর ব্রাহ্মণে পুঁথি — এই দুই-ই যথেষ্ট শক্তিশালী।
লক্ষণের সঙ্গে ঐ মেয়েটির বিয়েটাও ঐ পুরোহিত-ই দিয়েছিল। গাঁয়ের প্রচুর লোক পাত পেড়ে খেয়েছিল সে বিয়েতে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু লোক ছিল যারা মেয়েটিকে সতী করবার জন্যে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল — আর তারপর লক্ষণের লাঠির তাড়া খেয়ে সেখান থেকে পালিয়েছিল। মেয়েটির কাকাকেও নেমতন্ন পাঠিয়েছিল লক্ষণ। সে অবশ্য নেমতন্ন খেতে আসেনি।
বিয়ের পরে পরে লক্ষণ গিয়েছিল জমিদারের কাছারিতে — সঙ্গে প্রচুর ভেট। ভবশংকর তখন মারা গেছেন — জমিদার তার জামাই। জমিদারবাবু লক্ষণকে ঘুরিয়ে দেননি — তার কাজ করে দিয়েছিলেন। তার একটা বড় কারণ হতে পারে যে লক্ষণের দেয়া ভেটের ভেতর প্রচুর সোনা রূপোর জিনিসপত্র ছিল — নগদ টাকাও ছিল বড় বড় কয়েক তোড়া। লক্ষণের নাম উঠে গিয়েছিল জমির মালকিনের স্বামী হিসেবে।
জমি জায়গা প্রচুর বাড়িয়েছিল লক্ষণ। যথেষ্ট দ্রুত ছিল এই বৃদ্ধি। ডাকাতির রোজগার জমি জিরেতে লাগানোই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কয়েক বছরের মধ্যেই দু দশটা গাঁয়ের লোক সমীহ সম্ভ্রম করে তার সম্পর্কে বলতে শুরু করেছিল — জমিদার লক্ষণবাবু। আর সমীহ করবেই বা না কেন। লক্ষণবাবু তখন কত লোকের অন্নদাতা। জমির কাজ করে কত লোকের দানাপানি। তাছাড়া যে সব জোয়ান বয়সের ছেলেদের জমির কাজে মন নেই তাদের অনেকে লক্ষণবাবুর নৈশাভিযানের সঙ্গী — এই কাজে রোজগার তো হচ্ছে ছেলেগুলোর। আজকালকার দিন হলে নেতা হয়ে ভোটে দাঁড়াতে পারত লক্ষণ — মিডিয়ার লোকজন ডেকে নিজের মুখের সামনে মাইক লাগিয়ে হিসেব দিতে পারত — এত লোকের অন্নসংস্থান করেছি আমি — এতগুলো জব ক্রিয়েশানের ব্যবস্থা করেছি।
জমি জায়গা বাড়ানোর সাথে সাথে নিজের বংশবৃদ্ধির ব্যাপারেও যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছিল লক্ষণ। গড়ে দেড় বছরে একটি করে সন্তান উৎপাদন করেছিল চিতা থেকে কেড়ে আনা সেই স্ত্রীর গর্ভে। সার না দিয়ে বেশি ফসল ফলালে নাকি জমির উর্বরতা কমে যায়। গোটা পনেরো সন্তান প্রসবের পর আর গর্ভবতী হতে পারেনি মেয়েটি। এত সন্তানের জন্মদানের ধাক্কায় বোধহয় তার জীবনীশক্তিও কমে আসছিল। চল্লিশের কোঠায় পা দেয়ার আগেই সে লক্ষণের শয্যাসঙ্গিনী হবার ভয়াবহতার থেকে মুক্তি পায়, অর্থাৎ মারা যায়। সে সময় সেই পনেরোটি সন্তানও সবাই বেঁচে নেই — জন সাতেক যারা বেঁচে ছিল তারা উত্তম স্বাস্থ্য নিয়ে বহাল তবিয়তেই ছিল। স্ত্রী মরে গিয়ে লক্ষণ শোক বিশেষ পায়নি, কিন্তু বিব্রত হয়েছিল যথেষ্ট। বেঁচে থাকা সাতটি সন্তানের মধ্যে দু তিনটি একেবারে অপোগণ্ড — তাদেরকে লক্ষণ সামলায় কি করে?
বাড়ির একটি দাসীকে তাদের দেখাশোনার ভার দিয়েছিল লক্ষণ। দাসীটির নিজের তখন সবে একটি সন্তান হয়েছে, কাজেই লক্ষণের অপোগণ্ডদের স্তনদুগ্ধের কোনো অভাব হয়নি। তবে লক্ষণ সেই দাসীকে বা আর কোনো নারীকে নিজের বিছানায় ডাকেনি। বোধহয় ওর মেয়েমানুষে অরুচি এসে গিয়েছিল — এ পর্যন্ত অনেক মেয়েছেলে-ই তো ঘাঁটা হল, আর নয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর নাকি ডাকাতের দলও ভেঙে দিয়েছিল লক্ষণ। সাকরেদদের বলেছিল, বাপসকল, এবার তোমাদের ছুটি করে দিলাম, নিজেরা করেকম্মে খাওগে যাও। জমির কাজকর্মও বেশি দেখত না, নিজের বড়ছেলের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছিল। ছেলেটির তখন পুরুষ্ট গোঁফ গজিয়েছে, অর্থাৎ লক্ষণের ভাষায় ছোকরা সেয়ানা হয়েছে। কাজেই তার হাতে বিষয়কর্ম ছেড়ে দিতে কোনো অসুবিধে নেই।
কিছু লোক অবশ্য লক্ষণের এই আপাতবৈরাগ্য সম্পর্কে অন্যরকম বলেছিল। এ সব তো জমিদারের উপযুক্ত কাজ নয়। জমিদারের মেয়েমানুষে অরুচি, নিজের জমি দেখাশোনায় অরুচি — এ তো জমিদারবাবুর সাজে না। এই জমিদার কি সাধুসন্ন্যাসী হয়ে গেল নাকি? জমিদার হবে দুর্দান্ত — গেরস্তের ঘর থেকে বৌ-মেয়ে টেনে নিয়ে যাবে, নিজের জমির দখল নিজের কব্জায় রাখবে, প্রজার খাজনা বাকি পড়লে তার খেতের ফসল লুঠ করবে, দরকার পড়লে তার ঘরও লুঠ করবে, আবার প্রজা পায়ে ধরে কেঁদে পড়লে তার ওপর দয়াও করবে, নিজের গোলা থেকে বার করে তাকে ধান ধার দেবে, সে যাতে স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে খেয়ে বাঁচতে পারে। তবে তো জমিদার। উহুঁ — এ লোক তার জমি আর বেশিদিন রাখতে পারবে না। সাধু মানুষের জমি জায়গা — সে সব সাতভূতে লুটে খাবে না?
তবে সে সব কিছু হয়নি। লক্ষণের জমি লক্ষণের দখলেই ছিল।
মেনকা লক্ষণের বংশেরই মেয়ে। ওর বাপ ছিল লক্ষণের নাতির নাতির ছেলে। লক্ষণ মারা যাবার পর থেকে ওর ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওর ভূসম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হতে থাকে। তাছাড়া বেচাকেনায় হাত বদল তো ছিলই।
মেনকার বাপ লক্ষণের বড় ছেলের উত্তরপুরুষ — তার ভাগে পড়েছিল আজ মেনকার যা আছে সেই সব। মেনকার বাপ অপুত্রক ছিল, বাপের যা কিছু বিষয়সম্পত্তি ছিল তা মেনকাই পেয়েছিল।
মেনকার বাপ মারা গিয়েছিল মেনকার বিয়ের কিছুদিন পরেই। বড় ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যু। পেটের ভেতর ঘা হয়েছিল, তার জ্বলুনিতে ছটফটিয়ে মরেছিল মেনকার বাপ। অসুখের গোড়াতে সদর হাসপাতালে গিয়েছিল চিকিৎসার জন্যে। ফিরে এসেছিল শুকনো, ভয় পেয়ে যাওয়া মুখ করে। মহারোগ, কর্কট রোগ হয়েছে তার। সে রোগের চিকিৎসা নেই কোনো। একটি অদৃশ্য কাঁকড়া, পেটের ভেতরে জন্ম নিয়ে সে এখন মানুষটার সারা শরীরের ভেতর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, আর ভেতর থেকে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ডাক্তার জবাব দেবার পর শুরু হয়েছিল কবিরাজের গুলি আর পাঁচন। তান্ত্রিক ডেকে বাড়িতে যজ্ঞ করা হয়েছিল, সে যজ্ঞের পূর্ণাহুতি দিলে পরে মরা মানুষ ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। সেই সঙ্গে জাগ্রত পীরের থানের মাদুলিও ধারণ করেছিল মেনকার বাপ। কিছুতেই কিছু হয়নি। শরীরের ভেতর কর্কটটির চলাফেরা এবং নিরন্তর দংশন আটকানো যায়নি। সারাদিন, সারারাত কেবল চিৎকার করত — জ্বলে গেল, আমার সারা শরীর জ্বলে গেল — আমায় চান করিয়ে দে, ঠান্ডা জলের ভেতর আমায় চুবিয়ে রাখ। গাঁয়ের বয়স্ক লোকেরা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলেছিল — পাপ, নিজের পাপের ফল পাচ্ছে লোকটা। সে কথা সত্যি। বড় ভয়ানক পাপ করেছিল সেই লোক। সে পাপ এতই ভয়ানক যে চৌধুরিপুকুরের ঠাকরুন পর্যন্ত লক্ষণের বংশের ওপর তার নিজের মঙ্গলের হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
তখন দুনিয়ায় ঘোর যুদ্ধ চলছে। নানান জিনিস চালান যাচ্ছে যুদ্ধের লাইনে। চাল, গম, ডাল, আলু, সব্জী — মাংসের জন্যে গরু, পাঁঠা। আর যাচ্ছে মেয়েমানুষ। সৈনিকেরা গোলা, বারুদ, খাবার দাবার ছাড়া যুদ্ধ করতে পারবে না — মেয়েমানুষ ছাড়াই বা যুদ্ধ করবে কি করে? দেশগাঁয়ে চারপাশে আড়কাঠি ঘুরছে — ডবকা, অল্পবয়েসি মেয়েমানুষের জন্যে ভাল দাম ধরে দিচ্ছে। ছোটো দুই বোন ছিল মেনকার বাপের, তারা তখন সদ্য যুবতী। গোপনে আড়কাঠির সঙ্গে কথা বলেছিল মেনকার বাপ — ছোটো দুই বোনের জন্যেই। বাড়িতে বোন পুষে রাখলে তাদের বিয়ে দেয়ার ঝামেলা আছে — তাতে একগাদা খরচার ব্যাপার আছে। তার থেকে এভাবে চুপচাপ পাচার করে দিলে ওসব ঝামেলা আর থাকে না। আর বোনেদের জন্মটা তো আর ও দেয়নি, দিয়েছিল ওর বাপ। সেই বাপটা তাড়াতাড়ি মরে গিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেবার দায় এড়াবে, আর সেই ঝক্কিটা পড়বে গিয়ে তার বড় ছেলেটার ঘাড়ে এটাও তো ঠিক কথা নয়। কচি বয়েসের দুটো মেয়ে — আড়কাঠিটা দরটা ভালো দিচ্ছে। নেশাভাঙ করে, জুয়ো খেলে কিছু ধার-দেনা হয়ে গেছে, হাতে দুটো পয়সা এলে সেই সব দেনাও শোধ করে দেয়া যাবে। যার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে সে লোকটা একটা গুন্ডার সর্দার — এখন ভয় দেখাচ্ছে সুদে আসলে টাকা শোধ না দিলে জানে মেরে দেবে। ওর পাওনা টাকাটা মিটিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
অতএব পদ্ম কাওরানির বাড়ি থেকে এসেছিল রাতের জন্যে বড় মাছের খানা, একটা বিশেষ গাছের শেকড় বাটা মেশানো। অনেকরকম শেকড় বাকড় চিনত জানত কাওরানি বুড়ি। এই শেকড়বাটা কম মাত্রায় খেলে চৈতন্যলোপ, বেশিমাত্রায় প্রাণনাশ। রান্নাটা খুব ঝাল তেল দিয়ে করা হয়েছিল — শেকড় বাটার তিতকুটে ভাবটা চাপা দিতে হবে তো। হ্যাংলা মেয়েদুটো একপেট ভাত দিয়ে হাপুস হুপুস করে খেয়েছিল সেই মাছের খানা — ঝালের চোটে অবশ্য ওদের চোখ আর নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। ওদের দাদা নিজে সেই খানা খায়নি। অজুহাত দিয়েছিল সন্ধেবেলা বেরিয়ে জুয়ায় জিতেছে, সেই টাকায় কাবাব রুটি খেয়ে এসেছে।
খেয়ে ওঠার আধ ঘণ্টার ভেতর বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল মেয়েদুটো। কাওরানি ঠিকই বলেছিল — আধঘন্টাটাক সময় লাগবে, তারপর কম করে চব্বিশ ঘন্টা পুরো অজ্ঞান। বুড়িটার ওপর খুশি হয়েছিল ওদের দাদা, বুড়িকে ভালো করে বক্শিস করবে, সেরকম ভেবেছিল। আড়কাঠি এসে পৌঁছেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন পর পর কয়েকটা কাজ। মেয়েদুটোর মুখ বেঁধে চাদর মুড়ি দিয়ে পুঁটলি করে বেঁধে ফেলা। তারপর যে দুটো বোঁচকা তৈরি হল সে দুটোকে নদীর ঘাট পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়ে ঘাটে বাঁধা বড় নৌকোটার খোলের ভেতর ফেলে রাখা। নিশুতি, অন্ধকার রাত — কে-ই বা বেরিয়ে এ সব দেখবে। রাতে রাতেই নৌকো জোয়ারের টানে চালিয়ে চলে যাওয়া, যেখানে চালান যাবে বলে আরও সব মেয়েমানুষ এনে রাখা আছে সেখানে পৌঁছে যাওয়া। সেখানে সব লোকজন — ব্যবস্থা রয়েছে এইসব মেয়েদের যুদ্ধের লাইনে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে।
গাঁয়ের কিছু লোক অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল, কিন্তু জোরালো কোনো কথা ওঠেনি। মেয়েদুটোর দাদা বলেছিল তার বোনেরা তার টাকা চুরি করে রাতে রাতে পালিয়েছে, শহরে গিয়ে নাম লিখিয়েছে। গাঁয়ের লোক মোটামুটি একথাই মেনে নিয়েছিল। আর না মেনে উপায়ই বা কি? তখন দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা, অনেক গরিবগুর্বো খেতে পাচ্ছে না, অনেকে চুপচাপ নিজের ঘরের বৌ-মেয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। পাশের গাঁয়ের শিরোমণি মশায় নিজের ঘরের বৌ আর সদ্য কিশোরী মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন — এ রটনা করেছিলেন তার বৌ মেয়ে বিসূচিকায় মারা গেছে — সৎকারের কাঠের অভাবে তাদের দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই টাকায় ব্রাহ্মণ একটি বাড়ন্ত গড়নের কিশোরী মেয়েকে তার বাপের থেকে কিনে নিজের ঘরে এনেছিলেন। এটা অবশ্য শোনা কথা — এ কথা রটিয়েছিল তার গাঁয়েরই তার প্রতিদ্বন্দ্বী আর এক ব্রাহ্মণ। এ কথার সত্যি মিথ্যে যাচাই করা সম্ভব ছিল না।
বোন বেচা টাকায় মেনকার বাপ নিজের দেনা শোধ করেছিল, বিয়ে করেছিল, উত্তরাধিকারসূত্রে যা জমিজিরেত পেয়েছিল তাতে ফলের বাগান করেছিল। বোনেরা আর ফেরেনি। তাদের ফেরা সম্ভব ছিল না। তখন বনেজঙ্গলে লড়াই হচ্ছে — যুদ্ধে হেরে হেরে সেনাদল পিছিয়ে পিছিয়ে আসছে। ঐ হতভাগী মেয়েগুলোর জন্যে কার অত দরদ যে তাদের সঙ্গে নিয়ে পালাবে? মেয়েগুলো মরেছে — মাতাল সেনাদের অত্যাচারে, সাপ-বিছের কামড়ে, রোগে-অসুখে। বহু মেয়ে দলছুট হয়ে গেছে, তারা মরেছে অনাহারে — অনেককে শেয়ালে, বুনো কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে। যুদ্ধের লাইনে শরীর বেচতে এসে সেখান থেকে ফিরে আসা একরকম পুনর্জন্ম পাওয়া। সে ভাগ্য মেয়ে দুটোর হয়নি।
মেনকার বাপ মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল খুব ধুমধাম করে — বোনেদের বিক্রির টাকা তখনও তার হাতে যথেষ্ট বেঁচে ছিল। ছেলের বাড়ি ছিল একটু দূরের একটা গ্রামে। কিন্তু বাপের জমি জায়গা রইল তেঁতুলগাঁয়ে, মেনকা থাকবে দশ ক্রোশ দূরে বকুলপুরে — সে কেমন করে হয়? মেনকা অতি ধুরন্ধর মেয়ে, সে কি আর অতদূরে থাকার ব্যবস্থা মেনে নেয়? ও শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে তাকে রাজি করাল — মেনকা বাপের বাড়িতেই থাকবে, ওর বর সেখানে ওর সঙ্গে থাকবে, ঘরজামাই হয়ে। শ্বশুরের আপত্তি নেই, কারণ ছেলের বৌ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে — শ্বশুর শাশুড়ির খাইখর্চার সব টাকা বৌ জোগান দেবে। শ্বশুর খুশি — আরামে আয়েসে ভালো খাওয়াদাওয়া করে দিন কাটবে, নেশা ভাঙ করার, জুয়ো খেলার খর্চাও ঐ টাকার ভেতরেই হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সে ব্যবস্থায় ঘোর আপত্তি ছিল। ভাইবোন মরা ঐ একটাই ছেলে, সে বাপ-মাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকবে তা কি করে হয়? ক’দিন খুব কাঁইমাই করেছিল মেনকার বুড়ি শাশুড়ি। তিন দিন সকাল থেকে সন্ধে ঐ চিল চিৎকার সহ্য করেছিল মেনকার শ্বশুর। চারদিনের দিন নিজের বৌকে দিয়েছিল প্রচণ্ড এক দাবড়ি — মাগি, তুই থামবি? সেই সঙ্গে আরও দিয়েছিল জোরালো কয়েকটা থাবড়া। মোক্ষম কাজ হয়েছিল তাতে। আর রা কাড়েনি মেনকার শাশুড়ি।
শ্বশুরের সঙ্গে যে কড়ার হয়েছিল মেনকা তার খেলাপ করেনি। কয়েকমাস পর পর ওর শ্বশুর আসত ওর কাছে, থাকত কয়েকদিন। সে কদিন মেনকা খুব খাওয়াত তাকে — মাছ, মাছের মুড়ো দুই-ই। আর দিত টাকা। একটু বেশি করেই দিত। ও জানত শ্বশুরের মদের ওপর দুর্বলতা আছে। হাতে যত বেশি করে টাকা পাবে তত বেশি করে মদ খাবে। তাহলে বুড়োটা মরবে একটু তাড়াতাড়ি। আর হয়েছিলও তাই। কয়েক বছরের বেশি আর বাঁচেনি মেনকার শ্বশুর। আর তার পরেই শ্বশুরবাড়িতে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল মেনকা। শাশুড়ি একবার টাকা চাইতে এসেছিল। গলাধাক্কা দিয়ে তাকে তাড়িয়েছিল মেনকা। মেনকার বর মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিল — দুই ধমকে নিজের বরকে থামিয়ে দিয়েছিল মেনকা। টাকা দেয়ার কথা হয়েছিল শ্বশুরের সঙ্গে, শাশুড়ির সঙ্গে তো নয়। শ্বশুরের সঙ্গে তো মেনকা বেইমানি করেনি। যে মারা যাবার পর তার বেওয়া মেয়েমানুষকে টাকা দিয়ে যেতে হবে এমন কোনো কথা তো হয়নি। তবে সেই বেওয়াকে খামোকা টাকা দেবে কেন মেনকা? ভীমের বাপ পুরুষমানুষ, অতএব অল্পবুদ্ধি — সে এসব নিয়ে কথা বলে কেন?
মেনকার বর চুপ করে গিয়েছিল। বৌটা খাণ্ডারনি, কিন্তু পয়সাকড়ির মালিক। বৌ এর টাকাতেই ও নিজে ভালো খায়, পরে, নবাবি করে, আর করে প্রচুর মদ্যপান। বৌ রেগে গেলে এই সুখী জীবন গোলমাল হয়ে যেতে পারে। জাঁহাবাজ মেয়েমানুষটা যদি তাকে এ বাড়ি থেকে বার করে দেয় তবে সে যাবে কোথায়? নিজের গাঁয়ে মায়ের কাছে ফিরে যাবে? সেখানে খাবে কি? কোনো কাজকর্ম করে রোজগার করার অভ্যেস তো আর নেই। মায়ের হয়ে বৌকে আর কিছু বলতে না যাওয়াই ভালো। মা বুড়িটার কপালে যদি দুঃখ লেখা থাকে তাহলে তার ছেলে আর তাকে সাহায্য করবে কীভাবে?
জীবনের শেষ দিনগুলো খুব কষ্টেই কেটেছিল মেনকার শাশুড়ির। প্রায় দিনই দুবেলা বুড়ির খাওয়া জুটত না। যাও বা চেয়ে চিনতে জোগাড় করত তা ভাত আর নুন। আধপেটা খাওয়া, পড়শিরা মাঝে মাঝে দয়া করে দিত এক আধটা আলু, বেগুন, কিংবা নরম হয়ে যাওয়া কুমড়ো। গাঁয়ের মেয়ে বৌ-রা অনেক সহানুভূতি দেখিয়ে বুড়ির দুঃখের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিত — আহা রে, তোমার কি পোড়া কপাল, তোমার জোয়ান বয়েসের ব্যাটা বসে বসে বৌএর পয়সায় খায়, মায়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। কেউ কেউ আবার বুদ্ধি দিত — যাও না ব্যাটার শউরবাড়ি, কান ধরে ব্যাটাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে এস। মাকে খেতে না দিয়ে বৌএর আঁচলের তলায় বসে থাকবে এ কেমনধারা ছেলে?
তেঁতুলগাঁয়ে মেনকার তাড়া খেয়ে বাড়ি ফিরে আসা ইস্তক ছেলের বৌকে শাপ দিত বুড়ি — চেঁচিয়ে নয়, বিজবিজ করে। শুকিয়ে কুঁচকে যাওয়া ঠোঁটদুটো কেবল নড়ত। খুব মৃদু আওয়াজ বেরোত মুখ দিয়ে — অনেকটা গুনগুন করে গাওয়া গানের মতো — নিব্বংশ হবি, বিছানায় লেগে পড়ে মরবি, গতরে পোকা পড়বে, চোখে কানা হবি—
বুড়ির শাপে মেনকার কোনো ক্ষতি হয়নি। শকুনের শাপে গরু মরে না। শাশুড়ির শাপও ছেলের বৌ রোজগেরে হলে তাকে ছুঁতে পারে না।
মেনকার হাত দিয়ে জল গলে না সেটা সবাই জানত। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা কাজে মেনকা দরাজ হাতে খর্চা করেছিল। শাশুড়ি বুড়িটা মরার পরে ভীমের বাপকে দিয়ে খুব ধুম করে মায়ের শ্রাদ্ধ করিয়েছিল। পড়শিরা, বিশেষ করে মেয়েরা, আড়ালে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, মাগির যতসব ঢং। বুড়ি বেঁচে থাকতে ওকে খেতে পরতে দিল না, এখন আবার মাগের ভেড়ো বরটাকে দিয়ে ঘটা করে মায়ের ছেরাদ্দ করাচ্ছে। অবশ্য শ্রাদ্ধের নেমতন্নটাও সবাই খুব তরিবৎ করেই খেয়েছিল — নিরিমিষ তরকারি আর চাটনির স্বাদের খুব প্রশংসাও রটেছিল।
আর একটা কাজের দায়িত্বও মেনকা নিজের ওপর নিয়েছিল। ঠাকরুনের ভয়ে বহু, বহু বছর কোনো মানুষ চৌধুরিপুকুরের ধারেকাছে যায়নি। পুকুরের চারপাশে গজিয়েছিল আগাছা আর বুনো ঝোপের ঘোর জঙ্গল। সাপ-বিছে-বিষাক্ত পোকামাকড়ে ভরে গিয়েছিল পুরো জায়গাটা। পুকুর ভরে গিয়েছিল পানা আর জল ঝাঁঝিতে। পুকুরটা আড়ে পাশে বিশাল — তার ওপর খুব গভীর, সেজন্যে কিছু জল তখনও সেই পুকুরে ছিল। তা না হলে অত বড় পুকুরটা হয়তো বুজে যেত।
এই পুকুরের সংস্কার করেছিল মেনকা। পুকুরের চারপাশের জমির জঙ্গল কাটিয়ে সাফ করেছিল। পুকুরের জল পরিষ্কার করেছিল, তাতে করে একটা বর্ষার জল পেয়েই পুকুর একেবারে জলে ভরাভর্তি থই থই হয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে এই পুকুর আর তার চারপাশ সাফসুতরো করাত মেনকা। তা না হলে ভীমের এই পুকুরপাড়ে বসে আয়েস করে শীতের রোদ পোয়ানো সম্ভব হত না। আরও একটা কথা। ঠাকরুনের ফরমানের জন্যে আর পাঁচটা লোক এই পুকুরপাড়ে আসতে ভয় খেত। ভীমের সে ভয়টা ছিল না। অন্যান্য লোকের মতো ও-ও জানত লখ্না পাইকের ওপর, তার বংশধরদের ওপর ঠাকরুনের আশীর্বাদের গল্প। লখ্নার রক্তের ছিটেফোঁটা তো ওর নিজের শরীরেও আছে।
কিন্তু ঠাকরুনকে একেবারে চাক্ষুস দেখতে পেলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। তবে ওর ভয়টা আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেল। জল থেকে যে উঠে আসছে তার তো গায়ে রোদ লেগে ছায়া পড়েছে — ঠাকরুনের জগতের বাসিন্দাদের তো ছায়া পড়ে না। কিন্তু এবার ওর ঘাড়ে অন্য এক ধরনের আবেগ চেপে বসল — ওর শরীরে রক্ত দাপাদাপি করতে লাগল, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল, এই শীতকালেও কপালে, নাকের নিচে গোঁফের জায়গাটা অল্প অল্প ঘেমে গেল।
জল থেকে উঠে আসছে একটা মেয়েমানুষ — একেবারে উদোম — ভিজে গায়ে উঠে আসছে সে।
অবশ্যি ওই মেয়েমানুষের চেহারাটা বিশেষ নয়নমনোহর নয় — বলতে কি একেবারেই নয়। গায়ের রঙ নিকষ কালো, রোগা সিঁটকে চেহারা, বুকের ওপর ছোটো ছোটো দুটো মাংসপিণ্ড কোনোমতে ঝুলে আছে। দাঁত উঁচু, নাক খাঁদা, ছোটো ছোটো কুৎকুতে দুই চোখ — চেহারা দেখেই বোঝা যায় বয়েস চল্লিশ পার হয়ে গেছে।
এই গাঁয়েরই চিত্ত বাউরির বোন ভূতনি — একবারের বিয়ে, দু বারের সাঙা আর তিন বারের বিধবা হওয়া মেয়েমানুষ। বছরখানেক হয়ে গেল, শেষ বার সাঙা করার বরটা মারা যাবার পর দাদার কাছে এসে রয়েছে। চিত্ত এখন আবার বোনের সাঙার চেষ্টা করছে। একটা সুবিধে আছে — ভূতনির যে সব বাচ্চা কাচ্চা হয়েছিল সেগুলোর কোনোটাই বেঁচে নেই। ভূতনির হয় মরা বাচ্চা হয়, নয়তো হয়ে মরে যায়। কিন্তু ওর এখন বদনাম হয়ে গেছে — যে পুরুষ ওর সঙ্গে শোবে সে কিছুদিনের ভেতর মারা যাবে। বোনকে সাঙা দিয়ে টাকা নেয়া দূরে থাক চিত্ত এখন বিনা টাকাতেও বোনকে পার করতে পারছে না। তাই এখন মদ খায় আর বোনকে গালাগাল দেয়। চিত্তর বৌ-ও ননদকে গাল দেয় — হারামাজাদি, ডাইনি, ভাতারখাকি। চিত্তর তিন মেয়ে। আরও হয়েছিল, এই কটা বেঁচে আছে। বড় দুটোর পনেরো ষোলো বছর বয়েস হতেই চিত্ত ওদের বিয়ে দিয়ে পার করেছে। ছোটোটা অনেক ছোটো, বছর পাঁচেক বয়েস। ভূতনিকে ডাকে, এই ভাতারখাকি পিসী। ভূতনিও তাতে রাগ না করেই সাড়া দেয়।
ভীমও ভূতনিকে চেনে, ডাকে ভূতনি পিসী বলে। কিন্তু এভাবে তো ভূতনিকে ভীম কখনো দেখেনি। নদীর ওপারে বাজারের সিনেমায় সে উদোম মেয়েমানুষ দেখেছে। কিন্তু সে একটা পর্দার ওপর ছবিতে — জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মেয়েমানুষের এরকম চেহারা তো সে আগে কখনো দেখেনি — হলই বা সে মেয়েছেলেটা ঘোর কালো, আধবুড়ি, রোগা সিঁটকে, দাঁত উঁচু — এক কথায় হতকুৎসিৎ। ও একবার ভাবল ঠাকরুন পুকুরে এসে চান করার সাহস ভূতনিপিসীর হল কি করে? তারপরেই ওর মনে পড়ে গেল — আরে, পিসী তো বিধবা, তাও একবারের নয়, তিনবারের। ঠাকরুন তো বিধবাদের কিছু বলে না — নিজে বিধবা ছিল কিনা। তবে এসব চিন্তা মাত্র এক লহমার জন্যে — চোখের সামনে একেবারে বেআব্রু একটা মেয়েছেলে, তখন কি আর অন্য কোনো চিন্তা মাথায় ঠাঁই পায়? শত হলেও ভীম একটা পুরুষমানুষ, বয়েসটাও কাঁচা — কাজেই মেয়েমানুষ কি বস্তু তা জানার কৌতূহল ষোলোর জায়গায় আঠেরো আনা। ভীম দাঁড়িয়ে উঠে গাছটার আড়ালে ভালো করে লুকোল, তারপর গাছের ডালপালা পাতার ফাঁকে চোখ লাগিয়ে ভূতনিকে দেখতে লাগল।
জল থেকে পাড়ে ওঠার সময়েই ভূতনি গাছের তলায় বসা ভীমকে দেখতে পেয়েছিল। তারপর আর ভীমের দিকে তাকায়নি। তাকাবার দরকার হয়নি। পুরুষমানুষ যখন হাঁ করে মেয়েমানুষকে দেখে তখন সেদিকে না তাকিয়েও মেয়েমানুষ সেটা টের পায়। পাড়ের একটা গাছের ডালে ভূতনির শাড়ি আর গামছা টাঙানো ছিল। ও সেদিকে গেল না। সোজা যে গাছটার আড়ালে ভীম লুকিয়েছিল তার কাছে চলে এল। গাছটাকে ঘুরে এসে ভীমের সামনে দাঁড়াল, দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল — আয়।
সে ডাক কি আর ভীম সামলাতে পারে? সেই গাছতলাতেই শুয়ে পড়ল দুজনে। ভূতনির অবশ্য সারা গা ভেজা, তা রোদের তাপে সেই জল শুকোতে বেশিক্ষণ লাগবে না।