• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৪ | মার্চ ২০১৯ | উপন্যাস
    Share
  • হারাধন টোটোওয়ালা (৩) : সাবর্ণি চক্রবর্তী


    ।। ৪ ।।

    টোটো কেনার পর থেকে হারার দিনগুলো কাটছিল মন্দ নয়। খুব একটা খাটাখাটনি না করেও মাসে একটা ভদ্রগোছের রোজগার হয়ে যাচ্ছিল। রোজগারের একটা সহজ উপায়ও হারা করে নিয়েছে। খালের ওপারে একটা নতুন ইশকুল খুলেছে। ইয়াব্বড় বাড়ি — ঠাস বোঝাই করে ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয়। খেপে খেপে ইশকুল চলে — কারখানায় যেরকম পালা করে কাজ হয় ঠিক সেরকম। আর বলতে গেলে ইশকুল তো একরকম কারখানাই। সেখানে অল্পবয়েসের ছেলেমেয়েদের হাতুড়ি পিটে রাঁদা দিয়ে চেঁচে তৈরী করা হয় — কারখানায় ঢোকে কাঁচা জিনিষ, বেরিয়ে আসে একেবারে চোস্ত তুখোড় এক একজন ছেলেমেয়ে। সব ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, হাকিম হবার জন্যে তৈরী। সে সব কিছু হতে না পারলে নিদেন পক্ষে ইশকুল মাস্টার। ওখানে ঢোকে সব বাচ্চা বয়েসে — ঘোড়ার বাচ্চার পিঠে চেপে যায় জিন, তার মানে ইশকুলের বই ভরতি ভারি ভারি ব্যাগ। বাচ্চাদের কেলাস বলে একেবারে সকালে, ছুটিও হয় তাড়াতাড়ি — কয়েক ঘন্টা পরেই। হারা এইসব বাচ্চাদের বাড়ির সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছে। টোটোতে বসার জন্যে মুখোমুখি দুটো সীট — এক একটাতে তিনটে তিনটে করে বাচ্চা বসিয়ে নেয়। ইশকুল যাবার সময় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, আবার ছুটির পরে ফেরৎ নিয়ে এসে যার যার বাড়িতে ছেড়ে দেয়। বাচ্চাদের নেয়ার জন্যে হারা নিজের ছবি লাগানো ইশকুলের ছাপ মারা কার্ড করিয়ে রেখেছে। ছুটির পর ইশকুলের দিদিমণি বাচ্চাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে রাখে। দিদিমণিকে হারা নিজের কার্ড দেখায়, দিদিমণি সেটা হাতে ধরে হারার মুখের দিকে তাকায় — ছবির সঙ্গে মিলছে কিনা দেখে নেয়, তারপর তার হাতে বাচ্চাকে ছাড়ে। বাচ্চাটাও অবশ্য হারার দিকে আঙুল দেখিয়ে টোটোকাকু, টোটোকাকু বলে চেঁচাতে থাকে। এখন অবশ্য মুখ চেনা হয়ে গেছে — বেশ কিছুদিন হল হারা বাচ্চাদের নিয়ে যাতায়াত করছে তো। তবুও ছবির সঙ্গে মুখ না মিলিয়ে দিদিমণি বাচ্চাকে ছাড়ে না। উপায় কি? ভুল লোকের কাছে বাচ্চা চলে গেলে তো চিত্তির। পাবলিক এসে ইশকুল ঘেরাও করবে, থানা-পুলিশ, খবরের কাগজ, টিভি এসব তো আছেই। দিদিমণির চাকরি তো যাবেই, পুলিশ কেস হয়ে হরিণবাড়িও হয়ে যেতে পারে। সুন্দর নীল রঙের একটা টেপ দিয়ে হারা কার্ডটা গলায় ঝুলিয়ে রাখে। দিদিমণি বাচ্চাটাকে হারার দিকে এগিয়ে দেয় আর শক্ত হাতে হারা তার কব্জী চেপে ধরে। তবে একসঙ্গে তো ছ জনের কব্জী ধরে রাখা সম্ভব নয়। হারার দু হাতে ধরা থাকে দুটো বাচ্চা — ওদের হাতে আবার দুটো করে বাচ্চার হাতে হাতে ধরা। বাচ্চাদের এরকম একটা শেকল বানিয়ে হারা নিজের টোটোর দিকে এগোয়। সেটা অবশ্য একেবারে দু-পা। ইশকুলের গেটের ঠিক বাইরে রাস্তা — সেখানেই হারার টোটো রাখা।

    বাচ্চাদের খুবই যত্নআত্তি করে হারা। ও সামনে বসে চালায় — পেছনে ছ ছটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে — ও তো আর দেখতে পায় না ওরা কি করছে না করছে। যদিও টোটো যথেষ্ট আস্তে চলে আর হারা খুব সামলে চালায় তবুও যদি একটা বাচ্চা টোটো থেকে পড়ে যায়? বলা তো যায় না। হারা দুটো মোটা কাছি দড়ি রেখেছে ওর টোটোতে। বাচ্চাগুলো বসার পর দুটো সীটেই ওই দড়ি এপাশ থেকে ওপাশে বাচ্চাগুলোর কোমর বরাবর বেঁধে দেয়। চটপট বেঁধে ফেলার জন্যে হারা ঠিক জায়গামত দুটো দুটো চারটে হুক লাগিয়ে রেখেছে। একবার দড়ি বেঁধে দিলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। ওই দড়ি টপকে কোন বাচ্চার সীট থেকে পড়ে যাবার ভয় আর নেই বললেই চলে।

    ইশকুলটার খুব নাম হয়েছে, সব বাপ মায়েরা হুড়োহুড়ি করে তাদের বাচ্চাদের সেখানে ঢোকাবার জন্যে। ওখানে নাকি বাচ্চাদের বাংলায় কথা বলা বিলকুল মানা — মোক্ষম পাপ লেগে যায় তাতে। আর বাংলায় কথা বলা বারণ বলেই তো ইশকুলের মাইনে এত এত বেশি। যে সব বাচ্চাদের হারা বাড়ি থেকে ইশকুল ফেরি করে তাদের কারো কারো মা হারার সঙ্গে মাঝে মাঝে একটু হেসে কথা বলেন। এরকম এক মহিলার মুখেই হারা শুনেছিল — ঐ ইশকুলের বাচ্চারা বাংলায় কথা বললে তাদের শাস্তি হয়।

    কিন্তু ইশকুলের কেলাসে যে নিয়মই থাক, টোটোতে বসে বাচ্চারা নিজেদের ভেতর ঝগড়া বাংলাতেই করে। হারামজাদা-হারামাজাদী, শুয়োর, আঁটকুড়ির ব্যাটা, এইসব। সে সব কথা কানে গেলেই হারা রাস্তার পাশে টোটো থামিয়ে দেয় — নেমে এসে ঝগড়া থামায়। একবার একটা বাচ্চা মেয়েকে হারা জিগ্যেস করেছিল, এসব কথা শিখলে কোথা থেকে? মেয়েটা খুব টরটরে, ফটাক করে জবাব দিল — বা:, মা বাবা ঝগড়া করে এসব কথা বলে তো। ঝগড়ার পরেই আবার ভাব হয়ে যায় — বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।

    একবার একটা ঝামেলা হয়েছিল। টোটো কেনবার পরে পরেই। ইশকুলের বাচ্চাদের দেয়া নেয়ার দুটো খেপই হয়ে গিয়েছে — খালি টোটো ধীরে সুস্থে চালিয়ে হারা বাড়ি ফিরছিল। এখন ও আর কোন ভাড়া খাটবে না — কেউ খালি টোটো দেখে ভাড়া নেবার জন্যে হাত তুললেও মাথা নেড়ে না বলে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। বেশি খেটে বেশি রোজগার করে হবেটা কি? খাওয়া পরার জন্যে তো আর চিন্তা নেই। হ্যাঁ, এমন হত যে ওর একটা বাচ্চা থাকত — গৌরার যেমন আছে, তাহলে হয়তো ওর কিছু বাড়তি রোজগার করার দরকার পড়ত। কিন্তু ওর বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, বাতাসিটা এখনও পেটে কিছু ধরতে পারল না। শাউড়ি বলে বাতাসির শরীরেই দোষ, হারার নিজের ধারণাও তাই। পুরুষ মানুষ — নিজের ইস্তিরিকে নিয়ম করে ভোগসুখ করছে, তার আবার দোষ হয় কি করে? বাতাসিটা কিছুতেই হাসপাতালে গিয়ে নিজেকে দেখাবে না। ওখানে সব পুরুষডাক্তার — তারা ওর গায়ে হাত লাগাবে। ও মাগো, কি ঘেন্না আর লজ্জা। তবে মেয়ে ডাক্তারের কাছে চল্‌ — হারা বলেছিল। কত মেয়ে ডাক্তার সকাল সন্ধে নিজের বাড়িতে বা অন্য কোথাও ঘর নিয়ে রুগী দেখে — ভাল দেখে কারোর কাছে গেলেই হয়। তা বাতাসি সেরকম কারোর কাছেও যাবে না। হারা তো হা ক্লান্ত, শাউড়িও কত বুঝিয়েছে মেয়েকে। ঐ রোগা শরীর, মা হলে হয়তো তাতে একটু গত্তি লাগত, বুক দুটো একটু ভারী-ভরন্ত হত, হারারও একটু সুখ হত ওকে দিয়ে। কিন্তু বৌটা কারোর কথা শুনবে না, কোন ডাক্তারের কাছে যাবে না। মুখে এক কথা, ভগবান যখন দয়া করবেন তখন ঠিক আমার কোলে ছেলে আসবে। বিরক্ত শাউড়ি ওকে বোঝান ছেড়ে দিয়েছে। বুড়িকে কাজ করে টাকা রোজগার করতে হয় — মেয়ের সামনে বসে থেকে রোজ রোজ তাকে বোঝাবার সময় ওর নেই। হারাও বাতাসিকে ওই ব্যাপারে কোন কিছু আর বলে না। থাক মাগি ওরকম শুঁটকি মেরে — দ্যাখ কবে ভগবান তোর গর্ভে ঢুকে তোকে আশীর্বাদ করে।

    হারার চোখে পড়েছিল, একটা ষণ্ডা চেহারার লোক হাত দেখিয়ে ওকে টোটো থামাতে বলছে। বেলা এখন দুপুর, কড়া রোদ এসে হারার চোখে পড়ছিল — ও ভাল করে লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। একটা রোদ চশমা কেনা দরকার, অনেকদিন ধরে কিনবে কিনবে করেও কেনা হয়নি। তবে সে লোকটার মুখ চিনে তো হারার দরকার নেই — ও লোকটার মুখের দিকে তাকায় নি। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিয়েছিল ও এখন ভাড়া খাটবে না। ওর টোটো লোকটার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল। আর লোকটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়েই শুনতে পেয়েছিল একটা বাজখাঁই গর্জন, এই শালা।

    হারার টোটো বেশি জোরে চলে না। লোকটাকে ছাড়িয়ে ও তিন চার গজের মত এগিয়ে গিয়েছিল। ঘ্যাঁচ করে ও টোটো থামিয়ে দিল। লোকটা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড় ঘুরিয়ে ওর টোটোর দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি পেছনে হঠিয়ে হারা লোকটার পাশে এসে দাঁড়াল। না এসে উপায় আছে? গলার আওয়াজ শুনেই হারা লোকটাকে চিনতে পেরেছে। মনাকে এতল্লাটে খেটে খাওয়া লোকেরা সবাই চেনে — ওর ডাক শুনেও না থেমে হারা তার বাহন চালিয়ে নিয়ে চলে যাবে, হারার ঘাড়ের ওপর কটা মাথা? টোটো থেকে মাথা বার করে হারা দাঁত বার করে তোষামদের হাসি হাসল। বলল, মনাদা, চোখের ওপর রোদ পড়েছিল — তোমাকে চিনতে পারি নি।

    মনার চোখে কালো রোদ চশমা, রাগের চোখে তাকিয়ে আছে কিনা হারা সেটা বুঝতে পারল না। মনা বলল, ঝুট বলছিস না তো রে হারামি? ইচ্ছে করে তোর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে চলে যাস নি তো?

    হারা মুখের হাসিটা আরও বড় করল। বলল, কি যে বল মনাদা, তোমাকে ঝুট বলব আমি? আমার গাড়িতে উঠে পড়। যেখানে যাবে চল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

    মনা বিশ্বাস করল হারার কথা। তাছাড়া ও জানে ওর মুখের ওপর মিথ্যে কথা বলবে এত সাহস হারার হবে না। ও টোটোতে উঠে বসল। বলল, পোবীরদা তোকে ডেকেছে। পোবীরদা পার্টি অফিসে আছে, সেখানে চল।

    পোবীরদা মানে প্রবীর সরদার — এ তল্লাটে পার্টির একজন বিরাট হোমরা চোমরা। লোকের মুখের নাম হচ্ছে পোবীরদা। আজকাল তো কোন নাম কিংবা কথার গোড়ায় র-ফলা থাকলে সেটা আর কেউ কষ্ট করে বলে না। হারাদের ঘরের খুব কাছেই একটা মাঠ — সেটা কেলাবের ছেলেদের দখলে বলে কেউ সেখানে উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি তুলতে আসে নি। শীতকালে মাঝে মাঝেই সেখানে বাচ্চা ছেলে মেয়েদের দৌড়-ঝাঁপ, এসব হয়। প্রত্যেকবার সে সব করার আগে কেলাবের ছেলেরা বাড়ি বাড়ি এসে চাঁদা নিয়ে যায়। পাড়ার বাচ্চাদের দৌড় ঝাঁপ — সবাইকে চাঁদা তো দিতেই হবে। শাউড়ি বুড়ির রোজগার ভাল — সেটা ওরা জানে। লক্ষ্মীমণি আর তার ছেলে-মেয়ে-জামাইয়ের নামে চাঁদা ধরে দেয় পাঁচশো করে টাকা। কোন কমাকমি নেই — রসিদ কেটেই ওরা নিয়ে আসে। বুড়ি গজগজ করে, কিন্তু দেয় — দিতে তো হবেই। রবিবার দিন দেখে সে সব হয় — সব বাচ্চাদের ইশকুল ছুটি থাকে তো। হারারও রবিবার কাজে বেরোবার তাড়া থাকে না বলে ও বিছানায় শুয়ে আলসেমি করে। আর শুয়ে শুয়েই শুনতে পায় সবাইকে মাইকে ডাকাডাকি হচ্ছে — দৌড়ের পোতিযোগিতার পোতিদ্বন্দীরা সব এদিকে চলে এসো, শীগগীরই দৌড় শুরু হয়ে যাবে।

    এরকম কথা হারা আরও অনেকে শুনেছে। প্রচুর। ওর নিজের ভাষায় বললে, পোচুর। এক মাঝবয়েসী মোটা, ভারী শরীরের দিদিমণি এই নটা নাগাদ ওর বাড়ি থেকে একটু দূরে বটতলাটা থেকে ওর টোটোতে চাপেন। অনেকদিনের জানাশোনা, আগে ওর সাইকেল রিকশায় চাপতেন। কি একটা সরকারি আপিসে চাকরি করেন — কখনো ছুটি নেন না। ছুটি নেয়া মানেই লোকসান। আপিসে গেলে দিনের দিন রোজগার — মাস গেলে মাইনেটা তো নেহাৎই একটা ধরাবাঁধা হাত খরচা। সেজন্যে দীঘা, মন্দারমণি, পুরী, দার্জিলিং, এসব জায়গায় যাওয়া হয় না — বাড়ির কর্তা বাচ্চাদের নিয়ে গিন্নীকে ছাড়াই ঘুরে আসেন। পুরনো চেনা, এই খাতিরে বটতলা পর্যন্ত দুটো বসার জায়গা হারা খালি রেখে দেয়, সোয়ারি পেলেও নেয় না। মহিলা মোটা মানুষ — বসার জন্যে দুজনের জায়গা তো লেগেই যায়। মহিলা একটু নাকি সুরে কথা বলেন। একদিন মহিলা টোটোতে চড়েছেন, বাকি বসার জায়গাগুলোও ভরতি হয়ে গেছে, হারা পুরো জোর দিয়ে টোটো ছুটিয়েছে — এই সোয়ারিরা সব বাসস্ট্যান্ডে যাবে। নটা তিরিশে একটা বাস ছাড়ে, নটা পঁচিশের ভেতর টোটোর সেখানে পৌঁছন চাই। হঠাৎ সেই দিদিমণি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে হাঁরা, এঁক মিনিট থামা। ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল হারা। কি হল দিদিমণির? রাস্তায় কি কিছু পড়ে গেল? টাকা পয়সার ব্যাগ? নাকি কানের দুল?

    নাঃ, সে সব কিছু নয়। রাস্তার পাশ দিয়ে সুন্দরমত দেখতে এক বয়স্ক ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছিলেন, হারার গাড়ি তার পাশ কাটিয়ে তাকে পেছনে ফেলে একটু এগিয়ে গিয়েছিল। দিদিমণি টোটো থেকে মুখ বাড়িয়ে ঐ ভদ্রলোককে ডাকতে লাগলেন, পোঁদীপদা, ও পোঁদীপদা।

    ভদ্রলোক বেশি পেছনে ছিলেন না। তার কয়েক সেকেন্ড লাগল টোটোর পাশে চলে আসতে। মহিলা প্রদীপদার সঙ্গে মিনিটখানেক কথা বললেন। কি কথা সেটা হারা শোনে নি। তারপর হারা আবার পুরোদমে টোটো ছুটিয়েছিল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নটা পঁচিশের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে। ব্যাটারিটা একটু বেশি খরচা হয়ে গিয়েছিল — তা আর কি করা যায়?

    প্রবীর সরদার হারাকে চেনেন। উনি এদিককার মানুষজন অনেককেই চেনেন। হারা, নিতাইদের মত লোক — যারা টোটো, অটো, সাইকেল রিকশা চালায়, যাদের ছোটখাট দোকানপাট আছে, যারা বাজারে দিনকের দিন তাদের সওদা নিয়ে বসে তাদের তো আরও ভাল চেনেন। আর এত চেনেন বলেই তো তিনি পার্টিতে এত্ত বড় একটা মাতব্বর, ভোট টোটের সময় এ জায়গার ব্যাপারে উনি যা বলেন পার্টি তাই করে। আর মাতব্বর হবেনই বা না কেন, উনি কি আজ থেকে পার্টি করছেন? বহু বছর হয়ে গেল উনি একেবারে পার্টির হাড়ে মাসে জড়িয়ে আছেন। পুরনো চাকরিতে যেরকম হয় — উন্নতি হয়ে হয়ে লোকে যেরকম অনেক উঁচু পদে উঠে যায়। তবে দরকার পড়লে মাঝে মাঝে চাকরি বদলের মত পার্টি বদলও করতে হয়। সেটা কোন দোষের নয়। এই ধর হারা একটা কারখানায় চাকরি করে, সেটা দেউলে হয়ে গেল, তাহলে হারা কি আর পেটে গামছা বেঁধে সেখানে পড়ে থাকবে? অন্য জায়গায় চাকরি করতে যাবে না?

    পার্টি আপিসে প্রবীর সরদার একা থাকবেন তা হতেই পারে না। চারপাশে গিজ গিজ করছে লোক। চামচার দল তো আছেই, তা ছাড়াও প্রচুর লোক অনেক কারণে প্রবীরদাকে ধরা করা করতে এসেছে। এক প্রমোটার সস্তায় জমি জোগাড় করেছে, সেখানে বড় সড় উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি বানাবে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের হাত করা হয়ে গেছে, কিন্তু জমির পরচাতে গোলমাল — পোবীরদা দয়া করলেই সব ঠিক হয়ে যায়। একজন টাক পড়া বুড়োটে লোক তার যুবতী মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ে সরকারি আপিসে পিওনের চাকরি করে, বহুদিন ধরে আপিস কামাই করে পাড়াতে জেরক্সের দোকানে কাজ করছে, তবে আপিস থেকে মাইনেটা ঠিকই নিয়েছে। আপিসে এখন একটা ত্যাঁদড় ছোকরা বয়েসের অফিসার এসেছে, আর এসেই মেয়েটিকে সাসপেন্ড করেছে। তাই বাবার সঙ্গে পোবীরদার কাছে এসেছে অফিসারের এই অন্যায় কাজের সুরাহা পাওয়ার জন্যে। একজন মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোসামুদের হাসি হাসার মত মুখ করে দু হাত কচলাচ্ছে। লোকটার কোচিং ক্লাস আছে, তা চালিয়ে ভাল রোজগার করে — ছেলেদের, মেয়েদের সবাইকেই পড়ায়। একদিন একটা মেয়েকে একলা ডেকেছিল পড়তে, তারপর মেয়েটিকে চুমু খেয়েছে, শরীরের অজায়গায় বেজায়গায় হাত দিয়েছে। বেশ কিছুদিন হাজতে ছিল, তারপর জামিন পেয়েছে। তাই প্রবীরদার কাছে দরবার করতে এসেছে — যদি মেয়েটার মা-বাপের সঙ্গে একটা সমঝোতা করা যায়। এক বাড়িওয়ালা এসেছে — সে তার বাড়ি প্রমোটারকে দিতে চায় — প্রমোটার ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে, বাড়িওয়ালাকে দেবে একটা ফ্ল্যাট আর নগদ পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু বাড়িতে একটা নচ্ছার ভাড়াটে রয়েছে, সে কিছুতেই বাড়ি ছাড়বে না। এখন প্রবীরদা যদি কিছু একটা ফয়সালা করে দিতে পারে। এ সব লোকের ভীড় ঠেলে মনা হারাকে প্রবীরের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রবীর বললেন, এই যে হারা — তুই নাকি আজকাল টোটো চালাচ্ছিস?

    কারোর কোন কথা প্রবীর সর্দারের কাছে লুকোন থাকে না, লোকের বাড়ির হাঁড়ির খবরও নয়। সব কথা সত্যি সত্যি বলে ফেলাই ভাল। হারা মুখের সব কটা দাঁত বের করে ফেলল। দু'হাত জোড় করে বলল, আজ্ঞে, এই আপনাদের আশীর্বাদে।

    কোথা থেকে কিনলি? প্রবীর জিজ্ঞেস করলেন। কোম্পানির মাল?

    আজ্ঞে না, অত টাকা কোথায় পাব? সাধনদা বানিয়ে দিয়েছে।

    সাধন বানিয়েছে? ও কত নিল তোর থেকে?

    হারা একবার ভাবল টাকার অঙ্কটা একটু কম করে প্রবীরকে বলবে। কিন্তু তাতে বিপদ আছে । ওরা সাধনকে জিজ্ঞেস করলেই সত্যি কথাটা বেরিয়ে পড়বে — তখন হারার মারধোর খাবার ভয় আছে। হারা সত্যি কথাই বলল, আজ্ঞে, এই পঁয়ষট্টির মত।

    প্রবীর হারার দিকে বাঘের চোখে তাকিয়ে আছেন, ঐ চাউনি দেখেই হারার পেটের ভেতরটা গুরগুর করছে। প্রবীর আবার পুছলেন, কোথায় পেলি অত টাকা?

    হারা তক্ষুনি ঠিক করে ফেলল লক্ষ্মীমণির কথা বলবে না। বললে বুড়িটার আর রক্ষে নেই। কেলাবের ছেলেরা রোজ আসবে — শীতলা পুজো, মনসা পুজো, ওলাচণ্ডী পুজো, মঙ্গলচণ্ডী পুজো — চাঁদা দাও। চাঁদার পরিমাণটা আবার ওরাই ঠিক করে দেবে — ভালমানুষ বুড়িটাকে পাগল করে দেবে। চট করে একটা গল্প বানিয়ে ফেলল হারা। বলল, আজ্ঞে, আমার মা যখন দেহ রাখলেন তখন কিছু টাকা আমার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন, আমি ছাড়া তো মায়ের আর কেউ ছিল না — চোখে জল নেই তবু চোখে হাত রগড়ে চোখ লালচে করে ফেলল হারা — আমার অল্প কিছু ছিল, বৌটাও কাজ করে — ওরও কিছু ছিল — সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয়ে গেল আর কি।

    তারপরই আবার বলল, টোটো কিনে ইস্তক পস্তাচ্ছি স্যার — এবারে পোবীরদা না বলে স্যার বলল হারা। রোজগার যে বেশি কিছু হচ্ছে এমন তো নয়। এদিকে হাত একেবারে খালি — বৌটা রোগামানুষ, প্রায়ই জ্বরজ্বালা হয়ে বাড়িতে শুয়ে থাকে — ওকে যে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াব সে পয়সাটা পর্যন্ত নেই।

    প্রবীর সোজা চোখে তাকিয়েছিলেন হারার দিকে। উনি হারার গল্প বিশ্বাস করেননি। গল্পটা কাঁচা, ওনার মত ধূরন্ধর লোক চরিয়ে খাওয়া নেতা এত সহজে এই গল্প কখনই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু হারা তার মায়ের নাম নিয়েছে, এ নিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে থাকলে মরা মানুষের অসম্মান করা হয়। সেটা ঠিক কাজ নয়। তবুও উনি হারাকে একটা প্যাঁচে মেরে দিলেন। বললেন, টোটো কিনে পস্তাচ্ছিস তো ওটা রেখেছিস কেন? বেচে দে। আমার চেনা লোক আছে, ওটা কিনে নেবে। বেচবি তোর টোটো?

    হারা তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে মুখ কাঁচুমাচু করল। বলল, স্যার, কিছু একটা করে তো খেতে হবে — বৌটার মুখে দুটো ভাত দিতে হবে। কিছুদিন টোটো চালিয়ে দেখি, অসুবিধে বুঝলে যন্তরটা বিক্‌কিরির চিন্তা করব।

    প্রবীর বললেন, হুঁ।

    একটু থেমে আবার বললেন, শোন্‌, আজকাল অনেকে টোটো চালাচ্ছে। তাদের একটা ইউনিয়ন করার কথা আমরা ভাবছি। মনা তোকে সব কথা বলবে। তুই এখন যা — আমি একটু ব্যস্ত আছি।

    মনা হারার সঙ্গে অফিসের বাইরে এল। হারাকে বলল, ইউনিয়ন চালু করার জন্যে তো খরচাপাতি আছে — তোকে কিছু দিতে হবে। এই ধর হাজার দশেক। আমি হপ্তাখানেক পরে তোর কাছে আসব — টাকাটা তৈরী রাখিস।

    তারপরেই খপ করে বাঘের থাবায় ওর কাঁধ চেপে ধরল। চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে গলা একটু নামিয়ে বলল, কাউকে বলবি না আমাকে দশ দিয়েছিস। পোবীরদার সঙ্গে যদি কখনো তোর দেখা হয়ে যায় তাহলে বলবি পাঁচ দিয়েছিস। বাইরে কাউকে দশ দেয়ার কথা বললে তোকে শেষ করব — তোর রোগাপটকা বৌটাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাব। বুঝলি?

    হারার কাঁধে বিলক্ষণ লাগছিল। ও ঘাড় নেড়ে সায় দিল — মনার সব কথা ও খুব ভালই বুঝেছে।

    মনা পার্টি অফিসে ঢুকে গেল। একটা বড় রকম হাঁফ ছাড়ল হারা। তারপর টোটোতে উঠে সেটাকে স্টার্ট দিয়ে চালু করল। কাঁধের ওখানটা টনটন করছে, টোটোর হ্যান্ডেলটা নাড়াচাড়া করতে একটু একটু ব্যথা লাগছে। রাতে শোয়ার আগে একটু সেঁক দিতে পারলে ভাল লাগবে। বৌটা দেবে না — ও শালী খেঁকুরে। শাউড়িকে বললে পরে শাউড়িটা ঠিক দিয়ে দেবে। যা জোরে চেপে ধরেছিল ঐ শালা মনা। কিন্তু টাকাটা জোগাড় করবে কি করে? দিতে তো হবেই — কোন তো ছাড়ান কাটান নেই। শুয়ারের বাচ্চা মনাটা নিজে পাঁচ হাজার মারবে, সে টাকায় মাল খাবে আর রান্ডিবাড়ি যাবে। নইলে পাঁচ হাজারেই ব্যাপারটা মিটে যেত। যাক্‌, সে কথা ভেবে তো কোন লাভ নেই — পুরো দশই দিতে হবে। কিন্তু কি করে? আবার কি শাউড়ির কাছে চাইবে? না:, সেটা ঠিক হবে না। লক্ষীমনির কত কষ্টের জমানো টাকা — প্রায় সবই বোধহয় হারাকে দিয়ে দিয়েছে। জিতুর কাছ থেকেই নিতে হবে। কিন্তু ব্যাটা দেবে কি? হারা তো জামানত কিছুই রাখতে পারবে না। না হয় হারা সুদটা আরও একটু বেশি দেবে। তাহলে হয়তো হারামিটা টাকাটা দেবে। টাকাটা ফেলে রাখবে না হারা। সুদ আসল, সব ছ আট মাসে শোধ করে দেবে। টোটো নিয়ে খাটাখাটুনিটা অবশ্য একটু বেশি করতে হবে। তা আর কি করা যাবে? কপালের দুর্ভোগ — এইকটা মাস কষ্ট করতেই হবে।

    তবে জিতুর থেকে টাকা ধার নেয়া সহজ, শোধ দেয়া সহজ নয়। জিতু সুদটুকু নেবে, কিন্তু আসলের কিছু টাকা শোধ করতে গেলেই বলবে পুরো টাকা একসঙ্গে ফেরৎ দিতে। একসঙ্গে দশ দশটা হাজার টাকা, সেই সঙ্গে তার সুদ। সেই সুদ আবার হাওয়ায় বাড়ে, সুদের ছানাপোনা আসল হয়ে যায়। জিতু একটা কঠিন হিসেব কষে, তারপর একটা বড়সড় অঙ্ক তৈরী করে হারার কাছে সেই টাকা চায়। কয়েক মাস চেষ্টা করে হারা দেখল জিতু একসঙ্গে যতটা টাকা চায় ও সেটা কখনই একাট্টা করতে পারবে না। কিন্তু একটা উপায় তো বার করতে হবে। বেশ কয়েক রাত ঘুমোবার আগে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রাস্তা বার করার জন্যে চিন্তা করল। শেষ পর্যন্ত একটা রাস্তা বেরোল। বাতাসির থেকে টাকা নেবে। এমনি নয়, ধার হিসেবে।

    তা বাতাসি কি আর সহজে টাকা দেয়? হারা আজ না হয় ধার হিসেবে চাইছে, পরে যদি আর শোধ না দেয়? চাইতে গেলে ওকে ধরে যদি মার লাগায়। মা তো হারাধন বলতে অজ্ঞান, জামাই মেয়েকে ধরে মারুক আর খুনই করুক, রা টি কাড়বে না। তবে হারা-ও ছেড়ে দেবার লোক নয়, ও সমানে বৌ এর পেছনে লেগে রইল। বাতাসি ব্যাঙ্কে খাতা খুলেছে, যা রোজগার করে তার প্রায় সবটাই ওখানে জমা করে দেয়। অনেক টাকা বোধহয় জমিয়ে ফেলেছে — ও ওর ব্যাঙ্কের পাসবইটা নিয়মিত ভর্তি করিয়ে নেয়, আর খুব যত্ন করে সেটাকে এখানে ওখানে লুকিয়ে রাখে, কেউ যাতে দেখে না ফেলে ওর খাতায় কত টাকা জমেছে। তবে হারা সমানে ওকে তেল দিতে লাগল। বাতাসি মুখ ঝামটা দিলে দাঁত বার করে হেসে সোহাগের কথা বলল — অবশ্য মনে মনে গাল দিল, শুঁটকি মাগি, তুই মরলে তোর টাকা কি তোর সঙ্গে চিতায় যাবে? তা শেষ পর্যন্ত বাতাসি গলে গেল — মাসখানেকের টানা তেল দেওয়াতেও একেবারে গলবে না, তা কি হয়? টাকাটা দিল, কিন্তু শর্ত হচ্ছে তিন মাসের মধ্যে টাকাটা আবার ওর নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসতে হবে। হারা তাতে খুব রাজী। আগে তো জিতুর মুঠোর থেকে বেরিয়ে আসা যাক, তারপর বৌকে টাকা দেওয়া যাবে। আর বাতাসি তো আর জিতুর মত সুদকষার অঙ্ক ফাঁদবে না।

    টাকাটা পেয়ে জিতুর মুখটা কুকুরে কামড়ালে যেরকম হয় সেরকম হয়ে গেল। তাও আবার ধার শোধের রসিদ দেবে না। বলে — তোর সামনেই তো খাতায় তোর ধার কেটে দিলাম, রিসিদ আবার কিসের? হারা প্রথমে একটু নরম সুরে কথা বলছিল, তোমার তো ছাপান রসিদ বই রয়েছে, একটা রসিদ দিতে তোমার অসুবিধেটা কি? শালা জিতু রাজী হয় না। বলে, রসিদ দিয়ে তুই কি করবি? তোর ধার শোধ হয়ে গেছে, এবার কাট এখান থেকে। তখন হারা চেঁচামেচি শুরু করেছিল। সুদের ব্যবসা করে খাচ্ছিস, ধার শোধের রসিদ দিবি না মানে? দাঁড়া, কালই মনাদাকে নিয়ে আসব, তখন মজা টের পাবি।

    হারার মনাকে নিয়ে আসার ব্যাপারটা নেহাৎই বাজে কথা, মনার থোড়ি দায় পড়েছে হারাকে সাহায্য করতে। বরং হারা ওকে এই ব্যাপার নিয়ে কিছু বলতে গেলে ও হারাকেই দেবে এক রদ্দা, দিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। হারা সে সব জানে। কিন্তু সত্যি হক, মিথ্যে হক, মনার নাম করে জিতুকে ভয় দেখাতে তো হারার কোন অসুবিধে নেই। আর কাজও হল তাতে। জিতু একবার কটমট করে হারার দিকে তাকাল, তারপর একটা সাদা কাগজে রসিদ লিখে দিল। ছাপানো রসিদ ওর আসলে নেই — এসব সুদের ব্যবসায় আইনের গোলমাল আছে — ও কাউকেই ছাপানো রসিদ দেয় না। যাই হোক, হারা ধার শোধের লিখিত একটা প্রমাণ পেয়েই খুশি। ও কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করল, তারপর শার্টের পকেটে রাখল। প্যান্টের পকেটে রাখলে দুমড়ে যাবার ভয় থাকে — হারা এই কাগজটা সেরকমভাবে রাখবে না। বাড়ি গিয়ে ভাল করে বাক্সে তুলে রাখতে হবে। একটা জেরক্সও করিয়ে নেবে — সেটা বাতাসিকে রাখতে দেবে, সেটাও ভেবে রাখল হারা। বৌটা কাগজপত্র খুব ভাল করে যত্ন করে রাখে। ব্যাঙ্কে টাকা রাখা শুরু করা ইস্তক এই অভ্যেসটা ওর হয়ে গিয়েছে।

    এখন আর কোন কাজ নয়, এবারে হারা সোজা বাড়ি যাবে। ইশকুলের যাওয়া আসা, দুটো খেপই মারা হয়ে গিয়েছে, কাজেই বাড়ি যেতে কোন অসুবিধে নেই। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে, জিতুর হাত থেকে ছুটকারা পাওয়া গেছে। জিতু অবশ্য বলে দিয়েছে — তোকে আর কোনোদিন টাকা দেব না। তবে তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। হারার তো এক্ষুনি আর কোন টাকার দরকার পড়ছে না। পরে যদি দরকার হয় তখন দেখা যাবে। সেরকম দরকার পড়লে আর জিতুর কাছে চাইলে জিতু ঠিকই দেবে টাকা। আরে বাবা, টাকা ধার না দিলে জিতু খাবে কি? ওটাই তো ওর ব্যবসা, ওর লক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলবে জিতু? কখনই না।

    যাই হোক, ধার শোধ হয়ে গেলে যে একটা আনন্দ হয় সেটা এখন বুঝতে পারছে হারা। আজ বিকেলে চায়ের সঙ্গে ও ভাল কিছু খাবে — বেগুনি খেলে কেমন হয়? শাউড়ির কাছে আব্দার করবে — লক্ষ্মীমণি নিশ্চয়ই ওকে না বলবে না। বুড়িটা তোফা বেগুনি ভাজে। বেসনের পাতে ঢাকা সরুসরু বেগুনের ফালি — বেশ ঝাল, কিন্তু আবার এতটা ঝাল নয় যে জিভ জ্বলে যায়, খাওয়া যায় না। চায়ের সঙ্গে মুড়ি আর গরম গরম বেগুনি আর পেঁয়াজের ফুলুরি — বিলকুল জমে যাবে। লক্ষ্মীমণি যদি ওর বৌ হত — না, না, ছি, ছি — ওর বৌটা যদি বরং মায়ের মত হত — চেহারায়, স্বভাবে, রান্নাবান্নায়। বাতাসিটা চেহারায় শুঁটকি, স্বভাবেও তাই। মায়ের কাছে যে রান্নার কায়দাটা শিখে নেবে, তা-ও নয়। তবে সব কিছু তো আর একসাথে পাওয়া যায় না। বাতাসির জন্যেই তো এরকম একটা শাউড়ি পাওয়া গিয়েছে। কিছু ভাল পাওয়া গেলে কিছু বাজে জিনিষ তো মেনে নিতেই হবে।

    হারা ওর সামনে একটা মেয়েমানুষকে দেখতে পেল। মেয়েছেলেটা হেঁটে হেঁটে হারা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছে। পেছন থেকে হারা এখন ওকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ভারী চেহারার মেয়েমানুষ, এমনভাবে পেছন দুলিয়ে যাচ্ছে যে হারার চোখ তার ওপর আটকে আটকে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর হারার টোটো ওর পাশ দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবে — তখন হারা ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে খুব কাছ থেকে ভাল করে দেখে নেবে। এখন রাস্তায় গাড়িঘোড়া লোকজন বিশেষ নেই — হারা অল্প একটুক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে ঐ টনকো মেয়েমানুষটাকে দেখলেও দুর্ঘটনা ঘটে যাবার ভয় নেই। হঠাৎই হারার মনে হল মেয়েছেলেটা ওর চেনা। পেছন থেকে দেখলেও খুব, খুব চেনা, ওর হাঁটার ভঙ্গীটাও দারুণ চেনা। মেয়েমানুষটার একেবারে পাশে এসে টোটো থামিয়ে দিল হারা। যদি অচেনা হয় মেয়েমানুষটা রেগে যাবে, চেঁচামেচি করে লোক জড়োও করে ফেলতে পারে। সেরকম হলে হারা দু হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেবে, বলবে চেনা লোক ভেবে ভুল করেছিল, আর লোকজন ওর টোটো ভাঙচুর করার আগেই ও টোটো চালিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু ওসবের দরকার নেই — মেয়েছেলেটা সত্যিই ওর চেনা, ছেলেবেলার খেলার সাথী। হারা ওকে ডাকল, বেবি — অ্যাই, অ্যাই বেবি।

    মেয়েছেলেটাও থেমে পড়েছে। ওর ভুরু কুঁচকে গিয়েছে — বোঝাই যাচ্ছে রাগ না করলেও বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু হারার ডাক শুনে ও থমকে গিয়েছে, ওর চাউনি থেকে বোঝা যাচ্ছে ও এখন হারাকে চিনবার চেষ্টা করছে। চিনতে পারা শক্ত, শেষ দেখা হয়েছিল মোটামুটি বছর বারো তেরো আগে। আর যদিও বেবির বয়েস তখন বছর পনের ষোল, হারা তো তখন সবে বারো। তখন ওর গোঁফই বা কোথায়, জুলপীই বা কোথায়?

    হারাই আবার কথা বলল, চিনতে পারছিস না তো? আমি হারা, হারাধন — সুলোচনা মাসির ছেলে।

    এবার বেবি চিনল। আর চিনতে পেরেই ওর মুখ হাসিতে ভরে গেল। সত্যিকারের খুশিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ওমা! হারা — তুই। তুই এত বদলে গেছিস, তোকে আমি চিনব কি করে?

    সরে বোস, বেবি আবার বলল। আমি তোর পাশে বসব। তুই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি।

    টোটোর ড্রাইভারের সীটটা ছোট। দুজনের বসা শক্ত। যদি বেবি ওর পাশে বসে তাহলে হারার পক্ষে টোটো চালানো মুস্কিল হবে। একটু আমতা আমতা করে বলল, কি জানিস, সীটটা একটু ছোট — তুই পেছনে বসলেই ভাল হয়।

    বেবি এক ধমক দিল, চোপ্‌ ব্যাটা। এত বছর পরে দেখা আর তুই কিনা তোর পাশে না বসিয়ে বলছিস পেছনে বসতে। না হয় আমাকে কোলে নিয়েই বসবি। সর্‌, সরে বোস।

    এরপর হারার আর কোন কথা চলে না। বেবি বসল হারার পাশে — ওর শরীরের অনেকটাই রইল হারার কোলে। হারার একটু জোরে চাপ লাগছিল। বেবিটা একেবারে একটা পুরুষ্টু মেয়েছেলে। ওর পেছন, উরু, বিলক্ষণ ভারী। কিন্তু একথাও ঠিক যে বেবি এভাবে হারার কোলে বসাতে হারার বেশ একটু সুখ হচ্ছিল। বাতাসিটা কখনো হারার কোলে বসে না। আর বসলেও হারার তাতে বিশেষ সুখ হত কিনা সন্দেহ।

    পায়ের ওপর জবরদস্ত ওজনের চাপ আর একই সঙ্গে সুখের অনুভূতি — দুই এ মিলে হারাকে একটু আনমনা করে দিয়েছিল। টোটোটাও শামুকের মত গড়িয়ে গড়িয়ে এগোচ্ছিল। হারার চমক ভাঙল বেবির গলার আওয়াজে। শুনতে পেল বেবি বলছে, বাজারের দিকে চল্‌।

    হারা একটু অবাক হয়ে গেল। বলল, তোর বাড়ি তো ওদিকে নয়। কিছু কিনবি নাকি?

    বেবি চোখ নাচিয়ে হাসল। বলল, আমি যেখানে বলছি সেখানে চল। ওখানে গিয়ে সব বুঝিয়ে দেব।

    অতএব হারার গাড়ি গিয়ে পৌঁছল বাজারের পেছন দিকটায় — সেখানে সার সার টালির আর টিনের চালের ঘর। পাকা ছাদের ঘরও রয়েছে কয়েকটা, কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। হারা আরও অবাক। এটা তো রেন্ডি পট্টি। বেবি ওকে এখানে নিয়ে এল কেন?

    বেবি নেমে পড়ল। ও এখন গম্ভীর। সেভাবেই বলল, আমি নটি হয়েছি, বুঝেছিস, বাজারে নাম লিখিয়েছি। এখন পুরুষমানুষকে আমার ঘরের দরজা পেরোতে হলে টাকা দিতে হয়।

    হাতের ছোট ব্যাগটার থেকে বেবি একটা চাবি বার করল। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটা পাকা ঘর, সেটার তালায় চাবি লাগিয়ে সেটা খুলল। হাত দিয়ে ঠেলে দরজা খুলে ধরে বেবি হারাকে বলল, আয়, আমার ঘরে বসবি। ভয় নেই, ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবার জন্যে আমি তোর টাকা নেব না। অন্তত: প্রথমবার তো নয়ই।

    খিল খিল করে হেসে উঠল বেবি। ওর হাসিটা বড় সুন্দর, হারা ভাবল। সেই অনেক বছর আগে যেরকম ছিল।

    হাসি থামিয়ে বেবি বলল, তোর গাড়ি ভাল করে বেঁধে ছেদে রাখ। জায়গাটা তো ভাল নয়, হরেকরকম উৎপটাঙ লোক এখানে ঘোরাঘুরি করে। বেঁধে না রাখলে এখানে গাড়ি চুরি যাবার ভয় আছে।

    হারা এদিক ওদিক তাকিয়ে জায়গাটা ভাল করে দেখল। কোথায় একটু জায়গা আছে যেখানে গাড়িটা রাখা যায়? এখন দুপুরবেলা — বেশির ভাগ ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। খালি গোটা তিনেক যুবতি বয়েসের কুৎসিৎ মুখের মেয়ে একটা ঘরের খোলা দরজার বাইরে জলচৌকির ওপর বসে পা সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে — নিজেদের মধ্যে হি হি হা হা করে গল্প করছে। মেয়েগুলোর কাপড় হাঁটু অবধি তোলা, মুখ থেকে গত রাতে মাখা রঙ এখনও ভাল করে ওঠে নি। ওদের কাছেই বসে আছে একটা আধবুড়ি মেয়েমানুষ — চুল খোলা, খোলা চুলে দু হাত ঢুকিয়ে বিলি কাটছে। হারাকে দেখে মেয়েগুলো গল্প থামিয়ে ওর দিকে কৌতূহলের চোখে তাকাল, ঐ আধবুড়ি মেয়েমানুষটাও। বেবি দিন দুপুরেই টোটোতে চড়ে খদ্দের নিয়ে এসেছে, তাকে তো ওভাবে দেখবেই।

    বেবির ঘরের পাশে একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে কোনমতে টোটোটা ঢুকিয়ে রাখা যায়। হারা কায়দা করে টোটোটা আগে পিছে করে সেখানে ঢোকাল। তারপর একটা মোটা লম্বা শেকলে তালা লাগিয়ে টোটোর সামনের চাকাটা বাকি দুটোর সঙ্গে বেঁধে ফেলল। ওগুলো এখন আর ঘুরবে না। আর টোটোটা তুলে ঘাড়ে করে কেউ তো আর নিয়ে যেতে পারবে না। এবার বেবির ঘরের দিকে পা বাড়াল হারা।

    ভারী বর্ষায় এখানে মাঝে মাঝে জল জমে যায়। সেই জল আটকাবার জন্যে এই ঘরগুলোর দরজার চৌকাঠ একটু উঁচু। বেবির ঘরে ঢুকতে গিয়ে হারা ঐ চৌকাঠে একটা জোর হোঁচট খেল — ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটায় বেশ ব্যথা লাগল। বেবি ওকে ধরে না ফেললে ও হয়তো মুখ থুবড়ে পড়েই যেত। হঠাৎ করে ওর একটা খটকা লাগল। ওর এই হোঁচট খাওয়াটার কোন বিশেষ অর্থ নেই তো? এই ঘরে ঢুকলে পরে কোন এক সময়ে ওর খারাপ কিছু হবে না তো? কিন্তু ও সঙ্গে সঙ্গেই মন থেকে এই সন্দেহটা তাড়াল। দূর, এসবের কোন মানে নেই। বেবির ঘরে ঢুকে পড়ল হারা। বেবি কি করে এখানে এসে পড়ল তা জানবার কৌতূহল ওকে এখন কুরে কুরে খাচ্ছে। বেবির কথা সব কিছু না জেনে ও এখান থেকে কোথাও নড়তে পারবে না।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments