অঘ্রাণ মাস পড়ে গিয়েছে। অল্প অল্প শীত পড়েছে, কিন্তু এখনও সেরকম জাঁকিয়ে পড়েনি। সকালের রোদটা মিঠে লাগে বটে কিন্তু মাঝদুপুরের রোদ বেশ কড়া।
এখন দুপুরবেলা। মেনকা বাড়ি নেই। সকাল সকাল ভাত খেয়ে নিয়ে বাগানের তদারকিতে বেরিয়ে গেছে। ফিরবে সেই বিকেল পার করে। ওর হাতে অনেক কাজ। আগাছা কাটানো, বাগানে সার দেয়া, যারা এসব কাজ করছে তাদের ওপর হম্বিতম্বি করা। লোকগুলো সব সেয়ানা, ওদের ওপর নজর না রাখলেই কাজে ফাঁকি দেবে, কিন্তু দিনমজুরিটা ঠিকই নেবে। মেনকা আবার যে সে সার দেয় না, জৈবিক সার হওয়া চাই। একটা লোক আছে, তেঁতুল গাঁ থেকে কয়েকটা গ্রাম পরে থাকে — সে এসব সার তৈরী করে। গাছের পাতা, গোবর এসব পচিয়ে তৈরী করে। ভালো ব্যবসা করছে ছোকরা। দাম বাজারের কেমিক্যাল সারের চাইতে একটু বেশি নেয়, কিন্তু ওর বানানো সার দিলে ফলপাকুড় ফসলের স্বাদ খোলতাই হয় অনেক বেশি। তাছাড়া জৈবিক ফল, এই নামে বিক্রী হয়, তার দামও পাওয়া যায় বেশি। আজকাল ডাক্তারবাবুরা তো পরামর্শ দেন ঐ জৈবিক সার দিয়ে তৈরী হওয়া ফসল খেতে। সব লোকজনও খুব জোর ঝুঁকেছে জৈবিক ফসলের দিকে।
মেনকা ওই সারের একজন নিয়মিত খদ্দের। ভীমের বাপ যখন মারা গিয়েছিল, ভীম তখন নেহাতই ছেলেমানুষ, তখন ওর আশা ছিল ভীম বড় হয়ে এসব কাজকর্মের দায়িত্ব নেবে। এখন ভীম সোমও বয়েসের হয়েছে ঠিকই কিন্তু মেনকার সে আশায় ছাই পড়েছে। বাড়িতে ভীমের কাজ খালি জুৎ করে খাওয়া আর শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোন। কয়েকটা বখা ছোকরা ওর ইয়ার — ওরাও কোনো কাজ করে না, খালি বাপের অন্ন খায়। মেনকা মরলে হতভাগাটার কি যে হবে কে জানে। ওকি আর এইসব বাগানটাগান সামলাতে পারবে? সন্দেহ আছে। যাক্, ওর কপালে যা আছে তাই হবে। তখন তো মেনকা আর তা দেখতে আসবে না।
ভীম কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ঘুম দিচ্ছিল। একটু আগে একপেট খেয়েছে — ডালের সঙ্গে শীতের বেগুন দিয়ে ভাজা, কুচোচিংড়ি দিয়ে লাউ ঘন্ট, পারশে মাছের ঝাল। রান্নাটা মেনকা করে না — কমলামাসি আছে রান্না আর বাড়ির সব কাজের জন্যে। কমলা মেনকারই বয়েসী, কিন্তু অল্প বয়েসেই বিধবা হয়েছিল। ওর বাপ ছিল এই গাঁয়েরই লোক — বড় গরীব, মেয়ের পনেরো ষোলো বছর বয়েস হতে না হতেই ওকে একটা পঞ্চাশ পার করা লোকের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে মেয়ের দায়িত্ব নামিয়ে দিয়েছিল। কমলার বরটা বেশিদিন টেঁকেনি, কয়েক বছরের মধ্যেই মারা গিয়েছিল। কোলে একটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে কমলা ফিরল বাপের বাড়িতে। কিন্তু বাপ আর বাড়িতে ওকে জায়গা দিতে চায় না। কমলা আর তার বাচ্চাকে খাওয়াতে যে খরচা সেটা দেয় কে? তখন মেনকা নিজের বাড়িতে ঘরের কাজে বহাল করল কমলাকে। বাড়িতে কমলার আদর বেড়ে গেল। রোজগেরে মেয়ে, তার পয়সায় বুড়ো এখন বসে খায়, খাতির যত্ন তো করবেই। কমলার বাচ্চাকে সারাদিন তার দিদিমা সামলায়। কারণ মেনকার বাড়িতে ওর কাজ সারাদিনের, একেবারে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। সন্ধেবেলা নিজের রাতের খাবার কয়েকটা কৌটোতে ভরে পুঁটলি বেঁধে নিয়ে যেত কমলা। অবশ্য খাবারটা একটু বেশি করেই নিত, যাতে করে ওর বাপ মায়েরও তাতে কুলিয়ে যায়। সন্ধের পর গাঁয়ের রাস্তা অন্ধকার। যদিও ওর বাড়ি কাছেই ছিল তবুও অন্ধকারে হাঁটা ঝুঁকির কাজ। যুবতি মেয়েকে শুনশান ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় পেলে বদমাশ লোক তো বটেই, এমনকি ভদ্দরলোকের মাথাতেও বদ মতলব চাপতে পারে। তাছাড়া গরমকালে, বর্ষাকালে সাপ খোপ বিছেও তো পায়ের সামনে পড়তে পারে। মেনকা ওকে একটা হ্যাজাক লন্ঠন কিনে দিয়েছিল, তার আলো খুব জোরালো। একহাতে খাবারের পুঁটলি, আর একহাতে ঐ লন্ঠন নিয়ে দিব্যি বাড়ি চলে যেত কমলা। ঐ লন্ঠন দেখে দূর থেকেই লোকে বুঝতে পারত মেনকার কাজের লোক ঘরে ফিরছে। গাঁয়ের কিছু লোকের নজর অবশ্যি কমলার ওপর ছিল। কাঁচা বয়েসের বিধবা, বাপটাও গরীব, লোকজনের নোলায় জল আসতেই পারে। কিন্তু এটাও সবাই জানত কমলার পেছনে মেনকা আছে, কমলার দিকে কুনজর দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
কমলা একবার মেনকাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। মেয়েকে নিয়ে কমলা মেনকার বাড়িতেই থাকবে, রাতে রান্নাঘরে শোবে। মাইনেটা সে বাবদে কিছু কম নেবে। কিন্তু মেনকা তাতে রাজী হয়নি। ভীমের বাপ তখন বেঁচে। সে-ই যদি কমলার দিকে নজর দেয়? মেনকা সেটা আটকাতে পারবে কি? কি দরকার বাড়িতে ওসব ঝামেলা ডেকে আনার? এখন অবশ্যি কমলা মেনকার বাড়িতেই থাকে, কিন্তু সে অনেক পরের কথা। প্রথমে মারা গেল কমলার মেয়েটা। শক্ত রকম পেটখারাপ হয়েছিল। ডাক্তারবদ্দি তো আর দেখানো হয়নি, সেই পেটখারাপ আর সারলই না। আর তার পরে পরেই মরল কমলার বাপ, তার বছরখানেক পরে মা। জ্বর হয়েছিল, সেই সঙ্গে হাঁপের টান। বেশ কিছুদিন ধরেই হাঁপানিতে ভুগছিল। তবে গাঁয়ের কিছু শয়তান লোক অন্য কথাও বলেছিল। বাপ মরার পর কমলা নাকি মাকে ভাল করে খেতে দিত না। আধপেটা খানা দিয়ে বলত মেনকাদি ওটুকুই পাঠিয়েছে। দুপুরের ভাত রাঁধবার জন্যেও যেটুকু চাল বার করে দিয়ে যেত তাতে একটা লোকেরও খাওয়া হয় না। বছরখানেকের ভেতর হাড় জিরজিরে বুড়ি হয়ে গিয়েছিল কমলার মা। পাড়া প্রতিবেশী মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে আহা উহু করত, কমলার মায়ের হয়ে তার মেয়েকে গালাগাল দিত, মাঝে মাঝে কিছু রান্না করা খাবারও দিয়ে যেত। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। বারো মাস ধরে পাশের বাড়ির একটা বুড়িকে খাওয়াবার দায়িত্ব তো কেউ নেবে না। রোজগেরে মেয়ে আছে, তারই তো উচিৎ মাকে ঠিক করে খাওয়ানো। শীতের গোড়ায় ঠান্ডা লেগে সে বুড়ির হাঁপের টান উঠেছিল। শীত শেষ হওয়ার আগেই বুড়ি মারা গেল।
কিন্তু তখনও মেনকা কমলাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেয়নি। ভীমের বাপ বাড়িতে রয়েছে, রাতের বেলায় সে যেন মেনকা ছাড়া আর কোনো মেয়েমানুষকে হাতের কাছে না পায়। কমলার বাপের ভিটের ঘরটা ভাঙাচোরা, খড়ের চালের জায়গায় ফুটো — কমলা মেনকার কাছে ঘ্যানঘ্যান করলে মাঝে মাঝে মেনকা ঘর মেরামত করবার টাকা দিয়েছে। কিন্তু রাতে কমলার থাকার ব্যাপারে মেনকার রায় খুব পরিষ্কার। দ্যাখো বাপু, এখনও তোমার পুরুষমানুষের সঙ্গে শোবার বয়েস পার হয়নি, আর আমার কর্তাটিরও মেয়েমানুষের খিদে কিছু কম নয়। তোমাকে বাছা নিজের ঘরেই ফেরৎ গিয়ে রাত কাটাতে হবে।
ভীমের বাপ মারা গিয়েছিল আরও বেশ ক’বছর পরে। অজ্ঞান হয়ে গিয়ে আর হুঁশ ফিরে আসেনি। লোকে বলেছিল সন্ন্যাস রোগ। বেশিরকম দিশি মদ আর চর্বিদার খাসি খাওয়ার ফল। নদীর ওপারের দোকানে সেসব প্রচুর গিলে আসত মেনকার কর্তাটি। বেশ ক’দিন মেনকা কমলার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। তারপর নিজে থেকেই কান্না থামল। বাগানের দেখাশোনা করতে হবে, ভীমের এখনও গোঁফ গজায়নি, ওকে বড় করতে হবে — এসব চিন্তা মাথায় থাকলে কান্না বেশিদিন থাকে না। তখন মেনকা কমলাকে বলল, বাপের ঘরের আগলে তালা লাগিয়ে কাপড় জামা নিয়ে আমার এখানে চলে আয়। তোর শোয়ার জন্যে ছুতোর ডেকে একটা একজনের মতো তক্তপোষ বানিয়ে দেব। কমলা ভাবছিল মেনকা ওর মাইনে একটু কমিয়ে দেবে কিনা। কারণ অনেকদিন আগে ও নিজেই তো মেনকাকে সেরকম একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেরকম কোনো কথা উঠলে ও তাতে রাজী হবে না, কখনোই না। তবে মেনকা সেরকম কিছু বলেনি। সেই থেকে কমলা এ বাড়ির পাকাপোক্ত বাসিন্দা।
বেশ একটা ভাতঘুম দিয়ে ভীম উঠে পড়ল। বেরোতে হবে, সন্ধেবেলা ওদের ‘পোগ্রাম’ রয়েছে — আজ আবার ‘ইস্পেশাল পোগ্রাম’। মা বুড়ি ফিরে আসবে সন্ধের মুখে মুখে, তার আগেই বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়তে হবে। মা-র মুখোমুখি হলেই খিটখিট পিটপিট, বকুনি ঝকুনি — কাজকর্ম করার নাম নেই, অপদার্থ ছেলে চলল ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে নেশা করে আড্ডা দিতে। মা ফিরবার আগে বেরিয়ে গেলে এসব ঝামেলার ভয় নেই। ও বাগানের কাজকর্ম কিছু দেখে না বলে মায়ের খুব দুঃখ সেটা ভীম ভালরকম জানে। কিন্তু বাগানের কোথায় আগাছা কাটাতে হবে, কোন গাছের গোড়ায় পোকা ধরবে ধরবে করছে, কোথায় গোবরপচা সার দিতে হবে, কোন গাছে ফল পেকেছে তা বাদুড় যাতে না ঠোকরায় তার ব্যবস্থা করতে হবে সেসব ভীমের পোষাবে না। মা মরলে পরে ওসব তো ভীমের ঘাড়ে পড়বেই, তখন দেখা যাবে।
দেয়ালে লাগানো কয়েকটা বর পেরেকে ভীমের শার্ট, প্যান্ট এসব ঝুলছে। ঘরে একটা আলনা রয়েছে, কিন্তু নিজের জামা প্যান্ট এসব রাখার জন্যে ও দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেরেক পুঁতে নিয়েছে। এই পেরেক লাগানোর সময়তেও মায়ের সঙ্গে একচোট চিল্লামিল্লি হয়েছে ওর। অবশ্য চেঁচানোটা একতরফা, মেনকাই চেঁচামেচি করেছে ছেলের ওপর, ভীম চুপ করে থেকেছে। কদিন চেঁচিয়েই তো মা চুপ করে যাবে, তখন দেয়ালে পেরেক থাকাটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আর তাই হল। কদিন মেনকা চেঁচিয়ে ছেলেকে গালাগাল দিল — গাধা, শুয়োর, গরু। তারপর চুপ করে গেল, ভীম নিজের জামাপ্যান্ট দেয়ালের পেরেকেই ঝুলিয়ে রাখতে লাগল।
ভীম আটপৌরে জামা পাল্টে বাইরে যাবার পোষাক পরে নিল। গরম সোয়েটারও পরল একটা। ফিরতে রাত হবে, বেশ ঠান্ডা পরবে তখন। প্যান্টের পকেটে একবার হাত দিয়ে দেখে নিল — হ্যাঁ, টাকাগুলো ঠিক আছে। আজ সন্ধেবেলায় ভাল খরচা আছে। সেজন্যে ভীম মায়ের বাক্স থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়েছে। মা মাসে মাসে একটা হাতখরচা দেয় ঠিকই, কিন্তু ঐ কটা টাকায় কি-ই বা হয়? তাও আবার দেয়ার সময় কিপ্টে বুড়িটা গজর গজর করে। কাজেই ভীমকে মাঝেমাঝেই মায়ের বাক্সে হাত দিতে হয়। বুড়ি বাক্সে তালা লাগিয়ে রাখে, সেজন্যে ভীম চুপচাপ ঐ তালাটার একটা দু নম্বর চাবি বানিয়ে নিয়েছে। এই চাবিটা বানাতে ভীমকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নদীর ওপারে বাজারে একটা চাবিওয়ালা বসে। ও বলেছিল আসল চাবিটা নিয়ে আসতে। তাহলে ও ওই চাবিটার মাপের কাছাকাছি আর একটা চাবিকে ঘষে মেজে আর একটা চাবি বানিয়ে দেবে। কিন্তু তা বললেই কি করা যায় নাকি? চাবিটা থাকে এক গোছা চাবির সঙ্গে, মায়ের আঁচলে ওই গোছাটা সব সময় বাঁধা থাকে। ভীম তাতে হাত লাগাবে কি করে? তখন লোকটা বলল, তাহলে মোমের ওপর ওই চাবির ছাপ নিয়ে এখানে নিয়ে এসো, আমি ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে ঘষাঘষি করে আর একটা চাবি বানিয়ে দেব। কিন্তু সেটাও তো শক্ত কাজ, প্রায় অসম্ভব বললেই হয়। এক হয়, বুড়ি যখন পুকুরে চান করতে যায় সেই সময়। তখন পরণের কাপড় ছেড়ে রেখে দুটো গামছা গায়ে দিয়ে যায়, সেভাবেই ফেরে। কিন্তু তাতেও মুস্কিল আছে। প্রায় দিনই বুড়ির চান হয়ে যায় ভীম ঘুম থেকে ওঠার আগে, ভীম বুড়ির চানের আগে ঘুম থেকে উঠে মোম টোম নিয়ে তৈরী হয়ে থাকবে সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ভীম হাল ছাড়েনি, তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগ এল বেশ কিছুদিন পর। শক্ত অসুখে পড়েছিল মেনকা, কদিন জ্বরে একেবারে বেহুঁশ ছিল। ওর গায়ের কাপড়ের আঁচল আর তাতে বাঁধা চাবির গোছা ওর পাশে বিছানায় পড়েছিল। বাক্সের তালাটা টাইগার মার্কা, সেটা ভীম জানত। গোছার ভেতর থেকে টাইগার মার্কা চাবিটার ছাপ মোমের ওপর নিয়ে নিয়েছিল ভীম। মেনকা নড়াচড়া করেনি, চোখও খোলেনি। ভীম এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল। একে তো ধূম জ্বর, তার ওপর ডাক্তার আবার ঘুমেরও ওষুধ দিয়েছিল — মেনকার জেগে উঠে জানতে পেরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মোমের ওপর ছাপটা খুব সাবধানে চাবিওয়ালাটার কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। অনেকটা রাস্তা, মাঝখানে আবার নৌকোয় নদী পার হওয়া — মোমের তালটা ভেঙে গেলেই সব গেল। কপাল ভাল, সেরকম কিছু হয়নি। সেই ছাপের ওপর চাবি রেখে রেখে মিলিয়ে মিলিয়ে আর ঘষাঘষি করে একটা চাবি বানিয়ে দিয়েছিল লোকটা। তবে তার দামটা একটু বেশিই হেঁকেছিল। ওর প্রায় এক মাসের হাতখরচা। তবুও ভীম দিয়েছিল। ঐ চাবিটা হল একটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস। সেটা নিয়ে তাই ভীম আর দরকষাকষি করেনি। তবে একটা শর্ত করে নিয়েছিল। ঐ চাবিতে তালাটা না খুললে ও আবার চাবিটা নিয়ে আসবে চাবিওয়ালার কাছে — চাবিটা আর একটু ঘষে টষে ঠিকঠাক করে দিতে হবে। আর সেটা বিনে পয়সায়। চাবিওয়ালা ততক্ষণে নিজের অন্য কাজে মন দিয়েছিল। ভীমের দিকে আর না তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় জবাব দিয়েছিল, সে হবে — সেরকম হলে তখন দেখা যাবে।
বাড়ি ফিরে ইস্তক চাবিটা তালার ওপর পরীক্ষা করার জন্যে ছটফট করছিল ভীম। বাক্সটা যে ঘরে মেনকা তো সে ঘরেই শুয়ে আছে। যদিও মেনকা এখনও খুব কাহিল, বেশিরভাগ সময়েই ঘুমোচ্ছে, ওর জ্বরটা ডাক্তারের ওষুধে কমছে আস্তে আস্তে। বাক্সের তালায় চাবিটা লাগাতে সাহস হয় না — যদি আচানক ঘুম ভেঙে যায় আর চোখ খুলে তাকায়? তাহলে তো সর্বনাশ। রাতে যে চুপিচুপি কাজটা সেরে নেবে তাও হবে না। কমলামাসি রান্নাঘরের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে সন্ধে থেকে এ ঘরেই থাকছে, রাতে এ ঘরেই শুচ্ছে। মুস্কিল, বড় মুস্কিল।
কয়েকদিন পরে দাঁড়িয়ে উঠল মেনকা। সঙ্গে সঙ্গে বায়না ধরল এক আধ ঘণ্টার জন্যে হলেও গিয়ে বাগানের অবস্থা দেখাশোনা করে আসবে। কমলার তাতে প্রবল আপত্তি — ও কিছুতেই এখন মেনকাকে বেরোতে দেবে না। ভীম মনে মনে কমলাকে গালাগাল দিল। তারপর মাকে উৎসাহ দিল, ঠিক আছে মা, জ্বর তো বেশ কয়েকদিন হয় ছেড়ে গেছে — আধঘন্টা একঘণ্টার জন্যে একটুখানি বাইরে বেরোলে ক্ষতি কিছু হবে না। ডাক্তারবাবু তো বাইরে বেরোতে একেবারে মানা করেননি। তুমি বরং কমলামাসিকে সঙ্গে নিয়ে যাও। ফিরতে বেশি দেরি কোরো না।
কমলা অখুশি হওয়ার মুখভঙ্গী করে বলল, আমি কেন? তুমি রয়েছ, জোয়ান ব্যাটা, তুমিই মায়ের সঙ্গে যাও না কেন? আমার রান্নাঘরে ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে।
ভীম অসহায়ের মতো একটা মুখ করে বলল, আমিই যেতাম, কিন্তু আজ আমার পেটটা একটু খারাপ হয়েছে, বার বার বাইরে যেতে হচ্ছে। মাসি, মায়ের সঙ্গে তুমিই যাও। একদিন রান্না হতে আধঘন্টা দেরি হলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
মেনকা ছটফট করছিল বেরোবার জন্যে। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কমলা, তুই-ই আমার সঙ্গে চল। আমার ছেলেটা তো একটা অপদার্থের একশেষ — ওকে দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? লক্ষ্মী বোনটি, চল আমার সঙ্গে। আঁটকুড়ের ব্যাটারা এই কদিনে বাগানটা চুরি করে শেষ করে দিল কিনা কে জানে?
ওরা বেরিয়ে গিয়ে একটু তফাতে যেতেই ভীম তালাটায় নিজের চাবিটা লাগিয়েছিল। খুব ভাল জাতের তালা তো নয় — কিপ্টে বুড়ি বেশি দাম দিয়ে তালা কিনবার পাত্রী নয়। একটু আটকাচ্ছিল চাবিটা, কিন্তু অল্পবিস্তর আগে পিছে করে একটু চাপ দিতেই তালাটা খুলে গেল। সেই থেকে ভীমের পোয়াবারো।
মেনকা তার বাক্সে গুছিয়ে টাকা রাখে না। তা যদি হত তাহলে সেখান থেকে টাকা সরাতে ভীমের যথেষ্ট অসুবিধে হত, ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশিরকম থাকত। মেনকা টাকা বাক্সে রাখে এলোমেলো করে — সব নোটগুলো এদিক ওদিক মেশামেশি হয়ে থাকে। ও যা নগদ টাকা পায় সব বাক্সের ডালা তুলে ভেতরে ফেলে দেয় — দশ, একশো, পঞ্চাশ, পাঁচশো, সব নোট একসঙ্গে মিলেমিশে যায়। ও টাকা গুছিয়ে গুণে নেয় মাসে খালি একদিন — যেদিন ও একজন লোক সঙ্গে নিয়ে নদীর ওপারে ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকাটা জমা দেয়, ব্যাঙ্কে ওর যে খাতা তার বইটা ভরিয়ে নিয়ে আসে। ভীম টাকা সরায় খুব কায়দা করে। বাক্সের ওপর দিকের নোটগুলো নেয় না — ভেতর থেকে সাবধানে টেনে নেয় কয়েকটা নোট — কয়েকটা একশো টাকার নোট, সেই সঙ্গে কিছু পঞ্চাশ আর দশের নোট। ভীম পাঁচশো-হাজার টাকার নোট সরায় না। বুড়ির চোখ শকুনের মতো, তাহলে ঠিক ধরে ফেলবে। আর একদিনেও বেশি নেয় না ভীম। কেবল আজকেই একটু বেশি নিতে হয়েছে। শ’পাঁচেকের মতো সরিয়েছে। বুড়ি আবার টের না পেয়ে যায়। তাহলে যা ঝামেলা হবে না — মা একেবারে তাণ্ডব নাচবে। তাছাড়া বাক্সের তালা বদলে ফেলতে পারে। তাহলে আর এক গেরো। নতুন চাবি বানানো তো আর মুখের কথা নয়। যাক্, মা টের পেল কিনা বোঝা যাবে কাল সকালে। আজ ভীমের ফিররে রাত হবে, ততক্ষণে বুড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। সারাদিন বাগান তদারকি করে ভীমের ওপর চেঁচাবার জন্যে অত রাত অবধি জেগে থাকবে না।
বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়েও থমকে গেল ভীম। এখনও হাতে সময় আছে, একটু চা খেতে পেলে ভাল হয়। ও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
রান্নাঘরে কমলা মাদুর বালিশ পেতে তার ওপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, নাকও ডাকছে অল্প অল্প। এখন ডাকলে পরে রেগে যাবে, ভীমকে দেবে এক খ্যাঁচানি। কিন্তু ভীম জানে যে কমলামাসি ওকে ভালবাসে, নিজের ছেলের মতই দেখে। খিঁচুনি দেবে ঠিকই, কিন্তু চা-ও করে দেবে। ভীম খুব আস্তে করে ডাকল, কমলামাসি, একটু উঠবে? আমি বেরোব, আমাকে একটু চা বানিয়ে দেবে?
কমলার নাকের ডাক থেমে এল, কিন্তু ওর ঘুম ভাঙল না। বেলা পর্যন্ত খেটে সব কাজ সেরে এক পেট ভাত খেয়ে সবে ঘুমিয়েছে, এত চট করে কি আর ওর ঘুম ভাঙে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অন্য পাশ ফিরল কমলা।
ভীম ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ডাকল, ও মাসি, ওঠো না — আমাকে একটু চা করে দাও না।
এবার কমলা জাগল। সবে ঘুম ভাঙা লাল লাল চোখে কটমট করে ভীমের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় একটা ধমক লাগল, কি, চাইটা কি?
মুখটা বেচারা বেচারা করে ফেলল ভীম। করুণ গলায় বলল, মাসি, আমি এখন বেরোব। একটু চা যদি করে দাও তাহলে তা খেয়ে যাই।
বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে কমলা উঠল, নিজের কাঁথা মাদুর গুটিয়ে নিল। উনুনে এখন আর আঁচ নেই — কেরোসিন তেলের স্টোভ পাম্প করে জ্বেলে নিল কমলা। তারপর তাতে চায়ের জল চাপিয়ে দিল।
রান্নাঘরটা বেশ বড়। উনুনের তাতে ঘরটায় বেশ ওম হয়ে আছে, তার জন্যে এই শীতের বিকেলের মুখে এ ঘরটায় বেশ আরাম লাগছে। কমলার মাদুরটা আবার খুলে নিয়ে ভীম তার ওপরে রান্নাঘরের অন্যদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। দেখতে লাগল ফোটানো জলে চায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়েছে কমলামাসি, এবার গোটা দুই ডিম ফেটিয়ে নিয়ে তাতে চৌকো করে কাটা পাঁউরুটির চাক্তি ভেজাচ্ছে। কমলামাসি ওর ওপর যতই বিরক্ত হোক, শুধু চা ওকে কখনই দেবে না। চায়ের সঙ্গে কিছু না কিছু ‘টা’ থাকবেই।
গরম চায়ে বেশ কয়েক চুমুক দিয়ে একটা ডিমটোস্ট তুলে নিল ভীম। বলল, কমলামাসি, আজ আমার ফিরতে রাত হবে। এই ধরো এগারোটা কি সাড়ে এগারোটা। আমাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে জেগে থেকো। আর এ কথা মাকে বোলো না যেন।
গ্রাম জায়গা — সেখানে এগারোটা — সাড়ে এগারোটা গভীর রাত। শীতকালে তো কথাই নেই। মেনকা খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আটটা সাড়ে আটটার ভেতর। কাজেই ভীম এই আব্দারের অত্যাচারটা কমলার ওপরই করে। কমলা অবশ্য একথা শুনেই ওকে জ্ঞান দিতে শুরু করল — এই যে বিকেলে বেরিয়ে গিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরছ, সেটা কি ভাল হচ্ছে? মায়ের সঙ্গে নিজেদের বাগান-ব্যবসা, সেসব দেখাশোনা করলেও তো পার? তা নয়, মায়ের দেয়া অন্ন মারছ, মায়ের দেয়া টাকা ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে ওড়াচ্ছ। এদিকে মা বুড়িটা খেটে খেটে সারা হচ্ছে। তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ।
ভীম এসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে ডিমটোস্ট চিবোতে থাকে। কমলামাসি বকবক করছে করুক। এই বকবকানি সহ্য করা যায়, কারণ রাত করে ফিরলে ও জেগে থেকে দরজা খুলে দেবে, আবার মাকেও বলবে না কত রাত করে ভীম বাড়ি ফিরেছে। কমলা জানে মেনকা ভীমকে হাতখরচার টাকা দেয় — ওর জানা নেই যে ভীম মায়ের বাক্স থেকেও টাকা সরায়। সেটা জানতে পারলে সর্বনাশ — নির্ঘাৎ মা-কে বলে দেবে।
ভীম অন্য কথা বলে কথাটা ঘুরিয়ে দিল — কমলামাসি, এই ডিমটোস্টটা দারুণ বানিয়েছো। ও জানে কমলার রান্নার প্রশংসা করলেই ওর তৈরী খাবার আরও একটু ভীমের পাতে পড়বে। কয়েক মিনিটের ভেতর আরও কয়েকটা গরম ডিমটোস্ট ভেজে কমলা ভীমের পাতে ধরে দিল। তারপর ও স্টোভ নিভিয়ে দিল।
ভীম ডিমটোস্টগুলো চটপট খেয়ে নিল। তারপর কাপের বাকি চা-টুকু এক চুমুকে শেষ করল। ডিমটোস্ট ভাজা ডান হাতের আঙুল দিয়ে ধরেছিল, সেখানটায় তেলে লেগে গেছে। এখন আবার কে জল আর সাবান দিয়ে আঙুল ধুতে যাবে — পকেট থেকে রুমাল বার করে আঙুলগুলোর ডগা জোরে ঘষে মুছে ফেলল ভীম। কমলা রান্নাঘরেই উবু হয়ে বসে অপেক্ষা করছিল, ভীম খাওয়া শেষ করলে পর চায়ের কাপ, খাওয়ার বাসন, ডিমটোস্ট ভাজার বাসন এসব ধুয়ে রাখবে। ভীম দাঁড়িয়ে উঠল, তারপর কমলার দিকে একটা খুশির হাসি দিয়ে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
ওদের মধ্যে খালি পল্টুরই বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। ও রামুর চামচাগিরি করে, রামুর টাকায় মদ খায়। মাঝে মাঝে রামু ওকে নিজের খরচায় মেয়েছেলের বাড়িও নিয়ে যায়। বলাই-ও সে জায়গায় যায়। নদীর ওপারে বেশ বড়সড় একটা বাজার, তার পেছনদিকে ও সব মেয়েদের একটা ঠেক আছে — মেয়েগুলো প্রায় সবাই রামু আর বলাইকে চেনে। ওদের ঘরগুলোর সামনের গলিটায় দুই মূর্ত্তির কোনো একজন দেখা দিলেই ওরা হাসে, ডাকাডাকি শুরু করে।
খবরটা এনেছিল রামু। বাজারে যে নতুন খাবারের দোকানটা খুলেছে সেখানে দেশির সঙ্গে বিলিতিও পাওয়া যায় — তার সঙ্গে কষা মাংস আর রুমালি রুটি। তবে সেটাও সবচেয়ে বড় খবর নয়। দোকানের পেছনে একটা বড় ঘর অন্ধকার করে সেখানে সিনেমা দেখানো হয়। ছোটো ছোটো সব ছবি — দশ বিশ মিনিটের। সিনেমায় মেয়ে পুরুষেরা মেয়ে মরদের সব খেলা দেখায় — একেবারে উদোম হয়ে। কিন্তু দেখার ভাড়া বিলক্ষণ চড়া। সাদা চামড়ার মেয়ে পুরুষের ছবি হলে দেখতে আরও বেশি টাকা লাগে। দোকানের মালিক যেমন ইচ্ছে দর হাঁকে, শনি রবিবারে দর আরও চড়ে।
আজ চার ইয়ারে মিলে প্রথমে ঐ সিনেমা দেখেছে, তারপর খেয়েছে বিলিতি মদ, সেই সঙ্গে মাংস আর রুটি। সেখান থেকে বেরিয়ে রামু আর বলাই গেছে ঐ বাজারেরই পেছনে — সেখানকার মেয়েদের ঘরে। ঐ সব ছবি দেখে শরীর মাথা গরম হয়ে গেছে, তাপটা তো ঠান্ডা করার দরকার। অসুখ বিসুখ বাধিয়ে বসার ভয় নেই — দুজনেই কেউই পকেটে রবারের জিনিষপত্র না নিয়ে ওসব জায়গায় যায় না। পল্টুকে রামু সঙ্গে নেয়নি, পল্টু মনখারাপ করে বাড়ি চলে গিয়েছে। ভীমকে অবশ্য ওরা একটু সাধাসাধি করেছিল ওদের সঙ্গে ওখানে যাবার জন্যে। এমনকি রবারের জিনিষও ধার দিতে চেয়েছিল। ভীম রাজী হয়নি — যদিও ওদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে ওর পুরোমাত্রায় ছিল। ওখানে গেলে আজ রাতে আর বাড়ি ফেরা যেত না। আর সারারাত বাইরে কাটিয়ে সকালবেলায় বাড়ি ঢুকলে মা যে কি ভয়ঙ্করী মূর্তি ধরবে সেটা আন্দাজ করা ভীমের পক্ষে কঠিন নয়। দোস্তরা ভীমের ওপর রেগেছে, শালা হিজড়া বলে গাল দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে। তা যাক্, ওদের বাড়িতে তো আর মেনকার মতো খাণ্ডার মা নেই।
মা-কে ভীম বেশ ভালই ভয় পায়, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ওদের সঙ্গে যেতে না পেরে ভীমের একটু দুঃখ অবশ্য হয়েছিল, সেই দুঃখ মনে নিয়েই ও একা ফিরেছে খেয়াঘাটে। ওকে নদী পেরোতে হবে।
একটাই নৌকো নদীর এপার ওপার করে। এরপর ভুটভুটি নাকি একটা চলবে। ভীম ভুটভুটি কখনো দেখেনি — শুনেছে ওটা নাকি একটা বড়সড় নৌকোর মতই জিনিস, মেশিনে জল কেটে চলে। বলাই একদিন বলছিল। ও ঠিক করেছে ওই ভুটভুটির ব্যবসায় কিছু টাকা ঢালবে। তাহলে ভুটভুটি চালানোর লাভের টাকার ও ভাগ পাবে। বলাই ভীমকেও বুদ্ধি দিয়েছে ঐ ব্যবসায় টাকা লাগাতে। কোনো ঝামেলা নেই, একবার টাকা দিলে থোকে থোকে ঐ টাকার বাচ্চা পকেটে আসবে। ভীম কিছু না বলে চুপ করে থেকেছে। ওর নিজের তো আর টাকা নেই, দিতে হলে মায়ের কাছে চাইতে হবে। কিপ্টেবুড়ি কি দেবে? বরং ভীমের ওপর চেঁচিয়ে ওর ভূত ভাগিয়ে দেবে।
ফেরিঘাটের লাগোয়া বাজারের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা ঝাঁপবন্ধ দোকানের বাইরে রাস্তার একধারে কতগুলো ঠেলাগাড়ি দাঁড় করানো। ঠেলাওয়ালারা ওই ঠেলার ওপর শুয়ে টেনে ঘুম দিচ্ছে, বাজারের রাস্তার কুকুরগুলো ঐসব ঠেলার তলায় সামনের দুই থাবা পেতে থাবার মাঝখানে মাথা দিয়ে গুটিশুটি মেরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঐ লোকগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা কড়া গন্ধ পেল ভীম। দেশি মদ বেশি টেনে নিয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছে ওরা। হঠাৎ ওদের ওপর একটু হিংসে হয় ভীমের। ওদের বেশি কিছু চাহিদা নেই — বেশি রোজগারের কোনো দরকার নেই — ঠেলাগাড়িতে মোট বয়ে যা পায় তা দিয়ে প্রচুর পরিমাণ ছাতুমাখা খায়, সেই সঙ্গে রাতে একেবারে সস্তার দিশি। দেশে বৌ বাচ্চার জন্যে টাকা পাঠায় আর বৌকে ওখানে রেখে এসেছে বলে মাঝে মাঝে শরীরের চাহিদা জাগলে বাজারের আধবুড়ো সস্তা দরের মেয়েমানুষগুলোর কাছে যায়। ওদের রোগ অসুখের কোনো পরোয়া নেই, সেজন্যে রবারের জিনিসপত্রেরও বালাই নেই। বেশ আছে লোকগুলো।
নৌকোটা ঘাটে বাঁধা আছে। মাঝি পরাণ মণ্ডল নৌকোর গলুইয়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ওর সহকারি ছেলেটাও ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ঘুমোচ্ছে। ওদের নৌকোয় থাকার কথা নয়, এতক্ষণে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা। ফেরি অনেকক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভীমকে নদী পার করে দেওয়ার জন্যেই ওরা এখনও ফেরিঘাটে রয়েছে। কারণ নদী পার হয়ে এপারে আসার সময় ভীম পরাণকে বলে রেখেছে — একবার পুরো পারাপার করার জন্যে যা ভাড়া হয় তার ডবল টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়েছে। দিয়ে নিশ্চিন্ত। টাকা হাত পেতে নিয়েও ঘাটে ওর জন্যে অপেক্ষা করবে না এমন বেইমান পরাণ মাঝি নয়।
ভীম ঘাটের সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামল। সাবধানে, কারণ ধাপগুলো পেছল — জোয়ারের সময় এগুলোর বেশির ভাগই জলে ডুবে যায়। এখন ভাটা শুরু হয়ে নদীর জল একটু নেমে গিয়েছে, নৌকো আর ঘাটের সিঁড়ির মধ্যে বেশ একটু তফাৎ হয়ে গিয়েছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ভীম ডাকল, পরাণ ওঠ, আমি এসে গিয়েছি, আমাকে পার কর।
পরাণ উঠল না। এতক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছিল, এবার পাশ ফিরে শুল। ভীম আবার ডাকল, পরাণ, ওরে পরাণ, ওঠ। বেশি জোরে ডাকতে পারছে না — ঠেলাগাড়ির তলায় শুয়ে থাকা কুকুরগুলো জেগে উঠলে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে ভীমকে তাড়া করতে পারে। তাহলে ঘোর বিপদ হবে।
এবারে পরাণ জাগল, উঠে বসল। দু হাতে ভাল করে চোখ কচলে ঘুমটা তাড়িয়ে নিল, দুহাতে আঁজলা করে নদীর জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে নদীতেই ফেলল, নাকও ঝেড়ে নিল সেই সঙ্গে। তারপর ধাক্কা মেরে ওর সহকারি ছেলেটাকে তুলে দিল। ভাটার সময় যাত্রীরা যাতে ঘাটের সিঁড়ির ধাপ থেকে নৌকোয় উঠে আসতে পারে তার জন্যে নৌকোতে একটা মজবুত লম্বাটে কাঠের তক্তা রয়েছে। পরাণ আর ওর সঙ্গের ছেলেটা দুজনে মিলে ধরাধরি করে ওই তক্তাটার একটা দিক ঘাটের সিঁড়িতে লাগিয়ে দিল, তক্তার অন্য দিকটা নৌকোর পাটাতনের ওপর রইল। ওই তক্তার সেতু দিয়ে এসে নৌকোয় চড়ল ভীম। ভুটভুটি চালু হলে তাতে চড়বার জন্যে এখানে জেটি তৈরী হবে — ভীম তক্তার ওপর পা ফেলে আসবার সময় ভাবছিল। জোয়ার ভাটা কোনো সময়েই চড়তে কষ্ট হবে না, বাচ্চা কোলে মেয়েমানুষদেরও নয়। আহা, পরাণ বেচারার রুজি চলে যাবে, সেই সঙ্গে ওর নৌকোতে কাজ করা ছেলেটারও। ওরা খাবে কি? তারপরই আবার ভাবল, কিছু না কিছু কাজ ওরা পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই, কেউ কাজ না পেয়ে না খেয়ে মরেছে এরকম তো শোনা যায় না। আর সেরকম কিছু হলে কি রক্ষে আছে? যে যে পার্টি সরকারের বিপক্ষে তারা সরকারের ওপর রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে না?
নদীর বুকে জমাট কুয়াশা, জল না মেশানো দুধের মতো সাদা। ভীমের হঠাৎ একটু চিন্তা হল। এই কুয়াশার ভেতর পরাণ নৌকো নিয়ে নদী পার হবে কি করে? ওপার দূরে থাক সামনে দু হাত দূরে কি আছে তা বোঝা যাচ্ছে না — ওপারের ঘাট কোথায় সেটা বুঝে ও যাবে কি করে? কিন্তু পরাণ পাকা মাঝি, আজ প্রায় তিরিশ বছর ও শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা দিনে রাতে এই নদী এপার ওপার করেছে — ভীমের জন্মেরও অনেক আগের থেকেই এই কর্ম করছে। কতটা স্রোতে কিভাবে হাল ধরলে কতক্ষণে ঠিক ওপারের ঘাটে পৌঁছবে সেটা ও জানে। আর পাড়ের কাছাকাছি তো তত ঘন কুয়াশা নেই। বেশ তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে গেল নৌকো। ভাটার স্রোতটা নৌকোটাকে অন্য পারের ঘাটে পৌঁছে যেতে সাহায্য করেছে। নৌকো নিয়ে পরাণ যদি আবার অন্য পারে ফিরে যায় তাহলে উল্টোদিকের স্রোতে নৌকো বাইতে ও জেরবার হয়ে যাবে। ওপারে পৌঁছে নৌকো বেঁধেই ভীমের কাছে হাত পাতল পরাণ। একটা বড়সড় হাসি দিয়ে দাঁতগুলো সব বার করেছে — ক্ষয়ে যাওয়া ফাঁক ফাঁক হলদেটে দাঁত পানের রসের লালচে ছোপ। বাবু এবার উল্টো রেতে নৌকো নিয়ে ফিরতে হবে, আরও পঞ্চাশটা টাকা বেশি দ্যান।
ভীম চটে গেল, কিন্তু সে মনে মনে। ও জানে যে পরাণ এখন ওপারে যাবে না, রাতটা এখানেই নৌকো বেঁধে শুয়ে থাকবে। ভোরের পর ফিরবে, তখন স্রোতটাও ঘুরে যাবে আর আলো হয়ে গেলে পর কুয়াশাও অত থাকবে না। ও খালি ভীমকে বাগে পেয়ে ওর কাছ থেকে টাকা খিঁচে নিচ্ছে। চুপচাপ ভীম টাকাটা বার করে দিল। মাঝে মাঝেই বাড়ি ফিরতে রাত হয়, তখন পরাণ হাতে না থাকলে চলবে না। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে একবার ফিরে দেখল — নৌকোর লন্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় চোখে পড়ল, পরাণ আর ওর সঙ্গের ছেলেটা নৌকোতে দিব্যি শুয়ে পড়েছে। মুখ ঘুরিয়ে নিল ভীম, সামনে পা চালাল। কিন্তু পরাণকে মনে মনে গাল দিল — শালা।
নদীর এপারেও একটা ছোট্ট বাজার। সব দোকানপাট বন্ধ, কোথাও কোনো আলো নেই। বাজার ছাড়িয়ে মাটির কাঁচা রাস্তা, সেই ওদের গাঁ পর্যন্ত। অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে পঞ্চায়েত খোয়া, সুরকি এসব দিয়ে রাস্তাটা মজবুত করবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। হবে কি করে — নেতাদের পকেট ভর্তি হবার পর যদি কিছু টাকা বেঁচে যায় তবেই না কাজ হতে পারবে?
কৃষ্ণপক্ষের রাত, চাঁদ উঠবে সেই গভীর রাতে। চারপাশে ঘন অন্ধকার। ভীম পকেটে একটা পেনসিল টর্চ রাখে, ও সেটা মাঝে মাঝে টিপে রাস্তায় আলো ফেলে ফেলে চলল। একটানা আলো জ্বালানো চলবে না, টর্চের ছোট্ট ব্যাটারি শিগগির শিগগির কমজোর হয়ে পড়বে তাহলে। অবশ্য রাস্তা ওর একেবারে মুখস্থ — বাঁ পাশে কালো ভূতের মতো একটা বাব্লা গাছ, এখানে রাস্তায় একটা বড় গর্ত, ঐ লম্বা কালো দৈত্যটা একটা অশথ গাছ, ওটায় অনেক পাখির বাসা আছে — একবার একটা সাপ ঐ সব পাখির ছানা খেয়েছিল, তারপর একেবারে নট নড়নচড়ন হয়ে গাছটার গোড়ায় জড়িয়েছিল, দেখতে পেয়ে সেটাকে লাঠি পেটা করে মেরেছিল গাঁয়ের লোক, ভীমও ছিল দলের মধ্যে, যদিও ও হাতে লাঠি ধরেনি, দলের ভেতর দাঁড়িয়ে খালি দেখেছিল — এই, এই, আর একটু হলে রাস্তার বড় গর্তটায় পা দিয়ে দিত ভীম — ওই সাপটার কথা মনে আসায় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, পা দিয়ে দিলেই হয়েছিল আর কি, নির্ঘাৎ পা মচকে যেত — ঐ ঢিপিটার পরেই একটা বাঁশঝাড়, সামনে বড় ডোবাটা, তারপরই রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে, ওখানটায় একটু সামলে টর্চ জ্বেলে যেতে হবে, নইলে সোজা গিয়ে ডোবাটায় পড়ে যাবার ভয় আছে — ডোবাটার পাশে আবার কুয়াশা, একটা অবয়ব, হাল্কা কুয়াশায় তৈরী, বেশ কয়েক পা ভীমের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যায়, তারপর পিছিয়ে পড়ে — এবার দু পাশে জংলা ঝোপ ঝাড়, সেই সঙ্গে সোনাঝুরি গাছ, সেখানে সমানে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, জোনাকির ঝাঁক আলো জ্বেলে এ ঝোপ থেকে ও ঝোপ করছে, মাঝে মাঝে তক্ষকের ডাক — একটা প্যাঁচা বিশ্রী গলায় ডেকে উঠল, ওটা বোধহয় ইঁদুর ধরেছে — এবার মেঠো জমির ভেতর দিয়ে রাস্তা, দুপাশে গাছপালা বিশেষ নেই — কিন্তু দূরে একটা জঙ্গুলে জায়গা, সামনে বেলগাছটা, ডালপালা একেবারে রাস্তায় এপার থেকে ওপারে ছড়িয়ে দিয়েছে। চট করে টর্চ জ্বেলে ফেলল ভীম, বেলগাছে নাকি কারা সব থাকেন, বামুন মরলে ঐ যা হয় — যাক্ — গাছটা ছাড়িয়ে এসেছে, তবুও একটু ভয় ভয় করছে, বিলিতি মাল খেয়েছে, কিন্তু তাতে শীত ভাঙে না, রাস্তার ভয়ও কমে না — এর চেয়ে দিশি ভাল, শরীর গরম রাখে আর ঐ যাদের নাম রাতে করতে নেই তাদের ভয়ও করে না — দূরের জঙ্গলটায় একপাল শেয়াল ডেকে উঠল — হঠাৎ ওর একটা সন্দেহ হয় — শেয়াল ডাকল কেন, ওর পেছনে কেউ নেই তো? ঘাড় ফিরিয়ে টর্চের আলো পেছনে ফেলল ভীম — কেউ নেই, টর্চের মৃদু আলোর ছোট্ট গণ্ডীর বাইরে জমাট তাল পাকানো অন্ধকার — কেউ যদি পিছু নিয়ে থাকে তার তো শরীর নেই, টর্চের আলোয় তো তাকে দেখা যাবে না। এবার ভালরকম ভয় পেয়েছে ভীম, ও জোরে পা চালায় — রাম রাম বলে বিড় বিড় করে, ঘন ঘন ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে, এইভাবে চলতে গিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোনমতে সামলে নেয় — ওই, ওটা গাঁয়ের মুখের তেঁতুলগাছটা — ভীম নিজেকে সাহস দেয় — যাক গাঁয়ের কাছে, বাড়ির কাছে এসে পড়েছে, আর ভয় নেই।
রাত গভীর হয়েছে, গ্রাম একেবারে নিঝুম। বাড়ি পৌঁছে দরজায় টোকা দিল ভীম। বেশি জোরে ঘা দেয়া চলবে না, মায়ের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। কমলা জেগে ছিল — দরজা খুলে দিল। ভীম ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করতে করতে গজগজ করে ওকে বকুনি দিতে শুরু করল। একগাল হাসল ভীম। বাড়ি ঢুকে ওর মেজাজ পাল্টে গিয়েছে, রাস্তায় যে ভয় টয় পেয়েছিল তা বেমালুম ভুলে গিয়েছে। ও কমলাকে বলল, মাসি, ভাগ্যিস তুমি এ বাড়িতে রয়েছ, তাই আমার রক্ষে। তুমি না থাকলে রাত জেগে বসে থেকে কে আমাকে দরজা খুলে দিত?
কমলা একটা রাগ করা মুখ করল। বলল, নাও, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। খাবার উনুনের পড়তি আঁচের পাশে রেখেছি, তবুও একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর, নইলে আমি ঘুমোতে যেতে পারব না।
ভীম জানে কমলার রাগ সত্যি নয়, ওর তোষামোদ করা কথায় কমলা খুশি হয়ে গেছে। ও বলল, মাসি, আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি, এখন আর কিছু খাব না।
কমলা মুখ বাঁকাল। বলল, তবে আর কি, খাবার সব ফেলে দিই গে। এত খাবার নষ্ট, মেনকাদি জানতে পারলে ভারি রাগ করবে।
আবার ছোট্ট করে হাসল ভীম। খাবার আসলে কিছুই নষ্ট হবে না। কমলামাসি প্রচুর খেতে পারে — ও সব খেয়ে শেষ করে দেবে — ডাল, তরকারি, মাছের ঝাল — সব। কমলা বিধবা হলেও আমিষ সবই খায়। ডিম, মাছ, পাঁঠা — এমনকি মুরগীও। মেনকাই এসব খেতে শিখিয়েছে ওকে — মেনকা নিজেও খায় তো। কতদিন এরকম হয়েছে — বাড়ির গিন্নী আর কাজের লোক মুখোমুখি বসে মুরগীর হাড় চিবিয়ে গুঁড়ো করেছে। আর খাবে না-ই বা কেন? একটা মেয়েমানুষের ঘরের মানুষটা মরে গেল বলে বেঁচে থাকা মেয়েছেলেটা এটা ওটা খেতে পাবে না, অমুক অমুক তিথিতে খাওয়া দূরে থাক জল পর্যন্ত ছুঁতে পাবে না — এসব আবার কেমনধারা কথা? তবে হ্যাঁ, পরপুরুষের সঙ্গে পীরিত করে তার বিছানায় যাওয়া, সেটা একটা গুরুতর ব্যাপার, তাতে যে বারণটা আছে সেটা মেনে চলা উচিৎ বলেই মেনকা মনে করে। সে ব্যাপারে শাস্তরে যা লিখেছে তা মানতেই হবে। কিন্তু বামুন পুরুৎদের বিধেন দেয়া সব কিছু আচার বিচার মেনে চলা — আরে ছোঃ।
খুব ক্লান্ত লাগছে — আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল ভীম। হাত পা ধুয়ে জামা বদলে বিছানাতে লেপের নিচে নিজেকে ঢুকিয়ে দিল। এখন যা দরকার তা হচ্ছে তোফা একটু ঘুম — একেবারে সেই খটখটে রোদ ওঠা সকাল পর্যন্ত।
ঘুম কিন্তু আসে না। আজ সারা সন্ধেটা বহুত রংদার মজায় কেটেছে, সে সব মনে আসে। চোখের সামনে ভাসে সিনেমায় দেখা সেই সব ছবি। গা গরম হয়ে যায়, ঘুম টুম সব চটে যায়। লেপটা নরম আর উষ্ণ, ঐ সিনেমার মেয়েগুলোর শরীরও কি সেরকম? নাকি আরও নরম, আরও গরম? ইস, ও যদি বলাই আর রামুর সঙ্গে বাজারের মেয়েছেলের কাছে যেতে পারত! আমার রাগ হল মেনকার ওপর, মা বুড়িটা বেঁচে থাকতে তা তো হওয়ার নয়। ওসব মেয়েছেলের কাছে যেতে হলে টাকা লাগে, সে টাকা ভীম পাবে কোথায়? সেই তো মায়ের বাক্স থেকে সরাতে হবে। ওই মেয়েগুলো তো বিনে পয়সায় ওদের ঘরে বসতে দেবে না। আর বিনে পয়সায় ওরা ঘরে লোক ঢোকাবেই বা কি করে — ওরা তাহলে খাবে কি? কিন্তু ভীম কি করবে — ও মেয়েছেলে পাবে কোথায়? রামুর বাপ রামুর বিয়ে দিচ্ছে — ভীমের মা কি ছেলের বিয়েটা দেবে না? বুড়ির সেরকম কোনো গরজ তো ভীমের নজরে আসছে না।
ভীমের চোখ ঢুলে আসছিল — আর ও ভাবতে পারছিল না। চোখের পাতা বুজে ফেলল ভীম।