পরের দিন সকালে জলখাবারের পরে সন্ধ্যা চন্দনের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছিল — ওদের গত সাত দিনের বেড়ানোর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প। চন্দনও উৎসাহিত হয়ে কথা বলছিল। ওর মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে — সপ্তাহখানেক পরেই ওর বাবাকে বলে অন্য একটা জমিদারিতে বেড়াতে যাবে, সে কথা সন্ধ্যাকে বলছিল। সন্ধ্যা হাসিমুখে চন্দনের কথা শুনছিল। ছেলেটা এখনো কি সরল — একেবারে একটা ছোট বাচ্চার মত।
রমা ঘরের দরজায় টোকা মেরে দরজা ফাঁক করে উঁকি মারল। হাতছানি দিয়ে সন্ধ্যাকে ডাকল। সাহেবের বন্ধু ডাক্তার সাহেব এসেছেন। উনি চন্দনের সাথে কথা বলবেন। সেই সময়টুকুর জন্যে সন্ধ্যাকে একটু রমার ঘরে গিয়ে বসতে হবে।
অনিরুদ্ধ চন্দনের সঙ্গে কথা বললেন অনেকক্ষণ ধরে। আসলে বেশীরভাগ সময় চন্দনকেই কথা বলতে দিয়ে নিজে ওর কথা শুনলেন। দেখলেন চন্দনের বুদ্ধি এবং চিন্তা এখন সুশৃঙ্খল — কোন অস্বাভাবিকতার ছাপ নেই। চন্দন সেনকাকাকে তার আঁকা ছবিটা দেখাল। অনিরুদ্ধ সে ছবির প্রশংসা করলেন — ঈষৎ গর্বিত একটা লাজুক হাসি দেখা দিল চন্দনের মুখে। সে এই ছবিটাতে রঙ করবে — কোথায় কোন রঙ হবে তাও সে বুঝিয়ে দিল সেনকাকাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বলার পর অনিরুদ্ধ ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন — বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
লাইব্রেরি ঘরটায় সূর্য শেখর বসেছিলেন। একটু উৎকন্ঠিত ভাবে একটার পর একটা সিগারেট টানছিলেন। কি জানি বেরিয়ে এসে কি বলবে অনিরুদ্ধ। আশা করা যায় চন্দন এখন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু ডাক্তারের মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত তো ভরসা নেই। ঘন ঘন হাতের ঘড়ি দেখছিলেন — সময় যেন আর কাটছে না মনে হচ্ছে। এত কি কথা বলছে অনিরুদ্ধ ?
অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকলেন — সূর্যশেখর মুখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকালেন। মুখের চেহারায় পরিস্কার জিজ্ঞাসা — আমার ছেলেটাকে কিরকম দেখলে ?
অনিরুদ্ধ সোফায় সূর্যশেখরের পাশে বসে পড়লেন — নরম গদী প্রায় ইঞ্চি ছয়েক দেবে গেল। সূর্যশেখরের হাত সজোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, কনগ্র্যাচুলেশনস্ — চন্দন এখন সুস্থ। রাতে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়ে আসব — তবে তার অভিমতও কিছু আলাদা হবে বলে মনে হয়না।
একটু থেমে আবার বললেন, ওষুধগুলো কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে।
অকৃত্রিম খুশির হাসিতে সূর্যশেখরের মুখ ভরে গেল। এ জাতীয় আনন্দ তিনি বহুদিন পান নি। এত ভোগসুখের ভেতরেও চন্দনের অসুখের কাঁটাটা তার মনের ভেতর সব সময়েই ফুটে থেকেছে। আজ অনিরুদ্ধর কথা শুনে সেই কাঁটাটা চলে গেল — সেটার খচখচানি আর আর টের পাচ্ছেন না তিনি। অনিরুদ্ধও হাসলেন বন্ধুর মুখে এই খুশি দেখে। কিন্তু তারপরেই একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, কিন্তু একটা কথা। আর দেরী না করে ঐ মেয়েটাকে চন্দনের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। পারলে — আজ — এক্ষুণি । আর যেন চন্দনের সঙ্গে ওর দেখাও না হয় ।
সূর্যশেখরের মুখে একটা ছোট ছায়া পড়ল । এই মুহূর্তে বার করে দেওয়া — সেটা কি সম্ভব ? মেয়েটাকে তো ওর সব জামাকাপড়ও গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিতে হবে। যে টাকাটা তিনি মেয়েটাকে দেবেন সেটা অবশ্য তৈরীই আছে — গতকালই তিনি নীলমাধবকে নির্দেশ দিয়ে নগদ টাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন ।
অনিরুদ্ধ বন্ধুর মুখের এই ছোট ভাবান্তরটুকু নজর করলেন । বোঝাবার মত করে তিনি বললেন, শোন — মেয়েটা যদি এখন চন্দনের সঙ্গে দেখা করে বলে যে ও চলে যাচ্ছে, তাহলে চন্দন হয়তো ওকে ছাড়তে চাইবে না । আর হয়তো কেন — নিশ্চয়ই চাইবে না । সেটা কিন্তু একটা অসুবিধের ব্যাপার হবে ।
সূর্যশেখর চুপ করে রইলেন । কথাটা অনিরুদ্ধ ঠিকই বলেছে । একটু থেমে অনিরুদ্ধ আবার বললেন, এখন যত তাড়াতাড়ি পার চন্দনের বিয়ে দাও । এখন বৈশাখ মাস পড়ে গেছে — পাঁজিতে প্রথম যে দিনটা আছে সেদিনই লাগিয়ে দাও । আমি তোমাকে যতদূর চিনি তুমি নিশ্চয়ই চন্দনের জন্যে মেয়ে ঠিক করে রেখেছ । চন্দনকে মেয়েটির ছবি দেখাবার ব্যবস্থা কর — কোন মহিলাকে ভার দাও ওর কাছে মেয়েটির সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলার জন্যে । যাতে চন্দনের মনে ওর ভাবী স্ত্রী সম্বন্ধে একটা জোরালো কৌতূহল জেগে ওঠে । এখনকার মেয়েছেলেটাকে ওর মন থেকে তাড়াতে হবে তো । ঘুমের ওষুধটা হয়তো আজ রাত থেকেই একটু বাড়াতে হবে — যাই হোক সেটা রাতে সাইকিয়াট্রিস্ট এসে ঠিক করবে ।
অনিরুদ্ধ উঠে পড়লেন । সূর্যশেখরও উঠলেন । ঘরের দেয়ালের সুইচ টিপে ঘন্টি বাজালেন । রামু দৌড়ে এল । ওকে অনিরুদ্ধ যা বললেন সেটা বুঝিয়ে দিলেন সূর্যশেখর । তারপর বন্ধুকে গাড়িতে তুলে দিতে গেলেন ।
আধঘন্টাটাক পরে রামু এসে খবর দিল । মেয়েছেলেটাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে — তার জিনিসপত্র সমেত । সাহেবের হুকুমমত প্রভুদয়াল তাকে নিয়ে গেছে তার বাড়িতে ছেড়ে আসার জন্যে ।
বাড়ির ভৃত্যমহলে জোর জল্পনা শুরু হয়ে গেল । মেয়েমানুষটা তো গেছে — এখন দাদাবাবু কি করবে ? কাউকে খুন খারাবি করে ফেলবে না তো ? সূর্যশেখরও একটু চিন্তিত — কি জানি চন্দনের কি প্রতিক্রিয়া হয় । অনিরুদ্ধ বলে গেছে গোলমাল দেখলেই তাকে ফোন করে জানাতে । সূর্যশেখর ঠিক করলেন আজ আর অফিসবাড়ি যাবেন না — বাড়িতেই থাকবেন । একদিন নীলমাধব আর তার কর্মচারিদের কাজ না দেখলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না । চন্দনকে চোখে চোখে রাখা দরকার । সেটা সূর্যশেখর নিজে বাড়ি না থাকলে সম্ভব নয় ।
তবে চন্দন কোন গোলমাল করে নি । কয়েক ঘন্টা ধরে সন্ধ্যার জন্যে অপেক্ষা করার পর ও একটু অবাক হয়েছিল । সন্ধ্যা তো কখনও ওকে ছেড়ে রেখে রমার ঘরে গিয়ে আড্ডা দেয় না । তাও আবার এতক্ষণ ধরে । ও সন্ধ্যাকে রমার ঘর থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল । সন্ধ্যা আসে নি — এসেছিল রমা । অবশ্য রমা ঘরে ঢোকে নি — ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল । রমার এটা জানা ছিল যে চন্দনকে সন্ধ্যার এখানে না থাকার কৈফিয়ত ওকেই দিতে হবে । রামু বা অন্য কেউ এই ব্যাপারে মুখ খুলবে না — তার জন্যে দরকার হলে চুপ করে দাঁড়িয়ে চন্দনের মার খাবে । সেজন্যে রমা এতক্ষণ ধরে একটা গল্প বানিয়ে রেখেছিল চন্দনকে বলবার জন্যে — চন্দনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ গোল করে হাতমুখ নেড়ে সেই গল্পটা বলল । ও দাদাবাবু গো — ভয়ানক কাণ্ড । বাড়িতে পুলিস এসেছিল । সন্ধ্যা দিদিমণিকে ধরে নিয়ে গেল ।
তারপর রমা গল্পটা আরও খুলে বলল । বনগাঁ না ঐদিকে কোথায় সন্ধ্যার ঘর ছিল । ওর বর ওকে ধরে খুব মার দিত । একদিন সন্ধ্যা বরের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয় — তারপর পালায় । সাহেবের জমিদারিতে এসে আশ্রয় ভিক্ষে করেছিল — সাহেব দয়া করে তার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন ওকে । এতদিনে পুলিস ওকে খুঁজে পেয়েছে — এই তো পুলিসের দুই অপিসার এসে সাহেবের সঙ্গে কথা বলল — বসে চা কেক খেল । তারপর ওরা সন্ধ্যাকে ধরে নিয়ে চলে গেল ।
চন্দন রমার গল্পটা শুনে গুম মেরে গেল । ও সরল হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান — রমার বলা কাঁচা গল্পটা যে ডাহা মিথ্যে তা ও সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিল । কিন্তু ও এটাও বুঝে নিল যে সন্ধ্যার এই হঠাৎ উধাও হওয়ার কারণটা এরা সবাই যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে — সেটা ওরা কিছুতেই চন্দনকে জানতে দেবে না । সন্ধ্যার এভাবে এ বাড়িতে আসা আর হঠাৎ চলে যাওয়া — এই দুটো ঘটনার মধ্যেই বাড়ির লোকের হাত আছে — বাবার, সেনকাকার । সন্ধ্যার সম্পর্কে ও কোনদিনই আর কিছু জানতে পারবে না । কিম্বা হয়তো পারবে — দূর কোন ভবিষ্যতে — যখন সময় নিজে থেকেই এই রহস্যের ডালা খুলে দেবে ।
বাড়ির চাকর-বাকর, ড্রাইভার, দারোয়ানেরা একটু নিরাশ হয়েছিল । তারা ভেবেছিল চন্দন চেঁচামেচি করবে — জিনিষপত্র ছুঁড়বে — রামুকে ধরে খুব পিটবে । বাড়িতে একটা উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরী হবে যা নিয়ে বেশ কয়েকদিন খুব আড্ডা আর গল্প হবে । তাছাড়া কাজের লোকেদের মধ্যে অনেকেই রামু পিটুনি খেলে খুশি হয় — কারণ রামু কর্তাবাবুর কাছের লোক । চন্দন চুপ করে রইল — ওর আঁকা নদীর তীরের ছবিটা রঙ করায় মন দিল । ওকে অনিরুদ্ধ আবার দেখলেন — মনোরোগবিদ ওর সঙ্গে কথা বললেন । দুজনেই মত দিলেন যে চন্দনের অবস্থা ভালই আছে — কোন অবনতি হয় নি ।
সূর্যশেখর অতিদ্রুত ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন । তিনি ভোগী জমিদার হলেও একজন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক — ম্যানেজার আর নায়েবদের কাছে তার নিখুঁত এবং পাকা নির্দেশ চলে গেল । বিধুভূষণ সেদিনই মহেশ আর তার পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল । কলকাতার অফিসবাড়িতে নীলমাধব লোকলস্কর নিয়ে লেগে গেল — যাতে মহেশ এসে পৌঁছবার আগেই বাড়ির খালি পড়ে থাকা অংশটা ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে যায় । আসবাব দিয়ে সাজানো বাড়ি — মহেশ, তার বৌ, মেয়ে সেখানে আরামে থাকবে । সূর্যশেখর কলকাতায় চলে আসার দিনই মহেশ, সরমা আর শ্রীময়ীকে বলে এসেছিলেন যে শ্রীময়ী তার ছেলের বৌ হতে চলেছে । আগে থেকেই তো ব্যাপারটা ওদের আন্দাজ করা ছিল । এবার সূর্যশেখরের মুখ থেকে পরিষ্কার শুনতে পেয়ে সরমা তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল । মহেশও তার পুরোহিতের পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে সূর্যশেখরের পা ছুঁয়েছিল । শ্রীময়ী মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করেছিল — সূর্যশেখর তাকে তুলে ধরে সস্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন ।
মহেশ যে বাড়িতে রয়েছে তার বাসিন্দাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব বিধুভূষণের । তাকেও তার লোকজন নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছে । মহেশ আর সরমার অনেক আত্মীয়স্বজন এসে ঐ বাড়িতেই উঠেছে । সে সব লোকের খাওয়া, শোওয়া, খাবার জলের ব্যবস্থা করা — সব করেছে বিধুভূষণ। সরমা তিন বেলা চন্দনের কাছে যাতায়াতও করছে — প্রত্যেকবারই সে নিজের হাতে তৈরী কোন সুস্বাদু খাবার চন্দনের জন্যে নিয়ে যায় — চন্দনকে খাইয়ে তবে ফেরে । তাতে অবশ্য হরি বেশ দু:খিত । সে কিছুটা ভয়ও পেয়েছে — বিয়ের পর বৌরাণির মাটা যদি হরির রান্নায় খুঁত ধরে — আর কর্তাকে বলে ওকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে । সরমা এর মধ্যেই চন্দনকে নিজের খুব আপন করে নিয়েছে । ওর মধ্যে হয়তো একটি পুত্রসন্তানের বাসনা ছিল — এখন চন্দনকে পেয়ে ওর মনের ভেতরের সেই গোপন ইচ্ছেটা স্নেহের রূপ ধরে বেরিয়ে আসছে । চন্দনও ভালই মেনে নিয়েছে সরমাকে । সূর্যশেখর সরমা আর তার মেয়ের ব্যবহারের জন্যে একটা গাড়ি আর ড্রাইভার মোতায়েন করে দিয়েছেন । সে ড্রাইভার দুটি নারীকে গাড়ি চড়াচ্ছে আর মনের আনন্দে গাড়ির তেল চুরি করে যাচ্ছে । বিধুভূষণ এই তেল চুরির ব্যাপারটা জানে, সেজন্যে এই ড্রাইভার তেল বিক্রীর টাকার একটা বখরা বিধুকেও নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে । এই খবর জানতে পেরে প্রভুদয়ালের হিংসে হয়েছে আর সে মন খারাপ করে আছে । সে খোদ কর্তার গাড়ি চালায় — তার পক্ষে তেল চুরি করা সম্ভব নয় । এদিকে রমার আব্দার দিন থেকে দিন বেড়েই চলেছে । দাদাবাবুর বৌ এর জন্যে কী কী হীরে জহরতের আর সোনার গয়না হচ্ছে সে তার একটা ফিরিস্তি প্রভুদয়ালকে দিয়েছে । তারপর মাগি দাবী করেছে একটা ওজনদার সোনার হার । এদিকে প্রভুদয়ালের টাকা পয়সার অবস্থা এখব বেশ খারাপ । এই সেদিন দেশে একগাদা টাকা পাঠাতে হয়েছে — ছোট ছেলেটার অসুখ করেছে — তার চিকিৎসার খরচা । এখন হার কেনার টাকা কোথা থেকে মেটাবে প্রভুদয়াল ? গাড়ির তেল চুরি করতে পারলেও না হয় একটা কথা ছিল ।
ছেলের বিয়ে — এই কারণ দেখিয়ে সূর্যশেখর মার্গারেটের কাছ থেকে আপাতত: পনের দিনের ছুটি নিয়েছেন । মার্গারেট তার ফ্ল্যাটেই আছে । সেখানেই থাকবে — এখানে আসবে না । চন্দনের বিয়ে উপলক্ষে সব আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে । তাদের অনেকে এ বাড়িতেই আছে । অবশ্য আত্মীয় বলতে সবই সূর্যশেখরের দিকের — সুনয়নীর মৃত্যুর পর চন্দনের মামার বাড়ির লোকজন সূর্যশেখরের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখে নি । যে আত্মীয়রাই এ বাড়িতে থাক, তাদের সামনে মার্গারেট একটি শ্বেতবর্ণা দর্শনীয় বস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াবে, তা সূর্যশেখর চান না । নীলমাধবের চোখে ঘুম নেই । কর্তার বিভিন্ন আদেশ ঘন্টায় ঘন্টায় তার মাথায় পড়ছে । কর্তার আবার একটা বদ অভ্যেস আছে — হুকুম ঠিকমত আর সময়মত তামিল হল কিনা সেটা যাচাই করে দেখা । কাজেই নীলমাধবের দিনগুলো খুব অশান্তিতে কাটছে — সে কথা জোর দিয়েই বলা যায় । এ বাড়ির দাসী চাকরদের কাজ করার অভ্যেস নেই — এ বাড়িতে তাদের বিশেষ কাজ করবার দরকার পড়ে না । তারা এখন কাজের চাপে হাঁসফাঁস করছে — দিন গুনছে এই রাজসূয় যজ্ঞ কবে শেষ হয়ে বাড়িতে আবার শান্তি আসবে ।
সূর্যশেখর নিজেও খুব ব্যস্ত । বড় কাজ তো বটেই, ছোটখাট অনেক কাজও তিনি নিজে দেখাশোনা করছেন । ধমকের চোটে বিধুভূষণ আর নীলমাধবের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে — তারা কর্তার ধমক খেয়ে নি:শ্বাস বন্ধ করে কাজ করে যাচ্ছে । ধমকটা নীলমাধবের জুটছে বেশী — কারণ তাকেই সূর্যশেখর হাতের কাছে বেশী পাচ্ছেন । বিধুভূষণের অবস্থাও সুবিধের নয় । কর্তা তাকে হুকুম দিয়েছেন নদীয়ার জমিদারবাড়ির সব মেরামতি সেরে রাখতে । বিয়ের পর চন্দন আর শ্রীময়ী সেখানে গিয়ে থাকবে — সরমা চন্দনকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে । সূর্যশেখর ভেবেছিলেন তার এই ব্যস্ততা তাকে একটা বিশেষ মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি দেবে । তা কিন্তু হয় নি । একটা প্রপঞ্চ তাকে তাড়া করে ফেরে —
মাঝে মাঝেই দেখা দেয় তাকে । লাইব্রেরিতে ঢুকে হঠাৎ বুকটা ধক করে ওঠে — আরে কে যেন বসে আছে — শ্যামলারঙের এক যুবতী — তার ধারালো টানা টানা দুই চোখ সোজা তাকিয়ে আছে সূর্যশেখরের দিকে । তারপরই প্রপঞ্চ মিলিয়ে যায় — দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূর্যশেখর খালি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন । রাতে ঘুমের মধ্যে ভেসে আসে এক নারী — পেঁজা তুলোর মত হাল্কা আর নরম তার শরীর — উজ্জ্বল চিকন শ্যামলা তার গায়ের রঙ — সে একহাতে ভর দিয়ে বিছানা থেকে সামান্য তুলে রাখে তার সেই আশ্চর্য শরীর — স্বচ্ছ কুয়াশার মত পোষাকের ভেতর দিয়ে দেখা যায় তার দুই সুগঠিত বুক । সেই নারীকে কাছে টেনে নেবার জন্যে সূর্যশেখর হাত বাড়িয়ে দেন — হাওয়ায় ভেসে সরে সরে যায় সেই নারী — ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় — তারপর সে মিলিয়ে যায় । সূর্যশেখরের ঘুম ভেঙে যায় — আর আসতে চায় না । সিগারেটের পর সিগারেট পোড়ে — রাতজাগা সূর্যশেখরের বাসনা আরও তীব্র — আরও জোরালো হয়ে ওঠে । কিন্তু সেই সঙ্গে প্রচণ্ড এবং দৃঢ় হয়ে ওঠে তার প্রতিজ্ঞা । আর মাত্র কটা দিন — তুমি আর চকিতে মিলিয়ে যাওয়া ছায়া থাকবে না — হয়ে উঠবে রক্তমাংসের মানুষ — তুমি আসবে — আসতে তোমাকে হবেই — আমার হাতের মুঠোর মধ্যে — আমার পায়ের তলায়। আমি খেলা করব তোমাকে নিয়ে— তুমি ছটফট করবে — কখনো তীব্র সুখে — কখনো জ্বলন্ত যন্ত্রণায় ।
আজ সূর্যশেখর রায়চৌধুরীর বাড়ি আলোয় আলো । হাতার ভেতরে মূল বাড়িটার চারদিকের দেয়াল ছাদ থেকে ভুঁই পর্যন্ত ছোট ছোট লাল হলুদ রঙের বিজলী বাতির লম্বা লম্বা অগুণতি সারিতে সাজানো । বাগানের প্রতিটি গাছ ভর্তি এরকম বাতি । বাইরের রাস্তার ধারের দেয়ালও একই ভাবে সেজেছে । দেউড়িতে উজ্জ্বল সাদা হ্যালোজেন বাতি — সেই আলোয় সামনের রাস্তা সন্ধেবেলাতেও একেবারে দিন হয়ে গেছে । দেউড়ি, মূল বাড়ির দরজা — প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো — চারপাশ সেই তাজা ফুলের গন্ধে ভুরভুর করছে । বাড়িতে নহবৎ বসেছে — সানাই বাজছে সকাল থেকে ।
বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাথে একটু দূরে একটি স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে ছিল । ইচ্ছে করেই একটু অন্ধকার জায়গা বেছে নিয়েছে সে — তার ওপর ঘোমটা আর শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখের বেশীরভাগটাই সে ঢেকে রেখেছে । একটা হাতে টানা রিকশা চড়ে এখানে এসেছে সে — রিকশাটা রাখা আছে রাস্তার ওপর একটু দূরে — তাতে চড়েই আবার সে ফিরবে । রাস্তাটায় এমনিতে লোকজন কম — সেখানে অন্ধকারে একজন স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে থাকলে বদ মতলবে গুণ্ডা বদমাশ তার ওপরে চড়াও হতে পারে । কিন্তু ওর সেই ভয়টা নেই — ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক । সন্ধ্যা তাকে বলছে — রিকশাটা একটু দূরে অপেক্ষা করুক — নইলে ও বাড়ির লোকের চোখে পড়বে । কিন্তু তুই আমার কাছে থেকে আমায় পাহারা দে । মিঠাইলাল সে আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে । ও সশস্ত্র — ওর হাতে আছে একটা মাঝারি সাইজের মজবুত লাঠি আর ধুতির ওপর শার্টের নিচে লুকোন আছে একটা বড় চেহারার ছোরা । ও যে কোন বদমাশ বা বদমাশদের মহড়া নেবে — তার জন্যে ওর জান কবুল । সন্ধ্যা জানে একটু পরেই ঐ দেউড়ি দিয়ে আগে পিছে অনেক গাড়ি নিয়ে একটা ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ি বেরোবে । এতদূর থেকে সেই গাড়ির ভেতরে বসা চন্দন দিয়ে সাজানো একটি তরুণ মুখ সে দেখতে পাবে না — শুধু সেই গাড়িটাই সে দেখবে । তারপর গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলে পর সে তার জন্যে অপেক্ষা করা বাহনে চড়বে বাড়ি ফেরার জন্যে ।
সেদিন সকালবেলা সন্ধ্যাকে একরকম গলাধাক্কা দিয়েই ও বাড়ি থেকে বার করে দেয়া হয়েছিল । অনিরুদ্ধ চন্দনের সঙ্গে কথা বলছিলেন — রমা সন্ধ্যাকে নিজের ঘরে বসিয়ে তার আগের রাতের কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনা করছিল । প্রভুদয়াল বেশ কিছুদিন পর এ বাড়ি ফিরছে — কাজেই সে প্রায় পুরো রাতটাই রমার সঙ্গে কাটিয়েছে । খুব ধকল গেছে শরীরের ওপর — সে কথা রসিয়ে রসিয়ে বলছিল রমা । এ সব ঘটনার বর্ণনা শোনায় সন্ধ্যার বিশেষ আগ্রহ নেই — কিন্তু রমা সেটা বোঝে না— সন্ধ্যার মুখের হাসিটা যে কৃত্রিম তা ওর নজরে পড়ে না । এমন সময় রামু এসে দরজার বাইরে থেকে রমাকে ডাকল । একটু বোস ভাই, এক্ষুনি আসছি — বলে রমা সন্ধ্যাকে ওর ঘরে বসিয়ে রেখে রামুর সঙ্গে চলে গেল ।
রমার ফিরে আসতে দেরী হচ্ছিল। সন্ধ্যা অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। সমস্ত ঘটনাটার মধ্যে ও একটু অস্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছিল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ও ভাবছিল এবার ও চন্দনের ঘরে ফিরে যাবে কিনা। তখনি রমা ফিরে এল। সঙ্গে রামু আর নেপাল। রামুর হাতে একটা বোঁচকা — নেপালের এক হাতে সন্ধ্যার টিনের বাক্সটা, অন্য হাতে সন্ধ্যার প্রথম দিনে এ বাড়িতে পরে আসা চটি জোড়াটা। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই সে সন্ধ্যার সামনে সেটা মেঝের ওপর ছুঁড়ে দিল।
কথা বলল রমা। ভাই, তোমাকে এখনি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। ডাক্তার সাহেব বলে দিয়েছেন। তোমার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
রমার গলা ঠাণ্ডা, কঠিন, মালিক যে গলায় তুচ্ছ নফরের সঙ্গে কথা বলে সেই রকম। আর তার সঙ্গে সন্ধ্যার কোন সৌখ্যের সম্পর্ক নেই। দাসী হলেও এখন সে এ বাড়ির মালিকপক্ষের মুখপাত্র — তার ওপরে নির্দেশ এসেছে সন্ধ্যাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে। সে এখন সন্ধ্যার মত তুচ্ছ একটা শরীরবেচা মেয়েমানুষকে তার কর্তৃত্ব তো দেখাবেই।
রমা আবার বলল, তোমার ঐ বাক্সে টাকা রয়েছে। চল্লিশ। তিরিশ তোমার — দশ তোমার বাড়িউলিকে বকশীষ। ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে তোমার বাড়িউলির সেরকমই কথা হয়েছে।
রমার ইঙ্গিতে নেপাল বাক্সের ডালাটা একটু খুলে সন্ধ্যাকে ভেতরটা দেখাল। ওর কাপড়জামাগুলো খুব অযত্নে ঠেসে বাক্সে ভরে দেয়া হয়েছে। সেজন্যে বোধহয় সব জামা বাক্সে ধরানো যায় নি — বাকিগুলো ঐ বোঁচকায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। টাকাটা ঠিকই রয়েছে — চারটে একশ টাকার বাণ্ডিল — নারকেল ছোবড়ার শক্ত সরু দড়ি দিয়ে এক একটা বাণ্ডিল বাঁধা। রমা আবার ইঙ্গিত করল — নেপাল বাক্সের ডালা বন্ধ করে দিয়ে রামুর হাত থেকে বোঁচকাটা নিয়ে নিল। রমা বলল, নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে। তোমাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসবে।
ততক্ষণে নেপাল এগিয়ে গেছে নিচে নামবার সিঁড়ির দিকে। সন্ধ্যার পায়ে রমার বাড়িতে পরা চটি ছিল — এ বাড়িতে সে রমার এই চটিই ব্যবহার করছিল। এখন কোনরকমে চটি বদলে নিজের জোড়াটা পায়ে গলিয়ে নিল — তারপর নেপালের পেছনে ছুটল। বাক্সটা চোখে চোখে না রাখলে টাকাগুলো এদিক ওদিক হয়ে যেতে পারে। আর এখন সেরকম কিছু হলে সন্ধ্যা কিছুই করতে পারবে না — চেঁচামেচি করলে এরা সবাই ওকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেবে।
সন্ধ্যাকে সওয়ারি নিয়ে প্রভুদয়াল অত্যন্ত বিরক্ত আর অসন্তুষ্ট ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল। এত ড্রাইভার থাকতে এই ঝামেলা পড়ল কিনা ওরই ঘাড়ে। তবে ও হয়তো এই কাজটা করতে অসন্তুষ্ট হওয়ার বদলে খুশিই হত, যদি সন্ধ্যার সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু এ বাড়ির ভৃত্য সম্প্রদায়কে একটা অত্যন্ত উন্নাসিক তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছে — সেটা ওরা সবাই নজর করেছে। ও এখন গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়ির ভেতরের ভিউ মিরর দিয়ে পেছনের সীটে বসা সন্ধ্যাকে দেখছিল। মেয়েমানুষটা ঘোমটা দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে — মুখ পাশের দিকে ঘুরিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সন্ধ্যার বাড়ির গলির মুখে গাড়ি থামিয়ে দিল প্রভুদয়াল। রুক্ষ্মভাবে সন্ধ্যাকে বলল, গাড়ি আর যাবে না — এখানে নেমে রিকশা করে বাড়ি যাও।
কিন্তু প্রভুদয়াল গাড়ি থামিয়েছিল বড় রাস্তায় — ট্রামলাইনের ওপরেই। যাত্রীবোঝাই একটি ট্রাম ওর গাড়ির পেছনে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল — বিরক্ত ট্রামচালক প্রভুদয়াল যাতে রাস্তা ছেড়ে দেয় তার জন্যে সমানে অধৈর্য্য ঘন্টির আওয়াজ করে যাচ্ছিল। তাতে সূর্যশেখরের খাস ড্রাইভারের গলা সন্ধ্যার ওপর আরও কর্কশ হয়ে উঠল। সে সন্ধ্যাকে এক তাড়া দিয়ে বলল — আরে ঔরৎ — উতরো উতরো, জলদী ।
সন্ধ্যা একহাতে তার বাক্সের হাতল ধরে আর এক হাতে তার বোঁচকাটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই প্রভুদয়াল গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল — সন্ধ্যার মুখের ওপর কালো ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। সন্ধ্যা তার বাক্সপেঁটরা নিয়ে এভাবে নামতে গিয়ে রাস্তার ওপর প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ওর পেছনে আবার ট্রামটা — ও কোনমতে হাঁচোড় পাচোড় করে ফুটপাথে উঠেছিল — প্রভুদয়ালের উদ্দেশ্য একটা গালি ছুঁড়ে দিয়েছিল — সাল্লা হারামি কাঁহিকা।
গলির মুখের থেকে রিকশা নিয়েছিল সন্ধ্যা। ওর কাছে খুচরো টাকাপয়সা কিছু ছিল না — ও বাড়ি থেকে সে সব কোন কিছু ওকে দেয়া হয়নি। তাছাড়া দেবেই বা কেন — ওর তো নিজের বাড়ির দরজা পর্যন্তই গাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। মিঠাইকে বাড়ির সামনে দেখতে পেয়েছিল সন্ধ্যা — ওর থেকে একটা আধুলি নিয়ে রিকশাভাড়া মিটিয়েছিল — পরে ওকে বকশীষ দিয়েছিল পুরো দশটা টাকা।
ও বাড়ি থেকে ছুটি হয়ে যাবার পর পুরনো জীবনে ফিরতে সন্ধ্যার একটু সময় লেগেছিল। এই হপ্তাখানেকের মত। এই সময়টাতে সে তার ঘরে কোন লোক নেয়নি — কোন বাবুকে জানতেও দেয়নি যে ও ফিরে এসেছে। প্রথম দিনটায় সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই ওর একটা ঝটকা লেগেছিল। বিছানায় ও একা। চন্দন কোথায় গেল ! এত তাড়াতাড়ি তো ওর ঘুম ভাঙ্গে না। তারপরেই চোখে পড়েছিল নিজের পুরনো ঘর, বিছানা — সবকিছু মনে পড়ে গিয়েছিল। স্নানের সময়েও একটু অসুবিধে হয়েছিল। ফিরে এসে সেই বারোয়ারি বাথরুম। শাওয়ার, বাথটব, গরমজল — কিছুই নেই। সন্ধ্যা নিজের মনেই হেসেছিল আর নিজেকে গালাগাল দিয়েছিল। শালি খানকি মাগি — তুমি দেড় মাস বড়লোকের বাড়িতে ভাড়া খেটে পটের বিবি হয়ে গিয়েছ। আরও একটা কারণে ও ছটফট করে বেড়াচ্ছিল। চন্দনের খবর জানবার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছে ওকে দুশমনের মত চেপে ধরেছিল। চন্দন এখন কেমন আছে ? ওকে নিয়ে এখন ও বাড়িতে কি হচ্ছে ? ওর অসুস্থতা আবার ফিরে আসেনি তো ? শেষে নিজের উৎকন্ঠা আর চাপতে না পেরে ও মিঠাইকে ডেকেছিল। বলেছিল, কি করি রে মিঠাই ? ও বাড়ির খবরটা কি করে পাওয়া যাবে বলতো ?
মিঠাই আশ্বাস দিয়েছিল, ভেবো না দিদিমণি । আমি রোজ তোমাকে ও বাড়ির খবর এনে দেব ।
তারপর মিঠাই ব্যাপারটা ভেঙে বলেছিল । ও বাড়ির একজন দারোয়ান — রামভকত সিং — মিঠাইএর দেশের লোক । ওরা দেশ ছেড়ে কলকাতা এসেছিল কয়েকবছর আগে পরে । রামভকত রায়চৌধুরি বাড়ির দেউড়ি পাহার দেবার কাজ পেয়ে যায় — ও বাড়িতে কাজ করে সেরকম লোক ওর চেনা ছিল । আর মিঠাই হয়ে পড়ল মেয়েছেলের দালাল । ভগবান যার কপালে যা লিখেছেন — মিঠাই দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়েছিল ।
মিঠাই কথা দিলে তার নড়চড় হয় না । সে সন্ধ্যাকে রোজ ও বাড়ির খবর এনে দিয়েছে । তিনদিন আগে বড় খবরটা দিল । তিনদিন পর — বারই বৈশাখ — ইংরেজী সাতাশে এপ্রিল ও বাড়ির দাদাবাবুর বিয়ে লাগছে । সন্ধেবেলা সাড়ে আটটা নাগাদ সময়টা নাকি ভাল — ঐ সময় দাদাবাবু বাড়ি থেকে বেরোবে ।
মিঠাই আরও খবর দিচ্ছিল । রামভকত ওকে অনেক কিছু বলেছে । বিয়েতে কত লাখ খরচা হবে — কত লোক খাবে । রমা নাকি বৌ এর জন্যে তৈরী একটা দামী গয়না সরিয়ে ফেলেছিল — ম্যানেজার সাহেব তা ধরে ফেলেন । জমিদার সাহেব ওকে তাড়িয়েই দিচ্ছিলেন — রমা সাহেবের পা ধরে খুব কাঁদাকাটা করে — শেষ পর্যন্ত সাহেব ওকে ধমকধামক দিয়ে মাপ করে দিয়েছেন ।
মিঠাই কথা বলে যাচ্ছিল । এত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে — অনেক বলবার মত খবর পেয়েছে সে । সন্ধ্যা ওকে থামিয়ে দিয়েছিল । ও চন্দনের খবর জেনে নিয়েছে । ও বাড়ির অন্যান্য খবর জানার ওর কোন আগ্রহ নেই । বলেছিল, ঠিক আছে মিঠাই । আমার একটু কাজ আছে । তুই এখন যা । তিন দিন পর আমি সন্ধেবেলা ও বাড়ির কাছে যাব । তুই আমার সঙ্গে যাবি — আমাকে পাহারা দিবি ।
মিঠাই একটু অবাক হয়েছিল । দিদিমণি ওখানে যাবে কেন ? কিন্তু ও কখনো সন্ধ্যাকে কোন প্রশ্ন করে না — ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে চলে গিয়েছিল ।
সন্ধ্যা হাতের ঘড়ি দেখল । আটটা পঁচিশ বেজে গিয়েছে । যেকোন সময় চন্দন বেরোবে । এতদূর থেকে ও শুধু তার গাড়িটাই দেখতে পাবে — আর কিছু দেখা যাবে না ।
বাড়ির ভেতর একটা প্রবল উলুর আওয়াজ শুরু হল । দেউড়ির সামনে অনেক লোক জটলা করে দাঁড়িয়েছিল — তারা সব দুপাশে সরে দাঁড়াল । বাড়ির ভেতর থেকে গাড়ি বেরোতে লাগল । সন্ধ্যা গুণল — এক, দুই, তিন, চার — চার নম্বরের গাড়িটা ফুল দিয়ে সাজান, তাছাড়া এইমাত্র ওটার ওপর একগাদা ফুলের বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে তাও বোঝা যায় । তারপরও অনেকগুলো গাড়ি সার দিয়ে বেরোচ্ছিল — কিন্তু সন্ধ্যা সে সব আর দেখল না । সে একবার চার নম্বরের গাড়িটার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল — যদিও সেটা ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে । সন্ধ্যা শাড়ির আঁচল দিয়ে দু চোখের কোণ মুছে নিল । কেন যে চোখে জল আসে — দুত্তেরি । নিজেকে সামলে নিল সন্ধ্যা ।
সন্ধ্যা ফিরল হেঁটে। ওর জন্যে অপেক্ষা করা রিকশার কাছে আসতে ওর লাগল মিনিট দুই — ওর কব্জীতে বাঁধা ঘড়ির হিসেবে । কিন্তু সন্ধ্যা হাঁটল এক দীর্ঘ — অতি দীর্ঘ পথ — গজ, ফুট, মাইলের হিসেবে তাকে মাপা যায় না । দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টে লাগানো অল্পশক্তির মিটমিটে বিদ্যুৎ বাতি — তাতে পায়ের নিচের রাস্তায় অত্যন্ত মৃদু আর মোলায়েম আলো — প্রায় অন্ধের মত পা ফেলছিল সন্ধ্যা — মাঝে মাঝে মিঠাই সাবধান করছিল — দেখে দিদিমণি, সামলে । চন্দন এখন কি ভাবছে ? ওকি এই নতুন মেয়েটিকে সঙ্গিনী হিসেবে পেতে খুব উৎসুক ? ওর কি সন্ধ্যাকে মনে পড়ছে ? নাকি ও সন্ধ্যাকে ভুলে গিয়েছে ? হতেও তো পারে — ওর যা অসুখ ছিল তাতে ওর সন্ধ্যাকে এতদিনে ভুলে যাওয়া খুবই সম্ভব । বন্যার স্রোতের মত চন্দনের স্মৃতি সন্ধ্যার মনে ভেসে আসে — ওর সঙ্গে গল্প, খেলা, ওকে শাসন করা — হঠাৎই এক শূন্যতা বোধ সন্ধ্যাকে পেয়ে বসে — ওর গলা বুজে গিয়ে নি:শ্বাস বন্ধ হওয়ার মত লাগে — ও মুখ ওপরের দিকে তোলে — হাঁ করে মুখের ভেতর হাওয়া টানবার চেষ্টা করে । ওপরে মুখ তুলতে চোখে পড়ে মাথার ওপর স্থির গম্ভীর আকাশ — যার অসীম বিশালতার ভেতর জন্ম নেয় অগুনতি তারা — আবার সেগুলো মিলিয়ে যায় — মাটির মানুষের সব ব্যর্থতা, দু:খ ওই তারাভরা আকাশ হজম করে নেয় । এখন আকাশে চাঁদ নেই — কিন্তু অজস্র তারা চিকমক করছে । সন্ধ্যার মন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে । একটা প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষকে সে সুস্থ করে তুলেছে — বিশ্বের অনন্ত জীবনস্রোতে সে যোগ করেছে একটি পরিপূর্ণ জীবন । ওই ওপরের গ্রহ নক্ষত্রের মত, তাতে লুকিয়ে থাকা দেবতাদের মত, ওর ভেতরেও রয়েছে মানুষের মঙ্গল করার শক্তি — যা একজন মানুষের উপকারে এসেছে । এই বিরাট সার্থকতার পরিতৃপ্তিতে সন্ধ্যার মন ভরে ওঠে — একটু আগের শূন্যতার অনুভূতিকে অত্যন্ত তুচ্ছ মনে হয় । সন্ধ্যা এখন ওর জন্যে অপেক্ষা করা বাহনের কাছে পৌঁছে গিয়েছে — তাতে ও উঠে বসে — রিকশাওয়ালা তার গাড়ি নিয়ে দৌড়োবার বদলে হেঁটে হেঁটে চলতে থাকে — যাতে পেছনে পেছনে হেঁটে আসা মিঠাই পেছিয়ে না পড়ে । বাড়ি পৌঁছে সন্ধ্যা রিকশাওয়ালাকে একটা দশ টাকার নোট দিল । ও বেচারি নোটটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়েছিল — বিশ্বাস করতে পারছিল না দিদিমণি কি করে এত টাকা বকশীষ দিতে পারে । সন্ধ্যা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল । বলল, আজ বিয়ের তারিখ আছে । কত লোক কত জায়গায় বিয়েবাড়ির নেমতন্নে ভাল ভাল খাবার খাচ্ছে । তুমিও এ টাকায় ভাল খাবার খেও ।
বাড়ির দরজায় চার পাঁচটা মেয়ে বসে আর দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকছিল । ওরা ব্যাপারটা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল । একটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাদেরও দাও না সন্ধ্যাদি ।
সন্ধ্যাও হেসে ফেলল । তারপর ওদেরও প্রত্যেককে দিল । দশটা করে টাকা । দুটো মেয়ে মুখে আঙুল পুরে সিটি দিল । আর একটা মেয়ে বলে উঠল, সন্ধ্যাদি, তুমি আমার বাবু হয়ে যাও না মাইরি ।
আবারও হাসল সন্ধ্যা । তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল ।