সাধারণতঃ চন্দন যখন যা চায়, রামু সেটা সঙ্গে সঙ্গে ওকে দিয়ে থাকে। কিন্তু কতগুলো জিনিষ চন্দনের হাতে দেওয়া একেবারে বারণ। কোন ছুঁচলো বা ধারালো জিনিষ, আগুন লাগতে পারে এরকম কিছু। নেহাৎই যদি কখনো এঘরে তা আনতেই হয় তাহলে তা রামু নিজের কাছেই রাখে। কখনই চন্দনের হাতে দেয় না। চন্দন ওকে এলোপাথারি কিলো চড় লাগালেও না। বুড়ো হলেও রামু যথেষ্ট বলবান— চন্দন ওর কাছ থেকে এ সব জিনিষ কেড়ে নেবে তা একেবারেই অসম্ভব। আবার রামু ওর ওপর যা হুকুম হবে তা তামিল করতে গাফিলতী করবে, তাও হতে পারে না। এই বংশের লোকেদের প্রতি রামুর আনুগত্য সীমাহীন — তা সে খোড কর্তা সূর্যশেখরেরই হোক বা তার ছেলে চন্দনই হোক। রামু নিয়ে এল মোম আর দেশলাই। নিজের হাতে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল কি করতে হবে মোম জ্বেলে?
চন্দন জানে যে রামু ওর হাতে মোম আর দেশলাই দেবে না। ও রামুকে দিয়ে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে নিল। তারপর ওকে টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপরের পিঁপড়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, ওগুলোর ওপর গলানো মোম এক এক ফোঁটা করে ফেলতে থাক্।
এখানে তো একটা মরা টিকটিকিও পড়ে আছে, রামু বলল। ওটাকে তো ফেলে দিতে হবে।
আবার চেঁচাল চন্দন, তোকে যা বলছি তাই কর।
রামু গলে যাওয়া মোমের ফোঁটা টেবিলের ওপর ফেলতে লাগল। পিঁপড়ের দলটা ছটফট করে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় — ভয় পাওয়া দ্রুত পায়ে পালাবার চেষ্টা করে। যে কটার ওপর মোমের ফোঁটা পড়ে সেগুলো সেখানেই জমে যায় — স্বচ্ছ মোমের ভেতর দিয়ে কালো এক একটা পিঁপড়ের কবরস্থ শরীর দেখতে পাওয়া যায়। চন্দন দেখে আর হিংস্র আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতে থাকে। এইভাবে বেশ কিছু পিঁপড়ে টেবিলের ওপর মোমের নিচে সমাধিস্থ হল — বাকিগুলো পালিয়ে গেল — এদিকে ওদিকে, টেবিলের তলায়। দেয়ালে পিঁপড়ের সারি তখনও রয়েছে। চন্দন রামুকে হুকুম করল মোমবাতির জ্বলন্ত শিখাটা পিঁপড়েগুলোর গা ঘেঁষে ওদের লাইন বরাবর টেনে নিয়ে যেতে। রামু একবার মিনমিন করে বলল, ছেড়ে দাও দাদাবাবু। পিঁপড়েগুলো মরে পুরো দেয়াল নোংরা হয়ে যাবে। কিন্তু এককথায় চন্দন রেগে গেল আর রামুর কান ধরে খুব জোরে টেনে দিল। ও এখন অত্যন্ত নিষ্ঠুর — যারা ওর বন্ধুর শরীর ছিঁড়ে খেতে এসেছিল তাদের ও রেহাই দেবে না।
অতএব রামু চন্দন যা বলেছে তাই করল। জ্বলন্ত শিখার তাপে পিঁপড়েগুলোর শরীর ফেটে পুট পুট করে ছোট ছোট শব্দ হচ্ছিল আর তাদের দেহাবশেষ দেয়ালের গায়ে লেপ্টে যাচ্ছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেয়ালে পিঁপড়েগুলোর বদলে রইল একটা লম্বা একটু ছাড়া ছাড়া কালো দাগ। রামু মনে মনে দুঃখিত বোধ করে। এহেহে, খামোকা এতগুলো জীবহত্যা। তারপরই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, ভগমান, দাদাবাবুর দোষ নিওনি বাপু। ও তো সুস্থ নয় — পাগল মানুষ। তারপরই ভাবে, এ ঘরে ওই মোমের ফোঁটা পড়া টেবিলটা পালটে দিতে হবে, আর দেয়ালটা সাবানজল দিয়ে ঘষে মুছতে হবে। তাহলে আবার ঘরটা আগের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
রাজার দিকে আঙুল দকেহিয়ে চন্দন রামুকে বলল, ওকে বাগানে কবর দেব — একটা খুরপি আর একটা ছুরি নিয়ে আয়। তার পরেই ওর মনে পড়ে গেল রাজার জন্যে একটা ডেথ সার্টিফিকেটের দরকার। ওটা দেখিয়ে মৃত্যুটা করপোরেশনের খাতায় তুলতে হবে। কাজেই চন্দন রামুকে আরও হুকুম দেয় সেনকাকার থেকে সেরকম একটা সার্টিফিকেট রাজার নামে লিখিয়ে আনতে। রামু অনেকবছর ধরে চন্দনের খিদমত খাটছে। ও আগে অনেকবার এর চাইতে অনেক শক্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। ও চন্দনকে বলল, আমি একটা সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে আসছি। কাগজের ল্যাজা মুড়োয় জায়গা ছেড়ে রেখে তুমিই সাট্টিফিট লেখো। আমি লেখার ওপরে ডাক্তার সাহেবের স্ট্যাম্প লাগিয়ে নেব আর নিচে ওনার সই নিয়ে নেব।
রামুর এই বুদ্ধিটা চন্দনের মনে ধরে গেল। ও হেসে ফেলল — ওর হলদেটে দাঁতগুলো দেখা গেল। দাঁত হলদেটে কারণ দাঁত মাজা ব্যাপারটা চন্দন খুব একটা পছন্দ করে না আর রামু দাঁত মাজিয়ে দিতে গেলে ও রামুর আঙুল কামড়ে দেবার চেষ্টা করে। ও বলল, শালা তোর মাথায় মাঝে মাঝে ভাল বুদ্ধি খেলে। যা, দৌড়ে কাগজ কলম নিয়ে আয়।
রামু চুপ করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ও জানে কোন কথা বললেই চন্দন আরও খেপে উঠবে — ওকে মারধর শুরু করবে। চন্দন বিড় বিড় করে রামুকে গালাগাল দিতে দিতে রামুর হাতে কাগজ কলম ফেরৎ দিল। তারপর রামুকে বলল রাজার শরীরটা খবরের কাগজের একটা বড় টুকরো দিয়ে মুড়ে তুলতে। কফিন যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন খবরের কাগজের মোড়কই সই।
রামু খবরের কাগজ, ছুরি আর খুপরি নিয়ে এল। বাড়ির লাগোয়া বাগানের সামনের দিকেই একটা বকুল গাছ। তার গোড়ায় রাজাকে কবর দেওয়া হল। খোঁড়াখুঁড়ি, মাটি চাপা দেওয়া এসব রামুই করল — চন্দন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামনে। তারপরই ওর মনে হল যে গাছটার গোড়ায় যে খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে তাতে গাছটার শিকড়ে টিকড়ে ব্যথা লেগেছে। তখন ও রামুকে আবার হুকুম দিল গাছের গোড়ায় অ্যান্টিসেপটিক ক্রীমের মোটা করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে। রামু যতক্ষণে গাছের গোড়ায় ক্রীম ঢালা শেষ করল ততক্ষণে ওর খেয়াল হয়েছে যে ওর খিদে পেয়েছে, কারণ রাজার শোকে ও সকাল থেকে কিছু খায়নি। এই খিদের খোঁচায় ওর ভেতর একটা রাগ জেগে ওঠে। ওর এই খিদে পাওয়ার জন্যে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ দায়ী। তক্ষুনি আবার ওর চোখের সামনে লাল পর্দাটা ভেসে চলে আসে আর চন্দন ঐ গলার আওয়াজ শুনতে পায়, রামু — ঐ রামুই দায়ী। চন্দন দুহাতে কীল চড় চালায় — রামুর মাথায়, বুকে, পিঠে। রামু দু হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করে — চন্দনের কীল চড় ওর দু হাতে লেগে ফিরে আসতে থাকে। তাতে চন্দনের রাগ আরও বাড়ে। ও চেঁচিয়ে ওঠে, হারামজাদা শুয়োর — আমার খিদে পেয়েছে কেন?
রামুর কোন বিকার হল না। চন্দনের এরকম করা রোজকার ব্যাপার— এসব রামুর গায়েই লাগে না। রামু কখনো ছুটি নেয় না — ও এ বাড়ি থেকে বেরোলে দাদাবাবুর সেবা করবে কে? তবুও গত বছর ওকে যেতে হয়েছিল দিনকয়েকের জন্যে। দেশে ওর মাঠকোঠা বাড়ি — ঝড়ে তার ক্ষতি হয়েছিল। কর্তা সাহেব ঘর মেরামতের টাকা দিয়েছিলেন — রামু সে টাকা বাড়ির লোকদের হাতে দিয়ে এসেছিল। গ্রামে আছে ভোলাবাবার থান— খুব পুরনো আর জাগ্রত শিব। রামু ভোলাবাবার থানে পঞ্চাশ টাকা পূজো মানত করে এসেছিল — চন্দন দাদাবাবুকে একেবারে সুস্থ করে দাও বাবা ভোলানাথ। কলকাতায় ফিরে এসে দেখে তুলকালাম কাণ্ড। একদিনের জন্যে হরিদাস বলে আর একজন চাকর মোতায়েন হয়েছিল চন্দনের দেখাশোনা করবার জন্যে। চন্দন তাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে — থালাসুদ্ধ খাবার ছুঁড়ে মেরেছে ওর মুখে। রামু ফিরে আসার পর আবার খাওয়া দাওয়া করেছিল চন্দন। সেই সঙ্গে ছিল রামুকে ধরে মার। দুদিন এখানে ছিলি না কেন শুয়ারের বাচ্চা?
রামু খুব ঠাণ্ডাভাবে বলল, খিদে পেয়েছে তো এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি। তার আগে চানটা করে নাও। তোমার গা থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে।
চন্দন হুংকার দিয়ে উঠল, শালা হারামি — আমাকে না খাইয়ে রাখার মতলব?
রামু ওর তর্জনে ভয় পেল না। ওর হাত ধরে ফেলে ওকে টেনে নিয়ে চলল বাথরুমের দিকে। বাথরুম এই ঘরেরই লাগোয়া। শাওয়ার খুলে ওর গা মাথা ভিজিয়ে দিয়ে গা মুছিয়ে পোষাক পালটে দেবে। পাগলের মাথা এখন তেতে আছে — এখন ওকে বাথটাবে স্নান করানো সম্ভব নয়।
চন্দনের ডান হাতটা রামুর কব্জায় চলে যাওয়ার জন্যে ও সুবিধে করে রামুকে মারতে পারছিল না। রামুর টানে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে চন্দন এদিক ওদিক তাকিয়ে ছুরিটা খুঁজল। ওটায় হাত লাগাতে পারলে রামুর পেটে বসিয়ে দেবে। ওটা কোথাও নেই। রামু শালা এর মধ্যেই ওটা সরিয়ে ফেলেছে। আর কোন উপায় নেই। রামু শয়তানটা শাওয়ার খুলবে — ওর সারা গা মাথা ভিজে যাবে— ওর শীত করবে — কত কষ্ট হবে। হতাশায়, ক্ষোভে, গায়ে জল পড়ার শীতের আসন্ন কষ্ট পাওয়ার দুঃখে ওর চোখ ছাপিয়ে জল এল। ফোঁপাতে লাগল চন্দন।
রামু চন্দনের কান্নাকে একেবারেই পাত্তা দিল না। স্নান করতে গেলেই দাদাবাবু নানারকম ঝামেলা করে। ও চন্দনের স্নানপর্বটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল। চন্দন যতক্ষণ কাঁদে ততক্ষণ ঠাণ্ডা থাকে— হাত পা ছোঁড়ে না — মারধর করে না। কখন মেজাজ পালটে অন্য মূর্তি ধরবে তা বলা বড় মুস্কিল। স্নান করিয়ে পোষাক পালটে দিয়ে চন্দনকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রামু ওর খাবার আনতে গেল। ওর চুল আঁচড়ে দিতে গিয়ে রামুর একটু অসুবিধে হচ্ছিল। চুল খুব বড় হয়েছে — আর নোংরা জমে আঠাও হয়েছে তাতে। কেটে ছোট করার দরকার। কিন্তু চন্দনের চুল কাটা একটা শক্ত কাজ। চারপাশের চুল কাটার দোকানগুলোর লোকজন কেউ আর আসতে চায় না চন্দনের চুল কাটতে। কে খামোকা মারধর খেতে আসবে? বেশী টাকা দেখালেও আজকাল কাজ হচ্ছে না।
অনেক পুরনো কথা চন্দনের মনে নেই। একেবারে মুছে গেছে। শ্লেটের ওপর চকখড়ির লেখা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষে দিলে যে রকম হয় সেরকম। কিন্তু মায়ের মারা যাওয়ার সময়ের সব কিছু ওর মনে আছে। সেদিন সকালে ঘুম ভেঙে ওঠার পর মা ওর ঘরে আসে নি। এসেছিল রামুদা। ওর হাত মুখ ধুইয়ে দিল — সকালের জলখাবার নিয়ে এসে ওকে খাইয়ে গেল। ওর মুখ গম্ভীর। মা কেন আসছে না এ কথার একটাই জবাব দিচ্ছিল — গিন্নীমার অসুখ করেছে। নিজের ঘরে শুয়ে আছে। ডাক্তার ছাড়া আর কেউ সে ঘরে যেতে পাবে না। ডাক্তারের মানা।
রামুদা চলে যাবার পর নিজের বই খাতা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছিল চন্দন। আজ স্কুলে যাওয়া হবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না। স্কুলে যেতে হলে তো মা চান করিয়ে দেয়। আজ তার কি হবে? দিনটা যে কি অন্যরকম। এরকম দিনে কি কি করা উচিত তা তো কেউ চন্দনকে বলে দেয় নি।
তখন ঘরে ঢুকেছিল গণেশ। বাড়ির ছোকরা চাকর। রামুর দেশের ছেলে — রামুই ওকে ঢুকিয়েছিল এ বাড়িতে। বয়সে চন্দনের চাইতে দু এক বছরের বড়। চন্দন ওর সঙ্গে বাড়ির পেছনের বাগানে মার্বেল-গুলি খেলত। গনেশের হাতের টিপ ছিল খুব ভাল। প্রায়ই খেলাতে ও চন্দনকে হারিয়ে দিত। তখন চন্দন ওকে লাগাত মার। ও চাকর হয়ে কেন মনিবের চেয়ে ভাল খেলবে — কেন মনিবকে হারিয়ে দেবে? চুল ধরে টেনে চড়, ঘুষি, মাথায় গাঁট্টা। গণেশ তখন দু একদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকত। চন্দন ওকে ওকে ডেকে পাঠাত। আবার খেলত, আবার হারত, আবার গণেশের ওপর হাতের সুখ করত।
গণেশ ওকে বলল, দাদাবাবু, গিন্নীমা তো মারা গেছে। ও ঘরে সবাই আছে — সাহেব, ডাক্তারসাহেব — সবাই। খুব ভীড়।
চন্দন ওর মাথায় মারল এক গাঁট্টা। বাজে কথা বলছিস শয়তান? এইমাত্র রামুদা বলে গেল মার অসুখ। ডাক্তার ছাড়া আর কারোর ও ঘরে ঢোকা বারণ।
গণেশ একটু দূরে সরে গিয়ে মাথায় যেখানে চন্দন মেরেছে সেখানে হাত ঘষে ঘষে ব্যথা কমাবার চেষ্টা করছিল। বলল, নিজেই গিন্নীমার ঘরে গিয়ে দেখে এস না।
ঘরে ঢুকল রামু। ঘরের দরজা খোলা ছিল — বাইরে থেকে ওদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে। সোজা এসে গণেশের কান চেপে ধরল — ওকে সেভাবেই ধরে টানতে টানতে ঘর থেকেবার করে নিয়ে গেল। ঘরের দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল। তখন হঠাৎ চন্দন বুঝে ফেলল। গণেশ মিথ্যে কথা বলে নি।
ওরা পুড়িয়েছিল মার শরীরটাকে। চন্দনকে মুখে আগুন ছোঁয়াতে হয়েছিল। চন্দন ভাবছিল পুরো ব্যাপারটায় ভুল হয়েছে কিনা। মা মরেনি। খালি অজ্ঞান হয়ে আছে। মুখে আগুনের ছোঁয়া লাগলে মা ব্যথা পাবে — তাতে ধড়মড় করে উঠে বসবে। সেজন্যে খুব আশা নিয়ে মায়ের মুখের কাছে পাটকাঠি গুলোর জ্বলন্ত ডগা নিয়ে গিয়েছিল চন্দন। কিন্তু মুখে লাগায় নি। আহা, মার অমন সুন্দর মুখ — পোড়া দাগ না হয়ে যায়। একটা পুরুৎ কি সব মন্ত্র পড়ছিল — ও লোকটা তাড়াতাড়ি চন্দনের হাতটা ধরে আগুনটা মার মুখে ছুঁইয়ে দিল। মা নড়ল না। তারপর ওরা সবাই মার চিতায় বড় করে আগুন দিল।
চন্দন কাঁদে নি একেবারে। কিন্তু ওর শরীরে, মনে একটা অদ্ভুত ধরণের কষ্ট হচ্ছিল — সেরকম আগে ওর কখনো হয় নি। মনে হচ্ছিল ঢোঁক গিলতে পারছে না — নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কথাও বলতে পারছিল না। মুখ খুললেই মনে হচ্ছিল কে যেন গলা টিপে ধরছে। শ্মশানে লোকের ভীড়ের মধ্যে কোন একটা গলা শুনতে পেয়েছিল, ছেলেটার খুব মনের জোর আছে। এইটুকু ছেলে — কোন কান্নাকাটি নেই।
কিছুদিন ধরে চন্দনের মাথায় একটা ধারণা উঁকি দিচ্ছিল। মাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে একটা খুব বড় ভুল করেছে ওরা। ওর বাবা, সেনকাকা, ওই শালা শয়তান রামু। মাকে ঐভাবে রেখে দিলে তো মার বুকের ধুকপুকুনি আবার চালু হয়ে যেতে পারত। মা চোখ মেলে বিছানায় উঠে বসত। কদিন আগে ও মার ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ সেই আবছা লাল পর্দাটা। তার পরেই ঐ গলাটার আওয়াজ — গম্ভীর এবং জ্ঞানী। ওরা ভুল করেছে — ওরা সবাই। শরীরটা থাকলে তোমার মা আবার উঠে বসত। ওরা সেটা পুড়িয়ে দিয়েছে। তোমার মার বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চন্দনের মনে এই ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে ঢুকে গিয়েছে। কারণ ঐ গলাটা — ঐ গলার মালিক কখনো ভুল করতে পারে না। কিন্তু চন্দন এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ পায় নি ঐ আশ্চর্যগলার মালিকের কাছ থেকে। সে যদি চন্দনকে বলে দেয় বদলা নিতে চন্দন তা অবশ্যই নেবে — সে যার ওপরেই হোক — তার বাবা, সেনকাকা বা রামু — যে কেউ।
মায়ের ছবিটার থেকে চন্দনের চোখ চলে গিয়েছিল দেয়ালের দিকে। ওর নজর পড়ল একটা বড়সড় কালো পিঁপড়ের ওপর। দেয়াল বেয়ে নামছে। ওটা টেবিলটার ওপর নেমে এল। এক জায়গায় জমানো খানিকটা মোম — যেখানে ওর এক স্যাঙাতের শরীর মোমের ভেতর জমে আছে — সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে শুঁড় নেড়ে নেড়ে জায়গাটা অনুভব করতে লাগল। চন্দন খুব খুশি হয়ে দেখছিল। শালারা রাজাকে খেতে এসেছিল — এটাও নিশ্চয়ই তাদেরই একটা। দেখুক শালা, ওর সঙ্গীদের কি অবস্থা হয়েছে। ফিরে গিয়ে বলুক ওদের দলের সবাইকে — রাজাকে খাওয়ার চেষ্টা করলে কি হয়। ওটা কিন্তু ফিরে গেল না। টেবিলটার গায়ে লাগানো একটা কাঠের আলমারি — তার ওপর উঠে পড়ল। চন্দনও উঠল। পিঁপড়েটাকে টিপে মারবে। কিন্তু প্রাণীটা চালাক আর চটপটে। আলমারির পাল্লার চাবির ফুটোর মধ্যে ঢুকে পড়ল ওটা। চন্দনের চোখের আড়ালে চলে গেল।
চন্দন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। ঐ ফুটোয় ঢুকিয়ে খোঁচাবার মত কিছু একটা চাই। বদমাসটাকে খুঁচিয়ে বার করে আনতে হবে। তবেই না ওটাকে মারা যাবে। সে রকম কিছু চোখে পড়ল না। চন্দন রেগে গেল রামুর ওপর। উল্লুকটা কোন দরকারি জিনিস হাতের কাছে রাখে না। তার পরেই ওর মাথায় এল। আলমারিটা খুলে ফেলে দেখা যাক। হয়তো পিঁপড়েটাকে ভেতরে দেখতে পাওয়া যাবে। একটানে আলমারীর দুটো কপাটই খুলে ফেলল চন্দন।
ভেতরে চন্দনের সব বইপত্র রাখা রয়েছে — ও যখন স্কুলে পড়ত সে সময়কার সব বই। রামু সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। আগে বইগুলো একটা কাঁচের পাল্লার আলমারিতে থাকত। কয়েক বছর আগে চন্দন ঘুষি মেরে আলমারির কাঁচ ভেঙে দেয়। সারা ঘরে ভাঙা কাঁচের টুকরো — তার ওপর চন্দনের হাত কেটে রক্তারক্তি। রাতারাতি আলমারি বদলে ফেলা হল। এ আলমারি চাবিবন্ধ করা হয় না। চন্দন যদি কখনো কোন বই বার করে পড়তে চায় তাতে ডাক্তারের মানা নেই। বরঞ্চ সেটা একটা ভাল লক্ষণ হবে। কিন্তু চন্দন পড়ে না। পড়ার বই এর সঙ্গে বেশ কিছু গল্পের বইও আছে। সেগুলোও নয়। চন্দনের কোন উৎসাহ নেই। কাগজের ওপর অর্থহীন হিজিবিজি সব লেখা। কি হবে ওসব পড়ার চেষ্টা করে?
আলমারি খুলেও কিন্তু ও পিঁপড়েটাকে দেখতে পেল না। আলমারির ভেতর এদিক ওদিক উঁকি মেরেও নয়। হতাশায় আবার ওর রাগ হতে লাগল। তাক থেকে বার করে কতগুলো বই দুমদাম করে ছুঁড়ে ফেলল মেঝের ওপর। যে ফাঁকগুলো তৈরী হল সেখানেও উঁকি দিয়ে দেখল। নাঃ, কোথাও নেই। হাঁপিয়ে গিয়ে নিজের বিছানায় এসে বসল চন্দন। আজ খুব বেঁচে গেল শালা পিঁপড়েটা।
চন্দনের এখন ঠিক মনে পড়ে না ও শেষ যখন স্কুলে গিয়েছিল তখন ও কোন ক্লাসে ছিল। ক্লাস এইট — নাকি নাইন? চন্দন ক্লাসে বসেছিল। পেছনের বেঞ্চিতে। সামনের বেঞ্চগুলোতে ক্লাসের সব ভাল ছেলেরা বসত। চন্দন তাদের দলে ছিল না। মা মারা যাওয়ার পরে পরেই পড়াশোনায় ঢিলে দিয়েছিল চন্দন। ব্যাপারটা সূর্যশেখরের নজরে এসেছিল — একগাদা গৃহশিক্ষক ঠিক করে দিয়েছিলেন চন্দনকে বাড়িতে পড়াবার জন্যে। ফল বিশেষ কিছু হয় নি — তবে এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে ওঠার বেড়া কোনমতে টপকে যাচ্ছিল চন্দন। কিন্তু স্কুলে বখা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করছিল — নানা শকার বকারের গালাগাল শিখছিল। বাড়িতে কাজের লোকদের সঙ্গে ওর কথা বলাতে সেটা টের পাওয়া যেত। সূর্যশেখর মা মরা ছেলেকে শাসন করার চেষ্টা করেন নি। স্কুলে মাস্টাররাও ওকে বিশেষ কিছু বলতেন না। সূর্যশেখর রায়চৌধুরীর ছেলে কোনমতে ক্লাসে প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছে এই ঢের। ওকে তো আর পড়াশোনা ভাঙিয়ে করে খেতে হবে না। সেই পিরিয়ডটায় ছিল অঙ্কের ক্লাস। মাস্টারমশাই বীজগণিতের কিছু বিষয় পড়াচ্ছিলেন। বোর্ডে এ বি সি — তাদের স্কোয়ার, কিউব, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ — বোর্ড বীভৎসভাবে ভর্তি। হঠাৎ একটা অদ্ভূত ব্যাপার চন্দনের চোখে পড়ল। অঙ্কের মাস্টারের নাকটা অস্বাভাবিক রকম লম্বা হয়ে গেছে, আর তার ডগাটা একটু ঝুলে পড়েছে। ঠিক সেই সময় লালচে, স্বচ্ছ পর্দাটা নেমে এল ওর চোখের সামনে — সেই প্রথমবার। আর সেই সঙ্গে শুনতে পেল একটা জোরালো প্রভুত্বের গলা — তুমি সীট ছেড়ে ওঠো, এগিয়ে যাও, গিয়ে মাস্টারের নাকে একটা ঘুষি বসিয়ে দাও। তবেই আবার নাকটা তার পুরনো চেহারায় ফিরে আসবে। চন্দন বুঝতে পারছিল যে এই গলার স্বরের উৎপত্তি ওর শরীরের বাইরে কোথাও নয়। বক্তা ওরই ভেতর ঢুকে বসে আছে — হয়তো ওর বুকের খাঁচার ভেতরে — হয়তো বা ওর মাথার অত্যন্ত গভীরে — একটা কোণে। কিন্তু তবুও চন্দন উঠছিল না। ওর একটু ভয় করছিল। কোন ছাত্রের পক্ষে এরকম কাজ করা কি সম্ভব? কিন্তু ওর সামনের পর্দাটা গাঢ় লাল হয়ে উঠতে লাগল — ওর মাথার ভেতর দুপদুপ করে একটা ব্যথা শুরু হল — ঐ গলাটা টিনের পাতের ওপর ধারালো ব্লেড দিয়ে আঁচড়াভার মত হয়ে উঠল। ওর মনে হতে লাগল ওর শরীরের সমস্ত স্নায়ু এবার ছিঁড়ে খুঁড়ে যাবে। ও সীট ছেড়ে উঠল, সোজা টিচারের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। মাস্টারমশাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, পড়ানো থামিয়ে চুপ করে তাকিয়ে দেখছিলেন ওর দিকে। শিক্ষকের সামনে এসে চন্দন দাঁড়িয়ে পড়েছিল — এক মুহূর্তের দ্বিধা — সেই সময় আবার সেই গলাটার আদেশ — চালাও নাক টিপ করে ঘুষি।
তারপরের ঘটনাগুলোর স্মৃতি সব ভাসা, ভাসা — ঝাপসা। ক্লাসে বিকট চেঁচামেচি — তিন চার জন সহপাঠি ওকে জোর করে ধরে আছে। মাস্টারমশাই নাকে রুমাল চেপে ধরে আছেন, রুমালে লালচে তরলের ছোপ লাগছে। উনি ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ক্লাসের ছেলেদের বলে গেলেন চন্দনকে হেড মাস্টারের ঘরে নিয়ে যেতে।
চন্দনের সামনের লাল পর্দাটা আর ছিল না — ঐ ভুতুড়ে গলার আওয়াজটাও চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় ওর মাথা ছিঁড়ে পড়তে চাইছিল — মনে হচ্ছিল মাথার ভেতর কেউ একটা ভারি হাতুড়ি দিয়ে দুম দুম করে ঘা দিচ্ছে। হেডমাস্টার চন্দনকে সামনে বসিয়ে নানা কথা বলছিলেন, অনেক প্রশ্নও করছিলেন। চন্দনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল ক্লাসের ছেলের দল — ও একবার সেই ছেলেদের দিকে, একবার হেডমাস্টারের দিকে তাকাচ্ছিল। হেডমাস্টারের কোনো কথা ওর কানে যাচ্ছিল না। ও শুধু নিজের মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ছন্দবদ্ধ আর ভারি সেই শব্দ — ওর মাথার ভেতর তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আর চন্দনের মনে হচ্ছিল ওর মাথাটা টুকরো টুকরো হয়ে ফেটে ফেটে যাচ্ছে — আবার জোড়া লাগছে, আবার ফাটছে।
বাবা এল স্কুলে। হেডমাস্টারের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। চন্দনকে তখন হেডমাস্টারের ঘরের বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর বাবা সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল — চন্দনের হাত ধরে স্কুল থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। চন্দনের মাথার ভেতর দুর্গাপূজোর ঢাকের বাজনা— নিজের বাড়ি— সেনকাকা এল— কি সব জিজ্ঞেস করল চন্দনকে। সে রাতে সেনকাকার দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে তবে ঘুমিয়েছিল চন্দন।
পরের দিন থেকে শুরু হল বাড়িতে ডাক্তারের আসা যাওয়া। একজন-দুজন। শরীর পরীক্ষা আর নানা রকম প্রশ্ন। লাল পর্দাটা আসে যায়। ঐ গলার স্বর নানা রকম নির্দেশ দেয়। জলভর্তি কাঁচের গেলাসটা মেঝেয় আছড়ে ভেঙে ফেল— ঐ চাকরটা পাজি, ওকে ধরে মার লাগাও — ডাক্তাররা তোমাকে মেরে ফেলতে চায় — ওদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দাও। ঐ গলার আওয়াজ যখন ও শুনতে পায় তখন ওর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয় — ও যান্ত্রিকভাবে ওর মাথার ভেতর বেজে ওঠা ওই রহস্যময় নির্দেশগুলো মেনে কাজ করে। তারপর সেনকাকা ছাড়া বাকি সব ডাক্তারদের আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পড়াশোনা বন্ধ — গৃহশিক্ষকদের আসাও বন্ধ। রইল শুধু একগাদা ওষুধ। সকালে এটা খাও — দুপুরে খাওয়ার পর ওটা — রাতে শোবার আগে এই লাল ছোট বড়িটা। ওষুধগুলো থাকে রামুদার কাছে। শয়তানটা এক এক সময়ে এসে এক একটা খাইয়ে দিয়ে যায়। চন্দন ওষুধগুলো খায়। কারণ ও দেখেছে ওগুলো খেলে ওর সেই তীব্র অসহনীয় মাথাব্যথাটা থাকে না। তবে লাল পর্দাটা থাকে — সেটা ঘুরে ফিরে আসে। আর থেকে যায় ঐ গলার মালিক — যে ওর সঙ্গে প্রায়ই একতরফা কথা বলে।
সকালে খাওয়ার পর বিছানায় বসে আঙুল দিয়ে বিছানার চাদরের ওপর আঁকিবুকি কাটছিল চন্দন। ও ভাবছিল রাজাকে বাঁচিয়ে তোলার কথা। মাকে বাঁচানো যায়নি কারণ মাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজার বেলায় তো তা করা হয়নি — ওর শরীরটা তো আছে। আর ও মারা গেছে মোটে দু দিন আগে। একটা ডাক্তার চাই যে ওকে ওষুধ লাগিয়ে বাঁচিয়ে তুলবে। সেনকাকাকে দিয়ে কিছু হবে না। ও লোকটা খালি চন্দনকে ওষুধ দেয় — রাজার জন্যে কিছু করবে না। রামুকে পাঠাতে হবে একটা ডাক্তার খুঁজে আনতে। না পারলে ও শালাকে আর এঘরে ঢুকতে দেবে না চন্দন —
ঘরের দরজায় লোকজন দেখা দিল। রামুদা, সঙ্গে একটা অচেনা মেয়েমানুষ। একটু পেছন থেকে উঁকিঝুকি দিচ্ছিল রমা। ও অবশ্য চন্দনকে ভীষণই ভয় পায় — কখনই এ ঘরে পা দেয় না। কিন্তু আজ চন্দনের সঙ্গে সন্ধ্যার প্রথম মুলাকাতটা কিরকম হবে সেটা দেখার তীব্র কৌতূহল ও সামলাতে পারে নি। রামু আর সন্ধ্যা ঘরে ঢুকে এল — রমা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইল — বেগতিক দেখলেই পালাবে।
বিছানার দিকে আঙুল দেখিয়ে সন্ধ্যা চন্দনকে বলল, ঠাণ্ডা হয়ে ওখানে বোস। তারপর আমি যা জিজ্ঞেস করব তার জবাব দাও।
চন্দন দুহাতে নিজের দু গাল চেপে ধরে হাবার মত দাঁড়িয়েছিল। ও চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসল। তারপর সন্ধ্যাকে বলল, তুমি আমাকে কি জিজ্ঞেস করবে? তুমি কি ডাক্তার?
সন্ধ্যা হেসে ফেলল। বলব, না। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করব। তুমি তার জবাব দেবে। আর জবাব না দিলে — চোখ পাকিয়ে আবার চড় দেখাল সন্ধ্যা। চন্দন কুঁকড়ে গেল — আত্মরক্ষার ভঙ্গীতে দু হাত তুলে মাথাটা একটু পেছনে সরিয়ে রাখল — সন্ধ্যার চড় যাতে ওর গালে না পড়ে। হেসে ফেলল সন্ধ্যা। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বোস। আর যা প্রশ্ন করব তার জবাব দাও।
আসলে সন্ধ্যা চাইছিল চন্দনকে দিয়ে কথা বলাতে— যাতে ও সন্ধ্যার সঙ্গে সহজভাবে ব্যবহার করতে পারে। সন্ধ্যা ওর নাম, ওর বাবা মার নাম এসব ওর থেকে জেনে নিল — ওর ছেড়ে আসা স্কুল সম্পর্কে নানা কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল — চাকরদের মধ্যে কে কে শয়তান আর কেন শয়তান তা জেনে নিল। সন্ধ্যা নিজেও কথা বলছিল, চন্দনের কথায় নানা টিপ্পনি কাটছিল — মাঝে মাঝে অবাক হবার ভান করছিল — কখনো কখনো আবার খুশির ভাব দেখিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। সন্ধ্যা খেয়াল করে দেখছিল যে এর মধ্যেই চন্দন নিজের আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে— খেয়ালখুশি মত কথা বলে যাচ্ছে— যদিও সে সব কথার অনেকটাই সঙ্গতিহীন— যা থেকে ওর মানসিক ভারসাম্যের অভাবটা বোঝা যাচ্ছিল। রামু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে সব কথাবার্তা শুনছিল। ও যদিও চন্দনকে চড় মারার জন্যে সন্ধ্যার ওপর রেগে ছিল মনে মনে এই নতুন আসা মেয়েছেলেটার কিছুটা তারিফও করছিল। দাদাবাবুকে দিয়ে এত কথা বলাতে পেরেছে — বাপরে বাপ।
আরও লোক ঘরে ঢুকল। রান্নার লোক হরি চুলদাড়ি কাটার নাপিত ডেকে এনেছে। পরামানিকটি এ বাড়ির খুব কাছেই খোলা ফুটপাথের ওপর তার ব্যবসা চালায় — এ বাড়ির চাকর বাকররা ওকে খুব ভালই চেনে। সে হরির দেশের লোক। সেই খাতিরে আর হরির অনেক তোষামদে সে এখানে আসতে রাজী হয়েছে। নয়তো এ বাড়ির দাদাবাবুর চুলদাড়ি কাটতে সে কিছুতেই আসত না — একবার চন্দনের হাতে মার খাবার অভিজ্ঞতা আছে ওর। হরি আর নাপিতটির পেছনে রমাও ঘরে ঢুকেছিল। ওদের দেখেই চন্দনের চোখের চাউনি উগ্র হয়ে উঠল — খাট থেকে নেমে পড়বে এরকম একটা ভঙ্গী করল।
একটা কড়া ধমক দিল সন্ধ্যা। চন্দন দেখল মেয়েমানুষটা ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে — ডান হাতটায় একটা চড়ও তুলেছে। সঙ্গে সঙ্গে চন্দনের মনে পড়ে গেল ওর দু গালের জ্বলুনি — থাপ্পড়ের চোটে মাথার ভেতরটা ঝনঝন করে ওঠা। ওর উগ্রতা প্রশমিত হল, ও নাপিতের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিনমিন করে সন্ধ্যাকে বলল, ঐ লোকটা আমার চুল দাড়ি কেটে ফেলবে।
হ্যাঁ কাটবে— বলল সন্ধ্যা। কাটলে তোমরা অনেক ভাল লাগবে।
ভাল লাগবে? ঠিক জানো?
হ্যাঁ, ঠিক জানি। এবার শান্ত ছেলে হয়ে মেঝেয় বোস তো।
সন্ধ্যা গম্ভীর ভাবে ওর মাথার চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিল, পাবে পাবে। ওরা আবার গজাবে। কেঁদো না।
চন্দন আশ্বস্ত হল, কিন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, সত্যি তো? ঠিক পাব তো আবার?
হ্যাঁ পাবে, চিন্তা কোরো না— সন্ধ্যা বলল। এবার ভাল করে স্নান করবে চল। তোমার গায়ে জায়গায় জায়গায় ময়লা জমে আছে।
আমার খুব শীত করবে যে — আবার চন্দনের কান্না কান্না ভাবটা ফিরে এল।
কোন ভয় নেই। আমি বাথটবে ঠাণ্ডার সঙ্গে গরম জল মিশিয়ে দেব, একদম শীত করবে না। আবারও আশ্বাস দিল সন্ধ্যা।
কিন্তু তোমার সামনে সব জামা খুলব কি করে? ঐ রামু শালা তো শাওয়ার খুলে গায়ের জামার ওপরই জল দিয়ে দেয়। সব জামা তো খোলে না।
সন্ধ্যার হাসি পেয়ে গেল। সন্ধ্যা, যে কিনা রোজই পুরুষ মানুষের শরীর দেখে থাকে, তাকে একটি ছেলে আজ লজ্জা পাচ্ছে — ব্যপারটা বড় মজার। কিন্তু হাসি চেপে স্বাভাবিক মুখ করে রইল সন্ধ্যা। বলল, আচ্ছা, এখন যে হাফ প্যান্টটা পরে আছে সেটা থাকবে। আর ওটা ভিজে গেলে পাল্টাবার সময় তোয়ালে জড়িয়ে নেবে।
চন্দন খানিকক্ষণ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ওর মনে হল এই ব্যবস্থাটা তো ভাল। ও খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
ততক্ষণে রামু সব পরিষ্কার করে ফের এই ঘরে এসেছে। সন্ধ্যা ওকে বলল চন্দনের শুকনো জামা কাপড়া স্নান ঘরের লাগোয়া জামা পাল্টানোর জন্যে ছোট ঘরের দেরাজে সাজিয়ে রাখতে। তারপর সন্ধ্যা প্রথমে চন্দনের দাঁত ভাল করে মেজে মুখ ধুইয়ে দিল। চন্দন মাঝে মাঝে ছটফট করছিল বলে বাঁহাতে ওর ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল। চন্দনের মুখ ধোয়া হয়ে গেলে আবার চোখ পাকাল, কড়া গলায় বলল, এখন থেকে রোজ নিজে দাঁত মেজে মুখ ধোবে, আর না করলে — চড় দেখাল সন্ধ্যা।
চন্দন কুঁকুড়ে গেল, দু হাত ওপরে তুলে মুখ ঢাকল চড় আটকাবার জন্যে। সন্ধ্যা হেসে ফেলল — আহা, পাগলটা একেবারে বাচ্চা ছেলের মত।
চন্দনকে স্নান করাল সন্ধ্যা। চুল কেটেছে বলে মাথায় শ্যাম্পু দিল — গায়ের যে সব জায়গায় হাল্কা ময়লার পরত জমেছিল সে সব জায়গা ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে যতটা হয় পরিষ্কার করল। চন্দন অবশ্য তাতে মাঝে মাঝেই উঃ, আঃ, ওঁক, আঁক — এসব আওয়াজ করছিল। সন্ধ্যা চন্দনের সারা গা মাথা মুছিয়ে দিল — ওকে রামুর বের করে দেওয়া পরিষ্কার শুকনো জামা পরাল — চুল ভাল করে আঁচড়ে দিল। তারপর সন্ধ্যা তার জ্যান্ত পুতুলটিকে ভাল করে দেখল। দেখে মনে হয় কৈশোর এখনও কাটে নি। হাত বাড়িয়ে চন্দনের দুগাল টিপে দিল সন্ধ্যা। ওর এবার খেয়াল হল যে চন্দনকে স্নান করাতে গিয়ে ওর পরণের শাড়িও খানিকটা ভিজেছে। কিন্তু তা নিয়ে আর মাথা ঘামাল না সন্ধ্যা। ওটুকু ভিজে গায়েই শুকিয়ে যাবে। বেল বাজিয়ে রামুকে ডাকল সন্ধ্যা।
রামু এলে সন্ধ্যা ওকে বলল ওদের দুজনের খাবার নিয়ে আসতে। রামুর সন্ধ্যার এই কতৃত্বটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। ও তেতো মন নিয়ে খাবার আনতে গেল — রান্নাঘরে খাবার বেড়ে নিতে নিতে পাচক হরির কাছে গজর গজর করল। হরি অবশ্য শুনে মনে মনে খুব মজা পেল — মেয়েমানুষটা রামুর মাথায় উঠে নাচছে— খুব হোক রামুর। অবশ্য রামু যখন খাবারটা নিয়ে এল তখন একেবারে চুপচাপ ছিল কারণ ও বুঝেছিল যতদিন এই মেয়েমানুষটা এ বাড়িতে থাকবে ততদিন ওর হুকুম মেনে চলতেই হবে। সন্ধ্যা রামুকে বলল, আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসনগুলো নিয়ে যেও। আধঘন্টা পরে এসো। ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমাদের জন্যে চা আর জলখাবার নিয়ে আসবে। আর শোন, দরজা খুলে দুম করে ঢুকে আসবে না। দরজায় ঠক ঠক করবে। আমি ভেতরে আসতে বললে তবে ঢুকবে।
চন্দন কিছুটা ভয় আর অনেকটা কৌতূহল মেশানো অবাক চোখে সন্ধ্যাকে দেখে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা ওকে চালানোর সব ভার কিভাবে নিয়ে নিয়েছে তা ভেবে অবাকও হয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা ওকে জিজ্ঞেস করল, কি খাবে — লুচি আলুর দম?
চন্দন ঘাড় কাৎ করে সায় দিল। তখন সন্ধ্যা মাথা নেড়ে রামুকে ঘর ছেড়ে চলে যাবার ইঙ্গিত করল। রামু ঘর থেকে বেরোল — ওর পেছনে ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপরেই আবার দরজা খুলে সন্ধ্যা মুখ বাড়িয়ে রামুকে ডাকল। বলল, আর একটা কথা, একটা ছুতোর ডেকে এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার ব্যবস্থা কর। আজই কর। পারলে এখনই। তারপর ঘরের দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
সূর্যশেখর দিনের বেলা একবার যান অফিসবাড়িটাতে — দিনটা কাটে নীলমাধবের, তার লোকজনের থেকে জমিদারির খবর আর টাকা পয়সার হিসেব নিতে। বিভিন্ন জায়গার থেকে ট্রাঙ্ক টেলিফোনে খবরও আসে। ডাকে চিঠি, কাগজপত্র আসে। দরকারি কাগজপত্র তিনি নিজেই দেখে থাকেন। তারপর আবার বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর বাড়ি থেকে বেরোন সন্ধে পার করে। সেদিন সূর্যশেখরকে সন্ধের আগেই ধরে ফেলল রামু। বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সন্ধ্যার চন্দনকে চড় মারার গল্পটা করল। ও আশা করেছিল সূর্যশেখর বোমার মত ফেটে পড়বেন — মেয়েছেলেটাকে গুমখুন যদি নাও করা হয়, নিদেনপক্ষে বাড়ি থেকে পত্রপাঠ বার করে দেওয়া হবে। সূর্যশেখর বসার ঘরে সোফায় বসে শুনছিলেন — সেখানে বসেই রামুর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দামী বিলিতি সিগারেট লাইটার জ্বেলে ধরালেন। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে — ব্যাপারটা জানা রইল। তুই এখন তোর কাজে যা।
সূর্যশেখর বাড়ি থেকে বেরোলেন। সদর দরজার বাইরে গাড়িবারান্দার নিচে তার গাড়ি অপেক্ষা করছিল। রাস্তার লাল কাঁকর মাড়িয়ে দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়ি। রামু নিজের কাজে ফিরে গেল। ফিরতে ফিরতে ও নিজের মনে বিড়বিড় করে বকছিল। আজকের দিনটা অন্যরকম — একেবারে অন্যরকম।