ফাল্গুন শেষ হয়ে চৈত্র মাস শুরু হতেই কলকাতায় গরম পড়তে আরম্ভ হয়েছে। রায়চৌধুরীদের বাড়িটার পেছনের বাগানটা এখন গাছগুলোর থেকে ঝরে পড়া পাতায় ভর্তি। হারাধন দুহাতে দুটো ঝাড়ু নিয়ে পাতাগুলো ঝেঁটিয়ে সাফ করছিল। হারাধনের বয়েস হয়েছে — ষাট তো পার হয়েইছে। ওর পরনে একটা নোংরা হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট, মাথার চুল সব সাদা — গায়ের রঙ নিকষ কালো বলে তা আরও সাদা দেখায়। হারাধন এবাড়ির কর্তা সূর্যশেখর রায়চৌধুরীর দক্ষিণের জমিদারি থেকে আমদানি। ও ছোটবেলায় দেশ থেকে এবাড়িতে চলে এসেছিল। তখন বাড়ির মালির ফাইফরমাস খাটত। সে লোক বুড়ো হয়ে দেশে চলে যাওয়ার পর থেকে হারাধনই এই বাগানের মালি।
বাড়িটা বিরাট বড়। দেউড়ি দিয়ে ঢুকলেই বোঝা যায় যে এটা কোন অত্যন্ত ধনী লোক সাহেবি কায়দায় বানিয়ে নিয়েছে। এটা বানিয়েছিলেন সূর্যশেখরের বাবা — সে প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখন সবে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে — রমরমিয়ে ব্রিটিশ শাসন চলছে। জমিদার সাহেব উত্তর কলকাতার বনেদী পাড়াতেই বাড়ি করা পছন্দ করেছিলেন। তখন তো উত্তর কলকাতাই ছিল আসল শহর — বাকি যা ছিল তার তো আর সেই আভিজাত্য ছিল না। বাড়ির দেউড়িতে উঁচু লোহার গেট — সেখান থেকে লালচে নুড়ি-বিছানো রাস্তা মূল বাড়িতে ঢোকার দরজা হয়ে পেছনে বাগানের ভেতর দিয়ে গিয়ে বাড়িটাকে পাক খেয়ে আবার দেউড়িতে এসে মিশেছে। এই সদর দরজায় গাড়ি বারান্দা — সেখানে একটা অস্টিন গাড়ি দাঁড়ানো। অর্থাৎ এই সকাল বেলাতেই বাড়িতে কোন বিশিষ্ট অতিথি এসেছে। এই দরজার দারোয়ান তার গোঁফ চোমরাচ্ছে আর ঐ গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে খেজুরে আলাপ করছে। কারণ ড্রাইভারটি তার চেনা এবং তারা একই ভাষাভাষী। গাড়িটার মালিক অনিরুদ্ধ সেন সূর্যশেখরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাছাড়া অনিরুদ্ধ সেন একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ ডাক্তার — লোকে তাকে এক ডাকে চেনে।
দোতলায় সূর্যশেখরের স্টাডিরুমটা বাড়ির পেছনে বাগানের দিকটায়। সেঘরে চালু থাকা এসির আওয়াজে হারাধন বুঝল সাহেব বন্ধুকে নিয়ে ঐ ঘরে বসেছেন। ঘরটায় সূর্যশেখরের কয়েকজন বিশ্বস্ত চাকর ছাড়া কেউ ঢুকতে পায় না। এঘরে মালিকের অনেক দরকারি কাগজপত্র আয়রন সেফে রাখা আছে - তার চাবি আবার থাকে এই ঘরেই রাখা কম্বিনেশন লক দেয়া লোহার আলমারিতে। কিন্তু অনিরুদ্ধ সেনের কথা আলাদা - উনি এলে গৃহস্বামী তাকে নিয়ে এঘরেই বসেন - সাবেক বসার ঘরে নয়। দুই বন্ধু মুখোমুখি বসেছিলেন - দুজনের মাঝখানে আয়তক্ষেত্রাকার গ্লাসটপ সেন্টারটেবিল - তার ওপর দামি চিনেমাটির কাপে সুগন্ধী চা এবং প্লেটে প্রচুর পরিমাণে কেক-পেস্ট্রি। দুজনেই চা-টুকু খেয়েছেন - আর এক-আধ টুকরো পেস্ট্রিতে ঠোকর মেরেছেন। বড়লোকের বাড়ির ভৃত্যবর্গ এসব সময়ে ইচ্ছে করে কেক টেক বেশি করে দিয়ে থাকে। কারণ কর্তারা উঠে গেলে পরে যখন টেবিল সাফ করা হবে এই সব পড়ে থাকা কেক বা পেস্ট্রি তারাই খাবে।
আলোচনাটা হচ্ছিল চন্দনকে নিয়ে। চন্দন সূর্যশেখরের ছেলে - তার একমাত্র সন্তান। বছর কুড়ি বয়েস - ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছে। আজ পাঁচ ছ বছর হয়ে গেল - মানসিক রোগে ভুগছে। জীবনের সব কিছুতেই সূর্যশেখর অত্যন্ত সৌভাগ্যবান - এই একটি বিষয় ছাড়া। স্ত্রীর মৃত্যু তাকে কষ্ট দিয়েছিল ঠিকই - কিন্তু তা ছিল সাময়িক। সূর্যশেখরের জন্যে সমাজে ভোগ্যা নারীর অভাব নেই - তিনি আবার ডুব দিয়েছিলেন স্ত্রীর মৃত্যুর আগে তার যে ভোগের জীবন ছিল সেই জীবনে। কিন্তু এই একটা ব্যাপার তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে চলেছে। তার বিপুল টাকা, বিষয়সম্পত্তি, সমাজে প্রতিষ্ঠা - কোন কিছুই চন্দনের এই অসুখের জন্যে চিন্তাটা একেবারে তাড়াতে পারছে না। রায়চৌধুরীদের জমিদারি আর বিষয়সম্পত্তি গত একশ বছর ধরে বেড়ে চলেছে - শুরু হয়েছিল সেই ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে। চন্দন সূর্যশেখরের একমাত্র উত্তরাধিকারী - তার মৃত্যুর পর চন্দনের কি হবে - এই বিশাল সম্পত্তির কি হাল দাঁড়াবে - সেটা তিনি ভেবে উঠতে পারেন না - সেজন্যে ভাবতেও চান না। বন্ধু অনিরুদ্ধ যদিও নিজে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নন, তবুও তিনি চন্দনের যথাসাধ্য চিকিৎসা করেছেন - তাছাড়া কলকাতার অনেক বড় ডাক্তারও চন্দনকে দেখেছেন। চন্দনের অবস্থার উন্নতি হয় নি। সূর্যশেখরের এক আত্মীয়া এক নামকরা তান্ত্রিক জ্যোতিষীকে দিয়ে একটা যজ্ঞ করাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি নাকি সেই জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে তাঁর সমস্যার অভাবনীয় সমাধান পেয়েছিলেন। একটু কৌতূহলী হয়েই সূর্যশেখর শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছিলেন। দেখাই যাক্ — ব্রহ্মদৈত্য পৈতা গলে কিরকম ইকড়ি-মিকড়ি মন্ত্র বলে। সূর্যশেখর প্রচুর সাহিত্য পড়েছেন - বাংলা এবং ইংরেজি দুইই। অনেক সময়েই সেই সময়ের অবস্থার সঙ্গে প্রযোজ্য কোন গল্প-কবিতার লাইন তার মনে পড়ে যায়। যজ্ঞ করার সময় সেই জ্যোতিষী সে-ঘরের ছাদটা কালো ধোঁয়ার ছোপে ভরিয়ে দিয়েছিল - দেয়ালে সিঁদূর দিয়ে বড় বড় স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল - আর আগুন জ্বেলেছিল বলে মার্বেলের মেঝের জায়গায় জায়গায় পুড়ে গিয়েছিল। যজ্ঞের খরচ নিয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা, আর তার নিজস্ব দক্ষিণা আরও পাঁচ। ঘরটা মেরামত করিয়ে আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে সূর্যশেখর খরচা করেছিলেন আরও দশ। তবে চন্দনের অবস্থার কোন হেরফের হয় নি - না ভাল, না খারাপ।
সূর্যশেখর একটু ঝুঁকে পড়লেন অনিরুদ্ধর দিকে। বললেন, ধরো, ওকে যদি চিকিৎসার জন্যে বিলেত নিয়ে যাই? তাহলে কেমন হয়?
অনিরুদ্ধ একটু হাসলেন। বললেন, দ্যাখো ভাই, এ অসুখের ভাল চিকিৎসা এখনো পৃথিবীর কোথাও বেরোয় নি। বিলেতে গেলেই যদি এই অসুখ সারত তাহলে ও দেশে আর কোন মানসিক রোগী থাকত না। তবে তোমার অঢেল টাকা - এত টাকা যে বিলেতের সব রকম চিকিৎসা তুমি পয়সা দিয়ে কিনতে পারো। তবে বন্ধু হিসেবে আমি তোমাকে চন্দনকে বিলেতে নিয়ে যাবার উপদেশ দেব না। আমার মতে তাতে খুব একটা কাজ হবে না।
সূর্যশেখর একটু অপ্রতিভ হাসি হাসলেন। বন্ধু তাকে তার টাকার পরিমাণ নিয়ে একটা খোঁচা মেরেছে - সেটা তিনি হজম করলেন। অনিরুদ্ধ তার সঙ্গে এজাতীয় ঠাট্টা করতেই পারে। অবশ্যি ও নিজেও ধনীর ছেলে - যদিও সূর্যশেখরের তুলনায় ওদের আর্থিক অবস্থা কিছুই নয়। দুজনে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে দার্জিলিং-এ সাহেবি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন - বলতে গেলে তারা লঙোটিয়া দোস্ত। সূর্যশেখর হাসিমুখেই বললেন, কথাটা বাড়িয়ে বললে। অত টাকা আমার নেই সেটা তুমি ভালই জান। যাই হোক, তাহলে চিকিৎসার উপায়টা কি? একটা রাস্তা তো দেখাও। আমি তো চিরকাল ছেলেটাকে এভাবে থেকে যেতে দিতে পারি না।
অনিরুদ্ধ বন্ধুর চোখে চোখে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, একটা চিন্তাভাবনা আমার মাথায় আছে। তবে জানি না সেই আইডিয়াটা তোমার পছন্দ হবে কিনা, বা সেভাবে কাজ করে কোন ফল হবে কি না।
আচ্ছা, কথাটা তো আগে শুনি - সূর্যশেখর বললেন। তারপর তো মতামত দেবার প্রশ্ন আসবে।
চন্দনকে যদি মেয়েমানুষের সঙ্গে দেওয়া যায় - মানে বিয়ের মতো একটা ব্যাপার - থেমে থেমে বললেন অনিরুদ্ধ। তাহলে চন্দনের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে। তারপর তাড়াতাড়ি বললেন, তবে একটা কথা - ওর কোন ভরসা নেই। আর আমিও একথা ডাক্তার হিসেবে বলছি না। বলতে পারো এটা একেবারেই আমার নিজস্ব ধারণা - এরকম একটা পরীক্ষা করলে কিছু কাজ হবে কিনা।
সূর্যশেখর মুখ ওপরে তুলে ঘরের ছাদের দিকে তাকালেন। সচরাচর তার কোন সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষ দেরী হয় না। বললেন, পরীক্ষা করে দেখতে দোষ নেই। এতে চন্দনের অবস্থা যা আছে তার থেকে খারাপ কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু কি করে সেটা করা যাবে? চন্দনের এখন যা অবস্থা তাতে ওর বিয়ে দেয়া যাবে না। আর ধরো বিয়ে দিলামই, আর ওর অবস্থার কোন উন্নতি হল না। তাহলে তো একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা আমি করতে পারব না। এ ছাড়া উপায় কি বলো।
অনিরুদ্ধ আবারও একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ধরো যদি টাকা দিয়ে কোন পেশাদার মেয়েমানুষকে আনা যায়। অবশ্য এরা সচরাচর যেরকম অমার্জিত হয় সেরকম হলে চলবে না। একটু ভদ্র ঘর থেকে এসেছে - কথাবার্তা একটু ভদ্র - সেরকম দরকার। আর যদি অল্প স্বল্প লেখাপড়াও জানে তাহলে আরও ভাল হয়। চন্দনকে টানা সঙ্গ দিতে হবে তো।
সূর্যশেখর হো হো করে উঠলেন। বললেন, অর্থাৎ তুমি বলছ সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো। ঠিক আছে - একটা চেষ্টা করে দেখা যাক। এতে কাজ না হলে তখন আবার চিন্তা করা যাবে কি করা যেতে পারে।
অনিরুদ্ধও হাসলেন। মনে মনে বন্ধুর বিভিন্ন গল্প-কবিতা থেকে লাগসই উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলবার ক্ষমতাকে তারিফ করলেন। মুখে বললেন, বেশ বলেছ - সেই সাপ জ্যান্ত নিয়ে আসতে হবে। দেখো খোঁজ করে, যদি পাওয়া যায়।
অনিরুদ্ধ হাতের ঘড়ি দেখলেন এবং আঁৎকে উঠলেন। সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, সর্বনাশ, সাড়ে দশটা বেজে গেছে। চেম্বারে পেশেন্টরা হয়তো এতক্ষণে রিসেপশনিস্ট-এর ওপর চেঁচামেচি করছে। এখন চলি ভাই - পরে আবার আসব।
সূর্যশেখর বন্ধুর সঙ্গে নিচে এলেন - নিজের হাতে তার গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। এতখানি ভদ্রতা তিনি সকলের সঙ্গে করেন না। কিন্তু অনিরুদ্ধর কথা আলাদা। তাছাড়া ওর সঙ্গে সম্পর্কটা তো খালি ভদ্রতার নয় - বেশিটা অন্তরঙ্গতার। বাড়ির হাতার ভেতরের নুড়ি কড়মড় কচমচ করে মাড়িয়ে অনিরুদ্ধর গাড়ি দেউড়িতে দারোয়ানের খুলে ধরা গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল - দেউড়ির দারোয়ান ডাক্তার সাহেবকে একটা বড় গোছের স্যালুট দিলে।
স্টাডিতে ফিরে এলেন সূর্যশেখর। তিনি কোন কাজে দেরী করবার লোক নন। তার এখানকার ম্যানেজার নীলমাধব এ-বাড়িতেই থাকে - তাকে ডেকে পাঠালেন। নীলমাধব কর্তার তলব পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটতে ছুটতে ঘরে এল। তাকে কাজটা ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন সূর্যশেখর। শোরগোল না করে চুপচাপ কাজটা ভালভাবে সারতে হবে। না পারলে নীলমাধবের চাকরি তো যাবেই - আরও অনেক বিপদও হতে পারে। নীলমাধব মুখ নিচু করে মেঝের দিকে চোখ রেখে কাজটা কি তা শুনল। মনিবের চোখে চোখ রেখে তাকালে মনিবকে অসম্মান দেখানো হয়। তারপর মেঝের দিকে চোখ রেখেই বলল, আজ্ঞে কর্তা, আপনার হুকুম তামিল হবে। আমাকে শুধু কয়েকটা দিন সময় দিন।
সাত দিন সময় দিলাম - সূর্যশেখর বললেন। তারমধ্যে কাজ হওয়া চাই।
তারপর একটা টাকার তোড়া সামনের টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিলেন। সেটার দিকে তর্জনি দেখিয়ে নীলমাধবকে বললেন, ওটা নিয়ে যাও। এদিক ওদিক খরচা মেটাবার জন্যে দিলাম। আসল কাজের জন্যে যে টাকা সেটা আমি পরে দেব।
নীলমাধব হেঁট মাথা আরও নিচে ঝুঁকিয়ে জোড় হাত কপালে ঠেকাল। তারপর টাকাটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
|| ২ ||
একথা মানতেই হবে যে নীলমাধব সূর্যশেখরের একজন অত্যন্ত দক্ষ কর্মচারী এবং মালিকের হুকুম পেলে সে সাপের মুখের সামনে দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার মাথার মণি নিয়ে আসতে পারে। সূর্যশেখরের আদেশ পাওয়ার পরে পরেই সে চলে গিয়েছিল পেশাদার মেয়েছেলেদের খাস পাড়ায়। এই পল্লীর সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল - কম বয়সে সে এপাড়ায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে যাতায়াত করেছে। সে তার চেনাজানা বাড়িউলিদের কাছে গিয়ে উপযুক্ত একটি মেয়ের খোঁজ করেছিল। সব বাড়িউলি মাসিই টাকার অঙ্কটা শুনে উৎসাহিত হয়ে তাকে কোন না কোন মেয়ের খোঁজ দিয়েছে - তার কারণ তার বাড়ির কোন একটা মেয়েকে জমিদারবাড়ির ম্যানেজার যদি মনোনীত করে তাহলে মাসি যে বকশিসটা পাবে সেটাও একটা বড় মাপের টাকা। কিন্তু নীলমাধব জানত যে কোন একটা আজে বাজে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে কর্তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তার চাকরিটা সে দিনই চলে যাবে। শেষ পর্যন্ত ওপাড়ার একজন দালাল তাকে আরতিমাসির বাড়ির খোঁজ দেয়। সেখানে নাকি কয়েকটা ভাল গোছের মেয়ে আছে। নীলমাধব আরতির সঙ্গে দেখা করে যে মেয়েটি মনোনীত হবার যোগ্য তার সম্ভাব্য গুণাবলির ফিরিস্তি দেয়। শুনেই আরতি তার প্রকাণ্ড মোটা শরীর নিয়ে লাফিয়ে ওঠে — নীলমাধবকে জানায় যে সন্ধ্যা নামে তার বাড়ির একটি মেয়ে এই কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত, আর এই খবরটুকু দেবার জন্যে নীলমাধবের থেকে একমুঠো টাকা আগাম হিসেবে নিয়ে নেয়। তারপর সন্ধ্যা কিছু লেখাপড়াও শিখেছে সেটাও নীলমাধবকে জানিয়ে দিয়ে সন্ধ্যাকে ডেকে পাঠায়। সন্ধ্যার চেহারা আর তার হাবভাব দেখে নীলমাধব তাকে কোনরকম জিজ্ঞাসাবাদ করে নি। এ-মেয়েই চলবে একথা আরতিকে জানিয়ে দিয়ে সে তাড়াতাড়ি বিদায় হয়। আর যাওয়ার আগে বলে দিয়ে যায় যে পরের দিন সকালে সন্ধ্যাকে রায়চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
অতএব সন্ধ্যা পরের দিন সকালে সূর্যশেখরের বাড়ি এল এবং তাকে দোতলার একটা ঘরে বসানো হল। সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন সূর্যশেখর এবং অনিরুদ্ধ। পতিতা মেয়েটিকে দিয়ে এতবড় একটা কাজ করাতে হবে - তাকে তো একটু বাজিয়ে দেখে নেওয়া দরকার। সন্ধ্যাও এটা বুঝেই এসেছিল যে বাড়ির কর্তার পক্ষ থেকে তাকে কিছু জোর করা হবে - একেবারে সোজাসুজি কাজটা দেওয়া হবে না। তবে সে তো আর নিজের থেকে কোন কথা বলবে না। কাজেই খুব নির্বিকার উদাসীনভাবে সন্ধ্যা বাড়ির কর্তাদের প্রশ্নের অপেক্ষায় রইল।
সন্ধ্যা কোন উত্তর দিল না। স্থির চোখে চেয়ে রইল সূর্যশেখরের দিকে।
সূর্যশেখর একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। আসলে তার এই মন্তব্যের পিছনে কোন ভাবনাচিন্তা ছিল না। সেটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত - অনেকদিন ধরে একটু একটু করে তৈরী হওয়া একটা অভিমতের আকস্মিক প্রকাশ। সূর্যশেখর সীমান্তের ওপার থেকে আসা মানুষগুলোকে দু চোখে দেখতে পারেন না। এই কলকাতা শহরটা আগে কত ছিমছাম, সুন্দর, অভিজাত একটা শহর ছিল। এটা নষ্ট হতে শুরু করেছে পূবের থেকে আসা মানুষের পালের জন্যে। নোংরা লোকে ভরে যাচ্ছে শহরটা - উত্তর আর দক্ষিণের শহরতলিগুলোয় যেখানে সেখানে ঘর তুলে থাকতে শুরু করেছে তারা। চুরি ডাকাতি এসব ক্রমে বাড়ছে। সন্ধের পর পথে ঘাটে অল্পবয়েসী মেয়েদের দেখা যাচ্ছে - নানা অঙ্গভঙ্গী করে খদ্দের ডাকছে তারা। এই পঙ্গপালের দল ক্রমে সংখ্যায় বাড়ছে - একটা বেড়ে চলা ঘায়ের মত। এদের মধ্যে আবার কিছু কিছু লোক সব মারাত্মক ধ্যানধারণা সাধারণ লোকের মাথায় ঢোকাতে শুরু করেছে। এই তো বছরখানেক আগেকার কথা। পূবদেশী এক ছোকরা সূর্যশেখরের দক্ষিণের জমিদারিতে বাসা বেঁধে প্রজাদের কানে নানারকম উটকো কথা তুলছিল। জমিতে প্রজাদের অধিকার, সাম্যবাদ - আরও কি সব। ঘটনাটা দশ বছর আগে হলে সূর্যশেখর হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই ঝাড়ার মত টুসকি দিয়ে ব্যাপারটাকে খতম করে দিতেন। তেভাগার ঝামেলার সময় একটা প্রজা সকলের সঙ্গে ওসব তেভাগা টেভাগা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল। ডাকাত পড়েছিল ওর ঘরে - ওকে কেটে ফেলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ওর বৌ আর মেয়েকে ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিল। অবশ্যি খালি ওই প্রজাটার ঘরেই ডাকাত পড়লে লোকের মনে কোন সন্দেহ আসতে পারত। সেজন্যে আশপাশের আরও কয়েকটা ঘরে ডাকাতি করেছিল ওরা। লুঠ করার পর ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল - ঘরের মরদটাকেও কেটে রেখে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে ছিল দেশী বন্দুক - সেজন্যে গ্রামের লোক ওদের পেছনে তাড়া করতে সাহস করে নি। ওরা নিজেদের মধ্যে হিন্দুস্থানিতে কথা বলছিল বলে শোনা গিয়েছিল, আর সেজন্যে গ্রামের লোকজনের মত পুলিশও ওদের ভেবেছিল ভিন্ন প্রদেশের লোক। কিছুদিন পরে এই ডাকাতির কেসটা চুপচাপ বন্ধ হয়ে যায়। নীলমাধব বিভিন্ন লোকের কাছে পাঠিয়েছিল মোটা মোটা বন্ধ খাম।
কিন্তু এই ছোকরার ব্যাপারটা ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। ওর বেলায় সূর্যশেখর একটু সাবধান হয়েছিলেন। প্রথমে কথা বলেছিলেন তার এক বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধুটি বিলেতে পাশ করা আইনজ্ঞ। বিরাট পসার। কথা হয়েছিল সন্ধেবেলায়, সূর্যশেখরের বাড়িতে। ব্যবস্থা ছিল বিলিতি হুইস্কির - মুচমুচে করে ভাজা হাড়-ছাড়া মুরগীর বড়া, বেসন দিয়ে ভাজা বেগুনের ফালি, পেঁয়াজের বড়া, বড় সাইজের আস্ত কাঁচা লঙ্কা। বন্ধু বলেছিলেন, দ্যাখো ভাই, আইনকানুন দিয়ে ওসবে কিছু করা মুস্কিল। অন্য কায়দা করতে হবে। তোমরা সাত পুরুষের জমিদার - তোমরা তো ভালই জান কিভাবে কায়দা করা যায়।
ঠিক কথা। বাঁকা রাস্তায় গিয়েছিলেন সূর্যশেখর। যে প্রজার বাড়িতে ছোকরা ভাড়া থাকত তার সোমত্ত কিন্তু বয়েসে নাবালিকা মেয়ে বাপের সঙ্গে পুলিস থানায় গিয়ে নালিশ করলে ছোকরা তার গায়ে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে। সাক্ষীসাবুদও তৈরী ছিল। বেশ কিছুদিন পুলিশ হাজতের লপসি আর ডাণ্ডার গুঁতো খেয়েছিল ছোকরা। এখন ও জামিনে খালাস আছে - কোর্টে ওর নামে ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। উকিলের দরজায় আর পুলিস থানায় ছুটোছুটি করতে করতে জেরবার হয়ে গিয়েছে ছোকরা। সাম্যবাদটাদ সব বন্ধ।
কাজেই ঐ কথাটা উঠে এসেছিল একেবারে সূর্যশেখরের বুকের ভেতর থেকে - ছুটে গিয়েছিল সন্ধ্যার দিকে।
সন্ধ্যা অপলকে তাকিয়েছিল সূর্যশেখরের দিকে। এই দম্ভী, বিপুল অর্থশালী এবং অযৌক্তিকভাবে অশেষ ভাগ্যবান লোকটা কি জানে পূবদেশের ছিন্নমূল লোকেদের কষ্ট - কি তীব্র দুঃখ, দুর্দশা এবং মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে এদেশে এসে পৌঁছবার আগে? সেসব দিনগুলোর বীভৎস স্মৃতি এখন ওর কাছে ঝাপসা। কিন্তু সূর্যশেখরের কথার খোঁচায় তা আবার জ্বলজ্বল করে উঠেছিল - ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে।
কদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল চারপাশে হাওয়া একটু গরম। তবে ওদের শহরটা মোটামুটি শান্ত ছিল - সেজন্যে ওরা যে খুব একটা দুশ্চিন্তায় ছিল তা নয়। ওদের বাড়িটা ছিল শহরের একেবারে একটা ধারে - একটু ছেড়ে ছেড়ে আরও চার পাঁচটা বাড়ি। রাতের খাওয়া সেরে উঠেছিল ওরা। সন্ধ্যা বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে এঁটো বাসনগুলো মাজতে নিয়ে গিয়েছিল। পুকুরপাড়ের দিকেই পায়খানা ঘর - ওর বাবা গিয়েছিল প্রাকৃতিক বেগ সারতে। মা বাড়ির ভেতর কাজে ব্যস্ত ছিল - ভাই লণ্ঠনের আলোয় পড়ার বইগুলো নাড়াচাড়া করছিল। ওরা এসেছিল তখনি - একই সঙ্গে ওদের পাড়ার সবকটা বাড়িতে চড়াও হয়েছিল।
পুকুরপাড়ে কলাগাছের ঝাড় - তার আড়ালে লুকিয়েছিল সন্ধ্যা আর তার বাবা। বাড়ির ভেতরে তখন নারকীয় চীৎকার আর মশালের আলোর ঝলকানি। বাড়ির পেছনের দরজা খোলা দেখে কিছু লোক সেখান দিয়ে দৌড়ে পুকুরপাড়ের দিকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। ওদের হাতে লম্বা লম্বা বাঁশের লাঠি - কলাগাছের ঝাড় আর আশপাশের ঝোপ পিটিয়ে দেখবে কেউ লুকিয়ে আছে কি না। কিন্তু ওরা সে সুযোগ পায় নি। ওদের সামনে হঠাৎই উদয় হয়েছিল একটি প্রাণী। সোজা হয়ে উঠেছে - উদ্যত ফণা - মানুষের কোমর সমান উঁচু। ওরা ওদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে মারতে পারত। কিন্তু সাহস করে নি। দুর্বৃত্তরা যোদ্ধা নয়। প্রতিরোধ দেখলে তারা পিছু হটে। আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল লোকগুলো। খানিকক্ষণ পরে লুঠেরারা চলে গিয়েছিল। সব কটা বাড়ি থেকেই - কারণ তাদের চীৎকার আর শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু তখন বাড়িগুলোতে দেখা যাচ্ছিল আগুনের শিখার ঝলকানি। লুঠ সেরে চলে যাবার সময় ওরা বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার মা আর ভাইএর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। খোঁজ করা সম্ভবও ছিল না। পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দেয়াল ধসে গিয়েছিল - জায়গায় জায়গায় ছাদও ভেঙে পড়েছিল। তাছাড়া সন্ধ্যা আর তার বাবার পক্ষে দিনের আলো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা নিরাপদও ছিল না। অন্যান্য আক্রান্ত বাড়িগুলোর চারপাশ থেকেও লুকিয়ে থাকা লোকগুলো বেরিয়ে আসছিল। তখনই ওরা সবাই বেরিয়ে পড়েছিল - গাছগাছড়া ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে লুকিয়ে রওনা হয়েছিল পশ্চিমমুখো। দূরে - অনেক দূরে এক সীমান্ত - তার ওপারে এক দেশ - সেখানে গিয়ে পড়তে পারলেই জানমাল নিরাপদ।
সন্ধ্যা আর তার বাবা ধরেই নিয়েছিল ওর মা আর ভাই বেঁচে নেই - কিন্তু কিভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল সেটা ওদের কল্পনায় আসা সম্ভব ছিল না। ওরা কল্পনা করতে পারছিল না কি করে সন্ধ্যার ভাইকে দু তিনজন মিলে লাঠির ঘা দিল - ছেলেটি মাটিতে পড়ে যেতে আর একজন ওর গলায় বসিয়ে দিল দায়ের কোপ। এটাও ওদের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না যে দুর্বৃত্তরা চলে যাবার সময় ধরাধরি করে নিয়ে গিয়েছিল একটি মাঝবয়েসি স্ত্রীলোকের রক্তমাখা শরীর - রক্তের ছোপ কোথাও একটু ফিকে, বেশিরভাগ জায়গাতেই যথেষ্ট গাঢ়। বাড়ির ভেতর আগুন জ্বলছিল, ভেতরে ঢুকে কোন শরীরের খোঁজ করাও সম্ভব ছিল না। অসহিষ্ণু প্রতিবেশিরা তাগাদা দিচ্ছিল - রওনা হতে দেরী করা নিরাপদ নয় - কোন শোকদুঃখের সময় নেই - আবার লুঠেরাদের একটা দল এসে পড়লে কেউ প্রাণে বাঁচবে না।
কিন্তু সেসব অনেক বছরের পুরনো কথা - সবাই যা প্রায় ভুলেই গেছে। সেদিন সূর্যশেখরের ঐ মন্তব্যের পর সুদৃশ্য সেই ঘরে একটা অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ নেমে এসেছিল। সন্ধ্যাই সেটা ভাঙল। মুখ শান্ত অথচ কঠিন করে স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ। আপনি যেরকম ঘটি আমিও সেরকম বাঙাল।
উত্তরটা সূর্যশেখরের মুখে পড়েছিল চাবুকের মত। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। যত না রেগেছিলেন বিস্মিত হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। একটা রাস্তার মেয়ে, টাকা ফেলে যে কেউ তার সঙ্গে শুতে পারে, সে কিনা তারই বাড়িতে তার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলতে সাহস পায়। এই পায়ের তলার লোকগুলো আজকাল মাথায় উঠতে সাহস করছে। এই বেয়াদপ মেয়েটা কি জানে যে সূর্যশেখরের পূর্বপুরুষের আমলে প্রজারা বিয়ে করার পর জমিদারকে দিয়ে প্রসাদ করিয়ে তবেই সেই নতুন বৌকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারত? এ ঘটনাটা যদি আর দশটা বছর আগেও ঘটত - মেয়েটাকে সোজা করে দেওয়া যেতে পারত। এখনও কি মেয়েটাকে সহবৎ শেখানো একবারেই অসম্ভব? প্রথমেই প্রচুর টাকা দিয়ে ওর বাড়িউলির মুখ বন্ধ করে দেওয়া - লেঠেলদের সর্দার ধনঞ্জয়কে ডেকে পাঠানো - কোন একটা ফিকিরে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বার করে আনা। তারপর গড়ের মাঠের অন্ধকারে একটা লাইনের মেয়ের মারের চোটে অজ্ঞান শরীর - এমনকি মৃতদেহও যদি খুঁজে পাওয়া যায় - কার কি মাথাব্যথা হবে? আর ঝামেলাটা যদি ঘোরালো হয়ে ওঠে তাহলে চারপাশে একটু বেশি করে টাকা ছড়ালেই সব চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু তারপরেই একটা অন্যরকম চিন্তা তার মাথায় আসে। এটা কলকাতা শহর, সূর্যশেখরের খাস তালুক তো নয়। স্থানীয় নেতা এবং জনপ্রতিনিধি পুলিশের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে দোষীদের ধরার জন্যে। আর পুলিশ যদি কোনভাবে ধনুর খোঁজ পেয়ে ওকে ধরে ফেলে তাহলে সূর্যশেখরের নাম সামনে চলে আসতে পারে। দিনকাল বদলেছে - এই শয়তান মানুষগুলোকে শাসন করা শক্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া জমিদারি অবলুপ্তি আইন হবে - এরকম কথাবার্তাও চলছে। সূর্যশেখর একটা ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাস ফেললেন এবং চুপ করে রইলেন।
অনিরুদ্ধ ঠাণ্ডা মাথার লোক। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে এই কথাবার্তা একটা বাঁকা দিকে মোড় নিচ্ছে - তাই হাত বাড়িয়ে পাশে বসা বন্ধুকে চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করলেন। তারপর সন্ধ্যাকে বললেন, শোনো, ওটা নেহাতই কথার কথা। তুমি ও নিয়ে আর ভেবো না।
কথার পিঠেই সন্ধ্যা বলল, আমি কিছুই ভাবছি না। তবে একটা কথা আমার মাথায় এল। যে কাজের জন্যে আমাকে ডাকা হয়েছে তাতে ঘটি বাঙালে কোন তফাত হবে কি?
সূর্যশেখরের মুখের রঙ আর এক পোঁচ লাল হল। আবারও সামলালেন অনিরুদ্ধ। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে মুখের সামনে হাত নেড়ে বললেন, ছেড়ে দাও ও কথা। তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়াও জান। আমরা আসলে লেখাপড়া জানা মেয়েই চাইছি। সে চন্দনের - মানে আমাদের ছেলের যোগ্য সাথী হতে পারবে।
হ্যাঁ, আমি একসময় লেখাপড়া করেছি - আবারও খুব ঠাণ্ডাভাবে বলল সন্ধ্যা। কিন্তু কদ্দুর পড়াশোনা করেছি - কি করে এখানে এসে পড়লাম, দয়া করে এসব প্রশ্ন করবেন না। যদি করেন তাহলে তার কোন জবাব আমি দেব না।
এবার হেসে ফেললেন অনিরুদ্ধ। বললেন, না না, সে-সব কিছু জিজ্ঞেস করব না। তুমি বোসো - আমরা একটু পাশের ঘরে গিয়ে কথা বলে নিই। সূর্য, একবার এঘরে এসো ভাই।
সূর্যশেখরের হাত ধরে তাকে সোফা থেকে তুললেন অনিরুদ্ধ। তারপর তাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন।
সন্ধ্যা বসে রইল। ওর মুখোমুখি সামনের দেয়ালে ছাদের কাছে একটা বড় দেয়াল ঘড়ি - তার লম্বা দোলক টিকটিক আওয়াজ করে দুলছে। এখন সকালবেলা - দশটা বেজে বারো মিনিট দেখাচ্ছে ঘড়িটা। সন্ধ্যা নিজের হাতঘড়িটা দেখল - সেটা দুমিনিট বেশি দেখাচ্ছে। একটি যুবতী ঘরে ঢুকল - বোধহয় এ বাড়িতে কাজ করে। সন্ধ্যার সামনের কাচ-মোড়া সেন্টারটেবিলটায় এককাপ চা আর একটা প্লেটে বড় একটুকরো কেক রাখল। মেয়েটি খুব কৌতূহলের চোখে সন্ধ্যাকে নজর করে দেখছিল। কারণ সন্ধ্যা তাদেরই একজন যারা সূর্য ডুবলেই সাজগোজ করে এসে তাদের ঘরবাড়ির দরজায় দাঁড়ায়, সামনে রাস্তা দিয়ে কোন পুরুষমানুষ গেলেই তাকে ডাকাডাকি করে, আর সেই ডাকে সে সাড়া না দিলে গালাগাল দিয়ে তার চোদ্দগুষ্টির ভূত ভাগায়। সেরকম একজন মেয়েমানুষ এই বনেদী জমিদারবাড়ির বসার ঘরে আরামদায়ক সোফায় বসে আছে আর তাকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে দামী দার্জিলিং চা দিয়ে সেটা এই মেয়েটির মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। সন্ধ্যা তা বুঝতে পেরে মনে মনে হাসছিল অন্য কোন সময় হলে হয়তো ও মেয়েটিকে ডেকে কথাবার্তা বলত। কিন্তু এখন সন্ধ্যা এখানে এসেছে একটা পুরোপুরি ব্যবসার কাজে। চারদিকে একটা গুরুগম্ভীর আবহাওয়া আর ভেতরে একটা ঘরে দুই উন্নাসিক ধনী প্রৌঢ় কি সব গুজগুজ করছে - খুব সম্ভবতঃ সন্ধ্যাকে কাজটা দেয়া উচিত হবে কিনা তা আলোচনা করছে। সন্ধ্যা ওই মেয়েটির সঙ্গে এটা-সেটা অদরকারি আলাপ করে এ ঘরের থমথমে গাম্ভীর্যটা হাল্কা করতে চাইছিল না। সে চুপচাপ চায়ের কাপ তুলে নিয়ে সেই ধোঁয়াওঠা তরলে একটা ছোট চুমুক দিল। সুগন্ধি উষ্ণতায় তার ঠোঁট এবং জিভ ভিজে গেল। তখন কাজের মেয়েটি বুঝল যে সন্ধ্যার সঙ্গে কথাবার্তা চালু করার কোন সম্ভাবনা নেই। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একা বসে থেকে ঘটি বাঙাল প্রসঙ্গটা সন্ধ্যার মনে এল - আর আবার মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা।
ওদের ছোট্ট দলটা রাস্তায় আরও দু চারজন করে লোক পেতে পেতে বেশ একটা বড় দল হয়ে গিয়েছিল। ওরা সবাই তখন পার হচ্ছিল লম্বা এক দুঃখের পথ। দলটার প্রতিটি মানুষ তার নিজের দুঃখের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথ হাঁটছিল। কিন্তু তাদের আশা - পথের শেষে রয়েছে শান্তি - নিরাপত্তা। তারা সবাই হারিয়ে এসেছে তাদের কোন না কোন প্রিয়জনকে। কিন্তু এখন আর সেসব ভাবনা নয় - চিন্তা খালি নিরাপদে এই পথ পার হয়ে যাওয়া। অনেক দূরে কে বা কারা মাটির বুক চিরে একটা গভীর দাগ কেটে রেখেছে - সে দাগ পেরোলেই সব কষ্টের শেষ। সারা দিন ধরে মানুষগুলো পথ হাঁটে। মাঝে হয়তো পাঁচ দশ মিনিট একটু চিঁড়ে ভিজিয়ে খেয়ে নেয়া - এক গাল মুড়ি চিবোন। নিজেদের মধ্যে সেসব ভাগ করে নিয়ে খাচ্ছে এই মানুষগুলো। তাতে সন্ধ্যা আর তার বাবার মতো লোকেরা, যারা খালি হাতেই বেরিয়ে পড়েছে - তারাও দুটো খেতে পাচ্ছে। তবে যাদের পুঁটলিতে খাবার রয়েছে তাদেরও স্বার্থবোধ মাথা চাড়া দিচ্ছে। যখন তারা দেখছে তাদের খাবারের পরিমাণ কমে আসছে তখন তারা আর পাশে হেঁটে চলা খালি হাতের লোকটার দিকে চিঁড়ে মুড়ি বাড়িয়ে ধরছে না। প্রাকৃতিক বেগ সারতে কেউ পেছিয়ে গেলে তাকেই আবার জোরে হেঁটে এসে দলকে ধরে নিতে হচ্ছে। দল থামছে না। আশা আর আতঙ্ক একই সঙ্গে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে দলটাকে। চলো, চলো, এগিয়ে চলো। আর কিছুদূর - তারপরই আসবে সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
সুরেন নামের যুবকটি — যে দ্বিতীয় দিনই সন্ধ্যার পাশে চলে এসেছিল, সারাদিন ধরে ওর পাশে পাশে হেঁটেছিল — সেও মারা পড়েছিল একইভাবে। বয়েসের গুণে সুরেন সন্ধ্যার সঙ্গে একটু ভাবসাব করার চেষ্টা করেছিল। সন্ধ্যা ওকে খুব একটা আমল দেয় নি, আবার একেবারে হতাশও করে নি। সন্ধ্যার এই ভেবে একটু মজাই লাগছিল যে একটা পুরুষমানুষ এই অবস্থাতেও মেয়েছেলের জন্যে ছোঁক ছোঁক করছে। সে ছেলেটি মারা যাওয়াতেও ওর বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। সুরেন না হয়ে সাপের কামড় খাওয়া ছেলেটি কোন একজন হরেনও হতে পারত। কে মারা পড়ল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল যে সন্ধ্যা বেঁচে আছে আর সেই নিরাপদ আশ্রয় আরও কাছে এসে গেছে — একদিনের দূরত্ব কমে গেছে। সুরেনের মা ছেলের শরীর বুকে জড়িয়ে ধরে মড়াকান্না জুড়েছিল। ওর বাবা তাড়াতাড়ি স্ত্রীর মুখে হাত চাপা দেয়। চীৎকার চেঁচামেচি শুনে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে গেলে কোন বিপদও হতে পারে। তারপর দলটা আবার চলতে শুরু করলে ওরাও দলের সঙ্গে চলতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কাঁদছিল সুরেনের মা। বাবাটা মাটিতে পড়ে থাকা চিঁড়ে মুড়ির পোঁটলাটা মৃতদেহের পাশ থেকে তুলে নিয়ে আসে। খাবারটা পথে কাজে লাগবে।
তবে মরণ কিন্তু দলটার সঙ্গ ছাড়ে না। ওদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে — উঁকিঝুকি দিয়ে ওদের মুখগুলো দেখে। পছন্দসই কাউকে পাওয়া যায় কিনা। সেরকম কাউকে পাওয়া গেলে তাকে খুব চুপিসাড়ে আলিঙ্গন করে। তার পরে পরে মাথা ঘুরে বসে পড়ে মানুষটা। উঠবার চেষ্টা করে বার কয়েক — তারপর শুয়ে পড়ে পথের ওপর। প্রবল কোন অজানা জ্বর, বা শক্ত উদরাময়। তার চারপাশে এখন একটা পাতলা কিন্তু স্বচ্ছ পরদা যা তার সাথীদের কাছে অদৃশ্য। সেই পর্দার ভেতর দিয়ে সে দেখতে পায় তার চারপাশে দলের লোকজন জড়ো হয়েছে - নিজেদের মধ্যে কি সব দুর্বোধ্য কথা বলছে - একজন ওর মুখে জল দিচ্ছে। তারপর সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। যখন সে আবার চোখ খুলে তাকাতে পারে সে বোঝে যে সে একলা। সাথীরা এগিয়ে গিয়েছে —তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে পেছিয়ে রয়েছে মৃত্যু — সে এই মানুষটার সঙ্গী। সে মানুষটিকে নিয়ে একটু খেলা করছে — বেড়াল ইঁদুর খেলা। একেবারে লোকটাকে মেরে ফেললে বিশেষ মজা নেই। সূর্যের তাপ আর ভেদবমি ওর শরীরের সব জল শুষে নিক - যন্ত্রণায় ওর শরীরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠুক — ও গোঙাতে গোঙাতে এপাশ ওপাশ গড়াক - তারপর সন্ধেবেলা চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলে শেয়ালেরা এসে ওর শরীরে দাঁত বসাক — তবেই তো এই খেলার মজা। কিন্তু যখন অন্ধকার নামছে — মানুষটা খাবি খাচ্ছে - তখন তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সে অনেক দূরে তাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া সাথীদের দেখতে পায়। সে আরও দেখতে পায় তার সাথীদের জন্যে আগামী বহু বছর ধরে কি কি অপেক্ষা করে আছে। শোক, দুঃখ, অপমান, প্রিয়জনবিচ্ছেদ। সে বুঝতে পারে যে তার সঙ্গীরা যে কঠিন এবং দীর্ঘ সময়ের পথ পার হবে সে নিজে অতি দ্রুত সেই পথ পেরিয়ে এসেছে। তখন তার সব কষ্ট হাল্কা হয়ে যায় — সে তার শরীরের ওপর শেয়ালের দাঁতের ধার টের পায় না। সে শান্তিতে চোখ বোজে — আর তার নিঃশ্বাস নেবার দরকার পড়ে না।
তবে একবার থেমে গিয়েছিল এই কাফেলা। দলের মধ্যে একটি অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে ছিল। সে হঠাৎ রাস্তার পাশে শুয়ে পড়ে কাতরাতে থাকে। দলের অন্য মহিলারা ঘটনাটা বুঝে নেয় আর রাস্তার ওপর শোয়া মেয়েটির চারপাশে গোল একটা দেয়াল করে দাঁড়ায়। অতএব তখন দলটাকে থামতে হয়েছিল। কিন্তু সময় চলে যেতে থাকে — মেয়েটি যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে গড়ায় — প্রসব আর হয় না। ডাক্তার তো দূরের কথা, কোন দাই পর্যন্ত দলে ছিল না — থাকার কথাও নয়। দু একজন বয়স্কা মহিলা মেয়েটির পেটে কান পেতে ধুকপুকুনি শোনার চেষ্টা করে — তা শুনতে না পেয়ে বোঝে যে পেটের ভেতরের বাচ্চা মারা গেছে। শেষ পর্যন্ত প্রসব হয় নি। শরীরের ভেতরের তরলের বেরিয়ে যাওয়া আর রক্তপাতের জন্যে মেয়েটিও মারা যায়। দলের কর্তাব্যক্তিরা একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল — এই আকস্মিক ঝামেলার জন্যে কতটা সময় নষ্ট হতে পারে তার হিসেব করতে শুরু করেছিল। মেয়েটি মরে গিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করে দেয় এবং এই মানুষের দল আবার পথ চলা শুরু করে। যেসব মেয়েরা প্রসূতি মেয়েটিকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে সন্ধ্যাও ছিল। সেও হাঁটে। পেছনে রাস্তায় শুয়ে রইল আর একটি মৃত শরীর। সামনে জীবন।
মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল সীমানার এপারে — আশ্রয় পেয়েছিল একটা রেলস্টেশনের গায়ে ঘেঁষা ক্যাম্পে। প্রায় উপোষী সব মানুষ, তাদের সারা গায়ে নোংরা, পরনের জামা ছেঁড়া, পুরুষদের মুখে বড় বড় খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। অনেকের পায়ে জুতো নেই — তাদের পায়ে এখন দাগড়া দাগড়া জখম - পা ফুলে গিয়েছে। সরকারি লোকেরা বড়, মোটা, বাঁধানো খাতায় লিখে নিল তাদের নাম, প্রাক্তন বাসস্থান, কার কে মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে তার বিবরণ। স্নানটানের এমনি কোন ব্যবস্থা নেই — একটু দূরে একটা বড় কিন্তু অত্যন্ত নোংরা আর প্রায় মজে যাওয়া পুকুর - তাতেই যে যা পার কর। অবশ্য তাদের হাতে ধরান হল একটা করে শালপাতার প্লেট, তাতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে বড় হাতার দুহাতা লপসি। সেই খাবার দেখে সন্ধ্যার মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে শেষ খাওয়ার কথা। মা রান্না করেছিল নারকেল দিয়ে মুসুর ডাল ঝুরঝুরে কুচি আলুভাজা আর পোনা মাছের ঝোল। মাছের কাঁটা দিয়ে লাউঘন্টটা রান্না করেছিল সন্ধ্যা। সেজন্যে ভাইটা খেতে বসে চেঁচাচ্ছিল — বলছিল এই অখাদ্য রান্না মুখে তোলা যাবে না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভাই পাতের সবটা লাউ চেঁছেপুছে খেয়েছিল - আরও এক হাতা বাড়তি চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেসব গতজন্মের কথা। পথ হাঁটার সময় ওদের খেয়াল ছিল না ওরা কদিন ধরে হেঁটেছে। মনে হচ্ছিল কত যুগ ধরে - প্রায় জন্মের শুরু থেকে। এই ক্যাম্পে আসার পর একটা হিসেব করে দেখা গিয়েছিল ওরা হেঁটেছিল মোট সাড়ে চারদিন। অবশ্য ওদের জন্যে ক্যাম্প বলতে শোয়া বসার জায়গা ছিল স্টেশনের প্ল্যাটফরম। কারণ ক্যাম্পের যে-কটা সরকারি তাঁবু ছিল তার সব কটাই ওদের আসার অনেক আগের থেকেই ভরা ছিল — সেখানে থিকথিক করছিল মেয়েমদ্দ, তাদের ল্যাণ্ডাবাচ্চা। ক্যাম্পের লপসিটা দেখে সন্ধ্যার ছোটবেলায় ভূগোল পড়া পৃথিবীর বর্ণনা মনে পড়ে গিয়েছিল - তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। সেই লপসিই চেটেপুটে খেয়েছিল ওরা। সন্ধ্যা নিজের আর ওর বাবার শালপাতার থালাদুটো পরিষ্কার করে ধুয়ে যত্ন করে রেখেছিল। কারণ একই লোককে দুবার থালা দেওয়া যায় না। গিনতির সুবিধের জন্যে ব্যবস্থাটা ছিল — একমাথা একথালা।
এখানে সন্ধ্যার দিন দুয়ের বেশি থাকা হয় নি। ক্যাম্পটার চারপাশে নানারকম উটকো লোক ঘোরাঘুরি করছিল। তারা এই উদ্বাস্তুদের ওপর নজর রাখছিল — বিশেষ করে যুবতী মেয়েদের ওপর। সন্ধ্যা ওদের চোখে পড়ে যায়। গায়ের রঙ শ্যামলার দিকে হলেও ঐ দালাল গোছের লোকগুলো নজর করে রেখেছিল ওর ধারালো নাক চোখ মুখ - ভারী বুক এবং নিতম্ব। সন্ধ্যার বাবা কে সেটা খুঁজে বার করতে ওদের অসুবিধে হয় নি। ওরা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা নিতান্ত বৈষয়িক কথাবার্তা বলে। সন্ধ্যার বাবা রামমোহন বসু — সীমানার ওপারে যার পেশা ছিল শিক্ষকতা — সীমান্তের এপারে এসে জীবনকে একটা নতুন আঙ্গিকে দেখতে শুরু করেছিলেন। সেই বিপর্যয়ের রাত, সাড়ে চার দিনের পথচলা, ক্যাম্পের লাপসি এবং রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে শোয়া তার বিচারবুদ্ধি অনেক বদলে দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে একটা তীব্র এবং প্রচণ্ড শক্তি এখন এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করছে - যার বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করা বাতুলতা। সেজন্যে যদিও তিনি তার মেয়ের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন শেষপর্যন্ত তিনি ঐ লোকগুলোর বাস্তববাদী যুক্তি মেনে নেন এবং ওদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। পাঁচশো টাকায় রফা হয় এবং পুরোটাই অগ্রিম হিসেবে পাঁচটা একশো টাকার নোট শ্রী বসুর জামার পকেটে ঢুকে যায়। ওখানে থাকলে লোকজনের নজরে পড়বে বলে তিনি টাকাটা সেখান থেকে বার করে নিজের কোঁচার খুঁটে বেঁধে নেন। সেদিন একটু বেশি রাতে - চারপাশ যখন নিঃঝুম, খালি মাঝে মাঝে একটু জোরালো হাওয়া দিলে সর্ সর্ শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে — তখন রামমোহন বসু স্টেশনের প্ল্যাটফরমে নোংরা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে শুয়ে ঘুমন্ত সন্ধ্যাকে ডেকে জাগান এবং বলেন যে তিনি একটু মূত্রত্যাগ করার জন্যে দূরে ঐ বড় গাছটার আড়ালে যেতে চান। কিন্তু তার জ্বরভাব হয়েছে বলে মাথা ঘুরছে আর পা টলছে - সেজন্যে তিনি সন্ধ্যার হাত ধরে ধরে ওখানে যেতে চান। সন্ধ্যা ধড়মড় করে উঠে পড়ে, শাড়ি ভাল করে গুছিয়ে পরে নেয় আর প্ল্যাটফরমের কাঁকর পার হয়ে লম্বা লম্বা জংলা ঘাসের ভেতর দিয়ে বাবাকে ঐ গাছটার দিকে নিয়ে যেতে যেতে উদ্বিগ্নভাবে তার শরীরের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে থাকে। কিন্তু সেই গাছটার আড়ালে যেতে না যেতেই কারা সব পেছন থেকে ওর মুখ বেঁধে ফেলে আর চ্যাংদোলা করে একটু দূরে পিচ ঢালা বাস লরী চলার সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে লরী দাঁড়িয়েছিল। লোকগুলো ওকে লরীর মধ্যে একটা মালের বস্তার মতো তুলে দেয়। সেখানে আরও লোক তৈরী হয়ে ছিল - তারা সন্ধ্যাকে টেনে তুলে নেয়, লরীর খোলের পাটাতনের ওপর তাকে শুইয়ে ফেলে আর তার দু'হাত আর দু'পা লরীর পাশের ডালায় চারটে কোণে লাগানো আংটার সঙ্গে বেঁধে ফেলে। মুখ আর হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা গুণ চিহ্নের মত হয়ে লরীর পাটাতনের ওপর পড়ে থাকে সন্ধ্যা। এই শারীরিক অচলাবস্থায় শুয়ে শুয়ে সে আন্দাজ করে নিচ্ছিল তার এখন কি অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। সে আরও বুঝে নেয় যে এই ঘটনার সঙ্গে তার বাবারও যোগাযোগ আছে। কারণ তিনি কোন প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নি - লোক জড়ো করার জন্যে কোন চীৎকারও করেন নি। তবে সন্ধ্যা নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল এটা বুঝতে পেরে যে ওর বাবার ওপর ওর রাগ বা বাবার এই ব্যবহারে দুঃখ কোনটাই হচ্ছে না। ও বোঝে যে রূঢ় আর নির্মম বাস্তব ওর মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে অনেকটাই ভোঁতা করে দিয়েছে।
লরীটা মৃদু গর্জনে স্টার্ট নেয় এবং দূর দক্ষিণে কলকাতার দিকে দৌড় মারে। লরীর পেছনে লাগানো লাল বাতিটা যখন অদৃশ্য হয়ে যায় তখন রামমোহন বসু চুপিসাড়ে প্ল্যাটফরমে তার শোয়ার জায়গায় ফিরে আসেন। তখন তিনি একটা অদ্ভুত ধরনের শূন্যতা অনুভব করছিলেন - তার সঙ্গে মিশেছিল পরিবারের শেষ পরিজনকে হারাবার অল্পস্বল্প দুঃখ - বিবেকের দু একটা কমজোরি দংশন। তবে তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু শুয়ে পড়ার আগে তিনি একবার চারপাশে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিয়েছিলেন যে এই অন্ধকারে সবাই ঘুমন্ত, জলজ্যান্ত মেয়েটার অন্তর্ধান কোন লোকেরই নজরে আসে নি।
এইভাবে সন্ধ্যার সঙ্গে তার বাবার যোগসূত্র ছিঁড়ে যায় — সে আর কখনো তার বাবার কোন খবর পায় নি। যে রাতে সন্ধ্যা পাচার হয়ে যায় তার পরের দিনই ক্যাম্পে কলেরা লেগে যায়। শ্রী বসু সকালেই তাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর যেহেতু অসুখের তীব্রতা খুব বেশি ছিল সূর্য মাথার ওপর ওঠবার আগেই তিনি মারা যান। ক্যাম্পের আরও অনেক বাসিন্দাও তাকে সঙ্গ দেয় - অর্থাৎ মারা পড়ে। সেসব মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার কাজে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত তৎপরতা দেখায় এবং খুব তাড়াতাড়িই বেশ কয়েকজন মুদ্দফরাস সেখানে চলে আসে। নিধিরাম নামে একটি ডোম রামমোহন বসুর মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছিল — সরকারি দপ্তরের খাতায় তার নাম ছিল নিধি দাস। মৃতের ধুতির খুঁটের স্ফীততা তার নজরে আসে এবং সে সকলের অগোচরে অসামান্য ক্ষীপ্রতায় সেই খুঁট খুলে নিজের খাকী রঙের সরকারের দেওয়া হাফ প্যান্টের পকেটে সেই টাকা ভরে ফেলে। পরের দিন সকালে সে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে সোজা নিজের গ্রামে চলে যায়। তার বাপ বাস্তুভিটে বাঁধা দিয়ে মহাজনের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়েছিল নিজের মদের খরচা যোগাতে। টাকাটা পেয়ে ওর বাপ নিজের যকৃৎকে মদে ডুবিয়ে দিয়েছিল আর কিছু দিনের মধ্যেই মারা পড়েছিল। নিধি দাস সেই ধার শুধবার জন্যে মহাজনের কাছে চলে যায় আর তখন জানতে পারে যে ঐ টাকা বেড়ে বেড়ে এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দুশো বাষট্টি টাকা চার আনা। তাতে নিধি খুবই অবাক হয়ে গেলে মহাজন একটা লাল রঙের বাঁধানো মোটা এবং ভারী খাতা খুলে তার বাবার নাম লেখা পাতাটা বার করে আর অত্যন্ত জটিল এবং দুরূহ একটা হিসেব তাকে দেখায়। সেই হিসেবের গোলকধাঁধার মধ্যে ঢোকার অর্থহীন চেষ্টা না করে নিধি টাকাটা বার করে দেয় আর জমি-বাড়ির দলিলটা ফেরৎ চায়। মহাজন খুব দুঃখিতভাবে টাকাটা নেয় আর সে পাতাটার ওপর লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখে - ধার শোধ। তারপর ঘরের ভেতরের সিন্দুক খুলে দলিলটা বার করে নিধিকে দেয়। খাতার সে পাতায় লেখে — জমি-বাড়ির দলিল বুঝিয়া পাইলাম। তার নিচে নিধিকে দিয়ে সই করিয়ে নেয়। নিধি সই এর নিচে তারিখটাও লিখে দেয় কারণ এ পর্যন্ত মাস মাইনে নেয়ার সময় সে বরাবর এভাবেই সই করেছে। নিধি চলে যাবার পরে মহাজন স্থানীয় পুলিস চৌকিতে যায় আর চৌকির ভারপ্রাপ্ত জমাদারকে নিধির হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে আসে। জমাদার সাহেব নিধির ঘরে আসে, তার হঠাৎ অর্থশালী হওয়ার রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করে এবং নিধিকে পুলিশ চৌকিতে নিয়ে যেতে চায়। যে দুটো বড় নোট তখনও বেঁচে ছিল তার থেকে একটা নিয়ে নিধি জমাদার সাহেবের হাতে গুঁজে দেয় — তার ঘরে দাওয়াত খাওয়ার আর রাতটা থেকে যাওয়ার অনুরোধ করে। পুলিস কর্মচারীটি খুশি মনে রাজি হয় - পরের দিন সকালে চৌকিতে ফিরে গিয়ে নিধির নামের নালিশটা সম্বন্ধে ছোট একটা রিপোর্ট লিখে কেসটা বন্ধ করে দেয়। তবে পরে জানা যায় যে নিধি দাওয়াতের সঙ্গে পুলিসের লোকটিকে মদ্যপানও করিয়েছিল। আরও জানা যায় যে নিধির বৌ সে রাতটা নিধির বাড়ির একমাত্র ঘরের ভেতরে শুয়েছিল - নিধি ছিল ঘরের বাইরে। নিধি চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামেই থাকতে শুরু করে, মহাজনের ব্যবসা খোলে — সে অঞ্চলের আদি মহাজনের সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকে এবং নিজের ভিটেয় মাঠকোঠা তোলে। নিধি গ্রামে থাকতে শুরু করার ন'মাসের মাথায় তার বৌ একটি সন্তান প্রসব করেছিল। সুন্দর নাদুস নুদুস একটি ছেলে। বৌ তাকে তেল মাখিয়ে স্নান করায় - নিধি বাচ্চার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বুঝে উঠতে পারে না ছেলেটা কিরকম দেখতে - নিধি দাসের মত না পুলিস চৌকির সেই জমাদারের মত।
রাত শেষ হবার আগেই লরী কলকাতায় পৌঁছে যায় - গিয়ে ঢোকে একটা অন্ধকার নোংরা সরু গলিতে। এবার লোকগুলো প্রায় বিবস্ত্রা সন্ধ্যাকে একটা নোংরা দুর্গন্ধ চাদর দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত মুড়ি দেয় — তারপর ধরাধরি করে ওকে নামিয়ে ঢুকিয়ে দেয় রাস্তার পাশের একটা পুরনো বাড়ির খোলা দরজার ভেতর। এই কাজ শেষ হয়ে গেলে লোকগুলো বেরিয়ে আসে আর ঐ বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। লরীটা তার লোকজনদের নিয়ে ঐ গলি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। তার মাল খালাস করা হয়ে গিয়েছে।
দেশে থাকতে সন্ধ্যা ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক এবং আই এ পাশ করেছিল। তারপর বি এ পড়ছিল। কিন্তু এই প্রসঙ্গ এখন একেবারেই গুরুত্বহীন এবং অবান্তর।