সন্ধ্যার সামনের দেয়াল ঘড়িতে এখন দশটা সাড়ে সাতাশ। তবে নিচের দোলকটা যেরকম অবিশ্রাম দুলে চলেছে সেকেণ্ডের কাঁটাটাও সেরকম স্থিরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে — এর মধ্যেই সময়টা দশটা সাতাশ মিনিট উনচল্লিশ সেকেণ্ড হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা এ বাড়ি থেকে ওর বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা মনে মনে তৈরি করতে শুরু করল। ঘোমটাটা ভাল করে মাথায় দিয়ে তবে বেরোতে হবে— নইলে প্রচুর অপ্রীতিকর কৌতূহলের নজর এড়ানো যাবে না। ঢোকার সময়েই সন্ধ্যা নজর করেছিল — বেশ কয়েকজন এ বাড়ির চাকর লোভের চাউনিতে ওকে দেখছে। আর দেখাই তো স্বাভাবিক। বাজারের মেয়েমানুষ — পয়সা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় এমন একটা রসগোল্লা বা পানতুয়া — টপ করে তুলে মুখে দিলেই হল। সন্ধ্যার বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওরা ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে পারে — এমনকি হাত ধরে টানতেও পারে। কারণ সন্ধ্যাকে ওভাবে চলে যেতে দেখলেই তো ওরা বুঝে ফেলবে যে এবাড়িতে এই মেয়েছেলেটার কাজটা হয় নি — সেজন্যে ওকে কোন খাতির দেখাবার দরকার নেই। তাছাড়া পেশাদার মেয়েদের গায়ে হাত দেয়ার সুবিধেও আছে — পুলিশ কেস টেস হয় না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর একটা রিকশার দরকার হবে — পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা তো সম্ভব নয়। রিকশাটা ওকেই ডেকে নিতে হবে — এ বাড়ির কেউ আঙুল তুলেও সাহায্য করবে না। বাড়ি ঢুকলেই মাসি ছুটে আসবে। কি করলি সন্ধ্যা — অতগুলো টাকা ছেড়ে দিলি? হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললি? যত্ত ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান।
তবে সন্ধ্যা নিজে এটা ঠিক করেই এ বাড়িতে এসেছে যে কাজটা যদি ও করে তবে ভাল করেই করবে — ছেলেটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করবে। টাকা যদি ও নেয় তাহলে ও বেইমানি করবে না। সবাই জানে ছেলেটি অপ্রকৃতিস্থ - সোজা কথায় পাগল। ওর দৃষ্টিভঙ্গি তির্যক, সেজন্যে দুনিয়াটা সম্বন্ধে ওর ধারণাও তাই। কিন্তু একনজরে স্বাভাবিক, সেরকম বহুলোকও কি পাগল নয়? কেউ বেশি আর কেউ কম। পাগলামিটা কম এরকম লোকের সংখ্যা বেশি, তাই তাদের পাগল বলা হয় না। কত লোক বিভিন্ন ধান্দায় টাকা রোজগার করে — তারপর নিয়ম বা বেনিয়ম করে খরচা করে মদ আর মেয়েমানুষের পেছনে। তারাও কি এক ধরণের পাগল নয়? সন্ধ্যার যতগুলো বাঁধা খরিদ্দার আছে তাদের মধ্যে গোটা তিনেক ব্যবসা করে দেদার টাকা রোজগার করে। বলা ভাল যে ওরা প্রায় হাওয়ায় ছোবল দিয়ে টাকা ধরে — মুঠোয় ধরা টাকা পকেটে ভরে। টাকার জন্যে ওদের ভালবাসা চাঁদ আর চকোরের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু আবার সন্ধ্যা যখন বন্ধ ঘরের ভেতর খাটো জামাকাপড় পরে বা অনেক সময় কিছুই না পরে ওদের নাচ দেখায় তখন ওরা সামনে বসে মদের গেলাসে চুমুক দেয়, নাচের তালে তালে মাথা দোলায় আর ওদের এত ভালবাসার টাকার নোট সন্ধ্যার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়। সব কটার ঘরে বৌ আছে — একজন আবার নিজের বৌদির দিকেও নজর দিয়ে থাকে। তবু তাদের সন্ধ্যাকে ছাড়া চলে না। সন্ধ্যা মনে মনে হাসে। এমন কি আছে ওর ভেতর? চারটে হাত আর চারটে পা তো নেই। তবু ওরা আসে — সন্ধ্যার শরীরটা ওদের কিছু একটা দুর্লভ আনন্দ দেয়, যদিও তখনও অনেক সময়তেই সন্ধ্যা তার মনটাকে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেয় — দিপালী রান্নাটা ভালই করে, কিন্তু ঝাল একটু কম দেয়— ওকে কয়েকটা বাঙাল রান্না শেখাতে হবে — খাটের ওপর রেজকির সঙ্গে একটা দশ টাকার নোট রেখেছিল— সেটা পাওয়া যাচ্ছে না — নিশ্চয়ই আমার ছেলেটার কাজ — লোকটা এবার গালে দাঁত লাগাচ্ছে —
—বাবুটার মুখে পচা মাছের গন্ধ —একটা বড় মুখ ধোবার ওষুধের বোতল, জল আর একটা বড় গামলা ঘরে রেখে দিলে হয় — ওষুধজল দিয়ে গামলায় মুখ কুলকুচি করে তবে বাবুরা বিছানায় উঠবে — তাতে আবার তারা বিগড়ে না যায় —
ঐ তিনজনের মধ্যেও আবার যে লোকটা সন্ধ্যার কাছে খুব বেশি আসে তার নাম হীরালাল আগরওয়াল। সন্ধ্যা একটু মদ খেয়ে ফেললে আবার নাম মনে রাখতে পারে না — তখন সে লোকটিকে হরিলালবাবু বলে সম্বোধন করে থাকে। হীরালাল স্বনামে এবং বেনামে নানারকম ব্যবসা করে— কর্মচারীদের মাইনে বাকি রাখে আর কিছুদিন পর পর এক একটা ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। সে সব কর্মচারীদের আর মাইনে দেবার দরকার থাকে না। কিছুদিন আগে একটা চিটফাণ্ডের ব্যবসায় বেনামে টাকা খাটিয়েছিল। বহু লোকের জমা টাকা হাতিয়ে নিয়ে ফাণ্ডটি শেষ পর্যন্ত ডুব দেয় — কিন্তু হীরালাল তার মধ্যেই একটা বিরাট টাকা রোজগার করে নেয়। মাসের মধ্যে দশ দিন সে কলকাতার বাইরে বিভিন্ন ধান্দায় ঘোরে। যদ্দিন থাকে তদ্দিন প্রায় রোজই সন্ধ্যার কাছে যায়। হীরালালের বৌ ওর থেকে বছর পনেরোর ছোট —এখনও তাকে যুবতীই বলা যায়। কিন্তু এই বয়সেই স্নেহ পদার্থের বাহুল্যে তার পেট এবং নিতম্বদেশ অস্বাভাবিক রকম স্ফীত। হীরালাল তার গর্ভে একটি মেয়ে উৎপাদন করেছে। বছর সাতের এই বাচ্চা মেয়েটিকে পড়াতে আসে কলেজ পাশ কাঠ বেকার একটি ছোকরা। হীরালালের উদাসীন অনুপস্থিতির ঘাটতি পুরো করতে বৌটি এই ছোকরার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে। ছোকরাটি প্রথমে কিছুটা ভয়ে এবং তারপরে খুব খুশি মনে এই সম্পর্কের অংশীদার হয়েছে। সে এখন ছোট মেয়েটিকে নির্দিষ্ট সময়ের একঘন্টা আগে ছেড়ে দেয়, তাকে পুরনো পড়া পড়তে নির্দেশ দেয় আর এই বেঁচে যাওয়া সময়টা তার মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে কাটায়। চর্বির প্রাচুর্য হীরালালের শরীরেও অত্যন্ত প্রকট — তাই সন্ধ্যার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে সে বড় তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে যায়। যুবতী সন্ধ্যার জোশকে সামাল দেয়া হীরালালের পক্ষে সাধারণতঃ কঠিন হয় —
সে জলদি জলদি নির্জীব হয়ে নেতিয়ে পড়ে। তবে সন্ধ্যার সঙ্গে দ্বৈরথে নিয়মিত এ জাতীয় হার মাঝে মাঝে তার পৌরুষের অভিমানকে জাগিয়ে তোলে। তখন সে পরের দিন সকালে তার চেনা ডাক্তারের কাছে যায় —অনুরোধ করে তার যৌনশক্তিকে অশ্বশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেবার জন্য। ডাক্তার তাকে একটি সুঁই দেয়, তার চেম্বারে শেলফে রাখা বড় বড় কাঁচের বোতলে রাখা মোড়ক থেকে বার করা বিভিন্ন রঙের বড়ি তাকে নিয়মিত খাওয়ার জন্যে বুঝিয়ে দেয় এবং বাজারে সুঁই আর বড়ির যা দাম তার থেকে অনেক বেশি টাকা হীরালালের থেকে নিয়ে নেয়। শেষে পরামর্শ দেয় চর্বি কমিয়ে ফেলতে। বাড়ি ফিরে হীরালাল ঘি দেয়া রুটি খান বিশেক খায় — তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ ঘি দেয়া ডাল, সব্জী এবং এক বড় বাটি মাখন না তোলা গরুর দুধ। তারপর দিনটা কাটায় বিভিন্ন ব্যবসার ধান্দায় — নানা উপায়ে টাকা আদায়তসীল করে। তারপর শেষ বিকেলে রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠার আগেই সে সন্ধ্যার ঘরে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে - কারণ ডাক্তারের দেওয়া সুঁই এর ফলে তার শরীরে ছটফটানি জেগে ওঠে। প্রায়ই এরকম হয় যে সে রাস্তায় একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে তার গন্তব্যস্থানের নাম বলে এবং কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালাদের যা দস্তুর — সওয়ারী যেখানে যেতে চায় সেখানে যেতে প্রথমে অসম্মত হওয়া— ট্যাক্সিওয়ালা না করে দেয়। তারপর সেই দস্তুর অনুসারেই হীরালাল ভাড়ার ওপর অতিরিক্ত পাঁচ টাকা বকশীষ কবুল করে আর তখন চালকটি গাড়ির দরজা বাহনটিতে হীরালালের ঢুকে বসবার জন্যে ভেতর থেকে খুলে ধরে। রেণ্ডীটা হারামি। ওর ঘরে তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকতে না পারলে হয়তো আর কাউকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে। তখন কম করে এক দেড় ঘন্টার ধাক্কা। এমনকি সারা রাতও হতে পারে। এসব ঝামেলা কাটাতে হীরালাল সন্ধ্যাকে মাসির বাড়িতেই বাঁধা মেয়েমানুষ রাখতে চেয়েছিল। সন্ধ্যা রাজী হয়নি। হরিলালবাবু আসবে যাবে, টাকা ফেলবে — তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না।
সন্ধ্যার কাছে আর একটি বিচিত্র লোক আসে। পদস্থ সরকারি কর্মচারী — নীলাব্জ না নীলাম্বুজ, কি যেন একটা ব্যানার্জী। তার চাকরিতে মাইনে ছাড়াও প্রচুর রোজগার আছে। সেই উপরি রোজগারের বেশীর ভাগটাই সে সন্ধ্যার পেছনে খর্চা করে। লোকটি এলে সন্ধ্যা প্রথমেই তাকে দু পেগ লালপানি খাইয়ে দেয়। তখনও সে খাটের ওপর পা তুলে জুৎ করে বসে পড়ে আর তার মুখের আগল খুলে যায়। সে যে কত বড় একজন বুঝদার, বুদ্ধিমান এবং ওজনদার লোক তা অনবরত সন্ধ্যাকে শোনাতে এবং বোঝাতে থাকে। আমি এই বললাম — আমি ফাইলে এই নোট দিলাম — অমুক ব্যাপারে কেউ কিছু করতে পারছিল না, আমি এই করে দিলাম। রাজপুরুষটির এসব বলা, ফাইলে নোট দেওয়া এবং ঐ অমুক কাজ করাতেই দেশের আর দশের অভাবনীয় উপকার হয়ে থাকে। সন্ধ্যা এই উচ্চপদস্থ রাজপুরুষটিকে অপ্রকৃতিস্থ বলেই মনে করে। চন্দনের বাঁকা এবং মোচড়ানো দৃষ্টিভঙ্গি কোন একদিন সোজা হয়ে যেতেও পারে — কিন্তু এই লোকটি তো সারবে না। ক্ষ্যাপার পরশ পাথর খোঁজার মত সে তার আমিত্বের সার্থকতা খুঁজে বেড়াচ্ছে — সে কি তা পাবে কখনও?
তবে সন্ধ্যা এটা বুঝে নিয়েছে যে এই লোকগুলো কোন না কোন বাজারি মেয়েমানুষের পেছনে টাকা খরচা করতই। সন্ধ্যা না থাকলে তারা কোন চাঁপার কাছে যেত — তাকে পাওয়া না গেলে কোন দীপ্তি বা মিনতি। পৃথিবীতে টাকা জিনিষটা একটা প্রহেলিকা— সে তার নিজের ইচ্ছেয় এক হাত থেকে আর হাতে যায় — তার আমদানির বিভিন্ন রাস্তা যেরকম বিচিত্র, রপ্তানির সব রাস্তাও তাই।
কাজেই এ সব লোকগুলোর সন্ধ্যার জন্যে এই পাগলামি আর তার পেছনে টাকা ঢেলে দেওয়া দুনিয়ার একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। সব পুরুষমানুষেরই যদি একেবারে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী হয় তাহলে সন্ধ্যা টাকা রোজগার করবে কি করে — সে ভবিষ্যতে মাসীর থেকে এ বাড়িটা কিনবেই বা কি করে? অবশ্য সে পরের কথা আর অনেকগুলো টাকারও প্রশ্ন। আচম্বিতে সন্ধ্যার মনে হয় আশার মেয়েটা সোমত্ত হয়ে লাইনে নামলে ও হয়তো সন্ধ্যার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে — সন্ধ্যার রোজগারে ভাঁটা পড়বে। সে সময় আসার আগেই আখের গুছিয়ে নেওয়া দরকার। তখন সন্ধ্যা ওকে কষে জাপ্টে ধরা বাবুর দিকে একটু বিশেষ নজর দেয় — ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে। বাবু ওর হাতে দেয় আরও কতগুলো নোট — দিয়ে কৃতার্থ হয়ে যায়।
তবে সন্ধ্যার আর একটি প্রেমিক আছে যার সঙ্গে টাকার সম্পর্কটা তত জোরালো নয়। পল্টু। বাইশ তেইশ বছর বয়েস। বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বলে ও হচ্ছে সন্ধ্যার বাছুর প্রেমিক — এখনও ষাঁড় হয়নি। সন্ধ্যা ওকে একটু আস্কারা দেয়। ওর থেকে অনেক সময়েই টাকাপয়সা নেয় না — নিলেও অনেক কম নেয়। কারণ অন্যান্যদের থেকে সন্ধ্যা যা টাকা নিয়ে থাকে তা দেবার সাধ্য পল্টুর নেই। ও গরীব রিফিউজী ঘরের ছেলে — বাড়িতে খাওয়ার লোক অনেক। ও ট্যাক্সি চালায় — চালিয়ে যা রোজগার করে তার প্রায় সবটাই বাড়িতে দিতে হয়। বাকিটা যায় সন্ধ্যার পায়ে। পূববাংলার রেফিউজী ছেলে বলেই বোধহয় সন্ধ্যা ওকে একটু লাই দেয়। তবে ওই পর্যন্তই — হৃদয়ঘটিত কোন কিছু নেই — সেটা পল্টুও খুব ভালই জানে। বলতে গেলে ও সন্ধ্যার একটা খেলনা — তবে জ্যান্ত।
সন্ধ্যার সঙ্গে পল্টুর যোগাযোগ হয়েছিল অনেকটা আকস্মিকভাবে। এমন নয় যে পল্টু এ পাড়ায় এসেছিল মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করার জন্যে। ও একটা মাতাল সওয়ারিকে এই গলিতে নিয়ে এসেছিল- নামিয়েছিল এ বাড়ির কাছেই। মাতালটা গাড়ি থেকে নেমে অত্যন্ত দিলদরিয়া হয়ে যায় আর পল্টুকে ভাড়ার ওপরও একগাদা টাকা বকশীষ দেয়। ততক্ষণে ওই মাতালের চেনা একজন দালাল সেখানে এসে পড়ে আর তাকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। ফোকটে একগাদা টাকা পেয়ে পল্টু ঠিক করেছিল যে এক্ষুনি ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবে না — কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ও এখান থেকেই ফিরে যাওয়ার কোন সওয়ারি পেয়ে যাবে। আর সেও যদি মাতাল হয় তবে তো পোয়া বারো। আবার কিছু মোটা বকশীষ পাওয়া যাবে। কিন্তু গলিটা সরু। গাড়িটা রাখার জন্যে একটু চওড়া জায়গার দরকার যেখানে রাখলে অন্য একটা গাড়ি বা রিকশা ওর গাড়িকে ঘষে না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। একটু আগে পিছে করে সেরকম একটা জায়গা দেখে গাড়িটাকে রেখেছিল পল্টু। গাড়ির সব কটা দরজার কাঁচ তুলে দিয়ে গাড়ি চাবি বন্ধ করে এদিক ওদিক হেঁটে দেখছিল। ততক্ষণে গলিতে, বাড়িগুলোতে, দুপাশের পানসিগারেটের দোকানগুলোতে আলো জ্বলে গিয়েছে। একটা পানের দোকানে রেডিওতে ফিল্মি গান বাজছে — রেডিওটা পুরনো বলে মাঝে মাঝে কড় কড় ঘষ ঘষ করে আওয়াজ হচ্ছে। একটা হিন্দুস্থানি ফেরিওয়ালা একপাশে মাংসের ঘুগনি বিক্রী করছে — এর মধ্যেই ওর সামনে কয়েকজন খদ্দেরও দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনেই একটা বড় খাবারের দোকান — সেখানে একটা প্রকাণ্ড ডেকচিতে রান্না করা মাংস, তাতে প্রচুর তেল ভাসছে, লঙ্কার ঝালে লাল। একটা বড় উনুনের ওপর আগুনের তাতে সার সার শিকে গাঁথা কাবাব ঝলসাচ্ছে। একটা লোক খালি গায়ে দর দর করে ঘামছে আর একটা উনুনের ওপর রুমালি রোটি বানাচ্ছে। আর একজন মোগলাই পরটার জন্যে মাখা ময়দার ওপর ডিমের খোলা ভেঙে ভেতরের তরল অংশটা ঢেলে দিচ্ছে — তার মধ্যে কয়েকটা পচা ডিমও মিশিয়ে দিচ্ছে — সঙ্গে প্রচুর কুচিয়ে কাটা পেঁয়াজ আর সবুজ ঝাল লঙ্কা। ভুর ভুর করছে ঝাল তেলে রান্না আমিষের সুগন্ধ। চারপাশের দরজায় দরজায় রং মাখা সাজগোজ করা মেয়েদের ভীড়, ওপরের জানালাগুলোতেও গাদা গাদা মুখ। পল্টুর মুখোমুখি বাড়িটার দোতলায় রাস্তার সামনে একটা লম্বা টানা বারান্দা — সে বারান্দায় চার-পাঁচটা মেয়ে। পুরনো রংচটা রেলিংয়ের ওপর দুহাতে শরীরের ভার রেখে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। রং চং মাখে নি, চারপাশের মেয়েগুলোর মত খাঁদা ভোঁদা নয় — বেশ ধারালো, চোখে লাগার মত ঝকঝকে একটা শ্যামলা রঙের মুখ। কয়েক সেকেণ্ড দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখটা জিভ বার করে পল্টুকে একটা ভেংচি কাটল। কারণ সন্ধ্যা তখন মদ্যপান করে একটু ফুরফুরে মেজাজে ছিল।
খুব মজা পেয়ে একগাল হেসে ফেলে পল্টু। সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখটা সরে গেল, আর তার পরেপরেই একটা বলিষ্ঠ, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার লোক এসে পল্টুকে বলল, আপনাকে দিদিমণি ডাকছে। পল্টু একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল —মেয়েমানুষটা ওপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্যাঁদানি খাওয়াবে না তো? কিন্তু তারপরেই আবার ঐ মুখটা ওর মনে এল — বেশ বার বার ঘুরে ফিরে দেখার মত একটা মুখ। যাওয়াই যাক ওপরে — যা থাকে কপালে। মিঠাইলালের পেছনে পেছনে ও যখন বাড়ির দরজায় মেয়েদের জটলার ভেতর দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল তখন দরজায় দাঁড়ানো মেয়েগুলো হাসছিল — ওকে ডাকছিল। মিঠাই সবাইকে ধমক দিয়ে বলল, এই চুপ কর্ সব। সন্ধ্যা দিদিমণি ওকে ডেকেছে। কিন্তু তাতে আবার একটা হাসির হর্রা উঠল, আর একটা মেয়ে রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ওরে — সন্ধ্যা আজ একটা কচি পাঁঠার মুড়ো চিবোবে।
মিঠাই মেয়েদের কথায় কান না দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। পেছনে পল্টু। ও এ সব জায়গায় কোন বাড়িতে আগে ঢোকে নি। ওর স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজ করছিল না — দু কানে গরম বোধ হচ্ছিল। সন্ধ্যা দাঁড়িয়েছিল নিজের ঘরের দরজায়। পল্টু ওর কাছে পৌঁছে গেলে মিঠাই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যদি আবার ওর দরকার পড়ে— যদি দিদিমণি লোকটাকে ধরে পেটাবার হুকুম দেয়? বলা তো যায় না।
পল্টু কাছ থেকে সন্ধ্যাকে দেখছিল। সুন্দর চোখদুটো — এখন নেশায় সামান্য লাল। এই মেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। ওর চাউনিতে, ঠোঁটের গড়নে, গালের ছোট্ট একটা টোলে অন্যরকম কিছু একটা আছে। সন্ধ্যা পল্টুর মুগ্ধ ভাব দেখে মিটমিট করে একটা শয়তানির হাসি হাসল। তারপর বলল, ওরকম ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন? শুবি আমার সঙ্গে?
পল্টুর কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কিন্তু ও বুঝল মেয়েটার ওকে মার খাওয়াবার ইচ্ছে নেই। সাহস করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দিল — মুখে কোন আওয়াজ করতে পারল না।
খিলখিল করে হেসে লুটোপুটি খেল সন্ধ্যা। শালি ভালরকম মাতাল হয়েছে — পল্টু ভাবল। তারপরই শুনতে পেল সন্ধ্যা বলছে — ঠিক আছে। কিন্তু তোর আগে দুজনকে সময় দেয়া আছে। মিঠাইর সঙ্গে যা। ও তোকে বসাবে — তোর পালা এলে ডেকে আনবে।
একটু থেমে সন্ধ্যা আবার বলল, তুই তো একেবারে বাচ্চা — আগে মেয়েছেলের সঙ্গে শুয়েছিস কখনো?
পল্টু এখনও কথা বলতে পারছিল না। আবার মাথা নাড়ল। এবার না বলবার জন্যে।
যাঃ বাবা — সন্ধ্যা মাথায় হাত দিল। তোকে তো হাতে খড়ি দিয়ে অ আ ক খ শেখাতে হবে। আমার একগাদা সময় বরবাদ হবে। যাকগে— যা, মিঠাইর সঙ্গে— গিয়ে বোস।
আরতি মাসি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। সন্ধ্যাটার কথাবার্তাই ওরকম। খদ্দের থাকবে কি চলে যাবে তার পরোয়া করে না। এবার নিজে এগিয়ে এল, পল্টুকে বলল, তা ভাই — ওর দরটা একটু বেশী। পঞ্চাশ টাকা লাগবে। আছে তো সঙ্গে?
অত টাকা পল্টুর কাছে ছিল না। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে, মাতাল সওয়ারিটার কাছ থেকে পাওয়া বকশীষ ধরে ওর আজকের মোট রোজগার কোনমতেই বারো চোদ্দ টাকার বেশি হবে না। কাজেই ও কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই দেখে আবার হেসে উঠল সন্ধ্যা। বলল, মাসি, এখনও ওর ভাল করে দাড়ি গজায় নি। ওর হাপ টিকিট — পঁচিশ টাকা। তাও না থাকলে দশ টাকাই সই। ওর আমাকে বড় পছন্দ হয়েছে — উপোষ করে ঘরে ফিরতে হলে ও রাস্তায় আত্মহত্যা করবে — আমার পাপ লাগবে।
ততক্ষণে লম্বা বারান্দাটার অন্য কোণে হীরালালের মেদবহুল শরীরটা দেখা দিয়েছে। পরণের ধুতি একহাতে হাঁটুর ওপর তুলে ধরে সে দ্রুত হেঁটে এসে সন্ধ্যার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এস এস হরিলালবাবু, ভেতরে এস — বলে সন্ধ্যা তার ধুতির কোঁচা ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। পল্টু দেখল ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেল। মিঠাইলালের এগিয়ে দেওয়া একটা কাঠের নড়বড়ে চেয়ারে বসল পল্টু। আর খানিকক্ষণ পরেই সে সন্ধ্যার প্রেমিকদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে গেল।
সূর্যশেখরের বাড়ি আসার আগে সন্ধ্যা ওর বাবুদের অন্যান্য মেয়েদের হেফাজতে বেঁটে দিয়ে এসেছে। অফিস কাছারিতে কেউ ছুটিতে গেলে তার কাজ যেরকম কোন সহকর্মীকে দেওয়া হয় — তবে এখানে কাজটা একজনের বদলে কয়েকজনকে দেওয়া হয়েছে। পল্টু পড়েছে আশার ভাগে। সন্ধ্যা বেশ কিছুদিন এখানে থাকবে না শুনে ওর মুখটা একটু ব্যাজার হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিল, একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস মাইরি। ঐ কালো মোষটার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া বেশীদিন পোষাবে না। আশা কাছেই ছিল। পল্টুর কথাটা ও শুনতে পায়। ও পল্টুর একটা কান জোরে চেপে ধরে ওর গালে একটা ওজনদার চড় বসায়। তারপর ওর হাত ধরে ওকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। পেছনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ছিল সন্ধ্যা। শেষ পর্যন্ত আরতি মাসি এসে ওকে একটা ধমক দিল, চুপ কর মাগি। হাসছে তো হাসছেই। পাগল হয়ে গেলি নাকি?
সন্ধ্যা হাসি থামিয়ে আরতিকে জড়িয়ে ধরল। বলল — এ্যা:, মাসি, তুমি বড্ড মোটা। দু হাতের বেড় দিয়েও ধরা যায় না। বলে মাসির মাংসল গালে চপাৎ করে একটা চুমু খেল।
|| ৫ ||
দশটা উনত্রিশ। সন্ধ্যা ঝুঁকে পড়ে নিচু হল ওর টিনের বাক্সটা তুলে নেবে বলে। সেটা আর করা হল না। সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন গৃহকর্তা আর তার বন্ধু। এসে বসলেন সন্ধ্যার মুখোমুখি —উল্টোদিকের সোফাতে। সূর্যশেখরের মুখ গম্ভীর, থমথম করছে, ফর্সা রং লাল হয়ে আছে। অনিরুদ্ধ স্বাভাবিক — এই এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা হল তার কোন ছাপ তার মুখে নেই।
সূর্যশেখর সন্ধ্যাকে খারিজ করে দিতে চেয়েছিলেন। অসভ্য একটা মেয়ে, কোন সহবৎ জ্ঞান নেই— তাকে আর এক মুহূর্তও বাড়িতে রাখতে রাজী ছিলেন না সূর্যশেখর। অনিরুদ্ধ প্রথমে তাকে শান্ত করেছেন। মাথা গরম করলে কোন লাভ হবে না। তারপর একটু একটু করে বুঝিয়েছেন। মেয়েটার প্রায় সারাক্ষণই চন্দনকে সঙ্গ দিতে হবে — সেজন্যে লেখাপড়া জানা ওরকম মেয়েই তো ভাল। একটা যেমন তেমন মেয়ে ধরে আনলে তাকে চন্দনের ভাল না লাগতে পারে — ও আরও ক্ষেপে উঠতে পারে। তাহলে তো মুস্কিল। এ মেয়েটাকে দেখে চন্দনের ক্ষেপে যাওয়ার সম্ভাবনা কম — কারণ এর কথাবার্তায়, চেহারায় একটু ভদ্র পরিবারের ছাপ আছে। আর কদিনের বা ব্যাপার? মাসখানেকের মধ্যে চন্দনের অবস্থার কোন উন্নতি হলেও মেয়েটা ফেরৎ যাবে - না হলেও তাই। সেজন্যে দেখাই যাক না এ মেয়েটাকে দিয়ে চেষ্টা করে। তারপর ভগবানের হাত। শেষ পর্যন্ত সূর্যশেখর রাজী হয়েছেন, কিন্তু মনের প্রবল আপত্তিটা এখন পর্যন্ত হজম করে উঠতে পারেন নি।
ওদের দেখে নিজের বাক্স ছেড়ে দিয়ে আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসল সন্ধ্যা। মুখে একটু ছোট্ট হাসি মেখে অনিরুদ্ধকে বলল, কি, আমার চাকরি হল, না বাড়ি চলে যাব? ও সূর্যশেখরের দিকে তাকাচ্ছিল না। দুই বন্ধু ঘরে ঢোকার সময়তেই ও এক নজরে সূর্যশেখরকে দেখে নিয়েছে — তার মনের ভাব বুঝে নিয়েছে। তবে সূর্যশেখর সুপুরুষ আর তার একটা জোরালো ব্যক্তিত্ব আছে — এটা সন্ধ্যা মনে মনে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু এই তারিফটা নেহাতই নির্বিকার এবং যান্ত্রিক — তা সন্ধ্যার মনে কোন ছাপ ফেলতে পারে নি। বহুপুরুষ ধরে অন্য লোকের সম্পদ লুঠে এরা বড়লোক — সেই লুঠে আনা সম্পদই এই লোকটির চেহারায়, ব্যক্তিত্বে একটা বিশেষত্ব দিয়েছে — সেটাও সন্ধ্যার কাছে পরিষ্কার।
অনিরুদ্ধ একটু অমায়িক হাসলেন। সন্ধ্যার প্রশ্নের সোজা জবাব না দিয়ে বললেন, তোমার কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। আর সে পরীক্ষার ফল পাওয়া পর্যন্ত তুমি এই বাড়িতেই থাকবে। তোমার জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
ডাক্তারি পরীক্ষা? সে কিরকম? কিন্তু সন্ধ্যা মুখে কিছু বলল না — খালি নিজের ভুরু দুটো সামান্য ওপরে তুলে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইল। ও বুঝে নিয়েছে যে যা কিছু কথা বলার ভার তা এই ভদ্রলোকই নিয়েছে — গৃহকর্তা হলেও সূর্যশেখর আপাততঃ মৌনিবাবা। অনিরুদ্ধ ব্যাপারটা খানিকটা খোলসা করলেন — এই তোমার রক্ত, থুতু এসব পরীক্ষা করতে হবে। তারপর একটু আমতা আমতা করে বললেন, চামড়াতেও কোন রোগ আছে কিনা দেখতে হবে।
অনিরুদ্ধ যা বললেন না তা সন্ধ্যা বুঝে নিল। এই পরীক্ষাগুলো কিসের জন্যে তা ওর জানা আছে। এটুকু সাবধানতা এ বাড়ির লোকদের নিতেই হবে — তার জন্যে তাদের কোন দোষ দেওয়া যায় না। সন্ধ্যা যে জীবিকায় রয়েছে তাতে তার কিছু বিশেষ রোগ থাকার সম্ভাবনা ভালই আছে। রক্তে কোন কুৎসিত রোগের জীবাণু আছে কি? ফুসফুসে কি লুকিয়ে আছে যক্ষা রোগ? সূর্যশেখর একটা প্রকাণ্ড মোটা টাকা সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন সেটা পেতে গেলে সন্ধ্যার তো এসব পরীক্ষায় পাশ করা খুবই জরুরী। অনেকটা সরকারি চাকরির মত। লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করার পর ডাক্তার শেষ কথা বলে দেবে — ঐ চাকরিটা করার জন্যে আবেদনকারী শারীরিক আর মানসিকভাবে সুস্থ কিনা।
কাজেই এটা তো স্বাভাবিক যে সন্ধ্যাকে কাজটা দেবার আগে এ বাড়ির লোক একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে নেবে যে সন্ধ্যা পুরোপুরি নীরোগ। কারণ অনেক সময় বাবুরা ওর পাড়ার মেয়েদের টাকার সঙ্গে উপরি বকশীষ হিসেবে কোন রোগও দান করে দিয়ে যান — সেটা টের পাওয়া যায় কিছুদিন পরে। এই কিছুদিন আগে সন্ধ্যার একটা শুকনো কাশির ভাব হচ্ছিল — ও মিঠাইকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল পাড়ার ডাক্তারের কাছে। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে — এ পাড়ার ভেতরেই চেম্বার — বিরাট পশার। তখন বেলা দেড়টা —ডাক্তারের ঘরে গিজ গিজ করছে ভিড়। ঘরটা খুব বড় — ওখানে রোগীরা বসে থাকে— ডাক্তার সকলের সামনেই রোগীকে পরীক্ষা করে থাকেন— রাখ ঢাকের কোন বালাই নেই। ডাক্তারের সামনে একটি যুবতী বসা— এ পাড়ারই মেয়ে। গলায় টাই পরা, গরমে ঘেমে যাওয়া, চকচকে কালো চামড়ার মোটা ব্যাগ কোলে নিয়ে বসে থাকা কয়েকজন চটপটে চেহারার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভও ঘরে বসে আছে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবে বলে। ডাক্তার বিরক্ত মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আরও বিরক্ত গলায় বললেন, ভিড়টা তো দেখতে পাচ্ছেন? আজ আপনারা যান— পরে একদিন আসবেন। ছেলেগুলো ওঠে না— ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধিদীপ্ত হাসি দেয়। অনেকক্ষণ ধরে তারা বসে আছে— ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলে চলে গেলে এই সময়টা বরবাদ হবে। ডাক্তার দেখলেন তাদের ওঠবার কোন লক্ষণ নেই। তখন তিনি ঐ ছেলেগুলোর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন— সামনে বসা রোগিণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জামাটা খোল্।
ঘরভর্তি লোক —মেয়েটি ইতস্ততঃ করছিল। ডাক্তার তার দিকে ঝুঁকে পড়ে পটপট করে ওর জামার বোতামগুলো খুলে ওর ভেতরের অন্তর্বাস নিচে নামিয়ে দিলেন—আদুর গা হয়ে গেল মেয়েটি। শ্যামলা মেয়েটার মুখ এখন ঘোর বেগুনি। ডাক্তার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন না—ওর বুকের ছাতি, গলা, এসব ভাল করে দেখছিলেন। তারপর ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, প্রেসক্রিপশনের প্যাডটা নিজের সামনে টেনে নিলেন, চশমাটা নাকের ডগায় নেমে এল। মেয়েটি তাড়াতাড়ি করে নিজের জামা ঠিকঠাক করছিল—ডাক্তার লিখতে লিখতে বললেন, সারা বুকে তো র্যাশ বেরিয়েছে। মনে হচ্ছে বাধিয়েছ মোক্ষম রোগ। চটপট রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নাও। তারপর কিছু পাওয়া গেলে—মনে হচ্ছে পাওয়া যাবে—ইঞ্জেকশন নিতে হবে।
ডাক্তার প্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে মেয়েটির হাতে দিলেন। তারপর চোখ পাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, এখন কিন্তু তোমার ঘরে লোক টোক নেয়া সব বন্ধ।
অতএব অনিরুদ্ধর কথাটা একেবারে ঠিক — সন্ধ্যার শরীরের ভেতরে বা বাইরে কোথাও কোন রোগ আছে কিনা সেটা খুব ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে। ও খুব শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় অনিরুদ্ধকে বলল, শরীর পরীক্ষা হোক— কিন্তু আমার শরীর দেখালে আমি টাকা নিয়ে থাকি— সেটা মনে রাখবেন।
অনিরুদ্ধ ঢোঁক গিললেন। পাশে বসা বন্ধুটি অন্যদিকে তাকিয়ে —কোন কথা না শোনার ভান করছে। মেয়েটা সত্যিই দুর্বিনীত। কিন্তু কি আর করা যায়। অনিরুদ্ধ গলা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন— আচ্ছা আচ্ছা, সে কিছু একটা করা যাবে— তোমার যাতে কোন লোকসান না হয় সে আমরা দেখব।
অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন — সেই সঙ্গে সূর্যশেখর। আর হ্যাঁ, আমার কিন্তু লালজলের দরকার হয়— দুজনের দিকেই কথাটা ছুঁড়ল সন্ধ্যা। বিলিতি। তার ব্যবস্থা করবেন।
অনিরুদ্ধর ফর্সা মুখ লালচে হয়ে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি বলে ফেললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
আর দেরি না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অনিরুদ্ধ। কে জানে আবার কি বলে ফেলবে ওই বেয়াদপ মেয়েটা। পেছনে গেলেন সূর্যশেখর। খালি যাবার আগে সন্ধ্যাকে বললেন, রমা আসছে তোমার কাছে। ও তোমাকে সব দেখিয়ে টেখিয়ে দেবে।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে পরেই রমা ঢুকল — ঐ মেয়েটি, যে সন্ধ্যাকে চা আর কেক দিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাকে বলল, আসুন ভাই—আপনার ঘর দেখিয়ে দি। সন্ধ্যা ওর বাক্সটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, রমা বলল, ওটা আপনি ছেড়ে দিন—নেপাল ওটা আপনার ঘরে পৌঁছে দেবে।
সন্ধ্যা রমার সঙ্গে ওর জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে এল — আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন পুরুষ চাকর ওর বাক্সটা নিয়ে এসে এ ঘরে রেখে দিয়ে গেল।
সুন্দর বড়সড় ঘরটা। একপাশে একজনের একটা খাট— নরম গদির বিছানা আপাততঃ বেডকভার দিয়ে ঢাকা দেওয়া রয়েছে। খাটের মাথার ধারে একটা বেড সাইড টেবিল— আর একধারের দেয়ালের গায়ে লাগিয়ে রাখা একটা রাইটিং টেবিল আর তার সঙ্গে একটা গদি আঁটা চেয়ার। টেবিলটার ওপর একটা কাঁচের জাগে জল আর একটা ঢাকা দেয়া গেলাস। ওটার ওপর কয়েকটা ইংরেজি আর বাংলা সিনেমার পত্রিকাও পরপর রাখা আছে। ঘরের একপাশে একটা খুব বড় জানালা। এখন তার পর্দা সরানো - কাজেই ঘরটায় উজ্জ্বল আলো। একদিকে একটা দামী কাঠের আলমারি, তার একটা পাল্লায় একটা বড় আয়না লাগানো। ঘরে একটা আয়না লাগানো ড্রেসিং টেবিলও রয়েছে। আলমারির গায়ে চাবি লাগানোই ছিল। রমা চাবি দিয়ে আলমারি খুলে দিল, সন্ধ্যাকে বলল, আপনার জামা কাপড় এখানে রাখতে পারেন। চাবি আপনার কাছেই থাকবে।
সন্ধ্যা ভেতরে ঢুকেই ঘরটার সব কিছু দেখে নিয়েছিল। ঘরটা ওর পছন্দ হয়েছে। হয়তো এ বাড়িতে ওকে কিছুদিন থাকতে হবে। দিনগুলো আরামেই কাটবে মনে হয়।
ও রমাকে বলল, ভাই, আমি চান করব। বাথরুমটা কোথায়?
রমা মনে মনে হাসে। বাথরুম কি এ বাড়িতে একটা? এ ঘরের সঙ্গে লাগোয়াই একটা বাথরুম আছে— রমা দরজাটা দেখিয়ে দিল। বলল, আপনার জন্যে তোয়ালে, সাবান, সব কিছু ভেতরে রাখা আছে। আমি এখন যাচ্ছি, কোন দরকার হলেই বেল বাজিয়ে আমাকে ডাকবেন। দেয়ালের সুইচবোর্ডে একটা ঘন্টি আঁকা সুইচ দেখিয়ে দিয়ে রমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু স্নান করতে গিয়ে সন্ধ্যা একটু বিপদে পড়ল। এ জাতীয় বাথরুম ও কখনো দেখে নি — ব্যবহার করা তো দূরের কথা। বাথরুমটা বিরাট বড় — ওর শোয়ার ঘরের প্রায় অর্ধেক হবে। একদিকে কমোড রয়েছে — সন্ধ্যা কখনো তা ব্যবহার করে নি। একপাশে একটা লম্বা, সরু, অগভীর চৌবাচ্চার মত সুদৃশ্য একটা জিনিস— তা আবার বাথরুমের ভেতর প্লাস্টিকের তৈরি পর্দা লাগিয়ে আলাদা করা রয়েছে। দেয়ালে নানা রকম কল বসানো— মাথার ওপর জল পড়ার ঝারি — জলের পাইপ লাগানো একটা টেলিফোনের মত দেখতে জিনিস হাতের কাছেই রয়েছে। সন্ধ্যা কৌতূহলী হয়ে একটা কলে একটু চাপ দিয়েছিল— ঐ টেলিফোনটার থেকে খানিকটা জল হুশ করে বেরিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথা মুখ ভিজিয়ে দিল। প্রকাণ্ড সাইজের কতগুলো পরিষ্কার তোয়ালে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো রডে ঝোলানো। একদিকের দেয়ালে একটা আয়না — তার নিচে লাগানো তাকে সাবান, টুথপেস্ট, মুখে লাগানোর ক্রিম এসব সাজানো। সন্ধ্যা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বেল বাজিয়ে রমাকে ডাকল। ও একটু দেখিয়ে টেখিয়ে না দিলে সন্ধ্যা এই বাথরুম ব্যবহার করতে পারবে না।
রমা এসে সব দেখিয়ে দিল। ঠাণ্ডা আর গরম জলের কল, টেলিফোন শাওয়ার - কি করে কমোডে বসতে হয়। ঐ বেঁটে চৌবাচ্চার মত ব্যাপারটা বাথটব, সেখানে ঠাণ্ডাগরম মেশানো জলে সাবানের ফেনার মধ্যে শুয়ে স্নান করা যায়। তোয়ালে রোজ বদলে দেওয়া হবে তা বলে দিল। কি করে বাথ রোব গায়ে জড়াতে হয় তা দেখিয়ে দিল। তবে এসব দেখিয়ে দেবার সময় রমা সন্ধ্যার সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্য অনুভব করছিল। একটা বাজারের মেয়ে — এসব কিছুই জানে না — আরে ছোঃ ছোঃ।
সন্ধ্যা অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। ও এই বাথরুমটার সব কিছু ভাল করে দেখে নিয়েছে। মাসির থেকে ও যখন বাড়িটা কিনবে তখন ওর নিজের জন্যে একটা আলাদা বাথরুম বানাবে। এই রকম হবে সেটা।
দুপুরের খাবার এল ঠিক বেলা একটার সময়। রমার পেছনে নেপাল —সে একটা বড় ট্রেতে খাবার বয়ে এনেছে। ও ট্রেটা নামিয়ে রাখল রিডিং টেবিলটার ওপর। সন্ধ্যা তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা ইংরেজি সিনেমার পত্রিকা পড়ছিল। রমা তা দেখল। এক মুহূর্তে সন্ধ্যা সম্পর্কে ওর তাচ্ছিল্যের ভাব উধাও হয়ে গেল। আরে— এই মেয়েটা বাবুদের মত মনে মনে ইংরেজি পড়তে পারে।
খাবার পরিমাণে প্রচুর। ডাল, ভাজা, দুরকমের সব্জী, মাছ, মুরগী, সরু চালের ভাত, মিষ্টি বলতে রয়েছে পুডিং। সন্ধ্যা খুব বেশী খেল না। কারণ এ বাড়ি থেকে বেশি মোটা হয়ে ফিরলে ওর চলবে না। সন্ধ্যা যতক্ষণ খেল রমা ওর বিছানায় বসে রইল আর নেপাল দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। সন্ধ্যার খাওয়া হয়ে গেলে নেপাল ট্রেটা তুলে নিয়ে গেল। রমা একটা ভেজা ঝাড়ন দিয়ে টেবিলটা মুছে সাফ করে দিল। আর দুপুর পার হতে না হতেই ভৃত্যমহলে খবরটা চাউর হয়ে গেল — রেণ্ডীটা ইস্কুলের দিদিমণিদের মত ইংরেজি পড়তে পারে। জনা কয়েক পুরুষ চাকর আর দেউড়ির দারোয়ান —যারা সন্ধ্যাকে দেখেছিল— ভেবেছিল একটু সুযোগ সুবিধেমত মেয়েছেলেটাকে টাকা দিয়ে একবার চেখে দেখবে। এবার তারা একটু মুষড়ে পড়ল। ইংরেজি জানা মেয়েমানুষটাকে টাকা দেখিয়ে কি কোন কাজ হবে?
রাতে সন্ধ্যা খেয়ে ওঠার পর রমা এল। হাতে একটা জন্মরোধক বড়ির পাতা। সন্ধ্যা বুঝল রমাকে সন্ধ্যার কাজটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যাকে বড়ি খাওয়ানো হবে যাতে ওর মত একটা পতিতা মেয়ে রায়চৌধুরী বংশের রক্ত বয়ে নিয়ে যেতে না পারে। রায়চৌধুরী বংশের কোন সন্তানের জন্ম দিলে সন্ধ্যা তার জন্যে খোরপোষ তো বটেই, এমনকি সম্পত্তির ভাগ চেয়ে মামলা ঠুকে দিতে পারে। তখন তা এই বনেদী বংশকে অত্যন্ত বিব্রত করবে। কাজেই তার যে কোন সম্ভাবনাই আটকে দেয়ার দরকার।
(ক্রমশ)