• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (১০) : রঞ্জন রায়


    (একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)

    দ্বিতীয় ভাগ

    || ৫ ||

    দাদু দরবার করতে গেলেন স্কুলে। টিচাররা ধৈর্য ধরে বোঝালেন যে সেসব দিন গেছে। এখন আর সেকশনগুলো ছাত্রদের পারফরমান্স হিসেবে হয় না, হয় কে কবে ভর্তি হয়েছে তা নিয়ে। আগামী হাফইয়ারলিতে সি সেকশনের ছাত্রকে ফার্স্ট হতে দেখলে আশ্চর্য হবেন না।

    দাদু ময়মনসিং জেলার বাজিতপুর আদালতের ওকালতি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে সন্দিগ্ধ মনে বাড়ি ফিরলেন ও নাতির হাফইয়ারলি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিয়ে শ্যেনদৃষ্টিতে দেখাশুনো করতে লাগলেন। কিন্তু দাদুর শালগ্রাম শিলা বোধহয় কিঞ্চিৎ কুপিত হয়েছিলেন।

    হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার ক'দিন আগে বিশ্বকর্মা পুজো। পার্কসার্কাসের আকাশে রঙবেরংএর ঘুড়ির মেলা। পেটকাট্টি, মোমবাত্তি, চাঁদিয়াল, চৌরঙ্গী। দাম দু'পয়সা থেকে এক আনা দু'আনা করে চার আনা পর্যন্ত, সাইজ অনুসারে। মাঞ্জাও হয় চিঁড়ের নয় গঁদের। একটা টেনে খেলার, অন্যটা ঢিলে খেলার জন্যে।

    ভিজে ছাদে কদিন খালি পায়ে ঘুরে পাশের ফ্ল্যাটের সমবয়েসিদের সঙ্গে দৌড়ে কেটে আসা ঘুড়িগুলো ধরতে ধরতে বাবু রঞ্জন ঘুড়িশাস্ত্রে বিদ্যাদিগ্‌গজ মহাধনুর্ধর হয়ে উঠলেন। পরিশ্রমের ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। উনি লুটলেন একটি মোমবাত্তি ঘুড়ি সম্ভবত এক আনার আর তার সঙ্গে লেজে লেগে থাকা অনেকখানি মাঞ্জাসুতো। ফাউ হিসেবে জুটলো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।

    জ্বরো গায়ে অংক পরীক্ষা দিয়ে হাতে রইল ৩৬ নম্বর -- শিশুবিদ্যাপীঠের নিয়মে ফেল। প্রাপ্তিযোগ সাদা রঙের মার্কশীট।

    ব্যস্‌, উকিল সতীশচন্দ্রের মনে হল যেন তাঁর বিপক্ষ ডকুমেন্ট জাল করেছে! এবার উনি কোন্‌ মুখে নাতির সেকশন বদলের জন্যে পিটিশন দেবেন?

    ছোটভাই নাচতে নাচতে হলুদ কার্ড নিয়ে ঘরে ঢুকল। হলুদ রং? মানে ৮০% এর ওপরে? সতীশচন্দ্র গর্জে উঠলেন-- হইছে! বড়ভাই ফেইল মারছে আর ছোটভাই আনন্দে নাচে! কুন আক্কল নাই!

    উনি নাতির সাধের মোমবাত্তি ঘুড়িটি জানলা গলিয়ে নীচে ফেলে দিলেন।

    আস্তে আস্তে পাক খেতে খেতে ভিজে মাটিতে পড়ে ক্রমশ অস্তিত্বহীন হতে থাকা ঘুড়িটির দিকে ও জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ পারে।

    একটা গলি পরে থাকে হিরন্ময় সাহা। ডাক নাম শিবু। ওর বাবা ঢাকার শাঁখারিটোলা থেকে এসে এখানে জমি কিনে ছোট একতলা বাড়ি বানিয়ে নিজের ব্যবসাপত্তরে ব্যস্ত। ও একই স্কুলে পড়ে। কিন্তু ওর একটা মস্ত দোষ। ও পড়ে সি সেকশনে। দাদু নাতিকে পই পই করে মানা করেন-- সি সেকশনের ছেলের লগে কোন বন্ধুত্ব করবি না।

    কিন্তু নাতির মন মানে না। শিবু যে ওকে চায়! অনায়াসে এসে বলে আইজ আমার বাড়ির উঠানে জলসা করুম। তর বাড়ি থেইক্যা-- একটা চাঁদোয়া আছে কইছিলি না-- হেইডা লইয়া আয়।

    জলসা! সেটা কী জিনিস? মনে হয় শিবু যেন এক জাদুকর। ও চুপচাপ ঠাকুমার ট্রাংক খুলে ফুলকাটা চাঁদোয়া নিয়ে আসে। শিবু ঠিক করে কে কে গান করবে আর রঞ্জন ওদের পাঠ্যবইয়ের দশম পাঠের রুইদাস চাষীর অভিনয় করবে। কিন্তু জলসা শুরু হতে পারল না। কোথা থেকে টের পেয়ে দাদু এসে নাতির কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এলেন। ওই একশ কদম পর্যন্ত নাতির কান ওঁর হাতছাড়া হয় নি। ওর কানে বাজছিল শিবুর ঠাকুমার অনুরোধ-- মাইরেন না গো! ছাওয়ালডারে মাইরেন না!

    বাড়ি ফিরে সতীশচন্দ্র হিসহিস করে বললেন-- সি সেকশনের ছেলের সঙ্গে মিইশ্যা অধঃপাতে গেছস। স্কুল থেইক্যা বাড়ি না ফিরা বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা! আরেকবার যদি--!

    কানে আড়াই পাক খেয়েও ওর বোধবুদ্ধি হল না। ম্যাজিশিয়ান শিবু হঠাৎ হাজির হল এক নতুন অ্যাকশন প্রোগ্রাম নিয়ে। সরস্বতী পুজো করা!

    সত্যি সত্যি সরস্বতী পুজো? আমরা করব? কী করে? প্রতিমার দাম, ফলফুলের খরচ, পুরুতমশায়ের দক্ষিণা--এসব আসবে কেং করে?

    ম্যাজিশিয়ান শিব্যা তৈরিই ছিল। কেন, চাঁদা তুলে। বড়রা যেমন করে করে। ওরা তো রসিদ দেয়। তাতে কী, আমরাও দেব। এই দ্যাখ -- আমি বানিয়ে এনেছি। ওমা, কী সুন্দর! পার্কসার্কাস বালক সংঘ! অমুকের থেকে অত টাকা অত নয়া পয়সা "ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হইল"। হোক না হাতে লেখা, কিন্তু ঠিক বড়দের রসিদ বইয়ের মতো। পুজো কোথায় হবে? কেন, আমাদের আঙিনায়। সব ঠিক করা আছে, শুধু পাড়ার দোকানে দোকানে গিয়ে চাঁদাটা তোলা। কাল থেকে শুরু।

    ওর মনটা খুঁতখুঁত করে। সরস্বতী বানানটা ভুল! কেউ যদি কিছু বলে।

    না, কোনো দোকানিই বানান নিয়ে কিছু বলল না। শুধু হাতে লেখা রসিদ বলে অনেকেই মানা করল। যারা দিল তারাও চার আনা, আট আনার বেশি উপুড় করল না।

    একটি বড় দোকানে এক পয়সা দেব না বলায় শিবু বলল-- অত বড় দোকান! তাও ছোটছেলেদের পূজায় একটা গোটা টাকা দিতে পোঁদটা চুলচুল করে?

    ওরা তাড়া করল। চাঁদা তোলার সেখানেই ইতি। সব মিলিয়ে উঠেছিল ন'টাকা ষাট পয়সা। এত কমে পুজো হল না। তবে শিবুদের পারিবারিক পুরুতমশায় বল্লেন --এভাবে ছেড়ে দিলে সরস্বতী রুষ্ট হবেন, বাচ্চাদের পড়াশোনায় বাধা পড়বে। তাই আরো কিছু জুড়ে কুড়িটা টাকা দিন-- আমি কালীঘাটে ওদের নামে পুজো দিয়ে প্রসাদ এনে দেব।

    এক ক্লান্ত বর্ষার মনকেমন করা বিকেলে শিবু বা শিব্যা এসে গেল রঞ্জনদের ভাড়াবাড়ির ছাদে। ও তখন নিজের ছোটভাই আর পাশের ফ্ল্যাটের জনাদুই সঙ্গীসাথী জুটিয়ে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘুড়ি উড়বে কেমন করে?

    শিবু বলল-- আয়, আমি একটা মন্তর জানি। ঠাম্মা শিখাইছে। ওই ছাদের জলের ট্যাংকের উপরে উইঠ্যা আমরা তিনজন যদি দশবার জোরে জোরে মন্তরটা কই তো রইদ উঠব। আমরা মহা উৎসাহে গঙ্গাজলের খালি ট্যাংকের উপরে উঠে দাঁড়ালাম। বাঃ, এখান থেকে পার্কসার্কাসের ধাঙড়বাজারের পাড়া কেমন যেন অপার্থিব ও মজার দেখায়। আর নিজেদের বেশ শক্তিশালী মনে হয়। ওই তো সার্কাস হোটেল। বারান্দায় গনগনে উনুনে সেঁকা হচ্ছে গরুর মাংসের কাবাব। ওপাশে বুবুলদের বাড়ির তালগাছে তাল পাকছে, শিবুদের সাদা বাড়িটা কী ছোট। চোখে পড়ছে বালু হক্কাক লেনের গলিটাও।

    শুরু হল জোরে জোরে সমস্বরে মন্তর পড়াঃ

    "আলতা পালতা চুকার ঝোল, আদা দিমু ছেঁইচা,
    রইদ ওঠ ফাইট্যা! রইদ ওঠ ফাইট্যা!"
    বার চারেক বলার পরই দেখতে পেলাম ম্যাজিকটা। নীচের রাস্তা থেকে ভেসে এল তুমুল গর্জন। লক্ষ্য আমরা। আসলে অত নীচের এলিভেশন থেকে মনে হচ্ছে যে তিনটে বাচ্চা পাঁচিলের গায়ে লাগা জলের ট্যাংকের ওপর ওঠে তা-তা থৈয়া করছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই অত উঁচু থেকে শানবাঁধানো গলিতে আছড়ে পড়বে। কাজেই বাড়ির লোকজন যেন শীগ্গির ছাদে উঠে ওদের সাবধানে নামিয়ে আনে।

    বাড়ির আতঙ্কিত ক্রুদ্ধ ভদ্রজনের থেকে আমাদের কপালে জুটল কর্ণমর্দন আর শিবু বা শিব্যা চোখা চোখা বাক্যবাণের জ্বালায় ঢিল খাওয়া নেড়িকুকুরের মতো দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাল। আসলে ছাদের পাঁচিল ও জলের ট্যাংকের মধ্যে অন্তত চারফুট নিরাপদ দুরত্ব ছিল। কিন্তু অত তত্ত্বকথা বড়রা কোনদিন বোঝে?

    সি-সেকশনের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই শেষ।

    || ৬ ||

    ক্লাস থ্রি। এবার সেকশন এ বটেক। নতুন সব বই। মা সুন্দর করে মলাট লাগিয়ে ছোট্ট স্লিপে নাম লিখে দিয়েছে। শ্রীকুমার ব্যানার্জির ইংরেজি প্রাইমারটিতে আমি পাতা উল্টে বানান করে গোটা সেন্টেন্স পড়তে শুরু করেছি দেখে খুল্লতাতরা যারপরনাই খুশি।

    — হ্যাঁ, শিশুবিদ্যাপীঠ মাইয়ালোকের স্কুল হইলেও লেখাপড়া শিখাইতাছে।

    ন'কাকা দিলেন একটা বল-পয়েন্ট পেন। আমি হতবাক। দোয়াতে ডোবাতে হবে না, বা ঝর্নাকলমের মতো বারবার কালি ভরতে হবে না!

    আর ছিল "সাধারণ জ্ঞান"। ইউরোপের দেশগুলোর রাজধানীর নাম জেনে সেগুলো অ্যাটলাসে খুঁজে বের করতে কী মজা!

    কিন্তু the কোথায় কোথায় লাগায়?

    ইংরেজির ক্লাসে সব নামের আগায় লাগিয়ে দিলাম। লিখলাম--The Sita is wife of the Rama."

    প্রেম-মাসিমা গোল গোল চোখ করে আমায় দেখলেন। তারপর শুধরে দিলেন।


    একমাসের মাথায় দুই ভাই বোন ভর্তি হল--অর্পণ ও অর্পিতা। অর্পণ সেকশন সি, অর্পিতা আমার সেকশনে। প্রথম দিনেই মেয়েটির কাঁচের গুলির মতো চকচকে চোখ আর দুষ্টু দুষ্টু হাসি আমার ভাল লেগে গেল। আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন দিদিমণি ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন ও খেয়াল করে নি। তাই বকুনি খেয়ে জায়গায় ফিরে গেল। আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত। ইস্‌ নতুন মেয়েটা আমার দোষে—

    তবে টিফিনের সময় লোকসান পুষিয়ে দিয়ে মেয়েটা আমাকে একটা মজার প্যারডি গান শিখিয়ে দিল।

    শ্যামল মিত্রের সুপারহিট "চিনি আমি চিনি, ওগো নন্দিনী,

    তুমি যে মায়াসঞ্চারিণী"র জায়গায়:

    "গুনি আমি গুনি, সেই দিন গুনি,
    কবে হবে মোর সহধর্মিণী।"
    আমার ঝকাস লাগল।

    বাড়ি ফিরে স্কুলের শার্টপ্যান্ট বদলাতে বদলাতে অন্তরাটি গাইতে লাগলাম:

    "দেখেছি তোমায় আমি দুপুরবেলায়,
    কলেজের ফাঁকে আর সিনেমাতলায়;
    জেনেছি তুমি মোর অনুরাগিণী।"
    কাকিমারা প্রথমে চোখ বড় বড় করে তারপর মুচকি হেসে বললেন --হইসে, এইবার থাম। আমি তখন বার খেয়ে ক্ষুদিরাম।

    --না, আরও আসে। এইখানটা হুইন্যা লও।

    "তোমার বাবাকে তুমি বুঝিয়ে বলো,
    বেকার হলেও আমি ছেলেটি ভাল;
    প্রেম করে আমি তো গো কেটে পড়িনি।"
    ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়ল। ছোটকা চণ্ড-মুণ্ড-প্রচণ্ড হয়ে ঘরে ঢুকে আমার কলার চেপে ধরল।

    --আরেক বার যদি ঘরের মধ্যে এইসব অসইব্য গান শুনি তো তরই একদিন কি আমারই। কে শিখাইছে?

    --স্কুলে; নতুন মাইয়া --অর্পিতা।

    --কাইল থেইক্যা ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ।

    এক কাকিমা জিগাইলেন-তবে যে হুনছিলাম স্কুলডা ভালা?

    -- এর নাম ভালা? ভালা না পাদের ছালা!

    তখন কী আর জানতুম যে বঙ্গসমাজ একদিন "কাদের কুলের বৌ গো তুমি"র গায়েও অশ্লীল লেবেল সেঁটে দিয়েছিল! এটাও জানতাম না যে বঙ্গীয় কমিউনিস্টরা আসলে বিংশশতাব্দীর নববিধান ব্রাহ্মসমাজ।

    বছর নয় পরে একদিন ডবল ডেকার নয়নম্বর বাসের দোতলায় বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছি দেখি উল্টোদিকের সিটে অর্পণ ও অর্পিতা। অর্পণ চিনতে পেরে বলল যে বোনের কোন কলেজে অ্যাডমিশন টেস্ট ছিল, এখন বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। অর্পিতা সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। রঞ্জনের সাহস হল না ওই নবযুবতীকে বলার যে সেই প্যারডি গানটা আজও মনে পড়ে।

    ক্লাস থ্রি থেকে এক নতুন আপদ জুটল। ক্লাসের মনিটর। সে খালি নাম লেখে আর দিদিমণিদের দেখায়। কেবল ওর মুখের কথায় আমরা যখন তখন ভিলেন হয়ে যাই। বেঞ্চিতে উঠে দাঁড়াই বা ক্লাসের বাইরে যাই। আমি অবাক হয়ে মনিটরকেই জিগ্যেস করলাম-- এই ‘মনিটর’ কথাটার মানে কী? সে বলতে পারল না আর রিপোর্ট করল যে আমি বকবক করে ক্লাসের পড়াশুনোয় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলাম।

    অধিকাংশ সময় আমাদের মনিটর ছিল বিনীতা দাস। ওরা ক্রিশ্চান। ক্লাস টিচার প্রেমমাসিমাও ক্রিশ্চান। ও যা বলে সব মেনে নেওয়া হয়। আমরা-ওরা ভাগাভাগির ছবি যেন তখন থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

    প্রৌঢ় বয়সে দিল্লিতে এক আড্ডায় পার্কসার্কাসের বন্ধু অঞ্জন জিগ্যেস করল -- হ্যাঁরে, সেই সময় কড়েয়া রোডের কাছে একটি ক্রিশ্চান পরিবার থাকত। সাতটি বোন, সাতজনেই চোখে পড়ার মত সুন্দরী ছিল। বিশেষ করে প্রথম জন। ওদের সবাই বলত-সা-রে-গা-পা-ধা-নি। চিনতিস্?

    --কেন চিনব না? ওই "নি", যার নাম বিনীতা, আমাদের মনিটর ছিল।

    স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান হবে। পার্ক শো হাউস না কোথায় যেন বুক করা হয়েছে। আমি জানলায় উঠে উঠে রিহার্সাল দেখি।

    নাটক হচ্ছে "স্বার্থপর দৈত্য"।

    আবার নাচ হচ্ছে শিব-পার্বতী।

    একটি বড় মেয়ে ক্যালেন্ডারের শিবের মতো মুদ্রায় পোজ নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আর তার বক্ষলগ্না আর একটি মিষ্টিমতো মেয়ে বলছে-- ভোর হয়েছে, পাখিরা ডাকাডাকি করছে। প্রভু জাগো। প্রভু জাগো।

    প্রভু অনেক সাধ্যসাধনায় জাগলেন। তারপর দুর্গাকে নৃত্য শেখাতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই দুর্গার মন ভরে না। শেষে উনি শুরু করলেন তাণ্ডব নৃত্য। সেই দেখে দুর্গা "সম্বর সম্বর প্রভু! তোমার এই রূপ সহ্য হচ্ছে না" বলে ভির্মি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

    আমি মুগ্ধ। হাততালি দিতে লাগলাম। ফল হল --আমার কপালে রিহার্সাল দেখা বন্ধ।

    একবার স্কুল থেকে শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের ধর্মতলায় জ্যোতি সিনেমা হলে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি বালচিত্র দেখাতে নিয়ে যাওয়া হল।

    সেই প্রথম দেখছি ছবির নড়াচড়া। ছবি কথা বলে। সেই বিস্ময়ের ঘোর আজও কাটেনি।

    || ৭ ||

    ক্লাস থ্রি-তে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় নীল কার্ড পেলাম। মানে ৬০% থেকে ৮০% এর মধ্যে। মেজকাকা খুশি। এই দ্যাখ, তুই সেকন্ড হইছস।

    দাদু খুশি হলেন না। --এই নীচু ক্লাসে ৮০% না পাইলে চলে? দূর! দূর!

    সত্যি তো, ফার্স্ট হয়েছে বিমল, তার তো হলুদ কার্ড। আমার সঙ্গে তার দুস্তর ব্যবধান। সে কোন রেশনের চাল খায়?

    বন্ধুরা বলল-- এত ভাবনার কিছু নেই। ওর মাসি পূরবীদি আমাদের স্কুলের টিচার। উনি সব টিচারের থেকে কোশচেন জেনে নিয়ে ওকে মুখস্থ করিয়ে দেন।

    আমি মানতে রাজি নই। তাই বাইরের ঘরের দেয়ালে পেনসিল দিয়ে বাহরিনে তেলের কোম্পানিতে চাকরিরত বাবার উদ্দেশে চিঠি লিখলাম বাবা, আমি সেকন্ড হয়েছি।

    কিন্তু গানের ক্লাসে শোভামাসিমা বিমলকে সামান্য ছুতোয় যা তা করে বকলেন। আর বললেন--আমার ক্লাসে বাঁদরামো করলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব। ওরকম ফার্স্টবয় আমার ঢের দেখা আছে।

    শোভামাসিমার সোনার বালা পরা চওড়া কবজি আর নিমপাতা মুখ দেখে গোটা ক্লাস একেবারে স্পিকটি নট।

    আমরা শিখছি নতুন গান:

    "আমার বাড়ি এস ভ্রমর বসতে দেব পিঁড়ে,
    জলপান করিতে দেব শালিধানের চিঁড়ে গো,
    শালিধানের চিঁড়ে।
    উড়কি ধানের মুড়কি দেব, নতুন ধানের খই,
    বাড়ির গাছের পাকাকলা গামছাবাঁধা দই গো,
    গামছাবাঁধা দই।
    আমকাঁঠালের বনের ধারে শুয়ো আঁচল পাতি,
    গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস করব সারারাতি গো,
    করব সারা রাতি।"
    গানের মধ্যে কেমন একটা গোঙানো সুর, কান্না কান্না ভাব। অন্য একটা গান তখন রেডিওতে বাজে। শচীনকর্তার নস্যি নেওয়া গানেও সেই আকুলতা, সেই আর্তি!
    "জ্বালাইয়া চান্দের বাতি, জেগে রব সারারাতি গো,
    তুমি নীরব চরণে সেথা যাইয়ো রে ভোমরা,
    নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে।"
    কেন ভ্রমরকে এত খাতির তোয়াজ? ওকে নিয়ে আসার জন্যে এত সাধ্যসাধনা? বুঝি না। অদৃশ্য ভ্রমরকে বড় মেজাজি স্বার্থপর মানুষের মতো লাগে।

    হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে যায়।

    --- মাসিমা, মিতা আপনাকে খানকি বলল!

    টিচারের হারমোনিয়ামের বেলো করা হাত থেমে গেল।

    -- কে মিতা?

    উনি লাস্ট বেঞ্চের দিকে সোয়েটার পরা একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। আতঙ্কিত মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। না, আমি কিচ্ছু বলিনি।

    --বলেছে। ও বলল শোভামাসিমা খানকি।

    -- না, আমি বলেছি উনি খান কী? মানে রোজ কী খান?

    শোভাম্যাডাম মিতার দু'কাঁধ ধরে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

    আমি পাশের মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম--এই, খানকি মানে কী রে?

    --চুপ কর! ওসব বলতে নেই। ওটা খারাপ কথা।

    একদিন বীণা বলল--চল তোদের বাড়ি যাব।

    তখন বাড়ি ভর্তি লোক। সবাই অবাক হয়ে বীণা নামক মেয়েটিকে দেখতে লাগল, ও যে নেপালী!

    বললাম-- ও আমার বন্ধু, পাশের ডেস্কে বসে। সবার মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে বীণা একটু অসহজ হয়ে পড়ল। তারপর হেসে দিল। ব্যস্‌, এর পরে আমরাও হাসলাম। কাকিমা একটা চায়ের ডিশে করে ওকে দুটো রসগোল্লা আর একগ্লাস জল দিল।

    সবাই ওর সঙ্গে ভালভাবে গল্প করতে লাগল। এবার ও ফিরে যাবে। কড়েয়া রোড নাকি লোয়ার রেঞ্জ-এর দিকে থাকে।

    -- রঞ্জন, ওকে এগিয়ে দিয়ে আয়।

    কিছুদুর যাওয়ার পর বীণা বলল-- আয়, আমাদের বাড়িটাও দেখে যা। মাত্তর আর দু'পা।

    ওদের বাড়িতে ঢুকতে আর একটা বাড়ির ভেতর দিয়ে যেতে হল। ওর মা ঘাঘরা আর ফুলহাতা ব্লাউজ পরেন। দুইবেণী। ওর মার কোলে একটি বাচ্চা আর পাশে হামা দিচ্ছে দুজন। উনি অবাক হয়ে আমাকে দেখে বীণাকে কিছু বললেন। বীণা দৌড়ে গিয়ে একটা ভাইকে কোলে নিয়ে খুব আদর করতে লাগল। তারপর আমাকে একগ্লাস জল এনে দিল। আমি খেয়ে বেরিয়ে এলেম। চোখে পড়ল ওদের বাড়ির মেঝে মাটির। আমাদের ঘরের মতো সাধারণ সিমেন্টও নেই।

    বকুল আমার ইতিহাস আর স্বাস্থ্য বইদুটো নিয়ে গেছে। বলছে ওর কেনা হয় নি। ওর মা হাতে কপি করে দেবে। তারপর ফেরত দেবে, মাত্তর দু'দিন লাগবে।

    মাত্তর দু'দিন সাতদিন হয়ে গেল। তারপর দশদিন। বকুল বলল-- মা ঘরের কাজকম্ম সেরে রাত্তিরে কপি করে। গোটা বইটা করতে আরও সময় লাগবে। এদিকে পরীক্ষা এসে গেছে। আমি যতই তাগাদা দিই কোন লাভ হয় না।

    শেষে একদিন বলল--খুঁজে পাচ্ছে না।

    শুনে আমি তো প্রায় ভ্যাঁ!

    বাড়ি এসে বললাম এই অবস্থা। ছোটপিসি বললেন--তুই একটা প্যাটব্যাক্কল, একটা আউয়াখানা! হেই ছেড়ি কই থাকে? কড়েয়া থানার পাশে? চল দেখি, অর বাড়ি চল।

    বাড়ির নম্বর জানি না। কিন্তু ছোটপিসি তখন মুরলীধর কলেজের স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সেক্রেটারি। সিপিআইয়ের অ্যাকটিভিস্ট। থানার কাছের মুদিদোকান-পানদোকানে জিগ্যেস করে বাড়িটি খুঁজে বার করলেন। কিছু পাকাবাড়ির পেছনে একটা আঙিনা পেরিয়ে ওদের কাঁচা উঠোন। সেখানে বকুলের মা অনেকগুলো থালা ও কুলোয় করে বড়ি ও আচারের মশলা শুকোচ্ছিলেন। বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিতেন।

    পিসি বকুলের গার্জেনদের--হুগলির ঘটিদের ভাষায় বলতে গেলে --- ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিল। হারানো বইটা বেরিয়ে এল। আমরাও রওনা দিলাম। কিন্তু বকুলের মার অপমানিত মুখের চাউনি অনেকদিন ভুলতে পারিনি।

    বকুলের সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে গেল। আমার ক্ষতি।

    ও আমায় শিখিয়ে ছিলঃ

    বল--কাঁচের গ্লাস!

    বল্লাম। জবাব এল-- তোর বউ ফাসক্লাস।

    --পাথরবাটি?

    --তোর বউকে নিয়ে সাঁতার কাটি।

    --পিত্তলের দোয়ানি?

    --শ্যাকব্যাটা তোর সোয়ামি।

    --দুই দিকে দুই কলাগাছ,

    মধ্যিখানে মহারাজ।

    --দুই দিকে দুই বাঁদর,

    মধ্যিখানে মেথর।

    বাঃ, তোর বুদ্ধি আছে। তাড়াতাড়ি শিখে নিলি?

    এবার বল--কে? জোরে বলবি।

    আমি অন্য ছেলেমেয়েদের চোখ-টেপাটেপি দেখতে পেলাম না।

    --কে? --নাককাটা জগন্নাথ দে,

    ভস্‌ করে পেদে দিলি দশ্‌ টাকা দে!

    আমি স্কুলের ব্যাগ মাটিতে ফেলে ওকে তাড়া করলাম।

    || ৮ ||

    আমাদের বাড়িতে একটা লোক্যাল সেট রেডিও এসেছে। দুপুরে স্কুলের হোমটাস্ক করতে করতে গান শুনি। বিশেষ করে অনুরোধের আসর। সলিল চৌধুরির কথা ও সুরে লতা মঙ্গেশকর।

    "কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলছলে", “আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে"। হেমন্তের গলায় "দূরন্ত ঘুর্ণি, এই লেগেছে পাক, দুনিয়া ঘোরে বন বন", সতীনাথের "সোনার হাতে সোনার কাঁকন" বা "আকাশপ্রদীপ তারা জ্বেলো না, জ্বেলো না", মান্না দের "তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড়ভাঙা ঘর" মুগ্ধ হয়ে শুনি। ক্লাসের বন্ধুরা সুবীর, শ্যামল, শিবপ্রসাদ, শংকু ও প্রদীপ --এরা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে রিপিট করে।

    একদিন সুবীর এসে একটা অদ্ভুত গান শোনালো।

    "মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য"--জনৈক মানবেন্দ্র গেয়েছেন মায়ামৃগ সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে। ওই শব্দদুটোর মানে কী কেউ জানে না। চারদিকে মাইকে বাজছে মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য। বাজছে পার্ক ইউনিয়ন এবং পার্ক ইউনাইটেড বলে দুটো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের পুজোয়। বাজছে ঘাসিরামের গমভাঙানো কলের দোকানে ছটপুজোর দিনে, বাজছে বিয়েবাড়িতে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই এল কিশোরকুমারের "লুকোচুরি"র 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ, ডিম নেই তবু অশ্বডিম্ব'।

    আবার সুবীর ও টুটু বিশ্বাস শোনাল "দেড়শো খোকার কাণ্ড" বলে একটা ছোটদের সিনেমা এসেছে, তার গান—

    "জটাব্যাটা, জটাব্যাটা,
    ঘোড়ামুখো নাদাপেটা,
    মাথায় গান্ধীটুপি,
    ঘরে ঢুকে চুপি চুপি
    চুরি করে এটা সেটা।"
    আরে, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা বইটা তো আমি পড়েছি। ঘরে এসে বায়না ধরলাম--ক্লাসের সবাই এই সিনেমাটা দেখেছে, ভালো বই। মেয়েরাও দেখেছে। আমাকেও নিয়ে চল।

    তবে আমাদের বাঙালবাড়ির সিনেমাবিষয়ক কুসংস্কারের অচলায়তনের দেয়ালে একটি আঁচড়ও পড়ল না।

    এদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলে কোনো এক অজানা দেশের থেকে কিছু আশ্চর্য লোকজন ক্রিকেট খেলতে ভারতে এল। এই খেলাটার নাম কোনোদিন শুনিনি। কিন্তু বড়রা রেডিও চালিয়ে কান লাগিয়ে শুনছে।

    স্টেটসম্যান, আনন্দবাজার, যুগান্তর ও দেশ পত্রিকায় দেখছি ওদের ছবিশুদ্ধু সংক্ষিপ্ত জীবনী।

    গিলক্রিস্ট, হল, সোনি রামাধীন, ল্যান্স গিব্‌স--এদের বল নিয়ে ভেলকি। ব্যাটে সোবার্স, কানহাই, হোল্ট, হান্ট এবং কোলি স্মিথ। আর ক্যাপ্টেন ও উইকেটকিপার আলেকজেন্ডার।

    কিন্তু ভারতের কেমন যেন কাছাখোলা হাল। কখনও ব্যতিক্রম হিসেবে পঙ্কজ রায়, পলি উমরিগর, মঞ্জরেকর ও ভিন্নু মানকড় খবর হয়ে যান।

    এক রোববারে স্কুলের বন্ধু সুবীর একটা ছোট ব্যাট ও রবারের বল নিয়ে এল আমাদের বাড়ি। ছাদে ইঁটপেতে ক্রিকেট খেলা শেখাবে। কখন রান নিতে হয় আর কখন রান আউট হতে হয় --সেটা বুঝতেই একবেলা কাবার।

    একবার ওর হাত থেকে বল ফসকাতেই আমি দৌড় লাগালাম। বেশ খুশি, পেরেছি।

    কিন্তু ও চেঁচাতে লাগল-- দেইখ্যা রান দিমু না, দেইখ্যা রান দিমু না!

    রান নিতে হলে নাকি হিট করার পরই দৌড়তে হয়! সেটাই নাকি নিয়ম।

    বাড়িতে কাকাদের কাছে বলায় এসে গেল দুটো বই-- "মজার খেলা ক্রিকেট" আর "খেলার রাজা ক্রিকেট"; অজয় বসুর লেখা। ও দুটো ও আরও কিছু পড়ে আমি বাঁশবনে শেয়াল রাজা হলাম, পাড়ার ফুটপাথে বা গলি ক্রিকেটে বাচ্চাদের ম্যাচে সর্বজনমান্য আম্পায়ার।

    সবচেয়ে ভাল লাগত "হাউজ দ্যাট?" কল শুনে নট আউট না বলে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পেছন নাড়ানো বা ফিল্ডিং সাইডকে 'পোঁদ দেখানো'।

    দাদুর কেমন সন্দেহ হল যে গার্লস স্কুলে আমি বখে যাচ্ছি। বেশিক্ষণ বই নিয়ে বসি না। আধঘন্টা হল কি হল না, উঠে পড়ে বলি--হয়ে গেছে। সন্ধ্যেয় বলি দুপুরেই হোমটাস্ক করে নিয়েছি। বিশ্বাস না হয় পড়া ধরে দেখো। খাতা দেখে দাদু সন্দিহান--এত কম হোমটাস্ক দেয়--এ কেমনধারার স্কুল!

    সন্ধ্যে বেলা দাদু আকাশবাণীর পল্লীমঙ্গলের আসরের অনুষ্ঠান মন দিয়ে শোনে। প্রবাদপ্রতিম সুধীর সরকারের মোড়ল, সঙ্গে কাশীনাথ ও গোবিন্দর ঠ্যাং টানাটানি ও মাঝে মাঝে শ্রুতিনাটক--বেশ মন দিয়ে শোনে। আম্মো বসে যাই। বেস্পতিবারে আকাশবাণীর নিজস্ব নাটকগুলি হয়। প্রযোজনায় বাণীকুমার বা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

    এই ভাবেই শুনেছি মাধবীকংকণ, তটিনীর বিচার, তৃপ্তি মিত্র-শম্ভু মিত্রের ছেঁড়াতার।

    কিন্তু রঞ্জন আজকাল লতার "বাঁশী কেন গায়, আমারে কাঁদায়" বা "প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে" কেন গুনগুন করে? উত্তরে ও একটা বাঙাল পল্লীগীতির লাইন শুনিয়ে দিলঃ

    ও গুণের নাইয়া রে, ও গুণের মাঝি রে, কি গান শুনাইয়া গেলি গুন গুন গুন!

    নাঃ, ছেলেটা মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে। আজকাল আবার শুরু হয়েছে — ‘মধুমালতী ডাকে আয়!’ এবং ‘আর ডেকো না সেই মধুনামে’,-এর জন্যে ভাল হোম টিউটর লাগাতে হবে।

    দাদু খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আর নিজে নেসফিল্ড খুলে জেন্ডার পড়াতে লাগলেন। শুরুই হল গ্যান্ডার আর গুজ দিয়ে!

    বিকেলে খেলতে যাই জয়ন্তী মণিমেলায়। সেখানে শিশুবিদ্যাপীঠের কিছু সহপাঠী ছাড়া ওদের কারও কারও দাদা দিদিরাও আসে।

    ব্রতচারীর সঙ্গে শিখি পোল ড্যান্স, লেজিম ড্যান্স, মাস ড্রিল ইত্যাদি। আমাদের মণিবন্ধু, মণিকাঞ্চন, মণিপ্রিয় ইত্যাদি ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে তাদের মধ্যে কম্পিটিশন করানো হত। মণিমেলার নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল, পার্কসার্কাসের ঝাউতলা রোডে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসের পাশে শঙ্খনিধি পরিবারের বাড়ির একটি ঘরে।

    ---সবিতা মাসিমা, আপনি আজকে স্কুল ছুটির পরে আমাদের বাড়ি হয়ে একটু ---? মানে, দাদু বলেছে, যদি-- খুব ভাল হয়।

    --ক্যারে? বুইড়ার আবার আমারে কী দরকার পড়ল?

    -- মানে যদি আপনি আমাদের দু'ভাইকে একটু দেখিয়ে দিতে—

    এভাবেই শুরু হল আমাদের দু'ভাইয়ের হোম টিউশন। শিশুবিদ্যাপীঠের সবিতা মাসিমা ক্লাস ফোরের ক্লাসটিচার। উনি আবার ময়মনসিংহের বাজিতপুরের আমাদের প্রতিবেশী তালুকদার শ্যামাচরণ চক্রবর্তী মশায়ের ভাইঝি। সময়ের ফেরে এই বিধবা মহিলাটি কোলকাতায় একা হয়ে গেছেন। ঠনঠনের কালীবাড়ির কাছে কোথাও ভাড়াবাড়িতে থাকেন। প্রতিদিন ট্রামে করে সেখান থেকে এসপ্ল্যানেড হয়ে পার্কসার্কাসের এই স্কুলে মর্নিং সেকশনে পড়াতে আসেন এবং তারপরে একটা দুটো টিউশনি করে নিজের আস্তানায় ফিরে যান। বার্ষিক পরীক্ষায় অংক নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম, কিন্তু ভাল ভাবে উতরে গেল। আমার ভাই খেয়াল করল যে পরীক্ষার দিনদুই আগে উনি আমাদের একটা মক টেস্ট দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই পরীক্ষায় এসে গেছে।

    আমার সেদিন সবিতা মাসিমার জন্যে বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল।

    কিন্তু এর পরেই টিউশন বন্ধ হল। কারণ, বাবা আমাদের ভিলাইয়ে নিয়ে যেতে চায়। বাহরিনের চাকরি ছেড়ে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টে জয়েন করেছে। আবার অফিসার হয়ে! বড় কোয়ার্টার, তাতে বাগান, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার --সবই আছে; এবার ওখানের স্কুলে ভর্তি করবে। সেই সময় ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের টাউনশিপ মাত্র গড়ে উঠছে। গ্রাম উচ্ছেদ করে বসত। রুক্ষ শ্রীহীন। লালচে পাথুরে মাটি। রাস্তায় তখনও পিচ পড়েনি।

    ইংরেজি মিডিয়ম স্কুল অনেক দূর --সেক্টর টেন। ঘরের কাছে হিন্দি মিডিয়ম স্কুল। সেখানে মাস্টারমশাইরা থানার দারোগার মতো।

    কোন ছাত্র অন্যরকম বানান লিখলে বা উত্তর লিখে আনলে প্রশ্ন করা হয়ঃ

    -- ইয়ে কৌন শিখায়া? কিসনে?

    -- মেরা বাপনে।

    --তেরা বাপ তো বুদ্ধু হ্যায়।

    একদিন চোখে পড়ল:

    ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলের কিছু বাচ্চা স্কুলবাস থেকে নামছে আর হিন্দি মিডিয়ম স্কুলের বাচ্চারা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। দুদলের পোষাকে-আশাকে বডি ল্যাংগোয়েজে ব্যবধান চোখে পড়ার মতো।

    কুলীনের দল অন্ত্যজদের উদ্দেশে গায়ে পড়ে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করলঃ

    হিন্দি-মিডিয়াম চায় গরম,
    বাজার কা কুত্তা, বেশরম।
    আমরা প্রায় ভুখ হরতাল করলাম-- এ স্কুলে পড়ব না। দাও ফিরে সে কোলকাতা, লহ এ হিন্দি মিডিয়াম স্কুল।

    ব্যস্‌, কাজ হল। ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষার ঠিক আগে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। গুটিগুটি শিশুবিদ্যাপীঠের ক্লাস ফোরের রুমে ঢুকলাম।

    ক্লাস টিচার সেই সবিতা মাসিমা।

    ঠোঁট বেঁকিয়ে কেটে কেটে বললেন-- কী রে, তোদের ওখানে নিল না? বেয়ারিং চিঠির মতো ফেরৎ পাঠিয়ে দিল? যা ওই কোণার দিকে বোস গিয়ে।

    সন্ধ্যেবেলা দাদুকে জানিয়ে দিলামঃ আমি আর কারো কাছে টিউশন পড়ব না। মা একটু দেখিয়ে দিলেই যথেষ্ট, বাকিটা নিজেই দেখে নেব।

    পরের দিন রেণুমাসিমা নিচ্ছিলেন ধাঁধার ক্লাস।

    সবাইকে একটা করে ধাঁধা বলতে হবে।

    কেউ বলছেঃ

    একটুখানি জলে, মাছ কিলবিল করে?

    --ভাত।

    আরেকজনঃ

    এই আছে এই নাই, তারা বনে বাঘ নাই?

    -- বিদ্যুৎ।

    অথবাঃ

    সাদা মশারির ভেতরে,
    হলুদ খোকা আহারে।
    -- ডিমের কুসুম।

    কিন্তু গোল বাঁধলো দুজনের ক্যালোরব্যালোরে।

    শিবপ্রসাদ বললঃ

    পিঁ-পিঁ-পিঁ,

    লেজ দিয়া তেল খায় তার নাম কী?

    গোটা ক্লাস হেসে গড়াগড়ি। রেণু মাসিমা বললেন--এটা আবার কী?

    --প্রদীপের সলতে, মাসিমা।

    না, না; ওইসব পিঁ-পিঁ-পিঁ চলবে না। আরেকটা বল।

    শিবপ্রসাদ মাথা চুলকোচ্ছে দেখে পেছন থেকে নারান প্রম্ট করলঃ বল, কোন বাচ্চা কাঁদে না?

    শিবপ্রসাদ বেশ কনফিডেন্টলি আউড়ে দিল।

    --বেশ, এবার উত্তরটা বল।

    আবার প্রম্প্ট এবং শিবপ্রসাদ বেশ জোরে আউড়ে দিল--নুনুবাচ্চা।

    গোটাক্লাসে একেবারে কেলেংকারিয়াস প্যান্ডেমনিয়ম।

    --- বেরিয়ে যাও, ক্লাসের বাইরে! আউট!

    --মাসিমা, আমার দোষ নেই। নারাণ পেচন থেকে ওইরকমই বলেছে।

    মাসিমা দুজনকেই ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়াতে হুকুম দিলেন। এবার নজর পড়ল আমার দিকে।

    --এই যে, শ্রীমান! এতদিন ক্লাসে আসোনি কেন?

    আমি বেগুনি হয়ে গেলাম। মেয়েরা তাকিয়ে দেখছে। আমতা আমতা করে ভিলাইয়ের পড়াশুনোর অবস্থা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ নামাতে যাচ্ছি, উনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন --আচ্ছা,আচ্ছা! ওসব মহাভারত শোনার সময় নেই। একটা ধাঁধা বল, চটপট।

    এই রে! খেয়েসে। আমি ওসব একদম পারি নে।

    --কী হল, বল।

    হঠাৎ টিউবলাইট জ্বলে উঠল। কালকেই রাত্তিরে পড়েছি গল্পটা।

    টেনে টেনে বললামঃ

    "পায়ে ধরে সাধা,
    রা নাহি দেয় রাধা।
    শেষে দিল রা,
    পাগোল ছাড়ো পা।"
    --ধারাগোল। একটি গ্রামের নাম।

    টুটু, প্রদীপ, বিজন, সুবীর হৈ-হৈ করে উঠল।

    --মাসিমা, ও যা তা বানিয়ে বলছে। কোন গ্রামের এরকম নাম হয় নাকি? মেড়োর দেশ থেকে এসে চালাকি করছে। ম্যাপ খুলে দেখাক--কোন জেলায় ধারাগোল গ্রাম।

    রেণুমাসিমা আস্তে আস্তে বললেন-- না, ম্যাপে নেই। কিন্তু সাহিত্যে আছে। ও ঠিকই বলেছে।

    *******



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments