• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | রম্যরচনা
    Share
  • পঞ্চাশ-ষাটের হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার চালচিত্র (২১) : রঞ্জন রায়



    ।।১৩।।

    এই বিংশশতাব্দীর কোলকাতার ক্যান্টারবেরি টেলস্ এ কত বিচিত্র জলছবির সমাহার। কত বর্ণাঢ্য চরিত্র। যেমন ছাত্রপ্রাণ খঞ্জ সুনীলদা, তেমনি একজন হলেন অন্ধ পাখোয়াজ বাদক নগেশদা।

    শুধু শারীরিক পঙ্গুত্বে নয়, এঁদের দুজনের আসল মিল কাজের প্রতি সমর্পণে, নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায়। আমার বালকবুদ্ধির মাপকঠিতে আশ্রমের ভাল কিছু জিনিসের মধ্যে এই দুজন প্রায় নায়কের স্থানে বসে আছেন।

    প্রতিদিন সন্ধ্যেয় আরাত্রিক 'খন্ডন ভব বন্ধন' শুরু হওয়ার আগে দেখা যেত উনি কারও হাত ধরে বা একাই হাতড়ে হাতড়ে মাপা পা ফেলে প্রেয়ার হলে ঢুকছেন। পোদো ওর কাছে গিয়ে বসে একটা বড় আটার ভিজে তাল নিয়ে ওনার নির্দেশমত পাখোয়াজের বাঁয়ার দিকটায় চেপে চেপে বসিয়ে দিত।

    অতি বিলম্বিত লয়ে চৌতালে শুরু হত আরাত্রিক। বলিষ্ঠ হাতের চাপড়ে বাজত চৌতালের ঠেকা। খঞ্জনি হাতে পোদো মেলাতে গিয়ে ঘেমে যেত। তারপর দুনি চালে রিপিট হত। পোদো ওনার হাতে দেখানো মাত্রা ও ইশারায় চারপাশের বন্ধুদের সামনে ঘ্যাম নিয়ে খঞ্জনি বাজাতো। যেই না শেষের চার লাইনে 'নমো নমো প্রভু বাক্যগুণাতীত' আর 'ধে ধে ধে লঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গ, বাজে অঙ্গ সঙ্গ মৃদঙ্গ'--- ত্রিতালে ও একতালে জলদ বাজত, নগেশদার পাখোয়াজও গুরু গুরু মেঘগর্জনের মত কথা বলে উঠত। শেষে তেহাই -টেহাই দিয়ে সমে এসে নগেশদা কাঁধের গামছা দিয়ে ঘাম মুছতেন। পোদোর বুকের মধ্যে ঝরণা কল কল বইত আর ও প্রেয়ার ভুলে গিয়ে একটা বড় সড় পেতলের খঞ্জনি নিয়ে পাখোয়াজের বাঁয়ার দিক থেকে সেই ভিজে আটার শুকিয়ে যাওয়া দলাটিকে ঘষে ঘষে তুলত যতক্ষণ না নগেশদা হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলতেন --ঠিক আছে।

    কালীপূজার রাত। চারদিকে তুবড়ি, ফুলঝুরি হাউয়ের সমারোহ। দোদুমার ও চকলেট বোমের কানফাটানো আওয়াজ।

    জন্মবুড়ো পোদোর এর চেয়ে মন টানে প্রেয়ার হলের বারান্দায় জাজিম পেতে সারারাত্তির কালীকীর্তনের জমাটি আসর। কত খেয়ালিয়া ধ্রুপদীয়া এসেছেন। তবলা ও পাখোয়াজে সেই আদি ও অকৃত্রিম নগেশদা। আজ উনি একটা ধোপদুরস্ত শাদা শার্ট পড়েছেন, ধুতিও নীল লাগিয়ে কাচা। শীতের হালকা আমেজ, তাই গায়ে একটি চারটাকার মেটে রঙের মলিদা। আর আজকে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ির জায়গায় পরিপাটি করে কামানো গাল।

    এসেছেন সুদূর হরিনাভি থেকে ধ্রুপদীয়া সংগীতাচার্য অমরনাথ ভট্টাচার্য। ধপধপে ফর্সা, টাক মাথা, চোখে ছানি, বয়েস সত্তর পেরিয়ে আশি ছোঁয় ছোঁয়। গায়ে গরদের পাঞ্জাবি ও মুখে এক অভিজাত গাম্ভীর্য।

    যে কেউ গান গাইবে বলছে সে নগেশদার কানের কাছে ফিসফিস করছে আর উনি উঁচু আওয়াজে বলছেন--গুরুদেব , এবার বিশ্বনাথ একটি হামীর ( বা জয়জয়ন্তী) গাইতে চায়, আপনি অনুমতি দিন। উনি মাথা নাড়লে সে নবীন গায়ক তাঁর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে তানপুরা পিড়িং পিড়িং সেরে গান ধরছে।

    এর পর অমরনাথ নিজে গাইতে লাগলেন। আগের মত দম নেই, লম্বা তান করতে পারছেন না, তবু সুর লাগানো দেখে ভক্তেরা আহা আহা করে উঠছে।

    এদিকে পুজো শেষ, রাত ফুরিয়ে এল। এবার শান্তিজল নেবার পালা। যজ্ঞের আগুন কখন নিভে গেছে।

    সবাই উঠি উঠি করছে; নগেশদা বললেন--গুরুদেব একটি ঝাঁপতাল গেয়ে শেষ করলেন। অমরনাথ ধরলেন ভৈরবীতে ঝাঁপতাল-- ভবানী দয়ানী, মহাবাক্যবাণী।

    গান শেষ হল। কারও মুখে কথা নেই। নগেশদার অক্ষিগোলকহীন কোটর থেকে জল গড়াচ্ছে।

    একজন নতুন ওয়ার্ডেন এসেছেন-- বিজিত দত্ত। উনি নরেন্দ্রপুর থেকে ইকনমিক্সে অনার্স পাশ করে সাউথ সিঁথিতে কোলকাতা ইউনিভার্সিটির ইকনমিক্স বিল্ডিংয়ে এম এ'র ক্লাস করছেন। দক্ষিণ কোলকাতা থেকে দমদমের কাছে ইকনমিক্স বিল্ডিংয়ে রোজ যাতায়াত করে ক্লাস করা প্রায় না-মুমকিন।

    তাই ব্যব্স্থা হল যে উনি আমাদের ওয়ার্ডেন হওয়ার শর্তে আশ্রমে পেটভাতায় থাকবেন, এখানে থাকলে সময়মত ক্লাসে হাজির হতে পারবেন। উনি অন্য ওয়ার্ডেনদের মত ধুতি পড়তেন না। আসমানি নীল রঙের স্লিপিং স্যুট পরে থাকতেন। আশ্রমের মধ্যে সেটা প্রায় ফ্যাশন শোয়ের মর্যাদা লাভ করল।

    লম্বা ফর্সা চোপসানো গাল ও গর্তে বসা চোখের বিজিতদার মুখে সারাক্ষণ একটি অনাবিল হাসি লেগে থাকত। উনি আমাদের পড়াতেন না, টেবিল টেনিস খেলতে শেখাতেন। গল্প বলতেন--নানারকমের গল্প। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বন্ধুদের হয়ে প্রক্সি দেওয়া ডাকসাইটে মেয়েদের গল্প। এবং অবশ্যই কিছু যৌনগন্ধী গল্প ও জোকস্।

    আস্তে আস্তে উনি আমাদের বন্ধু হয়ে গেলেন।

    একদিন ক্লাস সেভেনের একটা নতুন ভর্তি হওয়া বাঁদর ছেলে ওনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছড়া শোনালঃ

    খ্যাঁচাদাদা যায়,
    নীল পাজামা গায়,
    বড় বড় মেয়েরা কেউ ফিরে না তাকায়,
    খ্যাঁচা ফিরে ফিরে চায়।
    উনি আমাদের ঘটনাটা বলেন নি। কিন্তু আমরা ছেলেটাকে ডেকে এনে ভাল করে চাঁটালাম। পরে বিজিতদা যখন ছেলেটার ঘরে রাত্তিরে দরজা কেন বন্ধ নয় দেখে ঠেলে ঢুকতে গেলেন, অন্ধকারে ৪৫ ডিগ্রিতে ভেজিয়ে রাখা দরজাটার মাথায় রাখা এনসিসির বুট ও একটা মুড়ো ঝাঁটা ওঁর মাথায় পড়ল। চিৎকার চেঁচামেচির পরে আলো জ্বললে দেখা গেল ঝাঁটার মধ্যে গুঁজে রাখা একটা কালির দোয়াতও মুখ খুলে রাখা ছিল!

    ওই ঘটনার পর থেকে ওয়ার্ডেন বিজিত দত্ত আমাদের সঙ্গে আরও মাই ডিয়ার হয়ে গেলেন। একেবারে হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না!

    যদিও নীচুক্লাসের ছেলেপুলেরা কিঞ্চিৎ হতাশ।

    কিন্তু আমাদের কপালটাই খারাপ। এই মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন চলেনি। কোনটাই বা চলে! দুমাসের মাথায় ঘটনাচক্রে সেই বিজিতদার সঙ্গেই ক্লাস টেন ও ইলেভেনের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায় দাঁড়িয়ে গেল।

    টালা পার্কে বিরাট মেলা। তাতে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিরাট একজিবিশন। আবার টেলিভিশন রাখা আছে। সেখানে গিয়ে চার আনা দিয়ে আপনিও গান গাইতে পারেন। পুরো পাবলিক আপনাকে পর্দায় গাইতে দেখবে। তবে দিনটা রোববার। ঠিক হল, আগে দুপুর বেলায় আমরা ময়দানে যাব। ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডানের ম্যাচ দেখব। তারপর সেখান থেকে টালা পার্কের প্রদর্শনী দেখে আশ্রমে ফিরব। পুরো প্রোগ্রাম ছকে নিয়ে আমরা সেক্রেটারি মহারাজের সঙ্গে দেখা করলাম।

    উনি ও মেজ মহারাজ রাজি। কিন্তু এতগুলো ছেলে, প্রায় পনের জন, তার জন্যে আশ্রমের ডজ ভ্যানটা দেওয়া সম্ভব নয়। সবাইকে বাসে যেতে হবে। আর একজন ক্যাপ্টেন হয়ে আগে ভাগে সবার থেকে ভাড়ার টাকাটা জমা নেবে।

    সব হিসেবমত চলছিল।

    কিন্তু সেই চোরাগোপ্তা শ্রেণীসংগ্রাম! একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। ক্লাস এইটের ছেলেগুলো মহারাজকে গিয়ে বলল-- ওরা যাচ্ছে, তো আমরা কি দোষ করলাম? আমাদেরও পারমিশন দিন।

    --তোমরা ছোট।

    --কীসের ছোট? আমরা দুজন তো প্রদ্যুম্নের সঙ্গেই পড়তাম। আমরা দুজন ক্যাপ্টেন হয়ে আমাদের ক্লাসের ছেলেগুলোকে সামলে সুমলে নিয়ে যাব।

    -- এ হয় না। এতগুলো বাচ্চাকে তোমাদের দুজনের ভরসায় ছাড়া যায় না। হ্যাঁ, যদি কোন ওয়ার্ডেন সঙ্গে যেতে রাজি হন, তো ভেবে দেখতে পারি।

    ওরা হোমওয়ার্ক করেই এসেছিল।

    নরেশ বলল-- ঠিক বলেছেন মহারাজ। আমরা এটা আগেই ভেবেছি। নীচের তলার ওয়ার্ডেন বিনুদা রাজি হয়েছেন। আমরা শুধু পয়সা তুলে ওনার হাতে জমা দেব। উনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন -- কোন অসুবিধে হবে না।

    বড় মহারাজ পুরো একমিনিট নরেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন--আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা যাবে।

    কিন্তু মেজমহারাজ সেই ধর্মক্লাসের সময় থেকেই আমাদের উপর চটে ছিলেন। উনি বললেন--একযাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? ক্লাস টেনের ছেলেরাও ওদের ওয়ার্ডেনকে সঙ্গে নিয়ে যাক, নইলে হবে না।

    ক্লাস এইট মহা খুশি।

    আমরা বল্লাম-- কুছ পরোয়া নেই। বিজিত দত্তকে রাজি করানো কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু কোথায় খচ হচ করছিল-- সিনিয়র ব্যাচের কোন মান-ইজ্জত নেই? ক্লাস এইটের নিয়ম আমাদের জন্যেও?

    ভুল বলিনি। উনি রাজি হয়েছেন ---বড় ও মেজমহারাজ দুজনকেই জানিয়ে দিলাম। ব্যস্, হোস্টেলে সাজো সাজো রব। সবাই গড়ের মাঠের ফুটবল দেখার নামে প্রায় নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে। পরিমল দে বলে-- খড়দহ না বালি কোথাকার যেন--একজন নতুন প্লেয়ার খেলবে, তার পায়ের কাজ নাকি দেখার মতো।

    কেউ কেউ বলল-- ও আমাদের পাড়ার ছেলে, জানিস? ওর পাড়ার নাম জংলা।

    যাওয়ার দিন আমরা খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়েছি --কিন্তু বিজিতদার দেখা নেই। উনি সকাল থেকেই বেপাত্তা, কোথায় গেছেন কেউ জানে না। আমরা জানি উনি ঠিক সময়ে এসে পড়বেন। ঘড়ির কাঁটা অন্যদিনের থেকে তাড়াতাড়ি ঘুরছে। এইটের ছেলেরা সেজেগুজে ওদের ওয়ার্ডেন বিনুদার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে নরেশ ট্যারা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর সঙ্গীকে বলল-- একটা ইংরেজি প্রোভার্ব শুনেছিস? ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস্!

    ওর সঙ্গী দোহার ধরল--ধুস্, ওসব পুরনো। আজকের লেটেস্ট শুনে নে। টেন প্রোপোজেস্, বিজিত ডিস্পোজেস্! হ্যা-হ্যা হ্যা-হ্যা!

    নাঃ, বিজিতদার কোন পাত্তা নেই। শেষে কি আমরা যারা পুরো প্রোগ্রামটাই বানালাম --আমরাই যেতে পারব না?

    আমরা তৈরি হয়ে বড় ও মেজ মহারাজকে ধরলাম।

    --আমরা সিনিয়র, ওয়ার্ডেন ছাড়াই যেতে দিন। কোন গন্ডোগোল হবেনা।

    মেজ মহারাজ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন। তা হয় না। ওয়ার্ডেন আসলে তবেই, নইলে নয়।

    এমন সময় প্রশান্ত দৌড়তে দৌড়তে অফিসে ঢুকল। বিজিতদা এসে গেছেন। কোন সমস্যাই নেই।

    আমরা আবার লাফালাফি করে দোতলায় নিজেদের ঘরে। বিজিতদা জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় পাজামা পরে লম্বা হয়েছেন।

    -- এ কী স্যার ! শিগগির তৈরি হয়ে নিন। একদম সময় নেই। এক্ষুণি বেরোতে হবে।

    --কোথায়?

    --কোথায় মানে? আগে গড়ের মাঠ, তারপর টালা পার্ক।

    --তোমরা যাও।

    -- কী বলছেন! আপনি না গেলে অমাদের যেতে দেওয়া হবে না, জানেনই তো!

    --আমি টায়র্ড, পারব না।

    --এসব কি বলছেন বিজিতদা? সেদিন যে কথা দিলেন?

    উনি মুচকি মুচকি হাসছেন।

    -- মিন্টু দাশগুপ্তের লেটেস্ট প্যারডি গানটা শুনেছ? সঙ্গম সিনেমার গানের?

    'আমার চিঠিখানা পাবার পর, আমাকে তুমি নিজে ভুল বুঝো না।
    যে কথা দিয়েছিলেম গো,
    সেকথা আমি ফিরিয়ে নিলেম গো।'
    তোমরা অন্য কোন ওয়ার্ডেনকে বল।

    -- বিজিতদা! স্যার! প্লীজ, এখন সময় নেই। উঠুন, জামাপ্যান্ট পরে নিন।

    --বললাম তো! অনেকগুলো ক্লাস ছিল। ভীষণ টায়ার্ড। অন্য কাউকে-- গুরু অমিয়দা খিঁচিয়ে ওঠে।

    --আগে বলেন নি কেন? এখন বলছেন? শেষ সময়ে কাকে বলব? ইয়ার্কি মারার আর-- ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন রোগা তালঢ্যাঙা বিজিতদা--যেন নোয়ানো বাঁশের ঝাড়ের একটা কচি।

    --বেরিয়ে যাও! অল অফ ইউ! জাস্ট গেট আউট!

    পরের দিন রাত্তিরে দশটা নাগাদ একটা গুজব কানাঘুষোয় গোটা আশ্রমে ছড়িয়ে পড়ল। রাত আটটা থেকে ন'টার মধ্যে যখন ফার্স্ট ব্যচ খেতে বসেছে, ঘরগুলো খালি, তখন কে বা কারা সুজিতদার ঘরের জানলা দিয়ে ওঁর বিছানায় কোন কড়া অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। বিছানার চাদর ফুটো ফুটো, ভাঁজকরা লেপে পুড়ে তুলো বেরিয়ে পরেছে। হ্যাঙারে ঝোলানো দুটো টেরিলিনের শার্ট-- সেগুলোও গেছে।

    সুজিতদা প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত।

    --ওরা আমাকে মারতেই চেয়েছিল। ভাগ্যিস খেতে গিয়েছিলাম। ঠাকুর রক্ষে করেছেন।

    দুদিন পরে সোমবার। স্কুল শুরু হবে সকাল আটটায়, কারণ গরম বেড়ে গেছে। এইভাবে দু' সপ্তাহ চলবে, তারপর ছুটি।

    মিটিংয়ে ঠিক হল আমরা পালা করে ক্লাস বাংক করব। প্রথম দিন বিপ্লব ও প্রশান্তের সায়েন্স এর প্র্যাকটিক্যাল আছে, ধরা পরে যাবে। ফলে প্রথম দু'দিন আমি আর গুরু। পরের দু'দিন ওরা।

    সেইভাবে তৈরি হলাম। চৌকির নীচে খালি জায়গাটা জল দিয়ে মুছে সতরঞ্চি পেতে দুজনের বালিশ ফিট করা হল। তক্তপোষের ওপরে টানটান বিছানা। একটা ডবল সাইজের চাদর মেজে অব্দি ঝোলানো, যাতে কারও চোখ চৌকির নীচে না যায়।

    এই প্ল্যানের কথা মানস জানে না। ও যে মেজমহারাজের স্পাই। ও বেরিয়ে গেলে বিপ্লব ও প্রশান্ত বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে চাবি নিয়ে চলে গেল। তাতে কি! আমি দরজার কড়ার একটার নাট ঘরের ভেতর থেকে সাঁড়াশি দিয়ে আলগা করে আবার হালকা করে লাগিয়ে দিয়েছি। বাথরুম পেলে হাত দিয়েই নাট খুলে নেব, তালাশুদ্ধ জোড়া কড়া আলগা হয়ে যাবে। ফিরে এসে আবার ভেতর থেকে নাট লাগিয়ে নেব। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো-- কোন কথা হবে না।

    এমন চমৎকার প্ল্যান! কিন্তু এবার ভগবান আমার সঙ্গে নেই।

    খানিকক্ষণ নীচু স্বরে গল্প করতে করতে দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গাঢ় ঘুমে তখন একটা হেরে যাওয়া টেনিস বলের পুরনো ম্যাচ রি-ওয়াইন্ড করে আবার স্বপ্নে দেখছি--এবার হয়তো জিতে যাব।

    এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কারা যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, নীচু গলায় কথা বলছে। কিস্যু মাথায় ঢুকছে না।

    ধরা পড়ে গেলাম? কেউ বেইমানি করেছে? কোন শালা!

    চাদরের তলা দিয়ে ফ্লোর লেভেল থেকে চোখ রেখে যা দেখলাম তাতে আমার ভয়ের চোটে হাত-পা পেটের ভেতরে!

    ঘরের মধ্যে তিনজন হাঁটাচলা করছে ও নীচু গলায় পরামর্শ করছে।

    একজন বিজিতদা ওয়ার্ডেন, আর একজন চামচা মানস, ও নির্ঘাৎ ঘরের চাবি বিপ্লবদের থেকে চেয়ে এনেছে। কিন্তু তৃতীয়জন? আমাদের কেমিস্ট্রির এড-- সুনন্দ স্যার।

    অমন কড়া কেমিস্ট্রির এইচ ও ডি সুনন্দ স্যার, রোজ সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে আশ্রমের গেটের উল্টোদিকে জয়শ্রী সিনেমার পাশে ওঁর বন্ধুর ইলেকট্রিক গুডস্ এর দোকানে বসে আড্ডা মারেন। কিন্তু ক্লাসে উনি টেরর। ওঁর সেট ডায়লগ--ওরে দিনের বেলায় আকাশে তারা দেখিয়ে ছাড়ব!

    তা উনি স্কুল ছেড়ে চুপিচুপি আমাদের ঘরে! কেসটা কী?

    ধরাপড়ার ভয়ের থেকেও কৌতুহল বেশি। নাকটা বাড়ালাম। না, ওঁরা কিছুই টের পার নি। আর মানস দালাল হলেও আসলে একটি ঢেঁড়স।

    দেখি, বিজিতদা কোথাথেকে একটা মাস্টার কী জোগাড় করেছেন। তাই দিয়ে কাঠের র‌্যাকের উপরে রাখা আমাদের চারজনের ট্রাংক একে কে খুলছেন আর মানসকে জিগ্যেস করছেন কোনটা কার ট্রাঙ্ক। যা বুঝলাম, গুরুর ট্রাংক সার্চ করা হয়ে গেছে। এবার আমার পালা। জামাকাপড় হাটকে একটা পানামা সিগ্রেটের প্যাকেট বেরল।

    এবার আমার ফাঁসি হবে। কিন্তু কোনভাবে যদি বেঁচে ফিরি তো মানসকে দেখে নেব। মনে পড়ল গার্লস স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস থ্রি তে হাতের লেখা লিখতে হত। রেখা বলে মেয়েটি লিখেছিল --পাপের বেতন মৃত্যু। কথাটা এখন মনে পড়ে গেল।

    কিন্তু সিগ্রেটের প্যাকেটের মতো মারাত্মক কন্ট্রাব্যান্ড পেয়েও সার্চ পার্টির কোন হেলদোল নেই। ওরা এর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছেন। তবে কি ওঁরা অন্য কিছু খুঁজছেন? কী সেটা? বিপ্লবের ট্রাংক খুলতেই --ইউরেকা! বিজিতদা ও মানসের মুখে একগাল হাসি। কোণা থেকে বেরল খাবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখা একটা বীকার। তাতে টলটল করছে একটা তরল পদার্থ।

    অ্যাসিড! সেরেছে। তবে কি বিপ্লবই বিজিতদার বিছানায় অ্যাসিড ঢেলেছে? কী করি! কীভাবে ওদের খবর পাঠাই? গুরুকে ঘুম থেকে তুলতে গেলে সার্চ পার্টি টের পেয়ে যাবে।

    পোদো, তুই এখন মহাভারতের সঞ্জয় হয়ে যা। অর্জুন হওয়া তোর কপালে নেই।

    এবার বিজিতদা তুলে ধরল একটা পুরনো নোংরা ঘরমোছার ন্যাকড়া গোছের একটা টুকরো কাপড়। সুনন্দস্যার সন্তর্পণে বীকার থেকে একটু অ্যাসিড ঢাললেন। নাঃ, কোন ধোঁয়া নয়, কিছু নয়। বীকারের দশফোঁটা অ্যাসিড ওই ন্যাকড়া বেমালুম হজম করে নিল।

    সুনন্দস্যার মুখ বেঁকালেন।--এটা নয়।

    এরপর প্রশান্তর ট্রাংক। ওর ট্রাংক থেকেও ওইরকম একটা বীকার বেরল। সেটার থেকেও দশফোঁটা ওই কাপড়ে ঢালা হলে স্যার মাথা নেড়ে বললেন-- নাঃ। এগুলো একটাও নয়। ক্রুদ্ধ হতাশ বিজিতদা এবার ওই কাপড়টার কোণা দুহাতে ধরে মারলেন একটা হ্যাঁচকা টান। ফ্যাঁস করে শব্দ হল। একটা কানি ছিঁড়ে আলগা হয়ে বিজিতদার হাত থেকে ঝুলতে লাগল।

    উল্লসিত বিজিতদা বললেন-- দেখলেন স্যার? এরাই আসল কালপ্রিট।

    স্যারের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর।

    --না ভাই বিজিত; ওটা আপনি জোর লাগিয়ে টেনে ছিঁড়লেন, পচা কাপড়। আপনার বিছানায় জামাকাপড়ে ঢালা হয়েছে সালফিউরিক অ্যাসিড। সম্ভবতঃ যেগুলো পায়খানা সাফ করতে কাজে আসে। আর এগুলো হল হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। এতে অমন করে লেপে ফুটো হয় না। বিজিতদা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।

    --স্যার, এরা ল্যাব থেকে অ্যাসিড চুরি করে লুকিয়ে রেখেছে। কেন? হয়তো ওই সালফিউরিক অ্যাসিড ওরাই এনেছে, কিন্তু অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ভাল করে জেরা করলেই জানা যাবে।

    সন্ধ্যেবেলা পুরো ক্লাস টেন এর প্যারেড নিলেন বড় মহারাজ।

    --এসব কী শুরু হয়েছে? তোরা ভেবেছিসটা কী? সাপের পাঁচ পা দেখেছিস! ওয়ার্ডেনের বিছানায় জামাকাপড়ে অ্যাসিড ঢেকে দেওয়া? ল্যাব থেকে অ্যাসিড চুরি করে আনা! তোরা কী চাস? আর বিপ্লব ও প্রশান্ত, সত্যি কথাটা বলে ফেল। কে অমন নোংরা কাজটি করেছে? বলবে না?

    মেজমহারাজ বললেন-- মুখ খোলানোর কায়দা আমার জানা আছে। এই যে আমাদের গুডবয় প্রদ্যুম্ন। তুমিই বলে ফেল, তোমাদের ঘরে অ্যাসিড লুকিয়ে রাখা হচ্ছে আর তুমিই জান না?

    --- ঠিক বলেছেন মহারাজ, আমাদের ঘরের ব্যাপার হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম। কিন্তু কে বলেছে যে আমাদের ঘরে অ্যাসিড পাওয়া গেছে? আমি বিশ্বাস করি না।

    -- কী বলছ? বিজিত ও কেমিস্ট্রির স্যারের সামনে বিপ্লব আর প্রশান্তর ট্রাংক খুলে অ্যাসিড পাওয়া গেছে।

    -- হতে পারে না! বিজিতদা মিথ্যে কথা বলছেন। উনি কী করে জানবেন কোনটা প্রশান্তর আর কোনটা বিপ্লবের? ওদের সামনে কেন খোলা হয় নি? আর ওরা দুজন ক্লাসে রইল, চাবি ওদের পকেটে অথচ ওদের ট্রাংক খোলা হয়ে গেল? বিজিতদা ম্যাজিক জানেন নাকি? সব মিথ্যে কথা। কেমিস্ট্রির স্যারকে কার না কার ট্রাংক দেখানো হয়েছে!

    --শাট আপ্। মানস তোমাদের রুম পার্টনার। ও দেখিয়ে দিয়েছে কোনটা কার; আর ওই একটা মাস্টার কী দিয়ে ওগুলো খুলেছে।

    -- সরি মহারাজ। কারও পারমিশন ছাড়া তার বাক্সপ্যাঁটরা হাটকানো ও অন্য চাবি দিয়ে খোলা চুরির পর্যায়ে পড়ে।

    এখন যদি প্রশান্ত আপনার কাছে রাইটিং এ নালিশ করে যে আজ সন্ধ্যের পর থেকে ও বাক্স খুলে একশ টাকার খুচরো পাচ্ছে না--তো আপনি নিশ্চয়ই তারও তদন্ত করবেন?

    মহারাজ প্রশান্ত ও বিপ্লবের মুখে দিকে তাকালেন। ওরা আস্তে করে ওপর নীচে মাথা নাড়ল। মেজমহারাজ ধৈর্য হারালেন।

    -- চোরের মায়ের বড় গলা! এই দুজনকে এখনই সাতদিনের জন্যে সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। আর এই অকালপক্ক উকিল প্রদ্যুম্ন? তুইও এর মধ্যে আছিস, এতে কোন সন্দেহ নেই। দু'দিন সময় দিলাম। ভাল করে ভেবে নে। দোষ স্বীকার করলে শাস্তি কম হবে।

    অ্যাসিড কান্ডে সারা আশ্রম তোলপাড়।

    দুটো সিনিয়র ছেলে --লেখাপড়ায় ভাল-- সাসপেন্ড হবে।

    আমরা গিয়ে মহারাজকে বললাম-- যা করি নি তার শাস্তি কেন ভোগ করব? বিজিতদার কথা ছাড়ুন; উনি একপক্ষ কাজেই বায়াসড্। যদি কেমিস্ট্রির হেড সুনন্দ স্যার বলেন যে এই দুজনের কাছ থেকে যে অ্যাসিড পাওয়া গেছে সেটাই আসল জিনিস তো মেনে নেব। আপনি ওনাকে ডেকে জিগ্যেস করুন।

    এদিকে আমরা ডেসপারেট; সুনন্দ স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম।

    স্যার একটু দেখুন না! আপনার নাম করে মহারাজ এই দুই ছাত্রকে সাসপেন্ড করছেন। আপনি যা সত্যি তাই বলবেন-- বিজিতদা একটা পচা ন্যাকড়া ছিঁড়ে বলছেন যে ওটা নাকি আপনার সামনে অ্যাসিড ঢেলে পরীক্ষা করা হয়েছে । আপনি তো জানেন ওটা সালফিউরিক অ্যাসিড নয়।

    স্যার গম্ভীর; এক এক করে আমাদের মুখে চোখ বোলালেন। তারপর বললেন--চিন্তা কর না; যেটা সত্যি সেটাই বলব।

    আমরা ফিরে আসছি--উনি ডাকলেন। অ্যাই শোন, এই কালো ছেলেটা! কোন ক্লাসে পড়িস? তুই তো আমার ছাত্র নোস্!

    --না স্যার, ক্লাস টেন আর্টস্।

    --বটে, তুই কী করে জানলি যে বিজিত নিজে জোর লাগিয়ে ন্যাকড়া ছিঁড়েছিল আর আমি বলেছি যে ওর ঘরে যে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে সেটা সালফিউরিক?

    বক্কেশ্বর শ্রীমান পোদোর মুখে কেউ লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিয়েছে।

    --কী রে বল? এমনি এমনি চলে যাবি? না বললে তোকে দিনের বেলায় তারা দেখিয়ে ছাড়ব। রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে! যা থাকে কপালে!

    ঠাকুরের নাম নিয়ে ডাইভ মেরে স্যারের পা ছুঁয়ে দিলাম।

    --একী একী! ওঠ, উঠে সত্যি কথাটা বল।

    --স্যার, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি। আমার সেদিন শরীরটা ভাল ছিল না। খাটের নীচে বিছানা করে ঘুমোচ্ছিলাম। আপনারা যখন সার্চ করছিলেন আমি তখন জেগে গেছলাম। প্লীজ স্যার, এসব মহারাজকে বলবেন না।

    --বেরিয়ে যা ! যত বাঁদরের পাল আশ্রমে জুটেছে।

    আমরা প্রায় দৌড়ে বেরোলাম। কানে এল দোর্দন্ডপ্রতাপ সুনন্দস্যার হো-হো করে হাসছেন।

    সুনন্দস্যার মহারাজের প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথাই বলেছিলেন। এমনকি এটাও বলেছিলেন, সায়েন্সের নতুন স্টুডেন্টরা অমন একটু আদহ্টু বিউরেট, পিপেট, বীকার ঘরে নিয়ে আসে। এটা নিয়ে উনি ছেলেদুটোকে বকে দেবেন। আলাদা করে শাস্তি দেওয়ার দরকার নেই।

    সরকারি ভাবে অ্যাসিড কান্ডের সেখানেই ইতি। ওটা রহস্য হয়েই রইল।

    ফুটনোটঃ

    মূল ঘটনার সাতদিন পরে একদিন শ্রীমান পোদো বিকেলে খেলার মাঠে না গিয়ে লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করাল-- স্বামী অভেদানন্দের "মরণের পারে"। তারপর বই বগলদাবা করে হোস্টেলে ফিরে এল। প্রেয়ারের ঘন্টা না পড়া অব্দি জমিয়ে পড়বে।

    কিন্তু ঘর যে বন্ধ। কী আপদ, বার বার কড়া নেড়েও কোন সাড়া নেই। কোন শালা ভেতরে ঘোড়া বেচে ঘুমুচ্ছে! সবাই খেলার মাঠে, নইলে ওর দরজায় ধাক্কার চোটে দোতলায় ভীড় জমে যেত।

    অবশেষে দ্বার খুলিল এবং পোদোর প্রবেশমাত্র পুনঃ বন্ধ হইল, তথা দ্রুত খিল আঁটিয়া দেওয়া হইল।

    ঘরের মধ্যে অপরাধী মুখে দাঁড়াইয়া দুইটি প্রাণী-- গুরু অমিয়দা ও উঁহার দক্ষিণহস্ত প্রশান্ত।

    না, দাঁড়াইয়া বলিলে ভুল হইবে, উভয়েই উবুড় হইয়া বসিয়া ঘর মোছার বালতিতে ন্যাকড়া ডুবাইয়া মেজে পরিষ্কার করিতে রত। কিন্তু ঘর কেরোসিন ও সরিষার তেলের গন্ধে পরিপূর্ণ। উহারা তেল ও কেরোসিন দিয়া ঘর মুছিতেছে! কী কারণে?

    কিংকর্তব্যবিমুঢ় পোদো বিছানায় উঠিয়া বসিল।

    সহসা তাহার দৃষ্টিপথে ধরা দিল প্রশান্তর জানলার উপরে নয়ফুট উঁচুতে একটি ঘুলঘুলি যে স্থানে চড়াইপক্ষী খড়কুটো দিয়া বাসা বাঁধিয়াছে। সেখান হইতে একটি ধারা দেওয়াল বাহিয়া মেজে পর্য্যন্ত পৌঁছিয়াছে এবং তাহার কটু গন্ধ কেরোসিন তেলের গন্ধেও চাপা পড়ে নাই।

    পোদোর মাথায় টিউবলাইট জ্বলিয়া উঠিল। সে চক্ষু গোল গোল করিয়া গুরুকে বলিল-- তাহলে তোমরাই! এতবড় অপারেশনটা দুজনে মিলে করলে--গুরু আর ডানহাত, বাঁহাত টের পেল না! এ বহোত না ইনসাফি!

    গুরু দাঁত বের করল। শোন-- ডানহাতের কথা বাঁ হাত জানবে না।সব সাকসেসফুল অপারেশনের এটাই মন্ত্র। রাগ করিস নে! তোকে বললে তুই রাজি হতিস না। উল্টে না করতিস। কাজটা ঠিক করি নি। কিন্তু তখন ঝোঁকের মাথায়।

    --কিসের সাকসেস? ঘরের মধ্যে ছড়িয়েছ, একটু পরে মানস বিপ্লব সব জেনে যাবে।

    -- না, জানবে না। জমাদার বৃহস্পতি দাস মুখ খুলবে না। এটা দোয়াতে করে ঘুলঘুলিতে চড়াইয়ের বাসায় রেখে দিয়েছিলাম, কিন্তু আজকে ওদের নড়াচড়ায় বোধহয় উল্টে গেছে। ঘরমোছা শেষ হলে সব দরজা জানলা খুলে রেখে দেব, গন্ধ চলে যাবে।

    কিন্তু এই গল্পটা আশ্রম ছাড়া পর্য্যন্ত কাউকে বলবি না। তোর প্রাণের বন্ধু বিপ্লবকেও না।

    ।।১৪।।

    অ্যাসিড রহস্যের ফলশ্রুতিতে আশ্রম জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন হল।

    বিজিতদাকে ওনার অনুরোধে একতলায় লোয়ার ক্লাসের বাচ্চাদের ওয়ার্ডেন করে দেওয়া হল। দোতলায় টেন ও ইলেভেনের জন্যে কোন ওয়ার্ডেন থাকবে না। কাছেই হেডস্যার আছেন। ফলে বেয়াড়া ছেলেপুলেরা একটু সমঝে চলবে।

    হ্যাঁ, মানস এর রুম বদলে গেল। ট্রাঙ্ক খোলার ব্যাপারের ওর সক্রিয় ভূমিকার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় জুনিয়র ব্যাচের ছেলেরা পর্য্যন্ত ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে দালাল--দালু-পচা আলু এসব বলতে আরম্ভ করল। প্রশান্ত ওকে সবার সামনে ডেকে বলল-- একশ' টাকা ফেরত দে।

    --কিসের টাকা?

    --যেটা আমার ট্রাঙ্ক থেকে নিয়েছিলি?

    -- বাজে কথা! আমি আবার কবে তোর ট্রাঙ্ক থেকে টাকা নিলাম?

    -- তা জানি না। তবে তুই মাস্টার কী দিয়ে আমাদের ট্রাঙ্ক খুলতে পারিস --কাউকে না জানিয়ে --এটা তো সত্যি! চুপি চুপি কতবার খুলেছিস তার ঠিক আছে? দেখছি ট্রাঙ্কে টাকা নেই। তুই ছাড়া কে করতে পারে?

    -- মানস, টাকাটা দিয়ে দে।

    আমাদের গুরুর গলার স্বর খাদে নামা, ক্যাজুয়াল।

    বিব্রত মানস আমাদের সবার মুখের দিকে অনুনয়ের ভঙ্গিতে তাকায়। আমরা কোন কথা বলি না।

    তারপর কোন কথা না বলে বিছানা থেকে উঠে গটগটিয়ে বেরিয়ে যায়।

    মানস ফিরল দু'ঘন্টা পরে। তখন প্রেয়ারের সময় হতে বেশি বাকি নেই। সোজা নিজের বিছানা জামাকাপড় বইপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। তার আগে কারও দিকে না তাকিয়ে বলল-- মেজমহারাজ আমাকে নীচের তলায় ১৫ নম্বর ঘরে বদলি করে দিয়েছেন।

    পরে জানলাম, ও মহারাজদের কাছে রুম বদলে দেওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করেছে। ওঁরা প্রথমে রাজি হন নি। দশদিন পরেই গরমের ছুটি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও ভয় পাচ্ছে ওর গায়েই না কেউ অ্যাসিড ঢেকে দেয়। ওর অবস্থা দেখে মহারাজরা মেনে নিলেন। আগামী দশদিন পর্য্যন্ত আমরা চারজন, মানসের তক্তপোষ খালিই থাকবে।

    বিপ্লব বলে-- আপদ গেছে, বেশ হয়েছে। থাকলে আরও ঝাড় খেত।

    শুধু বিজিতদা নয়, মানস নয়, বদলে গেল অনেক কিছু, বদলে যাচ্ছিলাম আমিও।

    শেষ শনিবারে প্রশান্ত বাড়ি গেছে। পরের শনিবারে হস্টেল বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে আমাদের গুরু পেটের অসুখে সিকরুমে ভর্তি হয়ে পেঁপে সেদ্ধ খাচ্ছে আর ভাবছে কবে ছাড়া পাবে! গোটা ঘরে খালি আমরা দুজন। আমি আর বিপ্লব।

    সেই এডিটোরিয়াল মিটিংয়ে ওর আমাকে নিয়ে সবার সঙ্গে তাল দিয়ে হ্যা--হ্যা একটুও ভাল লাগেনি। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে বিপ্লব যেভাবে আমার সাহিত্যবোধ বা কবিতাপ্রীতি নিয়ে ছ্যাবলামি করছিল, খোরাক করছিল। আমি তো বরাবর ওর জন্যে স্ট্যান্ড নিয়েছি। অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি। এত তু ব্রুটি!

    আমি ওকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম। ও আলাদা করে কথা বলার চেষ্টা করছিল, আমি পাত্তা দিইনি।

    আমি টিউটোরিয়াল অব্দি ঘরেই এলাম না। বিপ্লব আমার দিকে বারবার অনুনয়ের চোখে তাকাচ্ছে। শেষে খেয়ে দেয়ে ঘরে এসে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও বলল-- একটু কথা ছিল।

    --কাল সকালে, এখন ঘুম পাচ্ছে।

    রাত কত জানি না, কেমন দমবন্ধ হয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। বুকের উপর একটা চাপ। হাঁসফাঁস করে জেগে উঠি।

    বিছানায় কেউ ঢুকেছে, ওর ওজনটা আমার গায়ের উপর এবং একী! আমাকে চুমো খাচ্ছে।

    ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। জোর করে বুকের উপর থেকে চাপটা নামিয়ে দিই।

    বিপ্লব! এখানে কেন?

    --রাগ করেছিস লাকি?

    --চুপচাপ নিজের বিছানায় ফিরে যা!

    -- এত রাগ করে না। আমাকে দুটো থাপ্পড় মার, কিন্তু কথা বন্ধ করিস না লাকি। তুই এমন করলে!

    উঃ কী অসহ্য ন্যাকা কথা বার্তা। কেমন যেন অম্বলের মতো কিছু উঠে আসে। আমি মশারি থেকে হাত বাড়িয়ে লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করি। ও আমাকে জড়িয়ে টেনে ধরে।

    --কেন অমন করছিস? তুই চাইলে আমার সঙ্গে যা খুশি করতে পারিস।

    -- আমি যা চাইব তুই দিবি/ সত্যি করে বল।

    --এই তোকে ছুঁয়ে বলছি। বল তুই কী চাস?

    --- অনেক কিছু। চাই তুই এক্ষুণি নিজের মশারির ভেতরে গিয়ে ঢুকবি। চাই কাল থেকে আমাকে প্রদ্যুম্ন বলেই ডাকবি, কোন লাকি-মিতা নয়। কুকুরের নামে ডাকা আমার পছন্দ নয়। ও অবাক হয়ে বসে থাকে।

    আমি বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দিই।

    -- কী হল , যা!

    ও কেমন লাথি খাওয়া নেড়ি কুকুরের মত ভয় ও আশায় আমার দিকে তাকায়। তারপর নেমে যায়। আমি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খাই। তারপর আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ি।

    পরের দিন থেকে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।


    গরমের ছুটি কাটল একটা ঘোরের মধ্যে।

    স্কুল খুললেই হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। বাংলা ইংরেজি ঠিক আছে। ইকনমিক্স ও সংস্কৃত চলেগা। কিন্তু অংক?

    সেই যে বছরের গোড়ায় সরস্বতীপূজোর সেক্রেটারিগিরি করার আনন্দে পিছিয়ে পড়েছিলাম, তারপর ক্রমশঃ -- আমি যত চলি তত, যাই চলে যাই বহুদূরে।

    ট্রিগোনোমেট্রির কম্পাউন্ড অ্যাংগেল কি যথেষ্ট নয়? আবার মাল্টিপল/সাব-মাল্টিপল এসব কেন? এগুলো কী কাজে আসে? তারপর দেকার্তে বলে দার্শনিকের মাথায় পোকা নড়েছিল, তাই একটা বিন্দুর লোকাস না সঞ্চারপথ নিয়ে সংজ্ঞা বানাতে গেলেন, কেন রে বাবা? ভগবান টগবান নিয়ে ভাবা কি যথেষ্ট নয়? একটা স্ট্রেট লাইন -- তাকে কতরকম ভাবে বলা?

    গ্র্যাডিয়েন্ট, ইন্টারসেপ্ট, প্যারালাল, পারপেন্ডিকুলার ডিসট্যান্স--যা তা!

    কিন্তু এসবকে ছাড়িয়ে উঠেছে একটা অপরাধবোধ, একটা ভয়। এই হোস্টেল-লাইফ কি আমাকে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক করে দিচ্ছে? যৌনতা, স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক আমাদের কুরে কুরে খায়।

    শরীর বদলে যাচ্ছে, আমরাও কি বদলাচ্ছি না? যাদের গোঁফের রেখা নাকের নীচে মন্দমন্থরে দেখা দিচ্ছে তারা বন্ধুদের সার্কেলে হীনমন্যতায় ভোগে। মাকুন্দ বলে একটি নতুন অভিধার সঙ্গে পরিচয় হয়। একজন আঙুলের ডগায় ঘি নিয়ে আরেকজনের নাকের নীচে গালে ঘসে দেয়, সে শিউরে ওঠে। ব্যাপারটা হাতাহাতি পর্য্যন্ত গড়ায়। কেননা সবাই বিশ্বাস করে ঘি লাগালে গোঁফদাড়ি গজাবে না। গাল থাকবে মেয়েদের মতো নরম পেলব হয়ে।

    না, আমরা কেউ মেয়ে হতে চাই না, কিন্তু মেয়েদের চাই।

    এদিকে কথা হয় দেখা না দেখা স্বপ্ন নিয়ে। রমেন কমিক ঢঙে আবৃত্তি করে পাঠ সংকলন থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'অরণ্য'।

    "নিঃস্তব্ধ গম্ভীর ঘোর নিবিড় গহন,
    ঘনপত্র ঝোপে রুদ্ধ রবির কিরণ"।
    তারপর এক ঝটকায় প্যান্ট নামিয়ে দেয়। ও আমাদের চেয়ে এক বছরের বড়। আমরা সুন্দরবন দর্শন করে শিহরিত হই।

    আরও বুদ্ধিমান কেউ আশ্রমের পাঁচিলের বাইরে জয়শ্রী সিনেমার ফুটপাথ থেকে জোগাড় করে এনেছে 'সচিত্র কোকশাস্ত্র'। কোন কাশ্মীরি কোকা পন্ডিতের লেখা নাকি। সপ্তাহের ভাড়া আট আনা। সিনিয়ররা বোঝায়--এখন এটাই ঠিক টেক্সটবুক; বড় হলে কামসূত্র পড়বি।

    পাতলা চটি বইটা হাতে হাতে ঘোরে। তারপর বইওলা ফেরত নিয়ে নেবে।

    এইভাবে আমরা সমস্ত পুরুষ ও নারীকে চার-চারটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করতে শিখি। নিজেদের আত্মদর্শনও হয়।

    এইসব নবলব্ধ জ্ঞান আমার মনে আরও আতংকের সৃষ্টি করে। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে, ভাল ভাবে। নইলে কলেজে অনার্স পাব না। কিন্তু বৃহত্তর জীবনের পরীক্ষায়? সেখানে কি পাসকোর্সই নিয়তি?

    গরমের ছুটিতে তাই পার্কসার্কাসের ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করি। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ময়দানে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাই, সমর্থনে গলা ফাটাই।

    আর বারবার আউড়ে চলি--আমি নর্ম্যাল। বিপ্লব লাকি/মিতা এসব ফালতু। এদের থেকে দুরে সরে যেতে হবে। আমি বিপ্লবের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেছি। বেশ করেছি, ঠিকই তো।

    পুরনো খবরের কাগজ ওজনদরে বেচে দিয়ে সেই পয়সায় দেখি 'ওয়ার্ল্ড বাই নাইট', 'ওরিয়েন্ট বাই নাইট', 'আমেরিকা বাই নাইট'। কিন্তু এসব দেখে মুখ থেকে বেরোয়-- ধুর বাল।

    আমি এখন আর পোদো নই, প্রদ্যুম্ন।

    মেট্রো সিনেমায় সোফিয়া লোরেনের "টু উইমেন" দেখতে গেলে হাফপ্যান্ট পরা প্রদ্যুম্নকে ছ'ফিটের প্রবাদপ্রতিম গেটকিপার ঘাড় ধরে ৬৫ পয়সার লাইন থেকে বের করে দেয়। সমবেত হাসির মাঝে ও আবার পোদো হয়ে যায়, কিন্তু হাল ছাড়ে না। কোনো এক রোববারের মর্নিং শোতে গড়িয়াহাটের আলেয়া সিনেমায় একই সিনেমা ৪১ পয়সায় দেখে নিয়ে পুরোপুরি প্রদ্যুম্ন হয়ে ওঠে।

    গরমের ছুটির পরে হোস্টেল খুলতেই আবার চমক। প্রদ্যুম্নদের 'গ্যাং অফ ফোর’কে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। নাটের গুরু অমিয়দা ও তার তিন কেলে হাঁড়ি --যথা ডান হাত প্রশান্ত ও বাঁ-হাত প্রদ্যুম্ন ও তার সাথী বিপ্লব সব আলাদা ঘরে। এবং প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরে ক্যাপ্টেন। এদের ঘরে অন্য চারজন নাইন ও সেভেনের। ফলে এদের কামরায় কোন ভালমন্দ কিছু ঘটলে এরাই ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে দায়ী থাকবে।

    নিকুচি করেছে ক্যাপ্টেনগিরির!

    প্রদ্যুম্ন বোকার মতন মেজমহারাজকে বলতে গেল যে ক্যাপ্টেন হতে চাই না-- এবং গুছিয়ে প্যাঁক খেল। মেজমহারাজ পুলিশি ভোল পাল্টে মুচকি মুচকি হেসে ওকে বোঝালেন যে ওর মধ্যে লীডারশিপ কোয়ালিটি, পার্সিভিয়ারেন্স, ট্রুথফুলনেস এই সব দেখেই ওকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ও যেন এমন সুযোগ হেলাফেলা করে নষ্ট না করে।

    -- আরে তুমি তো আশ্রমের ভাল চাও। কোন অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ কর। আমাদের কাছে কমপ্লেন নিয়ে আসতে থাক। মহারাজ এ হয়েছে, সে হয়েছে--একটা বিহিত করুন। তাই মনে হল তোমার মতো ছেলেদেরই দায়িত্ব দেওয়া হোক।

    --- কিন্তু মহারাজ, আমাদের রুমে নিজেদের ক্লাসের কোন ছেলে নেই, সব জুনিয়র। তাই বলছিলাম কি অন্ততঃ একজন নিজের ক্লাসের না হলে--।

    --- দেখ, টিউটোরিয়াল তো ক্লাস-ওয়াইজ হবে। তোমাদের মতো ইন্টেলিজেন্ট ছেলেদের জন্য ওটাই যথেষ্ট।

    --- কিন্তু ক্লাস এইটের ছেলেদের তো প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ওরা তো আগের মতো নিজেদের ব্যাচের ছেলেদের সঙ্গেই রুম পেয়েছে।

    -- আরে কোথায় তোমাদের মতো পড়ুয়া সুপার-ইন্টেলিজেন্ট ছেলেদের গ্রুপ আর কোথায় ক্লাস এইটের বখা ছেলের দল! ওদের সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের ছোট কর না। তাছাড়া ওরা হল ছোট, যখন তোমাদের মতো লায়েক হবে—

    রাগে গরগর করতে করতে পোদো নিজেদের রুমে ফিরে এল।

    এছাড়া ওদের দোতলা থেকে নামিয়ে একতলায় রুম দেওয়া হয়েছে, আর ক্লাস এইটের ছেলেরা দোতলায়। ফলে ছোট ছাদের আড্ডা আর সিগ্রেট খাওয়ার স্বাধীনতা ওদের একচেটিয়া হয়ে গেল। এখন বিজিতদা ওদের ওয়ার্ডেন।

    আর পোদোদের কপালে জুটেছে জনৈক বীরেশদা, যিনি সিনিয়র বেসিক স্কুলে পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের নাটক ও অন্যান্য আধুনিক নাটক বেশ ভাল পরিচালনা করেন। পোদো ওর 'শারদোৎসব' ও 'হাস্যকৌতুক' প্রযোজনার মুগ্ধ ভক্তদের একজন। তবে ইদানীং উনি সন্ন্যাস নেবেন বলে সাদা পোষাক আর কাছা না দিয়ে ধুতি পরা শুরু করেছেন। মাথা কামিয়ে নিয়েছেন, নাম হয়েছে ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য।

    বোঝা যাচ্ছে যে এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে আন-সলভড্ অ্যাসিড কান্ডের নিবিড় সম্পর্ক।

    পরের দিন গুরু অমিয়দার ঘরে মিটিং। সবাই মিলে পোদোকে খোঁচাল-- কেন না ভেবে মহারাজের কাছে দরবার করতে গিয়েছিলি? মেজমহারাজ খুব খুশি, ভাবলেন যে তোকে আমরাই ডেলিগেট করে পাঠিয়েছি। আর এও বুঝলেন যে তির লক্ষ্যভেদ করেছে। নতুন ব্যবস্থায় আমরা খাবি খাচ্ছি।

    আর এদিকে আমাদের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে নির্বিকার থাকা, দেখানো যে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তোর গাধামিতে এইটের ছোকরাগুলো হাসির খোরাক পেয়ে গেল। না জিগ্যেস করে একা একা কিছু করবি না, বুঝলি?

    পোদোর মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।

    --- গুরু, আমিই ঠিক।

    --মানে?

    -- ভেবে দেখ, যদি ওরা বোঝে যে আমরা বিচলিত, নতুন ব্যবস্থায় কষ্টে আছি তো যারপরনাই খুশি হবে, তাই তো?

    -- হ্যাঁ; তো? এতে তোর কী লাভ হল?

    --- লাভ এই যে ওরা আর আমাদের পেছনে লাগবে না। যদি ভাবে যে আমরা দিব্যি আছি, কোন প্রবলেম নেই তো ওরা ভেবে ভেবে নতুন প্রবলেম তৈরি করবে। নতুন ফিকির খুঁজবে যাতে আমরা সত্যি সত্যি অসুবিধেয় পড়ি। তার চেয়ে।

    গুরু কোন কথা না বলে ওর প্যাকেট থেকে পোদোকে দুটো পানামা এগিয়ে দেয়।

    যাই বলি আর যাই করি, ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারি যে হেরে গেছি।

    মনটা ছটফট করতে থাকে কিছু একটা করে দেখিয়ে দিতে, ছেলেদের কাছে বাহবা পেতে। করব শালা একটা গেরিলা অ্যাকশন। কাউকে বলব না, গুরুকেও না। দেখিয়ে দেব যে আমি ডানহাত না বাঁহাত। কিন্তু একাই করব? যদি স্ট্র্যাটেজিতে কোন ভুল হয়? ক্লাস এইটের সংস্কৃত বইয়ে একচক্ষু হরিণের গল্পের মতো?

    ইউরেকা! পেয়েছি। আমারই রুমের ক্লাস নাইনের ছেলে প্রেমাংশু। ও একটু আমার ন্যাওটা, বই পড়ে, কিন্তু খেলাধুলোয় কম যায় না। হোস্টেলের বারান্দায় রবারের বল দিয়ে ফুটবল খেলার সময় ওইটুকু জায়গার মধ্যে অসাধারণ ইনসাইড ড্রিবল করে। ওকে আস্তে আস্তে কাল্টিভেট করতে হবে।

    একদিন ও আমার কাছে ট্রিগনোমেট্রির হাইট এন্ড ডিস্ট্যান্সের অংক বুঝতে এল। আমি বললাম-- একটা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন দেখবি? কাউকে বলবি না তো?

    --এই বিদ্যা ছুঁয়ে বলছি, কাউকে না।

    ওর চোখ চক্চক করে।

    --- বেসিক হল পিথাগোরাস থিওরেম। হাইট, বেস, হাইপোটেনিউস।

    -- কিছু বুঝলাম না, প্র্যাকটিক্যালটা কী?

    -- বলছি। মনে কর, ভাঁড়ার ঘর থেকে এককাঁদি কলা সরাতে হবে। দরজায় তো তালা। কী করে করবি? এন্ট্রি পাথ কোথায়? একটু ভাব দেখি।

    -- কলতলার দিকের খোলা জানলা।

    -- করেক্ট। জানলার নীচের পাট বন্ধ, ওপরের পাট খোলা। এবার?

    -- জানলার শিক ভাঙবো? --- ধ্যেৎ; জানলা দিয়ে একটা লম্বা, মুখ বাঁকা লোহার শিক ঢুকিয়ে কলার কাঁদিতে ফাঁসিয়ে জানলা অবদি টেনে আনব। তারপর কলাগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে বের করে নেব। ব্যস্।

    -- দারুণ তো! কিন্তু এর মধ্যে আবার পিথাগোরাস কেন?

    -- আরে শিকের সাইজ ? ছোট হলে চলবে না। বেশি বড় হলে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। কত বড় দরকার কী করে বের করবি? আঁক কষে। এই বার যা পড়িয়েছি সেটা ভাব একটু। ও খানিকক্ষণ চুপ করে মেজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উত্তেজিত হয়ে আস্তে আস্তে বলে--একটা কথা মাথায় এসেছে, রাগ করবে না, বলি?

    দেখ, ফ্লোর লেভেল থেকে জানলার হাইট হল সমকোণী ত্রিভুজের লম্ব; জানলার উচ্চতা থেকে ফ্লোরে রাখা কলার কাঁদিতে তাকালে সেটা হবে অ্যাংগেল অব ডিপ্রেসন। আর ভূমি হল লম্বটির ফ্লোরের উপরের বিন্দু থেকে কলার কাঁদিটির দূরত্ব। তাহলে জনলা থেকে কলার কাঁদিটির দূরত্ব হল অতিভুজ বা হাইপোটেনিউস। এখন জানলার হাইট বাইরে থেকে মেপে নেওয়া যাবে। ভুমির মাপ চোখের আন্দাজে হয়ে যাবে। আর পিথাগোরাস থিওরেম থেকে হাইপোটেনিউস এর মাপটাও আন্দাজ করা জাবে। তাহলে লোহার বাঁকামুখ শিকের দৈর্ঘ্য ওই অতিভুজের চেয়ে সামান্য বেশি রাখতে হবে।

    এমন গুরুমারা চ্যালার মুখোমুখি হয়ে আমার মুখে কথা ফোটে না। খালি বলি-- দু'দিনের মধ্যে শিকটা জোগাড় করে কলতলার কুয়োর পাশে ফেলে রাখ আর আমাকে দেখিয়ে দে। আর অংকটা কষা হয়ে গেলে আমাকে আগে দেখাবি।

    প্রেমাংশুর এলেম আর উৎসাহ আছে। চোখের আন্দাজ থেকে লম্ব ও ভূমির মাপ ও তার থেকে হাইপোটেনিউসের দৈর্ঘের হিসেব কষে ফেলে আমাকে দেখায়। জোগাড় করে ফেলে শিক। মাপে একটু বড়, সেটাই তো দরকার। তারপরে এল সেই দিন।

    অপারেশন কলার কাঁদি!

    সময় ঠিক করেছি রাত দুটো। সবাই গাঢ় ঘুমে। বারান্দায় কোন লাইট নেই। আর ওকে বলেছিলাম মশারি না টাঙিয়ে শুতে, আমিও তাই। ফলে মশার কামড়ে আন্দাজ দেড় থেকে দুটোর মধ্যে ঘুম ভাঙবে।

    ঠিক তাই হল। দুজনে ঘুম থেকে উঠে এক এক করে কলতলার পাশের বাথরুমে চলে গেলাম। তার পর কুয়োর পাড় থেকে শিকটি তুলে সোজা ভাঁড়ার ঘরের পেছনে। জানলার কাঠের ফ্রেমে পা দিয়ে উঠে একটু ঠেলতেই কপাট খুলে গেল। সেখান থেকে শিক ঢুকিয়ে একটা বড় সড় কাঁদি টেনে জানলার কাছে এনেও শিকের ফাঁক দিয়ে বের করা গেল না।

    অতঃ কিম্?

    - আমি কাঁদিটা টেনে রাখছি, তুই একটা একটা করে ছিঁড়ে শিকের ফাঁক দিয়ে বের কর। গোটা পনের বের করা গেল।

    তখন অন্ধকার কুয়োর পাড়ে বসে দুজনে মিলে সেগুলো শেষ করলাম।

    - প্রদ্যুম্নদা, অতগুলো খেতে পারছি না। পেট আইঢাই করছে, ট্রাংকে লুকিয়ে রাখি?

    -- খবরদার না; কাল সবার বাক্স সার্চ হবে, বামাল ধরা পড়ার সম্ভাবনা। যা পারিস খেয়ে নে, বাদবাকি জানলা গলিয়ে আবার স্টোররুমে ফিরিয়ে দিলেই হবে। খাবার জিনিস নষ্ট করা ঠিক নয়।

    অপারেশনের সাফল্যে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। হাসি কুলকুলিয়ে ওঠে।

    কুয়োর পাড়ে কলা খেতে খেতে প্রেমাংশু জিগ্যেস করে--- আচ্ছা, তোমার ভূতের ভয় করে না? এই অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষের রাত!

    --- করত; এখন আর করে না।

    -- আবার দেখ, একটা কালো কুকুর ঘুরঘুর করছে। আচ্ছা, কালো কুকুররা নাকি আসলে পিশাচ, নাকি প্রেতাত্মা? সত্যি ভয় করে না?

    -- যত্ত বাজে কথা।

    শোন, বছর দুই আগে বাথরুম পায়খানা ওই পুকুরপাড়েই ছিল। একবার রাত্তিরে পেটে দিল আমাশার মোচড়। মাঝরাত; ভয়ের চোটে চোখ বুজে মশারির মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে রইলাম। কিন্তু আমাশা বলে কথা।

    উঠে চোখ বুঁজে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পুকুরপাড়ের দিকে দৌড় লাগালাম। পায়খানা পর্যন্ত পৌঁছনো গেল না। প্যান্ট নষ্ট হবার জোগাড়। পুকুরপাড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। ওদিকে মজাপুকুরের পাড়ে সারি সারি নারকোল গাছ হাওয়ায় দুলছে। একটা কালো কুকুরও জুটে গেল, সে আমার পেছন পেছন চেটে চেটে মাটি সাফ করে চলেছে। ব্যস্, আমাশার কাছে ভুতের ভয় হেরে গেল।

    এবার চোখ ঘুমে ঢুলে আসছে।

    কিন্তু প্রেমাংশুর উৎসাহ বেশ সংক্রামক।

    --- প্রদুম্নদা, একটা কথা বলি? স্ট্যান্ডে ঝোলানো ঘন্টা খুলে নিলে কেমন হয়?

    উত্তরে আমি কোন কথা না বলে সোজা ওটা খুলে নামিয়ে নিয়ে এলাম।

    --এবার?

    --- চল, সোজা বড় পাতকো'র মধ্যে ফেলে দেব।

    যেই ভাবা, সেই কাজ।

    --চল, এবার শুয়ে পড়ি।

    --- দাঁড়াও, আমার একটা আধা মাস্টার কী মত আছে। স্টোরের তালা না খুললেও অন্য একটা ঘরের তালা খুলে যায়।

    --অ্যাই কাদের ঘরের?

    --মানসদাদের।

    -- চুপচাপ খুলে নিয়ে আয়। তারপর ওয়ার্ডেন বিজিতদার ঘরে লাগিয়ে দে। আমি গার্ড দিচ্ছি।

    পরের দিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙল বেলা করে। উঠে শুনি তুলকালাম কান্ড।

    হস্টেলের ঘন্টা গায়েব! আদ্দেক ছেলে প্রেয়ার হলে যেতে পারেনি। ওয়ার্ডেন বিজিতদা সকালে দরজা খুলে বেরোতে পারেন নি। বাইরে থেকে কেউ তালা মেরে দিয়েছে। ঘুমচোখে তলপেটে চাপ নিয়ে উনি ঘরে আটকে!

    অন্য কর্মচারিরা অফিস থেকে ডুপ্লিকেট কী এনে তালা খোলে। ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছল। অন্যায়! ঘোরতর অন্যায়! তদন্ত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক!

    কিন্তু বিকেল বেলায় মানস বেদম বেত খেল। ও এক্সপ্লেন করতে পারল না কী করে ওর ঘরের তালা মাঝরাত্তিরে ওয়ার্ডেনের ঘরের দরজায় লেগে গেল।

    কুখ্যাত চামচ বা দালাল মানসের সাতদিন সাসপেনশনের খবরে আশ্রমে মলয় পবন বহিতে লাগিল।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • প্রচ্ছদ | পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | "২১" | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments