|| হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার গল্প (১৯৬১—৬৯) ||
(ভুল বুঝবেন না, এটি মিশনের বা কোন মিশনারি শিক্ষাব্যবস্থার ভ্যালুয়েশন নয়; সে ইচ্ছে বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। পাঁচ বছর ধরে কিশোরবয়সে হস্টেলে থাকার টক-ঝাল-মিষ্টি স্মৃতি আমার সম্পদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে ক'টি প্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, রামকৃষ্ণ মিশন তার অন্যতম। এর সাফল্য-সীমাবদ্ধতা-বিফলতা সময় বলবে। পঞ্চাশ বছর পরে আজকের মিশনের হস্টেলের জীবন নিশ্চয়ই সময়ের চাপে অনেক বদলেছে, যেমন বদলেছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবন। আমার দায় শুধু গভীর ভালবাসায় তেরো-চোদ্দো বছরের চোখে ধরে রাখা স্মৃতির জলছবি আঁকা। এখানে যে কুশীলবদের কথা বলা হয়েছে তাঁদের অনেকে প্রয়াত, কিন্তু অনেকে আমার মতই বুড়ো, কিন্তু দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন। তাই কিছু নাম বদলে দিয়েছি। রঞ্জন নিজেও কখন যেন প্রদ্যুম্ন বা পোদো হয়ে যায়, আবার তার নিজের নামে ফিরে আসে।)
ওরা পাঁচজন। সওয়ার হয়েছে একটা ভাড়া করা চারচাকায়।
ওদের ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণ কোলকাতায়। গাড়ি এগিয়ে চলেছে খান্না সিনেমা, টালা পার্ক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ। গল্পে গল্পে এসে গেল সিঁথির মোড়। গাড়ি এগিয়ে গেল ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের বিদ্যামন্দির। ওরা হইহই করে ওঠে। সেবার আমরা এদের ৩-২ গোলে হারিয়েছিলাম না? নন্দন, তুই একটা বসা ব্যাকভলিতে গোল দিয়েছিলি না? নন্দনের মুখে হাজার ওয়াটের আলো। —হ্যাঁরে, তোদের সত্যি মনে আছে? এবার নবজীবন যুবক সংঘের মাঠ। ওরা গম্ভীর হয়ে যায়। বিজন বলে—একাত্তরে বরানগর হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার জন্যে বকরা করা হয়েছিল এদের মালিক, -কাম -লীডারকে। এই সেই বক্সিং-ব্যায়ামের আখড়া যার ডিক্টেটর ছিলেন ভদ্রলোক, একটু সহজে বার খেতেন আর অহংকারী মাথাগরম টাইপ। জেনে শুনে ওঁকে নকশালদের ঘাঁটি রতনবাবু রোড না কাশীমিত্রের ঘাট কোথায় যেন একা পাঠানো হল, উনি গেলেন আর নকুদের হাতে জবাই হলেন। ব্যস্, এটাই ছিল সিগন্যাল। খুলে হল কসাইখানার দোকান।
শুদ্ধ বলে —উনি কিন্তু আমাদের হস্টেলের কেনারামের জামাইবাবু ছিলেন। ওরা চুপ করে যায়।
জয়শ্রী সিনেমা হল।
—কিরে হরিদাস? তুই সেবার পাঁচিল টপকে জয়শ্রী সিনেমা নাইট শো দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছিলি না?
—ধরা পড়িনি তো! ওসব মহারাজদের পেঁয়াজি।
কিন্তু গাড়ি ভেতরে ঢুকে একপাশে দাঁড়ায়। সরস্বতী পুজোর ভিড়। বরানগরের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রসাদ পেতে আর ঠাকুর দেখতে উপচে পড়েছে।
—জানিস, সেবার আমি পুজোর সেক্রেটারি হয়ে কুমোরটুলিতে ঠাকুর আনতে গিয়ে—
—থাম তো! আরে অফিস আর সেক্রেটারি মহারাজের ঘর প্রায় সেই রকমই রয়ে গেছে; দেখ, দেখ—সেই পঞ্চাশ বছর আগের মত। কিন্তু অমন চমৎকার খেলার মাঠটা নষ্ট করে দিয়েছে মাইরি! এখানে আবার কার মন্দির তুলে দিয়েছে? ছেলেরা এখন কোথায় ফুটবল খেলে?
—দূর শালা! জানিস না নকশাল আন্দোলনের সময় আমাদের সময়ের সুনন্দবাবু ওয়ার্ডেন ছুরি খেলেন। তখন থেকেই হস্টেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের সেই থাকার ঘরগুলো এখন সেন্ট্রাল মডেল স্কুল।
নীরবতা। না আসলেই ভাল হত।
ওরা খবর পাঠায়। সেক্রেটারি মহারাজ কি এখন দেখা করবেন?
ওদের নিয়ে যাওয়া হয় দোতলায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন অল্পবয়সি ছিপছিপে সন্ন্যাসী, স্মিতমুখে বলেন—আপনারা?
নিউইয়র্ক থেকে আসা রবি গলাটা গম্ভীর করে বলে—আমরা ১৯৬৭র পাস আউট।
উনি হেসে বলেন—সে'বছর আমি জন্মে ছিলাম।
সবাই হাসে।
—মহারাজ, আপনার বাংলা শুনে মনে হচ্ছে আপনি অন্য প্রদেশের লোক, ঠিক বলছি?
—হ্যাঁ, আমি গুজরাতের, পোরবন্দর শহরের।
—মিশনের সাথে যোগাযোগ কী করে হল? মানে আপনি কি কোলকাতায় এসে পরে দীক্ষিত হয়েছেন, না গুজরাত থেকেই?
—ছোটবেলা থেকেই বিবেকানন্দ সাহিত্যের অনুরাগী ছিলাম, ভাল লাগত। গ্র্যাজুয়েট হতে হতে ঠিক করলাম মিশনে যোগ দেব। ওখানেই অনেক দিন কাজ করেছি। তারপর বেলুড়ের নির্দেশে কয়েক বছর হল এখানে বরানগর মিশনের দায়িত্বে এসেছি।
রঞ্জনের কেমন মনে পড়ে ওর চেনা বহু বাম পার্টির হোলটাইমারের কথা, যাঁরা একটা স্বপ্নকে রূপ দিতে সারাজীবন নিষ্ঠার সংগে সংগঠনের নিয়ম মেনে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে চলেছেন।
চরৈবেতি! চরৈবেতি! চরৈবেতি!
—নিশ্চয়ই! এই যে ইনি আপনাদের যেখানে বলবেন নিয়ে যাবেন। আপনারা চাইলে প্রেয়ার হলও একটু আগে খুলে দেয়া হবে।
ওরা সবাই নীচে নামার জন্যে তৈরি হয়। পাঁচ জন স্মৃতিবিভোর প্রৌঢ়, সবাই ষাটের ঘরে।
দোতলার দুটো ঘর ঠিক তেমনি রয়েছে। লাল সিমেন্টের মেঝে, সামান্য জোড়াতালির ছাপ, খাটগুলো বদলেছে। পুরনো মডেলের পাখা, গেরুয়া রঙের চাদরে ঢাকা বিছানা। না, মহারাজদের পোশাক সূতির কাপড়ে তৈরি। রঞ্জনের ছিদ্রান্বেষী মন কোথাও পলি-ফ্র্যাব্রিকের আভাস পেল না।
এইখানেই আগে ছিলেন ন'দা, অর্থাৎ স্বামী নিরন্তরানন্দ—পূর্বাশ্রমের নাম নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। উনি নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে কোন টেররিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অসুখে ভুগে বড় কষ্ট পেয়ে গেলেন। তারপর স্বামী শান্তিনাথানন্দ, মানে রামকানাইদা। তারপরে নির্জরানন্দ বা মোহিত মহারাজ। আপ্তানন্দ বা অনিলদা ছিলেন অনেক কাছের মানুষ, কিন্তু আগের মহারাজদের পরিশীলনের ছাপ ওঁর মধ্যে ছিল না।
ওরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসে। নীচে অফিস ঘর, সামনে একটা জাল লাগানো হয়েছে, কিন্তু কেন?
বারান্দায় দুটো কাঠের বেঞ্চি পাতা। সেগুলো ভরে যাওয়ায় কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, উৎকন্ঠায় পায়চারি করছে, কখন ডাক পড়বে? আজ ক্লাস ফাইভ থেকে এইট অব্দি ভর্তির জন্যে ইন্টারভিউ চলছে। গার্জেনদের সঙ্গে বাচ্চারা। বেলা প্রায় দশটা, জানুয়ারি মাস। অনেকের ভিড়ে দুটো কালোকোলো বাচ্চা ওদের মেজকাকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জন ওর ভাইয়ের দিকে তাকায়, বোকা বোকা হাসে। ভাই বোঝে দাদা খুব নার্ভাস। এর আগে ওরা কাকার সঙ্গে গিয়ে সরিষা মিশনেও রিটন টেস্ট দিয়েছে, পেপারগুলো বরানগরের মতই। ইংরেজি-বাংলা-অংক।
সরিষা মিশনের ক্লাসরুম, ব্ল্যাকবোর্ডগুলো বেশ বড়সড়, কেমন ভয় ভয় করে। ওরা দু'জায়গা থেকেই কল পেয়েছে। বাড়ির সবার ইচ্ছে সরিষায় দেয়া, ওখানে পাশের মেয়েদের স্কুলটিতে ওদের সম্পর্কে পিসি বোধহয় হেডমিস্ট্রেস, উনি নাকি ছোটবেলা থেকেই মিশনে, পড়াশুনো-নাচ-গান সবেতেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন কিন্তু ওটা বড্ড দূর, বেশ গ্রাম-গ্রাম। ধুলোভরা মাঠ, খেজুর গাছ, গাধা চরছে। বরানগর তো কোলকাতার মধ্যে, চারদিকে পাকাবাড়ি, সামনেই জয়শ্রী সিনেমা হল।
—এই, তোর নাম ডেকেছে, চল, ভেতরে চল।
একজন ব্রহ্মচারী কাকাকে আটকালেন। আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।
ভেতরে বেশ বড় একটি টেবিলের ওপাশে চশমা পড়া টাকমাথা একজন মোটাসোটা মহারাজ বসে। ওঁর চোখ দুটো হাসছে। রঞ্জন বুকের মধ্যে কাকিমার শিলনোড়ায় বাটনা বাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
(কাকা বলে দিয়েছিলেন—বসতে না বল্লে বসবি না কিন্তু। উনি আর বসতে বলেননি।)
—কী খেলতে ভালবাসো?
—ক্রিকেট।
—ফুটবল না?
—খেলি, খুব ভাল নয়।
—ক্রিকেটে কী করো?
—স্লো অফ স্পিন।
—আচ্ছা? গ্রিপটা দেখাবে? তোমার ছোট্ট হাতে লাগে না।
—লাগে, তবে আমরা পার্কসার্কাসের রাস্তায় ইটের উইকেটে রবারের বলে বা টেনিস বলে খেলি। রবারের বল খুব ঘোরে। আমার বল অফ স্টাম্পের বাইরে পড়েও লেগস্টাম্প ছাড়িয়ে যায়।
—বেশ, এটা বলো তো? অফ স্পিন আর অফ কাটারের মধ্যে তফাৎ কি? পারলে না? গুগলি বল জানো? আচ্ছা, তাহলে ওর আবিষ্কর্তা কে আর উনি কোন দেশের লোক বলতে পারবে?
—হ্যাঁ, বোসাঙ্কোয়েট, সাউথ আফ্রিকা।
দুজনের মধ্যে গল্প জমে ওঠে। রঞ্জন জানিয়ে দেয় যে অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দুটো ইনিংস মিলে শেষ বলে ড্র হয়েছে। ওয়েসলি হলের ঐতিহাসিক রান আউটটাও ও জানে। কিন্তু হঠাৎ প্রশ্নগুলো ঘুরে গেল। ও ‘আমি ভাত খাইয়াছি ‘এবং ‘আমি ভাত খাইতেছি’র ইংরেজি বলতে গিয়ে তোতলাতে লাগল। তারপর ও নমস্কার করে বেরিয়ে এসে কাকাকে জানাল—কয়েকটা বলতে পারিনি।
সাতদিন পরে চিঠি এল—টাকাপয়সা এবং বিছানাপত্তর-জামাকাপড় নিয়ে গার্জেনের সঙ্গে উপস্থিত হতে। আবার সেই অফিস ঘর।
সন্ধ্যে নামছে। শীতের সন্ধ্যে। মাত্র বিকেলের খেলাধুলো শেষ হয়েছে। স্কুল ছুটির পরে সামান্য জলখাবার বোঁদে-মুড়ি খেয়ে খেলার মাঠে। পার্কসার্কাসের ফুটপাথে ক্রিকেট খেলা রঞ্জন এতদিন জানত যে মাঠে খেলা শুধু বড়দের হক, তাও কোন ক্লাবের মেম্বার হলে। এখানে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেরা মাঠে বড়দের ক্রিকেট ডিউস বলে। আবার ঘেরা মাঠের বাইরে অনেকগুলো চটজলদি তৈরি পিচে টেনিস বলের ক্রিকেট খেলে চলেছে বিভিন্ন বয়সের ছোটরা। কিন্তু টেনিস বলের টার্ন ও বাউন্স রবাবের বলের চেয়ে অনেক কম, অবশ্যি পিচের রাস্তার হার্ড সারফেস আর ধুলোভরা বা ঘাসের সারফেসও আলাদা স্বভাবের।
আজকে ওকে কেউ খেলতে নেয়নি। ও ক্লাস সেভেনের খেলা একটু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখছিল। একটা বল উড়ে এসে ওদের প্লেয়ারের নাগালের বাইরে পড়ল। হরিদাস বলটা তুলে নিল। ওদের ক্যাপ্টেন হাতের ইশারায় বলটা ফেরত দিতে বলল। ও কিন্তু সোজাসুজি থ্রো না করে বলটা বোলিং অ্যাকশনের সঙ্গে হাত ঘুরিয়ে রিলিজ করল। বলটা সমীরণের সামনে ড্রপ খেল। তারপর সামান্য টার্ন নিয়ে সমীরণের প্রত্যাশায় বাড়ানো জোড়া হাতের পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। সবাই হেসে উঠল।
সমীরণের চোখ-মুখ রাগে গনগন করছে।
—এই তুই কে রে? নতুন ছেলে? কোন ক্লাস? সিক্স? বড়দের সঙ্গে পাকামি? যা, নিজের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে খেল গে যা!
ও আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে পড়ে। ঘন্টা বাজে। খেলা শেষ। দলে দলে ছেলের দল গোটা কয়েক কলের সামনে লাইন দিয়ে হাত পায়ের ধুলোকাদা ধুচ্ছে। এর পর? একটি ছেলে জানাল প্রেয়ার হলে যেতে হবে।
ও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছোটভাইটা কোথায় গেল। এ পরবাসে ওই তো স্বজন। গেল কোথায়?
ইতিমধ্যে মাথায় পড়ে একটা চাঁটা। পেছন ফিরে দেখে গোটা কয়েক ছেলে ভাবলেশহীন মুখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর চোখ ঘুরে বেড়ায় সবার মুখে? মারল কে? কেন মারল, উত্তর খোঁজে।
—প্যাট প্যাট করে কী দেখছিস রে? জানিস না, সিনিয়রদের দিকে অমনি করে তাকাতে নেই! আর সিনিয়ররা আগে হাত-পা ধোবে, তারপর তুই, সরে দাঁড়া।
ও সরে দাঁড়ায়।
গতকাল ঠিক এই সময়েই ওর কাকা এসে ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে ওদের দু’ভাইকে নামিয়ে দিয়ে গেছিলেন। অফিস ঘরে রুক্ষ চেহারার সুনীলদা বা স্বামী আপ্তানন্দ হাসিমুখে বরাভয় দিয়েছিলেন। —কিছু ভাববেন না, কদিন মন খারাপ করবে, তারপর এখানে এমন ভাল লাগবে যে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করবে না। অ্যাই কল্যাণ, এদিকে এসো।
একটি বছর চোদ্দোর চুলে সিঙ্গারা করা ছেলে এগিয়ে আসে।
—দেখুন, এ ক্লাস নাইনে পড়ে, এখন বন্ধুদের ছেড়ে আশ্রমের পরিবেশ ছেড়ে গরমের ছুটিতেও ঘরে যেতে চায় না। আর হ্যাঁ, এখানে সবাই সমান। ঠাকুর-স্বামীজির আদর্শে আমরা বাচ্চাদের বড় করি, কৃচ্ছসাধনে অভ্যস্ত করাই। সাদাসিদে জামাকাপড় দেবেন। হাতে পয়সা দেবেন না। দরকার হলে একস্ট্রা পয়সা অফিসে জমা রাখবেন।
ট্যাক্সি কাকাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ বলে যে এখন প্রার্থনা হলে যেতে হবে। দু-ভাই, যন্ত্রচালিত, অন্ধকার আঙ্গিনা পেরিয়ে বিশাল মোজাইক-পালিশ করা প্রেয়ার হলে ঢুকে সারি সারি বসে থাকা ছেলেদের পেছনে বসে পড়ে।
আলো ঝলমল হল। একটু দুরে ঠাকুর-শ্রীমা- বিবেকানন্দের ফটো। তার সামনে পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে কর্পূরের আরতি করছেন কেউ। সামনে হার্মনিয়াম নিয়ে মূল গায়ক। পাশে একজন খঞ্জনী বাজাচ্ছে। আর একজন অন্ধ বাদকের হাতে পাখোয়াজ কথা বলছে—ভদতং - ভদতং, ভদ-ভদ-ভদ-ভদ, তং -তং।
আর হলের শেষ প্রান্তে একজন বাজাচ্ছে ফুট-অর্গ্যান।
ইমনকল্যাণে চৌতালে আরাত্রিক গাওয়া হচ্ছে- "খণ্ডন-ভব-বন্ধন-জগ-বন্দন-বন্দি-তোমায়"। এত বিলম্বিতে গান এরা কখনো শোনে নি। তাই শব্দগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়, কানে ঢোকে, কিন্তু চেনা হয়ে ওঠে না।
গান শেষ হয়, সবাই আভূমি প্রণত হয়, কিন্তু কিছু ছেলে আর ওঠে না।
দ্বিতীয় গান শুরু হয়, কেউ একজন হার্মনিয়ামের রিড টিপে ফিসফিস করে—"ওং ঋং, ঋতং, ত্বমচলো-গুণজিৎ-গুণেড্যং,”
ওকে চমকে দিয়ে সবাই কোরাসে উঁচু স্কেলে চেঁচিয়ে ওঠে—
"নক্তংদিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম"।
রঞ্জন অবাক হয়। এটা কেন চেনা চেনা লাগছে? লাগার তো কথা না! কোথায় শুনেছিল?
মনে পড়েছে, না, কথাগুলো নয়, এই সুর এই গায়নভঙ্গিও শুনেছিলাম অনেক আগে, পার্কসার্কাসে ট্রামলাইনের পাশে একটি চার্চের খোলা দরজা দিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসছিল।
এবার টিউটোরিয়াল। ছেলেদের থাকার ঘরেই। নতুন ছেলেরা একজায়গায়। একটি বেঁটে ছোটমত ছেলে এগিয়ে এসে বলে—শোন, ক্লাস সিক্স-বি'র এগুলো হোমটাস্ক। এই খাতাগুলো আর বইগুলো নিয়ে চল, কানুদার কাছে। দেরি হলে মারে, বেত দিয়ে।
দোতলার হলঘরে সবাই পড়তে বসেছে। একদিকে ক্লাস সিক্স, অন্য দিকে ফাইভ। রঞ্জন দেখতে পায় ছোটভাই রজত দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে।
তারপর উনি বল্লেন—নতুন ছেলেরা শোন। যারা মার সহ্য করতে পারবে না তারা কাল থেকে অমলেশদার কোচিংএ চলে যাবে। বাকি এখানে আমার কাছে পড়বে। একটু পরে উনি টাস্ক দিয়ে কোথাও চলে গেলেন।
কেউ একজন বলল—-কালকের বাংলা কবিতাটা মুখস্থ করা যাক।
রঞ্জন বই খুলল। কালিদাস রায়ের কবিতা। এক বুড়ির পোষা ছাগলছানাকে কালীমার কাছে বলি দেয়া হয়েছে, সেই নিয়ে বুড়ির অভিশাপ।
শেষ লাইনদুটো সবাই কোরাসে জোরে জোরে পড়তে লাগল আর কিছু ছেলে হেসে উঠল।
'মরার বাড়া আর নেই শাপ বল ঠাকুর যাও,হাসছে কেন? পাশের ছেলেটি মুচকি হেসে বলল—জানো না? ওরা প্রথম লাইনের দ্বিতীয় শব্দটা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে পড়ছে, তাইতে সবাই হাসছে।
সকাল সকাল বুড়িটাকেই এবার শ্যামা নাও।'
—তাতে কী হল?
—আরে ওটা খারাপ কথা।
কানুদা কখন নিঃশব্দে ঢুকেছেন, প্রায় বেড়ালের মত। সমবেত "মরার বাড়া" আর হো-হো হাসি হঠাৎ বদলে গেল আর্তনাদে। তিনটে ছেলেকে উনি টার্গেট করে ঠ্যাঙাচ্ছেন। বেত চলছে মাথায়, মুখে, পিঠে।
রঞ্জন ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। উনি চলে গেলে ও সবচেয়ে ছোট কিন্তু সবচেয়ে বেশি মারখাওয়া ছেলেটাকে জিগ্যেস করল—খুব লেগেছে না?
ও একগাল হেসে বলল, "ধ্যেৎ, ও তো জলভাত।"
—তাহলে তুমি যে অত চেঁচাচ্ছিলে?
—ও তো অ্যাক্টিং! যদি না কাঁদো, না চেঁচাও তাহলে কানুদার রাগ আরও বেড়ে যাবে, আরও মারবেন।
—কী নাম তোমার?
—প্রহ্লাদ।
তিনকোণা থেকে তিনটে ছেলে চেঁচিয়ে উঠল—এঃ প্রহ্লাদ! ও হল পেল্লাদ। আল্লাদী, পেল্লাদী, গুয়ের লাদি।
কোচিং ক্লাসের পর বিবেকানন্দ হলে পিঁড়ি পেতে খাওয়া। তারপর মশারি খাটিয়ে বিছানা করে ঘুম। পরের দিন ভোরে উঠে প্রার্থনা, তারপর পিটি, জলখাবার, পড়া, চান-খাওয়া-স্কুল করে কখন যেন বিকেল হয়ে গেল, আবার খেলার মাঠে। তারপর সন্ধ্যের সময় হাত-পা ধোয়া। কালকে এইসময় মেজকা’ আমাদের ছেড়ে গেছল। চব্বিশ ঘন্টার একটা চক্র পূর্ণ হল। এমনি ৩৬৫ চক্রে বছর ঘুরবে। আর কত বছর, কত দিন, কত আবর্তন এই পরবাসে থাকতে হবে। কেউ ওর জামা ধরে টানছে। ফিরে দেখে ছোটভাই। কিছু বলার আগে ডুকরে কেঁদে ওঠে রজত, —দাদারে! কিচ্ছু ভাল লাগে না। চল, বাড়ি ফির্যা যাই।
—চুপ কর, কান্দে না। সব ঠিক হইয়া যাইবো। আস্তে আস্তে।
রঞ্জন জানে না, ওর পিতামহ এই আশ্বাসেই ১৯৪৯-এর দাঙ্গার সময় দেশভাগের পর কোলকাতায় এসেছিলেন। আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইবো।
সেদিন প্রেয়ারের পর ওদের রুমের ক্যাপ্টেন দিলীপদা (ক্লাস সেভেন) বলল—তোমাদের দুইভাইকে রামকানাইদা ডেকে পাঠিয়েছেন। সোজা ওঁর অফিস ঘরে যাও, তারপর পড়তে বসবে।
দু'ভাই রঞ্জন আর রজত (সিক্স আর ফাইভ) ইতিউতি তাকায়। কেন ডেকেছেন রামকানাইদা? গেলেই বুঝবে। ক্যাপ্টেনের গলার স্বরে একটু মস্করার ছোঁয়া।
রামকানাইদা? মানে স্বামী শান্তিনাথানন্দ? যিনি প্রেয়ারের জন্যে ভজনগুলোর একটি সংকলন সম্পাদন করেছেন! নীল রঙের বইটি, সুন্দর ভূমিকা, প্রায় শ'খানেক গান। প্রত্যেকটি গানের লিরিকের ওপর রাগ ও তাল লেখা আছে। তাতে ঠাকুর, সারদা-মা, বিবেকানন্দ, শিব, কালী, দুর্গা, দু একটা রামপ্রসাদী, মীরার ভজন—কী নেই?
আর আছে পরিশিষ্ট, তাতে চৌতাল থেকে শুরু করে ঝাঁপতাল, তেওড়া, কাহারবা-দাদরা আদি তালের মূল ঠেকার বোল, সম, তাল, ফাঁক সব চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া। কৌতূহল জাগে, এগুলো শিখতে পারলে কেমন হয়?
ওঁর চেম্বারে গিয়ে রঞ্জন অবাক —আরে, ইনি তো সেই সন্ন্যাসী যিনি ভর্তির আগে ইন্টারভিউয়ের সময় ক্রিকেট আর ইংরেজির টেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন।
কিন্তু আজ ওঁকে যেন চেনা যাচ্ছে না। রাগে গনগন করছেন রামকানাই মহারাজ।
—ব্যাটারা ভেবেছিস কি! দুটো ভাই সন্ধ্যেয় প্রেয়ারের সময় এত ঘুমোস কী করে? যারা প্রেয়ারের সময় ঘুমোয় তাদের নাম নোট করা হয়। এই দেখ, মাত্র একমাস হল ভর্তি হয়েছিস, রোজ তোদের নাম উঠেছে ঘুমোনোর খাতায়। আজ প্রেয়ারের সময় নিজে গিয়ে দেখেছি, পাশাপাশি দুই লাইনে দুভাই বসেছে, দুটৌই ঘুমোচ্ছে। আর সেকি ঘুম? বসা অবস্থায় ঢুলে ঢুলে পড়ছে, একটা ভাই উঠছে তো আর এক ভাই নামছে। যেন ঢেঁকিতে পাড় পড়ছে। ফের যদি দেখি তো সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেব, মনে থাকে যেন!
দু-ভাই হতভম্ব হয়ে বেরিয়ে আসে। কী করা যায়! এখন উনি যদি বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেন তো বড় সমস্যা হবে। সেশন শুরু হয়ে গেছে, কোনো স্কুল ওদের নেবে না। ভিলাইয়ে চাকরিরত বাবা বিব্রত হবেন। কী করা যায়?
ছোটভাই রজতের মাথা বেশ পরিষ্কার। ও বের করে দুই পয়েন্ট সমাধান।
এক, দু'ভাই কক্ষনো প্রেয়ার হলে দুটো লাইনে সমান্তরাল বসবে না। তাহলে আর ঢেঁকির- পাড়- দেয়া উপমাটা শুনতে হবে না।
দুই, নাম যারা নোট করে তাদের সঙ্গে ভাব করতে হবে।
আস্তে আস্তে ওরা জানতে পারল বিশাল প্রেয়ার হলের বারান্দা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিশ্বস্ত কয়েকজন। তারা ঘুমন্তদের নাম নোট করে। কখনও অনিলদা মহারাজ নিজে ঘুরে বেড়ান। একইভাবে বারান্দার বিশাল জানালাগুলো দিয়ে নজর রাখেন। কখনো ঘুমে ঢুলে পড়া ছেলেগুলোর আশপাশে বসা কাউকে ইশারা করেন জাগিয়ে দিতে। এটাও দেখল যে কয়েকজন সিনিয়র ছেলে প্রেয়ার হলে বসে ঘুমোনোর খেলায় সিদ্ধিলাভ করেছে। তারা সোজা হয়ে বসে চোখ বুঁজে ঘুমোয়, একটুও নড়েচড়ে না, ঢুলে পড়ে না।
তারা গান গায় না। জিগাইলে বলে ধ্যান করছে। এই ভাবেই তারা কাটিয়ে দেয় আরাত্রিক—বিলম্বিত ও দ্রুত, ওঁ- ঋং-ঋতং, এবং সব শেষে সর্বমঙ্গল্য -মঙ্গল্যে-শিবে-সর্বার্থসাধিকে। আরতি শেষ হলে তারা ওঠে এবং গম্ভীর পদক্ষেপে হল থেকে বেরিয়ে যায়, তাদের নিষ্ঠা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তোলে না,এবং ছোটরা তাদের ধ্যানের পরাকাষ্ঠায় প্রভাবিত হয়ে বিশেষ শ্রদ্ধা করতে থাকে। কিন্তু এদের নকল করতে গিয়ে কিছু ছেলে ধরা পড়ে যায়। কারণ, তারা একবার একটি স্তোত্রের শেষে প্রণাম করার সময় সেই যে শোয় আর ওঠে না। প্রসাদ বিতরণ হয়ে হলের লাইট নেভানোর সময় তাদের ঠেলে তোলা হয় বড় অনুকম্পা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে, যেন রাস্তায় পড়ে থাকা মাতালকে পাহারাওলা ঠেলে তুলছে।
আবার ডেকে পাঠিয়েছেন রামকানাইদা। ইতিমধ্যে আমি পড়ে ফেলেছি গানের বইটির শুরুতে রামকানাইদার লেখা ভূমিকা। উনি শুরু করেছেন "গানাৎ পরতরং নহি" এই সূত্রবাক্য দিয়ে। এর মানে কী জানা নেই। কিন্তু মন ছুঁয়ে যায় ওঁর এই বাক্যটিঃ “একটু সুরের ঝিকিমিকি, একটু তালের রংচং, হয়তো মনকে তাৎক্ষণিক ছুঁয়ে যায়, কিন্তু নিয়ে যায় সংগীতের মণিকোঠা থেকে অনেক দূরে।"
আজ রামকানাইদার ঘরে গিয়ে রঞ্জন প্রথমেই বলে—আমি আপনার লেখা বইটির ভূমিকা পড়েছি। আমি গান শিখতে চাই।
—বেশ, আপাতত প্রত্যেক রোববার সকালে ডানকুনি থেকে বীরেশ্বরদা আসবেন তোমাদের গানের ক্লাস নিতে। ওঁর কাছে যাও। পরে আমি ডেকে নেব। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে তুমি প্রার্থনা হলে ঘুমোবে না। এত ঘুম আসে কেন? এক কাজ করো, কাল থেকে তুমি বারান্দায় ঘুরে ঘুরে যারা ঘুমোচ্ছে তাদের নাম লেখার দায়িত্ব নাও। তাহলে আর ঘুমোনোর সুযোগ পাবে না। দেখো, হয়ত তোমার ঘুমের রোগ সেরে যাবে।
নিজের রুমমেটদের গিয়ে ও গর্বের সঙ্গে বলে—জানিস, কাল থেকে আমি—
আশ্চর্য, ওরা বিদ্রুপে মুখ বাঁকায়,—কিরে শ্লা, তুইও শেষে দালাল হলি?
দালাল? আমি দালাল?
নয়তো কি? কাল থেকে বন্ধুদের নামে চুকলি করবি মহারাজদের কাছে? ছ্যা-ছ্যা!
পরের দিন ও গিয়ে রামকানাইদাকে বলে—মহারাজ, আমি ঘুমোব না। প্রেয়ারে বসে গান গাইব, খঞ্জনী বাজাব।
আস্তে আস্তে ও গিয়ে বসে অন্ধ পাখোয়াজ বাদক নগেশদার পাশটিতে। বাঁয়ার গায়ে আটার গোলা লাগিয়ে ভারি আওয়াজ বের করাটাকে মন দিয়ে দেখে। তারপর প্রেয়ারের শেষে খঞ্জনী দিয়ে ঘষে আটা তোলায় হাত লাগায়। নগেশদাকে হাত ধরে সিঁড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।
কিন্তু মাঝে মাঝে মেতে ওঠে অন্য এক খেলায়। সামনে বা পেছনে বসা ঘুমে ঢুলে পড়া ছেলেটির নাকের সামনে ঘুষি পাকিয়ে অপেক্ষা করে কখন ঢুলতে ঢুলতে ওর নাক এসে পড়বে ওর পাকানো মুঠোর ওপরে। চমকে উঠে লাল চোখ করে তাকানো ছেলেটিকে অনায়াসে বলে—ঘুমোস্ না, অনিল মহারাজ দেখতে পেয়ে তোকে ডেকে দিতে বল্লেন।
সকাল বেলা, বিশেষ করে শীতের সকালে, অনেকেই শাল জড়িয়ে এসে প্রেয়ার হলে বসে। প্রায়ান্ধকার হলে প্রার্থনার সময় অনেকে ঘুমোয়। তারপর সূর্য ওঠে। কিন্তু রোববারে বাঁধা গতের গানের জায়গায় অন্য গান হয়। যেদিন রামকানাইদা এসে বসেন, টেনে নেন স্কেল-চেঞ্জার বিশেষ হার্মনিয়াম, সেদিন চেনাজানা গানগুলো অন্য মাত্রা প্রায়। বীরেশ্বরদা ভৈরবীতে গাইতে থাকেন—"শ্রীদুর্গা নামটি ভুলো না; ভুলো না, ভুলো না, ভুউউলো না।''
সেটাই রামকানাই মহারাজ যখন কানাড়ায় গেয়ে ওঠেন, অন্তরায়, "তারায় দিয়ে ভার, সুরথ রাজার, লক্ষ অসিঘাতে প্রাণ গেল না" তখন প্রেয়ার হলের বাতিগুলো উজ্বল হয়ে ওঠে। কেউ ঘুমোয় না।
একদিন, প্রেয়ার শেষ, জলখাবারের ঘন্টা বেজে গেছে, সবাই চলে গেছে—উনি অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সেদিন ওঁকে গানে পেয়েছে। একাই খালি হলে আপনমনে গান গেয়ে চলেছেন। একটু দূরে নিজেকে প্রায় গোপন করে রঞ্জন শুনছে।
নানান গানের পরে উনি ধরলেন অতুলপ্রসাদের "সে ডাকে আমারে, বিনা সে সখারে, রহিতে মন নারে''। তারপর হঠাৎ "বরষ বরষ ধরি থাকি চাহিয়া", অন্তরায় "দখিনা সমীরণে-এ-এ-এ, সমীরণ, হা- আ- সমীরণ!"
রঞ্জন তখন খেয়াল করল এগুলো তো ঠিক প্রথাসিদ্ধ ভজন নয়! তাহলে? স্বামী শান্তিনাথানন্দের মনের কি অনেকগুলো কোণ আছে? তার থেকে আলো ঠিকরে পড়ে? কার প্রতীক্ষায় উনি বরষ-বরষ-ধরি চাহিয়া থাকেন? ঈশ্বর? তাই কি!
গান শেষ হলে উনি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। বেলা বাড়ছে। রঞ্জন বলে উঠল—মহারাজ, আরেকটা গাইবেন?
উনি চমকে উঠলেন। যেন হলে আর একটি প্রাণীর উপস্থিতি এতক্ষণ খেয়াল করেননি। তারপর কোন কথা না বলে উঠে চলে গেলেন।
কিন্তু ঘুম আসে। আসে ক্লাসরুমে, ফার্স্ট ও ফিফথ পিরিয়ডে। এর কার্যকারণ-সম্বন্ধ বুঝতে হলে জানতে হবে আশ্রম বালকদের রোজকার রুটিন কেমন ছিল?
ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে লাইন দিয়ে বাথরুম ইত্যাদি সেরে পাঁচটা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মত প্রার্থনার পরে সোজা মাঠে গিয়ে পিটি এবং ড্রিল। আমাদের ড্রিল মাস্টার ছিলেন অমলদা। যতদূর জানতাম উনি পিতৃমাতৃহীন বালক হিসেবে আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছিলেন। তারপর ম্যাট্রিকুলেট হয়ে মিশনের স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে টিচার, আর সকালে ড্রিল করানো এবং বিকেলে বিভিন্ন অকেশনে ভলিবল বা ফুটবল খেলার সময় রেফারি হওয়া—এই ছিল ওঁর মিশন নির্দিষ্ট ভূমিকা আর সেটা তিনি যথেষ্ট যত্নের সঙ্গেই পালন করতেন। তখনো হিন্দিতে কম্যান্ড (আগে চলে আপ-পিছে মুড়, বা বাঁয়ে চলে আপ ডাইনে মুড়) শুরু হয়নি। আজও কানে ভাসে ওঁর গলায়—মার্ক টাইম, লেফট-রাইট-লেফ্ট। কেউ ড্রিলের সময় হালকা মুডে থাকলে বেদম চটে যেতেন। ক্লাস টেনের শান্তশিষ্ট গোবেচারা স্বভাবের একটু "লুকিং লন্ডন, টকিং টোকিও" টাইপের দেবেশদাকে অন্যমনস্ক দেখে উনি গর্জে উঠলেন—য়ু প্রফেসর! অ্যাম টকিং টু ইয়ু!
ব্যস্, দেবেশদার আশ্রম ছাড়া অব্দি "প্রফেসর" নাম আর ঘুচল না।
আমরা ক’জন দেবুদাকে পছন্দ করতাম ওঁর পাতলা আওয়াজে তালাত মামুদের বাংলা গান শোনানোর জন্যে; —'এল কি নতুন কোনো গোধূলি বেলা', বা 'হয়তো হাত লেগে পড়েছে খোঁপা থেকে ফুল ঝরে', অথবা সুপারহিট ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে, আজো ফুল ফোটে ভালোবেসে, বলো তুমি যাবে কি গো সাথে, এই পথ গেছে সেই দেশে'। আর হিন্দিতে ‘জায়ে তো জায়ে কহাঁ’।
সে যাই হোক, এর পরে টিফিন খেয়ে পড়া করে সাততাড়াতাড়ি চান সেরে ডাল-ভাত-কুমড়োর তরকারি নাকেমুখে গুঁজে ক্লাসে যাওয়ার পর অবধারিত ভাবে চোখে নামে ভাতঘুম।
ফার্স্ট এবং ফিফথ পিরিয়ড হয়তো ভগবান ঘুমোনোর জন্যেই সৃষ্টি করেছিলেন। সে পিরিয়ড যদি বাংলা বা ইতিহাস হয়, ঘুম অবধারিত। ইংরেজি, অংক বা সংস্কৃত হলে ঘুমোনোর ফ্রিকোয়েন্সি একটু কম।
ধরুন, ক্লাস নাইনের ফার্স্ট পিরিয়ড,—বাংলা।
পড়াচ্ছেন আর বি, অর্থাৎ রণেন্দ্র ভট্টাচার্য্য। আশ্রমের ছেলেরা অবধারিতভাবে ব্যাকবেঞ্চার। খানিকক্ষণ ওঁর লেকচার শোনার পর তুমি কনুই দুটো মুড়ে বেঞ্চের ওপর রাখলে। তারপর ঠান্ডা ডেস্কের ওপর গাল পেতে দিয়ে পেলে শীতলপাটির ছোঁয়া। আস্তে আস্তে ওঁর কথাগুলো একঘেয়ে হয়ে অস্পষ্ট হতে হতে মৌমাছির গুনগুন হয়ে গেল, আরামে জুড়ে গেল তোমার চোখ এবং তখন তুমি অন্য জগতে চলে গেলে।
হঠাৎ পাঁজরে আঙুলের খোঁচা, সঙ্গে ফিসফিসানি—ওঠ, ওঠ, স্যার দেখছেন। তুমি লাল চোখ নিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠলে, বোকা বোকা মুখ, মুখে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর টেবিলের ওপর মুখ থেকে গড়ানো নাল। একেবারে "বালিকা বধূ" সিনেমায় ক্লাসরুমে ঘুমন্ত বঙ্কিম ঘোষ!
স্যার এগিয়ে এসেছেন। গোটা ক্লাস হাসছে। সামনের সারির ডে-স্কলার ছেলেগুলো সাগ্রহে তাকিয়ে —আজ হোস্টেলের একটা ছেলে ঠ্যাঙানি খাবে।
(জনান্তিকে বলে রাখি, ফাইভ থেকে ইলেভেন অব্দি প্রত্যেক ক্লাসে মেরিট লিস্টের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে অন্তত দুই থেকে তিনজন হোস্টেলের। এটা কেন যেন কিছু ছেলের এবং টিচারের গাত্রদাহের কারণ ছিল।)
—এতক্ষণ কী পড়ানো হচ্ছিল?
বিমুঢ় তুমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ। ঘুমের ঘোর কাটেনি। মাথার মধ্যে মেঘ ও কুয়াশা। মাগো, কেন যে এইসব বোকাবোকা প্রশ্ন!
—কী পড়ানো হচ্ছিল? মানে আপনি যা পড়াচ্ছিলেন।
স্যার আরও দু'পা এগিয়ে এলেন।
—আমি কী পড়াচ্ছিলাম?
পেছন থেকে ফিসফিস—শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা!
—বেশ, তা শকুন্তলা পতিগৃহে পৌঁছেচেন, না কি মাঝরাস্তায় বঙ্কিমচন্দ্রের "ইন্দিরা"র মতো ডাকাতের খপ্পরে পড়েছেন?
এবার ওঁর হাতের ডাস্টার উদ্যত, তুমি ভাবছ হাউ-টু-ফেন্ড? কারণ, ওঁর হাতে ডাস্টার কথা বলে।
কিন্তু তোমার পাশ ও পেছন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে অন্তত জনা পাঁচেক আশ্রমিক ছেলে। প্রথম আঘাতের আগেই তাদের কোরাস শুরু হয়ে যায়—"স্যার, স্যার! প্লীজ ওকে মারবেন না। ওর কাল রাত থেকে গায়ে ব্যথা, জ্বর, বমি। আজকে ডাক্তার ওকে আসতে বারণ করেছিলেন। শুধু আপনার ক্লাস বলেই এসেছে। আপনি যদি চান তো টিফিনের পরে ডাক্তারবাবুর থেকে লিখিয়ে আনতে পারি।"
আরবি স্যার হকচকিয়ে যান। —ঠিক বলছিস? ডাক্তারের থেকে লিখিয়ে এনে দেখাতে পারবি?
—হ্যাঁ স্যার।
ছেলেগুলো জানে আশ্রম প্রাঙ্গণের হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়ের গোবেচারা ডাক্তারবাবুর, নিক নেম ‘মার্ক সল-থার্টি’র (উনি নাকি অধিকাংশ রোগীদের —তোর কী হয়েছে রে! জিগ্যেস করেই একটুকরো কাগজে মার্ক সল-৩০ লিখে দিতেন আর ওঁর কম্পাউন্ডার ব্রহ্মচারী শিশির কাগজের পুরিয়ায় কিছু সাবুদানার মত ভরে দিতেন) থেকে সার্টিফিকেট আনা দুনিয়ার সহজ কাজগুলোর মধ্যে একটি।
কনফিউজড আরবি তোমাকে—যা, বাইরে যা! হাত-মুখ ধুয়ে জল খেয়ে পরের পিরিয়ড থেকে ক্লাস করবি বলে ছেড়ে দিলেন।
এখন বুঝতে পারি কোন পলিটিক্যাল পার্টির লোককে পুলিশ অ্যারেস্ট করলে "জনগণ" কেন এবং কিভাবে অপরাধীকে ছাড়িয়ে নেয়।
টিফিনের পনেরো মিনিট ‘কমার্শিয়াল ব্রেক’-এর পর ফিফথ পিরিয়ডের স্যারেরা ঘুমোনোর অপরাধে ঠ্যাঙাতেন না। মুখে চুকচুক করে বলতেন—তোমাদের হস্টেলের ভাতে কিছু মেশানো থাকে নাকি? ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন, সর্বত্র এক ছবি! লাস্ট বেঞ্চে হস্টেলের কিছু ছেলে ঘুমোচ্ছে। ছ্যা-ছ্যা!
ঘুম আসার আরেকটি নির্ধারিত লগ্ন হল রোববারের সন্ধ্যেয় হস্টেলের প্রাঙ্গণে ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টরে ডকুমেন্টারি সিনেমা দেখার সময়।
সারা সপ্তাহ ধরে রুটিন মেনে চলার দিনগুলোয় অবচেতনে বাজে দাড়িদাদুর বাচ্চাটির মায়ের কাছে আকুতিঃ
রবিবার সে কেন যে মা এত দেরি করে?শনিবার স্কুলের হাফ ডে; তখন থেকেই মন যে খুশি-খুশি-আজ। ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার মাঠে চলে যাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। সন্ধ্যের কোচিংয়ের পর, রাত্তিরের খাওয়ার আগে এবং পরে, আড্ডা ও পরের দিনের জন্যে নানারকম প্ল্যান চলতেই থাকে।
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে সকল বারের পরে!
সকালে ড্রিল হয় একটু বেশি সময় ধরে। জলখাবারে একটু মুখ বদলানোর প্রত্যাশা—মানে বোঁদে-মুড়ি, পাঁপড়ভাজা-মুড়ি, ঘিঁচকে-মুড়ি (ঘি-চিনি-মুড়ি), এসবের বদলে পাঁপড়্বের ঝোল-মুড়ি অথবা দুধ-চিঁড়ে (দুধে-জল নয়, জলে-দুধ) না দিয়ে চারটে স্লাইস-ব্রেড - চিনি ও একটি চাঁপা কলা।
দুপুরে কারি-পাউডারের ঝোল ও অসিদ্ধ কাঁটা না দেয়া ডালের সাথে অন্তত মাসে একদিন মাংসের ঝোল (একটু-আধটু পোড়া হলেও কী আসে যায়!) আর রাত্তিরে মাসে একদিন পায়েস (পাউডার মিল্ক গুলে পঞ্চা রেঁধেছে তো একটু-আধটু তলানিতে লেগে যাওয়ার পোড়া গন্ধ থাকতেই পারে)।
আর পড়াশুনোর বদলে অনিলদার ধর্মক্লাস। উনি ভালো প্রচারক ন'ন; শিক্ষকও নন। কিন্তু গাঁ থেকে আসা এই সন্ন্যাসীর মধ্যে নিজের আদর্শের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও একধরনের সারল্য ছিল।
ওঁর উৎসাহ ছিল সব ব্যাপারে, গান-কোচিং- ক্রিকেট- নাটক কী নয়? কিন্তু কোনটাতেই গভীরতা ছিল না। মিশনের সন্ন্যাসীদের প্রোবেশন পিরিয়ডে (ব্রহ্মচারী অবস্থায়) গান শেখা কম্পালসারি। ফলে ভয়ানক বেসুরো অনিলদা (স্বামী আপ্তানন্দ) হারমনিয়ামের রীড টিপে কুল্যে তিনটে গান গাইতে পারতেন। উনি নিজেও বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেন। তাই কদাচিৎ প্রেয়ার হলে হার্মনিয়ামে বসতেন। কিন্তু যেদিন বসতেন সেদিন আমাদের মনে হত—না ভীষ্মলোচন নয়, অ্যাস্টেরিক্স নামের কমিক স্ট্রিপ থেকে ক্যাকোফোনিক্স এয়েছেন, সবাই মনে মনে কানে আঙুল দিত।
বছরে একবার নাটক হয়, কখনো কর্ণার্জুন, কখনো কেদার রায়। সেবার গরমের ছুটির আগে নাটক হবে চন্দ্রগুপ্ত। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে অনিলদার ঘরে প্রাথমিক রিহার্সাল চলছে। একটি দৃশ্যে বিজয়ী গ্রীকসৈনিকের দল যুদ্ধ জিতে রাত্তিরে নদীর তীরে আগুন জ্বালিয়ে আনন্দউল্লাস করছে, নাচ-গান চলছে (আইপিএল জিতে ক্যালকাটা নাইট রাইডার্সের উৎসবের কথা ভাবুন!)।
স্ক্রিপ্টে একটি গানের লিরিক দেয়া আছে। কিন্তু অনিলদা বল্লেন—ওসব ছাড়; বিজয়ী গ্রীক সৈনিকের দল গাইবে—জয় রামকৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ বলরে আমার মন!
ওঁকে বোঝানো মুশকিল যে ওদের সঙ্গে ঠাকুরের প্রায় দুহাজার বছরের বেশি ব্যবধান। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে গ্রীসেও মিশনের শাখা আছে।
একবার রাত্তিরে চোর এসে অনেক বাসনপত্তর চুরি করে নিয়ে গেল। সকালে দেখা গেল স্কুলের পেছনের গলিতে চোরটি পূজার বাসনের একটি বস্তা ফেলে দিয়ে গেছে।
অনিলদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বল্লেন—চোরের মনটা ভাল, শ্রদ্ধা আছে, তাই পুজোর বাসনগুলো ছেড়ে দিয়ে গেল। কিন্তু ও বুঝল না যে আশ্রমের সব বাসনই পুজোর বাসন!
ধর্ম ক্লাসে উনি বেদের হোমাপাখির গল্প শোনাচ্ছেন —যে পাখির ডিম আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই ডিম ফেটে ছানা বেরিয়ে পাখা গজিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু গল্পের মেটাফর ভেঙে আধ্যাত্মিক ভূমিতে আসতে অনিলদা অপারগ, ফলে ছেলেগুলো বোর হয়। আবার ক্রিকেট ম্যাচ আছে। খেলার জন্যে টিম তৈরি হয়ে গেছে। পেছনের সারি থেকে ফিসফিসানি বাড়তে থাকে। রঞ্জন বার খেয়ে শহীদ হওয়ার জন্যে তৈরি হয়।
অনিলদা প্রশ্ন করেন—মানুষ কখন দুপেয়ে থেকে চারপেয়ে হয়? পারলে না তো? যখন বিয়ে করে সংসারী হয়, বউয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়।
—-মহারাজ, বিয়ের পর বাচ্চা হয়ে গেলে কি ছ'পেয়ে হবে?
সবাই হেসে ওঠে, ধর্ম ক্লাসের ওখানেই ইতি। কিন্তু ক্রুদ্ধ আত্মানন্দের সর্ষের তেল মালিশ করে ব্যায়াম করা হাতে ছেলেটা রামক্যালানি খায়।
রোববার স্নানের আগে সারা সপ্তাহের বাসি জামাকাপড় কাচা —বিছানার চাদর কাচা, নোখ কাটা কম্পালসারি। তারপর দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে যেকোন সময়ে অনিলদা এসে রুম ইনস্পেকশন করবেন। সবার বিছানার চাদর, ঘরের কোনা, জানলার কাঁচ সব খুঁটিয়ে দেখবেন।
নীধের তলার ঘর থেকে খবর এসে যায় —ইনস্পেকশন শুরু হয়েছে। দ্রুত হাত-পা চালায় ছেলেরা। না-ধোয়া কাপড় বা ঝাঁট দিতে গিয়ে চোখ এড়িয়ে যাওয়া নোংরা কী করে লুকনো যায় তার ফন্দিফিকির চলে। আন্দাজ লাগানো হয় আর কতক্ষণ পরে উনি আমাদের ঘরে এসে পড়বেন। কিন্তু অনিলদার রাবার সোলের চটিতে শব্দ হয় না। দ্রুত তাঁর চলাফেরা। তাই ওঁর নিকনেম "প্রাইভেট বাস"। কখন পৌঁছে গিয়ে উনি তীক্ষ্ণ নজরে সব দেখে নিচ্ছেন, ধরা পড়ে যাচ্ছে তোষকের নীচে গুঁজে রাখা নোংরা জাঙ্গিয়ার নীচে একটি সিগারেটের প্যাকেট?