নীচের তলায় একই মাপের কুড়িটা ঘর, প্রতি ঘরে পাঁচটা চৌকি। ইউশেপের স্ট্রাকচার। দুটো সমান্তরাল লাইনে দশ-দশটা করে, আর মাঝখানের জোড়া দুটোঘর বেশ বড়ো মাপের, তাতে স্টোর আর মহারাজদের খাবার ঘর। সবশেষে ডাইনিং হল। আমাদের ঠাঁই হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উলটো দিকের শেষের ঘর কুড়ি নম্বরে আমাদের নতুন ওয়ার্ডেন বীরেশদা, থুড়ি ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য।
উনি সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। আমাদের বিশেষ ঘাঁটান না, নিজের পড়াশুনো এবং সকাল বিকেল প্রেয়ারের সময় দু’বার দু’পাক ঘুরে নিজের কর্তব্য সারেন। আমি ওনাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করি। আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ এবং ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ ওনার পরিচালনায় হয়েছিল।
লাইব্রেরির চার্জও উনি নিয়েছেন। আমি ওনার প্রশ্রয়ে সাঁটিয়ে আগাথা ক্রিস্টির বাংলা অনুবাদ পড়ছি, একবারে দুটো করে বই নিয়ে আসছি।
আহা, প্রথমবার ‘দশ পুতুল’, ‘একটি খুন হবে’ পড়ার আনন্দ আজও অমলিন। আবার অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে ঝাঁ-চকচকে নতুন বই এল—“শার্লক হোমস্ ফিরে এলেন”। উনিই বললেন— ‘তোর জন্যে আলাদা করে সরিয়ে রেখেছি, নিয়ে যা। কিন্তু তিনদিনে ফেরত দিবি।’
কিন্তু উনি একটু খোনা, মানে নাকিসুরে কথা বলেন।
শীত আসছে, আমিও ব্যাক লগ সামলানোর চেষ্টা করছি। একবার বাবা এসে কড়া করে ওয়ার্নিং দিয়ে গেছেন। এমন খারাপ ফল হলে আমাকে দক্ষিণ ভারতের মিশনের কোন স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের গ্যাং অফ ফোরের সংক্ষিপ্ত বৈঠক দিনে দু’বার করে হয়—সকালে জল খাবারের ফাঁকে পনের মিনিট আর রাত্তিরে খাওয়ার পর আধ ঘন্টা।
আমরা এখন অনেক শান্ত, কোন ঝামেলায় যেতে চাই না। এ’বছর ভালভাবে পাশ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক, কিন্তু দিন কেটে যাচ্ছে। যা চাই তা কি হয়?
রবিবারে রবিবারে সন্ধ্যেয় প্রেয়ারের পর ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হয়।
ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্র, কখনো কখনো আমেরিকান লাইব্রেরি বা বৃটিশ কাউন্সিলের কিছু। বছরে সাকুল্যে চারটে ফিচার ফিল্ম – কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’, পাহাড়ি সান্যাল, বসন্ত চৌধুরি এবং সুচিত্রা সেনের ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ বা অজয় করের ‘ভুলি নাই’।
একবার টম সইয়ারের গল্প অবলম্বনে একটি বাংলা ফিল্ম, যাতে শম্ভু মিত্র হলেন ভিলেন অঘোর কামার; আর একবার অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে বহুরূপী নাট্যদলের দিকপালদের নিয়ে তৈরি ‘মানিক’ যাতে ফাগিন হলেন ফকিরচাঁদ (শম্ভু মিত্র) আর ন্যান্সি হলেন লিলি (তৃপ্তি মিত্র)।
কিন্তু ওই সিনেমাতে ফকিরচাঁদের গলায় একটি গান ছিল—
পাথরচাপা এই কপালে যা হল তা ভালই হল,পুরোনো এক বাড়িতে আটকে রাখা ছেলেগুলো ঘুমুচ্ছে। পাজামা ও আলখাল্লা পরা শম্ভু মিত্র মৃদু হাসির সঙ্গে গানটা গাইতে গাইতে করিডোর দিয়ে যাচ্ছেন আর ‘বয়েই গেল’ উচ্চারণের সঙ্গে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন।
তোমার চোখে আমার সাগর শুকালো তো
বয়েই গেল।
অল্প আলোয় তাঁর ছায়া দেয়ালে সরে সরে যাচ্ছে। লিলি তৃপ্তি মিত্র শুধু তাকিয়ে দেখছেন ফকিরচাঁদের চলে যাওয়া।
ওই সিকোয়েন্স, অভিনয় আর গান আমার বুকে একটা অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি করে দেয়, মানুষের জন্ম-মৃত্যু-জীবন কেমন অর্থহীন মনে হয়। আজও মাঝে মাঝে ওই ক’টা লাইন আর শূন্যতার বোধ আমাকে কব্জা করে ফেলে।
কিন্তু ওইসব সিনেমাগুলো ছিল ব্যতিক্রম। বেশির ভাগ সময়েই বহুবার দেখা সরকারি তথ্যচিত্রগুলো, যেমন সিন্ধ্রির সারের কারখানা নিয়ে, আমাদের ক্লান্ত করত। ফলে সবাই একঘন্টা পরে ঢুলতে থাকত। অনেকে আগে থেকেই শতরঞ্চি বালিশ নিয়ে এসে মাটিতে পেতে বসে যেত। আলো জ্বলে উঠলে তাদের গভীর ঘুম থেকে টেনে তুলে দিলে ওরা কোনোরকমে ঘরে গিয়ে যে যার বিছানায় ডাইভ মারত, খাওয়ার ঘন্টা বাজার আগে যতক্ষণ ঘুমোনো যায় আর কি!
এমনি এক রাতে আমিও নিজের বিছানায়, হঠাৎ চৌকি নড়ে উঠল, দুলতে দুলতে কাত হয়ে গেল! ভূমিকম্প! আমি গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। অমনই ঘরে লাইট জ্বলে উঠল আর হা-হা-হি-হি!
অবাক হয়ে দেখছি গুরু সুইচ বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করছে আর প্রশান্ত আমার চৌকির পায়ের কাছে, বিশু পাশের দিকে। হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
--এটা কী হচ্ছে?
--অপারেশন আর্থ-কোয়েক!
গুরুর চটজলদি জবাব। প্রশান্ত বোঝাল, এখন ঘরে ঘরে কেউ না কেউ ঘুমুচ্ছে। ওরা গিয়ে একজন পায়ার কাছে আর অন্যজন চৌকির একপাশে দাঁড়ালে গুরু ওয়ান-টু-থ্রি বলে লাইট নেভাতেই ওরা চৌকিটা একটু কাত করে দিচ্ছে আর ঘুমন্ত ছেলেটি আতংকিত হয়ে হুড়মুড়িয়ে পপাত ধরণীতলে।
কিন্তু অন্ধকার ঘর থেকে তিনমূর্তি আগেই চম্পট দিয়েছে। ফলে মাটিতে পড়া ছেলেটি হতভম্ব হয়ে ভাবছে হলটা কী?
গুরু অমিয়দা আমার হাত ধরে টেনে তুলে বলল— ‘চ, আমাদের অপারেশন মাত্র শুরু হয়েছে। এবার তুইও হাত লাগা, সুইচ বোর্ড থেকে শুরু কর। দেয়ার উইল বি লট অফ ফান।’
আমাদের অপারেশন আর্থ কোয়েক এগিয়ে চলে। একের পর এক ঘর পেরিয়ে যাই। দু’একটা খালি, কোন একটাতে কেউ ঘুমোয় নি।
ধীরে ধীরে আমিও মজার স্বাদ পেতে শুরু করি। এবার কোণের দিকে একটা ঘর, মাত্র একজন সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আলোটা আগে থেকেই নিভিয়ে রাখা। অন্যেরা পজিশন নেয়।
ওয়ান-টু-থ্রি! খাটটা দোলাতেই কাপড়ে মোড়া সাদা শরীর মাটিতে হুড়মুড়িয়ে পড়ে।
আর নাকি সুরে একটা চিৎকার—ওঁরে বাঁবা, মঁরে গেঁলুম!
আমাদের আক্কেলগুড়ুম। এ যে ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্যের মানে বীরেশদার গলা! আরে তাই তো, এটাই তো বারান্দার শেষ ঘর, উনি একাই থাকেন। আমাদের ঝোঁকের মাথায় খেয়াল ছিল না।
দে ছুট! দে ছুট! খাবার ঘন্টা বাজছে।
--গুরু, কেলো হয়েছে। আজ আমরা খেতে যাব না।
--হাঁদারাম, না গেলেই তো চোখে পড়ে যাব। আমরা সবাই যে যার থালা নিয়ে অন্যদিনের মতোই খেতে বসব।
ডাইনিং হলে ঢোকার সময় চোখে পড়ল ঢালা বারান্দার অন্য কোণে বীরেশদা কয়েকটি জুনিয়র ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন আর আঙুল তুলে বারান্দার অন্যদিকে কিছু দেখাচ্ছেন।
ভাবলাম, ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে। কিন্তু পরের দিন খবর পেলাম ক্লাস এইটের ছেলেগুলো আমাদের নামে চুকলি করেছে যে এটা নাটের গুরু অমিয়দার চ্যালাদের কীর্তি, ওদের মধ্যে কেউ দিব্যি গেলে বলল যে বীরেশদার ঘর থেকে দু’জনকে দৌড়ে পালাতে দেখেছে।
বাজে কথা! ওদের ঘর দোতলায়। ওখান থেকে অন্ধকারে এত সব দেখা যায় না। মিথ্যে করে দিব্যি গেলেছে তো? এবারও অ্যানুয়ালে ফেল করবে।
গুরুর ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি হল দল বেঁধে একসাথে থাকা। তাহলে বীরেশদা কাউকে কিছু বলতে পারবেন না, কিন্তু একা পেলে?
পরের দিন ভোরবেলায় বিপ্লব বলল যে প্রেয়ারে যাবে না, অনেক রাত অব্দি পড়েছে, থার্মোডায়নামিক্সকে ঘায়েল করে ফেলেছে। এবার একটু ঘুমুবে।
গুরু মাথা নাড়ল। কিন্তু বিপ্লবের এক কথা। বড্ড ঘুম পাচ্ছে; আরে কিস্যু হবে না। তোমরা মশারির তিনটে কোণা খুলে দাও। আমি ওই একটার পেছনে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে ঘুমিয়ে থাকব। বাইরে থেকে কেউ টের পাবে না।
একঘন্টা পরে আমরা প্রেয়ার হল থেকে ফিরে এসে দেখি যা তা ব্যাপার! বিপ্লব মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য এসে ওকে খালি হাতেই চড় থাপ্পড় এবং দমাদ্দম কিল মেরেছেন। মাটিতে পড়ার পর একখানা গোদা পায়ের লাথি!
মারের চিহ্ন ওর গালে হাতে দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে উঠেছে।
গুরুর এমার্জেন্সি মিটিং। আমি বাদ, কেননা আমি নাকি লাইব্রেরির বইয়ের সুবাদে বীরেশদার প্রতি একটু ‘সফট’ আছি। কিন্তু সবাই চায় হার্ড অপারেশন।
সাতটা দিন কেটে গেল মানে মানে। শীতটা জাঁকিয়ে পড়ছে। আমার খাটের জানলার পেছনেই কলতলা।
রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেল। কলতলায় কিছু একটা হচ্ছে, একটা আওয়াজ।
কী হতে পারে? শেয়াল তো আজকাল এদিকে নেই। তাহলে কুকুর? চোখ কচলে মশারির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম।
এই ঠান্ডায় একজন কেউ খালি গায়ে সাদা ধুতি পরে থুপথুপিয়ে কাপড় কাচছেন, বিছানার চাদর, মশারি, লেপের ওয়াড়।
পরের দিন খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। গতকাল রাতে কে বা কাহারা ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্যের মশারির উপর এবং বিছানায় কিছু নোংরা পূতিগন্ধময় জিনিস কাগজের ঠোঙায় মুড়িয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছে। আশা করা যায় আশ্রম বালকেরা এই দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সূচনা দিবে। খবর দিলে তাহার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হইবে।
না, কোন আশ্রম বালক এগিয়ে আসে নি। কিন্তু আমি গুরুকে বললাম—এটা কিন্তু লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেল।
ওই বছর ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে কাশ্মীরে পাকিস্তানের বিশাল সৈন্যবাহিনী আমেরিকার থেকে সদ্য পাওয়া স্যাবর জেট ফাইটার প্লেন ও প্যাটন ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ চালায়। ভারতের ছিল ন্যাট এবং ফ্রান্সের তৈরি মিরাজ। আমাদের নিজের তৈরি বৈজয়ন্ত ট্যাংক তখনও মাটিতে নামে নি।
সে’সব পরে জেনেছি। তখন আমরা লালপাহাড়ির দেশে রাঙামাটির দেশে মিশনের স্কুলের হোস্টেলে থেকে এতসব বুঝি নি। কিন্তু নামগুলো বাতাসে ঘুরে বেড়াত। আরও ছিল—গিরিপথ হাজি পীর পাসের লড়াই; ক্যাপ্টেন হামিদের বীরগাথা। একটি জীপ ও সাধারণ বন্দুক নিয়ে প্যাটন ট্যাংকের মোকাবিলা।
আমাদের হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হলঃ
কিন্তু খড়গপুরের কাছে কলাইকুন্ডা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান হানা ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আলফ্রেড কুকের বীরত্বের পর আমাদের আশপাশেও বিমানহানার সম্ভাবনা দেখা দিল। সন্ধ্যের পর সব জানলায় কালো কাগজ আড়াআড়ি করে সেঁটে দেওয়া, কামরায় ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগল।
এক সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ আরাত্রিক “খণ্ডন ভববন্ধন জগবন্দন বন্দি তোমায়” শ’দেড়েক ছেলের সমবেত গলায় পূর্ণোদ্যমে চলছে এমন সময় তার ফাঁকে শোনা গেল আশেপাশের বাড়ি থেকে তারস্বরে সমবেত চিৎকার—মহারাজ, আলো নেভান। বিমান হানার সাইরেন বাজছে যে!
ওরে বাবা! চটপট প্রেয়ার হলের আলো নিভে যায়। আমরা নির্দেশ মতো মাটিতে কনুই এবং হাঁটু ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি। দত্ত রমেনকে সাবধান করে—বুক বা পেট যেন মাটিতে না লাগে, খবর্দার!
এতক্ষণ অ্যাটাকের কাটা কাটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু বোম পড়ার হুড়ুমদুড়ুম একবারও নয়। বেশ খানিকক্ষণ পরে বেজে উঠল টানা সাইরেন—অল ক্লিয়ার!
তার মানে হানাদার বিমানগুলো পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ওপারে পালিয়েছে, যাকগে বাবা। কিন্তু বোমা পড়ল কোথায়?
পরের দিন জানা গেল ওটা ছিল বিমানহানার সুরক্ষা মহড়া, কোন হানাদারি বিমান এ তল্লাটে আসে নি। আমার মাথায় একটা বেয়াড়া ছড়ার লাইন কোত্থেকে এসে বোলতার মতো ঘুরঘুর করছে:
প্রশান্ত বিশু এরা জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু আমি বলে দিয়েছি যে এটা পার্সোনাল ম্যাটার, এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে চাই না। গ্রুপের মধ্যেও কি একা হয়ে যাচ্ছি? গুরু অমিয়দা ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য থুড়ি বীরেশদার অপারেশনটায় আমাকে বাদ দিয়ে করল।
আমিও কিছুদিন আগে অপারেশন ব্যানানা অর্থাৎ পাইথাগোরাস থিওরেম গ্রুপের কাউকে না জানিয়ে জুনিয়র ছেলে প্রেমাংশুকে নিয়ে করেছি। পরে সবাই পিঠে চাপড়ে দিল, গুরু হাসল, কিন্তু ওর চোখ হাসে নি।
কিন্তু কোথাও কি কিছু ভুল করলাম? মনে একটুও শান্তি নেই কেন? ফের কিছু একটা করতে হবে। ক্লাসের ডে-স্কলার ছেলে দেবতোষ, বলল একটা নতুন হাসির সিনেমা এসেছে, মালঞ্চ হলে। বেশ মজার নাম—পতি সংশোধনী সমিতি। মঞ্জু দে, সাবিত্রী আরও কে কে যেন আছেন।
হঠাৎ টিউবলাইট জ্বলে উঠল।
--শোন দেবু, কালকে দুটো টিকিট কেটে এনে দিবি, সামনের লাইনের? কোন শো? উম্ম্, পরশু ম্যাটিনি, দুটোর শো। এই নে পয়সা।
স্কুলের টিফিনের সময় আমি আর প্রেমাংশু ডে-স্কলারদের ভিড়ের মধ্যে মিশে সোজা গেটের বাইরে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি বেশ স্পীডে, হাওয়াই চটির চটাস চটাস শব্দ। আমাদের চোখ রাস্তার দিকে।
মালঞ্চ হলটা আশ্রমের গেটের থেকে অন্ততঃ দেড় কিলোমিটার দূরে। যখন হলে অন্ধকারে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে সীটে গিয়ে বসলাম তখন সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছে। মহিলাদের এক গোপন সভায় মঞ্জু দে শপাং শপাং করে পতিদেবতাদের চাবকানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
সিনেমার অপারেশন সাকসেসফুল। সন্ধ্যের মুখে ফুটবল খেলে ফেরা ডে-স্কলারদের দলের ফাঁকে আমরা দু’জন আশ্রমের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলাম।
প্রেমাংশু উত্তেজিত।
--প্রদ্যুম্নদা, আশ্রম ছেড়ে যাবার আগে আরেকটা অপারেশন সিনেমা করতে হবে।
--মানে? তুইও এখান থেকে চলে যাবার কথা ভাবছিস?
--হ্যাঁ, বাড়িতে কথা বলেছি। বাবা এখন আসানসোল স্টিলে বড় পোস্টে রয়েছেন। আমার রেজাল্ট খারাপ নয়। ওখানকার পুরোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়ে টেন-ইলেভেনের পালা শেষ করব।
--তারপর কলেজ?
--হ্যাঁ, কলেজ। অনেক ফ্রীডম।
আমি ফোড়ন কাটি—অনেক ফ্রীডম, অনেক মেয়ে। কো-এড কলেজে পড়বি তো? নইলে গার্লস কলেজের গেটের আশেপাশে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ানোই সার হবে।
প্রেমাংশু লজ্জা পায়। তারপর হেসে ফেলে।
--ঠিক বলেছ। কো-এড কলেজ, অনেক মেয়ে, প্রজাপতির ঝাঁকের মতো। জান, আমাদের কোয়ার্টার বেশ বড়। চমৎকার বাগান, মালি আছে। অনেক ফুল আর প্রজাপতি। খুব সুন্দর।
পরের দিন রোববারে হালুয়া মুড়ির জলখাবার খেয়ে আমরা তৈরি হচ্ছি চানের আগের লিমিটেড ওভার ক্রিকেট খেলার জন্যে, অবশ্যই টেনিস বলে। পার্কসার্কাস পাড়ায় পিচের রাস্তায় ইঁটের উইকেটে রবারের বলে খেলার সময় দু’একবার কারও বাড়ির দোতলার কাঁচ ভেঙেছে বটে, কিন্তু এখানে সব কাঠের দরজা জানলা, কাজেই আমরা অকুতোভয়।
কী করে যেন আমি আর বিপ্লব দুই প্রতিদ্বন্দ্বী টিমে। ওদের ক্যাপ্টেন প্রশান্ত, আমাদের রমেন। গুরু মহা আলসে, ও স্নানে যাওয়ার গামছা কাঁধে ফেলে আম্পায়ারিং করবে।
কিন্তু মুশকিল হল ফিল্ড সাজাতে গিয়ে, আমাদের একজন প্লেয়ার কম পড়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি প্রেমাংশু বারান্দা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।
বললাম ওকে ডেকে নে।
কিন্তু রমেন বলল ও তো অনেক জুনিয়র! আমার যুক্তি তাতে কি, ও অফ স্পিন ভালো করে, টেনিস বলও।
রমেন নিমরাজি হল।
কিন্তু ওদিক থেকে একটা অশ্লীল মন্তব্য উড়ে এল।
--অফ স্পিন কেন, লেগস্পিনও করাতে পারে। টেনিস কেন সবরকম বলও ঘোরাতে পারে।
কথাটা কে বলল? বিপ্লব!
মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এগিয়ে গেলাম ব্যাটিং টিমের দিকে।
--কী ব্যাপার!
বিপ্লব দু’পা পেছনে সরে গেল। প্রশান্ত এগিয়ে এসে আমাদের মাঝখানে দাঁড়াল।
--ছেড়ে দে, এসব খেলার মাঠের উড়ো কথা, তোকে তো বলা হয় নি, পার্সোনালি নিচ্ছিস কেন?
আমি থেমে যাই, তারপর পেছন ফিরে পিচের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি এমন সময় আবার শোনা গেল—আরে দু’জনে মিলে ক্লাস কেটে পতি-পত্নী সংশোধন না কি যেন একটা সিনেমা দেখতে গেছল। এখন পতিকে তো পত্নীর পক্ষ নিতেই হবে।
হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা!
এবার বিপ্লবও দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার মুখোমুখি। চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে থুতনি একটু উঁচুতে তুলে।
--কী করবি তুই? সত্যি কথা শুনলে গায়ে বিছুটি লাগে?
গুরু দৌড়ে এসে আমাকে পেছনে থেকে জাপটে ধরে পেছনে টানতে থাকে। আমি সরে যাবার আগে পা বাড়িয়ে বিপ্লবের দু’পায়ের মাঝখানে একটা লাথি কষাই।
একটা ওঁক শব্দ করে বিপ্লব মাটিতে বসে পড়ে। সবাই মিলে ওকে টেনে তোলে, ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। ও একবার ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে। কিছু বলে না, তারপর প্রশান্তর কাঁধে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলে যায়।
গুরু, বিশু, রমেন আমাকে ঘিরে ধরে।
--এটা কী করলি পোদো? তোর আর বিপ্লবের মধ্যে কী হয়েছে আমরা জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু ওকে এভাবে মারলি? কেন?
আমি কোনো কথা বলি না। আমার চোখে ভাসছে—বিপ্লবের যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ, চোখে জল। আর ওর দৃষ্টিতে রাগ-দ্বেষের বদলে যেন অবাক হওয়া বোবাদৃষ্টি।